What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

জুতোর শব্দে চোখ খুলে ভরত দেখল মিসেস মুখার্জি বেরিয়ে এসেছেন। অদ্ভুত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ এসেছিল বুঝি?

হ্যাঁ। আমাদের কলেজে পড়ে।

মেয়েটি দেখতে বেশ। তোমার গার্লফ্রেন্ড?

ভরত ভদ্রমহিলাকে দেখল। তারপর নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল।

মহিলা হাসলেন, আমিও তাই ভাবছিলাম। এতদিন তোমাকে দেখছি, কখনও কোনও মেয়ের সঙ্গে মিশতে দেখিনি। কে যেন বলছিল নিচের তলার রবীনবাবু নাকি তোমাকে পাকড়ে নিয়ে গেছেন মেয়ের টিচার করে, আমার তো বিশ্বাস হয় না। যাগ গে এসব কথা, তোমার শরীর কেমন আছে বল!

ভালই।

ওঃ যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। অভিজ্ঞতা হল খুব, তাই না?

কীসের অভিজ্ঞতা?

ড্রাগ খাওয়ার। আচ্ছা, খাওয়ামাত্রই নেশা হয়ে গিয়েছিল?

ওটা বলে বোঝানো যাবে না। আপনি খেয়ে দেখুন।

খুব ইচ্ছে করে জানো! আমি একটু ডানপিটে আছি বলেই ইচ্ছেটা হয়। কিন্তু ভয় লাগে, যদি নেশা হয়ে যায়। ড্রাগখোরদের চেহারা কি বিচ্ছিরি হয়।

ভরত আর দাঁড়াল না। ভদ্রমহিলা ওইভাবে অনন্তকাল কথা বলে যেতে পারেন কিন্তু তার আর দাঁড়াতে ভাল লাগছে না। কিছুটা অভদ্রের মতই সে ভেতরে চলে এসে দরজা বন্ধ করল। সুদেষ্ণা এসেছিল এই খবরটা ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই মা জেনে যাবে। অবশ্য তাতে মা কিছু। মনে করবে বলে মনে হয় না। করলেই বা কী করা যাবে। সুদেষ্ণা এসেছিল বন্ধুর মতো খোঁজ নিতে। একা আসতে স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি বলে সঙ্গী নিয়ে এসেছে। হয়তো ওই সঙ্গী নিয়ে আসার কারণে মা-ও স্বচ্ছন্দ বোধ করবে।

ভরত আবার কলেজে যাওয়া শুরু করল। বাড়ি থেকে কলেজে ঢোকা এবং লাইব্রেরি ফেরত বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকলে হলে তোমাকে ঝামেলা এড়াতে হবে। দেশপ্রেম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বইপত্রে ছড়ানো থাকা কথাবার্তা সঙ্গে জীবনের কোনও মিল নেই এই সত্য তাকেও মেনে নিতে হবে। তার টিউশনিগুলো এখন হাতছাড়া হয়ে গেছে। এতকাল বিনা নোটিসে মাস্টারমশাই-এর উধাও হয়ে যাওয়া কোনও অভিভাবক মেনে নিতে পারেনি। আবার নতুন করে ছাত্র পড়ানোর কাজ জোটাতে না পারা পর্যন্ত মায়ের কাছেই হাত পাততে হবে। শেষপর্যন্ত সে নিজের সঙ্গে লড়াই করে সিদ্ধান্তে এল, হাত পাতা নয়, যতদিন চাকরি না পাবে ততদিন তাকে খরচ দেওয়া মা-বাবার পবিত্র কর্তব্য। সে পৃথিবীতে এসেছে ওদের ইচ্ছেয়, বড় হচ্ছে ওদের পরিকল্পনামাফিক। হ্যাঁ, স্কুল ছাড়ার পর পড়াশুনার ধারা হয়তো সে নিজে নির্বাচন করেছে কিন্তু কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় তাকে সাহায্য করার দায়িত্ব মা-বাবার। আদর্শ নামক একটি সোনার পাথরবাটির স্বপ্ন দেখে যারা তাদের মেরুদণ্ড ধীরে ধীরে বেঁকে গোল হয়ে যায়। চিড়িয়াখানা এবং মিউজিয়মের মধ্যে প্রাণবন্ত অবশ্যই প্রথমটি। আদর্শ এখন মিউজিয়ামে চমৎকার মানানসই।
 
কলেজে ঢুকছিল ভরত। গেটের কাছে ছেলেমেয়ে বেশি নেই। একটা বোগা মেয়ে হলুদ শাড়ি পরে সামনে হাঁটছিল। ওর হাতে দুটো খাতা। ভরত ওকে ভাল করে লক্ষ্যই করেনি কারণ তার প্রয়োজন ছিল না। হঠাৎ তার মনে হল মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গিয়ে টলতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই ভরত এগিয়ে গেল দ্রুত। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা ঢলে পড়েছে মাটিতে। খাতাদুটো ছিটকে গেল একপাশে। যারা দূরে ছিল তারা চিৎকার করে ছুটে এল। ভরত আগে পৌঁছেছিল। মেয়েটার চোখ বন্ধ, মুখ একেবারের সাদা। কপালজুড়ে ঘাম। ডাকাডাকিতেও ওর চোখ খুলল না।

এখনই একজন ডাক্তার ডাকা উচিত। অথবা হাসপাতালে। যে ভরত ইদানিং কোনও ঝামেলায় যাবে না বলে ঠিক করেছিল সে-ই নিজের অজান্তে উদ্যোগ নিল। কলেজে পৌঁছে দেওয়া এক ছাত্রীর গাড়িতে মেয়েটিকে তুলে আর একটি ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ছুটল মেডিক্যাল কলেজে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে তখন খুব ভিড়। মেয়েটিকে মাটিতে শুইয়ে রেখে একজন ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। করে বললেন, মনে হচ্ছে উইন্ড থেকে হতে পারে। শরীরে রক্তও নেই। পরীক্ষা না করে কিছু বলা যাবে না। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে একটা ইনজেকশন দিলেন ডাক্তার।

চারধারে চিৎকার চেঁচামেচি। বারান্দার গা ঘেঁষাঘেষি খাটে নিস্তেজ রুগিরা শুয়ে আছে। এইসময় মেয়েটা চোখ খুলল। ভরত তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন লাগছে? আমি একই কলেজে পড়ি।

মেয়েটা আবার চোখ বন্ধ করল, আমি কোথায়?

হাসপাতালে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে।

মেয়েটা চারপাশ তাকিয়ে দেখল। তারপর ভরত আপত্তি করা সত্ত্বেও উঠে বসল, আমি বাড়ি যাব। প্লিজ।

এই অবস্থায় তুমি কী করে যাবে? ডাক্তার বলেছে তোমার পরীক্ষা হবে।

আমি এখন ভাল হয়ে গেছি। আমি বাড়িতে যাব।

সঙ্গী ছাত্রটি বলল, ও যদি পারে তাহলে বাড়িতে ফিরে যাক। এখানে যা অবস্থা তাতে একটুও ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু যেতে হলে ডাক্তারে অনুমতি তো লাগবে।

কিস্যু দরকার নেই। ওর নাম এখনও এখানকার খাতায় ওঠেনি। আমাকে যেতে বলেছিল ওসব করতে। এই, তুমি উঠে দাঁড়াতে পারবে? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

মেয়েটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় থাক তুমি?

বাগবাজার।

মেয়েটা যে অসুস্থ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চিকিৎসা না করিয়ে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় আপত্তি ছিল ভরতের। কিন্তু এর মধ্যে সে জানতে পেরেছে কেবিন বা পেয়িং বেডে জায়গা পাওয়া নাকি এখনই সম্ভব নয়। যদি সোর্স অথবা টাকার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ব্যবস্থা হতে পারে। মানুষের প্রয়োজন নিয়ে কিছু মানুষ ব্যবস্থা করবেই এদেশে এবং সেটা মেনে নিতে হবে। ওই দুটোর কোনোটারই যখন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না তখন ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এভাবে বারান্দায় ফেলে রেখে যাওয়া যায় না।

সঙ্গী ছেলেটি বেরিয়ে গেল ট্যাক্সি ডাকতে। মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সি খোঁজার চেয়ে সেইটেই ভাল। মেয়েটা উঠে বসেছিল। ওর শরীর মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছে। মুখ একদম সাদা। ভরত আবার জিজ্ঞাসা করল, তুমি যেতে পারবে?

মাথা নাড়ল মেয়েটি। কিন্তু ওর কষ্ট হচ্ছে বোঝা গেল।

তোমার নাম কী?

শ্রাবণী।

তুমি আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াও দেখি পার কিনা! ভরত হাত বাড়াল।

শ্রাবণী চেষ্টা করল, সে যখন সোজা হল তখনও তার শরীর কাঁপছে। ভরত চারপাশে তাকিয়ে হাসপাতাল কর্মচারীদের কাউকে দেখতে পেল না। এভাবে নিয়ে যাওয়া অন্যায় কিন্তু সে কী করতে পারে!

ট্যাক্সিতে বসে একপাশে মাথা এলিয়ে দিল শ্রাবণী। ভরত তার পাশে বসেছে, সঙ্গী ছেলেটি সামনে। হ্যারিসন রোডের মোড় এসে ছেলেটি বলল, আমার একটা জরুরি কাজ আছে, তুমি তো ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছ, আমি আর গিয়ে কী করব!
 
ভরত শ্রাবণীর দিকে তাকাল। সে মাথা হেলিয়ে দিয়ে একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে। ট্যাক্সি থামিয়ে ছেলেটা নেমে যাওয়ার পর ভরতের খেয়াল হল ওর পকেটে মাত্র পনেরটা টাকা রয়েছে। যদি এর থেকে বেশি ভাড়া মিটারে ওঠে তাহলে সে কি করবে? শ্রাবণীর উচিত ট্যাক্সির ভাড়া মেটানো কিন্তু ওর যা অবস্থা তাতে একটুও ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। ভরত ঠিক করল বেশি ভাড়া উঠলে শ্রাবণীর বাড়ির লোকেদের বলবে ভাড়া মিটিয়ে দিতে। সে যে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে এই ঢের।

গিরিশমঞ্চের উল্টোদিকে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতে বলল শ্রাবণী। নিস্তেজ গলায় জানাল এই গলিতে ঢুকতে হবে। গলি এত সরু যে ট্যাক্সিওয়ালা রাজি হচ্ছিল না। শ্রাবণীর অসুস্থতার কথা বলতে লোকটা বাধ্য হলো। এর মধ্যে মিটার দেখে হিসেব করে নিয়েছে ভরত চোদ্দটাকা পঁচাত্তর দিতে হবে। আর এক ধাপ উঠে গেলে তার পকেটে পয়সা নেই। অতএব ওর বাড়ির সামনে গাড়িটাকে নিয়ে যেতে হবে।

একটি পুরনো বাড়ির সামনে পৌঁছে হাত তুলল শ্রাবণী। একজন টাক মাথা ভদ্রলোক সেই বাড়ির রকে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বসে কাগজ পড়ছিলেন। গলিতে ট্যাক্সি ঢুকছে দেখে কাগজ সরিয়েছেন মুখ থেকে। ভরত দরজা খুলে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, শ্রাবণী খুব অসুস্থ। ওকে ধরে ধরে নামাতে হবে।

কী হয়েছে? ভদ্রলোকের চোখ ছোট হয়ে গেল।

মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ছিল না।

বাড়ির ভেতরে গিয়ে বলুন।

ভরত দেখল শ্রাবণী শরীরটাকে কোনমতে নিচে নামিয়ে আনছে। মাটিতে পা দিয়ে মেয়েটা গাড়িটাকে আঁকড়ে ধরল। ওর হাঁটার ক্ষমতা নেই। বাধ্য হয়ে ভরত এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরল। শ্রাবণী বিড়বিড় করে বলল, আমি যেতে পারব।

.

কথাগুলো যে নিছকই সঙ্কোচের কারণে বলা সেটা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়, ভরত ওকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে চলল। দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎই একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। ভরত দেখল একজন মহিলা ছুটে আসছেন। পরনে আটপৌরে শাড়ি। রোগা মহিলা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন শ্রাবণীকে, কী হয়েছে? কী হয়েছে তোর?

শ্রাবণী যেন তার শরীরের শেষ শক্তিটুকু এতক্ষণ আঁকড়ে ছিল, মহিলা জড়িয়ে ধরা মাত্র সেটুকুও চলে গেল। শরীর এলিয়ে পড়ল তার। মহিলা কোনওমতে ওকে টানতে টানতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভরত কী করবে বুঝতে পারছিল না। এঁদের সঙ্গে ভেতরে যাওয়া কি শোভনীয় হবে? ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়া না মিটিয়ে দিলে মিটার বাড়বে। সে চটপট বাইরে এসে দেখল মিটার আর এক ধাপ উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। উনি এখন কাগজ পড়ছেন। নিশ্চয়ই এ বাড়ির কেউ নয়। অগত্যা পকেট থেকে পনের টাকা বের করল ভরত। ট্যাক্সিওয়ালা সেটা নিয়ে বলল, আরও আট আনা দিন। ভরত সত্যি কথা বলল, আট আনা নেই।

লোকটা কিছু না বলে ট্যাক্সিটা ঘোরাবার চেষ্টা শুরু করল।

ভরত ভেবে পাচ্ছিল না সে কী করবে। তার পকেটে এখন একটাও পয়সা নেই। বাড়ি যেতে হলে হেঁটে যেতে হবে। সেটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। সে সোজা টাকামাথা ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি শ্রাবণীর কোন আত্মীয়?

কেন?

দরকার ছিল।

সোজা ভেতরে গিয়ে বাঁ দিকে উঠে যান। ওই অংশটা ওদের।

লোকটাকে খচ্চর বললে সেই প্রাণীটিকে অপমান করা হবে বলে মনে হল ভরতের। কিন্তু সে হেঁটে বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ভেতরে ঢুকল সে। বাঁ এবং ডান দু দিক দিয়ে সিঁড়ি ওপরে ওপরে উঠে গেছে। বাঁ দিকটা ধরল সে। পুরনো বাড়ি, অনেককাল সংস্কার করা হয়নি কেমন স্যাঁতসেঁতে গন্ধ চাপ হয়ে বেরুচ্ছে।

ওপরে উঠতেই সেই মহিলার গলা শুনতে পেল, আমি কী করব! আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তুই একটু শুয়ে থাক আমি অবনীডাওারকে ডেকে আনি।
 
ভরত দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল শ্রাবণী বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর মহিলা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কথা বলছেন। চোখ তুলে তাকে দেখতে পেয়ে মহিলা দ্রুত চলে এলেন সামনে, আপনি–তুমি, তুমি ওকে নিয়ে এসেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কে তুমি?

আমরা একই কলেজে পড়ি। কলেজে ঢোকার সময় ও পড়ে যায় হঠাৎই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে ও কিছুতেই থাকতে চাইল না। বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি করে ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। ভরত ইচ্ছে করে ট্যাক্সি শব্দটা একটু জোর দিয়ে উচ্চারণ করল যাতে ভদ্রমহিলার খেয়াল হয় ভাড়াটা তার দিয়ে দেওয়া উচিত।

তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব বাবা! এত কষ্ট করে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলে। তুমি একটু বসো, আমি ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে আসছি।

আপনি কেন যাবেন? আমাকে বলুন, ডাক্তারের চেম্বার কোথায়, আমি যাচ্ছি।

না। তোমাকে উনি চেনেন না। তুমি গেলে এখনই আসতে চাইবে না। আমি আসছি। ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন।

ভরত অসহায় বোধ করল। এই বাড়িতে আর কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিছানায় মড়ার মত শুয়ে আছে শ্রাবণী। মেয়েটা যে খুবই অসুস্থ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওর বাবা দাদা অথবা কোনো পুরুষমানুষ কি এবাড়িতে নেই? এইসময় অস্ফুট শব্দ করল শ্রাবণী। চোখ বন্ধ করেই বলল, জল।

এইসময় জল দেওয়া উচিত কিনা তা জানে না ভরত। আবার কেউ জল খেতে চাইলে না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কি সম্ভব? সে টেবিলের ওপর জলের জাগ আর গ্লাস দেখতে পেল। গ্লাসে খানিকটা জলঢেলে সে বিছানার পাশে গিয়ে বলল, জল এনেছি, মুখ তুলে খেতে পারবে?

মাথাটা সামান্য তোলার চেষ্টা করেও পারল না শ্রাবণী। চোখ না খুলেই মাথা নেড়ে না বলল। ভরত সামান্য ঝুঁকে বলল, হাঁ করো।

ধীরে ধীরে মুখ খুলল শ্রাবণী। কিন্তু ওপর থেকে গ্লাস নামিয়ে মুখে জল ঢালা সহজ ব্যাপার নয়। চলকে বাইরে পড়তে পারে, বেশি পড়ে গেলে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। অতএব লক্ষ্য ঠিক রাখতে এক হাতে শ্রাবণীর মুখ ধরতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত শীতল একটা স্পর্শ পেল ভরত। পেয়ে শরীর শিরশির করে উঠল। গ্লাস থেকে সামান্য জল মুখে ঢালামাত্র শ্রাবণী সেটা বেশ কষ্ট করে গিয়ে ফেলল। গ্লাস সরিয়ে নিয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করল, শরীর কেমন লাগছে?

শ্রাবণী কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল ভাল নয়।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ভরত। শ্রাবণী তার থেকে সামান্য ছোট হতে পারে। এই বয়সে সে নিজে কদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নার্সিংহোম থৈকে ফিরে এসেছে। তার নিজেরও কোনো হুঁশ ছিল না সেসময়। নিজের অজান্তেই সে ওই পরিস্থিতিটাকে ডেকে এনেছিল। কিন্তু শ্রাবণীর মতো মেয়ে কেন অসুস্থ হবে। এই মেয়েটা বোগা, ফ্যাকাশে। কিন্তু ওর চোখ দুটো আশ্চর্য সুন্দর, চিবুকটা বড় মায়াময়ী, শ্রাবণী মোটেই সুন্দরী বলা যাবে না। যৌবনে পৌঁছানোর পরও প্রকৃতি বড় কৃপণ থেকেছে তার বেলায়। অধিকাংশ বাঙালি মেয়ের সঙ্গে শ্রাবণীর কোনও পার্থক্য নেই। তবু, এখন এই শায়িত শ্রাবণীকে দেখে তার মনে কি রকম মায়ার জন্ম হলো।
 
সিঁড়িতে কথা শোনা যাচ্ছিল। ভরত দরজার দিকে একটু এগোল। শ্রাবণীর মা প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরছেন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে। ডাক্তার ঘরে ঢুকে শ্রাবণীর পাশে চলে গেলেন, কী ব্যাপার? আবার কী হলো? শ্রাবণী জবাব দিল না। ডাক্তার ভরতের দিকে তাকালেন, অতএব ভরতকে বলতে হল। শুনতে শুনতে ডাক্তার পালস দেখে প্রেসার মাপার যন্ত্র চালু করেছেন। ওঁকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন, হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা অন্যায় হয়েছে।

ভরত বলল, ও থাকতে চাইছিল না। তাছাড়া ওখানে চিকিৎসা হচ্ছিল না।

কিন্তু ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রক্ত দেওয়া দরকার। এই মেয়ে বেশ অ্যানিমিক। হিমোগ্লোবিন কমতে কমতে এখন কোথায় গিয়েছে কে জানে। আপনাকে আমি বলেছিলাম ডক্টর দত্তের কাছে ওকে নিয়ে যেতে, গিয়েছিলেন?

ও যেতে চায়নি। বলেছিল এখন ভাল আছে।

ননসেন্স। এখনই অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালে নিয়ে যান। পার্ক স্ট্রিট-পার্কসার্কাস মোড়ে হসপিটালটা। ওখানে গিয়ে ডক্টর দত্তের সঙ্গে দেখা করুন। আমি ওঁকে ফোন করে দিচ্ছি।

ডাক্তারবাবুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে শ্রাবণীর মা বললেন, এখন কী করি!

উনি যা বললেন তাই করুন। ভরত বলল।

আমি বাবা একা মানুষ। রাস্তাঘাট তেমন চিনিও না। আমার হাত-পা কেমন করছে!

অগত্যা ভরতকে উদ্যোগী হতে হলো। ট্যাক্সি ডেকে আনার পর শ্রাবণীকে নামাতে তাকেই হাত লাগাতে হলো। সে বুঝতে পারছিল এই বাড়িটা এখন শরিকে ভর্তি এবং কেউ কারও সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে না। ট্যাক্সি ছাড়ার আগে সে পরিষ্কার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়েছেন? হাসপাতালে নিশ্চয়ই দরকার হবে।

শ্রাবণীর মা মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ বাবা।

মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে ভদ্রমহিলা পেছনের আসনে বসেছিলেন। ড্রাইভারের পাশে বসে ভরত চমকে উঠল। শ্রাবণীর নাকের ফুটো দিয়ে কাঁচা রক্ত চুঁইয়ে আসছে। ভদ্রমহিলাকে কথাটা বলতে তিনি চাপা আর্তনাদ করে আঁচল চেপে ধরলেন মেয়ের নাকে। ভরত শ্রাবণীর অসুখ বুঝতে পারছিল না। ডাক্তার বলে গেলেন ও অ্যানিমিক। তাহলে শরীর থেকে রক্ত বেরোবে কেন?

.

অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিট্যালে পৌঁছে জানা গেল আউটডোরের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। ইমার্জেন্সি কেস ছাড়া এখন ভর্তি হচ্ছে না। ডক্টর দত্ত ভোরবেলায় এসে বেলা পর্যন্ত পেশেন্ট দেখে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। শ্রাবণীকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল একটা বেঞ্চিতে। ভরতের মনে হল হসপিট্যালটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু শ্রাবণীকে তো আবার ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। হঠাৎ একজন কর্মী সামনে এসে চিৎকার করলেন, ডক্টর দত্তর সঙ্গে দেখা করতে কেউ কি এসেছেন? ভরত চমকে উঠল। তারপর দ্রুত কাছে গেল, তাঁ, আমরা এসেছি।

কর্মীটা বলল, ডাক্তারবাবু দোতলায় আছেন। পেশেন্টকে নিয়ে যান।

উনি তো বাড়ি চলে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আবার ফিরে এসেছেন। জলদি যান।

ছোট্ট ঘরটিতে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ফর্সা ছোটোখাটো চেহারা, সাদা চুল, হাসলেন, তুমি অসুস্থ? এখানে ওকে শুইয়ে দিন। হ্যাঁ।
 
শ্রাবণীকে প্রশ্নটা করেই উঠে দাঁড়িয়েছিলো ডাক্তার। শ্রাবণীর মা মেয়েকে শুইয়ে দিতেই পরীক্ষা আরম্ভ করলেন। তারপর ফিরে চেয়ারে গিয়ে টেলিফোনটা তুললেন, চটপট চলে এসো। একটি মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। কুইক।

রিসিভার নামিয়ে রেখে শ্রাবণীর মাকে জিজ্ঞাসা করলো, যা যা হয়েছে সব বলুন।

শ্রাবণীর মা বলতে লাগলেন মেয়ে রক্তাল্পতায় ভুগছে। অ্যানিমিক। ডাক্তারের ওষুধ ঠিকঠাক খেয়ে যাচ্ছে। আজ হঠাৎ কলেজে পড়ে যায়। ওর বন্ধুরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে থাকতে চায়নি শ্রাবণী। ফলে ওকে বাড়িতে আনতে হয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে। ডক্টর দত্ত বললেন, আগের রক্তপরীক্ষা করার রিপোর্টটা দেখি।

শ্রাবণীর মা যে ব্যাগে করে সেই কাগজপত্র এনেছেন তা জানত না ভরত। দেখে ডাক্তারের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, অনেক আগেই আমাদের কাছে এলে ভাল করতেন।

এইসময় অ্যাপ্রন পরা একজন ঢুকতেই ডাক্তার ইশারায় শ্রাবণীকে দেখিয়ে দিলেন। ভরত দেখল সূচ ফুটিয়ে টানা মাত্রা প্লাস্টিকের সিরিঞ্জের অনেকটা লাল হয়ে গেল। শ্রাবণী কোনও শব্দ করল না। ডাক্তার বললেন, রিপোর্ট পরে দিও। এখন শুধু হিমোগ্লোবিনটা কত বলে দাও। আমি অপেক্ষা করছি।

বলে যাওয়ার আগে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, স্যার, আপনি বাড়ি চলে গিয়েছিলেন না?

হ্যাঁ। কেন?

আবার ফিরে এলেন এসময়ে?

বাড়িতে বসে টিভি দেখার চেয়ে এই মেয়েটির পাশে থাকা অনেক জরুরি, যাও।

লোকটি মাথা নেড়ে চলে যাওয়ামাত্র আর একজন উঁকি মারল। ডক্টর দত্ত গলা চড়ালেন, কী চাই? এটা তো আমার পেশেন্ট দেখার সময় নয়!

না ডাক্তারবাবু। ট্রেন বন্ধ বলে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল আসতে। আমি শুধু জানতে এসেছিলাম ছেলেকে কি আপনার কাছে আনব?

কোথায় যেন থাকা হয়?

রাণাঘাট।

ও। শ্রীমান শ্ৰীমন্ত সওদাগর। কেমন আছে সে?

ভাল। স্কুলে যাচ্ছে।

ওষুধ?

ঠিকঠাক খাচ্ছে। আটমাস হয়ে গেল।

মাইগড! আমি আপনাকে বলেছিলাম ঠিক চারমাস পরে নিয়ে আসতে। আপনি ওর বাবা না ক্রিমিনাল? ছেলেকে খুন করতে চান? কালই নিয়ে আসবেন নইলে আর কোনদিন আসতে হবে না। গেট আউট।

লোকটি মাথা নেড়ে চলে যেতেই টেলিফোন বাজল। ডক্টর দত্ত সাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কত? উত্তরটা শুনে বললেন, ডিটেলস্ রেডি করো। রিসিভার নামিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন চোখ বন্ধ করে, ও কোথায় পড়ে?

প্রেসিডেন্সিতে।

ডক্টর দত্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে শ্রাবণীর মাথায় হাত রাখলেন, ওর বাবা?

চারবছর হল চলে গেছেন?

আপনাদের সোর্স অফ ইনকাম?

কিছু রেখে গিয়েছিলেন। তারই সুদে চলে যাচ্ছে।

কত?

কত মানে? শ্রাবণীর মায়ের মুখ শক্ত হল।

ভুল বুঝবেন না। কত সুদ পান? দুই তিন হাজার নাকি বিশ পঁচিশ?

উনি তো বেশি রেখে যেতে পারেননি। চার হাজার টাকার মতো পাই। আমি সঙ্গে টাকা এনেছি। কী লাগবে বলুন!

মাইগড! ডাক্তার চলে এলেন টেবিলে। তারপর ভরতের দিকে তাকালেন, তুমি কে?

ভরত বলল, আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ি।

ওর বন্ধু?

না। আজ ও পড়ে যেতে ওর সঙ্গে আসি।

বাঃ গুড। শুনুন মা, আপনি একটা দরখাস্ত লিখুন। তাতে বলবেন আপনার মাসিক আয় হাজার টাকার বেশি নয়। যদি হাসপাতাল থেকে আপনার মেয়ের চিকিৎসার জন্যে সাহায্য করা হয় তাহলে আপনি বাধিত হবেন। তুমি ওঁর হয়ে এখনই লিখে দাও।

সাহায্য নিতে হবে কেন? শ্রাবণীর মা প্রতিবাদ করলেন।
 
যদি আপনার মাসিক আয় অনেক হত তাহলে সাহায্য নিতে বলতাম না। কয়েক বছর আগে। আমি একটু শিশুকে বাঁচাবার চেষ্টা করি। অনেক করেও শেষ পর্যন্ত তাকে রাখতে পারিনি। তার বাবা বিরাট ব্যবসায়ী। ছেলে মারা যাওয়ার পর তিনি একদিন এখানে এসে এক কোটি টাকার চেক দিয়ে বললেন, তার ছেলের রোগে যেসব ছেলেমেয়ে আক্রান্ত হবে তাদের চিকিৎসা যেন ওই টাকায় হয়। আমরা একটা কমিটি করেছি। যে সব বাবা-মায়ের রোজগার কম তাদের সন্তানের চিকিৎসা ওই টাকায় করা হয়ে থাকে। যা সন্দেহ হচ্ছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে আপনার মাসিক আয়ের টাকায় এই মেয়ের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। একটা ইঞ্জেকশনের দামই হয় তো হাজার টাকা। দরখাস্ত লিখে আমাকে দিন। আমি রেকমেন্ড করে দিচ্ছি। আপনার ওটা নিয়ে সুপারের কাছে যান। তিনি অর্ডার করে দিলে বাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ততক্ষণে ওকে বেডে ভর্তি করে দিচ্ছি। হাত বাড়িয়ে একটা সাদা কাগজ আর কলম তুলে ভরতের দিকে এগিয়ে দিলেন ডক্টর দত্ত। তারপর উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ভরত হতভম্ব হয়ে বসেছিল। এরকম ঘটনা এখনও কলকাতায় ঘটে? তার চোখের সামনে মেডিকেল কলেজের বারান্দাটা ভেসে উঠল। কলকাতার বেশির ভাগ মানুষ যখন নিজের স্বার্থের বাইরে যেতে রাজি নয় তখন ডক্টর দত্তকে তার দেবদূত বলে ভাবতে ইচ্ছে করল। শ্রাবণীর মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে দরখাস্ত লেখা শেষ হবার আগেই দুজন লোক স্ট্রেচারে শুইয়ে শ্রাবণীকে নিয়ে গেল।

শ্রাবণীর মা পেছন পেছন যাচ্ছিলেন কিন্তু ভরত তাকে নিষেধ করল, এখন যাবেন না।

কিন্তু—

ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলা আগে দরকার।

কিন্তু ওর কী হয়েছে তা এখনও বলেননি।

এইসময় ডক্টর দত্ত ঢুকলেন। ভরত তার সামনে দরখাস্তটা রাখতেই তিনি চোখ বুলিয়ে হাসলেন, গুড। চমৎকার লিখেছ। নিজে দরখাস্তের একপাশে খসখস করে কয়েক লাইন লিখে বললেন, মা, আপনি একা সুপারের কাছে যান। এটা ওঁকে দেখান। ওখান থেকে পাশের অফিসে গিয়ে মেয়ের নামে কার্ড করিয়ে ভর্তির কাগজপত্র ঠিক করে নিন।

শ্রাবণীর মা জিজ্ঞাসা করল, ওর অসুখটা কী ধরনের?

ডক্টর দত্ত মাথা নাড়লেন, আপাতত ধরে নিন রক্ত কম। তা থেকে অনেক কিছু হতে পারে, সমস্ত রিপোর্ট আগে পাই তারপর আপনাকে বলব। আপনি আর দেরি করবেন না।

ভরত শ্রাবণীর মায়ের সঙ্গে এগোতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে হাত নেড়ে চেয়ারে বসতে বললেন ডক্টর দত্ত। শ্রাবণীর মা বেরিয়ে গেলে তিনি বললেন, ইয়ং ম্যান, তোমার সাহায্য যে এখন খুব দরকার।

কী করতে হবে বলুন?

রক্ত চাই। ফ্রেশ ব্লাড। মেয়েটির ব্লাডগ্রুপের সঙ্গে যাদের মিলবে তাদের বিকেলের মধ্যে এখানে জড়ো করো। ওকে আজই রক্ত দিতে হবে।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে আনলে হবে না?

নো। ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ত তাদেরই ব্যবহার করা উচিত যাদের ফ্রেশ ব্লাড পাওয়ার কোন সোর্স নেই। তুমি কলেজে পড়। সেখানে প্রচুর ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে পাবে। তোমার পক্ষে তাদের এখানে এনে জড়ো করা সহজ। তিনি টেলিফোন তুলে নম্বর ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, শ্রাবণীর ব্লাডগ্রুপ কী?
 
উত্তরটা শুনে রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, ভগবানকে ধন্যবাদ যে সহজ গ্রুপের রক্ত ওর শরীরে। তুমি ও গ্রুপের ছেলেদের জোগাড় কর। যারা নিজের গ্রপ জানে না তাদেরও নিয়ে। এসো। সামান্য রক্ত দিলে তাদের শরীরের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। কিন্তু অনেক বিপন্ন মানুষ বেঁচে যাবে। যাও।

ডাক্তারবাবু, শ্রাবণীর ঠিক কী হয়েছে?

আমি তো একটু আগে বললাম সমস্ত রিপোর্ট না দেখে বলা যাবে না। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে ওর লিউকোমিয়া হবার টেন্ডেন্সি আছে।

লিউকোমিয়া? তার মানে ব্লাড ক্যান্সার?

রাবিশ। ব্লাড ক্যান্সার! তার মানেই পেশেন্ট বাঁচবে না? এসব বোকা বোকা কথা শিক্ষিত ছেলের বলা উচিত নয়। আর লিউকোমিয়া হলেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওই রোগটার দুটো ধরন আছে। একটা হলে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের লিউকোমিয়া হলে আমরা লড়াই করতে পারি। আমি অন্তত আটজন পেশেন্টের নাম বলতে পারি যারা গত বারো বছর ধরে ঠিক বেঁচে আছে। কাজ কর্ম করছে কিন্তু তাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, আমার কাছে আসতে হয়। সুতরাং ছোকরা, কোনওরকম আপসেট হবে না। বন্ধুদের নিয়ে এসো, আমি চারটের সময় এখানে থাকব। বাই। ডক্টর দত্ত উঠে দাঁড়ালেন।

ভরত না বলে পারল না, আমার ভাবনা-চিন্তা পাল্টে যাচ্ছে।

কী কারণ? ডক্টর দত্ত দাঁড়িয়ে গেলেন পা বাড়িয়েই।

এখন আপনার মত মানুষ এই শহরে বেঁচে আছেন আমি ভাবতে পারিনি!

মাইগড! আমাকে দেখে কি অ্যাবনর্মাল বলে মনে হচ্ছে?

সত্যি বলতে হলে বলব ঠিক তাই। যেখানে কেউ কারো জন্যে ভাবে না, স্বার্থপরতা ছাড়া কোনো বোধ মানুষের নেই সেখানে আপনি পেশেন্টদের জন্যে এত ভাবছেন, এটা নর্মাল নয়।

তুমি ভুলে যাচ্ছে, আমি আমার কর্তব্যটুকুই করছি।

কেউ যেখানে সেটা করে না সেখানে আপনি করলে অ্যাবনর্মাল হবে। এই অসময়ে হাসপাতালে ফিরে এলেন, ওকে ফর্মালিটিস ছাড়াই ভর্তি করে নিলেন, ওর ব্লাড পরীক্ষা করানো জন্যে একদিন অপেক্ষা করলেন না এবং তার ওপর চিকিৎসার খরচের সুরাহা করে দিলেন কোনও সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও যেখানে মানুষ নিজের জমি বিক্রি করতে কর্পোরশনকে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়।

তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। আমি আবার বলছি যা করা উচিত তার বেশি কিছুই করছি না। যাদের তুমি দেখেছ তাদের বাইরেও মানুষ আছেন। মাদার টেরেসার কথা ছেড়ে দাও, ভারত সেবাশ্রমের কর্মীদের কথা ভাবো, পাড়ায় পাড়ায় এমন অনেক ছেলেকে পাবে যারা নিঃস্বার্থে কাজ করে যায়। এই যে তুমি, শ্রাবণীর আত্মীয় বা বন্ধু নও, তুমি কোন্ স্বার্থে এতক্ষণ এখানে আছ? কেন তুমি কলেজের ছেলেদের জোগাড় করে আনবে রক্তের জন্যে? চলো। তোমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাই।

নিচে নেমে শ্রাবণীর মায়ের কাছে জানা গেল হসপিটালের সুপার কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। সত্যি সত্যি তার আয় হাজারের নিচে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন। তারপর হেসে বলেছিলেন, ডক্টর দত্ত যখন সুপারিশ করেছেন তখন আমি ছেড়ে দিচ্ছি। মেয়ে ভাল হয়ে চলে যাওয়ার সময় সাধ্যমত ডোনেট করে গেলে খুশি হব।

ডক্টর দত্ত বললেন, অবশ্যই। আপনি তো আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিলেন, তখন যা পারবেন দিয়ে যাবেন। ভর্তি হয়ে গেছে?

আধঘণ্টা পরে আসতে বলেছে।

ঠিক আছে। আপনি কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যান। আজ বিকেলে আর আসার দরকার। নেই। ও আছে। চলি। ভরতকে নিয়ে ডক্টর দত্ত বেরিয়ে এলেন।
 
গাড়িতে ওঠার আগে ভরতের মনে হল এই বয়সে এত স্মার্ট চেহারা সে কখনও দ্যাখেনি। গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্র সে প্রশ্ন করল, আপনার বয়স কত?

সেভেন্টি ফাইভ। কেন?

আপনি এখনও তরুণ।

থ্যাঙ্কস। মিলিটারিতে ছিলাম হে। অভ্যেসটা রয়ে গেছে। তোমার প্রব্লেমটা কী বলে? চারপাশের মানুষদের ওপর তোমার খুব রাগ?

ছিল। এখন নেই।

কেন? উবে গেল কী করে?

দেখলাম রোমে থাকতে হলে রোমানদের মতনই থাকতে হবে। আগে যা অসৎ অন্যায় বলে মনে হত তার প্রতিবাদ করতাম। ঘরে বাইরে সেসবের বাড়াবাড়ি দেখে মাথা খারাপ হয়ে যেত। এখন আর করি না। বুঝে গেছি বাঁচতে হলে আমাকেও অসৎ হতে হবে। অসাড়ে অন্যায় কাজ করে যেতে হবে। ভরত অকপটে মনের কথা বলল।

ভরত আশা করছিল ডক্টর দত্ত তাকে উপদেশ দেবেন। যে সমস্ত উপদেশ সমস্ত বাঙালি পিতারা তাদের সন্তানকে দিয়ে থাক তারই কিছুটা শুনতে হবে। কিন্তু তিনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলেন। অতএব আর কথা এগোল না। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন।

.

কলেজের একটি মেয়ের লিউকোমিয়া হয়েছে এবং রক্ত দরকার, খবরটা চাউর হওয়া মাত্র অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। দলে দলে ছেলেমেয়েরা ইউনিয়ন অফিসের সামনে এসে জড়ো হলো। তারা সবাই রক্ত দিতে চায়। অভিজিৎ এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিল। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে সে বলেছিল, আমাদের কলেজের, এক বন্ধু, শ্রাবণী, আজ এই মুহূর্তে হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাকে শক্তি জোগাতে আমাদের এখনই রক্ত দেওয়া দরকার। আপনারা যদি একজন সহপাঠিনীর প্রাণ বাঁচাতে চান তাহলে সাড়ে তিনটের মধ্যে ইউনিয়ন অফিসের সামনে উপস্থিত হবেন। তার ফলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল একশ আটচল্লিশ।

অভিজিৎ ভরতকে জিজ্ঞাসা করল, আজ কতজনকে নিয়ে যেতে বলেছে?

কোনো সংখ্যা আমাকে উনি বলেননি।

তাহলে এক কাজ করি। তিরিশজন করে পর পর পাঁচটা ব্যাচে আমরা ওখান যাব। তিরিশজনের মধ্যে ও গ্রুপের রক্ত যা পাওয়া যাবে তা শ্রাবণীর পক্ষে আজকের জন্যে যথেষ্ট। অভিজিৎ লিস্ট রেডি করে ফেলল চটপট।

তিরিশজন ছেলেমেয়ে যেভাবে ট্রামে বাসে উঠল তাতে মনে হচ্ছিল কোনও বিজয় অভিযানে যাচ্ছে। মল্লিকবাজার থেকে হৈ হৈ করে ওরা যখন হাসপাতালের গেটে পৌঁছল তখন দুপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে। দারোয়ান গোছের কয়েকজন তাদের পথ আটকাল, দলবেঁধে আসার কারণ জানতে চাইল। ভরত বলল, ডক্টর দত্ত এদের আসতে বলেছেন রক্ত দেবার জন্যে। আমাদের এক বন্ধুর রক্ত দরকার।
 
লোকগুলো এত অবাক হয়ে গেল যে নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করল। ভরত সবাইকে লাইন বেঁধে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করতে বলল। সে সময় পেশেন্টদের দেখতে এসেছেন তাদের আত্মীয়স্বজন। ওরা লাইন করে দোতলায় উঠতেই ভরত ডক্টর দত্তকে দেখতে পেল। খবর পেয়ে বেশ হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। ভরত তাকে বলল, আজ আমরা তিরিশজন এসেছি।

তিরিশ? হাসিতে মুখ ভরে গেল ডক্টর দত্তের। দুহাতে বাড়িয়ে বললো, ওয়েলকাম, দোতলার কোণে ঘরে চলে যাও তোমরা। মাথা নাড়লেন তিনি, আমি খুব খুশি, খুব। তোমরা আছ বলেই এখনও পৃথিবীটা সুন্দর।

অভিজিৎ এগিয়ে এল, ডাক্তারবাবু, আরও একশ আঠারোজন ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করছে, প্রত্যেকদিন তিরিশজন করে এসে আপনাকে রক্ত দিয়ে যাবে।

থ্যাঙ্ক মাই বয়। তোমরা আমাকে লড়াই করার শক্তি দিলে। গো অ্যাহেড। তিরিশজন ছেলেমেয়ের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে জানা গেল পনেরজনই শ্রাবণীর সাহায্যে লাগবে। ভরত লক্ষ্য করল ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ নার্ভাস হচ্ছে কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছে না। রক্ত দেওয়া হয়ে গেলে অভিজিৎ বলল, ভরত, যাওয়ার আগে শ্রাবণীকে দেখে যাওয়া উচিত আমাদের। ও কোথায় আছে?

যেহেতু এখন ভিজিটার্স আসতে পারেন তাই ওরা কারও অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করল না। ভরত অভিজিৎ আর একটি মেয়ে তিনতলায় উঠে এল। খোঁজ করতে ওরা যখন শ্রাবণীর বিছানার পাশে উপস্থিত হল তখন একজন নার্স রক্তের বোতল টাঙাচ্ছেন। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে। শ্রাবণীর চোখ বন্ধ। মুখ সাদা। নাকের নিচে লালচে দাগ। নার্স রক্ত চালু করে সেই দাগ তুলো দিয়ে মুছে নিলেন।

এই ঘরে আরও গোটা আটেক বিছানা এবং তাতে অসুস্থ স্ত্রীলোক এবং শিশু শুয়ে রয়েছে। ভরত লক্ষ্য করল কোথাও নোংরা পড়ে নেই। অভিজিৎ নিচু গলায় ডাকল, শ্রাবণী? শ্রাবণী শুনছ? আমরা তোমার পাশে আছি।

শ্রাবণীর চোখের বন্ধ পাতা সামান্য নড়ল কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ওরা কিছুক্ষণে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসছিল কিন্তু অল্পবয়সী এক মহিলাকে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়াল। মহিলার সামনের বিছানায় একটি শিশু শুয়ে আছে। শিশুটি বলল, মা আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো আমি পায়খানায় যাব। এখানে থাকলে পায়খানা হবে না। ওমা। চল না। ওমা।

অভিজিৎ জিজাসা করল কি হয়েছে ওর?

মহিলা জবাব না দিয়ে কাঁদতেই লাগলেন। এই সময় নার্স এসে দাঁড়াল পাশে, স্থির হোন ভাই। ডাক্তারবাবু আজ রাত্রে শেষবার চেষ্টা করবেন। আপনাকে শক্ত হতে হবে।

ওরা তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে নার্স ইশারায় করিডোরে ডেকে নিয়ে এল, ডক্টর দত্তর কেস। প্রথমবার যখন এসেছিল তখন খুব খারাপ অবস্থা ছিল। লিউকোমিয়া কিন্তু লড়াই করা যায়। বাচ্চাটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় ডক্টর দাসও পই পই করে ওদের বলে দিয়েছিলো যদি নাক দিয়ে রক্ত বের হয় সঙ্গে সঙ্গে ওকে রক্ত দিতে হবে। প্রত্যেক পনেরো দিন অন্তর ব্লাড টেস্ট করতে। রক্ত দেবার নিয়ম হলো ফ্রেশ ব্লাড় নিয়ে বোতলটাকে উপুড় করে রাখতে হবে কিছুক্ষণ যাতে লোহিত কণিকা বোতলের মুখে চলে আসে আর শ্বেতকণিকা ওপরে উঠে যায়। রক্ত দেওয়ার সময় এর ফলে লোহিত কণিকা আগে যাবে শরীরে, সেটাই দরকার। এরা সেই নির্দেশ না মেনে লোকাল ডাক্তারের কথামত ফ্রেশ ব্লাড সঙ্গে সঙ্গে শরীরে দিয়েছে। যার ফলে বাচ্চাটার শরীর রক্ত নিতে পারেনি। হেমারেজ হয়ে গেছে। নাক কান দিয়ে তো বটেই পেটের ভেতর ছড়িয়েছে রক্ত। যার ফলে ওর পায়খানার দ্বারে চলে এসে রক্ত এমন জমাট হয়ে গেছে যে আর পায়খানা হচ্ছে না। ডক্টর দত্ত এবার কোনওমতে ব্লিডিং বন্ধ করেছেন। কিন্তু পেটের ভেতর সেই রক্তের ডেলাটাকে সরাতে পারছেন না। ওটাকে না সরালে ওর পায়খানা হবে না। এর ফলে ওর পেট ফুলছে। ডুস জোলাপ কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top