পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট মোটামুটি হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসেবে তার আরও ভাল নম্বর পাওয়া উচিত ছিল কথাটা মা খুলে না বললেও অভিব্যক্তিতে বোঝাল। বাবা আজকাল প্রায়ই কলকাতা থাকে না। ওঁদের ব্যাঙ্গালোর অফিসে প্রায়ই যেতে হচ্ছে। অনেক সময় মাস দেড়েক পরে ফিরে আসে। মাঝখানে যে ভরতের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে সে খবর বাবা জানে না। বাবার যে হঠাৎ অফিসের কাজের চাপে বাইরে যেতে হচ্ছে তা মা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। মা মনে করে বাবা ইচ্ছে করে ওই কাজটা নিয়েছে। এর চেয়ে যদি ট্রান্সফার নিয়ে চলে যেত তাহলে বলার কিছু ছিল না। তবে বাবার এই পরিবর্তনে বাড়িতে আর ঝামেলা তৈরি হচ্ছে না। সন্ধের পর একমাত্র টিভির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।
রেজাল্ট ভাল না হওয়ার ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি ভরত। অর্ণব বসুরায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে পার্ট ওয়ানে, পার্ট টুতেও পাবে হয়তো। এম-এসসিতে একই থাকলে হয় রিসার্চ করবে নয় পড়াবে। চার পাঁচ থেকে দশ হাজারে জীবন শেষ। কলেজের অধ্যাপকদের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় এইসব ভদ্রলোকেরা বছরের পর বছর নতুন নতুন ছাত্রছাত্রীদের একই কথা শুনিয়ে যাচ্ছে এবং এখন প্রায় যন্ত্র হয়ে গেছে। ওঁদের হয়তো একটুও ভাল লাগে না প্রতিদিন একই কথা বলতে কিন্তু মাইনে পাওয়া যাবে বলেই বলে যেতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম ছাত্র তৈরি করার উন্মাদনা যদি থেকেও থাকে তা কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে নিশ্চয়ই থাকতে পারে না। ব্যতিক্রম হয়তো আছে, কিন্তু অর্ণব বসুরায় যে সেই ব্যতিক্রম হবে একথা কী করে বলা যায়।
তাকে বি. এসসি পাস করতে বে কারণ বেঁচে থাকতে গেলে যে চাকরি দরকার তার জন্যে ওই ডিগ্রি প্রয়োজন। আবার বি. এসসি পাস করলেই যে চাকরি পাওয়া যাবে তা কোনো মূর্খ ভাবে না। এ এক অদ্ভুত গেঁড়াকল। ক্রমশ ওর মন থেকে বিজ্ঞান নিয়ে দেখা নানাবিধ স্বপ্ন উধাও হয়ে যাচ্ছিল এবং সেই সময় সে খবরের কাগজে একটি ঘটনা পড়ল। শিলিগুড়ি শহরে একজন প্রথিতযশা ডাক্তারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ভদ্রলোক গত তিরিশ বছর ধরে ওই শহরে প্র্যাকটিস করছেন। তার চিকিৎসার গুণে মানুষ এত উপকৃত যে মফস্বল থেকে রুগিরা ছুটে আসত। অন্যান্য ডাক্তারের থেকে তাঁর পসার অনেক বেশি ছিল। ভদ্রলোক গাড়ি বাড়ি করেও রুগিদের অবহেলা করতেন না। সারাদিন অন্তত দুঘন্টা গরিব রুগিদের বিনাপয়সায় দেখতেন এবং প্রয়োজন হলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে পাওয়া ওষুধও বিলিয়ে দিতেন। এই ডাক্তারের প্রথম স্ত্রীর অভিযোগক্রমে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছেন কারণ তাঁর কোনও মেডিক্যাল ডিগ্রি ছিল না।
প্রথমে ভরতের মনে হয়েছিল একটা চিটিংবাজকে ধরে পুলিশ ঠিক কাজই করেছে। পরে ভেবে দেখল কেন লোকটাকে চিটিংবাজ বলা হবে? সে মানুষের কোনো অপকার করা দূরের কথা উপকারই করে গেছে। বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের চেয়ে লোকটা সাধারণ মানুষের আস্থা বেশি অর্জন করেছে যখন তখন তার চিকিৎসায় কোনও ভুল ছিল না। সে অর্থবানদের কাছে যেমন পয়সা নিত তেমনি গরিবদের সাহায্য করত, এতে প্রমাণ হয় লোকটা চামার ছিল না। শুধু ডিগ্রি না থাকাটা যদি অপরাধ হয় তাহলে বাংলাদেশের মফস্বল গ্রামে যেসব ডাক্তার রোগ সামান্য জটিল হলেই শহরে নিয়ে যেতে বলে রুগিকে, তাদের ডিগ্রি কেন কেড়ে নেওয়া হবে না? ভরত এইসব ভাবনা গুছিয়ে নিয়ে বাংলা এবং ইংরেজি কাগজে চিঠি লিখল। স্কুল কলেজে না পড়িয়েও যদি কোনও শিক্ষিত মানুষ প্রাইভেট টিউশনি করতে পারেন অথবা কোচিং স্কুল খুলতে পারেন তাহলে এই ভদ্রলোকের দোষ কোথায়? চিঠি দুটো ছাপা হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভরতের বক্তব্যের বিরোধিতা করে চিঠি প্রকাশিত হতে লাগল। যে কেউ চিকিৎসার অনুমতি পেলে হাতুড়েদের কৃপায় মানুষের প্রাণ বিপন্ন হবে। একজন হাতুড়ে সফল হওয়া মানেই সবাই তা হবে মেনে নেওয়া যায় না। ব্যতিক্রম চিরকালই ব্যতিক্রম। এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। চিঠিগুলো পড়ে ভরতের মনে হলো সে ঠিকই ভাবছে। ব্যতিক্রম যে সে হবেই এমন স্থিরতা নেই। প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টরি যে করছে না তা কি হলফ করে বলা যায়?
পার্টটু পরীক্ষার পর সে সোজাসুজি মাকে বলল, আর আমি পড়ছি না।
রবিবারের সকাল। গতকাল বাবা ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। সবে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে এই সময় ভরত কথাটা বলল। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে?
দেখি। কিছু একটা করতে হবে।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
আমার তো মনে হয় না।
তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।
রেজাল্ট ভাল না হওয়ার ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি ভরত। অর্ণব বসুরায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে পার্ট ওয়ানে, পার্ট টুতেও পাবে হয়তো। এম-এসসিতে একই থাকলে হয় রিসার্চ করবে নয় পড়াবে। চার পাঁচ থেকে দশ হাজারে জীবন শেষ। কলেজের অধ্যাপকদের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় এইসব ভদ্রলোকেরা বছরের পর বছর নতুন নতুন ছাত্রছাত্রীদের একই কথা শুনিয়ে যাচ্ছে এবং এখন প্রায় যন্ত্র হয়ে গেছে। ওঁদের হয়তো একটুও ভাল লাগে না প্রতিদিন একই কথা বলতে কিন্তু মাইনে পাওয়া যাবে বলেই বলে যেতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম ছাত্র তৈরি করার উন্মাদনা যদি থেকেও থাকে তা কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে নিশ্চয়ই থাকতে পারে না। ব্যতিক্রম হয়তো আছে, কিন্তু অর্ণব বসুরায় যে সেই ব্যতিক্রম হবে একথা কী করে বলা যায়।
তাকে বি. এসসি পাস করতে বে কারণ বেঁচে থাকতে গেলে যে চাকরি দরকার তার জন্যে ওই ডিগ্রি প্রয়োজন। আবার বি. এসসি পাস করলেই যে চাকরি পাওয়া যাবে তা কোনো মূর্খ ভাবে না। এ এক অদ্ভুত গেঁড়াকল। ক্রমশ ওর মন থেকে বিজ্ঞান নিয়ে দেখা নানাবিধ স্বপ্ন উধাও হয়ে যাচ্ছিল এবং সেই সময় সে খবরের কাগজে একটি ঘটনা পড়ল। শিলিগুড়ি শহরে একজন প্রথিতযশা ডাক্তারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ভদ্রলোক গত তিরিশ বছর ধরে ওই শহরে প্র্যাকটিস করছেন। তার চিকিৎসার গুণে মানুষ এত উপকৃত যে মফস্বল থেকে রুগিরা ছুটে আসত। অন্যান্য ডাক্তারের থেকে তাঁর পসার অনেক বেশি ছিল। ভদ্রলোক গাড়ি বাড়ি করেও রুগিদের অবহেলা করতেন না। সারাদিন অন্তত দুঘন্টা গরিব রুগিদের বিনাপয়সায় দেখতেন এবং প্রয়োজন হলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে পাওয়া ওষুধও বিলিয়ে দিতেন। এই ডাক্তারের প্রথম স্ত্রীর অভিযোগক্রমে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছেন কারণ তাঁর কোনও মেডিক্যাল ডিগ্রি ছিল না।
প্রথমে ভরতের মনে হয়েছিল একটা চিটিংবাজকে ধরে পুলিশ ঠিক কাজই করেছে। পরে ভেবে দেখল কেন লোকটাকে চিটিংবাজ বলা হবে? সে মানুষের কোনো অপকার করা দূরের কথা উপকারই করে গেছে। বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের চেয়ে লোকটা সাধারণ মানুষের আস্থা বেশি অর্জন করেছে যখন তখন তার চিকিৎসায় কোনও ভুল ছিল না। সে অর্থবানদের কাছে যেমন পয়সা নিত তেমনি গরিবদের সাহায্য করত, এতে প্রমাণ হয় লোকটা চামার ছিল না। শুধু ডিগ্রি না থাকাটা যদি অপরাধ হয় তাহলে বাংলাদেশের মফস্বল গ্রামে যেসব ডাক্তার রোগ সামান্য জটিল হলেই শহরে নিয়ে যেতে বলে রুগিকে, তাদের ডিগ্রি কেন কেড়ে নেওয়া হবে না? ভরত এইসব ভাবনা গুছিয়ে নিয়ে বাংলা এবং ইংরেজি কাগজে চিঠি লিখল। স্কুল কলেজে না পড়িয়েও যদি কোনও শিক্ষিত মানুষ প্রাইভেট টিউশনি করতে পারেন অথবা কোচিং স্কুল খুলতে পারেন তাহলে এই ভদ্রলোকের দোষ কোথায়? চিঠি দুটো ছাপা হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভরতের বক্তব্যের বিরোধিতা করে চিঠি প্রকাশিত হতে লাগল। যে কেউ চিকিৎসার অনুমতি পেলে হাতুড়েদের কৃপায় মানুষের প্রাণ বিপন্ন হবে। একজন হাতুড়ে সফল হওয়া মানেই সবাই তা হবে মেনে নেওয়া যায় না। ব্যতিক্রম চিরকালই ব্যতিক্রম। এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। চিঠিগুলো পড়ে ভরতের মনে হলো সে ঠিকই ভাবছে। ব্যতিক্রম যে সে হবেই এমন স্থিরতা নেই। প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টরি যে করছে না তা কি হলফ করে বলা যায়?
পার্টটু পরীক্ষার পর সে সোজাসুজি মাকে বলল, আর আমি পড়ছি না।
রবিবারের সকাল। গতকাল বাবা ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। সবে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে এই সময় ভরত কথাটা বলল। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে?
দেখি। কিছু একটা করতে হবে।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
আমার তো মনে হয় না।
তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।