What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট মোটামুটি হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসেবে তার আরও ভাল নম্বর পাওয়া উচিত ছিল কথাটা মা খুলে না বললেও অভিব্যক্তিতে বোঝাল। বাবা আজকাল প্রায়ই কলকাতা থাকে না। ওঁদের ব্যাঙ্গালোর অফিসে প্রায়ই যেতে হচ্ছে। অনেক সময় মাস দেড়েক পরে ফিরে আসে। মাঝখানে যে ভরতের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে সে খবর বাবা জানে না। বাবার যে হঠাৎ অফিসের কাজের চাপে বাইরে যেতে হচ্ছে তা মা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। মা মনে করে বাবা ইচ্ছে করে ওই কাজটা নিয়েছে। এর চেয়ে যদি ট্রান্সফার নিয়ে চলে যেত তাহলে বলার কিছু ছিল না। তবে বাবার এই পরিবর্তনে বাড়িতে আর ঝামেলা তৈরি হচ্ছে না। সন্ধের পর একমাত্র টিভির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

রেজাল্ট ভাল না হওয়ার ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি ভরত। অর্ণব বসুরায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে পার্ট ওয়ানে, পার্ট টুতেও পাবে হয়তো। এম-এসসিতে একই থাকলে হয় রিসার্চ করবে নয় পড়াবে। চার পাঁচ থেকে দশ হাজারে জীবন শেষ। কলেজের অধ্যাপকদের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় এইসব ভদ্রলোকেরা বছরের পর বছর নতুন নতুন ছাত্রছাত্রীদের একই কথা শুনিয়ে যাচ্ছে এবং এখন প্রায় যন্ত্র হয়ে গেছে। ওঁদের হয়তো একটুও ভাল লাগে না প্রতিদিন একই কথা বলতে কিন্তু মাইনে পাওয়া যাবে বলেই বলে যেতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম ছাত্র তৈরি করার উন্মাদনা যদি থেকেও থাকে তা কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে নিশ্চয়ই থাকতে পারে না। ব্যতিক্রম হয়তো আছে, কিন্তু অর্ণব বসুরায় যে সেই ব্যতিক্রম হবে একথা কী করে বলা যায়।

তাকে বি. এসসি পাস করতে বে কারণ বেঁচে থাকতে গেলে যে চাকরি দরকার তার জন্যে ওই ডিগ্রি প্রয়োজন। আবার বি. এসসি পাস করলেই যে চাকরি পাওয়া যাবে তা কোনো মূর্খ ভাবে না। এ এক অদ্ভুত গেঁড়াকল। ক্রমশ ওর মন থেকে বিজ্ঞান নিয়ে দেখা নানাবিধ স্বপ্ন উধাও হয়ে যাচ্ছিল এবং সেই সময় সে খবরের কাগজে একটি ঘটনা পড়ল। শিলিগুড়ি শহরে একজন প্রথিতযশা ডাক্তারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ভদ্রলোক গত তিরিশ বছর ধরে ওই শহরে প্র্যাকটিস করছেন। তার চিকিৎসার গুণে মানুষ এত উপকৃত যে মফস্বল থেকে রুগিরা ছুটে আসত। অন্যান্য ডাক্তারের থেকে তাঁর পসার অনেক বেশি ছিল। ভদ্রলোক গাড়ি বাড়ি করেও রুগিদের অবহেলা করতেন না। সারাদিন অন্তত দুঘন্টা গরিব রুগিদের বিনাপয়সায় দেখতেন এবং প্রয়োজন হলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে পাওয়া ওষুধও বিলিয়ে দিতেন। এই ডাক্তারের প্রথম স্ত্রীর অভিযোগক্রমে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছেন কারণ তাঁর কোনও মেডিক্যাল ডিগ্রি ছিল না।

প্রথমে ভরতের মনে হয়েছিল একটা চিটিংবাজকে ধরে পুলিশ ঠিক কাজই করেছে। পরে ভেবে দেখল কেন লোকটাকে চিটিংবাজ বলা হবে? সে মানুষের কোনো অপকার করা দূরের কথা উপকারই করে গেছে। বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের চেয়ে লোকটা সাধারণ মানুষের আস্থা বেশি অর্জন করেছে যখন তখন তার চিকিৎসায় কোনও ভুল ছিল না। সে অর্থবানদের কাছে যেমন পয়সা নিত তেমনি গরিবদের সাহায্য করত, এতে প্রমাণ হয় লোকটা চামার ছিল না। শুধু ডিগ্রি না থাকাটা যদি অপরাধ হয় তাহলে বাংলাদেশের মফস্বল গ্রামে যেসব ডাক্তার রোগ সামান্য জটিল হলেই শহরে নিয়ে যেতে বলে রুগিকে, তাদের ডিগ্রি কেন কেড়ে নেওয়া হবে না? ভরত এইসব ভাবনা গুছিয়ে নিয়ে বাংলা এবং ইংরেজি কাগজে চিঠি লিখল। স্কুল কলেজে না পড়িয়েও যদি কোনও শিক্ষিত মানুষ প্রাইভেট টিউশনি করতে পারেন অথবা কোচিং স্কুল খুলতে পারেন তাহলে এই ভদ্রলোকের দোষ কোথায়? চিঠি দুটো ছাপা হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভরতের বক্তব্যের বিরোধিতা করে চিঠি প্রকাশিত হতে লাগল। যে কেউ চিকিৎসার অনুমতি পেলে হাতুড়েদের কৃপায় মানুষের প্রাণ বিপন্ন হবে। একজন হাতুড়ে সফল হওয়া মানেই সবাই তা হবে মেনে নেওয়া যায় না। ব্যতিক্রম চিরকালই ব্যতিক্রম। এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। চিঠিগুলো পড়ে ভরতের মনে হলো সে ঠিকই ভাবছে। ব্যতিক্রম যে সে হবেই এমন স্থিরতা নেই। প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টরি যে করছে না তা কি হলফ করে বলা যায়?

পার্টটু পরীক্ষার পর সে সোজাসুজি মাকে বলল, আর আমি পড়ছি না।

রবিবারের সকাল। গতকাল বাবা ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। সবে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে এই সময় ভরত কথাটা বলল। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে?

দেখি। কিছু একটা করতে হবে।

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

আমার তো মনে হয় না।

তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।
 
ইদানীং বাবা এখানে টানা না থাকার কারণেই, ভরত লক্ষ্য করেছে মা এবং বাবার মধ্যে সংঘাত হয় না। উল্টে কোথাও যেন সমঝোতা হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। কোনও কথা মাকে বললে উত্তর শোনা যায়, ঠিক আছে, তোমার বাবা আসুক, কথা বলে দেখি। এবং তার থেকে ভরতের মনে হয়েছে বিয়ের পনের কুড়ি বছর পরে স্বামীস্ত্রীর মাঝে মাঝে আলাদা থাকা উচিত যতদিন না তাদের শরীরে বার্ধক্য পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসছে। মানসিক ব্যবধান বাড়লে একসঙ্গে থাকলে যে চক্ষুলজ্জা একটু একটু করে চলে যায় তা সাময়িক বিচ্ছেদে শেষ পর্যন্ত থেকে যায়।

বাবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল, সমস্যাটা কী?

তোমার ছেলে বলছে আর পড়বে না।

ভরত লক্ষ্য করল এই সময়ে তোমার ছেলে শব্দদুটো বাবাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না।

কেন? তুই তো জয়েন্ট না দিয়ে এই লাইনেই পড়তে চেয়েছিলি।

ঠিকই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এসব আমার জন্যে নয়। তাছাড়া আলটিমেট লক্ষ্য যদি টাকা রোজগার করা হয় তাহলে সময় নষ্ট করে লাভ কী। যেটুকু না পড়লে লোকে বলবে মূর্খ হয়ে আছে সেটুকু তো শেষ করেছি।

কী ভাবে টাকা রোজগার করবি?

সেই পথটা ভাবছি।

ঠিক আছে, তোর যদি আর পড়তে ইচ্ছে না করে তাহলে আই এ এস, ডব্লু বি সি এস দে। ব্যাঙ্কের পরীক্ষাগুলোয় বোস। তোর মতো ছাত্রর পক্ষে ডিফিকালট হবে না।

তর্ক করল না ভরত। বলল, দেখি।

মা চুপচাপ শুনছিল। বলল, এখনই টাকার রোজগারের মতলব কেন? তোর তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। মানুষের জীবনে টাকা রোজগারই শেষ কথা নয়। তাহলে বড় মুদিওয়ালা, লোহার কারবারীরা সমাজে অনেক সম্মান পেত।

ভরত হেসে ফেলল। মা রেগে গেল আমি কি হাসির কথা বললাম?

ভরত বলল, একজন বিখ্যাত লোহার কারবারীর নাম জামসেদজি টাটা। সেদিন একটা কাগজে পড়ছিলাম আমেরিকায় কে মার্টস নামে একটা বিশাল মুদির দোকানের চেইন সারাদেশে ছড়িয়ে আছে যার মালিককে সবাই খাতির করে। প্রেসিডেন্ট থেকে ফার্স্টক্লাস পেয়ে পাস করা দারুণ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আই এ এস করে যখন মন্ত্রী ঘরে ঢোকে তখন সেই অশিক্ষিত মন্ত্রী চেয়ারে পা তুলে বসে থাকে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তাকে স্যার স্যার বলে ডাকতে বাধ্য হয়। মা, জীবনের কনসেপ্টটা পাল্টে গিয়েছে।

বাবা হাসল, তোর যদি পড়তে ইচ্ছে না করে তাহলে বোম্বেতে চলে যা। ওখানে একটা কোর্স করে অ্যাড এজেন্সিতে ঢুকে পড়। সেটা আমি পারব। পরিশ্রম করলে টাকার অভাব হবে না। বাবা আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল।

মা গজগজ করতে করতে কিচেনে ঢুকল। ভরতের মনে হলো তাকে নিয়ে বাবার চেয়ে মা বেশি স্বপ্ন দেখত। কী করা যাবে!

দ্বিতীয় যে কাগজটা বাড়িতে আসে তার পাতা খুলল ভরত। তলার দিকে অভিজিতের নাম। আজকাল ছাত্রনেতা হিসেবে তো বটেই, যুবনেতা হিসেবে অভিজিৎ প্রায়ই কাগজে প্রচার পাচ্ছে। কফিহাউসে শুনেছিল এজন্যে নাকি সাংবাদিকদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে হয়। নিয়মিত কাগজে নাম ছাপা হলে পার্টিতে কদর বাড়ে। অভিজিৎ যে কোনো সুযোগে কেন্দ্রকে যেমন গালাগাল দেয় তেমনি পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ব্যবস্থাকে ছেড়ে কথা বলে না। তার বক্তব্য মন্ত্রীরা যা করতে চাইছেন, বামফ্রন্ট যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কিছু আমলা বানচাল করে দিতে চাইছে বলে জনসাধারণ বঞ্চিত হচ্ছে। কোনো সমাজবিরোধী গুরুতর অভিযোগ ধরা পড়লে অভিজিৎ তার সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক অস্বীকার করে। তার বক্তব্য মানুষের সপক্ষে যারা কাজ করে তারা কেন মানুষের শত্রুকে দলে রাখবে। যখন বিরুদ্ধে প্রমাণ জোরদার হয় তখন তার বক্তব্য বামফ্রন্টের শত্রুরা তাদের হেয় করার জন্যে ওইসব সমাজবিরোধীকে চুপিসাড়ে দলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপার সাবধান হতে হবে। আর এই সব করে ক্রমশ অভিজিৎ প্রথম সারিতে উঠে আসছে। আজকের কাগজে লেনিনের জন্মদিনে তার বক্তব্য, বিকল্প কোনও দল নেই বলে বামফ্রন্টকে মেনে নিতে হবে এমন কথা কেউ যেন না ভাবেন। যেসব বামফ্রন্টীয় কর্মী জনসাধারণের আস্থা হারিয়েছেন তাদের নির্দ্বিধায় দল থেকে ছেটে ফেলতে হবে। মানুষের বিশ্বাস নিয়ে ফাটকাবাজি পার্টি কখনই বরদাস্ত করবে না।



ভরত হেসে ফেলল। অভিজিৎ ক্রমশ আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। সামনের নির্বাচনে পার্টির তরফে নমিনেশন পাওয়া ওর পক্ষে সহজ হয়ে যাচ্ছে। এই বিধানসভায় যদি নাও হয় পাঁচ বছর পরে মন্ত্রী ও হবেই হবে। কারণ ও শিখে গেছে কী করে ইমেজ বাঁচিয়ে কথা বলতে হয়। যেসব কর্মী এখনও চিরাচরিত স্লোগান আওড়ে চলেছে তারা কখনই ওপরের সারিতে উঠতে পারবে না। অভিজিতেরা পারবে।

অভিজিতের কথায় মনে এল শ্রাবণীকে। হাসপাতালে সেই শেষ দেখা। মেয়েটা কেমন আছে এখন? শ্রাবণীর কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ভেসে উঠল ডক্টর দত্তের মুখ। হঠাৎ একটা অপরাধবোধ মনে ঢুকে পড়ল। এই মানুষটির প্রতি তার মনে একসময় এত শ্রদ্ধা জন্মেছিল অথচ দীর্ঘসময় সে আর যোগাযোগ করেনি। ডক্টর দত্তকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু উনি নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না। সে কি বলবে যেহেতু অভিজিৎ সব করেছে তাই। আমি যোগাযোগ রাখিনি! মাথা নাড়ল ভরত। ডক্টর দত্তের কাছে যাওয়ার আগে একবার শ্রাবণীর বাড়িতে বুড়িছোঁয়ার মতো যাওয়া উচিত।

অনেকদিন বাদে গলিতে ঢুকে অস্বস্তি হচ্ছিল। বাড়িটার সামনে এসে দেখল সেই বৃদ্ধ একই ভঙ্গিতে রকে বসে আছেন। লোকটার সঙ্গে কথা বলার কোনও মানে হয় না। উনি কোনও খবর দেবেন না। পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল ভরত এইসময় প্রশ্ন শুনল, কাকে চাই?

শ্রাবণীর কাছে যাচ্ছি।

সে তো বাড়িতে নেই।

কোথায় গিয়েছে?

হাসপাতালে।

সেকি! কবে?

দিন দশেক হল।

ভরতের বুকের ভেতর ধক্ করে উঠল। প্রশ্ন করার মানে হয় না, শ্রাবণী নিশ্চয়ই অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চে আবার ভর্তি হয়েছে। সে ট্রাম ধরার জন্যে ছুটল।
 
হাসপাতালে ঢুকে তার মনে হল ডক্টর দত্ত তাকে কী বলবেন? দশদিন হল শ্রাবণী এখানে আছে আর সে একবারও আসেনি। হয়তো ওপরে গেলে দেখবে অভিজিৎ বসে আছে। এত রাজনীতি করেও অভিজিৎ নিশ্চয়ই শ্রাবণীর জন্যে সময় দিচ্ছে।

সেই একই ভিড় চেম্বারে। দরজায় বেয়ারা নেই। ভরত ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়াল। ডক্টর দত্ত আর একটু বৃদ্ধ হয়েছেন। ফর্সা রঙ যেন একটু ম্লান। একজন রুগির সঙ্গে কথা বলছিলেন। শেষ করে তাকতে ভরতকে দেখতে পেলেন, আজ আমি আর নতুন কেস দেখতে পারব না ভাই। আপনি কাল আসুন।

ভরত ঢোঁক গিলল। উনি তাকে চিনতে পারেননি। সে এক পা এগিয়ে বলল, আমি ভরত। প্রেসিডেন্সিতে পড়তাম। শ্রাবণী!

ওহো। তাইতো। কেমন আছ তুমি?

ভাল। শ্রাবণী কেমন আছে?

তোমার সঙ্গে তো ওর অনেকদিন যোগাযোগ নেই, তাই না?

হ্যাঁ।

আমি ওকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও তাই বলল। কথা শেষ করে ডক্টর দত্ত সামনে বসা এক ভদ্রলোককে বললো, মনে হচ্ছে আগামী সপ্তাহে আপনার ভাইকে ছেড়ে দিতে পারব। ও খুব ভাল ইমপ্রুভ করছে।

ভদ্রলোক কথা বলতে লাগল। ভরত লক্ষ্য করল ডাক্তারের কাছে এলে কিছু কিছু মানুষের কথা যেন শেষ হতে চায় না। ডক্টর দত্ত যেভাবে তার সঙ্গে কথা শেষ করলেন তাও পছন্দ করল না সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কতক্ষণ থাকা যায়।

ডক্টর দত্ত শার্টের হাতা সরিয়ে ঘড়ি দেখলেন, আপনারা একটু বসুন। বলে উঠে দাঁড়ালেন। ভরতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, এসো।

অতএব ভরত তাঁকে অনুসরণ করল। হাঁটতে হাঁটতে হক্টর দত্ত বললেন, আজ একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এসেছিলেন আমার কাছে। উনি এখানে তার পরের সিরিয়ালের শু্যটিং করতে চান। ব্যাপারটা আমার এক্তিয়ারে নয়। বলেছিলাম জেনে নিয়ে জানিয়ে দেব। হসপিটাল কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে আমিও একমত এখানে শুটিং করলে পেশেন্টদের অসুবিধে হবে। ওদের কাজের সঙ্গে এখানকার আবহাওয়ার মিলমিশ হবে না। ভদ্রলোক যে টেলিফোন নাম্বার দিয়েছেন তাতে শুধু রিঙ হয়ে যাচ্ছে।

ওঁকে কি খবরটা আজকেই দেওয়া দরকার?

হ্যাঁ।

আমাকে নামটা বলুন আমি দিয়ে আসব।

রাজেশ মুখার্জি। নিউথিয়েটার্স স্টুডিওতে অফিস।

ওরা ওপরে উঠে এসেছিল। একটা বিরাট হলঘরের দরজায় ডক্টর দত্ত দাঁড়াতেই নার্স ছুটে এল। সম্ভবত এখন ওঁর ওখানে যাওয়ার সময় নয়। ভরত দেখল এই ঘরটা অনেক বড়। এর আগেরবার শ্রাবণী এতবড় ঘরে ছিল না। তার মানে এটা জেনারেল বেড। বিভিন্ন বেডের রুগিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ডক্টর দত্ত যেখানে গেলেন সেখানে শ্রাবণী শুয়ে আছে। তার চোখ। বন্ধ। পেছনে আসা নার্সকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঘুমোচ্ছে নাকি?

নার্স ঝুঁকে পড়ল, ডাক্তারবাবু এসেছেন।

শ্রাবণী চোখ খুলল। আরও রোগা আরও বিবর্ণ এবং মাথার চুলগুলো খুবই উস্কোখুস্কো হয়ে আছে। ডক্টর দত্ত ধমকালেন, কী ব্যাপার মাদার, ঘুমোচ্ছ কেন?

শ্রাবণী হাসার চেষ্টা করল, একটু আগে আবার রক্ত বেরিয়েছে।

তাতে কী হয়েছে। ফোড়া হলে পুঁজ বের হবেই। উঠে বসো। দেখি।

ডক্টর দত্ত বললেন, সাহেবের এতদিন বাদে আমাদের কথা মনে এসেছে। শোনো সাহেব, তোমার বন্ধুদের খবর দাও। আমাদের আবার কয়েক বোতল রক্ত দরকার। আজ হলে আজই নইলে কাল। তোমরা কথা বলো। ডাক্তার দত্ত বেরিয়ে গেলেন।

ভরত আড়ষ্ট পায়ে কাছে এল, এরকম কবে থেকে হল?

শ্রাবণী ক্লান্ত গলায় বলল, হয়ে গেল।

আমি জানতাম তুমি ভাল আছ।

কী করে জানলে এখানে আছি।

আজ তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।

কেন?

এমনি।

এতদিন পরে?

জবাবটা দিতে পারল না ভরত। যা সত্যি তা ওকে বলা যায় না। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি জানতাম অভিজিৎ তোমাকে দেখাশোনা করছে।

অভিজিৎদাকে দেড়বছর দেখিনি।

সেকি?

কেন?

না, ও আমাকে বলেছিল তোমার পার্সেন্টেজের জন্যে লড়াই করছে। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া-আসা করছে।

চেষ্টা করেছিল, হয়তো এখন সময় পায় না। পরীক্ষা দিয়েছ?

হ্যাঁ।

কেমন হল?

জানি না। আমি তো আর পড়ব না।

কেন?

পড়ে কী হবে! তোমার মা ভাল আছেন?

আমার যা অবস্থা তাতে মা কী করে ভাল থাকে। এবারে সুপার ফুল ফ্রি করেননি। ওষুধ কিনে দিতে হচ্ছে না কিন্তু আর সব দিতে হবে। বারংবার যদি একজন সুযোগ পায় তাহলে নতুনরা বঞ্চিত হবে।

তাহলে তো তোমার মায়ের উপর চাপ পড়েছে।

হু। মাকে বলেছি বিয়ের কথা ভেবে যেসব গয়না গড়িয়েছিল একসময় তাই বিক্রি করে দিতে। আমার তো ওসবের প্রয়োজন নেই।

একথা বলছ কেন? তুমি নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে।

দুবছর যেতে না যেতে এরকম হল, এরপর মাস চারেকের মাথায় হবে। তারপর চলে যেতে হবে। আগে গেলে মায়ের কষ্ট কম হত।

দূর! তুমি বেশি ভাবছ। শোনো। বলতে গিয়ে থেমে গেল ভরত।
 
শ্রাবণী তাকিয়ে থাকল। ভরত পাশের টুলে বসে নিচু গলায় বলল, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি এতদিন খবর নিইনি বলে। সে বিছানার পাশে পড়ে থাকা শ্রাবণীর আঙুলগুলো স্পর্শ করল। আঙুলগুলো একটুও নড়ল না। কিন্তু শ্রাবণীর চোখের কোল টলটল করে উঠল। ভরত উঠে দাঁড়াল। বিকেলে আসব। বলে সে দাঁড়াল না।

রাস্তায় বেরিয়ে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। শ্রাবণী আর বেশিদিন বাঁচবে না নাহলে ডক্টর দত্ত তার প্রশ্নের জবাব দেননি কেন? তার মনে পড়ল আজ অথবা আগামিকালের মধ্যে ওর জন্যে রক্ত দরকার। কিন্তু কাদের বলবে সে? কলেজে এখন পরিচিত ছেলেরা নেই। আগে যেমন ক্লাসে গিয়ে অ্যাপিল করলে কাজ হত এখন নিশ্চই তা হবে না। বোঝাই যাচ্ছে শ্রাবণী আর কলেজের ছাত্রী নেই। ওর মনে হল অভিজিতের কাছে গেলে কাজ হতে পারে। অভিজিতকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?

বেশ কয়েকটা জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে শেষ পর্যন্ত অভিজিতের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে সেখানে উপস্থিত হল ভরত। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি আর জনা তিনেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অভিজিৎ নাকি একটু আগেই ফিরেছে, স্নানখাওয়া সেরেই বেরিয়ে যাবে। ভরতকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। তার মনে হলো অভিজিৎ এ মধ্যে তার থেকে অনেক বেশি মূল্যবান করতে পেরেছে নিজেকে।

বাইরে বোধহয় তাকে দেখে অভিজিৎ হবাক হলে, কিরে, হঠাৎ?

তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল। ভারত ওর সঙ্গীদের দিকে তাকাল।

বল।

শ্রাবণী আবার অসুস্থ হয়েছে। ডক্টর দত্ত বলছেন আজই রক্ত দরকার।

শ্রাবণীর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?

মিথ্যা কথা বলল ভরত, হ্যাঁ। ও এখন আসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালে আছে।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে হলে আমি বলে দিতে পারি।

না। ফ্রেশ ব্লাড ছাড়া হবে না।

ও। অভিজিতকে একটু চিন্তিত দেখাল। তারপর সঙ্গীদের একজনকে কাছে ডেকে বলল, জনা পাঁচছয় কর্মীকে আজই অ্যাসেমব্লি অফ গডচার্চ হসপিটালে গিয়ে ডক্টর দত্তর পেশেন্ট শ্রাবণীর জন্যে ব্লাড ডোনেট করে আসতে বলো। যারা একবছরের মধ্যে রক্ত দেয়নি তাদেরই বলবে।

ছেলেটা বলল, তেমন কাউকে কি পাওয়া যাবে। এত ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প হচ্ছে, কেউ তো বাকি নেই। প্রত্যেকেরই কার্ড হয়ে গেছে।

চেষ্টা করে দ্যাখো। এটা হওয়া চাই-ই।

ঠিক আছে। হবে। ছেলেটি মাথা নাড়ল।

অভিজিৎ হাসল, বল ভরত, আর কী দরকার?

অনেক ধন্যবাদ। আর কিছু চাই না।

তুই এখন কী করছিস?

বসে আছি।

একদিন পার্টি অফিসে আয় না। সন্ধের সময় রোজ থাকি। ও হ্যাঁ, তোর সঙ্গে রবীনদার সম্পর্ক কীরকম? তোদের ওখানেই তো থাকে!

দেখা হলে কথা হয়, এই আর কি!

লোকটার সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস, আখেরে কাজ দেবে। অভিজিৎ হাসল, কোনদিকে যাবি?

টালিগঞ্জে। একেবারে না ভেবেচিন্তে জবাব দিল ভরত।

বাঃ খুব ভাল হল। আমি নাকতলায় যাচ্ছি। চল, একসঙ্গে যাওয়া যাক।

.
 
অভিজিতকে একটুও ভাল লাগছে না ভরতের। সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও ওর ভাবভঙ্গিতে বেশ দাদা দাদা ভাব। যেন পৃথিবীর সব সমস্যা এক মুহূর্তে সমাধান করে দিতে পারে। ও এমন ভাব করছে যে ভরত যেন ওর কৃপাপ্রার্থী। যেভাবে শ্রাবণীর জন্যে রক্ত জোগাড় করে দিল তাতে আর যাই থাক আন্তরিকতা মোটেই নেই। তবু ওর সঙ্গে এক গাড়িতে উঠতে হলো। ওঠার পরই অভিজিৎ আর সঙ্গীরা অন্য আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাকতলায় যে মিটিং এ ওরা যোগ দিতে যাচ্ছে সেখানকার সমস্যা এবং সমাধানের কৌশল নিয়ে ওরা ব্যস্ত থাকল। প্রথমে বিরক্ত হলেও শেষে মনে হল এ ভালই হয়েছে। তাকে কথা বলতে হয়নি। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে নেমে গেল ভরত। ও শুনেছিল এর চারপাশেই নাকি ফিল্মের স্টুডিওগুলো আছে। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে স্টুডিওতে এসে দেখল কেউ তাকে আটকাচ্ছে না। অনেকটা হাঁটতে হয়েছে তাকে, বিরক্ত লাগছিল। টিনের দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে মনে হল কোনও মানুষজন নেই। ভরদুপুরেও সব ফাঁকা। সে খানিকটা এগিয়ে দেখল গাছতলায় দাঁড়িয়ে দুজন লোক কথা বলছে।

রাজেশ মুখার্জিকে কোথায় পাব?

কী দরকার? একজন পাল্টা প্রশ্ন করল দ্বিতীয়জন তাকে থামাল, অ্যাই, কী হচ্ছে? আপনি ভাই সোজা চলে যাবেন। বাঁ দিকে ক্যান্টিন দেখতে পাবেন, তার পাশের বিল্ডিং-এ রাজেশদার অফিস। যান।

ফিল্ম সম্পর্কে বাইরে লোকজন ভাল কথা বলে না। ভরতও সেসব শুনেছে। কিন্তু স্টুডিওতে ঢোকামাত্র এমন মন্তব্য কানে আসবে তা ভাবতে পারেনি। ভরতের ধারণা ছিল ফিল্মের স্টুডিও মানে খুব জাঁকজমক ব্যাপার। নায়ক-নায়িকারা সেজেগুজে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তাদের চোখে পড়া দূরের কথা, কিরকম ঘুমন্তপুরী বলে মনে হচ্ছে।

ক্যান্টিনের একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে সে দোতলা বাড়ির নিচের বারান্দায় উঠে রাজেশ মুখার্জীর ঘরের দরজায় চলে এল, আসতে পারি?

ভেতরে একটি সাজানো ঘরে দুই ভদ্রলোক আলোচনা করছিলেন। একজন একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই?

আমাকে অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিট্যালের ডক্টর দত্ত পাঠিয়েছেন। মিস্টার রাজেশ মুখার্জির সঙ্গে দেখা করব। স্পষ্ট গলায় বলল ভরত।

টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা মানুষটি মাথা বাড়ালেন, আসুন। বসুন। আপনাকে ডক্টর দত্ত শু্যটিং-এর ব্যাপারে পাঠিয়েছেন তো? বসুন না। হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

চেয়ারে বসল ভরত। তার পা ব্যথা করছিল অনেকটা হাঁটায়। সে জানত ভদ্রলোকের মুখের চেহারা এখনই পাল্টে যাবে খারাপ খবর শুনে।
 
রাজেশ মুখার্জি বেল টিপল। কেউ সাড়া না দেওয়ায় সামনের ভদ্রলোককে বললেন, দত্ত, আপনি একটু দেখবেন–তিন কাপ চা।

সামনের লোকটি উঠে গেল নিঃশব্দে। রাজেশ মুখার্জি এবার তাকাল, আমাদের এখানকার টেলিফোনটা আজ সকাল থেকেই খারাপ হয়ে গেছে। বিকেলবেলায় আমি কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতাম। ব্যাপারটা হল আমরা হসপিটালে শু্যটিং করতে পারছি না। লোকেশন হিসেবে ওই জায়গাটা আইডিয়াল ছিল কিন্তু আমার ক্যামেরাম্যান খুঁত খুঁত করছেন।

ও। ভরত ঠোঁট কামড়াল। কী বলতে এসে কি শুনল!

আপনি ডক্টর দত্তকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

ভরত মাথা নাড়ল। সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। রাজেশ মুখার্জি বাধা দিলেন, আরে, বসুন বসুন। চা আসছে। আপনি কি ওই হাসপাতালেই আছেন?

না। ডক্টর দত্ত আমার পরিচিত।

কী করেন আপনি?

এবার বি এসসি দিয়েছি।

রাজেশ মুখার্জি ওর মুখের দিকে হঠাৎই অন্যচোখে তাকালেন। ভরতের অস্বস্তি হল। এবং সেই মুহূর্তে চা এল। কাই-এর থালায় উপচে পড়া ছোট কাপে ক্যান্টিনের চা। একটু আগে বেরিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক আবার ফিরে এসে চায়ের কাপ তুললেন।

রাজেশ মুখার্জি হাসলেন, আপনার নামটা জানতে পারি?

ভরত নাম বলল। রাজেশ মুখার্জি জিজ্ঞাসা করলেন, কোন কলেজে পড়তেন?

প্রেসিডেন্সি।

গুড। কলেজে বা কোনো গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করেছেন?

না।

করার ইচ্ছে আছে?

ভাবিনি কখনও।

দেখুন, আমি এবার একটা সিরিয়াল করছি টিভির জন্যে। সমরেশ বসুর গল্প। আপনার বয়সী একটা ছেলে খুঁজছি, বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট। আমাদের ফিল্ম লাইনে যারা আসে তারা স্মার্ট হবার চেষ্টা নিয়েই আসে কিন্তু মুখে কোন ছাপও নেই। আমরা নতুনদের নিয়ে অভিনয়ের ব্যাপারে যে সমস্যায় পড়ি তা আপনার ক্ষেত্রে না হলে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

কিন্তু কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়া কি অভিনয় করা যায়? আমি তো কিছুই জানি না। ভরত বলল।

রাজেশ মুখার্জি বললেন, আমার যখন কথা বলি তখন যা বলতে চাই তার মানেটা বলার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিই। সেই সময় মুখচোখেও সেটা ফুটে ওঠে। এই ব্যাপারটা অভিনয় করার সময় যে যত ঠিকঠাক করতে পারবে সে তত ভাল অভিনেতা। অনুশীলন করতে করতে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বাড়ে। তুমি কি মনে জোর পাচ্ছ না? তুমি বললাম ভাই।

চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমাকে কী করতে হবে?

এখানে পার্ট মুখস্থ করার কোনও ব্যাপার নেই। বেশি হলে বড় জোর আট নটা লাইন একসঙ্গে বলতে হবে। সেটা রিহার্সাল মনিটরে হয়ে যাবে। তোমার খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পাজামা আছে? গুড়। পরশু বিকেলে চলে এসো। শু্যটিং-এর তারিখগুলো বলে দেব। রাজেশ মুখার্জি একটা খাতা বের করে এগিয়ে দিলেন, এখানে তোমার নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর লিখে দাও।

ভরত লিখল। দত্ত বলল, একবার ক্যামেরাটেস্ট করলে ভাল হত না?

দরকার কি। তাছাড়া এখন ক্যামেরা কোথায় পাবেন?

টেকনিসিয়ানে স্বপন শু্যটিং করছে সিরিয়ালের। ব্রেক হলে দুমিনিটে দেখে নিতাম। ও আপত্তি করবে না। আপনারই তো সহকারী ছিল। দত্ত বলল।

রাজেশ মুখার্জি বললেন, আপনি তাহলে ওকে নিয়ে যান।
 
দত্ত ইশারা করতে ভরত উঠে দাঁড়াল। রাজেশ মুখার্জি বিদায় জানালেন। বাইরে বেরিয়ে এসে দত্ত বলল, দেখুন কী করতে এসেছিলেন আর কী হয়ে গেল। একেই বলে কপাল। রোজ গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলে আসছে হাত কচলে, তাদের টপকে আপনাকে ওঁর মনে ধরে গেল। এখন ক্যামেরায় চেহারাটা ভাল এলে আর ডায়লগ বলতে পারলে লাইনে ঢুকে যাবেন।

ভরত কিছু বলল না। মিনিট সাতেক হেঁটে ওরা আর একটি স্টুডিওতে এল। এখানে কিছু মানুষ ঘুরছে। মেয়েরাও আছে। দেখা গেল দত্তকে সবাই খুব খাতির করছে। দত্ত একজনকে জিজ্ঞাসা করল, স্বপন কোন্ ফ্লোরে আছে?

একনম্বরে।

একটা বিরাট গুদামঘরের দরজায় দত্ত তাকে নিয়ে এল। টিনের দরজা বন্ধ। দত্ত সামান্য ঠেলতে ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এল, কাট, ওকে। নেক্সট সিন, আলো রেডি করো। লাইটস?

দত্ত বলল, আসুন।

ওরা ভেতরে ঢুকতেই চারধার আলোয় ঝলমল করে উঠল। ভরত দেখল বড় বড় আলোর স্ট্যান্ডের মধ্যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলা সিনেমার একজন নায়িকা। পোস্টারে যাকে এত মোহময়ী দেখায় তাকে সামনাসামনি নিতান্ত আটপৌরে বলে মনে হচ্ছিল। সুদেষ্ণা ওই ভদ্রমহিলার চেয়ে অনেক সুন্দরী।

দত্তকে দেখে একটা লোক এগিয়ে এল, কি, সৌভাগ্য দাদা, তুমি? এসো এসো। তোমার শু্যটিং কবে থেকে শুরু হচ্ছে?

নেক্সট উইকে। কাজ কেমন হচ্ছে? দত্ত জিজ্ঞাসা করল।

খুব ভাল। আমার তো দু সপ্তাহ পরেই টেলিকাস্ট।

স্বপন, রাজেশবাবু এই ছেলেটির চেহারা কেমন আগে দেখতে বলেছেন। তোমার কি ক্যামেরা অন করতে অসুবিধে হবে? দত্ত জিজ্ঞাসা করল।

আরে কি আশ্চর্য! এমন কথা বলো যার মানে হয় না। ওরা আলো ঠিক করছে ততক্ষণে তুমিই ক্যামেরা হ্যান্ডেল করো।

দত্ত তখন তার পরিচিত লাইটম্যানকে আলো দিতে বলতেই সেটের একাংশ সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত। দত্ত এবার ভরতকে বোঝাল, কোনও মেকআপ ছাড়াই নিচ্ছি। আপনি এখান থেকে হেঁটে ওই আলোর মাঝখানে যাবেন। তারপর ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হাসবেন। ব্যস দত্ত চলে গেল ক্যামেরার পেছনে। ভরত দেখল ওরা ক্যাসেট পাল্টে নিল। সেটের সবাই তাকে দেখছে এখন। একটু নার্ভাস হয়ে গেল ভরত। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দত্তর গলা ভেসে এল, স্টার্ট, হাঁটুন।

ভরত হাঁটল। সোজা আলোর বৃত্তে গিয়ে ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে জোরাল আলোয় ওর চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল। তবু সে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু এই হাসি বেশিক্ষণ হাসলে বোকা বোকা লাগে। সে অন্যপাশে তাকাল। দত্তর গলা ভেসে এল, এবার উল্টোদিকে তাকান। গুড। পেছন ফিরুন।

ভরত হুকুম মান্য করল। স্বপনের গলা ভেসে এল, ঝুমটা এগিয়ে ধরো তো। দত্তদা, ভয়েসটাও দেখে নিন না।

ঠিক আছে। শুনুন ভাই, আপনি যে কোন একটি কবিতার লাইন বলুন তো।

ভরত দেখল একটা নোক লম্বা লাঠি তার মাথার ওপর ধরেছে। সে সুকান্তর ছাড়পত্র বলতে লাগল। পুরো কবিতাটা শেষ হতেই দত্ত চিৎকার করল, কাট। লাইটস অন।

স্বপন বলল, এই মনিটারটা চালাও।


দত্ত টিভির মতো একটা বাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়াল স্বপনের সঙ্গে। ভরত চুপচাপ ওদের পেছনে এল। রি-উইন্ড হচ্ছে। ছবি স্থির হল। তারপর নিজেকে দেখতে পেল সে। ইস্, আর একটু সোজা হয়ে হাঁটা উচিত ছিল তখন। ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই যেন সামান্য ছোট হল যেন। এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে না ব্যায়াম করছে। কিরকম পুতুল পুতুল ব্যাপার। তারপর কবিতাটা শুনল। মনে হলো কোনো কোনো শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে, কোথাও গলা থেমে যাচ্ছে। একবার রিহার্সল করে নিলে এইসব খুঁত থাকত না। ওরা নিশ্চই তাকে বাতিল করে দেবে। কিন্তু প্রথমে স্বপনই বলল, বাঃ।

দত্ত বলল, কোনোরকম তৈরি না হয়ে ও যা করেছে তাতে রাজেশবাবুর চিন্তা থাকবে না। দ্যাখো, এই হল পরিচালকের চোখ। ঠিক আছে ভাই, ওকে! শেষ কথাগুলো চিৎকার করে বলে ভরতের পিঠ চাপড়ে দিল দত্ত।

ভরত বেরিয়ে যাচ্ছিল স্বপন তাকে ডাকল, আপনার নাম কী ভাই?

ভরত।

অদ্ভুত। বাঙালিদের সাধারণত এই নাম হয় না। আপনি আমার সিরিয়ালে একটা কাজ করবেন? দিন পাঁচেকের কাজ। চরিত্রটা ভাল। যাকে ভেবেছিলাম তার এখন অন্য ছবির আউড়োর পড়েছে?

ভরত দত্তর দিকে তাকাল। দত্ত হাসল। তাই দেখে স্বপন বলল, আপনার সঙ্কোচের কোনও কারণ নেই। আমি আজই রাজেশদার সঙ্গে কথা বলে নেব।

ভরত বলল, দেখুন, আমি এসব নিয়ে কখনও চিন্তা করিনি আগে। তাছাড়া ঠিকঠাক পারব কিনা তাও জানি না। রাজেশবাবু নিজে থেকে আমাকে সুযোগ দিচ্ছেন। উনি যা বলবেন এখন। তাই হবে।

ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনার ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে যান। স্বপন কথাগুলো বলতেই কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো একজন এসে ডায়েরি আর কলম খুলল। ভরত বলতেই লোকটা লিখে নিল।

.
 
এখন প্রায় বিকেল। ট্রাম ডিপোর সামনে থেকে বাসে উঠল ভরত। কী থেকে কী হয়ে গেল! একেই কি বলে যোগাযোগ? ডক্টর দত্তর কাছে না গেলে এবং যদি রাজেশ মুখার্জির কথা না বলতেন তাহলে এইসব ঘটনা ঘটত না। সারাদিন খাওয়া হয়নি তবু একটুও টায়ার্ড লাগছে না এখন। বসার জায়গা পেতেই রাস্তার ওধারে সিনেমার হোর্ডিং দেখতে পেল। তার ছবি ওখানে ঝুলবে নাকি! কি রকম মজা লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, দূর, সে তো সিনেমায়। কাজ করছে না। সিরিয়ালের হোর্ডিং হয় না। যারা সিরিয়াল করে তাদের কজনকেই বা সাধারণ মানুষ চেনে? আজকাল বাংলা সিরিয়ালের যা দুর্দশা তাতে লোকের আগ্রহও কমে গিয়েছে। মনটা একটু দমে গেল। তারপরই মনে পড়লে ওরা কেউ টাকার কথা বলেনি। কাজ করলে কত টাকা পাওয়া যাবে তা সে জানে না। জিজ্ঞেস করলেই ওরা খারাপ ভাববে। তাছাড়া তাকে যদি প্রশ্ন। করে কত টাকা চাই সে কি জবাব দিতে পারবে না সে। নিজে কাজটা কিরকম করবে তাই। জানা নেই আগে টাকার কথা কি বলা যায়? ভরতের মনে হল অভিনেতা হলে টাকা যখন পাওয়া যায় তাহলে তার রোজগারের পথ আজ খুলে গেল। অভিনেতাদের গাড়ি বাড়ি হয়, দারুণ স্টাইলে থাকে, বিদেশি সিগারেট খায়। বোম্বের মতো না হলেও কলকাতার কিছু অভিনেতা আরামেই থাকে। সফল হলে সে-ও ওই রকম থাকতে পারে। কিন্তু এমনও হতে পারে, ওরা আর তাকে ডাকল না। সে খোঁজ নিতে গিয়ে শুনল ওকে প্রয়োজন নেই, অন্য কাউকে নিয়ে। নিয়েছে, তাহলে? না, এখনই কাউকে বলা ঠিক হবে না। শেষকালে বাতিল হয়ে গেলে সবাই।

এ নিয়ে হাসাহাসি করবে। ফিল্মলাইনে নাকি সব হয়।

পার্কস্ট্রিটের মোড়ে এসে পড়ল ভরত। ছায়া বাড়ছে। এখান থেকে হসপিট্যাল অনেকটা পথ। দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, এখন ভয় করছিল। যদি অভিজিৎ তার কথা না রাখে, কেউ যদি রক্ত না দিয়ে যায়? ভরত ঠিক করল সেক্ষেত্রে সে নিজেই রক্ত দেবে। শেষবার দিয়েছিল অনেকদিন আগে; এখন দিলে কোনও অসুবিধে হবে না।

হসপিটালের ব্লাডব্যঙ্কে ডিপার্টমেন্ট গিয়ে আশ্বস্ত হল ভরত। দুজন ছেলে এসে শ্রাবণীর জন্য রক্ত দিয়ে গেছে। তাদের একজনের সঙ্গে ওর ব্লাড গ্রুপের মিল আছে। ভরত বলল, আমার ব্লাড় নিন। আমার একই গ্রুপের।

কয়েকটি প্রশ্ন করার পর ভদ্রলোক রাজি হলেন। রক্ত দেওয়ার পর যে খাবারটা ও পেল, তা যেন অমৃত মনে হল। খিদেটা আর থাকল না। অভিজিৎ জনাচারেক ছেলেকে পাঠাবে বলেছিল, অন্তত দুজন এসেছে, এও তো অনেক ভাগ্য। কাল এবং পরশুর জন্যে রক্ত জোগাড় করতে হবে। পরিচিত ছেলেমেয়েদের একটা লিস্ট তৈরি করে অনুরোধ জানাবে সে।
 
শ্রাবণীর বিছানার পাশে ওর মা বসেছিলেন। ভরত লক্ষ্য করল ভদ্রমহিলাকে খুবই শীর্ণ দেখাচ্ছে। সে বেডের সামনে গিয়ে দেখতে পেল শ্রাবণীকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। তার মানে অন্য কোনও পেসেন্টের আত্মীয়দের দেওয়া রক্তের সঙ্গে শ্রাবণীর ব্লাডগ্রুপ মিলে যাওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। অভিজিতের পাঠানো যে ছেলেটির রক্ত শ্রাবণীর কাজে লাগবে না তার সঙ্গে নিশ্চয়ই এটা বদলে দেওয়া হবে।

শ্রাবণীর মা বললেন, কেমন আছ?

এই প্রশ্নের অর্থ এতদিন তোমায় দেখিনি কেন! ভরত মাথা নাড়ল যার কোনো মানেই স্পষ্ট হয় না। মায়ের গলার স্বরে চোখ খুলল শ্রাবণী। ভরতকে দেখে হাসল। ভরত বলল, রক্তের কোনো সমস্যা নেই। ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

শ্রাবণী একবার চোখ বন্ধ করল। তারপর বলল, বসো।

ওরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। মাসিমা বললেন, তুই বিকেলে আপেলগুলো খাসনি? মিষ্টি ছিল তো!

আপেল খেতে ভাল লাগে না।

তাহলে কী আনব?

কিছু আনতে হবে না। আমার খেতে ভাল লাগে না।

না খেলে চলবে কেন, শরীরে জোর থাকবে কী করে।

আর জোর! শ্রাবণী নিঃশ্বাস ফেলল।

ওই হয়েছে মুশকিল। সব যেন জেনে বসে আছিস। তুমি একটু বোঝাও তো বাবা। মাসিমা ভরতের দিকে তাকালেন। ভরত কী বলবে ভেবে পেল না।

শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করল তুমি বাড়ি থেকে আসছ?

না। একটু কাজ ছিল।

সারাদিন খাওনি?

খেয়েছি। হঠাৎ বুকের ভেতর কি যেন নড়ে উঠল। ভরত মুখ ফিরিয়ে নিল।

এইসময় নার্স এসে মাসিমাকে বললে, কয়েকটা জিনিস বাড়ি থেকে আনতে হবে।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, তুমি পেয়ারা খেতে পার?

পেয়ারা! হঠাৎ?

আপেল ভাল লাগে না বললে। আসলে আমার কাছে আপেলকে পথ্য বলে মনে হয়। শুনেছি পেয়ারায় আপেলের চেয়ে কম গুণ নেই।

একটু ঝালমুন মিশিয়ে দিলে দারুণ লাগে।

কাল এনে দেব।

তুমি কালও আসবে?

কেন? আসব না কেন?

তোমার নিশ্চয়ই অনেক কাজ আছে।

দূর। এতদিন বেকার ছিলাম। সামনের সপ্তাহ থেকে কাজ করতে হবে।

কী কাজ? চাকরি?

না। ভরত হাসল।

তাহলে? ব্যবসা?

না। এখন বলব না। আগে কাজটা শুরু করি তারপর বলব।

শ্রাবণী মুখ ফিরিয়ে ছাদের দিকে তাকাল, তাহলে এতদিন আসনি কেন?

ভরত মাথা নিচু করল একটু, তারপর বলল, আমি তো ক্ষমা চেয়েছি।

কিন্তু দিনগুলো যে চলে গেল।

তা হোক, এখনও অনেকদিন সামনে আছে।

আমার নেই। আমার আর বেশি দিন নেই।

একদম এসব বলবে না। তুমি ভাল হয়ে যাবেই। এখন আমার ভাল সময় আসছে। আমার যারা কাছের মানুষ তাদের ভাল হবেই। ভরত জোরের সঙ্গে বলল।

তোমার কাছের মানুষ কারা?

বলতে গিয়ে থমকে গেল ভরত। কাছের মানুষ মানে কী? একসঙ্গে থাকলেই কি কাউকে কাছের মানুষ বলা যায়? বাবার সঙ্গে তার কথা হয় নেহাই প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে। সেসব কথাবার্তা কখনওই একমতে হয় না। মায়ের অনেক কিছুই সে বুঝতে পারে না। মা তাকে যেমন সব কথা খুলে বলে না, সে-ও আজকাল বেশির ভাগ কথাই মাকে বলার তাগিদ অনুভব করে না। এই দুজনের বাইরে তার তেমন কোনও বন্ধু বা আত্মীয় নেই যাকে কাছের মানুষ বলা যায়। তবু অভ্যেসে মাকেই কাছের মানুষ বলতে হবে। এখনও তার জন্যে ওঁর উদ্বেগ তিনি স্পষ্ট প্রকাশ করে ফেলেন। সে মুখ ফেরাল, মা এবং, হেসে ফেলল ভরত, এখন বলব না।কেন?বলার মুখ আমি রাখিনি।কবে বলবে?সামনের মাসে। মুখ থেকে বেরিয়ে এল ভরতের। সময় হয়ে গেলে ভরত মাসিমাকে নিয়ে নেমে এল নিচে। মাসিমা কোনও কথা বলছিলেন না। ডক্টর দত্তর চেম্বারের সামনে ওরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। উনি চেম্বারে নেই। জানা গেল বিকেলে হসপিটালে আসেননি।ভরত খোঁজ নিল। ডক্টর দত্তের এক সহকারী ডক্টর বললেন, স্যার নটা নাগাদ একবার আসবেন। কোনও বক্তব্য থাকলে আমাকে বলতে পারেন।মাসিমাকে বেঞ্চিতে বসিয়ে রেখেছিল ভরত। সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, শ্রাবণীর অবস্থা কিরকম বুঝছেন? ওকে তো আবার রক্ত দেওয়া হয়েছে।দুটো ইনজেকশন পড়েছে। তবে প্রথমবার যেরকম রেসপন্স করেছিল এবার সেরকম হচ্ছে না। এরকম কেসে কোনো ভবিষ্যৎবাণী করা ঠিক নয়। তবে আমি জানি স্যার একজন পেশেন্টকে বারো বছর দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। সহকারী বললেন।হঠাৎ কোনও বিপদ হবে না তো?নিয়মিত রক্ত না দিলে হিমোগ্লোবিন খুব ড্রপ করে যায়। রেড সেলস ম্যাচিওর হওয়ার আগেই ভেঙে যাচ্ছে। বোন ম্যারো অপারেশন করা হবে কাল। স্যার এখনও আশাবাদী।কাল কখন অপারেশন হবে?সকালে। নটার মধ্যে আপনারা রক্ত রেডি রাখবেন। ভরত বেরিয়ে এল। মাসিমার কাছে গিয়ে বলল, চলুন।ডাক্তারবাবু?ওঁর আসতে দেরি হবে। আমাদের কাল সকালেই আসতে হবে।.
 
ওপরে ওঠার আগে প্রণবদের ফ্ল্যাটে গেল ভরত। প্রণবের মা কর্পোরেশন থেকে কাগজপত্র পেয়ে জমি বিক্রি করতে পেরেছেন। মেসোমশাই-এর চিকিৎসা এখন ভাল ভাবেই হচ্ছে। প্রণব তাকে দেখে অবাক, কিরে?

তোকে একটা অনুরোধ করব।

বল।

আমার এক আত্মীয়ের আগামীকাল অপারেশন হবে। ব্লাডব্যাঙ্কের রক্তে কাজ হবে না। তুই সকালে গিয়ে ডোনেট করতে পারবি?

আমি? প্রণবের মুখ শুকিয়ে গেল।

যেটুকু রক্ত দিতে হয় তাতে শরীরে কোনও ক্ষতি হয় না।

সেটা শুনেছি। কিন্তু আমি কখনও রক্ত দিইনি।

দিলে দেখবি ব্যাপারটা কিছুই নয়।

এই সময় মাসীমা এলেন, নাই বা, খামোকা রক্ত দিতে যাবে কেন ও? একেই ছেলেটার শরীর দুর্বল। প্রচন্ড পরিশ্রম গিয়েছে।

ভরত বলল, মাসিমা, ডাক্তাররা পরীক্ষা করে তবেই ওর রক্ত নেবে।

তাহোক। জানি না শুনি না এমন একজনের জন্যে রক্ত দেওয়া কি ঠিক। ধরো, তোমার মেসোমশাই-এর জন্যে রক্তের দরকার পড়ল হঠাৎ, তখন কী হবে?

মাসীমার মুখটাকে একদম অচেনা মনে হচ্ছিল। ভরত চুপচাপ বেরিয়ে এল। লিফটে ওপরে উঠতে উঠতে একবার পারমিতার কথা মনে হল। পারমিতাকে অনুরোধ করবে? ইচ্ছে হল না। ওর রক্ত বোধহয় আরও বেশি মূল্যবান।

বাড়িতে ঢুকে বাবাকে দেখতে পেল ভরত। আজই বাঙ্গালোর থেকে এসেছে। মা জিজ্ঞাসা করল, সকালে থেকে কোথায় ঘুরছিস?

কাজ ছিল।

কী কাজ? আমি আজকাল তোকে একটুও বুঝতে পারি না।

মায়ের কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল ভরত। তারপর হাত মুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে বলল, কাল সকালে আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমাদের।

আমাদের মানে?

তোমাকে আর বাবাকে।

বাবা মন দিয়ে বাংলা কাগজ পড়ছিল টেবিলে বসে, মুখ তুলল। কোথায়?

হসপিটালে। শ্রাবণীকে রক্ত দিতে হবে। ওর কাল অপারেশন।

শ্রাবণী? মায়ের কপালে ভাঁজ পড়ল, সেই মেয়েটা?

হ্যাঁ। ওকে রক্ত দেবার কেউ নেই। ব্লাডব্যাঙ্কের রক্তে কাজ হবে না।

বাবা বলল, আমাদের তো রক্ত দেওয়া বারণ।

কেন?

আমার প্রেসারের সমস্যা আছে, ওষুধ খাই, তা তো জানিস। আর তোর মায়ের ব্লাডসুগার বেড়েছে। ডাক্তার এখনও ওষুধ শুরু করেনি বটে কিন্তু খাওয়া-দাওয়া রেসট্রিক্ট করেছে। মেয়েটি কে?

আমাদের কলেজে পড়ত।

তোদের কলেজের ছেলেদের বল না!

তারা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। ভরত বাবা মায়ের শরীর দেখল। বেশ চমৎকার চেহারা। সাজলে মাকে বেশ সুন্দরী দেখায়। মা যখন সকালে অফিসে বের হয় তখন চমৎকার হয়ে যায়। অথচ ওদের শরীরের রক্ত আর একটা মানুষের কাজে লাগবে না একথা ভাবা যায়?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top