What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলতে পারল, আমাকে সব কথা খুলে বল।

কি বলব! আমার কিছুই বলার নেই। কিন্ত–! অনিমেষ! আমি যা করেছি সেটা খুব সামান্য। নিজের মুখে সে সব কথা বলতে আর ভাল লাগছে। তুমি তো অনেক কিছু ভাবতে দেশের কথা, অনেক মানুষের কথা; আমার মত একটা সাধারণ মেয়ের কষ্টের কথা তুমি ভেবে নিতে পারবে না?

অনিমেষ নিঃশ্বাস ফেলল, তুমি আমার ছেলে বললে কেন? আমার পরিচয়–।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তুমি এখনও ছেলেমানুষ রয়েছে, মুখে যাই বল না কেন।

মানে?

যে কোন সন্তান প্রথমে তো মায়েরই। তাছাড়া, তুমি তো কিছুই জানো না, খোঁজও রাখোনি, তোমার ছেলে বলি কোন্ সাহসে?

কিন্তু আমি তো ওর, মানে, আমি…

বলতে পারছ না, আমি ওর বাবা!

হ্যাঁ তাই। তোমার পক্ষে যতটা সহজ আমার পক্ষে ততটা নয়। তুমি ওকে জন্ম দিয়েছ, প্রতিদিন মানুষ করেছ, তোমার সমস্ত অভ্যাসে ও মিশে রয়েছে।

সত্যি কথা। শান্তিনিকেতনের সেই রাতটাকে আমি আকণ্ঠ গ্রহণ করেছিলাম। তারপর তিলতিল করে সেই আনন্দটুকু আমার শরীরে বড় হল। অনেক আঘাত অনেক অপমান সয়েও আমি সেই আনন্দকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। তোমার মনে সে-সব চিন্তা হয়তো আসে। তোমার কাছে সেটা একটা মুহূর্ত কাউকে একটা কথা বলল। যে বলল সে হয়তো নানান কাজের ভীড়ে কি বলেছিল ভুলেই গেল। যাকে বলল সে কিন্তু চিরজীবন সেই কথাটাকে আঁকড়ে ধরে রইল। সেই ধরে থাকাটা কিন্তু অনেক শক্তি দেয়।

এই মাধবীলতা অন্যরকম। অনেক গভীর খাদের তলায় দাঁড়িয়ে চূড়োর দিকে তাকানোর মত অনিমেষ মাধবীলতার কথাগুলো শুনল। সে আর কথা বলতে পারল না। ক্রমশ এক ধরনের হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ওর মনে হচ্ছিল সে মাধবীলতার সমান যোগ্যতা নিয়ে কোনদিন ছেলেটির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এই পঙ্গু শরীর নিয়ে ছেলেটির কোন উপকারই সে করতে পারবে না।

এইসব ভাবতে ভাবতে আচমকা অনিমেষের শরীর শিহরিত হল। তার ছেলে এই পৃথিবীতে এসেছে। সরিৎশেখর, মহীতোষ এবং অনিমেষের রক্তস্রোত সেই ছেলেটির শিরায় বইছে। মাধবীলতা তাকে পরম যত্নে বাঁচিয়ে রেখে চলেছে। নিজের সন্তানকে দেখবার প্রচণ্ড আগ্রহ অনিমেষকে উত্তেজিত করল। আজ যদি মাধবীলতা তাকে চিনিয়ে না দেয় তাহলে কি সে ছেলেটিকে চিনতে পারবে? তার চোখ মুখ হাঁটাচলার ভঙ্গীতে কি অনিমেষ আছে? অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। ছুটন্ত ট্যাক্সির সিটে হেলান দিয়ে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো ভিজে টসটস করছে, যেকোন মুহূর্তে জলের ধারা গড়িয়ে পড়বে গালে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ট্যাক্সির সিটের এই সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে আর একবার সজাগ হল সে। দুহাতে ভর করে শরীরটাকে হিঁচড়ে মাধবীলতা কাছে গিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করা যায় না। নিজের কাছেই বড় দৃষ্টিকটু ঠেকে। শ্যামবাজার ছাড়িয়ে ট্যাক্সিটা আর জি কর হসপিটালের পাশ দিয়ে সোজা চলে এল বেলগাছিয়ায়। মাধবীলতা ডানদিকের একটা রাস্তায় ড্রাইভারকে ঢুকতে বলল। এদিকে কখনও অনিমেষ আসেনি।

সে জিজ্ঞাসা করল, এদিকটা চিনলে কি করে?

আমার স্কুলের একজন টিচার এখানে থাকেন।

তুমি কি তার সঙ্গে আছ?

না। তিনি এই মুখের বাড়িটায়, আমি ভেতরে।
 
দেখতে দেখতে একটা বস্তিমত এলাকা এসে গেল। রাস্তা খুব সরু। নর্দমায় জল উপসে এসে একটা দিক ডুবিয়ে দিয়েছে। অর্ধউলঙ্গ ছেলেমেয়েরা রাস্তায় খেলছে। তাদের সামনে ট্যাক্সিটার এগোতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। একটা চায়ের দোকানের সামনে ট্যাক্সিটাকে দাঁড়াতে বলল মাধবীলতা। বোধহয় এই গলিতে গাড়ি খুব কমই ঢোকে কারণ ততক্ষণে একরাশ ছোট ছেলেমেয়ে জুটে গেছে গাড়ির সামনে পিছনে। ড্রাইভার সমানে চিৎকার করেও তাদের সরাতে পারছে না। ভাড়া মিটিয়ে মাধবীলতা দরজা খুলে অসহায়ের ভঙ্গীতে এপাশ ওপাশ তাকাতেই চায়ের দোকান থেকে কয়েকটি ছেলে নেমে এল। অনিমেষ তাদের চেহারা দেখল। টিপিক্যাল মাস্তানদের চেহারা সব পাড়াতে একই ধরনের হয়। সাদা কালো প্যান্টের ওপর চকরা বকরা শার্ট, মোটা বেল্ট, হাতে বালা, ভঙ্গাচোরা শীতল মুখগুলো মাধবীলতার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে দিদি?

মাধবীলতা বলল, একটু বিপদে পড়েছি তাই। তোমাদের দাদাকে নিয়ে এসেছি। উনি হাঁটতে পারেন না।

হ্যাঁ হ্যাঁ সেসব জানি। পুলিশের অত্যাচার তো! আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা দাদাকে নিয়ে যাচ্ছি।

হৈহৈ করে ছেলেগুলো বাচ্চাদের গাড়ির সামনে থেকে সরিয়ে দিল। তারপর এপাশের দরজা খুলে দুজন খুব সতর্ক ভঙ্গীতে অনিমেষকে গাড়ি থেকে বের করে নিল। মানুষের কাঁধে ওঠার অভিজ্ঞতা এইভাবে প্রথম, অনিমেষ অস্বস্তিতে মাথা নীচু করেছিল। ততক্ষণে বোধহয় চারধারে খবর হয়ে গেছে। পিলপিল করে বস্তি থেকে কাচ্চাবাচ্চা মেয়েরা বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখছে। মাধবীলতার পিছু পিছু ছেলেরা অনিমেষকে নিয়ে এগোচ্ছিল। যেতে যেতে অনিমেষের কানে নকশাল শব্দটা বারবার প্রবেশ করছিল। এরা যে ওকে খুব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে তা বোঝা যাচ্ছে। মাধবীলতাকেও হাঁটতে হাঁটতে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। কবে ছাড়ল দিদি, একদম হাঁটতে পারেন না, আহা–পুলিশ পুলিশ পশু–এইসব। অনিমেষ বুঝল মাধবীলতা এখানে বেশ পরিচিত এবং তার ইতিহাসের কিছুটা এই বস্তির মানুষ জানে।

বড় গলি থেকে সরু গলিতে ঢুকল মাধবীলতা। দুপাশে চাপা ঘরের সারি। তার পরই একটা দেওয়াল। সদর দরজার পর চিলতে উঠোন। উঠোনের চারধারের চারটে ঘর। একটা বন্ধ দরজার তলা খুলে মাধবীলতা ইঙ্গিত করতে তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা তক্তাপোশের ওপর বসিয়ে দিল। সামনের উঠোনে সমস্ত বস্তি যেন ভেঙ্গে পড়েছে। সবাই মুখ ঢুকিয়ে অনিমেষকে দেখতে চায়। মাধবীলতা ততক্ষণে দুটো বালিশ অনিমেষের পেছনে এনে রেখেছে যাতে সে আরাম করে বসতে পারে।

মাস্তান ছেলেগুলো যেন একটা বিরাট কাজ করেছে এমন ভঙ্গীতে মাধবীলতাকে বলল, কোন দরকার হলে বলবেন, আমরা সবসময় আছি।

মাধবীলতা মুখে কিছু না বলে ঘাড় নেড়ে হাসল।

একটি ছেলে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, দাদা, আপনি কিসে স্পেশালিস্ট? পেটো না পাইপ?

অনিমেষ হেসে ফেলল, দুটোর একটাতেও না। আমি ওসব কিছুই জানি না।

তা বললে শুনবো কেন? শুনেছি আপনি অনেক পুলিশের লাশ শুইয়ে দিয়েছেন। তা কি এমনি এমনি হয়! ঠিক হ্যায়, পরে আপনার কাছ থেকে সব জেনে নেব। এখন চলি।
 
ছেলেগুলো আর একটা উপকার করল। যাওয়ার আগে বাইরে সব ভীড় সরিয়ে বাড়ি খালি করে দিয়ে গেল। শুধু পাশের তিনটে ঘরের বউ বাচ্চারা কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে কৌতূহল মেটানোর পর ঘরটায় শাস্তি এল।

দরজা থেকে ফিরে মাধবীলতা বলল, এখানে সবাই সবাইকে এমন করে চেনে-না, না চাইলেও এইরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়!

অনিমেষ বুঝতে পারছিল মাধবীলতা তাকে এই পরিবেশ সইয়ে দিতে চাইছে। এখানে আসার পর থেকেই অনিমেষের চোখ সন্ধানে ছিল কিন্তু তেমন কাউকে সে দেখতে পায়নি। অন্তত এই ঘরে যে ছেলেকে মাধবীলতা রেখে যায়নি সেটা তালা খোলা থেকেই বোঝা যায়।

খুবই সাধারণ ঘর। মেঝেটা সিমেন্টের, দেওয়ালও। কিন্তু ছাদ টিনের। এখনই বেশ গরম হচ্ছে। এই ঘরের ভাড়া কত অনুমান করা অসম্ভব। একটা তক্তপোশের ওপর পাতলা তোশক রঙিন চাদরে ঢাকা, সস্তার আলনায় কিছু শাড়ি আর বাচ্চাদের জামাপ্যান্ট ঝুলছে, ওপাশে তক্তাপোশের মাথার কাছে একটা কেরোসিন কাঠের টেবিলে কিছু বই পত্র চিঠি ছাড়া অন্য কোন আসবাব ঘরে নেই। ঘরের এক কোণায় কিছু হাঁড়িকড়াই, কলাই-এর থালা, চায়ের কাপডিস কেটলি আর স্টোভ দেখে বোঝা যায় রান্নাবান্না এখানেই সারতে হয় মাধবীলতাকে। মাধবীলতা বলল, আমাদের খেতে একটু দেরী হবে আজকে। এখনও তেল পাইনি।

তেল?

কেরোসিন। আমার তো স্টোভই ভরসা। মোড়ের দোকানে বলে রেখেছি। তেল না পেলে হোটেল থেকে খাবার আনতে হবে।

তাহলে তো মুশকিল।

এইসব মুশকিল নিয়েই তো আমাকে থাকতে হয়। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

তুমি কখন বের হও স্কুলে?

সকালে। রান্না করে দুজনে খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।

দুজনে?

ও স্কুলে যায়। ছুটির পরে দুঘন্টা যাতে স্কুলে বসে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করেছি। তার মধ্যে চলে আসি আমি। ও অবশ্য থাকতে চায় না, কি করা যাবে!

তোমরা একা থাকো, এখানে কেউ কোন প্রশ্ন তোলে না?

না। সমাজের উঁচু তলায় যেমন মানুষ মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না, ঠিক এই নীচুতলার মানুষেরা তেমনি ঘোট পাকায় না। যত কিছু গোলমাল তা ওই মধ্যবিত্ত সমাজ নিয়ে। আমি এখানে বেশ আছি।

ছেলের কোন অসুবিধে হয় না?

হয়। গালাগালি শুনছে দিনরাত। শিখছেও নিশ্চয়ই। আমি যেটুকু পারি সামলে রেখেছি। কদ্দিন পারব জানি না।

বুঝলাম।

কি বুঝলে?

আমার কোন ভূমিকা নেই!

সেটা তোমার ইচ্ছে। তুমি যদি এখানে না থাকতে চাও তাহলে আমার কি সাধ্য তোমাকে আটকে রাখি। আমি তোমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এলাম কারণ আমি চাই ছেলে তোমাকে একবার দেখুক। তুমি যদি বল ওর পিতৃত্বের কোন দায়িত্ব তুমি নেবে না, আমি কি তোমাকে জোর করতে পারি! চা খাবে?

না।

যা তৈল আছে দুকাপ চা হয়ে যেত।

ভাল লাগছে না।

মাধবীলতা এগিয়ে এসে অনিমেষের সামনে বসল। তারপর খুব গাঢ় গলায় বলল, অনিমেষ, আমাদের আইনসম্মত বা সামাজিক বিয়ে হয়নি। তুমি সেগুলোকে মানো কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু যে মেয়ে এতবছর ধরে সন্তানকে বড় করেছে তার কাছে ওসবের কোন মূল্য নেই। এখন আমি নতুন করে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি ভেবে দেখ, আমি জোর করব না।

কি ভাবতে বলছ? অনিমেষ হেসে ফেলল।

হাসির কথা নয়। তুমি কি আমাকে স্ত্রী বলে মনে কর?

এ প্রশ্ন কেন? আমি কি তোমাকে সেভাবে পরিচয় করাইনি?

তাহলে আমার জন্য অপেক্ষা না করে তুমি ওদের সঙ্গে চলে গেলে কেন? আমি যে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি তুমি জানতে না?

এই প্রথম অনিমেষ মাধবীলতাকে থরথর করে কেঁপে উঠতে দেখল। মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখল সে। মাধবীলতা, খাটের শেষপ্রান্তে এসে অনেক চেষ্টার পর নিজেকে সামলে নিল। অনিমেষ বলল, কোনদিন তোমাকে কিছু দিতে পারিনি, শুধু দুহাত ভরে তোমার কাছ থেকে নিয়েই চলেছি।। এ যে আমার কি লজ্জা!

মাধবীলতা মুখ তুলল। সেই মুখ, যা কিনা শত পলের চেয়ে উজ্জ্বল, বলল, তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না। আমি তো তোমার কাছে থেকে কিছুই চাইনি কোনদিন, শুধু তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে মনে হয় তা আমার জন্যেই করছি–এইটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করবে কেন?
 
অনিমেষ দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরল। বোধহয় এইরকম মুহূর্ত মাধবীলতার জীবনে অনেকদিনের আকাক্ষা ছিল। সে শিশুর মত অনিমেষের বুকে মুখে রাখল। ওরা অনেকক্ষণ কোন কথা বলল না। পেছনে দরজা হাট করে খোলা এই খেয়াল এখন ওদের নেই। অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল, লতা, আমাকে ক্ষমা কর।

সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল মাধবীলতা। তারপর অনিমেষের চোখে ভেজা চোখ রেখে বলল, ছি! আমাকে এভাবে তুমি ছোট করো না।

তারপর একটু সজাগ হয়ে বলল, দেখেছ কান্ড, দরজাটা খোলা রয়েছে সে কথা মনেই নেই। তুমি বসো, আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

অনিমেষ বলল, আমার খিদে নেই।

মাধবীলতা হাসল, আমার আছে। আর তিনি তো এখনই এক পেট খিদে নিয়ে আসছেন। তুমি বসো, আমি এক্ষুণি আসছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, সে কোথায়?

স্কুলে। আজকে হাফ ছুটি। আসবার সময় আমি নিয়ে আসব। তুমি ততক্ষণ একটু জিরিয়ে নাও।

ঠিক আছে।

আচ্ছা, তুমি ক্র্যাচ নিয়ে চলতে পারবে কিনা জানো?

না।

তাহলে একটা হুইল চেয়ার কিনতে হয়।

তার অনেক খরচ। তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না। আমার যা করে হোক চলে যাবে। শুধু ভাবছি, একা এমনভাবে বসে বসে সারা দিনরাত কি করব!

একা কেন, আমি আছি, আমরা আছি। তুমি কিন্তু এখনও মেনে নিতে পারছে না!

না, তা নয়। এ ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝবে না।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে খাটের এপাশে চলে এল। তারপর অনিমেষের চুলে হাত রেখে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বলল, হয়তো আমি অনেক কিছু বুঝি না। কিন্তু এইটুকু অন্তত বুঝি, আমাকে যা করতে হবে তা আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে করব। যে জানবে সে জানবে, আমি কিন্তু কাউকে জানতে যাব না।

কি কথার কি জবাব হল!

একটু ভাবো তাহলে জবাবটাকে খুঁজে পাবে। নাঃ আর দেরী করলে চলবে না। আমি এক্ষুণি ঘুরে আসছি, কেমন?

লতা, তুমি যেরকম পরিশ্রম করছ–।

এই পরিশ্রমের একটা আনন্দ আছে। এবার আমি বলি, সেই আনন্দটা তুমিও বুঝবে না।

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মাধবীলতা ব্যাগ আর টিন নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনিমেষ বালিশটাকে সামান্য সরিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আঃ কি আরাম। কিছুক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইল সে। বস্তিতে নানারকমের চিৎকার উঠছে। এই ঘরে ঢোকার পর থেকেই বোঝা গেছে এখানে এক মুহূর্ত কেউ চুপচাপ কাটাতে পারে না। মাধবীলতার পক্ষে নিশ্চয়ই প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়েছিল। আশেপাশের মানুষ এই ঘর–কোনটাই ওর রুচির সঙ্গে মানানসই নয়। অথচ কি চমৎকার মানিয়ে আছে ও। স্বৰ্গছেঁড়া কিংবা জলপাইগুড়িতে থাকতে অনিমেষ স্বপ্নেও ভাবেনি তার স্ত্রী এবং ছেলে বস্তির এই পরিবেশে দিন কাটাবে।
 
ঘুম আসছিল না। মিনিট দশেক বাদে অনিমেষ দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসল। দুটো পাকে সযত্নে সামনের দিকে ছড়িয়ে দিল সে। যত দিন যাচ্ছে তত লিকলিকে হয়ে যাচ্ছে ওগুলো। চিমটি কাটলে লাগে কিন্তু নিজের ইচ্ছে মত ওগুলোকে নাড়ানো যায় না। কাতর চোখে কিছুক্ষণ নিজের দুটো পা চেয়ে চেয়ে দেখল অনিমেষ। তারপর হঠাৎ সচেতন হতেই ঘরের চারপাশে নজর বোলালো। খাটের পাশে মেঝেতে যেটা রয়েছে সেটা যে একটা বেডপ্যান তা বুঝতে অসুবিধে হবার নয়। মাধবীলতা আগে থেকেই সেটা আনিয়ে রেখেছে। ঠোঁট কামড়ালো অনিমেষ।

টেবিলের ওপর কোন ছবি নেই। কিছু বইপত্র আর চিঠি। অনিমেষ একটা খাম তুলে ধরল। খামের ওপর নাম লেখা মাধবীলতা মিত্র। নামটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল অনিমেষ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা মেয়ের মুখ ফুটে উঠল চোখের সামনে। যে মেয়ের এই পৃথিবীর কাউকে কেয়ার করে না অথচ একটুও উদ্ধত নয়, যে অকারণে কোন বাধার কাছে মাথা নোয়ায় না অথচ একটুও দাম্ভিক নয়, সেই মেয়ে একটা সুখের পরিমন্ডল ছেড়ে শুধু ভালবাসার জন্যে–একা একা লড়ে গেল, কখনও কোন আপোস করল না। শান্তিনিকেতনের সেই রাতের ঘটনা অনিমেষের মনে কিছুটা গ্লানি ছিটোলেও তা স্পর্শ করেনি এই মেয়েকে। পরম যত্নে সেই রাতটাকে সে অক্ষয় করেছে। এই কোলকাতায় একা একটি অল্পবয়সী মেয়ে সেই রাতের ফসল দশমাস শরীরে ধরে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছে আইনের কোন অধিকার ছাড়াই, কোন প্রত্যাশা মনে না রেখেই এটা এমন এক ধরনের লড়াই যা নিজেকে পরিশুদ্ধ করে। কোনরকম ব্যাকরণ না মেনে এইভাবে লড়াই করে যাওয়া বোধহয় রাজনীতিতে সম্ভব নয় কিন্তু একটি মেয়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব বলা যাবে না কেন? মাধবীলতা কারও কাছে সফলতা ভিক্ষে করেনি, সাফল্য সে আদায় করে নিয়েছে। সেটা পেরেছে বলেই সে নামের পাশে মিত্র লিখতে পারে, অনিমেষ তার পাশে থাকুক, এই মানসিকতা কিছুতেই পাল্টাবে না।



আলনায় ছোট ছোট জামাপ্যান্ট ঝুলছে। নীচে একটা রাবারের সস্তা হাওয়াই চটি। অনিমেষের সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ল মাধবীলতাকে ওর নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কি নাম রেখেছে মাধবীলতা? সে টেবিলের ওপর আর একবার খোঁজ করল। না, কোন শিশুর বইপত্র নেই। যা আছে সবই মাধবীলতার। ছেলেটার বই কোথায় রাখে? ঘরে তো আর কোন রাখার জায়গা নেই। এই ঘরে একা বসে থাকা অনিমেষের উপকারে এল। এলোমেলো ভাবনা চিন্তাগুলো একসময় গুটিয়ে গিয়ে সে কিছুটা সুস্থ হতে পারল। সে আত্মহত্যা করতে পারবে না। পৃথিবীতে তাকে বেঁচে থাকতে হবে। অনেকদিন আগে সে একটা রাশিয়ান গল্প পড়েছিল। মরুভূমির মধ্যে একটা পাহাড়ে বছরে একবার বৃষ্টি হতো কিনা সন্দেহ। সেখানে জমি পাথুরে কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। বাতাস সারা দিনই তেতে থাকতো, শুরু শেষ রাতে একটু শীতল ছোঁয়া লাগত তাতে। জলের চিহ্ন নেই কয়েকশ মাইলের মধ্যে। পাখি দূরের কথা, হায়েনারাও এই পাহাড়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতো না। এরকম এক জায়গায় হঠাৎ একটা বীজ এসে পড়ল পাথরের খাঁজে। পাথরের আড়াল বলেই বোধহয় হাওয়ার দাপটে সেই বীজটা উড়ে গেল না। কোত্থেকে এল সেটা কে জানে, হয় কোন পথিক ফেলে গেছে নয় ঝড়ো বাতাস উড়িয়ে এনেছে। বীজটার গায়ে ভোরের ঠান্ডা হাওয়া লাগতেই তার শরীর টানটান হল। তার তলায় মাটি নেই কিন্তু ধুলো রয়েছে। দেখা গেল, বাতাস, সেই ভোরের বাতাস থেকে সে নিঃশ্বাস এবং আহার খুঁজে নিয়ে একটু একটু করে মুখ তুলছে, সারা দিনের রোদ ও গরম হাওয়া তাকে যতই পুড়িয়ে মারতে চায় তত সে ভোরের ঠান্ডা বাতাসকে জড়িয়ে ধরে। এইরকম লড়াই চলল কিছুদিন। বীজ থেকে ছোট্ট গাছ হল। পাথরটার আড়ালে আড়ালে সে বড় হল। সূর্য আর গরম হাওয়া ঠিক করল আর একটু বড় হলেই ওটাকে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তখন ওরা জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু যেই গাছটা মুখ তুলল দেখা গেল সেটা পাতা বা ডাল নয়, সূর্যের মুখ চাওয়া ফুল। ছোট্ট সুন্দর। সূর্যের স্পর্শ পেয়ে সুন্দরতর হল। এই উষর মরুভূমিতে সে একদিন মৌমাছি ডেকে আনল। অনিমেষের মনে হল তাকেও এমনি ভাবে লড়তে হবে। এই ঘরে বসে সে নিঃশব্দে লড়াই করে যেতে পারে। শুধু সেই লড়াইয়ের জন্যে তাকে মনে মনে প্রস্তুত হতে হবে। না, আর ভেঙ্গে পড়া নয়। জীবনটা বড় ছোট, বাকী দিনগুলো সুন্দরভাবে খরচ করা দরকার। খুব ছেলেবেলা থেকেই, যেদিনের কথা তার জ্ঞানে আছে সেদিন থেকেই সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভালো এবং মন্দ দুটোই এক সঙ্গে চিন্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটা মাধবীলতার মধ্যে একদম নেই। মাধবীলতা যদি কারো সাহায্য ছাড়াই একা লড়াই করে যেতে পারে তাহলে সে কেন পারবে না? পঙ্গুও তো পাহাড় পার হয়। একটু একটু করে নিজেদের ভুলগুলো ত্রুটিগুলো নিয়ে চিন্তা করা দরকার। আজকের এই হেরে যাওয়া থেকে যে অভিজ্ঞতা হল তাকে কাজে লাগানো দরকার। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই দেশে কখনই সর্বাত্মক বিপ্লব হয়নি। স্বাধীনতার পর এই প্রথম একটা চেষ্টা হয়েছিল। কয়েকটা ভুল–পা হেঁটে এলেও হাঁটা তো হয়েছিল। এরপরে যারা হাঁটবে তারা সেই ভুলটা করবে না।
 
জেলখানা থেকে বেরিয়ে দলের কারো সঙ্গে দেখা করার কথা মাথায় আসেনি। নিজে থেকেও কেউ যোগাযোগ করেনি। অনিমেষ ঠিক জানে না তাদের দলের ছেলেরা এখনও সক্রিয় কিনা। গোপনে কেউ আবার আগুন জ্বালাবার কথা ভাবছে কিনা। কিন্তু যারাই সেই ভাবনা-চিন্তা করুক তাদের আগে মাটিতে রাখতে হবে।

সে এসেছে। দরজায় শব্দ হতেই চোখ খুলল অনিমেষ। মাধবীলতা ফিরেছে। হাতে কোরোসিনের টিন, কাঁধে বাজারের ব্যাগ আর মুখ পেছন দিকে ফেরানো। খুব সহজ গলায় ডাকল, ওদিকে যেও না, ঘরে এসো।

দরজাটা হাট করে খুলে দিল সে। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুর। অনিমেষ দুহাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে কোনরকমে সোজা করে নিল। তারপর সতৃষ্ণ চোখে বাইরের দিকে তাকাল।

মাধবীলতা এখনও দরজা থেকে সরেনি। তার চোখ অনিমেষের মুখের ওপর স্থির। কয়েকমুহূর্ত বাদে অনিমেষ ওকে দেখতে পেল। দেখে চমকে উঠল।

অনিমেষের বুকের মধ্যে এখন একশোটা হিরোশিমা দুলছে। চারপাশ ভেঙ্গেচুরে গলে জ্বলে অন্ধকার হয়ে গেল আচমকা। তারপর ক্রমশ ধোয়া সরে গেলে সেই স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বুক শান্ত করে বয়ে যাওয়া আংরা ভাসা নদীর ওপর উপুড় হয়ে থাকা শিশু কিংবা বালকটি সামনে এসে দাঁড়াল। অপার বিস্ময় নিয়ে যে লাল চিংড়ি মাছেদের খেলা করতে দেখতো। অবিকল সেই চোখ, সেই মুখ, এমনকি তাকানোর ভঙ্গীটাও একই রকম। অনিমেষের মনে হল অনেক অনেক বছর আগের সে তখনকার তাকে দুচোখ ভরে দেখছে।

সেই বালক বলছে, কেমন আছ অনিমেষ?

এই মধ্যবয়স জবাব দিচ্ছে, ভাল না, একদম ভাল না।

তোমার তো এমন হবার কথা ছিল না।

আমি যখন তুমি ছিলাম তখন ছিল না। তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি যখন তুমি ছিলাম তখন সত্যি ভাল ছিলাম।

আমার শরীরটা তোমার মত হয়ে গেলে–।

না কক্ষণো নয়।

মাধবীলতার গলা শোনা যেতেই সব কিছু মিলিয়ে গেল আচমকা। দরজার ফ্রেমে ছবির মত এখনও মাধবীলতা এবং সে। মাধবীলতা বলল, অমন করে কি দেখছ? ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর হাসবার চেষ্টা করল, এসো।

ডাকটা যার উদ্দেশ্যে সে তখন মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুটো বড় চোখ মেলে এদিকে তাকিয়ে আছে। পায়ে ময়লা সাদা মোজা জুতো, প্যান্টশার্টের ওপর দীনতার ছাপ। পিঠে বই-ভরতি স্কুলের ব্যাগ। মাধবীলতা বলল, ডাকছেন, যাও।

একটু দ্বিধা কিন্তু কাটাতে সময় লাগল। তারপর মাধবীলতার আড়াল ছেড়ে সে ছোট পা ফেলে খাটের দিকে এগিয়ে এল। এসে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিমেষ দেখল ওর চোখ এখন তার পায়ের দিকে। চোখ কুঁচকে যাচ্ছে, ঠোঁটের কোণে ভাঁজ।

সহজ হবার চেষ্টায় অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, বল তো আমি কে?

সে চোখ তুলল, তুলে আবার পায়ের ওপর নজর রাখল, তুমি হাঁটতে পার না?

অনিমেষ ওই এক চিলতে দৃষ্টিতে বুঝে নিল মাধবীলতা ওর কাছে কিছু গোপন রাখেনি। তার গলা ভারী হয়ে গেল, না।

পুলিশ করে দিয়েছে?

হ্যাঁ।

কেন?

বুকের ঝড়টাকে কোনরকমে শান্ত করছিল অনিমেষ। দুহাত বাড়িয়ে বলল, অত দূর থেকে কি গল্প করা যায়? আমি তো তোমার কাছে যেতে পারব না, তুমি আমার কাছে এসো। মাধবীলতার শরীরটা কাছে চলে এল। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে দিল দুহাতের আলিঙ্গনে। এখন অনিমেষের দুহাতে এক তাল নরম কাদা, যা নিয়ে ইচ্ছে মতন মূর্তি গড়া যায়।
 
অসাধারন উপন্যাস । এক বসাতে শেষ করেছিলাম ।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top