শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলতে পারল, আমাকে সব কথা খুলে বল।
কি বলব! আমার কিছুই বলার নেই। কিন্ত–! অনিমেষ! আমি যা করেছি সেটা খুব সামান্য। নিজের মুখে সে সব কথা বলতে আর ভাল লাগছে। তুমি তো অনেক কিছু ভাবতে দেশের কথা, অনেক মানুষের কথা; আমার মত একটা সাধারণ মেয়ের কষ্টের কথা তুমি ভেবে নিতে পারবে না?
অনিমেষ নিঃশ্বাস ফেলল, তুমি আমার ছেলে বললে কেন? আমার পরিচয়–।
মাধবীলতা হেসে ফেলল, তুমি এখনও ছেলেমানুষ রয়েছে, মুখে যাই বল না কেন।
মানে?
যে কোন সন্তান প্রথমে তো মায়েরই। তাছাড়া, তুমি তো কিছুই জানো না, খোঁজও রাখোনি, তোমার ছেলে বলি কোন্ সাহসে?
কিন্তু আমি তো ওর, মানে, আমি…
বলতে পারছ না, আমি ওর বাবা!
হ্যাঁ তাই। তোমার পক্ষে যতটা সহজ আমার পক্ষে ততটা নয়। তুমি ওকে জন্ম দিয়েছ, প্রতিদিন মানুষ করেছ, তোমার সমস্ত অভ্যাসে ও মিশে রয়েছে।
সত্যি কথা। শান্তিনিকেতনের সেই রাতটাকে আমি আকণ্ঠ গ্রহণ করেছিলাম। তারপর তিলতিল করে সেই আনন্দটুকু আমার শরীরে বড় হল। অনেক আঘাত অনেক অপমান সয়েও আমি সেই আনন্দকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। তোমার মনে সে-সব চিন্তা হয়তো আসে। তোমার কাছে সেটা একটা মুহূর্ত কাউকে একটা কথা বলল। যে বলল সে হয়তো নানান কাজের ভীড়ে কি বলেছিল ভুলেই গেল। যাকে বলল সে কিন্তু চিরজীবন সেই কথাটাকে আঁকড়ে ধরে রইল। সেই ধরে থাকাটা কিন্তু অনেক শক্তি দেয়।
এই মাধবীলতা অন্যরকম। অনেক গভীর খাদের তলায় দাঁড়িয়ে চূড়োর দিকে তাকানোর মত অনিমেষ মাধবীলতার কথাগুলো শুনল। সে আর কথা বলতে পারল না। ক্রমশ এক ধরনের হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ওর মনে হচ্ছিল সে মাধবীলতার সমান যোগ্যতা নিয়ে কোনদিন ছেলেটির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এই পঙ্গু শরীর নিয়ে ছেলেটির কোন উপকারই সে করতে পারবে না।
এইসব ভাবতে ভাবতে আচমকা অনিমেষের শরীর শিহরিত হল। তার ছেলে এই পৃথিবীতে এসেছে। সরিৎশেখর, মহীতোষ এবং অনিমেষের রক্তস্রোত সেই ছেলেটির শিরায় বইছে। মাধবীলতা তাকে পরম যত্নে বাঁচিয়ে রেখে চলেছে। নিজের সন্তানকে দেখবার প্রচণ্ড আগ্রহ অনিমেষকে উত্তেজিত করল। আজ যদি মাধবীলতা তাকে চিনিয়ে না দেয় তাহলে কি সে ছেলেটিকে চিনতে পারবে? তার চোখ মুখ হাঁটাচলার ভঙ্গীতে কি অনিমেষ আছে? অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। ছুটন্ত ট্যাক্সির সিটে হেলান দিয়ে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো ভিজে টসটস করছে, যেকোন মুহূর্তে জলের ধারা গড়িয়ে পড়বে গালে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ট্যাক্সির সিটের এই সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে আর একবার সজাগ হল সে। দুহাতে ভর করে শরীরটাকে হিঁচড়ে মাধবীলতা কাছে গিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করা যায় না। নিজের কাছেই বড় দৃষ্টিকটু ঠেকে। শ্যামবাজার ছাড়িয়ে ট্যাক্সিটা আর জি কর হসপিটালের পাশ দিয়ে সোজা চলে এল বেলগাছিয়ায়। মাধবীলতা ডানদিকের একটা রাস্তায় ড্রাইভারকে ঢুকতে বলল। এদিকে কখনও অনিমেষ আসেনি।
সে জিজ্ঞাসা করল, এদিকটা চিনলে কি করে?
আমার স্কুলের একজন টিচার এখানে থাকেন।
তুমি কি তার সঙ্গে আছ?
না। তিনি এই মুখের বাড়িটায়, আমি ভেতরে।
কি বলব! আমার কিছুই বলার নেই। কিন্ত–! অনিমেষ! আমি যা করেছি সেটা খুব সামান্য। নিজের মুখে সে সব কথা বলতে আর ভাল লাগছে। তুমি তো অনেক কিছু ভাবতে দেশের কথা, অনেক মানুষের কথা; আমার মত একটা সাধারণ মেয়ের কষ্টের কথা তুমি ভেবে নিতে পারবে না?
অনিমেষ নিঃশ্বাস ফেলল, তুমি আমার ছেলে বললে কেন? আমার পরিচয়–।
মাধবীলতা হেসে ফেলল, তুমি এখনও ছেলেমানুষ রয়েছে, মুখে যাই বল না কেন।
মানে?
যে কোন সন্তান প্রথমে তো মায়েরই। তাছাড়া, তুমি তো কিছুই জানো না, খোঁজও রাখোনি, তোমার ছেলে বলি কোন্ সাহসে?
কিন্তু আমি তো ওর, মানে, আমি…
বলতে পারছ না, আমি ওর বাবা!
হ্যাঁ তাই। তোমার পক্ষে যতটা সহজ আমার পক্ষে ততটা নয়। তুমি ওকে জন্ম দিয়েছ, প্রতিদিন মানুষ করেছ, তোমার সমস্ত অভ্যাসে ও মিশে রয়েছে।
সত্যি কথা। শান্তিনিকেতনের সেই রাতটাকে আমি আকণ্ঠ গ্রহণ করেছিলাম। তারপর তিলতিল করে সেই আনন্দটুকু আমার শরীরে বড় হল। অনেক আঘাত অনেক অপমান সয়েও আমি সেই আনন্দকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। তোমার মনে সে-সব চিন্তা হয়তো আসে। তোমার কাছে সেটা একটা মুহূর্ত কাউকে একটা কথা বলল। যে বলল সে হয়তো নানান কাজের ভীড়ে কি বলেছিল ভুলেই গেল। যাকে বলল সে কিন্তু চিরজীবন সেই কথাটাকে আঁকড়ে ধরে রইল। সেই ধরে থাকাটা কিন্তু অনেক শক্তি দেয়।
এই মাধবীলতা অন্যরকম। অনেক গভীর খাদের তলায় দাঁড়িয়ে চূড়োর দিকে তাকানোর মত অনিমেষ মাধবীলতার কথাগুলো শুনল। সে আর কথা বলতে পারল না। ক্রমশ এক ধরনের হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ওর মনে হচ্ছিল সে মাধবীলতার সমান যোগ্যতা নিয়ে কোনদিন ছেলেটির সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এই পঙ্গু শরীর নিয়ে ছেলেটির কোন উপকারই সে করতে পারবে না।
এইসব ভাবতে ভাবতে আচমকা অনিমেষের শরীর শিহরিত হল। তার ছেলে এই পৃথিবীতে এসেছে। সরিৎশেখর, মহীতোষ এবং অনিমেষের রক্তস্রোত সেই ছেলেটির শিরায় বইছে। মাধবীলতা তাকে পরম যত্নে বাঁচিয়ে রেখে চলেছে। নিজের সন্তানকে দেখবার প্রচণ্ড আগ্রহ অনিমেষকে উত্তেজিত করল। আজ যদি মাধবীলতা তাকে চিনিয়ে না দেয় তাহলে কি সে ছেলেটিকে চিনতে পারবে? তার চোখ মুখ হাঁটাচলার ভঙ্গীতে কি অনিমেষ আছে? অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। ছুটন্ত ট্যাক্সির সিটে হেলান দিয়ে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো ভিজে টসটস করছে, যেকোন মুহূর্তে জলের ধারা গড়িয়ে পড়বে গালে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ট্যাক্সির সিটের এই সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে আর একবার সজাগ হল সে। দুহাতে ভর করে শরীরটাকে হিঁচড়ে মাধবীলতা কাছে গিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করা যায় না। নিজের কাছেই বড় দৃষ্টিকটু ঠেকে। শ্যামবাজার ছাড়িয়ে ট্যাক্সিটা আর জি কর হসপিটালের পাশ দিয়ে সোজা চলে এল বেলগাছিয়ায়। মাধবীলতা ডানদিকের একটা রাস্তায় ড্রাইভারকে ঢুকতে বলল। এদিকে কখনও অনিমেষ আসেনি।
সে জিজ্ঞাসা করল, এদিকটা চিনলে কি করে?
আমার স্কুলের একজন টিচার এখানে থাকেন।
তুমি কি তার সঙ্গে আছ?
না। তিনি এই মুখের বাড়িটায়, আমি ভেতরে।