What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি। এব্যাপারে আপনাদের ধারণা খুবই কম। আপনাদের এই ক্যান্ডিডেট দুজন অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা নিয়েছেন। ধরুন ডিজিট শিখে প্লাস মাইনাস ডিভিশন পর্যন্ত শিখেছেন। কিন্তু আমাদের চাই অঙ্কের মাস্টার ডিগ্রি এবং সেই সঙ্গে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা।

অভিজ্ঞতা! কাজ করতে না দিলে অভিজ্ঞতা হবে কী করে?

ঠিকই। কিন্তু ধরুন আপনাকে এয়ারক্র্যাফট চালানোর ট্রেনিং দেওয়া হলো। মেশিনপত্র চিনলেন। নিজে ফ্লাইং শুরু করা আগে কি একটা প্যাসেঞ্জার প্লেনের পাইলট হিসাবে আপনি দায়িত্ব নিতে পারবেন নাকি সেটা আপনাকে দেওয়া উচিত।

ঠিক তাই। আনস্কিলড পোস্টে কোম্পানি আপনার সঙ্গে যে কন্ট্রাক্ট করেছে তা মেনে চলতে বাধ্য। যদি আপনাদের কাছে কোনো স্কিল্ড ক্যান্ডিডেট থাকত তাহলে আমরা তার সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলতাম। কেউ কম্পাউন্ডারি পাস করলে তাকে আমরা এম. বি. বি. এস ডাক্তার হিসেবে চাকরি দিতে পারি না। প্লিজ, মাথা গরম না করে সহযোগিতা করুন।

নেতারা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন। নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ইন্টারভিউ হোক, আমরা কিন্তু সমস্ত ঘটনার ওপর লক্ষ্য রাখছি।

ভিড় সরে গেলে গৌরব ঘড়ি দেখল। ইতিমধ্যে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এই মানুষগুলো যদি শ্রমিকদের জন্যে দরদী হন তাহলে তাদের বাস্তব জ্ঞান বিসর্জন দিতে হবে? কোম্পানির যে কোনো কাজে প্রতি পায়ে এরা কি বাধা দেয়?

এইসময় একটি অল্পবয়সী স্মার্ট সুন্দরী মহিলা এসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এই অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্যে ক্ষমা চাইলেন। চা খেতে কারো আপত্তি আছে কি না জানতে চাইলে টাইপরা দুজন হেসে বললেন, আপত্তি নেই। গৌরব বলল, না, আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক ধন্যবাদ। মহিলা চোখ ঘুরিয়ে গৌরবকে একবার দেখে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই দুজনের জন্যে চা এল। আরও কিছুক্ষণ সময়। তারপর সুন্দরী আবার এলেন। তিনি যার নাম ডাকলেন তিনি স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠতেই অনুরোধ এল, প্লিজ। চেয়ারম্যান কথা বলবেন। ভদ্রলোক মহিলাকে অনুসরণ করলেন। অর্থাৎ ইন্টারভিউ শুরু হলো। মিনিট আটেক বাদে তিনি রুমালে মুখ মুছতে মুছতে ঘরের সামনে দিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন দ্বিতীয় টাই পরা লোকটা ডাকল, ও দাদা, প্লিজ। ভদ্রলোক তাকালেন। দ্বিতীয় জন জিজ্ঞাসা করল, কী কী প্রশ্ন করল?

ঢোকার আগে আমি তো জানতাম না, আপনি কেন জানবেন? বলে লোকটা জোরে পা ফেলে চলে গেল। সুন্দরী এসে মিষ্টি হেসে দ্বিতীয় জনকে ইশারা করতে তিনি টাই ঠিক করার জন্য চেষ্টা করে অনুসরণ করলেন। গৌরবের মনে পড়ল স্কুলে ছেলেরা একসময় একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করত। বাঙালির মানসিকতায় স্কুলের ছাপ বড্ড জোরালো।

এবার সুন্দরী এসে দাঁড়ালেন, মিস্টার গৌরব বাসু?

হ্যাঁ। গৌরব উঠে এল। মহিলা তাকে নিয়ে করিডোর পেরিয়ে একটা বিশাল দরজায় মৃদু নক করলেন। করে ইশারা করলেন ভেতরে যেতে। গৌরব দরজায় হাত দিতে সেটা খুলে গেল। সে দেখল ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট পাতা বিশাল ঘর। লম্বা টেবিলে ওপাশে যে তিনজন বসে আছেন তাদের একজন স্থির চোখে তাকে দেখছেন। চেয়ারম্যান বসে আছে মাঝখানে। গৌরব নমস্কার করল। তারপর এগিয়ে গেল চেয়ারের দিকে, বসতে পারি? চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন না মে আই কাম স্যার?

গৌরব উত্তর দিলো না। হেসে মাথা নাড়ল।

চেয়ারম্যান বললেন, বসুন মিস্টার বাসু। তারপর ফাইলটার কাগজ ওল্টাতে লাগলেন। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে গৌরব বাকি দুজনকে দেখল। তাঁরা মুখের দিকে যেন এক্সরে চোখে তাকিয়ে আছেন।
 
চেয়ারম্যান মুখ তুললেন, এখানে দেখতে পাচ্ছি আপনি স্টেটসে বারো বছর আছেন। এবার কিজন্যে এসেছিলেন?

আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে।

অর্থাৎ আপনি এখনও ওখানে চাকরি করছেন?

হ্যাঁ স্যার।

মিস্টার বাসু, আপনি আমেরিকায় এখন যে মাইনে পান তা যে কোনো ভারতীয়র কাছে স্বপ্নের অতীত। এমন লোভনীয় চাকরি ছেড়ে আপনি এখানে কেন আসবেন ভাবতে পারছি না।

এটা আমার একদম ব্যক্তিগত ব্যাপার। গেীরব হাসল।

দ্বিতীয়জন বললেন, আপনি মনে করছেন যে দেশকে সেবা করা উচিত মানে দেশের দামী ছেলেদের দেশ সেবার জন্যে ঘরে ফিরে আসা উচিত?

সত্যি কথা বলছি, আমার মনে এখনও কোনো ভাবনা আসেনি।

তাহলে?

বলতে পারেন যাঁদের সঙ্গে আমার মনের শিরা-উপশিরা জড়িয়ে আছে তাদের আর ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। এইসব মানুষ অথবা মানুষেরা কখনও এই দেশ ছেড়ে আমেরিকায় যাবেন না। গৌরব সত্যি কথাই বলল।

কিন্তু আপনার যে কোয়ালিফিকেশন সেইমত চাকরি পাওয়া স্টেটসেই সম্ভব, এদেশে সেটা কোনো কাজে লাগবে না।

হয়তো। তবে একজন ডক্টরেট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রকে তার মতো পড়াতে পারেন। অবশ্য যদি পড়ানোর আবহাওয়াটা ঠিক থাকে।

গুড। কিন্তু আবহাওয়া এখানে অনুকূল নাও হতে পারে। এদেশে মানুষ এখনও আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে ভয় পায়।

স্যার উপকার পেলে ভয় থাকবে না। কিছু স্বার্থলোভী মানুষ তাদের ভয় পাওয়ায়।

চেয়ারম্যান হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, আপনি রাজনীতি করেন?

না স্যার। সময় বা ইচ্ছে কখনই হয়নি।

এখানে যিনি আপনার রিপোর্ট নেবেন তিনি কিন্তু লেস কোয়ালিফায়েড।

যদি তার কমপ্লেক্স না থাকে তাহলে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

ওয়েল। এবার আপনি যেতে পারেন। উই উইল লেট ইউ নো। দিন তিনেকের মধ্যে জানতে পারবেন। চেয়ারম্যানের কথা শেষ হওয়ামাত্র গৌরব উঠে নমস্কার করল। তারপর স্বচ্ছন্দ পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে।

বাড়িতে ফিরে টিনাকে দেখতে পেল গৌরব। আজ আর জিনস কিংবা স্কার্ট নয়, সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে মেয়েটা। বাইরের ঘরে বসে মা আর মলির সঙ্গে গল্প করছিল। গৌরব ঢুকতেই বড় চোখ মেলে তাকাল, তাকিয়ে হাসল।

গৌরব বলে উঠল, আরে ব্বাস! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! কখন এসেছ?

অনেকক্ষণ। দেখা না করে যাব না বলে বসে আছি।

মলি বলল, না গো! আমরাই ওকে জোর করে বসিয়ে রেখেছি।

টিনা হাসল, কনগ্রাচুলেশন!

কী কারণে?

বাঃ। বিয়ের খবরটা এখানে না এলে পেতামই না!

ও, এই ব্যাপার!

মলি বলল, এমন ভাব করছ যেন ব্যাপারটা কিছুই না।

গৌরব হাসল, তোমার খবর বলো টিনা!

ভালো আছি! টিনা মাথা নাড়ল, আমার কিছু কথা ছিল।

বলে ফেলো। গৌরব উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়ল।
 
সরলা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন, এবার উঠে দাঁড়ালেন, তুই কী রে? ও নিশ্চয়ই কথাগুলো শুধু তোকেই বলতে চায় আর তুই আমাদের সামনে শুনতে চাইছিস?

গৌরব বলল, তাই? খুব পার্সোনাল টিনা?

না, মানে, আচ্ছা, মাসীমা আপনি বসুন।

সরলা আপত্তি করলেন, না, না, তুমি কথা বলো। আমি দেখি ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় গেল। সরলা আর দাঁড়ালেন না।

মলি বলল, তাহলে আমি আর বসে থেকে কী করব।

টিনা মাথা নাড়ল, না না। আপনি থাকলে কোনো অসুবিধে হবে না।

গৌরব জানতে চাইল, কী ব্যাপার বলো তো?

টিনা মাথা নিচু করল। একটু ভাবল। তারপর বলল, আমাদের বাড়ির আবহাওয়া এখন পাল্টে গিয়েছে। মা সংসারে সময় দিচ্ছেন! বাবার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি অবশ্য চলছে কিন্তু আমাকে আর আগের মতো একা থাকতে হচ্ছে না।

খুব ভালো ব্যাপার।

হ্যাঁ। ইন ফ্যাক্ট মায়ের সঙ্গে আমার একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মা দেখছি ইদানীং, তার পুরুষ বন্ধুদের এড়িয়ে চলছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে মায়ের এই সম্পর্ক বাবা ভালো চোখে দেখছেন না। মনে হয় তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা আমাকে বোঝাতে চাইছেন, ঠিক সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে, যে মায়ের জন্যে তাঁর জীবনে অশান্তি এসেছে।

গৌরব মলির দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতে মলি মুখ ঘুরিয়ে নিল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওকে কী বলছ?

আমি দুজনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা মিটবে বলে মনে হয় না। বাবা আর মায়ের মধ্যে অন্তত আট বছরের ডিফারেন্স। বাবা ক্যারিয়ার নিয়ে থেকেছেন, শরীরের যত্ন নেননি। যতটা বয়স তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। মা ঠিক উল্টো। ফ্যাট যাতে না হয়, স্কিন ভালো থাকে এসব চেষ্টা করে গেছেন। ফলে বয়সের তুলনায় ওঁকে অনেক ইয়াং লাগে। মনে হয় এটাই বাবার কমপ্লেক্স তৈরি করেছে। টিনা বলল।

গৌরব বলল, তোমার অনুমান সত্যি নাও হতে পারে।

না। আমি ভুল বলছি না। যদি দুজনে একই বয়সের হতো তাহলে হয়তো এমন সমস্যা হতো না। এখন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এদেশের মেয়েরা অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত নিজেদের তাজা রাখতে পারে, ছেলেরা সেই চেষ্টা করেই না।

মলি মাথা নাড়ল, কথাটা সত্যি। আমার ঠাকুমা তিরিশ বছরে পড়তেই আর রঙিন শাড়ি পরতেন না, সেমিজ ব্যবহার করতেন। মা চল্লিশে পৌঁছে পাউডার লিপস্টিকের কথা ভাবতেই পারতে না। সব রঙিন শাড়ি আমাদের দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন পঞ্চাশেও ওসব ভাবতে পারি না। ভালভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা মেয়েদের মনে এখন অনেক বেশি জোরদার হয়েছে।

গৌরব বলল, সেটা বাইরে বেরুতে হচ্ছে বলে। ছেলেদের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে তাই মেয়েরা চেহারা সম্পর্কে এখন সচেতন হয়েছে। কিন্তু টিনা, তোমার সমস্যা আগের থেকে এখন অনেক কমেছে নিশ্চয়ই।

কমেছে। কিন্তু এখন আমরা দাদাকে ফিরে পেতে চাই।

কেন?

মনে হয় দাদা ফিরে এলে একটা ব্যালেন্স তৈরি হবে।

কী ভাবে? সে তো তোমাদের ওপর বিরক্ত।

আমার ওপর নয়। মুশকিল হলো আমি জানি না দাদা কোথায় আছে!

এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি?

আমি জানি না। গৌরবদা, আমি বিয়ে করছি।

অ্যাঁ? মাই গড! এতক্ষণ বলোনি কথাটা? প্রশ্নটা করে গৌরব দেখল মলি হাসছে। সে বলছে, টিনা কিন্তু এসেই আমাদের বলেছে।

আচ্ছা! আর আমাকে এতক্ষণ অন্যকথা বলা হচ্ছিল। তা সেই ভাগ্যবান পুরুষটির পরিচয় দাও। তিনি কি করেন, কোথায় থাকেন?

ও আমার চেয়ে দুবছরের সিনিয়ার। কিন্তু আমার বন্ধু।

গুড। কিন্তু কী করে?

এখনও কিছু করে না। আসলে আমি যদি ওর পাশে না থাকি ও মরে যাবে।

মানে? গৌরব অবাক। মলিও।

সুদীপ ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। হতাশা থেকে একটু একটু করে নেশা করে ফেলেছে। কে না জানে এই নেশা থেকে মুক্তির পথ খুব কম। দুদুবার ওকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে কিন্তু সেরে উঠেই আবার নেশার দিকে এগিয়ে গেছে। কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে না, ব্রেন বেশি পরিশ্রম করলে কষ্ট পায়। অদ্ভুত ব্যাপার, আমাকে দেখলেই সুদীপ কেমন যেন হয়ে যেত। হাসতো, খুশি হতো। আমি যতক্ষণ কাছে থাকতাম ততক্ষণ ও চেষ্টা করত নেশা না করতে। ওরকম ব্রাইট স্বাস্থ্যবান ছেলের দুর্দশা দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। আমি যে আড্ডায় সেদিন গিয়েছিলাম সেখানে সুদীপ ছিল। প্রথম প্রথম দু-এক ঘণ্টা, পরে সাত আট ঘণ্টা ওর সঙ্গে থাকতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম ও মনের জোর আনতে পেরেছে। আমি যতক্ষণ সঙ্গে থাকতাম ততক্ষণ ও নেশা করত না। কষ্ট হতো কিন্তু সেই কষ্টটাকে শেষ পর্যন্ত সুদীপ উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। একটা ছেলের জীবন সম্পূর্ণভাবে আমার ওপর নির্ভর করছে।
 
টিনা থামতেই গৌরব বলল, তুমি খুব ভালো কাজ করেছ টিনা। ড্রাগের নেশা যাদের একবার ধরে নেয় তাদের মানসিক চিকিৎসা আগে দরকার। তুমি সেটা করেছ। কিন্তু একটা ভালো কাজ করার ইচ্ছে থেকে সমস্ত জীবন একসঙ্গে কাটানোর কথা ভাবা ঠিক হবে কিনা তুমি কি ভেবেছ? তুমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করো সুদীপকে কি করুণা করছ না? ও সুস্থ হলে তোমার জীবন যে অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে তা দেবার ক্ষমতা কি সুদীপের আছে?

তুমি একটা অদ্ভুত কথা বললে। আমি একটি শিক্ষিত মানুষ। যা পড়াশোনা করেছি তাতে নিজের খরচ চালানোর ক্ষমতা যদি না থাকে সেটা আমার সমস্যার। সুদীপ আর আমি মিলে রোজগার করলে নিশ্চয়ই না খেয়ে মরব না।

তোমার বাবা-মা এই বিয়ে মেনেছেন?

মাকে রাজি করিয়েছি। কিন্তু বাবাকে নিয়ে সমস্যা হয়েছে।

কী বলছেন তিনি?

তিনি সুদীপকে ভ্যাগাবন্ড, ওয়ার্থলেশ, লুম্পেন বলে গালাগাল দিচ্ছেন। আসলে মা যদি কথাগুলো বলত তাহলে বাবা আমাকে সমর্থন করতেন। আজ সকালে বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন সুদীপকে বিয়ে করলে তিনি সব সম্পর্ক ত্যাগ করবেন।

মলি বলল এতক্ষণে, তুমি যদি নিজেতে স্থির থাকো তাহলে ওকথায় কান দিও না। বাবা মা প্রথমদিকে এমন জেদ দেখান পরে সময় গেলে মেনে নেন।

টিনা মাথা নাড়ল, আমি আমার জন্যে চিন্তা করছি না। এইভাবে আমি চলে গেলে মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক আরও খারাপ হবে।

এই দুজনের মধ্যে তুমি কাকে ভালোবাসো টিনা?

আমি বাবাকে বেশি ভালবাসতাম।

এখন!

আমি জানি না।

আচ্ছা, বিয়ের ব্যাপারে একটু অপেক্ষা করা যায় না?

আমি তো ব্যস্ত নই। কিন্তু সুদীপের মা আমার সাহায্য চাইছেন। তিনি মনে করছেন একমাত্র আমিই সুদীপকে বাঁচাতে পারি। উনি ব্যস্ত হয়েছেন। এটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এদিকটার একমাত্র উপায় দাদাকে নিয়ে আসা।

কিন্তু তোমার দাদা দীর্ঘকাল বাড়ির বাইরে আছে। হয়তো তার মনের চেহারা এবং জীবনের অভ্যাস এতদিনে পাল্টে গিয়েছে। ফিরে এলে সে তোমাদের সঙ্গে মানিয়ে নাও থাকতে পারে।

আমি বিশ্বাস করি না। দাদার মধ্যে অনেক নরম ব্যাপার ছিল।

ছিল তুমি বলছ? তার মানে তুমি জানো না এখনও সেটা আছে কিনা! সে ফিরে এলে তোমার বাবা তাকে নাও মেনে নিতে পারেন। সংঘাতটা তার সঙ্গে ছিল, তাই না? গৌরব উঠল, তোমার মা জানেন যে তুমি তাকে খুঁজতে চাইছ?

না। মা খুব অভিমানী।

এক্ষেত্রে অভিমানটা কীসের?

দাদার চলে যাওয়া তিনি মানতে পারেননি। কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছেন।

থানা পুলিশ করেছেন?

দাদা প্রাপ্তবয়স্ক ছিল।

তাতে কী? একটা লোক হারিয়ে গেলে তাকে কেউ খুঁজবে না। ঠিক আছে, টিনা, আমাকে তুমি দুটো দিন সময় দেবে?

মানে?

আমি আগে তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বেশ।

তারা তো আমার কথা জানেন।

হ্যাঁ। আমি সব বলেছি।

এবার আমরা চা খাব। এত চিন্তাভাবনা স্থগিত থাক।

কিন্তু আমাকে উঠতে হবে। সুদীপকে কথা দিয়ে এসেছি। টিনা উঠে দাঁড়াল, আমি জানি না কেন তোমার ওপর নির্ভর করে আছি।

টিনা চলে গেলে মলি জিজ্ঞাসা করে, তোমার ইন্টারভিউ কেমন হলো?
 
গৌরব সংক্ষেপে তার অভিজ্ঞতার কথা বলল। যাওয়ার আগে টিনা সরলার সঙ্গে দেখা করেছিল। তাই তিনি ঘরে ফিরে এসেছিলেন। গৌরবের কথা শুনে বললেন, ওরা তোকেই নেবে। আমার কথা মিলিয়ে দেখে নিস।

কিন্তু মা, ওরা যদি আমাকে চাকরি করতে ডাকে তাহলেও আমি করতে পারব কি না সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। গৌরব গম্ভীর গলায় বলল।

কেন? মলি জানতে চাইল।

ওভাবে যদি প্রতিপদে ইউনিয়নের চোখ রাঙানি শুনতে হয় তাহলে আর কাজটা হবে না। ঝগড়া চালিয়ে যেতে হবে। তাতে আমি অভ্যস্ত নই।

আগে থেকে কেন এসব ভাবছিস। হয়তো উল্টোটাও হতে পারে। সরলা বললেন, তোর দাদাকে ফোন করেছিস? ও এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তা করছিল।

এমন কিছু খবর তো হয় নি। এসেই শুনবে। মা, তোমার শরীর কেমন আছে?

কেন বল তো? সরলা যেন অবাক হলেন।

তুমি প্রায়ই ওই কাশিটা কাশছ।

কোথায়? কি যে বলিস! সরলা উঠলেন। যেন এড়িয়ে যেতেই বাগানে বেরিয়ে গেলেন।

মলি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলো তো? আমি তো কিছুই জানি না মায়ের কী হয়েছে?

জানি না, গতকাল এবং আজ সকালে বাথরুমে গিয়ে খুব কাশতে শুনলাম। জিজ্ঞাসা করলে কী বললেন শুনলে তো। বনিকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখতো, রাতে বিছানায় শোওয়ার পর কাশিটা হয়নি?

মলি নীরবে মাথা নাড়ল। তারপর আচমকা জিজ্ঞাসা করল, টিনার ব্যাপারটা কী করবে? ও তোমার ওপর খুব নির্ভর করে আছে!

কী করব বুঝতে পারছি না। বাবা-মায়ের মনের মিল না হলে সেটা সন্তানদের ওপর প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আসলে আমরা প্রত্যেকে এতটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছি না যে অল্পেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ি!

তুমি কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছ?

অ্যাঁ? না তোমার কথা ভাবি নি বলার সময়। তবে দ্যাখো, তোমার সঙ্গে দাদার যে ঝামেলা চলছিল তা আর কিছুদিন লেগে থাকলে বনির অবস্থা যে টিনার মতো হতো না কে বলতে পারে।

ঠিক বলেছ। এ ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। মলি মাথা নাড়ল, তবে আমার মনে হয় ওদের ব্যাপারে তুমি কথা না বললেই ভালো করবে।

গৌরব জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

মলি বলল, তুমি হাজার হলেও বাইরের লোক। তোমার কাছে ওঁরা কিছুতেই মনের কথা অকপটে বলতে পারেন না। সেটা না হলে অবস্থা কোনো পরিবর্তন হবে না।

গৌরব উঠল, আমি একটু ঘুরে আসি।

এই তো এলে, হঠাৎ?

একটা ব্যাপারে তুমি ঠিক বলেছ বউদি। ওদের সমস্যার সমাধান করতে হলে ঠিকঠিক ভেতরের লোক দরকার। আমি তার সন্ধানে যাচ্ছি! গৌরব হাসল।

তার মানে?

পরে বলব। বাইরে বেরিয়ে এসে গৌরব দেখল সরলা বাগান পরিষ্কার করছেন। শুকনো পাতা ডাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন তন্ময় হয়ে। এ যেন গাছটার সুস্থ সুন্দর রূপ দিতে তার একান্ত চেষ্টা। অথচ তাঁর কথা ভাববার মানুষ কে আছে। গৌরবের মনে হলো বৃদ্ধ হলে, বয়স বাড়লে, মানুষের মন বোধহয় একমাত্র প্রকৃতির কাছে গেলেই শান্তি পায়। গাছেরা সবাইকে নিয়েই থাকতে ভালবাসে।
 
জয়-এর ডেরা খুঁজে বের করতে কিছু অসুবিধা হলো না। কিন্তু সে তখনও ফেরে নি। পাশের দরজায় একটি অল্পবয়সী বউ দাঁড়িয়েছিল, নাম বলতে ঠোঁট ওল্টানো, কে জানে! ফেরার তো কোনো ঠিক নেই। গৌরব কী করবে বুঝতে পারছিল না। বউটি জিজ্ঞাসা করল,আপনি ওর কে হন?

দাদা। গৌরব জবাব দিল।

যাক। তবু একজন আত্মীয়কে দেখা গেল।

গৌরব বাইরে চলে এল। প্রায় ঘন্টাখানেক এলোমেলো ঘুরে সে যখন আবার ফিরে এল তখন রাত হয়েছে। দরজায় তালা নেই। শব্দ করতে জয় দরজা খুলে অবাক, আরে আপনি? আসুন, আসুন।

না, ভেতরে যাব না। তুমি বরং পোশাক পরে নাও। যেতে হবে।

কোথায়?

এসো, বলছি।

চটপট তৈরি হয়ে দরজায় তালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে জয় জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

তোমাকে আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে।

বলুন।

টিনার খুব বিপদ। ও একটি ছেলেকে বাঁচাবার জন্যে বিয়ে করতে চায়। আমি কথা বলেছি। ওর সিদ্ধান্ত থেকে ওকে সরানো যাবে না। তোমার বাবা ব্যাপারটা মানতে পারছেন না। মায়ের আপত্তি নেই। এই নিয়ে ওই বাড়িতে খুব ঝামেলা হচ্ছে।

তারপর? জয় খুব সহজভাবে জিজ্ঞাসা করল যেন এসবে তার কিছু এসে যাচ্ছে না।

টিনা এসেছিল আমার কাছে। ওর ধারণা একমাত্র তুমি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ও জানল কী করে আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে?

আমি এখনও সেটা বলিনি। কিন্তু পাগলের মতো তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে টিনা। তুমি তো ওই বোনটাকেই সবচেয়ে ভালবাসতে, তাই না?

হুঁ। এবার যেন জয় চিন্তিত হলো।

তাহলে?

কিন্তু ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা আমাকে মেনে নাও নিতে পারেন। সত্যি কথা বলতে কি বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের যে টান থাকে তা ওঁদের সম্পর্কে আমার একদম নেই। আমার সম্পর্কেও একই ধারণা!

সবই ঠিক বলছ তুমি। আবার বেঠিক হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

মানে?

মানুষের মনের নাগাল পাওয়া অত সহজে সম্ভব নয়। কোনো ফর্মুলায় মানুষের মন পড়ে না। গিয়ে হয়তো দেখবে ওঁরা তোমার জন্যে কাঙাল হয়ে বসে আছেন। অসম্ভব কিছু নয়। গৌরবের কথা শেষ হওয়া মাত্র হো হো করে হেসে উঠল জয়, এমন জোরে যে রাস্তার মানুষ তাকিয়ে দেখল। জয় বলল, দাদা, আপনি আমার মাতৃদেবীকে চেনেন না। তিনি আগে একজন মহিলা তারপর মা বোন অথবা স্ত্রী। কিন্তু এই বয়সে টিনা বিয়ে করতে চাইছে আর তিনি সমর্থন করছেন? অদ্ভুত লাগছে।

তোমার বাবা সমর্থন করলে তিনি বিরোধিতা করতেন। বাবা মানতে চাইছেন না বলেই– গৌরব কথা শেষ করল না।

ছেলেটির কী হয়েছে যে টিনাকে বাঁচাতে হবে?

ছেলেটিকে টিনা নিশ্চয়ই ভালবাসে। কিন্তু সে ড্রাগের নেশা করে। আর ওর বিশ্বাস একমাত্র টিনার ভালবাসাই ওকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।

এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করে টিনা সারাজীবন কষ্ট পাবে।

তুমি জানো না। মানুষের পরিবর্তন হয় জয়।

বেশ। আমাকে আপনি কি করতে বলেন?

তোমার অভিমান আছে। অপমান বোধও। কিন্তু যেহেতু তোমার বোন এখন সাহায্য চাইছে তাই বাড়িতে যাওয়া উচিত। সেখানে থাকবে কি না তা তোমার মনের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু টিনার পাশে গিয়ে তুমি দাঁড়াও।

জয় ঘুরে দাঁড়াল, ঠিক আছে। আপনার কথা রাখব। আমি আজই যাচ্ছি। এখনই। আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন?

না জয়। এটা তোমাদের একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। আমি গেলে কেউ সহজ হবে না। উইশ ইউ গুড লাক। গৌরব বাড়ির পথে রওনা হলো।
 
আজ ভোরের বেলায় ঘুম ভেঙে গেল গৌরবের। মুখ ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকাতেই মনে হলো চমৎকার একটা দিন শুরু হতে যাচ্ছে। সে চটপট বিছানা ছেড়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়াতেই নির্মেঘ আকাশ দেখতে পেল। সূর্যদেব সবে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছেন। ঠিক এই সময় সে কাশির শব্দ পেল। চাপা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী। সে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের দিকে তাকাল। খুব সন্তর্পণে বাথরুমে ঢুকে দেওয়ালের গা-ঘেঁষে দাঁড়াতেই ওপাশে কাশির শব্দ তীব্রতর হলো। মা। এরকম কাশি কোনো সুস্থ মানুষ কাশতে পারেন না।

কিছুক্ষণ বাদে কল খোলার শব্দ এল। জল পড়ছে। দীর্ঘক্ষণ। তারপর সব চুপচাপ। গৌরব কী করবে বুঝতে পারছিল না। মাকে প্রশ্ন করলে সে কোনো জবাব পায় না। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গি করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান তিনি। আজ গৌরবের মনে হলো একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। বনিকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সে ঠাকুমার কাছে শোয়। ওকে দিয়েই শুরু করতে হবে।

দাঁত মেজে পরিষ্কার হয়ে বাইরে বেরিয়ে সে দেখল ব্যালকনিতে সরলা বসে আছেন চুপচাপ। এই ভোরেও তার বসার ভঙ্গিতে একটা ক্লান্তির ছাপ। বসে আছেন মাথাটা হেলিয়ে, তাকিয়ে আছেন গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে। এমন কি তিনি গৌরবের পায়ের শব্দও পেলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল গৌরব। তার মনে হলো এই মুহূর্তে মাকে বিরক্ত করা অত্যন্ত অন্যায় হবে। সে পা টিপে মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ল। বনি এখনও শুয়ে আছে কিন্তু তার চোখ খোলা। গৌরবের দেখা পেয়ে সে অবাক হয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল কিন্তু গৌরব তাকে ঠোঁটে আঙুল চেপে কথা বলতে নিষেধ করল। কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলল, ব্রাশ করে আমার ঘরে চলে আয় চুপচাপ, কথা আছে। বনি রহস্যের গন্ধ পেয়ে উৎসাহিত হলো। গৌরব যেভাবে এসেছিল সেইভাবেই বারান্দায় পৌঁছে দেখল মায়ের বসার ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিছুক্ষণ বাদে বনি ঘরে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে কাকু?

তুই এখানে বস। মা তোকে দ্যাখেনি তো?

না ঠাকুমা মনে হলো চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। কাল সারারাত ঘুমোয়নি তো!

কেন? কী হয়েছিল?

কি জানি!

মা খুব কাশছে আজকাল?

হ্যাঁ কাকু, খুব। কাশতে কাশতে বেঁকে যায়। যখন সামলাতে পারে না তখন বাথরুমে ছুটে যায়। কি যন্ত্রণা যে হয় তখন কি বলব!

কাউকে একথা বলিসনি কেন?

ঠাকুমা কাউকে বলতে মানা করেছিল।

কবে থেকে হচ্ছে? অনেকদিন।

গৌরব এবার সত্যি চিন্তায় পড়ল, ঠিক আছে, তুই যা।

কী বলবে বলে ডাকলে, বললে না তো! বনি বেশ অবাক হলো।

এখন নয়। পরে বলব।

ব্রেকফাস্টে বসার আগে গৌরব সৌরভের ঘরে গিয়ে দেখল সে শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছে। দেখামাত্র সৌরভ বলল, আয়। কী খবর?

অফিসে যাবে না?

নাঃ। সকাল থেকে খুব আলসেমি লাগছে। কাজও নেই তেমন।

তোমার সঙ্গে কথা ছিল। গৌরব চেয়ারে বসল।

সৌরভ উঠে বসল বাবু হয়ে, বল।

মায়ের শরীরে কোনো অসুখ হয়েছে।

মানে?

বেশ কিছুদিন ধরে বাথরুমে কাশির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আজ বনির কাছে শুনলাম কাশিটা পুরনো। মা বনিকে নিষেধ করেছেন কাউকে না বলতে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সাধারণ নয়।

মাকে জিজ্ঞাসা করেছিস?

না। করলেও স্বীকার করবে না। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ভালো ডাক্তার জানা আছে?

তা আছে। পাড়াতেই দুজন আছেন। কিন্তু তাতে কী হবে? পেশেন্ট যদি মনে করে তার কিছু হয়নি তাহলে ডাক্তারের কাছে যাবে কেন?

আমি যাওয়ার কথা কখনই বলছি না। তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব যদি ডাক্তার হন তাহলে তাকে বাড়িতে ডাকো। তিনি যদি মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চেক করতে পারেন।

ঠিক আছে। সৌরভ উঠে টেলিফোনের কাছে গেল। মিনিট দুয়েক কথা বলার পর বলল, শ্যামল দত্ত। নটা নাগাদ আসবে। মাকে কিছু বলার দরকার নেই।
 
নটার সময় ওরা সবাই বাগানে বসেছিল। মা যথারীতি গাছের গোড়া পরিষ্কার করছিলেন। গৌরব লক্ষ্য করছিল ওর ভঙ্গিতে ক্লান্তি ফুটে উঠছে। যেন শরীরের বিরুদ্ধে জোর করে কাজটা করছেন নিজেকে সুস্থ প্রমাণ করতে। এই সময় গাড়িটা এসে দাঁড়াতে সৌরভ এগিয়ে গেল। শ্যামল সৌরভের বয়সী, বেশ ভালো চেহারা। হাতে চ্যাপ্টা ব্রিফকেস। সৌরভ নিজের বন্ধু বলে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

মায়ের সঙ্গে আলাপ হতেই শ্যামল বলল, আপনার কথা খুব শুনেছি। কেমন আছেন আপনি?

মা বললেন, আমি খুব ভালো আছি।

কিন্তু আপনি এত ঘামছেন কেন?

ও কিছু না। কাজ করছিলাম বলে ঘাম হচ্ছে।

আপনি বসুন তো মা। শ্যামল একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলো।

কেন? সরলা অবাক।

বসুন। বলছি।

সরলা বাধ্য মেয়ের মতো বসলেন। শ্যা

মল জিজ্ঞাসা করল, আরাম লাগছে?

বসলে আরাম তো লাগবেই।

হুম এবার আমার দিকে তাকান। বলতে বলতে আঙুল দিয়ে সরলার নিচের পাতা টেনে দেখল শ্যামল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে অবাক হওয়ার পর সরলা প্রতিবাদের ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? তুমি ডাক্তার নাকি?

আপনার ছেলের বন্ধু এখন ছেলে ভাবতে পারছেন না কেন? কথা বলতে বলতে ব্রিফকেস থেকে স্টেথো বের করে পরীক্ষা শুরু করে দিলো সে।

সরলা প্রচণ্ড অস্বস্তিতে প্রতিবাদ করতে চাইছেন কিন্তু সেই সময় শ্যামল বলল, এবার একটু বড় করে হাঁ করুন তো মা। হ্যাঁ, আর একটু। শব্দ করুন, অ্যা এইরকম শব্দ, গুড, ঠিক আছে। এবার আপনার হাতটা দিন। প্রেসারটা দেখে নিন আপনি।

আমি প্রেসার দেখব?

হুঁ। শ্যামলের কাজ থেমে ছিল না। সরলার হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে বলল আপনি এখানে তাকান। এটা ডিজিটাল। আপনার যেমন প্রেসার তেমন ফুটে উঠবে নাম্বার। পাম্প করার পর সত্যি নম্বর ঘুরতে দেখলেন সরলা। এরকম প্রেসার যন্ত্র তিনি এর আগে দ্যাখেননি। ঘুরতে ঘুরতে যখন থামল তখন ফুটে উঠছে একশ তিরিশ আর নব্বই। শ্যামল চিৎকার করল, দারুণ। এত ভালো রক্তের চাপ আমারও নেই। চমৎকার।

এবার হাসি ফুটল সরলার মুখে, তবে দ্যাখো। তোমরা আমাকে নিয়ে খামোকা এইসব করলে। শরীর যে ভালো তা আমার মুখ থেকে শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না?

যন্ত্র গুটিয়ে ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রেখে শ্যামল থেমে গেল না। আঙুলের ডগায় বাইরে থেকে মায়ের গলার গ্যান্ডগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর বলল, ঠিক আছে, এবার আপনি যা করছেন তা করতে দিতে আমার আপত্তি নেই।

সরলা ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সৌরভের দিকে, কী ব্যাপার বলতো? ডাক্তার বন্ধুকে বাড়িতে এনে আমায় পরীক্ষা করাচ্ছিস কেন?

জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো, আমেরিকায় সব বয়স্ক মানুষই করায়। সৌরভ এই যুক্তিটা ভেবে রেখেছিল, এবার বলে ফেলল।

শ্যামল বলল, বাড়িটা তো বেশ সুন্দর। চলো বাগানে বসিয়ে রাখবে না ভেতরে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়াবে?

মলি লজ্জা পেল। সে শ্যামলকে ভেতরে আসার জন্যে অনুরোধ করে চায়ের ব্যবস্থা দেখতে দৌড়োল। মাকে বাগানে রেখে দিয়ে ওরা গাছপালা নিয়ে কথা বলতে বলতে বাইরের ঘরে উঠে এল। শ্যামলের ভঙ্গি দেখে গৌরবের ক্রমশ ধারণা হচ্ছিল মায়ের শরীর মোটামুটি ভালোই আছে। সোফায় বসে সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলে?
 
সঙ্গে সঙ্গে শ্যামল গম্ভীর হয়ে গেল, দ্যাখো বাইরে থেকে দেখে যে সব অসুখ বোঝা যায় তা তোমার মায়ের হয়নি। কিন্তু শরীরের ভেতরের কিছু কিছু অসুখ এভাবে চট করে বলে দেওয়া যায় না। ওঁর বুকের গলার একটা এক্সরে আমার এখনই পাওয়া দরকার। সেই সঙ্গে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।

এসব করাতে বলছ কেন?

কিছু লক্ষণ আছে যা আমার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আর এই লক্ষণগুলো আছে বলেই যে অসুখটা হয়েছে তা বলার কোনো হক আমার নেই যতক্ষণ না ওই রিপোর্টগুলো আমি দেখতে পাব।

কি লক্ষণ? তুমি একটু খুলেই বলো না।

লক্ষণ খুলে বললে তুমি বুঝতে পারবে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা রোগের লক্ষণ এক হতে পারে। ঠান্ডা লেগে কারো গলা ধরে যেতে পারে। আর গলা ধরে যাওয়া ক্যানসারের একটা লক্ষণ। তার মানে ঠান্ডা লেগে গলা ধরেছে না তার কি ক্যানসার হয়েছে? অতএব পরীক্ষা না করে বলা বোকামি হবে। আমি লিখে দিচ্ছি কী কী এখনই করতে হবে। শ্যামল প্যাড বের করল। গৌরব উঠে পড়ল। মাকে রাজি করাতে হবে এক্সরে করাতে।

কথাটা শোনামাত্র বেঁকে বসলেন সরলা, আমি বেশ ভালো আছি তোরা আমাকে ঝামেলায় ফেলছিস। এতদিন কত অসুখ গেল কেউ একবারও বলল না ডাক্তার দেখাতে আর এখন বিনা অসুখেই এসব হচ্ছে!

গৌরব বলল, দ্যাখো মা, আমাকে আমেরিকায় যেতেই হবে। যদি কলকাতাতেই ভবিষ্যতে চাকরি করি তবু ওখানকার পাট চুকিয়ে ফেলা যাবে না। তাই আমি যাওয়ার আগে নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে চাই আমার মায়ের শরীর সেন্ট পার্সেন্ট ভালো আছে।

আছেই তো।

সেটা ডাক্তারের রিপোর্ট না পেলে বিশ্বাস করব না।

আমার কথার চেয়ে ডাক্তারের রিপোর্ট তোর কাছে বড় হলো?

তোমার শরীরের ক্ষেত্রে তাই।

হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন সরলা, তোর ছুটি তো শেষ হয়ে এল গোরা।

ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি বলি কি বিয়ে করে জয়তীকে নিয়ে তুই চলে যা।

আর তুমি?

আমি এতকাল যেমন ছিলাম তেমনই থাকব।

না। এবার যদি জয়তীকে নিয়ে যেতে হয় তাহলে তোমাকেও সঙ্গে যেতে হবে।

যাব বললেই কি যাওয়া যায়? আমার তো পাসপোর্ট নেই।

জয়তীরও নেই। তাহলে দুজনের জন্যে একসঙ্গে অ্যাপ্লাই করি।

মাথা খারাপ দেশের মাটি ছাড়া আমি কোথাও মরলে শান্তি পাব না।

ওখানে গিয়ে তোমাকে মরতে হবে কেন? মরার আগে দেশে ফিরে এলেই হবে। এই কথাই ফাইন্যাল হয়ে গেল কিন্তু।

আমাকে লোভ দেখাস না গোরা!

কীসের লোভ? যা আকাশকুসুম তার প্রতি আকাঙ্ক্ষাই লোভ বলা যেতে পারে। আমেরিকায় যাওয়া এখন গুজরাট যাওয়ার চেয়ে সোজা। ধর যদি আমি নাগাল্যান্ডে চাকরি করতাম আর কলকাতায় আসতে তিনদিন লাগত তাহলে কি আমেরিকা থেকে দূরে থাকতাম না? লোভ দেখাব কেন, তুমি যাচ্ছ এটা আমার গর্ব। জানো মা, ওখানে কোনো ভালো জিনিস দেখলেই ভেবেছি তোমাকে দেখাতে পারলে কি আনন্দ হতো। এবার সেসব সখ মিটিয়ে নেব। আমি দাদাকে বলছি।

দাঁড়া। তোর অবস্থা, ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ের মতো।

এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাজ না করলে হয় না। তোমার কিছু ছবি তুলতে হবে। পাসপোর্টের জন্যে।

আমাকে তুই সত্যি নিয়ে যাবি?

আবার এক কথা!

শ্যামল কী বলল?

কোন শ্যামল?

ওঃ, তোর মন কি ভুলো। একটু আগে তোর দাদার বন্ধু এল–।

ওহো। সত্যি, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। গৌরব বলল, কিছু না, শরীর ঠিক আছে। তবে কয়েকটা এক্সরে আর ব্লাড পরীক্ষা করাতে হবে।
 
সরলা আকাশের দিকে তাকালেন, বেশ, ওসব করে নে আগে।

গৌরব চেঁচিয়ে উঠল, গুড। মা তুমি খুব ভালো।

এই সময় সৌরভ শ্যামল বেরিয়ে আসছিল বাড়ি থেকে। শ্যামল জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? হঠাৎ একটা আবিষ্কার করলেন মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ হঠাই। মায়ের যা জেদ তা আমরা জানি। দাদা, মা রাজী হয়েছেন এক্সরে ব্লাড করাতে।

ওকে! সৌরভ হাসল, কাল সকালেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

মলি নিয়ে গিয়েছিল সরলাকে এক্সরে করাতে। বাড়িতে এসে রক্ত নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষাগার থেকে। সেই সমস্ত রিপোর্ট পাওয়া গেল সন্ধেবেলায়। গৌরব রিপোর্ট নিয়ে শ্যামলের চেম্বারে হাজির হলো রাত আটটা নাগাদ। শ্যামলের পশার বেশ ভালো। অন্তত জন বারো মানুষ তখনও অপেক্ষা করে আছেন। এদের টপকে শ্যামলের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করল না সে। ডাক্তারের কাছে যখন কেউ আসে তখন সে প্রয়োজনটাকে জরুরি বলেই মনে করে। বারোজনের পরে এসে কেউ যদি দাদার বন্ধু হিসেবে সুবিধে নিয়ে আগে কাজ শেষ করতে চায় তবে অন্যান্যরা মেনে নিতে বাধ্য হবে কিন্তু একই সঙ্গে ডাক্তার এবং আগন্তুকের ওপর মনে মনে অপ্রসন্ন হবে।

দশটা নাগাদ শ্যমলের মুখোমুখি হতে পারল সে। রিপোর্ট দেখে শ্যামলের মুখ যে গম্ভীর তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পর শ্যামল বলল, আমার মনে হচ্ছে ডক্টর এস কে সরকারকে কালই দেখানো উচিত।

ডক্টর সরকার?

ই এন টি স্পেশালিস্ট।

গলায় কিছু হয়েছে?

মনে হচ্ছে। তবে কতদূর কী হয়েছে তা স্পেশালিস্ট বলতে পারবেন।

শ্যামলবাবু, আপনার কী মনে হয়?

আমার? দেখুন, কিছু কিছু অসুখ থাকে যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এক্তিয়ারে না। আপনার মায়ের অসুখটা আমার নয়, একজন ই এন টি বলতে পারবেন। তবে শুনলাম উনি। অনেকদিন ধরে কাশছেন। তাই না?

অনেকদিন কি না জানি না, আমি হঠাৎ শুনতে পেলাম দিন কয়েক আগে।

মুশকিল কি জানেন, আমাদের বাঙালি মহিলারা সব সময় ভাবেন শরীর খারাপের কথা অন্যকে বললে বিরক্ত করা হবে। যাই ঘটুক তারা চেপে যেতে চেষ্টা করেন। চেপে থাকল তো থাকল। কিন্তু যা লুকিয়ে রাখা যায় না তা প্রকাশ পেলে অন্যরা জেনেই যায় আর তখন অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। আচ্ছা, আমি ডক্টর সরকারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখব। আপনি সৌরভকে বলবেন টেলিফোন করতে।

আপনার কী সন্দেহ হচ্ছে?

দেখুন, ইটস টু আর্লি টু–। আর তাছাড়া আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও ঠিক নয়।

আপনি অনুমান করছেন এবং সেটা সত্যি নাও হতে পারে, এইভাবে বলুন।

শ্যামল গৌরবের মুখের দিকে তাকাল, আপনি বুঝতেই পারছেন?

চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল গৌরব। তার মুখ ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।

শ্যামল বলল, ডোন্ট গেট আপসেট। আপনার মাকে এসব জানানোর কোনো দরকার নেই। ওঁকে আনন্দে রাখুন। এও বলছি, আমার ভাবনা মিথ্যে হলে আমি খুশি হব।

সমস্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর সন্দেহ বলে কিছু রইল না। সন্দেহ শব্দটির মধ্যে কোথাও কিছু আশা অবশিষ্ট থাকে। না-ও হতে পারে। এমন ভাবনা কাজ করে। কিন্তু এখন সেই স্তর থেকেও উঠে এল গৌরব। শ্যামল, ডক্টর সরকার সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন রিপোর্ট দেখে। সরলার পেটে দীর্ঘদিন একটা ঘা ছিল। যখন সেটা বড় আকার নিয়েছে তিনি ওষুধ খেয়ে চাপা দিয়েছেন। চাপা পড়ে গিয়ে তলায় সেটা চেহারা পাল্টেছে। এখন খাদ্যনালীতে তার বিস্তার।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top