What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সামনের এক তারিখে যাব। কুন্তী হঠাৎ গলার স্বর বদলাল, আচ্ছা, আপনি ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে পারেন না?

অর্ক হাসল, আমাকে ওরা থাকতে দেবে কেন? আপনি শিক্ষকতা করেছেন তাই আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। আমার তো– ।

আচ্ছা, শিক্ষকতা ছাড়াও তো ওখানে প্রচুর কাজ আছে। সংগঠনের কাজ। আমি কমলবাবুকে আপনার কথা বলব? সোজা হয়ে বসল কুন্তী।

কী পরিচয় দেবেন?

যেটা ঠিক। বন্ধু। জবাব দিল কুন্তী।

এখনও এ দেশের মানুষ দুই অনাত্মীয় পূর্ণ বয়সের নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে বলে মনে করে না। তারা অন্য ব্যাখ্যা করে। অর্ক বলল।

দুহাজার তেরোতে এসে সেটা অনেক কেটে গেছে। আজ দুপুরে বেরিয়েছিলাম। মেট্রো স্টেশনের ঢোকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল দুটি উনিশ কুড়ির ছেলেমেয়ে। হঠাৎ মেয়েটা শব্দ করে কেঁদে উঠতেই ছেলেটা তাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম যেমন, তেমন যারা আশপাশে ছিল তারা দৃশ্যটা দেখেও দেখল না। কয়েক বছর আগে ওরকম করলে ওদের কী অবস্থা হত ভাবুন তো? যত রেপ হোক, ইভটিজিং হোক, তলে তলে মানুষের মানসিকতার বদল হয়েছে এটা তো মানেন? কুন্তী সরাসরি তাকাল।

না মানি না। আগে মানুষ প্রতিবাদ করত। এখন করে না। এখন নিজের স্বার্থ দেখে। ওই ছেলেমেয়ে দুটো যদি তৃণমুলের সমর্থক না হয় তা হলে প্রতিবাদ করলে পুলিশ তার বিরুদ্ধেই একটা সাজানো মামলা রুজু করতে পারে। তার চেয়ে চারপাশে যা হচ্ছে হোক, আমি যেন আমার মতো বাঁচতে পারি, এটাই এখন সত্যি। অর্ক বলল।

চোখ কপালে তুলল কুন্তী, এ কী? আপনার মুখে কী শুনছি?

তার মানে?

নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের পতন চেয়ে আপনি তৃণমুলকে সমর্থন করেছিলেন। হঠাৎ পালটে গেলেন যে! বেশ অবাক হয়ে বলল কুন্তী।

আমি এখনও মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করি। কিন্তু ওই ছেলেমেয়ে দুটো যদি বামফ্রন্টের সমর্থক হত তা হলে ইচ্ছে থাকলেও ওসব করতে সাহস পেত না। সাহসী হলে পুলিশ মেরে হাত ভেঙে দিত। ওরা শাসক পার্টির সমর্থক বলে সাহস পাচ্ছে, পুলিশ কিছু বলছে না। অর্ক পরিষ্কার বলল।

আপনি বলতে চাইছেন এর মধ্যেই বিজয়ী সমর্থকরা নেত্রীর নির্দেশ মানছে না?

হ্যাঁ। কিন্তু প্রকাশ্যে নয়। আমাদের পাড়ায় বিশ্বজিৎ চিরকাল সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। কিন্তু ইদানীং যিনি ওর পাশাপাশি নেতা হয়েছেন তিনি বছর দেড়েক আগে সিপিএম থেকে তোলা আত্মসাৎ করার জন্যে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এই খবর নেত্রী জানেন না। যেসব নেতারা ওই লোকটিকে বিশ্বজিতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তারা ওঁকে জানাবেন না। রাজা তো কান দিয়েই দেখেন! অর্ক বলল।

এইসব ঝামেলা ভাল পাহাড়ে নেই। ওখানে শান্তিতে কাজ করতে পারবেন। কুন্তী বলল, আপনি এলে আমার ভাল লাগবে।

অর্ক বলল, যদি যাই তা হলে আপনার জন্যেই যাব।

হাত বাড়িয়ে দিল কুন্তী। অর্ক সেই হাত ধরে বলল, খুশি হলাম।

.
 
তুমি মাথা কামাবে আমি কখনও ভাবিনি। মাধবীলতা বলল।

চুল ছাঁটিয়ে এসেছি তো দেখেছ, এখন পুরোটাই হেঁটে ফেলেছি। বেশি আর কী? অনিমেষ বলল, জীবনে দ্বিতীয়বার ন্যাড়া হলাম। চিনতেই পারছিলাম না।

হ্যাঁ। তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। মাধবীলতা গম্ভীর হল।

মানে?

তুমি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে আহত হলে, জেলে গেলে। নিজের স্বার্থের কথা, আমার কথা না ভেবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বাকি জীবন ধরে করে যাচ্ছ। সেই তোমার একটা বিশেষ চরিত্র ছিল। তোমার নিজের মায়ের মৃত্যুর সময় তুমি বালক ছিলে, কিন্তু ঠাকুরদা, বড় পিসিমা, বাবার মৃত্যুর পর তুমি অশৌচ পালন কররানি যা তোমার চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ছিল। সেই তুমি ছোটমায়ের শ্রাদ্ধ করলে মাথা ন্যাড়া করে। শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়লে পুরোহিতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যা অন্ধ সংস্কারে বলা হয়ে থাকে। এই তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। মাধবীলতা কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, অনিমেষ ডাকল, শোনো।

মাধবীলতা দাঁড়াল।

অনিমেষ বলল, পাথরও তো কোনও না কোনও সময় টুকরো হয়ে যায়। আমি যা এতদিন ভেবেছি তা কি সত্যি ছিল? পৃথিবীর কোনও দেশে একটি মানুষ কোনও রাজনৈতিক মতবাদ ছাড়া শুধু প্রতিবাদী হয়ে একক চেষ্টায় সরকার গঠন করতে পারেন না বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সেই বিশ্বাসটাও তো অসত্য প্রমাণিত হল। কমিউনিজমে বিশ্বাসী মানুষ অশ্লীল আচরণ করতে পারে না বলে দৃঢ় ধারণা ছিল। আমি সিপিএমের মতবাদের বিরোধী হলেও ওদের কমিউনিস্ট বলেই ভাবতাম। কিন্তু অনিল বসু আর তার সঙ্গীরা জনসভায় যে অশ্লীল কথার ফোয়ারা ছোটাল তা কি আমার ভাবনার সঙ্গে মেলে? আজ আমি যা করেছি তা আমার বিপক্ষে গিয়েছে। কিন্তু আমার নিজের পক্ষ কী তাই তো বুঝতে পারছি না। ছোটমা যে জীবনযাপন করতেন তাকে সম্মান দিয়ে নিজের যাবতীয় মানসিকতাকে অসাড় করে যে তার শেষ কাজ করলাম তাতে যদি তিনি এবং আমার ঠাকুরদা, বড় পিসিমা, বাবার আত্মা তৃপ্তি পান তার জন্যে নিজেকে বদলাতে আর আপত্তি নেই। এইসময় বাইরে থেকে রামজির গলা ভেসে এল, চাচা, দেবেশচাচা ডাকছেন।

অনিমেষ গলা তুলল, আসছি, গিয়ে বলো। তারপর মাধবীলতার দিকে। তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, রামজি যে এখানে আছে তা অর্ককে বলেছ?

না। ওর সঙ্গে একবারই কথা বলেছিলাম, বলার সুযোগ পাইনি।

কেমন আছে সে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছে। ওদের পার্টি সরকারে এসেছে। খারাপ থাকবে কেন?

.
 
দেবেশের অফিসঘরের দরজায় পৌঁছে অনিমেষ দেখতে পেল দুজন লোক ওর সামনে বসে আছে। একজন মোটাসোটা পাঞ্জাবি পাজামায়, অন্যজন ছিপছিপে, পরনে জিনস্ শার্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ডেকেছিলি?

গম্ভীর মুখে দেবেশ বলল, হ্যাঁ। বোস। অনিমেষ চেয়ারে বসার পর দেবেশ বলল, ও অনিমেষ, আমার বাল্যবন্ধু। ইনি স্থানীয় তৃণমূল নেতা, সম্পন্ন মানুষ, আর উনি ওঁর সহকারী।

তৃণমূল নেতা বললেন, আমার নাম অনুকুল রায়। আমি মশাই কাউকে ঝামেলায় পড়তে দেখলে স্থির থাকতে পারি না। কিছু মাথা গরম ছেলে, আমাদের দলের, দেবেশবাবুর সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়েছে। আরে, একজন মানুষ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের সেবা করছে, তাকে সেটা করতে দে।

দেবেশ বলল, অনুকূলবাবু বলছেন, ওরা যেসব শর্ত দিয়েছে তা উনি বাতিল করে দিচ্ছেন। হিসেব দেখাতে হবে না, ওঁর পরিচিত এক বৃদ্ধাকে যদি থাকতে দিই তা হলে উনি খুশি হবেন। ছেলেদের সঙ্গে যা বলার তা উনি বলে নিয়েছেন।

অনিমেষ বলল, বাঃ, এ তো ভালই হল। একজনের থাকা খাওয়ার যা খরচ তা যদি সবাই যা দেয় তা থেকে ম্যানেজ করে নিতে পারিস

সেটা চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে অনুকূলবাবু মাসে কুড়ি হাজার টাকা পারিশ্রমিক চাইছেন। সেটা দেব কোত্থেকে? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।

অনুকুলবাবু বললেন, আমি যে ছেলেদের শান্ত করলাম, আপনাদের গায়ে যাতে কোনও আঁচ না লাগে তার ব্যবস্থা করব তার জন্যে এটা কি খুব বেশি চাওয়া হচ্ছে?

কিন্তু আমার সামর্থ্য কোথায়! দেবেশ বলল।

হে হে। আপনি একদম ভুলে গেছেন। হাসলেন অনুকূলবাবু, কয়েকদিন আগে যে ভদ্রমহিলা গত হয়েছেন তিনি নাকি বাড়ি বিক্রির লক্ষ লক্ষ টাকা রেখে গেছেন। সেই টাকা তো আশ্রমই পাবে। তিনি নেই, খরচও নেই। সেই টাকার সুদ থেকেই তো এটা দিতে পারেন। আচ্ছা, একটা বন্দোবস্ত হোক, ওই টাকার যা সুদ পাবেন তার অর্ধেক আমায় দিলেই চলবে। মাসিক কিস্তি দিতে হবে না।

অনিমেষ মুখ খুলল, যিনি মারা গেছেন তিনি আমার মা। তার রেখে যাওয়া টাকা আশ্রম পাবে না। তার সুদ দেবেশ তো পাবে না।

বাঃ। এটা তো আরও সহজ হয়ে গেল। উনি তো জলপাইগুড়িতে একাই থাকতেন। আপনি তো ভুলেও দেখাশোনা করেননি। আজ মারা যেতেই উদয় হলেন। এ নিয়ে হইচই করতে পারি। কিন্তু করব না। আপনি অর্ধেক দিয়ে দেবেন।

অনিমেষ উত্তেজিত হল, আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। আমি আপনার দলের কলকাতার নেতাদের জানাব। এসব কী করছেন এখানে?

প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন অনুকূলবাবু, নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনলেন দেবেশবাবু! এই ভদ্রলোক গোখরোর মুখে হাত ঢুকিয়েছেন। আরে, কলকাতার নেতারা কী করবে? আমরা বিশ ত্রিশ কি এক লাখ খাচ্ছি। যারা আমাদের বাঁচাবে তারা কোটির নীচে মুঠো খোলে না। নেত্রীর কানে তারা কখনওই কথা তুলবে না, আর বাইরের লোক নেত্রীকে বললে আমরা তাঁকে জানিয়ে দেব ইনি সিপিএম। নেত্রী সেটাই বিশ্বাস করবেন। কিন্তু এর ফল ভোগ করবেন আপনারা। চল নাটা। অনুকুলবাবু বেরিয়ে গেলেন সঙ্গীকে নিয়ে। দেবেশ বলল, এখন কী করা যায়!

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কি কিছু করার আছে?
 
দেবেশ চিন্তিত গলায় বলল, ওরা যখন এতটা জেনেছে তখন এটাও জানবে যে, তোকে তোর ছোটমা নমিনি করে যাননি। ওঁর অবর্তমানে টাকাগুলো আশ্রমের কাজে খরচ করা হবে। আর সেই খরচের ব্যাপারটা তদারকি করবে মাধবীলতা। এই খবর জানামাত্র ওরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

অনিমেষ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ওদের সবচেয়ে বড় নেতার সঙ্গে পরিচয় আছে?

না। নেই। নির্বাচনের আগে তো দলটাই ছিল নড়বড়ে। সাধারণ মানুষ ওদের শক্তি জোগাল। যারা নেতা হয়ে বসল তাদের মুখ অচেনা। দেবেশ বলল।

তারা দলটাকে চালাচ্ছে কী করে?

দলনেত্রীর নাম ব্যবহার করে।

তা হলে তার কাছেই যাওয়া উচিত। যিনি এত বড় পরিবর্তন দেশে আনলেন, তিনি নিশ্চয়ই অমানবিক হবেন না। নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।

অনিমেষের কথায় অবাক হল দেবেশ, তা হলে তো কলকাতায় যেতে হবে। আর গেলেই মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ কী করে পাব? যিনি দেশের এত বড় বড় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন তিনি আমাকে সময় দেবেন কেন?

এ ছাড়া কোনও পথ নেই। চেষ্টা করতে হবে তার সাক্ষাৎ পাওয়ার। ঠিক তখনই গাড়ির শব্দ কানে এল। দেবেশ এবং অনিমেষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে দুটো গাড়ি থেকে থানার দারোগা নামছেন।

ওদের দেখতে পেয়ে দারোগা সামনে চলে এলেন, দেবেশবাবু, ইনি কে?

আমার বাল্যবন্ধু, অনিমেষ।

কোথায় থাকেন?

এখন কলকাতায়, কিন্তু এই শহরেই বড় হয়েছে।

দারোগা অনিমেষকে আপাদমস্তক দেখলেন, এটা কী করে হল?

অনিমেষ বলল, দুর্ঘটনাই বলা যায়।

আপনি নকশাল ছিলেন, জেল খেটেছেন? চোখ ছোট হল দারোগার।

হ্যাঁ।

বাঃ। আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

কেন? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। দারোগা বললেন।

কী অভিযোগ?

সেটা থানায় গিয়ে শুনবেন।

আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করছেন? তা হলে ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে।

কী আশ্চর্য! আমি তো একবারও বলিনি অ্যারেস্ট করছি। হাসলেন দারোগা। তারপর বললেন, একটু আগে আমরা এই এলাকায় একজন মাওবাদীকে ধরতে পেরেছি। দেবেশবাবু জানেন, ডুয়ার্সে মাওবাদীদের অস্তিত্ব ছিল না। সেই লোকটি বলছে যে আপনার সৌজন্যে এখানে এসেছে। আপনাকে সামনে বসিয়ে ওর সঙ্গে একটু কথা বলব। আপনি নকশাল ছিলেন, ও মাওবাদী। যতই বলুন কোনও সম্পর্ক নেই, তবু–। চলুন।
 
দেবেশ বলল, যদি কোনও মাওবাদী ধরা পড়ে তা হলে তার জন্যে ওকে নিয়ে যেতে হবে কেন? যা জিজ্ঞাসা করার তা এখানেই করতে পারেন।

বললাম না, লোকটা ওঁর কথা বলছে। দারোগা বিরক্ত হলেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি রামজিকে অ্যারেস্ট করেছেন?

আরে! এই তো, আপনি ওকে চেনেন তা প্রমাণ হয়ে গেল। দারোগা খুশি।

দেবেশ অবাক, কিন্তু কখন অ্যারেস্ট করলেন ওকে? রামজি একটু আগেও আশ্রমে ছিল। আপনাদের তো এখানে আসতে দেখিনি।

তাকে হাইওয়ে থেকে পেয়েছি আমরা। লোকটা মাওবাদী, এখানে অনিমেষবাবুর মদতে লুকিয়ে ছিল। হাসলেন দারোগা, এই ইনফরমেশন পাওয়া গিয়েছে অনিমেষবাবুর ছেলের কাছ থেকে। জেরার চাপে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন।

অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, জেরার চাপে মানে? ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে নাকি? কেন? ওর অপরাধ কী?

মাওবাদীদের সঙ্গে ওঁর পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। তা আড়াল করতে উনি তৃণমূলের সমর্থক হয়েছিলেন। চলুন অনিমেষবাবু। অনেক সময় নষ্ট হল! দারোগা বললেন।

অনিমেষ আপত্তি জানাল, তাকে আইনসম্মতভাবে গ্রেফতার করলে সে নিশ্চয়ই যাবে। এই আশ্রম থেকে নিয়ে যাওয়ার পথে তার কিছু হয়ে গেলে পুলিশ তো দায় অস্বীকার করতে পারে। দেবেশ এবং অনিমেষের সঙ্গে দারোগার যখন উঁচু গলায় কথা চলছিল তা পৌঁছে গেল অন্য আবাসিকদের কাছে। ভিড় জমল ওদের ঘিরে। অনিমেষ লক্ষ করল মাধবীলতা অন্য মহিলাদের একেবারে পেছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, মাওবাদীদের সাহায্য করার জন্যে অর্ককে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। জেরার চাপে সে রামজির কথা স্বীকার করেছে। এটা আমি ভাবতে পারছি না।

মাধবীলতা পাথরের মতো একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু প্রতিবাদে নামলেন অন্য আবাসিকরা। তারা কিছুতেই অনিমেষকে আশ্রম থেকে নিয়ে যেতে দেবেন না। দেবেশ দারোগার কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাতেই তিনি বললেন, দুর মশাই, কয়লা খেলে আংরাই তো পটি হবে। ওঁরা যখন আপনাদের এত করে অনুরোধ করলেন তখন যদি রাজি হয়ে যেতেন তা হলে আমাকে এখানে আসতেই হত না।

হকচকিয়ে গেল দেবেশ। তারপর বলল, আমি ওদের প্রস্তাবে রাজি।

গুড। এইজন্যেই তো ওকে ওয়ারেন্ট এনে অ্যারেস্ট করছি না। আমি থানায় নিয়ে গিয়ে এখন বসিয়ে রাখব। আপনি দুঘণ্টার মধ্যে ওঁদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিন। ওঁরা আমায় ফোন করে দিলে অনিমেষবাবুকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব। দারোগা সেপাইদের সাহায্যে অনিমেষকে গাড়িতে তুলে চলে গেলেন।

দেবেশ যাওয়ার জন্যে তৈরি হতেই মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়াল, কোথায় যাচ্ছেন?

নিশ্চয়ই সব শুনেছেন?

শুনেছি। কিন্তু আপনি কোথাও যাবেন না। মাধবীলতা শক্ত গলায় বলল।

মানে? দেবেশ অবাক।

আপনার বন্ধুর পাশে আমি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আছি। যখন নকশাল রাজনীতি করত আমি কখনও বাধা দিইনি। জেল থেকে প্রতিবন্ধী হয়ে বেরিয়ে আসার পরে সাধ্যমতো ওর পাশে থেকেছি। এতদিন পরে ও মাওবাদী জেনেও রামজিকে সাহায্য করেছে কারণ ওর মনের সেই আগুন নিভে যায়নি, যা আমি বুঝতে পারিনি। ছেলে বাবার কিছুটা পেয়েছে, অনেকটা পায়নি। ওর বাবা লালবাজারের পুলিশের হাতে প্রচণ্ড অত্যাচারিত হয়েও মুখ খোলেনি, ও সামান্য জেরার চাপে মুখ খুলেছে। মাধবীলতা হাঁফাচ্ছিল।

কিন্তু একটু সমঝোতা করলে যদি অনিমেষ ছাড়া পায়–! দেবেশ বলল।

কার সঙ্গে সমঝোতা করবেন? আশ্রমের এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত করে হঠাৎ ক্ষমতা পাওয়া লোভী নেতাকেই ঘুষ দিয়ে অনিমেষকে মুক্ত করবেন? অনিমেষ যদি দোষ করে থাকে তা হলে শাস্তি পাবে। যদি বিনা দোষে ওরা শাস্তি দেয় তা হলে যেদিন এরা ক্ষমতায় থাকবে না, সেদিন সে মুক্তি পাবে। দেবেশবাবু, আপনি যদি মাথা নিচু করেন তা হলে এই আমাদের সবার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না। মাধবীলতা মুখ তুলল।

ধীরে ধীরে দেবেশের দুটো হাত ওপরে উঠল। মাধবীলতার সামনে হাতজোড় করে সে মাথা নিচু করল।

.

মহাভারতের কৃষ্ণ মুষলপর্বে অসহায় চোখে যদুবংশ ধ্বংস হতে দেখেছিলেন। এটা ইতিহাস নয়, কাব্যকথায় যদিও বলা হয়ে থাকে, যা নেই মহাভারতে তা ভারতে নেই। তাই ইতিহাসে না থাকলেও ইতিহাস হয়ে গেছে মহাভারতের অনেক ঘটনা। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না তা আগামীকাল বলতে পারবে। জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে কুন্তী। সে কি মাধবীলতা হতে পারবে? আর যিনি কোটি কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাকে কি ধৃতরাষ্ট্র ক্রমশ গ্রাস করে ফেলবে? হায়!
 
সমরেশ মজুমদারের লেখা বরাবরই আমার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। অনেক কাল পর আবার উপন্যাস পড়লাম। শেয়ার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ মামা
 

Users who are viewing this thread

Back
Top