অনিমেষ উত্তেজিত গলায় বলল, আজ কলকাতায় খুব গোলমাল হয়েছে স্ট্রাইক নিয়ে, বাস পুড়েছে, গুলিতে লোক মারা গিয়েছে।
মহিলা আঁতকে উঠলেন, সে কী! হবে?
এই সময় ট্রেনটা দুলে উঠে চলতে শুরু করল। সুরমা জানলা দিয়ে সরে-যাওয়া স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলল, কালকাতায় হয়েছে তো আমাদের কী, আমরা তো শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।
এতক্ষণ বৃদ্ধ ভদ্রলোক চুপচাপ ওদের লক্ষ করছিলেন, এবার উদাস গলায় বললেন, নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়? পাথে যখন নেমেছি তখন আর ভেবে কী লাভ, যা হবার তা হবে!
কথাটা অনিমেষের ভালো লাগল। ওকে সুরমা বসার জায়গা দিয়েছিল। বৃদ্ধের মুখোমুখি বসে ও জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?
কলকাতায়। তুমিও বোলপুরে?
না, আমি কলকাতায় যাব।
কলকাতায় কোথায়?
ঠিকানাটা সুটকেসে থাকলেও রাস্তার নাম ওর মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ বলল, সাত নম্বর হবেন মল্লিক লেন, কলকাতা বারো।
বৃদ্ধ হেসে ফেলেন, তুমি কলকাতায় এর আগে যাওনি, না? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। বাবার এক বন্ধু স্টেশনে আসবেন।
তোমার ঠিকানা থেকে আমার বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা, স্টেশনের কাছেই বউবাজারে। কলকাতায় পড়তে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
অন্য দিন হলে ট্রেনে জায়গা পাওয়া যেত না, আজ গড়ের মাঠ। প্যানিক একেই বলে। এবার একটু শোয়ার ব্যবস্থা করা যাক। আমি বরং ওপরের বাকে উঠে পড়ি, একদম কাল সকালে মনিহারিঘা না এলে উঠছি না।উপযাচক হয়েই অনিমেষ বৃদ্ধকে সাহায্য করল। সমস্ত মালপত্র একটা বাছে জমা করে বৃদ্ধের জায়গা অন্যটায় কয় দিল। ওর নির্দিষ্ট ঠিকানার কাছাকাছি একটা মানুষকে পেয়ে বুকে এখন কেম সাহস এসেছে। যদি সবার বন্ধুকে স্টেশনে চিনতে না পারে তা হলে আর জলে পড়তে হবে না।
রাত বাড়লে ছুটন্তু কামরায় একটা অদ্ভুত নির্জনতা সৃষ্টি হয়। ফণাকা মাঠ অথবা নদীর ওপর দিয়ে যেতে-যেতে রাতের রেলগাড়ি গজীর শব্দে চরাচর কাঁপিয়ে যায়, তখন চুপচাপ বসে থাকা বড় মুশকিল। এখন কামরাভরতি ঘুম, কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে-মাঝে অজানা অচেনা মেনে গাড়ি থামছে, কখনো ফেরিওয়ালার চিকার, কখনো তাও নেই। এই কামরায় যাত্রীরা সম্ভাব্য ভয়ের হাত থেমে নিশ্চিত হবার জন্য দরজা লক করে রাখায় কাটির টেশনে গ্যাটফর্ম থেকে কেউ-কেউ ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করেছিল। নিশ্চয়ই তখন অবধি দরজার নিকটবর্তীরা জেগে ছিলেন, কিন্তু দরজা খোলা হয়নি। এখন ট্রেনের দুলুনিতে চাকার শব্দ আর বাইরে আকাশভাড়া বৃষ্টির শীতলতায় সমস্ত কামরা গভীর ঘুমে অচেতন।
ওর শোয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওপরের একটা বাঙ্ক থেকে মালপত্র নামিয়ে শোয়া যেত কিন্তু অনিমেষের আর পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করছিল না। ওর আজকের রাত্রে ঘুমাতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত মহিলা তাকে পায়ের কাছে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলে আধশোয়া হয়ে গড়িয়ে নিতে পারে। ওপরের বাঙ্কে বৃদ্ধের নাক ট্রেনের চাকার শব্দের সঙ্গে তাল রেখে চমৎকার ডেকে যাচ্ছে। প্রথম দিকে অসুবিধে হচ্ছিল, এখন এই নির্জনতায় সেটা খাপ খেয়ে গেছে। মহিলা দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে চাদরমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছন। এখন ওঁকে একদম অন্যরকম লাগছে। মানুষের ঘুমই বোধহয় তাকে সরলতা এনে দিতে পারে। অন্য বেঞ্চিতে সুরমা চিত হয়ে শুয়ে আছে। চাদর গলা অবধি টানা।
মহিলা আঁতকে উঠলেন, সে কী! হবে?
এই সময় ট্রেনটা দুলে উঠে চলতে শুরু করল। সুরমা জানলা দিয়ে সরে-যাওয়া স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলল, কালকাতায় হয়েছে তো আমাদের কী, আমরা তো শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।
এতক্ষণ বৃদ্ধ ভদ্রলোক চুপচাপ ওদের লক্ষ করছিলেন, এবার উদাস গলায় বললেন, নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়? পাথে যখন নেমেছি তখন আর ভেবে কী লাভ, যা হবার তা হবে!
কথাটা অনিমেষের ভালো লাগল। ওকে সুরমা বসার জায়গা দিয়েছিল। বৃদ্ধের মুখোমুখি বসে ও জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?
কলকাতায়। তুমিও বোলপুরে?
না, আমি কলকাতায় যাব।
কলকাতায় কোথায়?
ঠিকানাটা সুটকেসে থাকলেও রাস্তার নাম ওর মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ বলল, সাত নম্বর হবেন মল্লিক লেন, কলকাতা বারো।
বৃদ্ধ হেসে ফেলেন, তুমি কলকাতায় এর আগে যাওনি, না? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। বাবার এক বন্ধু স্টেশনে আসবেন।
তোমার ঠিকানা থেকে আমার বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা, স্টেশনের কাছেই বউবাজারে। কলকাতায় পড়তে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
অন্য দিন হলে ট্রেনে জায়গা পাওয়া যেত না, আজ গড়ের মাঠ। প্যানিক একেই বলে। এবার একটু শোয়ার ব্যবস্থা করা যাক। আমি বরং ওপরের বাকে উঠে পড়ি, একদম কাল সকালে মনিহারিঘা না এলে উঠছি না।উপযাচক হয়েই অনিমেষ বৃদ্ধকে সাহায্য করল। সমস্ত মালপত্র একটা বাছে জমা করে বৃদ্ধের জায়গা অন্যটায় কয় দিল। ওর নির্দিষ্ট ঠিকানার কাছাকাছি একটা মানুষকে পেয়ে বুকে এখন কেম সাহস এসেছে। যদি সবার বন্ধুকে স্টেশনে চিনতে না পারে তা হলে আর জলে পড়তে হবে না।
রাত বাড়লে ছুটন্তু কামরায় একটা অদ্ভুত নির্জনতা সৃষ্টি হয়। ফণাকা মাঠ অথবা নদীর ওপর দিয়ে যেতে-যেতে রাতের রেলগাড়ি গজীর শব্দে চরাচর কাঁপিয়ে যায়, তখন চুপচাপ বসে থাকা বড় মুশকিল। এখন কামরাভরতি ঘুম, কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে-মাঝে অজানা অচেনা মেনে গাড়ি থামছে, কখনো ফেরিওয়ালার চিকার, কখনো তাও নেই। এই কামরায় যাত্রীরা সম্ভাব্য ভয়ের হাত থেমে নিশ্চিত হবার জন্য দরজা লক করে রাখায় কাটির টেশনে গ্যাটফর্ম থেকে কেউ-কেউ ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করেছিল। নিশ্চয়ই তখন অবধি দরজার নিকটবর্তীরা জেগে ছিলেন, কিন্তু দরজা খোলা হয়নি। এখন ট্রেনের দুলুনিতে চাকার শব্দ আর বাইরে আকাশভাড়া বৃষ্টির শীতলতায় সমস্ত কামরা গভীর ঘুমে অচেতন।
ওর শোয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওপরের একটা বাঙ্ক থেকে মালপত্র নামিয়ে শোয়া যেত কিন্তু অনিমেষের আর পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করছিল না। ওর আজকের রাত্রে ঘুমাতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত মহিলা তাকে পায়ের কাছে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলে আধশোয়া হয়ে গড়িয়ে নিতে পারে। ওপরের বাঙ্কে বৃদ্ধের নাক ট্রেনের চাকার শব্দের সঙ্গে তাল রেখে চমৎকার ডেকে যাচ্ছে। প্রথম দিকে অসুবিধে হচ্ছিল, এখন এই নির্জনতায় সেটা খাপ খেয়ে গেছে। মহিলা দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে চাদরমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছন। এখন ওঁকে একদম অন্যরকম লাগছে। মানুষের ঘুমই বোধহয় তাকে সরলতা এনে দিতে পারে। অন্য বেঞ্চিতে সুরমা চিত হয়ে শুয়ে আছে। চাদর গলা অবধি টানা।