What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনিমেষ উত্তেজিত গলায় বলল, আজ কলকাতায় খুব গোলমাল হয়েছে স্ট্রাইক নিয়ে, বাস পুড়েছে, গুলিতে লোক মারা গিয়েছে।

মহিলা আঁতকে উঠলেন, সে কী! হবে?

এই সময় ট্রেনটা দুলে উঠে চলতে শুরু করল। সুরমা জানলা দিয়ে সরে-যাওয়া স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলল, কালকাতায় হয়েছে তো আমাদের কী, আমরা তো শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।

এতক্ষণ বৃদ্ধ ভদ্রলোক চুপচাপ ওদের লক্ষ করছিলেন, এবার উদাস গলায় বললেন, নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়? পাথে যখন নেমেছি তখন আর ভেবে কী লাভ, যা হবার তা হবে!

কথাটা অনিমেষের ভালো লাগল। ওকে সুরমা বসার জায়গা দিয়েছিল। বৃদ্ধের মুখোমুখি বসে ও জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?

কলকাতায়। তুমিও বোলপুরে?

না, আমি কলকাতায় যাব।

কলকাতায় কোথায়?

ঠিকানাটা সুটকেসে থাকলেও রাস্তার নাম ওর মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ বলল, সাত নম্বর হবেন মল্লিক লেন, কলকাতা বারো।

বৃদ্ধ হেসে ফেলেন, তুমি কলকাতায় এর আগে যাওনি, না? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। বাবার এক বন্ধু স্টেশনে আসবেন।

তোমার ঠিকানা থেকে আমার বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা, স্টেশনের কাছেই বউবাজারে। কলকাতায় পড়তে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

অন্য দিন হলে ট্রেনে জায়গা পাওয়া যেত না, আজ গড়ের মাঠ। প্যানিক একেই বলে। এবার একটু শোয়ার ব্যবস্থা করা যাক। আমি বরং ওপরের বাকে উঠে পড়ি, একদম কাল সকালে মনিহারিঘা না এলে উঠছি না।উপযাচক হয়েই অনিমেষ বৃদ্ধকে সাহায্য করল। সমস্ত মালপত্র একটা বাছে জমা করে বৃদ্ধের জায়গা অন্যটায় কয় দিল। ওর নির্দিষ্ট ঠিকানার কাছাকাছি একটা মানুষকে পেয়ে বুকে এখন কেম সাহস এসেছে। যদি সবার বন্ধুকে স্টেশনে চিনতে না পারে তা হলে আর জলে পড়তে হবে না।

রাত বাড়লে ছুটন্তু কামরায় একটা অদ্ভুত নির্জনতা সৃষ্টি হয়। ফণাকা মাঠ অথবা নদীর ওপর দিয়ে যেতে-যেতে রাতের রেলগাড়ি গজীর শব্দে চরাচর কাঁপিয়ে যায়, তখন চুপচাপ বসে থাকা বড় মুশকিল। এখন কামরাভরতি ঘুম, কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে-মাঝে অজানা অচেনা মেনে গাড়ি থামছে, কখনো ফেরিওয়ালার চিকার, কখনো তাও নেই। এই কামরায় যাত্রীরা সম্ভাব্য ভয়ের হাত থেমে নিশ্চিত হবার জন্য দরজা লক করে রাখায় কাটির টেশনে গ্যাটফর্ম থেকে কেউ-কেউ ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করেছিল। নিশ্চয়ই তখন অবধি দরজার নিকটবর্তীরা জেগে ছিলেন, কিন্তু দরজা খোলা হয়নি। এখন ট্রেনের দুলুনিতে চাকার শব্দ আর বাইরে আকাশভাড়া বৃষ্টির শীতলতায় সমস্ত কামরা গভীর ঘুমে অচেতন।

ওর শোয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওপরের একটা বাঙ্ক থেকে মালপত্র নামিয়ে শোয়া যেত কিন্তু অনিমেষের আর পরিশ্রম করতে ইচ্ছে করছিল না। ওর আজকের রাত্রে ঘুমাতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত মহিলা তাকে পায়ের কাছে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলে আধশোয়া হয়ে গড়িয়ে নিতে পারে। ওপরের বাঙ্কে বৃদ্ধের নাক ট্রেনের চাকার শব্দের সঙ্গে তাল রেখে চমৎকার ডেকে যাচ্ছে। প্রথম দিকে অসুবিধে হচ্ছিল, এখন এই নির্জনতায় সেটা খাপ খেয়ে গেছে। মহিলা দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে চাদরমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছন। এখন ওঁকে একদম অন্যরকম লাগছে। মানুষের ঘুমই বোধহয় তাকে সরলতা এনে দিতে পারে। অন্য বেঞ্চিতে সুরমা চিত হয়ে শুয়ে আছে। চাদর গলা অবধি টানা।
 
বৃষ্টি সমস্ত শরীরে মেখে ছুটন্ত রেলগাড়িতে এখন শীতল বাতাস ঢুকছে। যদিও জানলার কাচ নামানো তবু কোথাও বোধহয় ছিদ্র আছে। অনিমেষঅলস ভঙ্গিতে সামনের বেঞ্চিতে পা তুলে দিয়ে জানালায় চোখ রাখল। পুরু জলের ধারা কাচটাকে ঘোলাটে করে দিয়েছে। এখন দাদু নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। পিসিমা অত বড় বাড়িতে দুজন বৃদ্ধ মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এই রাত্রে-শুধু এই রাত কেন, বাকি জীবন কীভাবে কাটাবেন। আই উইল ওয়েট ফর ইউ! অনিমেষের এই কথাটা মনে আসতেই কেমন কান্না পেয়ে গেল।

হঠাৎ ও টের পেল পায়ের ওপর কিসের স্পর্শ, মৃদু চাপ দিচ্ছে। ও এস্তে পা সরিয়ে নিয়ে চোখ খুলতেই কিছু বুঝতে পারল না। সামনে সুরমা ঘুমুচ্ছে। ঘুমের ঘোরে কি ওর পায়ের সঙ্গে পা লেগেছে। সেই সময় সরমা চোখ খুলল, তারপর খুব চাপা গলায় বলল, ঘুম আসছে না?

অনিমেষ হেসে মাথা নাড়ল।

কার জন্যে মন-কেমন করছে।

কারও জন্যে নয়।

ধ্যেৎ, মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। আমার যে তা-ই হচ্ছে, একদম ঘুম আসছে না।

কেন?

লজ্জা-লজ্জা কুশ করল সুরমা, তারপর বলল, সব ছেড়ে যেতে কারও ভালো লাগে?

শান্তিনিকেতনে গেলে ভালো লাগবে।

মা ঘুমুচ্ছে?

হ্যাঁ। অনিমেষ মহিলার দিকে তাকাল।

গোবিন্দদাকে কেমন লাগল? ফিসফিস করে বলল সুরমা।

ভালো, কেন?

বাবা বলে, গুণ্ডা বদমাশ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মা বলে মেয়েরা নাকি কচুরিপানার মতো, যে-কোনো জায়গায় ঠিক জায়গা করে নেয়।

অনিমেষ কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ওর হঠাৎ সীতার কথা মনে পড়ল। সীতা এখন কী করছে? বুকের মধ্যে হুড়মুড় করে যেন সমস্ত ট্রেনটা ঢুকে পড়ল। ও প্রচণ্ড অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়াল। ভালো লাগছে না, কিছু ভালো লাগছে না। পাশ ফিরতেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। চাঁদরের তলায় সুমার সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। ও চট করে সুমার মুখের দিকে তাকাল।অ একটা হাত ভাঁজ করে চোখের ওপর চাপা দেওয়া আর দুটো গাল ভিজিয়ে টিপে রাখা টের দিকে জল গড়িয়ে আসছে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল।

এই সময় কোনো বিরাট নদীর ওপর ট্রেন উঠে এল। চারধারে গমগম আওয়াজ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। কারও কান্না দেখলেই চোখে জল এসে যায় কেন? অনেকদিন বাদে হঠাৎ সেই লাইনগুলো মাথার মধ্যে ছুটে এল, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই-আমাদের আছে কেবল সুজলা সুফলা মলয়জসমীরা শীতলা-। জোরে গলা খুলে এই ইনগুলো উচ্চারণ করলেও পুলের ওপর ছুটে যাওয়া রেলগাড়ির শব্দে কেউ শুনতে পারবে না। কিন্তু মনেমনে লাইনটা মনে করতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল অনিমেষ। এখন আর এই লাইগুলো একদম সান্তনা এনে দেয় না, বুকে জোর পাওয়া যাচ্ছে না একটুকুও। কেন? কেন এরকম হল? হঠাৎ যেন অনিমেষ আবিষ্কার করল তার কিছু-একটা খোয়া যেতে বসেছে।
 
মনিহারিঘাট স্টেশনে যখন ট্রেন থামল তখন সূর্য উঠব-উঠব করছে, আকাশ পরিষ্কার। মহিলা খুব চটপটে, খানিক আগেই মেয়েকে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ছিমছাম হয়ে এসেছেন। বিছানাপত্র গুছিয়ে অনিমেষকে ভাই সোনা বলে সেগুলোকে বাঁদিয়ে জানলার পাশে বসে আকাশ দেখছিলেন। আজ সকালে-পরা চমৎকার কমলারঙের শাড়ির ওর কচি কলাপাতা রোদ এসে পড়ায় ওঁকে খুব সুন্দরী মনে হচ্ছে। সুরমা পোশাক পালটায়নি, কুক্ষু চুল কপালের ওপর থেকে সরিয়ে বলল, কী নাইস বালির চর, না?

অনিমেষের কাল নিঘুম রাত কেটেছে, এখন ভোরের হাওয়ায় ভালো লাগছিল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেও দেখল দুধারে গাছপালা ঘরবাড়ি কিছুই নেই, যেন মরুভূমির ওর দিয়ে ট্রেনটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এই সময় ওপর থেকে বৃদ্ধ ভদ্রলোক নেমে এলেন, ঘাট এসে গেছে। আঃ, ফার্স্ট ক্লাস ঘুম হল! তারপর নিচু হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই সোজা হয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে গেলেন।

সুরমার কথাটা কানে গিয়েছিল, তাই ও বলল, এখন নদী পার হতে হবে?

মহিলা মুখ বিকৃত করলেন, বদারেশন। এখানকার কুলিরা খুব ডেঞ্জারাস!

মহিলা যখন এ-ধরনের কথা বলেন তখন তাকে মোটেই সুন্দর দেখায় না, বরং খুব কুটিল মনে হয়। কথাটা বলে এই যে উনি উদাস হয়ে সূর্যের দিকে তাকালেন তখন ওঁকে খুব সুন্দরী লাগছে, বিশেষ করে সকালবেলায় এই শাড়িটা পরায় সুরমার মা বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সুরমার দিকে তাকাল অনিমেষ, কাল রাত্রে ও চুপচাপ অনেকক্ষণ মেয়েটাকে কাঁদতে দেখেছে। অবাক কাণ্ড! খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে হঠাৎ ওইসব কথা বলে কাঁদতে লাগল, আবার কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ল। এখন এই সকালে ওকে দেখলে সেসব কেউ বিশ্বাসই করবে না।

গাড়ি মনিহারিঘাটে থামতেই চারধারে হইচই শুরু হয়ে গেল। গোলমালটা স্বাভাবিক নয়, অনিমেষ জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখল অসংখ্য স্বাস্থ্যবান কুলি সবাইকে ঠেলেঠুলে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করছে। যাত্রীরা যারা নামতে চাইছেন ওদের বিক্রমের কাছে নাজেহাল হয়ে পড়ছেন। চট করে মনে হয় বুঝি কিছু লোক খেপে গিয়ে ট্রেন আক্রমণ করেছে। এই সময় বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফিরে এসে বললেন, যে যার জায়গায় বসে থাকুন, ভিড় করে গেলে নামবেন, নইলে কুলিদের সামলাতে পারবেন না। ওর কথা শেষ না হতেই চার-পাঁচজন কুলি এসে পড়ল ওদের মধ্যে, প্রত্যেকেই হাত বাড়িয়ে। মালপত্রের দখর নেবার চেষ্টা করছে। মহিলা বোধহয় ভয় পেয়ে অথবা রেগে গিয়ে চিৎকার করতে। লাগলেন। সুরমা মুখে হাতচাপা দিয়ে বসে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের সামলালেন না। ওর কথা শেষ না হতেই চার-পাঁচজন কলি এসে পড়ল ওদের মধ্যে, প্রত্যেকেই হাত বাড়িয়ে মালপত্রের দখল নেবার চেষ্টা করছে। মহিলা বোধহয় ভয় পেয়ে অথবা রেগে গিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। সুরমা মুখে হাতচাপা দিয়ে বসে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের সামলালেন। একটা কুলির মালপত্র দুজনে বয়ে নিয়ে যাবে আবদার করছে। অনিমেষের জিনিসপত্র সে নিজেই বইতে পারে, কিন্তু কুলি যখন দুজন করতেই হবে তখন মহিলা ওকে আলাদা নিতে দিলেন না। বৃদ্ধ বললেন, আগে দর টিক করে তবে মার তুলতে দেবেন।

কথাটা বলতেই ওরা বিনয়ে গেলে, যা দেবে অনিমেষরা তা-ই ওরা নেবে। বাকি কুলিরা অন্যত্র চলে গেলে শেষ পর্যন্ত ওরা বলল, কুলিপিছু দশ টাকা চাই। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দরকষাকষি করার পর সেটা অর্ধেকে নামিয়ে ওরা ট্রেন থেকে নামল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, শিলিগুড়িতে এই মালপত্র আট আনায় বওয়ানো যেতে। এখানে টেন টাইমস বেশি। ভারতবর্ষের ইকোনমি কোনোদিন সমান। হবে না। অনিমেষ কুলিদের দেখল, বেশ সহজভাবে ওরা হাঁটছে। এরকম চার-পাঁচবার মাল বইলেই ওরা মাসে ছয়-সাতশো টাকা রোজগার করতে পারে। এম এ পাশ করেও এত মাইনে সকলে পায় না। এখানে কোনোদিন হরতাল হয় না বোধহয়।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পাশাপাশি হাঁটছিল অনিমেষ! এখানে কোনো স্টেশন নেই। বোঝাই যায় অস্থায়ী মেললাইন বসানো হয়েছে। বৃদ্ধ বললেন, প্রায়ই ঘাট বদলায় তাই স্টেশন করার মানে হয় না। এমনকি এই যে দুপাশের চাটাই-এর দোকানগুলো, এরাও ঘাট বুঝে সরে-সরে যায়। ওদের দেখে দোকানদাররা চিৎকার করে ডাকাডাকি করছে চা-শিঙাড়ার লোভ দেখিয়ে। বর্ষাকালে ইলিশমাছ আর ভাত নাকি এসব দোকানের মতো আর কোথাও পাওয়া যায় না। .

পিঁপড়ের সারির মতো যাত্রীরা বালির চরে হেঁটে যাচ্ছিল। এদিকে বোধহয় বৃষ্টি হয়নি। শুকনো বালি বাতাসে উড়ছে। দুটো কলিকে অনেকটা এগিয়ে যেতে দেখে অনিমেষ ওদের ধরার জন্য দৌড়াল। মহিলা আর সুরমা পাশপাশি দ্রুত হাঁটছেন। ট্রেনটাকে কাল খালি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন যাত্রীদের সংখ্যা খুব নগণ্য মনে হচ্ছে না। এখনও ঘাট চোখে পড়ছে না।
 
কুলিদের ধরে ফেলল অনিমেষ। একজন মহিলা বোধহয় বালিতে হাঁটতে পারছিলেন না, তাঁর স্বামী কোনোরকমে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন বিশালবপু মাড়োয়রি ইজিচেয়ারে শুয়ে চারজন কুলির ওপর ভর করে চলেছেন। তার দুই হাত বুকের ওপর জোড় করা, চোখ বন্ধ। অনিমেষ সামনে তাকিয়ে সূর্যদেবকে লক্ষ করল। বিরাট সোনার থালার মতো দিগন্তরেখার ওপর চুপচাপ দাঁড়েয়ে। চট করে দেললে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। দুপারে ধুধু বালির চরে এই যাত্রীরা ছাড়া কোনো মানুষ নেই। নির্জন এই প্রান্ততে চুপচাপ আমাশে উটে বসে সূর্য আলো ছুড়ে ছুড়ে মরছে। হঠাৎ সেই ছেলেবেলায় দাদুর সঙ্গে তিস্তার তীর ধরে হেঁটে গিয়ে সূর্যোদয়ের দর্শক হবার স্মৃতিটা মনে পড়ল অনিমেষের। মনটা এত চট করে খারাপ হয়ে যায়। কেন যে কোনো ভালো জিনিস দেখলেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়! সূর্য আস্তে-আস্তে রং পালটাচ্ছে, সেই ছেলেবেলার মতো ওর শরীরে যেন জুলনি শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এই সময়ের মধ্যে সে কত বড় হয়ে গিয়েছে, দাদু আরও বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু সে-সময়ের সকালবেলাগুলো, সূর্য ওঠার ভঙ্গিটা ঠিক একই রকম। রয়েছে। ওদের বোধহয় কখনো বয়স বাড়ে না, মানুষের হার এখানেই।

যে ওদের দেখেই তাড়াতাড়ি আসার জন্য স্টিমারটা হুইল বাজাচ্ছিল। বেশ গম্ভীর, জ্যাঠামশাই টাইপেলের গলা। এর আগে কখনো স্টিমার দেখেনি অনিমেষ। তিস্তায় একবার একটা বোট এসেছিল, তার ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দটা মনে আছে। এখন এই স্টিমারটাকে দেখতে ওর বেশ ভালো লাগল। অনেকটা লম্বা, লালে হলুদ সূর্যের আলো পড়ায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। পিলপিল করে মানুষেরা পাটাতনের ওপর দিয়ে ওর বুকে ঢুকে যাচ্ছে। এখানে কোনো ঘরবাড়ি নেই, দূরে কিছু খোড়ড়া জঙ্গল। যাত্রীদের কেউ-কেউ ঝটপট জলে নেমে দুএকটা ড়ুব দিয়ে নিল গঙ্গায়, কুলিদের পেছন পেছন

অনিমেষ ডেকে উঠে এল। চারধারে দড়ি লোহার বিম ছাড়ানো, এর মধ্যেই সবাই জায়গা করে। নিয়েছে। কুলি দুটো এক জায়গায় মালপত্র নামিয়ে পয়সার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল, অনিমেষ ওদের অপেক্ষা করতে বলল। সুরমারা মালপত্র নামিয়ে পয়সার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল, অনিমেষ ওদের অপেক্ষা করতে বলল। সুরমারা এখনও আসছে না কেন? ক্রমশ ভিড়টা বাড়ছে। ও দেখল কিছু সুরেশী মানুষ ভিড় বাঁচিয়ে দোতলায় চলে গেল। সেখানে সবাই উঠছে না। সুন্দর লোহার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ও অনুমান করে নিল, ওপরটা নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। নিচের তলায় হইচই হচ্ছে খুব। ওপাশে দুটো চায়ের স্টলের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। অনিমেষ লক্ষ করল, যেন পুরো ভারতবর্ষটাই উঠে এসেছে এখানে-বাঙালি, বিহারি, মদ্রাজি থেকে ভুটিয়ারা পর্যন্ত সবাই গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে।

শেষ পর্যন্ত সুরমারা এল। তখন স্টিমার ঘনঘন হুইসল দিচ্ছে। ভিড় সরিয়ে মহিলা যখন চারদিকে ওকে খুঁজছিলেন তখন অনেকের চোখ ওর ওপর এট ছিল। অনিমেষকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে ছেলেমানুষের মতো হেরে বললেন, হিমালয় থেকে একজন সাধু এসেছেন, দেখেই মনে হয় খুব খাটি মানুষ।

সুরমা বলল, সাধুরা খাটি হলে মানুষ থাকে না, মহামানব হয়ে যায়।

মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে যেন মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে বললেন, আরে, এখানে মালপত্র নামিয়েছ কেন? ওপরে চলল। এই বাজারের মধ্যে দুঘন্টা থাকলে আমি মরে যাব।

কুলিদের তাগাদা দিয়ে মালপত্র তুলিয়ে তিনিই প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চললেন। অনিমেষ সুরমার সঙ্গে ওর পেছনে যেতে-যেতে বলল, ওপরটা বোধহয় ফার্স্ট ক্লাস! আমাদের উঠতে দেবে?

সুরমা মুখ টিপে হেসে হলল, মা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।
 
দোতলায় সিঁড়ির মুখে স্টিমার কোম্পানির একজন হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহিলা তার সামনে গিয়ে ঘাড়টাকে সামান্য বেঁকিয়ে বললেন, ও, নিচে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওপরে জায়গা নেই।

ভদ্রলোক ধমতম হয়ে কোনোরকমে বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আজকে ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার কম। ওপাশটা একদম খালি আছে।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা হাত বাড়িয়ে কুলিদের নির্দেশ দিলেন রেলিং-এর ধার-ঘেঁষে একটা খালি সোফার সামনে জিনিসপত্র রাখতে। কুলিরা বিনা বাক্যব্যয়ে কম তামিল করতেই অনিমেষ আর সুরমা ওদের সঙ্গে এসে সোফায় বসল। অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মহিলা ভদ্রলোকের সঙ্গে মিষ্টি করে কীসব কথা বলতেই ভদ্রলোক হেসে ঘাড় নাড়লেন। যেন এইমাত্র পলাশির যুদ্ধটা জিতে গেছেন এইরকম ভঙ্গিতে ওদের কাছে ফিরে এসে মহিলা বললেন, চিরকাল ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়া-আসা করেছি, এরা সবাই আমাকে চেনে। নিচে নরককুও।

এবার একজন কুলি অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, পিয়া দিজিয়ে মেমসাব।

যেন মনে পড়ে গিয়েছে এইরকম একটা ভঙ্গি করে ব্যাগ খুললেন মহিলা, তারপর একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে সামনে ধরলেন। কুলি দুটো বেজায় খেপে উঠল। তারা বলতে লাগল দশ টাকা দেবার কথা হয়েছে এবং ওরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করায় আর মাল বইতে পারেনি আর এখন পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেবার কারণটা কী? মহিলা পুতুলের মতো মাথা নেড়ে বললেন, যে, নোটিশবোর্ডে লেখা আছে কুলিদের রেট কী। এই মাল সেইমতো ওজন করে যা পড়বে তিনি তা-ই দেবেন। অনেকক্ষণ ঝগড়া চলতে লাগল। অনিমেষ দেখল দোতলায় মুষ্টিমেয় যাত্রীরা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। যদিও কুলিরা বেশি নিচ্ছে তবু যখন একবার কথা হয়েই গিয়েছে তখন আর আর এখন করার কোনো অর্থ হয় না। ও ওদের ঝগড়ায় মধ্যে কোনো কথা বলছিল না। শেষ পর্যন্ত সুরমাকে বলতে শুনল, ম, টাকাটা দিয়েই দাও।

কিন্তু ভদ্রমহিলার অসম্ভব ধৈর্য, শেষ পর্যন্ত কুণিদের ছয় টাকায় রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল। যাওয়ার সময় অনিমেষ শুনল, ওরা চাপা গলায় বোধহয় গালাগালি দিতে দিতে চলে গেল। এবার মহিলা ধপ করে ওর পাশে এসে বসলেন, কী পুরুষমানুষ বাবা, আমি এতক্ষণ একা ঝগড়া করে গেলাম, একটাও কথা বললে না।

অনিমেষ সোজা হয়ে বসে বলল, না মানে, আপনি তো কথা বলছিলেন তাই-। এই প্রথম কোনো মহিলা তাকে পুরুষমানুষ বলল। ও চট করে একবার সুরমাকে দেখে নিল। ডানদিকে রেলিং ধরে একদম খাটো প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি-পরা একটা ছোকরা সাহেব প্যান্ট-পরা এক মেমসাহেবের সঙ্গে গল্প করছে-সুরমার চোখ সেদিক থেকে সরছে না। মহিলা সমস্ত শরীর সোফায় এলিয়ে দিয়ে সামনে তাকালেন। ওরা গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে, ঘাট দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। চট করে বোঝা যায় এই নদীর অপর পাড় সকরিকুলি। অনিমেষের মনে হল সমদ্র বোধহয় এইরকম। ওর হাতে নাকি বিদেশযাত্রার রেখা আছে। বেশ হত যদি এইস্টিমার গঙ্গানদী দিয়ে সমুদ্রে, সেখান থেকে ভারত মহাসগর, অতলান্তিক বেয়ে ইংলভ আমেরিকা চলে যেত। ও দেখল একটা লম্বাটে ধরনের পাখি ছোঁ মেরে জল থেকে মাছ তুলে নিয়ে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে পাড়ের দিকে উড়ে গেল।

মহিলা বললেন, এবার চা না খেলে মাথা ধরবে। অনিমেষ, বেয়ারাকে বলে এসো, তো!

চায়ের কথায় অনিমেষের খেয়াল হল সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। এখানে জিনিসপত্রের দাম কীরকম? যদি খুব বেশি হয় তা হলে নিচ থেকে খেয়ে এলেই হত। ওকে উঠতেদেখে মহিরা বললেন, ঠিক আছে চলল, রেস্তোরাতেই খেয়ে আসি। জাহাজটা ঘুরে দেখা যাবে। হ্যারে, তুই চা। খাবি?

সুরমা সাহেবদের দিকে মুখ রেখেই বলল, নাঃ! আমার জন্য একটা কেক এনো। আমার উঠতে ভালো লাগছে না।
 
সকালবেলায় চা না খেয়ে কীভাবে থাকিস বাবা, কে জানে! যাক, মালপত্রগুলো দেখিস তা হলে, আমরা আসছি।

অনিমেষ উঠতেই কান ফাট: হুইল বেজে উঠল। স্টিমার এবার ছাড়ছে। চিৎকার চামেচির মধ্যে ওরা পায়ের তলায় দুলুনি অনুভব করল। ঘড়ঘড় শব্দে কোথাও ইঞ্জিন চলছে, রোদে সমস্ত গঙ্গা এখন উজ্জ্বল। অনিমেষ দেখল ওপরের ডেকে যারা বসে আছেন তাদের মধ্যে কোনে উত্তেজনা নেই। এরা কথা বলেন চাপা গলায়। একজন বিরাট-চেহারার মাড়োয়ারিকে ও শুধু নিঃশব্দে ঘুমুতে দেখল। এখানে কেউ কাউকে দেখছে না, যেন প্রত্যেকে অস্তিত্ব ভুলে বসে আছে। বেয়ারারা চায়ের ট্রে নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। এই পরিবেশ ওর কাছে একেবারে নতুন।

রেস্তোরায় ভিড় নেই। মাত্র দুজন মানুষ বসে আছেন জানলায়। খুব চাপা গলায় ওঁরা কিছু আলোচনা করছিলেন, অনিমেষদের ভালো লাগল না। রেস্তোরার জাল বসলে বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যায়। মহিলা আর ও পাশাপাশি বসতেই বয় ছুটে এল! দুটো ওমলেট টোস্ট আর চা বললেন তিনি, জান অনিমেষ, সকালবেলা আমার একটা করে ডিম চাই। এমনিতেই আমি খুব লাইট খাবার নাই। ওজন বেড়ে যাচ্ছে খুব। আমি বাবা মিসেস কর হতে চাই না।

এই প্রথম এরকম সাহেবি রেস্তোরতে অনিমেষ এল। পরীক্ষার পর মণ্টুর সঙ্গে রূপশ্রীর পাশে একটা দোকানে ওরা কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যেস করেছিল। খাবার এলে ও সেটাকে কাজে লাগাল। মহিলা বললেন, তোমাকে যেন আমি এর আগে কোথায় দেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

চট করে হাত কেঁপে উঠল অনিমেষের। ও মন দিয়ে খাওয়া মুরু করল। এখনও চোখ বন্ধ করলে সে কুষ্ঠরোগীটাকে দেখতে পায়। এই মহিলা যদি সেই ঘটনার কথা মনে করতে পারেন তা হলে নিশ্চয়ই আর এখানে বসে থাকবেন না। নাকি এতদিন পরেও অনিমেষ সুস্থ আছে দেখে নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হবেন তবু অনিমেষ ঠিক করল সে চেনা দেবে না। মহিলা নিজের মনে বললেন, জলপাইগুড়ির ছেলেরা যা হয়েছে না, আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের সময় এরকম ছিল না। তাই তো আমি সুরমার ভাইকে কার্শিয়াং-এ পাঠিয়ে দিয়েছি পড়তে।

অনিমেষ সেই গোলালুর সন্ধান পেয়ে মাথা নাড়ল। তখনই তো সে ওর সমান ছিল, এখনও সে স্কুলে পড়ছে? অবশ্য মিশনারি স্কুলের নিয়মকানুন ও জানে না।

এই ছেলে, একদম মুখ নিচু করে খাচ্ছ যে, কথা বলবে না?

মুখ তুলল অনিমেষ, আবার সেই দৃশ্য। মহিলা যেভাবে বসে আছেন তাতে তার বুকের কাপড় জায়গায় থাকছে না। অতখানি সাধা উঁচু জায়গা এমন চট করে লজ্জা এনে দেয় কেন? তিস্তার পাড়ে অথবা স্বর্গহেঁড়ায় অনেক দেহাতি মেয়ে অথবা ভিখিরিদের নগ্ন বুক দেখেছে ও, তখন তো এরকম হত না! হঠাৎ মহিলা হাসলেন, আমার বয়স কত বলো তোর।

ওমলেট খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, চায়ের কাপ টেনে নিয়ে অনিমেষ বলল, বলতে পারব না।

এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন তিনি যেন অনিমেষকে নিয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না, থার্টিফাইভ। আমাকে অতটা দেখায়?

না। অনিমেষ হাসল।

সুরমা একদম বাপের মতো হচ্ছে, চেহারার দিকে যত্ন না নিলে বেঁচে থেকে লাভ কী? কলকাতায় গিয়ে কোথায় উঠছ।

আমার বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে। তারপর হোস্টেলে চলে যাব।

গুড। এর মধ্যে তুমি কলকাতাটা ভালো করে ঘুরে দেখে নাও। আমি ভাবছি সুরমাকে শান্তিনিকেতনে ভরতি করে মাসখানেক পরে কলকাতায় যাব। তখন তুমি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। কী, দেখাবে না?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। বিল মিটিয়ে দিয়ে উনি রেস্তোরাঁ থেকে দুটো কেক কিনলেন, কলকাতার মতো কেক আর কোথাও পাওয়া যায় না।

ওর বাইরে বেরিয়ে এলে মহিলা সুরমা যেখানে বসেছিল সেকানে না গিয়ে ওকে নিয়ে উলটোদিকের ডেকটা ধরে হাঁটতে লাগল। খুব বাতাস দিচ্ছে এখন। নদীর দিকে চোখ রেখে মহিলা বললেন, ওঃ, কতদিন পরে আজ একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! জলপাইগুড়িতে মানুষ থাকতে পারে! সেই সংসার আর সংসার। নিজের বলে আর কিছু থাকে না। অনিমেষ কিছু বলল না। ও ক্রমশ টের পাচ্ছিল এই মহিলার এত সাজগোজ, এত কথার আড়ালে একটা দুখি মন আছে। কেন কিসের জন্য দুঃখ তা সে জানে না। দূরে জলের মধ্যে কিছু ভেসে-ভেসে উঠছিল। অনিমেষ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই লক্ষ করল একটা জলচর প্রাণীর কালো পিঠ দেখা যাচ্ছে। ও উত্তেজিত হয়ে মহিলাকে সেটা দেখাতেই তিনি সেদিকে তাকিয় ভীষণ নার্ভাস হয়ে অনিমেষকে শক্ত হাতে ধরলেন, ওটা কী! কুমির?
 
ততক্ষণে প্রাণীটা বোধহয় সাহস বেড়েছে। গোল হয়ে ডিগবাজি খেতে-খেতে জল থেকে লাফিয়ে উঠছিল। নিচের ডেকে সবাই বোধহয় দেখেছে। খুব হইচই করে সবাই স্টিমারের এদিকে আসতেএপাশটা একটু কাত হয়ে গেল। একজন কুলিমতন লোক ডেকের এদিকে আসছিল, অনিমেষদের দেখে একগাল হেসে বলল, শুশুক।

আর এই সময় ইঞ্জিন প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল। ঘনঘন হুইসল বাজছে। ওরা এখন নদীর প্রায় মাঝখানে। গঙ্গার বড় বড় ঢেউগুলো স্টিমার ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওরা প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা, নিচের চিৎকারে বািক হয়ে মহিলা বললেন, কী হয়েছে নিচে।

স্টিমারের লোকজন তখন ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওরা সুরমার কাছে ফিরে আসতে শুনতে পেল জল কম থাকায় স্টিমার চরায় আটকে গেছে। অন্য যাত্রীদের মুখে এখন বিরক্তি, এভাবে স্টিমার চালানো হয় কেন? কেন জল মেপে আগে থাকতে গভীরতা বোঝা যায় না। ওদের ওপরে রেখে অনিমেষ ব্যাপারটা দেখবার জন্য নিচে নেমে এল। ওপরের বিরক্তি এখানে অন্যরকম চেহারা নিয়েছে। লোকে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সারেং মাল্লারা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্টিমারটাকে উদ্ধার করার জন্য। যেভাবে হেলে রয়েছে এটা একদিকে, বেশি নড়াচড়া করলে অন্যরকম বিপদ যেতে হতে পারে সেটাও সবাই বুঝে গিয়েছে।

অনিমেষ বুঝতে পারছিল না নদীতে যখন এত ঢেউ তখন চরায় ঠেকে যায় কী করে স্টিমার একজন বলল, জল অল্প বলেই ঢেউ বেশি, খালি পাত্রে বেশি শব্দ হয়। সেই শুকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। যদি স্টিমার ড়ুবে যায় তা হলে কী হবে? ওর নাকি জলে ডোবার ফাঁড়া আছে। সাঁতার না জানার জন্যে এখন আফসোস হচ্ছিল অনিমেষের।

একটু একটু করে পরবর্তী সমস্যাগুলো সবাই জানতে পারছিল। নদী পার হবার জন্য দুটো স্টিমার ছিল, অন্যটাকে জরুরি প্রয়োজনে রাজমহলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।এইটাই এখন পারাপার করছে। ট্রেনের যা সময় তাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না যাত্রীদের। ফলে জল বাড়া অথবা অন্য স্টিমারটিকে রাজমহল থেকে ফিরিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত ওদের এইখানেই আটক থাকতে হবে। এইভাবে বন্দি থাকার কথাটা যতই মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ছিল যাত্রীরা ততই নার্ভাস। হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টলের খাবারগুলো শেষ হয়ে গেল। অনেক দূরে জলের সীমার শেষে সকরিকলি ঘাট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা অনেক দূর। এখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে।

অনিমেষ ওপরে উঠে এল। মহিলা ওকে দেখেই ছুটে এল, কী হবে, অনিমেষ?

বিকেলনাগাদ জোয়ার আসবে বলছে সবাই। অনিমেষ ব্রিত হয়ে বলল।

বিকেল অবধি এখানে থাকলে আমরা কখন বোলপুরে পৌঁছাব? ওঁর মুখ কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অনিমেষের এই ব্যাপারটা একদম খেয়াল ছিল না। ওপারে গিয়ে ট্রেনে উঠলে সেটা দশটায় ছাড়ত, খুব আস্তে গেলেও বিকেলনাগাদ শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছাত। এখন যা অবস্থা তাতে কখন ওপারে পৌঁছাবে কখন ট্রেন ছাড়বে আর কখন সেটা কলকাতায় গিয়ে পৌঁছাবে কেউ বলতে পারবে না। তা হলে বাবার বন্ধুর দেখা সে পাবে কী করে? হঠাৎ যেন সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হতে বসেছে। অবশ্য এর ঠিকানা অনিমেষের কাছে আছে, অসুবিধে আর কতটুকু হবে।

কিন্তু এই স্টিমারের অনেকেই প্রচণ্ড সমস্যা দেখা দিল। কেউ যাবে রাতের প্লেন ধরতে, কাল ভোরেই অন্যত্র ট্রেন ধরার কথা, কারও ইন্টারভিউ, কেউ-বা আগামীকাল হাইকোর্টে কেস করতে যাচ্ছে। যদি ট্রেন আগামীকাল সকালের মধ্যেও না পৌঁছায়। বেলা বড়াতে লাগল। জল বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই, নিচের হইচই.এখন অনেকটা কম। সবাই বুঝে গিয়েছে কিছুই করার নেই। এবং এই স্টিমারে আর খাবার বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। অনিমেষের একবার মনে পড়ল ওর ব্যাগে পিসিমার দেওয়া খাবার এখনও পুরোটাই রয়েছে। কাল রাত্রে মহিলা ওকে নিজের খাবার খেতে দেননি। কিন্তু এখনও ওর একটুও খিদে পায়নি। মহিলা কয়েকবার খাবার খাবার করছিলেন। অনিমেষ ভাবল একবার বলে, ওরা ঘণ্টা দুয়েক আগে মাত্র জলখাবার খেয়েছে। এখনই খিদে লাগার কোনো কথা নয়। কিন্তু ও কিছু বলল না। খাবার নেই জানলেই বোধহয় মানুষের খিদেবোধটা চট করে বেড়ে যায়।
 
অনিমেষ আবার নিচে এল। দুএকটা মাছধরা নৌকো এখন ওদের স্টিমারের কাছাকাছি এসেছে। ওদের একটায় স্টিমারের একজন লোক পাড়ে চলে গেল। সে গিয়ে খবরাখবর দেবে। কই, নৌকোয় এত বড় নদী পার হবার সাহস কারও হল না। সবাই অসহায়ের মতো মুখ করে বসে। ভিড় বাঁচিয়ে কোনোরকমে হাঁটতে গিয়ে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। একটা জায়গায় কিছু মানুষ গোল হয়ে বসে, মধ্যিখানে সর্বাঙ্গে ছাইমাখা জটাধারী একজন সাধু। মুখচোখ দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। স্নিগ্ধ মুখে হাসি, মাথা নেড়ে শ্রোতাদের কথা শুনছেন। কেউ-একজন বলল, বাবা ইচ্ছে করলে স্টিমার চালু করতে পারেন। কে জানে হয়তো একটা বাবারই খেলা, নইলে রোজ স্টিমার চলছে, আজ হঠাৎ আটকে যাবে কেন? কথাটা যে অনেকের মনে লেগেছে সেটা একটু বাদেই বোঝা গেল। ভক্তদের। সংখ্যা বাড়ছে। কিছু বিহারি ভক্ত ধ্বনি দিয়ে উঠল, গঙ্গা মাঈকি জয়, সাধু বাবাকি জয়।

খানিক বাদেই, স্টিমারের সব মানুষ মাঝখানে জড়ো হয়ে গেল। অনিমেষ শুনল বাবা নাকি রাজি হচ্ছিলেন না কোনো পুজোআচ্চা করতে, কারণ তিনি ম্যাজিক দেখাতে ভালোবাসেন না, কিন্তু ভক্তদের চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়েছে। অনিমেষ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে আর। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। ও কোনোরকমে দোতলায় উঠবার সিড়িতে এল, এখান থেকে মানুষের মাথা ডিঙিয়ে বাবাকে দেখা যাচ্ছে। কিছু ভক্ত সবাইকে সামলাচ্ছে, কসময় দর্শক পাটাতনের ওপর বসে গেল। মুহুর্মুহু বাবার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। এর মধ্যে কোথা। কে কিছু ফুল বেলপাতা যাোড় হয়ে গিয়েছে। এগুলো নিয়ে যে মানুষ ট্রেনযাত্রা করতে পারে অনিষ বিশিত হয়ে আজ আবিষ্কার করল। বাবার নির্দেশে একটা পাত্রে টাটকা গঙ্গাজল তুলে আনা হল। নিজের ঝোলা থেকে কিছু কাঠ বের করে বাবা শেষ পর্যন্ত পুজোয় বসলেন।

অনিমেষ মহিলাকে ব্যাপারটা বলতে ওপরে উঠে এসে দেখল খরবটা আগেই এখানে পৌঁছে গেছে। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীরা এখন আর ছড়িয়েছিটিয়ে নেই, সবাই প্রায় এক জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সমস্যায় সমাধানের উপায় ভাবছিলেন। সেই বৃহৎ মাড়োয়ারি তখন কথা বলছিলেন, আরে নেহি নেহি, সাধুবাবালোগে সবকুছ কৃর সেকতা।

একজন সুট-টাই-পরা প্রৌঢ় পাইপ খেতে-খেতে বলনে, আই ডোন্ট থিংক সো, তবে কোনোকোনো সময় মিরাকল ততো হয়েও যেতে পারে।

সেই ছোট প্যান্ট-পরা সাহেবটি বলল, ড়ু ইউ থিংক হি ইজ এ রিয়েল সাধু?

সুরমার মা সঙ্গে ঘাড় নাড়লেন, আমার মনে একটুও সন্দেহ নেই, প্রথম দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম একদম খাটি মানুষ।

প্রোঢ় বললেন, আমাকে আজ রাত্রের প্লেন ধরতেই হবে, পারহ্যাপস দিস ম্যান ক্যান হেল্প মি।

মাড়োয়ারি বললেন, আরে ভাই, আজ কলকাতা নেহি যানেসে মেরা দো লাখ রুপয়া লোকসান হো যায়েগা।

কথাবার্তাগুলো আর সেইরকম চাপা গলায় নয়, নিচের তলার মতো গলা খুলে এরা কথা বলছিলেন। অনিমেষকে দেখতে পেয়ে সুরমা বলে উঠল, ওই যে মা, এসে গেছে।

মহিলা ওকে দেখতে পেয়ে উৎসুক মুখ করে কয়েক পা এগিয়ে এলেন, নিচু শুনলাম সেই সাধুবাবা পুজো করছেন?

অনিমেষ হাসল, হ্যাঁ, খুব ভিড় হয়েছে।

মহিলা বললেন, চলো, আমি যাব।

সঙ্গে সঙ্গে সুরমা বলে উঠল, আমিও যাব না।

মহিলা একটু ইতস্তত করলেন, যাবি? কিন্তু মারপত্র সব পড়ে রইলযে! আচ্ছা ভাই অনিমেষ, তুমি এখানে একটু থাকবে? তোমার তো দেখা হয়ে গেছে।

অগত্যা অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, যদিও ওর এখানে একটুও থাকতে ইচ্ছে করছিল না। ওকে রাজি হতে দেখে অন্য সবাই যেন চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। সবার মালপত্র পাহারা দেবার ভার নিতে হল ওকে। অনিমেষ দেখল মহিলার পেছন পেছন দোতলার মানুষগুলো একতলায় নেমে গেল। বিস্ময় বাড়ছিল ওর, কী তাড়াতাড়ি মানুষগুলো চেহারা বদলে গেল। কছুক্ষণ ও দোতলার রেলিং ধরে চেয়ে রইল জলের দিকে। ঘোলা জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। আকাশ বেশ মেঘলা, রোদের জৌলুস নেই একটুও, যদিও সূর্য আছে সামান্য ওপরে। ও মালপত্রগুলোর দিকে তাকাল। বেশির ভাগ ব্যাগের ওপর নামধাম লেখা। ওঁরা কী বিশ্বাসে সবকিছুর দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে গেলেন। যদি ও এগুলো নিয়ে কেটে পাড়ে, ভাবতেই হাসি পেল ওর, কারণ এইরকম মাঝগঙ্গায় আটক থেকে কেউ জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে পারবে না। তা ছাড়া নামবার সিডি তে মোট একটা।
 
নিচে কী হচ্ছে দেখার কৌতূহলটা আস্তে-আস্তে বেড়ে যাচ্ছিল। অনিমেষ সিড়ির কয়েক ধাপ নেমে এল, এখান থেকে দেশকে অসুবিধে হচ্ছে না। কালো মাখাগুলোর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সরিয়ে ও সাধুবাবার দিকে তাকাল। আর তাকাতেই চমকে উঠল অনিমেষ, পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করে মনে হয় মন্ত্র পড়ছেন সাধুবাবা আর তার সামনে সাষ্টাঙ্গে পড়ে আছেন সুরমার মা। তার দামি শাড়ি ডেকের ধুলোজলে লুটোপুটি খাচ্ছে, সুরমা পাশে হাঁটু গেড়ে দুহাত জোড় করে বসে! ওঁদের পেছনে ফাস্ট ক্লাসের অন্যান যাত্রী গদগদ হয়ে বসে আছে। মাড়োয়ারি ভাভদ্রলোক মা বাবার পায়ের কাছে মাথা নিয়ে গিয়েছেন। চারধার থেকে বাবার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। এখন আর ওপর আর। নিচতলার যাত্রীদের মধ্যে কোনো ফরাক নেই, সবাই গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছেন। ঠাৎ অনিমেষের সামনে সুনীলদার মুখটা ভেসে উঠল। সুনীলদারা কি এইরকম ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেন?

আকাশে মেঘ বাড়ছে, একটু একটু করে বাতাসের দাপট বাড়ছে। সুনীলদার কথা মনে হতেই ওর মনে হল গতকাল কলকাতায় বাস পুড়েছে, পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা গিয়েছে। ব্যাপারটা তার মনেই ছিল না সকাল থেকে। দেশের কিছু মানুষ খাবা দাবি করে ধর্মঘট করছে, কিছু লোক সেটাকে সমর্থন করছে না। এই দুদল যতক্ষণ-না এক হবে-অনিমেষের মনে হল খুব বড়, এই স্টিমারে যেমন হয়েছে সেরকম সমস্যা না এলে দুদল কখনো এক হাতে পারে না। যারা দেশের কথা চিন্তা করেন তারা এটা কি জানেন না।

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে এখন। ঝোড়ো বাতাস জাহাজটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মাঝে-মাঝে। হঠাৎ স্টিমারটা সামান্য দুলে উঠতেই সবাই চিৎকার করে উঠল। এতক্ষণ ইঞ্জিন বন্ধ ছিল, এবার সেটা শব্দ করে জেগে উঠল। ইঞ্জিন-চালক বোধহয় এই দুলুনিকে অবলম্বন করে স্টিমারটাকে নড়াবার চেষ্টা করছেন। এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো একসময় স্টিমার সত্যিই নড়ে উঠল। তারপর শব্দটাকে গানের মতো বাজিয়ে এগিয়ে চলল জল কেটে। ঝড়ের বেগ খুব বাড়ছে। বৃষ্টির জল এসে দোতলার ডেক ভিজিয়ে দিচ্ছে। অনিমেষ দৌড়ে এসে জিনিসপত্রগুলো সরিয়ে রাখত লাগল। এখন নদীর ওপর বৃষ্টি যেন অজস্র দেওয়াল তৈরি করে ফেলেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর ওঁরা উপরে উঠে এলেন। মহিলা এখন ভক্তিতে আপুত, নিমেষকে সামনে পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, দেখলে বাবার কী লীলা, তখনই বলেছিলাম কী জাগ্রত সাধু।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক পাইপ ধরাতে ধরাতে বললেন, ইটস ও মির্যাকল! যাক, মাত্র তিন ঘণ্টা লেট হয়েছে। নিশ্চয়ই মেকআপ হয়ে যাবে।

কে-একজন বলল, বৃষ্টি শুরু হল–।

দূর মশায় ট্রেনে উঠলে বৃষ্টি কোনো প্রব্লেম নাকি!

অনিমেষ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক কোথায়? নিচের ভিড়ে এতক্ষণ তাকে দেখেনি সে। সাধুবাবা সেই জায়গায় বসে আছেন। তার সম্পত্তিতে আর-একটা পুটুলি যোগ হয়েছে। ভক্তরা তাদের প্রণামি দিয়েছে। বেশকিছু মানুষ এখনও তাকে ঘিরে রয়েছে। কথা বলছেন না তিনি, মুখে প্রশান্তি। ঘট যত এগিয়ে আসতে লাগল তত উত্তেজনা বাড়তে লাগল। কে আগে ঘাটে নামতে পারবে তার জন্য ঠেলাঠেলি চলছে নামবার মুখটাতে। এখান থেকে বৃষ্টিতে-ভেজা ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে। স্টিমার আসছে দেখে ড্রাইভার বোধহয় খুশিতে দুবার হুইসল বাজিয়ে দিল।
 
স্টিমার ঘাটে লাগতেই একটা কাঠের পাটাতন নামিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে জলরাশির মতো মানুষ বেরিয়ে যেতে লাগল সেই ছোট্ট রাস্তা দিয়ে। নিচের তলায় সব মানুষ এখন মুখটাতে জড়ো হয়েছেন। স্টিমারের লোকজন বারণ করছে এভাবে দাঁড়াতে কিন্তু কে শোনে কার কথা! সাধুবাবাও এদের মধ্যে আছেন। অনিমেষ দেখল বাইরের মাটিতে পা রাখার উত্তেজনায় কেউ আর তাকে খেয়াল করছে না। এই সময় সে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখতে পেল। চোখাচোখি হতেই তিনি হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ওকে আসতে বললেন। ওপারে গিয়ে ট্রেনে ভালো জায়গা পেতে আগে যাওয়া দরকার। বৃষ্টিতে ভিজতে হবেই, কোনো উপায় নেই। মানুষেরা ধাক্কাধাক্কি করতে করতে যাচ্ছে। একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে পিছনের মানুষের পায়ের তলায় যেতে-যেতে বেঁচে গেল।

অনিমেষ জায়গা রাখতে, আপনারা কুলির সঙ্গে আসুন।

মহিলারা বললেন, বৃষ্টিতে যাব কী করে?

অনিমেষ বলল, উপায় নেই। ও আর দাঁড়াল না। দৌড়ে নিচে এসে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। প্রচণ্ড ঠেলাঠেলি, কনুইয়ের গুতো সামলে সে পাটাতনটার ওপর এসে দেখল দুধারের দড়ির রেলিংএর ওপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, বেতাল হলেই জলের তলায় চলে যাবে। নিজের ব্যাগ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল ও, চারধারে মানুষের আড়াল। সামনে বৃষ্টি হয়ে পথ পিছল থাকায় খুব সন্তর্পণে লোক এগুচ্ছে। একসময় হইহই গেল গেল শব্দ উঠল উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে, ততক্ষনে অনিমেষ বৃষ্টিতে নেমে পড়েছে, থেমে দাঁড়ালে পায়ের তলায় পড়তে হবে বলে ও দৌড়াতে শুরু করল। পেছনে কী হচ্ছে বোঝার আগেই ও সামনে ট্রেনটাকে দেখতে পেল। বৃষ্টির ফোঁটায় সমস্ত শরীর ভিজে একশা। ও অবাক হয়ে দেখল অত বড় ট্রেনটা একদম খালি। যে-যাত্রীরা আজকের ট্রেনের পক্ষে নিতান্তই সামান্য। অথচ কী ভয়েই সবাই এখনও ছুটে আসছে। এই সময় একজন কুলি চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল, সাধুবাবা গির গিয়া, জাহাজকা অন্দর ঘুস গিয়া।

হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। সে-মানুষটাকে বিপদের সময় সবাই আশ্রয় করেছিল তাকেই জনতার চাপে জলে পড়তে হল! সেই প্রশান্ত মুখটাকে মনে করে অনিমেষ ছুটন্ত যাত্রীদের দিকে তাকাল। কারও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। প্রয়োজন ছাড়া মানুষের অন্য কোনো আকর্ষণ বোধহয় থাকে না। অনিমেষ সামনে-বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। তিনি হেসে বললেন, আড়াই ঘণ্টা লেট। তা আমরা নটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যাব, বুঝলে!

যতদূর চোখদেখা যায় মাঠ আর মাঠ, মাছে-মাছে দলবাঁধা তালগাছগুলো গলাগলি করে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছে, এইরকম চিত্র ট্রেনের জানালার বাইরে অনেকক্ষণ স্থির ছিল। জলপাইগুড়ি শহরের বাইরের যে-বাংলাদেশ তার চেহারা এত আলাদা একথা কোনো ভূগোল বইতে অনিমেষ পড়েনি। সূর্য-ঢালা বিকেলে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস বোলপুরে এসে জিয়োল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top