What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

আগামীকাল ধর্মঘট। এবার যেভাবে কমিউনিস্টরা শহর পথে-পথে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, এর আগে কখনো সেরকম দেখা যায়নি। কিন্তু একটা জিনিস অনিমেষে কিছুতেই বুঝতে পারে না, সাধারণত মানুষ একদম উত্তেজিত নয়। বরং তাদের মধ্যে নিস্পৃহা ভাব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত ফেরার সময় ও লক্ষ করেছে, কারও মধ্যে তেমন চাঞ্চল্য নেই। অথচ মানুষের খাবারের জন্য এই হরতাল। তা হলে কি, জলপাইগুড়ির সমস্ত মানুষ কংগ্রেসের সমর্থক হয়ে গেল? কী জানি! কিন্তু যদি এই হরতালের ফলে কাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়-তা হলে? এ-সপ্তাহে আর নাকি ভালো দিন নেই।

ভেজানো দরজা খুলে বাইরে এল অনিমেষ। ওদের বাগানটা এখন জঙ্গলে ভরে গেছে। সামান্য সৃষ্টি হলেই গাছগুলো রতর করে বড় হয়ে ওঠে। ফুলের গাছ আর নেই, বিভিন্ন ফলের গাছেই বিরাট জায়গাটা ভরাট। এখন সবে চাঁদ উঠেছে। লম্বা সুপারিগাছগুলোর মাথায় তার জ্যোৎস্না, নেতিয়ে পড়ে আছে। চারধার একটা আবছা আলো-অন্ধকারের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। চট করে তাকালে বোঝা যায় না, কিন্তু চোখ সয়ে এলে দেখতে কোনো অসুবিধে হয় না। অনিমেষ দেখল দ্রাদুর ঘরে আলো জ্বলছে না, কোনো শব্দ আসছে না সেখান থেকে। পিসিমার রান্নাঘর থেকে সামান্য আলো আসছে বাইরে।

উঠোনে নেমে এল সে খালিপায়ে। এখন গরমকাল। সময়ে-অসময়ে বৃষ্টি আসে। উঠোনের ঘাসগুলো এখন মাথাচাড়া দিয়েছে, গোড়ালি ড়ুবে যায়। এভাবে নামা ঠিক হয়নি, কারণ এই সময় সাপেরা মেজাজে চারধারে ঘুরে বেড়ায়। কখন কে বিরক্ত হয়ে ছোবল মারবে-অনিমেষ সাবধানে পা ফেলতে লাগল। দাদুর ঘর পেরিয়ে পিসিমার রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সে। দরজার কাচ দিয়ে ঈষৎ আলো বাইরে আসছে। এটা ইলেকট্রিক আলো নয়, নিশ্চয়ই কুপির আলো। পিসিমা ইলেকট্রিক আলো বাঁচাতে কুপি জ্বালান রাত্রে শোওয়ার সময়। এইটে ওঁর বহু পুরনো অভ্যেস। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে আসবার সময় পিসিমা ওটা নিয়ে এসেছেন। নিঃশব্দে বারান্দায় উঠে দরজার কাছে এসে কাঠ হয় দাঁড়িয়ে পড়ল অনিমেষ। ভেতর থেকে চাপা গলায় পিসিমা কান্নাটা ঘরের মধ্যে পাক খেতে লাগলু। পিসিমা কাঁদছেন কেন? কান্নাটাও যেন সতর্কভাবে-সরিৎশেখর বা আর-কেউ টের পান তিনি চান না। যেন নিজের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে কান্না। আগে চলে-যাওয়া, বোধহয় চেহারা গুলিয়ে বা ভুলে-যাওয়া পিসেমশাইকে অভিযোগ করে কেঁদে যাচ্ছেন। কেন তাকে একা ফেলে রেখেছেন এতকাল। কতদিন তিনি এইভাবে পৃথিবীতে থাকবেন। এখানে থাকলেই তো দুঃখ পেতে হয়-এই যেমন যে-ছেলেটাকে মা মারা যাবার পর বুকে করে মানুষ করেছেন সেও আজ চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ নিঃশব্দে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ও একবার ভাবল পিসিমাকে ডাকবে, কিন্তু ওর মন যেন সায় দিতে চাইল না। ভীষণ ভাববোধ হল তার, কাউকে জানতে না দিয়ে সে আবার উঠোনে নেমে এল।

এখান থেকে চলে গেলে আর-কিছু না হোক দুজন মানুষকে ছেড়ে যেতে হবে, যারা তাকে আগলে রেখেছিলেন। পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে, জীবনের কোনো সময়ে কি আর-কাউকে সে পাবে এমন করে যে তাকে ভালোবাসবে? খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে সে মুখ তুলে পরিষ্কার আকাশের দিকে দিকে তাকাল। দূরে এক কোনায় বাচ্চা মেয়ের কাপা-হাতে-পরা বাকা টিপের মতো অর্ধেক চাঁদ আকাশে আটকে আছে। মাথার ওপর অনেক তারার ভিড়। যেন হইচই পড়ে গেছে সেখানে। আজ অনেকদিন পর কেন বারবার ছেলেটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে এইরকম তারার রাতে সে বিছানায় শুয়ে। শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেখানে অনেক তারার মধ্যে একটা তারা খুব জ্বলজ্বল চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকত আর কিছুক্ষণ চোখাচোখি হওয়ার পর সেই তারাটা যখন মায়ের মুখ হয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলত, সে-সময় ওই তারটাকে না দেখতে পেলে ওর কান্না পেত। যেন অনিমেষ আকাশের দিকে মুখ করে অনেক তারার মধ্যে সেই তারাটাকে খুঁজতে চাইল। আশ্চর্য, তারাও পালটে যায় নাকি! কারণ ওখানে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে তারা একসনে জ্বলছে, কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না।
 
অনিমেষ উঠোন পেরিয়ে পাশের দরজা খুলে বাড়ির সামনে চলে এল। আশেপাশের সব বাড়ির আলো নিবে গেছে। এখন আর মাইকের শব্দ শোনা যাচ্ছে না যেটা সন্ধেবেলায় ছিল। অনিমেষ চেঁকিশাকে জঙ্গলটা ছাড়েয় ভাড়াটের ঘরের সামনে ওদের সদরদরজার দিকে এগোল। চাঁদটা বোধহয় সামান্য ওপরে উঠেছে, কারণ এখন চারদিক মশারির মধ্যে ঢুকে দেখলে যেমন দেখায় তেমন দেখাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে কয়েক পা হেঁটে সামনে তাকাতে ওর চোখ যেন ঝাঁপসা দেখাল। জয়াদির ঘরের সামনে বারান্দায় কেউ-একজন দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশের থামের গায়ে হেলান দিয়ে যে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সে যে জয়াদি তা বুঝতে দেরি হল না অনিমেষের। জয়াদি ওখানে কী করছে? এভাবে কেন জয়াদি দাঁড়িয়ে থাকবে মানুষের যখন খুব দুঃখ হয় তখনই এরকম ভঙ্গিতে সে দাঁড়াতে পারে-অনিমেষ এটুকু বুঝতে পারছিল। জয়াদিতে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল সে। এত রাতে ও যদি জয়াদির সঙ্গে কথা বলে, তাহলে জয়াদির স্বামী রাগ করবেন না তো? সন্ধেবেলায় তিনি তো এ-ধরনের একটা কথা বলে জয়াদিতে আঘাত করেছিলেন। এখন কি আর আগের মতন জয়াদির সঙ্গে কতা বলা তার মানায় না?

অনিমেষ নিঃশব্দে আবার নিজের ঘরের দিকে ফিরে চলল। ওর মনে হল, আর যা-ই হোক এখন জয়াদিকে একা একা থাকতে দেওয়া উচিত, কারণ অনেক সময় ওর নিজেরই এক থাকতে ভালো লাগে। দরজা বন্ধ করে ও যখন উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছে তখনইরিংশেখরের ঘরের দরজা খুলে গেল। অনিমেষ দ্রুত নিঃশব্দে জায়গাটা পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে আলো নেবাল। এখন এত রাত্রে দাদু তাকে দেখলে অনেকরকম প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে। তার চেয়ে সে মুয়ে পড়েছে এটা বুঝতে দেওয়া ভালো। খাটে শুয়ে সে অন্ধকার ঘরে চুপচাপ কিছুক্ষণ পড়ে থাকল না, আজ রাত্রে ওর কিছুতেই ঘুম আসবে না। অন্ধকার ঘরের দেওয়ালের কাচের জানালায় চোখ বোলাতে গিয়ে সে শক্ত হয়ে গেল। একটা মুখ কাচের জানলার বাইরে থেকে মুখ চেপে ভেতরটা দেখবার চেষ্টা করছে। কে? চোর নয় তো? সঙ্গে সঙ্গে ওর মেরুদণ্ডে যেন একটা ভয় ঠাণ্ডা অনুভুতি নিয়ে যোরাফেরা করতে লাগল। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাটা সে এই মূহুর্তে হারিয়ে ফেলেছে, গলা থেকে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। বাইরের জ্যোৎস্নার পটভূমিতে, ভেতর থেকে একটা আবছা অন্ধকারমেশানো মুখের ছায়া কাচের ওপর ক্ষমতাটা সে এই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছে, গলা থেকে কোনো শব্দ, বেরুচ্ছে না। বাইরের জ্যোৎস্নার পটভূমিতে ভেতর থেকে একটা আবছা অন্ধকার-মেশানো মুখের মায়া কাচের ওপর লেপটে আছে এখনও। সে কী করবে অনিমেষ শার্শে এসে দাঁড়াল। বাইরে জ্যোত্রায় উঠোনটা পরিষ্কার হয়ে আছে। অনিমেষ প্রথম চমকটা কাটিয়ে উঠে খুব ধীরে হোঁচট খেতে-খেতে এগিয়ে-যাওয়া শরীরটাকে দেখতে পেল। এই শরীরটাকে সে জন্ম থেকে জানে। দাদুর এইরকম হেঁটে-যাওয়া অসহায় ভঙ্গি সে আগে কখনো দেখেনি, লাঠি না নিয়ে দাদু এসেছিলেন। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না, সরিৎশখর এত রাত্রে এই জানালায় মুখ দিয়ে কী দেখছিলেন।
 
খাওয়াদাওয়ার পর থেকেই সরিৎশেখর তাড়া দিচ্ছিলেন। সেই কোন সন্ধেবেলায় ট্রেন, অথচ দাদু এমন করে তাড়া দিচ্ছেন যেন আর সময় নেই। জিনিসপত্র গুছিয়ে বাইরে রাখা আছে।দাদু গিয়ে একজন পরিচিত রিকশাওয়ালাকে বলে এসেছেন, সে খানিক আগে এসে বসে আছে। অনিমেষ দেখল ট্রেন ছাড়তে এখনও আড়াই ঘন্টা বাকি। আজ জলপাইগুড়ি শহরে হরতাল বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে। দিনবাজার এলাকায় দোকান বন্ধ করা নিয়ে মারামারি হয়েছে। তবে অন্যদিনের চেয়ে আজকের দিনটা আলাদা সেটা বোঝা গিয়েছিল। রিকশা চলেছে তবে তা সংখ্যায় অর। সরকারি অফিস বা ফুলগুয়ে হয়নি। কিন্তু সিনেমা হল খোলা ছিল-সরিৎশেখর রিকশাওয়ালার কাছ থেকে এইসব সংবাদ আরও বিশদভাবে জেনে নিচ্ছিলেন।

নিজের ঘরে অনিমেষ যখন জামাকাপড় পরছে তখন হেমলতা দরজায় দাঁড়িয়ে। তার মুখটা থমথম করছে, শেষ পর্যন্ত অনিবাবা কলকাতায় চললি?

অনিমেষের বেশি কথা বলতে ভয় করছিল, ও চেষ্টা করে হাসল।

গিয়েই চিঠি দিয়ে খাখবর জানাবি আর প্রত্যেক সপ্তাহে যেন, চিঠি পাই। হেমলতা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

আচ্ছ। অনিমেষ চুল আঁচড়াতে লাগল।

বেশি বাইরে ঘুরি না, বাজে আড্ডা দিবি না। যত তাড়াতাড়ি পড়াশুনা শেষ করে চলে আসতে পারিস সেই চেষ্টা করবি। তোর যা খাওয়াদাওয়ার ধরন-ওখানে পেট পুরে খেতে দেবে কি না জানি না।

বাঃ, খেতে দেবে না কেন? অনিমেষ বলল।

যারে তাদের কলেজে মেয়েরা পড়ে নাকি?

জানি না।

দেখিস বাবা। কলকাতার মেয়েরা খুব-মানে অন্যরকম-ওদের সঙ্গে একদম মিশবি না। হেমলতা শেষবার সতর্ক করলেন।

আমার সঙ্গে মিশবেই-বা কেন? অনিমেষ ঠাট্টা করবার চেষ্টা করল।

কী জানি বাবা, শনিবাবা তো সেইরকম কী বলেছিল। আর হ্যাঁ, ওসব পার্টি-ফার্টি একদম করবি না। তোর জেলে যাবার ফাড়া আছে, মাধু তো সেই চিন্তায় গেল। আমি কী করব! ছটফট করতে লাগলেন হেমলতা।

অনিমেষের হয়ে গেলে হেমলতা ওর হাত ধরে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে প্রণাম করতে বললেন। পিসিমার মন বুঝে অনিমেষ মাটিতে মাথা ঠেকাতে ওর চুলে হাত পড়ল। অনিমেষ মুনল, বিড়বিড় করে পিসিমা সেই কাল রাত্রের মন্ত্রটা বলে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত একটা ড়ুকবে-ওঠা কান্নার মাঝখানে পিসিমা বললেন, ঠাকুরের সামনে বসে তুই আমাকে কথা দে যে এমন-কিছু করবি না যাতে তোর জেল হয়। বল, আমাকে ছুঁয়ে বল!

গলা বুজে এসছিল অনিমেষে, কোনোরকমে বলল, আচ্ছ।

আচ্ছা না, আমাকে ছুঁয়ে বল, কথা দিরাম। পিসিমা ওর হাত ধরলেন।

আর সেই সময় সরিৎশেখরের চিৎকার শোনা গেল, কী হর তোমাদের কেন, বাবাকে করবি তো! বলতে বলতে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর সেই মুহূর্তে কান্নার কোনো সঙ্কোচ থাকল না।

সরিৎশেখর আর অপেক্ষা করতে রাজি নন। পিসিমাকে নিয়ে অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এল। জয়াদি ওঁদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আজ সকালে জয়াদির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। একবারও কালকের কথা তোলেননি তিনি, অনিমেষও ঘুণাক্ষরে জানায়নি কাল রাতে সে ওঁকে দেখেছে। যাকিছু গল্প কলকাতাকে নিয়ে। এখন চোখাচোখি হতে জয়াদি স্নান হাসলেন, চললো।

মাথা নাড়ল অনিমেষ। বুকের মধ্যে এমন অর্কশো সমুদ্র ফুঁসছে-যে-কোনো মুহূর্তের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। মুখ ফিরিয়ে অনিমেষ দেখল তার জিনিসপত্র রিকশায় তোলা হয়ে গিয়েছে। দাদু পিসিমার কেচে-দেওয়া লংথের পাঞ্জাবি আর মিলের ধুতি পরে লাঠি-হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে দেখে আর-একবার ঘড়ি দেখে নিলেন, তাড়াতাড়ি করো। এই সময়যোগটা খুব ভালো আছে।

জয়াদি বললেন, আপনি স্টেশনে যাচ্ছেন তো?

সরিৎশেখর রিকশার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, কালীবাড়িতে যেতেই হবে, কাছেই যখন ঘুরে আসি।

অনিমেষ পিসিমার দিকে ফিরে বলল, পিসিমা, আমি যাচ্ছি।
 
হেমলতা চট করে থানের আঁচল হাতে জড়িয়ে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে সে-অবস্থায় ঘাড় নাড়লেন। ঘোট ঘোট পা ফেলে অনিমেষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রিকশায় চাপল, ঘাড় ঘুরিয়ে সে আবার নিজেদের বারান্দার দিকে তাকাল। রিকশা এখন চলতে শুরু করেছে। আশ্চর্য, পিসিমা এখন এই মুহূর্তে আর বারান্দায় নেই। কেমন খাখা করছে জায়গাটা। নিঃশব্দে টপটপ করে জল পড়তে লাগল অনিমেষের দুগাল বেয়ে। রিকশাটা যখন টাউন ক্লাবের কাছ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তখন অনিমেষ পাশেবসা সরিৎশেখরের গলা শুনতে পেল, তোমাকে অনেক দূরে যেতে হবে অনিমেষ। পাশাপাশি রিকশায় বসে সে দাদুর শরীর থেকে আর্নিকা হেয়ার অয়েলের গন্ধ পেল। গন্ধটা ওকেএক লহমায় অনেকদিন আগে যেন টেনে নিয়ে গেল যেদিন সরিৎশেখর ওর সঙ্গে স্বৰ্গছেঁড়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কলকাতায় যাবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এখন জরা এসে শরীর দখল করা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে সেই মানুষটি যেন একটুও পালটাননি। কাল রাত্রে-দেখা সেই সরিৎশেখরকে এখন জরা এসে শরীর দখল করা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে সেই মানুষটি যেন একটুও পালটাননি। কাল রাত্রে-দেখা সেই সরিৎশেখরকে এখন চেনা অসম্ভব।

টাউন ক্লাবের মাঠ, পিডব্লিউডির অফিস, করলা নদীর পুল পেরিয়ে রিকশাটা এফডিআই স্কুলের মোড়ে চলে এল। এখন বিকেল। দোকানপাট এ-চতুরে অন্যদিনের মতো খোলা। হরতাল শেষ হবার কথা ছটায়-কিন্তু দেখে মনে হয় এখানে হরতাল আদৌ হয়নি। রাস্তাঘাটে লোজন আড্ডা মারছে। এত দূর পথ এল, আশ্চর্য, একটাও চেনামুখ ওর চোখে পড়ল না!

স্টেশনের সামনেটা জমজমাট। রেডিও বাজছে দোকানে। রিকশা থেকে নেমে ওরা মালপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে এল। সরিৎশেখর চশমার খাপ থেকে টাকা বের করে ফাঁকা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলেন। ট্রেন আসতে অনেক দেরি। প্ল্যাটফর্মে লোজন বেশি নেই। কুলিকে জিজ্ঞাসা করে প্রু কোচ কোথায় দাঁড়ায় জেনে সেখানে মালপত্র নামানো হল। পেছনেই একটা বেঞ্চি, সরিৎশেখর সাবধানে সেখানে বসে নাতিকে পাশে ডাকলেন।

তোমার পিসি যে-খাবার দিয়েছে রাস্তায় তা-ই খেয়ো, বুঝলে? দাদুর কথা শুনে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। দুপায়ের মধ্যিখানে লঠিটাকে রেখে হাতলের ওপর গলা চেপে সরিৎশেখর কথা বলছেন, টাকাপয়সা সব সাবধানে নিয়েছ তো?

হ্যাঁ।

গিয়েই চিঠি দেবে।

আচ্ছা।

যে-ভদ্রলোক তোমায় নিতে আসবেন তিনি তোমাকে চিনবেন কী করে তা-ই ভাবছি, কোনোদিন দেখেননি তো।

টেলিফোন বুথের সামনে মালপত্র নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমার বর্ণনা দিয়ে ওঁকে চিঠি লিখেছেন। তা ছাড়া ওর ঠিকানা আছে আমার কাছে।

জানি না কী হবে! কলকাতায় ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। উটকো লোকের কথায় কান দিও ন! তার চেয়ে তোমার কাকাকে লিখলে বোধহয় ভালো হত।

কিছু হবে না।

তোমার কীসব ফাঁড়া আছে শুনেছি-রাজনীতি থেকে দূরে থেকো। আমাদের মতো লোকের ওসব মানায় না।

অনিমেষ কোনো জবাব দিল না। অনেকদিন বাদে দার পাশে বসে এইভাবে কথা বলতে ওর গরি ভালো লাগছিল। এতদিন ধরে এক বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও তিল তিল করে যে-ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেটা এখন হঠাই যেন মিলিয়ে গেছে। অনিমেষে চুপচাপ বসে থাকল।

কুলিদের চিৎকার, যাত্রীদের ব্যস্ততায় একসময় স্টেশনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। এত কুলি কোথায় ছিল কে জানে-অনিমেষ ট্রেন-টাইম ছাড়া কখনো এদের দেখতে পায়নি। সরিৎশেখর বেঞ্চি ছেড়ে সামান্য এগিয়ে কে বাঁদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, সিগনাল দিয়েছে দেখছি, রেডি হও।

কথাটা মুনেও অনিমেষ উঠতে চেষ্টা করল না। ওর মনে হচ্ছিল বুঝি জুর এসে গেছে শরীরে, হাত-পা কেমন ভারী বলে বোধ হচ্ছে। যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে-অনিমেষের এখন খুব ইচ্ছে করছিল ট্রেনটা দেরি করে আসুক। অথবা আজ তো ট্রেনটা নাও আসতে পারত। কত কী তো পৃথিবীতে রোজ হয়ে থাকে।
 
এই সময় বেশকিছু মালপত্র নিয়ে একটি পরিবার যেন সমস্ত প্ল্যাটফর্মে আলোড়ন তুলে এদিকে এগিয়ে এল। অনিমেষ দেখল কলিকে শাসন করতে করতে একজন মহিলা আগে-আগে আসছেন, তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটি মহিলার কন্যা। ওর সামনে এসে কুলি বলে উঠল, খাড়াইয়ে মেমসাব। পুরু গাড়ি ইহাই লাগে গা।

মহিলা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে ভদ্রলোককে ডাকলেন, আঃ, একটু তাড়াতাড়ি এসো-না, ওকে হেল্প করো! কিন্তু ততক্ষণে কুলি নিজেই মালপত্র নামিয়ে নিয়েছে। ভদ্রলোক কাছে এলে মহিলা বললেন, পইপই করে বললাম ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটো-চিরকাল কিষ্টেমি করে কাটালে। এখন এই পাহাড় নিয়ে গুতোগুতি করে ছোটলোকের মতো থার্ড ক্লাসে ওঠো, নিজে তো এখানে ফুর্তি সুটবেন!

ভদ্রলোক চাপা গলায় বলে উঠলেন, আঃ কী হচ্ছে কী, এটা স্টেশন! আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় তুমি জান। আর মেয়েরা একা থার্ড ক্লাসেই সেফ।

সেফ আর সেফ। সারাজীবন পুতুপুতু করে কাটালে। ট্রেন এলে তুমি লাফিয়ে উঠে জায়গা করবে-এই আমি বলে দিলাম। চট করে গলার স্বরে হুকুমের ঝাঝ আনলেন মহিলা।

এই সময় মেয়েটি কথা বলে, থমথমে গলার স্বর, এনলে শরীর কেমন করে, গোবিন্দদারা আসবে বলেছে।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা ঝাঁকুনি দিয়ে শরীর ওর দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ওমা তা-ই নাকি। তোকে বলেছে আসবে? মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।

তুমি আবার ওইসব লোফারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছ বিরক্তি-মেশানো গলায় জ্বলোক মেয়েকে ধমকালেন।

মাথা নিচু করল মেয়েটি কিন্তু তার মা জবাব দিল, মেলা বকবক করবে না তো! একটু আধটু কথা বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। তার বদলে ওরা প্রাণ দিয়ে যে-উপকার করবে, পয়সা ফেললে তা পাবে না। একটুও যদি বুদ্ধিশুদ্ধি থাকত।

অনেকক্ষণ থেকেই অনিমেষ সোজা হয়ে বসে ছিল। ওরা যখন প্রথম এদিকে এগিয়ে এসেছিল তখন ও বুঝতে পারিনি, কিন্তু মহিলাকে খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। কোথায় ওকে দেখেছে এটাই মনে করতে পারছিল না সে। কিন্তু যেই উনি কথা বলতে শুরু করলেন তখনই তিস্তার চরের সেই সকালবেলার ট্যাক্সিটা ওর চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। সেই কাবুলিওয়ালাদের গান, তার শরীরে ভার রেখে বসা এই মহিলা, সেই গুডবয়-মার্কা ছেলেটি আর সর্বদা ঠুকে-কথা-বলা ভদ্রলোক-ও স্পষ্ট দেখতে পেল। অনিমেষ তখনই এই ভদ্রলোকের দিকে লক্ষ করল, কোনো মানুষের চেহারা এত পালটে যায়? কী নোগা এবং কালো হয়ে গেছেন ইনি। পরনে প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট। একে একা দেখলে সে কখনোই চিনতে পারত না। অথচ মহিলাটি একইরকম আছেন, তেমনি স্লিভলেস রাউজ, কড়া প্রসাধন আর মেজাজি কথাবার্তা। তুলনায় ভদ্রলোক অনেক নিষ্প্রভ, ওঁকে দেখলেই মনে হয় ইদানীং খুব অর্থকষ্টে রয়েছেন। ওঁরা ওকে চিনতে পারেননি, কয়েক বছর আগে সামান্য এক ঘন্টার সঙ্গীকে মনে রাখার কথাও নয়। অনিমেষের সেই কুষ্ঠরোগীটার কথা মনে পড়ল। ওকে হাত দিয়ে জল থেকে টেনে তুলেছিল বলে ভদ্রলোক কার্বলিক সাবান ব্যবহার করতে বলেছিলেন। হাসি পেল। অনিমেষের, সেসব না করেও তো ও অক্ষত আছে! সেদিন ভদ্রমহিলা ওর ছোঁয়াচ বাঁচাতে ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে নিয়েছিলেন।
 
সরিৎশেখর ফিরে এসে বেঞ্চিতে বসে বললেন, ভিড় হচ্ছে, হরতাল বলে লোকে আজকাল ভয় পায় না। এই সময় মহিলার বোধহয়-বেঞ্চিটা নজরে পড়ল। তিনি মেয়েকে নিয়ে বাকি বেঞ্চিটা দখল করলেন। কাছাকাছি হতেই অনিমেষ সেই মিষ্টি গন্ধটা টের পেল, ট্যাক্সিতে বসে যেটাতে ফুলের বাগান বলে মনে হয়েছিল। কী আশ্চর্য, এতগুলো বছরেও তিনি গন্ধটাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখে এসেছেন। সরিৎখেরের মুখের পাশটা দেখতে পাচ্ছিল অনিমেষ, তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন।

এই সময় ভদ্রলোক কিছু করতে হবে বলেই যেন যেচে কথা বললেন, আপনারা কলকাতায় যাচ্ছেন

সরিৎশেখর তার দিকে একটু লক্ষ করে ঘাড় নাড়লেন, না, আমার নাতি একাই যাচ্ছে।

ভদ্রলোক অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি বুঝি কলকাতায় পড়?

সরিৎশেখরই জবাবটা দিলেন, ও এবার ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে, কল সুতি হতে যাচ্ছে।

বাঃ, গুড। আমার মেয়েও বেরিয়েছে এবার, তবে ও শান্তিনিকেতনে পড়বে। ওর মা আর ও যাচ্ছে-বোলপুরে নামবে।

ভদ্রলোক কথা শেষ করা মাত্রই মহিলা বলে উঠলেন, বোলপুরে আমার ভাই তাকে, খুব বড় প্রফেসর। তা তুমি ভাই বোলপুর অবধি আমাদের একটু হেল্প কোরো, কী, করবে তো?

অনিমেষ মাথা নাড়ল। সে দেখল দাদু সামনের দিকে মুখ করে বসে আছেন আর মহিলার হাসিহাসি-মুখের পেছনে ওর মেয়ে ঐ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কী নাম তোমার, ভাই। মহিলা আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ! নাম বলে অনিমেষ একটু আশা করল ওঁরা হয়তো চিনতে পারবেন।

এবার কিছুই হয় না। বরং মেয়েটি আকস্মিকভাবে উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ওই দ্যাখো মা, গোবিন্দদারা আসছে!

অনিমেষ দেখল তিনটি ওর চেয়ে বড় ছেলে হাসতে হাসতে এসে সামনে দাঁড়াল, কী বউদি, না বলে কখন বেরিয়ে এলেন, বাড়ি গিয়ে আমরা ফস খেয়ে গেলাম!

মহিলা খুব আদুরে ভঙ্গিতে বললেন, ওমা, কতক্ষণ অপেক্ষা করব ট্রেন এসে যাবে না? এখন এই ভিড় দেখে ভাবছি কী করে গাড়িতে জায়গা পাব।

রঙিন শার্ট পরা ছেলেটি হাত নাড়ল, এসে গেছি যখন তখন আর চিন্তা করবেন না। ট্রেন এলেই বডি ফেলে দেব-দুটো শোওয়ার জায়গা কবজা করতে না পারলে আমার নাম গোবিন্দ না!

ছেলেগুলো কথা বলছিল আর বারবার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছিল। মেয়েটির চোখেমুখে নানারকম ঢং পরপর ঘোরাফেরা করছে। অনিনেষ দেখল ওরা এবার ওকেও লক্ষ করছে এবং দৃষ্টিটা ভালো নয়। সে মুখ ফিরিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন, যেন এই ছেলেগুলোর উপস্থিতি ওঁর কাছে কিছু নয়। ছেলেরা যে ওঁর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি সেটা অনিমেষ লক্ষ করেছিল। ও এদের সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারছিল না-এদের কাউকেহ ও আগে দেখেনি।

একসময় প্ল্যাটফর্মটা চঞ্চল হয়ে উঠল। দূরে আশ্রমপাড়া ছাড়িয়ে কোথাও ইঞ্জিনটা হইসিল দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদিকের আকাশে কালো ধোঁয়া পাক খাচ্ছে। সরিৎশেখর এতক্ষণে কথা বললেন, তোমার ট্রেন এসে গেছে।

হইহই চ্যাঁচামেচির মধ্যে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে দাঁড়াল। গাড়িটা কিন্তু আজ একদম খালি, এমনকি–কোচেও ভিড় নেই। তবু গোবিন্দরা লাফিয়ে কম্পার্টমেন্টে উঠে অনাবশ্যক চিৎকার করে জায়গা দখল করল। অনিমেষ নিশ্চিন্তে জানালার পাশে একটা জায়গা পেয়ে জিনিসপত্র রেখে নিচে নামতে যাবে এই সময় ভদ্রমহিলা কন্যাসমত উপরে উঠে এলেন। অনিমেষকে দেখে বললেন, জায়গা পেয়েছ? ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল সে। বাথরুমটা কোথায়? জল-টল আছে কি না কে জানে! কথাটা যেন শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে অনিমেষ নিচে নেমে এল। ওর মনে হচ্ছিল যাওয়াটা খুব সুখকর হবে না, এই মহিলা ওকে আচ্ছা করে খাটাবেন।

প্ল্যাটফর্মে দাদু দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওকে দেখে বললেন, টিকিটটা তোমাকে দিয়েছি তো?

অনিমেষ বলল, হ্যাঁ।

তুমি গিয়েই চিঠি দেবে।

আচ্ছা।

আর বাইরের লোকের সঙ্গে বেশি আত্মীয়তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। সবার সঙ্গে মানসিকতায় নাও মিলতে পারে। কথাটা শেষ করে তিনি ট্রেনের জানালার দিকে তাকালেন, সেখানে গোবিন্দরা খুব হইচই করছে। অনিমেষ দাদুর দিকে তাকাল। ও চলে যাচ্ছে অথচ দাদুর মুখদেখে মনে হচ্ছে না তিনি একটুও দুঃখিত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সরিৎশেখর বললেন, এবার তুমি উঠে পড়ে, এখনই ট্রেন ছেড়ে দেবে। জিনিসপত্র নজরে রাখবে-পথে চুরিটুনি খুব হয়।
 
এবার অনিমেষ নিচু হয়ে সরিৎশেখরকে প্রণাম করল। ওর হাত তার শুকনো পায়ের চামড়া যেটুকু কাপড়ের জুতোর বাইরে ছিল সেখানে রাখতেই ও মাথায় স্পর্শ পেল। সরিৎশেখর দুহাত দিয়ে তার মাথা ধরে বিড়বিড় করে কিছু কথা উচ্চারণ করছেন। অনিমেষ শেষ বাক্যটি শুনতে পেল, বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও, হৃদয় দাও। ও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই সমস্ত শরীর শিরশির করে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, অনিমেষ আর নিজেকে সামলাতে পারল না, ঝরঝর করে জল দুচোখ থেকে গালে নেমে এল। সরিৎশেখর সেদিকে তাকিয়ে খুব নিচু গলায় বললেন, চোখ মোছো অনিমেষ, পুরুষমানুষের। কান্না শোভা পায় না।

নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল ওর, ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছিল। এই মানুষটির সঙ্গে আজকাল তার কেটেছে, তার সবকিছু শিক্ষা এর কাছে, অথচ আজ অবধি সে এঁকে ঠিক চিনতে পারল না। সরিৎশেখর ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে অনিমেষের কাঁধে রাখলেন, অনিমেষ, আমি অশিক্ষিত এবং খুব গরিব। কিন্তু আমার পিতাঠাকুর আমাকে বলেছিলেন মানুষ হতে। আমি চেষ্টা করেছি, তোমাকেও সেই চেষ্টা করতে হবে। তুমি কলকাতায় গিয়ে শিক্ষিত হও, তোমার স্থিতি হোক সেটাই আমার আনন্দ। আমি যা পারিনি আমার ছেলেরা যা করেনি তুমি তা-ই করো। মানুষের জন্য পূর্ণতার জন্যে, তোমার মধ্যেই সেটা আমি পেতে পারি। আমার জন্যে ভেবো না, যতদিন তুমি মাথা উঁচু করে না। ফিরে আসছ ততদিন আমি বেঁচে তাকব। আই উইল ওয়েট ফর ইউ। যাও, তোমার গাড়ি হুইসল দিয়েছে।

হয় ভাই, সহ্য করে নিলেই আনন্দ। যে-কোনো সৃষ্টির সময় যন্ত্রণা যদি না আসে, তা হলে সেসৃষ্টি বৃথা হয়ে যায়। তোমার আজ নতুন জন্ম হতে যাচ্ছে-কষ্ট তো হবেই। সরিৎশেখর বললেন।

এই মুহূর্তে অনিমেষের অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, এই মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে ছেলেবেলায় সে যেমন ঘুমোত তেমনি কিছু করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সে কিছুক্ষণ পাথরের মতো মুখটার দিকে তাকিয়ে আস্তে-আস্তে ফিরে দাঁড়াল। ও দেখল সেই ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে আসছে! উনি কখন উঠেছিলেন তা সে লক্ষ করেনি। ভদ্রলোক নেমে বললেন, উঠে পড়ে তাই, গাড়ি এখনই ছাড়বে।

একটা একটা করে সিড়ি ভেঙে অনিমেষ দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সরিৎশেখর এগিয়ে এলেন, চিঠি দেবে। আর হ্যাঁ, মহিকেও রিখবে।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। এই সময়ে ট্রেনটা হুইসল বাজিয়ে দুলে উটতেই গোবিন্দরা ওর পাশ দিয়ে লাফিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে জানালার কাছে চলে গেল। খুব আস্তে ট্রেনটা চলছে। সরিৎশেখর লাঠি হাতে ওর সামনে হাঁটছেন। অনিমেষ কান্না গিলতে গিলতে বলল, দাদু!

সরিৎশেখর বললেন, এসো ভাই। আমি অপেক্ষা করব।

একসময় আর তাল রাখতে পারলেন না সরিৎশেখর। ট্রেনটা গতি নিয়েছে। খানিক এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সন্ধের অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীতে। অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে দাদুকে দেখতে লাগল। অনেক লোকের ভিড়ে নিঃসঙ্গ মানুষটা একা দাঁড়িয়ে আছেন। ও হাত নাড়তে গিয়ে থমকে গেল, সরিৎশেখর ডান হাতের পাঞ্জাবিতে নিজের চোখ মুছে পেচনদিকে হাঁটতে আরম্ভ করেছেন। অনিমেষ আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ সমস্ত চারচর যেন অস্পষ্ট, একটা সাদা পর্দার আড়ালে চলে গেল। স্টেশনের আলো, মানুষ সব মিলেমিশে একটা পিণ্ডাপাড়ার রেলক্রসিং বোধহয়। হুশ করে বেরিয়ে গেল। যে-কালো রাতটা চুপচাপ জলপাইগুড়ির ওপর নেমে এসেছে, এই ছুটন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। দৃষ্টি যখন অগম্য হত কল্পনা সৃষ্টা হয়ে যায়। কিন্তু চোখের জলের আড়াল চোখের এত কাছে যে অনিমেষ দাদুর মুখকেই ভালো করে তৈরি করে নিতে পারছিল না। সন্ধে পার হওয়ায় বাতাস এসে ওর ভেজা গালে শুধুই শীতলতা এন দিচ্ছিল। অনিমেষ চোখ মোছার চেষ্টা করল না।
 
নিয়মিত শব্দের আয়োজন রেখে ট্রেনটা যখন প্রায় ফাটাপুকুরের কাছবরাবর চলে এসেছে ঠিক তখন অনিমেষ পেছনে কারও আসার শব্দ পেল। আরে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ, আর আমি খুঁজে মরছি, কোথায় গেল ছেলেটা! ও পেছন ফিরে মহিলাকে দেখতে পেল, বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলছেন। বাঁ হাতের কনুই-এ ঝোলানো তোয়ালেটা হাতে নিয়ে মহিলা কয়েক পা এগিয়ে এলেন, ওমা তুমি কাঁদছিলে নাকি, একদম বাচ্চা ছেলে, মন-কেমন করছে বুঝি?

চোখের জলের কথা খেয়াল ছিল না। অনিমেষ অপ্রস্তুত হয়ে গালে হাত দিল। দরজাটা বন্ধ করে সে এবার মহিলার পেছন পেছন ভেতরে চলে এল। পুরো কামরায় দশ-বারোজনের বেশি লোক নেই, ফলে যে যার শোওয়ার জায়গা পেয়ে গেছে। মহিলারা একেবারে কোনায় জায়গা দখল করেছেন, অনিমেষ তার আগের পোপের সামনে দাঁড়াল। মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে কেন, আমার ওখানে প্রচুর জায়গা আছে, চলে এসো, আবার কোনো উটকো লোক এসে জুটবে হয়তো। ওকে ইতস্তত করতে দেখে কপট রাগ করলেন মহিলা, কী হবে কী, শুনতে পাচ্ছ না? চলে এসো!

এখন কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, চুপচাপ জানলায় বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভালো লাগবে। অথচ মহিলা যেভাবে কথা বলছেন তাতে মুখের ওপর না বলা যায় না। ও তবু বলল, আপনি বসুন, আমি আসছি।

নিজের খোপে এল অনিমেষ। ওর ছোট্ট ব্যাগ আর বেডিং কোনায় দিকে রাখা আছে। সেগুলোকে সরিয়ে জানলার পাশে বসল ও। উলটোদিকের বেঞ্চিতে একজন বুড়োমতন মানুষ দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে বিড়ি খাচ্ছে। চোখাচোখি হতে বলল, শিশিগুড়ি আর কটা স্টেশন বাবু?

অনিমেষ বলল, তিন-চারটে হবে। লোকটা বিড়ি জানলা দিয়ে ফেলে চোখ বন্ধ করল। হুহু করে গাড়ি ছুটছে। বাইরের অন্ধকারে চোখ রাখল অনিমেষ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না অথচ কালকে আকাশে চাঁদ ছিল। হঠাৎ চটপটি জ্বালার মতো আকাশটাকে চিরে একটা আলো ঝলসে উঠতেই মাঠ গাছ পুকুর সামনে পলকের জন্য পরিষ্কার হয়ে মিলিয়ে গেল। আকাশ মেঘে চেয়ে গেছে, আজ চাঁদ উঠবে না।

জলপাইগুড়ি শহর এখন অনেক পেছনে, ট্রেনের চাকার প্রত্যেকটা আবর্তনে কলকাতা এগিয়ে আসছে। আজ সারা বাংলাদেশে হরতাল হয়ে গেল। কিন্তু এ কেমন হরতাল জলপাইগুড়িতে এর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তা হলে কি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে দেশের মানুষ তা সমর্থন করে না? কলকাতা শহরে আজ কী হয়েছে কে জানে? সেখানকার মানুষ আর জলপাইগুড়ির মানুষ কি আলাদা? অনিমেষ অন্ধকারের দিকে অলসভাবে তাকিয়ে বিদ্যুতের খেলা দেখছিল। জোলো হায়ো দিচ্ছে, বোধহয় বৃষ্টি নামবে। কলকাতায় বৃষ্টি হলে জল জমে যায়, খবরের কাগজে ছবি দেখেছে সে।

সামান্য পায়ের শব্দ সেইসঙ্গে মিষ্টি একটা গন্ধে অনিমেষ মুখ ফেরাল। ফেরাতেই ঝটপট সোজা হয়ে বসল সে। মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়েয়েছে। গাড়ির দুলুনি সামলাতে এক হাতে বাঙ্কটা ধরায় ওকে বেড় বড়সড় দেখাচ্ছে।

কী ব্যাপার, আপনার বুঝি আমাদের কাছে আসতেই ইচ্ছে করছে না? কথা বলার ভঙ্গি এমন আদুরে যে বয়সের সঙ্গে মানায় না। শরীর বেশিরকম ফীত, স্কার্টের কাপড়ে টান পড়েছে। ওর হাত এবং হাঁটুর ওপর মুক্ত পা থেকে চোখ সরিয়ে নিল অনিমেষ। মেয়েটি মুখ নেপালি-নেপালি ছাপ আছে, চোখ দিয়ে হাসছে সে। কী হল, কথা বলছেন না কেন?

যাচ্ছি। অনিমেষ ওঠার চেষ্টা করল।

যাচ্ছি না, আমার সঙ্গে চলুন, মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। একটুও নড়ছে না মেয়েটি, ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করলেই গুড বয় হতে হয়।

আমি মোটেই গুড বয় নয়। অগত্যা অনিমেষ ওর জিনিসপত্র দুহাতে তুলে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি সামান্য সরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার নাম তো অনিমেষ, আমার নাম জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে না?

অনিমেষ কোনোরকমে দুলুনি সামলে বলল, নাম কী?

মুখে আঙুলচাপা দিয়ে খিলখিল করে হাসতে গিয়েই, গিলে ফেলে বুড়োর দিকে চেয়ে চোখ বড় বড় করল, সুরমা। একদম সেকেলে নাম, না?

অনিমেষ হেসে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে এল। মেয়েটির পাশ দিয়ে আসবার সময় ওর কুব অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া হল না সুরমার। অনিমেষ মেয়েটিকে যত দেখছিল তত অবাক হচ্ছিল। এ-মেয়ে সীতার মতো নয়, এমনকি রঙা বা উর্বশীর সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েরা বোধহয় এক-একজন এক-এক রকম হয়, কেউ বোধহয় কারও মতন হয় না।
 
ওদের খোপে এসে অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। মুখোমুখি দুটো বোখিতে লম্বা করে বিছানা পাতা হয়ে গেছে। জিনিসপত্র ওপরের বাঙ্কে ভোলা। মহিলা বালিশে হেলান দিয়ে একটা রঙিন পত্রিকা পড়ছেন। অবাক হবার পালা অনিমেষের চলছেই, কারণ মহিলার পরনে সেই বাড়িটা নেই। এখন পা-বুল একটা আলখাল্লা পরে রয়েছেন উনি। ওকেদেখে পত্রিকা থেকে মুখ তুলে একগাল হাসলেন, এসো, সু না গেলে বোধহয় আসতেই না! আচ্ছা, এই জিনিসপত্র ওপরের বাঙ্কে তুলে দাও।

বাধ্য ছেলের মতো অনিমেষ হুকুম তামিল করল। ততক্ষণে সুরমা অন্য বেঞ্চির জানলার ধারে বসে পড়েছে। মহিলা বললেন, বসে পড়ো, এখানেই বসো। হাত দিয়ে নিজের সামনে থেকে চাদর সারিয়ে নিলেন মহিলা। অনিমেষ বসে মহিলার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। ওর চট করে মুভিং ক্যাসেলের মুখটা মনে পড়ল। ঠিক সেই একই দৃশ্য, মহিলার আলখাল্লার ওপরে অনেকখানি ভোলা এবং সেখানে বাজহাঁসের ডিমের মতো দুটো মাংসপিণ্ড উঁচু হয়ে রয়েছে।

তুমি কি খাবার এনেছ? যা। আমার সঙ্গেও আছে। তোমারটা আর খেতে হবে না। আমি ভাবছি এই সুখ আর কতক্ষণ কপালে সইবে। শিরিগুড়িতে গিয়ে দেখব হুড়মুড় করে হাজার লোক উঠে বসেছে। আমি আবার শাড়ি পরে রাত্রে পারি না। মহিলা আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেন।

অনিমেষ দেখল সুরমা ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। চোখাচোখি হতে বলল, শুনলাম আপনি কাঁদছিলেন, মায়ের জন্য-কেমন করছে বুঝি?

অনিমেষ ঘাড় নাড়াল, না।

সঙ্গে সঙ্গে মহিরা পত্রিকা সরিয়ে চোখ বড় বড় করলেন, ওমা, তবে কার জন্যে? কথা বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে সুরমা খিলখিল করে হেসে উঠল। মহিলা কপট রাগের ভঙ্গি করে মেয়ের দিকে মুখ ফেরালেন, এই,তোকে বছি না এমন করে হাসবি না! মেয়েদের এরকম হাসি ভালা না।

অনিমেষের অস্বস্তি বেড়ে গেল। এরা যেভাবে কথা বলছে তাতে তার সঙ্গে তাল রাখা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমিকি জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলে?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ।

ওমা, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছ না কেন? অবুসিধে হচ্ছে?

ঘাড় নেড়ে তাকাল অনিমেষ, সেই একই দৃশ্য। অনিমেষ হজম করার চেষ্টা করতে লাগল।

সুরমা বলল, জেলা স্কুল! উর্বশীদের আপনি চেনেন?

থতমত হয়ে গেল অনিমেষ। তারপর ঘাড় নাড়ল, দেখেছি।

বাব্বা, জেলা স্কুলের সব ছেলে তো ওদের বাড়িতে সারাক্ষণ পড়ে থাকে। ঠোঁট বেঁকিয়ে সুরমা কথা বলর, ওরা তো এখন কলকাতায়। আপনার সঙ্গে আলাপ নেই।

অনিমেষ বলল, সামান্য।

মহিলা ঘাড় নেড়ে বললেন, ওদের মা আমার বন্ধু। ভদ্রলোক তো সারাজীবন কংস করে কাটালেন, মিসেস কর না থাকলে যে কী হত! তবু দ্যাখো, লোকে বদনাম দিতে ছাড়ে না। আমাদের এই দেশটাই এরকম। কেউ যদি একটু সাজগোজ করল, কি আধুনিক পোশাক পরল, ব্যস, চারধারে, খই ফুটতে আরম্ভ হল। এই আমিই কি কম শুনেছি!
 
শিলিগুড়িতে এসে ওদের গাড়িটা নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হরে আগে মহিলা জোর করে ওকে পরোটা আর শুকনো মাংস খাইয়েছেন। দারুণ রান্না! একটু ঝাল, বোধহয় এদের ওয়াটার-বটলটা নিয়ে জল আনতে প্ল্যাটফর্মে নামল। অল্প লোক মেনে। এত বড় প্ল্যাটফর্ম এর আগে দেখেনি অনিমেষ। চারিধার নিওন আলোয় ঝকঝক করছে। এখনও বৃষ্টি নামেনি। কুলিরা, কীসব কথা বলাবলি করছে। যদিও এর আগে কোনোদিন সে এই স্টেশনে আসেনি, তবু ওর যেন মনে হল এই আবহাওয়া স্বাভাবিক নয়। বেশির ভাগ গাড়িই খালি। জল ভরে নিয়ে হঠাৎ একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল। এর আগে কখনো একা একা সিগারেট খায়নি অনিমেষ। একটা স্টলের সামনে দাঁড়য়ে ও সিগারেট কিনে ধরাতে গিয়ে শুনল একজন লোক খুব উত্তেজিত গলায় বলছে, একটু আগে রেডিওতে বলল, দুজন খুন হয়েছে। কলকাতায় গুলি চালালে মাত্র দুজন মরবে? অসম্ভব! শালারা খবর চাপছে।

আর-একজন বলল, তা হলে তো কাল কলকাতায় আগুন জ্বলবে। পাবরিক ছেড়েদেবে নাকিএরকম হল?

আরে মশাই, আজ নাকি বাস পুড়িয়েছে তিনটে, রেডিওর খবর-বুঝে দেখুন!

হয়ে গেল, এই ট্রেন শেষ পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না দেখুন।

আরও খবরের আশায় খানিক দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। কিন্তু ওরা আর-কিছু বলছেনা দেখে মুখ তুলে তাকাল। লোক দুটো কথা বন্ধ করে ওর দিকে চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মুখ সরিয়ে নিয়ে দুজনে হাঁটতে লাগল। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, ওদের একজন চাপা গলায় বলছে, এসব জায়গায় কতা বলা টিক নয়, দিনকাল কারাপ, কে যে কী ধান্দায় ঘুরছে বলা মুশকিল।

লোকগুলো কি ওকে সন্দেহ করল? কেন, সন্দেহ কেন? অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর চেহারার মধ্যে কি এমন কোনো চিহ্ন আছে যে অত বড় দুটো মানুষ ভয় পেয়ে যাবে। কিছুই বুঝতে না পেরে ও আস্তে-আস্তে ফিরে আসছিল নিজের কামরার দিকে। কলকাতায় আজ পুলিশ গুলি চালাল কেন? লোকেরা বাসই-বা পোড়াতে গেল কেন খামোকা? এই ট্রেন শেষ পর্যন্ত কলকাতায় যাবে না কেন?

কামরায় উঠে ও চমকৃত হল। কখন যে একটু একটু করে গাড়িটা বরে গিয়েছে বাইরে থেকে টের পায়নি এবং শুধু মানুষই নয়, চিৎকার করে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। একজন টাকমাথা মানুষ প্রথম খোপের বেঞ্চিতে বসে গলা তুলে বললেন, আরে মশাই, আমি নিজের কানে বাংলা খবর শুনেছি, লেফটিস্টরা স্ট্রাইক বানচাল হয়ে যাচ্ছে দেখে গুণ্ডামি করে ট্রামবাস পুড়িয়ে দিতে পুলিশ বাধ্য হয়ে দুএক রাউন্ড ফায়ারিং করেছে।

সঙ্গে সঙ্গে একজন চেঁচিয়ে উঠল, দাদু কি স্পটে ছিলেন?

আচ্ছা বুদ্ধি আপনার, দেখছেন এখানে বসে আছি, রেডিওতে বলল!–টাকমাথা খিঁচিয়ে উঠলেন।

আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক আজকের প্লেনে কলকাতা থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, কমপ্লিট স্ট্রাইক হয়েছে কলকাতায়। গরমেন্ট জোর করে ট্রামবাস চালাতে চেষ্টা করে ফেল করেছে। কোন খবর বিস্বাস করব বলুন? আর-একটি কণ্ঠ বলে উঠল।

আরে মশাই, আমি ভাবছি কাল শেষ পর্যন্ত কলকাতায় পৌঁছাতে পারব কি না কে জানে! যদিপথে ট্রেন আটকে দেয়, অনেক টাকার টেন্ডার হাতছাড়া হয়ে যাবে।

প্লেনে গেলে পারতেন।

সে-চেষ্টা কি করিনি, টিকিট সব হাওয়া এই মওকায়।

ওয়াটার-বটল নিয়ে অনিমেষ কামরার শেষপ্রান্তে চলে এল। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাড়া সুরমাদের এখানে কেউ ভিড় করেনি। ওরা দুটো রেঞ্চি বেশ মেজাজেই দখর করে আছে। বৃদ্ধ অভদ্রলোক মহিলার বেঞ্চির একটা কোনায় বসে আছেন। ওকে দেখে সুরমা বলে উঠল, এই, আমারা। ভাবলাম যে আপনি নিশ্চয়ই পথ ভুলে গিয়েছেন।

মহিলা বললেন, খুব কাজের ছেলে দেখছি, এত ভাবাও কেন?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top