আগামীকাল ধর্মঘট। এবার যেভাবে কমিউনিস্টরা শহর পথে-পথে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, এর আগে কখনো সেরকম দেখা যায়নি। কিন্তু একটা জিনিস অনিমেষে কিছুতেই বুঝতে পারে না, সাধারণত মানুষ একদম উত্তেজিত নয়। বরং তাদের মধ্যে নিস্পৃহা ভাব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত ফেরার সময় ও লক্ষ করেছে, কারও মধ্যে তেমন চাঞ্চল্য নেই। অথচ মানুষের খাবারের জন্য এই হরতাল। তা হলে কি, জলপাইগুড়ির সমস্ত মানুষ কংগ্রেসের সমর্থক হয়ে গেল? কী জানি! কিন্তু যদি এই হরতালের ফলে কাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়-তা হলে? এ-সপ্তাহে আর নাকি ভালো দিন নেই।
ভেজানো দরজা খুলে বাইরে এল অনিমেষ। ওদের বাগানটা এখন জঙ্গলে ভরে গেছে। সামান্য সৃষ্টি হলেই গাছগুলো রতর করে বড় হয়ে ওঠে। ফুলের গাছ আর নেই, বিভিন্ন ফলের গাছেই বিরাট জায়গাটা ভরাট। এখন সবে চাঁদ উঠেছে। লম্বা সুপারিগাছগুলোর মাথায় তার জ্যোৎস্না, নেতিয়ে পড়ে আছে। চারধার একটা আবছা আলো-অন্ধকারের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। চট করে তাকালে বোঝা যায় না, কিন্তু চোখ সয়ে এলে দেখতে কোনো অসুবিধে হয় না। অনিমেষ দেখল দ্রাদুর ঘরে আলো জ্বলছে না, কোনো শব্দ আসছে না সেখান থেকে। পিসিমার রান্নাঘর থেকে সামান্য আলো আসছে বাইরে।
উঠোনে নেমে এল সে খালিপায়ে। এখন গরমকাল। সময়ে-অসময়ে বৃষ্টি আসে। উঠোনের ঘাসগুলো এখন মাথাচাড়া দিয়েছে, গোড়ালি ড়ুবে যায়। এভাবে নামা ঠিক হয়নি, কারণ এই সময় সাপেরা মেজাজে চারধারে ঘুরে বেড়ায়। কখন কে বিরক্ত হয়ে ছোবল মারবে-অনিমেষ সাবধানে পা ফেলতে লাগল। দাদুর ঘর পেরিয়ে পিসিমার রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সে। দরজার কাচ দিয়ে ঈষৎ আলো বাইরে আসছে। এটা ইলেকট্রিক আলো নয়, নিশ্চয়ই কুপির আলো। পিসিমা ইলেকট্রিক আলো বাঁচাতে কুপি জ্বালান রাত্রে শোওয়ার সময়। এইটে ওঁর বহু পুরনো অভ্যেস। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে আসবার সময় পিসিমা ওটা নিয়ে এসেছেন। নিঃশব্দে বারান্দায় উঠে দরজার কাছে এসে কাঠ হয় দাঁড়িয়ে পড়ল অনিমেষ। ভেতর থেকে চাপা গলায় পিসিমা কান্নাটা ঘরের মধ্যে পাক খেতে লাগলু। পিসিমা কাঁদছেন কেন? কান্নাটাও যেন সতর্কভাবে-সরিৎশেখর বা আর-কেউ টের পান তিনি চান না। যেন নিজের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে কান্না। আগে চলে-যাওয়া, বোধহয় চেহারা গুলিয়ে বা ভুলে-যাওয়া পিসেমশাইকে অভিযোগ করে কেঁদে যাচ্ছেন। কেন তাকে একা ফেলে রেখেছেন এতকাল। কতদিন তিনি এইভাবে পৃথিবীতে থাকবেন। এখানে থাকলেই তো দুঃখ পেতে হয়-এই যেমন যে-ছেলেটাকে মা মারা যাবার পর বুকে করে মানুষ করেছেন সেও আজ চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ নিঃশব্দে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ও একবার ভাবল পিসিমাকে ডাকবে, কিন্তু ওর মন যেন সায় দিতে চাইল না। ভীষণ ভাববোধ হল তার, কাউকে জানতে না দিয়ে সে আবার উঠোনে নেমে এল।
এখান থেকে চলে গেলে আর-কিছু না হোক দুজন মানুষকে ছেড়ে যেতে হবে, যারা তাকে আগলে রেখেছিলেন। পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে, জীবনের কোনো সময়ে কি আর-কাউকে সে পাবে এমন করে যে তাকে ভালোবাসবে? খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে সে মুখ তুলে পরিষ্কার আকাশের দিকে দিকে তাকাল। দূরে এক কোনায় বাচ্চা মেয়ের কাপা-হাতে-পরা বাকা টিপের মতো অর্ধেক চাঁদ আকাশে আটকে আছে। মাথার ওপর অনেক তারার ভিড়। যেন হইচই পড়ে গেছে সেখানে। আজ অনেকদিন পর কেন বারবার ছেলেটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে এইরকম তারার রাতে সে বিছানায় শুয়ে। শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেখানে অনেক তারার মধ্যে একটা তারা খুব জ্বলজ্বল চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকত আর কিছুক্ষণ চোখাচোখি হওয়ার পর সেই তারাটা যখন মায়ের মুখ হয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলত, সে-সময় ওই তারটাকে না দেখতে পেলে ওর কান্না পেত। যেন অনিমেষ আকাশের দিকে মুখ করে অনেক তারার মধ্যে সেই তারাটাকে খুঁজতে চাইল। আশ্চর্য, তারাও পালটে যায় নাকি! কারণ ওখানে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে তারা একসনে জ্বলছে, কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না।
ভেজানো দরজা খুলে বাইরে এল অনিমেষ। ওদের বাগানটা এখন জঙ্গলে ভরে গেছে। সামান্য সৃষ্টি হলেই গাছগুলো রতর করে বড় হয়ে ওঠে। ফুলের গাছ আর নেই, বিভিন্ন ফলের গাছেই বিরাট জায়গাটা ভরাট। এখন সবে চাঁদ উঠেছে। লম্বা সুপারিগাছগুলোর মাথায় তার জ্যোৎস্না, নেতিয়ে পড়ে আছে। চারধার একটা আবছা আলো-অন্ধকারের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। চট করে তাকালে বোঝা যায় না, কিন্তু চোখ সয়ে এলে দেখতে কোনো অসুবিধে হয় না। অনিমেষ দেখল দ্রাদুর ঘরে আলো জ্বলছে না, কোনো শব্দ আসছে না সেখান থেকে। পিসিমার রান্নাঘর থেকে সামান্য আলো আসছে বাইরে।
উঠোনে নেমে এল সে খালিপায়ে। এখন গরমকাল। সময়ে-অসময়ে বৃষ্টি আসে। উঠোনের ঘাসগুলো এখন মাথাচাড়া দিয়েছে, গোড়ালি ড়ুবে যায়। এভাবে নামা ঠিক হয়নি, কারণ এই সময় সাপেরা মেজাজে চারধারে ঘুরে বেড়ায়। কখন কে বিরক্ত হয়ে ছোবল মারবে-অনিমেষ সাবধানে পা ফেলতে লাগল। দাদুর ঘর পেরিয়ে পিসিমার রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সে। দরজার কাচ দিয়ে ঈষৎ আলো বাইরে আসছে। এটা ইলেকট্রিক আলো নয়, নিশ্চয়ই কুপির আলো। পিসিমা ইলেকট্রিক আলো বাঁচাতে কুপি জ্বালান রাত্রে শোওয়ার সময়। এইটে ওঁর বহু পুরনো অভ্যেস। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে আসবার সময় পিসিমা ওটা নিয়ে এসেছেন। নিঃশব্দে বারান্দায় উঠে দরজার কাছে এসে কাঠ হয় দাঁড়িয়ে পড়ল অনিমেষ। ভেতর থেকে চাপা গলায় পিসিমা কান্নাটা ঘরের মধ্যে পাক খেতে লাগলু। পিসিমা কাঁদছেন কেন? কান্নাটাও যেন সতর্কভাবে-সরিৎশেখর বা আর-কেউ টের পান তিনি চান না। যেন নিজের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে কান্না। আগে চলে-যাওয়া, বোধহয় চেহারা গুলিয়ে বা ভুলে-যাওয়া পিসেমশাইকে অভিযোগ করে কেঁদে যাচ্ছেন। কেন তাকে একা ফেলে রেখেছেন এতকাল। কতদিন তিনি এইভাবে পৃথিবীতে থাকবেন। এখানে থাকলেই তো দুঃখ পেতে হয়-এই যেমন যে-ছেলেটাকে মা মারা যাবার পর বুকে করে মানুষ করেছেন সেও আজ চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ নিঃশব্দে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ও একবার ভাবল পিসিমাকে ডাকবে, কিন্তু ওর মন যেন সায় দিতে চাইল না। ভীষণ ভাববোধ হল তার, কাউকে জানতে না দিয়ে সে আবার উঠোনে নেমে এল।
এখান থেকে চলে গেলে আর-কিছু না হোক দুজন মানুষকে ছেড়ে যেতে হবে, যারা তাকে আগলে রেখেছিলেন। পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে, জীবনের কোনো সময়ে কি আর-কাউকে সে পাবে এমন করে যে তাকে ভালোবাসবে? খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে সে মুখ তুলে পরিষ্কার আকাশের দিকে দিকে তাকাল। দূরে এক কোনায় বাচ্চা মেয়ের কাপা-হাতে-পরা বাকা টিপের মতো অর্ধেক চাঁদ আকাশে আটকে আছে। মাথার ওপর অনেক তারার ভিড়। যেন হইচই পড়ে গেছে সেখানে। আজ অনেকদিন পর কেন বারবার ছেলেটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে এইরকম তারার রাতে সে বিছানায় শুয়ে। শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেখানে অনেক তারার মধ্যে একটা তারা খুব জ্বলজ্বল চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকত আর কিছুক্ষণ চোখাচোখি হওয়ার পর সেই তারাটা যখন মায়ের মুখ হয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলত, সে-সময় ওই তারটাকে না দেখতে পেলে ওর কান্না পেত। যেন অনিমেষ আকাশের দিকে মুখ করে অনেক তারার মধ্যে সেই তারাটাকে খুঁজতে চাইল। আশ্চর্য, তারাও পালটে যায় নাকি! কারণ ওখানে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে তারা একসনে জ্বলছে, কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না।