What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

ওরা তিনজনেই বসে পড়ল চটপট। লাইনে এখন জোর কথাবার্তা চলছে। সেইসঙ্গে হাসি আর চিৎকার। মাদলটা ঘুরেফিরে অনেকরকম বোল তুলছে এখন। এগিয়ে-আসা আওয়াজটা হঠাৎ থেমে গেছে। সামনের ওই বিরাট অন্ধকার-করে-রাখা অশ্বথগাছটার জন্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যে এসেছে সে কি ওদের সন্ধান পেয়েছে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল সেরা নিশ্চয়ই ওদের কথা ফিরে-আসা। কুলিদের বলবে না। আর যদি ওরা টের পেত তা হলে এতক্ষণে দল বেঁধে এদিকে ছুটে আসত। কিছুক্ষণ এভাবে উবু হয়ে বসে থেকে অনিমেষের অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল। চারাগাছগুলোর তলায় ঢোকার কোনোপ্রশ্ন নেই কিন্তু ওরা যেখানে রয়েছে তা তলায় অনেক দুলো আগাছা, ঘাস শরীরটাকে ব্ৰিত করছিল। মহীতোষ যেন ফিসফিসিয়ে ছোটমাকে বললেন, এও কপালে লেখা ছিল। ছোটমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এই সময় অনিমেষ ওকে দেখতে পেল। পায়েপায়ে এগিয়ে এসে মুখে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছে। মহীতোষও ওকে দেখেছিলেন। স্বস্তির নিশ্বাসটা তার এত জেরে হয়েছিল যে ছোটমা চোখ খুলে সামনে দেখল এবং সেই সময় বাচ্চাটা এদিকে মুখ ফেরাল। তিনটে মানুষ যে এভাবে উবু খুলে সামনে দেখল এবং সেই সময় বাচ্চাটা এদিকে মুখ ফেরাল। তিনটে মানুষ যে এভাবে উবু হয়ে বসে আছে সে-দৃশ্যে ওর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা। গেল না। ও অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ সামনে এগিয়ে এসে ডান হাতটা এগিয়ে ধরল।

অনিমেষ দেখল ওর হাতে একটা কাগজের মোড়ক ধরা আছে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে, এইভাবে। পেছন ধাওয়া করে এসে কী দিতে চাইছে ও? মোড়কটা নিয়ে কাঁপাহাতে সেটাকে খুলল অনিমেষ। পুরনো খবরের কাগজের ভাঁজগুলো খুলতেই অনিমেষ তাজ্জব হয়ে গেল। গোটা-চারেক গুড়ের বাতাসা রয়েছে তাতে। ও মুখ তুলে তাকাতেই দেখল ছেলেটা হলদে দাঁত বের করে হাসল, তারপর একটা হাত পেছনদিকে ওদের লাইনের দিকে নির্দেশ করেই সেটাকে ফিরিয়ে অনিমেষের দিকে উঁচিয়ে ধরে অবোধ্য শব্দ করে চলল। পেছন থেকে মহীতোষ জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?

অনিমেষ ওদের বাতাসাগুলো দেখাল। ছোটমা বলল, আহা রে, তোমাকে খেতে দিয়েছে বুড়ি, কী ভালো দ্যাখো তো!

মহীতোষ বললেন, আশ্চর্য!

অনিমেষ এতখানি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল, ও কোনো কথা বলতে পারছিল না। যাদের ভয়ে ওরা বাড়ি ছেড়ে চা-বাগানের মধ্যে লুকিয়ে আছে তাদেরই একজন তাকে প্রথম দেখল বলে চারটে বাতাসা পাঠিয়ে দিয়েছে মুখমিষ্টি করতে। হয়তো এই বাতাসাগুলো সেরার কাছে মহার্ঘ জিনিস, কিন্তু তা-ই সে পাঠিয়ে দিয়েছে সরিৎশেখরকে সম্মান দেবার জন্য। এই মুহূর্তে অনিমেষ দাদুর জন্য গর্ব অনুভব করছিল। ও দুটো বাতাসা বাচ্চাটার হাতে দিতেই সে একসঙ্গে মুখে পুরল, তারপর হাত নেড়ে অনিমেষকে ডাকতে লাগল।
 
অনেকক্ষণ থেকে অনিমেষের মনের মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা তিল তিল করে জন্ম নিচ্ছিল। এইভাবে বাড়িতে আসামাত্র কিছু গরিব কুলির ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ও মনেমনে আর সমর্থন করতে পারছিল না। ওর মনে হচ্ছিল আজ কুলিদের এই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পেছন নিশ্চয়ই সুনীলদার পরিশ্রম আছে। সেই সুনীলদার সঙ্গে তার মিত্রতা, সুনীলদার শেষযাত্রার সঙ্গী হওয়া, সর্বহারাদের সম্পর্কে সুনীলদার কথা শুনে অনেক কিছু স্পষ্ট করে দেখা-এখানে এসে এইভাবে পালিয়ে বেড়ানোর ফলে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। আসলে এখানে আসামাত্রই এতসব ঘটনা পরপর ঘটে গেল যে সে মাথা ঠিক করে কোনোকিছু চিন্তা করতে পারেনি। এখন এই মুহূর্তে বাচ্চাটার হাতে পাঠারে বৃদ্ধা। মদেসিয়া রমণীর ভালোবাসা পেয়ে ভীষণভাবে নাড়া খেল। এইভাবে পালিয়ে বেড়াবার কোনো অর্থ হয় না। ওর মনে হল ও নিশ্চয়ই রাগী কুলিদের বোঝাতে পারবে যে ওদের শত্রু: তারা নয়। এই বাচ্চাটা যেন অনিমেষকে লজ্জা দিয়ে গেল। ও আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাচ্ছি।

মহীতোষ চমকে উঠলেন, সে কী! কোথায় যাচ্ছিস?

অনিমেষ বাবার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণের ভাবা কথাগুলো বলব-বলব করেও বলল না। ওর মনে হল এসব কথা বাবা বুঝবেন না। বাবার যখন যৌবন ছিল তখন তিনি দেশকে স্বাধীন করার জন্য কোনো আন্দোলন করেননি। এই ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো নিজের পরিবারের বাইরে আর-কিছু ভাববার মতো মানসিকতা বাবার কখনো তৈরি হয়নি। এখানকার কংগ্রেস কমিউনিস্ট কোনো ব্যাপারই তাকে স্পর্শ করে না। এই চা-বাগানের কুলিদের ওপর তিনি কখনোই অত্যাচার করেননি বটে, কিন্তু এরা যে মানুষ, মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য, এরা চেষ্টা করতে পারে সেটাও তিনি ভাবতে পারেন না। যেন ঈশ্বর পৃথিবীতে যাকে যেভাবে চিরকাল রেখে এসেছেন সে সেইভাবে থাকবে। শুধু নিজের এবং পরিবারের মানুষের ওপর কোনো আঘাত হলে তিনি বিচলিত। হয়ে উঠবেন। অনিমেষের মনে হল, তার জানাশোনা মধ্যবিত্ত মানুষরা সবই বাবার মতো একা একা।

ও এইসব কথা বলল না, শুধু বলল, দেখে আসি কী ব্যাপার। এইভাবে কতক্ষণ বসে থাকব।

মহীতোষ স্পষ্ট বিরক্ত হবেন, কিন্তু ততক্ষণে অনিমেষ এগিয়ে গিয়েছে। মহীতোষ চাপা গলায় বললেন, মরবে মরবে, চিরকাল এইরকম জেদি থেকে গেল, বুদ্ধিসুদ্ধি হল না!

ছেলেটার হাত ধরে অনিশেষ চা-বাগান থেকে উঠে আসছে এমন সময় পেছন থেকে ছোটমার ডাক শুনতে পেল। পেছন ফিরে সে দেখল ছোটমা এগিয়ে আসছে। ও এটা ভাবতে পারেনি, ভেবেছিল বাবা আর ছোটমা আপাতত এখানে থাকুন, পরিস্থিতি বুঝে পরে ব্যবস্থা করা যাবে।

ছোটমা এসে বলল, চলো।

তুমি যাবে? অনিমেষ বিশ্বাস করতে পারছিল না।

আমি আর বসে থাকতে পারছি না। তা ছাড়া তোমার যদি কোনো ক্ষতি না হয় আমারও হবে। আর যা-ই হোক মেয়েদের ওরা কিছু বলবে না। চলো।

ছোটমাকে হাঁটতে দেখে অনিমেষ বলল, বাবা?

উনি থাকুন। সবাই তো সমান নয়। ওঁর পক্ষে এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। বরং এখানেই ওঁর মনে হবে বিপদ কম। ছোটমার কথা শুনে অনিমেষ চুপচাপ হাঁটতে লাগল। পেছন থেকে মহীতোষের গলায় চাপা ডাক ওরা আর শুনতে পেল না, কারণ ততক্ষণে সেই বিরাট অশ্বগাছটা ওরা পেরিয়ে এসেছে। ছোটমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের কেমন গুলিয়ে গেল। মানুষের চরিত্র ও এখন কিছুই বুঝতে পারে না।

দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন কলিলাইনে মেলা বসেছে। প্রচুর মানুষের ভিড়, গেল হয়ে তারা নাচ দেখছে। পরস্পরের কোমর জড়িয়ে ধরে ছেলেমেয়েরা মাদলের তালে আগুপিছু হয়ে নাচছে। প্রথমে ওদের দেখতে পেয়েই অনিমেষের বুকটা কেঁপে উঠেছিল, কী হবে কে জানে। কিন্তু খুব দ্রুত ও নিজেকে সামলে নিল, পরিস্থিতি যা-ই হোক ও তার মোকাবিলা করবে। ছোটমার মুখ দেখে মনে হল না একটুও ভয় পেয়েছে। যারা এইরকম আনন্দ করে নাচতে পারে তারা কি মানুষকে আক্রমণ করতে পারে?
 
স্বৰ্গছেঁড়ার কুলিলাইনে তাদের সীমানায় কোনো বাবুর বউকে আসতে দেখেনি কখনো, ফলে ওদের দেখতে পাওয়ামাত্র ভিড়টা জমাট বেঁধে গেল। সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখ তুলে ওদের দেখছে। ছেলেটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ওদের সামনে এসে অনিমেষ খুব অস্বস্তি বোধ করল। এই মানুষগুলোকে দেখে একটুও রাগী বলে মনে হচ্ছে না। কাকে কী কথা বলা যায়-পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় অনিমেষের গোলমাল হয়ে গেল। ও বাচ্চাটার হার টানে সেরার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ছোটমা বলল, সবাই দেখছে।

সেরা দাঁড়িয়ে ছিল দাওয়ায়। ওদের ফিরে আসতে দেখে ফোকলামুখে বাচ্চাটাকে কিছু বলতেই সে ঘাড় নেড়ে জবাব দিল, দিয়ে হাসল। লাটিতে ভর রেখে একটু সামনে এগিয়ে সেরা সমবেত জনতাকে দেখাল, বুড়োবাবুকে লাতি।

একটা গুঞ্জন উঠল, যেন মুহূর্তেই জনতা অনিমেষকে চিনতে পারল। ছোটমাকে অনেক কামিন চেনে। তারা ঠারেঠোরে কথা বলছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে একজন বয়স্ক মদেসিয়া এগিয়ে এল ওদের দিকে। অনিমেষ ঠিক বুঝতে পারছিল না হাওয়া কোনদিকে, শার্ট-প্যান্ট পরা প্রৌঢ় লোকটিকে দেখলে মনে হয় বেশ ভদ্র। লোকটি সামনে এসে ওদের দেখে বলল, আপনি মহীবাবুর ছেলে?শষ্ট বাংলা উচ্চারণ, কথা বলার মধ্যে একটা কর্তৃত্বের আভাস আছে। অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। এখানে কী করছেন?

অনিমেষ জবাব দেবার আগেই ছোটমা বলল, বেড়াতে এসেছি।

উত্তরটা বোধহয় আশা করেনি লোকটি হেসে বলল, এখানে কাউকে বেড়াতে আসতে দেখিনি কখনো। আমার নাম জুলিয়েন, এখানকার লেভার ইউনিয়নের সঙ্গে আছি।আজ হরতাল হবার পর বাবুরা তাদের কোয়ার্টার ছেড়ে বাজারে চলে গেছেন আমাদের ভয়ে আর আপনারা এখানে বেড়াতে এসেছে-এটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপার।

অনিমেষ এবার কথা বলল, আপনারা ভয় দেখাচ্ছেন কেন? বাবুদের বিরুদ্ধে তো আপনাদের লড়াই নয়!

নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু হরতাল জেনেও কাজে গিয়ে ওঁরা ভয় পেয়ে গেছেন। আসলে সাহেবকে হাতে রাখতে চায় সবাই। মিডলক্লাস মেন্টালিটি। অথচ আমাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না ওঁদের আক্রমণ করার। আমরা এত হাজার শ্রমিক ইচ্ছে করলে-যাক, সাহেব আমাদের বেশির ভাগ দাবি মেনে নিয়েছেন-প্রথম পদক্ষেপে এটা বিরাট জয়। সেই জয়-উৎসব এতে আমরা আপনাদের ওখানে গিয়ে দেখলাম কোয়ার্টাস খালি। জুলিয়েন হাসল।

কথাটা মুনে ভীষণ ভালো লাগল অনিমেষের। হঠাৎ ও বলে ফেলল, আজ সুনীলদা থাকলে খুব খুশি হতেন।

হ্যাঁ। ওঁর কাছে আমি অনেক গল্প শুনতাম।.

অনিমেষ বরতেই জুলিয়েন ওর দুই হাত জড়িয়ে ধরল, সুনীলবাবু না এলে আমরা অন্ধকারে থাকতাম। আপনি যখন সুনীলবাবুর বন্ধু তখন আমাদেরও বন্ধু।

অনিমেষ অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। এই মানুষগুলোকে কী চট করে ওরা ভুল বুঝেছিল! ওর মনে হল একসঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করেও মানুষের সঙ্গে মানুষের চেনাশোনা হয় না।

হঠাৎ ওর চোখে পড়ল ছোটমা অশ্বথগাছের পাশ দিয়ে চা-বাগানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জুলিয়েনের হাত-ধরা অবস্থায় ও বলল, আমার বাবা ওখানে আছেন।

জুলিয়েন ছোটমার যাওয়াটা দেখছিল। একটু চুপ করে থেকে ও বলল, বুঝতে পেরেছি। চলুন আপনি আমার ঘরে বসবেন।

অনিমেষ বুঝতে পারল, বাবাকে লজ্জা দিতে চাইছে না জুলিয়েন। ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে হাঁটতে লাগল অনিমেষ।
 
খাওয়াদাওয়া সারতে বিকেল গড়িয়ে এল। ছোটমা মহীতোষকে নিয়ে আগেই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। অবশ্য মহীতোষ নাকি কুলিলাইনের সামনে দিয়ে পার ফিরতে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে সামান্য এগিয়ে ফ্যাক্টরির পাশ-ঘেঁষে ছোট সাঁকোটা পেরিয়ে সুরকি-বিছানো ধটা দিয়ে ওরা ঘুরে এসেছেন। সমস্ত চা-বাগানে আজ খুশির আমেজ লেগেছে, দিনদুপুরে হাড়িয়া খেয়ে নাচগান গুরু হয়ে গিয়েছে। ওদের জীবনে এরকম ঘটনা এর আগে ঘটেনি, স্বয়ং সাহেব বাংলোর বারান্দায় জুলিয়েন আর তিনজনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেক্ষণ আলোচনা করে ওদের দাবি মেনে নিয়েছেন। ওরা জীবনে কখনো গল্প শোনেনি যে বাররা ওদের ভয়ে কোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। এই আনন্দের প্রকাশ কিছু ছেলের মধ্যে বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তারা বাবুদের কোয়ার্টারের উপর ঢিল ছুড়েছে, গাছপালা ছিঁড়েছে, গাছপালা ছিঁড়েছে-ব্যস, এর বেশি এগোয়নি। জুলিয়েন সম্পর্কে পুরনোপন্থি মানুষদের মনে, যে-সন্দেহের মেঘ ছিল তা রাতারাতি কেটে গিয়ে সে এখন নায়ক হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ জুলিয়েনদের ঘরে বসে সেটা বেশ টের পাচ্ছিল।

জুলিয়েনের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগল অনিমেষের। সরিৎশেখরকে স্পষ্ট মনে আছে ওর। ওর বাবা বকু সর্দারের দিনগুলো থেকে এতদিন স্বৰ্গছেঁড়া খুব-একটা পালটে যায়নি। কালো কালো মানুষগুলো হাঁড়িয়া খেয়ে নিজেদের মধ্যে যতই মারামারি করুক, সাহেব তো দূরের কথা, বাবুদের সামনে পড়লে কেঁচো হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর আগে ওদের একটা দাবি সাহেবদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল যে কুলিদের যেসব ছেলে কলেজে উঠবে, মিশনারিদের কাছ থেকে তবু আপত্তি উঠেছিল। জুলিয়েন আর একজন এই চা-বাগানে বাবুর গজ পেয়ে দেখল ওদের কোয়ার্টার অন্য বারদের সঙ্গে নয়-দূরে লাইন-ঘেঁষে তৈরি হল। আবার মজার ব্যাপার, অন্য যে লেবার-ছেলেটি বাবুর চাকরি পেল সে বড় কোয়ার্টারে যাবার পর অন্য লেবারের ভালোবাসা। এই সময় সুনীলদা না এলে এখানকার লেবারদের সংগঠিত করা যেতে না। এমনকি জুলিয়েন নিজেও খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল সে-সময়। পি এস পি বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার যে যোগযোগ ছিল তাতে ওদের সম্পর্কে ভালো ধারণা ও মনেমনে তৈরি করতে পারছিল নাউনীলদা ওকে একটা ছবি দিয়ে গেছে। ছবিটা দেখাল জুলিয়েন। এর আগে ছবি কখনো দেখেনি অনিমষে। দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ়ের ছবি। নিচে ইংরেজিতে নাম লেখা-কার্ল মার্কস। পেছনে সুনীলদার নিজের হাতে লেখা কয়েকটা লাইন-যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে, তার মুখে খবর পেলাম সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক। চট করে সুনীলদার মুখটা মনে গেল অনিমেষের, সেইসঙ্গে হুড়মুড় করে চলে এল ওকে শ্মশানে নিয়ে যাবার রাতটার কথা। জুলিয়েন বলল, সুনীলবাবুকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের জানি। বদলা নিতে পারতাম, কিন্তু তা তাদের বেশিদিন বাঁচতে দেওয়া হয় না। আবার মজার ব্যাপার হল, তারা নিহত হন বলেই সে-কাজটা দ্রুত হয়ে যায়। আ, এই মাকসও তো সাহেব ছিলেন-অথচ দেখুন।

ফিরে আসার সময় অনিমেষ চুপচাপ একা একা হেঁটে এল নদী পেরিয়ে। চারধারে যেন পরবের মেজাজ-মাদল বাজছে-ছেলেমেয়েরা গান গাইছে। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু এবং কার্স মার্কস-অনিমেষ যেন দুটো হাত দিয়ে এই তিনজনকে ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে হাটছিল। দেশ বড়, না। দেশের মানুষ বড়।

নদী পার হতেই ঝাড়িকাকুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওকে দেখেই গলা তুলে বকাঝকা করতে আরম্ভ করল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি-তোর বাবা কখন এসে গিয়েছে-বিকেল হয়ে গেল, খাওয়াদাওয়া করতে হবে না?

অনিমেষ হেসে ফেলল, খিদেবোধটা ওর একদম হয়নি আজ। সীতাদের বাড়িতে মিষ্টি খাওয়ার পর এতসব উত্তেজনাময় ঘটনা ঘটে গেল যে খাওয়ার কথা আর মনেই হয়নি। কিন্তু ঝাড়িকাকুর ব্যাপারস্যাপার অনেকটা দাদুর মতো, বিকেল হতে এখনও অনেক দেরি, তবু বলল বিকেল হয়ে গিয়েছে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ঝাড়িকাকু বলল, তোরা মিছিমিছি চলে গেলি, ওরা আনন্দ করতে এসেছিল। সীতাদের বাড়ি থেমে মিষ্টি খেয়ে গেল।

অনিমেষ বলল হুঁ। জুলিয়েন বলল।

জুলিয়েন? জুলিয়েনকে তুই চিনিস? ঝাড়িকাকু ওর মুখের দিকে তাকাল।

একটু আগে আলাপ হল। বেশ ভালো লোক।

ভালো লোক খিঁচিয়ে উঠল ঝাড়িকাকু, ওই তো সব নষ্টের গোড়া। এতদিন ধরে কুলিদের খেপিয়ে খেপিয়ে আজ এইসব করেছে। সবাই বলে ও নাকি কমনিষ্ঠ।

কী বলল? হেসে ফেলল অনিমেষ, কম নিষ্ঠ মানে জান?

ওই তো, যারা গরিব মানুষদের খ্যাপায়। নির্লিপ্ত গলায় ঝাড়িকাক জবাব দিল।

দূর। কম নিষ্ঠ মানে হল কোনো কাজে যার আন্তরিকতা নেই। আর তুমি যেটা বলতে চাইছ সেটা হল কমিউনিস্ট।
 
অনিমেষ বুঝয়ে বলতেই ঝাড়িকাকু কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা গান্ধীবাবা কি কমিউনিস্ট।

প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ হকচকিয়ে গেল প্রথমটা। ওর মনে হল, হ্যাঁ বলতে পারলে ওর ভালো লাগত। কিন্তু কোথায় যেন আটকে যায়। পরক্ষণেই ওর খেয়াল হল, ঝাড়িকাকু মহাত্মা গান্ধীর নাম জানে তা হলে। যে-মানুষটার নাম এইরকম নির্জন জায়গায় ঝাড়িকাকুর মতো নিরক্ষর মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে সে-মানুষ কংগ্রেসি কি কমিউনিস্ট-তাতে কিছু এসে-যায় না। কার্ল মার্কস সম্পর্কে ও তেমন-কিছু জানে না। সুনীলদার মুখে দুই-একবার নামটা শুনেছিল। দুনিয়ার সর্বহারাদের কথা যারা চিন্তা করেন তাদের গুরু হলেন কার্ল মার্কস। ছবিটা দেখে শ্রদ্ধা জাগে মনে। ওঁর সম্পর্কে আরও জানতে হবে-অনিমেষ মনেমনে স্থির করল। খাওয়াদাওয়া সারতে বিকেল হয়ে গেল। সকালবেলায় রান্নাবান্না হয়নি। কুলিরা চলে গেলে ঝাড়িকাকু বাড়ি ফিরে উনুন জ্বালিয়ে ভাত চাপিয়ে দিয়েছিল। ছোটমা সবকিছু অন্যদিনের মতো সেরে নিয়ে রান্না শেষ করলে অবেলায় ওদের খাওয়া হল। আঙ্গ অনিমেষ বাবার সঙ্গে বসে খেল। আজকের এই ব্যাপারটা মহীতোষকে বেশ নড়বড়ে করে দিয়েছে। তিনি যে অযথা ভয় পেয়েছিলেন এটা স্বীকার করতে এখন তিনি প্রস্তুত নন। সাহেব কুলিদের দাবি। মেনে নেবে এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। বরং গতকালও তিনি সাহেবকে ভীষণ একরোখা। দেখেছিলেন আর আজ সকালে কুলিদের মুখচোখ দেখে তিনি নিশ্চিত ছিলেন এরা একটা তুরকালাম কাণ্ড করতে পারে। কিন্তু কী ব্যাপার ঘটল যে সাহেব ওদের দাবি মেনে নিল, যাতে কুলিদের জয় হয়ে গেল! এটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। অন্য বাবুদের সঙ্গে কথা বললে অবশ্যই ব্যাপারটা জানা যেত। কিন্তু এরপর কী করে এই বাগানে থাকা যাবে? কুলিরা তো বেপরোয়া হয়ে যাবে। একবার অধিকারের স্বাদ পেলে কি আর তাদের তোয়াক্কা করবে? এতদিন, সেই ছেলেবেলা থেকে এখানে এই ছেঁড়ায়। এই সম্মানের সঙ্গে তিনি বসবাস করছেন-আজ মনে হচ্ছে তাতে ফাটল ধরে গেল। ওদের দাবি ছিল, বাস করবার মতো ভালো কোয়ার্টার্স, রেশনের পূর্ণ পরিমাণ দেওয়া। চাকরির নিরাপত্তা এবং কারও ব্যক্তিগত কাজে কোনো শ্রমিককে কাজে লাগানো চলবে না। সাহেব কী কী দাবি মেনে নিয়েছেন জানা। নেই-কিন্তু এর পরে ওরাই চোখে রাঙাবে। ওর মনে হল সরিৎশেখর যে-আরামে চাকরি করি গিয়েছেন, তার অনেক সময়ে কাঠোর হতে হয়, কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হবে না। দুপুর থেকেই তার মনে হচ্ছিল, যদিও এখনও অনেকদিন চাকরি বাগানে চাকরি পাওয়া অসম্ভব নয় কিন্তু সেখানেও এই স্বৰ্গহেঁড়ার হাওয়া যে লাগবে না তা কে বলতে পারে। সারাজীবনে নিজের সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি নয়, তারপর অনিমেষের পড়াশুনা আছে। যদি কলকাতায় ভালো ফল করে তা হলে ওদের ডাক্তারি পড়াবার বাসনা আছে। এই একটি প্রফেসনে এই দেশে কারও অর্থের অবাব হয় না। ডাক্তারি পড়বার খরচ অনেক, তিনি জানেন। তাই ও যতিদিন-না নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে ততদিন এইভাবে মুখ বুজে চাকরি করে যেতে হবে।

কেতে বসে তেমন কোনো কথা হয়নিইবকেলে খবরের কাগজটা দিয়ে গেলে মহীতোষ সিগারেট ধরিয়ে বাইরের ঘরের সোফায় বসেছিলেন কাগজ-হাতে। নিমেষ বেরুতে যাচ্ছিল, তিনি ওকে ডাকলেন। কলকাতায় যাবার ব্যাপারে বাবার সঙ্গে এখন অবধি কোনো কথাই হয়নি। মনের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি আছে-কোথায় গিয়ে উটবে, কীভাবে কলেজে গিয়ে ভরতি হবে-কত টাকা লাগবে। নিজের থেকে মহীতোষের সঙ্গে আলোচনা করতে ওর সঙ্কোচ হচ্ছিল। এখন তিনি ডাকতেই ও ঘু দাঁড়াল। মহীতোষ সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞাসা করলেন, কবে যাওয়া যেন ঠিক হল?

বাবার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, বুধবার।

টিকিট কাটা হয়েছে? মহীতোষ কাগজের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না।

অনিমেষের মনে হল এখন বাবার চেহারাটা যেন আমূল পালটে গেছে, দুপুরে কুলিদের। আক্রমণের সময়কার চেহারাটা যেন উধাও হয়ে গেছে। কুব গম্ভীর এবং চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে। ও বলল, না। হলদিবাড়ি থেকে ঞ কোচ আসে সেটায় উঠব।

আর-কেউ যাচ্ছে বন্ধুবান্ধব?

কয়েকজন যাবে কলকাতায় পড়তে, তবে একসঙ্গে যাকে কি না জানি না।

যেতে পারবে তো একা?

হুঁ।

আমি সঙ্গে গেলে ভালো হত, তা নিজেই যাও। কেউ দেখিয়ে দিয়ে শেখার চেয়ে নিজে ঠেকে শিখলে লাভ হয় বেশি। আমার এক বন্ধু আছে, বউবাজারের কাছে থাকে, তাকে লিখেছি তোমার কথা। সে সাহায্য করবে। তা ছাড়া তোমার ছোটকাকা এছ কলকাতায়। সে ব্যস্ত লোক-সময় পাবে কি না জানি না। আমাকে হঠাৎ চিটি দিয়েছে তমি পড়তে কলকাতায় গেলে যেন ওকে জানানো হয়। বুধবার রওনা হভে-উ, তা হলে এখনই টেলিগ্রাম করে দিতে হয় দেব্রতকে। কোন কলেজে অতি হবে?

জানি না। প্রেসিডেন্সি কলেজে–

হ্যাঁ, প্রথমে ওখানেই চেষ্টা করবে দেবব্রত, না হলে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়বে। সায়েন্স নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভরতি হবে, এটাই আমার ইচ্ছা।

সায়েন্স! অনিমেষ ঠোঁটটা কামড়াল, আমার ইচ্ছা আর্টস নিয়ে পড়ব। দাদুও চান ইংরেজিতে আমি যেন এম এ পাশ করি।
 
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে হাতের কাগজটা নামিয়ে রাখলেন মহীতোষ, না না, আর্টস নিয়ে পড়লে সারাজীবন কষ্ট করতে হবে। এখন সায়েন্স ছাড়া কদর নেই, তোমাকে ডাক্তারি পড়তে হবে।

অনিমেষ যেন চোখে আতঙ্ক দেখল, কিন্তু আমার ফে আর্টস ভালো লাগে!

হাত নেড়ে যেন মহীতোষ কথাটা উড়িয়ে দিলেন, শখের ভালো লাগা আর বেঁচে থাকা এক কথা নয়। আর্টস পড়ে এম এ পাশ করে তুমি কী করবে? স্কুল-কলেজে মাস্টারি? কত টাকা পাবে মাইনে? সারাজীবন কষ্ট পাবে, মনে রেখো। তা ছাড়া আমার আর চাকরি করতে ভালো লাগ না। যদ্দিন-না তুমি দাঁড়াচ্ছ ততদিন আমাকে করতে হবে। তাই ডাক্তারি পাশ করলে তোমার টাকার অভাব হবে না।

অনিমেষ কোনরকমে ঢোক গিলে বলল, আমার অঙ্কএকদম ভালো লাগে না।

মহীতোষ বললেন, চেষ্টা করলে সবকিছু সম্ভব। এই যে আমি, আমার কখনো ইচ্ছে ছিল না এই চা-বাগানের চাকরি করি। কিন্তু তোমার দাদুর পক্ষে আমাকে আর পড়ানো সম্ভব ছিল না তখন, আর আমাকে বাধ্য হয়ে এই চাকরি নিতে হল। তা চেষ্টা করে আমি তো অনেক বছর কাটিয়ে দিলাম। সেদিক দিয়ে তুমি ভাগ্যবান।

অনিমষ বলল, যদি ভালো রেজাল্ট না হয়।

এবার মহীতোষ বড় বড় চোখে ছেলের দিকে তাকালেন, তা হলে বুঝব তুমি পড়াশুনায় যত্ন নাওনি। শোনো, তোমার মার ভীষণ সাধ ছিল তোমাকেডাক্তার করাব।

এই ধরনের একটা বোঝা ও ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনিমেষ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। এ-ব্যাপারে যেন ওর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না! বাবা এবং দাদু যা বলবেন তা-ই ওকে মেনে নিতে হেব! আর ওদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেই অমোঘ অস্ত্রের মতো মায়ের নাম করে একটা বক্তব্য চাপিয়ে দেওয়া হবে। যেন মা যা বলে গেছেন, ও তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। অনিমেষের সন্দেহ, মা সত্যিই এইসব বলে গিয়েছেন কি না। ওর স্থির বিশ্বাস, মা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তা হলে নিশ্চয়ই সে তাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারত। ও এখন কী করবে? যদি সে বাবাকে মুখের ওপর বলে দেয় যে সায়েন্স নিয়ে পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তা হলে কি বাবা তার কলকাতায় যাওয়া বন্ধ করে দেবেন? কী জানি! সংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ও ঠিক করল, এব্যাপারে দাদুর ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাবা নিশ্চয়ই দাদুর মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারবেন না। অতএব এখন চুপ করে থাকাই শলো।

মহীতোষ খবরের কাগজটা আবার তুলে নিলেন, যেন-ব্যাপারে যা বলার তা বলা হয়ে গেছে, আমি খোঁজ নিয়ে তোমাকে মাসে একশো কুড়ি টাকা পাঠালেই ভালোভালো চলে অনিমেষ যাবে। দশ-বারো টাকার বেশি হাতখরচ লাগা উচিত নয়। আর বাজে ছেলেদের সঙ্গে একদম মিশবে না। কলকাতা হল এমন একটা জায়গা যেখানে একটু আলগা হলেই নষ্ট হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। কলেজ ছাড়া হোস্টেলের বাইরে কোথাও যাবে না, আর কখনোই ইউনিয়ন বা পলিটিক্যাল পাটির সংস্রবে যাবে না। রাজনীতি একটি ছাত্রের জীবন যেভাবে বিষিয়ে দেয় অন্যকিছু সেভাবে পারে না। যাহোক, আমি চাই তুমি মাথা উঁচু করে আমার সামনে ডাক্তার হয়ে এসে দাঁড়াও।



এখন প্রায় সন্ধে। আসাম রোডের গাছগুলোয় হাজার পাখির চিৎকার যেন রবিবারের হাটের চেহারা নিয়েছে। মাঝে-মাঝে এক-একটা গাড়ি শহুশ করে ছুটে যাচ্ছে। অনিমেষ শেষ সূর্যের রোদের আভা-মাখা কোয়ার্টারগুলোর দিকে তাকাল। এই ছবির মতো বাড়িগুলো ওপর বুকের ভেতরে সেই ছেলেবেলা থেকে একই রকম জায়গায় আছে, শুধ সীতাদের বাড়িটা ছাড়া। ওই ত্রিপল, দুটো কলাগাছ–দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল অনিমেষ। এই নির্জন রাস্তায় অজস্র পাখির গলা শুনতে শুনতে ও হাঁটছিল। ওর সমস্ত শরীর এখন কেমন ভারী লাগছে। বাজারের সীমা আসার আগেই ও থমকে দাঁড়াল, ওর বুকের মধ্যে চিরকালের চেনা এই স্বৰ্গছেঁড়া তিল তিল করে যে-মোচড় দিচ্ছে সেটা অনুভব করতে করতে এগিয়ে-আসা মানুষটার দিকে তাকান। এই এত বছর পরেও ও রেতিয়াকে একই রকম দেখল। সেই ময়লা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, একটা নোংরা ফুলহাতা শার্ট, চুলগুলো রুক্ষ, পা দিয়ে রাস্তা মেপে এগিয়ে আসছে। ওর বসন্তের ছাপ-মারা মুখটায় সেইরকম ভীরুতা এখনও লেগে আছে।
 
মুখোমুখি হতেই অনিমেষ রেতিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পায়ের শব্দ যত মৃদুই হোক-না কেন, রেতিয়া হঠাৎ কুঁকড়ে গেল, তারপর ওর অন্ধ চোখ দুটো চট করে বন্ধ করে কান খাড়া করে শব্দ চিনতে চাইল। অনিমেষের সেই খেলাটা মনে পড়ল। ও-এবার গলাটা ভারী করে জিজ্ঞাসা করল, কাহা যাহাতিস রে?

সেইভাবে দাঁড়িয়ে রেতিয়া জবাব দিল, ঘর।

মেরা নাম বোল।

প্রশ্নটা শুনেই বেতিয়ার মুখটা.আকাশের দিকে উঠে গেল। সেই বসন্তে-খোঁড়া মুখটা সহসা ছুঁচলো হয়ে গিয়ে দুটো চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। অনিমেষ বুঝতে পারল ও প্রাণপণে গলায় স্বরটা মনে করতে চেষ্টা করছে। কত বছর দেখা হয়নি অনিমেষে সঙ্গে, তা ছাড়া গলা পালটে সে কথা বলেছে, কিন্তু এখন অনিমেষ একাগ্র হয়ে প্রার্থনা করছিল যেন রেতিয়া ওকে চিনতে পারে। আর সেই মুহূর্তে রেতিয়া ওর লাল-ছোপ-ধরা দাঁত বের করে একগাল হাসল। যেন ওর ধাধাটা মিটে গেছে এমন ভঙ্গিতে ও হাত বাড়িয়ে দিল, অনি!

নিজের নামটা রেতিমার গলায় শুনে অদ্ভুত সুখে অনিমেষের সমস্ত শরীরে একটা কাঁপুনি এসে গেল। ও চট করে রেতিয়ার বাড়ানো হাত দুটো ধরতেই বুকের গভীরে দ্রুত-হয়ে-ওঠা মোড়টা ঝরঝর করে দুচোখ থেকে কান্না হয়ে ঝরে পড়ল। ও কোনো কথা বলতে পারছিল না। নেতিয়া যেন এরকমটা আশা করেনি, ও অনিমেষের হাত ধরেই জিজ্ঞাসা করল, অনি।

এবার হাতটা ছাড়িয়ে নিল অনিমেষ, তারপর দ্রুত চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, হ্যাঁ।

ক্যা হুয়া তুমহারা? রোতা হ্যায় কাহে।

কেন কান্না এল? রেতিয়ার এই প্রশ্নটার জবাব ও সত্যিই চট করে নিজেই খুঁজে পেল না। এই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে এই বোধটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র বুক চেপে ধরেছিল। তারপর সীতাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কী যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেতিয়ার মুখে নিজের নামটা শুনতে পেয়েই ওর মধ্যে চট করে কান্নাটা এসে গেল। অনিমেষ বলল, এইসেই। বেতিয়া হাম কলকাতামে যায়েগা।

বেতিয়া যেন চিন্তিত হল, উতো বহু দূর-জলপাই সে ভি-না?

অনিমেষ একথার জবাব দিল না। সে জলপাইগুড়িতে থাকুক কিংবা কলকাতায়-স্বৰ্গছেঁড়ার সঙ্গে যে-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তা কোনোদিন কমবে না। শুধু এই রেতিয়ার মতো কেউ যখন এত বছর পরও তার গলা মনে রেখে নাম ধরে ডেকে ওঠে, তখন মনটা কেমন হয়ে যায়।

বাজারের দিকে যাবার ইচ্ছে ছিল ওর। কাল হয়তো-দুপুরের আগেই ওকে চলে যেতে হবে। তাই আজ স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার-এলাকায় ঘুরে আসার ইচ্ছা ছিল ওর। বিশু কিংবা বাপীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে নিশ্চয়ই ভালো লাগত। কিন্তু এই সন্ধে-হয়ে-যাওয়া সময়টা.ওর মনে রেতিয়ার সঙ্গে হেঁটে ওকে লাইনে পৌঁছে দিলেই বোধহয় ভালো লাগবে। এখন আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ওর একটুও ইচ্ছে করছিল না। হঠাৎ ওর মনে হল, স্বৰ্গছেঁড়ার গাপালা মাটি মাঠ আংরাভা নদীর মতো রেতিয়া যেন প্রকৃতির একটা অদ। ও রেতিমার হাত ধরে রাখার পাশ ধরে হাঁটতে লাগল। কমশ অন্ধকার সমস্ত চরাচর ছেয়ে যেতে লাগল। মাথার ওপর পাখিরা এখন গাছে-গাছে জায়গা পেয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুম ক্যায়সা হ্যায় রেতিয়া?

রেতিয়া সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল কিছুটা, তারপর বলল, আজ হাম কুছ নেহি খায়-হামকো কই খানে নেহি দিয়া।

সে কী, কেন? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ।

বেচারা রেতিয়া অন্ধ বলে কাজ করতে পারে না এবং ওর বাপ মা দাদার কাছে থাকে। তা হলে তারা ওকে খেতে দেয়নি কেন? বিমর্ষমুখে রেতিয়া বলল, আজ সুবেরে সব হরতাল পরব কিয়া। কই, ঘমে নেহি হ্যায়। সামনে সব হাড়িয়া পিকে বেহুঁশ হো গিয়া।

বাজারে গিয়ে চা খাসনি?

কেন দেয়নি জিজ্ঞাসা করল না অনিমেষ, শুধু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশকিছু খুচরো পয়সা বের করে না শুনে রেতিয়ার হতের মুঠোয় গুঁজে দিল। রেতিয়া চমকে গিয়ে হাতটা ওপরে তুলতেই পয়াসগুলো আঙুলের ফাঁক গলে টুংটাং করে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল। যাঃ, গির গিয়া পয়সা। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে রেতিয়া মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে হাতড়ে পয়সা খুঁজতে লাগল। এখন এখানে ঘন অন্ধকার। সাদাচোখে কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে ছুটে-যাওয়া এক-টকেটা গাড়ি অন্ধকারকে ছুড়ে ফেলে মুহূর্তের জন্য চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। এইরকম একঝলক আলোয় অনিমেষ দেখল অনেক দূরে রেতিয়ার নাগালের বাইরে একটা এক আনা পড়ে আছে। ও চট করে এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলতেই জায়গাটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। তীব্র আলোর পর অন্ধকার আরও গাঢ়তর হয়। ছড়িয়ে-থাকা পয়সাগুলো খুঁজতে ওকে এখন হাতড়াতে হচ্ছে। অনিমেষ আবিষ্কার করল, ওর সঙ্গে রেতিয়ার এই মুহূর্তে কোনো পার্থক্য নেই-দুজনেই এই মুহূর্তে অন্ধ।
 
ছোটমা বোধহয় আগে থেকেই বিছানাপত্র ঠিক করে রেখেছিলেন। মহীতোষের একটা পুরনো হোন্ডল ছিল, সেটাই পরিস্কার করে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। ঝাড়িকাকু সেটাকে মাথায় নিয়ে ওর সঙ্গে চলল। সকালে মহীতোষ তাঁর বন্ধু দেব্রতবাবুর ঠিকানা-লেখা একটা চিঠি দিয়ে দিয়েছেন অনিমেষকে। টেগ্রিাম করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তিনি অবশ্যই স্টেশনে আসেন। প্রিয়তোষকে তিনি পরে জানাবেন, যদি ভরতি হতে অসুবিধে হয় তবেই যেন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মহীতোষ ভাই-এর সাহায্য নেওয়া ঠিক পছন্দ করছেন না।

টাকাপয়সা যত্ন করে ওর সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হল। ছোটমা বারবার করে এ-ব্যাপারে সজাগ হতে বললেন ওকে। যাবার সময় যখন অনিমেষ ওদের প্রণাম করল, তখন, মহীতোষ অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, যখন যা দরকার হবে আমাকে জানিও, সঙ্কোচ করবে না।

কুচবিহার থেকে আসা বাসে জিনিসপত্র তুলে ও যখন উঠতে যাচ্ছে হঠাৎই ঝাড়িকাকু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল অনিমেষ, কিন্তু কান্না বড় ছোঁয়াচে রোগ। তবু সে কোনোরকমে ঝাড়িকাকুকে বলল, এই, তুমি কাঁদছ কেন?

সমস্ত বাসের লোক অবাক হয়ে দেখল, ঝাড়িকাকু কান্না গিলতে গিলতে বলল, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না রে, তোকে আর আমি দেখতে পাব না-তুই ফিরে এসে দেখবি আমি নেই, মরে গেছি।

দাঁড়াতে পারল না অনিমেষ, ঠোঁট কামড়ে দ্রুত বাসে উঠে পড়ল। বাসসুদ্ধ লোক এখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝাড়িকাকু সরে রাস্তার পাশে যেতেই বাসটা ছেড়ে দিল। দুহাতে নিজের গাল চেপে সেই বেঁটেখাটো প্রৌঢ় মানুষটাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল সে। হঠাৎ ওর সমস্ত শরীরে টা দিয়ে উঠল, সত্যি যদি তার ঝড়িকাকুকে না দেখতে পায়? চোখ বন্ধ করে ফেলল অনিমেষ।

হুহু করে বাসটা ছুটে যাচ্ছে। সেই ইউক্যালিপটাস গাছগুলো-ওদের কোয়ার্টারগুলো, স্বৰ্গছেঁড়ালেখা বাগানের বিরাট বোটা সে দৌড়ে দৌড়ে পেছনে চলে যেতে লাগল। ওদের বাড়ির বারান্দায় কি ছোট দাঁড়িয়েছিলেন? ঠিক বুঝতে পারল না অনিমেষ। সবুজ গালচের মতো চা-বাগানটা যেন ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। দূরের ফ্যাক্টরি-বাড়িটার ছাদ চোখে পড়ল। মহীতোষ বোধহয় এতক্ষণে সেখানে ফিরে গিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। হঠাৎ এই মুহূর্তে অনিমেষের বাবার জন্য কষ্ট বোধ হল। ওর। মনে হল ও যেন বাবাকে ঠিক বুঝতে পারিনি। কেমন একা একা হয়ে আছেন উনি, সেখানে অনিমেষ কেন, ছোটমাও কোনোদিন পৌঁছাতে পারেনি।

মুঠো বন্ধ করার মতো একসময় স্বৰ্গছেঁড়া হারিয়ে গেল। আংরাভাসার পুল পেরিয়ে যেতেই অনিমেষ পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে দিল। ওকে এখন অনেক দূর যেতে হবে, অনেক দূর। পেছনে স্বর্গছেঁড়া চুপচাপ পড়ে থাক। সেই ছোট্টবেলার নদীটা এবং তার রঙিন মাছগুলো, সেই কুয়াশার অথবা কাঁঠাল গাছের অন্ধকারগুলো–তারা এখানে ঘোরাফেরা করুক। নতুন দিদিমণি নেই, ভবানী মাস্টার যেখানে গিয়েছেন সেখানে কি এই স্বৰ্গছেঁড়ার মতো শান্তি আছে? জানা নেই, কিন্তু সেই ঘামের গন্ধমাখা স্নেহের স্পর্শটুকু তিনি নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে পারেননি। স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার দিনদিন পালটে যাচ্ছে-জলপাইগুড়ি শহরটা যেন ক্রমশ স্বৰ্গছেঁড়াকে গ্রাস করে নিচ্ছে-নিক, এখন তার কিছুই এসে, যায় না। তবু কেন যে রেতিয়ারা এখনও বোকার মতো পায়ে মেপে এক কাপ চায়ের জন্য অতটা পথ হেঁটে যায় আর অনেক বছর পরও তার গলা শুনে চট করে চিনে ফেলে! হয়তো একদিন আর পারবে না। অনিমেষের খেয়াল হল এই পথ দিয়েই সীতা মাথায় মুকুট পরে দুটো চোখ-চেয়ে দেখতে-দেখতে চলে গেছে।
 
স্বৰ্গছেঁড়ার খবর শুনে সরিৎশেখর চিন্তিত হলেন। বকু সর্দারের ছেলে মাংরা, যে নাকি জুলিয়েন নাম নিয়েছে, সে-ই কুলিদের খেপিয়ে তুলেছে এরকম একটা চিত্র তিনি যেন স্পষ্ট দেখলেন। এরকম কিছু হবে তা তিনি অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন, যখন বাগানের কুলিরা তাদের সন্তানদের বাবু-চাকরিতে ঢোকাবার জন্য আবদার শুরু করেছিল। সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হুমকিতে পরিণত হবে এরকমটা অবশ্য ভাবেনি। এরপর মহীতোষের পক্ষে সেখানে কতদিন নিশ্চিন্তে চাকরি করা সম্ভব হবে। চা-বাগানের চাকরি ছাড়া ওর তো অন্য কোনো বিদ্যে জানা নেই যে বাইরের চাকরি পাবে! ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন সরিৎশেখর। অনিমেষ অবশ্য দাদুর এই দুশ্চিন্তার কারণ ঠিক বুঝতে পারছিল না। ও অনেকক্ষণ দাদুর সঙ্গে তর্ক করে গেল। কুলিরা তো কোনো অন্যায় করেনি। তারা যে-ঘরে থাকে সে-ঘর ওদের গোয়ালের চেয়ে ভালো নয়। যেরেশন ওরা চাইছে তা তো বাঁচার জন্য যে-কোনো মানুষ আশা করতে পারে। আর কেউ যদি শিক্ষিত হয়, তা হলে ভালো চাকরি আশা করতে পারে না? ওরাও তো ভারতের নাগরিক। সরিৎশখর অবশ্য সরাসরি এর জবাব দিলেন না। শুধু বললেন, যে-কোনো সৃষ্টির সময় একদল কয়েকজনের প্রতি নিীয় এবং অনুগত যদি না হয়, তা হলে সৃষ্টি সুসম্পন্ন হতে পারে না। যখনই অধিকারে সবাই সমান শক্তি অর্জন করে, তখনই অসম্মান আসে আর। আসল কৰ্ম লক্ষ্যচ্যুত হয়, বিশেষ করে আমাদের এই দেশের মানুষ যেহেতু নিরক্ষর তাই অধিকার তাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। দাদুর কথা পুরোপুরি মানতে পারল না অনিমেষ। সরিৎশেখর প্রসঙ্গটা শেষ করলেন, এখন তোমার বয়স কম। অভিজ্ঞতা হোক, চোখ চেয়ে জীবনটা দ্যাখো, নিজেই বুঝতে পারবে।

পিতাপুত্রের মধ্যে সন্তোষজনক কথাবার্তা হয়েছে শুনে সরিৎশেখর খুশি হলেন। ঠিক এইরকমটাই চাইছিলেন তিনি। পিতামার আশীর্বাদ ছাড়া কোনো সন্তান বড় হতে পারে না, এই কথাটা তিনি বারবার করে বলতে লাগলেন, তোমার মায়ের কাছ থেকে যখন তোমায় আমি চেনে এনেছিলুম তখন তুমি এই একটুখানি ছিলে। সেই থেকে তোমাকে বুকে আগলে এত বড় করেছি। এখন তুমি ভালোভাবে পাশ করেছ, কলকাতায় পড়তে যাচ্ছ, আমার দায়িত্ব শেষ। আমি তো কেয়ারটেকার হয়ে ছিলাম, কাজে ফাঁকি দিইনি কখনো।

কোত্থেকে দুধ যোগাড় হল কে জানে, পিসিমা পায়েসের ব্যাপারে বিকেল থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জয়াদি নেই। এখন যে কী হয়েছে, জয়াদি প্রায়ই বাপের বাড়ি যাচ্ছেন। জয়াদির বর একা-একাই থাকেন। সুনীলদা মারা যাবার পর সেই যে তার বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, আরকোনো নতুন ভাড়াটে আসেনি। শোনা যাচ্ছে সরকার এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো তাতে দাদুর ভালোই হবে, কারন দাদু প্রায়ই অভিযোগ করতেন যে সরকার তাকে কম ভাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আবার নতুন ভাড়াটের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং ভাড়া ঠিক করা এবং তাতে যে-সময় যাবে সেটা ম্যানেজ করা-দাদুকে সাহায্য করার কোনো লোক যে এখানে নেই। দাদুর দিকে তাকালেই আজকাল বোঝ। যায় যে বয়স তাকে চারপাশ তেকে কামড়ে ধরেছে। ভীষণ কষ্ট হল অনিমেষের দাদুর জন্য।
 
বিকেল থেকেই জলপাইগুড়ি শহরে মিছিল বের হল। আগামীকাল সারা বাংলা জুড়ে যে হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে, তা সফল করার জন্য আবেদন জানিয়ে মিছিলগুলো শহরের পথেপথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। টাউন ক্লাবের সামনে ছোটখাটো মিটিং হয়ে গেল। অনিমেষ বিকেলবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছিল। অর্ক এবং মণ্টু কলকাতায় গড়তে যাবে। ওরা যদি কাল ওর সঙ্গে যায় তো খুব ভালো হয়। দাদুর আর তর সইল না, এ-সপ্তাহে নাকি আর ভালো দিন নেই। এখন এসব ব্যাপার আর কেউ মানে? কিন্তু দাদু এমন বিশ্বাস নিয়ে বললেন যে মুখের ওপর প্রতিবাদ তে ইচ্ছে করে না।

রায়কতপাড়ায় মণ্টুদের বাড়ি। সেদিকে যাবার জন্য বেরিয়ে ও দেখল টাউন ক্লাবের সামনে বেশ জোরে বক্তৃতা চলছে। কৌতূহলী হয়ে সে রাস্তার একপাশে দাঁড়াল। যিনি বক্তৃতা করছেন, তাঁকে আর আগে দেখেনি সে, মাথায় টাক, খুব হাত নেড়ে কথা বলছেন, আপনারা জানেন এই দেশের স্বাধীনতা এল কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ যেখানে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। স্বাধীনতা কি কংগ্রেসের ব্যক্তিগত সম্পত্তি যে তা নিয়ে তারা যা ইচ্ছে করবে? যখন সাধারণ মানুষের মুখে ভাত নেই, পরনে। বস্ত্র নেই, যে-দেশের মানুষের গড় দৈনিক আয় মাত্র দুআনা সে-দেশের মন্ত্রীরা কোটিপতি হচ্ছেন, তাঁদের ছেলেরা বিদেশে পড়তে যাচ্ছে। কী করে সম্ভব হচ্ছে? কারণ এই দেশ চালাচ্ছে ওই কংগ্রেসিরা নয়, তাদের প্রভু হয়ে মাত্র চার-পাঁচটা ফ্যামিলি। তাদের তুষ্ট করে তাদের টাকার পাহাড় আরও বাড়াতে কংগ্রেসিরা আমাদের শরীর থেকে রক্ত শুষে নিচ্ছে, বিনিময়ে তারাও ছিটেফোঁটা পাচ্ছে। কংগ্রেসিরা জানে ওই চার-পাঁচটি পরিবার যদি বিরূপ হয়, তা হলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে আর তাদের স্থান হবে ডাস্টবিনে। তাই ওঁদের ঘাটানোর সাঙ্গ কংগ্রেসিদের নেই। আমরা নানা সময় এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করে এসেছি। কিন্তু দেশের মানুষকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই সোনার দেশের মানুষ আজ রিক্ত নিঃস্ব, তাদের পেটে ভাত নেই। আমাদের আগামীকালের হরতাল সেই প্রতিবাদের প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের স্পস্ট দাবি, খাবার দাও, বস্ত্র দাও, বাঁচার মতো বাঁচতে দাও। বলুন আপনারা আমার সঙ্গে, খাবার দাও, বস্ত্র দাও!

বক্তা পরবর্তী পাদপূরণের জন্য নীরব হলে দেখা গেল মুষ্টিমেয় কণ্ঠে মাত্র আওয়াজ উঠল। কিন্তু এই ত্রুটিটা যেন ওরা এড়িয়ে যেতে চাইল, এমন ভঙ্গিতে পরবর্তী বক্তা তার বক্তৃতা শুরু করলেন। মোটামুটি একই কথা হাত নেড়ে প্রচণ্ড চিৎকারে তিনি যখন বলছিলেন, তখন পথচলতি জনতা বেশ মজা পাচ্ছিল। এইরকম সিরিয়স ব্যাপারকে হাস্যকর করে তোলার জন্য ভদ্রলোক নির্ঘাত দায়ী। অনিমেষও দাঁড়াল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top