What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

খবরটা সবাই শুনে থ হয়ে গেল। স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ব্যাপার। এর আগে এফ ডি আই থেকে একজন নিচের দিকে স্ট্যান্ড করতেই শহরের হইচই পড়ে গিয়েছিল। কে সেই ছেলে? অরূপ? টেস্টে ওর রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো ছিল। এই সময় হেডমাস্টারমশাই গলা তুলে ডাকলেন, অর্ক-অর্ক আছ এখানে?

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা পেছনে দাঁড়ানো অর্ককে জড়িয়ে ধরল হইচই করে। হেডমাস্টারমশাই দেখলেন এই মুহূর্তে ওকে আলাদা করা অসম্ভব। তিনি একজনকে বলে গেলেন, অর্ক যেন যাবার সময় দেখা করে যায়।

ভূগোল-সার ততক্ষণে নোটিসবোর্ডে কাগজটা টাঙিয়ে দিয়েছেন। সবাই সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে একমাত্র অর্ক ছাড়া। সবাই একসঙ্গে নিজের রেজাল্ট দেখতে চায়। অনিমেষ কিছুতেই ভিড় ঠেলে এগাতে পারছিল না। ও দেখল অর্ক দূরে দাঁড়িয়ে মেজাজে নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাজ্জব হয়ে গেল অনিমেষ, এই মুহূর্তে কেউ সিগারেট খেতে পারে! ভিড়টার দিকে তাকাল সে–যদি থার্ড ডিভিশন হয়ে যায়-আর-এ হয়নি বোঝা যাচ্ছে, হলে হেডমাস্টারমশাই নিশ্চয় বলতেন। আর পারল না অনিমেষ অপেক্ষা করতে, ভিড়ের একটা দিক সামান্য ফাঁক হতেই সে ঢুকে পড়ল সেইখান দিয়ে। তারপর ঠেলেঠলে একেবারে নোটিসবোর্ডের। ছয় ইঞ্চির মধ্যে ওর চোখ চলে এল। প্রথমে সার-ওদওয়া পিঁপড়ের মতো নামগুলো চোখে ভাসল। সহ্য হয়ে এলে ও প্রথম থেকে নামগুলো পড়তে লাগল। অরূপ ফার্স্ট ডিভিশন-একটা দাড়ি, অর্ক একটা দাড়ি, তারপর দুটো দাঁড়ি-দুটো-দুটো-একটা-দুটো-নিজের নাম চোখে আসতেই দৃষ্টিটা পিছনে ডানদিকে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে ওপরে তুলে ধরে চিৎকার করে উঠল। নোটিসবোর্ডের ওপরে মাথা উঠে যাওয়ায় নিজের নামের পাশে এক দাড়িকে বিরাট লম্বা দেখল সে।

সমস্ত শরীরে লক্ষ কদমফুলের নন-তপনের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সময় নিল অনিমেষ। তপন সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে। এবং মণ্টু ফার্স্ট ডিভিশন। বারোজন ফাস্ট ডিভিশন, আঠারোজন সেকেন্ড, বাকিরা থার্ড ভিশিন। মন্ট এগিয়ে এসে সাহেবি কায়দায় গম্ভীরমুখে ওর সঙ্গে যাডশেক করল। তপনের কোনো আপসোস নেই-ও জানত দ্বিতীয় ডিভিশনই ওর বরাদ্দ। ওরা বেশ দৃঢ়পায়ে বাইরে হেঁটে এসে অর্ককে খুঁজল-না, অর্ক কোথাও নেই। হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরেও যায়নি।

তপন বলল, আমরা এখন কলেজ স্টুডেন্ট-আঃ, ফাইন!

মণ্টু বলল, মাইরি, শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে গেলাম। ভাবাই যায় না! শালা আজ যদি রম্ভারা এখানে থাকত তো ট্যারা হয়ে যেত।

অনিমেষ কিছু বলল না। স্কুল থেকে বের হবার আগে সে একবার নিশীথাবু সঙ্গে দেখা করে যাবে কি না ভাবল। কিন্তু মণ্টুরা বেরিয়ে যাচ্ছে-এবং সঙ্গে সঙ্গে কুষ্ঠরোগীদের ডেরাটার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ও শক্ত হয়ে গেল।

বাইরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। একটুও তোয়াক্কা না করে ওরা রাস্তায় নেমে পড়ল। মণ্টু বলল, চল গার্লস স্কুলটা দেখে আসি-ওখানে ফেলু মেয়েরা আজ হেভি কাঁদবে।

এখন এই বৃষ্টিতে হাঁটতে অনিমেষের ভীষন ভালো লাগছিল। ও একবার ভাবল, দাদুকে একছুটে বলে আসে খবরটা, কিন্তু বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা চেপে গেল। আজ বাংলাদেশে ও একাই শুধু স্কুল ফাইনাশ পাম করেনি। বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে ওরা শহরটাকে ভিজতে দেখল। শহরের লোকরাও বিভিন্ন ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে তিনটি কাকভিজে তরুণের ব্যাপার দেখে অবাক হল। গার্লস স্কুলের দিকে যেতে-যেতে তপন হঠাৎ গান ধরল, এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা হাতে হাতে ধর গো/আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন-স্বর্গ।

ও এক লাইন গাইছে, অনিমেষ আর মণ্টু পরের লাইনটা আবৃত্তি করছে। এই বৃষ্টির জল গায়ে মুখে মেখে গান গাইতে গাইতে ওরা ঝোলানো পুলের ওপর এসে দাঁড়াল। অনিমেষদের সুরের ঠিক নেই, কিন্তু একটা খুশির জোয়ার বুরকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। এক ভদ্রলোক ছাতি-মাখায় আসছিলেন, মন্টর চেনা-হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী, রেজাল্ট বেরিয়েছে। পাশ করেছ মনে হচ্ছে? গাইতে গাইতে ঘাড় নাড়ল মণ্টু, মুখে জবাব দিল না।


গার্লস স্কুলের কাছে এসে গানট থেমে গেল। আর তখনই ওরা একটা মেয়েকে দেখতে পেল। বৃষ্টির মধ্যে একা একা হেঁটে যাচ্ছে। ওরা দেখল মেয়েটার মুখ কান্নায় মুচড়ে গেছে। সামলাতে পারছে না বেচারা। ওদের তিনজনেরই মন-খারাপ হয়ে গেল আচমকা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখতে-দেখতে মণ্টু বলল, চল বাড়ি যাই। যেন এই কথাটার জন্যই ওরা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। তিনজনেই তিনদিকে কোনো কথা না বলে দৌড়তে লাগল।

বাড়ির গেটে হাত দিতেই অনিমেষ দেখল পিসিমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায় যেন সে চলে যাওয়ার পর থেকে একচুরও নড়েননি। দাদুকে দেখতে পেল না সে। পিসিমা ওকে দেখেছেন, তার চোখ দুটো অনিমেষের মুখের ওপর। পায়েপায়ে কাছে এগিয়ে গেল অনিমেষ। হেমলতা ভাইপোর। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। অনিমেষ ইচ্ছে করে চুপ করে ছিল। ওর বেশ মজা লাগছিল পিসিমার অবস্থা দেখে। কী বলবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে হেমলতাকে প্রণাম করল, আমি পাশ করেছি, ফার্স্ট ডিভিশন হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলেন হেমলতা। অনিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন, আতিশয্যে চিৎকারটা কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। অনিমেষ দেখল পিসমার মুখ ওর বুকের ওপর-ও অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে। কান্না-মেশানো গলায় হেমলতা তখন বলছিলেন, অনিবাবা, তুই পাশ করেছিস-ও। মাধু দ্যাখ-তোর অনি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে-মাধু চোখ-ভরে দ্যাখ।

মায়ের নাম শুনে থরথর করে কাঁপতে লাগল অনিমেষ। এই সময় জুতোর শব্দ তুলে সরিৎশেখর দরজায় এসে পঁাড়ালেন। অনিমেষ তখনও হেমলতার দুহাতের বাঁধনে আটকে! সরিৎশেখর গম্ভীরমুকে নাতিকে দেখলেন, তারপর বললেন, আশা করি ফার্স্ট ডিভিশন হয়েছে

বাবার গলা শুনে হেমলতা অনিকে ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ-আপনার নাতি মুখ রেখেছে-আপনি মাধুকে কথা দিয়েছিলেন।

নিজের শরীরটাকে যেন অনেক কষ্টে সামলে নিলে সরিৎশেখর, কথা তো সবাই দিতে পারে, রাখে কয়জন! এই আনন্দের খবরের জন্য এতকাল বেঁচে আছি, হেম।

অনিমেষ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দাদুকে প্রণাম করল। সরিৎশেখরের হাতটা ওর মাথার ওপর এলে অনিমেষ অনুভব করল দাদুর শরীর কাঁপছে। বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলছেন। অনিমেষ উঠে দাঁড়ালে সরিৎশেখর গম্ভীর গলায় বললেন, কিন্তু এতে আমি সন্তুষ্ট নই অনিমেষ, তোমাকে আরও বড় হতে হবে-আমি ততদিন বেঁচে থাকব।
 
সরিৎশেখর দিন ঠিক করে রেখেছিলেন পঞ্জিকা দেখে। বিদেশযাত্রা এবং জ্ঞানার্জনের প্রশস্ত সময় আগামী মঙ্গলবার। নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ছাড়ে রাত্রে, কিন্তু বিকেলবেলায় জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকেই যাত্রা শুরু করা যায়। এসব আগেভাগেই ছকে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু মুশকিল হল আজ কাগজে দেখলেন বুধবার কলকাতায় বামপন্থিরা হরতালের ডাক দিয়েছে। বাড়িতে কাগজ রাখা বন্ধ করেছিলেন তিনি, শুধু রবিবার দুটো কাগজ নেন। বাকি ছয়দিন কালীবাড়ির পাশে নিত্য কবিরাজের দোকানে বসে পড়ে আসেন। নাতির পাশের খবর সবাইকে দিয়ে সেদিনের কাগজটা হাতে তুলতেই সব গোলমাল হয়ে গেল। বাটারা আর হরতাল ডাকার দিন পেল না! সরিৎশেখরের হঠাৎ মনে হল নাতিকে তিনি একটা অনিশ্চিত এবং অগ্নিগর্ভ হাঁ-মুখের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কলকাতা শহরকে বিশ্বাস করতে পারা যায় না, অন্তত এই কাগজগুলো পড়ে মনে হয় কলকাতা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। রাতদিন মারামারি, মিছিল, হরতাল, ছাত্র-আন্দোলন সেখানে লেগেই আছে। অনিমেষ সেখানে গিয়ে নিজেকে কতটা নিরাপদে রাখতে পারবে? একেই ছেলেটার মাথায় এই ধরনের একটা ভূত সেই পনেরোই আগস্ট থেকে চেপে আছে-সেটা উসকে উঠবে না তো? হেমলতার ভয় কলকাতায় গেলে মেয়েরা তার ভাইপোকে চিবিয়ে খাবে। শনিবাবা বলেছিলেন, এর জীবনে প্রচুর মেয়ে আনবে, তারা সর্বনাশ করবে, আবার তাদের জন্যই ওর উন্নতি হবে। কিন্তু মাথা খেয়ে নিলে তারপর আর কী ছাই হবে! হেমলতার এইসব চিন্তা সরিৎশেখরকে স্পর্শ করে না। তার নাতির ওপর বিশ্বাস আছে। মেয়েছেলে ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তেমন হলে তিনি নিজে কলকাতায় যাবেন। কিশোরী মিত্তিরের বাড়ি শোভাবাজারে। এককালে এই অঞ্চলে ছিলেন তিনি, সরিৎশেখরের ভারি অন্তরঙ্গ। অনিমেষের দেখাশোনার ভার তিনি নিয়েছেন চিঠির মাধ্যমে। অতএব তেমন কিছু হলেই খবর পাবেন সরিৎশধর। এই সময় তার চট করে বড় ছেলে পতিতোষের কথা মনে পড়ে গেল। তাকে জলপাইগুড়িতে রেখেছিলেন আর-একজনের কাছ থেকে খবরাখবর ঠিকমতো পাবেন এই আশায়। পেয়েছিলেন? সবই ঠিক, কিন্তু কলকাতায় না গেলে অনিমেষের ভবিষ্যৎ এই শহরের চারপাইে পাক খাবে। আনন্দচন্দ্র কলেজ থেকে আহা-মমি ফল করে পাশ করার আশা পাগলও করবে না। অতএব প্রেসিডেন্সি অথবা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অনিমেষকে ভরতি করতে হবেই। তাঁর ইচ্ছা ও সেন্ট জেভিয়ার্সে প্রতি হোক। মিশনার কলেজ, ইংরেজিটা ভালো শিখবে, সহবত পাবে। সরিৎশেখর এখনও বিশ্বাস করেন ইংরেজিতে উত্তম ব্যুৎপত্তি না থাকলে জীবনে বড় হওয়া যায় না। তারপর খবরে জেনেছে সে-কলেজে মেয়েরা পড়ে না, হেমলতায় আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কোএড়ুকেশন কজে সম্পর্কে তার নিজস্ব কোনো গোঁড়ামি নেই। তবে চিকিৎসার চেয়ে সতর্কতাই শ্রেয়। অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজে দেশের ভালো ভালো ছেলেরা পড়ে, বিখ্যাত অধ্যাপকরা পড়ান। মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকা যায় ছাত্রের পড়াশুনার ব্যাপারে। যদিও সেখানে মেয়েরা পড়ে। তবে এই মেয়েরা যখন মেধাবী এবং কৃতী, নাহলেওই কলেজে ভতি হতে পারত না, তাই তাদের সময় হবে না ছেলেদের মস্তিষ্ক চর্বণ করার। আর করলেও তার নাতবউ পড়াশুনায় স্কলার-সরিৎশেখর অতটা আশা করতে পাবেন না। তা ছাড়া প্রেসিডেন্সির গায়েই নাকি বেকার হোস্টেল। পায়ে হেঁটে আসাযাওয়া করবে অনিমেষ। গাড়িঘোড়ায় চাপার ব্যাপারে কলকাতা শহরকে অবিশ্বাস করেন তিনি। বেকার হোস্টেল থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স কত দূর-হেঁটে যাওয়া অসম্ভব কি না কিশোরী মিত্রকে জানাতে লিখেছিলেন। অনেকেই যেমন হয়, চিঠি দেবার সময় সব পয়েন্টের কথা খেয়াল করে না–কিশোরী মিত্রও তা-ই করেছেন।
 
আজ নাতিতে স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠালেন সরিৎশেখর। যাবার আগে বাপের সঙ্গে দেখা করে আসুক। মাতাপিতার আশীর্বাদ ছাড়া কোনো সন্তান জীবনে উন্নতি করতে পারে না। অনিমেষকে তাই তিনি স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠালেন, দু-চারদিন থেকে আসুক। সাধারণত ছেলেটা সেখানে যেতে চায় না-এবার বলতেই রাজি হয়ে গেল। ফাঁকা বাড়িতে সরিৎশেখর চুপচাপ বসে অনিমেষের কথা ভাবছিলেন। ওর কলকাতায় পড়তে যাবার ব্যাপারে প্রথমে মহীতোষের ইচ্ছা ছিল না ঠিক, কিন্তু তিিন বরাবর জোর করে এসেছেন। কিন্তু সেখানে ছেলেটার পেছনে প্রতি মাসে যে-খরচ হবে তা যোগানোর সামর্থ্য তার নেই। পেনশন আর এই সামান্য বাড়িবাড়া-এতে তাকে যেভাবে চলতে হচ্ছে তা থেকে অনিমেষকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। ওরা পড়াশুনার দায়িত্ব তাই মহীতোষকে নিতে হবে। তিনি বিশ্বাস করেন সে তা নেবে। নিজের সন্তানদের পেছনে তিনি জীবনের কতখানি উপার্জন ব্যয় করেছেন, সেগুলো থাকলে আজ তিনি অনিমেষকে কারও কাছে পাঠাতেন না। অতএব মহীতোষ তার নিজের ছেলের জন্য টাকা খরচ করবে না কেন? ঠিক এই মুহূর্তে তার মনে হল যে এতদিন তিনি যেন অনিমেষের কেয়ারটেকার হয়ে ছিলেন। সেই স্বৰ্গছেঁড়া ছেড়ে চলে আসার সময় বউমার কাছ থেকে যে-ছেলেটার দায়িত্ব হাত পেতে চেয়ে নিয়েছিলেন, এত বছর ধরে যাকে বুক দিয়ে আড়াল করে রেখে বড় করলেন, আজ সেই দায়িত্ব তার শেষ হয়ে গেল। এখন তিনি মুক্ত। কিন্তু এটুকু ভাবতেই তার সমস্ত শরীর কেমন দুর্বল হয়ে গেল। উত্তরের বারান্দায় ভাঙা বেতের চেয়ারে বসে সরিৎশেখর অনেক বছর পরে তার জরাগ্রস্ত চোখ দুটো থেকে উপচে-পড়া জলের ধারাকে অনুভব করলেন। চোখ মুছতে একটুও ইচ্ছে হর না তাঁর।

কুচবিহার-লেখা বাসে চেপেছিল অনিমেষ। ময়নাগুড়ি রোড়ে এলে টিকিট কাটার সময় জানতে পারল সেটা স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবে না, ধূপগুড়ি থেকে ঘুরে অন্য পথ ধরবে। এখন নেমে পড়াও যা ধূপগুড়িতে নামাও তা। মিছিমিছি বেশি পয়সা খরচ হয়ে গেল। ধূপগুড়িতে নেমে ও স্বৰ্গছেঁড়ার দিকে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটবার হলে ঘনঘন বাস পেত, কিন্তু আজ বোধহয় অপেক্ষা করতে হবে। বার্নিশ থেকে পরের বাসা, অথবা মালবাজার মেটেলি থেকে বাস এলে সেটাতে উঠতে হবে। অথচ এখান থেকে স্বৰ্গছেঁড়া বেশি দূর নয়-মাইল আটেক। দৌড়েই চলে যাওয়া যায়।

অনেকদিন পরে স্বর্গহেঁড়ায় যাচ্ছে সে। অথচ সেই প্রথমবারের মতো উত্তেজনা হচ্ছে না, এখন সমস্ত মন বসে আছে বুধবার সন্ধেবেলার দিকে তাকিয়ে। মলবার ঠিক ছিল, কিন্তু হরতালের জন্য দাদু দিনটা পিছিয়ে দিলেন। বৃহস্পতিবার কলকাতায় পৌঁছাবে সে। ভাবতেই সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠল ওর। এতদিন ধরে বিভিন্ন বই, খবরের কাগজ আর মানুষের মুখেমুখে শুনে মনের মধ্যে কলকাতা এক স্বপ্নের শহর হয়ে গেছে। সেখানে যেতে পারার সুযোগ পেয়ে অনিমেষ আর-কিছু। ভাবতে পারছিল না। ওর মনে পড়ল অনেক অনেক দিন আগে যখন সে ছোট ছিল তখন একদিন দাদ ওকে বলেছিলেন, কলকাতায় যখন যাবে যোগ্যতা নিয়ে যাবে। প্রথম ডিভিশনে পাশ করলে নিশ্চয়ই যোগ্য হওয়া যায়। অনিমেষের মনটা এখন বেশ ভালো হয়ে গেল। স্বৰ্গছেঁড়ায় আসবার আগে সামান্য অস্বস্তি ছিল। মহীতোষের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তার পড়াশুনার খরচ যদি মহীতোষ না দেন তা হলে এ সি কলেজেই পড়তে হবে। মনেমনে একটা কুণ্ঠাও বোধ করছিল সে। সেই ঘটনার পর থেকে মহীতোষের সঙ্গে তার কথাবার্তা একদম হয় না বললেই চলে। জলপাইগুড়িতে তিনি কদাচিৎ আসেন, এলে মুখোমুখি হল দুএকটা ছাড়া-ছাড়া কথা বলে মহীতোষ কৰ্তব্য শেষ করেন। ছোটমা এর মধ্যে যে-কবার এসেছেন তার বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাপের বাড়িতে। মহীতোষ ইদানীং ছোটমাকে। নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছেন। বাবাকে ও কিছুতেই নিজের বলে ভাবতে পারে না। আঘ, বাবার সেসব অভ্যেস কি চলে গেছে? জী জানি!
 
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল অনিমেষ, কানের কাছে বিকট আওয়াজে একটা হর্ন বেজে উঠতেই ভীষণরকম চমকে উঠল। সামলে নিয়ে ও দেখল একটা কালো গাড়ি সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হটা বেজেছে ওটাতেই। ঝুঁকে পড়ে ড্রাইভারকে দেখতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। বত্রিশটা দাঁত বের করে বাপী স্টিয়ারিং-এ বসে হাসছে, চোখাচোখি হতে চেঁচিয়ে বলল, উঠে আয়। বাপী গাড়ি চালাচ্ছে-বুঝতে-না-বুঝতে অনিমেষ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। বেশ ঝকঝকে তকতকে গাড়ি তবে নতুন নয়।

বাপী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, তুই এখানে কী করছিলি?

অনিমেষ বলল, কুচবিহারের বাসে উঠে পড়েছিলাম। কিন্তু তুই-গাড়ি চালাচ্ছিস?

কেন? ভ্রূ তুলল বাপী, এটা আবার শক্ত কাজ নাকি!

কার গাড়ি এটা?



বীরপাড়ার খোকনদার। আমি মান্থলি সিস্মেমে চালাই। দুনম্বর পেট্রোল পেলে ভালো হয়, নাহলে এই ছয়-সাতশো টাকা মাস গেলে-তা-ই-বা কে দেয় বল!

বাপী ইঞ্জিন স্টার্ট করল। আরও বিস্ময়, অনিমেষ কোনোরকমে বলল, তুই ট্যাক্সি চালাস?

ইয়েস, প্রাইভেট। এই তো একজনকে বার্নিশে ছেড়ে এলাম।

বাপীর গাড়ি চলতে শুরু করলে অনিমেষ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ওর সমবয়সি একজন গাড়ি চালাচ্ছে-কীরকম চালায় কে জানে, যদি অ্যাক্সিডেন্ট করে। কিন্তু সে দেখল বাপীর গাড়ির চাকা একটু এপাশ-ওপাশ হচ্ছে না। আর মাঝে-মাঝেই ও এক হাত ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তমুখে বসে আছে-তার মানে বেশ পাকা ড্রাইভার। বাপীটা চিরকালই দুর্দান্ত, কিন্তু এইরকম হবে এটা কল্পনা করতে পারেনি সে। কিন্তু বাপীর তো এখনও আঠারো বছর হয়নি, তার আগে লাইসেন্স পাওয়া যায়। প্রশ্নটা করতেই বাপী গম্ভীরমুখে বলল, লাইসেন্স হয়ে গেছে। ডেট অভ বার্থ গণাদা ঠিক করে দিয়েছে। গণাদাকে চিনলি? আরে আমাদের এখানকার এম-এল-এ। ইলেকশনের সময় হেভি খেছিলাম তো ওর হয়ে, কমিউনিস্টরা শালা সব বোন্ড আউট হয়ে গিয়েছে। তা গণাদা দুই বছর ম্যানেজ করে লাইসেন্স বের করে দিয়েছে। আমার তো আর পড়াশুনা হল না।

পড়লি না কেন? অনিমেষ ওদের ছোটবেলার কথা ভাবল।

দুস! ওসব আমার আসে না। আর পড়েও তো টাকা রোজগারের ধান্দা করতে হবে। বিশুটা মাইরি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে এখন থেকে বাগানের চাকরির ধান্দায় লেগেছে। কত পাবে? বড়জোড় তিনশো, আমি পাচ্ছি ছয় সাত-ব্যস, আর কী চাই।

বিশ্ব সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছে?

ঘাড় নাড়াল বাণী, ই। তারপর যেন মনে পড়ে যেতে জিজ্ঞাসা করল, তুই?

মুখ নামিয়ে নিমেষে বলল, ফার্স্ট ডিভিশন।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে জবর ব্রেক কষল বাণী। মাথাটা অল্পের জন্য ইকে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল, কিন্তু তার আগেই হইহই করে ওকে জড়িয়ে ধরল বাপী, আরে বাস, আগে বলিসনি-আমি জানতাম তুই ফার্স্ট ডিভিশন পাবি-উঃ কী আনন্দ হচ্ছে, আমাদের অনি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে! কথাগুলো বলতে বলতে সে টপাটপ চুমু খেতে লাগল অনিমেষকে। অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই মুখ সরিয়ে নিতে পারবে না অনিমেষ, ও বুঝতে পারছিল বাপীর উচ্ছ্বাসের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই।

উচ্ছ্বাস কমে এলে বাপী স্টিয়ারিং-এ ফিরে গিয়ে বলল, তুই মাইরি বহুৎ বড়া অফিসার হবি, না? কলকাতায় পড়তে যাবি, না জলপাইগুড়িতে?

গম্ভীর গলায় অনিমেষ বসল, কলকাতায়।

কী কপাল মাইরি! কত সিনেমা-স্টার দেখবি-আঃ! নে সিগারেট খা।

এর মধ্যে ও কখন প্যাকেট বের করেছে দেখেনি অনিমেষ, এখন বাপীকে একটা কড়া সিগারেট ওর দিকে বাড়িয়ে ধরতে দেখল। আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না, আমার ঠিক অভ্যাস নেই।
 
সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল বাপী, যা বাবা, তুই খাস না? একদম গুড বয়? আরে তুই এখন স্কুলবয় নস, কলেজে উঠেছিস-একটা সিগারেট খা ভাই। আমার হাতে হাতেখড়ি কর-চিরকাল তা হলে আমাকে মনে রাখবি। বেশ কিছুক্ষণ পীড়াপীড়ি করতে অনিমেষ হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিল। ফস করে দেশলাই জ্বেলে নিজেরটা ধরিয়ে বাপী ওটা ধরিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। খুব আন্তে সিগারেটটায় টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ল অনিমেষ। একটা কষা স্বাদ জিভটাকে ভারী করে তুলেছে। নাক দিয়ে ধোয়া বের করার সাহস ওর হচ্ছিল না। জানলার পাশে বসে ভুড়য়া নদীকে চলে যেতে দেখল এবার। বাঁক ঘুরতেই স্বৰ্গছেঁড়া। উত্তেজনায় জোরে টানতে গিয়ে ধোয়াটা পেটে ঢুকে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে খকখকে কাশি এস গেল ওর। দম বন্ধ হবার যোগাড়। সিগারেটটা রাস্তায় ফেলে দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিল না সে। ব্যাপার দেখে বাপী হেসে বলল, মাইরি অনি, তুই একদম গুড বয় হয়ে আছিস!

মুঠো খুললেই হাতের রেখার মতো পরিস্কার, বাঁক ঘুরতেই চা-বাগানের মাথা ডিঙিয়ে স্বৰ্গছেঁড়া চোখ পড়ল। চায়ের পাতা দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন িবশির করে অনিমেষের। একটু আগে আঙরাভাসার ওপর দিয়ে পার হবার সময় বাপী বলেছিল, জি স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে একটা দারুণ ব্যাপার হচ্ছে।

স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে কোনো দারুণ ব্যাপার ঘটলে সেটা যেন ঠিক মানায় না। চুপচাপ শান্তভাবে স্বৰ্গছেঁড়ার দিনগুলো কেটে যাবে-ভোরবেরায় ট্রাকটরগুলো শব্দ করে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে যোরাফেরা করবে, বলিরা দল বেঁধে পাতি তুলতে বা ঝাড়াই-বাছাই-এর কাজে ছুটতে, বাবুরা সাইকেলে হেলতে দুলতে ফ্যাক্টরি বা অফিসে যাবেন, আর তারপর গোটা দিন স্বৰ্গছেঁড়া দেয়ালা করে যাবে একা একা। বাণী বলল, আজ সেবার হরতাল করেছে-কেউ সকার থেকে বের হয়নি।

সে কী। ভীষণরকম চমকে গেল অনিমেষ। ওর চট করে সুনীলদার মুখটা মনে পড়ে গেল। এখানকার কলিকামিনদের সঙ্গে সুনীলদা এসে কিছুদিন থেকে গেছে। কিন্তু এ-জিনস স্বর্গহেঁড়ায়। কখনো হয়নি। দাদুর চলে যাওয়ার দিন যে-কুলিরা ওঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছিল তারাই আজ ধর্মঘট করছে-কিছুতেই মেলাতে পারছিল না অনিমেষ। ও দেখল রাস্তার দুধারে আজ ছুটির দিনের দৃশ্য। কুলিলাইন থেকে বের হয়ে মেয়ে-পরুষ পিচের রাস্তায় দুপাশে বসে, দাঁড়িয়ে গল্প করছে। অনিমেষ বলল, কী করে করল? কেন করল?

পি এস পি আর সি পি আই। মাইনে বাড়াবার জন্য, ভালো কোয়ার্টারের জন্য, আর কী কী যেন সব। গোলমাল হতে পারে আজ। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাপী কথা বলছিল। স্বৰ্গছেঁড়া টি এস্টেটের নেমপ্লেটটা চোখে পড়তেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিল বাপী, ঠিক অনিমেষদের বাড়ির সামনে সেটাকে দাঁড় করিয়ে বলল, বিকেলে বাজারে আসিস। কাল অনেক রাত অবধি খুব খাটুনি গেছে, এখন ঘুমোব।

দরজা খুলে অনিমেষ মাটিতে পা দিতেই ইউক্যালিপটাস পাতার তীব্র গন্ধ ভক করে নাকে লাগল। ও দেখল পাশেই একটা বাঁদরলাঠি গাছে বড়সড় শকুনকে ঘিরে কতকগুলো কাক খুব চিৎকার করছে। ও বাপীকে বলল, এত খাটিস না, মারা পড়বি।

বাপী গাড়ি চালিয়ে চলে যাবার সময় বলে গেল, দূর শালা! বিয়েবাড়ির খাটুনি, কাল এসে তোকেও খাটতে হত। আমাদের সীতাদেবীকে কাল হরধনু ভঙ্গ করে রামবাবু আজ নিয়ে যাচ্ছে। একরাশ ধোয়া ছেড়ে গাড়িটা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ পাথরের মতো রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল।
 
এখান থেকে সার-দেওয়া বাগানের কোয়ার্টারগুলো পরিষ্কার দেয়া যায়। মাঠ পেরিয়ে কাঁঠালিচাঁপা গাছটার পাশ ঘেঁষে সীতাদের কোয়ার্টারটাকে আজ একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। বেশকিছু মানুষ সেখানে জটলা করছে, ত্রিপল টাঙিয়ে অনেকখানি জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। পাশেই একটা লরিতে পাট আলমারি তোলা হয়েছে, সেটার পাশ-ঘেঁষে কালো রঙের অস্টিন গাড়ি দাঁড়িয়ে। সীতার বিয়ে গেল। সংবিটা ফিরে আসতেই অনিমেষ বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করল। এই প্রথম ওর মনে হল কী-একটা জিনিস যেন হারিয়ে গেল, আর কোনোদিন সে ফিরে পাবে না। শেষবার-দেখা সীতার ঘুমন্ত জোরো মুখ, অদ্ভুত আড়াল রেখে কাছে টেনে নেওয়ার মতো কথা-অনিমেষ এই আসাম রোডের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করল সীতাকে ও ভালোবেসেছিল। ঠিক যেভাবে রম্ভা তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল কিংবা উর্বশীর চোখের চাহনিতে যে-আহ্বান ছিল এটা সেরকম নয়। সত্যি বলতে কী, প্রেম-ভালোবাসা ওর মাথায় কখনোই তেমন। জোরালোভাবে আসেনি, আর আসেনি বলে রম্ভাকে ওর ভালো লাগেনি একবিন্দু, উর্বশীর ব্যাপারে সে একটুও উৎসাহ পায়নি। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ওর মনে হল সীতা ওকে ভালোবাসত এবং একটুও চিন্তা না করে তার মনের ভেতর সীতার জন্য একটা নিশ্চিন্ত জায়গা তৈরি করা ছিল যেখানে বাইরের কোনো সমস্যার আঁচ লাগার কথা কখনোই কল্পনায় আসেনি। সীতাটা চট করে বিয়ে করে ফেলল। ওর মা তো ওকে পড়া করাতে চেয়েছিলেন। তা হলে কি ও পড়াশুনায় ভালো ছিল না। সেই সীতা-ছোটবেলায় হাত ধরলে যে ভ্যা করে কেঁদে উঠত, কয় বছর আগে ওর সঙ্গে কথা বলার সময় যে-সীতা একদম নিজের অনুভূতি ওর মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে-তার বিয়ে হয়ে গেল! অথচ ও তো সীতাকে কখনো কোনো চিঠি লেখেনি, মণ্টুর মতো মুখ করে বলেনি, আই লাভ ইউ সীতা। তা হলে ওর বুকের ভেতর এরকম করছে কেন? সীতা কী করে জানবে অনিমেষের মনের মধ্যে এরকম ব্যাপার ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হল, সীতা জানত, নিশ্চয়ই জানত–অন্তত জানা উচিত ছিল। দুপাশের মরে শুনিয়ে-যাওয়া পাতাবাহারের গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটুতে হাঁটুতে ওর মনে হল, এই পৃথিবীতে তার জন্য কোনো ভালোবাসা অপেক্ষা করে নেই।

ক্লাবঘর বন্ধ। ওপরের খড়ের চাল এলোমেলো। ওদের কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে এসে অনিমেষ একটু থমকে দাঁড়াল। এখন বাবার বাড়িতে থাকার কথা নয়। এই সময় ছোটমা নিশ্চয়ই জলখাবার খেতে ব্যস্ত। দরজার কড়া নাড়তে গিয়ে দূর থেকে উলুধ্বনি ভেসে এল। যেন শুনতে চায় এইরকম ভঙ্গিতে জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল।

ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। খিড়কিদরজার দিকে তাকাল অনিমেষ। বাইরে থেকে আঙুল ঢুকিয়ে একটু কায়দা করলে দরজাটা খোলা যেত, এখনও সেরকম আছে কি? সিড়ি দিয়েনিচে নামতে যাবে এমন সময় ও দেখল একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে আসছে ওর দিকে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, আপনাকে ডাকছে।

কে?

অনিমেষ অবাক হল। ছেলেটির মুখ সে আগে দেখেনি, ওরা চলে যাবার পর নিশ্চয়ই ও হয়েছে। ছেলেটির বুক ওঠানামা করছিল, বলল, মাসিমা।

মাসিমা কো অনমেষদের কোয়ার্টারটা দেখাল সে। ছোটমা ওকে ডাকছে তা হলে। ছোটমা কোথায় আছে নিশ্চয়ই গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে ওকে। অনিমেষকেইতস্তত করতে দেখে ছেলেটি বলল, দিদিমাও আপনাকে বারবার করে যেতে বলল।

দিদিমা?

ওই যে, যার বিয়ে হচ্ছে তার দিদিমা। ছেলেটি বিজ্ঞের মতো হাসল এবার। এতক্ষণে অনিমেষের কাছে ব্যাপারটা দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছে। ওর মনের ভেতরে যে-অভিমানটা এতক্ষণ টলটল করছিল সেটা যেন চট করে গড়িয়ে গেল। সীতাদের বাড়িতে সে যাবে কেন? ওকে দেখে ছোটমা তো চলে আসতে পারত। এতদিন পর সে স্বৰ্গছেঁড়ায় আসছে, অথচ ছোটমা ওখানে বসে থাকল। ও ভাল ছেলেটিকে বলে দেয় যে সে যাবে না, কিন্তু তার আগেই ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আসছে।
 
একটু দ্বিধা করল অনিমেষ। এখন সে কী করবে? নিশ্চয়ই কেউ এসে বাইরে দাঁড়িয়েছে যাকে ছেলেটি জানান দিল। না গেলে ব্যাপারটা খুবই খারাপ দেখাবে। আর এই সময় ওর মনে হল, সীতাকে আর কোনোদিন সে দেখতে পাবে না। কনের বেশে সীতাকে দেখবার লোভ হঠাৎ ওর মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ব্যাগটা হাতে নিয়েই অনিমেষ ছেলেটির সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ল। সীতাদের কোয়ার্টারের দিকে ঘুরতেই ও দেখতে পেল দূরে মাঠের ওপর নিজেদের বাড়ির সামনে একটি ছোট মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ঠাকুমা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পেছনে ত্রিপলের তলায় লোকজন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

অনিমেষ ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে ঠাকুমাকে প্রণাম করল। উঠে দাঁড়াতেই খপ করে বুড়ি ওর হাত চেপে ধরলেন, রাগ করেছিস?

ভীষণ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। ঠাকুমা কী বলতে চাইছেন? ও না-বুঝে ঘাড় নাড়ল। কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাকুমা বললেন, পাশের খবর এসেছে?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

ফাস্টো কেলাস?

হেসে ফেলল অনিমেষ, হ্যাঁ।

সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে, মিষ্টি নিয়ে আয়, অ বউমা, কোথায় গেলে সব–আমার অনিবাব ফাস্টো ক্লাস পাশ করেছে। সে-বেটি থাকলে আজ কী করত–বলতে বলতে মুখটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল ঠাকুমার। কান্নায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, সীতুটাকে আজ পার করে দিল রে।

ভালোই তো, মুহূর্তে শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ, ভালোই তো। আপনি বলতেন, মেয়েদের জন্ম হয়েছে সংসার করবার জন্য।

ঠাকুমার পায়ে জোর নেই, বোধহয় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আর শরীরটাকে খাড়া রাখতে পারছিলেন। ওকে টলতে দেখে অনিমেষ একহাতে জড়িয়ে ধরে সামলে দিল। সেভাবেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তাই বলে ডবল বয়সের মানুষের সঙ্গে বিয়ে দেবে গো! আমরা কথা শুনল না—পাত্র অফিসার নাকি।

ঠাকুমার কথা শেষ হবার আগেই পেছনের জটলা থেকে সীতার বাবা উঠে এসে তাঁকে ধরলেন, আঃ মা, কী বলছ তুমি! এখন এসব বলে লাভ আছে।

মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন ঠাকুমা, কিন্তু তার শরীরটা কাঁপতে লাগল থরথর করে। সীতার বাবা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তুমি তো খুব বড় হয়ে গেছ, কদিন পরে তোমাকে দেখলাম। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছ? বাঃ বাঃ, বেশ! খুব ভালো হল আজকের দিনে এসেছ। যাও ভেতরে যাও।

ঠাকুমাই লেংচে লেংচে ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন। অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। ত্রিপলের তলার লোকগুলো ওর দিকে উৎসুক-চোখে তাকিয়ে আছে। ঠাকুমার কথাটা শোনার পর ভেতরে যাবার ইচ্ছেটাই উবে গিয়েছিল। এই বিয়ে কি সীতার বাবা জোর করে দিয়েছেন? ওর খেয়াল হল, বিয়ের ব্যাপারে মতামত দেবার বয়স সীতার এখনও হয়নি। হলে পরে কি সীতা প্রতিবাদ করত?

চা-বাগানের বিয়েবাড়িতে আতিশয্য তেমন হয় না। জলপাইগুড়ি শহরে বন্ধুদের দাদা-দাদির বিয়েতে গিয়ে অনিমেষ মাঝে-মাঝে সানাই বা মাইক বাজতে দেখেছে, মেয়েরা ছুটোছুটি করে বিয়েবাড়ি জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু চা-বাগানের আচার-অনুষ্ঠান পালন হয় আন্তরিকভাবে, কিন্তু বিয়েবাড়ির চটক তেমন থাকে না। সাধারণত কোয়ার্টারের ভেতরে যে উঠোনমতো জায়গা থাকে সেখানেই অনুষ্ঠানটা হয় আর অসমবয়সি মেয়েরা আচার খাওয়ার মতো রসিয়ে রসিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানটা সম্পন্ন করায়। অনিমেষ দেখল ঠাকুমা ওকে ঘর পেরিয়ে উঠোনে নিয়ে যাচ্ছেন।
 
ভেতরে পা দিতেই আবার উলুধ্বনিটা কানে এল। কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে ঠাকুমা চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলেন। ততক্ষণে ওরা ভেতরের বারান্দায় পৌঁছে গেছে। ওখানে দাঁড়িয়ে উঠোনে নজর পড়ল অনিমেষের। ঠিক মধ্যিখানে চারদিকে চারটে কলাগাছ পুঁতে মাঝখানে বর-বউ বসে আছ। তাদের ঘিরে মেয়েদের জটলা। ছোটমাকে দেখল অনিমেষ, সীতাকে জড়িয়ে ধরে কিছু-একটা করছেন। ওকে দেখে হাসবার চেষ্টা করলেন। সীতার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। একটা জবুথবু কাপড়ের পুটলির মতো দেখাচ্ছে সীতাকে। মাথা নিচু, বেনারসি কাপড়ের পাড়টা চকচক করছে। সীতার মাথার মুকুট এখন বর্শার ফলার মতো তার দিকে তাক করা। মুখটা দেখতে পেল না অনিমেষ। সীতার পাশে যিনি বসে আছেন তাকে বেশ শক্তসমর্থ, বলে মনে হল ওর। নিশীথবাবুদের বয়সি হবেন বোধহয়। ঠাকুমার হাঁকডাকে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ মোটা গোঁফ আছে সীতার বরের! ঠাকুমার ডাকে সীতার মা আড়াল থেকে ঘোমটা-মাথায় বেরিয়ে এলেন। এক পলক দেখেই অনিমেষ বুঝে ফেলল উনি একটু আগেও খুব কাঁদছিলেন। সীতার। মা এসে ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আর-একজনের হাতে দিয়ে বললেন, কী ভালো লাগছে আজ তুমি এসেছ! সীতা বারবার তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করছিল তুমি আসবে কি না। অনিমেষ মাথা নিচু করল। ওর হঠাৎ খেয়াল হল পাশের খবর দিয়েছে যখন তখন এঁদের প্রণাম করা উচিত। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর সীতার বরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতেই ও মত পালটে ফেলল। ঠাকুমা ততক্ষণে ওর ফার্স্ট ডিভিশনে পাশের খবর, ওর মতো ভালো ছেলে হয় না, পনেরোই আগস্ট স্বৰ্গছেঁড়ার সমস্ত ছেলের মধ্যে থেকে শুধু ওকেই পতাকা তুলতে দেওয়া-এইসব সাতকাহন পাঁচজনকে গর্ব করে শোনাচ্ছেন।

অনিমেষ সীতার ওপর চোখ রেখেছিল। ও দেখল সে এসেছ, সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুনেও সীতা একবারও মুখ তুলে ওকে দেখল না। সীতার মা বললেন, জানিই তো, ও ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ না করলে কে করবে! তুমি বসো, এখন তো কলকাতায় পড়তে যাবে, আর কবে পেটভরে খাওয়াবার সুযোগ পাব জানি না।

উনি দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে অনিমেষ দেখল বিয়ের বরকনেকে ছেড়ে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে ঠাকুমা ওকে টানতে টানতে উঠোনে নামিয়েছেন, বিয়েতে এলি না তো কী হয়েছে, বাচিবিয়েতে এলি এই ভাগ্যি। নে আমাদের জামাইকে দ্যাখ। ওগো নাতজামাই, এই যে ছেলেটাকে দেছি, ভীষণ বিদ্বান। তোমার বউ-এর সঙ্গে ছেলেবেলায় খেলা করত। ভদ্রলোক এমনিতে খুব অস্বস্তি নিয়ে বসেছিলেন, কথাটা শুনে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে নমস্কার করলেন। এতবড় লোক তাকে নমস্কার করছে দেখে হকচকিয়ে অনিমেষ হাতজোড় করতেই ঠাকুমা হেসে ফেললেন, ওমা, এইটুকুনি ছেলেকে নমস্কার করছ কী গো! এই সময় সীতার পাশে বসে-থাকা ছোটমাকে বলতে শুনল অনিমেষ, আমার ছেলে।

ভদ্রলোক আবার হাসলেন, হাসিটা ভালো লাগল না অনিমেষের। কেমন বোকাবোকা। ঠাকুমা আবার ডাকলেন, ও হুঁড়ি, দ্যাখ কে এসেছে! লজ্জায় মাথা যে মাটিতে ঠেকল, আমাদের যেন আর কোনোদিন রে হয়নি!

একটু একটু করে মুখ তুলল সীতা। বেনারসি, মুকুট আর ওড়নার চালচিত্রের সামনে সীতার মুখটা ঠিক দুর্গাঠাকুরের মতো দেখাচ্ছে। বুকের মধ্যেটা হঠাৎ থম-ধরা দুপুর হয়ে গেল অনিমেষের, সীতার দুই চোখের পাতা শ্রাবণের আকাশ রয়েছে। অথচ কী সহজ গলায় সীতা কথা বলল, তোমরা নাড় গোপালকে না খাওয়াও ঠাকমা।

কথা শেষ হতেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ফেলল সীতা। চোখে জল না এনে বুকভরে কেঁদে যাওয়া যায়–অনিমেষ সেইরকম কাঁদতে কাঁদতে সীতার চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ঘুরে দাঁড়াল। প্রচণ্ড দুঃখের মধ্যে হঠাৎ একধরনের সুখ মানুষ পেয়ে যায়। অনিমেষের মনে হল বিয়ের খবরটা কানে যেতেই ওর বুকের মধ্যে যে-ইচ্ছেটার খবর ও পেয়েছিল, এই মুহূর্তে সীতা সেটাকে আসনে বসিয়ে দিল। পায়েপায়ে বারান্দায় উঠে এল অনিমেষ। বাসিবিয়ে আশীর্বাদ বোধহয় বাবা এসে তাড়া দিলেন, ওদের যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে!
 
মিষ্টিমুখ না করে সীতার মা ছাড়লেন না। এদিকে মেয়ে-জামাই চলে যাবে-বাড়িসুদ্ধ সেসব ব্যাপারে ব্যস্ত ছিল। এ-বাড়িতে অনিমেষের এখন কেমন একলা একলা লাগতে শুরু করল। কন্যাযাত্রীদের খাওয়াদাওয়া আগেই চুকে গিয়েছিল। জামাই যেতে বসেছে। সীতাকে খাওয়ানোর জন্য জোর চেষ্টা চলেছে, সে খাবে না। এলোমেলো একটু ঘুরে ওর মনে হল এখন এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়াই ভালো। ঠিক এই সময় ছোটমা ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে কাছে এল, চলো, এখন বাড়ি যাবে তো? ঘাড় নেড়ে ব্যাগটা ওর হাত থেকে নিয়ে অনিমেষ ছোটমার সঙ্গে বেরিলে এল। ছোটমা মাথায় অনেকখানি ঘোমটা টেনে দিয়েছে, চওড়া-পেড়ে টাঙাইল শাড়িতে ছোটমাকে চমত্তার দেখাচ্ছে। ওর হঠাৎ মনে হল, ছোটমা তেমনি রোগাই আছে।

বাইরে আর-একটা গাড়ি এসেছে মেয়ে-জামাইকে নিতে। লরিতে মালপত্র তোলার কাজ শেষ। ওরা চুপচাপ মাটে নেমে এল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছোটমা বলল, তুমি খুব রোগা হয়ে গেছ, আর কী লম্বা! অনিমেষ হাসল। ছোটমা আবার বলল, সীতাটা খুব ভালো মেয়ে ছিল, না?

ছিল বলছ কেন? অনিমেষ কথাটা ধরে দিতে চাইল।

বিয়ে হলে মেয়েদের পুনর্জন্ম হয়। তারপর একটু থেমে বলল, আমার ওপর তোমার রাগটা করেছে?

অনিমেষ মুখ তুলল, রাগ করতে যাব কেন খামোকা?

তা হলে নিজের মুখে আমায় তোমার পাশের খবর দিলে না কেন?

অনিমেষ দেখল ছোটমার মুখটা কেমন হয়ে গেল। ও তাড়াতাড়ি বাল, ঠাকুমা বললেন তাই ভাবলাম শুনেছ। সবাই তো ফার্স্ট ডিভিশন পায়-নতুন আর কী!

ইস, বেশি বেশি! তোমার বাবা শুনলে ভীষণ খুশি হবেন। কদিন থেকেই খবরটা শোনার জন্য ছটফট করছেন। এবার কলকাতায় যাবে তো, দিন ঠিক হয়েছে?

কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির সামনে চলে এসেছিল। অনিমেষ ঘাড় নাড়ল,, বুধবার।

বারান্দায় উঠে ছোটমা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর চট করে ডান হাতের মধ্যমা থেকে একটা আংটি খুলে অনিমেষের বাঁ হাতটাকে ধরে ফেলল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই ছোটমা আংটিটা ওর বাঁ হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিল, অনিমেষ, আমি তো হাজার হোক তোমার মা, তোমাকে কোনোদিন কিছু দিতে পারিনি-এইটে কখনো হাত থেকে খুলবে না, কথা দাও।

হাতটা মুখের সামনে তুলে ধরতেই অনিমেষ দেখল চকচকে নতুন সোনার আংটির বুকে বাংলায় অ অক্ষরটা লেখা রয়েছে। তার মানে ছোটমা তাকে দেবে বলেই আংটিটা করিয়ে রেখেছিল। অনিমেষের বুকটা ভার হয়ে গেল, কোনোরকমে সে বলল, তুমি জানতে আমি ফার্স্ট ডিভিশন পাব।

আস্তে-আস্তে ছোটমা বলল, আমি রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম যে!

ব্যাগটা মাটিতে রেখে অনিমেষ ছোটমাকে প্রণাম করল। খুব শান্ত হয়ে প্রণাম নিয়ে অনিমেষের নত মাথায় নিজের দুই হাত চেপে ধরল ছোটমা।

চাবি বের করে যখন অনিমেষকে দরজা খুলতে বল। ছোটমা, ঠিক তখন পেছনে সাইকেলের আওয়াজ হল। এতদিন কড়ায় তালা লাগানো হত, অনিমেষ–তালাটাকে আগে দেখেনি। সাইকেলের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, মহীতোষ নামছেন। চোখাচোখি হতেই মহীতোষ যেন কী করবেন বুঝতে পারলেন না। সাইকেলটাকে রেখে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এলেন কথা না বলে। অনিমেষ দেখল বাবার চেহারাটা কেমন বুড়ো বুড়ো হয়ে গিয়েছে, একটু রোগা লাগছে। সিড়ির ধাপে পা দেবার আগেই অনিমেষ দ্রুত নেমে গিয়ে ওঁকে প্রণাম করল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি।
 
কথাটা শুনেই মহীতোষ দুহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবার মাথা তার সমান, আলিঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল। মহীতো ওকে জড়িয়ে ধরে ওপরে উঠে এলেন, খোকাকে খেতে দাও।

চটপট অনিমেষ বলল, আমি খেয়েছি।

এই সময় একটা কান্নার রোল উঠল সীতাদের বাড়িতে। ওরা তাড়াতাড়ি বাইরে এগিয়ে এসে দেখল প্রথমে কালো গাড়ি, পেছনে লরিট। সীতাদের বাড়ি ছেড়ে এগিয়ে আসছে। সীতার ঠাকুমা মা প্রচণ্ড জোরে কেঁদে-কেঁদে উঠছেন। সীতার বাবাকে চোখে পড়ল না। গাড়ি যখন ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তার দিকে বাঁক নিচ্ছে, ঠিক তখন অনিমেষ সীতাকে দেখতে পেল। জানলার ধারে গাল চেপে সীতা একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এত দূর থেকেও সীতার চোখ থেকে জল গড়াতে দেখল অনিমেষ।

মহীতোষ হঠাৎ বলে উঠলেন, ভাগ্যিস আমাদের মেয়ে নেই। তারপর ছেলে আর স্ত্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন, দাদু ভালো আছেন?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

তোমার খবরে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন। ওঁর জন্যেই এটা সম্ভব হল। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, অনিমেষ, এখন তুমি বড় হয়েছ। আমরা তো ভগবান নই, অনেক সময় অনেক ভুল করি-সেগুলো মনে রেখো না। সুখ পাওয়া ভাগ্যের কথা, কিন্তু তাই বলে দুঃখের কথা মনে রাখলে শুধু কষ্ট পেতে হয়।

অনিমেষ কিছু বলল না। বাবা কী বলতে চাইছেন সে বুঝতে পারছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সেব কথা তার মনে এক আসছে না। সীতার চোখ দুটো মন থেকে সরাতে পারছিল না সে। ও দেখল, গাড়িগুলো ধূপগুড়ির রাস্তায় মিলিয়ে গেল। হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে মহীতোষ বললেন, ওহহো তোমরা তাড়াতাড়ি করো, বাগানের লেবাররা খুব খেপে গেছে আমরা কাজ করেছি। বলে, ওরা এখানে হামলা করতে আসতে পারে।

ছোটমা আঁতকে উঠে বলল, সে কী! কী হবে তা হলে?

মহীতোষ বললেন, জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। বাজারের সত্য সেনের বাড়িতে তোমাদের রেখে আস;। গোলমাল মিটে গেলে আবার ফিরে আসবে।

ছোটমা দৌড়ে দরজা খুলতে গেল। এই সময় অনিমেষ দেখল, কিছু কুলিকামিন হইহই করতে করতে ফ্যাক্টরির দিকে ছুটে যাচ্ছে আসাম রোড দিয়ে। নিজের শরীরের মতো পরিচিত স্বৰ্গছেঁড়ায় এধরনের ঘটনা ঘটতে পারে-একদম বিশ্বাস হচ্ছিল না অনিমেষের। এই মুহূর্তে ওর চোখের সামনে। সীতা নেই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top