What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

চালাঘরের ঠিক মাঝখানে বেঞ্চিগুলোর গায়ে ইটের গোল চৌহদ্দিতে আগুন জ্বলছে। কাঠের আগুন। ইটগুলো উঁচু বলে ওরা দূর থেকে এটাকে লক্ষ করেনি। আগুনটা এইভাবে জ্বলছে, কী কাজে লাগে কে জানে!

আপনারা কেন এসেছেন?

একটু খোনা-খোনা গলায় দুজনের একজন কথা বলল। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল না, তবে অনুমান করল নিশ্চয়ই হাতহীন লোকটি প্রশ্নটা করেছে। নিশীথবাবু নিশ্চয়ই একটু দমে গিয়েছিলেন, কারণ উত্তরটা দিতে তিনি ইতস্তত করছেন বোঝা গেল, মানে, চারধারে বন্যার জলে সব ভেসে গেছে, আপনারাও নিশ্চয়ই খাবার পাননি, আমরা রিলিফ নিয় বেরিয়েছি–তাই চলে এলাম।

উত্তরটা শুনে খোনা-খোনা গলা বলল, ভালোই হল। আমাদের অবশ্য দুদিনের খাবার মজুত ছিল-কী আছে ওতে?

নিশীথবাবুর আদেশের জন্য ওরা অপেক্ষা করল না, ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখানে বসার কী দরকার, এবার চলে গেলই হয়। অনিমেষ লক্ষ করছিল, নিশীথবাবু আপনিআপনি করে কথা বলছিলেন। অবশ্য খোনা-গলা লোকটার কথা বলার ধরনে ভিখিরিসুলভ কোনো ব্যাপারই নেই, বরং বেশ কর্তৃত্বের সুর প্রকাশ পাচ্ছিল।

মোটা লোকটা ব্যাগ নামানোর পর যেন মুক্তি পেয়ে বলল, চলুন যাওয়া যাক।

নিশীথবাবু এবারও তার কথায় কান দিলেন না। বরং আস্তে-আস্তে চালাঘরের ভেতরে ঢুকে বেঞ্চিতে বসলেন। অন্য লোক দুটো তার সামনে হেঁটে উলটোদিকের বেঞ্চিতে বসল। তৃতীয় লোকটি, যে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে, বডিগার্ডের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিশীথবাবু বসে ওদের দিকে তাকালেন, কী হল, তোমরা ওখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? অগত্যা অনিমেষকে চালাঘরে ঢুকতে হল, ও বুঝতে পারল মোটা লোকটি বেজারমুখে ওর সঙ্গে আসছে।

বেঞ্চিতে বসামাত্র কাঠের আগুনের ওম ওদের শরীরে লাগল। বাইরে যে হিম বাতাস বইছিল তার চেয়ে এই উত্তাপ অনিমেষের কাছে আরামদায়ক মনে হল। মোটা লোকটি অনেক ইতস্তত করে বেঞ্চিতে বসল। তার বসবার প্রনটা সবার নজরে পড়েছিল, কারণ এই সময় খোনা লোকটি বলে উঠল, চিন্তা করবেন না, যে-সমস্ত রোগী সংকামক তারা এই বেঞ্চিতে বসে না। আপনি স্বচ্ছন্দে বসুন।

অনিমেষ এতক্ষণে সবার সামনের দিকে তাকাল। তার অনুমানই ঠিক, যার নাক নেই সে এতক্ষণ কথা বলছিল। নিশ্চয়ই এ হল মোড়ল, আর দাঁত-বের-করা লোকটি ওর সহকারী। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চেহারাগুলো ক্রমশ ওর সহ্য হয়ে গেল। অভ্যাস হয়ে গেলে সবকিছু একসময় মেনে নেওয়া যায়। এই সময় মোড়ল খোনা গলায় বলল, খোকা, খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে, নৌকো করে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে।

অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না।

নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আপনাদের এখানে কতজন আছেন?

একশো তিনজন ছিলাম আজ সকাল পর্যন্ত, একজন একটু আগে মারা গিয়েছে। কেন বলুন তো? আপনারা কি সরকারি লোক? লোকটি এখনও একটাও কথা বলেনি, শুধু তখন থেকে সে অন্যমনস্কভাবে তার ঝোলা আলটা মুচড়ে যাচ্ছিল।

নিশীথবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না, আমরা কংগ্রেস থেকে রিলিফ দিচ্ছি। সরকারি লেভেলে এসব করতে সময় লাগে।

মোড়ল বলল, ও একই হল। কংগ্রেস আর সরকার তো আলাদা নয়। তা সরকার তো আমাদের সাহায্য দেয় না; শহরে ভিক্ষে করতে গেলে পুলিশ ঝামেলা করে।

নিশীথবাবু বললেন, সবে তো আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখনও সব দিক সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। চিন্তা করবেন না, আমি গিয়ে ডি সির সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলব।

মোড়ল বলল, ভালো খক ভালো। তারপর সে তার বডিগার্ডকে বলল, এদের খাবার ব্যবস্থা করো, এত দূর থেকে এসেছেন আমাদের উপকার করতে।

সঙ্গে সঙ্গে নিশীথবাবু বলে উঠলেন, না না, আপনাদের ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমরা ফিরে গিয়ে খাব।

মোড়ল বলল, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। তিনজন লোক আমাদের সবার জন্য রাধে। তাদের অসুখ আছে, কিন্তু তা একদম সংক্রামক নয়। আজ পাঁচ বছর হল অসুখ তাদের বাড়েনি।

নিশীথবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমরা এই রুটি গুড় খাচ্ছি। মাথা ঘুরিয়ে তিনি মোটা লোকটিকে বললেন, কিছু রুটি আর গুড় ব্যাগ থেকে বের করে আনো তো! :
 
তড়াক করে মোটা লোকটা উঠে গিয়ে ব্যাগের মুখ খুলতে লাগল। যদি এদের রান্না-করা খাবার খেতে হয় সেজন্য সে এক মুহূর্ত ব্যয় করতে রাজি ছিল না। অনিমেষ দেখল আকাশ আবার কালো। হয়ে আসছে।

নিশীথবার বললেন, আচ্ছা, আপনাদের এখানে যত লোক আছেন তাদের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ। কজন? মানে মুখচোখ দেখে বোঝা যায় না তাদের অসু হয়েছে, আমি এরকম লোকের সংখ্যা জানতে চাইছি।

বিকৃত মুখচোখ হলেও বোঝা গেল মোড়ল খুব অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। কয়েক মুহূর্ত তাকে ভাবতে দেখল অনিমেষ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এভাবে বলা মুশকিল।

নিশীথবাবু বললেন, তরু–।

মোড়ল বলল, এই রোগ হয়েছে জানলেই আপনারা সংসার থেকে বার করে দেন, তা আজ মুখচোখ খেয়ে যায়নি এরকম লোকের সন্ধান করছেন, উদ্দেশ্যটা কী?

নিশীথবাবু বললেন, আমরা একটা জিনিস চিন্তা করেছি, তাতে আপনাদের উপকার হবে।

মোড়ল বলল, উপকার পেলে কে না নিতে চায় বলুন! তবে তেমন বিশ্বাস হয় না। এই দেখুন, এতদিন কেউ আসেনি এখানে, রাখালগুলো গোরু চরাতে পাশের মাঠে এসে লক্ষ রাখত যেন কোনো গোরু দলছাড়া হয়ে এখানে না ঢুকে পড়ে। তা এখন এত জল, বৃষ্টি হল, চারধারে ভেসে গেল মানুষ-এই এখন আপনারা এলেন খাবার নিয়ে। আবার শুনছি উপকারও হবে–কী জানি!

মোটা লোকটি খাবার নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। ব্যাগের মধ্যে কী কী ছিল দেখেনি অনিমেষ। এখন মোটা লোকটি ওর হাতে একটা লালচে হাফ পউরুটি আর এক ঢেলা আখের গুড় দিতে ও নিশীতবাবুর দিকে তাকাল। নিশীথবাবুরও তা-ই বরাদ্দ এবং তিনি তা স্বচ্ছন্দে খেতে আরম্ভ করেছেন। মোটা লোকটি ইচ্ছে করেই চারটে রুটি এনেছে যাতে নিজেরটা শেষ করে সে চটপট অতিরিক্তটা খেতে পারে। দুপুরবেলায় আজ অবধি সে ভাত চাড়া কোনোদিন অন্যকিছু খায়নি। খুব ছোটবেলায় কারও বাড়িতে দুপুরে রুটি হলে ও মনে হত তারা খুব গরিব, ভাত খাওয়ার সামর্থ্য। নেই। এই পরিবেশে ওর এতক্ষণ খিদেবোধটা ছিল না, কিন্তু শুকনো রুটিতে একটা কামড় দিতেই মনে হল পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে। এখন এই খিদের মুখে ওর মনে হল এত ভালো খাবার অনেকদিন সে খায়নি।

নিশীথবাবু বললেন, আপনারা খাবেন না?

মোড়ল বলল, আমরা দুবার খাই। উদয় এবং অস্তকালে। আপনারা চিন্তা করবেন না। এখানে কত রুটি আছে।

নিশীথবাবু একটা আনুমানিক সংখ্যা বললে মোড়ল হাত নেড়ে বডিগার্ডকে ডেকে ফিসফিস করে কিছু বলতেই সোজা দূরের জটলার কাছে চলে গেল। শুকনো রুটি গলায় আটকে যাচ্ছিল, একটু জলে পেলে হত। কিন্তু মোটা লোকটা ফিসফিস করে বলল, খবরদার, জল খাবেন না। কলেরা হবে। লালা দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে গিলে ফেলুন।

এমন সময় অনিমেষ দেখল বডিগার্ডটার পেছনে পেছনে সমস্ত কুষ্ঠরোগী উঠে আসছে। মোটা লোকটা ফিসফিসিয়ে বলল, চলেন এইবেলা যাই।

এগিয়ে-আসা দলটার দিকে তাকিয়ে মোড়ল বলল, আমাদের এখানে একুশজন মেয়েছেলে আছে। তার মধ্যে সাতজন বুড়ি-তেমন হাঁটাচলা করতে পারে না, যে মারা গেছে সেটা মেয়েছেলে-বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল।

নিশীথবাবু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, তার স্বামীও এখানে আছেন?

মোড়ল বলল, আছে তবে খুঁজে বের করা যাবে না।
 
বডিগার্ড ততক্ষণে ওদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটা বিরাট সাপের মতো হয়েসেটা মাঠময় কিলবিল করছে। অনিমেষ ফোঁসফোঁস শব্দ শুনে শুনে দেখল মোটা লোকটি তার পাশে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এখন অনিমেষের আর সেই ভয়-ভয় ভাবটা নেই। সে স্থিরচোখে লোকগুলোকে দেখল। মেয়েরা আছে, তবে তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাধা। এতক্ষণ লক্ষ করেনি, এখন অনিমেষ দেখল বডিগার্ডের ডান হাত থেকে মাঝে-মাঝে টপটপ কমে রক্ত মাটিতে পড়ছে। ওর হঠাৎ সেই অনেকদিন আগের এক সকালবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তিস্তার ওপর নৌকোয় বসে সে আঙলহীন যে-মানুষটির হাত ধরে বাঁচিয়েছিল সে কি এখানে আছে? কুষ্ঠরোগীরা কতদিন বাঁচে। সেই লোকটা কি এখন বেঁচে নেই অনিমেষ এখনও চোখ বন্ধ করলে তার সেই চিৎকারটা শুনতে পায়, কেন বাঁচালি? কেন বাঁচালি? অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়ে লাইনটাতে ভালো করে সেই মানুষটিকে খুঁজতে লাগল। এমন সময় ওর নজরে পড়ল মাঠের শেষপ্রান্ত যেখানে এতক্ষণ মানুষগুলো বসেছিল সেখানে একটা শরীর ময়লা কাপড় মুড়ি দিয়ে টানটান হয়ে শওয়ে আছে। যে-মেয়েটির কথা একটু আগে মোড়ল বলছিল সে মাঠের ওপর মরে পড়ে আছে। মরে যাওয়া মানে বেঁচে যাওয়া-মাঝিটার সেই কথা এখন ভীষণরকম সত্যি বলে মনে হল অনিমেষের।

গুঞ্জন থেকে হইচই শুরু হয়ে গেল আচমকা। সবাই এগিয়ে এসে আগে ব্যাগটার কাছে পৌঁছতে চায়। বডিগার্ড চিৎকার করে তাদের সামাল চেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার একার পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব। অনিমেষ মুখগুলো দেখল, প্রত্যেকটি মুখ কিছু পাবার আশায় বীভৎস হয়ে উঠেছে। শেষতক মোড়ল উঠে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে ক্রমশ হইচইটা কমে এল। মোড়ল চিৎকার করে তাদের থামতে বলে কথা শুরু করল, এইসব, খাবার আমাদের জন্য। এই বাবুরা কংগ্রেস থেকে আমাদের জন্যে এত ভেঙে নিয়ে এসেছেন। কেউ কেড়ে নেবে না, সবাই পাবে। যে বেয়াদপি করবে আমি তাকে ক্ষমা করব না। প্রত্যেকে লাইন দিয়ে খাবার নিয়ে যাও।

সাধারণ দেখতে এই লোকটির এত প্রভাব নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না অনিমেষ। সবাই চুপচাপ এসে খাবার নিতে লাগল। বডিগার্ড এক-একটা রুটিকে কয়েক টুকরো করে কিছু চিড়ের সঙ্গে ওদের হাতে দিচ্ছিল। এই সময় মোড়ল ফিরে এসে নিশীথবাবুকে বলল, এইবেলা আপনি দেখে নিন প্রত্যেককে আপনার কাজে লাগবে কি না। নিশীথবাবু বোধহয় একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন, এখন সোজা হয়ে বসে ওদের লক্ষ করতে লাগলেন। তিনি খুব খুশি হচ্ছে না মুখ দেখে। বোঝা গেল।

এক এক করে সবার নেওয়া হয়ে গেল। শেষের দিকে কয়েকজন বুড়ি বোধ হয় খুব কম। পেয়েছিল। তারা গুঁইগুই করতে টুপটাপ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বুড়িগুলো পড়িমড়ি করে নিজেদের চালাঘরের দিকে ছুটে গেল। ওদের যাওয়ার ভঙ্গি দেখে কষ্ট হল অনিমেষের। এমন সময় দূর থেকে চিৎকার ভেসে এল। কারা যেন কাউকে ডাকছে। মোড়ল বলল, আপনাদের সঙ্গীরা বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়েছে। নিশীথবাবু মোটা লোকটিকে বললেন, ওদের গিয়ে বলো, আমরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি।

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র মোটা লোকটি প্রাণপণে দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। বৃষ্টি এলে নৌকোয় ওরা ফিরবে কী করে? অনিমেষ নিশীথবাবু দিকে তাকাল। তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। মোড়ল বলল, এখন বৃষ্টি হবে না। তা আপনি যা চেয়েছিলেন পেয়েছেন?

নিশীথবাবু মাথা নাড়তে সে বলল, পাওয়া যায় না কখনো। আমরাও বোধহয় আর আপনার উপকার পেলাম না, কী বলেন?

নিশীথবাবু বললেন, তা কেন! তবে যা দেখলাম তাতে জন-পনেরোর বেশি লোক পাওয়া যাবে না। মেয়েরা অবশ্য কাজে লাগতে পারে, তবে দেখতে হবে হাতের আঙুলগুলো ঠিক আছে কি না।

মোড়ল বলল, তাও হল না, সব মজে গেছে। গিয়ে ভালোই হয়েছে, প্রাণ বেরিয়ে যেত পুরুষগুলোর। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলবেন বাবু?

নিশীথবাবু বললেন, তেমন-কিছু নয়, যদি প্রয়োজন হয় এসে বলে যাব।

মোড়ল হাসল, আপনারা আর আসবেন না। এখান থেকে যে যায় সে আর আসে না।
 
নিশীথবাবু কথাটার জবাব দিলেন না, অনিমেষকে ইঙ্গিত করে চালাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর পেছনে যেতে গিয়ে অনিমেষের নজর পড়ল মোড়লের সঙ্গীর দিকে। এতক্ষণ সে একটাও কথা বলেনি, শুধু একনাগাড়ে হাতে হেঁড়া আঙুলটা মুচড়ে যাচ্ছিল। নিশ্চয়ই এটা ওর মুদ্রাদোষ, কিন্তু এরকম বীভৎস মুদ্রাদোষের ওপর এতক্ষণ চোখ রাখতে পারেনি অনিমেষ। এখন দেখল পাক খেয়ে খেয়ে আঙুলটার ঝুলে-থাকা চামড়াটা চুপচাপ খসে গিয়ে সেটা লোকটার অন্য হাতে উঠে এসেছে। প্রচণ্ড নাড়া খেল অনিমেষ। নিজের একটা আঙুল হাতের তালুতে নিয়ে লোকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সামান্যক্ষণ দেখল, তারপর সেটাকে ছুটে ইটের চৌহদ্দিতে জ্বলা আগুনের ভেতর ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা চামড়া-পোড়া গন্ধ বের হল সেখান থেকে। খুব জোর পা চালিয়ে অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এল। লোকটা তখন আগুনের কাছে ঝুঁকে পড়ে তার আঙুলটা দেখছে। চট করে নিজের আঙুলের দিকে তাকাল অনিমেষ।

মোড়ল বলল, চললেন?

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন।

মোড়লের যেন কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, যাওয়ার আগে একটু কষ্ট করতে হবে যে! আমার সঙ্গে একটু আসুন।

নিশীথবাবু অবাক হলেন, কেন? কী ব্যাপার?

মোড়ল কোনো উত্তর না দিয়ে ওদের ইঙ্গিতে আসতে বলে সামনের এক ঝুপসিঘরের দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। ওর বডিগার্ড তখনও ওদের পাশে দাঁড়িয়ে। নিশীপবাবু যেন বাধ্য হয়েই বললেন, চলো দেখে আসা যাক।

মাঠটা পেরিয়ে ছোট ঝুপসিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোড়ল বাইরে থেকে চিৎকার করে ডাকল, ক্ষেন্তি ও ক্ষেত্তি, বাচ্চাটাকে নিয়ে বাইরে আয়।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বউ বাইরে বেরিয়ে এল। তার সর্বাঙ্গ কাপড়ে মোড়া, মাথার মোমটা বুক অবধি নেমে আসায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। কোলের ওপর একগাদা কাপড়ের স্তুপের ওপর একটা লালচে রঙের শিশু শুয়ে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে।

মোড়ল একটু দূর থেকে ঝুঁকে পড়ে বাচ্চাটাকে চুকচুক শব্দ করে আদর করল। তারপর নিশীথবাবুর দিকে ফিরে মাঠের শেষপ্রান্তে শুয়ে-থাকা মৃতদেহটিকে দেখিয়ে বলল, ওর মেয়ে। কী সুন্দর মুখোনা দেখুন।

অনিমেষ দেখল, সত্যি একটা ফুলের মতো মেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। এত হাত পা মুখ চোখ সব নিখুঁত, কোথাও অসুস্থতার চিহ্ন নেই। পৃথিবীর আর যে-কোনো মানুষের বাচ্চার মতো সম্পূর্ণ সুস্থ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

মোড়ল বলল, একে নিয়ে যাবেন?

নিশীথবাবুর মুখের দিকে তাকাল অনিমেষ, তিনি ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েছেন। মুখচোখ কেমন হয়ে গেছে। কোনোরকম বললেন, দোখ, কথা বলে দেখি।

মোড়ল বলল, আপনি যেরকম চাইছিলেন ঠিক সেরকম না। তার চেয়ে বেশি বলতে পারেন। মুখ চোখ হাত আঙুল সব ঠিক আছে। বাবু একে নিয়ে যান, নইলে একদিন ও আমাদের মতো হয়ে যাবে! আপনি যা চেয়েছিলেন পেয়ে গেলেন বাবু।

নিশীথবাবু এবার ঘুরে দাঁড়ালেন, আমি গিয়ে খবর দেব। এসো অনিমেষ।

আর দাঁড়ালেন না তিনি, হনহন করে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ওঁকে যেতে দেখে অনিমেষও পা চালাল। পেছনে মোড়লের গলা ভেসে এল, কী এল, কী হল বাবু, ও বাবু অনিমেষ নিশীথবাবুর সঙ্গে জঙ্গলটার কাছে পৌঁছে গিয়ে দেখল মোড়ল দুহাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে আদর করছে। বডিগার্ডটা ওদের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাসছে আর চালাঘরের মধ্যে আগুনের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সেহ লোকটা এখনও তার আঙুলটাকে পুড়ে যেতে দেখছে।

ততক্ষণে অনিমেষ কথা বলল, বাচ্চাটা দেখতে খুব সুন্দর। নিয়ে এলে ওকে বাঁচানো যেত হয়তো। আপনি তো এইরকম চাইছিলেন।

জঙ্গল পেরিয়ে নৌকোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিশীথবাবু কেন এলেন কিছুতেই বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। জলপাইগুড়ি শহরে বা গ্রামে তো সেরকম মানুষ অনেক আছে। নাকি সেসব মানুষ নিশীথবাবুর কথা সবসময় শুনবে না, এদের পেলে সুবিধে হত? নৌকোয় বসে হিম বাতাসে কি না জানে না, অনিমেষের সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল আচমকা।
 
সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী বিপুল ভোটে বিরোধীদের পরাজিত করে নির্বাচিত হয়ে গেলেন। লোকসভার প্রার্থী অপেক্ষাকৃত অখ্যাত, কিন্তু তাকেও জিততে কিছু ব্লেগ পেত হ না। সেই বন্যার পর থেকে অনিমেষ আর বংগ্রেস অফিসে যায়নি, ফাইনাল পরীক্ষার চাপটা যেন পাহাড়ের মতো রাতারাতি ওর ওপর এসে পড়েছিল। সরিৎশেখর রাতদিন লক্ষ রেখেছিলেন বাইরের দিকে যেন ওর মন না যায়। নাতির পরীক্ষা নয়, যেন তিনি নিজেই স্কুল ফাইনাল দিচ্ছেন। নিশীথবাবু কয়েকবার লোক পাঠিয়েছিলেন অনিমেষকে ডাকতে, সরিৎশেখর সযত্নে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বন্যার সময়ে অনিমেষ যে-অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছল তার ফলে রাজনীতিতে ওর আগ্রহটা যেন হঠাই মিইয়ে গেল। ওর খুব মনে হয়েছিল এই নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী জিততে পারবে না। রাজনীতি করতে গেলে মিথ্যা কথা বলতে হয়, শঠতা ছাড়া রাজনীতি হয় না-এসব ব্যাপার এর আগে এমন চোখে আঙুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয়নি। নিশীথবাবুর মুখের কথা আর কাজের ধারার মধ্যে এত পার্থক্য-ব্যাপারটা মেনে নিতে ওর কষ্ট হচ্ছিল।

দুপুরে মণ্টু আর তপন মাঝে-মাঝে ওদের বাড়িতে আসত টেস্ট পেপার সলভ করতে। মণ্টুদের ও সেই অভিজ্ঞতার কথাটা বলেছিল। এই প্রথম সে নিশীথবাবুর সমালোচনা বন্ধুদের কাছে করল। ব্যাপারটা অনিমেষকে যতটা উত্তেজিত করেছিল মণ্টুকে তার কিছুই করল না। ইদানীং মণ্টু একদম পালটে গেছে। আগের মতো গা-জোয়ারি ভাবটা একদম নেই। মেয়েদের আলোচনার আর করে না। একসময় ও দাদার কাছ থেকে শুনে এসে কমিউনিস্ট পার্টির কথা বলত মাঝে-মাঝে, এখন তাও বলে না। নিশীথবাবুর কথা শুনে ও নির্লিপ্তের মতো বলল, এসব ব্যাপার নিয়ে তুই কেন ভাবছিস, তোর ভোট আছে?

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল, ভোট নেই বলে আমরা ভাবব না। কংগ্রেসকে কোথায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে বল তো! এই দল একসময় কারা করেছিল, ভেবে দ্যাখ!

মণ্টু বলল, আমার মাকে ছেলেবেলায় দেখেছি, কী সুন্দর দেখতে ছিল, চোখ জুড়িয়ে যেত। আর এখন রোগা হয়ে গিয়ে চামড়া ঝুলে গেছে, হাড় বেরিয়ে গেছে-এখন দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না মা এককালে সুন্দরী ছিল। তাই বলে হা-হুতাশ করে মাকে আমি আবার সুন্দরী করতে পারব? এখন যেরকম সময় সেরকম ভাবাই ভালো।

কথাটা ভাবতে ভাবতে অনিমেষ বলল, কিন্তু এরকম চললে আমাদের দেশের কোনো উন্নতি হবে?

মণ্টু খিঁচিয়ে উঠল, ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিস না তো! এই দেশ কি তোর পৈতৃক সম্পত্তি যে তুই ভেবে মরছিস! ধর তুই যদি তিনবার স্কুল ফাইনাল ফেল করিস, তোর দাদু যদি আর না পড়ায়, তা হলে কী করছি? কংগ্রেস তোকে দেখবে? কোনো বড় নেতার বাড়িতে গেলে তার ছেলেমেয়ে তোকে ভ্যাগাবণ্ড ভাববে! ওসব ছাড় অনিমেষ।

তপন ফিক করে হেসে বলল, হাঁস খেটেখুটে ডিম পাড়ে, আর দারোগবাবু ওমলেট খায়।

মণ্টু বলল, ঠিক। আগে নিজের কেরিয়ার তৈরি কর, তারপর অন্য কথা। দ্যাখ-না, বিরাম কর কেমন ম্যানেজ করে এখান থেকে কেটে পড়ল। শুনছি কলকাতার বরানগরে বাড়ি কিনেছে। মেনকার বিয়ে হয়ে গেছে এক বড়লোকের সঙ্গে। নিশীথবাবুর কী হল? হোল লাইফ শালা জেলা স্কুলে মাস্টারি করে কাটাবে।

জীবনে এই প্রথম অনিমেষ চিন্তা করল, ও যদি ভালোভাবে পাশ না করতে পারে তা হল কী হবে! দাদু আজকাল প্রায়ই বলেন, ফার্স্ট ডিভিশন হলে কলকাতায় পাঠাবেন-বাব নাকি এরকম প্রতিজ্ঞা দাদুর কাছে করে গেছেন। দাদুর ইচ্ছা অনিমেষকে ইংরেজির এম-এ হতে হবে অথবা আইন পাশ করবে অনিমেষ-এ-বংশে যা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারত না কোনোদিন। এই অবস্থায় যদি ওর রেজাল্ট খারাপ হয়! অনিমেষ মনেমনে বলল, তা কখনো হবে না, হতে পারে না। আজ অবধি সে কখনো খারাপ কিছু করেনি, খারাপ কিছু হতে পারে এরকম চিন্তা করতে ওর কষ্ট হয়। মণ্টুর দিকে তাকাল সে। কী করে বড়দের মতো ও যে-কোনো কাজ করার আগে দুটো দিক ভেবে নেয়।

হঠাৎ মণ্টু বলল, আচ্ছা অনি, তোর জীবনের অ্যাম্বিশন কী?

ভ্রূ কোঁচকাল অনিমেষ, অ্যাম্বিশন?

মণ্টু বলল, হ্যাঁ। তবে এইম অভ লাইফ বলে এসেটা মুখস্থ বলিস না।
 
চট করে জবাব দিতে পারল না অনিমেষ। সত্যি তো, কোনোদিন সে ভেবে দেখেনি বড় হয়ে কী করবে। কেউ চাকরি করে, কেউ ডাক্তার ইঞ্চিনিয়ার বা উকিল হয়। আবার কেউ-কেউ রাজনীতি করে মন্ত্রী হয়ে যায়। ব্যবসা করে বড়লোক হচ্ছে অনেকে। আবার চাকরি বা ব্যবসা করে সাধারণ মানুষ হয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাতে অনেককেই সে দেখছে চারপাশে। এককালে, কেউ যদি ওকে এই প্রশ্ন করত তা হলে সে চটপট করার দিত, দেশের কাজ করব। কিন্তু এখন-অনিমেষের একটা লেখার কথা মনে পড়ল। কার লেখা এই মুহূর্তে মনে নেই। মানুষ এবং জন্তুর মূল পার্থক্য হর, জন্তু চিরকাল জন্তই থেকে যায়। দুহাজার বছর আগে একটা গোরু যেভাবে ঘাস খেত, দিন কাটাত, আজও সেভাবেই সে ঘাস খায়, দিন কাটায়। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন যে-জ্ঞান অর্জন করে সেটা সে তার সন্তানের জন্য রেখে যায়। সে যেখানে শেষ করছে তার সন্তান সেখান থেকে শুরু করে। এই যে এগিয়ে যাওয়া, তার নামই হল উত্তরণের পথে পা বাড়ানো এবং সেটা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আফ্রিকার গভীর অরণ্যে সভ্যতার সংস্রবহীন যে-মানুষ আদিগন্তকাল একইভাবে জীবন কাটাচ্ছে তার মতো হতভাগ্য আর কেউ নেই। প্রকৃত সভ্য মানুষ এগিয়ে যাবে। তা-ই যদি হয়, তা হলে আমাদের পূর্বপুরুষ যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন আমরা তার চেয়ে আরও উন্নত কোনো উপায়ে কাটাব। যেভাবে. ওঁরা দেশের কথা ভেবেছেন, দেশের উন্নতির স্বপ্ন দেখেছেন, অথচ সে-সময় প্রতিকূল পরিবেশে তা অসম্ভব থেকে গেছে-আজ আমরা তা সব করব। কিন্তু শুধু একজন ডাক্তার, ইঞ্চিনিয়ার বা ব্যবসায়ী। হয়ে কি তা সম্ভব! আমরা যাদের উত্তরাধিকারী তাদের কাছে কী জবাব দেব সুভাষচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, দেশব, বুবদ্রিনাথ-এরা তো কেউ চাকরি করেননি কখনো। অন্যের চাকর হয়ে কি স্বাধীনভাবে দেশের কথা ভাবা যায়!

মণ্টু আর তপন একদৃষ্টিতে অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনিমেষ যে প্রশ্নটার উত্তর দিকে পারছে না এতে ওরা মজা পাচ্ছিল। মণ্টু বলল, কী রে, ধ্যান করছিস নাকি?

তপন বলল, আমার ঠিকুজিতে লেখা আছে আমিনাকি খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার হব।

ঠিকুজির কথা শুনে অনিমেষের চট করে শনিবার মুখটা মনে পড়ে গেল। শনিবাবা বলেছিলেন যে, আঠারো বছর বয়সে সে জেলে যাবে। আর অনেক অনেক বছর আগে অন্নপ্রাশনের সময় ও নাকি বই ধরেছিল-দাদু বলেছিলেন, বড় হলে এ আইনজ্ঞ হবে। এসব নিতান্তই ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। ওর। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলল, ভবিষ্যতে কে কী হবে আগে থেকে বলা যায়?

মণ্টু বলল, তবু লক্ষ্য তো থাকবে একটা, না হলে এগোবি কী করে?

অনিমেষ হাসল, তুই এবার সেই রচনার ভাষায় কথা বলছিস।

মণ্টু বলল, আমি ঠিক করেছি যদি ফার্স্ট ডিভিশন পাই তা হলে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হয়ে আই এসসি পড়ব। আমাকে ডাক্তার হতে বলে।

সেই রাতে অনিমেষ চুপচাপ ছাদে চলে এল। এখন শীত যাবার মুখে, সামান্য চাদর হলেই চলে যায়। সরিৎশেখর হেমলতা অনেকক্ষণ শুয়ে পড়েছেন। রাত বারোটা নাগাদ সরিৎশেখর পাশের ঘর থেকে একবার গলা তুলে বললেন, এবার শুয়ে পড়ো। ছাদে দাঁড়িয়ে সে একআকাশ তারা দেখতে পেল। এইসব তারার দিকে তাকালে একসময় ও মাকে দেখতে পেত। এখন হঠাৎ ওর সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই ছাদেই মা পড়ে গিয়েছিলেন, আঠারো বছর বয়সে জেলে যাবার কথা শুনে মা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। অনিমেষ দূরের বাঁধ পেরিয়ে নিরীহ বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে-থাকা তিস্তা নদীকে দেখল। দুমাসেই কাশগাছ গজিয়ে গেছে। কারা যেন মাইকে এখনও শহরের পথে-পথে ভোট চেয়ে আবেদন করে যাচ্ছে। আজ রাত বারোটার পর আর প্রচার চলতে না। অনিমেষ তারাদের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেলল, আমি বড় হয়ে কী হব? এই হিম-মাখা রাত, ঝকমকে তারার আকাশ, তিস্তার বুক থেকে উঠে-আসা নিশ্বাসের মতো কিছু বাতাস অনিমেষের প্রশ্নটা শুনে গেল চুপচাপ। খুব গভীর কোনো দুঃখ বুকের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে-খেতে যেন চলকে উঠল, অনিমেষ দেখল একটা তারা টুক করে খসে গিয়ে কী দ্রুত নেমে যেতে-যেতে অন্য একটা তারার বুকে মুখ লুকোল। সমোহিতের মতো ছাদময় পায়চারি করতে করতে একটা শব্দের সঙ্গে মনেমনে মারামারি করতে লাগল-জানি না, জানি না।
 
নির্বাচনে বামপন্থি প্রার্থী হেরে যাবার পর কংগ্রেস বিরাট বিজয়মিছিল বের করেছিল। খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেনি অনিমেষ। নির্বাচনের আগে অবধি ও শুনে আসছে সবাই কংগ্রেস সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করছে। ইংরেজ আমলে এর চেয়ে সবাই সুখে ছিল, জিনিসপত্রের দাম যেরকম আকাশছোয়া হয়ে গেছে তাতে সাধারণ মানুষ বাঁচতে পারে না। আর এসব কথাই বামপন্থিরা প্রকার করছিল একটু অন্যরকম সংলাপে। ফলে অনিমেষ ভেবেছিল এই নির্বাচনে কংগ্রেস একদম মুছে যাবে। কিন্তু বিপুল সমর্থন পেয়ে জিতেছে শুনে প্রথমে যে-স্বস্তিটা ওর এসেছিল, ক্রমশ তা থিতিয়ে গেলে নিজের কাছেই নিজে কোনো জবাব পেল না। তা হলে মানুষ যত কষ্ট পাক, যত গালাগালি দিক তবু কংগ্রেসকেই ভোট দেবে। বামপন্থিদের, বোঝাই যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। বন্যার সময় যে-রাজনীতি দেখে এসেছে, সাধারণ মানুষ সেসর জানলেও বোধহয় বিশ্বাস করতে চায় না। এমনকি সরিৎশের পর্যন্ত ভোট দেবার আগে কংগ্রেসকে লক্ষবার গালাগাল করে জোড়া বলদেই চাপ দিয়ে এলেন। জলপাইগুড়িতে কাস্তে ধানের শিষে সোনালি রোদ আর পড়ল না। এরকমটা যে হবে তা বোধহয় সবার আগে বামপন্থিরাই খবর রাখত। তাই নির্বাচন শেষ হবার পরপরই তারা আবার আন্দোলন নেমে পড়ল-যেন নির্বাচনের রায়ে তাদের কিছু এসে যায় না।



এতদিন ধরে জেলা স্কুলে চেনা গণ্ডিতে পরীক্ষা দিয়েছে অনিমেষ। সেখানকার পরিবেশ একরকম আর এবার ফাইনাল দিতে গিয়েও ভীষণরকম অবাক হয়ে গেল। চার-পাঁচটা স্কুলের ছেলেরা পাশাপাশি পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে অনিমেষের পামের ছেলেটি সমানে খুঁচিয়ে যাচ্ছে তাকে কাতা দেখাবার জন্য। ছেলেটির গালভরতি দাড়ি, বয়স হয়েছে। অনিমেষ বিরক্তি প্রকাশ করতে সে বলল, আট বছর হল ভাই, এবার পাশ করতে হবেই। বলে কোমর থেকে বই বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল, উত্তরগুলো দাগিয়ে দাও।

আপনি নকল করবেন? কোনোরকমে কথাটা জিজ্ঞাসা করল সে। জেলা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে নকল করার রেওয়াজ নেই। বড়জোর কেউ-কেউ হাতের চেটোয় কিছু-কিছু পয়েন্ট লিখে আনত। একবার একটি ছেলে মুদির দোকানের স্লিপের মতো কাগজে খুদি-খুদি করে উত্তর লিখে এনেছিল, সুশীলবাবু তাকে ধরতে পেরে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। ছেলেটিকে ট্রান্সফার নিতে হয়েছিল। ওই ধরনের কাগজকে বলা হয় চোখা, মণ্টুর কাছ থেকে জেনেছিল অনিমেষ। অত খুদিখুদি করে লিখতে যে পরিশ্রম এবং সময় দরকার হয় সে-সময় উত্তরটা সহজেই মুখস্থ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দেবার সময় এই ছেলেটির দুঃসাহস দেখে তাজ্জব হয়ে গেল।
 
ছেলেটি মুখ খিঁচিয়ে বলল, কোত্থেকে এলে চাঁদ, সতীত্ব দেখানো হচ্ছে! পেছনে চেয়ে দ্যাখো, টুকলির বাজার বসে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে অনিমেষ দেখল কথাটা একবর্ণ মিথ্যে নয়। ফসফস করেই বই-এর পাতা ছেঁড়ার শব্দ; খাতার তলায় কাগজ ঢুকিয়ে ঝুঁকে পড়ে যারা লিখছে তাদের কাছে যাদের কাছে উত্তর নেই তারা ক্রমাগত অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছে শেষ হয়ে গেলে দেবার জন্য। জেলা স্কুলের আরও কয়কটি ছেলে ছিল ঘরটাতে, অনিমেষ দেখল তারা যেন কিছুই ঘটছে না এরকম ভঙ্গিতে উত্তর লিখে যাচ্ছে। যে-ভদ্রলোক গার্ড দিচ্ছিলেন তিনি এখন চেয়ারে বসে মোহন সিরিজের একটা বই পড়ছেন তন্ময় হয়ে। বইটার নাম দেখতে পেল ও, হতভাগিনী রমা।

সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল অনিমেষের। সবাই যদি বই দেখে নকল করে লেখে তা হলেকেউ ফেল করবে না। এইসব মুখ কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি-ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার-সব জায়গায় নকল করে পাশ করা যায়? যদি যায় তা হলে ওরা তো কিছুইনা-জেনে যে যার মতো বড় হয়ে যাবে। এক মুহূর্তের জন্য অনিমেষের মনে হল ওর মাথায় কিছু নেই-ও একটাও উত্তর লিখতে পারবে না। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকল সে। পাশের ছেলেটি বোধহয় ভাবগতিক দেখে সুবিধে হবেনা বুঝতে পেরেছিল, নিজের মনেই উচ্চারণ করল, কী মালের পাশেই সিট পড়ল এবার!

অনিমেষ শুনল সে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, স্যার, পেচ্ছাপ করতে যাব।

গার্ড ভদ্রলোক বই থেকে মুখ না তুলে বললেন, এক ঘণ্টা হয়নি এখনও।

ছেলেটি বলল, এক ঘন্টা অবধি চেক করতে পারব না।

যাও।

শোনামাত্রই ছেলেটা বেরিয়ে গেল। অনিমেষ দেখল যাবার সময় সে উত্তরপত্রটা জামার ভেতর ঢুকিয়ে নিল। দ্বিতীয় ঘন্টার শেষে বাথরুমে গিয়েছিল সে। বাথরুমটা যেন পড়ার ঘর হয়ে গিয়েছে। যারা আসছে তারা কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। বিভিন্ন আকারের কাগজের টুকরো থেকে বই-এর পাতার স্কুফ হয়ে গেছে সেখানে। সেই ছেলেটিকে এখান দেখতে পেল না সে। কিছুই বলার নেই, অনিমেষের লজ্জা করছিল সেখানে জলবিয়োগ করতে। কোনো গার্ড বা কর্তৃপক্ষের কেউ একবারও তদারকিতে আসছেন না এদিকে। অনিমেষ ফিরে আসছে, মণ্টুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এক রুমে সিট পড়েনি ওদের, মণ্টু ওকে জিজ্ঞাসা করল, কটা বাকি আছে তোর?

অনিমেষ বলল, তিনটে!

খুব সিরিয়াস মুখচোখ করে মণ্টু বলল, তাড়াতাড়ি কর, সময় নেই বেশি।

অনিমেষ মাথা নেড়ে বলল, কী অবস্থা দ্যাখ, এরকম টুকলিফাই চলে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

মণ্টু গম্ভীরমুখে বলল, যারা করছে করুক, তোর কী?

অনিমেষ ফিরে এসে সিটে বসতেই একটা অভিনব কাণ্ড হয়ে গেল। ও দেখল ওর খাতাটা ডেস্কে নেই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এপাশ-ওপাশ দেখতে ও প্রথমে ঠাওর করতে পারল না খাতাটা কোথায়। এমন সময় পেছনের ছেলেটি চাপা গলায় ওকে বলল, লাস্ট বেঞ্চিতে নিয়ে গেছে। অনিমেষ দেখল দুটি ছেলে পাশাপাশি শেষ বেঞ্চিতে বসে একটা খাতা থেকে খুব দ্রুত টুকে যাচ্ছে। ও মোহন সিরিজের দিকে তাকাল, ভদ্রলোক টানটান হয়ে আছেন। ভীষণ রাগ হয়ে গেল অনিমেষের, দ্রুত শেষ বেঞ্চিতে গিয়ে চট করে খাতাটা কেড়ে নিল। আচমকা খাতাটা উঠে যাওয়াতে ছেলে দুটি হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যে একজন দ্রুত নিজেকে সামলে বলল, শেষ লাইনটা বলে দাও শুরু। কথাটা বলার মধ্যে এমন একটা রোয়ারি ছিল, অনিমেষ থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ওকে মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি বলল, কেন ওরকম করছ, আরে আমাকে চিনতে পারছ না? কংস অফিসে দেখা হয়েছিল, মনে নেই। আমরা ভাই-বেরাদার।

এমন সময় পেছন থেকে একটা চিৎকার কানে এল, অ্যাই, হোয়াট আর ইউ ড়ুয়িং দেয়ার? কী নাম তোমার, নম্বর কত? মোহন সিরিজ বইটাকে এক আঙুলে চিহ্নিত করে দ্রুত ছুটে এসে অনিমেষের সামনে দাঁড়ালেন, অ্যাই, তোমার সিট কোথায়?

ভীষণ নার্ভাস হয়ে অনিমেষ বলল, সামনের দিকে।

তা এখানে কী করছ? নকলবাজি। আমার ক্লাসে সেসব একদম চলবে না। কোন স্কুল তোমার, নম্বর কত বলো? তর্জনী তুলে গর্জন করলেন জ্বলোক।

আমার খাতা এরা নিয়ে এসেছিল—আমি কিছু জানি না। অনিমেষ কোনোরকম বলল। একটা ভয় আচমকা ওকে ঘিরে রল এইবার। এই ভদ্রলোক যদি রেগেমেগে ওরেক ক্লাস থেকে বের করে দেন, অথবা ওর নামে নালিশ করেন, তা হলে চিরকালের জন্য ও ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেল। নির্ঘাত ফেল করিয়ে দেবে ওকে।

খাতা নিয়ে এসেছিল আর আমি দেখলাম না, ইয়ার্কি। কে এনেছিল? ভদ্রলোক ফুঁসে উঠলেন।

এই সময় সেই এসেছিল আর আমি দেখলাম না, ইয়ার্কি! কে এনেছিল? ভদ্রলোক ফুঁসে উঠলেন।
 
এই সময় সেই কংগ্রেস অফিসের ছেলেটি উঠে দাঁড়াল, আমি স্যার, এই টেবিলের পাশে কাতাটাকে উড়ে আসতে দেখে তুলে রাখলাম। যা বাতাস চারধারে।

বাতাস বাতাস কোথায়? ফ্যান তো বন্ধ। আর উড়ে এল যখন তখন আমায় বললে না কেন? আর উড়ল কেন? তুমি কোথায় ছিলে?

ভদ্রলোক কী করবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। অনিমেষ ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার কথা মনে। কী চমৎকার মিথ্যে কথা বলে ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ওর মনে হল এই মুহূর্তে ছেলেটার কথায় সায় না দিলে বাঁচাবার উপায় নেই। ও বলল, বাথরুমে গিয়েছিলাম আমি। সেসময়

কী খাও যে এত ঘনঘন বাথরুম পায়। কিন্তু আমাকে বলনি কেন?

গার্ড আবার ছেলেটির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। হাসি চেপে ছেলেটি বল, স্যার, আপনার রমার বোধহয় খুব বিপদ তাই ডিস্টার্ব করতে চাইনি।

হকচকিয়ে গেলেন:ভদ্রলোক, আঁ, আমার মা? ওঃ হ্যা; তা বটে। ঠিক আছে, যে যার সিটে ফিরে যাও। আমার ঘরে কোনো আনফেয়ার ব্যাপার চলবে না।1.

যেমন এসেছিলেন তেমনি দ্রুত ফিরে গেলেন ভদ্রলোক। অমিমেষ নিজের সিটে যাবার জন্য সময় ছেলেটি আবার ডাকল, কই, লাস্ট লাইনটা হোক, আফটার অল আমরা এক পার্টির লোক।

অগত্যা অনিমেষকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের খাতা থেকে এক নম্বর প্রশ্নটার শেষ লাইনটা ফিসফিস করে পড়ে যেতে হল।



সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরছিল। এটা ঠিক সেই উত্তরবঙ্গীয় বৃষ্টি, যা কিনা এঁটুলির মতো দিনরাতের গায়ে সেঁটে বসে থাকে। রাত্তিরবেলায় ঝমঝমিয়ে আকাশ ভেঙে পড়ে, আবার সকালবেলায় ছিচকাঁদুনে মেয়ের মতো সুচ বেঁধায়। জেলা স্কুলের লম্বা ঢাকা-বারান্দায় অনিমেষরা সেই সকাল থেকে গুলতানি মারছিল। খবর আছে আজ রেজাল্ট বের হবে।

অবশ্য এরকম গত কয়েক দিন ধরে রোজই আসছে। হঠাৎ কেউ বলল, রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে-হোট ঘোট স্কুলে-কোথায় কী! গতকাল রেডিওতে নাকি বলেছে এ-বছর পার্সেন্টেজ খারাপ নয়। আবার আজ সকালে হেডমাস্টার মশায় এসে বললেন, দারুণ খবর আছে তার কাছে, মার্কশিট না এলে তিনি কিছু বলবেন না।

কদিন থেকে উত্তেজনাটা বুকের মধ্যে দলা পাকাচ্ছিল-যদি খারাপ হয় তা হলে কী হবে?

সরিৎশেখর গতকাল রেডিওতে কলকাতায় ফল বেরিয়ে গেছে শুনে আর ঘুমুতে পারেননি। সারারাত ছটফট করেছেন। ভোরবেলায় উঠেই অনিমেষকে বলেছেন, রেজাল্ট বের হলে অবশ্যই যেন সে বাড়িতে চলে আসে। আজকে তার বেড়াতে যাওয়া হল না। হেমলতা ভোরবেলায় বাবার হাঁকডাকে উঠে পড়ে একশো আটবার জয় নাম লিখে একমনে জয়গুরু বলে যাচ্ছেন। অনিমেষ যখন বেরুচ্ছে তখন একটা কাগজ ভাঁজ করে তার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। অনিমেষ গেট খুলে বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে একবার পেছন ফিরে দেখল দাদু আর পিসিমা বাইরের বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। দাদুর দুই হাত জোড় করে বুকের ওপর রাখা, পিসিমার ঠোঁট দুটো নড়ছে।

হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল ওর। চুপচাপ করে একা বাঁধের ওপর দিয়ে জেলা স্কুলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওর মনে সেই ভয়টা চট করে ফিরে এল। যদি সেই গার্ড ভদ্রলোক মুখে কিছু না বলে চুপিচুপি ওর নামে রিপোর্ট করে দেন তা হলে কী হবে! আর-এ হয়ে গেলে সে এই বাড়িতে ফিরে আসবে কী করে? অনিমেষ মনেমনে ঠিক করল, যদি সেইরকম হয় তা হলে সে ওই ভদ্রলোককে ছেড়ে দেবে না, তার জন্য যদি তাকে জেলে যেতে হয় তো তা-ই হোক। জেলে যাবার কথা মনে হতেই শনিবাবার ভবিষ্যদ্বাণী মনে পড়ে গেল ওর। যাঃ, আঠারো বছর হতে ওর তো এখনও দুই বছর বাকি আছে। কিন্তু ভয়টা কিছুতেই ওকে ছেড়ে যাচ্ছিল না, অস্বস্তিতা থেকেই গেল।

মুখচোখ সবারই শুকনো। ফিনফিনে বৃষ্টির জলে সবারই জামাকাপড় সঁতসেঁতে। বেরুবার আগে পিসিমা ছাতির কথা বলেছিলেন, ছাতি নিয়ে বের হলে বন্ধুরা খ্যাপায়-একথাটা পিসিমাকে বলে-বলে বোঝাতে পারে না সে। সকাল নটা বেজে গেল, এমনও মার্কশিট এল না। তপন বলল, আচ্ছ খেলাচ্ছে মাইরি, ভাল্লাগে না! যা করবি করে ফ্যাল!
 
অর্ক সিগারেট ধরাল। এই প্রথম স্কুল-কম্পাউন্ডে বসে অনিমেষ কাউকে সিগারেট খেতে দেখল। তপন বলল, অ্যাই অর্ক, কী হচ্ছে

অর্ক কেয়ার করল না, বেশ করছি, খাবার জিনিস খাচ্ছি। পারলে হেড়ুকে বল আমায় রাস্টিকেট করতে।

সেটা আর সম্ভব নয় এখন এই মুহূর্তে, সবাই মেনে নিল। জেলা স্কুলের কারওর ওদের ওপর কর্তৃত্ব এখন বুক ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে ও যেভাবে রিং বানাতে লাগল তাতে বোঝাই যায় ও এব্যাপারে বেশ পোক্ত। এই সময় নিশীথবাবু স্কুলে এলেন। ওদের সামনে দিয়ে যেতে-যেতে অনিমেষকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন, তোমাদের রেজাল্ট এসে গেছে। একটু পরেই স্কুলে এসে যাবে। অনিমেষকে মাথা নিচু করতে দেখে বললেন, কী, খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছ মনে হচ্ছে। কষ্ট করে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। এমন সময় উনি বোধহয় অর্ককে দেখতে পেলেন। অর্ক সেইরকম ভঙ্গিতে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে, নিশীথবাবুকে দেখে একটু সঙ্কোচ করছে না। চলে যাওয়ার আগে তিনি একটু হেসে বলরেন, আর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে পারলে না?

অনিমেষ দেখল, অর্কের মুখটা হঠাৎ কেমন হয়ে গেল। নিশীথবাবু চলে যাওয়ার পর ওর হাতেই সিগারেট জ্বলে-জ্বলে ছোট হয়ে যেতে লাগল। মুখে কিছু না বললেও আর যেন টানতে পারছিল না। আবার কী আশ্চর্য, সিগারেটটা ফেলে দিতেও ওর যেন কোথায় আটকাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত ওদের চোখের সামনে দিয়ে একজন স্যার রেজাল্টের কাগজপত্র নিয়ে হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরে ঢুকে গেলেন। দমবন্ধ উত্তেজনায় সবাই ছটফট করছে। স্কুলের টেকা দারোয়ান অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে, সে কাউকে ভেতরে যেতে দেবে না! ওদের পুরো ১টা হেডমাস্টারমশাইর ঘরে সামন দাঁড়িয়ে অথচ কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। এই সময় আনিমেষ লক্ষ করল, ওর হাতের তেলোয় চটচটে ঘাম জমছে-অদ্ভুত দুর্বল লাগছে শরীরটা। এর মধ্যে একজন স্যার এসে বলে গেলেন ওদের রেজাল্ট নাকি ভালো হয়েছে, মার্কশিট দেখে প্রত্যেকের ফলাফল। নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে-সেটাই একটু বাদে নোটিসবোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। মণ্টু, অনিমেষ এবং তপন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। মণ্টু বলল, লাস্ট ডে ইন স্কুল!

তপন ঘাড় নাড়ল, যদি শালা গাড্ডা মারি-অহঙ্কার করলে উলটোটা হয়। আর এই সময় বৃষ্টিটা নামল আর-একটু জোরে। ছাট আসছিল বারান্দায়-ওরা সরে সরে নিজেদের বাঁচাচ্ছিল। তপন আবার কথা জুড়ল, আমাদের কার দুঃখে আকাশ কাঁদছে কে জানে! শুনেছি অমঙ্গল কিছু এলে প্রকৃতি জানিয়ে দেয়।

তারপর দরজা খুলে গেল হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরের। তিনি বাইরে এলেন। এখন বর্ষাকাল, তবু তিনি গলাবন্ধ সাদা অংকোট পরেছেন। ওঁর পেছনে ভূগোল-স্যার। তার হাতে একটা বিরাট কাজ ভাজ করা। নোটিসবোর্ডের দিকে ওদের এগিয়ে যেতে সবাই নীরবে পথ করে দিল। সেখানে। হেডমাস্টার ঘুরে দাঁড়ালেন। সামনে দাঁড়ানো উদগ্রীব মুখগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে তিনি যেন। সামান্য কাঁপতে লাগলেন, এইমাত্র তোমাদের ফলাফল এসেছে-এ খবর তোমরা নিশ্চয়ই পেয়েছ। আজ আমার, আমাদের স্কুলের সবচেয়ে আনন্দের দিন। তোমরা জান, এ-বছর আমি রিটায়ার করব-যাবার আগে আমি যে-গৌরবের মুকুট তোমাদের কাছ থেকে পেলাম তা চিরকাল মনে থাকবে। আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, এই সময় তার কণ্ঠস্বর চড়ায় উঠে কাঁপতে লাগল, আমার স্কুলের কেউ অকৃতকার্য হয়নি। তোমরা আমার মুখ উজ্জ্বল করেছ। সঙ্গে সঙ্গে যেন পাথরচাপা একরাশ নিশ্বাস আনন্দের অভিব্যক্তি হয়ে প্রচণ্ড আওয়াজে ছড়িয়ে পড়ল। হেডমাস্টারমশাই দুহাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বললেন। শব্দ একটু ম্রিয়মাণ হলে তিনি বাঁহাতে গলার বোতামটা ঠিক করতে করতে বললেন, এ ছাড়া আর-একটি খবর আছে। আমাদের স্কুল থেকে একজন এই বছর স্কুল ফাইনালে দ্বিতীয় হয়েছে-এই জেলা থেকে আজ অবধি কেউ সে-সম্মান পায়নি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top