চালাঘরের ঠিক মাঝখানে বেঞ্চিগুলোর গায়ে ইটের গোল চৌহদ্দিতে আগুন জ্বলছে। কাঠের আগুন। ইটগুলো উঁচু বলে ওরা দূর থেকে এটাকে লক্ষ করেনি। আগুনটা এইভাবে জ্বলছে, কী কাজে লাগে কে জানে!
আপনারা কেন এসেছেন?
একটু খোনা-খোনা গলায় দুজনের একজন কথা বলল। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল না, তবে অনুমান করল নিশ্চয়ই হাতহীন লোকটি প্রশ্নটা করেছে। নিশীথবাবু নিশ্চয়ই একটু দমে গিয়েছিলেন, কারণ উত্তরটা দিতে তিনি ইতস্তত করছেন বোঝা গেল, মানে, চারধারে বন্যার জলে সব ভেসে গেছে, আপনারাও নিশ্চয়ই খাবার পাননি, আমরা রিলিফ নিয় বেরিয়েছি–তাই চলে এলাম।
উত্তরটা শুনে খোনা-খোনা গলা বলল, ভালোই হল। আমাদের অবশ্য দুদিনের খাবার মজুত ছিল-কী আছে ওতে?
নিশীথবাবুর আদেশের জন্য ওরা অপেক্ষা করল না, ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখানে বসার কী দরকার, এবার চলে গেলই হয়। অনিমেষ লক্ষ করছিল, নিশীথবাবু আপনিআপনি করে কথা বলছিলেন। অবশ্য খোনা-গলা লোকটার কথা বলার ধরনে ভিখিরিসুলভ কোনো ব্যাপারই নেই, বরং বেশ কর্তৃত্বের সুর প্রকাশ পাচ্ছিল।
মোটা লোকটা ব্যাগ নামানোর পর যেন মুক্তি পেয়ে বলল, চলুন যাওয়া যাক।
নিশীথবাবু এবারও তার কথায় কান দিলেন না। বরং আস্তে-আস্তে চালাঘরের ভেতরে ঢুকে বেঞ্চিতে বসলেন। অন্য লোক দুটো তার সামনে হেঁটে উলটোদিকের বেঞ্চিতে বসল। তৃতীয় লোকটি, যে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে, বডিগার্ডের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিশীথবাবু বসে ওদের দিকে তাকালেন, কী হল, তোমরা ওখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? অগত্যা অনিমেষকে চালাঘরে ঢুকতে হল, ও বুঝতে পারল মোটা লোকটি বেজারমুখে ওর সঙ্গে আসছে।
বেঞ্চিতে বসামাত্র কাঠের আগুনের ওম ওদের শরীরে লাগল। বাইরে যে হিম বাতাস বইছিল তার চেয়ে এই উত্তাপ অনিমেষের কাছে আরামদায়ক মনে হল। মোটা লোকটি অনেক ইতস্তত করে বেঞ্চিতে বসল। তার বসবার প্রনটা সবার নজরে পড়েছিল, কারণ এই সময় খোনা লোকটি বলে উঠল, চিন্তা করবেন না, যে-সমস্ত রোগী সংকামক তারা এই বেঞ্চিতে বসে না। আপনি স্বচ্ছন্দে বসুন।
অনিমেষ এতক্ষণে সবার সামনের দিকে তাকাল। তার অনুমানই ঠিক, যার নাক নেই সে এতক্ষণ কথা বলছিল। নিশ্চয়ই এ হল মোড়ল, আর দাঁত-বের-করা লোকটি ওর সহকারী। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চেহারাগুলো ক্রমশ ওর সহ্য হয়ে গেল। অভ্যাস হয়ে গেলে সবকিছু একসময় মেনে নেওয়া যায়। এই সময় মোড়ল খোনা গলায় বলল, খোকা, খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে, নৌকো করে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে।
অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না।
নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আপনাদের এখানে কতজন আছেন?
একশো তিনজন ছিলাম আজ সকাল পর্যন্ত, একজন একটু আগে মারা গিয়েছে। কেন বলুন তো? আপনারা কি সরকারি লোক? লোকটি এখনও একটাও কথা বলেনি, শুধু তখন থেকে সে অন্যমনস্কভাবে তার ঝোলা আলটা মুচড়ে যাচ্ছিল।
নিশীথবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না, আমরা কংগ্রেস থেকে রিলিফ দিচ্ছি। সরকারি লেভেলে এসব করতে সময় লাগে।
মোড়ল বলল, ও একই হল। কংগ্রেস আর সরকার তো আলাদা নয়। তা সরকার তো আমাদের সাহায্য দেয় না; শহরে ভিক্ষে করতে গেলে পুলিশ ঝামেলা করে।
নিশীথবাবু বললেন, সবে তো আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখনও সব দিক সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। চিন্তা করবেন না, আমি গিয়ে ডি সির সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলব।
মোড়ল বলল, ভালো খক ভালো। তারপর সে তার বডিগার্ডকে বলল, এদের খাবার ব্যবস্থা করো, এত দূর থেকে এসেছেন আমাদের উপকার করতে।
সঙ্গে সঙ্গে নিশীথবাবু বলে উঠলেন, না না, আপনাদের ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমরা ফিরে গিয়ে খাব।
মোড়ল বলল, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। তিনজন লোক আমাদের সবার জন্য রাধে। তাদের অসুখ আছে, কিন্তু তা একদম সংক্রামক নয়। আজ পাঁচ বছর হল অসুখ তাদের বাড়েনি।
নিশীথবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমরা এই রুটি গুড় খাচ্ছি। মাথা ঘুরিয়ে তিনি মোটা লোকটিকে বললেন, কিছু রুটি আর গুড় ব্যাগ থেকে বের করে আনো তো! :
আপনারা কেন এসেছেন?
একটু খোনা-খোনা গলায় দুজনের একজন কথা বলল। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল না, তবে অনুমান করল নিশ্চয়ই হাতহীন লোকটি প্রশ্নটা করেছে। নিশীথবাবু নিশ্চয়ই একটু দমে গিয়েছিলেন, কারণ উত্তরটা দিতে তিনি ইতস্তত করছেন বোঝা গেল, মানে, চারধারে বন্যার জলে সব ভেসে গেছে, আপনারাও নিশ্চয়ই খাবার পাননি, আমরা রিলিফ নিয় বেরিয়েছি–তাই চলে এলাম।
উত্তরটা শুনে খোনা-খোনা গলা বলল, ভালোই হল। আমাদের অবশ্য দুদিনের খাবার মজুত ছিল-কী আছে ওতে?
নিশীথবাবুর আদেশের জন্য ওরা অপেক্ষা করল না, ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখানে বসার কী দরকার, এবার চলে গেলই হয়। অনিমেষ লক্ষ করছিল, নিশীথবাবু আপনিআপনি করে কথা বলছিলেন। অবশ্য খোনা-গলা লোকটার কথা বলার ধরনে ভিখিরিসুলভ কোনো ব্যাপারই নেই, বরং বেশ কর্তৃত্বের সুর প্রকাশ পাচ্ছিল।
মোটা লোকটা ব্যাগ নামানোর পর যেন মুক্তি পেয়ে বলল, চলুন যাওয়া যাক।
নিশীথবাবু এবারও তার কথায় কান দিলেন না। বরং আস্তে-আস্তে চালাঘরের ভেতরে ঢুকে বেঞ্চিতে বসলেন। অন্য লোক দুটো তার সামনে হেঁটে উলটোদিকের বেঞ্চিতে বসল। তৃতীয় লোকটি, যে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে, বডিগার্ডের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিশীথবাবু বসে ওদের দিকে তাকালেন, কী হল, তোমরা ওখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? অগত্যা অনিমেষকে চালাঘরে ঢুকতে হল, ও বুঝতে পারল মোটা লোকটি বেজারমুখে ওর সঙ্গে আসছে।
বেঞ্চিতে বসামাত্র কাঠের আগুনের ওম ওদের শরীরে লাগল। বাইরে যে হিম বাতাস বইছিল তার চেয়ে এই উত্তাপ অনিমেষের কাছে আরামদায়ক মনে হল। মোটা লোকটি অনেক ইতস্তত করে বেঞ্চিতে বসল। তার বসবার প্রনটা সবার নজরে পড়েছিল, কারণ এই সময় খোনা লোকটি বলে উঠল, চিন্তা করবেন না, যে-সমস্ত রোগী সংকামক তারা এই বেঞ্চিতে বসে না। আপনি স্বচ্ছন্দে বসুন।
অনিমেষ এতক্ষণে সবার সামনের দিকে তাকাল। তার অনুমানই ঠিক, যার নাক নেই সে এতক্ষণ কথা বলছিল। নিশ্চয়ই এ হল মোড়ল, আর দাঁত-বের-করা লোকটি ওর সহকারী। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চেহারাগুলো ক্রমশ ওর সহ্য হয়ে গেল। অভ্যাস হয়ে গেলে সবকিছু একসময় মেনে নেওয়া যায়। এই সময় মোড়ল খোনা গলায় বলল, খোকা, খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে, নৌকো করে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে।
অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না।
নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আপনাদের এখানে কতজন আছেন?
একশো তিনজন ছিলাম আজ সকাল পর্যন্ত, একজন একটু আগে মারা গিয়েছে। কেন বলুন তো? আপনারা কি সরকারি লোক? লোকটি এখনও একটাও কথা বলেনি, শুধু তখন থেকে সে অন্যমনস্কভাবে তার ঝোলা আলটা মুচড়ে যাচ্ছিল।
নিশীথবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না, আমরা কংগ্রেস থেকে রিলিফ দিচ্ছি। সরকারি লেভেলে এসব করতে সময় লাগে।
মোড়ল বলল, ও একই হল। কংগ্রেস আর সরকার তো আলাদা নয়। তা সরকার তো আমাদের সাহায্য দেয় না; শহরে ভিক্ষে করতে গেলে পুলিশ ঝামেলা করে।
নিশীথবাবু বললেন, সবে তো আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখনও সব দিক সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। চিন্তা করবেন না, আমি গিয়ে ডি সির সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলব।
মোড়ল বলল, ভালো খক ভালো। তারপর সে তার বডিগার্ডকে বলল, এদের খাবার ব্যবস্থা করো, এত দূর থেকে এসেছেন আমাদের উপকার করতে।
সঙ্গে সঙ্গে নিশীথবাবু বলে উঠলেন, না না, আপনাদের ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমরা ফিরে গিয়ে খাব।
মোড়ল বলল, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। তিনজন লোক আমাদের সবার জন্য রাধে। তাদের অসুখ আছে, কিন্তু তা একদম সংক্রামক নয়। আজ পাঁচ বছর হল অসুখ তাদের বাড়েনি।
নিশীথবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমরা এই রুটি গুড় খাচ্ছি। মাথা ঘুরিয়ে তিনি মোটা লোকটিকে বললেন, কিছু রুটি আর গুড় ব্যাগ থেকে বের করে আনো তো! :