What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

টেলিফোনটা বাজল কিন্তু অর্ক দেখল নাম্বারটা অচেনা। ল্যান্ডলাইন থেকে কেউ কল করেছে। সে সাড়া দিতেই কুন্তীর গলা কানে এল। কী করছেন? এখন তো আপনাদের ভাল থাকার কথা।

অর্ক হাসল, আমাদের মানে?

ছাড়ুন। শুনুন, আমি একটা অফার পেয়েছি। ভাবছি, অ্যাকসেপ্ট করব। কুন্তী বলল, আপনি কী বলেন?

আমি তো কিছুই জানি না, কী উত্তর দেব? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ওহো! আজ কীরকম ব্যস্ত আছেন? আসুন না কথা বলি।

বেশ তো। কোথায়?

আমাদের বাড়িতেই আসুন। মা তো আপনাদের কথা জানে। একটু দূর হবে, আসতে আপত্তি নেই তো?

উত্তর থেকে দক্ষিণ, এমন কী দূর! নিশ্চয়ই যাব।

কুন্তী তাকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে যেতে হবে। ঠিক হল কাজের পরে অর্ক সোজা পাতাল রেল ধরে চলে যাবে।

সারাদিন ধরে অন্য অস্বস্তি। মোবাইলে সেই কলটা এল না। অস্বস্তি বাড়িতেও। অর্ক বুঝতে পারছিল তারা তিনজন এখন প্রায় তিনটে দ্বীপের মতো। অনিমেষ অতিরিক্ত চুপচাপ, বাড়ির বাইরে এখন একদম বের হয় না। মা মুখ বুজে সংসারের কাজ করে যাচ্ছে। অর্কর সঙ্গে কথা বলে দুবেলা খাবার দেওয়ার সময়ে। বাকি সময় বই নিয়ে বসে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কুন্তীর ফোন শীতল বাতাসের আরাম দিল অর্ককে।

এখন নির্বাচনী প্রচার বন্ধ। পশ্চিমবঙ্গ যেন সুচের ওপর দাঁড়িয়ে। সমস্ত মিডিয়া বুঝতে পারছে বিশাল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভাবনাটা ভুল হয়ে যেতেও তো পারে। বিরোধী নেত্রী তাঁর শেষ নির্বাচনী সভার পরে বলেছেন, আর পশ্চিমবাংলায় দলতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথে রাজ্য চলবে। মানুষের জীবন যাতে একটু সুস্থভাবে চলে তার জন্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। তার প্রথম কাজ হবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। চৌত্রিশ বছরের বাম কুশাসনের অবসান হলে তিনি কোনওরকম বদলার রাজনীতি করবেন না।

অর্ক এই প্রতিশ্রুতিতে খুব খুশি হল। কলকাতাকে লন্ডন বা দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড করা সম্ভব নয় তা যে-কোনও শিশুও জানে। কিন্তু কথাটাকে সাধারণ অর্থে নিলে ভুল হবে। নেত্রী বলতে চেয়েছেন ওই দুই জায়গার মতো উন্নত এবং সুন্দর চেহারা তিনি দিতে চাইবেন। বিরোধীরা সেটা বুঝেও অপব্যাখ্যা করছে। যদিও অর্কর কাজের দফতরের প্রধান ঠাট্টা করেছিলেন, আমি তো দুবার লন্ডনে গিয়েছি। কলকাতাকে যদি লন্ডন করে দেওয়া হয় তা হলে সেটা হবে খুব দুর্ভাগ্যের। কারণ লন্ডনের রাস্তায় নোংরা পড়ে থাকতে দেখেছি, ছেঁড়া কাগজ উড়ছে ফুটপাতে। চারপাশে ঘিঞ্জি এলাকা। ট্রাফালগার স্কোয়ারের চারপাশে প্রায় সবসময় ট্র্যাফিক জ্যাম হয়ে থাকে। একশো বছর আগের লন্ডন আর এখনকার লন্ডনের মধ্যে কোনও মিল নেই। হয়তো ভদ্রলোক ঠিক বলেছেন। কিন্তু অর্কর মনে হচ্ছিল, শহরটা নয়, লন্ডন নামটার যে মাহাত্ম আছে তার কথাই ভেবে বলেছেন নেত্রী। বিশ্বজিত্রাও তাই বলেছিল। এখন ওরা খুব টেনশনে রয়েছে। কথা বলতে এসেছিল বিশ্বজিৎ, অর্কা, যা ভাবছি তা হবে তো? না হলে সুরেন মাইতির দল আমাদের পাড়া ছাড়া করবে।

আমি নিশ্চিত, এবার পরিবর্তন হবেই। অর্ক বলল।

কেন? কেন আপনি এত নিশ্চিত? বিশ্বজিৎ তাকাল।
 
এই প্রথম এত বড় একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যিনি তিনি মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত বা ধনী পরিবার থেকে রাজনীতি করতে আসেননি। তাঁর সাজ পোশাক এমনকী পায়ের চটিও বাংলার সাধারণ গরিব মানুষের অভ্যস্ত জীবনের সঙ্গে জড়িত। এই প্রথম সান অব দ্য সয়েল হাল ধরেছেন আন্দোলনের। কথাটা পালটে ডটার অফ দ্য সয়েল বলাই ঠিক। মানুষ তো চোখ খুলে এটা দেখছে। তাই ঘরের মানুষের সঙ্গেই এবার রাজ্যের মানুষ থাকবে। দেখে নিয়ে। অর্ক বলল।

আপনার কথা যেন ঠিক হয় দাদা। বিশ্বজিৎ খুশি হল।

কুন্তীর বাড়িতে পৌঁছাতে অসুবিধে হল না। দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা অর্কর খুব সড়গড় নয় তবু কুন্তীর বর্ণনা শুনে একটুও ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। দোতলা বাড়ি, গলির মুখে। দরজার সামনে লোহার খাঁচায় তালা ঝুলছে। হাত গলিয়ে বেলের বোতামে চাপ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে ওপরের ব্যালকনি থেকে বৃদ্ধার গলা ভেসে এল, কে?

দুপা পিছিয়ে অর্ক মুখ তুলে দেখল খাটো চেহারার বেশ ফরসা এবং অতি বয়স্কা মহিলা নীচের দিকে দেখার চেষ্টা করছেন।

সে সামান্য গলা তুলে বলল আমার নাম অর্ক। কুন্তী আছেন?

না। সে বাইরে গেছে। কিছু বলতে হবে? বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন।

আমাকে এই সময় আসতে বলেছিলেন। অর্ক বলল।

দাঁড়াও। ওর মা কলে গিয়েছে, জিজ্ঞাসা করে দেখি। বৃদ্ধা ভেতরে চলে গেলেন। উত্তর কলকাতায়, বিশেষ করে রাজাবাজার-শোভাবাজার অঞ্চলে এই শব্দগুলো এককালে খুব চালু ছিল। বাথরুম মানে কলঘর, লুচি মানে ময়দা, স্নান করতে যাওয়া মানে নাইতে যাওয়া, মাথা না ভিজিয়ে শরীরে জল ঢালা মানে গা ধোওয়া। বাঙালরা, মানে যাদের দেশ পূর্ববঙ্গে ছিল, এই ভাষাভাষীদের ঘটি বলে হাসাহাসি করত। ঘটিরাও বাঙালদের প্রচুর খুঁত ধরত। মায়ের কাছে শুনেছিল অর্ক। গত তিরিশ বছরে এই বিভাজন উধাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধা অবশ্যই ওই ঘটি সম্প্রদায়ের একজন। কিন্তু কুন্তী বাড়িতে নেই আর বৃদ্ধার মেয়ে বাথরুমে, এর অর্থ কী? বৃদ্ধা কি কুন্তীর ঠাকুমা আর যিনি এখন বাথরুমে তিনি মা? কুন্তী কিন্তু ঠাকুমার কথা তাকে বলেনি। বলেছে মা একা থাকেন এই বাড়িতে।

মিনিট তিনেক বাদে মাধবীলতার বয়সি এক মহিলা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেই বোঝা যায় বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা। বললেন, আপনি অর্ক? কুন্তী বলেছিল যে আপনি আসতে পারেন। জরুরি দরকারে ও একটু বেরিয়েছে এখনই এসে পড়বে।

তা হলে আমি কি পরে আসব? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বুঝতেই পারছেন আপনাকে আগে দেখিনি তো! বাড়িতে আমরা দুজন মহিলা আছি। আমার মনে হয় মিনিট কুড়ির মধ্যে এসে যাবে। মহিলা বললেন।
 
অর্ক মাথা নেড়ে বাড়ির সামনে থেকে সরে বড় রাস্তায় চলে এল। না। এতে ক্ষুণ্ণ হওয়ার কোনও কারণ নেই। আগে মানুষ ভদ্রতা সৌজন্যবোধ ইত্যাদিকে এত গুরুত্ব দিত যে নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করত না। কিন্তু প্রতারিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত সতর্ক না হয়ে উপায় থাকল না। যে-কোনও লোক নিজেকে অর্ক বলে ওই বাড়ির বেল টিপতে পারত। ওঁরা দরজা খুলে দিলে সর্বনাশ করতে কতটা সময় লাগত? মাধবীলতা মাঝে মাঝে অনিমেষকে যা বলত তা মনে পড়ে গেল অর্করা বলত, নকশাল আন্দোলন করে কার কী লাভ হল জানি না তবে মানুষের মন থেকে অনেকগুলো বোধ খুন করে গিয়েছিল। ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যবোধ, পরস্পরকে সম্মান জানানোর মানসিকতা। মানুষ এখন তাই আত্মসর্বস্ব হয়ে গিয়েছে। কথাগুলো কতটা সঠিক অর্ক জানে না। তবে মা যে-কোনও ভাঙনের জন্যে নকশাল আন্দোলনকেই প্রথম দায়ী করে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই কুন্তীকে দেখতে পেল অর্ক। একটু দ্রুত হাঁটছে। সে সামনে দাঁড়াল, আস্তে, আস্তে।

ওঃ এসে গেছেন, সরি, খুব দুঃখিত। কতক্ষণ এসেছেন? কুন্তী বিব্রত।

এই তো! অর্ক হাসল।

একটা ওষুধের জন্যে সাতটা দোকান ঘুরতে হল।

কীসের ওষুধ?

প্রেশারের। রোজ যা খেতে হয় তা শেষ হওয়ার পর কেনার কথা কেন যে এঁদের মনে পড়ে! দিদি নাকি প্রায়ই সেটা ভুলে যান। চলুন।

কুন্তীর ব্যাগে চাবি ছিল, তাই দিয়ে প্রথমে খাঁচা পরে দরজার তালা খুলে বলল, চলুন, ওপরে গিয়ে বসি।

অর্ক দেখল নীচেও বসার ঘর রয়েছে। কিন্তু সে কুন্তীকে অনুসরণ করে ওপরে উঠে এল। পরপর তিনটি ঘর, সামনে সুন্দর বারান্দা ব্যালকনি। বারান্দার এক পাশে বসার ব্যবস্থা। কুন্তী বলল, বসুন!

ঠিক তখনই কুন্তীর মা এবং দিদিমা বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে, কুন্তী বলল, এই নাও তোমার ওষুধ। কুড়ি দিন চলে যাবে। পনেরো দিনের মাথায় কেনার কথা বলবে। খুব হাঁটিয়েছ আজ।

বৃদ্ধা ছেলেমানুষের হাসি হাসলেন। এই বয়স তো হাঁটার। দে–।

ওষুধের প্যাকেট দিয়ে কুন্তী পরিচয় করাল।

কুন্তীর মা বললেন, বসো। তোমার বাবার কথা ওঁর মুখে শুনেছি। উনি এখন কেমন আছেন?

একটা পা তো সেই থেকেই জখম। তবে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে পারেন। আপনারাও বসুন। অর্ক বসল।

বসার পরে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে কে কে আছেন?

বাবা মা আর আমি। অর্ক শেষ কবে এই প্রশ্ন শুনেছে মনে পড়ল না। কুন্তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন, কী করো তুমি?

আমি একটা ল্যাবরেটরিতে চাকরি করি। অর্ক জবাব দিল।

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ে থা করেছ নিশ্চয়ই। ছেলেমেয়ে কী?

অর্ক হেসে ফেলল, বিয়ে করা হয়নি।

ওমা! কেন? বৃদ্ধা অবাক।

কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করেনি। অর্ক মজা করে বলল।

ও তাই তো। দিদিমা হাসলেন, আজকাল শুনি ছেলেরা বিয়ে করে না, মেয়েরাই বিয়ে করে। তা মা-বাবা চাপ দেননি?

কুন্তী কথা বলল, আচ্ছা দিদা, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুমি নাক গলাচ্ছ কেন? কত মানুষ তো বিয়ে করে না। বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, এঁরা কি বিয়ে করেছেন?
 
দেশের জন্যে কাজ করতে ওঁদের নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না, বিয়ে করবেন কখন? তবে শুনেছি, বিধানবাবু নাকি কাউকে ভালবাসতেন, তাঁকে না পেয়ে সারাজীবন আইবুড়ো থেকে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধা বললেন।

নাও শুরু হল গল্প! কুন্তী মন্তব্য করল।

তুমি কি রাজনীতি করো? কুন্তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্ক মুখ খোলার আগেই কুন্তী বলল, আগে রাজনীতির ধারে কাছে থাকত না। কিছুদিন আগে একটু সমস্যায় পড়েছিল। এখন সেটাকে কাটিয়ে পরিবর্তনের পথে হাঁটছে।

অর্ক অবাক হল। কিছুদিন আগে, রামজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে যেদিকে যাচ্ছিল তার ইঙ্গিত কুন্তী পেল কী করে! সে বলল, পুরোটা ঠিক নয়। আমি এখনও সক্রিয় রাজনীতি করি না। তবে তিন দশকের ওপর বামপন্থীরা যা করতে পারেনি তা যদি তৃণমূল করতে পারে তা হলে তাদের সমর্থন না করার কোনও কারণ দেখি না। পরিবর্তন যদি সামান্য ভাল এনে দেয় তা মানুষেরই লাভ।

দিদিমা বললেন, ঠিক বলেছ বাবা। আমি তো মেয়েটাকে সবসময় দুহাত তুলে আশীর্বাদ করি। ওইটুকু মেয়ে কিন্তু তার কী তেজ!

কুন্তীর মা বললেন, সব ভাল কিন্তু কথায় কথায় অত ইংরেজি বলার কী দরকার? ওই ইংরেজি শিখলে বাচ্চারা তো পরীক্ষায় ফেল করবে! আচ্ছা জাপানি বা চিনেরা শুনেছি মাতৃভাষায় কথা বলে, আমাদের দেশের তামিল তেলেগুভাষী নেতারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ইংরেজি ব্যবহার করে । তা হলে বাঙালির সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা বললে দোষ কী! গরমেন্ট না বলে সরকার বললেই তো হয়।

দিদিমা রেগে গেলেন, তোর স্বভাব হল সবসময় অন্যের খুঁত ধরা। না হয় একটু আধটু ভুল ইংরেজি বলছে কিন্তু কাজটা কী করছে তা দ্যাখ। কার এই কাজ করার হিম্মত আছে?

কুন্তীর মা হেসে ফেললেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা কথা বলো। আমি কাজ সারি। মা, তুমি ওষুধ খেয়ে নাও।

ও হ্যাঁ। বসো বাবা। দিদিমা মেয়েকে অনুসরণ করলেন।

অর্ক কুন্তীর দিকে তাকাল, কীসের অফার পেয়েছেন?

বলছি। কুন্তী মাথা নাড়ল, মাস্টারি ছেড়ে বাড়িতেই ছেলেমেয়ে পড়াব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার এক বান্ধবী, ও জামশেদপুরে থাকে, খবরটা দিল। আপনি কমল চক্রবর্তীর নাম শুনেছেন?

না। কে তিনি?

গল্প লেখেন। জামশেদপুর থেকে কৌরব নামে একটি পত্রিকা দীর্ঘকাল ধরে বের করে চলেছেন।

না। আমি নাম শুনিনি। অর্ক মাথা নাড়ল।

বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম কমলবাবু পুরুলিয়ার খুব নির্জন প্রান্তরে একটি স্কুল চালান আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। চাকরি ছেড়ে সমমনস্ক কয়েকজনকে নিয়ে প্রচুর স্ট্রাগল করে স্কুলটাকে দাঁড় করিয়েছেন। কুন্তী বলল, ওইরকম নির্জন জায়গা, যার চারপাশে জঙ্গল আর পাহাড়, সেখানে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগিয়েছেন ওঁরা।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরকম জায়গায় ছাত্র পাচ্ছেন কী করে?
 
আমিও তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। শুনলাম দশ-বারো মাইল দূরের গ্রাম থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় প্রতিটি ভোরে। স্টেট ব্যাঙ্ক ওঁদের সাহায্য করেছে একটা বাস দিয়ে। বাচ্চাদের খাওয়ানোর পর পড়ানো হয়। কুন্তী বলল, জানেন, ওইসব গ্রামগুলোর বেশির ভাগকেই মাওবাদী গ্রাম বলে। চিহ্নিত করা হয়েছিল।

তা হলে তো বাচ্চারা ওইসব পরিবারের থেকেই আসে?

হয়তো!

ভদ্রলোকের তো খুব সাহস।

হয়তো সেটাই ওঁর ভরসা। কেউ নিজের সন্তানের ক্ষতি করতে চায় না বলেই স্কুলের গায়ে হাত পড়বে না। কুন্তী বলল, আমি বান্ধবীর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কমলবাবুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, আপনি স্বাগত। যদি আসেন তা হলে আমাদের শক্তি বাড়বে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার দেখে যান। আমরা আপনাকে শহরের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারব না। জীবনযাপনের জন্যে যা প্রয়োজন তার কিছুটা অবশ্যই পারব। আর হ্যাঁ, আমাদের কোনও ধর্মাধর্ম নেই। আমরা একমাত্র বৃক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা তাই সম্বোধন করি জয় বৃক্ষনাথ বলে।

অদ্ভুত তো? অর্ক বলল।

হ্যাঁ সে কারণেই ভাবছি, দেখে আসি। কলকাতা থেকে চার ঘণ্টার পথ। ওখান থেকে দিনে দিনেই জামশেদপুরে বান্ধবীর বাড়িতে চলে যাব।

কলকাতা ছেড়ে চলে যাবেন?

আমি তো বাইরেই ছিলাম। ব্যান্ডেল কি কলকাতা?

তবু তো পা বাড়ালেই চলে আসা যায়।

মাথা নাড়ল কুন্তী, বিশ্বাস করুন, ভাল লাগছে না। মায়ের কথা ভেবে চুপচাপ বসে থাকব এখানে? মা বাধা দিচ্ছে না। বলল, যাতে শান্তি পাবি তাই করবি।

শান্তি খুঁজতে যাচ্ছেন?

ঠাট্টা করবেন না। আপনাকে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করল, তাই কথাগুলো বললাম। কুন্তী মুখ ফেরাল।

এই সময় ওর মা এসে গেলেন, হাতে ট্রে-তে বসানো চা এবং কেক। কুন্তী উঠে দাঁড়াল মাকে সাহায্য করতে।

.

কুচবিহার থেকে ডায়মন্ডহারবারে নিঃশব্দে ব্যালট বক্সে বিপ্লব হয়ে গেল। তিন দশকের বেশি প্রাসাদটা ভেঙেচুরে পড়ল মাটিতে। আবেগে মানুষ উচ্ছ্বসিত।

পরিবর্তিত জীবনের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ একটি নারীর মুখের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে এখন।

.
 
হাওয়া বইছিল, সেটা ঝড় হয়ে গেল। সেই ঝড়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কখনওই যুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়ী সৈনিকরা কী আচরণ করে থাকে তা তারা বই-এ অথবা সিনেমা দেখে জেনেছে।

চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন যা অনেক আশা জাগিয়ে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত সকালটাকে রাতের চেয়ে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল তা ধসে পড়ায় মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হল। বিজয়ী সৈন্যরা জয়ের পরমুহূর্তে কিছুটা অসংযমী হয়। এতদিনের নির্যাতন সহ্য করার পর জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে জয়ের স্বাদ পাওয়া মানুষেরা মনের সাধ মেটাতে চাইল। কিন্তু দলনেত্রী, যিনি এখন। মুখ্যমন্ত্রী, ঘোষণা করলেন, বদলার রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। দলতন্ত্র নয়, চাই গণতন্ত্র। দলের কর্মীদের সংযত থাকতে আবেদন করলেন তিনি।

অনিমেষ খবরের কাগজ পড়ছিল। ইদানীং কাগজ পড়ার সময় তার অনেক বেড়ে গেছে। মাধবীলতা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তুমি কি বিজ্ঞাপনগুলোও মুখস্থ করো?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি বিজ্ঞাপনগুলো পড়ো না?

আমার অত সময় নেই। মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়েছিল, দশজন কাগজ পড়লে তার নয়জন বিজ্ঞাপনে চোখ রাখে না।

তা হলে যারা বিজ্ঞাপন দেয় তারা পয়সা খরচ করে কেন?

আশায়। ভাবে যারা কাগজটা কিনছে তারা পড়ে মুগ্ধ হবে। উঃ, আজকাল তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। যা বলব অমনি তুমি জেরা করতে শুরু করবে। সত্যি তুমি বুড়ো হয়ে গিয়েছ। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

অনিমেষ হাসল, বিজ্ঞাপনগুলো মন দিয়ে পড়লে দেশের সামাজিক, আর্থিক পরিস্থিতি কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা জানতে পারতে। আচ্ছা বলো, আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে কেউ কি ভাবতে পারত এই কলকাতার কোনও টেলিফোন নাম্বার ঘোরালে একটা সংস্থার সদস্য হওয়া যাবে যারা পছন্দমতো মহিলার সঙ্গে এক দিনের বন্ধু হওয়ায় সুযোগ করে দেবে অর্থের বিনিময়ে?

কী যা তা বলছ! মাধবীলতা চাপা গলায় বলল।

আজ্ঞে হ্যাঁ। এই যে কাগজের দ্বিতীয় পাতায় যে পত্ৰ-মিতালি শিরোনামে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় তা কখনও পড়েছ? আজ এরকম বিজ্ঞাপনের সংখ্যা সাতটা।

না পড়িনি। কারণ ওগুলো তো চিঠি লিখে বন্ধুত্ব তৈরি করা। ভেবেছি যাদের কোনও বন্ধু নেই, একা থাকে, তারাই পত্রমিতালি করে। মাধবীলতা বলল।

চল্লিশ বছর আগে হয়তো তাই হত। এখন, এই দেখো, ভরসা দেওয়া হয়েছে, কোনও ঝুঁকি নেই। প্রতারিত হবেন না। বুঝতেই পারছ।

অনিমেষ বলল, এই বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হচ্ছে তার কারণ যেসব মানুষ রেডলাইট এরিয়ায় যেতে সংকোচ বোধ করে তাদের সাহায্য করতে। খবরের কাগজে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে এবং মানুষ যে তা মেনে নিচ্ছে তার কারণ আমাদের সামাজিক জীবন অনেক উদার হয়ে গিয়েছে। রেডলাইট এলাকায়। যে খরচ করতে হয়, এদের ডাকে সাড়া দিলে তার অনেক বেশি টাকা দিতে হবে জেনেও লোকে যাচ্ছে তার কারণ এখন এই ধরনের মানুষের আর্থিক সংগতি অনেক বেড়ে গেছে।

পুলিশ কিছু বলছে না?

পুলিশ? অনিমেষ হেসে ফেলল, আমাকে বরং এক কাপ চা খাওয়াও।

মাধবীলতা একটা বড় শ্বাস ফেলল, শোনো, আমার আর এখানে থাকতে ভাল লাগছে না। তুমি সারাদিন চুপচাপ বসে শুয়ে থাকো, নয়তো কাগজ পড়ো। ছেলে সেই সকালে কাজে বেরিয়ে রাত করে ফেরে। বাধ্য হয়ে সারাদিন আমাকে বোবা হয়ে থাকতে হয়। এইভাবে থাকতে থাকতে একদিন আমরা মরে যাব, ভাল্লাগে না।

অনিমেষ হাসল, আমার কিন্তু ভাল লাগল।

তার মানে? মাধবীলতা ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল।

এতগুলো বছর পরেও আমরা দুজনে একই রকমভাবে ভাবি, এটা জেনে আনন্দ হবে না? কিন্তু কোথায় যাব? এত সস্তায় থাকার জায়গা কোথায় পাব? বলো?

ঠিক। তবু–। মাধবীলতা বলল, এখন মনে হয় জলপাইগুড়ির বাড়িটা বিক্রি না করলে ভাল হত। ওখানে গিয়েও তো আমরা থাকতে পারতাম। এখন

তো বামফ্রন্টের আমল নয় যে পার্টির নোক এসে লাল চোখ দেখাবে।

কে যে পার্টির লোক ছিল তাই এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বোকা বোকা কথা বোলো না। সুরেন মাইতিদের খুঁজে পাবে না?
 
সুরেন মাইতিদের কোনও উপায় নেই হারিয়ে যাওয়ার। তা ছাড়া ওরা যত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে ততটা চক্ষুলজ্জাহীন হতে পারেনি। কিন্তু আজ গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখলাম তৃণমূলের যে মিছিল যাচ্ছে তাতে সুরেন মাইতির পেছনে ঘোরা বেশ কয়েকজন স্বচ্ছন্দে পতাকা বইছে। হয়তো ওদের কেউ কেউ এই বাড়ি সুরেনের নির্দেশে ভাঙচুর করে গেছে। যে নৌকো ভাসে তাতে উঠে পড়তে ওরা দেরি করে না। অনিমেষ বলামাত্র মোবাইল বেজে উঠল। মাধবীলতা এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে যন্ত্রটা তুলে কানে চাপল, হ্যালো। কে বলছেন?

আমি দেবেশ বলছি, জলপাইগুড়ি থেকে। কানে গলা ভেসে এল। মাধবীলতা চাপা গলায় অনিমেষকে জানাল, দেবেশ। তারপর গলা তুলে বলল, বলুন।

ওপাশের কথা শুনতে শুনতে চোখ বড় হয়ে গেল মাধবীলতার। তারপর বলল, আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন? আচ্ছা, আমি ওকে বলছি।

মোবাইল রেখে দিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল মাধবীলতা, ছোটমাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে।

সে কী? সোজা হয়ে বসল অনিমেষ।

দেবেশবাবু বললেন, আচমকা পড়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলছে হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা কী করব জানতে চাইছিলেন। মাধবীলতা বলল, শোনো, দেরি না করে আজই রওনা হই।

হ্যাঁ। কিন্তু যাব কী করে? ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে কি?

ট্রেনে যেতে না পারলে বাসে যাব। আমি অর্ককে ফোন করে বলছি টিকিটের ব্যবস্থা করতে। আমার খুব খারাপ লাগছে। মাধবীলতা ঠোঁট কামড়াল।

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে লাইন ঠিক থাকে। নিশ্চয়ই অর্ককে ফোন করছে মাধবীলতা। ছোটমা এখন হাসপাতালে। হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। দেবেশকে ফোন করলে জানা যেত হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে কি না। ঠাকুরদা-বড়পিসিমা বাবার চলে যাওয়ার সময় সে পাশে থাকতে পারেনি। মা মারা যাওয়ার পরে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ছোটমাকে মেনে নিতে প্রথম দিকে খুব অসুবিধে হয়েছিল। ক্রমশ সম্পর্কটা আপাত স্বাভাবিক হলেও দুরত্ব থেকে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মহিলা সারা জীবন স্বামীর সংসার, শ্বশুরের বাড়ি আগলে গিয়েছেন, বিনিময়ে কিছুই পাননি। শেষপর্যন্ত বাড়ি বিক্রির টাকাগুলো ওঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হলেও তা ভোগ করার কথা ছোটমা ভাবেননি, চলে গেলে সেই সুযোগও থাকবে না। কিন্তু এটা সত্যি, ছোটমাই তার একমাত্র গুরুজন যিনি এখনও জীবিত। অনিমেষ এও ভাবল, হয়তো দেবেশ বলতে পারেনি, ছোটমা সম্ভবত আর বেঁচে নেই।
 
মাধবীলতা ফিরে এল, অর্ক বলছে ও সঙ্গে টাকা নিয়ে যায়নি। এটিএম কার্ড বাড়িতে রেখে গেছে। বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর স্টেশনে গিয়ে টিকিটের চেষ্টা করতে পারে। তা হলে তো ওর সঙ্গেই স্টেশনে যেতে হবে আমাদের।

গিয়ে যদি টিকিট না পাওয়া যায়? অনিমেষ তাকাল, না, লতা, আমি আজই যেতে চাই। তুমি আমাকে টাকা দাও, আমি বাসের টিকিট কিনে আনছি।

বাসের টিকিট পাওয়া যাবে?

আগে তো যেত। অনিমেষ বলল।

না, থাক। বাসে চেপে সারারাত বসে বসে শিলিগুড়ি, তারপর আবার বাস পালটে জলপাইগুড়িতে যাওয়ার ধকল অনেক। আমরা কেউ আর একুশ বছরের নেই। তার চেয়ে স্টেশনে চলো। রিজার্ভেশন পাওয়া না গেলেও দুটো বসার জায়গা পেলে ট্রেনে অনেক স্বস্তিতে যাওয়া যাবে। মাধবীলতা বলল।

যদি না পাই?

আঃ। এখন কি নর্থ বেঙ্গলে যাওয়ার একটাই ট্রেন? একটা না একটাতে ঠিক পাওয়া যাবে। আমি গুছিয়ে নিচ্ছি। মাধবীলতা পা বাড়ান।

কিছু টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নাও। অনিমেষ বলল।

সত্যি। হেসে ফেলল মাধবীলতা, তুমি যে এখনও কোথায় পড়ে আছ! সঙ্গে এটিএম কার্ড থাকলে টাকা বয়ে নিয়ে যেতে হয় না তা ভুলে গেলে? মাধবীলতা বেরিয়ে গেল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। আজকাল অনেক কিছু ঠিকঠাক সময়ে মনে আসে না। প্রায়ই কোনও নাম মনে করতে গিয়ে দেখতে পায়, মনে আসছে না। তখন মাথায় যে অস্বস্তি শুরু হয় তার থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে নিজেই জানে না কোথায় পড়ে আছে। সে কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে না, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি তার কাছে হিব্রু। সে আজ পর্যন্ত কোনও বড় শপিং মলে যায়নি।

সময় এগিয়ে চলেছে দ্রুত কিন্তু তার সওয়ারি হওয়ার, ইচ্ছে হোক বা ক্ষমতা হোক, তার নেই। ফলে তাকে একা একা থাকতে হচ্ছে। মাধবীলতা তার সর্বসময়ের সঙ্গী কিন্তু তার পরেও তো নিজের একাকিত্ব থেকেই যাচ্ছে। অর্ক তার ছেলে কিন্তু মনে হয় তারা দুজন এমন দুটো দ্বীপ যাদের মধ্যে অনেক যোজন সমুদ্রের ফারাক। এখন মনে হয় সেই ছাত্রকাল থেকে যা সে শিখেছিল, জেনেছিল সব মিথ্যে হয়ে যাবে? ভাবতেই মন মুষড়ে পড়ে। এই যে পশ্চিমবাংলায় যে নির্বাচন হল, মার্কসবাদী কমিউনিস্টদল তার বিপুল সংগঠন থাকা সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়ল তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না যদি বিজয়ী দল একটি রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হত। একজন মহিলার বিপুল আবেগ আর আন্তরিকতার জোয়ারে বেশির ভাগ ভোটার ভেসে গেল, কোনও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের পক্ষে তা বিশ্বাস করা মুশকিল। সব কিছুর একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। শুধু আবেগ বুকে নিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিন চালানো যায় না। যদি কেউ সেটা সচল করে ফেলে তা হলে তা অত্যন্ত সাময়িক ব্যাপার হবে, দুর্ঘটনা হতে বাধ্য। ভালবাসার আবেগ বুকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে একা কতদিন রাজ্যে সুশাসন করা সম্ভব যখন তার চারপাশে অসংখ্য স্বার্থলোভী চাটুকারের ভিড়? এ কথা ঠিক, ভদ্রমহিলা প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে বিপ্লব এনেছেন। থেমে থাকা ট্রেনে গতি এনেছেন। কিন্তু তারপর? এইসব কথা অর্ক জানে না তা হতেই পারে না। অনিমেষের কানে এসেছে, অর্ক সক্রিয়ভাবে না হোক, এই বিজয়ের উল্লাসে শরিক হয়েছে। এটাও অনিমেষের কাছে বিস্ময়। এইসব ভাবনাচিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দেবেশের ওখানে থাকলে হয়তো শান্তি পাওয়া যাবে। অনিমেষ মাথা নাড়ল। কে জানে? শান্তি কোথায় আছে তা মানুষ কি জানে?
 
একটু আগে ছুটি চেয়ে নিয়ে অর্ক বাড়ির পথে বাস ধরল। সেই বাসের ভেতর মোবাইল বেজে উঠল। কুন্তী।

কেমন আছেন?

চমৎকার। অর্ক, আপনি ভাবতে পারবেন না আমি এমন জায়গায় এসেছি যা কল্পনার বাইরে ছিল। আশপাশে মানুষের বসতি নেই। লক্ষ লক্ষ গাছের মধ্যে বাচ্চাদের স্কুল। এখানে মাস্টারমশাইরা সকাল বিকেলে রান্না করেন, সবাই সব কাজ করেন, বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় দূর দূর গ্রাম থেকে। ওরা বাস থেকে নেমেই কচি গলায় বলে ওঠে, গুডমর্নিং। কমলবাবু ওদের ফেনাভাত আর আলুসেদ্ধ পেট ভরে খাইয়ে স্কুলের পড়া শুরু করান। বেচারারা এত গরিব যে ওই খাওয়ার লোভেই বোধহয় কামাই করে না। অর্ক, আমি কাল কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাচ্ছি দীর্ঘদিন এখানে থাকব বলে। কুন্তীর গলায় উচ্ছ্বাস।

জায়গাটার নাম কী?

কী নাম ছিল জানি না। এখন সবাই বলে ভাল পাহাড়। নামটা কমলবাবু রেখেছেন। দারুণ নাম, তাই না?

কীভাবে যেতে হয়?

গালুডি স্টেশনে নেমে কুড়ি কিলোমিটার যেতে হবে। অটো, ট্যাক্সি ছাড়া মাঝে মাঝে বাস পাওয়া যায়। ঘাটশিলা থেকেও যাওয়া যায়। যাক গে, আপনি কেমন আছেন? কুন্তী প্রশ্নটা করামাত্র মোবাইল শব্দহীন হল। লাইন কেটে গেছে। অর্ক চেষ্টা করে শুনল, আউট অফ রেঞ্জ।

দিনটা যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। ওই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাধবীলতা যেন দশ হাতে এক মাটি থেকে শেকড় উপড়ে আর এক মাটিতে স্থিতু হওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি করে নিচ্ছিল। বিকেলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনতে গলির মোড়ে এসেছিল অনিমেষ। অর্ক এখনও ফেরেনি। দোকানদার পরিচিত। জিনিসগুলোর নাম শুনে জিজ্ঞাসা করল, কোথাও যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। জলপাইগুড়িতে।

ও। ওখানেও নিশ্চয়ই পরিবর্তনের ঢেউ পৌঁছে গেছে। দোকানদার হাসল।

সেটা স্বাভাবিক। জায়গাটা তো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নয়। জিনিসগুলোর দাম মিটিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুনল একজন খেকুরে চেহারার বৃদ্ধ বলছেন, এটা ঠিক নয়। এত লড়াই করে দিদি পরিবর্তন আনলেন, আর ওরা এসব করছে কী!

দোকানদার বলল, পাবলিকলি ওসব কথা বলব না দাদু।

তা ঠিক। এখন তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। বৃদ্ধ বললেন।

কী হয়েছে? অনিমেষ দোকানদারের দিকে তাকাল।

কিছু সমাজবিরোধী দুপুরবেলায় সিপিএমের পার্টি অফিসে আগুন দিয়েছিল। পুরোটা পোড়েনি। তৃণমূলের ছেলেরা ধাওয়া করতেই ওরা পালিয়ে গেছে। দোকানদার বলল, এই রকমটাই তো শুনলাম।

সমাজবিরোধীরা পার্টি অফিস পোড়াতে যাবে কেন?

বৃদ্ধ বলল, বন্যা বয়ে যাচ্ছে এখনও। এই পুকুরের মাছ ভেসে ঢুকছে ওই পুকুরে। জল থিতিয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। তখন কোন মাছ কোন পুকুরে ছিল তা আর বোঝা যাবে না।

অনিমেষ আর কথা বাড়াল না।

.

অর্কর উদ্যোগে ব্যবস্থা হল। টিটি অর্ডিনারি থ্রি টায়ারে দুটো শোওয়ার জায়গার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে লোকাল ট্রেন ধরে জলপাইগুড়ি শহরে যেতে হবে। মাধবীলতা বলল, এসি-র দরকার নেই। বাসে যাওয়ার চেয়ে এটা ঢের ভাল হল।

রাতের খাবার বাড়িতেই খেয়ে এসেছিল ওরা। অর্ক বিছানা পেতে দিয়ে বলল, যাচ্ছি।

অনিমেষ বলল, শোনো, ছোটমার কী অবস্থা তা জানি না। দেবেশকে কয়েকবার ফোন করেও লাইন পাইনি। ওখানে যাওয়ার পরে জানতে পারব। কিন্তু কবে ফিরতে পারব তা বলতে পারছি না। তুমি তোমার মতো থেকো।

অর্ক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ট্রেন হুইসল দিচ্ছে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার। মাধবীলতা বলল, তোকে তো কিছু বলার নেই, যথেষ্ট বুঝতে পারিস। শুধু একটা কথা, আর যাই করিস যে-কোনও রকম রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াস না। রাজনীতি মানুষকে হয়তো ক্ষমতা দেয় কিন্তু কখনওই শান্তি দেয় না।

কথাগুলো শুনে অনিমেষ অন্য দিকে তাকাল। সে যখন নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, পেছন ফিরে তাকায়নি। তখন মাধবীলতা কোনও বাধা দেয়নি, বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি। উলটে লালবাজারে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেও তাকে নিষেধ করেছিল মুখ খুলতে। আজ, এতকাল পরে ছেলেকে কি মনের কথাটা জানাল?

.
 
পশ্চিমবাংলার মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন শিক্ষিত গুণীজনেরা আছেন যারা কখনওই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। যেহেতু এইসব মানুষেরা সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র তাই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাল সবাই। কিছু সংবাদপত্র স্বীকার করল যে দলীয় রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে উপযুক্ত মানুষদের হাতে দফতরগুলো দিয়ে ঠিকঠাক কাজ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সামনে রয়েছে পাঁচ বছর। চৌত্রিশ বছরের কুশাসন সরিয়ে প্রচুর কাজ তারা করবেন, জীবনযাপনে পরিবর্তন আসবে। মানুষ সেই আশায় স্থির। কিন্তু তারা শুনছিল প্রতিদিন মন্ত্রীরা, বিশেষ করে যারা রাজনীতি করে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন তাঁরা মুখ খুললেই বামফ্রন্টকে গালাগাল করছেন। কাজ করার চেয়ে এই গালাগাল দিয়ে যেন অনেক বেশি সুখ পাচ্ছেন। মানুষ দেখছে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় অফিসে রাতারাতি তৃণমূলের সংগঠন তৈরি হয়ে যাচ্ছে এবং যাদের দলে বিতাড়িত কংগ্রেসি এবং ছেড়ে আসা বামফ্রন্টের সমর্থক ভিড় করছেন।

এবং তার পরেই পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেল। কোনও খবর না নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ওটা স্রেফ সাজানো ঘটনা। তাঁর সরকারকে হেয় করার জন্য সাজানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যা বললেন তার ওপর রং চড়িয়ে পুলিশ কমিশনার অপপ্রচারের জন্যে সংবাদ মাধ্যমকে দায়ী করলেন। কিন্তু তারই অধস্তন একজন মহিলা পুলিশ অফিসার যখন অভিযুক্তদের বেশির ভাগকে গ্রেফতার করে বললেন, সত্যি ধর্ষণ হয়েছিল, তখন মানুষের মন থমকে দাঁড়াল। তারা দেখল সেই মহিলাকে সত্যি বলার অপরাধে সরিয়ে দেওয়া হল এমন দফতরে যেখানে তার কোনও জনসংযোগ থাকবে না।

ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। মুখ্যমন্ত্রীর অসম্ভব জনপ্রিয়তায় সামান্য ছাপ লাগলেও তার প্রতি রাজ্যের মানুষের আস্থা এখনও প্রবল। যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে রাজনীতি করেন না, দেশের মানুষের জন্যে যাঁর জীবন উৎসর্গিত তার পাশে জনসাধারণ থাকবেই।

কিন্তু মহাভারতের মুষল পর্ব শুরু হয়ে গেলে একা শ্রীকৃষ্ণ যা পারেননি তা কি মুখ্যমন্ত্রী পারবেন? স্টেশন থেকে বাইরে বের হওয়ামাত্র অর্কর মোবাইল জানান দিল। সুইচ অন করে হ্যালো বলতেই কানে এল, দাদা, আমি রামজি বলছি।

অর্ক কথা বলল, হ্যাঁ, বলুন রামজি!

রামজির গলা কানে এল, আপনি কি এখন কলকাতায়?

হ্যাঁ।

দাদা, আমি এখন জলপাইগুড়িতে।

সে কী! ওখানে কী করছেন আপনি?

আমার অবস্থা খুব খারাপ। কলকাতায় থাকতে পারলাম না। আপনার বাবা যদি জলপাইগুড়িতে থাকার ব্যবস্থা না করে দিতেন তা হলে– কথা শেষ করল না রামজি।

আমার বাবা আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু দাদা, আমার হাত একদম খালি। এই মোবাইলে পঞ্চাশ টাকা ভরেছিলাম, সেটাও শেষ হয়ে আসছে। আমাকে এক হাজার টাকা পাঠাতে পারবেন? আমি কথা দিচ্ছি, মাস তিনেকের মধ্যে শোধ করে দিতে পারব। করুণ গলায় বলল রামজি।

না শব্দটা মুখে চলে এসেছিল কিন্তু সামলে নিল অর্ক। বলল, আপনি জলপাইগুড়ির কোথায় আছেন, কীভাবে টাকা পাঠাব তা জানি না। পাঠালে কতদিনে পাবেন তারও ঠিক নেই। আপনার সঙ্গে তো বাবার পরিচয় হয়েছে, তিনি আপনাকে সাহায্যও করেছেন। এক কাজ করুন, উনি এখন জলপাইগুড়িতে। ওঁর সঙ্গে দেখা করে টাকাটা চান। যদি উনি বলেন তা হলে টাকাটা আমি ওঁকে পাঠিয়ে দেব পরে। অর্ক কথাগুলো বলে খুশি হল।

আপনার বাবা এখন জলপাইগুড়িতে? এখানে যে আসবেন তা আমায় বলেননি তো। কোথায় উঠেছেন? রামজি বেশ অবাক হয়ে গেল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top