What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

শ্যামল যে তার কাঁধে হাত রেখেছে এটাও টের পেল না সে। শ্যামল সেটা বুঝতে পেরে ওকে আবার সোফায় বসিয়ে দিল। গৌরব তখনই যেন মাটিতে ফিরল। মুখ দুমড়ে মুচড়ে কান্না আসছিল তার। এই সময় শ্যামলের কথা কানে এল, উনি ভাগ্যবতী। আর কিছু না হোক এই যন্ত্রণা বেশিক্ষণ ওঁকে সহ্য করতে হয় নি। ওঁর হার্ট বিকল হয়েছে। গৌরব, এটা যে কী ভালো হলো এই মুহূর্তে তোমরা বুঝবে না। চোখের সামনে দিনের পর দিন ওঁকে যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো তা তোমাদের কাছে সহ্য করা অসম্ভব। তার চেয়ে এই ভালো হলো।

মায়ের ঘর থেকে সৌরভের চিৎকার ভেসে আসছিল। মানুষের কান্না যখন বাঁধ মানে না তখনই অমন আওয়াজ হয়। গৌরব আর শ্যামল ছাড়া সবাই ততক্ষণ মায়ের ঘরে।

শ্যামল বলল, এবার তোমাদের উচিত আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া।

গৌরব কিছু বলল না। ধীরে ধীরে মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সবাই এমন ভিড় করে আছে যে দরজায় দাঁড়িয়ে দুটো পা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।

.

মায়ের কাজের ব্যাপারে একমত হয়েছিল গৌরব আর সৌরভ। কয়েক সপ্তাহ আগে এক রাত্রে সরলা গল্প করতে করতে বলেছিলেন, আমি মরে গেলে তোদের কয়েকটা কাজ করতে হবে।

বাজে কথা নিয়ে আলোচনা করব না। গৌরব বলেছিল।

সরলা হেসেছিলেন, এখন বাজে কথা বলে মনে হলেও এটা তো সত্যি হবেই। আচ্ছা, কী কী করতে হবে না তাই বলি। শ্রাদ্ধের পর বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়াবি না। যাদের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়, খোঁজ নেবার দরকার মনে করে না যারা, তাদের ডেকে খাওয়ানোর কোনো দরকার নেই। ওতে আমি কষ্ট পাব।

সৌরভ জানতে চাইল, আর?

সরলা বললেন, আর পুরুত ডেকে আমার শ্রাদ্ধ করাবি না।

সৌরভ হেসেছিল, তুমি তো হিন্দু।

মরে যাওয়ার পরে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টানদের কী হয় তা তো কেউ জানে না। কিন্তু কয়েকটা শেখা মন্ত্র আউড়ে পুরুত আমার আত্মাকে উদ্ধার করবে এ আমি বিশ্বাস করি না। সারা জীবনে তো মন্ত্র শুনলাম না।

সরলার মৃত্যুর তিনদিন পরে এসব কথা উঠলে মলি প্রথম আপত্তি করেছিল, তখন ওঁর যা মনে হয়েছিল তাই বলেছিলেন। সেসব ধরতে হয় নাকি? আমি যদি বলি মরে যাওয়ার পরে আমার ছাই মানস সরোবরের জলে গিয়ে বিসর্জন দেবে তবে সেটা সম্ভব হবে? বাস্তব বলে একটা কথা আছে। আত্মীয়স্বজন কী বলবে? আমার বাড়ির লোকজন? সবাই বলবে পয়সা বাঁচাবার জন্যে এসব করছ তোমরা?
 
সৌরভের মনে একটু অস্বস্তি ছিল কিন্তু সে গৌরবকে বলতে শুনল, কে কী বলছে তাতে কান দেওয়া দরকার নেই। মায়ের কথাই শেষ কথা। যদি তিনি মানস সরোবরের কথা বলতেন আমি যেতাম। তাছাড়া, আমার মনে হয় শ’তিন চার আত্মীয় বন্ধু এবং কিছু ব্রাহ্মণ এসে গাণ্ডেপিণ্ডে হৈ-চৈ করে চব্যচষ্য খেলে মায়ের আত্মা মোটেই শান্তি পাবে না। খেতে বসে মানুষ যেমন আচরণ করে তাতে বিয়ে বাড়ি আর শ্রাদ্ধবাড়ির মধ্যে পার্থক্য থাকে না। আমার মায়ের মৃত্যুতে কেউ আনন্দ করে খাচ্ছে এ আমি সহ্য করতে পারব না।

সৌরভ মাথা নাড়ল, ও ঠিক কথা বলছে। আমিও একমত। আমরা কাউকে নেমন্তন্ন করব না। মাদার টেরেসা আর ভারত সেবাশ্রমে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসব। কিছু মানুষের উপকার যদি ওঁরা ওই টাকায় করতে পারেন, তাহলে মা অনেক বেশি শান্তি পাবেন।

তোমাদের মা, তোমরা যা ভালো বোঝো তাই হবে।

তুমি মা বলতে ওঁকে। সৌরভ মনে করিয়ে দিলো।

তাহলে অন্তত কাঙালি ভোজন করাও।

গৌরব বলল, সেটা করা যায়। কিছুনা খেতে পাওয়া মানুষকে একটা দিন পেট ভরিয়ে খাওয়ানো যায়। কথাটা খারাপ বলেনি।

সৌরভ বলল, আর পুরুতটুরুত যজ্ঞ এসবের কোনো দরকার নেই। মা গান ভালবাসতেন। সেদিন ভালো শিল্পীকে বাড়িতে এনে গান বাজনা করা হবে।

মলি অবাক হলো, গান বাজনা? কি গান? কীর্তন?

গৌরব বলল, খুব ভালো আইডিয়া। না কীর্তন নয়, রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে নিয়ে ভালো গান আছে। আমার মনে হয় ওই পরিবেশে মায়ের খুবই ভালো লাগবে। এটাই করা যাক।

মলি আপত্তি করল না। কাঙালি ভোজনের প্রস্তাবটা মেনে নেওয়ায় সে খুশি হয়েছিল। যদিও এই ব্যবস্থাটায় তার মনে অস্বস্তি রয়েই গেল।

মায়ের কাজের দিন প্রায় না বলতেই জনা তিরিশেক মানুষ এসে গেলেন। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিছু মানুষ কাজের অছিলায় ফিরে গেলেন। একজন, গৌরবের মাসীমা সরাসরি সমালোচনা করলেন। এতে তার দিদির আত্মার কোনোদিন মুক্তি পাবে না। শ্রাদ্ধ এবং পিণ্ডি না দিলে আত্মা ঘুরে ঘুরে পাক খাবে আর নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে। তিনি নিজে পুরুত আনানোর উদ্যোগ নিলেন। দেখা গেল কেউ কেউ তাঁকে সমর্থন করছেন। গৌরব এগিয়ে এল, মাসীমা আপনি কবে ফিরে এলেন?

মানে? আমি আবার কোথায় গেলাম যে ফেরার কথা বলছিস?

বাঃ এই যে বললেন মায়ের আত্মা ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে আর নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে। সেখানে গিয়ে দেখে না এসে নিশ্চয়ই আপনি এত বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে পারতেন না। গৌরব হাসল।

ও। তুই আমার সঙ্গে রসিকতা করছিস? বেঁচে থাকতে মেরে ফেলছিস? খুব অহংকার হয়ে গিয়েছে তোর আমেরিকায় গিয়ে না?

সৌরভ শুনছিল এতক্ষণ, এবার বলল, মাসীমা আমি কিন্তু আমেরিকায় যাইনি কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে মৃত্যুর পরের জগতটা সম্পর্কে আপনি খুব অভিজ্ঞ। দেখুন, আমরা তো কিছুই জানি না। আন্দাজে একটা কিছু বানিয়ে বলে কী লাভ। মা যা জীবিতকালে ভালবাসতেন। আমরা তাই করছি। যার এসব পছন্দ হবে না তিনি নাও থাকতে পারেন।

তুই আমাকে চলে যেতে বলছিস?

আপনার স্বাধীনতা আছে।

অপমান করলি তবু আমি যাব না। তোর মা আমার দিদি। আমি দেখতে চাই তোরা দিদির কী কাজ করলি। মাসীমা হলঘরের কার্পেটে বসে পড়লেন। আজ এই ঘর থেকে সমস্ত টেবিল চেয়ার সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের এক প্রান্তে টেবিলের ওপর সাদা চাদর পেতে ফুলের মালায় সরলার ছবি সাজিয়ে রেখেছে ওরা। ছবিতে তিনি হাসছেন। স্নেহ-প্রশ্রয়ের হাসি। গান শুরু হলো। কলকাতার এক পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক একটার পর একটা গান পূজা পর্ব থেকে গেয়ে গেলেন। শেষ গান, নয়ন ছেড়ে গেলে চলে শুরু হওয়া মাত্র গৌরব উঠে বাইরে এসে দাঁড়াল। কেমন একটা চাপ আসছে বুকের ওপরে। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। তবু তার মনে হচ্ছিল মা শান্তি পাচ্ছেন। তার আত্মা এতে তৃপ্তি পাচ্ছে। সে বাগানের দিকে তাকাল। মায়ের হাতের স্পর্শে বড় হয়ে ওঠা গাছগুলো এখন বাতাসে দোল খাচ্ছে আদুরে ভঙ্গীতে।
 
গেট খুলে একটি লোক ঢুকছিলেন। সম্ভবত মায়ের জন্যেই আসছেন বলে ভাবল গৌরব। কাছাকাছি হতেই বুঝতে পারল ইনি পোস্ট অফিস থেকে আসছেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, গৌরব বসু এখানে থাকেন?

হ্যাঁ। আমিই গৌরব।

আচ্ছা। আপনার একটা রেজিস্টার্ড লেটার আছে। ব্যাগ খাতা বেছে নিয়ে খাতা বের করে এগিয়ে ধরলেন ভদ্রলোক। সই করে চিঠি দিলেন পিওন। তারপর কান খাড়া করে গান শুনলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, গানটান হচ্ছে।

গান হচ্ছে। আমার মা খুব ভালবাসতেন।

আপনার মা? মানে, এ বাড়ির সরলাদেবী?

হ্যাঁ।

বাসতেন মানে? উনি—

নেই।

সেকি। উনি মারা গিয়েছেন? কী করে? এই তো কয়েক মাস আগে আমার সঙ্গে ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বললেন। ভদ্রলোক হতভম্ব। সেটা কোনোমতে সামলে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি একটু ভেতরে যেতে পারি?

অবশ্যই যান। সরে দাঁড়ালেন গৌরব। মাথা নিচু করে পিওন জুতো খুলে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই ভঙ্গিটা ভালো লাগল ওর। ভেতর থেকে না এলে এমনভাবে হাঁটতে বড় অভিনেতা হতে হয়।

খামের ওপর ছাপা ঠিকানা দেখে হাসি ফুটল গৌরবের মুখে। মুখটা ছিঁড়ে চিঠি বের করতেই অনুমান মিথ্যে হলো না। তার ইন্টারভিউতে সন্তুষ্ট হয়ে কোম্পানি তাকে চাকরি দিচ্ছে! এক বছর পরে কনফার্ম করবে। মাইনেপত্র ইত্যাদির বিস্তৃত আলোচনার জন্যে তাকে অবিলম্বে দেখা করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে কোম্পানি তার কাছে লিখিত একটা প্রতিশ্রুতি চাইছে যে যোগ দেবার দুবছরের মধ্যে সে কোম্পানি ছেড়ে যাবে না।

গতকাল বিশেষ প্রয়োজনে ওই অফিসের সামনে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। গৌরব দেখেছিল বেলা বারোটার সময় অফিসের বারান্দায় সতরঞ্চি পেতে জন বারো মানুষ বসে আছে। তাদের মধ্যে চারজন তাস খেলছিল। পেছনে ফেস্টুন টাঙানো ছিল, কোম্পানি এবং তাঁদের ইউনিয়ন নিপাত যাক। তার মনে হয়েছিল এরা ওই অফিসের কর্মী। বেলা বারোটায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন শান্তিপূর্ণ ভাবে। ঠিক কথা। অত্যাচারিত হলে এটা করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু কর্মীরা কি তাদের কাজ থেকে আইনসম্মত ছুটি নিয়ে ওখানে বসে আছেন? যদি তা না হয়, যদি অফিসে এসে খাতায় সই করে ওঁরা ওখানে বসে প্রতিবাদ জানান তাহলে আগামীকাল আর একদল কর্মী একই কাজ করতে পারেন। কর্তৃপক্ষের যদি ব্যবস্থা নেবার ক্ষমতা না থাকে তাহলে কোম্পানির ভিত ধ্বসে পড়তে বাধ্য। আজকের চিঠিটার মর্ম হলো তাকে ওই কোম্পানিতে চাকরি করতে যেতে হবে। ইন্টারভিউ-এর সময় যে সমস্ত ইউনিয়ন নেতা বাধা দিতে এসেছিলেন তাদের মন যুগিয়ে অথবা বিরোধিতা করে চলতে হবে। দ্বিতীয়টি করলে দুবছর কেন, দুমাস কাজ করা অসম্ভব সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।

তুমি এখানে?

চমকে মুখ ফেরাল গৌরব। জয়তী এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও চোখের কোণ ভেজা। গলার স্বর থমথমে।

হুঁ। জয়তী, তোমার সঙ্গে আমার কথা ছিল।

কী কথা?

এখানে এভাবে বলা যাবে না। চলো হাঁটি।

কি আশ্চর্য। ভেতরে অনুষ্ঠান শেষ হয়নি, সবাই বসে আছেন, এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে কী ভাববে বলো তো?

আচ্ছা। বেশ বাগানে চলো। বাড়ির মধ্যেই থাকা যাবে।

এই অনুরোধ উপেক্ষা করল না জয়তী। ওরা ধীরে ধীরে বাগানে এসে দাঁড়াল। হাওয়ায় গাছের পাতা ডাল নড়ার শব্দ হচ্ছে। কেমন সুন্দর ছিমছাম সবুজ চারধারে। জয়তী জিজ্ঞাসা করল, কী বলবে?

খামটা দেখাল জয়তীকে গৌরব, ইন্টাভিউ দিয়েছিলাম, আজ এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে। পড়ে দেখবে?
 
জয়তী উজ্জ্বল মুখে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। পড়ে বলল, কনগ্রাচুলেশন।

কিন্তু আমার মন চাইছে না এখানে চাকরি করতে।

কেন?

এখানকার কাজের আবহাওয়ার সঙ্গে আমি বোধহয় খাপ খাইয়ে নিতে পারব না। সব ব্যাপারে এত মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

চাকরি করতে হলে কিছু কিছু মেনে নিতেই হয়।

সেটা জানি। কিন্তু চারপাশের মানুষগুলো যদি কোনো না কোনো অজুহাতে ঝামেলা তৈরি করার জন্যেই চাকরি করেন তাহলে? আমি একতরফা দোষ দিচ্ছি না। হয়তো মালিক পক্ষের আচরণ ওঁদের ইন্ধন যোগাচ্ছে।

জয়তী একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, তোমার যা ভালো লাগে করো।

গৌরব নিশ্বাস ফেলল, এখন আর আমার কি ভালো লাগবে? কিচ্ছু না।

আমি থাকতেও না? জয়তী অজান্তে প্রশ্নটা করে ফেলল।

জয়তীর মুখের দিকে তাকাল গৌরব, সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। মা বেঁচে থাকলে তুমি আজ এ বাড়িতে থাকতে। একটা মৃত্যু–!

এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।

গৌরব হাসল, মা চলে যাওয়ার পর তুমি এমন প্রশ্ন করতে পারছ?

মানে?

এই সময় পিওন ভদ্রলোকটি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে বাগানটা পেরিয়ে গেট খুলে আবার বন্ধ করে চলে গেলেন। ওরা চুপচাপ মানুষটির যাওয়া দেখল।

গৌরব বলল, তোমার জন্মদিন এসে গেল।

জয়তী কথা বলল না। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ওই দিন কি আমরা বিয়ে করতে পারি? ওই দিন?

জয়তী মাথা নামাল, তোমার যা ইচ্ছে।

কিন্তু জয়তী মা চলে গিয়েছেন কদিন আগে, ওঁর ইচ্ছে ছিল আমাদের বিয়েটা দেখে যেতে, সেটা হলো না। আমার তাই একদম ইচ্ছে নেই কোনো বড় আয়োজন করার। লোকজন নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর কোনো বাসনা হচ্ছে না।

বুড়ো বয়সে বিয়ে করছি, ওগুলো তো বাহুল্য।

বুড়ো বয়স?

নয় তো কী।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। এবার গৌরব বলল, এই কয়েক মাসে এখানকার জীবন নানাভাবে দেখলাম। হয়তো পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করে থাকে। বিদেশে থাকতে ভাবতাম দেখে ফিরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বেশ হৈচৈ করে থাকব। দেশে সবাই বেশ মজায় আছে। এখানে এসে দেখলাম যে যার মতো এক একটা গর্ত করে তার মধ্যে ঢুকে রয়েছে। আমার দাদার সঙ্গে আত্মীয়স্বজন কারো সম্পর্ক নেই। ওর মতো প্রায় সবাই। এ কলকাতায় না থেকে বুলগেরিয়ায় থাকলেও ওর কোনো অসুবিধা হতো না। এই চাকরি নিয়ে আমি এমনভাবে থাকতে পারি যাতে কারো সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে। বড় আশা ভঙ্গ হলো, জানো!

আমেরিকার অফিসে তোমার ছুটি আর কত দিন?

যা নিয়েছিলাম তা শেষ। এখানে এসে বারংবার এক্সটেন্ড করে যাচ্ছি। আর করা যাবে না।

কী করবে তাহলে?

দ্যাখো, যদি ভারতবর্ষে পাকাপাকি থেকেও যাই তবু একবার ওখানে যেতেই হবে। বারো বছরে অনেক দায় জমিয়ে ফেলেছি।

গৌরব, তুমি ওখানে স্বচ্ছন্দ?

হ্যাঁ। কারণ কাজের সময় মনের ওপর চাপ পড়ে না। কিন্তু কাজের বাইরে নিজেকে ভীষণ একা লাগে।

আমি যদি সঙ্গে থাকি?

তুমি? তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

একদিন নিজের অহঙ্কার নিয়েছিলাম। এই বাগানে মা যখন আমাদের আশীর্বাদ করলেন তখন থেকে এসব ধুয়েমুছে গিয়েছে গৌরব।

তাহলে?

যদি তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও আমি যাব। যদি তোমার মনে হয় আমাকে নিয়ে ওখানে ভালো আছ তাহলে তাই থাকব। আজ নিউইয়র্ক আর কোলকাতার কোনো ব্যবধান নেই। তুমিই তো একথা বলেছ।

কিন্তু তোমার মা?

আমি জানি না। বিয়ের পর আমি এ বাড়িতে এলে ওখানে একা থাকবেন। আমি হয়তো সপ্তাহে দুতিনদিন দেখতে যাওয়ার সময় পাব। মনে রেখো, শুধু দেখতে যাওয়া। অর্থাৎ আমি বাইরের মানুষ হয়ে যাব।

তা ঠিক। তবু তো এক শহরে থাকলে খবর পেলেই ছুটে যেতে পারবে। বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানো সম্ভব।

এটা কোনো কথা হলো? বিপদ আসার আগে যদি প্রতিরোধ না করতে পারি তাহলে বিপদ চলাকালীন পাশে দাঁড়িয়ে আমি কি শান্তি পাব?

জয়তী!

বলো?

উনি যদি আমাদের সঙ্গে যান?

মানে?

তোমার মাকে যদি আমার প্রয়োজন হয়? আমি যদি নিয়ে যেতে চাই?

এমন কাজ করো না যা তোমাকে পরে আফসোস করাতে পারে।

আমি ভেবেচিন্তেই কথা বলেছি।

বেশ। মায়ের সঙ্গে কথা বলো।


গৌরব জয়তীর হাত আঁকড়ে ধরল। এক মুহূর্তে নিঃশব্দে যেন অনেক কথা বলা হয়ে গেল। এইসময় বাড়ির ভেতর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এল। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়েছে। মাসীমা চুপচাপ বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সবাই কথা বলছে।

গৌরব বলল, চলো, এখন আমাদের যাওয়া উচিত।

জয়তী বলল, সবাই এভাবে দেখলে কী ভাববে?

গৌরব হাসল, কী আবার ভাববে। আজ মায়ের কাজের দিনে তার সব চেয়ে বড় ইচ্ছেটা পূর্ণ করতে আমরা একমত হলাম। এতে কে কী ভাবল তা আমি মোটেই কেয়ার করি না। তুমি করো?

জয়তী উত্তর দিলো না। তারপর হাত ছাড়িয়ে বলল, চলো।

জবাব দিলে না যে!

আমরা কিন্তু নিজেদের ইচ্ছে প্রথমে পূর্ণ করলাম না। মা এই ইচ্ছেটাকে সমর্থন করেছিলেন, তাই না?

তাই।

ওরা দু’জন পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের দিকে এগিয়ে চলল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top