ডাক্তারবাবু বললেন, “কিছু মনে করবেন না, আমার সঙ্গে অন্য যে-মেয়েটি এসেছে, সে মদেশিয়া, অথচ এখানকার মানুষের সঙ্গে ওর ভাষার অনেক পার্থক্য আছে। এতোয়ারিও আপনার সব কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে না, তাই তো?”
“ঠিক। কিন্তু এই মেয়েটি এত চুপচাপ যে মনের কথা বুঝতে দেয় না। তবে আমার সঙ্গে এখানকার মেয়েদের অনেক তফাত হয়ে গিয়েছে। বিয়ের পর আমি আর আত্মীয়দের কাছে ফিরে যাইনি। স্বামীর ভাষা শিখে নিয়েছি একটু একটু করে। স্বামী হিন্দি বলতেন ভাঙা ভাঙা। সেই ভাঙা হিন্দি বলতেও আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার গায়ের রং কালো হলেও স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার সবকিছু এমন বদলে গেল যে, লোকে আমাকে কালা মেম বলে আড়ালে কথা বলত,” বুড়ি হাসলেন। বেশ গর্বিত দেখাচ্ছিল ওঁকে। জানেন, “এতু আজ আমার হাত-পা-মাথায় এত সুন্দর হাত বুলিয়ে দিয়েছে যে, খুব আরাম হয়েছে।”
“এতু?”
“ও হো! আপনার সঙ্গে যে মেয়েটি এসেছে, আমার সঙ্গে আছে।”
“ও,” হেসে ফেললেন ডাক্তারবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি বিয়ের পর থেকেই আর আগের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি?”
“না। কী করব বলুন! প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হত। কিন্তু আমার স্বামীর ওই একটাই নিষেধ ছিল। তিনি চাইতেন আমি মেমসাহেব হয়ে থাকি, মা-বাবার ভাষায় যেন কথা না-বলি,” হাসলেন বৃদ্ধা, “প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, কিন্তু স্বামীর ভালবাসা সেই কষ্টকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।”
“কিছু মনে করবেন না, আপনার স্বামীর মৃত্যুর পরে আবার গ্রামের আত্মীয়দের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয়নি?”
“নাঃ। আমি নিজেই অনেক বদলে গিয়েছিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পরে সরকার আমাকে যে-ভাতা দেয়, তাতে দিব্যি চলে যায়। স্বামীর খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে নিয়ে ওঁর দেশে যাওয়ার। কিন্তু সাহস পাননি। আমার চামড়ার রংকে ওঁর দেশের আত্মীয়রা মেনে নেবেন না বলে ওঁর ভয় ছিল।”
উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবু, “আপনি এখন বিশ্রাম করুন।”
“একটা কথা বলব?”
“নিশ্চয়ই, বলুন!”
“আপনি যে-উদ্দেশ্যে এসেছেন, সেটা সফল হবে বলে আমার মনে হয় না। আজ থেকে দু’পুরুষ আগে যারা খাবারের লোভে এই মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে যারা থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের বংশধরদের কোনও আগ্রহ নেই। খবর তো চাপা থাকে না। ওদের সেই পুর্বপুরুষদের খ্রিস্টান করা হয়েছিল, মৃত্যুর পরে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পোড়ানো হত না— এই সব খবর কিছু লোক এখানে প্রচার করেছে।”
“কিছু লোক? ওখান থেকে কেউ এসেছে বলে শুনিনি।”
“তারা আসেনি কিন্তু এই দেশের যেসব ছেলে ইংরেজদের তাড়াতে চাইছে, তারা এইসব খবর রটিয়ে দিয়েছে। আমি খ্রিস্টান হওয়ার পর থেকে ওরা আমাকে এড়িয়ে চলে। আমার এখানে যারা কাজ করে, তারা বারবাকানার মানুষ। ধর্মে মুসলমান,” বৃদ্ধা বললেন।
নমস্কার জানিয়ে নীচে নেমে এলেন ডাক্তারবাবু। তাঁর মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা যতটা সরল হবে বলে ভেবেছিলেন, ততটা নয়। ঘরের কাছে এসে দেখলেন পুষি বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাঁর ঘরে ঢুকতেই পুষি দরজায় এসে দাঁড়াল। ডাক্তারবাবু চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওই দু’জন কোথায়? কী করছে এখন?”
“ঘুমাচ্ছে,” গম্ভীর গলায় বলল পুষি।
“সে কী? এই অসময়ে?”
“খুব ভয় পেয়েছে বোধহয়,” হাসল পুষি।
ডাক্তারবাবু তাকালেন, “ও! কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?”
“আপনার অনুমতি নেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।”
“কীসের অনুমতি?”
খুব মিষ্টি হাসি হাসল পুষি, “বলতে সাহস পাচ্ছি না, যদি ভরসা দেন তা হলে বলব।”
“বেশ, বলো।”
“চা-বাগান থেকে একটা জিনিস এনেছিলাম। খাওয়ার জিনিস। আজ সেই জিনিসটা খেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপনি যদি অনুমতি না দেন তা হলে…”
“কী সেই খাবার জিনিস?”
ছুটে বেরিয়ে গেল পুষি। কিন্তু ফিরে এল অল্প সময়ের মধ্যে। হেসে বলল, “এটা চা-বাগান থেকে এনেছি। খুব ভাল হাঁড়িয়া।”
“সর্বনাশ!”’ চোখ বড় হল ডাক্তারবাবুর, “তুমি ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ? না না, ওটা খেয়ে মাতলামি করলে…”
“না না, আমি মাতলামি করি না, যারা আমায় দেখে তারাই মাতাল হয়,” খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পুষি।
“তুমি কি রোজ হাঁড়িয়া খাও?”
“কী করব! না-খেলে সবাই মনখারাপ করে। তবে সবাই বলে খাওয়ার পর আমি কখনও মাতাল হইনি,” চোখ ছোট করল পুষি, “একটু খাই?”
“আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি না, কিন্তু কেউ যদি তোমার বিরুদ্ধে নালিশ না-করে, তা হলে আমার কিছু বলার নেই।”
শোনামাত্র এক মুহূর্ত না-দাঁড়িয়ে পাশের ঘরে চলে গেল পুষি।
“ঠিক। কিন্তু এই মেয়েটি এত চুপচাপ যে মনের কথা বুঝতে দেয় না। তবে আমার সঙ্গে এখানকার মেয়েদের অনেক তফাত হয়ে গিয়েছে। বিয়ের পর আমি আর আত্মীয়দের কাছে ফিরে যাইনি। স্বামীর ভাষা শিখে নিয়েছি একটু একটু করে। স্বামী হিন্দি বলতেন ভাঙা ভাঙা। সেই ভাঙা হিন্দি বলতেও আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার গায়ের রং কালো হলেও স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার সবকিছু এমন বদলে গেল যে, লোকে আমাকে কালা মেম বলে আড়ালে কথা বলত,” বুড়ি হাসলেন। বেশ গর্বিত দেখাচ্ছিল ওঁকে। জানেন, “এতু আজ আমার হাত-পা-মাথায় এত সুন্দর হাত বুলিয়ে দিয়েছে যে, খুব আরাম হয়েছে।”
“এতু?”
“ও হো! আপনার সঙ্গে যে মেয়েটি এসেছে, আমার সঙ্গে আছে।”
“ও,” হেসে ফেললেন ডাক্তারবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি বিয়ের পর থেকেই আর আগের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি?”
“না। কী করব বলুন! প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হত। কিন্তু আমার স্বামীর ওই একটাই নিষেধ ছিল। তিনি চাইতেন আমি মেমসাহেব হয়ে থাকি, মা-বাবার ভাষায় যেন কথা না-বলি,” হাসলেন বৃদ্ধা, “প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, কিন্তু স্বামীর ভালবাসা সেই কষ্টকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।”
“কিছু মনে করবেন না, আপনার স্বামীর মৃত্যুর পরে আবার গ্রামের আত্মীয়দের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয়নি?”
“নাঃ। আমি নিজেই অনেক বদলে গিয়েছিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পরে সরকার আমাকে যে-ভাতা দেয়, তাতে দিব্যি চলে যায়। স্বামীর খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে নিয়ে ওঁর দেশে যাওয়ার। কিন্তু সাহস পাননি। আমার চামড়ার রংকে ওঁর দেশের আত্মীয়রা মেনে নেবেন না বলে ওঁর ভয় ছিল।”
উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবু, “আপনি এখন বিশ্রাম করুন।”
“একটা কথা বলব?”
“নিশ্চয়ই, বলুন!”
“আপনি যে-উদ্দেশ্যে এসেছেন, সেটা সফল হবে বলে আমার মনে হয় না। আজ থেকে দু’পুরুষ আগে যারা খাবারের লোভে এই মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে যারা থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের বংশধরদের কোনও আগ্রহ নেই। খবর তো চাপা থাকে না। ওদের সেই পুর্বপুরুষদের খ্রিস্টান করা হয়েছিল, মৃত্যুর পরে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পোড়ানো হত না— এই সব খবর কিছু লোক এখানে প্রচার করেছে।”
“কিছু লোক? ওখান থেকে কেউ এসেছে বলে শুনিনি।”
“তারা আসেনি কিন্তু এই দেশের যেসব ছেলে ইংরেজদের তাড়াতে চাইছে, তারা এইসব খবর রটিয়ে দিয়েছে। আমি খ্রিস্টান হওয়ার পর থেকে ওরা আমাকে এড়িয়ে চলে। আমার এখানে যারা কাজ করে, তারা বারবাকানার মানুষ। ধর্মে মুসলমান,” বৃদ্ধা বললেন।
নমস্কার জানিয়ে নীচে নেমে এলেন ডাক্তারবাবু। তাঁর মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা যতটা সরল হবে বলে ভেবেছিলেন, ততটা নয়। ঘরের কাছে এসে দেখলেন পুষি বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাঁর ঘরে ঢুকতেই পুষি দরজায় এসে দাঁড়াল। ডাক্তারবাবু চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওই দু’জন কোথায়? কী করছে এখন?”
“ঘুমাচ্ছে,” গম্ভীর গলায় বলল পুষি।
“সে কী? এই অসময়ে?”
“খুব ভয় পেয়েছে বোধহয়,” হাসল পুষি।
ডাক্তারবাবু তাকালেন, “ও! কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?”
“আপনার অনুমতি নেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।”
“কীসের অনুমতি?”
খুব মিষ্টি হাসি হাসল পুষি, “বলতে সাহস পাচ্ছি না, যদি ভরসা দেন তা হলে বলব।”
“বেশ, বলো।”
“চা-বাগান থেকে একটা জিনিস এনেছিলাম। খাওয়ার জিনিস। আজ সেই জিনিসটা খেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপনি যদি অনুমতি না দেন তা হলে…”
“কী সেই খাবার জিনিস?”
ছুটে বেরিয়ে গেল পুষি। কিন্তু ফিরে এল অল্প সময়ের মধ্যে। হেসে বলল, “এটা চা-বাগান থেকে এনেছি। খুব ভাল হাঁড়িয়া।”
“সর্বনাশ!”’ চোখ বড় হল ডাক্তারবাবুর, “তুমি ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ? না না, ওটা খেয়ে মাতলামি করলে…”
“না না, আমি মাতলামি করি না, যারা আমায় দেখে তারাই মাতাল হয়,” খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পুষি।
“তুমি কি রোজ হাঁড়িয়া খাও?”
“কী করব! না-খেলে সবাই মনখারাপ করে। তবে সবাই বলে খাওয়ার পর আমি কখনও মাতাল হইনি,” চোখ ছোট করল পুষি, “একটু খাই?”
“আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি না, কিন্তু কেউ যদি তোমার বিরুদ্ধে নালিশ না-করে, তা হলে আমার কিছু বলার নেই।”
শোনামাত্র এক মুহূর্ত না-দাঁড়িয়ে পাশের ঘরে চলে গেল পুষি।