What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (4 Viewers)

গৌরব এবং সৌরভ পাশাপাশি বসেছিল। সৌরভ দুহাতে মুখ ঢেকে রয়েছে। তার শরীর শক্ত। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল সে! কান্নাটি চাপতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। শ্যামল বলল, শক্ত হ সৌরভ। নিজেকে তৈরি কর। মাসীমাকে এসব কথা জানানোর কোনো দরকার নেই। ওঁকে ওর মতো বেঁচে থাকতে দে।

সৌরভ জবাব দিল না। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোনো চান্স নেই?

চান্স বলতে? ডক্টর সরকার জিজ্ঞাসা করলেন।

চিকিৎসাশাস্ত্রে যদি কোনো উপায় থেকে থাকে, যদি তার জন্য মাকে বিদেশে কোথাও নিয়ে যেতে হয় তাহলে সেটা করতে আমি রাজি আছি। গৌরব বলল।

ডক্টর সরকার বললেন, গাছের একটা ডাল পচে গেলে সেটা কেটে বাদ দিয়ে দিলে গাছটা বেঁচে যাবে। কিন্তু ধরুন পচন যদি শেকড়ে ধরে আর ওপরের গাছটা নিস্তেজ হয়ে আসে তাহলে বাদ দেবেন? য়ুরোপ আমেরিকায় গিয়ে হয়তো বাদ দেওয়ার কাজটা হতে পারে কিন্তু বাঁচানো অসম্ভব।

হঠাৎ সৌরভ হাত সরাল মুখ থেকে, আমি একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, গোরা যদি সন্দেহ না করত তাহলে মায়ের এই অসুখটা এখনও ধরা পড়ত না। মা দিব্যি থাকতেন।

সেইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন পড়তেন তখনই মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে যেত।

এখন আবিষ্কার করে আপনারা কি উপকারটা করলেন?

উপকার করার উপায় থাকলে নিশ্চয়ই করতাম। যদি দেখা যেত এটা প্রাথমিক অবস্থা তাহলে আমরা লড়াই করার সুযোগ পেতাম। এরকম অনেক কেস আমি পেয়েছি সেই সব রোগী ধরা পড়ার পরেও দশ বছর দিব্যি বেঁচে আছেন। রোগটাকে বেঁধে রাখতে পেরেছি। এক্ষেত্রে একান্তই দুর্ভাগ্য যে ধরা পড়ল প্রায় শেষ অবস্থায় এসে।

সৌরভ বড় করে নিশ্বাস নিল। বোঝাই যাচ্ছিল তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ডক্টর সরকার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা দুজন ছাড়া আর কেউ ঘটনাটা জানেন?

না। গৌরব মাথা নাড়ল। বউদিকেও এখনও বলা হয়নি।

না বলাই ভালো। মেয়েরা মেয়েদের ব্যবহারের পরিবর্তন চট করে বুঝতে পারে। আপনার মাকে আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো মূলত ভিটামিন জাতীয় এবং ঘুমের ওষুধ। যেটুকু রিলিফ এই অবস্থায় দেওয়ার যায় তা ওঁকে দেব।

সৌরভ বলল, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?

মানে? ডক্টর সরকার অবাক হলেন।

আজ সকালেও মা বাগানে কাজ করেছেন, আমাদের জন্যে একটা তরকারি জোর করে রান্না করেছেন, নাতিনাতনিদের সঙ্গে গল্প–! মাথা নাড়ল সৌরভ, কোথাও ওঁর আচরণের অসুস্থতার চিহ্ন দেখা যায়নি। অথচ আপনারা বলছেন–।

ঠিকই। ওঁর প্রাণশক্তি যতক্ষণ জোরালো থাকবে ততক্ষণ উনি এসবই করবেন। কিন্তু যে মুহূর্তে ব্যথা শুরু হবে তখনই সব পাল্টে যাবে।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, মায়ের অসুখ যে স্টেজে আছে তাতে আমরা কতদিন সময় পেতে পারি বলে আপনার অনুমান?

ঠিক অঙ্ক কষে সময় বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ওটা যে স্টেজে আছে তাতে আমরা মাস তিনেকের বেশি আশা করতে পারি না।

.
 
সৌরভ খুব ভেঙে পড়েছিল। গৌরবের প্রচন্ড কষ্ট হলেও সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল। শ্যামলের গাড়িতে চেপে ওরা বেশ কিছুটা পথ আসার পর সৌরভ বলল, বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা হলে কী বলব? তার গলায় কান্না বাজছিল।

শ্যামল গড়ের মাঠের পাশে গাড়ি থামাল। বলার কোনো দরকার আছে?

মা তো জিজ্ঞাসা করবেন।

জিজ্ঞাসা করলে একটা কিছু বললেই হবে। আমি যাচ্ছি, আমি বলব।

সিটের ওপরে মাথা হেলিয়ে দিয়ে সৌরভ বলল, গোরা, তুই ভাবতে পারছিস, তিনমাস পরে মা থাকবে না। এত বছর ধরে কত অত্যাচার করেছি আমি মায়ের ওপরে। তুই আমেরিকা থেকে ঠিক মতো চিঠি দিতিস না বলে মা যখন কান্নাকাটি করত তখন আমি মাকে বকতাম। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন মায়ের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছিলাম, কত মিথ্যে কথা বলেছিলাম।

গৌরব পেছনের সিটে একা বসে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো শুনছিল। সৌরভ থামতেই বলল, দাদা তুমি এসব যত ভাববে তত ভেঙে পড়বে।

তুই তো বারো বছর দেশে ছিলি না, তুই কী করে বুঝবি আমার অবস্থা। মলি আর মায়ের মধ্যে যে ক্র্যাশ তা আমিই সামলেছি। আমি কখনও বউ বলে মলিকে সাপোর্ট করিনি আবার মা বলে তার হয়ে মলির ওপর অবিচার করতে যাইনি। আমার কষ্টটা তোরা বুঝবি না।

গৌরব মুখ ফিরিয়ে সৌরভকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। তার মানে হলো পাল্টা কথা সে অনেক বলতে পারত। কিন্তু বলে কী লাভ।

গাড়ি থেকে নামার আগে শ্যামল আবার সৌরভকে সতর্ক করে দিল। ওরা বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে বারান্দায় উঠতেই মলি বেরিয়ে এল, রিপোর্ট পাওয়া গেল?

শ্যামল হাসল, হ্যাঁ, আপনার স্বামী এবং দেওর যা ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিস্যু হয়নি। পেটে একটা আলসার মতো হয়েছে সময়মতো না খেয়ে। কোথায় উনি?

ছটফট করছেন! এত দেরি হচ্ছে কেন ফিরতে জানতে চাইছেন। জোর করে ডক্টর সরকারের ওখানে ফোন করালেন। শুনলাম বেরিয়ে গেছেন।

সৌরভ গৌরবের দিকে তাকাল, তোরা বোস। আমি একটু শোব। সে দাঁড়াল না।

মলি জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে ওর?

মাথা ধরেছে। বললাম একটা ওষুধ খেতে। রাজি হলো না। শ্যামল বলল।

আশ্চর্য। বড্ড জেদী জানেন! রাত্রে বেশ ড্রিঙ্ক করে সকালে যখন হ্যাঙ ওভার হয় তখন কিন্তু আমাকে না জানিয়ে মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খাবে আর আমি যদি কোনো অসুস্থতা দেখে ওষুধের কথা বলি সঙ্গে সঙ্গে না বলবে। রোগ বাড়লে তবে হ্যাঁ। মলি খুব বিরক্ত হয়ে যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন দরজায় এসে দাঁড়ালেন সরলা।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে বউমা?

আপনার ছেলের মাথা ধরেছে।

ও। এক কাজ করো, ও যদি ট্যাবলেট না খেতে চায় তাহলে আমার কাছে মলম আছে, ওর কপালে মাখিয়ে দাও, আরাম পাবে। সরলা বললেন।

আপনার ছেলে কি কচি খোকা যে আপনি যা বললেন তাই শুনবে। এর আগে যতবার মাথা ধরার সময় কাছে গিয়েছি বিরক্ত হয়েছে সাত বার তো বলেই দিয়েছে এই সময় তুমি আমাকে একদম বিরক্ত করবে না। আমি খাব না। মলি বলল।
 
শ্যামল হাসল, আপনারা কিন্তু মিছিমিছি চিন্তা করছেন। জ্যামের মধ্যে গাড়িতে বসে একটু ওরকম হয়েছে, রেস্ট নিলে ছেড়ে যাবে। বসুন মাসিমা। মা ঘরে ঢোকা থেকেই গৌরব তাকে লক্ষ্য করছিল। কাল পর্যন্ত যাঁকে মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ সুস্থ আজ যেন মনে হচ্ছে একটা কালোছায়া তার শরীরে মাখানো। দেখামাত্র বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল তার। সে মুখ নামিয়ে নিল।

এই সময় জিজ্ঞাসা করলেন, তোর আবার কী হলো? অমন মুখ কেন?

চমকে তাকাল গৌরব। তারপরেই কাঁধ নাচিয়ে বলল, দাদার ব্যাপারে কী বলব।

তা আমার ব্যাপারে বলবি তো।

সরলার এই কথায় মুখ তুলতে পারল না গৌরব। মায়ের সামনে চট করে মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস আজও তৈরি হয়নি। এই বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করল শ্যামল। সরলা প্রশ্ন করামাত্র সে বলল, ও কী বলবে? বলব তো আমি। কী করেছেন বলুন তো পেটের অবস্থা। আর আপনি কী রকম বউমা?

কেন? আমি কী করলাম?

উনি কি খাচ্ছেন, কখন খাচ্ছেন দেখার প্রয়োজন মনে করেন নি?

সরলা মাথা নাড়লেন, আঃ। রোগটা কী তা বলবে তো?

শ্যামল বলল, কী বলব মাসীমা! সময়মতো না খেয়ে আপনার পেটের ভেতর একটা ঘা হয়ে গেছে। আলসার। এখনই ধরা পড়ল তাই রক্ষে!

মলি বলল, ও বাব্বা। আলসার তো খুব ভোগায়!

যে ভুগতে চায় তাকে ভোগায়।

অপারেশন করাতে হবে? মলি বলে যাচ্ছিল, আমার এক পিসিমার আলসার হয়েছিল, অপারেশন করার পর ভালো হয়ে গিয়েছে।

না, না। ওঁর একদম প্রাথমিক অবস্থা। অপারেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। যেটা দরকার সেটা আপনার ওপরে। মলির দিকে তাকাল শ্যামল।

আমার ওপরে? মলি অবাক।

হ্যাঁ। নিয়ম করে ওঁকে খাওয়াতে হবে। কোনোরকমে ঝাল-মশলা চলবে না। সেদ্ধ, সূপ, একটু আধটু মিষ্টি চলবে। ঝাল কিংবা মশলা ওঁর কাছে বিষ বলে মনে করবেন। শ্যামল সিরিয়াসলি বলছিল আর তার দিকে তাকিয়ে বোধহয় গৌরব অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কি সহজে শ্যামল সব ঢেকে ফেলছে।

মলি বলল, মা। আর আপনার কথা শুনব না। আমি যা বলব তাই এখন থেকে আপনাকে করতে হবে।

সরলা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো না করলে পেটে যে ঘা হয় তার জন্যে কি কাশি হয়?

হতে পারে। শ্যামল মাথা নাড়ল, পেটের সঙ্গে শরীরের সব অংশের সংযোগ আছে। কাশিটা ওই কারণে হতেই পারে। আপনাকে কয়েকটা ওষুধ নিয়ম করে খেতে হবে। রোজ সকাল বিকেল নিয়ম করে বাগানের কাজ যেমন করছিলেন করে যাবেন। অসুখের কথা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন।

হঠাৎ বাগানের কথা উঠছে কেন?

না, মানে আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যাতে ব্যাহত না হয় তাই বলছি।

শ্যামলের যুক্তি শুনে মা উঠে গেলেন। মলি বলল, চা খাবেন তো?

শ্যামল মাথা নাড়ল, না। আমি এখন চলি।
 
গৌরব ওকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল। তার ওপরে উঠতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল শ্যামলের সব কথা মন দিয়ে শুনেও সরলা যেন কোথায় একটা অবিশ্বাস রেখে দিয়েছেন। মুখোমুখি হলেই তিনি সেই মতো প্রশ্ন শুরু করবেন। এই মুহূর্তে হয়তো সত্যি কথাটা বেরিয়ে আসতে পারে। সে মোক্ষদাকে দেখতে পেল, মোক্ষদা। আমি আর ওপরে উঠব না। তুমি মা-বউদিকে বলে দিও আমি একটু বের হচ্ছি।

এইতো ফিরলে। পায়ে সরষে লাগিয়ে রাখো নাকি? কিছু খেয়ে যাও।

মোক্ষদা গৌরব একা থাকলে মন খুলে কথা বলে।

নাগো। খিদে নেই। আর আজ রাত্রে আমার বাইরে নেমন্তন্ন আছে। ওদের সবাইকে খেয়ে নিতে বল। গৌরব বেরিয়ে এল বাইরে। ইচ্ছে করেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিল না। মন বলছিল সরলা নিশ্চয়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখছেন। চোখাচুখি হলেই ধরা পড়ে যাবে সে।

এলোমেলো হাঁটছিল গৌরব। সন্ধে হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হলো সে কি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে? বাস্তবের মুখোমুখি হবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এটা কি তার চারিত্রিক দুর্বলতা? নইলে সে মায়ের মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছে না কেন? শুধুই মিথ্যে কথা বলার দায় থেকে মুক্তি পেতে? পৃথিবীতে কেউ তো চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি মানুষকে একটু আগে অথবা পরে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। সেই একই নিয়মের শিকার হয়েছেন মা। অতএব যা সত্যি তাকে স্বীকার করাই স্বাভাবিক হবে। এরকম একটা ভাবনা ভেবেও কিন্তু সহজ হতে পারছে না গৌরব। সে একটা ট্যাক্সি ডাকল।

জয়তীদের বাড়িতে পৌঁছে মন স্থির হলো গৌরবের। দরজা খুলল জয়তী। খুলেই গৌরবের মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার?

কেন? গৌরব মুখ ফেরাল।

ভেতরে এস।

গৌরব বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কেমন আছ?

আমার কথা ছেড়ে দাও। তোমার চেহারার এই অবস্থা হলো কেন?

গৌরব মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করল। চটপট তার পাশে চলে এল জয়তী। একটা হাত আলতো করে গৌরবের কপালে রাখল। খুব নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোনো খারাপ খবর পেয়েছ?

সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ল গৌরব। ডক্টর সরকারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর যে শক্তি দিয়ে নিজেকে সংযত রেখেছিল তা এক কথায় ভেঙে গেল। জয়তীর হাত আঁকড়ে মুখের ওপরে ধরে সে শব্দ করে কেঁদে উঠল। জয়তী হতচকিত। দ্রুত সে গৌরবের পাশে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরল তাকে, কী হয়েছে গৌরব? তুমি কাঁদছ কেন?

প্রথম কান্নাটা বুক থেকে উঠে আসতেই আবার শক্তি ফিরে পাচ্ছিল গৌরব। জয়তীর বুকের ওপর চেপে থাকা তার মুখ একটু একটু করে সহজ হতেই সে মাথা তুলল। জয়তী তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিল। সে আর কোনো প্রশ্ন করছিল না। মানুষটাকে শান্ত হবার জন্য সময় দিচ্ছিল। ওই একই ভাবে ওরা বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর যেন সম্বিত ফিরতেই গৌরব সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। জয়তী বলল, না। তুমি এভাবেই থাকো।

মাসীমা আসতে পারেন।

মা বাড়িতে নেই।

গৌরব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, জয়তী!

বলো।

মা–৷ গৌরবের গলার স্বর রুদ্ধ হলো। জয়তী চুপ করে রইল। যেন গৌরবকে বলতে দিল। গৌরব ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর বলল, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন অসহায় এ জীবনে কখনও হইনি। মায়ের সবরকম ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। আজ রিপোর্ট পেয়েছি।

কী আছে রিপোর্টে?

মায়ের ক্যানসার হয়েছে। অ্যাডভান্সড স্টেজ। আর মাস তিনেক।
 
কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র শক্ত হয়ে গেল জয়তী। হঠাৎ তারও চার পাশ কেমন কাঁপতে লাগল। সরলার মুখখানা মনে করতেই সে বলে উঠল, না!

এটাই সত্যি জয়তী। মাকে কিছুই জানানো হয়নি। বলা হয়েছে ওঁর পেটে আলসার হয়েছে। কিন্তু আমি জানি আমাকে একা পেলেই মা জিজ্ঞাসা করবেন তার কী হয়েছে। আমি তখন কী জবাব দেব?

জয়তী উত্তর দিল না। দীর্ঘ সময় ওরা চুপচাপ বসে রইল। শেষ পর্যন্ত গৌরব উঠল। জয়তী মুখ ফেরাল, কোথায় যাচ্ছ?

দেখি।

না, এভাবে পাগলের মতো তুমি ঘুরে বেড়াবে না।

জয়তী, তুমি বুঝতে পারছ না, আমার সমস্ত মন জ্বলে যাচ্ছে।

ডাক্তার কি কোনো আশা দেননি?

না। শুধু ঈশ্বর যেন মাকে ক্যানসারের শেষ যন্ত্রণাটা থেকে মুক্তি দেন সেই প্রার্থনা করতে হবে। বাট হোয়াই? আমার মায়ের মতো সর্বংসহা মহিলা, যাঁকে সারাজীবন প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে তার শেষ জীবনে ঈশ্বর এমন শাস্তি কেন দিলেন? কর্মফল বলে কি তাহলে কিছু নেই? প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ল গৌরব। জয়তী উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তুমি একটু শান্ত হও। এখন এত উত্তেজিত হলে মাসীমার কোনো উপকারই তুমি করতে পারবে না।

কী উপকার করব জয়তী? ঈশ্বর আমাকে ঠুটো জগন্নাথ করে রেখেছেন। আমরা মায়ের কোনো উপকারই করতে পারি না।

কিন্তু তাকে একটু স্বস্তি, একটু আরাম দিতে পারি। আমি জানি তোমার কিরকম কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ভেবে দ্যাখো, এছাড়া আমরা আর কী করতে পারি।

গৌরব জয়তীর দুটো কাঁধ ধরল, মা যদি জিজ্ঞাসা করেন কী বলব?

যা বলা হয়েছে। আমার মনে হয় তিনি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। মাসীমা সাধারণ মহিলাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী।

সোফায় ফিরে এল গৌরব। সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।

কিছুই হয় নি। ভুলে যেও না মা এখনও আছেন।

হ্যাঁ, আছেন। একমাত্র মিরাকল ছাড়া কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।

তুমি বাড়ি থেকে আসছ?

হ্যাঁ।

কী বলে এসেছ?

মোক্ষদাকে বলেছি নেমন্তন্ন আছে।

মোক্ষদাকে কেন?

তখন নিচে কেউ ছিল না।

জয়তী নিশ্বাস ফেলল, এখানে খেয়ে যাবে?

না।

তাহলে তো তুমি কোথাও খাবে না।

দেখি।

না। এভাবে চললে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে যদি তুমি মাকে সুস্থ করতে পারতে তাহলে আমিই তোমাকে সেটা করতে বলতাম।

আমার কিছুই ভালো লাগছে না জয়তী।

গৌরব, তুমি স্বাভাবিক হও। তোমার অস্বাভাবিকতা দেখে মাসীমা আরও তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ওঁর জন্যে তোমাকে ঠিকঠাক আচরণ করতেই হবে। জয়তী বলল, শোনো তুমি এখানে খেয়ে যাবে।

তোমাকে আবার–।

না। এটুকু যদি না পারি তাহলে বাঙালি মেয়ে হয়ে জন্মানো উচিত হয়নি আমার। তবে খুব ভালো কিছু খাওয়াতে পারব না আজ। আমি যা খাব তাই তোমাকে খেতে হবে।

আঃ। আজ আমি খাওয়া নিয়ে মোটেই ভাবছি না।

.
 
রাত এগারোটা নাগাদ বাড়িতে ফিরল গৌরব। সমস্ত বাড়ি নিঝুম। মোক্ষদা দরজা খুলতেই গৌরব জিজ্ঞাসা করল, মা কেমন আছে?

ভালো। মোক্ষদা বলল, একটু আগেও তোমার খোঁজ করছিল।

আলো না জ্বেলেই সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল গৌরব। মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ। সে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালল। এক মুহূর্ত দাঁড়াল।

খেয়ে এসেছিস?

গৌরব চমকে পেছন ফিরতেই দরজায় মাকে দেখতে পেল।

হ্যাঁ। গৌরব মাথা নেড়ে জামা খুলতে লাগল। এক ধরনের নার্ভাসনেস তার ভেতরে সক্রিয় হয়ে উঠল।

নেমন্তন্ন ছিল?

হ্যাঁ।

কোথায়?

জয়তীদের বাড়িতে।

ও। বলিসনি তো।

ভুলে গিয়েছিলাম।

কেমন আছে ওরা?

আছে।

শোন। আমি চাইছি দিন দশেকের মধ্যে বিয়েটা সেরে ফেলতে৷ তার আগে যদি লগ্ন থাকে তাহলে আরও ভালো হয়।

কেন?

আমি চাইছি তাই।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি, সব ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে।

কলকাতা শহরে সব কিছুই করা সম্ভব।

দেখি।

দেখি না। এটা আমার ইচ্ছে। জয়তীকে এ বাড়ির বউ হিসেবে আমি তাড়াতাড়ি দেখতে চাই। সেই মতো ব্যবস্থা কর।

ওদেরও তো সুবিধে-অসুবিধে আছে।

আমি গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলব?

না, তার দরকার নেই। ঠিক আছে তাই হবে।

শুয়ে পড়। সরলা চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গৌরব। তার মন পরিষ্কার বুঝে নিল মা জানেন তাঁর হাতে আর বেশি সময় খরচ করার মতো নেই।

.

বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সৌরভ। চিঠি ছাপানো, বিলি করা, ক্যাটারারকে বলা থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় কাজ সে একাই করতে লাগল। এসব শুনে জয়তীর মা সহযোগিতা করলেন। কিন্তু কারো ইচ্ছেপূরণের জন্যে এই তাড়াহুড়ো তা প্রত্যক্ষ হওয়ামাত্র এক ধরনের অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছিল।

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙল গৌরবের। ভাঙামাত্র তার কান সজাগ হলো। প্রতিদিনের মতো আজও সে মায়ের কাশি শুনবে বলে ভেবেছিল। দীর্ঘসময় ধরে এক যন্ত্রণাদায়ক কাশি। কিন্তু আজ সব কিছু আশ্চর্যরকম শান্ত। কোনো আওয়াজ কানে এল না তার। কাল রাত্রে সরলা মলির সঙ্গে বেশ বিয়ের কাজকর্ম তদারকি করেছেন। বিয়ের জন্য যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে সৌরভ সেটা কীভাবে সাজাতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের কাকে কী দেওয়া দরকার তার এটা লিস্ট করেছিলেন সেটারও অদলবদল করেছেন। আর দূরে বসে তার দিকে তাকিয়ে গৌরব চুপচাপ ভেবে যাচ্ছিল। এই মানুষটির জীবন একেবারে কানায় এসে ঠেকেছে। যে কোনো ব্যাপারে আগ্রহের অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। মুখের রঙ পাল্টে গিয়েছে, শরীর শীর্ণ হয়েছে আরও কিন্তু মনের চেহারার বদল হয়নি।
 
গৌরব আরও কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। ক্রমশ তার একটি অস্বস্তি বাড়ল। ওষুধে কি কাজ হচ্ছে? কাশি বন্ধের কোনো ওষুধ শ্যামলদা দিয়েছেন কি না তার জানা নেই। সে উঠল। বাসি মুখেই দরজা খুলে মায়ের ঘরে এল। অদ্ভুত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল সে। মনে হচ্ছিল বন্ধ দরজা খুলেই ভয়ানক কিছু দেখতে পাবে। তবু দরজায় শব্দ করতে সাহস হচ্ছিল না তার। বনির ঘুম যদি না ভাঙে তাহলে সে বুঝতেও পারবে না তার ঠাকুমার কি হয়েছে। সে চাপা গলায় ডাকল, মা।

কোনো সাড়া এল না। সে আবার ডাকল, মা ওঠো, ভোর হয়ে গেছে।

এবারও কোনো সাড়া নেই। গৌরব দরজায় শব্দ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল কাশির শব্দ হচ্ছে। বেশ জোরে। সে চট করে মুখ ফেরাল। শব্দটা আসছে বাইরে থেকে। দ্রুত ব্যালকনিতে চলে আসতেই তার নজরে পড়ল, বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুকে হাত চেপে কাশি সামলাবার চেষ্টা করছেন সরলা। যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উবু হয়ে বসলেন। এবং কাশির সঙ্গে এবার রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এল। দৃশ্যটা দেখে চিৎকার করে উঠল গৌরব, মা!

সেই অবস্থায় মুখ ফেরালেন সরলা। তার ঠোঁট রক্তে লাল। কিন্তু তা বিস্মৃত হয়েই তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। বাঁ হাত নেড়ে বোঝাতে চাইলেন কিছু হয়নি। গৌরব দৌড়াতে লাগল। তার মা চিৎকার এত জোরে হয়েছিল যে মলির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে বারান্দায় এসে দেখল গৌরব ছুটে গিয়ে সরলাকে জড়িয়ে ধরেছে।

রক্তে ঘাস ভিজে যাচ্ছিল। সরলা দুহাতে আকঁড়ে ধরেছিলেন গৌরবকে। গৌরব মুখ ফিরিয়ে মলিকে দেখেই চিৎকার করল, শ্যামলদাকে ডাকো। তাড়াতাড়ি।

সরলা হাত নেড়ে নিষেধ করল কিন্তু মলি ছুটে গেল টেলিফোনের দিকে। ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে সৌরভ। ধরাধরি করে তাকে নিয়ে ওরা ওপরে সরলার ঘরে চলে এল। তখনও বনি ঘুমিয়েছিল। তাকে তোলা হলো। সরলা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন। সেই অবস্থায় চিৎকার করে উঠলেন, ছেড়ে ফেল, জামা ছেড়ে ফ্যাল। ও মাগো। গৌরব নিজের জামার দিকে তাকাল। ছোপ ছোপ রক্ত লেগে রয়েছে তাতে। ছটফট করছে অথচ কিছু করার নেই। শ্যামল এল বেশ তাড়াতাড়ি। দেখে শুনে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিল। দিয়ে বলল, আপাতত ঘুম আসবে কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। একবার যখন পেইন শুরু হয়েছে তখন সামলানো অসম্ভব। আমি বলি কি, ওঁকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাও।

কেন? গৌরব জিজ্ঞাসা করল।

বেটার কেয়ার নেওয়া হবে।

কী বেটার হবে সেখানে? গৌরব মাথা নাড়ল, আপনারাই তো বলেছেন এর কোনো ট্রিটমেন্ট নেই! চিকিৎসা ছাড়া–!

আমি বলেছি বেটার কেয়ার নেওয়া হবে। ইঞ্জেকশনে ওষুধে ওঁকে কিছুটা আরাম দেওয়া যাবে যাতে এই যন্ত্রণাটা কম টের পান। এছাড়া, শুনতে খারাপ লাগবে, নিজের মা অমন যন্ত্রণা পাচ্ছেন তা সন্তানের পক্ষে সহ্য করা খুব কষ্টকর। ব্যাপারটা চোখের আড়ালে হওয়া উচিত।

শ্যামলদা, যা হবার এখানেই হবে। আপনি নার্স আয়ার ব্যবস্থা করে দিন চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে। অনেক যন্ত্রণা তো মাকে দিয়েছি আমরা, শেষ সময়ে এটুকু যদি সহ্য করতে না পারি–! গৌরব স্পষ্ট বলল।
 
শ্যামল কিছু ভাবছিল। এবার বলল। সৌরভ, আমি একজন স্পেশালিস্টকে এনে মাসীমাকে দেখাতে চাই। আপত্তি আছে?

যা ইচ্ছে কর। কিন্তু একটা কথা বলো তো। এই অবস্থায় মা কতদিন থাকতে পারেন? গৌরবের বিয়ে আর মাত্র দিন তিনেক বাদে। তিনচার দিন মা সেন্সে থাকবেন তো? সৌরভ জানতে চাইল।

আমরা আশা করতে পারি। শ্যামল ঘড়ি দেখল।

এই সময় মলি বলল, আচ্ছা, শুনেছি সিঁথিতে একজন সন্ন্যাসী আছেন যিনি শেকড় দিয়ে অসুখ সারিয়েছেন। তার কাছে গেলে হয় না?

সৌরভ চেঁচিয়ে উঠল, ও মলি, প্লিজ।

আশ্চর্য! তোমার বিশ্বাস না থাকলে আমার বিশ্বাস থাকতে পারে না?

পারে। যা ইচ্ছে করো, নিজে করো, আমাকে বলতে এসো না।

এবার শ্যামল বলল, ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। শুনুন, যদি শেকড়ের রসে রোগ দূর হয়ে যেত তাহলে এত হাসপাতাল ডাক্তারখানার দরকার হতো না। তবে আপনার মন যদি খুব চায় করতে পারেন। এতে আর কী ক্ষতি হবে! শ্যামলকে এগিয়ে দিতে সৌরভ নিচে নেমে গেল। মলি গম্ভীর মুখে বলল, দেখলে! কীভাবে বাইরের লোকের সামনে মুখ করল?

গৌরব বলল, এখন মাথা ঠিক নেই বুঝতেই পারছ।

আচ্ছা খুব ভালো হোমিওপ্যাথের কাছে গেলে হয় না?

হোমিওপ্যাথ!

হ্যাঁ। শুনেছি এসব বড় অসুখ হোমিওপ্যাথিতে সারে।

বেশ। খোঁজ নিচ্ছি। গৌরব আবার মায়ের ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সরলা এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। মুখ হা, চোখ যেন কোটরে বসছে। ভঙ্গিতে ক্লান্তির ছাপ। গৌরবের বুক নিংড়ে একটা কান্না উঠে আসছিল। এখন ডাক্তার আর দিনও বলতে পারছে না। বারো বছর এই মানুষটাকে না দেখে ছিল সে। সেই সময় একবারও মনে হয়নি যে মা তার পাশে নেই। আর আজ এই মুহূর্তে এত কাছে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে মা অনেক দূরে চলে গিয়েছেন। এই সময় কাঁধে স্পর্শ পেল সে। চমকে মুখ ফেরাতেই সৌরভকে দেখতে পেল। ইশারা করল সৌরভ।

বাইরের ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে সৌরভ বলল, তুই সকালেই চলে যা জয়তীদের বাড়িতে। ওকে ডেকে আন।

কেন?

মায়ের এই অবস্থায় ওর থাকা উচিত।

না না। ভিড় বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।

ভিড়? কী যা তা বলছিস? জয়তী আমদের বাড়ির বউ হবে।

যখন হবে তখন হবে।

আমি তোকে বুঝতে পারছি না গোরা।

এ অবস্থায় অন্য কিছু চিন্তা করতে পারছি না দাদা।

তাহলে আমাকেই যেতে হয়। জয়তীকে আনা খুব জরুরি। মা যদি তোর বিয়ে অবধি না থাকেন তাই একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করতেই হবে। অন্তত মায়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করতে হবে।

কী ব্যবস্থা?

আজই মায়ের সামনে তুই জয়তীকে গ্রহণ করবি।

এটা কি নাটক হয়ে যাচ্ছে না।

জীবনের অনেকটাই তো নাটক। মায়ের শেষ ইচ্ছে তুই পূর্ণ করতে চাস না?

ঠিক আছে। আমিই যাচ্ছি।

.
 
ঘন্টাখানেক বাদে গৌরব যখন জয়তীদের বাড়িতে পৌঁছল তখন সে স্কুলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে বেরুচ্ছে, তাকে দেখা মাত্র জয়তী জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার? মাসীমা কেমন আছেন?

ভালো না আজ সকালে কাশতে কাশতে ব্লাড ভোমিট করেছেন। প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

সর্বনাশ। কী করে হলো?

নিয়ম মেনে। রোগ এভাবেই প্রকাশ পায়। তোমার মা কোথায়?

আছে। কেন?

ওঁর সঙ্গে দরকার আছে।

কী ব্যাপার বলো তো?

ডাকো ওঁকে।

জয়তীর মা এলেন। সব শুনলেন। শুনে বললেন, এমন মানুষকে তোমরা বাড়িতে রেখে দিলে? বাড়িতে ঠিকঠাক যত্ন হবে?

নার্স এসে গেছে আমি দেখে এলাম।

মন খারাপ হয়ে গেল বাবা। এখনই তো কিছু ঘটবে না?

বলা যাচ্ছে না। দাদার ইচ্ছে আপনারা আমাদের বাড়িতে চলুন।

হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাব।

দাদার ইচ্ছে মায়ের জ্ঞান ফিরলে ওঁর সামনে যেন আমি জয়তীকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করি। মা দেখে গেলে খুশি হবেন।

জয়তী বলল, না। হয়তো ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেতে পারে।

জয়তীর মা বললেন, এতে তো আপত্তি করার কিছু দেখি না। ওঁর আশীর্বাদ জয়তীরও দরকার। তুই কি এই শাড়ি পরেই যাবি?

জয়তী কোনো কথা বলল না।

ট্যাক্সি থেকে নেমে আসতেই মলিকে দেখতে পেল গৌরব। সে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম ভেঙেছে?

না। তোমার দাদা এতক্ষণ বসেছিল, বনিকে বসতে বলেছি। আর নার্স তো আছেই। আয়া এখনও পৌঁছায়নি। মলি মুখ ফেরাল, আসুন মাসীমা। এসো জয়তী। সে জয়তীর হাত ধরল।

সরলা একই ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছেন। ওদের দেখে বনি টনি উঠে এল। ছেলেমেয়ে দুটোর মুখ শুকিয়ে আমসি। নার্স ইশারা করলেন কথা না বলতে। ওরা চুপচাপ সরলাকে দেখল। তারপর বাইরে বেরিয়ে এল।

জয়তী বলল, আমি ওঁর কাছে গিয়ে বসব?

গৌরব বলল, বেশি হাঁটাচলা করলে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

মলি জয়তীর দিকে তাকাল, ওঁর ঘুম ভেঙে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমি নার্সকে বলছি আবার ইঞ্জেকশন দেবার আগে আমাদের যেন খবর দেন। যন্ত্রণা যদি হয়ও একটু জ্ঞান নিশ্চয়ই থাকবে।

জয়তীর মা মেয়েকে বললেন, তাহলে না যাওয়াই ভালো।

মলি বলল, কী থেকে কী হয়ে গেল বলো তো? কাল রাত্রেও আমার সঙ্গে বসে বিয়ের ব্যাপারে কত কথা বললেন। আমি ঠাট্টা করলাম, ছেলের বউকে নিয়ে আমেরিকায় ছেলের বাড়ি দেখে আসুন।

জয়তীর মা বললেন, এই তো জীবন। আগে থেকে যদি বোঝা যেত।

এই সময় নার্স বারান্দায় এসে চাপা গলায় বলল, ওঁর সেন্স ফিরছে।

সৌরভ বেরিয়ে এসেছিল, শোনামাত্র সে আগে ছুটল।

সরলা মাথা এপাশ ওপাশ করছেন। যন্ত্রণার চিহ্ন স্পষ্ট ওঁর মুখে। সৌরভ ওঁর পাশে গিয়ে বলল, মা মা, জয়তী এসেছে।

সরলা চোখ খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ককানি ছিটকে এল ওর গলা থেকে, মাগো! ওঃ বাবাগো!

নার্স বলল, আপনারা যা করার তাড়াতাড়ি করে নিন। আমি এখনই ইঞ্জেকশন দেব। পেইন বাড়ছে।

যন্ত্রণা কাতর সরলা বললেন, এখানে কেন? আমাকে বাগানে নিয়ে চল। গাছপালার কাছে নিয়ে চল।

এখানে তোমার অসুবিধে হচ্ছে মা?

হ্যাঁ। নিশ্বাস নিতে পারছি না। ওঃ, আমাকে বাইরে নিয়ে চল। বাগানে নিয়ে চল। মাগো। ছটফটানি প্রবল হলো।

গৌরব বলল, দাদা, মাকে বাগানে নিয়ে চলো। বাগান মায়ের খুব প্রিয় জায়গা। ওখানে কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো মন ভালো হবে।

নার্স আপত্তি করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরলাকে সযত্নে বাইরে বের করে আনা হলো। বাগানে একটা সোফা পেতে তাতে শুইয়ে দেওয়া হলে কিছুক্ষণের জন্যে কাতরানি বন্ধ হলো। সরলা কাঙালের মতো চোখ ঘুরিয়ে চারপাশের গাছপালা দেখতে লাগলেন।

মলি ছুটে গেল ভেতরে, টেলিফোন করতে। সৌরভ সরলার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল। এবার ডাকল, মা কেমন লাগছে?
 
সরলা যেন প্রশ্নটা শুনতেই পেলেন না। তার চোখ গাছপালার ওপর কেবলই ঘুরতে লাগল। সৌরভ আবার ডাকল, মা। জয়তী এসেছে। জয়তী।

এবার সরলা যেন বুঝতে পারলেন। মুখ ঘোরালেন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জয়তীকে ডেকে সামনে নিয়ে এল সৌরভ। জয়তীর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন হাসার চেষ্টা করলেন সরলা। সৌরভ বলল, ওদের বিয়ের আগে তুমি কি আশীর্বাদ করবে?

মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বললেন সরলা। তারপর বিপরীত দিকে মুখ ফেরালেন। উঠে দাঁড়াল সৌরভ, গোরা এদিকে আয়। মলি কোথায়? মাসীমা আপনি আগে বলুন তো এই আশীর্বাদে ধান, দুর্বো লাগে নাকি? নিয়মটিয়ম কী?

কিছু লাগবে না বাবা। জয়তীর মা আঁচল মুখে তুলেছিলেন, আশীর্বাদ করলেই হয়ে যাবে। কিন্তু এবার ওঁর মুখে রোদ লাগছে যে।

এতক্ষণ আকাশে কুচি কুচি মেঘেরা ভেসে ছাতা হয়ে ঝুলছিল। ফলে পৃথিবীটা ছিল ছায়ায় ঢাকা। এখন সেই ছাতা সামান্য সরেছে। নার্স মহিলাটি অসহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার বললেন, কী করবার করে নিন, আমি আর এখানে ফেলে রাখতে চাই না। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘরে নিয়ে যাব।

আর তখনই যন্ত্রণাটা বাড়ল। সমস্ত শরীর উথাল পাথাল। নার্স একটুও বিলম্ব না করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলো সরলার শরীরে। তখনও নার্ভগুলো শিথিল হয়নি। সৌরভ আবার বসে পড়ল সামনে, মা, আশীর্বাদ করবে না?

সরলার ডান হাত সামান্য উঠল। কিন্তু সেটা আশীর্বাদ করার ইচ্ছায় না যন্ত্রণার কারণে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। নার্স তাগাদা দিচ্ছিলেন ওঁকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। হঠাৎ জয়তী কেঁদে উঠল। কেন কান্না জানতে অথবা ওকে সান্ত্বনা দেবার মতো মানসিকতা তখন কারো ছিল না। সরলাকে আবার ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া হলো। ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। শ্যামল এল ঘণ্টাখানেক বাদে। সব শুনে বলল, তোমরা ভেবে দ্যাখো, ওঁকে নার্সিংহোমে শিফ্ট করবে কিনা?

গৌরব বলল, যদি সেখানে একটু আরাম পায় তবে তাই করা উচিত।

আরাম পাচ্ছেন কি না তা আমরা বুঝব কি করে? ঠিক আছে। এখানেই থাকুন। তবে এখন থেকে উনি যা চাইবেন তাই করতে যেও না। আমি একটু দেখে আসি। শ্যামল চলে গেল সরলার ঘরে।

মলি বলল, নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে যদি অক্সিজেন দরকার হয় তা পাওয়া যাবে। মানে সমস্ত মেডিক্যাল হেল্প পেতে অসুবিধা হবে না। এখানে–।

সৌরভ মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী বলো জয়তী?

জয়তী মলির দিকে তাকাল, মলিদি বোধহয় ভুল বলেননি। আর সব পেলেও এখানে তো চব্বিশঘন্টা ডাক্তার পাওয়া যাবে না।

সৌরভ গৌরবকে বলল, শ্যামলকে বল ব্যবস্থা করতে! গৌরব চুপচাপ দেওয়ালের দিকে তাকিয়েছিল। কথাটা শুনেও ওঠার কোনো চেষ্টা করল না। কেমন একটা অবসাদ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মায়ের এই অবস্থায় আর যাই হোক বিয়ে করা যায় না। মায়ের জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত তো নয়। কথাটা বলার জন্যে সোজা হয়ে বসতেই শ্যামলকে দেখা গেল। মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। মুখ গম্ভীর। মলি জিজ্ঞাসা করল, ঘুমিয়ে পড়েছেন?

হ্যাঁ। এ জন্মের মতো। ভাঙা গলায় বলল শ্যামল।

হো-য়াট? চিৎকার করে উঠল সৌরভ।

ঘুমের মধ্যেই উনি চলে গেছেন। শি ইজ এক্সপায়ার্ড!

শ্যামলের কথা শেষ হওয়া মাত্র দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বনি ডুকরে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ এই দুটি বালক বালিকার অস্তিত্ব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। বনির কান্না কানে যাওয়া মাত্র সৌরভ ছুটে গেল মায়ের ঘরে। মলি দুহাতে মুখ ঢেঁকে ফুঁপিয়ে উঠল। কান্না আসছিল না কিন্তু অদ্ভুত এক শূন্যতা চারপাশ থেকে ধেয়ে এসে তাকে তুলে নিয়ে যেন লোফালুফি করতে লাগল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top