What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বুকের ঘরে বন্দী আগুন♨️ (3 Viewers)

বড়বাবু চারজনের জন্যে পঞ্চাশ টাকা বরাদ্দ করতে বড়সাহেবকে রাজি করালেন। ডাক্তারবাবুকে বললেন, “বড়সাহেবকে এই খাতে টাকা দিতে রাজি করাতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি বলি কী, টাকাটার পাঁচ ভাগ করে এক ভাগ আপনিও নিন।”

মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু, “ওসব কথা থাক।”

“আর-একটা ভাল খবর আছে। পুষিকে বলেছি দশ দিনের জন্যে দশ টাকা দেওয়া হবে। তার বেশি বড়সাহেব পারবেন না। সে গুঁইগাই করেও শেষপর্যন্ত রাজি হল। তা হলে তৈরি হয়ে নিন। এই খামটা রাখুন। এতে সমস্ত টাকা রয়েছে। আপনারা কাল সকালেই রওনা হয়ে যান,” বড়বাবু বললেন।

সকাল হতেই ফ্যাক্টরির সামনে ভিড় জমতে লাগল। কুলিলাইনগুলো থেকে দলে দলে মানুষ এসেছে। যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটে দেখতে যাচ্ছে, তাদের বিদায় জানাতে। তারা নিজেদের মধ্যে যেসব কথা বলছিল, তা সেইসব গ্রাম নিয়ে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের ছিল। তারা কেন, তাদের বাবা-কাকারাও সেই গ্রাম চোখে দেখেনি। শোনা কথার সঙ্গে কল্পনা মিশে গিয়ে গল্প ক্রমশ লম্বা হচ্ছিল।

স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারবাবু এলেন। সঙ্গে কাজের লোকের মাথায় একটা বেডিং আর সুটকেস। এতোয়ারি এবং তার মা একপাশে দাঁড়িয়ে। ফ্যাক্টরির লোকটির নাম কালু, সাহেবের বেয়ারার নাম সোমরা। দু’জনেই বেশ সেজেগুজে এসেছে। তাদের বউ-ছেলেমেয়েরা ঘিরে রেখেছে তাদের।

একটু পরে বড়সাহেব মেজ এবং ছোটসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। বড়সাহেব ডাক্তারবাবুর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, “গুড লাক। ওখানকার যত খারাপ সব এদের দেখাবে!”

গাড়ি এল। বাগানের গাড়ি। এই গাড়িতে সবাই দু’ঘণ্টা দূরে তিস্তা নদীর গায়ে গিয়ে নামবে। সেখান থেকে নৌকোয় ওপারে গিয়ে বাসে চেপে শিলিগুড়িতে পৌঁছে ট্রেন ধরবে।

বড়সাহেব বললেন, “ওরা চারজন কেন? আর-একজন মহিলার আসার কথা ছিল, সে কোথায়?”

ঠিক তখনই পুষিকে দেখা গেল দুলতে দুলতে আসছে। তার হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। বড়সাহেবকে বড়বাবু ফিসফিস করে কিছু বললে তিনি পুষিকে দেখলেন।

চোখাচোখি হওয়া মাত্র অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল পুষি। দেখা গেল বিদায় জানাতে প্রত্যেকের আত্মীয়বন্ধুরা এলেও পুষির জন্যে কেউ আসেনি। ড্রাইভারের পাশের আসনে উঠে বসলেন ডাক্তারবাবু। বাকিরা পেছনের দু’সারি আসনে। বড়সাহেব বললেন, “ডক্টর, কোনও বড় সমস্যা হলেই লোকাল থানাকে জানালে, ওরা এখানকার থানাকে ওয়্যার করে জানালে, আমি খবর পেয়ে যাব। ও হো, আপনি এটা রাখুন।”

বড়সাহেবের নির্দেশে একটা থলি এগিয়ে দিল তাঁর বেয়ারা। বড়সাহেব বললেন, “এর মধ্যে ক্যামেরা আছে। সঙ্গে অনেক ছবি তোলার জন্যে ফিল্ম। ওখানকার মানুষের দারিদ্র্যের ছবি যতটা পারেন তুলে আনবেন।”

থলিটা নিয়ে মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু। বড়সাহেব বললেন, “ওয়েল, ভালভাবে সব কাজ শেষ করে ফিরে আসুন। মনে রাখবেন, ওখানকার দু’জন মানুষ, অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীকে যেমন করে হোক এখানে নিয়ে আসবেন। ওদের মুখে না-শুনলে এখানকার মানুষ বিশ্বাস করবে না। ব্যাপারটা ভুলে যাবেন না যেন।”
 
গাড়ির চাকা গড়াতে আরম্ভ করলেই অনেকগুলো নারীকণ্ঠ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। একটু পরে পুরুষকণ্ঠ সঙ্গে যোগ দিল। কান্না যে সংক্রামক, তা আর-একবার প্রমাণিত হল। গাড়ির পেছন পেছন শ্রমিকেরা প্রথমে হাঁটতে, পরে দৌড়োতে লাগল সবাই গাড়ির পেছন পেছন। একসময় গাড়ির গতি বেড়ে যেতে তারা পেছনে পড়ে রইল।

জলপাইগুড়ি আর বার্নিশের মধ্যে যে-বিশাল তিস্তা নদী, তার ওপর নৌকো যাতায়াত করছে। চা-বাগান থেকে সেখানে পৌঁছতে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লাগল। ডাক্তারবাবু লক্ষ করছিলেন, এই পথটুকু পেছনে বসা চারজন মানুষ কোনও শব্দ করেনি। সবাই অদ্ভুত চোখে দু’পাশের গাছপালা, গ্রামের ঘরবাড়ি দেখে গিয়েছে।

ডাক্তারবাবু গাড়ি থেকে নেমে ওদের ডাকলেন। কালু বলল, “আমি যাব না ডাকদারসাব। আমার খুব ভয় করছে।”

“ভয় করছে? কেন? আমরা তো দশদিন পরে ফিরে আসব।”

ঠিক তখনই গাড়ি থেকে নেমে হাসল পুষি, “আমার তো ভয় দূরের কথা, খুব মজা লাগছে। জীবনে কখনও ট্রেনে করে কোথাও যাইনি, আজ যেতে পারব,” হাত তুলে কালুকে বলল, “তুমি কী! বাচ্চা ছেলে নাকি? নেমে এসো।”

নৌকায় চেপে নদী পেরিয়ে আসার পর সোমরা বলল, “এতবড় নদী আমি কখনও দেখিনি। নৌকোতেও আজ প্রথম চড়লাম।”

অন্যরা কথা না-বললেও মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তারাও একইরকম ভাবছে। নদীর এ পাশে তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। প্রথম ড্রাইভার সাগ্রহে রাজি হল শিলিগুড়ি স্টেশনে ওদের পৌঁছে দিতে। ভাড়া নিয়ে একটুও দরাদরি করল না। অনেকদিন পরে জলপাইগুড়ি শহরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ডাক্তারবাবুর মনে হল, স্ত্রী সঙ্গে না-থাকলে চা-বাগানে থাকা সম্ভব হত না। হঠাৎ পেছন থেকে পুষির চিৎকার ভেসে এল, “রোককে, রোককে, জারা রোককে।”

ড্রাইভার ঝটপট গাড়ি থামালে পুষি জানলা দিয়ে মুখ বের করে কিছু দেখে বলল, “কী সুন্দর, কী সুন্দর!”

এতোয়ারি পুষির মাথার পাশ দিয়ে দেখতে পেল রাস্তার ধারে একটা খুব সুন্দরী মেয়ের ছবি টাঙানো রয়েছে। এত সুন্দরীকে সামনাসামনি দূরের কথা, ছবিতেও কখনও দেখেনি সে।

ডাক্তারবাবু গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে বললেন, “চলো।”

গাড়ি চলতে শুরু করলে আবার বসে পড়ে পুষি জিজ্ঞাসা করল, “বাব্বা! এত সুন্দরী মেয়ে সত্যি সত্যি হয়?”

“ছবিটা আমি দেখিনি, বলতে পারব না,” ডাক্তারবাবু বললেন।

শিলিগুড়ির টাউন স্টেশনটি বেশ ছোট। অবশ্য সারা দিনে হাতে গোনা কয়েকটি ট্রেন এই স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ভাড়ার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে একটা অপেক্ষাগৃহে ঢুকে ডাক্তারবাবু বললেন, “তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো। ওপাশে বাথরুম আছে। ছেলেরা আমার সঙ্গে এসো।”

এখন দুপুর প্রায় শেষ। সামনের দোকান থেকে চারজনের জন্যে খাবার কিনে ওদের পাঠিয়ে দিয়ে, ডাক্তারবাবু স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে দেখলেন, ভদ্রলোক বাঙালি। আলাপ হল।

সব শুনে ভদ্রলোক বললেন, “আমি এতদিন এখানে আছি, কাউকে আপনার মতো উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করতে দেখিনি। আপনি কি ওদের সঙ্গে যাবেন, না আলাদা কোচে যেতে চান?”

“ওদের আলাদা ছাড়া উচিত হবে না। ওই ক্লাসে আমার তেমন অসুবিধে হবে না। অন্য কোচে গেলে চিন্তায় থাকব,” ডাক্তারবাবু বললেন। স্টেশন মাস্টার টাকা নিয়ে তাঁর কর্মচারীকে দিয়ে টিকিট করিয়ে আনলেন। বললেন, “ও হ্যাঁ, দু’মিনিট বাঁ দিকে গেলে ভাল খাবারের দোকান পাবেন। বললে ওরা পথের জন্যে প্যাক করে দেবে।”
 
টিকিট নিয়ে ওয়েটিং রুমে এসে ডাক্তারবাবু দেখলেন, একদিকের মেঝের ওপর বসে আছে এতোয়ারি। উলটোদিকে কালু ও সোমরা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পুষিকে না-দেখতে পেয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “পুষি কোথায়?”

ছেলেরা তাকাল। কালু হাত তুলে দরজা দেখিয়ে বলল, “বাইরে চলে গেল।”

ডাক্তারবাবু আবার ঘরের বাইরে এসে দু’পাশে তাকিয়েও মেয়েটাকে দেখতে পেলেন না। যেরকমই জীবনযাপন করুক, পুষি যদি হারিয়ে যায় তা হলে তাঁকেই জবাব দিতে হবে।

খানিকটা এপাশ-ওপাশ ঘোরার পর ডাক্তারবাবু পুষিকে দেখতে পেলেন। একটা সিগারেটের দোকানের সামনে দুটো ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হেসে কথা বলছে। তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন, “পুষি!”

ঘাড় ঘুরিয়ে পুষি তাঁকে দেখে একটা হাত নাড়ল। তখনই ডাক্তারবাবু দেখলেন, ওর অন্য হাতে সিগারেট জ্বলছে। শ্রমিক মেয়েরা বিশেষ করে যাদের একটু বয়স হয়েছে, তাদের বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস আছে। হাট থেকে তামাক পাতা আর তামাক কিনে বাড়িতে বিড়ি বানিয়ে নিলে খুব কম খরচ হয়। কিন্তু পুষির হাতে সিগারেটটা খুব চোখে লাগল।

ছেলেদের কিছু বলে পুষি বেশ কায়দা করে সিগারেট নিভিয়ে হেলতে দুলতে কাছে এল, “একটু দেখতে না-পেয়ে মাথাখারাপ হয়ে গেল নাকি! বলুন কী বলছেন।”

“তোমরা চারজন একসঙ্গে থাকবে, একা কোথাও যাবে না। এটা তো চা-বাগান নয়। বদমাশ লোকজন চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে!”

“ও মা! তাই?” হাসল পুষি।

“যাও, ওদের কাছে যাও।”

“আচ্ছা আপনি বদমাশ লোকদের চেনেন?” তাকাল পুষি।

“তাদের দেখে বোঝা যায় না, ব্যবহারে প্রকাশ পায়।”

“ও! কিন্তু ওই যাদের এনেছেন, তাদের সঙ্গে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগছে না। বিচ্ছিরি,” ঠোঁট বেঁকাল পুষি।

“মানে?” অবাক হলেন ডাক্তারবাবু।

“সেই চা-বাগান ছাড়ার পর কেউ কথা না-বলে মুখ ভেড়ার মতো করে বসে আছে। কথা বললেও উত্তর দেয়নি।”

“তুমি এতোয়ারির সঙ্গে কথা বলতে পারো!”

“এতোয়ারি? সে তো সতী-সাবিত্রী! আমার সঙ্গে কথা বললে যদি তার চরিত্র খারাপ হয়ে যায় এই ভয়ে কুঁকড়ে আছে,” খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পুষি।

“তুমি তো খুব বাচাল! যাও, ওদের সঙ্গে বসে থাকো। খবরদার একা একা কোথাও যাবে না। এটা শহর, চা-বাগান নয়। এখানকার মানুষেরা সবাই সরল নয়। যাও!” শেষ শব্দটা বেশ জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন ডাক্তারবাবু।

অবাক হয়ে একবার ডাক্তারবাবুকে দেখে স্টেশনের ঘরের দিকে চলে গেল পুষি। ডাক্তারবাবু লোকগুলোর মুখ দেখে বুঝলেন বেশ হতাশ হয়েছে।
 
কাঠের বেঞ্চ, যাত্রী কম থাকায় তাতেই কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে। যতই সংকুচিত হয়ে থাকুক, মানুষ দেখেই শেখে। ট্রেন ছাড়ার পর খাওয়া সেরে সোমরা এবং কালু সাহসী হল। ওরা ওপাশের একটা খালি বেঞ্চে দু’পাশে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। জানলার ধারে বসে ছিল পুষি। তার পাশে এতোয়ারি। ট্রেন চলছে সাধারণ গতিতে। ডাক্তারবাবু ওদের উলটোদিকে বসে আদিবাসীদের ইতিহাস সংক্রান্ত একটা বই পড়ছিলেন।

হঠাৎ পুষি চিৎকার করে এক হাতে চোখ চেপে এপাশে মুখ ফেরাল।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে?”

বাঁ হাতে একটা চোখ ঢেকে অন্য খোলা চোখে তাকাল পুষি। বলল, “উঃ, কী একটা ঢুকল চোখে। খুব জ্বলছে ওঃ মাগো?”

“ধোঁয়ার সঙ্গে ইঞ্জিনের কয়লার কুচি উড়ে আসে। তারই গুঁড়ো হয়তো ঢুকেছে। এতোয়ারি ওর চোখ থেকে গুঁড়োটা এই রুমালের একটা কোণ দিয়ে তুলে বাইরে বের করে দাও। অস্বস্তি চলে যাবে,” ডাক্তারবাবু বললেন।

একটু ইতস্তত করল এতোয়ারি। তারপর ডাক্তারবাবুর এগিয়ে দেওয়া রুমাল নিয়ে পুষির পাশে বসে নিচু গলায় বলল, “চোখ খুলে তাকাও।”

পুষি চোখ বড় করল। করে আঃ, আঃ বলতে লাগল।

রুমালের কোনা সুচলো করে চোখের কোণ থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কয়লার কুচি বের করে এনে এতোয়ারি বলল, “বেরিয়ে গেছে।”

পুষি তিন-চারবার চোখের পাতা ফেলে বন্ধ করে চিৎকার করল, “ওঃ, এখনও কচকচ করছে। বের হয়নি।”

এতোয়ারি বলল, “দেখি!” সে আবার ভাল করে চোখ দেখে নিয়ে বলল, “আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

“কিন্তু আমার চোখে ব্যথা করছে!” কাঁদো কাঁদো হল পুষি।

ডাক্তারবাবু দেখলেন, এতোয়ারি তার আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে রুমালটা এগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে বাধ্য হয়ে ডাক্তারবাবু পুষির সামনে গিয়ে বললেন, “দেখি চোখটা, মুখ ওপরে তোলো।”

আদুরে আদুরে ভঙ্গিতে পুষি মুখ তুলে দু’চোখই বন্ধ করে রাখল। চিবুকে আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে ডাক্তারবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “চোখ খোলো।”

সঙ্গে সঙ্গে দুটো চোখই খুলল পুষি। ডাক্তারবাবু যখন পরীক্ষা করছিলেন, তখন লক্ষ করলেন পুষি যে-চোখে ময়লা পড়েনি, সেই চোখ বারবার খুলছে আর বন্ধ করছে। দেখা হয়ে গেলে ডাক্তারবাবু বললেন, “ওপাশের ছোট্ট দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে ভাল করে চোখ ধুয়ে এসো। ময়লা যা ছিল বেরিয়ে গেছে। যাও।”

যে-চোখে ময়লা পড়েছিল সেই চোখের পাতা কয়েকবার খোলা বন্ধ করে একগাল হাসল পুষি, “নাঃ, চলে গেছে। আর ধুতে হবে না। আপনি হাত দিলেই সব অসুখ সেরে যায়।”
 
দু’-দু’বার ট্রেন পালটে ওরা যখন মহুয়ামিলন স্টেশনে পৌঁছল, তখন দুটো দিন কেটে গিয়ে তৃতীয় দিনের ভোর এসেছে। ওরা পাঁচজন ছাড়া খুব অল্প যাত্রী ট্রেন থেকে নামল, উঠল। টিকিট দেখিয়ে বাইরে আসার সময় ইউনিফর্ম পরা একটি লোককে দেখে ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন ইনি স্টেশন মাস্টার। এগিয়ে গিয়ে বললেন, “গুড মর্নিং। আমি ডক্টর মুখার্জি। নর্থ বেঙ্গল থেকে আসছি। আপনি…”

“স্টেশন মাস্টার অফ দিস স্টেশন,” বলতে বলতে ভদ্রলোক গর্বের হাসি হাসলেন।

“আপনার কাছে একটু সাহায্য চাইছি।”

“ইয়েস!” ভদ্রলোক বোধহয় বাংলা বলতে চাইছিলেন না।

“কাছাকাছি থাকা-খাওয়ার হোটেল কোথায় আছে?”

“নো হোটেল।”

“সর্বনাশ!”

“হোয়্যার টু গো?”

“আমরা এখানকার গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে চাই।”

“ও! দেন ইউ আর গভর্নমেন্ট অফিসার। ইউ ইন মাই স্টেশন। দেয়ার ইজ় আ গেস্টরুম। দে আর উইথ ইউ? দেন দে ক্যান স্টে ইন দ্য প্লাটফর্ম। ফুড ইজ় নো প্রবলেম। মাই নেম ইজ় মিস্টার এস কে দে,” ভদ্রলোক হেলতে-দুলতে চলে গেলেন।

খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে একটা বুড়ো লোক হাফপ্যান্ট আর চাদর মুড়ি দিয়ে কথা শুনছিল। স্টেশন মাস্টার চলে গেলে এগিয়ে এল সে। কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, “আপনারা যদি থাকা-খাওয়ার জায়গা চান, তা হলে দু’মাইল দূরে মরা সাহেবের বাংলোতে চলে যান।”

“মরা সাহেবের বাংলো মানে?”

“ওখানে একজন বুড়ো সাহেব থাকতেন। অনেকদিন হল মরে গিয়েছেন। এখন যে-বুড়িটা থাকে, তাকে সবাই ওই মরা সাহেবের বউ বলে। সঙ্গে মেয়েছেলে আছে দেখলে বুড়ি হয়তো জায়গা দিতে পারে। মুশকিল হল সাহেবের সঙ্গে থাকতে থাকতে বুড়ি আর মদেশিয়া ভাষায় কথা বলে না। বাইরের লোকের সঙ্গে শুধু ইংরেজিতে কথা বলে। আপনারা ওখানে যেতে পারেন।”

কথাগুলো মনে ধরল ডাক্তারবাবুর! লোকটির কাছে ঠিকঠাক হদিশ জেনে নিয়ে চারজনকে বললেন, তাঁকে অনুসরণ করতে।

স্টেশন ছাড়াতেই যেসব গাছ নজরে এল, তাদের উত্তরবাংলার চা-বাগান অঞ্চলে দেখা যায় না। সুরকির রাস্তা। তার ওপর গাড়ির চাকার দাগ রয়েছে। কিন্তু দু’পাশে কোনও বাড়িঘর নেই।

স্টেশনের রাস্তাটা একটা বড় রাস্তায় মিশে যেতে ডান দিকে ঘুরলেন ডাক্তারবাবু। লোকটা এই দিক দিয়েই যেতে বলেছিল। এখন পরিচিত গাছ দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগই আমগাছ। দূরে দূরে কয়েকটা খড়ের বাড়ি, কিন্তু লোকজন নজরে পড়ছে না। রাস্তাটা বাঁক নিতেই যে-বাড়িটা চোখে পড়ল, সেটা যে মরা সাহেবের বাংলো তাতে ডাক্তারবাবুর আর সন্দেহ থাকল না।

দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িটাকে বেশ যত্ন করে তৈরি করা হয়েছিল।

মানুষসমান পাঁচিলে চারপাশ ঘেরা দোতলা বাড়িটার কাছাকাছি অন্য কোনও বাড়ি নেই। ডাক্তারবাবু তাঁর দল নিয়ে বাড়ির বন্ধ লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভেতরে খানিকটা ঘাসের জমি, তারপর বারান্দা পেরিয়ে ঘরগুলো। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ, বারান্দায় কেউ নেই।

ডাক্তারবাবু ইংরেজিতে চিৎকার করে জানতে চাইলেন ভেতরে কেউ আছে কি না! দ্বিতীয়বারে নীচের দরজা খুলে কুঁজো চেহারার প্রৌঢ় বেরিয়ে ওঁদের দেখে বেশ অবাক হয়ে তাকাল। ডাক্তারবাবু বললেন, “ভেতরে আসতে পারি?”

“আপনি কে?” হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল লোকটা।

“আমি একজন ডক্টর।”

“ডক্টর? আপনি চিকিৎসা করেন?” লোকটি গলা তুলল।

“হ্যাঁ।”

সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে গেটের তালা খুলে লোকটা বলল, “ম্যাডামের শরীর খুব খারাপ, দয়া করে দেখে বলবেন, কী করতে হবে!”

“চলুন।”

“এরা?” বাকিদের দিকে তাকাল লোকটা।

“ওরা আমার সঙ্গে এসেছে। চলুন।”
 
ডাক্তারবাবু সঙ্গীদের বললেন, “তোমরা বারান্দায় অপেক্ষা করো,” নিজের সুটকেস থেকে একটা ব্যাগ বের করে এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আমার সঙ্গে এসো। ঝোলাটাকে ওখানেই রেখে দাও। তোমরা অপেক্ষা করো।”

পুষি ঠোঁট ওলটাল। বুঝিয়ে দিল এতোয়ারিকে গুরুত্ব দেওয়া তার পছন্দ হয়নি। প্রৌঢ় ওদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলে একটা ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট তিনেক পরে প্রৌঢ়র সঙ্গে একজন প্রৌঢ়া বেরিয়ে এলে, প্রৌঢ় বলল, “ইনি ডাগতারবাবু, ভেতরে নিয়ে যা।”

প্রৌঢ়া ইশারা করে ভেতরে ঢুকলে ওঁরা পা বাড়ালেন। ডাক্তারবাবু দেখলেন, সুন্দর গদিওয়ালা খাটে একটি মহিলা শুয়ে আছেন। তাঁর মাথার চুল ধবধবে সাদা। পরনে পা ঢাকা স্কার্ট। বুকের ওপর চাদর চাপা দেওয়া।

মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। বললেন, “গুড মর্নিং, আর ইউ ডক্টর?”

“ইয়েস!” কাছে গিয়ে মহিলাকে ভাল করে দেখে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কী অসুবিধে হচ্ছে?”

“সারা শরীরে ব্যথা, মাঝে মাঝে জ্বর আসছে। আমার বয়স এখন বাহাত্তর, কিন্তু আরও আট বছর আমি বাঁচতে চাই,” মহিলা বললেন।

হাত বাড়িয়ে মহিলার কবজি ধরে নাড়ি পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু বুঝলেন, গতি সামান্য বেশি। হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আশি কেন? তার বেশি?”

ডাক্তারবাবুকে থামিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন, “আমার স্বামী আশিতে মারা গিয়েছেন। ওয়েল, এখানে একজন হোমিওপ্যাথ ছাড়া কোনও ডাক্তার নেই। আমার স্বামী ওর ওষুধ পছন্দ করতেন না। মুশকিল হল এখানে কোনও অ্যালোপ্যাথি ওষুধের দোকান নেই। তুমি আমার চিকিৎসা কীভাবে করবে?”

ডাক্তারবাবু বুঝলেন মহিলা কথা বলতে ভালবাসেন। তাই উত্তর না-দিয়ে যা যা পরীক্ষা করার, তা করে কিছু প্রশ্ন করলেন। উত্তর পেয়ে বললেন, “আমার সঙ্গে সামান্য কিছু ওষুধ আছে, যা ইমার্জেন্সিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি রাঁচি থেকে ওষুধ আনানো যায়, তা হলে খুব ভাল হয়।”

ব্যাগ খুলে একটা শিশি আর ট্যাবলেট বের করে তিনি এতোয়ারিকে বললেন, “দু’চামচ জলের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দাও। দশ মিনিট পরে ট্যাবলেটটা দেবে। ম্যাডাম, যদি এই ওষুধে কাজ হয় তা হলে খুব ভাল, তা না হলে ওষুধ আনাতে হবে।”

ডাক্তারবাবু দেখলেন, মহিলা শুয়ে শুয়ে হাতজোড় করে চোখ বুজে বিড়বিড় করে, সম্ভবত প্রার্থনা করলেন।

প্রৌঢ়া মহিলার সহযোগিতায় গ্লাসের জলের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে এতোয়ারি সযত্নে খাইয়ে দেওয়ার পর বৃদ্ধা বললেন, “তোমরা নীচে গিয়ে অপেক্ষা করো। এই মেয়েটি আমার কাছে থাক।”

নীচে তিনটে ঘর খুলে দিল প্রৌঢ়া নেমে এসে। বলল, “আজকের দিনটা আপনি, আপনারা এখানে থাকতে পারেন। চার ক্রোশ দূরে একটা বাজার আছে। সেখানকার ধর্মশালায় অনেকে থাকেন। কাল সেখানে চলে যেতে পারেন।”

“অনেক ধন্যবাদ,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“ওই মেয়েটি বলল, আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। সেখানে নাকি চা গাছের বাগান আছে। এখানে নাকি মেয়েটার পূর্বপুরুষ থাকত। তারা কোথায় থাকত তাই দেখতে এসেছেন। কথাটা কি সত্যি?” প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করল।

“হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“আপনার সঙ্গের লোকদুটো কি মেয়েদের স্বামী?”

“না না। ওরা একই চা-বাগানে থাকে।”

“ওদেরও পুর্বপুরুষ এই দেশে থাকত?”

“হ্যাঁ।”

প্রৌঢ়া চলে গেলে ডাক্তারবাবু পুরুষদের এবং মেয়েদের ঘর আলাদা করে দিলেন। একটু পরে যে-লোকটি প্রথম দরজা খুলেছিল, সে দুটো প্লেট নিয়ে নীচে এল। একটা প্লেটে অনেকগুলো মোটা রুটি আর অন্য প্লেটে গুড় রয়েছে। লোকটা বলল, “ঘরেই ছোট প্লেট আছে, তাতে খাবার ভাগ করে নিন। আর হ্যাঁ, ওপরে যে-মেয়েটা আছে, সে ওপরেই খেয়ে নেবে।”

প্রৌঢ়া চলে গেলে ডাক্তারবাবু পুষিকে ডেকে বললেন, অর্ধেক রুটি আর অর্ধেক গুড় একটা প্লেটে ঢেলে পাশের ঘরে ছেলেদের দিয়ে আসতে। এইসময় প্রৌঢ়া আবার ফিরে এল। বলল, “বাড়ির পেছনে কুয়ো আছে। তার জলে স্নান করা, খাওয়া, কাপড় কাচা করা যাবে।’ তারপর পুষিকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি রাঁধতে পারো?”

পুষি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে না বলে জানাল, “এতোয়ারি, মানে যে-মেয়েটি ওপরে আছে, সে খুব ভাল রাঁধতে পারে।”

“তা হলে ঠিক আছে,” প্রৌঢ়া চলে গেল।

অবাক হয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এতোয়ারির রান্না তুমি কোথায় খেয়েছ? তোমার সঙ্গে পরিচয়ই ছিল না!”

“না থাক, দেখে তো বোঝা যায়,” হাসল পুষি, “আমার আবার রান্নাবান্না একদম ভাল লাগে না। আচ্ছা, আমরা বাইরে যাব না?”

“এতটা পথ ট্রেনে চেপে এসেছ, স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম করে নাও। তারপর বাইরে যাবে,” ডাক্তারবাবু বললেন, “ওদের ওই প্লেট দিয়ে বলে এসো বাড়ির পেছনের পুকুরের জল ব্যবহার করতে পারে।”

মুখ ভ্যাটকালেও প্লেট তুলে বেরিয়ে গেল পুষি।
 
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আগে প্রৌঢ়া এসে ডাক্তারবাবুকে ডেকে বৃদ্ধার কাছে নিয়ে গেল। বৃদ্ধাকে দেখার আগেই এতোয়ারির ওপর চোখ গেল। বেশ অবাক হলেন তিনি। এরই মধ্যে স্নান সেরে নেওয়ায় অনেক ঝকঝকে দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ছে ওর পরনের পোশাক। আসার সময় যা পরে এসেছিল, তা এখন ওর অঙ্গে নেই। যদিও পুরনো কিন্তু বেশ ধবধবে সাদা পায়ের পাতার কাছাকাছি ঢাকা স্কার্ট পরে আছে এতোয়ারি। চোখাচোখি হতে যেন লজ্জা পেল সে।

ডাক্তারবাবুকে দেখে উঠে বসলেন বৃদ্ধা, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। তিনদিন ধরে খুব কষ্টের মধ্যে ছিলাম। এখন আপনার দেওয়া ওষুধ খেয়ে খানিকটা আরাম পাচ্ছি। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব জানি না।”

“আপনি আপনার হাতটা একবার দিন তো!” পাশে বসে ডাক্তারবাবু বৃদ্ধার নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, “আপনার হয়তো একটু আরাম লাগছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও একটু সময় লাগবে।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করল, “কী খেতে দেব?”

“হালকা খাবার, যা সহজে হজম করতে পারবেন। এতোয়ারি হাসপাতালে কাজ করে, ওকে জিজ্ঞাসা করলে ঠিক বলে দেবে। এতোয়ারি, দুপুরের খাওয়ার পর ওঁকে সকালের ওষুধটা আবার দিয়ে দিয়ো,” ডাক্তারবাবুর এবার প্রৌঢ়াকে বললেন, “ওঁর মাথা ভাল করে ধুয়ে দিন। এমন করে মুছিয়ে দেবেন যেন চুলে জল না-থাকে। ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দেবেন।”

প্রৌঢ়া মাথা নাড়লে ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনারা এখানে একটু দূরে যাতায়াত করেন কীভাবে?”

“গোরুর গাড়িতে, ঘোড়াও ভাড়া পাওয়া যায়,” বৃদ্ধা বললেন, “আপনি কোথায় যেতে চান তা ওদের বলুন, ব্যবস্থা করে দেবে।”

“আমরা বাজারে যাব। ওখানকার ধর্মশালায় যদি জায়গা পাওয়া যায় তার চেষ্টা করব,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“সেটা কাল করলেও তো হবে। আজ এখন খাওয়াদাওয়া করুন,” বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করলেন।

পুরুষ দু’জনকে তাদের ঘরে খাবার দেওয়া হল। রুটি, সবজি আর ডালের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ। পুষি খাবার নিয়ে সামনে বসে বলল, “আমি তো রান্না জানি না। কিন্তু ওই মেয়েটার চেয়ে ভাল রাঁধতে পারতাম।”

ডাক্তারবাবুর খিদে পেয়েছিল, চুপচাপ খেয়ে নিলেন।
 
রোদ একটু পড়লে কালু ও সোমরাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারবাবু যখন বেরোচ্ছিলেন, তখন পুষি সঙ্গ নিল, “আমি কি ঘরে বসে থাকতে এতদূর এসেছি? আমিও আপনার সঙ্গে জায়গাটা দেখতে যাব।”

ডাক্তারবাবু পুষির কথাটা উপেক্ষা করলেন। মেয়েটি হয়তো ইচ্ছে করে ‘আপনাদের সঙ্গে’ না-বলে ‘আপনার সঙ্গে’ বলেনি। এ নিয়ে কথা বললে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। তিনি তিনজনকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। বৃদ্ধা যেভাবে এতোয়ারিকে আঁকড়ে ধরেছেন, তাতে এখন ওকে নিয়ে আসা ঠিক হত না।

এখন বিকেল হয়ে এলেও রোদের তেজ মরেনি। রাস্তায় মানুষ নেই। রোদ্দুরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ পুষি চেঁচিয়ে আঙুল তুলে পেছন দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ডাক্তারবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একটা এক-ঘোড়ার গাড়ি ধীরে-ধীরে আসছে। ওঁরা অপেক্ষা করলেন গাড়িটার জন্যে। সামনে এলে হাত তুলে থামিয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি আমাদের নিয়ে একটু ঘুরে জায়গাটাকে দেখিয়ে দেবে? এর জন্যে যা ভাড়া চাও আমরা যদি দিতে পারি নিশ্চয়ই দেব।”

লোকটা মাথা নাড়ল। তারপর যে-ভাষায় কথা বলল, তা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল পুষি। তার মুখ থেকে অনর্গল ওই ভাষায় কথা বেরিয়ে আসতে লাগল। ঘোড়ার গাড়ির চালক বেশ অবাক হয়ে গেল। তারপর মাথা নেড়ে ডাক্তারবাবুকে ইশারা করল উঠে বসতে।

ডাক্তারবাবু চালকের পেছনের আসনে উঠে বসলেন। দু’জন পুরুষ পেছনের দাঁড়ানোর জায়গায় উঠে দাঁড়াল কিন্তু পুষি পাদানিতে পা রেখে উঠে সামনের চালকের পাশে বসে পড়ল। তার মুখ থেকে কথা যেন উপচে পড়ছিল। দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকার কারণে চা-বাগানের মুন্ডা, ওরাওঁ, মদেশিয়া শ্রমিকদের মুখের ভাষা ধীরে ধীরে অনেকটা মিলমিশ হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ির চালকের ভাষা তা থেকে কিছুটা আলাদা হলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। পুষি একটু চেষ্টা করেই সেই ভাষায় কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবু লক্ষ করলেন চালক মাঝে-মাঝেই পুষিকে আড়চোখে দেখছে। ও যে খুব বিস্মিত তাতে সন্দেহ নেই।

বেশির ভাগই শুকনো মাঠ, তারপর নদীটাকে দেখা গেল। কাছে গিয়ে বোঝা গেল ওটা নদী নয়, কোথাও নিশ্চয়ই নদী রয়েছে, সেখান থেকে খাল কেটে জলের ধারা আনা হয়েছে। জলে স্রোত আছে। কিছু লোক সেই জল যাতে জমির মাটি ভেজাতে পারে, তার ব্যবস্থা করছে। লোকটার সঙ্গে কথা বলে পুষি মুখ ফিরিয়ে বলল, “এই জল নদী থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে দু’পাশের জমিতে বছরে অন্তত দু’বার ফসল ফলাতে পারে। কী ভাল, তাই না? এখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা থাকত। আমার তো মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই।”

ডাক্তারবাবু কথা বললেন না। এই আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, তা তিনি জানেন।

অনেকটা ঘোরার পর যেখানে ঘোড়ার গাড়ি এল, সেখানে চালাঘরগুলো প্রায় শূন্য। কয়েকটি মানুষ খালিগায়ে নিম্নাঙ্গে কাপড় জড়িয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু বললেন, “ধর্মশালা কোথায়?”

চালক একটি চালাঘরের সামনে ঘোড়া থামাল। নিচু গলায় পুষিকে বলল, “এই হল ধর্মশালা। এখন কেউ নেই বলে মনে হয়।”

ডাক্তারবাবু চারপাশ দেখে আবার গাড়ি চালাতে বললেন। পুষি জিজ্ঞাসা করল, “এবার কোনদিকে যেতে বলব?”

“গ্রামের দিকে যেতে বলো।”

পুষি পাশ ফিরে চালককে কথাটা বললে সে অবাক হল। পুষি হাসল, “আমরা শুধু একটু ঘুরে বেড়াব।”
 
কপালে ভাঁজ পড়ল লোকটার। পুষির কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছিল না সে। পুষি ততক্ষণে রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। চালক পেছন ফিরে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে ভঙ্গিতে বোঝাল সে পুষির কথা বুঝতে পারছে না। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি মদেশিয়া?”

দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল চালক। তারপর বলল, “আমি একটু একটু হিন্দি বুঝতে পারি। এই মেয়েটা যখন হিন্দিতে কথা বলছিল তখন বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, এখন যা বলল তা বুঝতে পারলাম না।”

“ও বলল তোমাদের গ্রাম দেখতে চায়,” হিন্দিতে থেমে থেমে বললেন ডাক্তারবাবু। মাথা নেড়ে সামনের দিকে ফিরে ঘোড়া ছোটাল চালক। ডাক্তারবাবুর মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিলেন, মানুষ যখন তার জন্মস্থান ত্যাগ করে পরবাসে যেতে বাধ্য হয়, তখন ধীরে ধীরে নতুন দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসে রপ্ত হয়ে ওঠে। পরের প্রজন্ম পূর্বপুরুষের ভাষা একটু একটু করে ভুলতে শুরু করে। তার পরের প্রজন্ম নতুন দেশের ভাষায় স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে, তবে পূর্বপুরুষদের ভাষার কিছু শব্দ তাদের বলা বাক্যে থেকে যায়, অজান্তেই মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে। এই চালক লোকটি এবং তার আত্মীয়রা এখন যে-ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষায় পুষির পূর্বপুরুষরা কোনও এককালে কথা বলত। পুষি হয়তো বাবার কাছ থেকে শোনা দু’-তিনটি শব্দ বলে চালককে বিস্মিত করেছে। অথবা এই ঘোড়ার গাড়ি চালানোর সুবাদে চালক ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে কোনওরকমে পারছে।

অনেকটা খোলা জমি পার হওয়ার পর দূরে বেশ কিছু একতলা চালাঘর দেখা গেল। চালক তার হাতের চাবুক উঁচিয়ে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “গ্রাম।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “আমরা ওই গ্রামে যাব।”

গাড়ি এগিয়ে চলল। সামনে চাষের খেত। তারপর মাঠের ধার ঘেঁষে মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি দেওয়া একতলা ঘরগুলোর সামনে বাচ্চারা খেলা করছে। ডাক্তারবাবুর অনুরোধে গাড়ি দাঁড়াল। ডাক্তারবাবু নীচে নামতেই পুষিও লাফিয়ে নামল। বাকি দু’জন গাড়ির পেছনে যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। ইশারায় চালককে নীচে নামতে বলে বাচ্চাদের দিকে এগোলেন ডাক্তারবাবু। ততক্ষণে বাচ্চারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে অবাক চোখে আগন্তুকদের দেখছে। সম্ভবত এমন অভিজ্ঞতা আগে ওদের হয়নি। আরও একটু এগোতেই বাচ্চারা চিৎকার করতে করতে যে যার ঘরের দিকে ছুটল। তারপর অনেক মানুষ বেরিয়ে এল সেই সব ঘর থেকে। প্রত্যেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে চালককে কিছু জিজ্ঞাসা করল। প্রশ্নের কিছু শব্দ পরিচিত মনে হলেও সবগুলো নয়। তবে ডাক্তারবাবু বুঝলেন। চালককে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তারা কারা, কী কারণে এসেছে?

চালক হাত নেড়ে কিছু বলে পুষির দিকে তাকাল। ভাঙা হিন্দিতে বলল, “ওদের সঙ্গে কথা বলুন!”

পুষি হাসিমুখে যা বলল, তাতে বাসিন্দাদের কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। ডাক্তারবাবু চালককে বললেন, “ওদের জিজ্ঞাসা করো, বহু বছর আগে জল আর খাবারের কথা বলে যাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের কথা ওরা শুনেছে কি না!” চালক ওই কথাগুলো দিশি ভাষায় বলামাত্র অতিবৃদ্ধরা প্রায় একসঙ্গে কথা বলা শুরু করল। চালক বলল, “ওরা বলছে এসব কথা ওরা শুনেছে।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “ওদের জিজ্ঞাসা করো, পূর্বপুরুষেরা যে-দেশে গিয়েছে সেই দেশে ওরা যেতে চায় কি না?”

চালকের মুখ থেকে প্রশ্ন শুনে অনেকগুলো মাথা একসঙ্গে দু’পাশে দুলতে লাগল, যার অর্থ ওরা যাবে না। তারপরেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল। বয়স্ক মানুষেরা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। চালক বলল, “চলুন।”
 
সন্ধে নামছিল। ডাক্তারবাবুর অনুরোধে চালক তাদের যেখান থেকে তুলেছিল, সেখানে নামিয়ে দিল। ডাক্তারবাবু পকেট থেকে টাকা বের করতেই লোকটি হেসে কোনও কথা না-বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। খুব অবাক হয়ে গেলেন ডাক্তারবাবু। তাদের জন্যে অনেক সময় নষ্ট করেছে লোকটা। কিন্তু টাকা না-নেওয়ার পেছনে একটাই কারণ অনুমান করতে পারছেন তিনি। এখানে তাঁদের আসার কী উদ্দেশ্য তা বুঝতে না-পারায় নিজেকে দূরত্বে রাখতে চাইছে চালক। এইসময় পুষি বলল, “লোকটার ভাষা ঠিক আমাদের মতো নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা কি ওর মতো কথা বলত!”

চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোড়া। শুধু পাঁচিলে ঘেরা দোতলা বাড়ির ভেতরে যে-আলো জ্বলছে, তা জানলার কাচের দিকে তাকালে বোঝা যায়। সদর দরজা ভেতর থেকে তালা বন্ধ। কয়েকবার আওয়াজ করার পর সেই প্রৌঢ় লোকটি হারিকেন নিয়ে এসে আলো মাথার ওপর তুলে পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। ডাক্তারবাবুর পরিচয় পেয়ে সে দরজা খুলে দিল।

লোকটি বলল, “অন্ধকারে বাইরে থাকলে বিপদ হতে পারে। সাপ তো আছেই, বন্য জন্তুও চলে আসে। আসুন।”

যে যার ঘরে ঢুকে দেখতে পেল আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পরে এতোয়ারি একটা থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে রাখল। ডাক্তারবাবু বললেন, “বাঃ, ওদের সাহায্য করছ দেখে ভাল লাগছে। আমরা অনেকটা ঘুরলাম। একটা গ্রামে গিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাও বললাম। কিন্তু ওদের ভাষা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না। বহু বছর আগে যারা এদেশ ছেড়ে গিয়েছিল, তাদের ভাষায় অন্য ভাষা একটু একটু করে মিশে এমন বদলে গিয়েছে যে, মূল ভাষার সঙ্গে আর মিলছে না। কিন্তু ওদের যখন জিজ্ঞাসা করলাম, যে-দেশে ওদের পূর্বপুরুষরা গিয়েছে, সেই দেশে যেতে ইচ্ছে আছে কি না, তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। ওরা খুব ভয় পেয়ে যে যার ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।”

চোখ বড় করে শুনছিল এতোয়ারি। কথা শুনে মাথা নিচু করে ঘর থেকে চলে গেল। মেয়েটির ব্যবহার এত শীতল যে, ডাক্তারবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না।

আধঘণ্টা পরে প্রৌঢ়া মহিলা দরজায় এসে বললেন, “আপনাকে একবার ওপরে আসতে হবে। উনি ডাকছেন।”

ডাক্তারবাবু প্রৌঢ়ার সঙ্গে ওপরের ঘরে ঢুকে দেখলেন বৃদ্ধা বিছানার ওপরে উঠে বসেছেন। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কেমন আছেন?”

“অনেক ভাল, আপনি খুব ভাল ওষুধ দিয়েছেন। ওই ওষুধ আর কতদিন খেতে হবে?”

“মনে হয় আর দু’দিন খেলেই হবে।”

“বাঃ,” একটু ভেবে বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা আজ কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন? কিছু দেখা হল?”

খানিক ইতস্তত করে ডাক্তারবাবু তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বিস্তারিত জানালেন। সব শুনে হাসলেন বৃদ্ধা, “আমি এই ভাঙা হিন্দি মেশানো ইংরেজি শিখেছি আমার স্বামীর কাছ থেকে। আমার স্বামী ছিলেন খাঁটি ইংরেজ। কিন্তু এই দেশটাকে ভালবেসেছিলেন। চার্চে গিয়ে বিয়ে হয়েছিল আমাদের।”

“আপনার বাবা-মা কি খ্রিস্টান ছিলেন?”

“না, না। ওঁকে বিয়ে করব বলেই আমি খ্রিস্টান হয়েছিলাম,” বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করলেন। যেন অতীতের কথা ভাবলেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top