হাসপাতালের দরজায় ছোট নার্স দাঁড়িয়েছিল। মাকে দেখে চোখ কুঁচকে বলল, “কী হল তোমার? আবার শরীর খারাপ?”
“একটু। মাথা ঘুরছে!” মা দুর্বল গলায় বলল।
“শরীর দুর্বল, ঘরে শুয়ে থাকলে উপকার হত। এলে কেন?”
“ঘরে থাকলে অপকার হত,” বিড়বিড় করল মা।
“কী বললে?” চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল ছোট নার্স।
মাথা নাড়ল মা, “কিছু না।”
“ভেতরে গিয়ে বোসো। একটু পরে নাম লেখানো হবে,” ছোট নার্স চলে গেল। এতোয়ারি বলল, “নিজে যেতে পারবে?”
“হ্যাঁ। এখন একটু ভাল লাগছে।”
আজ কাজ করতে করতে কেবলই বুধুয়ার বউয়ের মুখ মনে পড়ছিল। এতদিন যে বুধুয়ার বউ লাইনে থাকত, তা কারও তেমনভাবে নজরে পড়ত না। সেই বউটা ওরকম রুগ্ণ শরীর নিয়েও মনের জ্বালা মেটাতে স্বামীকে খুন করে তার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পর নিজেকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারল না। যতই স্বামীকে খুন করুক, আত্মহত্যা করা মানে তো নিজের কাছে নিজের হেরে যাওয়া। আত্মহত্যা না-করলে কী হত ওর? তাকে খুন করতে দেখেছে বলে কেউ সাক্ষী দিলে, পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে হয় ফাঁসি নয় সারা জীবন জেলে ঢুকিয়ে রাখত। জেলে ঢুকিয়ে রাখলে তো সে বেঁচে থাকত। তার বদলে বোকার মতো আত্মহত্যা করে ফেলল? কী লাভ হল!
দুপুরে ডাক্তারবাবু কোয়ার্টার্সে চলে যান স্নান-খাওয়া করতে। বিকেলে ফিরে আসেন হাসপাতালে। দুপুরে তেমন কাজ থাকে না। কিচেনে গিয়ে খাওয়ার প্লেট চেয়ে নিতেই এতোয়ারির মনে পড়ল মা না-খেয়ে আছে। সে প্লেট হাতে মাকে খুঁজতে বাইরে এসে হতাশ হল। মা কোথাও নেই। ডাক্তারবাবু যেখানে পেশেন্ট দেখেন, সেখানটা এখন ফাঁকা। মা কোথায় গেল, ভেবে পাচ্ছিল না এতোয়ারি।
সবে সে খাওয়া শেষ করেছে বড় নার্স সামনে এসে দাঁড়ালেন, “তুই তো ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্স চিনিস!”
এতোয়ারি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“শোন, এই প্যাকেটটা নিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে দিয়ে আয়,” বড় নার্স বললেন, “তাড়াতাড়ি যাবি। বুঝলি?”
এখন আকাশে হালকা মেঘ। প্যাকেটটা নিয়ে একটু এগোতেই দূরে গাড়ির আওয়াজ হল। নতুন লালমুখো ম্যানেজার প্রায়ই গাড়ি নিয়ে চা-বাগানের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। লোকটির চরিত্র নাকি খারাপ। চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথমেই বাংলোর বয়স্ক মহিলা কর্মচারীদের ছাঁটাই করে অল্পবয়সি মেয়েদের চাকরি দিয়েছে। ক’দিন আগে লোকটা হাসপাতালে এসেছিল। বড় নার্স যখন ওঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন দূরে দাঁড়ানো এতোয়ারিকে লোকটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। পরে বড় নার্স তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছোটসাহেবের বাংলো দেখাশোনার কাজে যেতে রাজি আছিস? এককথায় না বলে দিয়েছিল।
চটপট পাশের চা-বাগানের ভেতর লুকিয়ে পড়ল এতোয়ারি। জিপটা জোরে শব্দ তুলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আর গাড়ির রাস্তা না-ধরে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে ডাক্তারবাবুর বাংলোয় পৌঁছে গেল। ডাক্তারবাবু নিজে দরজা খুলে চারপাশে নজর বুলিয়ে বললেন, “ভেতরে এসো। দেখি প্যাকেটটা!”
দরজা বন্ধ করে প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে খুলে দেখলেন। এইসময় ভিতরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন তিনি। তারপর স্বামীকে বললেন, “আর একবার ভেবে দ্যাখো।”
“আমি অমানবিক হতে পারব না। প্লিজ়, তুমি পাশে থাকো,” ডাক্তারবাবু এতোয়ারির দিকে তাকালেন, “আমি এখানে একটা অপারেশন করব। তোমাকে সাহায্য করতে হবে। আর এই অপারেশনের কথাটা বাইরের কেউ যেন না-জানে।”
মাথা নিচু করে এতোয়ারি বলল, “আচ্ছা।”
পাশের ঘরে এল সে ডাক্তারবাবুর পেছন পেছন। একটা চৌকিতে শুয়ে যে-লোকটা ছটফট করছে, তার মুখে কিছু ঢুকিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এক ডাক্তারবাবু হিন্দিতে বাংলা মেশানো ভাষায় বললেন, “আর-একটু কষ্ট করুন। একটু পরে কষ্ট অনেক কমে যাবে।”
লোকটা মাথা নাড়ল প্রবলভাবে। ডাক্তারবাবু আলমারি খুলে চামড়ার স্ট্র্যাপ বের করে এনে লোকটার হাতে একটা দিকে বেঁধে অন্য দিকটা চৌকির গায়ে শক্ত করে জড়িয়ে দিয়ে বললেন, “হাসপাতালে গেলে তোমাকে যেটুকু আরাম দিতে পারতাম, এখানে তো তা দিতে পারব না। গুলিটা বের করে দিচ্ছি, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করো ভাই।”
“একটু। মাথা ঘুরছে!” মা দুর্বল গলায় বলল।
“শরীর দুর্বল, ঘরে শুয়ে থাকলে উপকার হত। এলে কেন?”
“ঘরে থাকলে অপকার হত,” বিড়বিড় করল মা।
“কী বললে?” চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল ছোট নার্স।
মাথা নাড়ল মা, “কিছু না।”
“ভেতরে গিয়ে বোসো। একটু পরে নাম লেখানো হবে,” ছোট নার্স চলে গেল। এতোয়ারি বলল, “নিজে যেতে পারবে?”
“হ্যাঁ। এখন একটু ভাল লাগছে।”
আজ কাজ করতে করতে কেবলই বুধুয়ার বউয়ের মুখ মনে পড়ছিল। এতদিন যে বুধুয়ার বউ লাইনে থাকত, তা কারও তেমনভাবে নজরে পড়ত না। সেই বউটা ওরকম রুগ্ণ শরীর নিয়েও মনের জ্বালা মেটাতে স্বামীকে খুন করে তার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পর নিজেকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারল না। যতই স্বামীকে খুন করুক, আত্মহত্যা করা মানে তো নিজের কাছে নিজের হেরে যাওয়া। আত্মহত্যা না-করলে কী হত ওর? তাকে খুন করতে দেখেছে বলে কেউ সাক্ষী দিলে, পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে হয় ফাঁসি নয় সারা জীবন জেলে ঢুকিয়ে রাখত। জেলে ঢুকিয়ে রাখলে তো সে বেঁচে থাকত। তার বদলে বোকার মতো আত্মহত্যা করে ফেলল? কী লাভ হল!
দুপুরে ডাক্তারবাবু কোয়ার্টার্সে চলে যান স্নান-খাওয়া করতে। বিকেলে ফিরে আসেন হাসপাতালে। দুপুরে তেমন কাজ থাকে না। কিচেনে গিয়ে খাওয়ার প্লেট চেয়ে নিতেই এতোয়ারির মনে পড়ল মা না-খেয়ে আছে। সে প্লেট হাতে মাকে খুঁজতে বাইরে এসে হতাশ হল। মা কোথাও নেই। ডাক্তারবাবু যেখানে পেশেন্ট দেখেন, সেখানটা এখন ফাঁকা। মা কোথায় গেল, ভেবে পাচ্ছিল না এতোয়ারি।
সবে সে খাওয়া শেষ করেছে বড় নার্স সামনে এসে দাঁড়ালেন, “তুই তো ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্স চিনিস!”
এতোয়ারি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“শোন, এই প্যাকেটটা নিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে দিয়ে আয়,” বড় নার্স বললেন, “তাড়াতাড়ি যাবি। বুঝলি?”
এখন আকাশে হালকা মেঘ। প্যাকেটটা নিয়ে একটু এগোতেই দূরে গাড়ির আওয়াজ হল। নতুন লালমুখো ম্যানেজার প্রায়ই গাড়ি নিয়ে চা-বাগানের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। লোকটির চরিত্র নাকি খারাপ। চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথমেই বাংলোর বয়স্ক মহিলা কর্মচারীদের ছাঁটাই করে অল্পবয়সি মেয়েদের চাকরি দিয়েছে। ক’দিন আগে লোকটা হাসপাতালে এসেছিল। বড় নার্স যখন ওঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন দূরে দাঁড়ানো এতোয়ারিকে লোকটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। পরে বড় নার্স তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছোটসাহেবের বাংলো দেখাশোনার কাজে যেতে রাজি আছিস? এককথায় না বলে দিয়েছিল।
চটপট পাশের চা-বাগানের ভেতর লুকিয়ে পড়ল এতোয়ারি। জিপটা জোরে শব্দ তুলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আর গাড়ির রাস্তা না-ধরে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে ডাক্তারবাবুর বাংলোয় পৌঁছে গেল। ডাক্তারবাবু নিজে দরজা খুলে চারপাশে নজর বুলিয়ে বললেন, “ভেতরে এসো। দেখি প্যাকেটটা!”
দরজা বন্ধ করে প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে খুলে দেখলেন। এইসময় ভিতরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন তিনি। তারপর স্বামীকে বললেন, “আর একবার ভেবে দ্যাখো।”
“আমি অমানবিক হতে পারব না। প্লিজ়, তুমি পাশে থাকো,” ডাক্তারবাবু এতোয়ারির দিকে তাকালেন, “আমি এখানে একটা অপারেশন করব। তোমাকে সাহায্য করতে হবে। আর এই অপারেশনের কথাটা বাইরের কেউ যেন না-জানে।”
মাথা নিচু করে এতোয়ারি বলল, “আচ্ছা।”
পাশের ঘরে এল সে ডাক্তারবাবুর পেছন পেছন। একটা চৌকিতে শুয়ে যে-লোকটা ছটফট করছে, তার মুখে কিছু ঢুকিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এক ডাক্তারবাবু হিন্দিতে বাংলা মেশানো ভাষায় বললেন, “আর-একটু কষ্ট করুন। একটু পরে কষ্ট অনেক কমে যাবে।”
লোকটা মাথা নাড়ল প্রবলভাবে। ডাক্তারবাবু আলমারি খুলে চামড়ার স্ট্র্যাপ বের করে এনে লোকটার হাতে একটা দিকে বেঁধে অন্য দিকটা চৌকির গায়ে শক্ত করে জড়িয়ে দিয়ে বললেন, “হাসপাতালে গেলে তোমাকে যেটুকু আরাম দিতে পারতাম, এখানে তো তা দিতে পারব না। গুলিটা বের করে দিচ্ছি, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করো ভাই।”