What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বুকের ঘরে বন্দী আগুন♨️ (1 Viewer)

মায়ের শরীর এখন স্বাভাবিক। সকালেই বড় নার্স ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতোয়ারির অনুরোধে মাকে সন্ধে পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে দিলেন তিনি। এতোয়ারি ছুটির পরে মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে।

কাজ একটু হালকা হলে এতোয়ারি ছোট নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, “দিদি, আপনি কি জানেন মহুয়ামিলন বলে যে-জায়গা আছে, সেটা কোথায়?”

ছোট নার্স অবাক হয়ে তাকাল, “মহুয়ামিলন?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।

“জায়গার নাম না ফুলের নাম?” ছোট নার্স জিজ্ঞাসা করল।

“জায়গার নাম,” এতোয়ারি জবাব দিল।

ঠোঁট ওলটাল ছোট নার্স, “বড়দিকে জিজ্ঞাসা করো, উনি হয়তো জানেন।”

বড় নার্সকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস হচ্ছিল না। ঘণ্টাখানেক পরে দুই দিদি যখন একসঙ্গে পেশেন্টদের দেখতে এলেন, তখন ছোট নার্স বলল, “এই কী নাম বলছিলি?”

বড় নার্স জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?”

“ও একটা জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল, নামটা আমার অচেনা,” ছোট নার্স হেসে কথাগুলো বলে সামনের রোগীর দিকে এগিয়ে গেল।

বড় নার্স তাকালেন, চোখে জিজ্ঞাসা।

এতোয়ারি নামটা বলল। বড় নার্স চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে মাথা নাড়লেন, “এরকম নামের কথা আমি শুনিনি। বোধহয় কোনও ছোট জায়গা বা গ্রামের নাম। কিন্তু তুমি জানতে চাইছ কেন? কোনও দরকার আছে?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি, কোনও কথা বলল না।

“তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে পারো,” বড় নার্স চলে গেলেন।

বিকেলে ডাক্তারবাবু যখন ওয়ার্ডে এলেন, তখন এতোয়ারি একজন জ্বরাক্রান্ত রোগীর কপালে জলপট্টি লাগিয়ে দিচ্ছিল। দেখতে পেয়ে ডাক্তারবাবু কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “জ্বর এখন কত?”

তাঁর পেছনে ছিল ছোট নার্স। বলল, “একশো এক।”

“তা হলে কিছুটা কমেছে। থাক, আর জলপট্টি দিতে হবে না। ওকে একবার ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দাও,” বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা হেঁটেই ফিরে তাকালেন ডাক্তার, “বড়দিদি বলছিল তুমি মহুয়ামিলনের কথা জিজ্ঞাসা করেছ।”

নীরবে মাথা নাড়ল এতোয়ারি।

“এই নামটার কথা তুমি জানলে কী করে?”

“শুনেছি,” নিচু গলায় বলল এতোয়ারি।

“ও। মহুয়ামিলন নামে বোধহয় একটা জায়গাই আছে। সেটা এখান থেকে প্রায় আট-ন’শো মাইল দূরে বিহার প্রদেশে। আমার খুব অবাক লাগছে শুনে, তুমি কার কাছে জায়গাটার নাম শুনলে?” ডাক্তারবাবুর কথা শেষ হতে না-হতেই বড় নার্স দ্রুত ঘরে এসে বললেন, “ডক্টর, ম্যানেজার সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
 
ডাক্তারবাবু চলে গেলেন কিন্তু আধ ঘণ্টা পরে এতোয়ারির ডাক পড়ল তাঁর ঘরে। সংকোচের সঙ্গে ঘরে ঢুকে দাঁড়াতেই ডাক্তারবাবু মুখ তুললেন। তাঁর সামনের টেবিলে একটা বই খোলা। বললেন, “হ্যাঁ, তুমি মহুয়ামিলন নামের জায়গাটার কথা জিজ্ঞাসা করছিলে তো?”

কথা না-বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।

“বলছি। কিন্তু তার আগে বলো এই নাম তুমি শুনলে কার কাছ থেকে?”

একটু ইতস্তত করে এতোয়ারি বলল, “ধনুবুড়ো বলেছিল।”

“ধনুবুড়ো?” কপালে ভাঁজ পড়ল ডাক্তারবাবুর। তারপর অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল যে-বৃদ্ধ মানুষটি মারা গিয়েছে তার নাম ধনুবুড়ো না?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।

“আচ্ছা!” ডাক্তারবাবু বললেন, “মহুয়ামিলন বিহারের রাঁচির কাছে একটা জায়গা। ওই নামে একটা স্টেশনও আছে। ধনুবুড়ো আর কী বলেছিল তোমাকে।”

“আমাকে বলেননি উনি। কিন্তু ওই জায়গায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন।”

“কেন?”

“বোধহয় ওখানে ওঁর দেশ ছিল, সেই দেশ থেকে উনি এখানে এসেছিলেন।”

“হ্যাঁ। চা-বাগানের প্রয়োজনে শ্রমিকদের আনা হয়েছিল বিহারের ওইসব জায়গা থেকে। তোমার সঙ্গে ঠিক কী কথা হয়েছিল ধনুবুড়োর?” ডাক্তারবাবু কৌতূহলী হলেন।

মাথা নিচু করল এতোয়ারি। সে যেটুকু জানে, তা বলা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ডাক্তারবাবু তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সে বলল, “উনি তো হাঁটাচলা করতে পারতেন না, এক জায়গায় সারা দিন বসিয়ে রাখা হত ওঁকে। কিন্তু ওঁর মন সবসময় চলে যেত ছেলেবেলায় যে-দেশ ছেড়ে এসেছেন, সেই দেশে। বয়সের জন্যে ভাল করে কথা বলতে পারতেন না। অনেক কথা ওঁর মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এমনকী, যে-দেশ থেকে উনি ছেলেবেলায় এসেছিলেন, সেই দেশের নামটাও মনে করতে পারতেন না। কাল যখন আমি বললাম, ওঁকে দেশে নিয়ে যেতে পারি, তখন খুব খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু যে-জায়গায় ফিরে যাবেন, তার কথা কিছুতেই মনে করতে পারেননি। পরে তাঁর হঠাৎ নাম মনে পড়েছিল। বাড়ির বউদের সেই নাম বলেওছিলেন। আমি তাঁর এক নাতবউয়ের মুখে নামটা শুনেছি।”

চুপচাপ শুনলেন ডাক্তারবাবু। তারপর শ্বাস ফেলে বললেন, “মহুয়ামিলন নামটা যদি কিছুদিন আগেও ওঁর মনে পড়ত, তা হলেও ওই শরীরে ট্রেনে চেপে যাওয়া সম্ভব হত না। ভেরি স্যাড। কিন্তু উনি তোমাকে বলেছিলেন যে ফিরে যেতে চান?”

“হ্যাঁ।”

“তা তো হল, কিন্তু তুমি জায়গাটা কোথায় তা জানতে চাইছ কেন?”

“উনি কতদূর থেকে এদেশে এসেছিলেন তা জানতে চাইছিলাম।”

“দ্যাখো, যখন চা-গাছের চাষ এদেশে চালু হল, তখন তা করার জন্যে শ্রমিক পাওয়া যায়নি। শ্রমিক আনা হয়েছিল বিহারের সেইসব অঞ্চল থেকে, যেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় ফসল জন্মায় না। সেখানকার মানুষ জল আর খাবারের লোভে এদেশে চলে এসেছিল দালালদের সঙ্গে। যারা এসেছিল তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবত না। চা-বাগানে কাজ করে দু’বেলা পেট ভরে খাবার খাওয়াটা তাদের কাছে এত মূল্যবান ছিল যে, তারা আর ছেড়ে আসা দেশের ভয়ংকর কষ্ট ভোগ করতে চাইত না। সেই সময় যারা এসেছিল, শুধু তারা কেন, তার পরের মানুষগুলোও এখানেই মরে গিয়েছে। হয়তো ধনুবুড়োর মতো অতিবয়স্ক কিছু মানুষ ডুয়ার্স কিংবা আমাদের চা-বাগানে এখনও অথর্ব হয়ে বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে,” কথা শেষ করে ডাক্তারবাবু তাকালেন এতোয়ারির দিকে।

মন দিয়ে শুনছিল এতোয়ারি। এই দেশ তার নয়, একথা সে-ও জানে। কিন্তু কীভাবে তাদের পূর্বপুরুষরা এদেশে এসেছিল, সেই কাহিনি সে কারও কাছে শুনতে পায়নি।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব কথা তুমি লাইনের বয়স্ক মানুষদের মুখে শোনোনি?”
 
মাথা নেড়ে নিঃশব্দে না বলল এতোয়ারি। তারপর ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, ওই মহুয়ামিলন নামের জায়গাটা কি এখনও আছে?”

“না থাকার তো কোনও কারণ নেই। যাদের প্রাণ আছে তাদের একসময় মৃত্যু হয়, এমনকী নদীর বুকে জলের যে-ধারা, তার প্রাণ না-থাকলেও শুকিয়ে গেলে গতি হারায়। পাহাড়ও ধ্বংস হয়। আর মাটির চেহারা পালটাতে পারে কিন্তু কখনওই ধ্বংস হয় না। তাই নাম বদলে গেলেও, মহুয়ামিলন নামের জায়গাটা নিশ্চয়ই আছে,” ডাক্তারবাবু কথা শেষ করে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

চুপচাপ সরে এল এতোয়ারি।

সন্ধের মুখে মাকে নিয়ে ফিরে এল এতোয়ারি। এখন মাকে অনেক ভাল দেখাচ্ছে। আসার পথে ধনুবুড়োর মৃত্যুর খবরটা সে মাকে দিয়েছিল। শুনে মা বলেছিল, “যাক, মানুষটা বেঁচে গেল এতদিনে।”

অবাক হয়েছিল এতোয়ারি, “এ কথা বলছ কেন?”

“বা রে! ওরকম পুতুলের মতো বেঁচে থেকে কী লাভ হত বুড়োর! কিছু ভাবতেও তো পারত না, কাজ করা দূরের কথা,” মা বলেছিল।

“ভাবতে পারত। নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবত।”

“নিজের দেশ আবার কী! যতসব ফালতু কথা,” মা হেসেছিল।

ঘরে ফিরে দেখল ভেজানো দরজার ওপারটায় অন্ধকার। এতোয়ারি হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে বুঝল তাতে তেল নেই। হাতড়ে হাতড়ে ঢিবরি বের করে তার সলতেতে আগুন দিতে ঘরের অনেকটা দেখা গেল। বাবা শুয়ে আছে পাশ ফিরে। সকালে রেখে যাওয়া খাবার খেয়ে নিয়েছে।

মা বলল, “কুয়ো থেকে এক বালতি জল এনে দে।”

“নদীতে যাবে না?”

“না।”

“রাতে খাবে তো? আমি তিনটে ডিম হাসপাতাল থেকে ধার করে এনেছি।”

ডিমের কথা কানে যেতেই বাবাকে উঠে বসতে দেখল এতোয়ারি। মা বসে পড়লে সে বালতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একটা মানুষ বছরের পর বছর চুপচাপ তিনমাথা এক করে বসে থাকত। গাছ, ঢিপি অথবা পাথরের মতো পড়ে থাকত সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। শুধু বৃষ্টি হলে মানুষটাকে দয়া করে বাইরে খোলা আকাশের নীচে আনা হত না। সেই মানুষটা আর নেই। এতোয়ারির মনে হচ্ছিল এই না-থাকায় কারও কিছু এসে যাচ্ছে না। এই ডুয়ার্সের চা-বাগানের শ্রমিকদের লাইনে বসে, মনে মনে ধনুবুড়ো চলে যেত তার বাল্যকালের মহুয়ামিলনে। এখন মহুয়ামিলনে কি পৌঁছে গিয়েছে ধনুবুড়োর আত্মা?

বালতিভরা জল মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ঘরে পরার কাপড় এবং গামছা নিয়ে আধা অন্ধকারে এতোয়ারি নদীর ধারে চলে এল। কুলকুল আওয়াজ তুলে ছোট ছোট ঢেউ ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে ডুডুয়া নদীর দিকে। সেই জলের পাশে বড় পাথরের ওপর বসে এতোয়ারির কেবলই ধনুবুড়োর কথা মনে পড়ছিল। দিনের পর দিন মানুষটা ভেবে গিয়েছিল যে, সে একদিন মহুয়ামিলনে যেতে পারবে। তার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হল না।

জলে শব্দ হতে চমকে তাকাল এতোয়ারি। জলের ওপর অন্ধকার কি একটু পাতলা হয়ে যায়? এতোয়ারি সোজা হয়ে বসে দেখল তরতর করে লম্বা কিছু নদীর জলে সাঁতার কেটে ওপারে চলে গেল। ওটা যে একটা সাপ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দিনের বেলায় সে কোনওদিন এই নদীতে সাপ দেখেনি।
 
ঘরে ফিরে সে দেখল বাবা একদিকে আর মা অন্যদিকে শুয়ে আছে। টেবরিটার আলো কমে এসেছে। কাঠের আগুন জ্বেলে ভাত রাঁধতে বসল এতোয়ারি। আগুনটার দিকে তাকিয়েই মনে হল ধনুবুড়োর কথা। মরে গেলে হিন্দুদের দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, খ্রিস্টানদের কবর। সেই কবে থেকে নাকি চা-বাগানের শ্রমিকদের বেশির ভাগই খ্রিস্টান। অনেকেই রবিবারে গির্জায় যায়। যত দিন যাচ্ছে, তত গির্জায় যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সে ছেলেবেলায় প্রতি রবিবারে গির্জায় যেত। আজকাল শুধু বড়দিনের সময় যায়। আর মরে গেলে খ্রিস্টান বলে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু এতোয়ারি শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষরা খ্রিস্টান ছিল না।

হাসপাতালে কাজের চাপ ছিল না। ছোট নার্স হাসতে হাসতে বলল, “মানুষের যত শরীর কম খারাপ হয়, তত হাসপাতালের ওপর চাপ কমে যায়। যদি কোনওদিন এই হাসপাতালে একটাও পেশেন্ট না-থাকে, তা হলে কোম্পানি গর্বের সঙ্গে বলবে, এই বাগানের মানুষের অসুখ হয় না,” বলে হাসল ছোট নার্স।

বড় নার্স ওপাশ দিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো শুনতে পেয়ে বললেন, “এখন হাসছ, তখন কী করবে?”

“মানে?” ছোট নার্স হকচকিয়ে গেল।

“এই বাগানের কোনও কর্মচারীর যদি অসুখবিসুখ না-হয়, তা হলে আমাদের চাকরি থাকবে কি না ভেবে দেখেছ?” বলে গেলেন বড় নার্স।

শোনামাত্র জিভ কেটে সরে গেল ছোট নার্স।

প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়ে, এতোয়ারি জানে না কেন, চোখ উপচে জল বেরিয়ে এল। সেটা মুছে ঘরে ফিরে মায়ের হাতে টাকাটা তুলে দিলে মা বলল, “না, সবটা দিবি না। নিজের জন্যে রাখ। কালই ছুটি নিয়ে পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজের নামে খাতা খুলবি। আমি তোর সঙ্গে যাব।”

বাবা তাকিয়ে দেখল। কিছু বলল না।

সেই রাতে চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল মা-মেয়ের। ধড়মড়িয়ে উঠে দেখল, বাবা নেই। চেঁচামেচি চিৎকারটা খানিকটা দূরে হচ্ছে। ওরা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। যে-মানুষটা একটা লাঠি নিয়ে কোনওমতে লেংচে লেংচে চলে, এত রাতে সে কোথায় গেল?

যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল সেদিকে বেশ অন্ধকার। তবু মা-মেয়ে সেদিকে যেতেই ছোট্ট ভিড়টাকে দেখতে পেল। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল লোকগুলো মাতাল। ওরা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। আরও একটু এগোতেই বুঝতে পারল ওই লোকগুলোর মাঝখানে মাটিতে শুয়ে আছে একজন। লোকটা যে তার বাবা, বুঝতে পেরে মায়ের দিকে তাকাল সে। মা শক্ত মুখে তাকিয়ে দেখছে।

এতোয়ারি নিচু গলায় বলল, “আমি গিয়ে দেখছি।”

সে পা বাড়াতেই মা খপ করে তার হাত ধরল, “না, যাবি না।”

অবাক হল এতোয়ারি, “ওখানে বাবা পড়ে আছে।”

“থাক। আমাদের না-জানিয়ে নিজের ইচ্ছেয় ও ওখানে গিয়েছে। নিশ্চয়ই খুব হাঁড়িয়া গিলেছে। নিজেই তো গিয়েছে, ও নিজেই ফিরে আসবে। ঘরে চল,” মা তার হাত ধরে টানল।
 
অবাক হয়ে তাকাল এতোয়ারি। মাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হল সে। ঘরে ফিরে আবার শুয়ে পড়তে গিয়েও উঠে বসল মা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “এই, তুই তোর মাইনের টাকা কোথায় রেখেছিস?”

“বালিশের নীচে,” এতোয়ারি বলল।

“ওগুলো আঁচলে বেঁধে রাখ শক্ত করে।”

হেসে ফেলল এতোয়ারি, “তোমার কী হল?”

“কী হল মানে?” মা বিরক্ত।

“এই ঘর থেকে চুরি করবে?” বলে বালিশের তলায় হাত ঢোকাল সে। কিন্তু হাতে কিছু ঠেকল না। চটপট বালিশ তুলে নিতে দেখতে পেল সেখানে কিছুই নেই। টাকাগুলো ভাঁজ করে রেখেছিল সে। উত্তেজিত হয়ে আশপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজেও নোটগুলো চোখে পড়ল না।

মা জিজ্ঞাসা করল, “কী হল?”

“বালিশের নীচে টাকা রেখেছিলাম, এখন দেখছি নেই,” বেশ উত্তেজিত গলায় বলল এতোয়ারি।

“সর্বনাশ। এটাও দেখতে হল,” মা কপাল চাপড়াতে লাগল।

“তার মানে?”

“বুঝতে পারছিস না হতভাগী। তোর টাকায় দলবল জুটিয়ে লোকটা লেংচে লেংচে ভাটিখানায় গিয়ে মচ্ছব করেছে। এখন একগলা গিলে মাটিতে পড়ে আছে। ছি ছি ছি! লোকটা মরে না কেন? মেয়ের রোজগারের টাকা চুরি করে হাঁড়িয়া খাচ্ছে দলবল জুটিয়ে!” চিৎকার করে কথাগুলো বলল এতোয়ারির মা। ঠিক তখন বাইরে মাতালদের গলা শোনা গেল। এতোয়ারি দরজায় গিয়ে দেখল, চারটে লোক বাবার দেহটাকে টেনে এনে কোনওমতে ঘরের সামনে রেখে দিয়ে টলতে টলতে চলে গেল।

ঘরের দরজা বন্ধ করে মা বলল, “শুয়ে পড়, পড়ে থাক ওখানে।”

গরমকালে লাইনের অনেক পুরুষ খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়ে থাকে। যদি লাইনের কুকুরগুলো ঘুম ভাঙানো চিৎকার করে, তা হলে উঠে বসে সতর্ক হয়। মাঝে-মাঝেই চিতাবাঘ চলে আসে জঙ্গল থেকে, বাইসন তো আছেই। কুকুরগুলোর চিৎকার শুনে বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যায়। অতএব ঘরের বাইরে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকলেও বিপদের সম্ভাবনা খুব আছে তা বলা যায় না। এসব জানা সত্ত্বেও মনের মধ্যে কাঁটা ফুটছিল এতোয়ারির। নেশা যখন মানুষের সমস্ত বোধ কেড়ে নেয়, তখন তার মুখ খুব অসহায় দেখায়। বাবার মুখ সেরকম মনে হয়েছিল। ওর ইচ্ছে করছিল বাবার বেহুঁশ শরীরটাকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসতে।

“এক পয়সা রোজগার করার মুরোদ নেই অথচ মেয়ের গোটা মাসের মাইনের টাকায় লোক জুটিয়ে হাঁড়িয়া খেল। এই লোক মরে গেলে আমরা বেঁচে যেতাম,” তারপর খেয়াল হতে পাশ ফিরে মা বলল, “কী রে! চুপ করে আছিস যে! অতগুলো টাকা ও উড়িয়ে দিল, তোর রাগ দুঃখ কিছুই হচ্ছে না?”

শোনামাত্র টাকাগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পেল এতোয়ারি। চা-বাগানের কেরানিবাবু, যিনি বাক্সে টাকা ভরে নিয়ে আসেন হাসপাতালে, নাম ডেকে ডেকে সবাইকে মাইনে দেন, বলেছিলেন, “প্রথম মাসের মাইনে, সাবধানে রেখো। নইলে ফুড়ুৎ হয়ে যাবে।”
 
কেরানিবাবুর কথা সত্যি হয়ে গেল! হঠাৎ এতোয়ারির মনে হল, হাঁড়িয়ার দাম তো বেশি নয়, যে-ক’জন লোককে সে বাবার সঙ্গে দেখেছে, তাদের সবাই মিলে যদি খায়, তা হলেও কি অতগুলো টাকা শেষ হয়ে যাবে! ধন্দে পড়ল এতোয়ারি।

“কী হল? কী ভাবছিস? তুই যদি দয়া দেখাতে চাস…”

“না মা, আমি ভাবছি, অতগুলো টাকার হাঁড়িয়া নিশ্চয়ই ওরা খেতে পারেনি, তা হলে বাকি টাকা গেল কোথায়?” এতোয়ারির গলায় প্রশ্ন।

“ঠিক কথা!” মা উঠে বসল, “নিশ্চয়ই টাকাটা ওর কোমরে আছে। চল, দেখি।”

মায়ের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল এতোয়ারি। চিত হয়ে শুয়ে আছে বাবা। দুটো হাত দু’দিকে ছড়ানো, মুখ হাঁ করা। চোখ বন্ধ, কোনও হুঁশ নেই। উবু হয়ে পাশে বসে পড়ল মা। তারপর কোমরের কাপড় খুলে তল্লাশি করতে লাগল। শেষপর্যন্ত মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বলল, “নাঃ, নেই। সব উড়িয়ে দিয়েছে রে!”

“কী করে সব উড়ল?” সন্দেহ যাচ্ছিল না এতোয়ারির।

মা একটু ভাবল। তারপর বলল, “চল তো!”

“কোথায় যাবে?” অবাক হল এতোয়ারি।

উত্তর না-দিয়ে মা হানহনিয়ে হাঁটা শুরু করলে, দ্রুত তাকে অনুসরণ করল সে। কুলিলাইনের শেষপ্রান্তে, নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সোমরা আর তার ছেলে এঁটো গ্লাস, প্লেট গুছিয়ে তুলছিল। মা এবং মেয়েকে ওইভাবে আসতে দেখে অবাক হয়ে সোমরা বলল, “আমাকে দোষ দিয়ো না। আমি তোমার মেয়ের বাবাকে অনেক নিষেধ করেছিলাম, সে কোনও কথা শুনতেই চায়নি, উলটে গালি দিয়েছিল। বলল, সবাইকে হাঁড়িয়া খাইয়ে জন্মের ঋণ শোধ করতে চায়। আমি কী করব বলো!”

“সে কোথায় টাকা পেল জিজ্ঞাসা করোনি কেন?” মা চেঁচিয়ে বলল।

“করেছিলাম,” সোমরা মাথা নাড়ল, “বলল, তুমি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছ বলে মেয়ে টাকা দিয়ে বলেছে, সবাই মিলে আনন্দ করতে। কিন্তু একটু খেয়ে সে সহ্য করতে পারল না।”

মা মেয়ের দিকে তাকাল। এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “বাবা যা টাকা এনেছিল তার সবটাই কি হাঁড়িয়া খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে?”

সোমরা কিছু বলার আগে তার বালক ছেলে হাত নাড়ল, “না, না। অনেক টাকা বুধুয়াচাচার কাছে রাখতে দিয়েছিল। সব টাকা খরচ হয়নি।”

সঙ্গে সঙ্গে সোমরা ছেলেকে ধমক দিল, “অ্যাই চোপ! তোকে কে কথা বলতে বলেছে,” তারপর এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাবা তো বুধুয়ার বন্ধু। তাই বোধহয় রাখতে দিয়েছিল। ভাগ্যিস বুধুয়া দাম দিয়ে আগেই চলে গিয়েছিল, না-হলে ওরা এত খেত যে, কেউ হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারত না।”

মা আর দাঁড়াল না। বলল, “তাড়াতাড়ি চল।”

কিছুটা যেতেই ওরা বুধুয়ার বউকে দেখতে পেল। দ্রুত হেঁটে আসছে। এতোয়ারির মা জিজ্ঞাসা করল, “এ কী, এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?”

সে বলল, “আর কোথায়! আমি গলায় দড়ি দেব তবে তার আগে লোকটাকে নিজের হাতে মেরে তবে মরব। ভাটিখানার পাশ দিয়ে এলে তোমরা?”

“হ্যাঁ। ভাটিখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওখানে কেউ নেই,” মা বলল।

কপালে বাঁ হাতের চড় মারল প্রৌঢ়া, “ওঃ, কী করি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নাতি-নাতনি হয়েছে তবু লোকটা বদলাল না। নিশ্চয়ই পুষির ঘরে গিয়ে ফুর্তি করছে। আজ ওকে শেষ করবই।”
 
মা মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। পুষিকে এই তল্লাটে সবাই চেনে। আগে ওরা লাইনেই থাকত। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পরে পুষির স্বভাবচরিত্র বদলে যায়। প্রায়ই এই বাগান সেই বাগানে চলে যায়। ফিরে আসে অনেক উপহার নিয়ে। স্বামী মারা যাওয়ার পরে কিছুদিন পাতি তোলার কাজ করে ছেড়ে দেয় পুষি। এখন সে চা-বাগানের লাগোয়া ফরেস্টের বস্তিতে ঘর ভাড়া করে একাই থাকে। পছন্দমতো লোককে সে তার ঘরে ঢুকতে দেয়। সেখানে নেশা করে। যেহেতু ওই বস্তি চা-বাগানের লাগোয়া হলেও, কুলিলাইন থেকে বেশ খানিকটা দূরে, তাই পুষিকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

মা বলল, “মাথা ঠান্ডা রাখো। আমি তোমার স্বামীকে খুঁজছি। সে আমার মেয়ের রোজগারের টাকা নিয়ে বোধহয় ফুর্তি করতে গিয়েছে। চলো,” মা হাঁটতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। দুটো হাত দু’দিকে বাড়িয়ে কিছু ধরতে চাইল। পাতলা অন্ধকারে প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি এতোয়ারি। যখন পারল, তখন মায়ের শরীর কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, ছুটে এসে মাকে জাপটে ধরল সে। চিৎকার করে ডাকল, “মা!”

চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড থাকার পর মা চোখ খুলল, “ঠিক আছে।”

“কী হয়েছে তোমার?” জিজ্ঞাসা করল এতোয়ারি।

“মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। এখন ঠিক আছে,” মা জোরে শ্বাস ফেলল।

“চলো, ঘরে চলো। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না,” মাকে জড়িয়ে পা ফেলল এতোয়ারি। এতক্ষণ বড়বড় চোখে দেখছিল বুধুয়ার বউ। এতোয়ারিদের ঘরের দিকে পা বাড়াতে দেখে, সে হনহন করে হাঁটতে লাগল ফরেস্টের দিকে। মাকে কোনওরকমে ঘরে নিয়ে এল এতোয়ারি। বাবা তখনও শুয়ে আছে, যেভাবে একটু আগে দেখে গেছে। শুধু পাড়ার দুটো কুকুর এসে বসে আছে বাবার মাথার পাশে। ঘরে ঢুকে মাকে শুইয়ে দিল এতোয়ারি।

টাকাগুলো হাতে আসতে না-আসতেই হাতছাড়া হয়ে গেল। বাবা এরকম করল কেন? পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর বাবা ঘরেই শুয়ে-বসে থাকত। হঠাৎ পুরনো বন্ধুদের হাঁড়িয়া খাওয়ানোর ইচ্ছে হল কেন?

উত্তরগুলো এতোয়ারির জানা নেই। দুটো কুকুরের পাশে বাবা প্রায় অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। বাবাকে তার পক্ষে একা তুলে ঘরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। মাকে বললে সুস্থ অবস্থাতেই তাকে সাহায্য করতে রাজি হত না, এখন তো হবেই না। শ্বাস ফেলল এতোয়ারি। সে চোখ বন্ধ করল কিন্তু বন্ধ চোখে ঘুম এল না।

হঠাৎ মনে হল কেউ একজন দৌড়ে এসে তাদের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে থামল। এতোয়ারি চটপট উঠে বসল। তারপর গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, “কে?”

“আমি,” হাঁপাতে হাঁপাতে শব্দটা যেন কোনওমতে বের হল মহিলার গলা থেকে।

তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিভু নিভু ঢিবরি হাতে নিয়ে দরজা খুলে এতোয়ারি অবাক হয়ে দেখল বুধুয়ার বউ উবু হয়ে বসে আছে সামনে।

এতোয়ারি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”

কোমরে হাত দিয়ে বুধুয়ার বউ যা বের করে মাটিতে রাখল, সেটা যে পাকানো টাকার বান্ডিল, তা আন্দাজে বুঝতে পারল এতোয়ারি। হাত না-বাড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় পেয়েছ?”

তখনও শ্বাস স্বাভাবিক নয়, হাত নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করেও পারল না। বোঝাই যাচ্ছিল তার শরীরে শক্তি নেই।

এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “তুমি জল খাবে?”

চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে নিতে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল বুধুয়ার বউ। তারপর থেমে থেমে বলল, “টাকাটা দিয়ে গেলাম।”

“কোথায় পেলে টাকা? তোমার বর দিয়েছে?”

মাথা নেড়ে ‘না’ বলে উঠে দাঁড়াল বুধুয়ার বউ।

“তা হলে? কোথায় পেলে তাকে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল এতোয়ারি।

“পুষির ঘরে।”

“তুমি চাইতেই টাকা দিয়ে দিল?”

অদ্ভুত হাসি যেন ছিটকে বের হল বুধুয়ার বউয়ের মুখ থেকে, “আর কোনওদিন সে কথা বলবে না। ওর শরীর থেকে প্রাণটা বের করে দিয়েছি। আচ্ছা…” কথাগুলো বলেই সে আবার দৌড়োতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার ছোট্ট শরীরটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অবাক চোখে সেই অন্ধকার দেখে কুকুরের চিৎকারে সংবিৎ ফিরল এতোয়ারির। সে নিচু হয়ে টাকার বান্ডিলটা তুলতেই বুঝতে পারল ওগুলো যেন খানিকটা ভিজে আছে। সন্দেহ হতে ওটা নাকের কাছে আনতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে এল সে। মায়ের ঘুম ভাঙেনি। ডাকতে গিয়েও থেমে গেল এতোয়ারি। অসুস্থ শরীরটার ঘুম দরকার। ডেকে তুললে আবার অসুস্থ হতে পারে। ঘরের কোণে টাকার বান্ডিলটাকে একটা বাটি চাপা দিয়ে রেখে দিল সে।
 
ঘণ্টাখানেক পরে চিৎকার চেঁচামেচিতে লাইনের লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পাশের লাইনের দুটো লোক বুধুয়াকে জঙ্গলের কাছে পড়ে থাকতে দেখে বয়ে নিয়ে এসেছে। বুধুয়ার বুকে একটা বড় ক্ষত যা থেকে রক্ত বেরিয়ে জামা ভিজে গিয়েছে। লোক দুটো যখন বুধুয়াকে দেখেছিল, তখনই ওর শরীরে প্রাণ ছিল না।

খবর পেয়ে বুধুয়ার ছেলেরা, ছেলের বউরা ছুটে এল। সবাই বলাবলি করছিল, হাঁড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে কারও সঙ্গে মারপিট করতে গিয়ে ছুরির আঘাতে মারা গিয়েছে। বউগুলো কাঁদছিল। একজন বলল, “তোদের মা কোথায়? মাকে খবরটা দে।”

আর-একজন বলল, “বেচারা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে, জানতেই পারল না কী সর্বনাশ হয়ে গেল। কী আর করা যাবে, কপাল, কপাল!”

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন প্রতিবাদ করে উঠল, “পুলিশে খবর দাও, ওকে খুন করা হয়েছে।”

মাথা নাড়ল একজন প্রবীণ মানুষ, “আমরা থানায় যাব কী করে? থানা তো বারো মাইল দূরে। এরকম ঘটনা ঘটলে প্রথমে বড়বাবুকে জানাতে হয়। তিনি বড়সাহেবকে জানাবেন। বড়সাহেব পুলিশকে ফোন করবেন। বুঝলে!”

এক যুবক বুধুয়ার ক্ষত দেখে মাথা নাড়ল, “ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। কার রাগ ছিল বুধুয়ার ওপর? চল, দু’জন চল আমার সঙ্গে, আমি যাচ্ছি বড়বাবুর বাসায়।”

একজন বলল, “এত রাতে গেলে বড়বাবু খুব রেগে যাবে। তার চেয়ে সকাল হলে যাওয়াই বোধহয় ভাল।”

সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ প্রতিবাদ করে উঠল। তারা বলল, একটা মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছে শুনে যদি রাগ করে, তা হলে লোকটা মানুষ নয়।

এই সময় বুধুয়ার ছোট পুত্রবধূ ঘর থেকে ফিরে এসে জানাল সে তার শাশুড়িকে খুঁজে পায়নি। ঘরের আশপাশে কোথাও নেই।

একজন বলল, “হয়তো পেটখারাপ তাই নদীতে গিয়েছে। এখনই ফিরে আসবে। তোমরা বড়বাবুর কাছে যাও, দেরি কোরো না।”

তিনজন রওনা হওয়ার পর কিছু সময় চলে গেল, কিন্তু বুধুয়ার বউ ফিরে এল না। তখন লাইনের শিশুরা ছাড়া সবাই জেগে উঠে বুধুয়ার মৃতদেহের চারপাশে ভিড় করেছে। কিন্তু বুধুয়ার বউকে দেখা যাচ্ছে না।

যে-দু’জন লোক বুধুয়াকে বহন করে নিয়ে এসেছিল, তাদের প্রশ্ন করা হলে তারা বলল, বুধুয়ার বউকে দেখেনি। জল্পনা শুরু হল, বুধুয়ার বউ গেল কোথায়! কিন্তু কেউ ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিল না।

ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে এতোয়ারি এইসব কথা শুনছিল। এখন তার মনে হল, সে যা জানে, তা বলা উচিত। মনস্থির করে ভিড় ঠেলে পা বাড়াতেই দূর থেকে চিৎকার ভেসে এল, “জলদি এসো, পাওয়া গিয়েছে,” যারা বড়বাবুকে খবর দিতে নদী পার হয়ে যাচ্ছিল, তাদের একজনের কণ্ঠস্বর। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের বেশির ভাগ মানুষ নদীর দিকে ছুটল। কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন বুধুয়ার বউকে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে এল।
 
বুধুয়ার বউয়ের শরীর নগ্ন। সে পরনের শাড়িটাই গাছের ডালে বেঁধে গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়েছিল। দুর্বল শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। সেই পরনের কাপড়েই মৃতার শরীর গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বুধুয়ার ছেলে-বউরা গলা খুলে কাঁদতে শুরু করল। তাদের সঙ্গে গলা মেলাল কলোনির কিছু বউ। ছেলে, ছেলের বউরা বুধুয়ার বউয়ের চারপাশে বসে কাঁদতে লাগল।

মুখ খুলতে গিয়েও খুলতে পারল না এতোয়ারি। একটু আগে স্বামীকে খুন করে টাকা নিয়ে বউটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তখন সে ভাবতেই পারেনি টাকা পৌঁছে দিয়ে বউটা নদীর ধারে গাছের ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করবে। এতোয়ারির মনে হল সব কথা বলা ঠিক হবে না। বললে লোকে বিশ্বাস না-ও করতে পারে। বুধুয়াকে খুন করেছে তার বউ, একথা তার মুখ থেকে শুনলে লোকে নিশ্চয়ই প্রমাণ চাইবে। তার কাছে কোনও প্রমাণ নেই। তাই বললে সমস্যায় পড়তে হবে।

কী করবে তা এতোয়ারি বুঝতে পারছিল না। অথচ মৃত্যুর আগে বুধুয়ার বউ যা যা করেছিল তার কিছুটা মা জানে, সে অনেকটা।

লোকজন উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। স্বামী খুন হয়েছে বলে বউ আত্মহত্যা করবে? কিন্তু বুধুয়ার বউ কী করে ঘরে বসে জানল তার স্বামী খুন হয়েছে? তা হলে তাকেও কি খুনি মেরে ফেলেছে। কেন? কী করেছিল বুধুয়া?

হঠাৎ একজন মৃতদেহ বয়ে নিয়ে আসা দু’জনকে জিজ্ঞাসা করল, “বুধুয়ার শরীর কোথায় পেয়েছ?”

“জঙ্গলের পাশে বস্তির সামনে,” একজন জবাব দিল।

লোকটা বুধুয়ার ছেলেদের জিজ্ঞাসা করল, “বুধুয়া ওইরকম জায়গায় কেন গিয়েছিল জানো?”

একটু চুপ করে থেকে দু’জনে মাথা নেড়ে না বলল।

ভিড়ের একজন বলল, “এত রাতে গিয়েছিল যখন, তখন নিশ্চয়ই কেউ ওখানে থাকে, যাকে সে চেনে। ওই বস্তিতে বুধুয়ার চেনাজানা কে থাকে তা কি তোমরা জানো?”

ছেলেরা বা ছেলের বউরা কাঁদছিল, জবাব দিল না।

ভোর হয়ে আসছিল। ধীরে ধীরে ভিড়টা হালকা হয়ে গেল। শুধু বুধুয়ার ছেলে, ছেলের বউ এবং তিন-চারজন আত্মীয়বন্ধু বসেছিল মৃতদেহের পাশে। এখন আর ওরা কাঁদছিল না। একটি বউ এতোয়ারিকে বলল, “আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ডিউটিতে যেতে পারব না,” সে চলে যেতে এতোয়ারি ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল।

তখন কলোনির ঘরগুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছে। সূর্য ওঠেনি, হালকা অন্ধকার চারপাশে। ঘরের সামনে এসে এতোয়ারি অবাক, বাবার ঘুমন্ত শরীরটা মাটিতে পড়ে নেই। সে দরজা ঠেলে পাতলা অন্ধকারেও বুঝতে পারল ঘরের একপাশে বাবা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। উলটোদিকে মা ঘুমিয়ে আছে। কখন বাবার ঘুম ভাঙল, হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল তা কি মা জানতে পেরেছে? নিজের জায়গায় গিয়ে বসল সে।

হঠাৎ একটা ভাবনা তাকে ছোবল মারল। তার কপালে আব ছিল বলে স্বামী মারধর করত, টাকা নিয়ে যেতে বলত, সব টাকা পেয়ে গেলেও লোকটা অত্যাচার বন্ধ করত না। মায়ের সঙ্গে বাবার কোনও ব্যাপারেই মনের মিল হতে সে দেখেনি। সুস্থ থাকার সময় বাবা ঝগড়া করত, দু’-তিনবার মায়ের গায়ে হাত তুলতে সে দেখেছে। লাইনের অনেক স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়া করতে দেখে মনে হয়েছে, ওরা কেন বিয়ে করে একসঙ্গে আছে? তার আজ দুটো মেয়ে, নাতি-নাতনি, জামাইরা থাকা সত্ত্বেও কতখানি সম্পর্ক খারাপ হলে বুধুয়ার বউ স্বামীকে খুন করতে পারে!

মাথা নাড়ল এতোয়ারি। দশজনের মধ্যে আট-ন’জন স্বামী-স্ত্রীরই এই এক অবস্থা। এতোয়ারি বাবার দিকে তাকাল। বাবা কি নিজেই ঘরে উঠে এসে শুয়েছে? যে-অবস্থায় বাবাকে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে গিয়েছিল, তাতে এত তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়বে, তা কল্পনা করতে অস্বস্তি হল। তা হলে কি মা বাবাকে বাইরে থেকে ঘরে তুলে নিয়ে এসেছে? অসম্ভব! বাবাকে মা এতটাই অপছন্দ করে যে, এই কষ্টটুকু করবে না। তা ছাড়া হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আজ উত্তেজিত হওয়ার পর মায়ের শরীরে বাবাকে বয়ে ঘরে নিয়ে আসার শক্তি নেই।
 
আলো ফুটছে। এখনই উঠে নদী থেকে ঘুরে এসে রান্না না-চাপালে ঠিকসময় হাসপাতালের কাজে যাওয়া যাবে না। এতোয়ারি উঠল। মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না সে। মায়ের এখন অনেকটা ঘুম দরকার।

নদীতে স্নান করতে গিয়ে এতোয়ারি দেখল, আজ অনেক মহিলাই এসেছে। কাল রাতের ঘটনাগুলো ঘুম কেড়ে নেওয়ায়, কাজে বেরোনোর আগে স্নান করে সবাই একটু ঝরঝরে হতে চাইছে। নদীর ধারে এসে ওদের মুখে বুধুয়া আর তার বউয়ের গল্প ছাড়া আর কিছু নেই।

টুনিয়াবুড়ি জলে নামেনি। পাড়ে বসে কপাল চাপড়াচ্ছিল। যারা কাছে ছিল, তারা জিজ্ঞাসা করল, “কী হল, ওরকম করছ কেন?”

“তোরা কেউ পুলিশকে বলে দিবি, বুধুয়ার শরীর যেখানে পড়েছিল তার পেছনেই ওই মেয়েমানুষটার বাড়ি,” টুনিয়াবুড়ি বলল।

“কোন মেয়েমানুষ?”

“যে-দু’জন ওকে বয়ে এনেছিল, তাদের মুখে শুনলাম,” কথাগুলো বলেই চুপ করে চোখের পাতা ওলটাল বুড়ি।

“কী শুনেছ?”

“যেখানে বুধুয়াকে পাওয়া গিয়েছিল তার পেছনেই ওই হারামজাদি পুষির ঘর। নিশ্চয়ই ওর কাছে গিয়েছিল বুধুয়া,” বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলল বুড়ি, “আর কত মাথা খাবে পুষি তা কে জানে!”

এতোয়ারি স্নান করে ঘরে ফিরে দেখল, মা উঠে বসেছে। বোধহয় মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিয়েছে। এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “এখন কেমন আছ মা?”

“একটু ভাল,” তারপর হতাশ গলায় বলল, “তুই দেখেছিস?”

“কী?” এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল।

“বুধুয়ার বউকে।”

“হ্যাঁ। গলায় কাপড় বেঁধে ঝুলেছিল নদীর পাশের গাছে।”

“হায় ভগবান!” শ্বাস ফেলল মা, “এরকম স্বামীকে আর কতদিন সহ্য করতে পারে।”

শুনে মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “তা হলে তো প্রায় সব মেয়েকেই গলায় দড়ি দিতে হয় মা। আমাদের কুলিলাইনের বেশির ভাগ মেয়েরই তো এইরকম অবস্থা।”

“আমি যে কী করি!” নিচু গলায় বলল মা।

মায়ের দিকে তাকাল এতোয়ারি। তারপর বলল, “তুমি আজ সারা দিন ঘুমিয়ে থাকো। এই শরীরে কাজে যাওয়ার দরকার নেই।”

“পাগল!” মা শ্বাস ফেলল।

অবাক হয়ে তাকাল এতোয়ারি।

মা বলল, “একদিন না-গেলে টাকা কাটবে। তা ছাড়া কাজে না-গেলে ওই লোকটার সঙ্গে এই ঘরে সারা দিন থাকতে হবে! পারব না, পারব না আমি।!”

এতোয়ারি বাবার শরীর দেখল। তাদের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে।

“তা হলে কী করবে?”

“এখানে ওর সঙ্গে থাকা আর বুধুয়ার বউয়ের মতো গলায় ফাঁস দেওয়ার মধ্যে কোনও তফাত নেই রে! তুই বেঁচে গিয়েছিস। খুব কপাল করেছিলি বলে স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাসপাতালে কাজ পেয়েছিস। সব মেয়ের যদি তোর মতো কপাল হত, তা হলে তারা বেঁচে যেত!” মা উঠল।

বাবাকে উঠে বসিয়ে হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বেশ ঝাঁজালো গলায় এতোয়ারি বলল, “খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। নদীর ধারে যখন যাবে তখন দরজা বন্ধ করে যেয়ো।”

শোনামাত্র দু’হাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কেঁদে উঠল বাবা। সঙ্গে সঙ্গে দরজার পাশে দাঁড়ানো মা চেঁচিয়ে উঠল, “শুনিস না, লোকটা মনভেজানো কান্না কাঁদছে,” এতোয়ারি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে মা হাঁটতে শুরু করল।

এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কোথায় যাবে?”

“হাসপাতালে।”

“সে কী! আবার শরীর খারাপ লাগছে?”

“ঘরে বসে থাকার চেয়ে ওখানে গেলে ভাল থাকব,” মা বলল।

লাইন ছাড়িয়ে চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে খুব ধীরে হাঁটতে হচ্ছিল এতোয়ারিকে। মায়ের শরীর যে পুরোপুরি সুস্থ নয়, তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top