What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বুকের ঘরে বন্দী আগুন♨️ (3 Viewers)

বিকেলে আসার সময় ছোট নার্স যে-রুটি তরকারি দিয়েছিল, তাতেই ওদের রাতের খাবার হয়ে যেত। কিন্তু ঘরে আসার পর থেকেই বাবা গালাগাল শুরু করেছিল। অপারেশনের পর এতোয়ারির চেহারা বদলে গিয়েছে। এই খবরটা চাউর হওয়ায় লাইনের অনেকেই দেখতে এসেছিল। তাদের দেখে গলা আরও ওপরে উঠেছিল। সে বারবার বলতে লাগল তার মেয়েকে শহরে নিয়ে গিয়ে একটা খারাপ মেয়েমানুষকে ঘরে নিয়ে এসেছে তার বউ। শুধু তাই নয়, নিজের সাজগোজও খারাপ মেয়ের মতো করে ফেলেছে। সে চিৎকার করে সবাইকে চলে যেতে বলেছিল সামনে থেকে।

মহল্লার লোকজন চলে গেলেও চিৎকার থামছিল না। এবার তার লক্ষ এতোয়ারির মা। সে শহরে গিয়ে নিজের চরিত্র নষ্ট করেছে। নইলে শাড়ি পরার ধরন আর চুল বাঁধার কায়দা বদলে যাবে কেন? গালাগালি দিতে দিতে যখন তার মধ্যে অশ্লীল শব্দ ঢুকে গেল, তখন এতোয়ারির মা উঠে দাঁড়াল। তার চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। এতোয়ারি মায়ের এই রূপ কখনও দেখেনি। গলা ফাটিয়ে মা ধমকাল, “চুপ।”

“ধমকাচ্ছিস? আমাকে ধমকাচ্ছিস? মেরে হাড় ভেঙে দেব। শহরে গিয়ে তোর গায়ে অনেক তেল জমেছে দেখছি,” উঠে বসল বাবা।

এতোয়ারির মা ছুটে গিয়ে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা উনুন ধরানোর চ্যালাকাঠ তুলে নিয়ে এসে বাবার শরীরে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল। এতোয়ারি চিৎকার করে মাকে থামাতে চাইলেও তা মায়ের কানে ঢুকছিল না। বাবার কাঁধে, পিঠে পাগলের মতো আঘাত করতে করতে হাঁপিয়ে পড়ল মা। দু’হাতে নিজের মাথা আগলে বসেছিল বাবা। মার খাওয়ার পর থেকেই তার চিৎকার বন্ধ হয়েছিল। মার খাওয়ার সময় তার শরীর থরথর করে কাঁপছিল। শেষপর্যন্ত পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল মাথা দু’হাতে চেপেই।

চ্যালাকাঠ ফেলে দিয়ে মা টলতে টলতে ঘরের অন্য কোণে ধপাস করে বসে পড়ল। এতোয়ারি ধীরে ধীরে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মা দুটো হাত ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর রেখে মুখ ঢেকে বসে ছিল। এতোয়ারি তার পিঠে হাত আলতো করে রাখতেই বড় শ্বাস ফেলল মা। এতোয়ারি কিছু বলার আগেই সে মুখ তুলে বলল, “ওঃ।”

“শান্ত হও মা, একটু শুয়ে পড়ো,” এতোয়ারি বলল।

“আমার এখন খুব শান্তি লাগছে। এত শান্তি আমি জীবনে কখনও পাইনি। উঃ, এতদিন বুকে যে-রাগ পুষে রেখেছিলাম তা আজ…” মাথা নাড়ল মা।

এতোয়ারি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের এমন তৃপ্ত মন সে কখনও দেখেনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে শুধু মাকে বাবার হাতে মার খেতে দেখেছে। মুখ বুজে সহ্য করেছে মা। আজ প্রথমবার উলটো দৃশ্য দেখল। মা হিংস্র হয়ে বাবার গায়ে হাত তুলল আর বাবা সেটা মেনে নিতে বাধ্য হল। হতভম্ব এতোয়ারির মনে হল তার মরে যাওয়া উচিত।

অপারেশন খুব ভালভাবেই হয়েছে। পরের কাজটা বাগানের ডাক্তারবাবুই করে দিলেন। কপালের ওপর একটা কাটা দাগ থাকল বটে কিন্তু বড় নার্স মলমের টিউব দিয়ে বললেন, “এই নে, ডাক্তারবাবু দিয়েছেন। রোজ রাত্রে, শোওয়ার সময় লাগাবি। দেখবি, ধীরে ধীরে দাগটা মিলিয়ে যাবে।”
 
শেষপর্যন্ত মা অসুস্থ হল। চা-পাতা তুলে ঝুড়িতে বোঝাই করে ফ্যাক্টরির সামনে নিয়ে আসতে হয়। সেই পাতা ওজন করে যে এনেছে, তার নামের পাশে খাতায় লিখে রাখা হয়। সাপ্তাহিক টাকা যে যত পাতা তুলেছে, তার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়। ওই চা-পাতার ঝুড়ি পিঠে বেঁধে নিয়ে আসার সময় বাগানের ভেতরের সরু পথে মাথা ঘুরে পড়ে গেল এতোয়ারির মা। অন্য কামিনরা দৌড়ে এসে দেখল ওর দাঁতে দাঁত লেগে আছে। কারও কাছে জল নেই। নদীও বেশ দূরে। তাই ধরাধরি করে মানুষটাকে নিয়ে আসা হল হাসপাতালে। ততক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে। ঘোলাটে চোখে তাকাচ্ছে। যে-খাটটা খালি ছিল, তাতে শুইয়ে মাকে হাওয়া করতে লাগল এতোয়ারি। মাকে বয়ে নিয়ে আসা লোকেরা বলতে লাগল, কীভাবে এতোয়ারির মা চা-বাগানের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। বড় নার্সকে নিয়ে ডাক্তারবাবু এসে মাকে পরীক্ষা করলেন। সংবিৎ ফিরে আসতেই মা উঠে বসতে চাইলে বড় নার্স ধমক দিলেন, “না, একদম না। শুয়ে থাকো।”

ডাক্তারবাবু সবরকম পরীক্ষা করে বললেন, “ভয়ের কিছু নেই। আজ এখানেই থাকো, বিশ্রাম হবে। প্রেশারটা বেশ বেড়ে গিয়েছে। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, খাইয়ে দাও,” ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।

এতোয়ারির মা মাথা নাড়ল। বড় নার্স জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হল?”

“ঘরে ও একা থাকলে মুশকিল হবে।”

“তোমরা মা-মেয়ে কাজে বেরিয়ে এলে তো ও একাই থাকে। ঝামেলা কোরো না।”

বড় নার্স বেরিয়ে গেলে এতোয়ারি বলল, “বাবার জন্যে চিন্তা কোরো না, আমি তো থাকব।”

“খুব গালি দেবে, আমি সহ্য করতে পারব না,” মা করুণ গলায় বলল।

“তোমাকে সহ্য করতে হবে না,” জোর গলায় বলল এতোয়ারি।

“মানে?” বলার ধরনে মা অবাক।

“এতদিন তুমি সহ্য করেছ, আমি দেখেছি। এখন যা বলার আমি বলব, তোমাকে কিছু বলতে হবে না,” মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মেয়ে তার কাজে চলে গেল।

খারাপ খবর বাতাসের আগে দৌড়োয়। হাসপাতালে ভরতি হয়েছে বউ, এই খবর ঘরে বসেই পেয়ে গিয়েছিল এতোয়ারির বাবা। এতোয়ারি ঘরে ফিরে দেখল বাবা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে এসেছে বুঝেও মুখ খুলল না।

মুখ খুলল রাতের খাওয়া শেষ করে একটা বিড়ি ধরিয়ে।

অবাক হয়ে এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “বিড়ি কোথায় পেলে?”

“যেখান থেকেই পাই, তোর দরকার কী!” ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “সব শুনেছি। তা ডাক্তার কী বলল? মরবে না বেঁচে যাবে?”

ঠোঁট কামড়াল এতোয়ারি। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী চাইছ?”

“কী আর চাইব? আমার কথা কে শুনছে!” মুখ বেঁকাল বাবা।

কিছুক্ষণ পরে নেভা বিড়ি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাবা আবার বলল, “কাল তোর শরীর খারাপ বলে হাসপাতালে যাবি না।”

“আমার শরীর খারাপ? কে বলল তোমাকে?” নাক দিয়ে শব্দ বের হল এতোয়ারির, “আমার শরীর এখন ঠিক আছে।”

“আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। তুই কাল ঘরে থাকবি।”

“কিন্তু কেন সেকথা বলবে তো!”

“আমি কোনও কথা বলব না। আমি যদি তোর বাপ হই, তা হলে তুই আমার কথা শুনবি!” বাবার চোখ বন্ধ হল এবং খানিক পরেই নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল।

ফাঁপরে পড়ল এতোয়ারি।
 
ভোর হতে না-হতেই এঁটো বাসন নিয়ে নদীতে গিয়ে চটপট ধুয়ে নিয়ে সে জল ভেঙে ওপারে চলে এল। এখনও সূর্য ওঠেনি। এ দিকটায় একের পর এক বাবুদের কোয়ার্টার্স। এত ভোরে তাদের ঘুম ভাঙার কথা নয়। কিন্তু এখানে না-আসা ছাড়া তার মাথায় অন্য উপায় এল না।

একটু আলো ফুটলে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্সের দরজা খুলল কাজের লোক।

এতোয়ারিকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? হবে না। এখন উনি ঘুমাচ্ছেন। অসুখ-বিসুখ হলে হাসপাতালে যখন যাবেন, তখন দেখা কোরো।”

“কিন্তু আমার যে এখনই ওঁর সঙ্গে দেখা করা দরকার,” জোর দিয়ে বলল এতোয়ারি।

এই সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। হেসে বললেন, “ওমা, তুমি। এই ভোরবেলায় এসেছ, ডাক্তারবাবুকে দরকার নিশ্চয়ই।”

“হ্যাঁ। আমার মা হাসপাতালে ভরতি হয়ে আছে। আবার বাবারও শরীর হঠাৎ খারাপ হয়েছে। আমি যদি আজ হাসপাতালে যেতে না-পারি, তা হলে ডাক্তারবাবু কি ছুটি দেবেন,” বেশ কাতর গলায় কথাগুলো বলল এতোয়ারি।

“এ কথা ওকে বলার জন্যে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমি ওকে বলব তোমাকে একটা দিন ছুটি দিতে। কিন্তু তোমার বাবাকে তো হাসপাতালে আনা উচিত।”

“না, সেরকম খারাপ হয়নি, হলে নিয়ে যাব।”

“ঠিক আছে, তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাও,” ডাক্তারবাবুর স্ত্রী হাসলেন।

সকালেই রান্না শেষ করে বারান্দায় বসেছিল এতোয়ারি। ঘুম থেকে উঠে বাবা মুখ-হাত ধুয়ে এক বাটি মুড়ি খাওয়ার পরে ভাল জামা পরে ঘরে বসে আছে। হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাবা জামা পরে গিয়েছিল, না হলে সারাক্ষণ তো খালি গায়েই থাকে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিল না এতোয়ারি। এই সময় তার কপাল টনটন করে উঠল। ডাক্তারবাবু বলেছেন, ওটা কিছুদিন করবে, এটা নিয়ে ভাবার কিছু নেই।

হঠাৎ মুখ ঘোরাতেই এতোয়ারি লোকটাকে দেখতে পেল, ডোরাকাটা পাজামার ওপর নীল শার্ট পরে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁত বের করে হেঁটে আসছে। কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে। তারপরেই সে তড়াক করে উঠে ঘরের ভেতর চলে গেল। বাবা বসেছিল ছোট্ট জলচৌকির ওপরে, তাকে ওইভাবে ঘরে ঢুকতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটল।

এতোয়ারি সোজা বাবার সামনে এল, “ওই লোকটা কেন আসছে?”

বাবা চোখ বন্ধ করল, “কোন লোকটা?”

“তুমি জানো না আমি কার কথা বলছি? ও কেন আসছে?”

“তা আমি কী করে বলব!”

“কী করে বলব মানে? আমি কার কথা বলছি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ! তুমি তো এই ঘরে বসেই বুঝে গেলে। বাবা, চালাকি কোরো না!” বেশ জোরে প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করল এতোয়ারি।

এই সময় বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, “এসে গেছি, ভেতরে আসব?”

সঙ্গে সঙ্গে বাবা ঠোঁটে আঙুল চাপা দিল। তারপর গলা তুলে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসো, ভেতরে এসো।”
 
লোকটা দরজায় এসে দাঁড়াল। প্রথমেই তার চোখ গেল এতোয়ারির মুখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বিস্ফারিত হল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না লোকটা। তার মুখ থেকে শব্দ বের হল, “বাঃ।”

চোখ ছোট হল, কপালে ভাঁজ পড়ল এতোয়ারির। লোকটা ঘরের ভিতর ঢুকতেই সে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে এল। কোথায় যাবে ঠাওর না-করে খানিকটা হেঁটে সে বটগাছটার কাছে এসে ধনুবুড়োকে দেখতে পেল। তিনমাথা এক হওয়া বুড়োটাকে রোজ বাড়ির লোক এখানে বসিয়ে দিয়ে যায়। দুপুরে নিয়ে গিয়ে স্নান পায়খানা করিয়ে আবার রাত পর্যন্ত এখানেই ফেলে রেখে দেয়। ধনুবুড়োর হাতে একটা লাঠি আছে যার সাহায্যে পাশের জঙ্গলে জলবিয়োগ করে আসে। আর সারাক্ষণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে যে-ভাবনা ভাবে, তা এই লাইনের এমন কেউ নেই যে জানে না।

এতোয়ারির মাথা এত গরম হয়ে গিয়েছিল, সে আর কিছু ভাবতে না-পেরে ধনুবুড়োর পাশে এসে বসল। ধনুবুড়ো তার দিকে তাকালও না। কিছুক্ষণ পরে একটা বড় শ্বাস ফেলল এতোয়ারি। তারপর ধনুবুড়োর দিকে তাকাল। সে যখন ছোট ছিল, তখন ধনুবুড়োর মুখে শুনতে পেত অনেক কাহিনি। এই চা-বাগান তার দেশ নয়। তার দেশ বহুদূরে, রেলগাড়িতে চড়ে যেতে হয়। সেই দেশ থেকে সে চা-বাগানে এসেছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে। যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘ও ধনুবুড়ো, এখন তোমার বয়স কত হল?’ ধনুবুড়ো মুখ তোলে। ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখ আকাশের দিকে তুলে অনেকক্ষণ ভাবে। তারপর উত্তর খুঁজে না-পেয়ে আবার মুখ নামিয়ে নেয়।

আজ এতোয়ারি নিচু গলায় ডাকল, “ও ধনুবুড়ো, ধনুবুড়ো, শুনতে পাচ্ছ?” এতোয়ারি ধনুবুড়োর খালি পিঠে তার বাঁ হাতটা রাখল। শীতের কয়েক মাস ছাড়া ধনুবুড়োর বাড়ির ছেলেরা তাকে শুধু নেংটি পরিয়ে রেখে দেয় দিনরাত।

ধনুবুড়ো মুখ তুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে এতোয়ারিকে দেখে ফিক করে হাসল। এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “ধনুবুড়ো, তোমার দেশে যাবে?”

যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ধনুবুড়ো।

এতোয়ারি বলল, “আমি চাকরি করছি, মাইনে পাব। সেই টাকায় টিকিট কেটে রেলে চড়ে তোমাকে নিয়ে তোমার দেশে যাব। তুমি যাবে তো?”

কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে এতোয়ারির হাত শক্ত করে ধরল ধনুবুড়ো, “সত্যি?”

“হ্যাঁ। তুমি রাজি হলে আমি এখানে থাকব না,” এতোয়ারি বলল।

ধীরে ধীরে অপূর্ব এক আলো ফুটে উঠল ধনুবুড়োর মুখে। ধনুবুড়োর এমন মুখ এতোয়ারি কখনও দেখেনি। সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার দেশে যেতে হলে কোন স্টেশনে নামতে হয়? কোথাকার টিকিট কাটতে হয়?”

বুড়ো হাঁ করল, যেন কথা হাতড়াল কিন্তু খুঁজে পেল না।

“নামটা তোমার মনে নেই? ছেলেবেলায় তোমাকে বলতে শুনেছি।”

এবার ধনুবুড়োর মুখ দেখে মনে হল সে প্রাণপণে চেষ্টা করেও বিফল হচ্ছে। পিঠে আলতো আদর করল এতোয়ারি। বলল, “ঠিক আছে। ধীরে ধীরে মনে করার চেষ্টা করো।”

এইসময় দূর থেকে একটা বাচ্চা ছুটে এল ওদের সামনে, “ও পিসি, তোমাকে তোমার বাবা ডাকছে,” বলে ছুটে চলে গেল অন্যদিকে।

“যা যা,” খসখসে গলায় বলল ধনুবুড়ো, “আমি ভাবি, নামটা কী যেন, ঠিক মনে পড়ে যাবে, ভাবিস না,” বলে বুড়োর মাথা দুই হাঁটুর ওপর নেমে গেল। চোখের পাতা বন্ধ হল।

হঠাৎ এতোয়ারির মনে হল, সে যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওই নির্লজ্জ লোকটাকে যা বলার তা সামনাসামনি বলাই উচিত। এতোয়ারি বড় বড় পা ফেলে নিজেদের ঘরের দরজায় পৌঁছতেই হাঁড়িয়ার কটু গন্ধ টের পেল। বাবা বলল, “এই যে, এসে গিয়েছিস। জামাইকে একটু খাতিরযত্ন কর, তোর মা ঘরে থাকলে সে সব করত।”
 
থমথমে মুখে লোকটার দিকে তাকাল এতোয়ারি, “অ্যাই! লজ্জা করে না তোমার তা জানি, কিন্তু এতখানি নির্লজ্জ তুমি! এত লোক রোজ মরে যাচ্ছে, তোমার কেন মরণ হয় না। কোন মুখে তুমি এ বাড়িতে এসেছ, অ্যাঁ?”

বাবা বলল, “আঃ, এতি, চুপ কর। ভুলে যা আগের কথা। আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ছেলেমানুষ তো, একটা ভুল করে ফেলেছে…”

“বাঃ, তুমি কীরকম বাপ? লোকটা এসে তোমাকে হাঁড়িয়া খাওয়াল আর তুমি সব ভুলে আমাকে ক্ষমা করতে বলছ? তুমি বাপ না কসাই?” চিৎকার করল এতোয়ারি।

“আঃ, যা মুখে আসছে তাই বলছিস? চাকরি পেয়ে তোর পা ভারী হয়ে গেছে। জামাই এসে ক্ষমা চেয়েছে, তা জানিস?” হাঁড়িয়ার বোতলে চুমুক দিল বাবা।

লোকটা দাঁত বের করে হাসল, “আহা, মাথা তো গরম হতেই পারে। একসময় তো বেচারা খুব কষ্ট পেয়েছে, দোষ তো আমারই।”

আর-একটা চুমুক দিয়ে বাবা বলল, “দেখ, ও নিজের দোষ স্বীকার করছে। আরে, মানুষ তো চিরকাল একরকম থাকে না।”

কোমরে দুটো হাত রেখে এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “কেন এসেছ এখানে?”

“তোর জন্যে খুব মনকেমন করছিল তাই চলে এলাম। তোর বাপের কাছে ক্ষমা চাইলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আরে, আমি যতই অন্যায় করে থাকি, তবু তো আমি তোর স্বামী। জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। হ্যাঁ!’’ লোকটা বলল।

বোতল থেকে হাঁড়িয়া গলায় ঢেলে বাবা বলল, “জামাই বলেছে ওর আর টাকা চাই না। উঃ, আমার মাথার ওপর থেকে পাহাড় সরে গেল।”

“ওঠো, ওঠো বলছি। ফের যদি এখানে দেখি, তা হলে তোমার পা ভেঙে দেব,” দৌড়ে ঘরের কোণে গিয়ে একটা বড় কাটারি তুলে এতোয়ারি ঘুরে দাঁড়াল।

দ্রুত উঠে দাঁড়াল লোকটা। তারপর এতোয়ারির বাবার সামনে গিয়ে হাত পাতল, “দাও, এই পাগলি মেয়েমানুষকে আমার চাই না। দাও টাকা ফেরত।”

অবাক হয়ে এতোয়ারি দেখল বাবা গোল করে পাকানো নোটগুলো বেশ অনিচ্ছায় লোকটাকে ফেরত দিল। টাকা পাওয়ামাত্র হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। এতোয়ারি কাটারি হাতে এগিয়ে এল বাবার সামনে, “ছিঃ! তুমি না আমার বাবা! লজ্জা! কী লজ্জা! ছিঃ! আজ দুপুরে তোমাকে কোনও খাবার দেব না, গেলো, গেলো ওই বিষ,” হনহন করে রান্না করা খাবার নিয়ে এতোয়ারি সোজা চলে এল ধনুবুড়োর সামনে। খাবার তার সামনে রেখে বলল, “ও বুড়ো, খিদে পেলে খেয়ে নিয়ো, আমি পরে পাত্রটা নিয়ে যাব।”

বুড়ো মুখ তুলে খাবার দেখল। তার মুখে হাসি ফুটল। বলল, “যাবি তো?”

“যাব। কিন্তু স্টেশনের নামটা মনে পড়েছে?” এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল।

“পড়বে, পড়বে। ঠিক মনে পড়বে,” ধনুবুড়ো মাথা নাড়ল।

এখন দুপুর শুরু হতে দেরি নেই। এতোয়ারি হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালে চলে এল। প্রথমেই দেখা হয়ে গেল বড়নার্সের সঙ্গে, “তোর বাবা এখন কেমন আছে?”

“ভাল,” মুখ নিচু করে বলল এতোয়ারি।

“ছুটি যখন নিয়েছিস তখন আজ এলি কেন?” বড় নার্স বলে গেল।

এতোয়ারি চুপচাপ মায়ের বিছানার পাশে এসে দেখল মা পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। একটা টুল টেনে মায়ের মাথার পাশে বসল সে। এই সময় ছোট নার্স এগিয়ে এসে নিঃশব্দে ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ইশারা করল কথা না-বলতে। এতোয়ারি উঠে দাঁড়াতেই ইশারায় তাকে বসতে বলে ছোট নার্স অন্য কাজে চলে গেল। নিঃশব্দে আবার টুলের ওপর বসল এতোয়ারি। মায়ের শীর্ণ শরীরটা মড়ার মতো বিছানায় পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বহুকাল পরে মা এখন তৃপ্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে।
 
বেশ অনেকক্ষণ পরে চোখ বন্ধ করেই পাশ ফিরল মা। আর তখনই একটা কাক জানলার ওপর বসে কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল। সেই শব্দে মায়ের চোখের পাতা খুলে গেল। একটু বিরক্তির ছাপ ফুটল মুখে। তারপর পাশ ফিরতেই মা মেয়েকে দেখতে পেল। বুঝতে একটুখানি সময়, তারপরেই হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাতের স্পর্শ পেয়ে এতোয়ারির বুকে বর্ষার ডুডুয়া নদী যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে মায়ের হাত ধরে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন লাগছে এখন?”

কিছুক্ষণ হাত ধরে থেকে মা জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”

ঢোঁক গিলল এতোয়ারি। কোনওমতে বলল, “কিছু না।”

এই সময় ছোট নার্স ফিরে এল, “কী, মাকে কেমন দেখছিস?”

“কথা বলছে,” চোখ মুছল এতোয়ারি।

মা কথা বলছে আর তুই চোখ থেকে জল ফেলছিস? কী বোকা মেয়ে রে তুই! তোর মাকে ইচ্ছে করলে বাসায় নিয়ে যেতে পারিস। আর যদি চাস তা হলে আর-একটা দিন এখানে রেখে দিতে পারিস। হাসপাতালের আরও দুটো বেড খালি হয়েছে, নতুন পেশেন্ট এলে অসুবিধে হবে না,” ছোট নার্স হাসিমুখে কথাগুলো বলল।

“কিন্তু ডাক্তারবাবু তো একদিন থাকতে বলেছিলেন!” এতোয়ারি বলল।

“সেটা কাল বলেছিলেন। আজ সকালে তোর মায়ের প্রেশার দেখে বলেছেন যদি তোদের ইচ্ছা হয়, তা হলে আজ এখানে থাকতে পারিস,” ছোট নার্স চলে গেল।

মা মাথা নাড়ল, “না, আমি আজ ঘরে ফিরে যাব।”

“কেন?” মায়ের কপালে হাত বুলিয়ে দিল এতোয়ারি।

“আমি এখন ভাল আছি। কাল একটু মাথা ঘুরে যেতে হাসপাতালে ভরতি করে দিল। আমার শরীর ঠিক আছে।”

“না, ঠিক থাকলে ডাক্তারবাবু রাখতে চাইত না।”

“তুই সব বুঝে গিয়েছিস,” চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বাদে মা বলল, “আমি এখানে আরামে ঘুমোব, ভাল ভাল খাবার খাব আর তোরা…” কথা শেষ করল না মা।

“ঠিক আছে। আর-একটা দিন এখানে থাকো, ডাক্তারবাবু যখন বলেছেন।”

হঠাৎ মা জিজ্ঞাসা করল, “তুই কেমন আছিস?”

“আমার অপারেশনের ঘা তো কবে শুকিয়ে গিয়েছে, এই দাগটা বোধহয় কোনওদিন মিলিয়ে যাবে না,” হাসার চেষ্টা করল এতোয়ারি।

হঠাৎ শক্ত করে মেয়ের হাত ধরল মা। এতোয়ারি অবাক হয়ে তাকাল মায়ের মুখের দিকে। তার চোখে চোখ রেখে মা বলল, “আমি আবার তোর বিয়ে দেব।”

“পাগল! একবার তো দিয়েছিলে, তাতে শিক্ষা হয়নি?” মুখ ফেরাল এতোয়ারি।

“তখন তুই এইরকম ছিলি না,” মায়ের কথা শেষ হতেই ছোট নার্স খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আবার ঠোঁটে আঙুল চাপল। মা চোখ বন্ধ করলে এতোয়ারির স্বস্তির শ্বাস পড়ল। এই সময় মাকে বাবার কীর্তির কথা বলাটা ঠিক হত না।
 
সন্ধের মুখে ঘরে ফিরে এতোয়ারি দেখল তার বাবা চিত হয়ে শুয়ে আছে। বুক ওঠানামা করছে বলে বোঝা যাচ্ছে মরে যায়নি। পাশে হাঁড়িয়ার খালি বোতল। সারাদিন পেটে কোনও খাবার যায়নি। এখন এতোয়ারি দু’-দুটো খালি বোতল দেখতে পেল। ওই বদমাশ লোকটা শ্বশুরের জন্যে দুটো হাঁড়িয়ার বোতল নিয়ে এসেছিল!

একরাশ বিরক্তি সত্ত্বেও ঘর পরিষ্কার করল এতোয়ারি। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর আগে ছোট নার্স তাকে টিফিন খাইয়ে দিয়েছিল। এখন রাতের ভাত রান্না করার ইচ্ছেটা মন থেকে চলে গেল। এই সময় বাইরে থেকে কিছু লোকের চেঁচামেচি ভেসে এল। কেউ একজন বেশ জোরে কাঁদছে। কৌতূহলী হয়ে সে ঘরের বাইরে এসে খানিকটা দূরে একটা ছোট্ট ভিড় দেখতে পেল।

এতোয়ারি ভিড়ের কাছে যেতেই শুনতে পেল, বিকেল থেকে ধনুবুড়ো তিনমাথা এক করে বসে ছিল, কেউ তাকে নড়াচড়া করতে দেখেনি। মাংরা সর্দার বলল, “মারা নাও যেতে পারে, অনেক সময় মানুষ অজ্ঞান হয়ে গেলে এরকম দেখায়!”

শেষপর্যন্ত একজন বাজারের এক কম্পাউন্ডারকে নিয়ে এল। লোকটা ধনুবুড়োকে ভাল করে পরীক্ষা করে বলল, “নাঃ। নেই। অনেক আগেই প্রাণ বেরিয়ে গেছে।”

শোনামাত্র একজন চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তাকে সান্ত্বনা দিল কয়েকজন। মাংরা সর্দার ধমক দিল, “কাঁদছিস কেন? কত বয়স হয়েছিল তা জানিস? আমি ছেলেবেলাতেই ওকে ঠিক এই চেহারায় দেখেছি। বয়সের গাছপাথর নেই বুড়োর। মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।”

ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে ধনুবুড়োর মুখ দেখল এতোয়ারি। চোখ বন্ধ। চুপসে যাওয়া মুখ। একটাও দাঁত নেই। কিন্তু ঠোঁটের কোণে যেন চিলতে হাসি জড়িয়ে আছে। এতোয়ারি যেন শুনতে পেল, ‘পড়বে, পড়বে। ঠিক মনে পড়বে।’ ধনুবুড়োর দেশ যে-গ্রামে, সেখানে পৌঁছতে যে-স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতে হয়, তার নামটা বুড়োর মন থেকে মুছে গিয়েছিল। মৃত্যুর আগে কি ধনুবুড়োর সেই নামটা মনে পড়েছিল?

কত বয়স হয়েছিল ধনুবুড়োর, এই নিয়ে আলোচনা চলছিল। চার্চে খবর দিতে হবে। কবরখানায় নিয়ে গিয়ে গোর দেওয়ার আগে চার্চের পাদরিকে খবর দিতে একজনকে পাঠাল মাংরা সর্দার। ধীরে ধীরে সরে এল এতোয়ারি।

ধনুবুড়োর বহুকালের ইচ্ছে পূর্ণ হল না। এতোয়ারির কথা শুনে মানুষটা বেশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু স্টেশনটার নাম বুড়োর স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। ট্রেনের টিকিট কাটার সময় রেলের বাবুকে বলতেই পারত না কোথায় যাবে। দিনের পর দিন, মাস, বছর এখানে তেমাথা এক করে বসে বুড়ো ভেবে গেছে একদিন না-একদিন তাকে তার পূর্বপুরুষের গ্রামে ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু শেষ শ্বাস ফেলার আগে ধনুবুড়ো দেশের স্টেশনের নামটা জেনে যেতে পারল না।
 
আজ লাইনের অনেক লোক রাত জাগবে। বয়স্ক মানুষ মারা গেলে লাইনের সর্দার বাগানের সাহেবদের খবর দিয়ে আসে। রাতে মরলে আধবেলা ছুটি মঞ্জুর হয়। দিনে মরলে ছুটি নিলে রোজ কাটা হয়। তাই কথাটা চালু আছে, মরতে হলে মাঝরাতের আগেই মরো! এতোয়ারি দেখল, ধনুবু়ড়োর মৃতদেহ একপাশে কাপড়ে ঢেকে হাঁড়িয়া খাওয়া শুরু হয়ে গেল শোক ভুলতে। সে হাঁটতে শুরু করল।

চা-বাগানের ভেতরে রাত ঘন হলে বিচিত্র শব্দের জন্ম হয়। প্রথমে খুব মৃদু; শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যায়। তারপর হঠাৎ চারধার চমকে দিয়ে কোনও রাতপাখি চিৎকার করে গাছের ডাল ছেড়ে ঝাপসা হয়ে পড়ে থাকা চা-বাগানের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। সেই শব্দ মিলিয়ে যেতেই চরাচর অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে, চারদিক দেখেশুনে, সাহস করে পেঁচারা ডেকে এ ওর খবর নেয়। সেই ডাক কানে যেতে, চা-বাগানের ভেতরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে, আজ এতোয়ারির মনে হল, পাখিদেরও বন্ধু আছে, তারাও বন্ধুর সঙ্গ চায়, কিন্তু তার কোনও বন্ধু নেই।

ছোটবেলায় এতোয়ারির কোনও বন্ধু ছিল না। সাত বছর বয়সেই চারমাসের বাচ্চা ভাইকে কাপড়ে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। শীতকাল এলে, শরীর একটু লম্বা হলে পিঠে ভাইকে নিয়ে নদী পেরিয়ে চলে যেত বাবুদের কোয়ার্টার্সের সামনের মাঠের পাশে। সেখানে বিকেলের রোদ মরে যাওয়ার আগেই বাবুদের ছেলেরা জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে খেলত। এতোয়ারি ভাইকে পিঠে নিয়ে খেলা দেখতে দেখতে দুটো দলের একটাকে নিজের দল ভেবে নিত। যখন খেলা শেষ করে বাবুদের ছেলেরা যে যার ঘরে চলে যেত, তখন গরম হয়ে চেপটে যাওয়া জাম্বুরাটাকে ফেলে দিত। নির্জন সেই খেলার মাঠে পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত ফলটাকে তুলে নিতেই হাতে রস লেগে যেত। দ্রুত ভাইকে পিঠে নিয়ে নদীর গায়ে চলে আসত সে। একটু চাপ দিতেই জাম্বুরার একটা দিক ফেটে গলগলিয়ে রস বের হত। ঘুমন্ত ভাইকে ডাকত সে, “এই রস খাবি?”

দিদির পিঠে গাল চেপে ঘুমিয়ে থাকা ভাইয়ের সাড়া পাওয়া যেত না। তখন বাতাবিটা মুখের ওপর তুলে চাপ দিতেই গলগল করে রস বেরিয়ে আসত মুখে। বেশির ভাগ জাম্বুরার রস এত টক থাকত যে ফেলে দিতে হত। মাঝে মধ্যে কম টক আর একটু মিষ্টি মেশানো রস পাওয়া গেলে তৃপ্তি করে অনেকটা পান করে নিত এতোয়ারি।

ভাইয়ের ওজন বাড়ছিল। পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টের হয়ে উঠছিল। তা ছাড়া ও তখন ভাল হাঁটতে পারে বলে সহজে পিঠে উঠতে চাইত না। তখন ওকে জাম্বুরার রসের লোভ দেখিয়ে পিঠে নিতে পারত এতোয়ারি। ওকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, নদীর জল মাঝে মাঝে ওর গলাসমান হয়ে বয়ে যেত। আর বাবা-মা ওর ওপর ভাইয়ের দায়িত্ব ছেড়ে কাজে যেত বলে, এতোয়ারি একা বল খেলা দেখতে যেতে পারত না। ভাইকে পিঠে ওঠাতে হত লোভ দেখিয়ে, কষ্ট হলেও।

সেই ভাইয়ের এক রাতে জ্বর এল। ভাইয়ের মাথা জলে ধুয়ে দিচ্ছে মা, এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল এতোয়ারি। ঘুম ভাঙল মায়ের কান্নার শব্দে। বাবার কোলে ভাই, মা এবং লাইনের আরও কয়েকজন পেছনে। এতোয়ারি শুনতে পেল, ভাইয়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, তাই ওকে নিয়ে সবাই বাগানের হাসপাতালে যাচ্ছে। কেউ তাকে ডাকেনি, তবু দলটার পেছন পেছন এতোয়ারি হাঁটতে লাগল।
 
জীবনে প্রথমবার সে হাসপাতালে গিয়েছিল। তাকে এবং অন্যদের বাইরে রেখে মা আর বাবা ভাইকে ভেতরে নিয়ে গেল। বেলা বাড়লে বাবা-মা ভাইকে হাসপাতালে রেখে তাকে লাইনে ফেরত নিয়ে এসেছিল ওরা। দুপুরের খাবার ওদের কাছ থেকেই পেয়েছিল সে। লাইন থেকে বেরোনোর মুখে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির ওপর সারা দুপুর বসে থাকল এতোয়ারি। বিকেলে ওরা এল। পাগলের মতো কাঁদছিল মা। বাবাও। বাবার কোলে ভাই। সাদা কাপড়ে ঢাকা শরীর। জীবনে প্রথমবার কাউকে মরে যেতে দেখেছিল এতোয়ারি।

তার শরীরের সঙ্গে ভাইয়ের শরীর প্রতিটি দিনের বেশ কয়েক ঘণ্টা মিশে থাকত। ভাইয়ের শরীরের গন্ধ নাকে আসত তখন। এসব তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কান্না ধীরে ধীরে কমে এল, বাবাকে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এতোয়ারি ঘরের দাওয়ায় পাথরের মতো বসে থাকত। ভাই ছাড়া তার কোনও সঙ্গী ছিল না। সে মরে যাওয়ার পরে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছেই হয়নি। সে জানত তার কপালের ওপর আব থাকায় সে অন্যদের চেয়ে আলাদা। ওই আবের জন্য সমবয়সি মেয়েরা তাকে এড়িয়ে যায়। ছেলেরা দূরে দূরে থাকে। মাকে বলতে শুনেছে, “ছেলেটাকে কেড়ে নিলে তুমি? কী পাপ করেছি আমি?”

বাবা শুয়ে শুয়ে বলত, “ভগবান মেয়েটাকে নিতে পারত। ওই আবওয়ালি মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে? চিরকাল ঘাড়ে বসে খাবে।”

কথাগুলো কানে যেত। কিন্তু শুনতে শুনতে মন আর খারাপ হত না। অভ্যেস হয়ে গেলে ব্যথাকে ব্যথা বলে মনে হয় না। যে-লোকটা তাকে দু’চোখে দেখতে পারত না ভগবান তাকেই শাস্তি দিলেন, কিন্তু পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও বাবার মুখের তেজ এতদিন কমেনি। কিন্তু বউয়ের হাতে মার খাওয়ার পর থেকে একদম চুপ করে গিয়েছে মানুষটা।

ফিনফিনে অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছিল এতোয়ারি। একবার তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পাথরে ধাক্কা খাওয়ায় ব্যথা সামলে সে সজাগ হল। অন্যমনস্ক হয়ে সে হাসপাতালের দিকেই হেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন ইমার্জেন্সির পেশেন্ট ছাড়া কাউকে হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাকে দেখলে চৌকিদার নিশ্চয়ই চিনতে পারবে, ঢুকতেও হয়তো দেবে কিন্তু বড় নার্স তার কৈফিয়ত চাইবেন। এমন কী প্রয়োজন হল যে, অত রাতে সে মাকে দেখতে এসেছিল!

দ্বিধায় পড়ল এতোয়ারি আর তখনই তার কানে খিলখিল হাসির শব্দ বাজল। মহিলার গলায় খুশির হাসি, অবাক হয়ে বাঁ দিকে তাকাল এতোয়ারি। তারপরেই মহিলাকণ্ঠে কথা শুনল, “যদি মরে যাই।”

এবার একটি পুরুষ কণ্ঠ নিচু গলায় যা বলল তা বুঝতে পারল না এতোয়ারি। খুব অবাক হয়ে গেল সে। এই রাতের অন্ধকারে লোকালয়ের বাইরে, নদীর ধারে নারী ও পুরুষ এভাবে গল্প করতে আসবে ভাবা যায় না। মহিলা যে আনন্দে আছে তা ওর হাসি থেকে বোঝা যাচ্ছে। কৌতূহলী হল এতোয়ারি। নিঃশব্দে সে নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বড় ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল। অন্ধকারে নদীর জল ভাল করে বোঝা না-গেলেও সেটা যে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, তা আঁচ করা যাচ্ছে। মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই নদীর পাশে ঝোপের গায়ে দুটো শরীরকে অস্পষ্ট দেখতে পেল এতোয়ারি। দু’জনে ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়ে আছে ঘাসের ওপর। ওরা কারা তা বুঝতে পারছিল না সে। নারীকণ্ঠ বলল, “আজ ওটা না। যদি লেগে যায় তা হলে পেটে যেটা আছে তার ক্ষতি হবে।”

“আহা,” পুরুষ বলল, “পেটে যে আছে তার বাবা কে?”

নারী হাসল, “তুমি, তুমি, তুমি।”

“বাবা হয়ে আমি ওর ক্ষতি চাইতে পারি?”

“জানি। শোনো, তোমার বন্ধুও বাচ্চার জন্যে খুব ভাবছে।”

“তাই?”

“হ্যাঁ, আজ ওকে লুকিয়ে এখানে এসেছি। অবশ্য আমি যা বোঝাব তাই ও মেনে নেয়। নিজের যে ক্ষমতা নেই তা বুঝতেই চায় না।”

“ভাগ্যিস তোমার স্বামীর ক্ষমতা নেই, তাই আমি তোমাকে পেলাম,” পুরুষ এবার নারীর ঘনিষ্ঠ হল। নারী আনন্দিত এবং সতর্ক স্বরে বলল, “সাবধান, যেন বেশি চাপ দিয়ো না। দুষ্টু!”

সরে এল এতোয়ারি। সে বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। শেষপর্যন্ত মনে হল ঘরে ফিরে যাওয়াই ভাল। সে ঘরের পথ ধরল।
 
তখন কুলিলাইনে রাত ঘন হয়েছে। ধনুবুড়োকে কবর দিতে অনেকেই চলে গেছে কবরখানায়। এতোয়ারি দেখল ধনুবুড়োর নাতবউ আর একজন প্রৌঢ়া গাছতলায় বসে আছে, যেখানে ধনুবুড়োকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হত। সম্ভবত কবরখানা থেকে লোকজন ফিরে না-আসা পর্যন্ত ওরা গম্ভীর মুখে ওখানে বসে থাকবে।

এতোয়ারিকে দেখে ধনুবুড়োর নাতবউ হাত নেড়ে কাছে ডাকল।

এতোয়ারি কাছে এলে প্রৌঢ়া ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, “তোর মা কেমন আছে?”

“ভাল।”

“সব কী যে হয়ে যাচ্ছে!” ধনুবুড়োর নাতবউ শ্বাস ফেলল। তারপর যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, “তোর সঙ্গে ধনুবুড়োর কোনও কথা হয়েছিল?”

“কোন কথার কথা বলছ?” এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল।

“মারা যাওয়ার একটু আগে ধনুবুড়ো নাকি দুটো কথা বেশ কয়েকবার বলেছিল! আমার ছেলের বউ খাবার দিতে গিয়ে শুনেছিল।”

“কী কথা?”

“তোর নাম বলছিল আর বলছিল মহুয়ামিলন,” বেশ ভেবে ভেবে বলল প্রৌঢ়া, “মহুয়ামিলন মানে কী তুই জানিস?”

মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “না।”

অন্য মহিলা জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ছেলের বউ ঠিক শুনেছিল?”

“হ্যাঁ। ঘরে ফিরে তখনই আমাকে বলেছিল। আমিও কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। তুই কথাটা কখনও শুনিসনি?”

“না,” মাথা নাড়ল এতোয়ারি।

সঙ্গের মহিলা বলল, “কী বলতে কী বলেছে, মাথার কি ঠিক ছিল!”

ঘরে ফিরে এল এতোয়ারি। যেভাবে বাবাকে সে দেখে গিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে বাবা। এই কুলিলাইনে যে একটা ঘটনা ঘটে গেল, তার খবর বাবার কাছে এখনও পৌঁছয়নি। ঘরের বিপরীত দেওয়ালে বিছানা করে শুয়ে পড়ল এতোয়ারি। চোখ বন্ধ করতেই আচমকা নদীর গা ঘেঁষে শুয়ে থাকা দুই নারী-পুরুষের শরীর সামনে চলে এল। আসন্ন সন্তানসম্ভবা ওই নারীটি কে, সে গলা শুনে বুঝতে পারেনি। নিশ্চয়ই এই লাইনে থাকে না। পুরুষটিকেও সে চেনে না। কিন্তু সন্তানের পৃথিবীতে আসার দিন যখন বেশি দেরিতে নেই, তখনও ওরা শরীরের আনন্দ পেতে রাতের অন্ধকারে নদীর ধারে মিলিত হয়েছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়, ওদের সন্তান কখনওই বাবার নাম জানতে পারবে না। কিন্তু এতোয়ারির মনে আজ অন্য রকমের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ছিল। তার স্বামী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শরীর ভোগ করত। সে-সময় ভয়ংকর যন্ত্রণা পেত সে। আজ ওই নারীর মুখ থেকে যেসব শব্দ বের হচ্ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র যন্ত্রণা ছিল না। উলটে উপভোগের সুখ ঝরে পড়ছিল।

ঘুম ভেঙে গেল এতোয়ারির। শ্বাস ভারী হল। আর ঘুম আসছিল না।

একদম যন্ত্রের মতো অন্ধকার থাকতেই ঘুম থেকে উঠে নদীতে যাওয়া, ঝটপট সেদ্ধ ভাত আর ডাল রেঁধে তৈরি হয়ে বাবার সামনে খাবার রেখে দিয়ে এতোয়ারি শাড়ি বদলে যখন বাইরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে, তখন সূর্য উঠে গেছে। উঠে বসে বাবা তার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে, দেখেও দেখে না এতোয়ারি। হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top