What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে লোকজন তেমন নেই। কিছু ভিখিরি আর ছন্নছাড়া টাইপের মানুষ শুয়ে রয়েছে। ওরা ওদের পাশ দিয়ে মূল গেটে চলে গেল। এগিকে মেইন প্ল্যাটফর্মের মতো জোরালো আলো নেই। কোলাপসিবল গেটের সামনে এসে ওরা থমকে দাঁড়াল। সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা, ডানদিকে স্টেশনে ঢোকার গেট, গেট ছাড়িয়ে রাস্তা দেকা যাচ্ছে। ওপাশটা অন্ধকার। বৃদ্ধ ভদ্রলোক অনেকক্ষণ সেদিকে নজর রেখে ফিসফিস করে বললেন, কোনো মানুষজন তো দেখতে পাচ্ছি না। পুলিশও নেই।

ওটা কী রাস্তা? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

সার্কুলার রোড। ওটা পোয়রালেই হয়ে গেল, পায়েপায়ে বাড়ি পৌঁছে যাব। অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ প্রথম কলকাতাকে দেখল। বৃদ্ধের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, চলো আড়ালে পথটুকু পেরিয়ে যাই।

কিন্তু আমি এখন ঠিকানাটা কি খুঁজে বের করতে পারব।

অনিমেষ কী করবে বুঝতে পারছিল না। এই গ্যাটফর্মে রাতটা কাটানোই নিরপদ বলে মনে হচ্ছিল ওর। বৃদ্ধ বললেন, আঃ, কলকাতা শহরে ঠিকানা থাকলে বাড়ি খুঁজে পাওয়া খুব সোজা। বলছি তো, ওটা আমারই পাড়া।

আমিতো পথঘাট কিছু চিনি না। অনিমেষ বিড়বিড় করল।

সে তো ট্রেনে উঠেই শুনেছি। আমার ওপর ভরসা নেই। যদি আজ তোমার সেই ঠিকানা নাও পাওয়া যায় তুমি তো জলে পড়বে না। আমার বাড়িতে তোফা রাতটুকু কাটিয়ে যেতে পার। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, সেটা নিশ্চয়ই প্ল্যাটফমের চেয়ে নিরাপদ।

অনিমেষ অবাক হয়ে বলল, এখানে কী হতে পারে?

তুমি এখনও নাবালক। বৃদ্ধ ঠোঁট ওলটালেন, গুণ্ডাদের খুঁজতে পুলিশ এসে হামলা করলে তুমি কী করবে? তোমার বয়সের ছেলেদেরই তখন বিপদ হবে। আমার কী বলল, এতটা পথ একসঙ্গে এলাম, কেমন মায়া পড়ে গেছে বলে এত কথা বলা। একা একা যেতে ঠিক মানে-বুঝলে, সঙ্গী থাকলে সাহস পাওয়া যায়।

বৃদ্ধ চলে গেলে একা এই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে থাকার কথা ভেবে অনিমেষ ঘাবড়ে গেল। মেইন প্ল্যাটফর্মে অত লোকের সঙ্গে থাকলে এক কথা ছিল, পুলিশ খামোকা নাজেহাল করতে আসতই-বা কেন। কিন্তু এই ভিখিরিদের সঙ্গে সারাটা রাত থাকা অসম্ভব। এরা যদি হঠাৎ দল বেঁধে তার জিনিসপত্র টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয় ও কিছুই করতে পারবে না। তা ছাড়া পুলিশ এলে আর-কেউ তা দেখার থাকবে না। এক হয়, আবার যে-পথ দিয়ে ওরা মেইন স্টেশন থেকে এখানে এসেছিল সেই পথে ফিরে যাওয়া। অনিমেষ একা একা সাহস পাচ্ছিল না ফিরে যেতে। তার চেয়ে যা ইনি বলছেন তা-ই শোনাই ভালো। অন্তত ওর বাড়িতেও রাতটা নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে।

ওকে রাকি হতে দেখে বৃদ্ধ খুশি হলেন, কিছু চিন্তা করতে হবে না তোমাকে, শুধু আমার পেছন পেছন চলে এসো!

কোথাও কোনো শব্দ নেই, ওরা শেডের অন্ধকারে পা টিপে পিটে মেইন গেটের কাছে চলে এল। বৃদ্ধ সামনে, অনিমেষ পেছনে। সমুখেই বিরাট রাস্তা, মাঝখানে লোহার লাইন পোঁতা। নিশ্চয়ই এটা ট্রামলাইন। রাস্তার ওপাশের যেটুকু চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছিল তাতে বোঝা যায় যে এখন কোনো দোকানপাট খোলা নেই। বৃদ্ধ মুখ বের করে রাস্তাটা দাঁড়িয়ে দেখেনি ল, না, কেউ নেই, ধুধু করছে। এসো।

অনিমেষ আড়ালের আড়ালে ওঁর সঙ্গে নিঃশব্দ পায়ে বাইরে চলে এল। এতক্ষণ দুহাতে বয়েআনা ব্যাগ-বেডিং-এর ওজন সম্পর্কে ওর কোনো খেয়ালই ছিল না, এই বিরাট শহরের চওড়া রাস্তার ধারে নিজের দুটো হাতের টনটনানি হঠাৎই সে অনুভব করতে লাগল। সামনে আর-একটা বড় রাস্তা এসে এই রাস্তায় মিশেছে। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, এখানে না, ধার দিয়ে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আমরা রাস্তা পার হব, বুঝলে?

ওটা কী রাস্তা?

হারিসন রোড। লোকজন কী প্যানিকি হয়ে গেছে আজকাল, মিছিমিছি ভয় পায়-দেখছ তো পথে একটাও পুলিশ নেই। ওরা যখন ফুটপাথের গা-ঘেঁষে অনেকটা সামনে এগিয়েছে তখন হঠাৎ দূরে কিছু শব্দ বেজে উঠল। অনিমেষ দেখল কী যেন কালোমতন এগিয়ে আসছে। বৃদ্ধ বললেন, আলো নেই-ট্রাম চলছে, ডিপোয় যাচ্ছে বোধহয়। এপাশটায় সবে এসো, কেউ দেখতে পাবে না তা হলে।
 
দেওয়ালের গায়ে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে অনিমেষ অনেক দূরে থাকা ট্রামটাকে দেখছিল। এর আগে কখনো ট্রাম দেখেনি, বিস্ময় নিয়ে এই বিচিত্র পরিবেশে সে অপেক্ষা করছিল। ওদের সামনে রাস্তার উলটোদিকে একটা বিরাট ব্যানারে সিনেমার বিজ্ঞাপন। এত বড় বিজ্ঞাপন সে এর আগে কখনো দেখেনি। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মুখটা কী দারুণ জীবন্ত দেখাচ্ছে চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে! পাশেই একটা বীভৎস মুখ, কী ছবি ওটা?

হঠাৎ বৃদ্ধ খপ করে হাত শক্ত করে ধরতেই অনিমেষ চমকে সামনের দিকে অকাল। চারপাঁচজন মানুষ খুব দ্রুত এগিয়ে এসে ট্রামের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে। ওদের পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না অনিমেষরা। ট্রামটা আর চলছে না। বৃদ্ধ খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। অনিমেষ অনুভব করল, ওর হাত কাঁপছে। কোনোরকমে কথা বললেন তিনি, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। চলো রাস্তা পেরিয়ে যাই এইবেলা। কথা শেষ করেই তিনি উর্বশ্বাসে দৌড়ে রাস্তাটা টার হয়ে গেলেন। অনিমেষ তেমন দ্রুত দৌড়ে যেতে পারল না হাতে বোঝা থাকায়। সে যখন পার হয়ে গিয়ে বৃদ্ধের কাছে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখন দাউদাউ করে ট্রামটায় আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়া-ছায়া শরীরগুলো দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। বৃদ্ধ ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ইস, ওরা ট্রামে আগুন ধনিয়ে দিয়েছে! এখনই পুলিশ আসবে-পালাও।

অনিমেষ ওঁর পেছন পেছন ছুটতে চেষ্টা করে বলল, আর কত দূরে? বৃদ্ধ কী বলতে মুখ ফেরাতে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়লেন। উঃ, বাবা গো! চিৎকারটা আচমকা অনিমেষকে পাথর করে দিল। ফুটপাথের একদিকে বেঞ্চিতো পাতা, বোধহয় হকাররা এখানে কেনাবেচা করে, তারই এক পায়ার সঙ্গে দড়ি বাঁধা ছিল, বৃদ্ধ তাতেই হোঁচট খেয়েছেন। অনিমেষ তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, খুব লেগেছে।

বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন, ওর খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। সামনে দাউদাউ করে ট্রাম জ্বলছে। কলকাতায় পা দিয়ে অনিমেষ প্রথম যে-ট্রামটাকে পেল তার সর্বাঙ্গে আগুন। বৃদ্ধকে নিয়ে কী করা যায় বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। ও জিনিসপত্র মাটিতে রেখে ওঁকে তুলে ধরতে চেষ্টা করল, উঠতে পারবেন?

বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন, বড় কষ্ট হচ্ছে। তুমি বরং সামনে গলিতে ঢুকে বাঁ-হাতি পাঁচ নম্বর বাড়িতে খবর দাও। আমার ছেলের নাম সুজিত। সে-ই ভালো। বুদ্ধের বাড়ি তা হলে খুব কাছে। অনিমেষ উঠে মালপত্র নিয়ে কয়েক পা এগোতেই থমকে দাঁড়াল। খুব দ্রুত একটা কালো রঙের ভ্যান ছুটে আসছে এদিকে। পাশাপাশি একটা জিপগাড়ি। পেছনে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বায়ে বোধহয় একটা দমকালের গাড়ি আসছে। শব্দ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িগুলো। সঙ্গে ঙ্গে কতগুলো পুলিশ লাফিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে, নেমে ট্রামের দিকে ছুটে গেল। ওদের হাতের রাইফেল সামনের দিকে তাগ করা। জিপের লোকগুলো বোধহয় অফিসার, হাত নেড়ে ওদের কীসব উপদেশ দিচ্ছে। ওরা যদি এদিকে তাকায় তা হলে অনিমেষদের দেখতে পেয়ে যাবে। দেখতে পেলে ওরা মনে করবে। সে ট্রামগাড়িতে আগুন দিয়েছে। অন্তত তাকে ওরা প্রশ্ন নিশ্চয়ই করবে, আর তা হলেই জানতে পারবে সে এই প্রথম মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কলকাতায় এসেছে, এখনও টিকিট পকেটে আছে আর হাতের সুটকেসগুলো তো জলজ্যান্ত প্রমাণ। কিন্তু উচানো বন্দুকের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কেমন টিপটি করতে লাগল অনিমেষের। যে-ট্রামটা জ্বলছে এখন সেটার আগুন নেবানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কতকগুলো লোক। আশেপাশে কোনোমানুষ নেই, কেউ কৌতূহলী হয়ে দেখছে না এখানে কী হচ্ছে। কলকাতা শহরে নাকি লোক সবসময় গিজগিজ করে, তারা এই মুহূর্তে কোথায় গেল!

অনিমেষ পেছন ফিরে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখল। তিনি বোধহয় পুলিশদের লক্ষ করেছেন, কারণ



তার শরীর এখন হকারদের বেঞ্চির তলায় অনেকখানি ঢোকানো। চট করে রাস্তা থেকে বোঝা যাবে না কেউ ওখানে আছে। অনিমেষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ও বুঝতে পারছিল, সামান্য নড়াচড়া করলেই পুলিশের নজরে পড়ে যাবে। ওই পাথরের মতো মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় ধরা পড়লে তা কখনোই সুখের হবে না। লোকগুলো আমোক এই ট্রামটা পোড়াতেই-বা গেল কেন? ট্রাম তো জনসাধারণের উপকারেই আসে। খাদ্য চাওয়ার সঙ্গে ট্রাম পোড়ানোর কী সম্পর্ক আছে। নাকি ওরা এইভাবেই সরকারকে জব্দ করতে চায়?

কিন্তু যা-ই হোক, একটা লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা শহরে। সেই লড়াই-এর এক পক্ষ কংগ্রেস সরকার আর তার পুলিশবাহিনী, কিন্তু অন্য পক্ষ কে? অনিমেষ নিজের শরীরের ভার এক পা, থেকে অন্য পায়ে আনার জন্য সামান্য নড়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কড়া আলো ওর মুখের ওপর এসে পড়ল আচমকা। তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে সে শুনতে পেল, কে ওখানে? হু আর ইউ?।
 
টর্চের আলো ওর মুখ থেকে সরছে না, কিন্তু কেউ-একজন এদিকে এগিয়ে আসছে। অনিমেষের সঙ্গে একটা কাঁপুনি এসে গেল। কী করবে ও? চিৎকার করে নিজের নাম বলে ওদের দিকে এগিয়ে যাবে? ঠিক সেই সময় ও কয়েকটি ছুটন্ত শরীরকে সামনের গলি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল। কিছু বোঝার আগেই দুমদুম আওয়াজে সমস্ত কলকাতা যেন কাপতে লাগল। যারা ছুটে এসেছিল তারা। শব্দটার সঙ্গেই আবার গলির মধ্যে তুরিতগতিতে ফিরে গেছে। অনিমেষ তাকিয়ে দেখল যে-পুলিশ অফিসার টর্চ-হাতে ওর দিকে এগিয়ে আসছিল তার শরীর মাটিতে পড়ে আছে। সামনের ভ্যানটা ধোয়ায় ভরতি। ওরা বোমা ছুড়ে গেল। অনিমেষ আর-কোনো চিন্তা করতে পারল না। এইরকম একটা আকস্মিক ব্যাপার ওপর সমস্ত চেতনাকে নাড়া দিয়ে গেল। কোনোদিকে না তাকিয়ে শরীরে যত জোর আছে সব একত্রিত করে ও ছুটতে লাগল পাশের গলিটার দিকে। এক দুই তিন চার পাঁচ নম্বর বাড়িটার সামনে পৌঁছে গেলেই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। হঠাৎ একটা তীব্র ব্যথা এবং কানফাটানো গর্জন অনিমেষের সমস্ত শরীর অসাড় করে দিল। কিছু বোঝার আগেই ওর দুটন্ত শরীরটা হুমড়ি খেয়ে গলির মধ্যে পড়ে গেল, ব্যাগ আর বেডিং ছিটকে চলে গেল দুদিকে। পড়ে যাওয়ার পরও আওয়াজ বন্ধ হয়নি। একটা হাঁটু ভাজ করে অনিমেষ গলির রাস্তায় শুয়ে ছটফট করতে করতে আবিষ্কার করল, উষ্ণ স্রোত নেমে আসছে হাঁটুর ওপর থেকে। চটচটে হয়ে যাচ্ছে হাতের চেটো। সেখান থেকে উঠে ব্যথাটা এখন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে-সে কথা বলতে পারছে না। ক্রমশ চোখ ঘোলাটে হয়ে গিয়ে সমস্ত কলকাতা শহর অন্ধকার হয়ে গেল অনিমেষের সামনে।

কোনোদিন ঘোড়ায় অথবা পালকিতে চড়েনি অনিমেষ। হঠাৎ যেন ওর মনে হল সেরকম কিছুতে সে চেপে যাচ্ছে। বেশ দ্রুত। যন্ত্রণা হচ্ছে কেন এত পায়ে? চোখ খুলে কিছু দেখতে পাচ্ছে না কেন? স্বৰ্গছেঁড়ায় আঙরাভাসা নদীর হাঁটুজলে চেষ্টা করে ড়ুব দিয়ে চোখ খুলে যেরকম ঘোলাটে জগৎটাকে দেখা যেত এখন কেন সেরকম দেখাচ্ছে? কেউ কি ওকে পাজাকোলা করে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে কে? যে বাবা যারা নিয়ে যাচ্ছে তারা ওর হাত-পা-ধরে আছে, ওর বুক পেট নিচের সামনে অন্ধকারটাকে আসতে দেখল।

আর এই সময় একটা অদ্ভুত বাঁশির সুর বাজছে কোথাও, এরকম বোধ হল। মাথার ওপর কালীগাই-এর আদুরে চোখ দুটোর মতো আদর-করতে-চাওয়া আকাশ আর ওরা তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সঙ্গীদের সে কখনো দেখেনি, কিন্তু তাদের মুখচোখ অদ্ভুত উজ্জ্বল। একটা নীলচে ধোয়া ওদের পাকে পাকে কোমর অবধি ঘিরে রেখেছে। স্বৰ্গছেঁড়ার মাঠে যে কাঁঠালচাপা ফুটত সেইরকম একটা গন্ধে নাক ভরে যাচ্ছে। কেউ-একজন বলল, এখন তুমি এমন সুন্দর গান শুনতে পাবে যা কোনোদিন শোননি। কোনোদিন শুনবেও না। ওদের সামনে একটু ওপরে আরও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে, শরীর নীল ধোয়ায় ছেয়ে আছে, কারওর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অপূর্ব জ্যোতি বের হচ্ছে সেখান থেকে। এই নীলাভ আলোয় অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল একটি মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রচণ্ড নাড়া খেয়ে সে দুহাত বাড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা নড়ছে না কেন? যেন তাকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ও দেখল, মাধুরীর হাসির মধ্যে যেন তিরস্কার, নাকি অনুযোগ, অথবা অভিমান! ও মনেমনে বলে উঠল, মাগো মা আমাকে আসতে দাও। কিন্তু সেই মূর্তি ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালেন। আর সঙ্গে সঙ্গে এক অপূর্ব সুর উঠল বাতাসে। একে কি গান বলে? অনিমেষ এরকম গান এর আগে শোনেনি কখনো। তার সামনে থেকে সবকিছু সরে যাচ্ছে আর এই যাওয়ার জন্য এখন একটুও আফসোস হচ্ছে না তার।

হঠাৎ কেউ কথা বলল চাপা গলায়, খোকাকে শুট করেছে দাদা।

খোকাকে একটা ভারী গলা এগিয়ে আসতেই অনিমেষ অনুভব করল তাকে শক্তমতো কিছুর ওপর নামিয়ে রাখা হল। যেন কোনো গভীর কুয়োর তলা থেকে তীরবেগে সে ওপরে উঠে আসছে-এইরকম একটা বোধে দুলতে দূলতে অনিমেষ চোখ খুলল। কিন্তু এত অন্ধকার কেন? ঘরটাই কি অন্ধকার ও শুনতে পেল ভারী-গলা বলছে, সেন্স আছে, না ডেড?

আর-একজন খুব কাছ থেকে জবাব দিল, না, অজ্ঞান হয়ে আছে বোধহয়-খুব ব্লিডিং হচ্ছে। ওকে পড়ে যেতে দেখে বোম চার্জ করে পুলিশটাকে হটিয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে এসেছি।

ওদিকের অবস্থা কেমন?

গলির ভেতর পুলিশ ঢুকবে না মনে হয়।

কিন্তু খোকা ওখানে কী করতে গেল? ওর তো ওখানে থাকার কথা নয়? ভারী-গলাকে খুব চিন্তিত দেখাল।

একটু একটু করে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে, কিন্তু তক্ষুনি মনে হল কে যেন ওর ডান উরুতে পেরেক পুঁতে দিয়েছে-যন্ত্রণাটা তুবড়ির মতো সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। নিজের দুটো হাত সেখানে রাখতেই চটচটে হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে শরীরটা দুমড়ে-মুচড়ে ও যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে লাগল। দাতের বাঁধন ছিটকে বেরিয়ে এল, মা-মাগো!

সঙ্গে সঙ্গে কেউ বলল, সেন্স এসেছে।

ভারী-গলা কাউকে বলল, গুলি যদি পেটে লেগে থাকে কিছু করার নেই, তুমি জলদি শিবু ডাক্তারের কাছে যাও, আমার নাম বলে নিয়ে আসবে।
 
দুহাতে মুখচাপা দিয়ে অনিমেষ স্থির হয়ে থাকতে চাইছিল। এইটুকু বোধ ওর কাজ করছিল যে, ও পুলিশের হাতে পড়েনি। এরা কারা? একটা ক্ষীণ আলো আস্তে-আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ও হাতদুটো মুখের ওপর তুলতেই সেই স্বল্প আলোয় টকটকে লাল রক্তমাখা আঙুলগুলো দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে একটা দৃশ্য ওর সামনে চলে এল। মাধুরী চিৎকার করে ওকে বলে উঠেছেন, ওরে মুছে ফ্যাল, তোর হাত থেকে রক্ত মুছে ফ্যাল! চোখের সামনে জ্বলা দাউদাউ চিতার আগুন ওকে যেন ঠেলে আবার সেই কুয়োটার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। অনিমেষ প্রাণপণে চেষ্টা করছিল জ্ঞানটাকে আঁকড়ে ধরার। আলোটা এখন ওর ওপরে। ভারী-গলা হাত দিয়ে ওর পা ছুঁয়ে বলল, থাইতে গুলি লেগেছে। যাক, বেঁচে যাবে। তারপর আলোটা ওর মুখের কাছে এল, আরে, এ কে? কাকে আনলে তোমরা? এ তো খোকা নয়!

খোকা নয়? খোকার মতো ফিগার-হ্যাঁ, তা-ই তো! এ তো অন্য লোক।

ক্রমশ অস্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে আলোটা। যন্ত্রণাটা এখন সারা শরীরে নিজের ইচ্ছেমতন খেলা করে যাচ্ছে। অনিমেষ কিছুতেই চোখ খোলা রাখতে পারছিল না। ভারী-গলা ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই, তোমার নাম কী?

প্রাণপণে ঠোঁট নাড়তে চাইল অনিমেষ। ওর সমস্ত শরীর কথা বলতে চাইছে, অথচ কোনো শব্দ হচ্ছে না কেন?

ওর দুধ ধরে কেউ ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে সমানে। মুখের ওপর অস্পষ্ট একটা মুখ। ক্রমশ কুয়োর গভীরে যেতে-যেতে অনিমেষ দুটো শব্দ শুনতে পেল, তুমি কে?

ঠোঁট নাড়ল অনিমেষ। চিত হয়ে শুয়ে থাকা শরীরটার পরে মাথাটাকে সোজা রাখতে চেষ্টা করছিল সে প্রাণপণে।

ঠিক এই সময়ে কেউ-একজন বাইরে থেকে অনিমেষের নাম ধরে ডাকতে লাগল। সে বেরিয়ে দেখল ওদের পাড়ারই একটি ছেলে, কংগ্রেস করে, দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষকে দেখে সে বলল, তাড়াতাড়ি কংগ্রেস অফিসে চলো। মারাত্মক ফ্লাড হয়েছে ওপারের দিকে। নিশীথদা তোমাকে খবর দিতে বললেন-রিলিফ পর্টি যাবে।

ঠিক এই সময় কেউ-একজন বাইরে থেকে অনিমেষের নাম ধরে ডাকতে লাগল। সে বেরিয়ে দেখল ওদের পাড়ারই একটি ছেলে, কংগ্রেস করে, দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষকে দেখে সে বলল, তাড়াতাড়ি কংগ্রেস অফিসে চলো। মারাত্মক ফ্লাড হয়েছে ওপারের দিকে। নিশীথদা তোমাকে খবর দিতে বললেন-রিলিফ পার্টি যাবে।

অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে একছুটে দাদুর কাছে ফিরে এল, দাদু, বন্যাতে অনেক লোক খুব বিপদে পড়েছে। কংগ্রেস থেকে রিলিফ পার্টি যাচ্ছে, আমাকে ডাকছে।

হেমলতা কাছেই ছিলেন। সরিৎশেখর কিছু বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন, তোর যাবার কী দরকার! অনেক বেকার ছেলে আছে, তারা যাক। দুমাস গেলেই তোর পরীক্ষা।

অনিমেষ এরকমটাই আশা করেছিল, গোঁ ধরে বলল, এখন তো পড়াশুনা শুরু হয়নি, মানুষের বিপদ শুনে ঘরে বসে থাকব?

সতিৎশেখর নাতির দিকে তাকালেন। হঠাৎ অনেকদিন পরে তার শনিবাবার কথাটা মনে পড়ে। গেল। কোনো কাজে একেবাধা দিও না। তিনি নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কখন ফিরছ।

অনিমেষ বুঝল আরা বাধা নেই, বুঝতে পারছি না, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। চিন্তার কিছু নেই।

সরিৎশেখর আর-কিছু বললেন না দেখে হেমলতা গজগজ করতে লাগলেন।

কংগ্রেস অফিসে মানুষ গিজগিজ করছে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে রিলিফ পার্টি যাচ্ছে। সরকার থেকে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে, তা ছাড়া দলীয় তার থেকে চিড়ে-মুড়ি-গুড়ের বড় বড় থলে বোঝাই করা হয়েছে। অনিমেষ স্বভাবতই নিশীথবাবুর দলে যাবে স্থির হল। এর মধ্যে খবর এল বামপন্থিরাও রিলিফের জন্য ব্যবস্থা করছে। তবে তারা এখনও বের হয়নি।
 
অনিমেষ দেখল প্রত্যেকটা দলকে আলাদা-আলাদা করে জায়গা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক যাবার মুখটায় বিরামবাবু কংগ্রেস অফিসে এলেন। তিনি সব দেখেশুনে নিশীথবাবুকে একটু আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে গোপনে কিছু পরামর্শ এবং একটা কাগজ দিলেন। শেষ পর্যন্ত ওরা রিলিফ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটা ট্রাকে দুদলের রিলিফ নিয়ে শহর ধরে রায়কতপাড়া দিয়ে সেনপাড়া ছাড়িয়ে বাধের শেষপ্রান্তে ওঁদের নামিয়ে দেওয়া হল। আগে থেকেই সেখানে লম্বা লম্বা ডিঙিনৌকো প্রস্তুত ছিল। দুটো দল নৌকোগুলো ভাগ করে নিল। অনিমেষদের ভাগে তিনটে ডিঙি জুটল। ওরা থলেঘুলো নৌকোতে চাপাতে বেশ ভারী হয়ে গেল সেগুলো। আজ অবধি কখনো ডিঙিনৌকাতে চড়েনি অনিমেষ। জলে ড়ুবে মরার একটা চান্য নাকি তার আছে যদিও প্রত্যেকটা নৌকোতে দুজন করে পাকা মাঝি আছে। এক-একটা ডিঙিতে ছয়জন মানুষ স্বচ্ছন্দে চড়াতে পারে। কোনোরকমে ব্যালেন্স রেখে ওরা নৌকোতে উঠল। নিশীথবাবু বললেন, তিনিও কোনোদিন ডিঙিয়ে চড়েননি।

তিস্তার চেহারাটা রাতারাতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বর্ষার সময় এইরকম মাঝে-মাঝে দেখা যায়। যদিও মাথার ওপর এখন কড়া রোদ, কিন্তু যে-বাতাসটা তিস্তার বুক থেকে ভেসে আসছে সেটা বুঝিতে দিয়ে শীতটা বাধ্য হয়ে দূরে অপেক্ষা করছে। অনিমেষ নিশীথবাবুর পাশে বসে ভয়েভয়ে জল দেখছিল। গেরুয়া রঙের ঢেউগুলো পাক খেতে-খেতে যাচ্ছে। সরু নৌকো বেশ তীরের মতো জল ঠেলে যাচ্ছে তীর ধরে।

নিশীথবাবু বললেন, বাড়িতে বলে এসেছে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

নিশীথবাবু বললেন, কখন ফিরব জানি না। আজ দুপুরে আমাদের এইসব খেতে হবে। বুঝলে অনিমেষ, এই হল প্রকৃত দেশসেবা। শুধু বিপ্লবের ফাঁকা বুলি নিয়ে দেশসেবা হয় না। .

বাঁধ ছাড়িয়ে কিছুটা ওপরে যেতেই অনিমেষ স্বম্ভিত হয়ে পড়ল। গাছপালা, মাটির ঘরবাড়ি যেন উপড়ে নিয়ে তিস্তা অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। নতুন-তৈরি বাঁধ ভেঙে শহরে ঢুকতে পারেনি বলে তার আক্রোশ এইসব খোলা এলাকায় নির্মমভাবে মিটিয়ে নিয়েছে। এখনও জল এদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, তিস্তা ঢুকে পড়েছে অনেকটা। মাঝে-মাঝে কালাগাছ কিংবা দুএকটা খড়ের চাল দেখা যাবে। একটি মানুষ কোথাও নজরে পড়ল না ওদের। অনিমেষ খেয়াল করেনি, নদী ছেড়ে ওরা এখন মাঠের ওপর দিয়ে চলেছে। জলের রঙ দেখে ঠাওর করা মুশকিল। কিছুটা দূরে গিয়ে নৌকোগুলো দুভাগ হয়ে গেল। অন্য দলটা বাঁদিক ঘুরে ভেতরে ঢুকে পড়ল, অনিমেষদের নৌকো চলল তিস্তার শরীরকে পাশে রেখে সোজা ওপরে।

নিশীথবাবু দুহাতে চোখ আড়াল করে নদীর অন্য পাড় দেখার চেষ্টা করছিলেন। সমুদ্র দেখেনি অনিমেষ, কিন্তু ওর মনে হল সমুদ্র নিশ্চয়ই এইরকম হবে। নিশীথবাবু মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু ওর মনে হল সমুদ্র নিশ্চয়ই এইরকম হবে। নিশীথবাবু মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওপারে যাওয়া যাবে মনে হয়?

মাঝি, যার সামান্য দাড়ি দাছে, বলল, আরও আধ ক্রোশ চলেন আগে। বুক হিম হয়ে গেল অনিমেষের। ওইরকম পাগলা কুঁসে-ওঠা ঢেউগুলো পার হতে গেলে নৌকো নির্ঘাত ড়ুবে যাবে আর এখানে একবার ড়ুবে গেলে বাঁচবার কোনো চান্স নেই। হয় ডেডবডি মঙ্গলঘাটে গিয়ে ঠেকবে, নয় সোজা পাকিস্তানে। সে তার সঙ্গীদের দিকে তাকাল। সবাই চুপচাপ নৌকো ধরে বসে আছে।
 
সামনে একটা গ্রাম পড়ল। জল এখনও চালের নিচে। এখানে বোধহয় সোতটা মারাত্মক ছিল, কারণ বাড়িগুলোর কিছু বেঁচে আছে। মাটির ঘর খড়ের চাল। দূর থেকে ওদের দেখে কিছু মানুষ চিৎকার করে উঠল। অনিমেষ দেখল একটা বিরাট ঝাকড়া বটগাছের ডালে-ডালে অনেকগুলো মানুষ ঝুলছে। তারাই প্রাণপণে চিৎকার করে চলেছে। নৌকো কাছাকাছি হতে অনিমেষের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বটগাছের কাছাকাছি একটা আমগাছে একজন নগ্ন মানুয গলায় কাপড়ের ফাঁস দিয়ে ঝুলছে। তার শরীরের চামড়া এখন কালচে, একটা বিকট গল্প বেরুচ্ছে শরীরটা থেকে। দুটো শকুন তার দুই কাঁধের ওপর বসে অনিমেষের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে আছে। মানুষটার চোখ দুই, শরীরের নানা। জায়গায় নিরক্ত ক্ষত।

প্রায় মানুষটির পায়ের তলা দিয়েই ওরা ডিঙি নিয়ে বটগাছটার দিকে এগিয়ে গেল। চিৎকারটা ওদের এগোতে দেখে সামান্য কমে এল, একটি গলা আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, আসেন বাবু, আমাগো বাঁচান, তিনদিন খাই না।

সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলো বিভিন্ন কণ্ঠে আবৃত্তি করল। নিশীথবাবু সাবধানে নৌকোর ওপরে উঠে দাঁড়ালেন, এই গ্রামে কেউ মারা গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ সংখ্যাটি বলতে লাগল। বটগাছের ডালে-বসা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল অনিমেষ। অনাহার এবং বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের চেহারা যে কতটা বীভৎস হতে পারে এদের না দেখলে বোঝা যাবে না। ওরা যে গাছ থেকে নামবে তার উপায় নেই। নৌকোটা গাছের তলায় নিয়ে গেলে একদম নিচের ডালে যারা আছে তাদের হাতে খাবারের ব্যাগ পৌঁছে দেওয়া যায়। নিশীথবাবু মাঝিকে নৌকোটা থামাতে বললেন। তিনজন লোক মারা গেছে। দুজন মহিলা আর একজন বৃদ্ধি। বাকি মানুষ পেছনের দিকে একটা শিবমন্দিরের চুড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। খাবার জোটেনি কারও। নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ওই লোকটা আত্মহত্যা করল কেন?

ওর বাবু বড় ব্যথা। জল আইলে ঘর থিকা ইস্ত্রি আর মায়েরে লইয়া হুহ উঁচু ঢিবায় রাইখ্যা আইছিল। তারপর জলের মধ্যে ঘরে ফিইর‍্যা জিনিসপত্র যা পরে লইয়া গিয়া দেখল তারা নাই। জল, ওই রাক্ষুসী তিতামাগি অগো খাইছে। আমরা তখন যে যার প্রাণ বাঁচাই। একরাত ওই আমগাছে বইস্যা থাইক্যা শেষমেষ পরনের বস্ত্র দিয়া আমাগো সামনে গলায় ফাঁস দিল, বাবু।

ঘটনা শুনে অনিমেষ চোখের জল সামলাতে পারল না। এই তিনদিন তিনরাত ওরা শহরে বসে এসব ঘটনার কিছুই জানতে পারেনি। এতক্ষণ একটানা কথা বলে লোকটার গলা ধরে এসেছিল। এবার সবাই মিলে খাবার চাইতে লাগল। অনিমেষের সঙ্গীরা থলির মুখ খুলছিল, কিন্তু নিশীথবাবু তাদের হাত নেড়ে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। অনিমেষের সঙ্গীরা থলির মুখ খুলছিল, কিন্তু নিশীথবাবু তাদের হাত নেড়ে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। তারপর লোকগুলোর দিকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই গ্রামটার নাম কী?

নামটা শুনে নিশীথবাবু চট করে পকেট থেকে বিরামবাবুর দেওয়া কাগজ বের করে তাতে কী দেখে নিলেন। অনিমেষ দেখল, নিশীথবাবুর মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। খানিক ভেবে নিয়ে মাঝিকে নৌকো ঘোরাতে বললেন। মাঝি বোধহয় একদম আশা করেনি হুকুমটা, ফস করে জিজ্ঞাসা করে বসল, অগো খাবার দিবেন না?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top