What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

দোতলায় উঠতে পারল না অনিমেষ। একজন সিপাই ওকে প্রায় পাঁজাকোষা করে ওপরে তুলে দিয়ে গেল। দুটো ঘর পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজার সামনে অফিসারটি থামল। তারপর হেসে বলল, আপনার স্ত্রী ভেতরে আছেন, আসুন।

অনিমেষের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হল। অফিসারের পেছনে সে ঘরে ঢুকল। একটা সাধারণ আলো জ্বলছে কারণ ঘরটির কোন জানলা চোখে পড়ছে না। সামনেই একটা চেয়ার, অনিমেষ তার হাতল ধরে দাঁড়াতেই মাধবীলতাকে দেখতে পেল। ঘরের আর এক প্রান্তে একা বসে আছে সে। সেখানে অন্য কোন চেয়ার নেই। এতবড় ঘরের দুপাশে দুটো চেয়ার সাজানো–মাধবীলতা উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ আচমকা বেরিয়ে এল। অনিমেষ মাধবলিতাকে দেখল। একটা হাত মুখের ওপর চাপা, বিস্ফারিত। হ্যাঁ, শরীরের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতন। বিশেষ করে কোমরের নীচের স্ফীতি চোখে পড়ছে সহজেই। অনিমেষ কোনরকমে উচ্চারণ করল, লতা!

মাধবীলতার কানে শব্দটা যেতেই যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। বিদ্যুতের মত কাছে চলে এল সে ওই শরীর নিয়ে, অনিমেষ, এ কি চেহারা হয়েছে তোমার?

অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করেও পারল না।

তুমি ভাল আছ অনি?

এবার পেছনে মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। মেঝেতে কার্পেট পাতা, হাঁটাচলায় আওয়াজ হয় না। অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জনা চারেক মানুষ ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের গায়ে য়ুনিফর্ম না থাকলেও চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তারা পুলিশ। অফিসারটি এবার এগিয়ে এলেন, অনেকদিন বাদে আপনাদের দেখা হল, তাই না? অবশ্য অনিমেষবাবু যদি নিজে আপনার কথা আমাদের জানাতেন তাহলে অনেক আগেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারতাম। অনেক কষ্টে আপনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে হয়েছে মাধবীলতা দেবী। তবে দেরী হল বলে আফসোস করে লাভ নেই, বেটার লেট দ্যান নেভার। আপনার এ অবস্থায় অনিমেষবাবু আপনাকে ছেড়ে আছেন কি করে তাই বুঝতে পারছি না।

মাধবীলতা গলার স্বর পাল্টে গেল, আপনারা ধরে রেখেছেন বলেই ওকে এখানে থাকতে হচ্ছে, জেনেশুনে এরকম কথা বলছেন কেন?

ঠিক কথা। আমরা ধরে রেখেছি কটি মাস মাত্র। তার আগে উনি আপনার ত্রিসীমানায় ঘেঁষেননি স্বইচ্ছায়। আমরা ভেবেছিলাম উনি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে ক্লেইম করবেন না, অবশ্য সেটা ভুল হয়েছে, উনি করেছেন। আপনি ভাগ্যবতী! অফিসার হাসল।

মানে?

মাধবীলতা দেবী, আপনার স্কুলে কিংবা আগে যে হোস্টেলে থাকতেন সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে আপনার মিত্র হবার কোন নোটিফিকেশন নেই। কবে আপনাদের বিয়ে হল সেখবর কারো জানা নেই। অথচ আপনার শরীর বলছে আপনি মা হতে যাচ্ছেন। ব্যাপারটি যদি বৈধ না হয় তাহলে–।

অনিমেষ চাপা গলায় কথা বলল, কেন বাজে কথা বলছেন, মাধবীলতা আমার স্ত্রী, একথা আগেও বলেছি।

গুড। সেকথাই আমি বলতে চাইছি। মুখের কথাই যথেষ্ট। আমরা কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না। আপনাকে এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে দায়িত্বজ্ঞানহীন হবেন না। আপনার স্ত্রীর আপনার কথা মেনেই বলছি, আপনার স্ত্রীর কাছে এইসময় থাকা উচিত। আপনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।

কী ভাবে?

আপনি জানেন মহাদেব একজন নটোরিয়াস লোক। তার ঠিকানা আপনি জানেন। জানি সেখানে সে এখন নাও থাকতে পারে তবু আমরা তার একটা ক্লু পেতে পারি। এটা আমার প্রস্তাব, আপনি যদি ঠিকানাটা বলেন আমরা এক্ষুণি আপনাকে ছেড়ে দেব এবং ব্যাপারটা কেউ জানতে পারবে না। আপনার কোন ফেলো কমরেডরা টেরও পাবে না। এই সময় ওঁর সঙ্গে আপনার থাকা উচিত।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, আপনারা মিথ্যে চেষ্টা করছেন।

তাহলে আপনি কোঅপারেশন করবেন না?

যা ইচ্ছে ভাবুন।

অফিসার কি ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?

মাধবীলতা বলল, ও যা ভাল মনে করছে তাই করছে।

সঙ্গে সঙ্গে অফিসার বলে উঠল সামান্য গলা তুলে, তাহলে আপনাকে অ্যারেস্ট করছি।

অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, কেন?

আপনার সঙ্গে আঁতাতের জন্যে। দেশদ্রোহিতার জন্যে।

দেশদ্রোহী?

নাকি বিপ্লব? থুঃ। সাধারণ মানুষ আপনাদের নাম শুনলে ভয় পায়। একটা অর্গানাইজড ডাকাতের দল আপনারা। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে চেয়েছেন। অনিমেষবাবু, দিস ইজ লাস্ট টাইম, আপনার স্বপ্নের আন্দোলন ভেসে গেছে, যারা পারছে বিদেশে পালাচ্ছে, বেশিরভাগই ধরা দিচ্ছে, নেতারা জেলে–এখন আর আপনাদের অস্তিত্ব কিছু নেই। তাই বলছি, খামোকা জেদ করবেন না। মহাদেববাবুর ঠিকানাটা বলুন।
 
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। কী রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। কণর হাড় বেরিয়ে গেছে, গালের হাড় উঁচু, শরীর ফ্যাকাশে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে বুকের আড়ালে রাখতে। মাধবীলতা ওর দিকে তাকাতেই সে দুচোখে যেন ইচ্ছেটাকেই বোঝাতে লাগল। সে কোনরকমে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় আছ এখন?

দেখুন, কি চমৎকার দায়িত্বজ্ঞান!

আপনি কোথায় আছেন সে খবর আপনার স্বামী রাখেন না, অবশ্য আপনার স্বামী যদি হন! কি হল চুপ করে আছেন যে?

অনিমেষের মাথায় গনগনে আগুন ছড়িয়ে পড়ল, এই যে, আপনি যা বলার আমাকে বলুন।

শাট আপ, চেঁচাবেন না। আপনি চুপ করে আছেন কেন?

আমার কথা বলতে ঘেন্না করছে!

অনিমেষ দেখল অফিসারের ডান হাত চাবুকের মত বাতাস কেটে মাধবীলতার গালে আচড়ে পড়ল। লোকটা মাধবীলতাকে চড় মারল! নিজের শরীরের কথা খেয়ালে থাকল না অনিমেষের, প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল অফিসারটির ওপর। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সে নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে একটা প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করল সে। ব্যথাটা এমন মারাত্মক যে ককিয়ে উঠে নিঃসাড়ে মেঝেতে পড়ে থাকল। ওকে টেনে তোলা হল। তারপর টানতে টানতে চেয়ারে বসিয়ে কতগুলো বেল্ট দিয়ে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হল যাতে সামান্য নড়াচড়া না করতে পারে। কোমরের তলায় শরীরের অবশিষ্ট অঙ্গগুলোর অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল না অনিমেষ। এতক্ষণ মাথার ভেতরটা চৈত্রের আকাশ হয়েছিল, এবার একটু একটু করে চিন্তা করার ক্ষমতা ফিরে আসতেই সে মাধবীলতার দিকে তাকাল। সে কি ঠিক দেখছে? নিজের চোখকে বিশ্বাস করা শক্ত, অনিমেষ একবার জোরে চোখ বন্ধ করে আবার স্বচ্ছ হবার চেষ্টা করল। মাধবীলতার মাথা নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দুটো হাত উঁচু করে দুটো লোহার বালার সঙ্গে বাঁধা। বালা দুটো ওপরের কড়িকাঠে ফাস দেওয়া একটা দড়ির সঙ্গে নেমে এসেছে। দুটো হাত ওপরে টানটান থাকায় ওর শাড়ির আঁচল খসে পড়েছে। সন্তানের আবাস্থল এখন কুৎসিত দেখাচ্ছে। মাধবীলতার চিবুক শক্ত, দাঁতে ঠোঁট চেপে আছে সে।

এই শূয়োরের দল, সাবধান বলছি, ওকে ছেড়ে দাও। অনিমেষের চিৎকার শুনে দাঁত বের করে হাসল লোকগুলো।

মাধবীলতার সামনে এখন অফিসার ছাড়া আর একজন দাঁড়িয়ে। রোগা, লম্বা, মুখের দিকে তাকালে বিশ্বাস করা যায় দুহাতে দুটো শিশুর গলা টিপতে পারে হেসে হেসে। লোকটি বলল, মা জননী, আমার নও, পেটের বাচ্চাটার, এবার দিগম্বরী হও, দর্শন করি।

অনিমেষ পাগলের মত চিৎকার করে উঠল। কোমরের তলায় কোন সাড় নেই, দুহাত বাঁধা, পেছনের লোক চেয়ার ধরে রাখায় সে একটু নড়াতেও পারল না।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে মুখ তুলল, আপনারা কী চান?

অফিসারটি একটু নড়ল, তার গলায় অদ্ভুত পেলবতা, সামান্যই, ওকে বলুন ঠিকানাটা জানাতে। এসব ঝামেলা কার ভাল লাগে বলুন।

আমার ওপর অত্যাচার করছেন কী অধিকারে?

যে অধিকারে ওরা মানুষ খুন করে, পুলিশের গলা কাটে! যে অধিকারে বিয়ে না করেও আপনার শরীরে এরা সন্তান দেয়–।

হঠাৎ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মাধবীলতা, শোন, আমি মরে গেলেও তুমি এদের কিছু বলো না। আমার জন্যে তুমি হেরে যেও না, লক্ষীটি!

লম্বা লোকটি হা হা করে হাসতেই অফিসার চোখ টিপে তাকে ইঙ্গিত করল। সে হাত বাড়িয়ে মাধবীলতার পড়ে থাকা আঁচল কুড়িয়ে নিল। তারপর মিউজিক্যাল চেয়ারের ভঙ্গিতে আওড়াচ্ছে, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ চলছে চলবে। অনিমেষ আর তাকাতে পারছিল না। কিন্তু পেছন থেকে ওর মুখ দুহাতে চেপে তুলে ধরল, সামনে তাকাও!

অনিমেষ বাধ্য হয়ে দেখল। দেখেই শেষবার শক্তি ব্যবহার করে নিষ্ফল হল। না, সে হেরে গেল। নিজেকে একটা অপদার্থ নির্জীব ক্লীব মনে হতে লাগল ওর। এখন মাধবীলতার শরীরে শাড়ি নেই। দাঁতে দাঁতে চেপে মাধবীলতা মাথা পেছনে হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষের মুখ লোকটার হাতে ধরা, সে চোখ বন্ধ করতেই আচমকা কপালে তীব্র জ্বলুনি বোধ করল। অস্ফুট চিৎকার করতেই লোকটা একটা চুরুট ওর সামনে নাচাতে লাগল। অনিমেষের কপাল জ্বলে যাচ্ছিল। লোকটা বলল, চোখ বন্ধ রাখলে চলবে না। দেখতে হবে–সব দেখতে হবে।

এইসময় লম্বা রোগা লোকটা এগিয়ে এসে চুরুটটা নিয়ে মাধবীলতার কাছে ফিরে গেল। অফিসার এবার অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, কি মশাই, বলবেন, না দেখবেন?
 
অনিমেষ উত্তর দিল না। সে বুঝতে পারছিল তার কাছ থেকে কিছু শুনতে না পাওয়া পর্যন্ত ওরা মাধবীলতার ওপর অত্যাচার চালাবে। এখন পর্যন্ত যা হয়েছে তা সহ্য করা যে কোন মেয়ের পক্ষেই কষ্টকর। শুধু তার জন্যেই মাধবীলতাকে এই জঘন্য অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। একজন সন্তানসম্ভবা মহিলার পক্ষে এই অত্যাচার মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এরা তা জেনেও করছে। অথচ মাধবীলতা একটুও মুখ খুলছে না। সে এখন কি করবে? চোখের ওপর এই অত্যাচার দেখতে আর পারছে না সে। মহাদেবদা এখন আলিপুরদুয়ারে আছেন কি না সে জানে না। যদি খবরটা দিয়েই দেয় তা হলেও মহাদেবদার ক্ষতি নাও হতে পারে। কিন্তু মাধবীলতা বেঁচে যাবে। এক পলক চিন্তাটা মাথায় আসতেই সে ঠোঁট খুলেছিল। অফিসার তার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎ মাধবীলতার আর্তনাদ শুনতে পেল সে। লম্বা লোকটা মাধবীলতার কোমরে চুরুটটা চেপে ধরেছে। কিন্তু আর্তনাদ যন্ত্রণার হলেও মাধবীলতার গলা অনিমেষকে কাঁপিয়ে দিল, তুমি কিছু বলল না গো, আমার জন্যে তুমি ছোট হয়ো না–আঃ আ–!

অনিমেষ মুখ বন্ধ করার আগে একদলা থুতু মাটিতে ফেলল। পেছনের লোকটা তখুনি একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে সজোরে ওর মাথায় আঘাত করল, সামনে তাকাও, চোখ বন্ধ করলে মুশকিলে পড়বে।

অফিসার এবার এগিয়ে এল ওর দিকে, থুতু ফেলা হচ্ছে? এখনও বিষদাঁত ভাঙ্গেনি না! শেষবার বলছি, কথা বলুন। আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না আপনাদের আর কোন চান্সই নেই। আন্দোলন ফান্দোলন দেওয়ালে শুরু হয়ে সেখানেই থেমে গেছে। সাধারণ মানুষ চাইছে না আপনাদের, সবাই বুঝে গেছে এটা সি আই এ-র টাকায় একরকমের ধান্দাবাজী। আপনাকে আমি স্বচ্ছন্দে মেরে ফেলতে পারি, কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। নাউ ডিসাইড!

অনিমেষ কথা বলল না, কথা বলার শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সে চোখ খুলে রাখতে বাধ্য হচ্ছিল কিন্তু দৃষ্টি এখন প্রায় সাদা। মাঝে মাঝে মাধবীলতার শরীর যীশুখ্রীষ্টের আদল নিচ্ছে, নিয়েই আবার ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

অফিসারের গলা কানে এল, দেখুন, এই ভদ্রলোক আপনাকে ভালবাসেন না। আপনার শরীরে সন্তান এনে দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। সামান্য একটা কথা বলে দিলে আপনাকে আমরা ছেড়ে দেব জেনেও উনি মুখ বন্ধ করে আছেন। তার মানে, আপনার কি এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, আমরা ওপরের দড়ি গুটিয়ে নিচ্ছি। তা নিলে আপনার শরীর মাটি ছেড়ে ওপরে উঠে যাবে, এই রকম শরীরে সেটা বেশ ডেঞ্জারাস হবে, আস। ইনি যদি আপনার সন্তানের বাবা হন তা হলে তার জন্ম হলে স্বাধীন ভারতবর্ষের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।

মাধবীলতা কোন কথা বলল না। কথাগুলো অনিমেষের মাথায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ঢুকে একসময় জোড়া লাগতেই সে চিৎকার করে উঠল। শেষবার সব বাঁধন ছিঁড়ে সে মাধবীলতার কাছে পৌঁছবার জন্যে মরিয়া হল। কিন্তু এক পাও নড়তে পারল না সে। কিন্তু পেছনের লোকটির অসহিষ্ণু হাত তার চেতনাকে মুছিয়ে দিল। তলিয়ে যাওয়ার আগে অফিসারটির আক্ষেপ শুনতে পেল সে, আঃ, এ সময় তোমাকে মারতে কে বলল? ও অজ্ঞান হয়ে থাকলে আজ আর কোন কাজ হবে!

জেলখানায় অনিমেষের সঙ্গে মাধবীলতাকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মাধবীলতা যে এসেছে তা অনিমেষের জানার কথা নয়। কিন্তু এখন পশ্চিমবাংলার জেলগুলো নকশাল ছেলেতে ভরে গেছে। সবার বিরুদ্ধে এক রকমের অভিযোগ নয় এবং সবাই এক ধরনের ব্যবহার পায় না। ফলে বাইরের খবর ভেতরে আসছিল নানান পথে। অনিমেষ জানল, মাধবীলতা তিন চার দিন এসে ফিরে গেছে। আত্মীয় বন্ধুরা দেখা করতে এলে নির্দিষ্ট দিনে কয়েদীদের একটি বিশেষ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় সাক্ষাৎকার ঘটে। মুখোমুখি নয়, এই জেলে একটা জালের আড়াল রাখা হয়। পুলিশ বসে থাকে সামনে। তবে বিশেষ কয়েকজনের ক্ষেত্রে এই অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনিমেষ তাদের একজন।
 
ক্রমশ এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে পড়ছে অনিমেষ। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না। মাধবীলতা এসেছিল এই খবর পেয়ে তার এক ধরনের উত্তেজনা হয়েছিল। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল ওকে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের কথা ভেবে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অনেক হল মেয়েটার ওপর আর বোঝা চাপাতে চায় না সে। মাধবীলতা দেখা করতে এসেছিল মানে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। বুকের ভেতর একটা জানার বাসনা তীব্র হয়, মাধবীলতার সন্তান সুস্থভাবে হয়েছে কি? হলে তাকে নিয়ে সে কোথায় আছে? কেমন আছে? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরাধবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার কোন অধিকার নেই এসব জানতে চাওয়ার। সে এই জীবনে কোনদিন মেয়েটাকে আশ্রয় দিতে পারবে না যখন তখন! চুপচাপ শুয়ে বসে দিন কাটে অনিমেষের ছোট্ট সেলে। তার সঙ্গী ওরা খুব সুন্দর নির্বাচন করেছে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ত ছেলেটি। সুন্দর চেহারা। কিন্তু কথা বলতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। খাবার খাইয়ে দিতে হয়। পুলিশ ওর শরীর থেকে সমস্ত কেড়ে নিয়েছে। এই ঘরের দেওয়াল ছাদ দরজার মতই ছেলেটির অস্তিত্ব তার কাছে। এ বরং ভাল। এরকম কাঠের মানুষ বলেই তাকে বিরক্ত হতে হয় না। সপ্তাহে একদিন ওর মা আসেন। তখন একে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় সাক্ষাতের জন্যে। ভদ্রমহিলা কাঁদেন আর ছেলেকে খাওয়ান। ছেলে কিছু টের পায় না–কাঠের পুতুলের যেমন বোধশক্তি থাকে না।

অনিমেষের কথা জেলের সবাই জেনে গেছে। বস্তুত ওদের সেলটা এখন এই জেলের বন্দীদের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশী অত্যাচারের পরিণাম হিসেবে এই সেলের দুজন বন্দী সম্পর্কে অনেকেরই মমতা। একজন পৃথিবীতে থেকেও চিরকালের জন্যে মুছে গেছে আর একজনের মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কোমরের তলা থেকে শরীরের বাকী অংশ আর কাজ করছে না। মুখে একরাশ দাড়ি, চুল খোঁচা খোঁচা, দুহাতে ভর করে লেংচে লেংচে এগোতে হয়। ক্রমশ পা দুটো সরু হয়ে আসছে। জেলাখানায় ডাক্তার আছে কিন্তু চিকিৎসার তৎপরতা নেই। অনিমেষ বুঝতে পারে সে আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এর ওপর মাথায় এক ধরনের যন্ত্রণা মাঝে মাঝে তীব্র হয়ে উঠে। সেই অপারেশনের পর থেকেই এটা একটু একটু করে বাড়ছে। তখন চিন্তাশক্তি লন্ডভন্ড হয়ে যায় তার। এইভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। আত্মহত্যা করার কথা ভাবলে কি রকম কাপুরুষ মনে হয় নিজেকে। কিন্তু দুহাতের ওপর ভর করে ব্যাঙের মত থপ থপ করে মেঝে লাফিয়ে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত তাকে অবসাদ এনে দেয়। নিজের অর্ধেক শরীরটাকে টেনে আনার পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়ে সে। এর চেয়ে তার সঙ্গী ছেলেটির অবস্থায় যদি সে থাকত তা হলে অনেক ভাল হতো। সম্পূর্ণ বোধশক্তিহীন হলে পৃথিবীর কোন কষ্টই আর কষ্ট মনে হত না।

জেলখানায় বসে অনিমেষ খবর পেল মহাদেবদা নিহত হয়েছেন। উত্তর বাংলা থেকে কলকাতায় এসে বেলেঘাটার এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এ খবর ফাঁস হয়ে যায়। মাঝ রাতে পুলিশ তাঁকে বন্দী করে। খবরটা এই রকম, তাকে ভ্যানের মধ্যেই মেরে ফেলা হয়। আবার এও শোনা যাচ্ছে, গড়ের মাঠে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়। হতবুদ্ধি হয়ে তিনি যখন এগোচ্ছিলেন তখন পেছন থেকে গুলী করে তাকে মেরে ফেলা হল। বেশ দেরীতে পাওয়া খবর, কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারল মহাদেবদার মৃত্যুর জন্যেই পুলিশ তার ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।

এখনও নাকি পুলিশ বনাম নকশালদের সংঘর্ষ চলছে। ডেবরা, গোপীবল্লভপুর কিংবা বরানগর সিথির নাম শোনা যাচ্ছে। এসবই বিক্ষিপ্ত ঘটনা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ভারতবর্ষে তাদের পুলিশ হয় হত্যা করেছে নয় করছে। আর যারা এ তত্ত্বেও বিশ্বাসী নন তাদের বিভিন্ন জেলে ছুঁড়ে ফেলছে। এরকম ঘটনা ঘটা সত্ত্বে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রতি সপ্তাহে হিন্দী ছবি মুক্তি পাচ্ছে এবং লোকে তাই দেখার জন্যে স্বচ্ছন্দে লাইন দিচ্ছে।
 
অনিমেষ বুঝতে পারছে বিরাট ভুল হয়ে গেছে। নিজেদের প্রস্তুত না করে, দেশের মানুষকে সঙ্গী না করে শুধু মাত্র বুকভরা উত্তেজনা এবং বিদেশী শ্লোগানকে পাথেয় করে তারা সত্যিই হঠকারিতা করে ফেলেছে। সে এখনও মনে করে এদেশের কমুনিস্ট পার্টিগুলোর কাছ থেকে কোন কিছু আশা করার নেই। এই রাজনৈতিক কাঠামোয় তারা শুধু একটা লেবেলআঁটা পার্টিমাত্র। সেই দলে থেকে সে ঠিক কাজই করেছে। কিন্তু তার পাল্টা পথ বেছে নিয়ে তারা যেভাবে এগিয়েছিল সেটাও গোলকধাঁধার শেষ হল। প্রতিটি প্রদেশের মানুষের মানুসকতা জীবনযাত্রা এবং দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন। এদের প্রত্যেককে একটা সুতোয় বাঁধতে পারা আকাশকুসুম কল্পনা। এসব তথ্য নতুন নয়, আগেও জানা ছিল। কিন্তু উত্তেজনা মানুষকে অন্ধ করে। তখন মনে হয়েছিল প্রয়োজন বুঝতে পারলেই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাদের সঙ্গী হবে। ব্যর্থ তারাই, কারণ দেশের মানুষকে তারা বোঝাতে পারেনি। অবসাদ আর অবসাদ। নিজের শরীরের দিকে তাকালে অবসাদে আচ্ছন্ন হতে হয়, নিজের দেশের দিকে তাকালেও একই অবস্থা। অনিমেষের মাঝে মাঝে তাই মনে হচ্ছে তার সঙ্গে ভারতবর্ষের কোন পার্থক্য নেই। এইভাবে লেংচে লেংচে পাছা ঘষটানি দিয়ে চলছে দেশটা তাকে দাঁড় করবার কোন ওষুধ কারো জানা নেই, আবার এই মুহূর্তে সে মরবেও না। এই জেলের নকশালপন্থী ছেলেদের অনেকেই তার মতন বিমর্ষ। কিন্তু কেউ কেউ এখনও খুব সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা করে। তবে যত দিন যাচ্ছে তত ওরা ওকে এড়িয়ে থাকছে। তার শরীরের এই অবস্থায় সে যে কোন সাহায্যে আসতে পারবে না একথা ওরা বুঝেই তার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। তা ছাড়া নকশালবাড়িকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়েছিল তার ভুল ভ্রান্তিগুলো নিয়ে এরা আলোচনা করতে ইচ্ছক নয়।

মাসের পর মাস চুপচাপ চলে যাচ্ছে। খুব কম ছেলের নামে কোর্টে কেস উঠেছে। বেশিরভাগই থাকছে বিনা বিচারে। নাম পাল্টে পাল্টে স্বচ্ছন্দে রাখতে পারছে জেল কর্তৃপক্ষ। সেই প্রথম দিকে অনিমেষকে একবার কোর্টে তোলা হয়েছিল। কোন কথা বলতে দেওয়া হয়নি, সে সুযোগও ছিল না। আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশি কাউকে বিনাবিচারে আটক রাখার আইন নেই। কিন্তু এদেশে একটা আইন করলেই তার একশটা ফাঁক রাখা হয়। তাই একবার কোর্টের মুখ দেখে অনন্তকাল এখানে বাস করতে হতে পারে।
 
তাছাড়া এ ব্যাপারে অনিমেষের নিজস্ব কোন তাড়াহুড়ো নেই। এই সেল থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যাবে? যে মুখ প্রথমেই মনে পড়ে তা মাধবীলতার। মাধবীলতার কথা ভাবলেই এখন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটা তীব্র অপরাধবোধ তাকে সারাক্ষণ বল্লমের মত খুঁচিয়ে মারে। সে অতীতের ঘটনাগুলোকে খুঁটিয়ে ভেবেছে অনকবার। য়ুনিভার্সিটিতে পড়তে মাধবীলতা কি দেখে তাকে ভালবেসেছিল? অনিমেষ কোন স্থির জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই জেনেও সে এক কথায় নিজের নিরাপদ। আবাস ছেড়ে হোস্টেলে উঠে এল। অনিমেষ যখন প্রতিদিন ঘটনার আবর্তে পাক খাচ্ছে তখন মাধবীলতা স্থির হয়ে তার অপেক্ষায় ছিল। সামনে কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই, অতীতটাকে নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে এভাবে থাকতে মেয়েরাই পারে। শান্তিনিকেতনের সেই রাতে অনিমেষ কি একটুও সংযত হতে পারত না? চিরকালের জন্য মাধবীলতাকে সে অগ্নিকুন্ডে ঠেলে দিল! এবং সবশেষে অনিমেষের কাছ থেকে খবর আদায় করতে পুলিশ সেই মাধবীলতার ওপরই অত্যাচার করেছে কিন্তু মাধবীলতা মুখ খোলেনি। ভালবাসা হয় সমানে সমানে। কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারছিল সে প্রতিটি স্তরে মাধবীলতার কাছে হেরে যাচ্ছে। এখন একটা দীর্ঘ দৌড় প্রতিযোগিতায় মাধবীলতা তাকে ছাড়িয়ে এত দূরে এগিয়ে গেছে যে তার পক্ষে আর ওকে ধরা সম্ভব নয়। মাধবীলতার কোন খবর সে এখন জানে না। স্কুলের চাকরি আছে কিনা, সন্তান স্বচ্ছন্দে ভূমিষ্ঠ হয়েছে কিনা, তাকে নিয়ে সে এখন কোথায় আছে, কিভাবে আছে তা জানতে পারছে না সে। এই সামাজিক ব্যবস্থায় একটি কুমারী মেয়ে হঠাৎ মা হয়ে গেছে এই খবর সবাই কিভাবে নেবে তা জানা কথা। অনিমেষ সারা পৃথিবীর সামনে চিৎকার করে বলতে পারে যে মাধবীলতা তার স্ত্রী। কিন্তু যতক্ষণ না তাকে আইনের ছাপ পড়ছে ততক্ষণ মাধবীলতা কি করে লড়াই করছে। আর একটা চিন্তা আজকাল অনিমেষকে উত্তেজিত করছে। সে বাবা হয়ে গেল! তার রক্তের সৃষ্টি এখন পৃথিবীর বুকে। সে ছেলে কি মেয়ে তা জানা নেই এবং সে সুস্থভাবে জন্মেছিল কিনা তাও অজানা কিন্তু মায়ের পেট থেকে সে নিশ্চয়ই অনুভব করেছে তার বাবার জন্যে তার মাকে কিভাবে অপমানিত হতে হয়েছে। এতটা দায় যে মেয়ে মুখ বুজে বয়ে চলেছে আজ জেল থেকে বেরিয়ে বাকী জীবনটার পাথর তার ওপর চাপিয়ে তাকে মেরে ফেলতে চায় না অনিমেষ। সেই কারণে তার কোন হাড়াহুড়ো নেই এখান থেকে বের হবার। জলপাইগুড়িতে গিয়ে বাবা এবং ছোট মায়ের সামনে এই অবস্থায় যাওয়ার কোন প্রশ্ন ওঠে না। বাবা বিলাপ করবেন। তাঁর সব আশা নির্মূল করে যে ছেলে নকশাল হয়েছে তাকে হয়তো তিনি ভৎর্সনা করতে পারেন কিন্তু তাকে সেই কারণে পঙ্গু দেখলে তার আক্ষেপ অসহনীয় হয়ে উঠবে। না, নিজের দায় কারো ওপর চাপিয়ে দেবে না সে। কিন্তু এরা যদি তাকে ছেড়ে দেয়, যদিও সে সম্ভাবনা নেই, তবু তা হলে সে কোথায় যাবে?

জেলে বসে অনিমেষ টের পায়নি কিছু। একদিন আচমকা চারধারে পাগলাঘন্টি বাজতে লাগল। অনিমেষ শুয়েছিল। শব্দ শুনে কোনরকমে হামা দিয়ে দিয়ে সে দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। বাইরে মানুষ পাগলের মত ছুটছে। বোমা পড়ছে ওপাশে। ছেলেরা দৌড়াচ্ছে গেটের দিকে। এখান থেকে সামনের পুকুরটা দেখা যায়। অনিমেষ দেখল তিন চারটে পুলিশ দৌড়ে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিল। তারপর ডুব দিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে হাস্যকর ভাবে। মৃত্যুভয় এখন ওদের চোখে মুখে। অনিমেষের মাথায় একটা চিন্তা চলকে উঠল। তা হলে কি বিপ্লব শুরু হয়ে গেল? জেল ভেঙ্গে বন্দীদের উদ্ধার করা হচ্ছে? ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। বাইরে তখন চেঁচামেচি, সবাই অকস্মাৎ ছাড়া পাওয়ার রাস্তাটা যেন আবিষ্কার করে ফেলেছে। অনিমেষ চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল সামনে যে যাচ্ছে তাকেই। ওদের সেলে তালা দেওয়া থাকে না, বোধহয় পঙ্গু বলেই তালা খরচ করতে চায় না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাইরে থেকে আটকানো থাকে দরজাটা। অনিমেষের ডাক কারো কানে যাচ্ছে না। অথচ এই রকম একটা মহান সময়ে সে যোগ দিতে পারছে না এই কষ্ট অনিমেষকে পাগল করে তুলছিল। বারংবার দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সে। নিজের শরীরের কথা এই মুহূর্তে তার মাথায় ছিল না, তাকে ছেড়ে দিলে ওই গেট অবধি পৌঁছতে হয়তো তার এক ঘণ্টা লেগে যেতে পারে–এই বোধ কাজ করছিল না।


হঠাৎ গুলীর শব্দ কানে এল। পর পর কয়েক রাউন্ড এবং খুবই কাছে। কয়েকটা আর্তচিৎকার শোনা গেল। এবং আচমকা বাইরের ছুটোছুটি থেমে গেল। যারা রাস্তা পার হতে পারেনি তারা যেন কে আগে সেলে পৌঁছাতে পারবে এইভাবে ফিরে আসতে লাগল। এখন আর বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু গুলী চলছে মাঝে মাঝে। তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল। একটুও আওয়াজ নেই কোথাও। পুকুরে যে পুলিশগুলো ডুবছিল আর ভাসছিল তারা ক্রমশ মাটিতে উঠে এল য়ুনিফর্ম সম্পূর্ণ সিক্ত কিন্তু হঠাৎ তাদের চেহারা যেন পাল্টে গেল। প্রচণ্ড ক্রোধে তারা ছুটে গেল অফিস ঘরের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সামনের লনটা পুলিশে ছেয়ে গেল।

দরজায় সেঁটে থাকা অনিমেষ ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ল। না, এটা কোন বিপ্লব নয়, বিক্ষিপ্তভাবে জেল ভেঙ্গে পালাতে চাইছিল কিছু ছেলে। কিন্তু কোথায় পালাতে চাইছিল? এই জেলের বাইরে যে ভারতবর্ষ সেটা কি এই জেলের চেয়ে নিরাপদ! সেখানে কি ওদের কেউ চিরকাল আশ্রয় দেবে? সারা দেশ যেখানে শীতল হয়ে রয়েছে সেখানে কয়েকটা কাঠকয়লার আগুনের কী মূল্য আছে!

এখন সেলে চিৎকার চলছে। পুলিশরা দল বেঁধে প্রতিটি সেলে ঢুকে বদলা নিচ্ছে। বন্দীদের যন্ত্রণায় এখন জেলের প্রতিটি দেওয়াল কাঁপছে। সামনের বারান্দায় বুটের শব্দ হল। তিনজন এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। একজন বলল, না, এরা বের হয়নি। তা ছাড়া একজন ফিজিক্যালি হ্যান্ডিকাপড আর একজন পাগল।

দ্বিতীয়জন থুতু ফেলল, সো হোয়াট? এরা সব এক রক্তের। আজ কাউকে স্পেয়ার করব না। শব্দ করে দরজা খুলে গেল। দরজা খুললেই অনিমেষের সঙ্গী, হাঁ করে খাওয়ার অভ্যেসটুকু তার হয়েছে। কুঁকড়ে পড়ে থাকা অনিমেষ দেখল একটা লাঠি ছেলেটিকে নির্মম ভাবে আঘাত করল। অন্য দুটো তার দিকে এগিয়ে আসছে।
 
সেদিন যারা গা ঢাকা দিতে পেরেছিল তারা খুব সামান্য সময়ের জন্যেই মুক্তির আনন্দ পেয়েছিল। আনন্দ শব্দটা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে অনিমেষের দ্বিধা আছে। সব সময় পুলিশের ছায়া পেছনে ঘুরছে, প্রতি মুহূর্তে দুশ্চিন্তায় কাটা হয়ে থাকতে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে–এই রকম পরিস্থিতিতে কি জেলের বাইরের খোলা আকাশ আনন্দের হয়! যারা ধরা পড়ছে এবং জেলে ফেরত আসছে তাদের অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু যারা জেলেই পড়েছিল তাদের ওপর আক্রোশ মিটিয়ে নিয়েছে পুলিশ।

অনিমেষের পাশে দীর্ঘসময় পড়েছিল ছেলেটি। তার পশ্চাদ্দেশ রক্তাক্ত। মোটা রুল সেখানে প্রবশে করিয়ে শাস্তি দিয়ে গেছে ওরা ছেলেটিকে। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল ছেলেটি। কাটা ছাগলের মত ছটফট করেছিল, কিন্তু সামান্য বাধা দেবার মত মানসিকতা ছিল না ওর। এমনকি এতবড় আঘাত যে ও তারপরে টের পাচ্ছিল বলে মনে হল না অনিমেষের। একটা গাছও বোধহয় ওর চেয়ে বেশি অনুভূতিশীল হয়ে থাকে।

পঙ্গু বলে হয়তো অনিমেষের ওপর ওই বীভৎস আক্রমণটি করেনি। কিন্তু বেধড়ক পিটিয়ে গেছে ওরা ওকে। কপালের আঘাত ফুলে চোখ ঢেকে দিয়েছে একটা দাঁত থুতুর রঙ পালটে বেরিয়ে এসেছিল। ওরা চলে গেলে অনিমেষ অনেক্ষণ চুপচাপ পড়েছিল। তারপর মুখের রক্ত মুছে ছেলেটিকে দেখল। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অর্ধ নগ্ন শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে। দুহাতে হামা দিয়ে অনিমেষ ছেলেটির পাশে গিয়ে গায়ে হাত রাখল, এই, এই যে, শুনছ–।

এই ঘরে ওরা যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিন থেকেই অনিমেষ জানে ওর সঙ্গে কথা বলে কোন লাভ হবে না। একটা মানুষের চোখের দৃষ্টি সাদা হয়ে যায় এমন করে তা সে কখনও জানত না। এই ঘরে পায়খানা করে ফেললে রোজ দরজায় বসে অনিশেষকে চিৎকার করে পাহারাদারদের নজর কাড়তে হয় কিন্তু তবু আজ ওর আঘাত দেখে না ডেকে পারল না। ছেলেটির কাপুনি কমছিল না।

অনিমেষ ওর পাজামা টেনেটুনে ভদ্রস্থ করে চুপচাপ বসে থাকল।

কী হল? হয় পঙ্গু নয় শরীর থেকে বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ উধাও হয়ে ক্লীবের মত বেঁচে থাকা–জীবনের এই পরিণতি শেষ পর্যন্ত? এমন যদি হতো বিপ্লবের চূড়ায় পৌঁছাতে ওরা সিঁড়ির কাজ করেছে, পরের মানুষেরা সেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর কর উঠে যাবে তাহলে নিজেদের এতটা অসাড় বলে মনে হত না। পুলিশ–খুনের চেষ্টার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে কোন খবর তার কাছে নেই। এর মধ্যে একজন এসে জানতে চেয়েছিল সে কোন উকিলের সাহায্য চায় কি না। অনিমেষ পরিষ্কার না বলেছে। নিজের কথা তার চেয়ে কোন উকিল ভাল করে বলতে পারবে না। প্রথম দিকে সে একটা উত্তেজনায় ভুগতো। কাঠগড়ায় যদি তাকে বিচারক জিজ্ঞাসা করেন সে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেবে। এই বিচারব্যবস্থার সুস্থতা সম্পর্কে সে স্পষ্ট অভিযোগ জানাবে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত এই উত্তেজনাকে তার ছেলেমানুষী মনে হচ্ছে। ধরা যাক, সরকারি উকিলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে সে মুক্তি পেল। তখন সে কোথায় যাবে? বাকী জীবনটা সে কী ভাবে কাটাবে? তার চেয়ে এই ভাল। কোনরকম পাল্টা জবাব সে দেবে না। যদি তার যাবজ্জীবন জেল হয় এখন সেটাই তার পক্ষে মঙ্গল। এইরকম বিষাদে সে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছিল। শারীরিক অক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের মানসিক ক্লীবতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। মাছে মাঝেই তার মাথায় অন্যসব চিন্তা আসতে লাগল। কোর্ট পুলিশ তার কেস তুলছে না। ঠিক যে ভাবে ওর সঙ্গী ছেলেটিকে ফেলে রাখা হয়েছে ওকেও যেন ওরা তেমনি দেখছে। নিজেকে এইরকম ছেঁড়া কাগজের মত দেখতে যখন অসহ্য লাগে তখনই মরে যাওয়ার কথা মনে হয়। এই ঘরে বাস করে আত্মহত্যা করার আপাতত কোন সুযোগ নেই। গলায় দড়ি কিংবা বিষ খাওয়ার কোন উপায় নেই। আত্মহত্যার কথা মনে হলেই যার মুখ চোখের সামনে ভাসে তাকে অনেক কষ্ট করে মন থেকে সরাতে চাইতে সে। সেই মুখ যেন ভার হয়ে বলে, ছিঃ! তুমি তো এত দুর্বল নও অনিমেষ।
 
তখনই হো হো করে হেসে ওঠে অনিমেষ জেলের ঘরে বসে। শেষের দিকে হাসিটা ভেঙ্গে যায়। গলা বন্ধ হয়ে যায়। দুর্বল কাকে বলে? যে লড়তে পারে না, যার সর্বস্ব কেড়ে নিলেও প্রতিবাদের সামান্য ক্ষমতা যে ধরে না সে কি দুর্বল নয়! এইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে যাকে হাঁটতে হয় তার বল কোথায়? এমনকি আত্মহত্যা করার মত শক্তিও তার নেই। এই সব ভাবনা মাথায় এলেই সে ছটফট করে। মনে হয় ক্রমশ উন্মাদ হয়ে যাবে। একদম বোধশূন্য হয়ে যাওয়া বরং ভাল। পৃথিবী সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে না তাহলে। কিন্তু তা হচ্ছে না যখন তখন অনিমেষ কি করত সে জানে না যদি পাশের ছেলেটি এরকম আহত না হত।

একটু একটু করে ছেলেটি ওর ওপর নির্ভর করতে শিখল। ওর সঙ্গে কথা বলে অনিমেষের সময় কেটে যায়। এ এক মজার খেলা। অনিমেষ কথা বলতে শুরু করলে ছেলেটি চুপচাপ ওর দিকে চোখ মেলে বসে থাকে। যতক্ষণ না অনিমেষের মুখ বন্ধ হচ্ছে ততক্ষণ দৃষ্টি সরায় না সে। ক্রমশ এ এক নতুন খেলা হয়ে দাঁড়াল। সময় কাটানোর সমস্যা আর নেই। নিজের কথা, যা করার উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু করা হল না সেই সব কথা ছেলেটিকে বলত অনিমেষ। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করত সে। একটা রক্ত-মাংসের মানুষ তার কথা শুনছে। ছেলেটির কোন প্রতিক্রিয়া হতো না, তবু মানুষ তো! এইরকম একদিন কথা বলতে বলতে হেসে ফেলল অনিমেষ। এই ছেলেটি যেন গোটা ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হয়ে তার সামনে বসে রয়েছে। যে যাই বলুক, যার কোন কিছুতেই এসে যায় না।

জেলে বসে সময়ের হিসেব রাখা মুশকিল। মাঝে মাঝে অনিমেষেরই হিসেব গুলিয়ে যায় ঠিক কত বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে জেলের এক কর্তা এসে অনিমেষকে বলেছিল, মুক্তি পেলে কোথায় যাবেন?

মুক্তি, পাচ্ছি নাকি?

বলা যায় না, যা তোড়জোড় চলছে, পেলেও পেতে পারেন।

অনিমেষ লোকটির দিকে তাকাল। শুধু পোশাক একটা মানুষের চেহারা পালটে দেয়। এই কয় বছরে এই লোকটি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে না। লোকটি আবার বলল, এখন কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে করতে পারেন। তেমন ইচ্ছে থাকলে আপনি তাদের চিঠিতে জানিয়ে দিন।

কি হবে দেখা করে?

সেটা আলাদা কথা। কিন্তু আপনার এই শারীরিক অবস্থায় জেলের বাইরে যাতে বিপদে না পড়েন তার জন্যেই যোগাযোগ করা দরকার।

আমি কারো দায় হতে চাই না।

প্রতিবন্ধীদের জন্যে একটা আশ্রম আছে এখানে নানা হাতের কাজ শেখানো হয় তাদের জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে। সেখানে যাবেন?

হেসে ফেলল নিমেষ, বাঃ চমৎকার। একটু দেখুন না আমার জন্যে।

সরকার পালটে গেছে এর মধ্যে অনিমেষ জানল ভারতবর্ষ এখন চুপচাপ, শান্ত। কোন শোক নেই কিংবা আফসোস। কোথাও আনাচে কানাচে যারা একদা স্বপ্ন দেখত তারা বেঁচে মরে আছে অথবা তাদের অস্তিত্ব আর তেমন জোরদার নয়। পশ্চিমবাংলার মানুষ বিপুল ভোটে বামপন্থীদের নির্বাচিত করেছে। নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের ওপর দেশের মানুষ তাদের আস্থা জানিয়েছে। অনিমেষেদের প্রচার এবং বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে এখন আর কেউ ভাবে না। জেলের ভেতরে যারা গোপনে গোপনে এখনও আশা রাখতো তারা ভেঙ্গে পড়ল।

অনিমেষের কিন্তু এই খবরে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। তবে নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিলে সে একটা নাম দেখে ঈষৎ চমকে উঠেছিল। পরে হেসে ফেলেছিল শব্দ করে। সুদীপ মন্ত্রিসভায় একটি ভাল জায়গা পেয়েছে। বিমান নয়, য়ুনিভার্সিটির ছাত্র ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারীর থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে সুদীপ চুরুট মুখে পশ্চিম বাংলার মন্ত্রী হয়ে বসেছে। অনিমেষের মনে পড়ল, সুদীপের মধ্যে একটা পরিকল্পিত ভাবনা সব সময় কাজ করত। কিসে বেশি লাভ হয় কিংবা কোন ঘটনা বেশি প্রচার এনে দেবে এ ব্যাপারে য়ুনিভার্সিটিতে সে বিমানের থেকেও সজাগ ছিল।
 
হঠাৎ জেলের মধ্যে একটা উৎসবের মেজাজ এসে গেল! নতুন সরকার নাকি রাজনৈতিক ভাবে নকশাল বন্দীদের মোকাবিলা করবেন। বাইরে এখন বন্দীমুক্তি আন্দোলন চলছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছু কিছু নকশালপন্থীদের যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিংবা এদের মেরুদণ্ডটি ভেঙ্গে দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আর জেলে রাখার দরকার নেই। কীভাবে কখন মুক্তি দেওয়া হবে। তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। আদালতে যে সব মামলা চলছিল তা সরকারপক্ষ তুলে নেবার সিদ্ধান্ত করলেন। সরকারের এই উদারতায় নানান মহলে নানান প্রতিক্রিয়া হলেও বন্দীরা স্বাভাবিকভাবে খুশি হল।

এর মধ্যে জেলের সেই কর্তাব্যক্তি অনিমেষের কাছে এসেছিলেন। ভদ্রলোক যে কেন অনিমেষকে পছন্দ করছেন তা সে বুঝতে পারে না। এসে বললেন, ব্যস, হয়ে গেল। আপনাদের জেলবাস পর্ব সমাপ্ত।

অনিমেষ হেসে বলল, কোন মানে হয় না। ধরলোই বা কেন আর ছাড়ছেই বা কেন?

আপনাকে দুটো খবর দিতে। এক ভদ্রমহিলা প্রায়ই আসছেন আপনার খবরাখবর নিতে। আপনি কারো সঙ্গে দেখা করতে চান না জেনেও তিনি বিরক্ত হননি। গতকাল এসে জানতে চাইছিলেন যে আপনি কবে মুক্ত পাবেন।

আপনি কী বললেন? শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ।

আমাদের কাছে কোন সঠিক খবর আসেনি। আমি সামনের সপ্তাহে ওঁকে আবার খবর নিতে বললাম। তারপর একটু হেসে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে জিজ্ঞাসা করছি, উনি আপনার কে হন?

অনিমেষ মথা নাড়ল, ছেড়ে দিন এসব কথা। আর একটা খবর কি যেন বলছিলেন? আর কেউ আমার খবর নিতে আসছে নাকি?

ভদ্রলোক বললেন, না, না। আর কেউ আসেনি। আমি একজনের আন্তরিক ধন্যবাদ এবং আশীর্বাদ আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

কার কথা বলছেন?

দীপকের মা।

দীপক অনিমেষ অবাক হয়ে ডান দিকে তাকাল। এই ছেলেটির নাম যে দীপক তা ওর মনেই ছিল না। এখনও দীপকের মা প্রতি সপ্তাহে আসেন। ওকে তখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। মহিলা ছেলেকে খাইয়ে যান কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু তিনি কোন কারণে তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন? এই বোধবুদ্ধিহীন ছেলেটি একটি নামের অধিকারী তা-ই খেয়াল ছিল না অনিমেষের।

ভদ্রলোক বললেন, আপনার কথা ওঁকে আমি বলেছি। আপনারা এক ঘরে থাকেন এবং আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেন ওর সাড়া না পেয়েও। একমাত্র আপনি যখন কথা বলেন তখন ওর দৃষ্টি খানিকটা স্বচ্ছন্দ হয়। এসব শুনে মহিলা আপনার কথা জানতে চাইছিলেন। শোনার পর আপনার সঙ্গে কথা বলতি তিনি আগ্রহী। যখন জানলেন যে আপনি কারো সঙ্গে দেখা করতে চান না তখন আমাকে ওই কথাগুলো জানাতে বললেন।

অনিমেষ হাসল। এ ছাড়া সে আর কি করতে পারে। তার নিজের শরীরের যা অবস্থা তাতে একথা স্পষ্ট যে সে কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এই অবস্থায় ছেলেটির কোন উপকারেই সে আসতে পারে না। কথা বলছে নিজের প্রয়োজনে। একা মুখ বন্ধ করে থাকলে সে এতদিন পাগল হয়ে যেত।

কিন্তু তার পরের দিনই যে এমন চমক ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে কল্পনাতেও আসেনি তার। দুজন সিপাই সাতসকালে ওদের সেল থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে। অনিমেষকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। দুটা পা ঝুলে পড়েছে। সঙ্গী ছেলেটি, যার নাম দীপক, হাঁটছিল উদাস পায়ে।
 
অফিস ঘরে বসার পর ওদের খবরটা জানানো হল। সরকার দয়াপরবশত ওদের বিরুদ্ধে আনীত সব রকম অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। এবং সেই সঙ্গে আশা করছেন ভারতবর্ষের দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে তারা বাকী জীবনটা কাটাবে।

মুক্তি! খবরটা শুনে অনিমেষের একটুও উত্তেজনা হল না। এই মুক্তি নিয়ে কি হবে! এতদিন মনে মনে এই দিনটির আশংকা করেছিল সে। এখন সে কী করবে? চোখ বন্ধ করল অনিমেষ। এভাবে সে মুক্তি চায়নি কখনো। দীপকেরও এই খবরে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। আর হাজারটা শব্দের মত মুক্তি শব্দটার আলাদা কোন মানে নেই ওর কাছে। শূন্যদৃষ্টি মেলে সে দাঁড়িয়ে রইল অনিমেষের গা ঘেঁষে। এই জিনিসটি সম্প্রতি ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় কোন মানুষ এলে তার অস্তিস্ত বোধহয় অনুভব করে দীপক। কারণ সেই সময় সে অনিমেষের কাছচাড়া হতে চায় না। ব্যাপারটা ওর পরিবারের লোকের জানা দরকার। দীপকের চেতনা ফিরে আসবার একটা সূত্র হিসেবে এটাকে ডাক্তাররা কাজে লাগাতে পারেন।

কাগজপত্রে যখন তাদের মুক্তির ব্যাপারটা আইনসম্মত করা হচ্ছিল তখন সেই ভদ্রলোক এলেন, আপনি কোথায় যাবেন কিছু ঠিক করেছেন?

না।

কিন্তু কোথাও তো যেতে হবে। দেখি।

এখান থেকে বের হয়ে তারপর ভাবব।

বুঝলাম। কিন্তু আপনি তো একজন সুস্থ মানুষের মত ঘুরে বেড়িয়ে ভাবতে পারবেন না। আমি আপনার হয়ে সেই আশ্রমে খোঁজ নিয়েছিলাম।

কোন আশ্রমে?

প্রতিবন্ধীদের। আপনাকে বলেছিলাম।

ও হ্যাঁ, সেখানে যাওয়া যাবে?

যাবে। কিন্তু এই মাসটা আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।

এই মাসটা!

হ্যাঁ, আর মাত্র আট দিন আছে মাস শেষ হতে। এই কদিন আপনি যদি দীপকের সঙ্গে থাকেন তাহলে ওর মা খুব খুশি হবেন।

দীপকের সঙ্গে? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। দীপকের সঙ্গে তার থাকার কথা ওঠে কি করে? সামান্য পরিচয় যেখানে নেই। সে ঘাড় নাড়ল, না, তা হয় না।

ভদ্রলোক কাঁধ ঝাঁকালেন, বেশ যা ভাল বোঝেন করবেন। আমি আশ্রমের ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু দীপকের মাকে এড়াতে পারল না অনিমেষ। এক একজন বয়স্ক মহিলা আছেন যাদের চেহারা এবং কথায় এমন এক স্নেহময়ী জননী-জননী ভাব থাকে যে তাদের মুখের ওপর কটু কথা বলা যায় না। দীপকের মা সেই রকম একজন। তিনি ওর হাত ধরে বললেন, বাবা, আমি জানি তোমরা খুব অভিমানী হও। কিন্তু আমার দিকে তাকাও। যে ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল আর যাকে নিয়ে আমি আজ বাড়ি ফিরছি সে তো এক নয়। আমার তো পৃথিবীতে কেউ কেউ, আমি কি নিয়ে থাকবো?

অনিমেষ জবাব দিল না। মহিলা তখনও ওর হাত ছাড়েননি। বললেন, আমি সব শুনেছি। তুমি না থাকলে আমার ছেলে মরে যেত।

না, এটা সত্য নয়। আপনাকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে।

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, পৃথিবীর সব চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও মায়ের চোখকে কিছুতেই দিতে পারবে না। আমি এতদিন ধরে ওকে দেখতে আসছি, ও আমাকে একদিনও চিনতে পারেনি। কেঁদে ফেললেন উনি। কিছুটা সময় লাগল সামলাতে, তারপর অন্যরকম গলায় বললেন, কিন্তু তোমার পাশে কেমন সিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখো।

অনিমেষ হাসল, এটা একসঙ্গে থাকার অভ্যেস থেকে হয়েছে।

ভদ্রলোক বললেন, যাই হোক, ও তো একটা পাথর হয়েছিল, এটুকু কম কি?

অনিমেষ বলল, দীপক ভাল হয়ে যাবে। কথাটা বলেই কেমন যেন অন্তঃসার শূন্য মনে হল। ভদ্রমহিলা সে কথায় কান দিলেন না মোটেই।

বললেন, তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top