What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

সামনে পেছনে কোন গাড়ি নেই। যেন ওদের জিপটা একাই অন্ধকার সাঁতরে চলছে। কিন্তু হঠাৎ জিপটা নড়ে উঠল বেয়াদপভাবে। রাস্তার একপাশে জিপটাকে কোনরকমে দাঁড় করিয়ে সিরিল লাফিয়ে নামল। তারপর ঘুরে এসে বিষণ্ণ গলায় জানালো, তেল নেই।

অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। এইটুক আসতেই তেল যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে সে কিভাবে জলপাইগুড়ি যেত? ওরা জিপ থেকে নেমে এল। গাঢ় অন্ধকারেও আকাশের রঙ পরিষ্কার থাকে। তার নিজস্ব আলোয় মানুষ অভ্যস্ত হলে পরস্পরের মুখ বোঝা যায়। অনিমেষ সিরিলকে জিজ্ঞাসা করল, এদিকে কোন পাম্প নেই?

জানি না।

মহাদেবদা বললেন, থাকলেও সেখানে যাওয়া সেফ হবে না। ফুন্টশিলং এখান থেকে কতদূর?

দেখা গেল সঠিক আন্দাজ কারো নেই। তবু যেটুকু আঁচ করা যায় তাতে এখন হাঁটা শুরু করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

মহাদেবদা বললেন, জিপটার কি গতি হবে? এটা এখানে থাকলে পুলিশ আমাদে হদিস জেনে যাবে।

কথাটা শোনা মাত্র অনিমেষ স্থির হল। করুণাসিন্ধুর জ্ঞান ফিরে আসতে নিশ্চয়ই দেরী হবে না। আর তারপরেই সে পুলিশের মন পাওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগবে। এই রাত্রেই পুলিশ যদি বেরিয়ে পড়ে তাহলে হদিস পেতে দেরী হবে না। কথাটা মাথায় আসামাত্রই দূরে হেডলাইট দেখা গেল। ওরা আর জিপের কাছে না দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে রাস্তার পাশে গাছের আড়ালে চলে এল। দুধার আলোয় ভাসাতে ভাসাতে একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটা বেশ স্পীডে খানিক এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। তারপর হেড লাইট জ্বালা অবস্থায় ব্যাক করে এল ওদের জিপটার কাছে।

রাস্তা থেকে বেশি দূরে না থাকায় স্পষ্ট গলা কানে এল, জিপটা এভাবে পড়ে আছে কেন?

বোধহয় খারাপ হয়ে আছে।

কিন্তু এখানে খারপ হবে কেন? নাম্বারটা আমার চেনা। নেমে দ্যাখো তো কি ব্যাপার!

খারাপ হয়েছে স্যার, নাহলে লোক থাকত।

দূর, যা বলছি তাই করো। এটা কন্ট্রাক্টরবাবুর জিপ।

বোঝা যাচ্ছে বেশ অনিচ্ছায় একটি লোক নেমে এল গাড়ি থেকে। অনিমেষ শক্ত হয়ে দাঁড়াল। গাড়িটা পুলিশের। এই রাত্রে এ পথে পুলিশের গাড়ি কেন এল তার মাথায় ঢুকছে না। অনিচ্ছুক লোকটা বাতিল জিপের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে বলল, কেউ নেই স্যার।

সে তো বুঝতেই পারছি, চাবি আছে?

হা স্যার আছে। বলে লোকটা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। তারপর ইঞ্জিনের বিকট একটা গোঙানি শোনা গেল। সেটাকে থামিয়ে লোকটা নিশ্চিন্ত-গলায় জানাল, তেল নেই বলে এখানে রেখে গেছে। গাড়ি অলরাইট।

তেল নেই। যারা এসেছিল তারা জানতো না তেল নেই?

বোধহয়। কিন্তু যাওয়ার সময় তো গাড়িটাকে দেখিনি!

তা ঠিক স্যার। তবে এ নিয়ে ভাববার কি আছে?

বাতিল জিপ থেকে লোকটা নেমে এসে নিজেদের গাড়ির দিকে এগোলে। কিন্তু অফিসার তাকে আবার ফিরিয়ে দিল, চাবিটা নিয়ে এস। তেল আনতে কেউ চাবি ফেলে গেছে বলে কখনও শুনিনি। সামথিং ফিশি ব্যাপার আছে। চলো গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। এদের গাড়ি থেকে চাবি খুলে নিয়ে লোকটা ফিরে যেতেই গাড়িটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল হাসিমারার দিকে।

আবার সব চুপচাপ, অন্ধকার আরো ঘন হয়ে নির্জনতা আনল। ওরা রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াল।

অনিমেষ বলল, আর ঘণ্টখানেক সময় পাওয়া যেতে পারে, তার মধ্যে এই এলাকা ছেড়ে যেতে হবে আমাদের।

সিরিল বলল, রাস্তা দিয়ে তো হাঁটা যাবে না।

মহাদেবদা বললেন, ওরা কিন্তু সহজেই বুঝবে আমরা ফুন্টশিলিং-এর গিয়েছি। যাদের জঙ্গলে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাদের স্টেটমেন্ট পেয়ে গেলে তো আর কোন কথা নেই। ফুন্টশিলিংটা এ্যাভয়েড করাই ভাল।

অনিমেষ একটু উত্তেজিত হল, ফুন্টশিলিং এ্যাভয়েড করবেন আবার এদিকে হাসিমারাতেও যাওয়া যাবে না। তাহলে?

মহাদেবদা হাসলেন, উত্তেজিত হয়ো না। ভেবে দ্যাখো, এই অবস্থায় হাসিমারাই আমাদের পক্ষে নিরাপদ। কারণ ওরা ভাববেই না যে ওদের নাকের ডগায় আমরা যেতে পারি।

হঠাৎ একট গোঁ গোঁ শব্দ কানে বাজল। পায়ের তলায় পথটা কাঁপছে। সিরিল হাত দিয়ে রাস্তাটা ছুঁয়ে বলল, ফুন্টশিলিং থেকে একটা গাড়ি আসছে।

মহাদেবদা বললেন, সাধারণ গাড়ি হলে লিফট চাওয়া যায় না?

সিরিল হাসল, এরকম ফাঁকা জায়গায় থামাবেই না।

অনিমেষ বলল, ওটাকে থামাতে হবে। দরকার হলে গায়ের জোরে ওই গাড়িতে উঠতে হবে।

মহাদেবদা বললেন, কিভাবে করবে? ওটা তো স্পীডে আসছে। হাত দেখালে থামবে?

সিরিল মাথা নাড়ল। তারপর অনিমেষকে বলল, মনে হচ্ছে লরি আসছে। কোনভাবেই থামাতে পারবে না। রাত্তিরে ওরা অচেনা লোককে ভয় পায়। তার চেয়ে চলুন হাঁটতে শুরু করি।
 
ততক্ষণে গাড়ির হেডলাইট ডাইনির চোখের মত জ্বলছে অন্ধকারে। ক্রমশ গর্জন করে গাড়িটা ছুটে এল। ওরা জিপটার আড়ালে দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে চলে যেতে দেখল। একটা মালবোঝাই লরি।

কোন দিকে যাচ্ছে ওরা কেউ জানে না। কিন্তু মূল পিচের পথটা ছাড়িয়ে এসেছে ওরা অনেকক্ষণ। এদিকের জঙ্গল তেমন গভীর নয় কিন্তু ডুয়ার্সের বনের মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাঁটা যায় না। অনিমেষের শরীর ক্লান্তিতে টলছিল। সিরিল আগে আগে যাচ্ছে, মাঝখানে মহাদেবদা পেছনে অনিমেষ। নিজের শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বুঝলেও অনিমেষ মুখে প্রকাশ করেনি। কারণ মহাদেবদার পক্ষে এই দুর্গম পথে হাঁটা যে অসম্ভব হয়ে পড়ছে এটা ওরা টের পাচ্ছিল। চটি এবং ধুতি পরে এভাবে জঙ্গলে হাঁটা যায় না। পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে ওদের। এক সময় মহাদেবদা ভেঙ্গে পড়লেন। মাটিতে উবু হয়ে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।

অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

মহাদেবদা কোন শব্দ করলেন না।

অনিমেষ ওঁর শরীরে হাত দিল, বেশ গরম। মহাদেবদার জ্বর হয়েছে?

সে আবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি হাঁটতে পারবেন?

এবার মাথা নড়লেন মহাদেবদা, না।

তাহলে?

তোমরা এগোও, আমি ভোর অবধি এখানেই বিশ্রাম নিই।

তা কি হয়! এই জঙ্গলে কি বিপদ আছে জানি না, তাছাড়া আপনাকে আমরা ছেড়ে যেতে পারি।

হঠাৎ সিরিল মহাদেবদার দুই বগলে হাত দিয়ে ওঁকে সোজা করে দাঁড় করাল, আপনি আমার পিঠে উঠুন।

মহাদেবদা চমকে উঠলেন, না। তা হয় না!

কেন হবে না? আপনার বয়স হয়েছে আর ওজনও বেশি নয়। আমার মাল বয়ে নেবার অভ্যেস আছে। কথা শেষ করে মহাদেবদার আপত্তি সত্ত্বেও সিরিল ওঁকে পিঠে তুলে নিল। অনিমেষ অবাক চোখে ব্যাপারটা দেখল। এই কালো প্রায় অশিক্ষিত ছেলেটি প্রতি মুহূর্তে তাকে নতুন করে শিক্ষা দিচ্ছে। ওর পিঠে উঠেও মহাদেবদা আপত্তি জানাচ্ছিলেন।

সিরিল স্বচ্ছন্দ গলায় বলল, চলুন। আপনি আগে যান।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?

সিরিল হাসল, জানি না।

সারাটা জঙ্গল যেন ওরা মাড়িয়ে এল। যদিও মাঝে মাঝেই ওরা বিশ্রাম নিয়েছে কিন্তু অনিমেষের মনে হল ওর শরীরে এখন একটুও শক্তি নেই। মাথা ঘুরছে, খিদে এবং পরিশ্রমে শরীর টলছে। এদিকে আকাশ এখন প্রায় পরিষ্কার। অন্ধকার চলে যাওয়ার আগে সামান্য সময় দ্বন্দ্ব বাড়ায়। এটি সেই মুহূর্ত। টলতে টলতে অনিমেষ এগোচ্ছিল। পেছনে সিরিলের দিকে তাকাবার সাহস কিংবা ইচ্ছে ওর নেই। একটা প্রমাণ সাইজের মানুষকে কি অবলীলায় বয়ে আনছে ওই ছিপছিপে ছেলেটা; একটুও কষ্টের কথা বলেনি। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের চোখের সামনে সব টলছিল এখন, কোমর থেকে পা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে হঠাৎ চোখ বন্ধ করল। সামনে ওটা কি? পেছন থেকে সিরিলের গলা পাওয়া গেল, ব্যস, আ গিয়া।

অনিমেষ নিজের দৃষ্টি কয়েকবারের চেষ্টায় সহজ করে ভালভাবে তাকাল। একটা ছোট্ট একতলা ঘর। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা জঙ্গলের শেষ। ঘরটা যে একটা স্টেশন তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কারণ ওপাশে রেললাইন দেখা যাচ্ছে। দু-তিনটে লোক এই প্রায় ভোর হওয়া সময়টায় প্রায় গুটিসুটি মেরে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। কোন রেলের লোককে নজরে পড়ল না।

সিরিল মহাদেবদাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিতেই অনিমেষ দেখল ওর মুখ ফ্যাকাশে। মহাদেবদা এখন অনেকটা সুস্থ কিন্তু ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। যেন এতক্ষণ পিঠে বোঝা ছিল বলেই সে চলতে পারছিল, বোঝা নামিয়ে সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। সিরিলের কাঁধে হাত দিল অনিমেষ, কি হয়েছে?

মাথা নাড়ল সে, কিছু হয়নি।

জোর করে ওকে মাটিতে বসিয়ে অনিমেষ নিজেও বসল। এখানে কারো চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই। যেহেতু জায়গাটার হালচাল বোঝা যাচ্ছে না তাই সামান্য সময় অপেক্ষা করা দরকার।

মহাদেবদা বললেন, কোন ট্রেন এলে উঠে পড়তে হবে। কোনদিকে যাচ্ছে জানার দরকার নেই। এই এলাকাটা অবিলম্বে ছাড়া দরকার।

মনে হচ্ছে বাঁ দিকটা শিলিগুড়ি, ডান দিকটায় আসামের পথ।

আসাম! এখান থেকে আলিপুরদুয়ার কতক্ষণ লাগবে?

ঘণ্টা দুয়েক।

গুড। চল ওখানেই যাই। তুষার সেন ওখানে থাকে, স্কুলে পড়ায়। ওটা খুব ভাল শেলটার হবে।

তিনজনেই যেতে পারব?

হ্যাঁ। ওর বাড়িতে বুড়ি মা ছাড়া লোকজন নেই। ঠিক এই সময় একটা জিপ সজোরে এসে ব্রেক চাপল স্টেশনের সামনে।
 
তিন-চারজন পুলিশ লাফিয়ে নেমে স্টেশনে ঢুকে গেল। হাঁকাহাঁকির পর দেখা গেল রেলের লোকজন বেরিয়ে এসেছে। অফিসার কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। অনিমেষরা পাথরের মত চুপচাপ ওদের দেখল। সন্দেহ না থাকলে ওরা এখানে আসবে না এবং শেষ পর্যন্ত নীচ থেকেই ওরা ঘুরে গেল। এসবই যে তাদের তল্লাসে তা বুঝতে অসুবিধে হল না।

শেষ পর্যন্ত পুলিশের গাড়িটা ফিরে গেল কিন্তু যাওয়ার আগে দুজন কনস্টেবলকে এখানে রেখে গেল। একজনের হাতে রাইফেল অন্যজনের হাতিয়ার লাঠি। মিনিট কয়েক তারা খুব আগ্রহের সঙ্গে পায়চারি করে শেষ পর্যন্ত পাশাপাশি বসে গল্প করতে লাগল।

মহাদেবদা বললেন, ঝুঁকি নিতেই হবে। এদের সামনে দিয়েই ট্রেনে উঠতে হবে। মনে হচ্ছে ম্যানেজ করা যাবে।

সিরিল কি বুঝল বোঝা গেল না, আস্তে আস্তে উঠে নীচে নামতে লাগল। অনিমেষ চাপা গলায় তাকে ডাকলেও ততক্ষণে সিরিল নেমে গেছে। যেন কোন উত্তেজনার সঙ্গে সংস্রব নেই এমন ভঙ্গীতে স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগল সে। অনিমেষরা দেখছিল ওকে। কনেস্টবলের সামনে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করল সিরিল। বেশ বিরক্ত হয়ে কোন উত্তর দিল না তারা। সিরিল বোকা বোকা ভাব করে ওদের পাশে বাঁ দিকে তাকাচ্ছে। তারপরই ট্রেনের হুইল শোনা গেল। মহাদেবদা চাপা গলায় বললেন, চলো এগিয়ে যাই।

দুপায়ে যেন লোহার ওজন, অনিমেষ কোনরকমে নীচে নেমে এল। এবার মহাদেবদাই জিজ্ঞাসা করলেন, হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ এবং সেই মুহূর্তেই পুলিশ দুটোর নজর পড়ল ওদের দিকে। বোধহয় চেহারার বিবরণ আগেই পেয়েছিল ওরা, কারণ দেখা মাত্র সোজা হয়ে দাঁড়াল দুজনেই। নিজেদের মধ্যে কথা বলেই একজন রাইফেল উঁচিয়ে চিৎকার করল হল্ট!

অনিমেষরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। একজন রাইফেল তাকে করে দাঁড়িয়ে, অন্যজন লাঠি হাতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে এমনভাবে আসছে যে সঙ্গীর লক্ষ্য থেকে সে এদের আড়াল না করে। দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল লোকটা, কাঁহা সে আতা হ্যায়?

অনিমেষের নজর তখন রাইফেলধারীর দিকে। তার পেছনে বেড়ালের পায়ে হেঁটে এসেছে সিরিল। লোকটার একাগ্র নজর এদিকেই। এক পলকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সিরিল। আচমকা আক্রমণে ছিটকে পড়ে গেল লোকটা, রাইফেলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রিভলভার বের করে লাঠিধারীকে পাথর করে দিল অনিমেষ। তখন গাড়ি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে।

যদিও যাত্রী কম তবু সবার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটল। কিন্তু কেউ এক পা এগিয়ে যেতেই অন্য পুলিশটা চোঁ চোঁ দৌড় শুরু করল। অনিমেষ যখন ওদের কাছে পৌঁছেছে তখন সিরিল মাটিতে আর তার ওপর দুপা দিয়ে পুলিশটা বসে আছে। ওর হাত দুটো সিরিলের গলায় সাড়াশির মত বসে যাচ্ছে। উন্মাদ হয়ে গেল অনিমেষ। জোরে রিভলভারের বাট দিয়ে আঘাত করল পুলিশটার মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল মাথা থেকে, চুপচাপ শুয়ে পড়ল লোকটা।

সিরিল! অনিমেষ চাপা গলায় ডাকল। চিত হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। চোখ বিস্ফারিত, মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে। এক মুহূর্ত মাত্র, কিন্তু অনিমেষের বুকের ভিতরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। সিরিল নেই, ওদের বাঁচাতে ছেলেটা লড়ে গেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত! সারা রাতের ক্লান্তির কথা আমল দেয়নি। সেই মুহূর্তে অনেক শব্দ বাজল কানে। ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে। মহাদেবদার গলা পাওয়া গেল, অনিমেষ উঠে এসো।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। ট্রেনটা সাপের মত এগিয়ে যাচ্ছে। কামরায় কামরায় মুখগুলো এখন ওর দিকে তাকিয়ে। রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে সে ছুটে গেল ট্রেনটার দিকে। সামনে মহাদেবদার হাত, হাতটা সরে গেল। অনিমেষ পরের কামরার হাতল ধরার জন্যে লাফ দিতেই হাঁটুতে সেই ব্যথাটা আচমকা চলকে উঠল। নিজের শরীর এক পলকেই নিজের নয়, ট্রেনের গায়ে আঘাত খেয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ল অনিমেষ। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে কেন্নোর পায়ের মত ট্রেনের চাকাগুলোকে ছুটে যেতে দেখলো সে। তারপর সব অন্ধকার।

একটা রেললাইন, তার ওপারে ছোট ছোট গাছ যার ওপর আকাশটা উপুড় হয়ে আছে। এমন একটা স্থিরচিত্র দুচোখের সামনে, অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। পরক্ষণেই মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভবে এল। হাত চলে এল অজান্তেই, অনিমেষ চটচটে উষ্ণতা স্পর্শ করতেই আবার চোখ খুলল। আঙুলগুলো গড়িয়ে রক্ত ঝরছে। এক মুহূর্ত মাত্র, অনিমেষ চট করে সোজা হয়ে বসল। যন্ত্রণাটা এখন যত তীব্ৰই হোক না কেন, অনিমেষ সাদা চোখে চারধারে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। দশ-বারোজন দেহাতি মানুষ গোল হয়ে ঘিরে তাকে দেখছে। সে উঠে বসতেই একটা অস্ফুট শব্দ হল কারো কারো মুখে, ভাবটা এমন যে লোকটা বেঁচে আছে। একজন চেঁচিয়ে কাউকে ডাকল।
 
কোনরকমে উঠে দাঁড়াতেই মানুষের বৃত্তটা বড় হল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল তার আঘাত বীভৎস রকমের, কারণ লোকগুলোর চোখে দারুণ বিস্ময়। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মাথায় চিন্তাটা চলকে উঠল। পালাতে হবে, এখান থেকে এক্ষুণি চলে যাওয়া দরকার। আশেপাশে কোথাও রেলগাড়ির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, এমন কি সেই ছুটে যাওয়া পুলিশটাও নেই। অনিমেষের চোখের ওপর এখন একটা লালচে পরদা আসতেই রগড়ে নিল চোখ। ওপাশে সিরিলের শরীর মাটিতে শক্ত হয়ে পড়ে আছে, পুলিশটা দেহের পাশে।

অনিমেষ এক পা এগোতেই মানুষগুলো যেন চিন্তিত হল। কোন দিকে গেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে সে জানে না। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা বোকামি হবে। সে পা ফেলল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, বারংবার ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে চোখ, কাঁধ থেকে মাথা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, অনিমেষ জঙ্গলের দিকে এগোল। বৃত্তটা এর মধ্যে ভেঙ্গে গেছে। অনিমেষ এগিয়ে যেতে লোকগুলো কৌতূহলী হয়ে ওর পেছনে হাঁটা শুরু করল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ওদের নিষেধ করতে গিয়ে উত্তেজিত হল অনিমেষ, কেউ আসবে না, খবরদার বলছি, আমার সঙ্গে বোমা আছে, সবকটাকে মেরে ফেলব!

চিৎকারটা শুনে লোকগুলো প্রথমে খতিয়ে গেল। কিন্তু অনিমেষ হাঁটা শুরু করতেই ওরাও এগোতে লাগল। সঙ্গে একটা পেনসিল কাটা ছুরিও নেই, অনিমেষ এবার দৌড়াবার চেষ্টা করল। আর তার ফল হল বিপরীত। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো চিৎকার করে উঠল, ভাগতা হ্যায়, ডাকু ভাগতা হ্যায়। আচম্বিতে একটা পাথর এসে ছিটকে পড়ল পিঠে। মাথা থেকে যন্ত্রণাটা যেন এবার সারা শরীরে ছড়ালো। অনিমেষ ঘুরে তাকাল। লোকগুলো এবার তার দিকে ছুটে আসছে। প্রত্যেকের হাতে পাথর। সে না তাকালে এতক্ষণে ওগুলো ছোঁড়া হয়ে যেত। এখন তাকাতেই হাতগুলো নেমে এল কিন্তু পাকড়ো পাকড়ো চিৎকারটা কমল না।

অনিমেষ দুহাত জোড় করল, শুনুন, আপনারা ভুল করবেন না, আমি ডাকাত নই, আমি আপনাদের মতই একজন মানুষ। আমি নিজের জন্যে কখনো খুন করিনি। আপনারা বিশ্বাস করুন।

পাকড়ো পাকড়ো, মার ডালা সিপাইকো। পেছনে আরো গলা পাওয়া যেতেই সামনের লোকগুলো উজ্জীবিত হল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল এদের এখনই থামানো দরকার। সে মরিয়া হয়ে চিৎকার করল, শুনুন, আমি ডাকাত নই। আমরা এই দেশের জন্য কাজ করছি। আপনাদের অবস্থা আমরা পাল্টাতে চাই। সারা দেশে আজ আমরা লড়ছি। আপনারা নিশ্চয়ই নকশালবাড়ির নাম শুনেছেন।

ন–ক–শা–ল। শব্দটা অস্পষ্ট শোনা গেল মানুষগুলোর মুখে। সেই মুহূর্তে দূরে পালিয়ে যাওয়া পুলিশটাকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সমানে চিৎকার করছে সে পাকড়ো পাকড়ো!

অনিমেষ আবার কিছু বলতে গিয়ে হতাশ হল। সে লোকগুলোর হাত থেকে দূরে সরে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করল। এতক্ষণে চোখ অন্ধ, রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে মুখে। অনিমেষের ছুটন্ত শরীরে ছোট ছোট পাথর ছিটকে পড়ছিল। এসময়ে মাথার পেছনটা ঝনঝন করে উঠতেই অনিমেষ বসে পড়ল। পরমুহূর্তেই অনেকগুলো হাত একসঙ্গে নেমে এল ওর শরীরে। অনিমেষে শেষবার চেষ্টা করল কথা বলতে। হাতগুলো এখন নির্মম।

সারা শরীর আগুনে পুড়ছে এমন অনুভব হল অনিমেষের। চোখ বন্ধ, চেষ্টা করেও দুটা পাতা খুলতে পারল না সে। একটু বাদে বুঝতে পারল কোন চলন্ত জিনিসের ওপর শুয়ে আছে। দুর্বল একটা চিন্তাশক্তি কোনরকমে টিকেছিল মাথায়, সেটাকে জিইয়ে রাখতে চাইছিল সে। ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল, দুএকবার হর্ণ, কোন ছুটন্ত গাড়িতে শুয়ে চলেছে সে। গাড়িটা কার, কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন কোন ভাবনা মাথায় এল না। আচ্ছন্নের মত বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যাবার পর সে কাঁধে নরম স্পর্শ পেল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে একটা কিছু তার শরীর স্পর্শ করছে বারংবার। পেটের ওপর পড়ে থাকা হাত দুটো তোলার চেষ্টা করল সে। কাঁধের কাছটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, দুটো হাত এক সঙ্গে ওপরে উঠেই পড়ে গেল। কবজিতে সার নেই। দুটো কবজি এক সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয়ে আছে। অর্থাৎ এখন সে বন্দী। আর একবার চোখ খোলার চেষ্টা করল সে প্রাণপণে। অস্পষ্ট সাদা যেন সামনে ঝুলছে। সে কি অন্ধ হয়ে গেল। অনিমেষ চেষ্টা করল মনে করতে কোন আঘাত তার চোখে লেগেছিল কিনা। ভাবতে পারছে না, কিছুই মনে পড়ছে না।
 
মুখ ঘোরালো সে। একটা বোধ তার হচ্ছিল, মাথার বাঁ দিকটা ফেটেছে। ডান দিক দিয়ে পাশ ফেরার চেষ্টা করল সে এবার। যে জিনিসটার সে স্পর্শ পাচ্ছে সেটা মানুষ। অথচ সেই মানুষটা এমনভাবে ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে গড়িয়ে পড়ছে যে বোঝাই যাচ্ছে তার নিজের কোন শক্তি নেই। অনিমেষ চাপা গলায় ডাকবার চেষ্টা করল, কে?

কোন উত্তর এল না। গাড়ির একটানা ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কোন কিছু কানে বাজছে না। পাশের মানুষটি কোন সাড়া দিল না। মাথার মধ্যে ফিকে অন্ধকার হঠাৎ দুটো টুকরো হয়ে গেল। পাশের মানুষটাকেও তা হলে তারই মত বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কে হতে পারে? চিন্তাটা স্পষ্ট হতে শক্ত হয়ে গেল সে। সিরিল নয়তো! আর কেউ তো তাদের সঙ্গে ছিল না। মহাদেবদা তো সেই ট্রেনেই চলে গেছেন। সিরিল যদি হয় তা হলে তো–! জোর করে চোখ বন্ধ করে আচমকা পাতাগুলো খুলতেই অস্পষ্ট একটা মুখ ভেসে উঠল। মুখটা যে সিরিলের তা বুঝতে অসুবিধে হল না ওর। সিরিলের মৃত শরীরের পাশে সে শুয়ে যাচ্ছে। আহ, সিরিল! সেই উজ্জ্বল ছেলেটা! অনিমেষ চোখ বন্ধ করতেই আর একটা আওয়াজ এই প্রথম তার কানে ঢুকল। অস্ফুট যন্ত্রণার অভিব্যক্তি কারো গলায় বাজছে। মাঝে মাঝেই ককিয়ে উঠছে সে। কে হতে পারে? নির্ঘাৎ সেই পুলিশটা। নিশ্চয়ই তাকেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই গাড়িতে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।

গাড়িটা কখন থেমেছিল টের পায়নি অনিমেষ। স্পষ্ট একটা গলা কানে এল, ডেড? শব্দ হল, কেউ গাড়িতে উঠল। মচ মচ্ শব্দটা কানে যেতে অনিমেষ স্থির হয়ে গেল। বেশ জোরে কেউ লাথি মারল তার পাছায়। অনিমেষ অনেক কষ্টে শক্ত হয়ে থাকল। লোকটার গলা কানে এল, মরে গেছে মনে হচ্ছে।

ভাল করে দ্যাখ। হুকুমটা এল বাইরে থেকে।

নড়ছে না। কিন্তু এখনও রক্ত বের হচ্ছে।

মড়ার শরীর থেকে রক্ত বের হয় না। তা হলে বেঁচে আছে। একটা হাত গলা এবং বুকের ওপর কিছুক্ষণ হাতড়ে চেঁচিয়ে উঠল, মরেনি স্যার, অজ্ঞান হয়ে আছে।

হরমোহনের কি অবস্থা?

গোঙাচ্ছে।

ওটাকে নামিয়ে আন।

কাকে স্যার!

নকশালটাকে। শেষ করে নিয়ে যাই।

গুলী করবেন স্যার?

হ্যাঁ। এখানে ধারে কাছে কেউ নেই।

কি দরকার স্যার। জলপাইগুড়িতে পৌঁছাবার আগেই পাশের বডিটার মত শক্ত হয়ে যাবে। এ কেস টিকবে না।

নকশালদের তুই চিনিস না। তা হলে স্যার গাড়িতেই গুলী করুন। কষ্ট করে নামালে আবার ওঠাতে হবে তো।

তা ঠিক তবে এমন ভাবে গুলী করবি যাতে গাড়িতে দাগ না হয়। বুঝলি?

আমি করব স্যার?

আমি তুমি আবার কি কথা? জলদি কর৷ করা দরকার সেটাই আসল কথা। এই শালা নকশালদের ঝাড়েবংশে শেষ করা দরকার।

পায়ের আওয়াজ একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল। আসাটা খুব স্বচ্ছন্দ নয় বুঝতে পারা যাচ্ছিল। এবার ওরা গুলী করবে, অনিমেষ এটুকু ভাবতে পারল। গুলীটা গায়ে লাগলেই সে মরে যাবে। অথচ তার হাত নাড়ার সামান্য ক্ষমতা নেই। গুলীটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে অনিমেষ নিজের অজান্তেই ভয়ের কথা ভুলে গেল। এই মুহূর্তে, সম্পূর্ণ অসচেতনতায় মাধবীলতার মুখ চলকে উঠল সামনে। মাধবীলতার সেই আদুরে হাসিটাকে বন্ধ চোখের পাতায় অনুভব করতে করতে কান ফাটানো শব্দটা তার শরীর কাঁপিয়ে দিল। পেটের ভেতর আর একটা যন্ত্রণা জন্ম নিল মাত্র। কিন্তু চোখের সামনে থেকে মাধবীলতা এখন উধাও, তার চেতনা মুছে যেতে যেতে একটা সুতোয় যেন ঝুলতে লাগল। সিপাহিটা বলল, হয়ে গেছে স্যার।

মরছে?

একদম পেটের ভেতরে।

রক্ত পড়ছে?

গলগল করে।

মুছে ফ্যাল।

মুছব? মুছব কিসে?

সেই জন্যেই তো বাইরে বের করে কাজটা শেষ করতে বলেছিলাম। এত কুঁড়ে হলে চলে! এখন। ওই রক্তের দাগ নিয়ে তো আর ফেরা যাবে না।

যেতে যেতে রক্ত বের হতেও তো পারে।

তা পারে। রক্ত বের হলে আমরা কি করব। ঠিকই তো!

তা হলে নামি স্যার?

বেশ, নাম।

দুটো শরীরকে ওরা পাশাপাশি রাখছিল। এমন সময় একটা গলা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, স্যার, মরেনি এখনও।

মরেনি? এই যে বললি মরে গেছে।

তাই তো ভেবেছিলাম তখন।

ভেবেছিলাম! এরকম ভাবলে অ্যাডমিনিস্টেশন চলে?

তবে বেশিক্ষণ টিকবে না স্যার। হয়ে গেল বলে।

এখন তো কিছুই করা যাবে না। পাবলিক দেখছে, এটা হাসপাতাল। এই যে, আপনারা কি দেখছেন এখানে? যান যান, নিজের কাজে যান। ডেডবডি দ্যাখেননি কখনো? যান। –আসুন ডাক্টর।

দুটোই ডেড কেস?

অলমোস্ট।

অলমোস্ট মানে? এ দেখছি এখনও মরেনি। খুব সিরিয়াস কেস। অনেকগুলো উন্ড হয়েছে দেখছি। এই, একে তোল শিগগির।

অফিসারের গলা শোনা গেল, ঝামেলা বাড়াচ্ছেন কেন? মর্গে যেতে যেতে টেসে যাবে। এখন জামাই আদর করে কি লাভ?

তা সত্ত্বেও অনিমেষ যেন টের পেল সে দোলনায় দুলছে অথবা পালকিতে চড়ে যাচ্ছে কোথাও। শারীরিক যন্ত্রণার বোধগুলো কখন নেতিয়ে গিয়েছিল। অনন্ত শূন্যে সে যেন একা ভেসে যাচ্ছে। তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না, কাউকে কিছু করার ক্ষমতা অথবা ইচ্ছেটুকুও তার নেই। আঃ, কি আরাম!
 
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনিমেষ চুপচাপ দরজার দিকে তাকিয়েছিল। এখানে সে কতদিন এসেছে হিসেব নেই। যেটুকু অনুমান তাতে দুটো মাসের হিসেব সে পাচ্ছে না। অজ্ঞান হবার পর শরীরের কষ্টগুলো ওকে পাগল করে তুলেছিল। এখন সেগুলো থিতিয়েছে। সব সময় অবসন্ন লাগে। আজ সকালে প্রথম পা রেখেছিল মাটিতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শরীর টলতে লাগল। নিজেকে এখন ঝাঁঝরা লাগছে।

মাথায় চুল নেই বললেই হয়। কবার কামানো হয়েছে সে জানে না। ব্যান্ডেজ খুলে এখন হাওয়া লাগানো হচ্ছে। হাত দিতেই বোঝা যায় খুব বড় অপারেশন হয়ে গেছে। পেটের কাটা দাগ এখন শুকনো। কিন্তু–শরীরে জোর নেই এক ফোঁটাও। যে নার্স অথবা ডাক্তার তাকে দেখতে আসেন তারা কথা বলেন না বাড়তি। মেসিনের মত কাজ করে যান তারা। অনিমেষ চেষ্টা করেও জানতে পারেনি সে কি অবস্থায় আছে। তবে দরজার দিকে তাকালেই পাহারাদার চোখে পড়ছে।

প্রথম বার পায়ে গুলী লাগার পর দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কলকাতার সেই হাসপাতালে থাকার সময় মনের ওপর চাপ পড়ত খুব। এখন একটা দিন এল কি গেল তাতে কিছুই এসে যায় না। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে চিন্তা করার ক্ষমতটাই তার হারিয়ে গেছে। বোধ যদি ভোতা হয়ে যায় তখন যন্ত্রণা অনুভবে আসে না। যেমন সকাল থেকে সে একটা চিরকুট পড়ার পর থেকেই সেটা নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। অবশ্য ঘর মোছার পর যে লোকটা ওটা এনেছিল সে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যে লিখেছে তাকে অনিমেষ মনে করতে পারছে না আজ দুপুরে নাকি তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন নিয়ে যাবে তখন যেন সে চুপচাপ থাকে। সেখানে বেশি পুলিশ যাবে না। তাই যে চিঠি লিখেছে সে জানিয়েছে একটা চেষ্টা হবে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে। সে যেন সজাগ থাকে।

দরজার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ সকাল থেকে ব্যাপারটা ভেবে কূল পাচ্ছিল না। কেনই বা তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে কিংবা কেনই বা তাকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে? ছিনিয়ে যারা নেবে তারা কোথায় তাকে রাখবে? মুশকিল হল, এই সব ভাবনা চিরকুট পড়ার পর থেকেই মাথায় তুবড়ির মত ফিনকি দিয়ে উঠেই নিবে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ ভাবলেই কান-মাথা গরম হয়ে শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।

এখন কেমন আছো হে?

একটি বয়স্ক গলা জুতোয় শব্দ তুলে পাশে এসে দাঁড়াল। অনিমেষ তার ইউনিফর্মটা দেখল। মোটাসোটা লোকটার কোমরে রিভলভার ঝুলছে। অনিমেষ মুখ ফেরালো। লোকটি হিকহিক করে একটু হাসলো, নাও, মুক্তি। ডাক্তার তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। এবার শ্বশুর বাড়িতে চল। ওঠ।

কোন প্রতিবাদ না করে অনিমেষ উঠে বসতে চেষ্টা করল। শরীর কাঁপছে। লোকটা বলল, এখনও কাহিল দেখছি। আরে আবা মিছিমিছি কষ্ট করছ তুমি। আমার সঙ্গে হাত মেলাও দেখবে তুমি ড্যাং ড্যাড্যাং করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছ। কি, হাত মেলাবে?

অনিমেষ তাকাল লোকটার দিকে। কি বলতে চাইছে ধরতে পারল না সে। লোকটা ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, মহাদেব কোথায়?

মহাদেব! অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। মহাদেব–কে? তারপরেই মহাদেবদার কথা মনে পড়ল। মহাদেবদা রেলের কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে চিৎকার করে ডাকছিলেন। সেই মহাদেবদার কথা জিজ্ঞাসা করছে এরা। অনিমেষ আর কিছু ভাবতে না পারলেও এটা স্থির করতে পারল মহাদেবদার কথা কিছুতেই বলা উচিত নয়। সে নীরবে মাথা নাড়ল। জানি না।

হারামীর বাচ্চা! একশবার প্রশ্ন করলাম তবু এক উত্তর। মেরে পেছনের ছাল ছাড়িয়ে নেব যখন তখন বুজতে পারবে। আরে বাবা, বলেই ফেল না লোকটাকে কোথায় লুকিয়েছে? কেউ জানতে পারবে না, মাইরি বলছি, আমার প্রমোশনটাও হয়ে যাবে আর তুমিও ছাড়া পেয়ে যাবে। বল ভাই! লোকটি ওর কাঁধে হাত রাখল। কিন্তু অনিমেষ ততক্ষণে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এই প্রশ্নটা তাকে অনেকবার করা হয়েছে? কিন্তু তার একথা একটুকুও মনে পড়ছে না কেন? স্মৃতিশক্তি কি একদম অকেজো হয়ে গেছে! অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।
 
তোমরা তো একসঙ্গে হাসিমারা থেকে হাওয়া হয়েছিলে। আরে বাবা, ওই করুণাসিন্ধু সেকথা আমাদের বলেছে। মহাদেব ট্রেনে উঠে পড়েছিল, তুমি পারোনি। লোকটা কি স্বার্থপর দ্যাখো, তোমাকে একা ফেলে বেশ কেটে পড়ল। তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে সেইটে বলে দাও ভাই।

অনিমেষ চোখ খুলল, আমি জানি না। নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগল তার। সরু এবং কাঁপা কাঁপা হয়ে গেছে কখন।

শালা! সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না দেখছি। তখনই টেসিয়ে দিলে ভাল হত। ঠিক আছে, এক ঘন্টা সময় দিলাম, এর মধ্যে ভেবে দ্যাখো বলবে কি না। তারপর তোমার হচ্ছে। এখন ওঠো, থিয়েটার করে আসবে চল।

থিয়েটার! অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাতেই লোকটা ওর কাধ ধরে টেনে দাঁড় করাল সমস্ত শরীরে ঝনঝনানি শুরু হয়ে গেল তার। এবার পেছন থেকে একটা লোক এগিয়ে এসে ওর কোমরে একটা দড়ির ফাস পরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে টানতে লাগল।

তাল রাখতে অনিমেষের অসুবিধে হচ্ছিল। সুতো কাটা ঘুড়ির মত সে টাল খাচ্ছিল। অফিসার ওর পাশে হেঁটে এসে নিজের মনেই বলল, মালের হাল যা দেখছি তাতে হাতকড়া পরাবার কোন দরকার নেই। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, গাড়িতে তোল। যত আদিখ্যেতা হয়েছে আজকাল। কেউ মরলেই নিয়ে যেতে হবে দেখাতে।

গাড়ির দরজা ধরে নিজেকে সামলালো অনিমেষ। কে মরেছে? সে অফিসারের দিকে তাকাতেই, তাকে প্রায় তুলে ভ্যানের পেছনে ফেলে দেওয়া হল। দুটো সিপাই বন্দুক নিয়ে ওর সঙ্গে উঠল। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হওয়ামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কিছুক্ষণ চেষ্টার পর নিজেকে সামলাতে পারল অনিমেষ। পুলিশ দুটো নির্বিকার মুখে বসে আছে। মাথার পাশে ছোট্ট জানলার মত চৌকো গর্ত। অনিমেষ তাতে চোখ রাখল। হাঁটছে বা আড্ডা মারছে। দেওয়ালের গায়ে গায়ে লেখা নকশালবাড়ি লাল সেলাম।

একসময় গাড়ি থামাল। সিপাই দুটো দরজা খুলে নিচে নেমে দড়ি ধরে টানতে অনিমেষ নেমে এল। এই সময় অফিসারটি হাসতে হাসতে এসে এসে ওর হাতে হাতকড়া পরিয়ে বলল, যাও, শেষবার দেখে নাও। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে।

অনিমেষ গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই লোকজন দেখতে পেল। সবাই চুপচাপ বসে আছে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চিতা সাজানো হয়ে গেছে। চিতার পাশেই মাটিতে কাপড়ের ওপর একটি দেহ শুয়ে আছে। সিপাই ওকে দড়ি ধরে টেনে নিয়ে এল শরীরটির কাছে। অনিমেষ পাথর হয়ে গেল।

সরিৎশেখর শুয়ে আছেন। খুব স্বাভাবিক মুখের চেহারা, যেন ঘুমাচ্ছেন। তার শরীর একটা কাপড়ে বুক অবধি ঢাকা, চোখ বন্ধ। দাদু মারা গেছেন? অনিমেষের চিবুক বুকের ওপর নেমে এল। ঠিক সেই সময় অনিমেষ কনুইতে হাতের স্পর্শ পেল। অনিমেষ মুখ তুলল, ছোটমা।

ছোটমায়ের মাথায় ঘোমটা, মুখ পাথরের মত। নীচু গলায় বলল, কাছে চল। তোমার জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছিল।

আচ্ছন্নের মত অনিমেষ ছোটমায়ের সঙ্গে দাদুর পাশে এসে দাঁড়াল। দুটো চন্দন মাখা তুলসীপাতা দাদুর চোখে লাগানো। অনিমেষের বুকের ভেতর হুহু করছিল কিন্তু আশ্চর্য, তার চোখে জল আসছিল না। কাঁদতে চাইছিল সে কিন্তু কিছুতেই কান্না আসছিল না। ছোটমায়ের গলা শুনতে পেল সে, উনি তোমাকে দুদিন দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু ওরা দেখতে দেয়নি। তবে উনি জেনে গেছেন তুমি ভাল হয়ে গেছ।

এই সময় শ্মশানবন্ধুরা দাদুর শরীরটাকে চিতায় শোওয়াবার ব্যবস্থা করতে লাগল। ছোটমা অনিমেষের বাজু থেকে হাত সরায়নি। চাপা গলায় বলল, তোমার দাদুর শেষ ইচ্ছে তাই।

অনিমেষ মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। বেশ কিছুটা দুরে মহীতোষ বসে আছেন দুহাতে মুখ ঢেকে। বাবার কাছে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে ওর। কিন্তু ছোটমা ওকে চিতার পাশে টেনে নিয়ে গেলেন। দাদুর শরীর এখন আগুনের অপেক্ষায়। ছোটমা মুখ ঘুরিয়ে বলল, দু-মিনিটের জন্যে হাতকড়া খোলা যাবে না?

অফিসারটির গলা শোনা গেল, হাতকড়াতে কোন অসুবিধে হবে না।

আপনারা কি মানুষ! হিস হিস করে উঠল ছোটমা।
 
হাতকড়া পরা অবস্থায় মুখাগ্নি করল অনিমেষ। চিতা জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। হঠাৎ অনিমেষের চোখের সামনে বহু বছর আগের সেই ছবিটা ছিটকে চলে এল। এই শ্মশানে সে একদিন মায়ের মুখে আগুন ছুঁইয়েছিল। মায়ের শরীরের রক্ত তার হাতে শুকিয়েছিল। লাল আগুনের আড়াল থেকে মায়ের ছড়ানো চুল দেখা যাচ্ছিল। সেদিন সে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। মহীতোষ তাকে সান্তনা দিয়েছিলেন। আজ, দাদুর চিতার দিকে তাকিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সেই প্রিয় শরীরটা, জন্ম থেকেই যা ছিল তার আশ্রয় তা এখন কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে আগুনে। চোখ বন্ধ করল সে।

হরিধ্বনি চলছিল তখনও। এমন সময় কানের পাশে ফিসফিসে গলা পেল অনিমেষ, কোমরের দড়িটা কেটে দিলেই আপনি ডানদিকে দৌড়ে যাবেন। ওখানে গাড়ি স্টার্ট করা আছে। আমরা ওদের বোম মারব।

চিতায় কাঠ শব্দ করে ফাটছে। অনিমেষ ছেলেটির দিকে তাকাল। শুশানবন্ধুদের মধ্যে একজন এরকম পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছে! কিন্তু সে দৌড়ে যাবে কি করে? স্বাভাবিকভাবেই সে হাঁটতে পারছে না। তাহলে? সে মাথা নাড়ল না। ছেলেটি বলল, সে কি! সবাই রেডি, এখন না বলছেন কেন?

আমি পারব না।

বোকামি করবেন না।

অনিমেষ পেছনের দিকে তাকাল। পুলিশ দুটো অন্যমনস্ক হয়ে চিতার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু অফিসারের একটা হাত কোমরে ঝোলানো রিভলভারের ওপর। চোখ তার দিকে সতর্ক। অনিমেষ বুঝতে পারল পালিয়ে যাওয়ামাত্র তাকে গুলী খেতে হবে। এখন তার শরীরের যা অবস্থা তাতে গুলীর হাত থেকে রক্ষা পাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তাকে মেরেই এরা শান্ত হবে না, যারা এই পরিকল্পনা করেছে তারাও বিপদে পড়বে। অনিমেষ এটুকু ভাবতে পারল এটা খুব বোকামি হবে। হ্যাঁ, হঠকারিতা বোধ হয় একেই বলে। নিজের জন্যে সে চিন্তা করছে না, এই ছেলেগুলোকে বিপদে পড়তে সাহায্য করা কিছুতেই উচিত হবে না। সে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে অফিসারটির দিকে এগিয়ে গেল, চলুন।

অফিসার বলল, ছোঁড়াটা তোমাকে কি বলছিল?

আমার শরীরের কথা জিজ্ঞাসা করছিল। চলুন।

ভাবভঙ্গী ডাউটফুল। পরে দেখব। এই, চলে এসো সব। অফিসার গাড়ির দিকে এগোলেন। অনিমেষের মাথার ভেতরটা টনটন করছিল। মাঝে মাঝেই সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির দরজায় হাত রেখে ওর মহীতোষের কথা মনে পড়ল। এখন দূরত্বটা অনেক বড় গেছে বাঁ দিকে নদীর গায়ে দাদুর শরীর এখন পূর্ণ-আগুনে গলে গলে পড়ছে। ডানদিকে সেই একই অবস্থায় মহীতোষ বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি এখন অনিমেষের দিকে। চোখাচোখি হলেও চোখ সরিয়ে নিলেন না। বিমর্ষ ওই চোখ দুটো যেন অনিমেষকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। বাবার সঙ্গে কোনদিনই তার আন্তরিক সম্পর্ক হয়নি। কিন্তু বাবা একলা, খুব একলা একথা অনিমেষ বুঝল। আজ পুলিশের ভ্যানে ওঠার সময় সে যেন এই বোঝার ব্যাপারটা বাবাকে নতুন করে বোঝাতে পারলে খুশি হতো। এই সময় সে ছোটমাকে এগিয়ে আসতে দেখল। পেছনে চিতার উজ্জ্বল আলোর পটভূমিতে ছোটমাকে খুব দীপ্ত দেখাচ্ছে। ভ্যানের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল ছোটমা, ওকে শ্রাদ্ধের দিন বাড়িতে আনা যাবে?

অফিসার ঘাড় নাড়লো, না।

কেন?

পরশু ওকে কলকাতায় চালান করা হবে। ডেঞ্জারাস এলিমেন্ট তো। ওঠ, উঠে পড়। অনিমেষ ভ্যানে উঠে বসামাত্র সিপাই দুটো দরজা বন্ধ করল। তাদের জানলার মত ফোকর দিয়ে অনিমেষ বাইরে তাকাতেই চিতাটাকে চোখে পড়ল। দাদুর শরীর আর চেনা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই একটা গোল পিন্ডের মত হয়ে গেছেন সরিৎশেখর। দাদু নেই। দাদুর চলে যাওয়াতে ওর কোন কষ্ট হচ্ছে না। শেষ সময়ে উনি যে কষ্ট পাচ্ছিলেন তার চেয়ে চলে যাওয়া ওর পক্ষে অনেক ভাল হল। কিন্তু মুখাগ্নিটা ওকেই করতে বলে গিয়েছিলেন কেন? তার এত কথা জানার পরও কি দাদুর কোন মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়নি? বাবা মহীতোষের যে তার সম্পর্কে অভিমান রাগ কিংবা আক্ষেপ হয়েছে একথা স্পষ্ট। কিন্তু দাদু কি তাকে সমর্থন করতেন।
 
চিতাটা এখন চোখের আড়ালে চলে গেছে। পিচের রাস্তায় উঠে এসেছে গাড়ি। এমন সময় কান ফাটানো শব্দ হল। গাড়িটা সামান্য নড়ে উঠল, বোধ হয় সামনের কাঁচগুলোই ঝনঝন করে পড়ে গেল। অনিমেষের পাশে বসা সিপাই দুটো চেঁচিয়ে উঠল, বোম মারতেছে।

বোম চার্জ হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্টা ফায়ারিং-এর শব্দ কানে এল। বোধ হয় সামনের সিটে বসে থাকা অফিসার গুলী ছুঁড়ছেন। ড্রাইভার বোধ হয় আচমকা আক্রমণেই গতি কমিয়েছিল, এখন সেটা বাড়িয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। শহরের মধ্যে এসে গাড়িটা খুব শান্ত ভঙ্গিতে চলতে লাগল। অনিমেষ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করল। আর তখনি আচম্বিতে দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে এল গালে। ওরা ওকে ভালবেসেই ছাড়িয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু শুধু ভালবাসা কখনই ধারালো হয় না যদি তাতে বাস্তবের শান না দেওয়া থাকে। ঠোকর খাওয়ার আগে আমরা যে সেটা বুঝতেই চাই না।

হাসপাতালের নয়, জলপাইগুড়ি থানায় এসে থামল ভ্যানটা। প্রথমে বেশ উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পেল অনিমেষ। মানুষজনের ছুটোছুটি, গাড়ির আওয়াজ থেকে বোঝা গেল আর একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। অনিমেষের পাশের সিপাই দুটো দরজা খুলে নেমে দাঁড়িয়েছিল। এই সময় অফিসার ওদের কাছে এলেন, গর্তে মুখ লুকিয়ে ছিলি কেন তোরা? ফায়ার করতে পারিসনি?

কি করে করব? গাড়ি যে থামেনি।

থামেনি! এই করে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালানো যায়? এই যে হিরো, নেমে এসো। এবার তোমার চামড়া দিয়ে তবলা বানাবো। বন্ধুদের দিয়ে আমার ওপর বোমা মারানো হচ্ছিল! পালিয়ে যাওয়ার মতলব? নামো! চিৎকার করে উঠল অফিসার।

অনিমেষ এটুকু বুঝতে পারছিল তার ওপর ঝড় নেমে আসছে। কিন্তু যতটা পারা যায় নিজেকে ততটা নির্লিপ্ত রাখতে চাইছিল সে। কিন্তু ভ্যান থেকে নামতে গিয়েই মাথাটা এমন টলে উঠল যে, সে তাল রাখতে পারল না। হুড়মুড় করে পড়তে পড়তে সে একবার মাত্র আকাশটাকে দেখতে পেল।

স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপর অনিমেষ শুয়েছিল। জ্ঞান ফিরতেই বুঝতে পারল তার হাত এবং পা ভাল করে বাধা। তবে ঘরটায় আলো আসছে। প্রথমে ওর মাথায় একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এল না, বরং পেট চিনচিন করছে, বেশ ক্ষুধা বোধ হল তার। এখন বোধ হয় বিকেল। কারণ ক্রমশ আলো কমে আসছিল। এই সময় লোহার দরজা খুলে অফিসারটি ঘরে ঢুকল, ঘুম ভাঙল?

অনিমেষ কোনরকমে উঠে বসল, বসে বলল, খাবার দিন।

খাবার! ও গড। তোমার খাবার দরকার। খিদে পায় তাহলে! কি খাবে, এখানে যা পাওয়া যায় সব এনে দেব! মহাদেব কোথায়? লোকটা পা ফাঁক করে ওর সামনে এসে দাঁড়াল।

এক প্রশ্ন বার বার করছেন কেন?

চাবুকের মত পাটা নেমে এল, এ্যাই বাঞ্চোত, বলবি কিনা বল।

প্রচণ্ড যন্ত্রণা মাথা থেকে ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ল। অনিমেষ দাঁতে দাঁত টিপে সামলাতে থাকল নিজেকে। তার মুখ হাতের টানে এখন ওপরের দিকে। অফিসার গরগর করলো, সবকটাকে ধরব আজ। পুলিশকে মারার তাল হচ্ছিল। বিপ্লব করছেন। পেচ্ছাপ করে দিই বিপ্লবের মুখে। হাঁ কর হাঁ। কর বলছি।

হঠাৎ শরীরের মধ্যে অস্থিরতা পেল অনিমেষ। ঘেন্নায় গুলিয়ে উঠছে পেট বুক, সর্বাঙ্গ। তার মাথা এক দলা থুতু লোকটার শরীরে মাখামাখি হতেই প্রথমে হতভম্ব হয়ে হাত ছেড়ে দিল লোকটা। তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে অনিমেষের ওপর, শকুনের মত।
 
আজ আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসছেন। মিষ্টি গলায় বলল একজন অফিসার। তার সাদা য়ুনিফর্ম কলকাতা পুলিশের। জায়গাটা লালবাজার।

একটু আগে একটা খবরের কাগজ ওরা ওকে দিয়ে গিয়েছিল। তার প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে একজন বিখ্যাত নকশাল নেতার গ্রেপ্তারের খবর ছাপা আছে। অনেক চেষ্টার পর তাকে ধরা সম্ভব হয়েছে। ভদ্রলোক খুব অসুস্থ। নকশালবাড়ির আন্দোলন ওঁকে গ্রেপ্তারের পরই শেষ হয়ে গেল বলে পুলিশ আশা করছে। খবরটার সত্যতা সম্পর্কে অনিমেষ চিন্তা-ভাবনা করল না। কোন বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা সেই হাসপাতালেই সে হারিয়ে এসেছে। মুশকিল হল, পুলিশগুলো এই ব্যাপারটা বুঝছে না। কলকাতায় ওকে নিয়ে আসবার পর মহাদেবদার ঠিকানা জানার জন্যে ওরা ওকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছে। নিজের পক্ষে লড়বার মত সামান্য ক্ষমতা তার অবশিষ্ট নেই, এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে তার কষ্ট হয়।

অফিসারের কথাটা শোনার পর সে একটু অবাক হল। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে এ খবর কাউকেই তো সে জানাতে পারিনি। জানাতে গেলে পুলিশ তাকে নাজেহাল করত। মাধবীলতার কথা বারংবার তার মনে পড়েছে কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করেছে সে।

কে আসছে? অনিমেষ মাথা তুলল।

আপনার স্ত্রী!

আমার স্ত্রী?

হ্যাঁ, অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি বিবাহত নন?

মাথা নাড়াল অনিমেষ, হ্যাঁ। মাধবীলতার কথা জেনে গেছে? বুকের মধ্যে এক ধরনের ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। মাধবীলতা কেমন আছে এখন? কতদিন ওর কোন খবর পায়নি সে। নাকি কোন সূত্রে খবর পেয়ে মাধবীলতা নিজেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে! ইস, যদি কোন সূত্রে ওকে নিষেধ করা যেত!

শুনুন, আপনাকে আমি অনুরোধ করছি আর চুপ করে থাকবেন না। মহাদেববাবুর খবর আপনি যা জানেন বলে দিন। আপনার স্ত্রী এখন অসুস্থ, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে আমরা তার ওপর চাপ দিই। অফিসারটি নরম মুখে বলল।

অসুস্থ!

কি আশ্চর্য, আপনি জানেন না? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। মাধবীলতার অসুস্থতার খবর সে জানে না।

আপনি জানেন না তিনি সন্তানসম্ভবা? অফিসার হাসল।

একটা বরফের তীক্ষ্ণ ছুরি আচমকা অনিমেষের হৃৎপিন্ডকে চেপে ধরল। কি বলছে লোকটা? সত্যি কথা? নাকি এদের অসংখ্য মিথ্যের মত এটাও এক ভাঁওতা? মাধবীলতা মা হতে যাচ্ছে? অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। শান্তিনিকেতনের সেই রাতটা এখন অজস্র শুড়ওয়ালা অক্টোপাসের মত তাকে জড়িয়ে ধরছিল। সেই রাত কি আজ মাধবীলতাকে–। অনিমেষ কিছু ভাবতে পারছিল না। সেই রাতের ঘটনার পর তার এক মুহূর্তও এই চিন্তা মাথায় আসেনি। কখনো ভাবেনি মাধবীলতা ওই এক মুহূর্তের উত্তেজনায় মা হয়ে যেতে পারে।

অফিসারটি মাধবীলতাকে তার স্ত্রী হিসেবে ভেবেছে। অবশ্যই। কিন্তু এটা দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সম্পূর্ণ আন্তরিকতার ভিত্তিতে তৈরি। আইন কিংবা সমাজ স্বীকৃতি দেবে না। তাছাড়া সে মাধবীলতার পাশে ছিল না, কখনো পাশে আসতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা ছিল না বা নেই, তাহলে মাধবীলতা ঘটনাটিকে মেনে নিল কি করে। খুব স্বচ্ছন্দে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারত। কেন করল না?

অফিসারটি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ এখন একা। নির্জনে নিজেকে খুনী আসামীর মত মনে হচ্ছে তার। নিজের দুর্বলতার বোঝা মাধবলিতার কাঁধে চাপিয়ে সে নিশ্চিন্তভাবে এতকাল কাটিয়ে গেল। চিন্তাটা এতক্ষণ একমুখী ছিল, এবার তার অন্য কথা মনে পড়ল। মাধবীলতা কলকাতার মেয়েদের হোস্টেলে এসে উঠেছিল। তার বিয়ে হয়নি একথা সবাই জানে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের পর যখন তার শরীরে মাতৃত্বের চিহ্ন ফুটে উঠল তখন কি করেছিল সে? হোস্টেলে নিশ্চয়ই তাকে থাকতে দেয়নি। কোথায় আছে এখন মাধবীলতা? কুমারী মেয়ে মা হতে যাচ্ছে–ওর বাবা কখনই তা মেনে নেবেন না। অনিমেষ ছটফট করতে লাগল।

একটু বাদে অফিসার ফিরে এল, চলুন।

অনিমেষ উঠল। এখন ওঠার সময় সমস্ত শরীর নড়বড় করে উঠে। কোমরের হাড়ে ব্যথাগুলো খচখচ করে। হাঁটতে গেলে মাথায় টং টং করে লাগে। বাঁ দিকে একটু হেলে লেংচে লেংচে হাঁটে অনিমেষ। অনেকটা পথ তাকে পার হয়ে আসতে হল। ওর পাশে হেঁটে এলেও অফিসার একবারও সাহায্যের কথা বলল না। কিন্তু অনিমেষ যখন জিরিয়ে নেবার জন্যে থামছিল তখন মৃদুস্বরে জানাচ্ছিল, মহাদেববাবুর ঠিকানাটা বলে দিলেই তো সব গোলমাল মিটে যায়। এত কষ্ট করতে হয় না। অনিমেষ জবাব দেয়নি। আশেপাশের লোকজন, সবাই পুলিশেরই লোক, এদিকে লক্ষ্যই করছে না। এরকম ঘটনা রোজ ওরা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছিল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top