What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

প্রথম বিস্ফোরণ সাতষট্টি সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে, শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়িতে। দলে দলে গরীব, শুকিয়ে যাওয়া কৃষকরা বেরিয়ে এল ঘর চেড়ে বেনামী জমি দখল করতে। জোতদাররা প্রতিরোধ করল বন্দুক হাতে। কিন্তু মানুষ যখন মরিয়া হয় তখন সে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। সে সময় তাকে দাবিয়ে রাখা শক্ত। কৃষকরা ব্যাপক হারে জমি দখল করতে লাগল। জোতদারের হাত শক্ত করল পুলিশ। স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাওয়া গরীব কৃষকের রক্ত ঝরল। তারা চেষ্টা করল পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে, জোতদারকে নিরস্ত্র করতে। কিন্তু বিনিময়ে মহিলা এবং শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা করল পুলিশ। নকশালবাড়ির মাটিতে যে রক্ত ঝরল তার প্রতিবাদ কোন রাজনৈতিক দল কিন্তু গলা খুলল না। যুক্তফ্রন্টে বাস করে মার্কসবাদীরা কিছুটা প্রতিবাদ জানানোর ঝুঁকি নিয়ে চুপ করে গেল। কারণ তখন সারা দেশে একটা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে মার্কসবাদীরা নাকি খুব কট্টর। তাদের মনোভাব জঙ্গী। শক্তি প্রয়োগ ছাড়া অন্য চিন্তা করতে পারে না। ফলত তাদের সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি অন্য শরিক দলের মধ্যে সঞ্চারিত হল। তারা এদের বিরুদ্ধে সরব হল না। কিন্তু এতচেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্টকে বাঁচানো গেল না। পরস্পরকে প্রতিনিয়ত সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করে একটি পরিবার কখনো টিকে থাকতে পারে না।

নকশালবাড়িতে যে আন্দোলনের সূচনা হল তা সেখানেই আপাতদৃষ্টিতে থেমে গেলেও সারা দেশে তার প্রতিক্রিয়া হল ব্যাপক। এই আন্দোলনের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, ত্রিপুরা, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, আসাম ইত্যাদি রাজ্যে ভূমিহীনদের জন্যে জমি দাবী, জোর করে বাড়তি জমি দখলের চেষ্টা, উচ্ছেদ হওয়া বর্গাদাররা মাঠের ফসল কেটে নিতেচেষ্ট করতে লাগল। নকশালবাড়িতেযে রক্ত ঝরেছিল কৃষকের শরীর থেকে তা যেন সমস্ত নিরস্ত্র কৃষকের বুকে ছড়িয়ে পড়ল।

অনিমেষ এতদিন সংবিধানের কাজে ব্যস্ত ছিল। শিলিগুড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ। নকশালবাড়ির আন্দোলনের পর সারা দেশে পুলিশী তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। বেশির ভাগ সময়েই তাকে এবঙ সঙ্গীদের গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হত। একটা ব্যাপারে অনিমেষকে প্রায়ই চিন্তিত করত। এত কাছে নকশালবাড়িতে যে ঘটনা ঘটে গেল তার কোন প্রতিক্রিয়া মধ্যবিত্ত কিংবা শ্রমজীবীদের মধ্যে হচ্ছে না। যেন, এসব করে কৃষকরা জমি পাচ্ছে তাতে আমাদের কি এইরকম প্রবণতা দেখা দিচ্ছিল। অনিমেষরা আজ সারা দেশে ব্যাপকভাবে নকশালবাড়ির সমর্থনে পোস্টার ফেলছে। ছোট ছোট জনসভা করছে। ওরা ধরে নিচ্ছিল এইভাবে ওরা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পারবে।

খুঁটিমারী জঙ্গলের মধ্যে অনিমেষের সাময়িক আস্তানাটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। সিরিল প্রায়ই খবর আনছিল যে স্বৰ্গছেঁড়া অঞ্চলে পুলিশী তৎপরতা বাড়ছে। এখন সারা দেশ গরম। কাগজ খুললেই পুলিশের সঙ্গে নকশালপন্থীদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কথাটা ভাবলে অনিমেষের অবাক লাগে। যেহেতু নকশালবাড়িতে প্রথম বিস্ফোরণ তাই একটা দলের নাম চিহ্নিত হয়ে গেল নকশালপন্থী বলে? অন্ধ্র প্রদেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কেউ নিহত হলে তাকে বলা হয়েছে নকশাল। কেন? অবশ্যই নিজেদের নকশালবাড়ির কৃষকদের উত্তরসূরী বলতেগর্বিত বোধ করার কারণ আছে কিন্তু সমস্ত দেশে যখন বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা চলছে তখন একটা ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে নিজেদের পরিচয় আবদ্ধ করা কেন? এসবই বুর্জোয়া মানসিকতার ফসল কিন্তু তারাও ক্রমশ সেটা মেনে নিচ্ছে।

নির্দেশ এসেছে এই এলাকায় যত ব্যক্তি মালিকানায় বন্দুক আছে তা জোর করে ছিনিয়ে নিতে হবেসেই লিস্ট এখন অনিমেষের হাতে। আজ রাত্রে প্রথম অ্যাকশনে বের হবে সে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটুও উত্তেজনা বোধ হচ্ছিল না। সিরিল এবং সে ছাড়া এই তথ্যটি কাউকে জানানো হয়নি। বিকেল হয়ে যাওয়া এ সময়টায় অনিমেষ একা বসেছিল। বড় বিষণ্ণ লাগে এই সময়টা। তার ওপর জলো বাতাসবইছে। ভুটানের পাহাড় থেকে মেঘ ভেসে আসছে কদিন থেকে। প্রথম বর্ষণ শেষ হবার পর কিছুদিন প্রকৃতি চুপচাপ ছিল। এখন যে বর্ষা নামবে তা চলবে একটানা। সময়টা অবশ্যই অকশনের পক্ষে উপযুক্ত।
 
সন্ধ্যের খানিক বাদে জুলিয়েন এল। সঙ্গে সিরিল। মালবাজার মেটেলি অঞ্চলে কাজ করছে জুলিয়েন। আজ ওর আসবার কথাও নয়। অনিমেষ হাত মিলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ এখানে?

কিছু টাকার দরকার। কিছু ভাল মাল আসছে পাকিস্তান থেকে।

কি আছে?

যা আছে তাতে একটা থানা উড়ে যাবে।

অনিমেষ বলল, ভালই হল। চলুন, দেখি কপালে কি আছে আজ। তারপর সে জুলিয়েনকে আজকের পরিকল্পনার কথা খুলে বলল। সিরিল চুপচাপ শুনছিল, শেষ হলে বলল, আজ রাত্রেই এখান থেকে হাওয়া হয়ে যেতে হবে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলেছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কার গাড়ি?

পানিরামেরই। ওর গ্যারেজে তিনটে জিপ আছে। চাবি কার কাছে থাকে আমি জেনে এসেছি।

জুলিয়েন বলল, কাজ শেষ হলে কোথায় যাওয়া হবে?

শিলিগুড়ি চলে যাব।

মোটেই তা করতে যাবেন না। শিলিগুড়ি এখন খুব গরম। রাত্রে জিপ দেখলে পুলিশ ছাড়বে না।

কিন্তু একটা বড় শহরে গিয়ে গা ঢাকা না দিলে মুশকিল হবে। শিলিগুড়ি ছাড়া আর কিছু তো মাথায় আসছে না।

জিপ নিয়ে সোজা নাগরাকাটায় চলে যান। সেখানে রাতটুকু কাটিয়ে ভোরের ট্রেন ধরে হাসিমারায় ফিরে আসবেন। ওখান থেকে ভুটানের বর্ডার মিনিট পনের রাস্তা। পুলিশ জিপ খুঁজে পেলে ভাববে শিলিগুড়ির দিকেই গিয়েছেন। আবার উল্টো রাস্তায় ফিরে যেতে পারেন একথা ওদের মাথায় ঢুকবে না।

নাগরকাটায় অনিমেষ কখনো যায়নি। হাসিমারায় গিয়েছে ওখান থেকে ফুন্টশিলি খুব কাছে। পাশেই নদীর ওপর বিরাট বাধের কাজ হচ্ছে। সেখানে ওদের কিছু লোক আছে। আস্তানা পেতে অসুবিধে হবে না। জুলিয়েনের পরিকল্পনা তাই ওর খুব পছন্দ হল। লোকটির মাথায় খুব স্বাভাবিক ব্যাপারটা চমৎকার খোলে।

রাত বারোটায় একদম মৃত হয়ে যায় স্বৰ্গছেঁড়া। কোথাও সামান্য শব্দ নেই। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অনিমেষ আর জুলিয়েন স মিলগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল। সিরিলকে বলা হয়েছে মেছুয়া পুল থেকে স্কোয়াডের বাকী সবাইকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেখানে চলে আসতে। অনিমেষের একটুও উত্তেজনা আসছিল না। সে একবার পেটের ভেতরে গোটা অস্ত্রটা দেখে নিল। সুবাসদার দেওয়া জিনিসটা খুব ভাল। একদিন বৃষ্টির রাত্রে সে নিয়ম কানুন মেনে পরীক্ষা করেছিল। হাত কাঁপেনি কিন্তু একটি গুলী ছোঁড়ার অভিজ্ঞতা ছাড়া তার কোন সম্ভল নাই। বরং জুলিয়েনের হাতের ঝোলার মধ্যে যে মালগুলো আছে তা অনেক নিরাপদ। অ্যাকটিভ করে ছুঁড়ে দাও। একসঙ্গে অনেকটা জায়গা উড়ে যাবে।

অনিমেষ চার পাশে তাকাল। সামনেই ওদের স্কুল। এখন অবশ্য নামেই স্কুল, আসলে কিছু ভাঙাচোরা টিনের ঘর আর পূজো মন্ডপ। আসল স্কুল হচ্ছে ওপাশে মাঠের গায়ে। কিন্তু এখানেই ভবানী মাস্টার ওদের পড়াতেন। সেই সাত চল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট এই স্কুলের সামনে সে জাতীয় পতাকা তুলেছিল। কানের পর্দায় এখনও বন্দেমাতরম চিৎকারটা মাখামাখি হয়ে আছে। অনিমেষ হাসল, সে সব শৈশব স্মৃতি সুদৃশ্য রাঙতায় মোড়া যেন।

ছায়ায় ছায়ায় সিরিল বেরিয়ে এল, রেডি।

জুলিয়েন বলল, তুমি চলে যাও আগে। হাওয়া দেখলে সিটি দেবে। আমরা আসছি।

মোট আটজন। অনিমেষ এদের প্রত্যেককে চেনে। একটা সুবিধে এই যে এদের কারোর নাম পুলিশের খাতায় নেই। কিন্তু ছেলেগুলোর মুখ চোখ দেখে অনিমেষ বুঝতে পারছিল এরা ঠিক স্বাভাবিক নেই। সে ওদের সামনে গিয়ে বলল, কমরেডস আজ আমরা যা করতে যাচ্ছি তা এই দেশের জন্যেই। মনে কোন সংকোচ রাখবেন না কেউ।

ছেলেগুলো কোন কথা বলল না। অনিমেষ জানে সিরিল ওদের যা বোঝানোর বুঝিয়েছে। দুটো দলে ভাগ হয়ে ওরা রাস্তা পার হল। বৃষ্টির জল মাথায় জমছে। ভাগ্যিস এখন মেঘ ডাকছেনা; কারণ বিদ্যুৎ ঝলসালে অসুবিধেয় পড়তে হত।
 
চৌমাথায় এসে ওরা পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। পানিরামের বাড়ি দেখে যাচ্ছে। নিঝুম এই রাতে সেখানে একটাও আলো নেই। এই সময় সিটি বাজল। তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আচমকা কানের পর্দায় স্ক্রুর মত পেচিয়ে ঢুকে যেতেই অনিমেষ সোজা হয়ে দাঁড়াল।

পাঁচিলটা কাঁধ বরাবর। ওরা সবাই ডিঙ্গিয়ে এপারে চলে এল। গেটে ভেতর থেকে তালা দেওয়া। একজন একটা ছোট লোহার রডের চাপ দিয়ে তালাটাকে খোলার চেষ্টা করতেই শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর ডেকে উঠল ভেতরে। ততক্ষণে তালা খুলে গেছে। ওরা চট করে বাড়ির দেওয়ালের দিকে সরে এল। কুকুরটা তখন প্রবল শব্দে ডেকে যাচ্ছে। একটা মানুষের গলা শোনা গেল। কুকুরটাকে ধমকাচ্ছে।

কিন্তু আরো মরিয়া হয়ে উঠল ওর গলার শব্দ। অস্বাভাবিক ব্যবহার করে লোকটা ঝুঁকে পড়ে বাইরের দিকটা দেখতে চেষ্টা করে হাঁক, দারোয়ান দারোয়ান!

গেটের ডান দিকে দরজা বন্ধ একটা ছোটঘর থেকে উত্তর এল, জি সাব।

শালা শূয়ারকি বাচ্চা! রাত ভোর নিদাতা। দেখো বাহার মে কেয়া হুয়া।

অনিমেষ দেখল ছোট ঘরের দরজাটা খুলে গেল। একটা মাঝবয়সী লোক সন্দেহ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চার পাশ দেখতে লাগল। অনিমেষরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চট করে নজর পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু অনিমেষ চট করে ভেবে নিল, লোকটাকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। ওপরের লোকটা তখনও ঝুঁকে আছে বারান্দায়। কুকুরের চিৎকারও কমেনি। গেটের তালা যে ভাঙ্গা হয়েছে দারোয়ান বোধ হয় ভাবতে পারেনি কারণ সেটা ফাঁক করা ছিল না। একটু অসতর্ক হয়েই লোকটা ঘুরে দেখার জন্য এপাশে এল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ওর খুব অস্বচ্ছন্দ হচ্চিল, তাছাড়া রাত দুপুরে বিছানা ছেড়ে উঠে আসার আলসেমিও হয়তো চোখে জড়িয়ে ছিল। অনিমেষরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে লোকটাকে লক্ষ্য করছিল। কাছাকাছি আসতেই সিরিল আচমকা ওর মাথায় আঘাত করল। একটাও শব্দ বের হল না কাটা কলাগাছের মত লোকটা মাটিতে নেতিয়ে পড়ল। ওরা দ্রুত শরীরটাকে কার্নিশের নীচে নিয়ে এল যাতে ওপর থেকে এ ব্যাপারটা দেখা না যায়।

তখনি ওপর থেকে চিৎকার এল, দারোয়ান সব ঠিক হ্যায়? কোন উত্তর না পেয়ে লোকটা খিঁচিয়ে উঠল আরে এ হারামী, কাহা হ্যায় তুম?

অনিমেষ ইশারায় সবাইকে চুপ করে থাকতে বলে গুটি গুটি করে বারান্দায় উঠে এসে সদর দরজার পাশে দাঁড়াল।

কিছুক্ষণ হাঁকাহাঁকির পর বোধ হয় লোকটার মনে সন্দেহ ঢুকল। কুকুরটাকে টানতে টানতে সে ভেতরে ঢুকে গেল। জুলিয়েন অনিমেষের পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ওরা অ্যালার্ট হবার আগে আমাদের ঢোকা উচিত।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। ওরা কিছুই আন্দাজ করতে পারবে না। ওয়েট করুন।

ভেতরে তখন অনেকগুলো গলা কথা বলছে। তারপর পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অনিমেষরা ততক্ষণে প্রস্তুত। বিরক্ত গলায় কিছু বলতে বলতে কেউ দরজাটা খুলতেই কুকুরটা তীরের মত ছিটকে বেরিয়ে এল। কিন্তু বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছবার আগেই আর্তচিৎকার করে বেচারাকে শুয়ে পড়তে হল। সিরিলের সঙ্গীদের মধ্যে একজন এত চটপটে হাতে কাজ শেষ করতে পারবে তা অনিমেষও ভাবতে পারেনি। ফলে যে লোকটা দরজা খুলেছিল সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। অনিমেষ লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, পানিরাম কোথায়? তিন চারবার কথা বলার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত লোকটা আঙ্গুল দিয়ে ভেতরটা দেখিয়ে দিল।
 
সময় নষ্ট করল না অনিমেষরা। লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে অন্দরে ঢুকে পড়ল। বেশ বড় বাড়ি। চারপাশের ঘরগুলোর কিছু মুখ কৌতূহলে বাড়িয়ে হকচকিয়ে গেল।

অনিমেষ চিৎকার করল, আপনারা সবাই বেরিয়ে আসুন নইলে এই লোকটিকে মেরে ফেলা হবে। অস্ত্রটি বের করে লোকটির শরীরে ঠেকাল সে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। ম্যাজিকের মত কাজ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। পিল পিল করে পাঁচ ছয় জন নারী পুরুষ জড়সড় হয়ে ঘরের কোণায় এসে দাঁড়াল। সিরিল গিয়ে ঘরগুলো দেখে এল। এসে ঘাড় নাড়ল, কেউ নেই।

ঠিক তখনই একটা গুলীর শব্দ হল আর অনিমেষ দেখল ওদের দলের একটি ছেলে ছিটকে পড়ে গেল। অনিমেষ দ্রুত মুখ তুলে একটা মোটা লোককে দেখতে পেল। দুই হাতে বন্দুক নিয়ে আবার টিপ করছে। কিছু বোঝার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে গেল ওপরে। জুলিয়েনের হাত শূন্য থেকে নেমে আসার আগেই দোতলার কাঠের রেলিং-এর একাংশ খসে গেল, বন্দুকধারী উবু হয়ে বসে আর্তনাদ করতে লাগল।

দুজনকে এদের পাহারায় রেখে অনিমেষরা ওপরে উঠে এল। সিরিল চটপটে হাতে লোকটিকে তুলে ধরল, কেয়া পানিরামজি, কেয়া হুয়া?

সর্বাঙ্গে রক্ত ঝরছে হাতের বন্দুক পড়ে গেছে, লোকটা তখনও গোড়াচ্ছে। মরে যাওয়ার মত আহত হয়নি বোঝা যায়। অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, সে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করল, গুলী করলেন কেন?

ডাকু–উ উ পানিরাম তখনও কাঁপছিল।

জুলিয়েন বলল, আর দেরী করা ঠিক হবে না। শব্দ পেয়ে লোকজন ছুটে আসতে পারে। চটপট–জলদি।

বেশিক্ষণ সময় লাগল না দুটো বন্দুক হাতাতে। পানিরামের শোয়ার ঘরের সিন্দুকে টাকার স্তূপটা পাওয়া গেল। দুটো বাজারের থলেতে পুরে নিল সেগুলোকে। সিরিল সোনার গয়না গুলোর দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল নিষেধ করল অনিমেষ, ওগুলো নিয়ে ঝামেলা বাড়বে। তুমি গাড়ির চাবি যোগাড় কর।

এক লাফে নীচে নেমে গেল সিরিল। অনিমেষ দ্রুত বারান্দায় গিয়ে বাইরের দিকটা দেখল। আশেপাশে লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। গুলীর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে এ তল্লাটের মানুষের। আর এখানে থাকা যায় না।

ভেতরের বারান্দায় আসতেই জুলিয়েনের গলা পাওয়া গেল, আজ বদলা হল পানিরামবাবু। এতদিনে যে রক্ত শুষেছেন গরীব মানুষের তার হিসেব মেটালেন আজ। কথাটা শেষ করে ইঙ্গিত করতেই সিরিলের সেই সঙ্গীটি যে কুকুরটাকে ঠান্ডা করেছিল তার হাত চলল। অনিমেষ দেখল বসে থাকা বিরাট শরীরটা লাশ হয়ে গেল।

অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জুলিয়েন হাসল, উপায় ছিল না। শালা আমাদের চিনতে পেরেছিল। বাঁচিয়ে রাখলে বেশি দাম দিতে হতো।

অনিমেষ আবিষ্কার করল এই ছারপোকাটির মৃত্যু চোখের ওপর দেখে তার একটুও খারাপ লাগল না। বরং অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল নার্ভগুলো। চট করে মনে পড়ে গেল নীচের মাটিতে ওদের একজন শুয়ে আছে। ওরা এবার নীচে নেমে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়াল। এক পলকেই বোঝা যায় প্রাণ গুলী লাগা মাত্রই চলে গেছে। বুকের ওপর অনেকটা রক্ত মাখামাখি হয়ে আছে। জুলিয়েন নীচু গলায় নির্দেশ দিতেই ছেলেরা শরীরটাকে তুলে নিল। ঘরের কোণায় দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, দশ মিনিটের মধে যে ঘর থেকে বের হবে তাকেই পানিরাম বানিয়ে দেব।

ওরা বারান্দায় এসে দেখল অন্তত জনা পনের লোক গেটের বাইরে জমা হয়ে গেছে। দু-একজন গেট টেনে ঠেলে ঢুকব ঢুকব করছিল, ওদের দেখে কি করবে বুঝতে পারছে না। যদিও এখানে বেশ অন্ধকার, মুখের আদল পরিষ্কার দেখা যায় না। তবু কোন সুযোগ নিতে চাইল না অনিমেষ। শূন্যে মুখ করে গুলী ছুড়ল আচমকা। সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল জটলাটার মধ্যে। কে আগে পালাতে পারে সে চেষ্টা চলল এবার।
 
পাশের গ্যারেজ থেকে একটা জিপ নিয়ে সিরিল তখন প্রায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, দুটো গাড়ি পাওয়া গেল না। একটার আবার ইঞ্জিন খারাপ।

ওরা সন্তর্পণে মৃত ছেলেটিকে জিপের পেছনে দুই সিটের মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে উঠে বসল এক এক করে। জায়গা কম হচ্ছিল কিন্তু তা নিয়ে কেউ কোন কথা বলল না। জিপ চলতে আরম্ভ হবার আগে অনিমেষের মনে পড়ে গেল। এক মিনিটি দাঁড়াতে বলে সে লাফিয়ে নেমে পকেট থেকে কালো চক বের করে সাদা দেওয়ালের ওপর দ্রুত হাতে লিখল, নকশালবাড়ি লাল সেলাম। গরীব মানুষের শত্রু পানিরামরা সাবধান।

চটপট লিখে জিপে উঠতেই জুলিয়েন বলল, হাতের লেখার প্রমাণ রেখে গেলেন।

অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলল, আজ থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল যখন তখন সারা শরীর দিয়েই তো প্রমাণ রাখছি।

গেট পার হবার সময় জুলিয়েন উঠে দাঁড়িয়ে ঝোলা থেকে বস্তুটি বের করে পানি রামের বাড়ির ওপর ছুঁড়ে মারল। প্রচণ্ড শব্দে স্বৰ্গছেঁড়া কেঁপে উঠতেই ওরা রাস্তায় এসে পড়ল। একটি মানুষকেও কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে না। জিপ ছুটল নাগরাকাটার দিকে। অনিমেষ একা পা বাইরে রেখে সামনের সিটে কোন মতে বসে আছে। তার পাশে জুলিয়েন। জুলিয়েনের পায়ের নীচে থলে ভরতি টাকা। পেছনের একটি ছেলের হাতে বন্দুক দুটো।

কেউ কোনো কথা বলছিল না। মুখে কোন শব্দ কেউ না করলেও প্রত্যেকেই মৃতদেহটির কথা ভাবছিল। যাবার সময় সে সবার মতই সহজভঙ্গীতে হেঁটে গিয়েছিল। এখন তার শরীর নিথর, জিপের মেঝেতে থলের মতই পড়ে আছে। প্রথম অ্যাকশনেই একটা বড় দাম দিতে হল। অনিমেষ এই কুড়ি একুশ বছরের ছেলেটিকে আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু ছেলেটির কথা যত ভাবছিল সে তত তার ভেতরে ক্ষরণ হচ্ছিল। ওর সঙ্গীরাও এখন চুপচাপ। ডানদিকে বানারহাটকে রেখে ওর ডায়না নদীর উপর উঠে আসতেই অনিমেষ সিরিলকে গাড়িটা থামাতে বলল। চুপচাপ সে নীচের নদীটার দিকে তাকাল। অনেকটা জায়গায় চর পড়ে আছে। মাঝখানে সরু ফিতের মত জলের রেখা। সে ফিরে এসে বলল, গাড়িটাকে ব্যাক করে নদীর বেডে নিয়ে যাওয়া যায় না।

হ্যাঁ, ওপাশে একটা রাস্তা আছে।

তাই করুন।

ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সিরিল ধীরে ধীরে গাড়িটা পিছু নিয়ে গেল। অনিমেষ সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকাল, সে যা ভাবছে এরাও কি তাই ভেবেছে। নাহলে কি কারণে জিপটাকে নিচে নিয়ে যেতে বলল তা কেউ জিজ্ঞাসা করল না কেন? আঘাত সব মানুষের ভাবনা এক খাতে বইয়ে দেয়?

ওরা নিঃশব্দে নীচে নেমে এল। বড় বড় বোলন্ডারের পাশ দিয়ে সরু প্যাসেজ দিয়ে জিপটাকে কোন মতে নদীর ওপর নিয়ে এল সিরিল। ছেলেটা খুব ভাল গাড়ি চালায়। ওরা সেই আবছা অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে ঠিক ব্রীজের নীচে একটা নরম জায়গা পেল। অনিমেষ দেখল জায়গাটা অনেকটা বালি, পাথর-টাথর বড় একটা নেই।

সিরিল গাড়ি থেকে নেমে বলল, আমরা সবাই একমত তো?

সবাই জিজ্ঞাসার চোখে তাকাতেই সিরিল খানিক ইতস্তত করল, সোমবার ডেডবডি ওর মায়ে কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা।

জুলিয়েন বলল, অসম্ভব। সেটা করলে পুরো দল ধরা পড়ে যবে।

অনিমেষ সিরিলকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ইচ্ছে?

হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সিরিল। সবাই চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। অনিমেষ বুঝতে পারছিল এদের অনেকের কান্নাই সিরিল প্রকাশ্যে কাঁদছে। অনেক চেষ্টার পর নিজেকে শান্ত করল সিরিল, শুধু আমার কথা শুনে সোমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমি ওর মায়ের সামনে কখনও যেতে পারব না। ঠিক আছে এখানেই হোক।

বালি নরম বলে অসুবিধে হল না। ওরা সবাই মিলে হাত চালাল। জিপের মধ্যে একটা ছোট ত্রিপল পাওয়া গেল। গর্তটা ফুট চারেক খুঁড়তে প্রায় দেড় ঘন্টা খরচ হয়ে গেল। এখন এখানে কোন শব্দ নেই। নদীর দুধারে জঙ্গল। মাঝে মাঝে এক একটা ভারী ররি ওপরের ব্রিজ দিয়ে হু হু করে ছুটে যাচ্ছে। আশে পাশে কোন জনবসতি নেই। ঠিক ব্রিজের নীচে থাকায় কোন চলন্ত গাড়ির নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এক সময় খুঁড়তে খুঁড়তে জল বেরিয়ে এল। খোঁড়া বন্ধ করে জুলিয়েন ছেলেদের বলল কিছু মাঝারি সাইজের বোলডার জড়ো করতে। তারপর গাড়ি থেকে ত্রিপলটা বের করে গর্তের মধ্যে সুন্দর করে বিছিয়ে দিল। ত্রিপলের একটা দিক অনেকখানি বাইরে বের করে রাখল সে।

সিরিল এবার তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে জিপ থেকে সোমবার শরীরটাকে পরম যত্নে বয়ে নিয়ে এল সেখানে। এই পাতলা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল ছেলেটার মুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক। যেন গভীর ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে সে।

অনিমেষ জানে না এই কালো ছেলেটি রাজনীতি বুঝতো কিনা। লেখাপড়া কতদূর শিখেছে, আদৌ শিখেছে কিনা তাও তার জানা নেই। কিন্তু একটা নতুন ভারতবর্ষ তৈরি করার যে স্বপ্ন এখন তাদের চোখে এ তার শরীক ছিল। কিংবা এসবের কিছুই সে তেমন করে জানতো না। বন্ধুর কথায় হয়তো অ্যাডবেঞ্চারের স্বাদ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু অনিমেষের মনে হল আসন্ন বিপ্লবের ভিত তৈরি করতে সে একটা ইট পাতল।
 
জুলিয়েনের মাথা ঠিক ছিল। চটপটে হাতে সে ছেলেটির পকেট দেখে নিল। একটা চারমিনারের প্যাকেট, দেশলাই আর গোটা তিনেক টাকা ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু বুকের ওপর নেতানো ক্রশ দেওয়া চেনটাকে সযত্নে খুলে নিয়ে সে সিরিলের হাতে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিড় বিড় করে ঠোঁট নাড়ল। তারপর কপালে, দুই কাঁধে হাত ছুঁইয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ সঙ্গীতের দিকে এগিয়ে এল, কমরেডস। এটা অত্যন্ত বেদনার যে আমাদের একজন সাথী আজ প্রথম অ্যাকশনের দিনেই শহীদ হলেন। আসন্ন বিপ্লবের সূচনায় এই মৃত্যু আমাদের যদিও নিঃসঙ্গ করল কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদের উদ্যমকে আরো শক্তিশালী করবে। যা সত্য তা আমাদের মানতেই হবে। আসুন আমরা সবাই কমরেড সোমরার কাছে শপথ করি, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমরা যেন তার আত্মার অপমান না করি।

সবাই এসে সোমরাকে ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসল। সেই নির্জন মধ্যরাতের নদীর চরে শিরশিরে বাতাস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। প্রত্যেকের হাত সোমরার শরীর স্পর্শ করতেই অনিমেষের মনে হল এখনও তাপ আছে মৃতদেহে। অনিমেষ গাড় গলায় বলল, আপনারা আমার সঙ্গে উচ্চারণ করবেন যতদিন ভারতবর্ষের বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস না হয় ততদিন আমরা বিশ্রাম করব না।

খুব গম্ভীর বিষণ্ণ কিন্তু দৃঢ় গলায় শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হল। তারপর অত্যন্ত যত্নে সোমরার শরীর গর্তের ভেতরে ত্রিপলের ওপর শুইয়ে দিয়ে ত্রিপলের অন্য প্রান্তটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হল। সামান্য বালিছড়িয়ে দিয়ে এক এক করে বোলডারগুলো সাজানো হল শরীরের ওপর। এবার প্রত্যেকে বালি চাপিয়ে দিতে লাগল গর্তে। জুলিয়েন চাপা গলায় বলল, কমরেড সোমরা যুগ যুগ জিও। ওরা সাড়া দিল যুগ যুগ জিও। নকশালবাড়ি লাল সেলাম–লাল সেলাম, লাল সেলাম।

কমরেড সোমরা লাল সেলাম–লাল সেলাম, লাল সেলাম।

সেই রাত্তিরে কতগুলো বুকের গভীর কষ্টের মধ্যে ভীষণ উত্তাপ জন্ম নিচ্ছিল। প্রতিটি শব্দ যেন জ্বলন্ত মশালের মত ওদের সমস্ত শরীরে সেই তাপ ছড়াচ্ছিল। এক সময় যখন সেই গর্তটির কোন অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছিল না তখন ওরা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল।

নাগরাকাটা স্টেশনের মাইল খানেক আগেই ওরা জিপটাকে বড় রাস্তা থেকে ডান দিকের জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিল। সিরিল চাইছিল ওটাকে জ্বালিয়ে দিতে কিন্তু জুলিয়েন নিষেধ করল। আগুন জ্বাললেই অনেকদূর থেকে মানুষ আকৃষ্ট হবেই। তাছাড়া ভোর হয়ে আসছে। নিজের অস্তিত্ব সবাইকে জানিয়ে দেওয়া কখনই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো দু-একদিনের মধ্যে জিপটা কারোর নজরে নাও পড়তে পারে।

যতটা সম্ভব জিপ থেকে হাতের ছাপ মুছে ফেলা হল। সিরিল ইঞ্জিনের তারগুলো ছিঁড়ে রেখে দিয়ে দাঁত বের করে হাসল। অনেকক্ষণ পরে তাকে স্বাভাবিক চেহারায় দেখে অনিমেষের ভাল লাগল। মুশকিল হল বন্দুক দুটো নিয়ে। ওগুলো প্রকাশ্য বয়ে নিতে দেখলে অনেকের সন্দেহ হতে পারে। জুলিয়েন পথ বাতলালো। নাগরাকাটায় ঢোকার মুখে ওর পরিচিত এক ডেরায় বন্দুক জমা রেখে যাবে। বিশ্বাসী লোক, প্রয়োজনে পেতে অসুবিধে হবে না। টাকাগুলো আপাতত ব্যাগেই থাক।

কিন্তু অনিমেষ এত টাকা কোথাও রেখে যেতে রাজী নয়। টাকার পরিমাণ কত তাও জানা নেই। এখন গুণে দেখারও সময় নেই। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল টাকা নিয়ে জুলিয়েন একাই চলে যাবে। প্রয়োজনটা আপাতত ওর মারফত জানতে পেরেছিল অনিমেষ। মালপত্র কেনার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি হাতবদল হয় ততই মঙ্গল। জুলিয়েন অবশ্য আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে নিল। ঠিক হল নাগরাকাটা থেকে দলটা আপাতত ভেঙ্গে যাবে। ঠিক দশ দিন পরে ফুন্টশিলিং-এ সবাই দেখা করবে। জায়গাটা ঠিক করে নেওয়া হল।
 
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট দল ভাগ করে ওরা হাঁটা শুরু করল। নাগরাকাটার মুখে এসে জুলিয়েন অনিমেষের দিকে হাত নাড়ল। তারপর বাঁ দিকে নেমে গেল সঙ্গীকে নিয়ে। ওদের দুজনের হাতে দুটো বন্দুক আর দুটো ব্যাগ। লোকটার সাহস আছে প্রচণ্ড। জঙ্গল ছাড়ার আগে সে প্রস্তাব দিয়েছিল এখন যেহেতু কারোর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের কোন উপায় নেই তাই প্রয়োজনের খরচ চালাতে অর্থের প্রয়োজন হবেই। সেক্ষেত্রে পানি রামের টাকা থেকে প্রত্যেককে একশ করে টাকা দিয়ে দেওয়া হোক। অনিমেষের এতে সায় ছিল না। সাধারণ ডাকাতির পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে যেন ব্যাপারটা। যদিও তার নিজের কাছে সামান্য কিছু অর্থ আছে কিন্তু এ কথা ঠিক যে, অন্যান্যদের পকেটে কিছু নাও থাকতে পারে। তবু ওখান থেকে টাকা নেওয়াতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু জুলিয়েন বোঝালো, আমরা তো যুদ্ধের জন্যেই টাকাটা নিচ্ছি। যদি শুধুমাত্র টাকার অভাবেই কেউ ধরা পড়ি তাহলে বিপ্লবটা করবে কে? আমরা বিলাসের জন্য এই টাকা নিচ্ছি না। প্রয়োজন মেটাতে নেওয়া বন্দুকের গুলী কেনার মতই স্বাভাবিক।

সেই মত কিছু টাকা সে সবাইকে দিয়েছিল। ব্যাগের টাকার পরিমাণ দেখে বোঝা গিয়েছিল, যে টাকাটা ওরা খরচের জন্য তা মূল টাকার দুশো ভাগের এক ভাগও নয়।

সকাল যে ট্রেনটা এল সেটা একদম ফাঁকা। অনিমেষ আর সিরিল অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসল। সিরিল টিকিট কাটতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে নিষেধ করল অনিমেষ। এই ভোরে কাউন্টারে গেলে রেল কর্মচারীটি মনে রাখবে তাদের। মাত্র দুজন লোক চাদর মুড়ি দিয়ে এক কোণায় ঢুকছিল অনিমেষ ঠিক করল সামনের কোন স্টেশনের টিকিট কেটে নেবে। এসব ট্রেনে চেকার বড় একটা ওঠে না।

জানলার ধারে বসার পর প্রথম ক্লান্তি বোধ করল অনিমেষ। একটা পুরো রাত কিভাবে উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেছে টের পাওয়া যায়নি। এখন শরীরে ভার বোধ হচ্ছে। সিরিল ট্রেনে উঠেই একটা বেঞ্চিতে টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছিল। এর মধ্যেই তার ঘুমন্ত শরীর থেকে মৃদু নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। মুখ শিশুর মত শান্ত। একে দেখলে কে বলবে যে গতরাতে এক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়েছে। কিন্তু ক্লান্তিবোধ করলেও অনিমেষের ঘুম আসছি না। জানলার বাইরে পৃথিবীটা একটু একটু করে ফরসা হয়ে কচি চেহারা নিয়েছে। নরম কলাপাতার মত রোদ জঙ্গলের শরীরে। দুপাশে গাছ গাছালি আর চা বাগান রেখে ট্রেন ছুটছিল হাসিমারার দিকে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।

যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। আজ অনিমেষরা যেমন সলতে পাকানোর কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং ভারতবর্ষের সবদিকেই এ রকম ছোট ছোট দল এই রকম ঘটনা ঘটচ্ছে। এভাবে কতগুলো রক্ত চোষা বাদুড়কে সরিয়ে দিতে পারলেই ব্যবসায়ীরা ভয় পাবে। আর নির্যাতিত জনসাধারণ বুঝতে পারবে তারা ওদের বন্ধু। অবশ্যই প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে তারা। এইসব ছোট ছোট মশালগুলো একসময় বিরাট অগ্নিকুন্ডের চেহারা নেবে সারা দেশ জুড়ে। নির্যাতিত মানুষের সেই পথে নেমে আসা স্রোতে ভেসে যাবে বুর্জোয়া ফ্যাসিবাদীর দুর্গ। এ সময় যদি কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো তাদের সঙ্গে আসতো তাহলে বোধ হয় ব্যাপারটা আরো দ্রুততর হতো। কিন্তু অনিমেষ মাথা নাড়াল এই ভাল, জনসাধারণ এদের চেহারা আরো ভাল করে চিনুক। তাহলে তাদের শক্তি আরো জোরদার হবে।

আজ এই মুহূর্তে স্বৰ্গছেঁড়ায় কি হচ্ছে অনুমান করতে চাইল সে। ওই ছোট্ট শান্ত জায়গায় মানুষগুলো তাদের স্মৃতিতেও এমন ঘটনার কথা খুঁজে পাবে না। পনিরামের মৃত্যুর খবর পেয়ে ওরা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে চা বাগানের যেসব গরীব শ্রমিক গলায় ফাঁস পরেছিল তারা নিশ্চয় স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। অনুমান করা যায় এখন পুলিশ ছুটে গিয়েছে বানারহাট থেকে। দলে দলে মানুষ এসে ভিড় করেছে পানিরামের বাড়ির সামনে। ডাকাতির গল্প মুখে মুখে ছড়াচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে লেখাগুলোও পড়ছে লোকে। যদি কেউ তাদের চিনে ফেলে পরোয়া নেই। অন্তত ওই লেখাগুলো স্বৰ্গছেঁড়ার গরীব কুলি মজুরদের মনে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। তারা যদি বুঝতে পারে অনিমেষরা ওদের ভাই তাহলে আর কিসের ভয়।
 
হাসিমারায় বসে কলকাতার খবর পাওয়া মুশকিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলের খবর আসতে লাগল। সমস্ত দেশ একটু একটু করে নকশালবাড়ি হয়ে উঠছে। বীরভূম মেদিনীপুর চব্বিশ পরগণা তো বটেই, খোদ কলকাতায় এখন পুলিশের সঙ্গে সংগ্রাম চলছে। বেলঘরিয়া যাদবপুর বেলেঘাটার কিছু কিছু জায়গা প্রায় মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। রেডিও শুনলে অবশ্য মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এই সব ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে সমাজবিরোধীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। যে খবরটা সবচেয়ে আনন্দের তা হল সাধারণ মানুষ নকশালপন্থীদের জন্যে মৌন সমর্থন রাখছে। ঘর ছাড়া ছেলেগুলোকে আশ্রয় বা খাবার দেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই প্রশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

সাধারণ মানুষ এখনও সক্রিয়ভাবে বিপ্লবে যোগ দেয়নি। কিন্তু এভাবে যদি এগিয়ে যায় তাহলে তাদের দরজা খুলবেই। স্বৰ্গছেঁড়ায় এর মধ্যে কতকগুলো মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে বলে খবর এসেছে। পুলিশ নাকি পানিরামের হত্যার বদলা নিতে ওই অঞ্চলে চিরুনি অপারেশন চালিয়েছে। ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে। কিন্তু ওদের কাউকে পুলিশ ধরতে পারেনি। তবে খুঁটিমারীর জঙ্গলের ডেরাও পুলিশ আবষ্কিার করেছে। এই মুহূর্তে অনিমেষ সিরিল এবং জুলিয়েনকে পুলিশ গরুখোঁজা খুঁজছে। স্বৰ্গছেঁড়ার ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে গেছে খুব কিন্তু সাধারণ মানুষ যে স্বস্তি পেয়েছে তা হাটে বাজারে গেলেই বোঝা যায়।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হল অনিমেষের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার পর পুলিশ চা বাগানে গিয়ে ছিল। মহীতোষকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কি কথাবার্তা হয়েছে অনিমেষ খবর পায়নি তবে থানা থেকে ফিরে এসে মহীতোষ লম্বা ছুটি নিয়ে ছোটমাকে সঙ্গে করে জলপাইগুড়িতে চলে গেছেন। কথাটা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অনিমেষ। এত কাছাকাছি দীর্ঘকাল থেকেও সে বাবার সঙ্গে দেখা করেনি। করেনি যাতে ওরা না জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই হল। অনিমেষ এখানেই ছিল এবং পানিরাম হত্যার সঙ্গে জড়িত জেনে বাবার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? খুবই সামান্য সময় অনিমেষ তারপর ব্যাপারটাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করল।

নদীর ওপর তাঁবু পেতে বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে। অনিমেষের আপাতত আশ্রয় এখানেই। ওর বয়সী যে ছেলেটি কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করছে তার সঙ্গে দলের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগে। আশ্রয় চাইতে সে একটুও আপত্তি করেনি। শুধু বলেছিল, সহজ হয়ে ঘোরাফেরা করুন। নদীর বেডে পুলিশ আসবে না। আমি বলব আপনি আমার মাসতুতো ভাই। সিরিলকে সেই কাজে লাগিয়েছিল। কুলিরা মাথায় করে যে পথ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার তদারকির কাজ। ফলে এখানে এসে আর সবার সামনে সিরিলের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। যা কিছু খবর ওই ছেলেটির মাধ্যমেই পাচ্ছে অনিমেষ। একদম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এই ছেলেটির বুকে উত্তাপ আছে, নাম করুণাসিন্ধু। তবু এর মধ্যে একদিন শিলিগুড়িতে গেল অনিমেষ। করুণাসিন্ধু নিষেধ করেছিল, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে যখন তখন যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু এভাবে হাত পা গুটিয়ে নদীর উপর তাঁবুর ভেতরে ইঁদুরের মত লুকিয়ে বসে থাকতে আর ভাল লাগছিল না। পরবর্তী কাজকর্মের ব্যাপারে কথা বলা দরকার। সমচিন্তাযুক্ত দলগুলো এখন একত্রিত হয়েছে কিনা। আন্দোলনের নেতৃত্ব এখন কোন যোগ্য হাতে গিয়েছে কিনা পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা নিয়ে একটা সুষ্ঠু ধারণায় আসা হয়েছে কিনা–এইসব জানতে আগ্রহ হচ্ছিল তার। একজন পানিরামকে হত্যা করে সেই তল্লাটের কিছু মানুষের আশীর্বাদ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু সেখানেই শেষ কথা নয়। আশেপাশে তাকালে মনে হয় না, সাধারণ মানুষ তাদের বিপ্লব নিয়ে তেমন ভাবছে। একথা ঠিক, একদিনে সেটা সম্ভবও নয় কিন্তু তার আয়োজন করা দরকার।
 
আকাশে মেঘ করেছিল। তাঁবুতে বসে চিঠি লেখা শেষ করল অনিমেষ। নাম সই করল না, কেউ চিঠিটা পড়লে রাজনীতির গন্ধ পাবে না। কিন্তু যাকে চিঠি লিখছে সে বুঝবে। মাধবীলতাকে লেখা এটি তার চতুর্থ চিঠি। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসার পর সে একতরফা চিঠি লিখে যাচ্ছে। মাধবীলতার কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার উপায় নেই। মাধবীলতাকে নিজের আস্তানার ঠিকানা দেওয়ারও উপায় নেই। অনিমেষ চিঠিটা ভাঁজ করে ফেলার আগে আর একবার পড়ে নিল। এবার সে সম্বোধন করেনি, সরাসরি শুরু, ‘তুমি কেমন আছ জানি না, তবে আমার জন্য তুমি ভাল থাকবেই এটা জানি। কেমন স্বার্থপরের মত শোনাচ্ছে কথাটা তবু তোমার কাছেই তো আমি স্বার্থপর হতে পারি?

ছটফট করছি কাজ শুরু করতে কিন্তু কিছুদিন হল চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না। এ যে কি যন্ত্রণা তা তুমি বুঝবে না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমরা যা করত চাইছি ত হবেই। পৃথিবীটা পালটে যাবেই। আমাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তা করতে হবেই।

শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পর বেশি করে তোমার কথা মনে পড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই তোমার মুখের প্রতিটি টান দেখতে পাই। আইন কিংবা ধর্ম কি বলবে জানি না কিন্তু আমি চিৎকার করে বলতে পারি তুমি আমার স্ত্রী।

কিন্তু আমি তোমাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে বললাম না কেন? কেন তোমাকে দুরে সরিয়ে রাখলাম? যে কেউ এই প্রশ্ন করতে পারে। হয়তো একজন প্রকৃত কমুনিস্টের একটা অপরাধ। যে কম্যুনিজমে বিশ্বাস করে তার কর্তব্য আর একজনকে সেই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু আমি যখন বুঝলাম তুমি আমার এই আমি টাকেই গ্রহণ করেছ আমার আর সব কাজকর্মে তুমি বাধাও দেবে না, মুখ ফুটেও কিছু বলবে না তখন তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাইনি। শুনেছি বিখ্যাত গুরুদেবদের শিষ্যরা নাকি বন্ধু বান্ধবীদের গুরু ভাই করতে ব্যগ্র হয়। সে রকম করতে চাইনি আমি। কিন্তু তোমার সমস্ত ভাল মন্দের জন্যে আমি নিজের কাছে দায়বদ্ধ অথচ এই মুহূর্তে যদি তুমি অসুস্থ হও তবু আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারব না। এ যে কি যন্ত্রণা তা কি করে বোঝাই।

কবে দেখা হবে জানি না, আদৌ দেখা হবে কিনা তাও জানি না, কিন্তু আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার স্পর্শ পাচ্ছি।‘

ইনল্যান্ড লেটারের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে মাধবীলতার নাম ঠিকানা লিখে তাঁবুর বাইরে এসে দেখল করুণাসিন্ধু আসছে। এখন সকাল। চারদিকে ফিনফিনে রোদের ছড়াছড়ি। নদীর ওপর শুকনো নুড়িতে অবশ্য এখনও দুপাশের পাহাড়ের ছায়া মাখামাখি। কিন্তু মুখ তুললেই সোনাগলা রোদ্র। জায়গাটা সত্যি সুন্দর। চওড়া নদীর দুধারে গাছে মোড়া বড় পাহাড়। নদীর জল এখন এক পাশ দিয়ে ছোট্ট শরীর নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কুলিরা এখনও কাজে নামেনি।

করুণা সিন্ধু কাছে এসে বলল, কপাল ভাল বলতে হবে।

কেন?

আপনি শিলিগুড়িতে যাবেনই?

হ্যাঁ।

তাহলে তৈরি হয়ে নিন। আধ ঘন্টার মধ্যে আমাদের একটা জীপ ছাড়ছে। সন্ধ্যে নাগাদ শিলিগুড়ি থেকে ঘুরে আসবে। আমি একটু গায়ে পড়ে কাজটার দায়িত্ব নিলাম। অতএব আপনি সঙ্গে যেতে পারেন।

কথাটা শুনে অনিমেষ স্বস্তি পেল। বারোয়ারী ট্রেন কিংবা বাসে যাওয়ার চেয়ে প্রাইভেট জিপে যাওয়া অনেক নিরাপদ এবং সময়ও কম লাগবে। তাবুর ভেতরে ঢুকে করুণাসিন্ধু বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করব।

বলুন।

দাড়িটা কেটে ফেলুন।

চমকে নিজের গালে হাত দিল অনিমেষ, সেকি?

করুণাসিন্ধু হাসল, লোকে নিজেকে লুকোতে দাড়ি রাখে। তাই দাড়ি দেখলেই অনেকে সন্দেহের চোখে তাকায় আজকাল। তাছাড়া আপনাকে যারা চেনে তারা দাড়ি দেখেই অভ্যস্ত। ওটা কেটে ফেললে কেউ চিনতেই পারবে না। শিলিগুড়িতে যখন যাচ্ছেনই তখন একটু সতর্ক হয়ে থাকা ভাল।

অনিমেষ ইতস্তত করছিল, এ কত বছরের দাড়ি জানেন? আমি জীবনে কখনো গালে খুর লাগাইনি।

করুণাসিন্ধু ঠাট্টার গলায় বলল, এত হাজার বছরের জঞ্জাল যখন সরাতে নেমেছেন তখন আর সামান্য দাড়িতে মায়া করছেন কেন?

কথাটা শুনে অনিমেষের ভ্রূ কুঁচকে গেল দেখে গলা পালটিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না। আমি কিছু মিন করতে চাইনি।
 
করুণাসিন্ধুর দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম ব্যবহার করতে অনিমেষকে বেশ পরিশ্রম করতে হল। গালের কয়েক জায়গায় কেটে কুটে গেল। কিন্তু মুখ মোছার পর সে নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই চিনতে পারছিল না। মসৃণ গাল একটি সুশ্রী মোলায়েম তরুণকে হাজির করছিল। সিমেনার পোস্টারে এ রকম মুখ দেখা যায়। করুণা সিন্ধু ক্যাম্পখাটে বসে ওর পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল, এবার বলল, অ্যাদ্দিন আপনি দাড়ির আড়ালে বয়সটাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, এবার এখন ধরা পড়ে গেলেন।

অনিমেষ হাসল কিন্তু প্রতিবাদ করল না। তার চেয়ে বয়সে বড় অনেকই তাকে দাদা এবং আপনি বলে থাকে। এটা যে দাড়ির জন্যেই তা বোঝা যেত। কিন্তু কারুর ভুল ভাঙ্গিয়ে দিত না সে। যে যা বলে খুশি হয় তাই হতে দেওয়া উচিত। করুণাসিন্ধুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, চলুন।

জিপে ওরা চারজন। বাড়তি দুজনের একজন করুণাসিন্ধুর মালিকের ছেলে অন্যজন ড্রাইভার। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই ছেলেটিকে লক্ষ্য করছিল অনিমেষ। বছর কুড়ি বয়স হবে বেশ মোটাসোটা। করুণাসিন্ধু ওর কথা বলে রেখেছিল তাই কোন প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়নি। হাসিমারা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ছেলেটি বলল, বাবা কি আজই ফিরতে বললেন?

করুণাসিন্ধু মাথা নাড়লো, হ্যাঁ।

ধ্যুৎ এতদিন বাদে শিলিগুড়ি গিয়ে রাত না কাটিয়ে ফিরে আসা যায়?

আপনি আজ ফিরবেন না?

আমি মানে আমরা সবাই। বাবাকে বলব, গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

কেন? কোন কাজ আছে ওখানে?

কাজ? ধ্যুৎ আপনি একদম বেরসিক। আপনি এর আগে শিলিগুড়িতে গিয়েছেন? প্রশ্নটা অনিমেষকে উদ্দেশ্য করে।

সঠিক উত্তর দিল সে, না। মানে থাকার জন্যে যাইনি।

নীচু হয়ে ছেলেটি একটা ব্যাগ খুলে বোতল বের করল। ভুটানের সামচিতে তৈরি সস্তা দামের রাম। তারপর করুণাসিন্ধুকে বলল, আপনি তো মাল খান না?

না স্যার। করুণাসিন্ধু দ্রুত ঘাড় নাড়ল।

আপনি?

গোড়ামি নেই কিছু, তবে এখন খাবো না। অনিমেষ জানাল।

কেন? সকাল বেলায় চা-ই ভাল লাগে।

ছেলেটি আর কথা বলল না। ব্যাগ থেকেই গেলাস আর জল বের হল। প্রথমটা এক চুমুকে শেষ করে হাসল, আজ মশাই অনেকদিন বাদে স্বাধীনতার আলো দেখেছি। শালা বুড়ো শকুনটা মদ ছুঁতে দেয় না আমাকে। অথচ সতের বচর বয়স থেকে মালাবৃত হয়ে আছি। তখন থেকে সাইটগুলোতে আমি যেতাম একা একা। তা একবার রাত্তিরে শকুনটা গিয়ে হাজির। আমরা মাল খেয়ে বোতলগুলো একটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিতাম। শকুন সেটায় বুকে দেখল প্রায় বুজে গেছে বোতলে। ব্যাস, আমার স্বাধীনতা চৌপাট হয়ে গেল। আজ অনেকদিন পর ফিফটিনথ আগস্ট হল।

করুণাসিন্ধু বলল, কিন্তু কাজটা যদি না হয়।

সে জন্যেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। মন দিয়ে কাজ করবেন।

এ রকম একটি বাচ্চা ছেলের মুখে এমন পাকা পাকা কথা শুনতে শুনতে অনিমেষের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছি। তবে ছেলে বেশ তৈরি এখন গেলাস হাতে ধরে রেখেছে, বেশ সময়ের ব্যবধানে চুমুক দিচ্ছে। অনিমেষ বাইরে তাকাল। চা বাগান সবুজ গালচের মত দিগন্তে ছড়ানো। মাঝখানের শেড ট্রিগুলোয় পাখির ঝাক। খুব স্পীডে গাড়ি ছুটছে, রাস্তা ফাঁকা। এক সময় নীরসাড়া ছাড়ির স্বৰ্গছেঁড়ার কাছে এসে গেল ওরা। করুণাসিন্ধু ওর দিকে তাকাতেই সে একটু পেছনে সরে বসল। বলা যায় না কিছু, যদি কারো নজর খুব তীক্ষ্ণ হয় তাহলে মুশকিল।

হঠাৎ ছেলেটি বলল, আপনি কি করেন মশাই।

করুণাসিন্ধু বলল, পড়াশুনা করে। কলকাতায়। এখানে বেড়াতে এসেছে।

ছেলেটি বলল, কি হবে পড়াশুনা করে? শালা পরের গোলামী করে করে জাতটা ডুবে গেল। ব্যবসা করুণ মাল কামান। শকুনকে দেখছেন না? ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল বলে শুনেছি।

অনিমেষ বলল, শকুন কে?

যার গাড়িতে আপনি চড়েছেন মাই ফাদার। সব সময় ভাগাড়ে নজর। যতদূরেই থাক কিছুতেই অ্যাভয়েড করতে পারি না। দাঁড়ান দাঁড়ান এ গাড়ি থামা তো। ছেলেটি ব্যগ্র হয়ে বাইরে তাকাল। অনিমেষ গুটিয়ে গেল। ওরা এখন স্বৰ্গছেঁড়ার চৌমাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। পকেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটি ড্রাইভারকে দিল, নায়ারের হোটেলে যা, পাঁচটা রামের বোতল আনবি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top