What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

জুলিয়েনের ওপর সমস্ত ভার দিয়ে অনিমেষ ট্রেনে চাপল। রিজার্ভড বার্থ কিংবা সিট নয়, বারোয়ারী কামরায় উঠল সবার নজর এড়াবার জন্যই। শিলিগুড়ি থেকে অনেকেই যাচ্ছে বোলপুরে। যতটা সম্ভব পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, কারণ বোলপুরে মিটিং অত্যন্ত গোপনে হচ্ছে। প্রথমে বসার জাগয়া পায়নি অনিমেষ। শেষে একটা বাকের ওপরে বাবু হয়ে বসতে পারল একসময়। এবং এই ট্রেনের দুলুনিতে হঠাৎ মনে হল খুব ক্লান্ত লাগছে। এই দিনগুলোয় নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়নি। কিন্তু যত দ্রুত ভাল কাজ হয়েছে বলে বোধ হচ্ছিল ঠিক ততটা কি হয়েছে? এতদিন এখানে রইল অথচ সে স্বৰ্গছেঁড়া বা জলপাইগুড়ির বাড়িতে যায়নি। প্রথম দিকে এড়িয়ে ছিল, শেষের দিকে সত্যি আর সময় হয়নি। অনিমেষ খবর পেয়েছে, মহীতোষ জেনে গেছেন সে উত্তর বাংলায় আছে। পরিচিতজনেরা নিশ্চয়ই খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। স্বৰ্গছেঁড়া ছাড়া সব জায়গাতেই সে প্রকাশ্যে ঘুরেছে অতএব তাকে দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। খবরটা ওঁকে বিহ্বল কর দেবে। নিশ্চয়ই ভেবে কোন কিনারা করে উঠতে পারবেন না। যারা খবর দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কথাও জানিয়েছে। বাবার জন্যে অনিমেষের খারাপ লাগছিল। বাধা লাইনে তাকে ঘিরে যে আশা উনি করেছিলেন সেটা পূর্ণ করা সম্ভব হল না। কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে ওঁর! অনিমেষ এ নিয়ে ভেবেছে। প্রথমে নিশ্চয়ই খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, তারপর একসময় নির্লিপ্ত হয়ে কোন সম্পর্ক না রাখার জন্যে ছোটমাকে হুকুম করবেন। হয়তো জ্যাঠামশাইকে দাদু যেভাবে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন সেইভাবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। অনিমেষ জানে সে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে বললে তা মহীতোষের কাছে আরো দুঃখজনক হবে। বরং তার নিজের কথা লিখে সে বাবাকে একটা চিঠি দেবে। পাশাপাশ সরিৎশেখরের মুখ মনে পড়লে অনিমেষের কিন্তু অস্বস্তি হয় না। সে যে সব ছেড়েছুঁড়ে সক্রিয় রাজনীতির অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই খবর মোটেই সরিৎশেখরকে চিন্তিত করবে না। একটা মানুষ দীর্ঘজীবন যাপন করে শেষ পর্যন্ত কি লাভ করে তা সরিৎশেখরকে চেয়ে কেউ বেশি জানে না।

অনিমেষ এই রাতের ট্রেনে একা একা যেতে যেতে শুধু একজনের জন্যে অস্বস্তি অনুভব করছিল। মাধবীলতা তাকে ভালবাসে এবং তার মূল্য দিতে একটুও পিছপা নয়। অথচ অনিমেষ যে রাজনীতি করে তার ছায়ায় সে পা রাখছে না। অনিমেষের সঙ্গে জড়িয়েও সে আড়ালে আড়ালে থাকছে। একটি মানুষকে নিঃশর্তে ভালবেসে মাধবীলতারা সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারে। তার কাজকর্মের সঙ্গে নিজের মানসিক সংযোগ না থাকলেও তা নিয়ে বিরক্ত করে না। কিন্তু উত্তর বাংলার দিনরাত এই অনিশ্চিত উত্তেজনায় কাটিয়ে আজ অনিমেষের মনে হচ্ছিল মাধবীলতাকে মুক্তি দেওয়া দরকার। এভাবে সে যদি তার জন্যে অপেক্ষা করে তাহলে নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হয়। একজন আমার মুখ চেয়ে রয়েছে অথচ আমি তার জন্যে কিছুই করতে পারছি না এই বোধ তাকে কিছুতেই শান্তি দিচ্ছিল না। মাধবীলতাকে কখনো বিয়ে করতে পারবে কিনা তা সে জানে না। শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? অনিমেষ জানে, ভাল করে বুঝিয়ে বললেও মাধবীলতার কোন পরিবর্তন হবে না। ও সেই দলের মেয়ে নয় যারা প্রেমিক অক্ষম বুঝলেই সুড় করে বাবার আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে সংসারী হবে; মুশকিলটা এখানেই। তবু, অনিমেষ মনে মনে ঠিক করল এবার সে সরাসরি মাধবীলতাকে নিষেধ করবে তার জন্যে অপেক্ষা করতে। প্রয়োজেনে কঠোর হতে হবে। অন্তত ওই নরম মনের মেয়েটাকে বাঁচাবার জন্যে তাকে রূঢ় ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া তার নিজেরও মুক্তি নেই।
 
রামপুরহাট ছাড়তেই ট্রেনে প্রচণ্ড ভীর বাড়ল। পৌষমেলার জন্যে সবাই বোলপুর যাচ্ছে। আগে কখনও বোলপুরে সে যায়নি। পৌসমেলার কথা কাগজেই পড়েছে। বোলপুর স্টেশনের চেহারা দেখে ওর মনে হল এখানে সভা করে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। এত মানুষের ভীড়ে পুলিশের পক্ষে সন্দেহ করার কোন কারণ থাকবে না। মেলার মানুষের জঙ্গলে তারা স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারবে। শিলিগুড়ির খবর অনুয়ায়ী রাত দশটায় বোলপুর ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গোয়াল পাড়া বলে একটা গ্রামে তাকে যেতে হবে। সেখানে গ্রামের ভাটিখানার পাশদিয়ে নদীর দিকে একটু এগোলে বাঁ হাতের চার নম্বর বাড়িটা আলোচনার জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কোন কারণে স্থানের পরিবর্তন হলে বোলপুর কোঅপারেটিভ স্টোরসের সামনে বিকেল পাঁচটায় এলেই জানা যাবে। সবাইকে জানানো হয়েছে যে তারা যেন বোলপুরে পৌষমেলা দেখতে যাচ্ছে এমন প্রকাশ পায়। অনিমেষ এ ব্যাপারে অবশ্য খুবই আশ্বস্ত। শান্তিনিকেতন দেখার এমন সুযোগ পাওয়া গেল সেটা উপরি লাভ। তার ওপর সঙ্গে মাধবীলতা থাকায় তাদের তো ভ্রমণবিলাসী বলেই মনে হবে। কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। নিশ্চিন্ত হতে গিয়েই অস্বস্তিতে পড়ল অনিমেষ। আবার সে মাধবীলতাকে বর্মের মত ব্যবহার করছে। না, এই শেষ, মাধবীলতা যদি বর্ধমানে আসে তাহলে তো আর সেখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। বোলপুরে মিটিং শেষ হলে যে সময় হাতে থাকবে তখন সে মাধবীলতাকে বোঝাবে, পরিষ্কার হয়ে নেবে।

বর্ধমানে ট্রেনটা থামতেই বুকের মধ্যে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ এরকম উত্তেজনা তার সমস্ত শরীর মনকে আক্রমণ করবে একটু আগেও সে টের পায়নি। মাধবীলতাকে দেখতে পাবে শুধু এই কারণেই তার অবচেতন মন এত অধীর ছিল? এই তো সেদিন সে কোলকাতা ছেড়ে গেল! তবে? অনিমেষ নিজেকে সংযত করল। ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবার পরও কিছুক্ষণ বসে রইল সে। তারপর ধীরে ধীরে নীচে নেমে দুপাশে তাকাল। প্রচুর মানুষ বিপরীত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ভাববঙ্গীতেই বোঝা যাচ্ছে সবাই পৌষমেলার যাত্রী। স্পেশাল ট্রেন না দিলে কোন ট্রেনেই এত লোকের জায়গা হবে না। অনিমেষ কুলিদের সামলে এগোল। মাধবীলতাকে চোখে পড়ছে না। আর একটু খোঁজাখুঁজির পর অনিমেষ আবিষ্কার করল তার শরীর ক্রমশ অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। মাধবীলতা কি আজকের তারিখটার কথা ভুলে গেছে? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না। তন্ন তন্ন করে প্ল্যাটফর্মটা খুঁজে সে ওভারব্রীজের নীচে এসে দাঁড়াল। মাধবীলতার কিছু হয়েছে! হয়তো খুব অসুস্থ হয়ে শুয়ে রয়েছে হোস্টেলে। এও তো হতে পারে, ওর বাবা জোর করে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। কিংবা যদি মাধবীলতা এতদিনে তার ভুলটা বুঝতে পেরে থাকে। কথাটা ভাবতেই অনিমেষের বুকের ভেতরটায় দাউ দাউ চিন্তা জ্বলে উঠল। কোন চিন্তা আর মাথায় সুস্থভাবে আসছে না। শুধু মনে হল এই ট্রেনটায় দাউ দাউ চিত্ত জ্বলে যাওয়া উচিত। সরাসরি হোস্টেলে পৌঁছে মাধবীলতার খোঁজ না করলে সে শান্তি পাবে না।

ঠিক সেই মুহূর্তে সে শূন্য চোখে ওপরে তাকাতেই নড়ে উঠল। প্রথমে কি দেখছে তা বুঝতেই কয়েক পলক গেল। তারপর চোখের সামনে কয়েক লক্ষ পদ্ম ভোরের রোদ পেয়ে ঝকমকিয়ে উঠল। যেন বুকের চিতায় কেউ নরম হাত রাখল। অনিমেষ পাথরের মত দাঁড়িয়ে সেই উজ্জ্বল হাসিতে মাখামাখি মুখটাকে নীচে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। সামান্য সময়, তারপরেই মাধবীলতা ওভারব্রীজটা প্রায় দৌড়ে পার হয়ে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসছিল। অনিমেষের মনে হল একটা ঝরণা যেন উদ্দাম বেগে তার দিকে ছুটে আসছে।
 
অনিমেষ একটুও নড়ল না। মাধবীলতাকে দেখে ওর যে শান্তি বুকে ছড়াচ্চিল তা ক্রমশ অভিমানের ছায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ও তাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করেছে কিন্তু অযথা এই উদ্বেগে রেখে মজা পাচ্ছিল। সামনে এসে দাঁড়াল মাধবীলতা, ওমা, তোমার চেহারা কি হয়েছে? আয়নায় মুখ দেখেছ?

তাই এতক্ষণ চিনতে পারোনি? অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল।

পারিনি তো! ঢ্যাঙা, রোগা আর কি কালো হয়ে গেছ। মাধবীলতার মুখ সত্যি সিরিয়াস, খুব অত্যাচার করেছ বুঝতে পারছি। খাওয়াদাওয়া করতে না?

ওখানে তো কোন শরৎচন্দ্রের নায়িকা ছিল না যে আমাকে পিড়ি পেতে খাওয়াতে খাওয়াতে হাওয়া করবে! অনিমেষ মুখ ঘোরাল।

খুব কথা শিখেছ। একটু আগে যখন দেখতে পেলাম তখন সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে না দেখতে পেয়ে তুমি না কেমন বোকা বোকা মুখ করে তাকাচ্ছিলে। মাধবীলতা ঠোঁট টিপে হাসল।

খুব আনন্দ লাগছিল তাই দেখে?

অনিমেষের গলার স্বরে এমন একটা পাঁচিল ছিল যে মাধবীলতার হাসি চট করে নিভে গেল। সে চট করে অনিমেষের হাত ধরল, এই, রাগ করছে আমার ওপরে। আসলে আমারই ভুল। এখানে এত ভীড় যে ভাবলাম দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। তার চেয়ে ওভারব্রীজের ওপরে দিয়ে দাঁড়ালে তোমাকে আমি ঠিক দেখতে পাব। তা করতে গিয়ে তোমাকে যেই দেখতে পেলাম আমার বুকের ভেতরটা এমন করতে লাগল যে–। আসলে তোমাকে লুকিয়ে তোমায় দেখতে আমার খুব ভাল লাগছিল। এই, রাগ করো না, প্লিজ!

অনিমেষ দেখল এই পদ্মের মত মুখ উদগ্রীব হয়ে তার দেখে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর অনিমেষ নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল। না, এ মেয়ের ওপর সে কখনই রাগ করতে পারবে না।

স্পেশাল ট্রেনটা ছেড়ে দিতে হল। এত ভীড়ে যে ঝুলে যাওয়ারও উপায় নেই। পরের ট্রেনটা প্রায় ঘন্টা আড়াই পরে। এতক্ষণ এখানে চুপচাপ বসে থাকার কোন মানে হয় না। ওরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। অনিমেষ আড়চোখে মাধবীলতাকে দেখছিল। তাকে যাই বলুক মাধবীলতা নিজেও কিন্তু বেশ রোগা হয়েছে। তবে এবার ওকে খুব প্রাণবন্ত লাগছে। উচ্ছাস একটু বেশি। অনিমেষকে দেখে ওর খুশি হওয়ার ব্যাপারটা আর চেপে রাখছে না। বাস ট্যান্ড অবধি ওরা হেঁটে এল। আসতে আসতে অনিমেষ জানতে পারল মাধবীলতার বাবা একদিন হস্টেলে এসেছিলেন। মেয়েকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। একটি ভাল পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি চান মাধবীলতা সুখী হোক। এই ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে হলে ওরা স্বচ্ছন্দে সারাজীবন আমেরিকায় থাকতে পারে। ছেলেটি সেখানেই সেটলড। মাধবীলতা তার বাবার কথা মন দিয়ে শুনে বলেছে সেটা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক তিতিবিরক্ত হয়ে ফিরে গেছেন। এবং যাওয়ার আগে অনিমেষের নাম জেনে গেছেন। মাধবীলতাই বলেছে। মেয়ে যে এমন মারাত্মক ভুল করছে এবং কে জানে স্বৰ্গছেঁড়ায় অভিযোগ জানিয়ে চিঠিও দিতে পারেন। এসব বলে মাধবীলতা হাসল, তোমাকে বোধহয় আমি খামোকা ঝামেলায় ফেললাম।

কি রকম?

এবার বাবা-মায়ের কাছে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে।

সে দায় বোধহয় আর নেই। কিন্তু তুমি কি ঠিক করছ?

মানে? তোমার বাবা একটুও অসঙ্গত কথা বলেননি।

বুঝতে পারছি না।

তোমার এসব পাগলামি না করে অন্য কোথাও বিয়ে করে সংসারী হওয়া উচিত। আমার কথা ছেড়ে দাও। এইসব করতে করতে কখন কি হবে কেউ বলতে পারে না। আমার জন্যে তুমি বসে থাকবে কেন? এসব কথা বলার জন্যে অনিমেষের মানসিক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বলতে হবে ভাবতে পারেনি। সুযোগ এসেছে যখন–অনিমেষের কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মাধবীলতাকে বাঁচাতে এগুলো বলতেই হবে।

বেশ, আমি তাহলে এখান থেকেই কলকাতায় ফিরে যাই। মাধবীলতার চোখের দৃষ্টি পালটে গেল। মুখ গভীর এবং ঠোঁটের কোণায় ভাঁজ পড়ল।
 
এখন থেকে ফেরার দরকার নেই। বোলপুরে চল। সত্যি বলছি, এ ব্যাপারটা নিয়ে তোমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলার দরকার। যত দিন যাচ্ছে আমার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। শেষ কথাটা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলল অনিমেষ।

মাধবীলতা তখন দাঁড়িয়ে পড়েছে। একদৃষ্টে সে অনিমেষের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি হয়েছে?

কেন?

এরকম উন্মাদের মত কথা বলছ!

উন্মাদ? তুমি কি আমাকে একটুও চিনতে পারোনি? মাধবীলতার মুখ দেখে অনিমেষের মনে হল এ বিষয়ে আর একটা কথা বলা মানে রাস্তার মধ্যেই একটি দৃশ্য তৈরি করা। তাছাড়া ওই মেঘ জড়ানো মুখের দিকে সে আর তাকাতেও পারছিল না। বলল, বড্ড খিদে লেগেছে। ট্রেনে কিছুই খাওয়া হয়নি। চলো কিছু খাই।

মাধবীলতা কিছুক্ষণ মাথা নামিয়ে ভাবল। তারপর অন্যকরম গলায় বলল, এরকম কথা আর কখনো বলো না। আমি আলু বেগুন ময়দা নই।

কথাগুলো যেন মাধবীলতাকে কাঠিন্যের পর্দায় ঢেকে দিল। স্টেশনে দেখা সেই উজ্জ্বল মেয়েটা যেমন চট করে ডুব দিল গভীরে। অনিমেষ আর এ ব্যাপারে কথা বলতে সাহস পেল না। বাসস্ট্যান্ডেও প্রচুর ভীড়। ছাদে লোক বসেছে। ডাবল ভাড়ায় ট্যাক্সী ছুটছে। সেদিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, এদিকে এসো।

মাধবীলতা উত্তরের অপেক্ষা না করে এগিয়ে যেতেই অনিমেষ অনুসরণ করল। পাশের একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে একগাদা খাবারের হুকুম দিল মাধবীলতা। আগে হলে প্রতিবাদ করত অনিমেষ, কিন্তু এখন চুপচাপ খেয়ে নিল। মাধবীলতা নিজে একটা সিঙ্গাড়া আর চা ছাড়া কিছু নিল না।

মেয়েরা চিরকালই ছেলেদের খাইয়ে একধরনের সুখ পায়। ব্যাপারটা শরত-মার্কা সুখ বলে ঠাট্টা করত অনিমেষ। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব কথা বলতে বাধলো তার। এখন মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালে একটা ঠান্ডা স্রোতের স্পর্শ পাচ্ছিল সে। এ মেয়েকে কি করে বোঝানো যায়, বোঝাতে গেলে নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। অথচ অনিমেষ বুঝতে পারছে, বুঝলে মাধবীলতার উপকার হত।

কোনরকমে একটা প্রাইভেট ট্যাক্সিতে জায়গা পেয়ে গেল ওরা। ড্রাইভারের পাশে চারজনকে বসিয়েছে। অস্বস্তিতে দম বন্ধ হবার যোগাড় কিন্তু কোন উপায় নেই। পুরো ট্যাক্সিতে এগারজন লোক। ভাড়া ডাবল। মাধবীলতা জানালার পাশে বসলেও তার শরীরের চাপ অনিমেষের ওপর। নিজেকে পাশের লোকের ওপর প্রায় চাপিয়ে দিয়েও অনিমেষ ওকে স্বচ্ছন্দ রাখতে পারছে না। মাধবীলতার শরীরের স্পর্শ অনিমেষকে বিব্রত করছিল। বিব্রত মাধবীলতাও। ধুলোর ঝড় উড়িয়ে ট্যাক্সিটা বর্ধমান ছাড়িয়ে বীরভূমে ঢুকল। মাধবীলতা নীচু গলায় বলল, তোমার মাথায় কোন বুদ্ধি নাই।

সে তো জানা কথাই, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল কেন?

আমি যদি সরাসরি বোলপুরে গিয়ে নামতাম আর তুমি যদি এতদূর এগিয়ে না আসতে তাহলে এত ঝামেলা পোয়াতে হতো না।

সাবধানের মার নেই বলে একটা কথা আছে।

তোমার আবার সব তাতেই বাড়াবাড়ি। পুলিশ যেন তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে! মাধবীলতা ঝাঁঝালো গলায় জবাব দিল। ট্যাক্সির ভেতর খুব গুলতানি চলছে। সহযাত্রীরা সব কলকাতা থেকে আসছে। ওদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে অনিমেষের খেয়াল হল আজ রাত্রে কোথায় থাকবে তাই ঠিক হয়নি। সারারাত মাধবীলতাকে নিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। এদিকে যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে কোন হোটেলে জায়গা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কথাটা মাথায় ঢোকামাত্র অনিমেষের অস্বস্তি শুরু হল। একা থাকলে সব কিছু ম্যানেজ করা যায় কিন্তু একজন মহিলাকে নিয়ে তো তা সম্ভব নয়। তাছাড়া আর একটা সমস্যার কথা তার খেয়ালে আসেনি। হোটেলে যদি একটা ঘর পাওয়াও যায় তাহরে মাধবীলতার সঙ্গে এক ঘরে রাত্রে থাকাটা কি ভাবে হোটেলে যদি একটা ঘর পাওয়াও যায়। তাহলে মাধবীলতার সঙ্গে এক ঘরে রাত্রে থাকাটা কি ভাবে সম্ভব? না, তার ব্যক্তিগত বঙ্কোচ নেই, নিজের ওপর আস্থা আছে তার। কিন্তু মাধবীলতা নিজে কিভাবে নেবে ব্যাপারটা? ওরকম গভীর মনের মেয়ে এই ব্যবস্থাটাকে মেনে নিতে কি পারবে! হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতাকে এখানে আসতে বলেই সে ভুল করেছে। আগে থেকে কোন কাজ করছে না বলেই শেষমেষ ঝামেলায় জাড়িয়ে পড়ছে সে।
 
বোলপুরে মাটিতে নামতেই মেলার গন্ধ পাওয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী আজ নাকি ভাষণ-টাষণ দিয়ে গেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের তৎপরতা এখন বেশি হবে। অনিমেষ আর মাধবীলতা বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ রাখছিল। রোদের তেমন তেজ নেই এখন। কিন্তু এই মুহূর্তে ভাল করে সেরে খেতে ইচ্ছে করছে। মাধবীলতা বলল, মেলা তো রাত্তিরে?

হ্যাঁ।

এখন তো কোথাও গিয়ে উঠতে হবে। চল দেখি।

হোটেলে জায়গা পাওয়া যাবে?

এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো পাওয়া যাবে না।

অনিমেষ একটা রিকশাওালাকে ডাকল। লোকটি খুব তৎপরতার সঙ্গে এসে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় বাবু? টুরিস্ট লজ?

অনিমেষ বলল, ট্যুরিস্ট লজে জায়গা পাওয়া যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে লোকটির মুখ হা হয়ে গেল, আপনারা জায়গা বকে করেন নাই?

না। হঠাৎই এসে পড়লাম তাই।

এখানে বাবু মাছি ঢোকার যায়গা নেই কোথাও। টুরিস্ট লজ, হোটেল, বোর্ডিং সবখানে লাইন দিয়ে লোক বসে আছে। কোন চান্স নেই।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। অবস্থা খুবই খারাপ। মাধবীলতা একটু এগিয়ে এল, আচ্ছা ভাই, এসেছি যখন তখন কোথাও থাকতে হবে তো। তুমি এখানকার লোক, একটা জায়গার কথা বল না!

রিকশাওয়ালার কপালে ভাঁজ পড়ল, না দিদি, ভদ্রলোকের থাকার জায়গা এখানে নাই। সারা বছর সব ফাঁকা পড়ে থাকে কিন্তু পৌষমেলার সময় যেন হাভাতের ভীড় পড়ে যায়।

অনিমেষ বলল, একটা রাত তো, যেমন হোক একটা জায়গা পেলেই হয়ে যাবে। সারাক্ষণ তো মেলাতেই ঘুরব আমরা। একটু দ্যাখো না।

লোকটি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, উঠে আসেন, দেখি কি করা যায়।

স্বস্তিতে বসতে পেরে আরাম লাগল। হিমমাখা হাওয়ায় রিকশা সাঁতারে যাচ্ছে যেন। অনিমেষ বললো, দ্যাখো কপালে কি আছে!

মাধবীলতা হাসল, আমি যখন সঙ্গে আছি তখন বিফল হবে না।

বোলপুর ডিঙ্গিয়ে শান্তিনিকেতনকে পাশে রেখে রিকশাওয়ালা শ্রীনিকেতনের রাস্তায় চলে এল। প্রায় মিনিট দশেক ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর ডান দিকে একটা মাটির রাস্তায় ঢুকে পড়ল সে। অনিমেষ দেখল সুন্দর সুন্দর বাড়ি হয়েছে এদিকে। মেলার ভীড় ভাট্টার ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি এখানে। শুধু টুরিস্টরা বড় রাস্তা দিয়ে শ্রীনিকেতনে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা ওদের বসে থাকতে বলে একটা বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। অনিমেষ দেখল বাড়িটার সদর দরজা জানলা বন্ধ। প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় যে এখানে লোকজন থাকে না। খানিক বাদে একটি দারোয়ান গোছের লোককে সঙ্গে নিয়ে রিকশাওয়ালা ফিলে এল। এসে এক গাল হাসল, আপনারা তো একটা রাতই থাকবেন?

অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল।

রিকশাওয়ালা বলল, নেমে আসেন। সব কথা হয়ে গেছে। এ হল এই বাড়ির মালি। বাড়ির বাবু বোম্বেতে থাকেন। এবার আসবেন না তারা। আপনাদের একট ঘর খুলে দিচ্ছে, আরাম করে থাকুন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কত দিতে হবে?

তিরিশ টাকা এত সস্তায় আরামের জায়গা আর কোথাও পাবেন না বাবু। তবে একটা কথা, জানলা খুলতে পারবেন না।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কেন?

মানে সবাই জানে এখানে কেউ থাকে না। জানলা খুললে পাশের বাড়ির লোক টের পেয়ে গেলে মালিকের কানে যাবে। মানে, একটু গোপনে গোপনে থাকতে হবে বাবু। একটা রাত, শীতকাল, কোন অসুবিধা হবে না।

তোমার কত দিতে হবে?

সে যাহয় দেন। আপনাদের যা মন চায়।

অনিমেষ দুটো টাকা দিতে গিয়ে কি ভেবে তিন টাকা দিলে। মুখ দেখে মনে হল লোকটা আরো বেশি আশা করেছিল। এতক্ষণ মালি কোন কথা বলেনি। চুপচাপ ওদের দেখছিল। অনিমেষরা রিকশা থেকে নামতেই বাড়ির ভেতর ফিরে চলল সে। রিকশাওয়ালা ফিরে যেতেই অনিমেষরা বাড়ির ভেতর ঢুকল। সামনে বাগান আছে কিন্তু ভাল করে যত্ন নেওয়া হয় না বোঝা যাচ্ছে। সদর দরজার নয়, পাশের খিড়কি দরজা দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। বেশ বড় বাড়ি। ভেতরে বাঁধানো চাতাল। চাতালের ওপাশে ঠাকুর চাকরের ঘর আর একদিকে ভেতরে যাওয়ার দরজা। মালি সিঁড়ি দিয়ে ওপারে উঠে একটা দরজা খুলে প্রথম কথা বলল, এই ঘরে থাকবেন।
 
অনিমেষ দেখল ঘরটা বেশ সুন্দর। বেশ বড় খাট বিছানা চেয়ার সাজানো আছে। ওরা বসা মাত্র লোকটি বলল, শুনলেনই তো, জানালা খুলবেন না। আর আমি ছাড়া কেউ ডাকলে সাড়া দেবেন না।

অনিমেষ বলল, ঠিক আছে। কিন্তু স্নান করব কোথায়?

ওপাশে বাথরুম আছে। লোকটি একটু এগিয়ে এটাচড বাথ দেখিয়ে দিল।

মাধবীলতা বলল, যার বাড়ি তিনি আসেন না?

আসেন। তবে এবার আসবেন না। কিন্তু কেউ যদি তার হয়ে আসেন, তাহলে চুপচাপ আপনাদের চলে যেতে হবে।

সেকি! আঁতকে উঠল অনিমেষ।

দ্যাখেন, ভেবে দ্যাখেন।

মাধবীলতা বলল, আর ভাবতে পারছি না। কেউ এলে আমরা চলে যাব।

ভাল কথা। আপনারা খেয়ে এসেছেন?

না। এদিকে হোটেল আছে?

আছে। তবে আমি এনে দিচ্ছি।

না। আমরা গিয়ে খেয়ে আসব।

সেটা ঠিক হবে না। বারবার যাওয়া-আসা করলে লোকে দেখবে। একবারে বেরিয়ে গিয়ে রাতে ফিরবেন। টাকা দিন।

মাধবীলতা ব্যাগ খুলে দশ টাকা বের করে দিতে লোকটি বলল, ভাড়াটা?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ওটাও এখনই দিতে হবে?

হ্যা বাবু। দিতেই তো হবে, আগে আর পরে। লোকটি টাকা নিয়ে দরজা ভেজিয়ে চলে গেল। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এই বড় বাড়িটার বন্ধ ঘরে সে আর মাধবীলতা ছাড়া আর কেউ নেই। সঙ্কোচ কাটাতে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কেমন বন্দী বন্দী লাগছে নিজেকে, না?

মাধবীলতা তখন হাতের ঘড়ি খুলে টেবিল রাখছিল। সেদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, কার বাড়িতে কারা এল! লোকটা বোধহয় মাঝে মাঝেই ঘরটা ভাড়া দেয়।

কি করে বুঝলে? অনিমেষ এগিয়ে এল।

মাধবীলতা আঙুল দিয়ে একটা লেডিস রুমাল দেখিয়ে দিল। কোচকানো রুমালটা টেবিলের কোণে পড়ে আছে। মালিটার চোখ এড়ালো কি করে?

অনিমেষ মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখল। তারপর বলল, খুব খিদে পেয়ে গেছে। স্নান করে আসি। কথা শেষ করেই সে ব্যাগটা তুলে নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। রাত জেগে ট্রেনে আসা, দেরীতে স্নান খাওয়ার জন্যে অনিমেষের আলসেমি বোধ হচ্ছিল। কিন্তু মাধবীলতার পিড়াপিড়িতে ওকে উঠতে হল। বাইরে মিষ্টি রোদের আলপনা, এখন ঘরে বসে থাকার নাকি কোন মানে হয় না। অথচ অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল এই ঘরে মাধবীলতার মুখোমুখি বসে গল্প করতে। এরকম নির্জনে থাকার সুযোগ ওদের আগে কখনও হয়নি। বেশ সংসারী সংসারী লাগছে। কিন্তু মাধবীলতার বাইরে যাওয়ার জন্যে যে ছটফটানি তার একটা কারণ ওর চোখ এড়াচ্ছিল না। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তির। বিশেষ করে মাধবীলতার মত মেয়ে, যে এক কথায় নিজের বাড়ি ছেড়ে তার জন্যে হোস্টেলে এসে উঠেছে, সে এই নির্জন ঘরে তার সঙ্গে থাকতে যেন ভয় পাচ্ছে। ব্যাপারটা মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। অনিমেষের মনে হল, যত শক্ত ধাতের হোক, মেয়েরা কোন কোন জায়গায় এক। আগাম কিছু চিন্তা করে দুর্ভাবনায় ভোগে অথচ সেটা মোটেই মুখে প্রকাশ করবে না।
 
বড় রাস্তায় বেরিয়ে অনিমেষের মনে হল আজকের দুপুরটা সত্যিই চমৎকার। পৌষ মেলায় এখানে বোধহয় প্রতি বাড়িতে অতিথি আসে। বাড়িগুলোর সামনের লনে কিংবা বাগানে রোদ পোয়ানোর ভীড় দেখালেই তা বোঝা যায়। বেশ উৎসবের মেজাজ এখন শান্তিনিকেতনে। শ্রীনিকেতন থেকে যে রাস্তাটা সোজা শান্তিনিকেতনের ভেতরে চলে গেছে ওরা সেই পথ ধরল। বেশ ভীড় এখানে। পাশাপাশি হাঁটতে মাধবীলতা বলল, দারুণ!

কি দারুণ!

জায়গাটা।

তাই বল।

কেন, তুমি কি ভেবেছিলে?

আমি তো অনেকেরকম ভেবে থাকি। সেগুলো তো আর সত্যি হয় না।

যেমন?

ধরো, আজ দুপুরে তোমার সঙ্গে ঘরে বসে গল্প করব ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি যেমন করে বাইরে আসার জন্যে ছটফট করছিলেন তাতে নিজেকে রাক্ষস-টাক্ষস মনে হচ্ছিল। অনিমেষ খুব লঘু গলায় বলল।

মাধবীলতা চট করে অনিমেষের মুখ দেখে নিল। হলুদ শাড়ি আর ফরসা গালে এমন একটা শ্রীমাখানো ওর চেহারায় যে অনিমেষ সেই দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পরও চোখ ফেরাতে পারল না। মাধবীলতা মুখ নামিয়ে নীচু গলায় বলল, তুমি কিস্যু বোঝ না।

বুঝি না?

না। আমরা যদি সারা দুপুর ঘরে বসে থাকতাম তাহলে দারোয়ানটা যা অনুমান করেছিল তা সত্যি বলে ভাবত। আমরা যে এখানে বেড়াতে এসেছি, ঘরে বসে থাকতে নয়, এটা ওকে বোঝানো দরকার ছিল।

যাচ্চলে! ও যে আমাদের সম্পর্কে এত ভাবছে তা তুমি জানলে কি করে?

আমরা যখন রিকশা ছেড়ে দিলাম তখন থেকে লোকটা আমার মাথার দিকে তাকাচ্ছিলো। যে কেউ বুঝতে পারবে আমি বিবাহিতা নই।

সিঁদুরের কথা বলছ? আমরা তো খৃষ্টানও হতে পারি।

বাজে বোকো না। বিবাহিতা মেয়েদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।

অনিমেষ চমকে মাধবীলতাকে দেখল। ও মাথা নিচু করে হাঁটছে। তর্ক করতে পারত অনিমেষ। শুধু দারোয়ানের জন্যেই ঘরছাড়া হতে হল এটা সে মানতে পারছে না। কিন্তু মেয়েরা কখনও কখনও সত্যি কথাটা আড়াল করতে একটা কিছু বাহানার ঘোমটা টানে, জেনেশুনে সেটা নিয়ে টানাটানি করে কি লাভ!

সারাটা দুপুর ওরা শান্তিনিকেতন দেখল। আজ খুব ভীড়। বেশির ভাগ ঘরবাড়ির দরজা বন্ধ। কিন্তু ছড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যগুলো, মাঠঘাট, ছাতিমতলা, শ্যামলী অথবা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে সময়টা কখন ফুরিয়ে গেল। মাধবীলতা বলছিল, রবীন্দ্রনাথ এখানে ছিলেন আর তার চারপাশে সেইসব বিখ্যাত মানুষ ঘিরে আছেন–কথাটা ভাবলেই কেমন শিহরণ লাগে।

অনিমেষ বলল, ধরো, এই পথ দিয়ে নন্দলাল হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁকে দেখে রামকিঙ্কর শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে গেছেন। দীনু ঠাকুর, দীনবন্ধু এনড্রজ, প্রভাত মুখার্জী, জগদানন্দ রায়ের সঙ্গে একটু এদিক ওদিক গেলেই দেখা হয়ে যাবে। আর এইসব ছেড়ে-ছুঁড়ে অপারেশনের জন্যে শেষবার কলকাতায় যাওয়ার আগে ভোরে ছেলেমেয়েরা তাদের গুরুদেবকে গান শোনাচ্ছে বাইরের মাঠে দাঁড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথের চোখে জল। সেই ভোরটায় তার শান্তিনিকেতন কখনই শান্তির ছিল না তার কাছে।

মাধবীলতা বলল, আমি এই প্রথম এলাম এখানে। আমাদের জন্যে কেউ এত সুন্দর জায়গা তৈরী করে গিয়েছিলেন, পড়াশুনা শুধু ভালবাসা থাকলে কতটা আন্তরিক হতে পারে-এখানে না এলে বুঝতাম না।

অথচ দ্যাখো, ছেলেবেলা থেকে আমরা গল্প শুনতাম এখানকার ছেলেরা নাকি মেয়েলি, এই গরু সরে যা–বলে, অথচ এখানে এসে একজনও তো তেমন চোখে পড়ল না।

আমার কিন্তু এখানে এসে একটা লাভ হয়েছে।

কি?

তোমাকে।

মানে!

তুমি যতই বিপ্লবের কথা বলো, দেশের সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তন চাও, আসলে ভেতরে ভেতরে তুমি খুব রোম্যান্টিক।

কি করে বুঝলে?

রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গেলে তোমার মুখ চোখ অন্যরকম হয়ে যায়। ঠিক কিনা বলো? দুচোখে ঝকঝকে হাসি মাধবীলতার।
 
অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াল। যা কিছু সচল তাই তো বিপ্লবের অবলম্বন। জড়পদার্থ কখনও বিপ্লব করতে পারে না। প্রকৃত বিপ্লবী যে সে কিন্তু মনে মনে ভীষণ রোমান্টিক। চে গুয়েভারা কিংবা মাও সে তুং তো কাঠখোট্টা লোক ছিলেন না। অবশ্য রোম্যান্টিক যে সেই বিপ্লবী হবে এমন আশা করা যায় না, কিন্তু বিপ্লবী যে তাকে কিন্তু রোম্যান্টিক হতেই হবে। রোমান্স মানে জানো তো? মাধবীলতার দিকে দুষ্টুমি চোখে তাকাল অনিমেষ।

সুন্দরের প্রতি আকাঙক্ষা এবং অজানাকে জানতে চাওয়া।

বাঃ, গুড। এরকম সুন্দরী মহিলাকে যখন জানতে চেয়েছি তখন অবশ্যই আমাকে রোম্যান্টিক বলা যায়।

আমি মোটেই সুন্দরী নই। আর তোমাদের জানার আগ্রহটা একবার মিটে গেলেই তো প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল।

সেটা যাকে জানতে যাচ্ছি তার বিশালতার ওপর নির্ভর করে।

মাধবীলতা ভ্রূকুটি করল। তারপর হাতে রাখা শালটা খুলে শরীরে জড়িয়ে নিল। এখন বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বাতাসে। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। সারা দুপুর ধুলো মেখে শরীর বেশ ক্লান্ত। কাছাকাছি কোন রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ছিল না যে সেখানে গিয়ে চা খাওয়া যায়। কোঅপারেটিভের সামনের মাঠটা বাসে বাসে ভর্তি। সরা বাংলা চাপমারা বাসগুলো মেলার যাত্রী নামিয়ে এখানে জিরোচ্ছে। অনিমেষরা কোঅপারেটিভের সামনে এসে দাঁড়াতেই আলো জ্বলে উঠল। তেরাস্তার মোড় এটা। কোন খবর থাকলে এই সময়েই এখানে সেটা পাওয়ার কথা। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ? চল, মেলায় যাই।

অনিমেষ বলল, মেলা তো সারা রাত ধরে চলবে। একটু জিরিয়ে যাই।

পা ব্যথা করছে? বাবা, এটুকু হেঁটেই পা ব্যাথা। তাহলে চল কোথাও বসি।

অনিমেষ এখন এই জায়গা ছেড়ে যেতে রাজী নয়। অথচ সে কথা মাধবীলতাকে বলাও যাচ্ছে না। মাধবীলতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝল কে জানে, আর মেলায় যাওয়া কথা তুলল না। অনিমেষ দেখছিল জনস্রোত বয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। এত মানুষের ভীড়, রিকশার আওয়াজ ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। প্রায় মিনিট কুড়ি দাঁড়ানোর পর অনিমেষের মনে হল সব ঠিকঠাকই আছে।

হলে কেউ না কেউ এতক্ষণে এসে যেত। গোয়ালপাড়া এখান থেকে কত দূর কে জানে। মাধবীলতার সামনে খোঁজখবর নিতে বাধছে। আবার এই ব্যাপারটা মাধবীলতাকে লুকিয়ে করতেও সঙ্কোচ হচ্ছে ওর। সে বলল, চল, এবার মেলার দিকে যাওয়া যাক।

ভীড় বাঁচিয়ে পাশে হাঁটছিল মাধবীলতা। হঠাৎ বলল, তোমার কোন কাজে বাধা দিইনি আমি। বলতেই তো পারতে এখানে দাঁড়ানোটা তোমার একটা কাজের মধ্যে পড়ে।

অনিমেষ কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ও দেখল, কথাটা বলার পর তার উত্তর শোনার আগ্রহ মাধবীলতার মুখে নেই। সে চারপাশের বাগান লোকজন আগ্রহ নিয়ে দেখছে। মেলার মাঠ যত এগিয়ে আসছে তত শব্দ বাড়ছে। মাইক বাজছে। জমজমাট ভীড় আর অজস্র দোকানের আলো মানুষদের চুম্বকের মত টানছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা চিন্তা বিদ্যুৎচমকের মত অনিমেষের মাথায় ঝলসে উঠল। আজ রাত্রে ওদের যে গোপন মিটিং হচ্ছে সেখানে মাধবীলতাকে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না তাহলে এই সময়টা মাধবীলতা কোথায় থাকবে? মিটিং কতক্ষণ চলবে আগে থেকে বলা যাচ্ছে না। মাধবীলতা অবশ্য জানে অনিমেষ গোপন মিটিং-এ যোগ দিতে শান্তিনিকেতনে এসেছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোন আলোচনা করেনি, ঔৎসুক্য দেখায়নি। এ রাত্তিরে এক যুবতী মেয়েকে রেখে যাওয়াটা অত্যন্ত দায়িত্বহীন ব্যাপার হবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল। অবশ্য তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে মাধবীলতাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে সে মিটিং-এ যেতে পারে। একা থাকার ঝুঁকি থাকছে বটে কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে তবু কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
 
মেলায় ঢুকে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল মাধবীলতা। তেস্টা পেয়েছিল। ওরা দু কাপ চা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খাচ্ছে এমন সময় খুব চাপা গলায় নিজের নামটা শুনতে পেল অনিমেষ। ব্যাপারটা এত আকস্মিক যে, হাতের কাপের চা চলকে উঠল, অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে দেখল রে ঠিক পাশেই একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। আলোয়ানে মোড়া শরীর এবং মাথার ফাঁক দিয়ে শুধু এক গাল দাড়ি আর চোখ দেখা যাচ্ছে। এক মুহূর্ত, কিন্তু অনিমেষ চিনতে পারল।

অনিমেষ বলল, বল।

সুবাসদা বলল, তোমার এভাবে মেলায় ঘুরে বেড়ানোটা ঠিক হচ্ছে না।

কেন?

বোলপুর স্টেশনে আমাদের দুজন ছেলেকে পুলিশ ধরেছে। মেলা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও। সুবাসদা যেন নিজের মনেই কথা বলছিল। অনিমেষ আড়চোখে মাধবীলতার দিকে তাকাল। চা খেতে খেতে মাধবীলতা এর মধ্যে একটু সরে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি অন্য দিকে। বুঝতে অসুবিধে হল না যে সে অনিমেষের সঙ্গে সুবাসদার কথাবার্তায় অসুবিধে না হওয়ার জন্যে এইরকম ভঙ্গী করছে। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমাদের মিটিং হচ্ছে তো?

সুবাসদা বলল, হ্যাঁ। কারণ যারা ধরা পড়েছে তার জানতো না কোথায় মিটিং হবে। ঠিক সময়ে নির্দেশ পাবে জেনে এসেছিল। মেয়েটি কে?

আমার আত্মীয়। আচমকা মুখে এসে গেল অনিমেষের।

বিশ্বাস করা যায়?

অনিমেষ নীরবে ঘাড় নাড়ল। তুমি দায়িত্ব নিচ্ছ?

হ্যাঁ। কিন্তু কি ব্যাপার?

সুবাসদা আলোয়ানের নীচ থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে অনিমেষের হাতে দিয়ে দিল, এটা ওর কাছে রাখতে বল। সাবধানে।

কি আছে এতে?

এমন কিছু যা সঙ্গে থাকলে আমার বিপদ হবে। মনে হচ্ছে আমি খুব সেফ নই। তোমরা কোথায় উঠেছ?

একটা বাড়িতে।

ওকে সেখানে ফিরে যেতে বল। মিটিং-এর পর আমি গিয়ে জিনিসটা ফেরত নিয়ে নেব। তোমরা আর দাঁড়িও না। কথাটা শেষ করেই সুবাসদা চোখের পলকে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল।

মাধবীলতা চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে অনিমেষের দিকে ফিরতেই সে খালি কাপটা নামিয়ে রেখে প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল। সামান্য ভ্রুকুটি কিন্তু মাধবীলতা ওটাকে নিয়ে ওর দিকে তাকাল।

অনিমেষ বলল, কি আছে জানি না তবে খুব গোপনে রাখতে হবে। তুমি রাখতে পারবে?

মাধবীলতা বলল, না পারলে কি করবে? আমি রাখব জেনেই তো তুমি প্যাকেটটা নিয়েছিলে।

অনিমেষ বলল, আমি তোমাকে জড়াতে চাইনি কিন্তু।

ঠিক আছে। কথা বাড়িও না। মাধবীলতা প্যাকেটটাকে কাপড়ের আড়ালে এমনভাবে চালান করে দিল যে অনিমেষ স্বস্তি পেল। এক মুহূর্ত মেলার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, আমার পক্ষে মেলায় ঘোরা ঠিক হবে না। তুমি কি করবে?

আমি একা একা ঘুরতে পারব না। ভাল লাগে একা একা ঘুরতে?

তাহলে?

তোমার মিটিং কটায়?

দেরী আছে।

তাহলে চলে বাড়িতে ফিরে যাই।

এখন বাড়িতে ফিরে কি করবে?

গল্প করব। মুখোমুখি বসে! মুখ টিপে হাসল মাধবীলতা।

আমি যখন বেরিয়ে আসব তখন একা থাকতে পারবে?

কি আশ্চর্য। ঘরটার তো দরজা জানলা আছে। আর সেটা এই খোলা আকাশের চেয়ে নিশ্চয়ই বেটার, তাই না?

খারাপ লাগছিল মেলা ছেড়ে যেতে কিন্তু প্যাকেটের ভেতরে কি আছে না জেনে এভাবে ঘুরে বেড়ানো ঝুঁকি নেওয়ার মানে হয় না। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে অনিমেষ ডাকল। মাধবীলতা প্রতিবাদ করলে গিয়ে কি ভেবে চুপ করে গেল।

বিপরীতমুখী ভীড় ঠেলে ওরা যাচ্ছিল। রিকশায় ওঠার পর যেন ঠান্ডাটা আরো বেড়ে গেল। অনিমেষের শীতবস্ত্র এই ঠান্ডার পক্ষে মানানসই নয়। উত্তর বাংলায় যা গায়ে দেওয়া যায় তা এখানে বয়ে আনার কথা মনে ছিল না। মাধবীলতার গায়ে চাদর আছে কিন্তু বোধহয় মেয়েদের শীতবোধ একটু কম।
 
রিকশাটা বড় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে ওরা কাঁচা পথটা হেঁটে আসছিল। দুপাশের বাড়িগুলোর আলো জানলা দরজা বন্ধ থাকায় বাইরে আসছে না। ওরা গেট সরিয়ে বাগানে ঢুকল। অন্ধকার ঝুপসি হয়ে রয়েছে বিরাট বাড়িটায়। কোন মানুষ আছে কিনা টের পাওয়া যাচ্ছে না। খিড়কি দরজা দিয়ে ওরা চাতালে ঢুকে দেখল একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ওদের শব্দ পেয়ে দারোয়ান মুখ বের করে বলল, ও আপনারা। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে?

অনিমেষ বলল, রাত্তিরে আবার বের হবে তাই একটু বিশ্রাম নিতে এলাম।

খাওয়াদওয়া কোথায় করবেন?

অনিমেষের খেয়াল হল রাত্তিরে সে একাই বেরুবে। অতএব মাধবীলতার জন্যে খাবার দরকার। সে একটু এগিয়ে আলো জ্বালা ঘরটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে ভেতরে উনুন জ্বলছে। লোকটি আটা মাখছিল।

ভাবছি খেয়েই বের হবো। তুমি তো নিজের খাবার বানাচ্ছ। আমাদের জন্যে কয়েকটা রুটি আর তরকারী করে দাও না। দামটা নিয়ে নাও।

ডিম খাবেন? ডিমের ঝোল রুটি?

বাঃ, খুব ভালো।

করে দেবো।

টাকাটা এখন নেবে?

থাক, খেয়েই না হয় দেবেন।

লোকটি ওদের পেছনে পেছনে ঘর অবধি এল। দরজাটা ভেজানো ছিল। অনিমেষ সেটা খুলে দেখল টেবিলে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে।

দারোয়ান বলল, বিজলি আলো জ্বালবেন না বাবু। লোকে টের পাবে।

একটু বিরক্ত হলেও অনিমেষ বলল, ঠিক আছে।

দরজা ভেজিয়ে লোকটি বিদায় হরে অনিমেষ বলল, কেমন চোর চোর লাগছে নিজেকে। এভাবে মাথা নীচু করে থাকতে ভাল লাগে না।

উপায় না থাকলে কি করা যাবে। কত লোক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই শীতে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কথা ভাবো তো! মাধবীলতা গায়ের চাদর খুলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে চিন্তা করছিল। তারপর কি ভেবে সেটাকে একটা আলমারির মাথায় রেখে দিল।

ব্যবস্থা না করে যারা আসে তাদের তো ভুগতেই হবে। অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে হ্যারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখল সেটা কাজ করছে না। ঘরের মধ্যে কেমন একটু ভুতুড়ে আলো ম্যাড় ম্যাড় করছে।

মাধবীলতা বলল, আমরা কি ব্যবস্থা করে এসেছিলাম?

আমাদের সঙ্গে বাচ্চা নেই।

নেই! বলে হেসে ফেলল মাধবীলতা।

অনিমেষ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলল ইয়ার্কি হচ্ছে?

ইয়ার্কি কেন! তোমার মত বৃদ্ধ রাশভারী মানুষের সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে পারি? মাধবীলতা খাটের ওপর গুছিয়ে বসল।

অনিমেষ বলল, আমি বৃদ্ধ রাশভারী?

তা নয় তো কি? য়ুনিভার্সিটিতে পড়া একটা ছেলে সব সময় গোমড়া মুখ করে থাকবে? যেন পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা তার মাথায়। চমৎকার!

কথাটা এই প্রথম কেউ আমাকে বলল।

তোমার দুর্ভাগ্য।

হঠাৎ একথা মনে হচ্ছে কেন?

হঠাৎ নয়। আজ অবধি আমকে নিয়ে তুমি কোন সিনেমা দেখতে যাওনি। এই বয়সে ছেলেরা সত্যজিৎ রায় মৃণাল সেন নিয়ে আলোচনা করে, সমরেশ বসুর বিবর নিয়ে তর্ক করে, তুমি করো না। তোমার ব্যবহার একটু এবনরম্যাল মা?

কথাটা অনিমেষের মাথায় কখনো আসেনি। সে মাধবীলতার প্রতিবাদ করল না। হেসে বলল, কি হয়েছে তেমার?

কিছু নয়। এগুলো করছ না বলে আমার অবশ্য বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করল।

অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে মাধবীলতার মাথায় হাত রাখল, আমার সঙ্গে ঝগড়া করছ কেন?

ঝগড়া? কই না তো!

তাহলে এত কড়াকথা শোনাচ্ছ যে! সবাই তো একরকম হতে পারে না।

একরকম হওয়ার কথা আমি বলিনি।

প্রায় অজান্তেই অনিমেষ মাধবীলতার মাথায় হাত দিয়েছিল। মাধবীলতার মুখ এখন গম্ভীর অথচ ছেলেমানুষীর কতগুলো রেখা সে মুখে অদ্ভুত মায়ায় খেলা করছে। অনেমেষ খুব ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। মাধবীলতা মুখ নামিয়ে অনিমেষের বাজুতে গাল রাখল। নরম এবং উষ্ণ চাপ অনিমেষকে বিহ্বল করে তুলছিল। সে মুখ ফিরিয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাতেই দেখল তার দুগাল বেয়ে জলের ধারা নামছে। বিস্মিত অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাঁদছ?

মাথা নেড়ে না বলল, মাধবীলতা কিন্তু চোখের জল মোছার কোন চেষ্টা করল না। অনিমেষ কিছুক্ষণ ওইভাবে নীরবে বসে থেকে ধরা গলায় বলল, লতা, এখনও সময় আছে তুমি ভেবে দ্যাখো।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top