What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

চটপট মুখ ধুয়ে নিয়ে গৌরব নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় শব্দ করল। এই ঘরে এখন মা আর বনি শোয়। টনির আলাদা ঘর। এমন কাশির শব্দে বনির ঘুম ভেঙে যাওয়া উচিত। তিনবার আধ মিনিটের ব্যবধানে শব্দ করার পর মায়ের গলার স্বর শোনা গেল, কে?

গৌরব জানান দিলো। তার পরেও কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মা ধীরে ধীরে দরজা খুললেন। গৌরব দেখল মা পরিষ্কার, মুখে জলের ভেজা দাগও নেই। বরঞ্চ চোখে বিস্ময়, কিরে?

তুমি কাশছিলে?

কই! না তো।

কিন্তু আমি যে তোমার বাথরুম থেকে কাশির শব্দ ভেসে আসতে শুনলাম।

দূর! ভুল শুনেছিস।

গৌরব আচমকা শক্ত হয়ে গেল। সে ভুল শুনতে পারে না। মা ব্যাপারটা গোপন করতে চাইছেন। কিন্তু কেন? সে লক্ষ্য করল মায়ের মুখ সামান্য লাল। এই সময় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কি সারারাত জেগে বই পড়িস যে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছিস ভোরবেলায়?

গৌরব হাসবার চেষ্টা করল, সরি। তুমি রেস্ট নাও। এখনই উঠো না। সে চলে এল ব্যালকনিতে। ব্যাপারটা তার একদম ভালো লাগছিল না। বাংলাদেশের মায়েরা তাদের অসুখের কথা প্রথম দিকে বলতে চান না। হয়তো কাউকে বিরক্ত করার জন্যে সঙ্কোচ হয় তাঁদের। কিন্তু মা তাদের দলে পড়বেন কেন? তার সঙ্গে তো খুব সহজ সম্পর্ক। তারপরেই মনে হলো সে হয়তো একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। কত কি কারণে মানুষের কাশি হতে পারে। আর সবসময়ে যে কারণগুলো খুব ভয়ঙ্কর তা তো নয়।

এরকমটা ভাবতে মন কিছুটা হাল্কা হলো। সে বাগানের দিকে তাকাল, এখন ছায়া ছায়া চারধার। গাছপালাগুলো অত্যন্ত তাজা। সামান্য হাওয়ায় ওরা হাল্কা দুলছে। সে আকাশের দিকে তাকাতেই ধন্দে পড়ল। আকাশ বেশ মেঘলা। যাকে সে এতক্ষণ প্রথম ভোর বলে মনে করছিল সেই সময়টা নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে। যেহেতু সূর্যদেবকে মেঘেরা অক্টোপাশের মতো ঢেকে রেখেছে তাই সেটার চেহারা ফোটেনি রোজের মতো। গৌরব ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। সদর দরজা খুলে বারান্দা পেরিয়ে বাগানে এসে দাঁড়াল। সৌরভ মলি এখনও ওঠেনি। আজকের মেঘলা আকাশ নিশ্চয়ই ওদের সময় সম্পর্ক বিভ্রান্ত করছে। সৌরভ তো ছুটির দিনে সহজে বিছানা ছাড়তে চায় না। সে বাগানে হাঁটতে লাগল। প্রায় প্রতিটি গাছ মায়ের নিজের হাতে যত্নে লাগানো। স্নেহপ্রবণ মানুষের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক খুব নিবিড়। এইখানে বোধহয় মাইনে করা লোকের ওপর নির্ভর করলে মনে তৃপ্তি আসে না।

মেঘলা বলেই সম্ভবত রাস্তা আজ নির্জন। অন্যদিন প্রাতঃভ্রমণকারীদের ক্রমাগত যাতায়াত করতে দেখা যায় রাস্তায়। গৌরব একটা গোলাপফুলের কুঁড়ির দিকে তাকাল। ঈষৎ মুখ খোলা, যেন চুপিসারে আকাশ বাতাস এবং মৌমাছির জন্যে নিজেকে বিকশিত করতে তৈরি হচ্ছে! হঠাৎ গৌরবের মনে হলো আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব চারপাশে ঘিরে থাকলেও মানুষ সবসময়ই একা। কলকাতা কিংবা নিউইয়র্ক অথবা লন্ডনের শহরতলিতে যদি সে একা বাস করে তাহলে কিছু কিছু মুহূর্তে সে একই রকম থাকে। তার নিজস্ব উপলব্ধির মুহূর্তে অন্য কেউ তাকে সঙ্গ দিতে পারে না। এই একাকীত্ব সাময়িকভাবে দূর হয় গ্রথিত সম্পর্কে মানুষের সংশ্রবে এলে। কিন্তু তার আগে পরে সে তার নিজের জন্যেই একা। নিউইয়র্কে বাস করেও মাঝে মাঝে তার মনে যেসব অনুভূতিরা স্বচ্ছন্দে চলে আসে কলকাতার এই ভিড়ে তাদের আসতে কোনো অসুবিধা হয় না যদি সে একা থাকে। হঠাৎই গৌরবের মনে হলো কেউ যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। জয়তী–!
 
এত সকালে জয়তী তার কাছে এসেছে। বুকের ভেতর যেন, অজস্র ড্রাম বেজে উঠল তার। প্রায় দৌড়েই সে পৌঁছে গেল গেটের সামনে, তুমি?

অসুবিধে করলাম? জয়তী হাসার চেষ্টা করল।

কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না গৌরব। জয়তী তার কাছে এলে সে অসুবিধে বোধ করতে কখনও পারে। হ্যাঁ, আমার পক্ষে সময়টা একটু–!

সে জবাব না দিয়ে গেট খুলতে লাগল, এত ভোরে তুমি এলে কী করে? বাস ট্রাম চলছে?

ওগুলো রাত থাকতেই চলাচল শুরু করে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে বসলাম। তারপরই বাড়ির দিকে তাকাল সে, মাসীমা ওঠেননি?

মা উঠেছেন তবে এখনও বাইরে আসেননি। আর সবাই তো ছুটির দিন বলে চুটিয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। খুব অবাক হয়ে যাবে সবাই তোমাকে দেখে।

ঠোঁট কামড়াল জয়তী, একটু ভাবল, তুমি এই অবস্থায় রাস্তায় বেরুতে পারবে?

কেন? তুমি বসবে না? অবাক হলো গৌরব।

একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে।

একটা সময় ছিল রাস্তায় বেরুবার জন্যে গৌরব পোশাকের তোয়াক্কা করত না। কৈশোরে গেঞ্জি গায়ে বাইরের রাস্তায় খেলতে গিয়ে কতবার মায়ের বকুনি খেয়েছে। পরে পাজামা শার্ট পরে স্বচ্ছন্দে বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে আড্ডা মেরেছে। বিদেশে থাকার ফলে ওর স্বভাবে বাড়ির বাইরে এবং বাড়ির ভেতরের পোশাক সম্পর্কে স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি হয়েছে। যে পোশাকে বিছানায় শোওয়া যায় সেই পোশাকে কখনই রাস্তায় বেরুনো উচিত নয়। যে চটি পরে ঘরের ভেতর ঘোরা যায় তাকে রাস্তায় বের করা অনুচিত। কিন্তু এখন তার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। দুটোর কোনোটাতেই সামান্য ইস্ত্রি নেই। ইস্ত্রি করা কাপড় পরে শুলে কিছুতেই ঘুম আসে না। গৌরব রাস্তার দিকে তাকাল। এখনও বেশ নির্জন। স্বভাববিরোধী কাজ করল সে, চলো, একটু হাঁটা যাক। গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে। শূন্য পিচের রাস্তায় গাছেরা এখনও গাঢ় ছায়া ফেলে রেখেছে।

হাঁটা শুরু করে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি রোজ এত সকালে ওঠো?

ওখানে উঠতে হতো। এখানে এসে লেটরাইজার হয়ে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎই। হাসল সে।

ওরা আরও কিছুটা চুপচাপ হাঁটল। ডান দিকে একটা পার্ক। সেখানে কিছু বৃদ্ধ এবং অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতন যুবক রয়েছে। জয়তী জিজ্ঞাসা করল, এই সাতসকালে আমি কেন তোমাদের এখানে এলাম তা তো একবারও জিজ্ঞাসা করলে না!

এত তাড়া তো আমার নেই। তুমি এসেছ সেইটেই আসল কথা।

জয়তী মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। যেন নিশ্বাস বন্ধ করল। তারপর অন্য রকম গলায় গৌরবকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমায় এখনও কি ভালোবাসো?

জবাব না দিয়ে আলতো শব্দ করে হেসে ফেলল গৌরব। সঙ্গে সঙ্গে চাবুক খাওয়ার অভিব্যক্তিতে জয়তী মুখ ফেরাল, হাসছ তুমি?

না। একটা কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল। এই গতকালই আমি একটা ছেলেকে বলছিলাম ভালবাসা হলো একটা চারাগাছের মতো। সবসময়ে আদরযত্ন করতে হয়। তাকে বেড়া দিয়ে রাখতে হয়। গৌরব বলল, এত তাড়াতাড়ি প্রশ্নটাকে শুনতে হবে ভাবি নি।

আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
 
দুটি মানুষ পরস্পরকে যে কারণে ভালবেসেছিল সেই কারণগুলো যদি পরবর্তীকালে দুজনের অসাক্ষাতের জন্যে আর তেমন সক্রিয় না থাকতে পারে। দুজনের মনের ওপর নানা স্তর পড়তে পারে নয় ওই দূরত্ব তৈরি হবার জন্যেই অজানা থেকে গেছে। এরকম ক্ষেত্রে সেই আগের ভালবাসা কতটা জোরালো থাকবে তাই ভাবনার বিষয়।

তার মানে তুমি আর আমাকে ভালবাসো না?

ফিরে এসে আমার আচরণ দেখে তোমার কি তাই মনে হয়েছে?

এই বারো বছরে আমি তো অনেক পাল্টে যেতে পারি যা তুমি জানো না।

নিশ্চয়ই পারো। এবং সেটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তাহলে?

সেটা আমাদের দুজনের ওপর নির্ভর করছে। বারো বছর বিদেশে থাকার সময়ে আমার জীবনে কোনো নারীকে আমি আমন্ত্রণ করিনি। কলকাতায় এসেও যখন পাগলের মতো তোমায় খুঁজে বেড়িয়েছি তখন নিশ্চয়ই পৃথিবীর যে কোনো কোণে তোমার জন্যে যেতে পারি।

কিন্তু তারপর?

তারপর মানে?

দেখা হলো, কথা হলো। আমার এই পরিবর্তিত জীবন তুমি দেখলে। দেখে একটা সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ তোমার আছে। তোমার গত বারো বছরের জীবন আমি জানি না। কিন্তু আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি।

এসব কথা উঠছে কেন?

কারণ তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না!

আমার দিকে তাকাও। এবার বলো, তুমি উত্তরটা জানো না? গৌরব দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমি নিজের মুখে শুনতে চাই। জয়তী চোখে চোখ রাখল।

কী শুনলে তুমি খুশি হবে? গৌরব কোনো তল পাচ্ছিল না।

যা সত্যি। তা এখনও সত্যি।

কীভাবে কথাটাকে বলবে ভাবতে গিয়ে ওঁদের দেখতে পেল গৌরব। সন্দীপ আসছে। সঙ্গে ওর স্ত্রী এবং এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। মানুষটির অনেক বয়স হয়েছে। লাঠিতে ভর করে হাঁটছেন। সম্ভবত সন্দীপের ঠাকুর্দা ইনি যাকে রিসিভ করতে ওরা সেদিন স্টেশনে গিয়েছিল। দূর থেকে হাত নাড়ল সন্দীপ। গৌরব বলল, আমার পুরনো দিনের এক বন্ধু। ইদানীং যোগাযোগ নেই।

জয়তী কিছু বলল না। যে ভাবে কথা এগোচ্ছিল তাতে ওই মুহূর্তে এই বাধা সে খুব একটা পছন্দ করছিল না। তবু মুখ সহজ করার চেষ্টা করল।

সন্দীপরা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। সন্দীপ বলল, তুই মর্নিং ওয়াক করিস, অথচ তোকে কোনোদিন এপথে দেখিনি তো!

সন্দীপের স্ত্রী হেসে উঠল। তুমি এমন করে বলছ যেন কত বছর ধরে মর্নিং ওয়াক করছ, দাদু না এলে তো সাতটার আগে বিছানা ছাড়ানো যেত না।

সন্দীপ লজ্জা পেল না। কাউকে তো একটা জায়গা থেকে শুরু করতেই হয়। ওহো, দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, দাদু আমার বন্ধু গৌরব বসু, আমেরিকায় আছে অনেক দিন পর এদেশে বেড়াতে এসেছে।

গৌরব নমস্কার করল বৃদ্ধকে। তিনিও দুটো হাতযুক্ত করলেন। এবং এবার অস্বস্তি। ওদের নজর জয়তীর দিকে। স্বভাবতই জয়তীর পরিচয় জানতে ওরা উৎসুক। গৌরব বলল, তোদের সঙ্গে জয়তীর আলাপ করিয়ে দিই। জয়তী, এ হলো সন্দীপ। ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী ছিল। সন্দীপের স্ত্রী এবং ওদের দাদু। আর জয়তী আমার সঙ্গে পড়ত।

সন্দীপের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, আপনি এপাড়ায় থাকেন?

জয়তী মাথা নাড়ল, নাঃ। গৌরবের সঙ্গে একটু দরকার ছিল। পরে এলে ওকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না তাই সাতসকালকে বেছে নিতে হলো।
 
গৌরব জয়তীর গলায় উষ্ণ আভাষ পেল। সে হাসল। এসে অবধি সারাদিন এত চক্কর মারছি। তোদের বাড়িতে যে যাব তার সময় পাইনি।

সন্দীপ জয়তীকে বলল, আপনাকে আমি কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি। এতগুলো বছর হয়ে গেল, খুব একটা পাল্টে যান নি।

এই স্বাভাবিক কথায় জয়তী যেন স্বস্তি পেয়েই সামান্য হাসল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগছে দাদু, নাতির কাছে এসে।

ভালো খুব ভালো। এদিকটা তো বেশ ফাঁকা তাই আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। শহরের ভেতরে না যেতে হলে আমার কোনো অসুবিধে নেই।

সন্দীপ বলল, দাদুর একটা প্রব্লেম হয়েছে। ওঁর বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে একটা ঘা কিছুতেই শুকোচ্ছে না। অনেক ওষুধ দেওয়া হলো!– ভাবছি একজন ভালো স্কিন স্পেশালিস্টকে দেখাবো। আজ চলি, আর তোদের আটকে রাখব না।

মাথা নাড়ানাড়ি করে ওদের দলটা চলে গেলে গৌরব কথা খুঁজল। হঠাৎ যেন কিছুক্ষণ হইচই হবার পর বড্ড বেশি থিতিয়ে গিয়েছে আবহাওয়া। ওরা চুপচাপ কিছুটা পথ হাঁটার পর একটা ভাঁড়ের চায়ের দোকান দেখতে পেল গৌরব। সে জিজ্ঞাসা করল, চা খাবে?

এখানে? জয়তী অবাক হলো। এটাকে দোকানও বলা যায় না। একটা কাপড় মাথার ওপর কোনোমতে টাঙিয়ে লোকটা কয়লার উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে বসেছে। দুটো দেহাতি চেহারার মানুষ তার সামনে উবু হয়ে বসে চা খাচ্ছে।

হ্যাঁ, খুব খারাপ করবে না মনে হয়। গৌরব লোকটাকে দুটো চা দিতে বলল ভাঁড় ধুয়ে। লোকটা তার সম্ভব মতো যত্ন নিয়ে ভাঁড়ে চা ঢেলে দিলো। চুমুক দিয়ে গৌরব বলল, আঃ। দারুণ।

চা একটু ঠাণ্ডা না করে খেতে পারে না জয়তী। সে ভাঁড়টাকে ধরেই বলল, আমেরিকায় নিশ্চয়ই ভাঁড়ের চা পাওয়া যায় না?

মাথা খুঁড়লেও নয়। তবে যদি কেউ অনুমতি যোগাড় করে ভাঁড়ের চা আর তেলেভাজার দোকান খুলতে পারে তাহলে পাঁচ বছরে মিলিওনিয়ার হয়ে যেতে পারবে। ওখানে এই পরিমাণ চা ম্যাকডোনাল্ডের মতো রাস্তার দোকানে প্রায় আটটাকা পড়ে ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে কনভার্ট করলে। আমেরিকার পঞ্চাশ পয়সা।

তা তুমি কি এখানে এসে পুরনো অভ্যেসে এই ভাবে ঝালিয়ে নিচ্ছ না ইচ্ছে করেই দেখাতে চাইছ আমেরিকায় বারো বছর তোমার মাথা ঘুরিয়ে দেয় নি!

জয়তী, আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি।

চায়ের দাম মিটিয়ে ওরা এবার ফিরল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাল রাত্রে ঘুমিয়েছিলে তো?

কেন?

মুখ এত শুকনো লাগছে কেন?

তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি।

প্রশ্ন? ও গৌরবের মনে পড়ল। তারপর বলল, তোমাকে না ভালবেসে বেঁচে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারি না জয়তী।

কেন?

এটা আমার রক্তে মিশে গিয়েছে। এতেই আমার শান্তি। অদ্ভুত আলো খেলে গেল জয়তীর মুখমণ্ডলে এই মেঘের সকালে। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। গৌরবের পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটতে লাগল। কখনও গৌরবের হাতে তার হাতে চলার ছন্দেই স্পর্শ নিচ্ছে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল গৌরব অগ্রণী হয়ে আঙুলগুলো আঙুলে জড়িয়ে নিক। কথা না বলে সে পারল না, আচ্ছা তুমি তো আমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করলে না কেন আমি এই অদ্ভুত সময়ে এসেছি!

দুটো কারণ। প্রথম কথা আমার কাছে আসার জন্যে তোমার সময় বিচার করার কোনো দরকার নেই। তোমার এমন ইচ্ছে হওয়াটাই আমার আনন্দ। দ্বিতীয় কারণ তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারো। এই সময় কেন এলে জানতে চাইলে তোমার মনে হতে পারে আমি কৈফিয়ত চাইছি। মাথা নেড়ে নিজের কথা বোঝাল গৌরব।
 
বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিল ওরা। জয়তী দাঁড়িয়ে পড়ল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী হলো?

জয়তী মুখ নামাল, আমি তোমাকে ছেড়ে আর থাকতে পারব না।

গৌরবের সমস্ত শরীরে রোমাঞ্চ ছড়াল। সে আবিষ্কার করল গলার স্বর আসছে না। সমস্ত শরীরে অদ্ভুত আনন্দ।

জয়তী নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, কাল সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি গৌরব! কেবলই মনে হচ্ছিল আমরা আমাদের বানানো কিছু ভাবনা আঁকড়ে থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র করে রাখি। আমরা সবসময় প্রতিরোধ করতে চাই, সমর্পণের আনন্দ পেতে জানি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা সত্যি। নইলে বারো বছর কলকাতা শহরে একা এমনভাবে সব কিছু উপেক্ষা করে থাকতে পারতাম না। কিন্তু ওই সত্যিটার ওপরে নানা ডালপালা চাপিয়ে নিজেকে ভোলবার চেষ্টা করে এসেছি এতদিন। কিন্তু কী পেয়েছি তাতে? কিছু না।

গৌরব বলল, তোমার কোনো দোষ নেই। এটা নাগরিক সভ্যতার ফল। সবসময় জটিল ভাবনা এসে সরল সত্যকে আড়াল করে রাখে। নিজের ইগো ক্রমশ এতবড় চেহারা নেয় যে নড়াচড়া করার কোনো উপায় থাকে না।

জয়তী বলল, তুমি, তুমি আমার সঙ্গে একমত?

হ্যাঁ, কিন্তু–?

আবার কিন্তু কেন? তোমার সমস্যা? আমায় নিয়ে?

না, না। আমার পক্ষে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসা কতখানি সম্ভব হবে জানি না। আমি দেশে না ফিরলে তোমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া মা রয়েছে। সব মিলিয়ে!

আমি আর এসব নিয়ে ভাবতে পারছি না। জীবন যেমন চলার তেমন চলুক।

জয়তী কপাল থেকে চুল সরাল।

.

যা ছিল বারো বছরের বিতর্কিত বিষয়, কলকাতায় এসে এতদিনেও গৌরব যার কোনো সুরাহা করতে পারে নি সেই সমস্যা যে এই সাতসকালে কয়েক পা হাঁটাহাটি করেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে তা গৌরবের ধারণার বাইরে ছিল। মানুষ যখন আন্তরিকভাবে কিছু চায়, যখন ভালবাসাই তার কাছে হৃদপিণ্ড হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রিয়জনকে সে আর প্রতিপক্ষ বলে কল্পনা করে না। তার সব ত্রুটি বিচ্যুতি, আচরণের অন্ধকার অংশগুলো সে উপেক্ষা করে যায়। যা একসময়ে একান্তই অবাস্তব বলে মনে হতো তাই হয়ে যায় সরল সহজ। তখন আর কথা নয়, কথায় কথা তৈরি হয় এবং সেটা বাতাসের মতো অবয়বহীন হয়ে ভেসে চলে।

জয়তীকে নিয়ে বাড়ির গেটে পৌঁছতেই সরলার সামনে পড়েছিল গৌরব। ভদ্রমহিলা তখন বাগান পরিচর্যা করছিলেন। এত অবাক হয়ে তাকালেন তিনি যে গৌরবের লজ্জা করছিল। দ্রুত এগিয়ে এসে তিনি বলেছিলেন, ও মা, জয়তী আসবে তা তুই আমায় বলিসনি তো?

গৌরব মাথা নাড়ল, আমিই কি ছাই জানতাম!

সরলা বললেন, যা মোক্ষদাকে তিন কাপ চা করতে বল, আমরা এখানেই চা খাব।

একবারও এমন প্রশ্ন করলেন না যাতে জয়তী বিব্রত হতে পারত। অথচ এই সকালে আসার জন্যে জয়তী সেরকম প্রশ্নের সামনে পড়তে পারত।
 
দাঁত মেজে, পরিষ্কার হতে না হতেই মোক্ষদার চা হয়ে গেল। গৌরবের খেয়াল হলো, জয়তী যদি সাত তাড়াতাড়ি চলে আসে তাহলে ওরও তো পরিষ্কার হবার প্রয়োজন আছে। একথা মায়ের সামনে বলতে কোনো অসুবিধে নেই অথচ এখন তার একটু অস্বস্তি হচ্ছে কেন? সে বাইরে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। বাগানে কেউ নেই। তারপরেই পেছনে মাকে দেখতে পেল।

সরলা বললেন, ঘুম থেকে উঠেই চটপট চলে এসেছে, মেয়েটা এখনই আসছে, মোক্ষদাকে বললাম ব্যালকনিতেই চা দিতে।

গৌরব চেয়ার টেনে বসে পড়তেই সরলা বসলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ওর সঙ্গে তোর সব কথা হয়ে গিয়েছে?

হ্যাঁ। গৌরব মাথা নাড়ল।

আমি তোকে একমাস সময় দিলাম। তার মধ্যে যা করার করবি।

কী করতে বলছ?

জানিস না আমি কী বলছি?

সেটা তো যে কোনো দিনই হতে পারে। একমাস অপেক্ষা করার কোনো কারণ আছে কি। নোটিস টোটিস দেওয়ার ব্যাপারটাও ম্যানেজ করা যায়।

তুই মন্ত্র পড়তে চাস না?

দ্যাখো মা, আমাদের যা বয়স তাতে মন্তর পড়ার মানসিকতা থাকতে পারে না। অবশ্য তুমি এবং জয়তী যদি চাও তাহলে আমাকে মেনে নিতেই হবে।

তুই আর একটি মানুষের কথা ভুলে যাচ্ছিস। জয়তীর মা।

ও হ্যাঁ। কিন্তু উনি বোধহয় আপত্তি করবেন না। ওঁর ছোট মেয়ের বিয়েতে মন্ত্র শাঁখ বাজা এসব হয়নি।

তোর যদি মন্ত্র পড়তে আপত্তি থাকে তাহলে এক কাজ কর। যে ভাবে হিন্দু পরিবারে বিয়ে হয়, তত্ত্ব যাওয়া আসা, গায়ে হলুদ আশীর্বাদ এসব হবে। তুই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিয়ে করতেও যাবি কিন্তু সেখানে ছাঁদনাতলায় বসে মন্ত্র না পড়ে দুজনে সই করবি। এতে হবে?

একশ বার। কিন্তু সেখানে আর একটু যোগ করা দরকার। আমি যতক্ষণ সেখানে না যাচ্ছি ততক্ষণ বিয়ে বাড়িটা মেয়েদের দখলে, মানে মেয়েপক্ষের। আমি পৌঁছে যাওয়ার পর দুপক্ষের।

বুঝলাম না।

তখন বরযাত্রী কন্যাত্রী একাকার হয়ে যাবে। বিয়ে এবং বউভাত একই সঙ্গে হবে। ক্যাটারার সব করবে। দুদুবার একই ঘটনা ঘটানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

বেশ আমার আপত্তি নেই।

তাহলে তুমি এইভাবে কথা বলো। এই সময় মলি এসে দাঁড়াল, বাবাঃ, তোমরা সাত সকালে উঠে পড়েছ। তারপর গলা তুলে বলল, মোক্ষদা আমার জন্যে চা করো। এই গোরা, চা খাবে?

তুমি আগে নিজের চা বলে তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করছ?

আমি জানি মা যখন উঠেছেন তখন তোমার এক কাপ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মলি এসে তৃতীয় চেয়ারটিতে বসল। ফুল ছড়ানো সাদা শাড়ি পরেছে মলি। বয়সের ছাপ পড়লেও দেখতে আরাম লাগে। অন্তত মলির যখন মেজাজ ভালো থাকে তখন তাকে সবার পছন্দ হবেই। মলি চোখ ছোট করলো, কী দেখছ?

তোমাকে। গৌরব গম্ভীর হবার ভান করল, কী সুন্দর তুমি।

মলি সরলার দিকে তাকাল, মা শুনছেন?

সরলা হাসলেন, কথাটা তো মিথ্যে নয়।

গৌরব বলল, এত সুন্দর কেন তুমি?

আমি জানি না, যাও। মুখ বাঁকাল মলি।

জানো, খোঁজখবর নাও। মুরুব্বিচালে বলল গৌরব।

ওমা! কীসের খোঁজ নেব? অবাক মলি।

কেন তুমি এত সুন্দর!

সকালবেলায় কেন আমায় লেগপুল করছ বলো তো?

এই সময় জয়তী আর বনি বেরিয়ে এল মায়ের ঘর থেকে। তাকে দেখে চমকে গেল মলি, ওম্মা! তুমি কখন এলে? কাল রাত্রে? আমি জানি না তো! শেষ শব্দ তিনটি সরলার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল মলি।

সরলা বললেন, জয়তী একটু আগে এসেছে। এসো, এখানে এসে বসো জয়তী।

জয়তী এগিয়ে এল। একটু হেসে মলিকে জিজ্ঞাসা করল, ভালো আছেন?
 
মলি মাথা নাড়ল। তার বিস্ময় যেন যাচ্ছিল না। সে গৌরবের দিকে তাকাল। গৌরব মিটি মিটি হাসছে। সেই হাসি দেখে সন্দেহ হলো মলির। চকিতে সরলার দিকে তাকাল সে, মা সত্যি? বেশ উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা গলায় জিজ্ঞাসা করল মলি।

সরলা নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠল মলি। প্রায় দৌড়েই চলে গেল নিজের শোয়ার ঘরের দিকে। চেয়ারে বসে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, কী হলো?

সরলা বললেন, ওর অমন মাঝে মাঝে হয়। এই বনি দাঁত মাজা হয়েছে?

হ্যাঁ।

যা টনিকে তোল আগে। তারপর আসছি।

বনির যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তাকে যেতে হলো। এই সময় মোক্ষদা চায়ের ট্রে নিয়ে এল। সঙ্গে বিস্কুট। সরলা প্রথমে জয়তীকে দিলেন। চা নেওয়া হয়ে গেলে তিনি মোক্ষদাকে কিছু নির্দেশ দিলেন। ওদিকে মলির গলা পাওয়া যাচ্ছে। সে যেন জোর করেই সৌরভকে বিছানা থেকে তুলল।

জয়তী বলল, আমি বোধহয়ে সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

ভালোই তো। একটু অন্যরকম হলো।

সেদিন সকাল জুড়ে বাড়িতে আড্ডা হইচই। যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। জয়তীরও খুব ভালো লাগছিল কারণ কেউ তার আর গৌরবের বিষয়ে কোনো কথা তুলছিল না। অথচ বোঝাই যাচ্ছিল সেটা প্রত্যেকেরই জানা।

ব্রেকফার্স্ট খাওয়ার পর জয়তী উঠল, আমি চলি।

মলি আপত্তি তুলল, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে?

সরলা বাধা দিলেন, না, না। কত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ওর মা চিন্তা করছেন। গোরা, তুই ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয়।

তৎক্ষণাৎ কথা বলল সৌরভ, না, গোরা না। আমি জয়তীর সঙ্গে যাব।

মলি খেঁকিয়ে উঠল, তুমি যাবে মানে? তোমার কি মাথায় কিছু ঢোকে না?

খুব ঢোকে। আমি যাচ্ছি, জয়তী, এক মিনিট অপেক্ষা করো ভাই।

সৌরভ উঠে গেল। গৌরব কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে ভেবেই রেখেছিল যে জয়তীর সঙ্গে বেরুবে। কিন্তু সৌরভের এই কথার পরে আপাতত কিছু করা সম্ভব নয়। সে জয়তীকে জিজ্ঞাসা করল, বিকেলে বাড়িতে থাক?

হ্যাঁ। জয়তী মাথা নাড়ল।

.

খানিকক্ষণ হাঁটার পর ট্যাক্সি নিল সৌরভ। গাড়িতে উঠে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, জয়তী, তুমি কি চাও গোরা আমেরিকায় সেটল করুক?

জয়তী জবাব দিলো না। সৌরভ কোনো অর্থ বুঝতে পারল না। সে বোঝাতে চেষ্টা করল, না, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দ্যাখো, এদেশের ভালো ছেলেরা কিছু কমফর্টের আশায় বিদেশে চলে যায় তাহলে সর্বনাশ। কোনোদিন উন্নতির মুখ দেখব না আমরা। তাছাড়া ওখানে একা থেকে ও করবে কী? তোমারও সমস্ত আত্মীয়স্বজন এখানে, আমরাও থাকব, তোমার ভালো লাগবে আমেরিকায়?

আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন? নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল জয়তী।

হ্যাঁ। ও ভেবে পাচ্ছে না। ওর মনে হচ্ছে এখানে চাকরির আবহাওয়া নেই। আমি জোর করে একটা অ্যাপ্লিকেশন করিয়েছি। সামনের সপ্তাহে ইন্টারভিউ। যদি ও ইন্টারভিউ দিতে যায় তাহলে চাকরি না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মাইনে এখন প্রায় পাঁচ হাজার। কটা বাঙালি পায়। অবশ্য ও আমেরিকায় যে ডলার পায় তার সঙ্গে তুলনা করা ভুল হবে।

জয়তী নিজের অভিমত স্পষ্ট বলতে পারল না। আসলে সে নিজেই বুঝতে পারছিল না গৌরবের কী করা উচিত। দেশে ভালোভাবে কেউ যদি থাকতে পারে তাহলে তার বিদেশে যাওয়ার কি দরকার? মুস্কিল হলো, এই ভালোভাবে থাকার ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। কে কীসে শান্তি পায় তা বোঝা সহজ নয়। অতএব এই কিছু চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে যদি এর জন্যে কথা শুনতে হয় তবে তার থেকে খারাপ আর কিছু হবে না।

জয়তীদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো সৌরভ। তারপর বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দেখে ভাবছ আমি এমন হুট করে চলে এলাম কেন?

না না, আপনি আসুন, আমি কিছু ভাবছি না। জয়তী এগিয়ে চললো।
 
দরজায় শব্দ করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। জয়তীর মা দরজা খুলে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। জয়তী বলল, মা ইনি গৌরবের দাদা।

সৌরভ এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চেষ্টা করতেই ভদ্রমহিলা দ্রুত সরে দাঁড়ালেন, আরে না, প্রণাম করতে হবে না। জয়তী, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়।

বাইরের ঘরে সৌরভকে বসিয়ে, জয়তী ভেতরে চলে গেল। মা আগেই চলে গিয়েছিলেন, মেয়েকে বললেন, কোথায় গিয়েছিলি, আমি চিন্তায় মরছি।

গৌরবদের বাড়িতে। জয়তী মাথা নামাল।

সেকী? কেন? মা বিস্মিত।

এমনি।

মা মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। জয়তী বলল, বাইরের ঘরে উনি বসে আছেন। যাও।

জয়তীর মা ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে এলেন। এসে জিজ্ঞাসা করলেন, সব খবর ভালো?

সৌরভ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

জয়তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু বলবে?

হ্যাঁ। আমরা আপনার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে পাকাপাকিভাবে নিয়ে যেতে চাই।

এ তো ভালো কথা। এই খবরটা শোনার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি।

ব্যাপারটা হলো গোরা তেরো সপ্তাহের ছুটিতে কলকাতা এসেছে আমাদের ইচ্ছে ওর ছুটি ফুরোবার আগে বিয়েটা হয়ে যাক।

তোমরা যা চাও তাই হবে।

তাহলে একটা দিন ঠিক করা যাক। সৌরভ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল, অন্তত দিন পনেরো সময় দরকার। আপনাদের আত্মীয়স্বজন, আমাদের সকলকে খবর দিতে হবে।

তোমরা কি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দিতে চাও।

আপনার যা ইচ্ছে। অবশ্য গোরা বলছে সে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করবে না, তবে বর যেভাবে আসে সেইভাবেই আসবে। বিয়ের পিঁড়িতে বসে সই সাবুদ করবে। বিয়ে এবং বউভাত একসঙ্গে করতে হবে। কিন্তু এসব ওর ইচ্ছে, যদি আপনার ইচ্ছে আলাদা রকমের হয় তাহলে সেটাকে মেনে নিতে ওকে বাধ্য করব।

না না। বাধ্য করতে হবে না কাউকে। বিয়ে করবে ওরা, ওদের যেমন ইচ্ছে সেইরকম হবে। ভালোই তো, আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে তো ওরা কিছু করতে চাইছে না। জয়তীর মা বললেন, ছোট মেয়েকে যা দেবার দিয়ে দিয়েছি। এখন যা আছে তা তো জয়তী পাবে। আমি চেষ্টা করব তাই দিয়ে বিয়েটা ভালোভাবে দিয়ে দিতে।

সৌরভ হাত তুলল, শুনুন। এই বিয়েতে কোনোরকম দেওয়া-থোওয়ার কথা তো উঠতেই পারে না। আমাদের পরিবারে এর চল নেই। আপনি এমন কিছু করবেন না যা আপনার সাধ্যের অতিরিক্ত। মা হিসেবে আপনার সম্মানে যাতে আঘাত না লাগে তাই শুভকাজের সব আয়োজন আপনাকেই করতে দিচ্ছি। কিন্তু ওই পর্যন্ত। বাকিটার দায়িত্ব আমাদের।

কথাটা বুঝতে পারলাম না।

আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম যা মেয়েদের তরফ থেকে করতে হয় তার দায়িত্ব আপনি নেবেন। কিন্তু নিমন্ত্রিতদের খাওয়া-দাওয়া মানে ডিনারের আয়োজন আমরাই করব!

সেকি? আমার মেয়ের বিয়েতে যারা আসবে তাদের আমি খাওয়াবো না?

কথাটা ঠিক। কিন্তু আপনি আপনার আত্মীয় বন্ধুদের নেমতন্ন করবেন। সেই সঙ্গে বরযাত্রী হিসাবে যারা আসবে তাদেরও। কিন্তু তার সংখ্যা কত বড়জোর দশ পনের। কিন্তু বউভাতে তো আমাদের কয়েকশ মানুষ আসবেন। তাদের দায়িত্ব তো আপনার নয়। যখন বিয়ে আর বউভাতের রিসেপশন আমরা একসঙ্গে করছি তখন মনে করুন আমরা আপনার ছেলে, একসঙ্গে সব দায়িত্ব নিচ্ছি। সৌরভ আন্তরিক গলায় জানাল।

জয়তীর মার পছন্দ হচ্ছিল না কথাগুলো। কিন্তু তিনি প্রতিবাদও করতে পারলেন না। প্রতিবাদ করা মানে বলতে হয় অনুষ্ঠান দুটো আলাদা করে করতে।

.
 
চৌরঙ্গীর ওপরে কোম্পানির নিজস্ব চারতলা বাড়ি। গেটে দারোয়ান, পার্কিং প্লেস, বিশাল কাচের দরজা ঝকঝকে মেঝে এবং সুদৃশ্য রিসেপশনে সুন্দরী রিসেপশনিস্টদের অবস্থা বলে দিচ্ছে কোম্পানিদের অবস্থা খুব ভালো। আর যাই হোক চৌরঙ্গী এলাকায় নিজস্ব পার্কিং স্পেস রাখার ক্ষমতা কম অফিসেই আছে।

রিসেপশনিস্ট খুব স্মার্ট অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা। জিজ্ঞাসা করলেন, কী করতে পারি?

অনুগ্রহ করে বলে দিন মিস্টার এস কে গোয়েল, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের কাছে পৌঁছতে গেলে আমায় কী করতে হবে? গৌরব বারো বছরে অভ্যস্ত মার্কিনি উচ্চারণে প্রশ্নটা করল। তফাতটা কানে লাগল মহিলার। অপাঙ্গে একবার দেখে নিয়ে সতর্ক ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আসবেন তা উনি জানে?

হ্যাঁ, কারণ উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

টেলিফোনের রিসিভারে হাত রেখে মহিলা জানতে চাইলেন, কী নাম বলব?

গৌরব বসু। আজ একটা ইন্টারভিউ নেবার কথা আছে।

মহিলা সেই কথা জানাতে ওপাশ থেকে অনুমতি মিলল। টেলিফোন নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, সামনেই লিফ্ট। সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে সোজা চলে যাবেন করিডোরের শেষ। ওখানেই ওয়েটিং রুম। বলে হাসলেন, উইশ ইউ এ গুড লাক!

ধন্যবাদ। গৌরব পা বাড়াল। লিফট নেমে আসছিল নিচে। পাশাপাশি দুটো। ভেতরে ঢোকার আগে পেছন ফিরে তাকাতেই গৌরব দেখল রিসেপশনিস্ট মহিলা ওই অতদূর থেকেও তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন। সে মাথা নাড়তেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

অপেক্ষা করার ঘরে গিয়ে গৌরব দেখল আরও দুজন ভদ্রলোক সেখানে আগে থেকেই বসে আছেন। পুরো বাড়িটাই সেন্ট্রালি এয়ার কন্ডিশল্ড তবু একজন কপালের ঘাম মুছলেন। দুজনের পরনে স্যুট, টাই। গৌরব ইচ্ছে করেই স্যুট পরেনি। কলকাতার গরমে স্যুট পরার কোনো যুক্তি নেই। আর টাই-এর ব্যবহার তো আজকাল আমেরিকাতেও বন্ধ হতে চলেছে। নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে সে পৌঁছে গিয়েছে। এই সময় দরজায় একজন বয়স্কা মহিলা এলেন। হাতে ডটপেন। সেটা নেড়েচেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি এখান থেকে পাঠানো চিঠিগুলো এনেছেন?

টাইপরা একজন সটান উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

ঘরে ঢুকে চিঠিগুলো নিয়ে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেলেন একটু অপেক্ষা করতে হবে। আধঘণ্টার মধ্যেই চেয়ারম্যান এবং মেম্বাররা আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

গৌরব একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল। এই ধরনের কোম্পানিগুলোর বার্ষিক কার্যকলাপের রিপোর্ট পাতায় পাতায় ছড়ানো। একটা লেখার দিকে নজর পড়ল তার। লেখক কোম্পানির চেয়ারম্যান। কম্পুটার এবং উৎপাদন বিষয়ক প্রবন্ধ। পড়তে পড়তে বেশ মজা লাগছিল তার। একদম প্রাথমিক স্তরের কথাবার্তা হঠাৎ একজন চেয়ারম্যান বলবেন কেন? ভারতবর্ষে কম্পুটার প্রবর্তনে বেকার সমস্যা বাড়বে না বলেছেন ভদ্রলোক কিন্তু এর পেছনে তেমন জোরালো যুক্তি নেই। কম্পুটারের কাজ যদি কয়েক হাজার মানুষের সময় বাঁচিয়ে দিতে পারে, দীর্ঘসূত্রতাজনিত দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করতে পারে সেইটে করাই অন্যায়। কলকাতায় বসে কম্পুটার বলে দিতে পারে মাদ্রাজ থেকে বাঙ্গলোর যাওয়ার রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে কিনা। জীবনযাপন স্বস্তির না হয়ে কিছু বেকারের চাকরির নামে অষ্টাদশ শতকে দেশটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার মতো মূর্খতা সহ্য করা যায় না।
 
গৌরব দেখল চারজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়। তাদের খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। একজন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কী জন্যে এখানে এসেছেন তা জানতে পারি?

টাই পরা একজন বলল, আমাদের ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হয়েছে।

মাথা নাড়লেন, আপনারা এই মুহূর্তে অফিস ছেড়ে চলে যান।

টাই পরা লোকটি খুব ঘাবড়ে গেল, কেন?

আমরা ইন্টারভিউ নিতে দেব না। আজ ইন্টারভিউ হবে না।

কিন্তু একটু আগে এক মহিলা বলে গেলেন।

যে যাই বলুক, এখন আমরা যা বলছি তা করুন। সমস্ত অফিস খেপে উঠেছে। কর্মীরা যদি আপনাদের ওপর নির্যাতন করে তাহলে দায়ী হব না।

গৌরব এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার উঠে দাঁড়াল, কিছু মনে করবেন না। আপনারা কারা?

ইউনিয়নের নেতা আমরা।

আচ্ছা! ইন্টারভিউটা কেন হতে দেবেন না?

আমাদের সঙ্গে কোম্পানির কন্ট্রাক্ট হয়েছে কোনো ভ্যাকেন্সি হলে সেই পোস্টে এমপ্লয়িসদের মধ্যে স্যুটেবল থাকলে তাকে আগে প্রেফারেন্স দিতে হবে। আপনারা জানেন না এটা।

না জানতাম না। গৌরব বলল, কন্ট্রাক্ট হয়ে থাকলে সেটা ভাঙা ঠিক নয়। কিন্তু সব পোস্টের ক্ষেত্রে কি একই কন্ট্রাক্ট।

না। কিন্তু আমরা স্যুটেবল প্রার্থীর লিস্ট নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি সময় দিতে চাইলেন না। এর প্রতিবাদে আজ ইন্টারভিউ হতে দিতে পারি না আমরা। কর্মীদের জীবন নিয়ে কোম্পানিকে ছেলেখেলা করতে দেওয়া হবে না। আপনারা চলে যান।

জঙ্গী ভঙ্গিতে বললেন নেতা।

এই সময় তিনজন অফিসার গোছের লোক সেই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। টাক মাথা একজন, যিনি বাঙালি নন, ইংরেজিতে নেতাকে জিজ্ঞস করলেন, আমরা আপনাদের দাবি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। চেয়ারম্যান খুবই ক্ষুব্ধ।

উনি ক্ষুব্ধ হলে আমাদের কিছু করার নেই। নেতার জবাব।

আপনারা ইন্টারভিউ করতে দেবেন না?

না। ঘরের ছেলেদের বঞ্চিত করে বাইরে থেকে লোক নেওয়া চলবে না।

আপনারা ঠিক কী চান?

আমাদের কর্মী এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে যারা প্রার্থী তাদের ডাটা আপনাদের দিয়েছি

দিয়েছেন। কিন্তু ধরুন পোস্টটা একজন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারের আর আপনাদের ক্যান্ডিডেট সংস্কৃতে অনার্স।

হতেই পারে না। নেতা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন, এই দেখুন, দুজন ক্যান্ডিডেট বি এস সি করে কম্পুটারে কোবাল কোর্স কমপ্লিট করেছে এদের ডাকুন ইন্টারভিউতে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top