What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

বাইরের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জয়তী বলল, কি লজ্জায় ফেললে! এই সময় মলি ও সরলা নেমে এলেন। পরিচয় করিয়ে দেবার পর জয়তী সরলাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই সরলা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন মা? এইভাবে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলতে হয়?

জয়তী কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পারল না। গৌরব আর সেখানে দাঁড়াল না। তার এবার স্নান করা দরকার। খিদেও কম পায়নি। খুব ভালো বলেছে টনি। মেয়ে ইন্দ্রজিত। সমস্যাগুলোকে সামনে রেখে শুধু নিজেকে আড়াল করে যাচ্ছে জয়তী, দেখা যাক, আজ ওঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়।

জলই যদি মাছের জীবন তবে নদীর মাছ কি সমুদ্রের গিয়ে স্বস্তি পায়? কিন্তু অনেক সামুদ্রিক মাছ স্বচ্ছন্দে উজান বেয়ে ঢুকে যায় নদীর ভেতরে। তাদের জীবনের অন্যতম কর্তব্য ডিম উৎপাদন করে ফিরে যায় সমুদ্রে। কোনো কোনো মাছ যারা নুনে মানুষ, তাদের মিঠে জলে অসুবিধে হয় না কিন্তু মিঠে জলের মাছেরা নুনজল সহ্য করতে পারে না। সেই বিকেলে বাড়ি ফিরে একথা মনে হয়েছিল জয়তীর। সে নিজে কি নুনজলের মাছ? নইলে অতক্ষণ একটা পরিবার সবার আদরের মধ্যে থেকে একটু অস্বস্তি হলো না তো তার? এ তো তার অভ্যেস ছিল না। গৌরবের মা যে ভাবে কথা বলেছেন সেইভাবে কেউ কখনও কোনোদিন কথা বলেনি। বস্তুত লজ্জাই করছিল তার। তিনি যে ধরেই নিয়েছেন জয়তী তার ছোটবউ। এবং সে যেন ইচ্ছে করেই তাকে এবং তার ছেলেকে কষ্টের মধ্যে রেখেছে। গৌরবের বউদি বলেছেন তিনি একা আর কতদিন সংসারের ভার বইবেন? জয়তী এলে সেটা ভাগ করে নেওয়া যেত। এমন কি টনি বনি পর্যন্ত তার সঙ্গে আঠার মতো লেগেছিল। চলে আসার আগে সবাই বলেছিল, ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। গৌরবের মা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন তিনি আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে পারবেন না। এইসব কথা শুনতে এমন আন্তরিক ব্যবহার পেতে কোন্ মেয়ের না আনন্দ হয়? কিন্তু জয়তীর যে একই সঙ্গে অস্বস্তি হচ্ছে সেকথা ওখানে বলার উপায় ছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল যোগ্যতা ছাড়াই তাকে সম্মান দেখানো হচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে আর একটা ভাবনা মাথায় এল। গৌরব ইচ্ছে করেই তাকে এই পরিবেশে এনে ফেলেছে। নিজে কয়েকবার বলে যখন জয়তীর কাছ থেকে ঠিকঠাক সাড়া পায়নি তখন বাড়ির লোকের মধ্যে তাকে এনে কথা বের করার চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই মাথা গরম হয়েছিল জয়তীর। কিন্তু পরিবেশটা এমন কিছু সে সব কিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফেরার সময় ট্যাক্সিতে বসে গৌরব চুপচাপ ছিল। জয়তী জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা কী হলো? নির্বিকার মুখে গৌরব জানতে চাইল, কোনটা?

বাড়িতে নিয়ে এসে তুমি আলাদা সরে রইলে। আর এঁরা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করলেন যেন এ বাড়ির বউ হয়ে আসাটা আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে এবং সেই ইচ্ছেটা করছি না বলেই এরা অসুখে রয়েছেন। জয়তী সোজাসুজি তাকাল।

তোমার কী মনে হলো? এ বাড়ির লোক চাইলেই তুমি আসতে পার না?

দ্যাখো গৌরব। এঁরা খুব ভালো। আমি কিন্তু এঁদের বিয়ে করছি না।

মানে?

বিয়ে হবে তোমার সঙ্গে আমার। এঁরা সম্পর্কে সম্পর্কিত।

নিশ্চয়ই।

তোমার আমার সমস্যাটাকে সমাধান না করে আমাকে এঁদের মধ্যে এনে খুব অন্যায় করেছ। এখন নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।
 
তুমি কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বলেছিলে আমি যেখানে যাব তুমি সেখানেই যাবে। অতএব তোমাকে জোর করে বা ভুলিয়ে আমি এই বাড়িতে আনিনি।

জয়তী মুখ ফেরাল। হ্যাঁ, এই কথাটাও মিথ্যে নয়।

গৌরব গলা নামাল, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? আমি কি তোমার উপযুক্ত নই?

না। আমার মধ্যে একটা ধারণা কাজ করছে, আমিই তোমার উপযুক্ত নই।

অদ্ভুত।

না গৌরব, মাঝে মাঝে তোমাকে আমার খুব অচেনা মনে হয়।

কেন?

তা বলতে পারব না।

তাহলে আর আমি জোর করব না। জোর করার জন্যে অধিকার বোধ থাকা দরকার তা তুমি আমাকে দিতে চাও না অথবা আমিই অর্জন করিনি। কিন্তু তোমার মা আমাদের বাড়িতে আসবেন।

কেন?

আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে।

আমি নিষেধ করে দেবো।

কী বলবে?

বলব প্রয়োজন নেই।

না।

মিছিমিছি ওদের মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে কী লাভ?

স্বপ্ন তো মিথ্যেই। স্বপ্ন কি বাস্তব? ওটা মনের কল্পনা। জয়তী হাসতে চাইল, যদি কিছু বলার হয় আমিই বলব। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বল তো, বারো বছর আগে তুমি আমাকে যেমন দেখে গিয়েছিলে আমি কি তেমন আছি? আমাকে কি তোমার একটুও পাল্টানো বলে মনে হয় না?

তুমি একটু ভারী হয়েছ। বারো বছর সময় তোমাকে গম্ভীর করেছে। নদীর চেহারা পাহাড়ে যেমন থাকে সমতলে পড়লে তেমন থাকে না। এখন তুমি অনেক শান্ত। মনে রেখ আমার বয়স বারো বছর বেড়েছে। গৌরব জয়তীর দিকে তাকাল, তোমার গাল ভরাট হয়েছে, চোখের চাহনিতে সেই চটপটে ভাব নেই, চুলের সংখ্যা একটু কমলেও কমতে পারে। শরীর।

থাক, আর বলতে হবে না। গৌরবের এসব কথা কেড়ে নিয়ে জয়তী বলল, পাল্টানো বলতে আমি শুধু শরীরের কথাই বলছি না। আমার মন

তোমার মন? তার তলই পেলাম না যে চিনতে পারব। গৌরব হেসে উঠল।

জয়তী আর কথা বাড়াল না। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, মাকে তুমি কীভাবে নেবে?

ওঁর যা ইচ্ছে তাই করতে দিলে ভালো হয়।

কিন্তু আমি আমেরিকায় যেতে চাই না।

বেশ তো, তুমি এখানেই থাক। বিয়ে করলে যে একসঙ্গে আমাদের থাকতে হবে এমন কোনো বাঁধাধরা শর্ত নেই। গৌরব ট্যাক্সি ড্রাইভারকে থামাতে বলল। জয়তীর বাড়ি এসে গেছে।

দরজা খুলে নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল জয়তী। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, আমি যখন যেটা করি সেটা পুরোপুরিই করি। আধাখেঁচড়ায় বিশ্বাস নেই আমার। এই বয়সে যদি বিয়ে করি তাহলে বিবাহিতার মতনই থাকব। জয়তী যতক্ষণ বাড়িতে ঢুকে না গেল ততক্ষণ চুপচাপ বসে রইল গৌরব। তারপর ড্রাইভারকে বলল গাড়ি ঘোরাতে। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। কলকাতায় এসে অনেকগুলো মোটাদাগের সমস্যা দেখেছে বলেই কি জয়তীকে সে ঠিক বুঝতে পারছে না, এমনও হতে পারে!

.
 
টনি বনির স্কুল পর পর তিনদিন ছুটি। সৌরভ অফিসের কাজে যথারীতি বাইরে, সরলা বাগান পরিষ্কার করছিলেন গৌরবকে দেখে বললেন, ছেলেমেয়েদুটো ইস্কুল আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যেতে পায় না। তুই যা, ওদের নিয়ে তোর জেঠিমাকে দেখে আয়।

জেঠিমা? প্রশ্ন করেই গৌরব লজ্জিত হলো।

বারে ছেলে! জেঠিমাকে এর মধ্যে ভুলে গেলি! সরলা অবাক।

না, না, ভুলব কেন? আসলে অনেকদিন সম্পর্ক না থাকায় সম্পর্কগুলোর ওপর ধুলো পড়ে যায়। জেঠিমা কেমন আছেন এখন?

দুবছর আগে সতু এসেছিল একবার। তখন বলেছিল চোখে একদম দেখতে পান না। তাই নিয়েই সংসারে সব কাজ করে যাচ্ছেন।

সতুদা এর মধ্যে আসেনি কেন?

হয়তো সময় পায় না। তবুও তো ও এসেছিল, তোর দাদা একবারও যায়নি।

সতুদা কী করছে?

যা করত গ্রামের স্কুলে মাস্টারি।

গৌরব মানুষটিকে মনে করতে পারল। কালো রোগা, বড় বড় চোখ মুখে হাসি লেগে থাকত সবসময়। অভাব ব্যাপারটাকে যেন গ্রাহ্যই করত না। সতুদা গৌরবের বাবা সম্পর্কিত ভাই-এর ছেলে। ওর মাকে জেঠিমা বলত গৌরবেরা। একদম বাল্যকালে সেই গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমেরিকায় যাওয়ার আগে সে ঘুরে এসেছিল জেঠিমার সঙ্গে দেখা করে। চমৎকার আচার করতেন ভদ্রমহিলা। গৌরবের মন যাওয়ার প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলো। সে বলল, শুধু টনি বনি কেন? তুমি আর বউদিও চলো আমাদের সঙ্গে।

সরলা মাথা নাড়লেন, নারে রাস্তা থেকে অনেকটা হাঁটতে হয়। আমি পারব না, তোর বউদি যদি যেতে চায় নিয়ে যা ওকে।

মলি কথাটা শুনেই চোখ তুলল কপালে, ইম্পসিবল। একদিনের জন্যে অত খাটুনি আমার পোষাবে না ঠাকুরপো।

গৌরব বোঝাতে চাইল, আহা ওদের তো তিনদিন ছুটি আছে, তোমার ইচ্ছে হলে আমরা একটা রাত ওখানে কাটিয়ে আসতে পারি।

না বাবা। গ্রামের ওই বাড়িতে রাত কাটানো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তোমার মায়ের কাছে শুনেছি বাথরুম করতে নাকি মাঠে যেতে হয়।

দূর। সেসব অনেক আগের কথা। এখন নিশ্চয়ই বাথরুম হয়ে গিয়েছে।

হলেও তার ধরন কতটা ভালো হবে বোঝাই যাচ্ছে। কলকাতায় বাস করে মিনিমাম যে কর্মকাণ্ডগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তা থেকে বেরুতে তো পারব না। ছেলেমেয়েরা যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারো। তবে রাত কাটিও না। গ্রামে শুনেছি চড়ুই পাখির সাইজে মশা ওড়ে।

টনি বনি কিন্তু লাফিয়ে উঠল প্রস্তাব শুনে। ওরা এখন পর্যন্ত গ্রাম দ্যাখেনি।

বনি বলল, এই গ্রামটা কি নিশ্চিন্দিপুরের মতো কাকা?

নিশ্চিন্দিপুর?

আঃ, অপুদের গ্রাম।

গৌরব হেসে ফেলল, তোরা বুঝি গ্রাম বলতে পথের পাঁচালির গ্রাম বুঝিস। সিনেমা দেখে না বই পড়ে ধারণাটা হয়েছে?

টনি বলল, সিনেমা দেখে।

বনি বলল, আমি বইটাও পড়েছি। ফ্যান্টাস্টিক।

গৌরব বনির মুখের দিকে তাকাল। পথের পাঁচালি সম্পর্কে ফ্যান্টাস্টিক শব্দটা কখনও ব্যবহৃত হয়েছে? ওই শব্দটির মানে যাই হোক না কেন একটু হাল্কাভাব যেন লেগে থাকে। সে আর এ ব্যাপারে কথা বাড়াতে চাইল না। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশের ভাষা হয়তো এরকমই। পথের পাঁচালি যে ভালো লেগেছে, অ্যাকশন নেই, স্লো, গেঁয়ো বলে নি তাই ঢের।
 
একটা ঝুলিতে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে পরদিন সকালে ওরা বাড়ি থেকে বের হলো। সরলা চেয়েছিলেন একপ্রস্থ কাপড়জামা সঙ্গে দিয়ে দিতে। কিন্তু মলি আপত্তি করেছিল। ওগুলো নিয়ে গেলেই এরা রাত কাটিয়ে আসবে। বাইরে গিয়ে ছেলেমেয়েরা হাতির পাঁচ পা দেখবে!

ধর্মতলায় এসে বাস ধরল গৌরব। আগে সরাসরি বাস ছিল দিনে তিন-চারটে। এখন আধঘণ্টা অন্তর আর তাদের নম্বরও অনেক, জিজ্ঞাসা করে করে তবে বাস বাছতে হলো। টনি বনি পাশাপাশি বসার জায়গা পেয়েছিল, গৌরব ওদের পেছনে। বাস ছাড়া মাত্র ওটা প্রায় ভরে গিয়েছিল। বনি মুখ ফিরিয়ে বলল, দারুণ থ্রিলিং ব্যাপার কাকু।

কেন রে? গৌরব জানতে চাইল।

এই ভাবে কোনোদিন যাইনি আমরা।

টনি জানলায়। সে জিজ্ঞাসা করল, কলকাতাটা কখন শেষ হবে কাকু?

সামনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক এদের কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার শব্দ করে হেসে বললেন, কলকাতা কোথায় শেষ হবে বলা শক্ত। যেভাবে চার পাশের গ্রাম শহর কেড়ে নিচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত পেছনে ফেলে বাস যে পথে ছুটতে লাগল তার দুপাশে চাষের মাঠ জলা আর পরিষ্কার আকাশ। মাঝ বাসের ভেতরটা মানুষের চাপে হাঁসফাস করছিল। এখন প্রায় প্রতিটি স্টপেই কিছু কিছু যাত্রী নেমে যাচ্ছেন। গৌরবের মনে পড়েছে রাস্তাটা আগে এমন ছিল না। কে বলে পশ্চিমবঙ্গে কাজকর্ম বা উন্নতি তেমন হয়নি। এদিকে পিচের রাস্তার কথা পনের বছর আগে কেউ ভাবতেও পারত না। রাস্তার ধার দিয়ে ইলেকট্রিকের লাইন চলে গিয়েছে। অর্থাৎ এখন গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।

ওরা যেখানে বাস থেকে নামল সেখানে কোনো ঘরবাড়ি নেই, বাসস্টপ বলেই একটা ভাঙাচোরা চায়ের দোকান রয়েছে। এই রকম চায়ের দোকান পশ্চিমবাংলায় সর্বত্র এবং ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় পথ চলতেই দেখা যায়। অথচ সমস্ত আমেরিকার অথবা য়ুরোপে এর সন্ধান পাওয়া যাবে না। গৌরবের মনে পড়ল একবার এক ছুটির দিনে নিউইয়র্কের থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে সে পরিকল্পনাহীন বেড়াতে গিয়েছিল। যে বাসে যাওয়া তাতেই ফিরে আসা। ঘণ্টাখানেক জিরোবে বাস, আর সেই ফাঁকে একটু গ্রাম ঘুরে নেওয়া। দুশো কিলোমিটার যেতে বাসটা সময় নিয়েছিল আড়াই ঘণ্টা। যা হোক, বাস থেকে নেমে সে সুন্দর সাজানো গ্রামের বাড়ি, মাঠের শস্য, বাচ্চাদের খেলা দেখতে দেখতে ভেবেছিল এক কাপ চা অথবা কফি পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু পুরো গ্রাম খুঁজেও চায়ের দোকান চোখে পড়েনি। ডিপার্টমেন্টাল শপে যাবতীয় জিনিস বিক্রি হচ্ছে। গ্রামের মানুষ সেখান থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে গিয়ে রান্না করে খায়। অথচ শ পাঁচেক টাকায় এখানে চমৎকার চায়ের দোকান খোলা যায় আর এই সব চায়ের দোকানদাররা দিনে পঞ্চাশ টাকার বিক্রি সহজেই করে যা বিদেশে কেউ ভাবতেই পারে না। টনি জিজ্ঞেসা করল, কী ভাবছ কাকু?

গৌরব বাস্তবে ফিরে এল, কিছু না।

বাস চলে যাওয়ার পর জায়গাটা একদম ফাঁকা। চায়ের দোকানদার ওদের জিজ্ঞাসা করল, কোন্ গাঁয়ে যাবেন?

গৌরব বলল, হলদিয়ানি।

কার বাড়িতে?

সত্যদা।

অ, মাস্টার, তা অনেকখানি হাঁটতে হবে। ডানদিকের রাস্তা ধরে চলে যান। মিনিট পাঁচেক বাদেই গঙ্গা পাবেন। গঙ্গার ধার দিয়ে গেলেই হলদিয়ানি।

গায়ে পড়ে উপকার বোধহয় এশিয়ার মানুষ ছাড়া কেউ করে না। মাটির চওড়া রাস্তায় নেমে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁরে হাঁটতে পারবি তো তোরা? নইলে চল, এখান থেকেই ফিরে যাব।

বনি চিৎকার করল, না কক্ষনো না।

বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এই গ্রামের পথ বালিতে ভরা। হাঁটতে সুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু চমৎকার বাতাস বইছে। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়েছে, বোঝা যাচ্ছে ওরা খুব আনন্দ পাচ্ছে। টনি তো চেঁচিয়ে উঠল, দ্যাখো কাকু, আকাশটা কী নীল!

গৌরব হেসে বলল, আকাশ তো নীলই হয়।

মোটেই না। প্রতিবাদ করল টনি, কলকাতার আকাশ কক্ষনো নীল নয়।

এই সময় একটা সাইকেল রিকশাকে এগিয়ে আসতে দেখল। বনি বলল, কাকু রিকশা।

গৌরব মাথা নাড়ল, না। ভালো করে দ্যাখ এটা কিন্তু সাইকেল রিকশা নয়। পেছনে সিট নেই। বসার, ছোট্ট একটা প্ল্যাটফর্ম। এতে করে জিনিসপত্র নিয়ে যায়।

ততক্ষণে রিকশাটা এসে গিয়েছে। রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে জিজাসা করল, কোন্ গাঁয়ে যাবেন বাবু?

গৌরব উত্তর দেওয়ার আগেই টনি বলল, হলদিয়ানি।

পাঁচ টাকা দিন পৌঁছে দিয়ে আসি। রিকশাওয়ালা নেমে দাঁড়াল।

বনি বলল, আরে, এই রিক্সায় মানুষ যাতায়াত করে?

হ্যাঁ দিদি। গ্রামের ব্যাপার তো, মাল মানুষ যখন যেটা পাই তুলে নিই। সিটওয়ালা রিকশা হলে মাল নিতে অসুবিধে হতো, মাল তো নয়, এক একজন যেন পাহাড় তুলে নিয়ে যায়। উঠুন আপনারা।

গৌরব ইশারা করতেই টনি বনি সন্তর্পণে উঠে মাঝখানে বসল পাশাপাশি।
 
গৌরব পেছনে দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। রিকশার দিক বদল হলো। দেখা গেল পা মুড়ে বসতে হলেও খুব খারাপ লাগছে না। ঝাঁকুনি হচ্ছে কিন্তু সেটা কিছু নয়। বনি জিজ্ঞাসা করল, গঙ্গা কতদূর?

ওইতো বাঁক ঘুরলেই, হাওয়ায় জলের গন্ধ ভাসছে, বুঝতে পারছেন না? টনি নাক টানল। যেন গন্ধটা নিতে চাইছে সে। তারপর হেসে ফেলল। বাঁকা ঘুরতেই চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপার। গঙ্গা যেন আচমকা গায়ের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু এ কোন গঙ্গা? বনি বলল, ও কাকু এ তো সমুদ্র!

টনি বলল, হ্যাঁ কাকু ওপার দেখা যাচ্ছে না। কলকাতায় তো দেখা যায়।

গৌরব দেখল বড় বড় ঢেউ আসছে, ভেঙে পড়ছে পাড়ের ওপর। এত বছরেও নদীটার চেহারাটা পাল্টায়নি। হ্যাঁ এখানে গঙ্গাকে আর নদী বলে মনে না। আর কয়েক কিলোমিটার পরেই তো সমুদ্র। তাই দেখলে মনে হয় সমুদ্র যেন নিজেই উঁচিয়ে গঙ্গায় ঢুকে পড়ে বিশাল করে তুলেছে চেহারাটা।

বনি আদুরে গলায় বলল, ও কাকু, এখানে একটু বসবে?

টনি ধমকে উঠল, রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকবে?

অগত্যা আর বসা হলো না। গঙ্গার গা ঘেঁষে কিছুটা যাওয়ার পর রিকশা আবার পথ পাল্টালো। এবার গাছ চেনার খেলা। আম, কাঁঠাল চেনা গেল, লিচু চিনতে হিমশিম খেয়ে গেল দুজনে, কটা কালচে পাতার ঝোঁপ দেখিয়ে গৌরব জিজ্ঞেস করল, ওটা কি বল তো। রিকশাওয়ালাও মজা পেয়েই দাঁড়িয়ে গেল। টনি বনি অনেক ভাবল। শেষ পর্যন্ত বনি বলল, কোনো ডেকোরেটিভ পাতা।

হো হো করে হেসে উঠল গৌরব। রিকশাওয়ালা এগিয়ে গিয়ে দুটো পাতা ছিঁড়ে এনে দুজনের হাতে দিয়ে বলল, লক্ষ্মণকে যখন প্রায় মেরে ফেলেছিল তখন হনুমান গিয়েছিল গন্ধমাদন পর্বতে বিশল্যকরণী পাতা খুঁজতে। ওই পাতার রস যদি লক্ষ্মণকে খেতে দেওয়া যায় তো তিনি সেরে উঠবেন। পাতা চিনতে না পেরে পুরো পাহাড়টাকেই উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল হনুমান। তাই এখানে ওখানে ওই পাতার গাছ ছড়িয়ে গিয়েছে। এটা হলো বিশল্যকরণী পাতা।

দুজনেই প্রবল বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল, সত্যি?

গৌরব বলল, আমি তো সেই সময় ছিলাম না যে বলতে পারব এই পাতাই লক্ষ্মণকে বাঁচিয়ে ছিল কি না। তবে কেটে গেলে এই পাতার রস লাগালে খুব তাড়াতাড়ি জুড়ে যায়, এটা দেখেছি।

বনি বলল, উঃ ফ্যান্টাস্টিক। এটা নিয়ে যাব, আমার বন্ধুদের দেখাতে হবে।

গৌরব বলল, ঠিক আছে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, যাওয়ার সময় একটা ডাল নিয়ে গেলেই হবে। আচ্ছা, আমরা তো গ্রামের মুখে এসেই গেছি, এখান থেকে হেঁটে গেলে খারাপ লাগবে না। নাও, ভাই তোমাকে আর যেতে হবে না। পাঁচটা টাকা রিকশাওয়ালার হাতে গুঁজে দিলো সে।
 
দুপাশে ছোট শাকের খেত, মাঝে মাঝে গ্রাম্যবাড়ি, ওরা হাঁটছিল। এরই মধ্যে গৌরব নাজেহাল হয়ে পড়েছে ওদের প্রশ্নে। এটা কী গাছ ওটা কোন ফুল যেন একদিনেই সব জেনে নিতে চায় টনি বনি। এই সময় এক বৃদ্ধকে আসতে দেখা গেল বিপরীত দিক থেকে। তাকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল গৌরবের কিন্তু সঠিক ধরতে পারছিল না। মুখোমুখি হতেই বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে গেলেন।

কেমন আছ? অনেকদিন পরে তোমায় দেখলাম। বৃদ্ধ বললেন।

ভালো। হ্যাঁ, আসা হয় না বড় একটা। গৌরব বিব্রত গলায় জবাব দিলো।

আমেরিকা থেকে কবে ফিরলে?

এই তো কিছুদিন হলো।

বিয়ে থা করেছ?

আজ্ঞে না। উত্তর দিতেই গৌরবের সন্দেহ তীব্র হলো।

এরা তোমার দাদার ছেলে মেয়ে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি কেমন আছেন মাস্টারমশাই?

এতক্ষণে চিনতে পারলে? আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি গুলিয়ে ফেলছ। দেখছিলাম শেষ পর্যন্ত চিনতে পার কিনা। না, সাকসেসফুল মানুষের গুণ তোমার মধ্যে আছে। তোমার নিজেরই মনে নেই আমিই তোমার হাতে খড়ি দিয়েছিলাম!

গৌরব ভদ্রলোককে প্রণাম করল। আপনি আমাকে লজ্জা দেবেন না।

মাস্টামশাইকে গর্বিত বলে মনে হলো। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ছুটিতে এসেছ?

হ্যাঁ।

গৌরব। বিদেশে অনেকদিন আছ নিশ্চয় এমন কিছু শিখেছ যা এখানকার মানুষ জানে না। যদি সম্ভব হয় তাহলে সেই বিদ্যেটা দেশের মানুষকে শেখাও। মাস্টারমশাই সামান্য হাতটা তুললেন, আচ্ছা চলি। যদি বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে।

শ্লথগতিতে ভদ্রলোক হাঁটা শুরু করলেন। গৌরব চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দিকে তাকিয়ে ছিল। এই রকম ভুল তার হলো কী করে? মাস্টারমশাইকে ভুলে যেতে পারল সে? যদিও এই ভদ্রলোকের কাছে সে ছমাসের বেশি পড়েনি এবং সেটা পাঁচ বছর বয়সে তবু! হঠাৎ টনি জিজ্ঞাসা করল, কাকু হাতেখড়ি মানে কী?

গৌরব হেসে ফেলল, তোর হাতেখড়ি হয়নি?

না তো। টনি ঘাড় নাড়ল।

গৌরব বনির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তুই বুঝিয়ে দে।

না, আমি তোমার মুখে শুনব। টনি জেদ ধরল।

হাঁটা শুরু করল গৌরব, আগে পাঁচ বছর বয়স পার না হলে লেখাপড়া করতে হতো না, পাঁচ বছর পূর্ণ হলে সরস্বতী পূজোর দিন সকালে কোনো বয়স্ক মানুষ শ্লেটে খড়ি দিয়ে, খড়ি মানে চক, অক্ষর লেখাতেন। অ আ ই ঈ। ব্যস তখন থেকে তার লেখাপড়ার পালা শুরু হয়ে গেল। কোনো অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে যেমন ফিতে কাটতে হয় তেমনি ছাত্রজীবনের উদ্বোধনের নাম হাতেখড়ি।

আমার হাতেখড়ি হয়নি কেন?

কী করে বলব? আমি তো তখন বিদেশে ছিলাম।

বনি বলল, তুই তিন বছর বয়স থেকে নার্সারিতে পড়ছিলি। আর তোকে কখনও শ্লেটপেন্সিলে লেখানো হয় নি, তোর হাতেখড়ি হবে কী করে?

টনির মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছিল হাতেখড়ি না হওয়ায় তার একদম ভালো লাগছে না।

বাঁ দিকে একটা খেলার মাঠ। মাঠের প্রান্তে টিনের চালওয়ালা একতলা কয়েকটা ঘর। দেখলে ব্যারাক বাড়ি বলে মনে হয়। সেখান থেকে গান ভেসে আসছিল। গৌরব বলল, ওই তো স্কুল। চল দেখি, সতুদাকে বোধহয় স্কুলেই পেয়ে যাব।
 
মাঠের মাঝ বরাবর আসতেই গানের লাইনগুলো স্পষ্ট হলো, ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী। ওরা বারান্দার সামনে দাঁড়াল যতক্ষণ গান শেষ না হয়। মাঝখানের ঘরে ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে ছাত্ররা গান গাইল। তাদের সামনে চারজন শিক্ষক গলা মেলাচ্ছিলেন। গান শেষ হতেই ছাত্ররা চারটে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় এবং বনিকে দেখে ওদের চোখে কৌতূহল স্পষ্ট। এই সময় শিক্ষকদের একজনের নজর পড়ল এদিকে। গৌরব দেখল সতুদা এগিয়ে আসছে দ্রুত পায়ে। মানুষটাকে আরও রোগা আরও বয়স্ক মনে হচ্ছে। কিন্তু হাসি আর চেহারা পাল্টায় নি।

প্রায় চিৎকার করে সতুদা জিজ্ঞাসা করল, আরে গোরা তুই?

চলে এলাম। গৌরব হাসল।

কোত্থেকে? কবে এসেছিস আমেরিকা থেকে? সতুদা খুব উত্তেজিত।

কিছুদিন হলো।

আমি ভাবতেই পারছি না তুই এসেছিস!

কিন্তু অসময়ে তোমাকে বিব্রত করলাম। এখন তোমার কাজের সময়।

তোর অনারে এক ঘন্টা ছুটি করে নিতে পারব। ওঃ, মা চমকে যাবে।

জেঠিমা কেমন আছেন?

মা মায়ের মতনই। চোখে দেখতে পান না একদম।

ছানি কাটাওনি?

ছানির ব্যাপার নয়। মায়ের আইবল দুটোই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তার জন্যে তিনি বিন্দুমাত্র বিব্রত নন। বাড়ি গেলেই দেখতে পাবি। একটু দাঁড়া।

সতুদা ভেতরে চলে গেল। গৌরব বনিকে জিজ্ঞেস করা, তোরা ওকে চিনিস না? দুবছর আগে আমাদের বাড়িতে তো গিয়েছিল।

বনি জবাব দিলো, আমরা তখন স্কুলে ছিলাম। তার অনেক আগে একবার এসেছিলেন ঝাপসা মনে আছে।

প্রণাম করবি।

ফস্ করে টনি বলে বসল, পায়ে ভীষণ ধুলো।

গ্রামে বাস করলে পায়ে ধুলো লাগবেই।

সতুদা বেরিয়ে এল, চল।

এই সময় টনি আর বনি প্রণাম করল। দুহাতে দুজনকে জড়িয়ে ধরে সতুদা হাঁটতে লাগল, বাপরে, সৌরভদার ছেলেমেয়ে কত বড় হয়েছে। সৌরভদা বউদি তো ভুল করেও গ্রামে আসেন না। তোমরা বড় হচ্ছ, তোমরা তো আসতে পার। দ্যাখো শহরের কোনো আরাম গ্রামে নেই। কিন্তু খুব সামান্য জিনিসের মধ্যেও গ্রামে অনেক স্বস্তি পাওয়া যায়। ধর, তুমি স্কুল যাচ্ছ য়ুনিফর্ম পরে, বেড়াতে যাচ্ছ খুব সাজগোজ করে কিন্তু রাত্রে যখন নিজের বিছানায় ঘুমাতে যাও তখন কি সেই পোশাক থাকে? থাকে না। তখন তুমি আটপৌরে পোশাকেই শুয়ে পড়। কারণ বিয়েবাড়ি যাওয়ার সাজে ঘুম আসবে না। গ্রামে মাঝে মাঝে আসবে ওই আটপৌরে হবার জন্যে বুঝলে।

গৌরব হাসল, তুমি এখনও ঠিক আগের মতো সুন্দর কথা বলো।

এক ভদ্রলোক সাইকেলে চেপে যাচ্ছিল। সতুদা হাত তুলে চিৎকার করলেন, ও অজয়দা একটু দাঁড়াবে।

ভদ্রলোক প্যাডেল থেকে পা নামালেন। সতুদা এগিয়ে যেতে চিৎকার করলেন, একে চিনতে পারছেন?

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না।

গৌরব বলল, আমি কিন্তু আপনাকে চিনেছি। আপনি খুব ভালো সাঁতার কাটতেন। একবার গঙ্গা পার হয়েছিলেন বাজি ধরে।

অজয়বাবু মাথা নাড়লেন, যাচ্চলে! আমি তো একে চিনতে পারছি না সতুমাস্টার।

সতুদা বলল, আমার ভাই গোরা। গৌরব।

গোরা? যে শুনেছি আমেরিকা গিয়ে মেম বিয়ে করেছে?

সেটা আমি বলতে পারব না। সতুদা হাসল।

হো হো করে হেসে উঠল গৌরব, এরকম গল্প চালু হয়েছে বুঝি? আমেরিকায় গেলেই বিয়ে করতে হবে মেমসাহেবকে?

করোনি? যাচ্চলে!

মেম বিয়ে করা খুব সহজ নয়।

সেকি শুনেছি বাঙালি ছেলেরা সে দেশে গিয়ে বাড়ির ঝি কিংবা রেস্টুরেন্টের চাকরানিকে বিয়ে করে নিয়ে আসে।

আমেরিকায় বাড়িতে কাজ করার জন্যে ঝি পাওয়া যায় না। যদি রাখতে হয় তবে তাদের মাইনে আমাদের টাকায় মাসে পনের হাজার।
 
অজয়বাবু অবিশ্বাসী চোখে তাকালেন, অত দিতে হবে না, ওর দশ ভাগের এক ভাগ দিলেই আমাদের দেশের মঙ্গলার মা, বাবুর মা, পাঁচির মা ছুটে যাবে আমেরিকায় কাজ করতে। যাক, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগল। আমরা তো কিছুই হতে পারলাম না, তুমি অন্তত তোমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ।

গৌরব এই ধরনের কথাবার্তার সামনে কিঞ্চিত অসহায় বোধ করল। তাকে ইনি প্রশংসা করছেন না নিজের জন্যে আফসোস করছেন তা ধরা মুশকিল। বাঙালির একটা নিজস্ব ধরন আছে আফসোস করার। অন্যকে প্রশংসা করার ছলে নিজের জন্যে হা-হুতাশ ছিটকে বের করে তারা। সেই প্রশংসাকে প্রশংসা বলে ধরা নিতান্তই বোকামি। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম। আমার কিছু হয় নি তোমার হয়েছে মানে আমি সুযোগসুবিধা পাইনি বলে বঞ্চিত হয়েছি আর তুমি সেগুলো পেয়েছ বলে এগিয়ে গিয়েছ। এই এগিয়ে যাওয়াটা আমার দ্বারাও সম্ভব ছিল। অতএব তোমার আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই তোমার ডাঁট দেখাবারও কিছু নেই।

সতুদা বলল, অজয়দা, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। গোরা এক মিনিট। সতুদা ভদ্রলোকের সঙ্গে এগিয়ে গেলেন কিছুটা। কথাবার্তা কী হলো গোরার পক্ষে শোনা সম্ভব ছিল না কিন্তু সতুদাকে পকেট থেকে টাকা বের করে অজয়বাবুর হাতে দিতে দেখল সে। সেখান থেকেই হাত নেড়ে অজয়বাবু চলে গেলে সতুদা হাসিমুখে ফিরে এল, চল।

কিছু দরকার ছিল না আমাদের জন্যে অত টাকা খরচ করার। গৌরব বলল।

তোর জন্যে কে বলল। ভাইপো ভাইঝি এসেছে না? সতুদা হাসল। এখন তোর আমেরিকা জীবন সম্পর্কে কিছু বল।

গৌরব বলল, একই রকম। দিল্লি বম্বেতে আমি থাকলে যেমন হতো। শুধু আরও কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধে পাওয়া যায়, কাজের জায়গায় মন দিয়ে কাজ করা যায় এই আর কি!

শুনেছি ওখানে প্রচুর বাঙালি আছে!

তা আছে। ছেড়ে দাও ওসব কথা। তুমি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলে না সতুদা?

দূর! বিয়ে করে খাওয়াবো কী?

এর পরে সতুদা টনি বনির সঙ্গে জমে গেল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে ওরা। কোন জিনিসটা কী তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা চলছে সমানে। বনি টনি সেগুলো মন দিয়ে শুনছে। সেই বিশাল বট গাছটা চোখে পড়ল। ছেলেবেলায় শুনত ওই গাছে নাকি এক ব্রাহ্মণ দম্পতি মারা যাওয়ার পর বাস করেন। কি যেন বলে, ব্রহ্মদৈত্য। তারা নাকি কারো কোনো ক্ষতি করেন না। গাছটাকে দেখল গৌরব। একই রকম রয়েছে। শুধু সেই ব্রহ্মদৈত্য দম্পতি এখনও আছেন কিনা কে জানে। সতুদাকে ইচ্ছে করেই জিজ্ঞাসা করল না সে। সতুদা তখন দুজনকে বোঝাতে আরম্ভ করেছে কত রকমের ধান হয় আর তাদের কী কী নাম।

ইটের পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলা পড়েছে। কোথাও একটু আধটু ভাঙনের চিহ্ন। এই পাঁচিলটাকে এক সময় ভালো চেহারায় দেখেছিল গৌরব। টিনের দরজা ভেতর থেকে একটা তারের হুকে আটকানো। সতুদা ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে সেটা খুলে বলল, এসো। ভেতরে অনেকখানি জায়গা, গাছপালা, বাগান। বাগানে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। লতানো ডালে কুমড়ো হয়েছে। টনি সেদিকে ছুটে গেল। কুমড়োর গায়ে হাত রেখে বলল, আমি এই প্রথম কুমড়োকে গাছে ঝুলতে দেখলাম।

গৌরব এগিয়ে গেল। বড় বাড়ি বলে যেটাকে এক সময় চিহ্নিত করা হতো তার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। সম্ভবত কাজের একটি মহিলা অবাক হয়ে বেরিয়ে এসেছিল দরজা খুলে। সতুদা তাকে ডাকতে সে নেমে এল। গৌরব খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল। তিন পাশে ইউ-সেপে ঘরগুলো আর মাঝখানে উঠোন। উঠোনটি বেশ বড়। ওপাশে রান্নাঘর আর কোণের দিকে বাথরুম টয়লেট। একটুও চেহারা বদল হয়নি। ভেতরের বারান্দায় নেমে গৌরব চুপচাপ দাঁড়াল। শূন্য বাড়ি। রান্নাঘরের দাওয়ায় সিঁড়ি পেতে বসে আছে জেঠিমা। সম্ভবত সতুদার গলা তার কানে গিয়েছিল। দুচোখ বন্ধ কিন্তু মুখ তুলে কানে শোনবার চেষ্টা করছেন।
 
গৌরব প্রায় নিঃশব্দে উঠোন পেরিয়ে পাশে দাঁড়াল। কেউ যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেলেন জেঠিমা। চোখের পাতা খুলল। গৌরব দেখল মণি দুটো সাদা হয়ে রয়েছে। জেঠিমা সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে, কে এসেছে?

গৌরব ধীরে ধীরে নিজের হাত রাখল তার পায়ে। প্রণাম করে উঠে দাঁড়াবার সময় খপ করে হাত ধরে ফেললেন জেঠিমা, কে, কে তুমি?

এই সময় পেছন থেকে সতুদা বলে উঠল, বলো দেখি মা, কে এসেছে?

গৌরব দেখল ওপাশের বারান্দায় সতুদার পাশে টনি বনি দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। বৃদ্ধার খুব অসুবিধা হচ্ছে, গৌরবের হাতে হাত বোলাচ্ছেন। গৌরবের ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের পরিচয় দিতে। তার আগেই জেঠিমার হাত ওর কনুই-এর কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সেখানে একটা কাটা দাগ ছিল। ওঁর আঙুল কয়েকবার সেই দাগের ওপর স্পর্শ করল। তারপর দুটো হাত শূন্যে তুলে মুখ ধরতে চাইলেন বৃদ্ধা। গৌরব নিচু হতেই মুখের স্পর্শ নিলেন। কান ছুঁলেন। তারপরেই অস্ফুটে বলে উঠলেন, গোরা! গোরা তুই শেষ পর্যন্ত এলি!

আচমকা শরীরে ঝড় উঠল যেন, দেহের সমস্ত জল হু হু করে উঠে এল বুকে, বুক ছাপিয়ে গলায় চোখে। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কৃত হলো শব্দ আটকে যাচ্ছে। পাশে বসে গৌরব জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরল। জেঠিমা আজ উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছেন, বল, কথা বল, তুই গোরা না?

গৌরব কোনো মতে বলতে পারল, হ্যাঁ।

কেমন আছিস তুই? কত বড় হয়েছিস? ওঃ তোকে কতদিন দেখি না। আমি আর দুচোখে দেখতে পাই না রে! জেঠিমার গলায় কান্না ছিটকে উঠল। গৌরব কথা বলতে পারছিল না। আমরা দুটো দেখার চোখ থাকতেও জীবনের অনেক কিছু দেখতে পাই না। আর এই বৃদ্ধা অন্ধ হয়েও শুধু স্পর্শ দিয়ে কত বছর আগে শেষ এক কিশোরকে যৌবনের মধ্য স্তরেও ঠিক দেখে নিলেন।

সতুদা এগিয়ে এলেন, মা তুমি গোরাকে নিয়েই আছ, এখানে আরও দুজন বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভের ছেলেমেয়ে।

জেঠিমা হাত বাড়ালেন, কই কোথায় ওরা। এসো দাদু-দিদা কাছে এসো। তোমাদের তো কোনোদিন চোখে দেখি নি। তোমার বাবা-মা সাহেব মেম হয়ে গিয়ে আর তো এখানে আসে না। তোমরা নিশ্চয়ই খুব ভালো নইলে এত কষ্ট করে এই গ্রামে আসতে না।

বনি টনির দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে জেঠিমাকে প্রণাম করল। একটু বাদেই জেঠিমার দুদিকে, তাদের কাঁধে হাত রেখে তিনি সানন্দে বসে আছেন। ওপাশের বারান্দা থেকে একটা কাঠের চেয়ার টেনে জেঠিমার সামনে বসে গৌরব জিজ্ঞাসা করল তুমি আমাকে চিনলে কী করে বলো তো?

জেঠিমার চোখে জল কিন্তু মুখে হাসি ফুটল, গন্ধ শুঁকে।

যাঃ।

হ্যাঁরে তোর শরীরে হাত রাখা মাত্র মনে হলো খুব জানি। নাকে যেন ভক্ করে একটা চেনা গন্ধ লাগল। প্রথমে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেবেলায় প্রত্যেক মানুষের শরীরে একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। বড় হতে হতে সেই গন্ধটা চাপা পড়ে যায়। ছেলেবেলায় খুব ভালবাসলে সেই গন্ধটা নাকে থেকে যায়। চাপা পড়ে গেলেও সেটা ঠিক টের পাওয়া অসম্ভব নয়। তাছাড়া তোর কনুইতে হাত দিতেই গন্ধটা পরিষ্কার হলো। কাটা দাগটা আমগাছ থেকে পড়ে তোর এই বাড়িতেই হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কান পরীক্ষা করলাম তোর কানের লতি জোড়া। ব্যস, দুই দুইয়ে চার।

তুমি সত্যি অদ্ভুত একই রকম আছ।

হ্যাঁ আমরা মা জেঠিমা একই রকম থাকি, তোমাদের ডানা গজালে আর পাত্তা পাওয়া যায় না। অসতু, তুই কি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবি? বাচ্চারা রোদে তেতে পুড়ে এলো অন্নদাকে বল কিছু খেতে দিতে। বলেই টনির হাতে চাপ দিলেন, অ্যাই তোরা মুড়কি খাবি?

মুড়কি?

খাসনি কখনও? তোদের শহুরে খাবার কোথায় পাব দাদু।

তিন বাটি মুড়কি এলো। দেখা গেল বনির সেটা খুব পছন্দ না হলেও টনি সোৎসাহে খাচ্ছে। এই সময় একটা নীল রঙের পাখি লেজ ঝুলিয়ে কাঁঠালগাছে এসে বসল। টনি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, দিদি দ্যাখ।
 
সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই ছুটল গাছটার দিকে। গৌরব কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সতুদা আপত্তি করল, ওদের বাধা দিস না। কলকাতায় তো এই জীবন পায় না।

এই সময় জেঠিমা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে তোর মা কেমন আছে?

ভালো।

কতদিন দেখি না ওকে। আমার পক্ষে তো কোথাও যাওয়া সম্ভব না। ওকে তো নিয়ে আসতে পারতিস। অনুযোগ গলায়।

মা এতটা হাঁটাহাঁটি পারত না। পায়ে বাত আছে। হাঁটাহাঁটি কিসের। বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠত। জেঠিমা বললেন, এতদিন তুই মাকে ছেড়ে বিদেশে পড়ে রইলি কিসের টানে বুঝি না বাবা। মাকেও তো নিয়ে যেতে পারিস।

মা যাবে না। দেশের মাটির মায়া বড় বেশি।

হওয়াই তো উচিত। তুই আর ফিরে যাস না, এখানেই থেকে যা।

দেখি!

বিয়ে থা করবি না? নাকি দাদার মতো সিড়িঙ্গে হয়ে থাকবি?

ভাই তো দাদাকেই অনুসরণ করে।

না তোকে বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে পছন্দ আছে?

গৌরব জবাব দিলো না। সতুদা বলল, তুমি ও আসামাত্র প্রশ্ন করে নাজেহাল করছ। ওদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না?

হবে বাবা হবে। আমি অন্নদাকে বলছি, পোস্ত, কলাই-এর ডাল, কাঁকরোল ভাজা দুধ কলা ওকে খাওয়াতে। পোস্তটা আমি রাঁধব।

মাছ আসছে। আমি অজয়দাকে বলেছি, চিংড়ি আনতে। গলদা না পাওয়া গেলে বাগদা। ওটা তুমি রান্না করো। সতুদা বলল।

আপত্তি করল গৌরব, কি আশ্চর্য তুমি এই অবস্থায় রান্না করবে কি?

করি তো। অভ্যেস, কোনো অসুবিধে হয় না। তাছাড়া এত বছর পরে তুই খাবি আর আমি রাঁধব না, এ কখনও হয়। হয়তো এই জীবনে আর সুযোগই পাব না। তুই কলাই ডাল ভালবাসতিস, কাঁকরোল ভাজা পেলে খুশি হতিস আর আমার হাতের পোস্ত পেলে মাছ দরকার হতো না, মনে আছে? জেঠিমা উঠে দাঁড়ালেন, অন্নদা ও অন্নদা।

সতুদা বলল, তোরা কথা বল। আমি স্কুল থেকে একটা পাক দিয়ে আসি।

জেঠিমা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্নদার সঙ্গে। উঠোনের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল গৌরব। পৃথিবীটা সত্যি অদ্ভুত। জীবন আরও বেশি। এখন সভ্যযুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা অনেক কিছু পাই। অনেক সুখ অনেক আরাম সেই জীবনে আহরণ করা যায়। শুধু তার জন্যে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। যোগ্যতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় মানুষেরা এখন মরিয়া। কিন্তু এসবের বাইরে আর এক ধরনের জীবন আছে। যে জীবন স্বার্থহীন এক অপার্থিব আনন্দ চুপচাপ বহন করে যায়। সভ্যতার বর্ণাঢ্য জমকে আমরা অন্ধ হয়ে থাকি বলে সেই জীবনের রূপ রস গন্ধ হারিয়ে ফেলি। হয়তো এই প্রজন্মের মানুষই শেষ ভাগ্যবান যাদের জন্যে এমন জেঠিমা অথবা মা পিসিমারা বেঁচে আছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরের মানুষ বইতে পড়বে কিন্তু তাদের জন্যে কোনো জেঠিমা অপেক্ষা করবেন না যিনি গন্ধ নিয়ে স্পর্শ দিয়ে দীর্ঘ অদর্শনের পরেও বলতে পারেন তার আত্মার আত্মীয় এসেছে সামনে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top