What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অত্যন্ত বিরক্ত হলেও হেডমাস্টার অনুরোধ রাখলেন। দুটো খাতা আনানো হলো। দেখা গেল প্রশ্নের উত্তর টনি যতটুকু লিখেছে পুরো সময় পরীক্ষা নিয়েও সুনীল তা লিখতে পারে নি। গম্ভীর মুখের ভদ্রলোক খাতা দুটো টেনে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, সুনীল ছেলেটি যে সব বানান ভুল করেছে এ তা করেনি। একটা উত্তর ধরে লেখা আর একটা তাড়াহুড়োর। হেডমাস্টার মশাই আপনি ভুল করেছেন। হেডমাস্টার মশাই ঢোঁক গিললেন, আসলে আমি আচমকা দেখেছিলাম তো–। মানে ডিসিপ্লিন রাখতে গিয়ে–! ঠিক আছে, তুমি কাল থেকে ক্লাসে এস। গৌরব মাথা নাড়ল, না। আপনি ওকে টি সি দিন। কারণ এর পরে ও আপনাকে শ্রদ্ধা করতে পারবে না। আপনাদের খামখেয়ালিতে কত ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়ে যায় তার খোঁজ আপনারা রাখেন না। চলি। হেডমাস্টার মশাই মুখ নামিয়ে বসেছিলেন। গম্ভীর মুখের ভদ্রলোক বললেন, মিস্টার বোস, আপনাকে একটা অনুরোধ করব। এখন মিড সিজন। কোথাও ওকে ভর্তি করতে পারবেন না। আপনাদের আত্মসম্মানবোধকে আমি শ্রদ্ধা করছি। কিন্তু আমি বলি কি ওকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা অবধি এখানে রাখুন। নতুন ক্লাসে উঠলে টি সি নেবেন। আমি স্কুল ইন্সপেক্টর। ভালো স্কুলে ভর্তি করার প্রব্লেম হবে না তখন। তারপর হেডমাস্টারমশাইকে বললেন, আপনি খুব অন্যায় করেছেন। প্রথমেই খাতা দুটো কমপেয়ার করার দরকার ছিল। সুনীল তো শেষ প্রশ্নটার উত্তর কমপ্লিট করতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন।

আমি একবার ভেবেছিলাম–। হেডমাস্টারমশাই থেমে গেলেন।

ভেবেছিলেন তা করেননি কেন?

আসলে সুনীলকে ঘাঁটাতে চাইনি। ওর বাবা খুব বড় রাজনৈতিক নেতা।

গৌরব বলল, টনি বাইরে যাও। উনি চলে গেলে সে বলল, এখানে আপনার ডিসিপ্লিন কতটা থাকছে হেডমাস্টারমশাই? একটি ছেলের বাবার প্রভাব আছে বলে আপনি নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে অক্ষম হলেন?

হেডমাস্টার মশাই কিছু বলার আগেই ইন্সপেক্টর বললেন, আপনি সুনীলের বাবাকে ডেকে পাঠান কাল। আমি থাকব। যে স্টেপ এর বিরুদ্ধে নিতে গিয়েছিলেন তা সুনীলের বিরুদ্ধে নেবেন। কারণ সে-ই অপরাধী।

.

সন্ধের পরে সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, তুই এসব কথা আমায় বলিসনি কেন গোরা?

যেটা আমি ম্যানেজ করতে পারব সেটা তোমাকে বলে বিব্রত করতে চাইনি।

আমি ওই হেডমাস্টার নামে কেস করতাম। ক্রিমিন্যাল!

না। তুমি শুধু টনিকেই বকতে। ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবতে না।

সৌরভ হেসে ফেলল, এই তোর আমার সম্পর্কে অ্যাসেসমেন্ট!

যে কোনো বাবা-মাই তাই করত। লীনাদেবীর খবর কিছু জানো?

না। কেন?

ওঁকে ওর বাড়িওয়ালা নোটিস দিয়েছিল, কী হলো কে জানে!

না। আমি ফোনটোন করি নি। লীনার সম্পর্কে ভাবছিস যে বড়?

হ্যাঁ। কলকাতা শহরে একটা মেয়ে স্রেফ একা বাস করছে দেখলে তাকে বাহবা দিতে হয়।

গৌরব উঠল, তুমি আর টনির ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। এ বছর ওখানে থাকুক। সামনের বছর নতুন ক্লাসে উঠলে যদি আবহাওয়া পাল্টায় তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা কোরো।

সৌরভ বলল, আমি একটা ব্যাপার ভাবছিলাম গৌরব। তোর তো আমেরিকায় অনেক বছর হয়ে গেল। ভালো চাকরি করছিস। অত মাইনে এদেশের কোনো চাকরিতে পাওয়া যায় না। তবু তোর কি এখানে সেটেল্ড করতে মন চায় না?

গৌরব বলল, আমি তো কথাটা আগেও বলেছি। তের সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আমি এখানে এসেছি নিজেকে পরীক্ষা করতে। বারো বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এখানকার পরিবেশ মানুষজন, কাজের সুযোগ কেমন পাল্টেছে তা দেখে সিদ্ধান্ত নেব। আসলে আমেরিকায় আমি যে চাকরি করি ঠিক সেই কাজ এখানে পাব না। তবে–?

বাধা দিলো সৌরভ, সেই কাজ এখানে নেই বলছিস?

মাথা নাড়ল গৌরব, নামের দিক দিয়ে এক। কিন্তু তফাতটা হলো কেউ একজন অক্ষর চিনে শব্দ বুঝে বাক্য লিখতে শিখেছে। সেও বলছে আমি পড়াশোনা করি। আর যে থিসিস লিখছে তাকেও বলতে হচ্ছে আমি পড়াশোনা করি। টাকাটা আমার কাছে কোনো সমস্যা নয়। মাসে পাঁচ হাজার টাকা পেলে এদেশে দিব্যি ভালো থাকা যায়। দেখি দাদা, আর একটু দেরি আছে। যাওয়ার আগে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
 
গৌরব মাকে বলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাইক নিয়ে। এই বাইক চালাতে তার খুব ভালো লাগে। বাইক মানে গতি, গতি হলো জীবন। কিন্তু কলকাতায় রাস্তাঘাট যদি একটু ভালো হতো, গর্তগুলো কেউ যদি রাতারাতি বুজিয়ে দিত, ফুটপাত দুটো আরও একটু ওপাশে সরিয়ে দিত তাহলে ভালো হতো। কয়েকদিন ধরে ভেবে ভেবে সে কি করে কলকাতাকে ভদ্ৰশহর করা যায় তার একটা পরিকল্পনা করেছে। রোজ রাত্রে কাগজে কলমে এই নিয়ে সে মতামত লিখছে। কিন্তু ওই কাগজপত্র নিয়ে কার কাছে যাবে সে ভেবে পাচ্ছে না। শহর সংক্রান্ত ব্যাপারে সাধারণত মেয়রের কথাই শেষ কথা। কিন্তু ক’সপ্তাহের কাগজ পড়ে মনে হচ্ছে মেয়রের ভূমিকা পুতুলের মতো। তিনি নামেই প্রধান কিন্তু তাঁর শহরে বাস-দুর্ঘটনা হলে রাজ্যমন্ত্রী ছুটে যান, শহরের প্রশাসনের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। তিনি শুধু পৌরকর আদায় করান। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেই কাজ হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়া এদেশে সহজেই সম্ভব নয়। সুব্রতকে ধরতে হবে। ওর মারফত রাইটার্স বিল্ডিং-এ পৌঁছানো সম্ভব।

নির্জন রাস্তার রকে কাউকে বসে থাকতে দেখল না গৌরব। এর আগে লীনার বাড়িতে আসার সময় সে ছেলেগুলোকে ওখানে দেখেছে। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ধান্দা জুটে গেছে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে বেল টিপল সে। লীনা আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। কারণ এপাশ থেকে বোঝা যায় না ভেতরে আলো জ্বলছে কি না! দ্বিতীয়বার বেল টেপার পর যখন কেউ খুলল না তখন চলে আসার জন্যে পা বাড়াল সে। তারপর কি মনে হতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজাটায় চাপ দিল। গৌরব অবাক, দরজা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার। লীনা কি তাড়াহুড়োয় দরজা বন্ধ না করে গিয়েছে? কিন্তু, না বাইরে থেকে তালা দেওয়া নেই। এটাই সে এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। ঘর অন্ধকার করে এই সন্ধে পেরোনো রাতে লীনা কী করতে পারে? সে হাতড়ে হাতড়ে বাইরের ঘরে আলো জ্বালল। তারপর দ্বিতীয় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, লীনা!

ভেতর থেকে কোনো উত্তর এল না। গৌরব ইতস্তত করল। তারপর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আলো জ্বালতেই চিৎকার করে উঠল। লীনা পড়ে আছে বিছানায় চিত হয়ে। তার জামাকাপড় বীভৎসভাবে ছেঁড়া। মুখ ক্ষতবিক্ষত। নিম্নাঙ্গ থেকে রক্তের ধারা নেমেছে। ঘরের জিনিসপত্র, বিছানার চাদর লণ্ডভণ্ড। দৌড়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে সে নিচু হলো। না, প্রাণ আছে। এখনও নিশ্বাস পড়ছে। সোজা হয়ে সামনের ওয়ার্ডরোব থেকে একটা শাড়ি বের করে লীনার শরীরের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে ও একছুটে বাইরে বেরিয়ে এল। এপাড়ায় কোথায় টেলিফোন আছে তার জানা নেই। কিন্তু পথেই একটা থানা দেখেছিল। আর তখনই সে একটা অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পেল। কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে। দ্রুত বাইক চালিয়ে গাড়িটাকে আটকাল সে। অ্যাম্বুলেনসের ড্রাইভার মাথা নাড়ল, না মশাই, এভাবে পেশেন্ট নিয়ে যেতে পারব না।

কেন? পারব না শুনে উষ্ণ হলো গৌরব।

এটা ট্যাক্সি নাকি যে রাস্তায় ধরে বললেই হয়ে যাবে। আপনি অফিসে যান, রিপোর্ট করুন, অফিস থেকে অর্ডার দিলে চলে আসব।

আর ততক্ষণে যদি পেশেন্ট মারা যায়?

আগে রিপোর্ট করেন নি কেন?

আগে তো জানতাম না। গৌরব নিজেকে সামলালো, সেই আপনাকেই হয়তো এতটা পথ ফিরে গিয়ে আবার আসতে হবে। আপনার পরিশ্রম আর সরকারি তেল বাঁচান। আমি রিপোর্ট করব আপনার অফিসে যাতে আপনি আপনার খাতায় কাজটার কথা লিখতে পারেন।

ড্রাইভার বলল, এভাবে পথ আটকানো বে-আইনি। পেশেন্টের অবস্থা খারাপ বলে যাচ্ছি, চলুন। গৌরব একটু হালকা হয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।

ঘরে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্স-এর লোকেরা বেঁকে বসল, এ পুলিশ কেস।

নিশ্চয়ই। পুলিশকে আমরাই রিপোর্ট করব। তার আগে ওঁকে বাঁচান।

লীনাকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো তখন আশেপাশের বাড়ির জানলায় ভিড়, কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। রাস্তায় ধারের রক তখনও খালি। পেশেন্টের অবস্থা দেখেই অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত বেরিয়ে গেল। বাইক নিয়ে প্রথম গৌরব চলে এল থানায়। একজন সাব-ইন্সপেক্টর বসে ছিলেন। সব শুনে বললেন ভিক্টিম আপনার কে হয়?

প্রশ্নটির জন্যে তৈরি ছিল না গৌরব। একটু ভেবে বলল, বন্ধু।

কী রকম বন্ধু যে তাকে গুণ্ডারা রেপ করে? লোকটা হাসল।

এসব প্রশ্নের জবাব আমাকে পরে দিতে দিন। ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সে। সেখানে আমাকে যেতে হবে।

সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, দাঁড়ান। আগে ডায়েরি লিখি। আপনার হদিস দিন।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, একটা টেলিফোন করতে পারি? ওঁকে হাসপাতালে এখন অ্যাটেন্ড করা দরকার। ভদ্রলোক একটু চিন্তা করে ইশারায় টেলিফোন দেখিয়ে দিলেন।
 
তিনবার ডায়াল করার পর বাড়ির ফোন বাজল। সৌরভ রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো!

দাদা আমি গোরা বলছি। লীনার বাড়িতে এসেছিলাম। এসে দেখি কেউ বা কারা ওর ওপর ভয়ঙ্কর টর্চার করে অজ্ঞান করে ফেলে গেছে। মনে হচ্ছে রেপ কেস। আমি অ্যামবুলেন্সে পিজিতে পাঠিয়ে থানায় এসেছি। এঁরা ডায়েরি নিচ্ছেন। তুমি এখনই পি জি-তে চলে যাও। না, জ্ঞান নেই। কুইক দাদা। সে ফোন রেখে দিল।

আপনার বন্ধু আই মিন বান্ধবীকে আপনার দাদা চেনেন?

প্রথম কথা বান্ধবী বললে ভারতবর্ষে যা মনে হয় উনি আমার তা নন। তাই বন্ধু বলেছি। দাদা চেনেন কারণ লীনা দাদার এক্সকলিগ।

ভদ্রমহিলার ঠিকানা?

নাম-ঠিকানা বয়স জানাল গৌরব। বয়সটা অবশ্যই আন্দাজে।

একা থাকেন কেন?

আর কেউ নেই বলে।

ম্যারেড?

হু। কিন্তু ডিভোর্সি।

এইসব সিঙ্গল মেয়েদের নিয়েই যত বিপদ।

কেন?

আরে মশাই দেশে কোনো মেয়ে একা থাকলেই তাকে নিয়ে কথা ওঠে তার ওপর যদি সে ডিভোর্সি হয় তাহলে তো কথাই নেই। প্রচুর ছেলে বন্ধু ছিল?

আমি জানি না।

আপনি তো নিজেকেও ওঁর বন্ধু বলছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু আমি কাউকে ওর ফ্ল্যাটে দেখি নি। আজ আমি দ্বিতীয়বার ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম অতএব কাউকেই চিনি না।

চাকরি করে?

হ্যাঁ।

ওর কোনো শত্রুর কথা জানেন? এক্স হাজব্যান্ড, বয়ফ্রেন্ড এনিবডি?

না। তবে বাড়িওয়ালা ওঁকে উঠে যেতে বলেছেন।

কেন?

উনি সম্ভবত আর সিঙ্গল লেডিকে ঘর ভাড়া দেবেন না। অবশ্য সেই কথাটা যুক্তি হিসেবে বলেননি। এবার আমি আসতে পারি?

ঘরে জিনিসপত্র যে অবস্থায় ছিল তা আছে?

হ্যাঁ। অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা কোনো কিছু স্পর্শ করে নি।

আপনি?

আমার কথা উঠছে কেন?

উঠছে, কারণ আপনি ওই ঘরে ঢুকেছিলেন। সেন্স নেই বললেন না? ওর একটা স্টেটমেন্ট নেওয়া পর্যন্ত আপনার যাওয়া চলবে না।

বেশ তো, আপনি আমার পাসপোর্ট রেখে দিন।

পাসপোর্ট? মানে?

আমি আমেরিকায় থাকি। ওটা যদি আপনি রেখে দেন তাহলে কখনই ফিরে যেতে পারব না। আমাকে কি আপনি সন্দেহ করছেন? গৌরব পাসপোর্ট টেবিলে রাখল।

পাসপোর্ট নেড়েচেড়ে সাব-ইন্সপেক্টর তখন বললেন, আপনি তো বেশিদিন আসেন নি। ঠিক আছে। আপনার পাসপোর্টের নাম্বার, বাড়ির ঠিকানা রেখে দিচ্ছি। কাল একবার সকালে এখানে আসবেন। আপনি তো হাসপাতালে যাচ্ছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওখানে দেখা হতে পারে। ভদ্রলোক পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন।

বাইরে বেরিয়ে বাইকে চড়তে চড়তে গৌরবের মনে হলো পুলিশ হিসাবে সাব-ইন্সপেক্টর যা করেছেন তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কোনো অপরাধ হলে পুলিশের কাজই হলো সন্দেহ করা। আমেরিকান পুলিশও তাই করে। কিন্তু তারা প্রথমেই সেটা মুখে প্রকাশ করে না। এইটাই যা তফাত। সে হাসপাতালের দিকে বাইক ছোটাল।

সৌরভ ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল, সঙ্গে মলি। ওকে দেখতে পেয়েই ওরা এগিয়ে এল। সৌরভ বলল, খুব খারাপ অবস্থা। এখনও সেন্স ফেরেনি।

পুলিশ কী বলল?

ডায়েরি নিয়েছে। কাল সকালে যেতে বলেছে।

আমার এসব ভালো লাগছে না। ডাক্তার বলল, অন্তত চারজনের কীর্তি। মার্সিলেস রেপিং। কী ভাবে বেঁচে আছে সেটাই আসল। তুই এর মধ্যে বেশি জড়িয়ে পড়িস না। কি থেকে কি হয় কিছুই বলা যায় না। সৌরভ মুখ ফেরাল গম্ভীরভাবে।

বেশি আর কম বলে কোনো ফারাক করা যায়? কারো বাড়িতে গিয়ে যদি দেখি সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব না? কিন্তু আমি ওঁকে দেখে ভেবেছিলাম মেয়েরা একা সম্মান নিয়ে থাকতে পারে–! কথাটা শেষ করল না গৌরব।

মলি বলল, ছাই পারে। ছেলেরা সেটা হতে দিতে চায় না।

গৌরব এবার অবাক হলো। মলি কি লীনার পক্ষে কথা বলছে?

কী দেখছ অমন করে? মলি জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়ল গৌরব, না লীনার সেন্স না ফিরলে জানা যাবে না ওই পাশবিক কাজটা করল কে? ওই লোকগুলোকে গুলি করে মারা উচিত।
 
কোনোদিন সেটা সম্ভব না। মেয়েদের ওপর যারা অত্যাচার করে তারা চিরকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মলির কথা শেষ হতে না হতেই একজন বেয়ারা গোছের লোক হাঁকল, লীনাদেবীর লোক কেউ আছেন? ভেতরে ডাকছে।

মলি বলল, গোরা, তুমি এস, ও এখানে থাক।

করিডোর পেরিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। একজন ডাক্তার দাঁড়িয়েছিলেন। মলি তাকে বলল, আমরা লীনার জন্যে এসেছি।

ও। শুনুন ব্লাড চাই। এখনই। ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে। কন্ডিশন ভালো নয়। বলে ডাক্তার একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন, এতে ওঁর ব্লাড গ্রুপ লেখা আছে। অন্তত তিন বোতলের ব্যবস্থা করুন। গৌরব কাগজটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখানকার ব্লাড ব্যাঙ্কে পাওয়া যাবে না?

অ্যাপ্রোচ করুন। ডাক্তার ফিরে যাচ্ছিল এমন সময় সেই সাব-ইন্সপেক্টর এসে দাঁড়ালেন, ডাক্তার, মিসেস লীনা চ্যাটার্জির একটা স্টেটমেন্ট নিতে চাই।

পরশু আসবেন। এখন উনি কথা বলার স্টেজে নেই। ডাক্তার চলে গেলেন।

সাব-ইন্সপেক্টর একটু থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর বললেন স্যাড! খুব স্যাড ঘটনা।

দাদা বউদিকে হাসপাতালে রেখে ব্লাডব্যাঙ্কে চলে এল গৌরব। ব্লাড ডোনারের সার্টিফিকেট না থাকলে রক্ত কিনতে পাওয়া যায় না। একটি লোক এসে বলল, কোনো চিন্তা নেই বাবু, আপনি খোঁজ নিন যে গ্রুপটা চাইছেন তা এখানে আছে কি না ডোনার যোগাড় করতে অসুবিধে হবে না।

ডোনার কোথায় পাবো?

আমার আন্ডারে আছে। মাল্টু ছাড়লেই চলে আসবে।

গৌরব এগিয়ে গেল। এখানে কিছু লোক রক্ত দিয়ে রোজগার করে। ইনি তাদের দালাল। অর্থাৎ হাসপাতালের নিয়ম কিছু লোকের জীবিকার উপায় ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু ব্লাডব্যাঙ্কের ডেস্কে পৌঁছে মাথায় বজ্রপাত হলো। লীনার ব্লাডগ্রুপ এখন স্টকে নেই। ওটা খুব স্বাভাবিক গ্রুপের রক্ত নয়। তিনচারটি ব্লাডব্যঙ্কের সন্ধান দিলেন কর্মচারী যেখানে গৌরব খোঁজ করতে পারে। হনহন করে বেরিয়ে আসছিল সে, লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল, হলো বাবু?

না। এখানে স্টক নেই।

স্টক নেই? শেয়ালের মতো হাসলো, স্যার, ক বোতল দরকার?

তিন।

আসুন আমার সঙ্গে। ওটা অবশ্য আমার ডিপার্টমেন্ট নয়। তবু ভাই ভাই ব্যাপার।

আরে আমার কোন্ গ্রুপ দরকার না জেনেই বলছেন কেন?

পৃথিবীর যত প্রকারের রক্ত হয় সব স্টকে আছে। তবে কম বেশি। আসুন। প্রায় হতবুদ্ধি গৌরবকে নিয়ে এল লোকটা ব্লাডব্যাঙ্কের পেছনে। জায়গাটা আধা অন্ধকার। লোকটা হাঁকল, মানুদা? অন্ধকার থেকে ভেসে এল, আছি।

তিন বোতল।

একটি সিড়িঙ্গে প্রৌঢ় এগিয়ে এল অন্ধকার ফুঁড়ে, দেখি।

গৌরব তার হাতে কাগজটা তুলে দিলো। আধা আলোতেই কাগজটাকে উল্টেপাল্টে বলল, কপাল ভালো, চার বোতলই আছে। দেড়শ করে পড়বে।

আপনারা কি ব্লাডব্যাঙ্কের লোক? মানে দেবেন কোত্থেকে?

খিক খিক হাসি বাজল, তাহলে ব্লাডব্যাঙ্কেই যান।

গৌরবের গাইড বলল, মানুদা হলো এখানকার বিপদতারণ। আমি যেসব কেসে ফেল করি মানুদা তা টেকআপ করেন। মাল দিয়ে দিন বোতল পেয়ে যাবেন।

অরিজিন্যাল দাম কত?

নাথিং। সিড়িঙ্গে বলল, কিন্তু প্রয়োজনে পাঁচশো হাজার পেয়েছি।

আপনারা রক্ত ব্ল্যাক করছেন?

আপনি সতীপনা করবেন না পেশেন্টকে বাঁচাবেন?

গৌরবের মনে হলো লোকটার চোয়ালে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মারতে। কিন্তু তখনই লোকটা বলল, একটু বেশি পয়সা নিচ্ছি বটে কিন্তু বাবু, মানুষের জানও তো বাঁচাচ্ছি!

নিজেকে কোনোমতে সামলে গৌরব বলল, কিন্তু আপনি যা দেবেন তা জেনুইন কিনা।

সেন্ট পার্সেন্ট। মানুষের জান নিয়ে সরকার খেলা করতে পারে মানুষ তারা নয়। মাল ছাড়ুন। বহুৎ টাইম নিয়ে নিয়েছেন।

আমি ব্ল্যাকে রক্ত কিনব না। লোকটার হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে গৌরব হনহনিয়ে গেটের দিকে চলল। কলকাতা শহরে অনেক ব্লাডব্যাঙ্ক আছে। কোথাও না কোথাও লীনার রক্ত পাওয়া যাবে।
 
বাইক রেখে দিয়ে ট্যাক্সি নিয়েছিল গৌরব। দেড়ঘণ্টার মধ্যে কলকাতার সবকটা বড় ব্লাডব্যাঙ্কে ঢুঁ দিয়ে ফেলল, লীনার গ্রুপের রক্ত কারো কাছে নেই। হাতে আর বেশি সময় নেই। রাত হচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা। যে কটা জায়গার কথা সে ইতিমধ্যে জেনেছে তার সবকটায় খোঁজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। অসহায়ের মতো ট্যাক্সিতে এসে বসল সে। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাব এবার? গৌরব উত্তর দিতে পারছিল না। হঠাৎ সে বলল, দেখুন ভাই, আমরা এতক্ষণ ব্লাডব্যাঙ্কে ঘুরলাম। বুঝতেই পারছেন একটা অপারেশনের জন্যে এখনই রক্ত দরকার। আর কোনো ব্লাডব্যাঙ্ক আপনার জানা আছে?

লোকটা একটু ভাবল তারপর মাথা নাড়ল, প্রাইভেট ব্লাডব্যাঙ্ক কিছু আছে।

প্রাইভেট মানে?

বাবু মাঝে মাঝে পাড়ায় তাঁবু খাটিয়ে যে রক্তদান করা হয় না তার সব রক্তই কি সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে যায়? কিছু রক্ত মাঝে মাঝে প্রাইভেট ব্যাঙ্কে বিক্রি হয়ে যায়। আমাদের বস্তির ছেলেরা তো এই করে হাজার টাকা কামালো অথচ ভালো কাজ করছে বলে ওদের ছবি ছাপা হলো কাগজে। ড্রাইভার হাসল, চলুন, ওয়েলেসলিতে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্ক আছে। একবার মাঝ রাত্তিরে দুজন প্যাসেঞ্জার ওখানে গিয়েছিল ব্লাড কিনতে।

ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ঘোরাল। গৌরব কোনো থই পাচ্ছিল না। বড় বড় ব্লাডব্যাঙ্ক যেখানে নেই বলছে সেখানে প্রাইভেট ব্যাঙ্ক দিতে পারবে? আর সেই রক্ত খাঁটি হবে তো? অবশ্য রক্ত খাঁটি কিনা তা পেশেন্টকে দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করে নেবে ডাক্তারবাবু। এক্ষেত্রে যেহেতু তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাই বিশ্বাস করতেই হবে। ইলিয়ট রোডের মোড়ের কাছে ওয়েলেসলির ওপরেই গাড়ি থামাল লোকটা। তারপর গৌরবকে বলল, সোজা ওই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যান। সামনেই যে দরজা দেখতে পাবেন সেখানেই বেল টিপবেন।

ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে মাটিতে পা রাখল গৌরব। কেউ জিজ্ঞাসা করলে এক্ষেত্রে ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিলেই চলবে। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দরজার সামনে দাঁড়াল সে। ওটা বন্ধ। কিন্তু ওপরে কোনো নেমপ্লেটও নেই। একটু দ্বিধা নিয়েই বেলের বোতাম টিপল সে।

আধ মিনিট বাদে দরজা খুলল। একজন বৃদ্ধা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বললেন, ইয়েস!

গৌরব ইংরেজিতে বলল, আমি খুব বিপদে পড়ে এসেছি। আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল আপনাদের কাছে রক্ত পাওয়া যেতে পারে। ব্যাপারটা কি সত্যি?

মহিলা হাত বাড়ালেন, গিভ মি দ্য পেপার।

গৌরব চটজলিদ কাগজটা বের করে দিতেই মহিলা ভেতরে চলে গেলেন। গৌরব রুমালে মুখ মুছল। খুব টেনসন হচ্ছিল তার। এই সময় মহিলা ফিরে এলেন, সরি। এই গ্রুপের ব্লাড মাত্র এক বোতল স্টকে আছে। কালকে নিলে বাকি দুবোতল পাবেন। হান্ড্রেড পার বটল।

অর্থাৎ পঞ্চাশ টাকা কম। কিন্তু এক বোতল নিয়ে গিয়ে কী হবে? সে মাথা নেড়ে নিচে নেমে এল। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, পেলেন না স্যার?

না।

আর কোথায় পাওয়া যায় জানি না।

জেদ চেপে গেল গৌরবের। কলকাতা শহরে অপারেশনের জন্য যদি রোগীর আত্মীয়রা রক্ত যোগাড় না করতে পারে তাহলে কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই? সেই রোগী কি বিনা অপারেশনে মারা যাবে? পি-জিতে ফিরে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ মনে হলো ওই একটা বোতল নিয়ে নিলেই হতো। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ঢের ভালো ছিল। সে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে আবার গাড়ি ঘোরাতে বলল।
 
গৌরব যখন এক বোতল রক্ত নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল তখনও মলি আর সৌরভ বসে। ওকে দেখেই ছুটে এল তারা। মলি বলল, উঃ, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

গৌরব ক্লান্ত গলায় বলল, কলকাতা শহরের কোথাও লীনার রক্ত নেই বউদি। শেষে এই এক বোতল মাত্র পেলাম। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। খুলে বলি সব।

সৌরভ বলল, ঠিক আছে। তুই বোস।

মানে? গৌরব চমকে উঠল।

রক্ত যোগাড় হয়ে গিয়েছে।

কী করে? কে করল?

তুই চলে যাওয়ার খানিক বাদেই ডাক্তার বললেন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে অপারেশনে করতে হবে। আমরা ভাবলাম তুই তার আগে ফিরে আসবি। এলি না। তখন ব্ল্যাডব্যাঙ্কে গিয়ে খোঁজ করলাম। ওই সময় স্থানীয় কিছু লোক সাহায্য করল। রক্তটা ওদের কাছ থেকেই কিনেছি, অপারেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। সৌরভ জানাল।

মানু সাহা?

হ্যাঁ। তুই জানলি কী করে?

কত টাকা নিল? দুশো টাকা করে বোতল।

দাঁতে দাঁত ঘষল গৌরব, চামার!

কী বলছিস?

লোকটা আমাকে দেড়শ বলেছিল।

হ্যাঁ। তখন নাকি আর একটা পার্টি এসে গিয়েছিল। আমাকে ইকনমিক্স বোঝাল। ডিম্যান্ড বাড়লে সাপ্লাই না থাকলে দাম ঊর্ধ্বগামী হবেই। আর পঞ্চাশ টাকার জন্যে অপারেশন বন্ধ রাখা যায় না। ব্ল্যাকে যখন রক্ত কিনছি তখন আর ও নিয়ে দর কষাকষি করে কী লাভ! সৌরভ বলল, ওই বোতলটা দে। ভেতরে দিয়ে আসি। যদি দরকার হয় তো উপকারে লেগে যাবে।

গৌরব বোতলটা দিয়ে দিলো। মলি পাশে দাঁড়িয়েছিল। সৌরভ চলে যেতে গৌরব তাকে বলল, লীনার কপাল দ্যাখো, ব্ল্যাকের রক্তে জীবন বাঁচাতে হচ্ছে।

মলি বলল, এভাবে কথাটা বলছ কেন? আমরা কি জীবনের সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছি? মোটেই নয়। গ্যাসের লাইন থেকে স্কুলে ভর্তি, সর্বত্র কোনো না কোনোরকম ঘুষ দিতে হচ্ছে। যারা লীনার ওপর অত্যাচারটা করল, তারা ধরা পড়লেই শান্তি পাব।

গৌরব বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে বউদি। তুমি আর দাদা বাড়ি চলে যাও। নাতিনাতনিদের নিয়ে মা বোধহয় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।

তোমার দাদা মাকে ফোন করে সব বলেছেন। ও হ্যাঁ, খবরের কাগজের লোক এসেছিল।

কেন?

ওরা জানতে পেরেছে আমরা লীনার জন্যে এখানে এসেছি। অদ্ভুত প্রশ্ন করছিল। তুমি কেন লীনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে? কাদের সন্দেহ হয়। আমার সঙ্গে আলাপ নেই কেন?

তুমি কী বললে?

যা ঠিক তাই বললাম। কাগজের লোকেরা চলে যাওয়ার পর আবার পুলিশের বড় অফিসাররা এল। তোমার দাদার সঙ্গে কথা বলল।

দাদা-এর মধ্যে জড়ায়নি তো?

তোমার দাদা বলেছে লীনা তার সঙ্গে কাজ করত। সেই সুবাদে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার পর তুমি লীনার বাড়িতে আজ ভদ্রতা করে গিয়ে ঘটনাটা আবিষ্কার করেছ। আমিও বলেছি, একটা মেয়ে একা এই শহরে মাথা উঁচু করে বাস করতে পারবে না এমন কোনো আইন যখন নেই তখন তার কাছে যে কোনো ভদ্রলোক যেতে পারে। মেয়েটি যতক্ষণ ভদ্র আচরণ করছে ততক্ষণ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই শুধু ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। মলি বলল।

গৌরব অবাক হয়ে মলিকে দেখছিল। এই মলিই কদিন আগে লীনা সম্পর্কে ক্ষিপ্ত হয়ে সৌরভের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চলেছিল। কিন্তু এখন তাকে দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই।

পরদিন সকালের কাগজগুলোয় লীনার ফ্ল্যাটের ছবিসহ খবর ছাপা হলো। চাকরিরতা একা মহিলাকে তার ফ্ল্যাটে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন গুণ্ডা। মহিলা মুমূর্ষপ্রায়। পুলিশ তদন্ত করছেন। কিছু সূত্র পাওয়া গিয়েছে। খবরের কোথাও সৌরভের বা মলির নাম নেই কিন্তু গৌরবের উল্লেখ আছে। মহিলার বন্ধু গৌরব বসু ঘটনাটির পরেই তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়ে তৎপর না হলে হয়তো তিনি নিঃশব্দে মারা যেতেন। একই খবর বিভিন্ন কাগজে বিভিন্নভাবে ছাপা। কেউ কেউ লীনার পূর্ব ইতিহাস খুঁজতে চেয়েছে। এক পুলিশকর্তা বলেছেন লীনা ডিভোর্সি এবং তার কয়েকজন পুরুষবন্ধু ছিল। এদের সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে। বস্তুত, লীনা চ্যাটার্জির জ্ঞান ফিরে এলে বিস্তারিত জানা যাবে।

দুপুরবেলায় হাসপাতালে গিয়ে শুনতে পেল লীনার চেতনা এসেছে। কিন্তু সে এত দুর্বল চিকিৎসকরা কথা বলতে দিচ্ছে না। বিকেলেও দেখা হলো না।
 
ফ্লুরিসে ঠিক সময়ে উপস্থিত হলো গৌরব। জয়তী নেই। সে ভেতরেও ওকে দেখতে পেল না। প্রায় মিনিট চল্লিশেক অপেক্ষা করার পর গৌরব চলে এলো হাসপাতালে। বারো বছর-আগে জয়তী কখনও কথা দিয়ে আসেনি এমন একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে না। সময় রাখার ব্যাপারে ও চিরকাল খুব তৎপর ছিল। বরং গৌরব কখনও কখনও দেরি করে বকুনি খেয়েছে। নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যে কারণে আসতে পারল না জয়তী। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তা নাহলে টেলিফোনেও জানাতে পারত। মাথার ভেতরে নানা দুশ্চিন্তা নিয়ে সে পিজি হাসপাতালে এলো। সেখানে সৌরভ দাঁড়িয়েছিল।

সৌরভ বলল, শুনলাম আজ দুপুরে পুলিশ লীনার স্টেটমেন্ট নিয়েছে।

ডাক্তার ওঁকে কথা বলতে দিয়েছে তাহলে?

হ্যাঁ। চল। আমি ব্যবস্থা করেছি দেখা করার।

লীনা চ্যাটার্জি শুয়েছিল চোখ বন্ধ করে। দাদার সঙ্গে গৌরব পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। কপালে এবং গালে এখনও প্লাস্টার আঁটা। গলা পর্যন্ত সাদা কাপড় টানা। সৌরভ মাথার পাশে গিয়ে ডাকল, লীনা।

লীনা চোখ খুলল। খুব দুর্বলভাবে সৌরভকে দেখল। সৌরভ প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, একটু ভালো লাগছে এখন? লীনার ঠোঁট কাঁপল। একটু।

তারপর সে মুখ নামাতেই পায়ের দিকে নজর গেল। গৌরবের সঙ্গে চোখাচোখি হতে মৃদু হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। সে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কে নিয়ে এসেছে এখানে?

সৌরভ বলল, গোরা। ও তোমার ফ্ল্যাটে গিয়ে আবিষ্কার করে।

আবিষ্কার! নিঃশ্বাস ফেলল লীনা। সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, কে, কারা করেছে?

পুলিশকে বলেছি। সব মুখই তো একরকম। গৌরববাবু, আমার ফ্ল্যাটের চাবি কার কাছে?

থানায়। ওরা সব বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে।

আমি আর বাড়ি পাল্টাবো না। এর বেশি তো আর খারাপ হতে পারে না। কী বলেন? চোখ বন্ধ করল লীনা।

.

লীনার আততায়ীদের খুঁজে বের করা খুবই মুশকিল। তাদের চেহারার যে বর্ণনা সে পুলিশকে দিয়েছে তার সঙ্গে এই কলকাতার অন্তত তিনলক্ষ মানুষের মিল আছে। ভাঙা চোয়াল, রুক্ষ দৃষ্টি, রোগা লম্বা শরীর আর অমিতাভ বচ্চনের মতো ঘাড় ঢাকা চুল। এদের কারো সঙ্গে তার কখনও আলাপ ছিল না। কথা যা বলেছিল তাতে পড়াশোনার ছাপ বিন্দুমাত্র নেই। বোঝাই যাচ্ছিল এদের কেউ নিয়োগ করেছে এবং টাকার সঙ্গে অমন স্তরের এক নারী যা কিনা তাদের নাগালের বাইরে ছিল এতকাল পরে ভোগ করতে পেরে প্রচুর উল্লাস পেয়েছে।

পুলিশ তদন্ত করবে বলে কথা দিয়েছে। গৌরবকে কিছুটা হেনস্তা করতে হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছে কিন্তু কাজের কাজ কতটা হবে তাতে সন্দেহ থেকেই গেছে। পরদিন লীনার অবস্থা অনেক ভালো। বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল সে। গৌরব যেতেই হেসে বলল, বাঃ আপনি তো খুব ভালো।

ফুলগুলো রাখার জায়গা পাচ্ছিল না গৌরব। সকালে লীনাকে দেখতে আসার পথে ফুল কিনেছে সে। লীনার মনোমতো এই ফুলগুলোর জন্যে সে খুব খুশি হলো। একজন নার্সকে ডেকে অনুরোধ করতেই ভদ্রমহিলা বড় বোতল এনে সেটা লীনার মাথার পাশে রেখে তাতে ফুল সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বিছানার পাশে টুল নিয়ে বসল গৌরব। বসে জিজ্ঞাসা করল, দেখে মনে হচ্ছে একটু ভালো!

অনেক ভালো।

আপনাকে দেখতে বাড়িওয়ালা এসেছিল?

হঠাৎ এই প্রশ্ন?

বাঃ ভাড়াটে হাসপাতালে গেলে বাড়িওয়ালার তো দেখতে আসা উচিত?

উচিত! ভারতবর্ষে এই শব্দটাকে অধিকাংশ মানুষই আর গুরুত্ব দেয় না।

আপনি-বললেন আর বাড়ি পাল্টাবেন না। মন স্থির করে ফেলেছেন?

হ্যাঁ।

কেন?

উত্তরটা দিতে পারব না। তবে এখন আর ও বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। লীনা হাসল, আজ সকালে ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যারা আমার শরীরটাকে ভোগ করে গেল তাদের কোনো স্মৃতি আমি বহন করছি কিনা। ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। প্রশ্নটার মানে বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানি না।

না বোঝার তো কারণ নেই। ঠিক আছে, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলব।

আচ্ছা গৌরবাবু, আপনি আমার জন্যে এত করছেন কেন বলুন তো?

গৌরব হেসে ফেলল, বিশ্বাস করুন, আমার কোনো বদ মতলব নেই।

বদ না হোক মতলব তো আছে।

তাও নয়। আসলে এটা আমার স্বভাব।

অথচ আমাকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে সমস্যা তৈরি হয়েছিল।

অতীত অতীতই। যতক্ষণ কেউ অন্যায় করছে না বলে মনে করে ততক্ষণ তার একটা জোর থাকে। সেই জোর তাকে মাথা সোজা রাখতে সাহায্য করে। আপনার সেটা আছে।

আপনি চমৎকার বাংলা বলেন। আমেরিকায় এত বছর থেকেও দেখছি ভোলেন নি।

মনেপ্রাণে হয়তো ভেতো বাঙালি।

মোটেই নয়। আপনার সঙ্গে এখানকার বাঙালির মানসিকতার পার্থক্য অনেকে।

জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি যখন এদেশে ছিলাম তখন অনেক কিছুই চোখে পড়ত না। এখন সেগুলো অসহ্য মনে হয়। আজ উঠি। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন।

কী রকম ভালো বলছেন? ভালো হয়ে ওঠা কি যায়? লীনার মুখ শক্ত হলো।

উঠে দাঁড়াল গৌরব, না, আজ আর তর্ক নয়। এলাম। সে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পেছন থেকে ডাকল লীনা, শুনুন। গৌরব ফিরে তাকাল।

তারপর কাছে এসে হাসল, বলুন।

লীনা মুখ নিচু করল, কবে আসবেন?

আপনাকে রিলিজ করার আগে একবার আসব। গৌরব আর দাঁড়াল না।

.
 
জয়তীদের বাড়িতে গিয়ে মাসীমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করল গৌরব। জয়তী নেই। সকালে বেরিয়ে গিয়েছে। ওর স্কুলে নাকি ঝামেলা হয়েছে। ঘণ্টা দেড়েক বসেও দেখা পেল না সে। আজ সারা বাংলা টিচার-স্ট্রাইক। জয়তী নাকি তাই নিয়ে ব্যস্ত। গৌরবের খুব ইচ্ছে করছিল মাসীমাকে প্রশ্ন করে যে তিনি সেদিন জয়তীর ফ্লুরিসে না যাওয়ার ব্যাপারটা জানেন কি না। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্বস্তিটা জয়তীর কারণেই। সে যদি মাকে কিছু না বলে থাকে তবে মাসীমার ধন্দ লাগবে। এটা ভারতবর্ষেই ঘটে থাকে। মা বা বাপ বন্ধুর মতো। ওদেশে ছেলেমেয়েরা নিজেদের কথা অসংকোচে আলোচনা করে। কিন্তু এখানে বয়ঃসন্ধি পার হতে না হতেই দূরত্ব বেড়ে যায়।

জয়তী না থাকায় মাসীমারও খারাপ লাগছিল। বললেন, তুমি এসে অপেক্ষা করেছ শুনলে ও মন খারাপ করবে। প্রণতি চলে যাওয়ার পর তো ও ভীষণ একা হয়ে গিয়েছে। আমার আর ভালো লাগে না বাপু। কোথাও যদি কোনো ভালো ওল্ড-এজ হোম পেতাম সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, জয়তী সেটা মানবে?

মানতে চায় না। কিন্তু তাতে তো ও নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করছে, হঠাৎ থমকে গেলেন প্রৌঢ়া, গৌরব কিছু যদি মনে না কর একটা প্রশ্ন করব?

মনে করার কিছু নেই মাসীমা, আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।

বারো বছর ধরে তোমরা পরস্পরের জন্যে অপেক্ষা করলে, এবার আর একা ফিরে যেও না।

মাসীমা আমি তৈরি হয়ে এসেছিলাম। এদেশের অনেক মেয়ে আমেরিকায় বিয়ের পর গিয়ে ঠিক একটা না একটা কাজ পেয়ে যায়। জয়তীরও কাজ পেতে অসুবিধে হবে না। সেক্ষেত্রে আপনি ওখানে গিয়ে থাকতে পারেন। অথচ ও সেটাই বুঝতে চায় না।

না গৌরব। এদেশের মানুষকে আমি চিনি। আমাকে তোমরা নিয়ে গেলে কথা উঠবে। নিজের মা ভাইকে না নিয়ে গিয়ে শাশুড়িকে। সেটা আমার কাছে মোটেই ভালো লাগবে না। আমার ব্যাপারটা আমাকেই বুঝতে দাও। তুমি ওকে বোঝাও।

.

একমাত্র সে যদি কলকাতায় থেকে যায় তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। জয়তীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গৌরব ভাবছিল। একই শহরে মা আছেন, ইচ্ছে করলেই পৌঁছনো যায়, চাই কি দুচারদিন থাকাও যায় গিয়ে, এমন হলে জয়তী আপত্তি করবে না। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে গৌরবকে অনেক কিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে আর যাই হোক এ দেশে কাজের পরিবেশ নেই। কাজের চেয়ে মানুষের নিত্য চাহিদার মুখ বন্ধ করতে আন্দোলনের নামে এক ধরনের উত্তেজনা পোয়াতে উৎসুক সবাই।

এই সময় মিছিলটাকে দেখতে পেল গৌরব। সারা বাংলা টিচার ইউনিয়নের ফেস্টুন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল শিক্ষক-শিক্ষিকারা। জয়তী কি এই দলে আছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত আন্দোলিত করে একজন স্লোগান দিচ্ছে আর অন্যেরা সেটিকে মন্ত্রের মতো আবৃত্তি করছেন। পুরুষদের পর কিছু মহিলা। মহিলাদের মধ্যে জয়তী নেই। স্লোগানগুলো মন দিয়ে শুনল গৌরব। এখন বোধহয় শ্রমিক কৃষক ছাত্র শিক্ষক যে যার নিজের আন্দোলনে একই স্লোগান ব্যবহার করে। তাদের বলার ভঙ্গিও এক। দুই-একটি বিশেষ দাবী ছাড়া সব একাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, যে নতুন শুনবে তার কাছে। তার মনে হলো এই ভাবে মিছিল করতে হচ্ছে বলে একটু সংকোচে আছেন তারা, যেন বাধ্য হয়েই পথে নেমেছেন। হাঁটা চলা চাহনিতে আড়ষ্টতা আছে।
 
মিছিলের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল গৌরব। পথে আরও মিছিল যাচ্ছে। ক্রমশ এটির চেহারা বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। সব মিছিলের লক্ষ্য এসপ্ল্যানেড ইস্ট। প্রায় জেদের বশেই সোজা এসপ্ল্যানেডে চলে এল গৌরব। রাস্তা জ্যাম, ট্রামবাস, ট্যাক্সি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মিছিলে মিছিলে ধর্মতলা উত্তাল। সাধারণ মানুষ যাদের সব কাজ থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা মেনে নিয়েছে নির্বিকার হয়ে। একটা বাসভর্তি লোক ঠাসাঠাসি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে।

কে সি দাসের মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে রাজভবনের খানিকটা এগিয়ে গৌরব দেখল রাস্তায় শিক্ষকরা বসে গেছেন। অনেক দূরে একটা মঞ্চ তৈরি করে নেতারা বেশ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। এবং তখনই গৌরব জয়তীকে দেখতে পেল। কয়েকজন মহিলার সঙ্গে জয়তী বসে বক্তৃতা শুনছে। গৌরবের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল চেঁচিয়ে ওকে ডাকে। তারপরই মতটা পাল্টালো। জয়তী যখন উঠবে তখনই চমকটা দেওয়া যাবে। মেয়েটাকে এখন খুব কাহিল দেখাচ্ছে। চুল এলোমেলো, মুখে ঘাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধৈর্য ধরতে হলো গৌরবকে। এই সময় আর একজন মহিলার সঙ্গে জয়তী উঠে দাঁড়াল। ভিড় কাটিয়ে কাটিয়ে এ পাশের ফুটপাতে চলে এল ওরা। গৌরবের দিকে নজর নেই জয়তীর। দূরত্ব এবং মানুষের ভিড় এর একটা কারণ। একজন ভদ্রলোক জয়তীর সঙ্গে কথা বলছে। কোনো ব্যাপারে ওরা দ্বিমত বলে মনে হলো গৌরবের। শেষ পর্যন্ত ওরা এগোতে লাগল। সরে দাঁড়াল গৌরব ইচ্ছে করেই। তিনজনকে ও একটা রেস্টুরেন্টের ভেতর পা বাড়াতে দেখল। ভদ্রলোক কে, জয়তীর সঙ্গে কি সম্পর্ক ঠাওর করতে পারছিল না সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গৌরব রেস্টুরেন্টে ঢুকল। বেশ ভিড়। মিছিলের ক্লান্ত মানুষেরাই টেবিল দখল করে রেখেছে। আর তখনই জয়তী তার সামনে এসে দাঁড়াল।

জয়তী কিছু বলার আগেই গৌরব বলল, অনুসরণ করে চলে এলাম।

মানে? জয়তীর কপালে ভাঁজ পড়ল।

তোমাদের এই রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখলাম। ভালো আছ?

চা খাবে?

না।

তুমি একটু দাঁড়াও, আমি আসছি। জয়তী ফিরে গেলে গৌরব বাইরে এসে দাঁড়াল। মিছিলগুলো এখনও আসছে। মানতে হবে দিতে হবের ডাক চলছে। এই ভাবে যদি জীবনের সব ইচ্ছা চেঁচিয়ে জানান দেওয়া যেত! জয়তী এল মিনিট পাঁচেক বাদে। এসে বলল, তুমি এদিকে কী মনে করে?

তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। হাঁটতে আরম্ভ করল গৌরব।

ও। কিন্তু মা তো জানে না যে আমি এখানে এসেছি।

আমি অনুমান করলাম।

এই ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পেলে কী করে?

ভাগ্যবান বলতে পার, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে।

ওরা ক্রমশ নির্জন জায়গায় চলে এল। জয়তী এবার দাঁড়িয়ে পড়ল, আমি কিন্তু আর হাঁটতে পারব না। অভ্যেস নেই তো, অনেক হেঁটেছি।

গৌরব বলল, এখানে বসা নিয়ে আমরা একসময় রসিকতা করতাম। তুমি ফিরবে না অন্য কোথাও যাবে?

বাড়ি। খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছি।

ভাগ্যক্রমে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। সিটে বসে রুমালে মুখ মুছল জয়তী, দেখছ তো কী ভাবে বেঁচে আছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে প্রাণধারণ।

গৌরব কিছু বলল না। সে লক্ষ্য করছিল জয়তীর একবারও ফ্লুরিস না যাওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করছে না। সেই প্রসঙ্গই তুলছে না ও। অতএব গৌরব নিজেই কথা টানল, তোমার সঙ্গে আমার এর মধ্যে দেখা হওয়ার কথা ছিল।

কবে? জয়তী মুখ ফেরাল।

তুমি ভুলে গিয়েছ?

বিশ্বাস করো–ও, হ্যাঁ, ফ্লরিস না? ইস, একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তুমি গিয়েছিলে, না? আমার এরকম কখনও হয় না। আসলে আমি এতরকম ঝামেলা নিয়ে আছি যে- কোনটা সামলাব বুঝে উঠতে পারছি না।

গৌরব কোনো কথা বলল না। সেটা লক্ষ্য করে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, এই রাগ করেছ?

হাসবার চেষ্টা করল, কী হবে করে?

তুমি আমাকে বুঝতে চাইছ না।

না আগে তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো আমার জন্যে তোমার ভালবাসা অবশিষ্ট আছে কিনা, টানবোধ কর কিনা। আমার জীবনটার সঙ্গে জড়িয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয় কি না। তোমার উত্তরের ওপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি সরাসরি জানতে চাইছ আমি সম্পর্ক রাখতে চাই কিনা?

সম্পর্ক? কিসের সম্পর্ক? তার ধরনটাই বা কী?

তুমি জানো না?

না, দুটো মানুষ পরস্পরকে আকাঙ্ক্ষা করল। তারা নিজেদের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পেয়ে রোমাঞ্চিত হলো। বারো বছর ধরে দুজন রইলো পৃথিবীর দুই মহাদেশে। দুজনেই অন্য কোনো মানুষকে জীবনের ধারে কাছে আসলে দিল না। আবার একজন যত অনুরোধই করুক অন্যজন তার কাছে পৌঁছতে চাইল না ব্যবধান ঘুচিয়ে। সম্পর্কের কথা বলছ তুমি, আমি এবার এদেশে এসেছি তোমার জন্যে আর তুমি আমাকে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। কয়েক মাইল হেঁটে পিচের রাস্তায় ঘামমুখে বসে থাকতে তোমার খারাপ লাগে না অথচ আমার সঙ্গে দেখা করার সময় হয় না এটা কী ধরনের সম্পর্ক। ঠিক আছে। যেটা চোখে দেখা যায় না স্পর্শ করা যায় না অথচ আছে বলে মনে হয় সেই রকম সম্পর্ক আমি সারাজীবন চালিয়ে যেতে পারি। তোমাকে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না।
 
জয়তী জবাব দিল না। ট্যাক্সি বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে। খুব অবসন্ন লাগছিল তার। গৌরব কোনো কথাই মিথ্যে বলেনি। কিন্তু কেন সে নিজেকে এখন আড়ালে রাখছে তা বুঝতে পারেনি গৌরব। বারো বছর আগের গৌরব তার খুব কাছের মানুষ ছিল, বড় চেনাজানা। দীর্ঘকাল আমেরিকায় থেকে গৌরবের মানসিকতা এবং জীবনযাত্রায় কি ছাপ পড়েছে তা তো তার জানা নেই। কেমন একটা আড়ষ্টতা এসে গেছে মনের খাঁজে খাঁজে। একে কি কমপ্লেক্স বলে? হয়তো। তাছাড়া, মাকে ফেলে রেখে সে কোথায় যাবে। প্রণতিরা যা পারে তা সে পারে না। ট্যাক্সি থেকে নেমে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তুমি নামবে না?

না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমি তো আজ অনেকক্ষণ এখানে কাটিয়ে গিয়েছি। আচ্ছা চলি।

কবে দেখা হচ্ছে?

তোমার কি দেখা করার ইন্টারেস্ট আছে?

নইলে জিজ্ঞাসা করব কেন?

বলে কী লাভ? হয়তো সময় পাবে না কিংবা ভুলে যাবে।

জয়তী ঠোঁট কামড়ালো। তারপর বলল, এক মিনিট দাঁড়াও। বলে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে গেল গৌরব দেখল মাসীমা দরজা খুললেন আর জয়তী ভেতরে ঢুকে গেল। কেন অপেক্ষা করতে বলল এই নিয়ে গৌরব যখন নানারকম ভাবছে তখন ফিরে এল জয়তী। মুখে ঘাম নেই চুলে সম্ভবত চিরুনি পড়েছে কিন্তু আর কোনো পরিবর্তন হয়নি বেশ বাসে। এসে দরজা খুলে উঠে বসলো সে, তুমি কোথায় যাচ্ছ চলো, আজ সারাদিন আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

তুমি সঙ্গে থাকতে চাইলেই যে আমি রাখতে পারব তা কী করে ভাবলে?

সেটা তোমার সমস্যা।

এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে কাউকে নিয়ে যাওয়া শোভন নয়।

সেইরকম জায়গায় না গেলেই হলো।

কী ব্যাপার বলো! হঠাৎ এমন উৎসাহ?

জয়তী মুখ ঘুরিয়ে নিল কোনো জবাব দিল না। অগত্যা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল গৌরব। এই মুহূর্তে তার এমন কোনো জায়গার কথা মনে পড়ছিল না যেখানে যাওয়া যায়। সে চলন্ত ট্যাক্সিতে বসে জয়তীর দিকে একবার তাকিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো।

এখন প্রায় অপরাহ্ন। বাড়ির সামনে গাড়ি থামলে জয়তী প্রথম কথা বলল,

আমরা কোথায় এলাম?

চিনে নাও। গৌরব ট্যাক্সিওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিলো।

তোমাদের বাড়ি? জয়তী রাস্তায় নেমে চাপা গলায় বলল।

গেট খুলতে খুলতে গৌরব হাসল, হুঁ।

ইসস্। তুমি এভাবে এখানে আমাকে আনলে?

কী ভাবে?

এরকম বিশ্রী– ওঃ ভালো।

আরে তুমি তো ঠিকই আছ। তাছাড়া যে চেহারা নিয়ে তুমি আমার সঙ্গে বেরুতে পার সেই চেহারায় পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যাওয়া সম্ভব। এসো।

টনি দাঁড়িয়েছিল বাগানে। সেই প্রথম দেখল। গৌরব তাকে ডাকল,

টনি। জলদি। এঁর সঙ্গে আলাপ কর। ইনি জয়তী।

টনি এগিয়ে এসে জয়তীকে দেখল, তোমাকে আগে কখনও দেখিনি।

জয়তী কী বলবে বুঝতে পারছিল না। গৌরব জবাব দিলো, দেখবি কী করে? ইনি চিরকাল মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে যুদ্ধ করেন।

ইন্দ্রজিত! টনি শব্দটা বলেই মাথা নাড়ল, মেয়ে হলে কী বলব?

এই সময় মলি বেরিয়ে এল বারান্দায়, ও গৌরব, তুমি সারাদিন না খেয়ে–। বোঝা গেল জয়তীকে দেখেই মলি কথা শেষ করতে পারল না।

গৌরব বলল, একদিন না খেলে মানুষের শরীর ঠিকই থাকে। তুমি নেমে এসো। বাড়িতে অতিথি এসেছে। মলি দোতলা থেকে অদৃশ্য হলো। গৌরব জয়তীকে বলল, এসো, আমাদের ঘরে এসো।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top