বাঙালির বুকে যত সুখ যত আনন্দ তার চেয়ে কষ্ট এবং আক্ষেপ অনেক বেশি। যে কোনো বয়স্ক অথবা বয়স্কা বাঙালির সঙ্গে, যিনি আত্মীয়তা সূত্রে জড়িত, একা বসলেই সেইসব আক্ষেপ আর কষ্টের কথা শোনা যায়। পৃথিবীর অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরাও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নয় কিন্তু বাঙালি দীর্ঘকাল কষ্ট লালন করতে ভালবাসে। এক বৃদ্ধা বা বৃদ্ধ মনের কথা বলার মতো মানুষ পেলে যে আক্ষেপের কথা বলেন তাতে স্পষ্ট অভিযোগ মিশে থাকে। ছেলে দেখছে না, অমুক সময়ে তমুক পান নি, নিজেকে অত্যন্ত বঞ্চিত বলে মনে হয়, নেহাৎ প্রাণ শরীর ছেড়ে যাচ্ছে না তাই বেঁচে থাকা ইত্যাদি আক্ষেপের পাঁচালি পাঠ করে মনে মলম দিতে চান তারা। কিন্তু একবার মলম বুলিয়ে শান্তি পান না তারা। যখনই উপযুক্ত শ্রোতা পান তখনই এই কান্নার গল্প শুনিয়ে দিতে সময় নষ্ট করেন না। পৃথিবীর অন্য মানব সম্প্রদায়ের সঙ্গে এখানেই কিছুটা পার্থক্য তৈরি হলো। একজন ব্রিটিশ অথবা আমেরিকান বৃদ্ধ যত অসহায় অবস্থায় থাকুন না কেন কষ্ট বা আক্ষেপ দীর্ঘকাল ধরে চলে বলে আবার গ্রহণ করেন না। বঙ্গীয় বৃদ্ধ বৃদ্ধা যার বিরুদ্ধে পাঁচজনকে বলে এক ধরনের আরাম পান সেই মানুষটি যদি বর্ণনা করার সময় সামনে এসে পড়েন তাহলে তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিতে অতিশয় পারদর্শী। সেই ব্যক্তির সঙ্গে এই সময় যে কথা বলেন তাতে বোঝাই যায় না এতক্ষণ তার বিরুদ্ধেই বিষোদগার করছিলেন। হয়তো পরবর্তীকাল আরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনায় মনের জ্বালা চেপে রেখে তাকে অভিনয় করতে হয়। কিন্তু যারা এমন অভিনয় করতে জানেন তারা নিজের দুঃখকে বারোয়ারি ভাবে প্রকাশ না করার শক্তি কেন আয়ত্ত করতে পারবেন না এটাই বোধগম্য নয়।
গৌরব ভেবেছিল আজকের দুপুরটা জেঠিমার কাছে বসে তার দুঃখের পাঁচালি শুনে কাটাতে হবে। একজন অন্ধ মহিলা একা একা গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছেন, ছেলে যত ভালোই হোক, তার নিশ্চয় বুকের ভেতরে অনেক হা-হুঁতাশ জমা আছে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না।
অনেকদিন বাদে পুকুরে স্নান করল সবাই। গৌরব সাঁতার জানে কিন্তু টনির কাছে ব্যাপারটা দারুণ চমকপ্রদ। পোশাক আনা হয়নি বলে বনি জলে নামেনি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দেখল টনি প্রথম জলে নেমে ভয়ে চিৎকার করছে। গৌরব তাকে সাহসী করার চেষ্টা চালিয়েও কোমর জলের বেশি নিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু সেখানেই পা ছুঁড়ে টনি প্রতিজ্ঞা করল ফিরে গিয়েই সে সুইমিং ক্লাবে ভর্তি হবে। এত মজা এত আনন্দ সে কখনও পায়নি।
খেতে বসে গৌরবের নাকে শৈশবের ঘ্রাণ লাগল। এমন তরকারি সে অনেক বছর খায়নি। জেঠিমার হাতের রান্নার স্বাদ তার কাছে অপূর্ব বলে মনে হলেও সে লক্ষ্য করল টনি বনি খুব আরাম পাচ্ছে না। জন্মাবধি মলি তাদের যে রেস্ট্রিক্টেড ডায়েটের মধ্যে রেখেছে তার অভ্যাসের বাইরে যেতে ওদের অসুবিধা হবেই। জেঠিমা বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন তারা খেতে পারছে কিনা। টনি বলেই ফেলল, মা না এরকম রাঁধে না।
জেঠিমা বললেন, সে তো শহরের মেয়ে, কত নতুন রান্না জানে, আমরা সেই ছেলেবেলায় যা শিখেছিলাম তাই করে চলেছি। এর উপর চোখে দেখি না কি রাঁধতে কি রেঁধেছি। ও সতু ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে রে।
বনি একটু বড় বলেই ঢাকতে জানে, বলল, না ঠাকুমা, একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। ডালটা খুব ভালো হয়েছে।
তাহলে তোরা ডাল দিয়ে খেয়ে নে। খুব কষ্ট হলো।
সতুদা বলল, মা তুমি, গোরাকে জিজ্ঞাসা করছ না?
জেঠিমার মুখ উজ্জ্বল হলো, সব কথা কি জিজ্ঞাসা করে জানতে হয়?
খাওয়া থামিয়ে গৌরব জানতে চাইল, কী জেনেছ?
খেতে ভালো লাগলে ছেলেবেলায় তুই এইরকম শব্দ করে খেতিস।
সঙ্গে সঙ্গে বনি বলে উঠল, হ্যাঁ কাকু, তুমি আজকে শব্দ করে খাচ্ছ।
জেঠিমা বললেন, তোর খেতে শব্দ হতো বলে সরলা খুব বকত তখন।
টনি জিজ্ঞাসা করল, কলকাতায় খাওয়ার সময় তো এমন শব্দ করো না কাকু, তুমি আমেরিকায় কি শব্দ করে খেতে?
গৌরব হেসে ফেলল, কলকাতা কিংবা আমেরিকায় যে এমন খাবার পাওয়া যায় না রে, পয়সা দিলেও না। তারপর সতুদার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে কি জানো, কোনো কোনো অভ্যেস মনের অজান্তে মনের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। আমরা যতই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করি না কেন নিজের জায়গা পেয়ে গেলেই অভ্যেসটা টুক করে বেরিয়ে পড়ে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা।
গৌরব ভেবেছিল আজকের দুপুরটা জেঠিমার কাছে বসে তার দুঃখের পাঁচালি শুনে কাটাতে হবে। একজন অন্ধ মহিলা একা একা গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছেন, ছেলে যত ভালোই হোক, তার নিশ্চয় বুকের ভেতরে অনেক হা-হুঁতাশ জমা আছে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না।
অনেকদিন বাদে পুকুরে স্নান করল সবাই। গৌরব সাঁতার জানে কিন্তু টনির কাছে ব্যাপারটা দারুণ চমকপ্রদ। পোশাক আনা হয়নি বলে বনি জলে নামেনি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দেখল টনি প্রথম জলে নেমে ভয়ে চিৎকার করছে। গৌরব তাকে সাহসী করার চেষ্টা চালিয়েও কোমর জলের বেশি নিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু সেখানেই পা ছুঁড়ে টনি প্রতিজ্ঞা করল ফিরে গিয়েই সে সুইমিং ক্লাবে ভর্তি হবে। এত মজা এত আনন্দ সে কখনও পায়নি।
খেতে বসে গৌরবের নাকে শৈশবের ঘ্রাণ লাগল। এমন তরকারি সে অনেক বছর খায়নি। জেঠিমার হাতের রান্নার স্বাদ তার কাছে অপূর্ব বলে মনে হলেও সে লক্ষ্য করল টনি বনি খুব আরাম পাচ্ছে না। জন্মাবধি মলি তাদের যে রেস্ট্রিক্টেড ডায়েটের মধ্যে রেখেছে তার অভ্যাসের বাইরে যেতে ওদের অসুবিধা হবেই। জেঠিমা বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন তারা খেতে পারছে কিনা। টনি বলেই ফেলল, মা না এরকম রাঁধে না।
জেঠিমা বললেন, সে তো শহরের মেয়ে, কত নতুন রান্না জানে, আমরা সেই ছেলেবেলায় যা শিখেছিলাম তাই করে চলেছি। এর উপর চোখে দেখি না কি রাঁধতে কি রেঁধেছি। ও সতু ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে রে।
বনি একটু বড় বলেই ঢাকতে জানে, বলল, না ঠাকুমা, একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। ডালটা খুব ভালো হয়েছে।
তাহলে তোরা ডাল দিয়ে খেয়ে নে। খুব কষ্ট হলো।
সতুদা বলল, মা তুমি, গোরাকে জিজ্ঞাসা করছ না?
জেঠিমার মুখ উজ্জ্বল হলো, সব কথা কি জিজ্ঞাসা করে জানতে হয়?
খাওয়া থামিয়ে গৌরব জানতে চাইল, কী জেনেছ?
খেতে ভালো লাগলে ছেলেবেলায় তুই এইরকম শব্দ করে খেতিস।
সঙ্গে সঙ্গে বনি বলে উঠল, হ্যাঁ কাকু, তুমি আজকে শব্দ করে খাচ্ছ।
জেঠিমা বললেন, তোর খেতে শব্দ হতো বলে সরলা খুব বকত তখন।
টনি জিজ্ঞাসা করল, কলকাতায় খাওয়ার সময় তো এমন শব্দ করো না কাকু, তুমি আমেরিকায় কি শব্দ করে খেতে?
গৌরব হেসে ফেলল, কলকাতা কিংবা আমেরিকায় যে এমন খাবার পাওয়া যায় না রে, পয়সা দিলেও না। তারপর সতুদার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে কি জানো, কোনো কোনো অভ্যেস মনের অজান্তে মনের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। আমরা যতই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করি না কেন নিজের জায়গা পেয়ে গেলেই অভ্যেসটা টুক করে বেরিয়ে পড়ে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা।