What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

বাঙালির বুকে যত সুখ যত আনন্দ তার চেয়ে কষ্ট এবং আক্ষেপ অনেক বেশি। যে কোনো বয়স্ক অথবা বয়স্কা বাঙালির সঙ্গে, যিনি আত্মীয়তা সূত্রে জড়িত, একা বসলেই সেইসব আক্ষেপ আর কষ্টের কথা শোনা যায়। পৃথিবীর অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরাও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নয় কিন্তু বাঙালি দীর্ঘকাল কষ্ট লালন করতে ভালবাসে। এক বৃদ্ধা বা বৃদ্ধ মনের কথা বলার মতো মানুষ পেলে যে আক্ষেপের কথা বলেন তাতে স্পষ্ট অভিযোগ মিশে থাকে। ছেলে দেখছে না, অমুক সময়ে তমুক পান নি, নিজেকে অত্যন্ত বঞ্চিত বলে মনে হয়, নেহাৎ প্রাণ শরীর ছেড়ে যাচ্ছে না তাই বেঁচে থাকা ইত্যাদি আক্ষেপের পাঁচালি পাঠ করে মনে মলম দিতে চান তারা। কিন্তু একবার মলম বুলিয়ে শান্তি পান না তারা। যখনই উপযুক্ত শ্রোতা পান তখনই এই কান্নার গল্প শুনিয়ে দিতে সময় নষ্ট করেন না। পৃথিবীর অন্য মানব সম্প্রদায়ের সঙ্গে এখানেই কিছুটা পার্থক্য তৈরি হলো। একজন ব্রিটিশ অথবা আমেরিকান বৃদ্ধ যত অসহায় অবস্থায় থাকুন না কেন কষ্ট বা আক্ষেপ দীর্ঘকাল ধরে চলে বলে আবার গ্রহণ করেন না। বঙ্গীয় বৃদ্ধ বৃদ্ধা যার বিরুদ্ধে পাঁচজনকে বলে এক ধরনের আরাম পান সেই মানুষটি যদি বর্ণনা করার সময় সামনে এসে পড়েন তাহলে তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিতে অতিশয় পারদর্শী। সেই ব্যক্তির সঙ্গে এই সময় যে কথা বলেন তাতে বোঝাই যায় না এতক্ষণ তার বিরুদ্ধেই বিষোদগার করছিলেন। হয়তো পরবর্তীকাল আরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনায় মনের জ্বালা চেপে রেখে তাকে অভিনয় করতে হয়। কিন্তু যারা এমন অভিনয় করতে জানেন তারা নিজের দুঃখকে বারোয়ারি ভাবে প্রকাশ না করার শক্তি কেন আয়ত্ত করতে পারবেন না এটাই বোধগম্য নয়।

গৌরব ভেবেছিল আজকের দুপুরটা জেঠিমার কাছে বসে তার দুঃখের পাঁচালি শুনে কাটাতে হবে। একজন অন্ধ মহিলা একা একা গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছেন, ছেলে যত ভালোই হোক, তার নিশ্চয় বুকের ভেতরে অনেক হা-হুঁতাশ জমা আছে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না।

অনেকদিন বাদে পুকুরে স্নান করল সবাই। গৌরব সাঁতার জানে কিন্তু টনির কাছে ব্যাপারটা দারুণ চমকপ্রদ। পোশাক আনা হয়নি বলে বনি জলে নামেনি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দেখল টনি প্রথম জলে নেমে ভয়ে চিৎকার করছে। গৌরব তাকে সাহসী করার চেষ্টা চালিয়েও কোমর জলের বেশি নিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু সেখানেই পা ছুঁড়ে টনি প্রতিজ্ঞা করল ফিরে গিয়েই সে সুইমিং ক্লাবে ভর্তি হবে। এত মজা এত আনন্দ সে কখনও পায়নি।

খেতে বসে গৌরবের নাকে শৈশবের ঘ্রাণ লাগল। এমন তরকারি সে অনেক বছর খায়নি। জেঠিমার হাতের রান্নার স্বাদ তার কাছে অপূর্ব বলে মনে হলেও সে লক্ষ্য করল টনি বনি খুব আরাম পাচ্ছে না। জন্মাবধি মলি তাদের যে রেস্ট্রিক্টেড ডায়েটের মধ্যে রেখেছে তার অভ্যাসের বাইরে যেতে ওদের অসুবিধা হবেই। জেঠিমা বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন তারা খেতে পারছে কিনা। টনি বলেই ফেলল, মা না এরকম রাঁধে না।

জেঠিমা বললেন, সে তো শহরের মেয়ে, কত নতুন রান্না জানে, আমরা সেই ছেলেবেলায় যা শিখেছিলাম তাই করে চলেছি। এর উপর চোখে দেখি না কি রাঁধতে কি রেঁধেছি। ও সতু ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে রে।

বনি একটু বড় বলেই ঢাকতে জানে, বলল, না ঠাকুমা, একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। ডালটা খুব ভালো হয়েছে।

তাহলে তোরা ডাল দিয়ে খেয়ে নে। খুব কষ্ট হলো।

সতুদা বলল, মা তুমি, গোরাকে জিজ্ঞাসা করছ না?

জেঠিমার মুখ উজ্জ্বল হলো, সব কথা কি জিজ্ঞাসা করে জানতে হয়?

খাওয়া থামিয়ে গৌরব জানতে চাইল, কী জেনেছ?

খেতে ভালো লাগলে ছেলেবেলায় তুই এইরকম শব্দ করে খেতিস।

সঙ্গে সঙ্গে বনি বলে উঠল, হ্যাঁ কাকু, তুমি আজকে শব্দ করে খাচ্ছ।

জেঠিমা বললেন, তোর খেতে শব্দ হতো বলে সরলা খুব বকত তখন।

টনি জিজ্ঞাসা করল, কলকাতায় খাওয়ার সময় তো এমন শব্দ করো না কাকু, তুমি আমেরিকায় কি শব্দ করে খেতে?

গৌরব হেসে ফেলল, কলকাতা কিংবা আমেরিকায় যে এমন খাবার পাওয়া যায় না রে, পয়সা দিলেও না। তারপর সতুদার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে কি জানো, কোনো কোনো অভ্যেস মনের অজান্তে মনের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। আমরা যতই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করি না কেন নিজের জায়গা পেয়ে গেলেই অভ্যেসটা টুক করে বেরিয়ে পড়ে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা।
 
খাওয়া দাওয়ার পর টনি বাগানে ছুটল। সতুদার সঙ্গে দাওয়ায় বসে আড্ডা মারছিল গৌরব। জেঠিমা রান্নাঘরে। সতুদাকে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তারপর, তুমি এখানে কেমন আছ, বলো?

যেমন দেখছিস। একমাত্র শরীর ছাড়া আমার কোনো সমস্যা নেই।

তুমি একইরকম রয়ে গেলে।

দুতিন রকম হতে পারার ক্ষমতা নেই বলে একরকম থাকতে হলো।

কিন্তু এই গ্রামের জীবনে তোমার একঘেয়েমি লাগে না!

একটুও না। স্কুল আর গান-বাজনা নিয়ে চমৎকার সময় কেটে যায়। কলকাতায় গেলে হাঁপিয়ে উঠি, কতক্ষণে গ্রামে ফিরব। আসলে এখানে যে জীবন তাতে জটিলতা খুব কম। গ্রাম্য রাজনীতির কথা ছেড়ে দে, সবাই জানে আমি সাতে পাঁচে নেই তাই আমাকে কেউ জড়াতে চায় না।

এই মাইনেতে, মানে তোমার স্কুলের চেহারা দেখে যা মনে হলো, তাতে তো খুব বেশি কিছু পাওয়ার কথা নয়। তোমার অসুবিধা হয় না?

নারে। দুবেলা ভাত ডাল আর জামাকাপড় হয়ে যাচ্ছে। কিছু জমি আছে তা থেকেই কিছুটা আসছে। আচমকা যদি বড় খরচের ধাক্কা না আসে তাহলে টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবনার দরকার পড়ে না। আসলে আমার কোনো চাহিদা নেই তাই বেঁচে গেছি। চাহিদা থাকলে তো তারও শেষ নেই। সতুদা হাসল, যেমন ধর, বাড়িতে একটা ক্লাইভের আমলের রেডিও আছে। এখনও চমৎকার বাজে। কেউ যদি বলে মডেলটা খুব পুরনো এখন নতুন নতুন মডেল বেরিয়েছে তাহলে আমি বলি শব্দ শোনার জন্যে যতক্ষণ এটি উপযুক্ত ততক্ষণ পাল্টানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন গ্রামের অনেক বাড়িতে টিভি এসেছে। আমি কিনব কার জন্যে? মা তো টিভির সামনে বসলে সেটা রেডিওর মতো কাজ করবে। কোনো ভালো প্রোগ্রাম থাকলে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসি। সতুদা হাসল। খুব অকপট হাসি। গৌরবের বড় ভালো লাগল। আজকের মানুষ শুধু টেনশন আর সমস্যায় পিষ্ট হচ্ছে অনবরত। একটু আরাম একটু সুখের জন্যে যে ইঁদুর দৌড় হয়েছে তাতে যোগ না দিয়ে উপায় নেই কারণ আধুনিকতা নামক একটি বেড়াল ক্রমাগত তাড়া করে যাচ্ছে পেছন থেকে। অথচ সবাই শান্তি চায়, শান্ত জীবনের প্রত্যাশী কিন্তু চাহিদার তীব্রতা যখন আকাশচুম্বী তখন শান্তি মরীচিকার মতো শুধুই পিছু হঠে। এখন আর হবে না। মনের গঠন যেভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে তার পক্ষে আর সতুদার মতো জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তার জীবনের সমস্যাগুলো যেমন, জয়তীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া, আমেরিকার জীবন ছেড়ে এসে কলকাতায় চাকরি নেওয়া, দাদা-বউদির ব্যক্তি জীবনের গোলমাল সামলানো, এখানকার মানুষের ব্যবহারের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো এসব তো সতুদার নেই। সে বলেই ফেলল, সতুদা তোমাকে এই মুহূর্তে আমি ঈর্ষা করছি।

সতুদা বলল, শ্মশান বৈরাগ্য রে। শ্মশানে এলে সংসার সম্পর্কে যে অনাসক্তি মনে আসে তা শ্মশান থেকে বেরিয়ে গেলেই উধাও হয়ে যায়। আমি আর একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসি, তুই মায়ের সঙ্গে গল্প কর, আমি এলাম বলে। জেঠিমা খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে বসেছেন। সতুদা বেরিয়ে গেলে গৌরব যেই জেঠিমার পাশে গিয়ে বসেছে অমনি ছাদে চিৎকার হলো। কিছু একটা ভাঙলো। জেঠিমা বললেন, দ্যাখ দেখি, ওদের বোধহয় কিছু হলো! গৌরব উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, টনি, এই টনি।

একটু বাদে বনি ছাদের আলসেতে অপরাধীর ভঙ্গীতে এসে দাঁড়াল। গৌরব মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে ওপরে?

বনির ঠোঁট নড়ল। একবার পেছন দিকে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, হঠাৎ হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছে।

কি ভাঙলো?

শিশি।

জেঠিমা হেসে ফেললেন, দ্যাখ, হাত পা কাটল কিনা!

কিসের শিশি?

আচারের।

কিরে, তোরা বেড়াতে এসে আচারের শিশি ভাঙলি?

জেঠিমা বললেন, আঃ ভাঙুক না। এ বাড়িতে তো কেউ কিছু ভাঙে না আজকাল।

এই সময় আড়াল থেকে টনির গলা পাওয়া গেল, কাকু, দিদি চুরি করে আচার খাচ্ছিল। আমি দেখতে পেয়েছি।

গম্ভীর গলায় গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কারও হাত পা কেটেছে?

বনি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

গৌরব হুকুম করল, চটপট নিচে নেমে আয়।

চোরের মতো নিচে নামল বনি। হাতে আচারের রস মাখামাখি ঠোঁটের কোণেও রয়েছে। বাঁ হাতের আঙুলে রক্ত ছড়িয়ে আছে। ভালো করে জল দিয়ে ধুইয়ে হাত পরিষ্কার করার পর দেখা গেল কেটেছে আধইঞ্চির বেশি নয় কিন্তু রক্ত বেরিয়ে আসছে সমানে। জেঠিমা জিজ্ঞাসা করলেন, রক্ত বেরুচ্ছে?

গৌরব আঙুলটা চেপে ধরে বলল, হ্যাঁ।

উঠোনের ওই কোণে বিশল্যকরণী গাছ আছে, দুতিনটি পাতা ছিঁড়ে এনে ধুয়ে টিপে রসালো করে কাটাটার ওপর চেপে দে। ঠিক হয়ে যাবে।
 
গৌরব একটু অস্বস্তি নিয়েই কাজটা করল। এই অবস্থায় একটা অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দেওয়া দরকার। ডেটল আছে কি না জানতে ইচ্ছে করলেও সে করল না। ইঞ্জেকশন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দেওয়া যায়। এখন পাতার রসের কি প্রতিক্রিয়া হয় তাই দেখা যাক। টনিও নেমে এসেছিল। রসালো পাতা দেখে সে বলল, আসবার সময় তুমি গল্প বলছিলে আর দিদির আঙুলে ওটা লেগে গেল। গৌরব নকল গলায় বলল, হ্যাঁ তোমার দিদি হলেন লক্ষ্মণচন্দ্র আর আমি হলাম গিয়ে হনুমান। সবাই হেসে উঠল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। গৌরব পাতার রস এবং পাতা ক্ষতের ওপর চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, কিরে লাগছে?

বনি মাথা নেড়ে বলল, না। রসটাও রঙিন কিন্তু বোঝা গেল রক্ত বের হওয়া বন্ধ হয়েছে। কাজের মেয়েটির কাছ থেকে একটা পরিষ্কার কাপড় চেয়ে আঙুলে জড়িয়ে দিলো গৌরব। এই সময় বনি বলল, কাকু!

কী হলো?

এই কথাটা মাকে বলবে না। মা খুব রেগে যাবে।

ঠিক আছে। টনি যদি না বলে তাহলে আমিও কিছু বলব না।

এই সময় সতুদা একটি লোককে নিয়ে ফিরে এল। লোকটার হাতে ক্যামেরার স্ট্যান্ড, একটা বড় ব্যাগ। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার সতুদা?

ছবি তোলাবো। আবার কবে আসবি তোরা তার তো ঠিক নেই। তোদের এই আসাটাকে স্মরণীয় করে রাখতে মায়ের সঙ্গে সবার একটা ছবি চাই।

জেঠিমা আপত্তি করলেন, না, না। চেহারার কি ছিরি হয়েছে জানি না। আমাকে আর ছবি তোলাতে বলিস না।

গৌরব হাসল, রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণ হয় না।

জেঠিমা বললেন, রাম জন্মাবার আগেই রামায়ণ হয়ে গিয়েছে।

আঃ বড্ড তর্ক করো। তোমার সঙ্গে আমরা ছবি তুলব। কোনো আপত্তি শুনছি না। তবে তোমার শাড়িটা পাল্টে নেওয়া দরকার।

শাড়ি নয়, ছোঁড়া, এটা ধুতি।

সেই কথাই বলছি। ধুতিটা পাল্টে একটা পরিষ্কার শাড়ি পরে নাও।

লোকে বলবে ভীমরতি হয়েছে। চিতায় ওঠার আগে ভোল পাল্টাচ্ছে।

সেই লোকগুলোকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো। কি সতুদা, তুমি কিছু বলছ না যে?

আমি অনেক চেষ্টা করেছি মাকে সাদা শাড়ি পরাতে, পারি না। দ্যাখ, তুই যদি পারিস!

জেঠিমা বললেন, শোন গোরা, সতু অনেক বলেছিল কিন্তু আমি তখন রাজি হইনি। এখন যদি তোর কথায় মত দিই ও কষ্ট পাবে না?

সতুদা বলে উঠল, মোটেই না। আমি সত্যি খুব খুশি হব।

কিন্তু আমার বোধহয় একটাও শাড়ি নেই।

সতুদা ঘরের ভেতরে চলে গেল। তারপর একটা মাঝারি পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি আর জামা এনে কাজের মেয়েটির হাতে দিলো। সে জেঠিমার হাত ধরে নিয়ে গেল ঘরের ভেতর পোশাক পাল্টাতে।

এদিকে ক্যামেরাম্যান ততক্ষণে যন্ত্রপাতি ফিট করে ফেলেছে। যে দিকে রোদ্দুর পড়ছে সেদিকে ক্যামেরা লাগিয়ে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে অ্যাঙ্গেল ঠিক করতে করতে তাড়া দিলো, বড্ড দেরি হচ্ছে। চটপট করুন।

সতুদা বলল, আমরা সবাই বসে যাই, আপনি ক্যামেরা ঠিক করুন, মাঝখানে মায়ের জন্যে জায়গা ছেড়ে রাখছি।

কিন্তু জেঠিমার আসতে দেরি হলো না। ছোট চুল আঁচড়ে দিয়েছে কাজের মেয়েটি। সুন্দর দেখাচ্ছে। সতুদা বলেই ফেলল, আমার মা কেমন সুন্দর গোরা?

জেঠিমা ধমক দিলেন, গুরুজনদের নিয়ে রসিকতা হচ্ছে?

বনি বলে উঠলেন, না ঠাকুমা, সাজলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়।

জেঠিমা রঙ্গ করে বললেন, তবু তো পমেটম মাখিনি।
 
গৌরব দুহাতে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে মাঝখানে বসাল। টনি বনি ওদের সামনে। ক্যামেরাম্যান কালো কাপড় মুখে ঢেকে ফোকাস ঠিক করতে লাগল। এক দুই করে অনেকগুলো মুহূর্ত বলে যাচ্ছে, স্মাইল প্লিজ, একটু হাসুন, হাসতে থাকুন।

গৌরব বলল, কতক্ষণ ধরে হাসা যায়?

এই আর একটু। হ্যাঁ, আপনি বাঁ দিকে চাপুন, খুকি তুমি ডানদিকে। হঠাৎ মাথা কাপড় থেকে বের করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আঃ সানটা খুব শিফট করছে। একটু দাঁড়ান।

ক্যামেরা সরিয়ে নিল সে আর একটু আবার অ্যাডজাস্টমেন্ট শুরু হলো। গৌরব বলল, আপনার কোথায় যেন যাওয়ার তাড়া ছিল না?

হ্যাঁ। কেন? লোকটা সেই অবস্থায় প্রশ্ন করল।

না অনেক সময় লাগছে তো!

লাগবেই। এটা একটা আর্ট। আর্টের জন্যে সময় লাগবেই।

জেঠিমা বললেন, আমি তো বাবা আর সোজা হয়ে বসতে পারছি না। বাবা মাজা ধরে গেছে যে।

ক্যামেরাম্যান বলল, আপনি একটু ডান দিকে ঝুঁকে বসুন।

জেঠিমার আরাম হলো যেন। গোরা দেখল জেঠিমা সতুদার দিকে শরীর ছেড়ে দিয়ে পাদুটো সামনে ছড়িয়ে দিলেন। আর তখন ক্যামেরায় সাটার টেপার শব্দ হলো। সতুদা বলে উঠল, আরে মা তুমি তো প্রায় শুয়ে পড়েছ। এই আর একবার ছবি তুলুন।

জেঠিমা বললেন, না বাবা, অনেক হয়েছে। আমি উঠলাম। বাচ্চাদুটোর নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে। দেখি কি আছে ঘরে।

কারও কথা না শুনে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ক্যামেরাম্যান তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগল। সতুদা হতাশ হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কবে ছবি পাওয়া যাবে?

পাঁচ দিন। এখনও কয়েকটা বাকি আছে। শেষ হলেই ধুয়ে ফেলব।

লোকটা চলে গেল। গৌরব বলল, সতুদা, তুমি কিন্তু আমাকে দুটো ছবি পাঠাবে।

নিশ্চয়। তবে একবার শাটার টিপেছে, ছবি উঠলে হয়।

টনি বনি আবিষ্কার করল, নারকেলের নাড়ু আর চিড়ের মোয়ার মতো উপাদেয় খাবার কেক প্যাস্ট্রিও নয়। জেঠিমার খুব ইচ্ছে ছিল ওরা আজকের রাতটা থেকে যাক। কিন্তু গৌরব বলল, ওদের মাকে কথা দিয়েছি আজই ফিরিয়ে নিয়ে যাব জেঠিমা। আবার একবার এসে রাত্রে থাকব।

তাহলে সেই সময় সরলাকে নিয়ে আসিস। কতদিন দেখিনি ওকে। আমি তো যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে আছি, হঠাৎ খবর পাবি নেই, কিন্তু যাওয়ার আগে তোর মায়ের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।

কী কথা? গৌরবের কৌতূহল হলো।

তোকে বলব কেন? জেঠিমা হাসলেন, আমরা দুই জা, তোরা তো পরে এসেছিস। এক সময় আমরা তো বন্ধুর মতো ছিলাম।

বিদায় দৃশ্যটা সত্যি বেদনাদায়ক হয়ে পড়ল। জেঠিমা কাঁদলেন। কিন্তু শুধুই কান্না, কোনো আক্ষেপ নেই। টনির চোখে জল, বনির মুখ গম্ভীর। সতুদা বলল, কলকাতায় গিয়ে বনির আঙুলটা কোনো ডাক্তারকে দেখাস।

বনি মাথা নাড়ল, আমার আর ব্যথা নেই।

জেঠিমা চোখ মুছে বললেন, ওই পাতা ধন্বন্তরি, ঠিক জুড়ে যাবে। ফেরার পথে যখন সূর্যদেব পাটে যেতে চলেছেন তখন মালবাহী রিকশায় বসে টনি আচমকা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা কাকু, আমরা কেন মাঝে মাঝে এখানে আসি না? কি সুন্দর আকাশ, নদী, মাঠ, মানুষ।

কী করে বুঝলি মানুষ সুন্দর?

বোঝা যায়। টনি নিশ্বাস ফেলল।

বনি বলল, মা আসবে না তাই বাবা আসে না।

টনি বলল, বাবা সময়ই পায় না।

বনি মাথা নাড়ল, বাবা সারা ভারতবর্ষ ঘোরার সময় কী করে পায়?

গৌরব কোনো কথা বলল না। অনেকদিন বাদে নিজেকে সমস্ত টেনশন চিন্তা ভাবনার বাইরে আসা একটি মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। ঈশ্বর যদি এক-আধদিন মানুষকে এমন সময় উপহার দেন তাহলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তার ভালো লাগছিল টনি বনির কথা ভেবে। এই বয়স পর্যন্ত ওরা ইট কাঠ সিমেন্টের বাইরের জীবন দ্যাখেনি। কে বলে জেনারেশন গ্যাপ দূরত্ব বাড়ায়। পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হয়েও ওদের যদি গ্রাম থেকে ফিরে যেতে মুখ ভার হয়, মাঝে মাঝে আসার জন্যে মনে ইচ্ছে আসে তাহলে তার নিজের সঙ্গে ওদের কোনো পার্থক্য নেই। আসলে প্রয়োজন মেটাতে দ্রুতলয়ে বয়ে যাওয়া গা ভাসিয়ে আধুনিকতার সব কটি সুবিধে ভোগ করতে করতে যারা রঙিন চশমা পরে ফেলে তাদের কথা আলাদা, কিন্তু দেখার চোখ যদি ফুটিয়ে দেওয়া যায় তাহলে এক পা আগামীকালে রেখেও গতকালের গল্প শুনতে আগ্রহ না করে এদের উপায় নেই। আর তা হলেই মানুষের মতো বেঁচে থাকব।

দিন আটেক বাদে কলকাতার ঠিকানায় ছবি এল। সঙ্গে সতুদার চিরকুট। হতভাগা ফটোগ্রাফারের কান্ডটা দ্যাখ। ভাগ্যিস মা চোখে দেখতে পান না। প্রথমে ভেবেছিলাম এই ছবি তোকে পাঠাবো না। পরে মনে হলো মা যখন চলে যাবেন তখন তো তুই কাছেপিঠে থাকবি না। এই ছবিটাই সেই সময়টাকে মনে করিয়ে দিতে পারে।

ঠোঁট কামড়ালো গৌরব। ছবিতে জেঠিমা সতুদার ওপর এমন ভঙ্গীতে শরীর রেখে তার সামনে পা ছড়িয়েছেন যে দেখে হঠাৎ মনে হয় কোনো মৃতদেহকে নিয়ে ছবিটি তোলা হয়েছে। গৌরব স্থির করল, ছবিটা মাকে দেখাবে না।
 
এখন বাড়ির আবহাওয়া মোটামুটি শান্ত। সৌরভের সঙ্গে মলির একটা আপাত সমঝোতা হয়েছে। অন্তত সামনাসামনি মলি সৌরভের সঙ্গে কথা বলছে। সৌরভও প্রয়োজনে চেঁচিয়ে মলি বলে ডাকছে। স্বভাবতই সরলা এতে খুশি। গৌরব দোতলায় ব্যালকনিতে বসে মাকে নিয়ে ভাবছিল। এই মা কত বদলে গেল। রুচি শিক্ষা এবং সহবৎ নিয়ে যে মা এককালে কোনো কিছুর সঙ্গে আপোষ করত না সেই মা একে একে সব মেনে নিচ্ছে। সৌরভ যে রাত আটটার পরে স্নান সেরে হুইস্কি নিয়ে বসে সেটাও তার অজানা নয়। কিন্তু হুইস্কি খেয়ে যদি কেউ মাতলামি না করে তাহলে তার যে আপত্তি নেই সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যতই ভাবভালবাসা আপাতভাবে ছড়িয়ে থাক মলির সঙ্গে মায়ের যে মানসিক দূরত্ব কয়েক যোজনের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুটি নারী নেহাৎ নিজস্ব শান্তির জন্যে একটা অভিনয় জিইয়ে রেখেছে। জয়তী যদি এই সংসারে বউ হিসেবে আসে তাহলে তার সঙ্গেও কি মায়ের সম্পর্ক ওই রকম স্তরে পৌঁছবে? জয়তী আধুনিকা, কিন্তু তার উগ্রতা নেই। বরং আবেগের চেয়ে যুক্তিতে তার বেশি ভরসা। মলি আবার যুক্তির ধার ধারে না। তার মনে যখন যা আসে তাই ঘটাতে চায়। মলির সঙ্গে জয়তীর মিল হওয়া নিতান্তই অসম্ভব। মায়ের সঙ্গে মিলবে এমন ভরসা কোথায়?

মোটরবাইক নিল না গৌরব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে চড়বে বলে স্থির করল। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই একটা ট্যাক্সি নজরে এল। সেটা বোধহয় সওয়ারী পেতে অপেক্ষা করছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার দরজা খুলে এগিয়ে এল, আরে দাদা, আপনি? এদিকে থাকেন নাকি?

গৌরব লোকটার দিকে তাকাল। অল্প অল্প দাড়ি, বেশি বয়স নয়। পাঞ্জাবি ড্রাইভারদের মতো নস্যি রঙের পাঞ্জাবি। চিনতে অসুবিধা হলো না তবু, আরে! এ বেশে এখানে?

আমাকে চিনতে পারছেন দাদা?

বিলক্ষণ!

আমি এখন ড্রাইভারি করছি। কন্ট্রাক্টে ট্যাক্সি চালাই। দিনে গোটা চল্লিশেক হয়। ফার্স্ট ক্লাস। নিজেই নিজের রাজা।

মাস্তানি? মারপিট?

আর লজ্জা দেবেন না দাদা। ভেবে দেখলাম ওতে কোনো ফায়দা নেই। আপনি ভেবে দেখুন, এই কলকাতা শহরে আমার মতো পাড়ার মাস্তান অন্তত হাজার পাঁচেক আছে। এরা কেউ এইট নাইন পর্যন্ত পড়েছে কি না সন্দেহ। তিরিশ বত্রিশ বছর পর্যন্ত রংবাজি করে দিব্যি চালিয়ে যায়। কিন্তু তদ্দিনে অল্পবয়সী রংবাজ উঠে আসে। যা বাইশে মানায় তা চল্লিশে চলে না। এর মধ্যে মারপিট, পুলিশের ধোলাই এসব তো রয়েছে। তাই পঁয়ত্রিশের পর মাস্তানরা বেকার হয়ে যায়। আর পলিটিক্যাল দাদারা পাত্তা দেওয়া বন্ধ করলে কেস খতম। তখন না পায় চাকরি না করতে পারে ব্যবসা। কী ভাবে যে বেঁচে থাকে তা ওরাই জানে।

জমানো টাকা পয়সা থাকে না?

দূর, সব মেজাজ দেখাতে ফক্কা হয়ে যায় আসার পরেই। সেদিন খুকিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর মারপিট হতেই আমার মনে হলো অনেক হয়েছে এবার একটু অন্যরকম জীবন যাপন করা যাক। ড্রাইভিংটা জানতাম। বেরিয়ে পড়লাম ট্যাক্সি চালাতে, জয় বলল।

এখন কোথায় আছ?

এন্টালিতে। যার ট্যাক্সি তার একটা ছোট ঘর খালি ছিল। দুশোটাকা ভাড়া দিয়ে আছি। আপনি যাবেন কোথায়?

কোথাও না। মানে কোথাও যাব বলে ঠিক করি নি। এমনি।

তাহলে চলে আসুন দাদা, আমার পাশে বসবেন। ট্যাক্সিওয়ালাদের জীবনটা একটু দেখে নিন। জয় কথা শেষ করতে না করতেই এক ভদ্রলোক চিৎকার করলেন, ট্যাক্সি। জয় ইশারা করল গৌরবকে। মজা লাগছিল গৌরবের। ছোটকাকার বাড়িতে গিয়ে এই মাস্তানটার যা চেহারা দেখেছিল আজ তার একদম বিপরীত রূপ। ছেলেটা কথাগুলো ঠিকই বলেছে। তাদের সময় যেসব মাস্তান আতঙ্ক সৃষ্টি করে বিরাজ করত তারা এখন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।

স্রেফ সময় কাটানোর জন্যেই জয়ের পাশে উঠে বসল। জয় বলল, মিটারটা ডাউন করে দেবেন দাদা?

হাত বাড়িয়ে সেটা করতে গৌরবের কিঞ্চিত অসুবিধে হলো। পেছনের আসনে বসে ভদ্রলোকে বললেন, তাড়াতাড়ি যাবেন। তারাতলার মোড়।

অর্থাৎ কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। জয় বেশ ফুর্তির সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিল। হঠাৎ ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, তুমি খুব অন্যায় করছ।

ভদ্রলোক ফুঁসে উঠলো, বেশ করেছি।

তুমি কি আমাকে তোমার দাসী মনে করো? তুমি যা বলবে তাই আমাকে শুনতে হবে? এভাবে আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।

না হলে বাপের বাড়ি চলে যাও। আমার বাড়িতে যদ্দিন থাকবে তদ্দিন আমার কথা শুনতে হবে। পরিষ্কার কথা। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক।
 
পুরোটা পথ দুজনে ঝগড়া করে গেলেন গলা তুলে। এটা একটা ট্যাক্সি এবং সামনের আসনে দুটো মানুষ বসে আছে একথা তারা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। গৌরব এর আগে যখনই ট্যাক্সিতে উঠেছে তখন যাত্রী হিসেবেই উঠেছে। আজ এই নতুন ভূমিকায় তার মনে হলো কলকাতার যাত্রীরা সত্যি কিম্ভূত।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে মনে হলো ড্রাইভার হিসেবে জয় নিতান্তই ব্যতিক্রম। কাউকে না বলছে না। খালি থাকলে যে ডাকছে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গন্তব্য স্থান নিয়ে আপত্তি করছে না। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক খামোকা ঝগড়া করলেন। ট্যাক্সি খালি ছিল। হাত তুলে চিৎকার করে থামালেন। কাছে এসে চেঁচিয়ে বললেন, কানের মাথা খেয়েছ, এত চিৎকার করছি শুনতে পাচ্ছ না?

জয় বলেছিল, হাত নাড়লেই হতো, খামোকা চিৎকার করতে গেলেন কেন?

কি? খামোকা? ডাকলে তোমরা থামতে চাও না আবার কথা। শোনো তুমি যদি আমাকে রিফুজ কর তাহলে আমি থানায় যাবো।

আমি আপনাকে কিছুই বলি নি। জয় হাসল।

কোনো কথা না বলে পেছনের দরজা খুলে উঠে বসলেন বৃদ্ধ, এই আমি বসলাম। এবার দেখি তুমি কী করো।

আপনি যেখানে যেতে চাইবেন নিয়ে যাব।

ও তাই নাকি? হঠাৎ এত ভদ্র কথা। শ্যামবাজার।

জয় গৌরবের দিকে তাকাল। গৌরব হেসে ফেলল। বৃদ্ধ সম্ভবত সেটা দেখতে পেলেন, হাসি কেন? এত হাসি কীসের? বদ মতলব আছে নাকি?

জয় ইশারা করল গৌরবকে কথা না বলতে।

এরপরে সারাটা পথ বৃদ্ধ টিকটিক করে গেলেন। এত স্পিডে কেন, ওভারটেক করবে না, এই রাস্তায় জ্যাম হয় একটা বাচ্চা ছেলেও জানে তবু তুমি ঢুকলে, বাঙালির থেকে সর্দারজি ট্যাক্সি ড্রাইভার হাজার গুণ ভালো, এই জন্যেই বাঙালির কিছু হলো না– যেন নিজের মনেই কথা বলে গেলেন।

স্টার থিয়েটারের একটু আগে ট্যাক্সি থামালেন বৃদ্ধ। ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলো, কত হয়েছে? ঠিক মতো হিসেব করবে।

জয় গম্ভীর মুখে রেট কার্ড বের করে ওঁকে দিলো। বেশকিছুক্ষণ ধরে সেটাকে পড়ে তিনি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়লেন। জয় বলল, এ ধরনের প্যাসেঞ্জার প্রচুর। কত যে গালাগাল রোজ শুনতে হয়। বলতে বলতে সে পেছনে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল, দাদু, দাদু! বৃদ্ধ ততক্ষণে উল্টো ফুটপাতে, চিৎকার শুনে ফিরে তাকালেন। পেছনের সিট থেকে একটা ছোট চামড়ার ব্যাগ তুলে জয় ওঁকে দেখাতে তিরের মতো ছুটে এলেন, ইস,সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। একদম ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি তো মন্দ ছেলে না। অবশ্য তেমন কিছু ছিল না, টাকা বিশেক। চলি।

বৃদ্ধের আচরণে গৌরব হতভম্ব হয়ে গেল। জয় বলল, এই হলো জীবন দাদা।

.

সারাদিন নানা অভিজ্ঞতা মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হলো গৌরবের কাছে। সেই সঙ্গে জয়কেও। গৌরবের বারংবার মনে হচ্ছিল এই ছেলেটি নেহাৎই একটি অশিক্ষিত পাড়ার মাস্তান নয়। এর মধ্যে দু-দুবার প্রমাণ পেয়েছে সে। কিন্তু বলে ফেললেই জয় সেটাকে ঘোরাতে চেয়েছে। একবার দেওয়ালে সাঁটা জনৈকের মৃত্যু নামে একটা নাটকের পোস্টার দেখে গৌরব বলেছিল, বাঃ, একই নাটক কলকাতায় আর ন্যুয়র্কে অভিনয় হচ্ছে।
 
জয় ঘাড় নেড়ে বলেছিল, এটা এর আগেও এখানে রেগুলার শো হয়েছে। ডেথ অফ এ সেলসম্যান। প্রথমে খেয়াল করেনি গৌরব। পরে কানে লাগল। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের পক্ষে মূল নাটকটির নাম জানা সহজ ব্যাপার নয়। জয় কিন্তু ওই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালই না। গৌরব দু-একবার বললেও শ্রোতার ভূমিকা নিয়ে নিল। গৌরবের তখন মনে হয়েছিল হয়তো খুকিদের কাছে প্রসঙ্গে ওই নামটা শুনে মনে করে রেখেছে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে মদ খাওয়া, মাতলামো নিয়ে কথা উঠতে জয় ফট করে বলে বসল, ইংরেজি ছবিতে অনেকেই মদের গ্লাস হাতে নিয়ে কথা বলে কিন্তু মাতালকে নিয়ে ছবিতে হাসাহাসি আজকাল হয় না।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি খুব ইংরেজি ছবি দেখো মনে হচ্ছে?

না না। আজকাল সময় পাই না, আগে দেখতাম।

তোমার অতীতটা বলতে অসুবিধা আছে?

কথা না বলে জয় গাড়ি চালাচ্ছিল। বড়বাজার থেকে বালিগঞ্জ। পেছনে এক বৃদ্ধ মাদ্রাজী দম্পতি। প্যাসেঞ্জার বুঝে যে নিজস্ব কথা বলা চলে এই ধারণাটা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে গৌরবের। জয় জবাব না দেওয়ায় কৌতূহল বাড়ছিল গৌরবের। সে বলল, আমি তোমার সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড। কেন জানতে চাইলে বলব তোমাকে এই শ্রেণির লোক মনে হয় না।

কোন্ শ্রেণির?

পাড়ায় যারা মারামারি করে অথবা ট্যাক্সি চালায়।

একটু ভুল হলো দাদা। পাড়ায় যারা মারপিট করে, মাস্তান নামে বিখ্যাত হয় তাদের কোনো শ্রেণি নেই তাই আত্মমর্যাদা বলে কোনো ব্যাপারও নেই। কিন্তু যারা ট্যাক্সি চালায়, নিজের পেটের রুটি পরিশ্রম দিয়ে রোজগার করে তারা ওদের সঙ্গে এক হতে পারে না। বেশ জোরালো গলায় বলল জয়।

সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নিল গৌরব, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।

জয় স্টিয়ারিং-এ টোকা মারল। ট্যাক্সি ডালহৌসি ছাড়িয়ে এখন রাজভবনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে বলল, দাদা শুনেছি আপনি আমেরিকায় অনেক কাল আছেন। সেখানে কি স্নেহমাখা প্রীতি ভালবাসা, মানে এইসব সম্পর্কগুলো উঠে গিয়েছে?

মোটেই না। মানুষের জীবন থেকে এগুলো কখনই উঠে যাওয়ার নয়।

ঠোঁট কামড়ালো জয়, আমার সব গোলমাল হয়ে যায়। শ্রেণির কথা আছে মনে করেন? নেই। আই হেট দেম। ওইসব মুখোশপরা মানুষগুলোকে আমি ঘেন্না করি।


গৌরব নিঃসন্দেহ হলো। আজ অবধি কোনো বাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে এই ভাষায় কথা বলতে শোনেনি। জয়ের নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কোনো গোপন ক্ষত আছে। সে কিছু বলল না দেখে জয় গলা নামাল, আমার এভাবে কথা বলা হয়তো ঠিক হয় নি কিন্তু ওদের কথা ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায়। আমি ওদের দেখেছি, দেখতে বাধ্য হয়েছি কারণ ওরকম একটা পরিবারে দুর্ভাগ্যবশত আমার জন্ম হয়েছিল। যে ভদ্রলোককে বাবা বলতাম তিনি বিদেশি কোম্পানির বড় চাকুরে। যাঁর পেটে আমি জন্মেছিলাম অসম্ভব সুন্দরী আর সৌন্দর্য নিয়ে মশগুল থাকা ছাড়া আর কিছু জানেন না। দুজনের মধ্যে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক অথচ কখনই ডিভোর্স করবেন না। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলার দেখা হয় একমাত্র ব্রেকফার্স্ট টেবিলে। প্রতিটি সন্ধ্যায় ভদ্রমহিলা সেজেগুজে পার্টিতে চলে যান বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ফিরে আসেন মধ্যরাত শেষ হলে। ভদ্রলোক বাইরে মদ গিলে আউট হয়ে ঘরে নাক ডাকায়। এই অবস্থায় আমার বাল্যকাল কেটেছিল। আমার একটা বোন ছিল। খুব মিষ্টি। সে মানুষ হতো আয়ার কাছে। আমাকে খুব ভালবাসতো। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকে আমি আর বাবা-মাকে সহ্য করতে পারতাম না।

জয় চুপ করল

তারপর?

সকালবেলায় দুজনে আমাকে খুব জ্ঞান দিতেন। ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে আর আমি মনে মনে ভাবতাম। স্কুল লিভিং পাস করার পর আর স্কুলে যেতাম না। তখন কিছু বন্ধু জুটে গিয়েছিল। তারা ট্যাবলেট খেত। আমিও খেয়েছি কয়েকবার। কিন্তু ব্যাপারটা কেন জানি না আমাকে টানত না। এর মধ্যে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির একটা লোক ঝি-এর সঙ্গে অশ্লীল ব্যবহার করেছিল। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল লোকটার বউ। সে বেচারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিল। ঘটনাটা শুনতে পেলে আমরা তিনজন বন্ধু সেদিনই লোকটাকে রাস্তায় ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারলাম। ওই লোকটাকে আমি কদিন মাকে নিয়ে পার্টিতে যেতে দেখেছি। সেই রাগটাও ভেতরে ছিল। মার খেয়ে হাত ভেঙে লোকটা নিশ্চয়ই বাবামায়ের কাছে নালিশ করেছিল। সেদিন ফেরামাত্র দুজন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গায়েও হাত তুলেছিল। আঁতে ঘা লাগলে ওই এলিট সম্প্রদায়ের সঙ্গে বস্তির লোকের কোনো পার্থক্য নেই। বাবা আমায় বাড়ি থেকে দূর হয়ে যেতে বলল। মা বলল, আমার মুখ দেখা পাপ। আমি কথা না বাড়িয়ে জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কদিন এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। তারাও অস্বস্তিতে পড়ল আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসায়। মাসখানেক ছিলাম। তদ্দিনে একটু একটু করে আমি বেশ মাস্তান হয়ে গিয়েছি। শেষে একটা বস্তিতে গিয়ে ঘর ভাড়া করে বেশ ছিলাম। দলটল তৈরি হয়ে গেল সেই সঙ্গে অ্যান্টি পার্টি। আমার অসুবিধে হচ্ছিল একটাই আমি কোনো বড় মাস্তানের সেল্টার নিই নি বা পলিটিক্যাল নেতার চামচে হই নি। ওটা না হলে শুধু মাস্তানি করে টিকে থাকা মুশকিল।

তোমার মা-বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি?

না।

ওঁরা কোথায় থাকেন?

কি হবে জেনে? আমি ওই চ্যাপ্টারটা ভুলে যেতে চাই।

গৌরব ওর মুখের দিকে তাকাল। মনের ভেতরে একটা সন্দেহ ক্রমশ প্রবল হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সে জিজ্ঞাসা না করে পারল না, তোমার বোন কি এখনও ছাত্রী?

হ্যাঁ। বাচ্চা মেয়ে। ওর জন্যই মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। খুব মিস করি ওকে। যাত্রী নামিয়ে ওরা এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা খেল। ভাঁড়ের চা বহুদিন বাদে খেতে মন্দ লাগল না। এবার সন্ধে হয়ে গিয়েছে। গৌরবের বাড়ি ফেরার কথা মনে হলো। জয়কে সেকথা বলতেই সে বলল, চলুন ফিরে যাই। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ট্যাক্সি গ্যারেজ করে দেবো আজ।

আমাকে নামাতে অতদূরে যেতে হবে না তোমাকে। আমি চলে যাব।

দূর! তা কি কখনও হয়?

জয় ছাড়ল না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে আসছিল ওরা। রাস্তায় আলো জ্বলছে। ফুটপাতে লোক চলাচল এমনিতেই কম থাকে এদিকে। হঠাৎ দেখা গেল একটি মেয়ে মরিয়া হয়ে দৌড়োচ্ছে। তার পেছন পেছন দুটো মানুষ। ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে জয় দ্রুত মেয়েটির পাশে গাড়ি নিয়ে গিয়ে ব্রেক কষল। সে চিৎকার করল, কী হয়েছে? দৌড়চ্ছেন কেন?

মেয়েটি আতঙ্কিত মুখে এপাশে তাকাল তারপর পেছনে। যে লোক দুটো অনুসরণ করছিল তারা দাঁড়িয়ে পড়েছে। জয় আবার জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

মেয়েটি কথা বলতে পারছিল না ভালো করে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওরা–ওরা।

ওরা আপনাকে বিরক্ত করছে?

মেয়েটি আবার পেছন দিকে তাকাল, ওরা খুব খারাপ লোক।

জয় ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়াতেই লোকদুটো পিছু হটল। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। জয় বলল, আপনি চলে যান এবার, ওরা পালিয়েছে।
 
মেয়েটির চোখে মুখে তখনও ভয়, না ওরা লুকিয়ে আছে, আপনারা চলে লেগেই আবার আসবে। দোহাই, আমাকে এখান থেকে অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে নামিয়ে দিন। দয়া করে বাঁচান আমাকে।

জয় গৌরবের দিকে তাকাল। গৌরব বলল, যা করার করো, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো হচ্ছে না। জয় মেয়েটিকে ইঙ্গিত করল, পেছনে উঠুন।

মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে পেছনে উঠে বসল। ট্যাক্সিতে ফিরে এসে জয় বলল, দেখুন, আপনাকে আমরা চিনি না। কোনো নাটক করার চেষ্টা করবেন না। সে ইঞ্জিন চালু করে অ্যাকসিটারে চাপ দিলো।

এবার গৌরব জিজ্ঞাসা করল, আপনি এদিকে এসেছিলেন কেন? এই সময়ে?

মেয়েটি জবাব দিলো না। মুখ নিচু করে রইল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী করেন আপনি?

কিছু না। নিচু গলাতেই জবাবটা এল।

তাহলে এখানে কী করছিলেন?

একজন নিয়ে এসেছিল। বলেছিল চাকরি দেবে।

এখানে চাকরি?

আসার পর বুঝলাম কী চাকরি।

তার সঙ্গে আলাপ হলো কোথায়?

ট্রেনে।

ট্রেনে? কোথায় থাকেন আপনি?

নিউ ব্যারাকপুর।

মেয়েটি বলামাত্র জয় হাসল গাড়ি চালাতে চালাতে, এসব গল্প এর আগে অনেকবার শোনা হয়ে গেছে। ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না এরা।

মেয়েটি ককিয়ে উঠল, বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে বলছি না। আমি স্কুল ফাইন্যাল পাশ। পড়াশোনা করতে পারি নি টাকার অভাবে। বাবা নেই, দাদার রোজগার খুব কম। চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসতাম। এই সময় লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বিশ্বাস করুন আমার কথা।

হঠাৎ জয় বলল, চলুন আমি নিউব্যারাকপুরে আপনার বাড়িতে যাব।

মেয়েটি বলল, চলুন। দেখবেন আমি সত্যি বলছি।

জয় শিয়ালদা স্টেশনে নিয়ে এল ট্যাক্সি। বলল, নেমে যান। মেয়েদি কেঁদে ফেলল, আপনারা ভগবান।

দূর। আমরা কিছু নই। আমি তো নই। যদি সত্যি কথা বলে থাকেন তাহলে আজ না হয় বাঁচলেন কিন্তু রোজ আমি থাকব না উদ্ধার করতে।

মেয়েটি চুপচাপ নেমে চলে গেল। জয় স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে ওর যাওয়া দেখল। তারপর বলল, মেয়েটা সত্যি বলেছে, না দাদা?

গৌরব কোনো কথা বলল না। তারও মন খারাপ লাগছিল। পৃথিবীর সব দেশেই অভাব এভাবে মেয়েদের সর্বনাশের পথে নিয়ে যায়। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, জয়? তোমার বোনের নাম কি টিনা? চমকে ফিরে তাকাল জয়। এত অবাক সম্ভবত কখনও হয়নি সে। কথা বলতে একটু সময় নিল, আপনি চিনলেন কী করে?

আমি চিনি। তোমার সঙ্গে যেভাবে আলাপ হয়েছিল সেইরকম এক ঘটনাচক্রে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তোমাদের বাড়িতেও গিয়েছি। অবশ্য আমি আন্দাজে এত কথা বলছি, যদি আমার চেনা টিনা তোমার বোন হয়!

আপনার পরিচিত টিনা কোথায় থাকে?

গৌরব এলাকাটা বলল। স্টিয়ারিং-এ রেখে গম্ভীর মুখে জয় জিজ্ঞাসা করল। আপনার সঙ্গে আলাপ হলো কীভাবে?

আগে শুনতে চাই ওই টিনা তোমার বোন কিনা?
 
জয় নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। গৌরব শুরু করল সেই রাত্রে একা টিনা যেভাবে পথে বেরিয়ে এসেছিল, সেখান থেকে। সমস্ত ঘটনা শোনার পর জয় বিস্ময়ে জমে গেল, টিনা এত বড় হয়ে গিয়েছে?

তুমি ওকে কতদিন দ্যাখোনি?

বছর চারেক।

এই সময়ে চার বছর মেয়েদের পক্ষে বড় হবার জন্যে অনেক বেশি সময়।

আমি ভাবতেই পারছি না দাদা, সেই টিনা, ছোট্ট টিনা—

তুমিও তখন খুব বড় দাদা ছিলে না জয়!

কিন্তু আপনি নিশ্চিত টিনা ড্রাগের আড্ডায় যায়? আমি এটা মানতে পারছি না। এটা সত্যি হলে আমি কাউকে ছেড়ে দেবো না। কঠোর হলো ওর মুখ।

হ্যাঁ, ড্রাগের আড্ডায় সে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ড্রাগ সে নেয়নি তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। আমার ধারণা সেই রাত্রের পরে ও আর নিজেকে নষ্ট করতে বাইরে বের হবে না। কিন্তু ধারণাটা যদি ভুল হয় তুমি কী করতে পার? দূর থেকে কোন্ মানুষকে তুমি কতটা বুঝবে?

মানে থতমত হয়ে গেল জয়।

কথাগুলো শুনে তোমার খুব খারাপ লেগেছে, বোনকে অত্যন্ত ভালবাসতে এবং সেই স্মৃতি এখনও তোমার মনে রয়ে গেছে। গৌরবকে কথা শেষ করতে দিলো না জয়। মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, স্মৃতি নয় দাদা আমি পৃথিবীর যে কোনো মানুষের চেয়ে ওকে বেশি ভালবাসি।

তোমার সেটা ধারণা।

কী বলতে চাইছেন আপনি? রুখে উঠল জয়।

গৌরব হাসল, ভালবাসা একটা বায়বীয় ব্যাপার নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্ক তৈরি হয় এবং বেঁচে থাকে পরস্পরের ব্যবহার, চালচলন, মানসিকতার ওপর। ধর, তুমি যাকে ভালবাসতে সে বরফ। বরফই তোমার খুব প্রিয়। এইবার তুমি পরিস্থিতির চাপে সেই বরফের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য হলে। কিন্তু তোমার মনে সেই ভালবাসা অটুট হয়ে রইল। যখনই তার কথা ভাব তখনই শেষ দেখা স্মৃতিটি তোমাকে সাহায্য করে। এই অবধি বলে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, আমার কথার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি আছে মনে হয়?

জয় মাথা নাড়ল। তারপর?

এবার বেশ কিছুদিন পরে তুমি সেই বরফের কাছে এসে দেখলে তা জল হয়ে গিয়েছে। জল সম্পর্কে তোমার আগ্রহ নেই বরফ সম্পর্কে ছিল। তুমি সেই জলকে আগের মতো বরফ ভেবে ভালবাসতে গেলে পারবেও না উল্টে দুঃখ পাবে। জয়, পণ্ডিতরা বলে গিয়েছিলেন ভালোবাসার নিয়ত পরিচর্চা হওয়া উচিত। সেটা না হলে পরে সব হিসেব ওলোট পালোট হয়ে যায়। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলব না কিন্তু ব্যতিক্রমই তো নিয়ম নয়।

কথাগুলো মন দিয়ে শুনে জয় ট্যাক্সি চালাতে লাগল। এখন অনেকেই হাত নেড়ে তাকে থামতে বলছে কিন্তু সে ভ্রূক্ষেপ করছে না। একেবারে গৌরবের পাড়ায় পৌঁছে বলল, যাকগে। ও তো এখন বড় হয়ে গিয়েছে, আমার কি! যাদের দায় তারা বুঝবে। আমি যখন ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি তখন আর ভাবতে যাব কেন?

গৌরব হাসল, কিন্তু তুমি ভাববে।

জয় ঠোঁট কামড়াল।

গৌরব বলল, তোমাদের সঙ্গে সংঘাত হয়েছিল বাবা এবং মায়ের। তাদের জীবনযাত্রা তুমি পছন্দ করোনি। তোমার মনে হয়েছে পিতামাতা হিসাবে তারা ব্যর্থ। প্রতিবাদ জানাতে নিজের ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে তুমি বেরিয়ে এসেছিলে। ভালো মন্দ প্রশ্ন আমি করছি না। কিন্তু টিনার সঙ্গে তো তোমার কোনো মতবিরোধ ঘটেনি। সে তোমাকে ভালবাসত তুমি এখনও তাকে ভালবাসো। দাদা হিসেবে সে কর্তব্য যদি না করো তাহলে বাবা মাকে সমালোচনা করার কোন অধিকার তোমার নেই। আচ্ছা, আসি।

ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে যাচ্ছিল গৌরব জয় বাধা দিলো, দাদা, এক মিনিট।

গৌরব থামল। জয় মুখ ঘুরিয়ে নিল, আপনার বাড়িটা ঠিক কোথায় দেখে গেলে কোনো অসুবিধে হবে?

গৌরব আবার দরজা বন্ধ করে বসে পড়ল, বিন্দুমাত্র নয়।

একদম বাড়ি তো আমি ঢুকব না। টিনার সঙ্গে দেখা করি কী করে?

গৌরব হাসল, ঠিক আছে আগামী পরশু তুমি আমার কাছে একটা খবর নিও। এ বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিচ্ছি। ছোট্ট একটা কাগজে নম্বর লিখে এগিয়ে ধরতে জয় সেটা নিয়ে বলল, দেখা হবে দাদা। সে চলে গেল।

.
 
কলকাতা শহরে মানুষ আরামে বাস করতে পারে না। দুশো বছর এদেশে বাস করে ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে শহরটিতে যেসব আধুনিক সুবিধে তৈরি করে গিয়েছিল স্বাধীনতার পর চল্লিশ বছর ধরে তার অধিকাংশই আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। একমাত্র পাতাল রেল ছাড়া নতুন কিছু তৈরি করিনি। যে শহরে চল্লিশ হাজার মানুষের চলাফেরা ছিল সেখানে চল্লিশ লক্ষ মানুষ নিঃশ্বাস ফেলছে। যে রাস্তা একশটা গাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল সেখানে দশ হাজার গাড়ি ঠেলাঠেলি করে চলেছে। একমাত্র বক্তৃতা এবং মিছিল ছাড়া কলকাতার মানুষের জীবনযাত্রার কোনো উন্নতি হয় নি।

আমেরিকা থেকে কলকাতায় বাস করতে হলে তাকে অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হবে। এই ছাড়ার হিসেব করতে গিয়ে গৌরব দেখল সবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অমন আরামদায়ক বাড়ি যা স্বচ্ছন্দেই ঠাণ্ডা গরম করা যায় অত্যন্ত অল্প পয়সায় তা কলকাতায় পাওয়া যাবে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি যার দাম খুবই অল্প, যেটা চালানোর জন্যে মসৃণ রাস্তা দেশময় বানিয়ে রেখেছে আমেরিকান সরকার তা এখানে স্বপ্নেও কল্পনা করা যাবে না। বাজারে গিয়ে দুধ মাংস মাছ সবজি থেকে যা কিছু খাদ্যদ্রব্য নির্ভেজাল বলে কিনে আনা আর এ দেশে সম্ভব নয়। চাকরির ক্ষেত্রে চমৎকার কাজের আবহাওয়া এ দেশে কখনই তৈরি হল না। দেশ আমাকে যা দিচ্ছে তার বিনিময়ে আমার শ্রম এবং মেধা দেশকে দেওয়া প্রথম কর্তব্য–এই বোধ যাতে তৈরি না হয় সেই চেষ্টা করে গিয়েছে ভারতবর্ষের মানুষের সুখদুঃখের ইজারা নেওয়া, কয়েকটি রাজনৈতিক দল। অন্যের উল্লাস, অন্যের বেখেয়ালী আনন্দের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। প্রতিবাদ করলেও প্রতিকার পায় না। ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক দেশ কিন্তু সেই গণতন্ত্রে আদালতে নির্ভর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অর্থবান মানুষের পক্ষে কথায় কথায় আদালতে যাওয়ার শ্রম পোষায় না। হার্টের রোগে শয্যাশায়ী মানুষের বাড়ির পাশে শীতলা পুজো উপলক্ষে সারারাত মাইক বাজানো মানে প্রথম ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা। এই ভদ্রলোক পুলিশের কাছে তেমন সহযোগিতা পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। পুলিশের পক্ষেও প্রতিটি মানুষকে ধরে গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। আসলে একটা জাত শিথিল হতে হতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে এখানে বাস করতে হলে প্রতি মুহূর্তে ঠোক্কর খেতে হবে। কিন্তু আমেরিকায় সে যাতে অভ্যস্ত তাতে যা কিছু আরাম তা নিজের জন্যেই পেয়ে এসেছে। তার স্নেহের শ্রদ্ধার ভালবাসার মানুষেরা যদি এই পরিবেশে পড়ে থাকে তাহলে কি সে একা ব্যক্তিসুখ ভোগ করবে না স্বেচ্ছায় সবরকম কষ্ট মেনে নেবে? এই দোটানায় তখন দুলছে গৌরব। এইসময় চিঠিটা বাড়িতে এল। ডব্লু অ্যান্ড ডব্লু নামক মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানি তাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছে।

ব্যাপারটার পেছনে সৌরভের উদ্যোগ রয়েছে।

আজ রবিবার। বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে কিন্তু ভোর হতেই ঘুম ভেঙে গেল গৌরবের। ঘুম চলে যাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে থাকা খুবই কষ্টকর। গৌরব উঠে পড়ল। তার ঘরে লাগোয়া বাথরুমের ওপাশে মায়ের ঘরের বাথরুম। দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে সে থমকে দাঁড়াল। মায়ের কাশির আওয়াজ ভেসে আসছে। অনেকটা সময় ধরে কষ্ট করে যে কাশি চেপে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও বেরিয়ে আসছে তার আওয়াজ মোটেই ভালো নয়। গৌরব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কাশতে কাশতে মা বেদম হয়ে শেষতক আবার আঃ আঃ করতে লাগলেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top