What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

এবার মহিলা সম্ভবত এস্টাব্লিশমেন্ট সেকশনে টেলিফোন করলেন। ওঁদের কথাবার্তায় গৌরব বুঝল মহিলার নাম লীনা চ্যাটার্জি। তার টেবিলে টেলিফোন করে জানা গেল তিনি অফিসে আসেন নি। তিনদিনের ছুটি নিয়েছেন। গৌরব হতাশ হলো। বউদির কাছে চেয়ে নেওয়া সময় পেরিয়ে যাবে তিনদিন অপেক্ষা করতে হলে। রিসেপশনিস্ট মহিলা এর মধ্যে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ওকে আর ঘাটানোর সাহস পাচ্ছিল না সে। হঠাৎ মহিলাই বললেন, আপনি ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে পারেন যদি খবরটা খুব জরুরি হয়।

অবশ্যই জরুরি কিন্তু মুশকিল হলো আমি ওঁর বাড়ির ঠিকানা জানি না।

গৌরব ম্লান হাসল। কি বুঝলেন তিনিই জানেন, দেখা গেল মহিলা আবার উদ্যোগ নিচ্ছেন, রেকর্ড সেকশনে ফোন করে তিনি লীনা চ্যাটার্জির বাড়ির ঠিকানা উদ্ধার করে একটা কাগজে লিখতে লিখতে বললেন, এঁকে আপনি আগে কখনও দ্যাখেননি বলেছিলেন, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। গৌরব বিনয়ে গলে গেল যেন।

কী করেন আপনি?

কিছু না, বেকার। আপাতত।

চোখ ছোট করলেন মহিলা। কাঁধ নাচিয়ে বললেন, কারো বাড়ির ঠিকানা দেওয়া সম্ভবত ঠিক নয়। তাই আপনার নাম ঠিকানা এখানে লিখে দিন।

কলম আর একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা। অভ্যেসে নিজের নামের নিচে আমেরিকার ঠিকানাটা লেখার পর কাটতে গিয়েও মন পাল্টাল সে। তারপর কলকাতার ঠিকানাটা জুড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এবার যেতে পারি?

খুব অনাগ্রহ নিয়ে চিরকুট চোখের সামনে ধরেই মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল, আপনি আমেরিকায় থাকেন? ইঞ্জিনিয়ার?

ওই আর কি? গৌরব আর দাঁড়াল না। সে বুঝতে পারছিল মহিলার দৃষ্টি ওর পিঠের ওপর আঠার মতো সেঁটে আছে। আমেরিকার রাজনীতি সম্পর্কে বাঙালির একটা বিরক্তি আছে। খুব বড়লোককে যেমন সহ্য করা মুশকিল হয়। কিন্তু কোনো বাঙালি ছেলে আমেরিকায় বেঁচে বর্তে থাকলে তার সম্পর্কে এক ধরনের রোমান্টিক আগ্রহ তৈরি হয় কেন? কলকাতায় যার চার হাজার টাকা মাইনে আমেরিকায় সে তিন হাজার ডলার পেলে সেটা সেখানে ছত্রিশ হাজার টাকা হয়ে যায় না। পঞ্চাশ পয়সায় এখানে বাসে চেপে শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলায় পৌঁছানো যায় কিন্তু এই দূরত্ব আমেরিকান বাসে পৌঁছাতে ভারতীয় টাকায় বারো টাকা লাগে। কিছু উন্নত মানের সুবিধে যা জীবনযাত্রায় প্রয়োজন হয় তাছাড়া অন্য কোনো মোক্ষলাভ আমেরিকায় চাকরি করলে হয় না। হ্যাঁ, যেটা ব্যক্তিগত লাভ সেটা হলো যে যার নিজস্ব কাজ নিশ্চিন্তে করতে পারে এবং তাকে সবরকম সুবিধে দেওয়া হয়। কিন্তু তার সঙ্গে সাংসারিক জীবনযাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই।
 
রাস্তাটার নাম ফার্ন রোড। গোলপার্কের একটা মুখ থেকে ভেতরে ঢুকল গৌরব। আজ অসময়ে সন্ধে নামব নামব করছে। বৃষ্টি আর নামেনি কিন্তু মেঘেরা অনেক নিচে নেমে এসেছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নম্বর মিলিয়ে সে যখন বাড়িটার কাছাকাছি তখন কয়েকটি ছেলেকে গল্প করতে দেখল। উত্তর কলকাতার মতো রকে বসে না এরা কিন্তু মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা চমৎকার কাটিয়ে দেয়। বাড়িটার সঠিক হদিশ এরাই দিতে পারে ভেবে গৌরব ওদের সামনে এগিয়ে গেল। নম্বরটা শুনে একজন জিজ্ঞাসা করল, নামটা বলুন?

মিসেস লীনা চ্যাটার্জি।

সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টিগুলো পাল্টে গেল। একটি ছেলে বেশ রহস্যময় হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করল, দাদা কি ওঁর রিলেটিভ?

গৌরব মাথা নেড়ে না বলতেই আর একজন বলল, ধান্দাটা কী?

গৌরবের কান লাল হলো, কী বলতে চাইছেন?

পাড়ার মধ্যে একটা মেয়ে একা থাকে। উল্টোপাল্টা পার্টিরা যাওয়া আসা করছে। এটা আমরা অ্যালাউ করব ভাবছেন কী করে?

দ্বিতীয় জন বলে উঠল, ছেড়ে দে। বাড়িওয়ালা তো নোটিস দিয়েই দিয়েছে। সোজা চলে যান। বাঁ দিকের ওই তিনতলার ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় থাকেন উনি।

কথা বাড়াল না গৌরব। সে হাঁটা শুরু করতেই পেছনে কিছু ইতর হাসি ভেসে উঠল। মিসেস লীনা চ্যাটার্জি নিশ্চয় খুব আরামে নেই। একা কোনো মেয়ে যদি ভদ্রভাবে বাস করে তাহলে পাড়ার ছেলেরা তার পেছনে লাগবে কেন? নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা ওদের সুযোগটা করে দিয়েছেন।

বাড়িটায় ঢুকতেই এক বৃদ্ধের মুখোমুখি হলো গৌরব। ভদ্রলোক ছাতি নিয়ে বেরুচ্ছিলেন। গৌরব দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন?

মিসেস লীনা চ্যাটার্জি এখানে থাকেন?

এখন পর্যন্ত আছেন।

কোন্ দিকে ওঁর ফ্ল্যাট?

ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান হাতে। আপনাকে তো আগে দেখিনি।

আমি আজ প্রথম আসছি।

অ।

আপনি?

এই বাড়িটা দুর্ভাগ্যক্রমে আমার। বৃদ্ধ আর দাঁড়ালেন না। গৌরব বুঝল ঘরে এবং বাইরে পরিবেশ খুব প্রতিকূল হয়ে রয়েছে। সে দোতলায় উঠে দরজায় গায়ে কলিং বেল খুঁজল। বোঝা যায় একটা বস্তু ছিল কিন্তু এখন খুলে নেওয়া হয়েছে। অতএব আঙুলের টোকা দিলো দরজায়। তৃতীয় বারের পর দরজায় দেখল গর্ত দিয়ে জরিপ করছে কেউ বলে মনে হলো। তারপর দরজাটা খুলল। ঘরে আলো জ্বলছে। সেটাকে পেছনে রেখে দরজার পাল্লা ধরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার ফাঁপা চুল কাঁধ ছোঁওয়া, গায়ের রঙ মাজা, পরনে ম্যাক্সি, চোখে মুখে শুকনো ক্লান্তি। দাঁড়াতে যেন কষ্ট হচ্ছে ওঁর।
 
গৌরব নমস্কার করল, নমস্কার। আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু কিছু কথা বলার দরকার।

কোত্থেকে আসছেন? খুব ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল লীনা চ্যাটার্জি।

আমার নাম গৌরব। গৌরব বসু। আমার দাদাকে আপনি চেনেন।

ও! পরিচিত ভঙ্গি ফুটে উঠল লীনার মুখে। আপনি কি আমেরিকায় থাকেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অর্থাৎ মহিলা দাদার কাছে ওর কথাও শুনেছেন।

আসুন ভেতরে আসুন। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে গৌরবকে ভেতরে আসার পথ করে দিয়ে ওটাকে বন্ধ করে দিলো লীনা। গৌরব দেখল শোভন বসার ঘরে সোফাসেট ছাড়া রুচিম্মত কিছু আসবাব রয়েছে। গৌরবকে বসতে বলেই লীনা নিজেও বসে পড়ল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে খুবই অসুস্থ মনে হচ্ছে!

তেমন কিছু না। কথাটা বললেও ভাবে সেটা ফুটে উঠল।

আমার এভাবে আসা উচিত হয়নি। আপনি বরং বিশ্রাম করুন, পরে একদিন আসব।

-না। আপনি সঙ্কোচ করবেন না, আমি ঠিকই আছি। একটু আধটু জ্বরজ্বারি তো মানুষ মাত্রেই হয়। কিন্তু আপনাকে আমার এখানে দেখতে পাব তা ভাবতে পারিনি।

আপনার জ্বর কত?

থার্মোমিটার দিইনি।

ওষুধপত্র?

যদি কমে যায় তাহলে আর দরকার হবে না। লীনা হাসার চেষ্টা করল, বলুন, কী ব্যাপার?

গৌরবের অস্বস্তি শুরু হলো। শিক্ষিত মহিলারা যখন গ্রাম্য মানসিকতার নকল করে কথা বলেন তখন যে অভিমান স্পষ্ট হয় তাতে বরফের স্পর্শ থাকে।

গৌরব সরাসরি কথায় চলে আসতে চাইল, আপনার ঠিকানা দাদার কাছে থেকে নিইনি আমি। আপনার নতুন অফিসে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এখানে এলাম।

কেন? সৌরভকে বললেই তো জেনে যেতেন।

বুঝতেই পারছেন আমি ইচ্ছে করেই ওকে জিজ্ঞাসা করিনি।

তাহলে বলুন কেন এসেছেন?

না। আজ আপনার শরীরের যা অবস্থা তাতে এসব কথা আলোচনা করা ঠিক হবে না।

সেকি! নানা। কোনোটাই বেঠিক নয়। শরীর খারাপ বলে আমি কি কিছু রান্না করে খাচ্ছি না। এক গ্লাস জল চাইলেও তো কেউ দেবার নেই। কাজের মেয়েটি না আসা পর্যন্ত নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে বসে থাকছি না। যাকে একা থাকতে হয় তাকে সব কিছুই মেনে নিতে হয়। আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।

বেশ। আপনি তো দাদার বন্ধু!

তাই জানতাম।

বুঝতে পারলাম না।

শুনলাম আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকায় সৌরভের বাড়িতে প্রব্লেম তৈরি হয়েছে। চোখ বন্ধ করল লীনা, বন্ধু যদি সমস্যা তৈরি করে তাহলে সে কীসের বন্ধু।

আপনি সমস্যাটার কথা জানেন?

সৌরভ বলেছে।

ও।

আপনি মনে হয় ওই ব্যাপারেই এসেছেন। আমি সৌরভকে বলেছি আমার জন্যে ওকে বিব্রত হতে হবে না। আর কিছু বলবেন? লীনা সরাসরি তাকাল।

দাদার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক যে শুধুই বন্ধুত্বের তা বউদি মানতে রাজি নন।

ঠিকই করেছেন উনি, নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সীমারেখা এত সূক্ষ্ম যে চোখে দেখা যায় না।

কিন্তু দাদা বউদির সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাইছেন না।

গৌরববাবু এটা সৌরভের সমস্যা।

অবশ্যই। আমি এসেছিলাম আপনার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে।

কী কথা? আমি যেন আর সৌরভের সঙ্গে দেখা না করি, সৌরভের সংসার আমার জন্যে ভেঙে যাচ্ছে অতএব আমি যেন নিজেকে সরিয়ে নিই। আঃ। গৌরববাবু, আপনি তো এতদিন বিদেশে ছিলেন, এরকম অনুরোধ নিয়ে এদেশের মানুষেরাই আসে।

একটু পরিষ্কার করুন।

নিজের ঘরের মানুষকে সংশোধন, যদি অবশ্য সংশোধনের প্রয়োজন হয়, না করে বাইরের মানুষকে ধমকানো বা তার কাছে ভিক্ষে চাওয়াটা কি হাস্যকর নয়!

আমি কিন্তু সেসবের জন্যে আসিনি।

তাহলে কেন এসেছেন?

জানি না কেন আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।
 
ক্লান্ত লীনা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, সৌরভের সঙ্গে যদি আমার প্রেমের সম্পর্ক থাকত তাহলে আমি কিছুতেই ওকে ছেড়ে দিতাম না। কারণ ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারতাম না। নিজের ভালবাসাকে দান করে দেওয়ার মতো উদার অথবা দুর্বল মানুষ আমি নই। চারপাশের লোভী মানুষগুলোর থেকে সৌরভকে আমার আলাদা মনে হয়েছিল বলে ওর সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে বন্ধুত্ব এক ধরনের নির্ভরতা দেয়।

আপনি দাদাকে চিঠি দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। সৌরভ সেই চিঠি পায়নি। লীনা অবাক হলো, আপনি জানলেন কী করে?

বউদি ওটা পেয়ে এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে দাদাকে দেননি।

ও। ওয়ান্স এগেইন আই অ্যাম সরি। সেদিন আমার বাড়িওয়ালা নোটিস দিয়েছিলেন যাতে তিনদিনের মধ্যে আমি এই ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠে যাই। চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম তাই ওর অফিসে টেলিফোন করি। অফিস বলল সৌরভ ট্যুরে যাচ্ছে। ভাবলাম বাড়িতে পাব তাই পিওন দিয়ে চিঠি পাঠাই। সৌরভ এল না। অনেক চেষ্টায় বাড়িওয়ালার কাছে দুমাস সময় নিয়েছি।

ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে কেন?

মুখে বলছেন ওর ঘরের প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। সত্যি কথাটা বলতে চাইছেন না উনি। একা আমার বয়সের মেয়েকে উনি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন কিন্তু সে তার বন্ধুদের এ বাড়িতে আসতে বলবে তা ভাবেননি। এ ব্যাপারে আঠারো আর আটত্রিশের মধ্যে কোনো পার্থক্য এদের কাছে নেই। আমি একা থাকি, চাকরি করি, আমার কোনো আত্মীয় নেই সুতরাং আমার সম্পর্কে এ পাড়া সমস্ত মানুষের অগাধ কৌতূহল। সবাই আমার মধ্যে নোংরা আবিষ্কার করতে ব্যস্ত। আমার কাছে যে আসবে তার সঙ্গেই একটা নোংরা সম্পর্ক তৈরি করে নিতে চায় সবাই। ঘেন্না ধরে গেল। এই যে আপনি এলেন, আপনিও বাদ যাবেন না।

সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কিন্তু কেন বলুন তো?

আমার যদি একজন স্বামীদেবতা থাকতেন তাহলে রোজ পাঁচটা করে ছেলে এলেও সবাই চোখ বন্ধ করে থাকতেন। যেহেতু পাড়ার কারো সঙ্গে মিশি না তাই জ্বালা হয়ে দাঁড়িয়েছে বোধহয়। ছেড়ে দিন আমার কথা। আপনি তো অনেক দিন পরে দেশে এলেন। আপনার কেমন লাগছে?

অদ্ভুত। আর নয়। এবার আপনি শুয়ে পড়ুন। কোনো ওষুধপত্র আনতে হবে?

না নিজের দেখাশোনা আমি নিজেই করতে পারি।

জানলাম। তবু যদি মনে হয় অসঙ্কোচে বাড়িতে ফোন করতে পারেন। দাদার ফোন নাম্বার নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। আর যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে মাঝে মাঝে দেখা করে যাব। নমস্কার। গৌরব হাত জোড় করে উঠে দাঁড়াল। তারপর সোজা দরজা খুলে সেটা বন্ধ করে নিচে নামতে লাগল।
 
যে কালো ঝড়টা অনেক অন্ধকার নিয়ে ছুটে এসেছিল বসু পরিবারের ওপর শেষপর্যন্ত সে দিক পরিবর্তন করল। মলি যদিও ঠিক আগের মতো সহজ নয় তবু কিছুটা স্বচ্ছন্দ। গৌরব তাকে বিস্তারিত বুঝিয়েছে। পুরুষ মানুষদের কথায় মেয়েরা খুব একটা আমল দেয় না যদি না তাদের হৃদয় সায় দেয়। মলি শুনেছিল, বাড়ি ছেড়ে যায়নি কিন্তু কোথাও একটা ফারাক থেকে গিয়েছিল ব্যবহারে। গৌরব এই নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায়নি। সময় সেই ওষুধের নাম যা নিরানব্বই ভাগ ক্ষত সারিয়ে দেয়। কলকাতায় কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল। অথচ গৌরব ঠিক করতে পারছিল না তার কী করা উচিত। আমেরিকা থেকে আসবার সময় ভেবেছিল দেশে কাজের সুযোগ পেলে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাবে। ভারতবর্ষের টাকার কথা ভাবলে নিশ্চয়ই আর্থিক ক্ষতি হবে তার। কিন্তু সেটা আমেরিকার ডলার কলকাতায় নিয়ে এলে। আমেরিকায় এক ডলারে যে সুবিধে পাওয়া যায় ভারতবর্ষে এক টাকাতেও তাই। কিন্তু যেটা সবচেয়ে কাম্য তা হলো কাজের সুযোগ এবং পরিবেশ। অনাবাসী নাগরিক হিসেবে তাকে কি কেউ সেই সুযোগ দেবে? ইদানীং রাস্তাঘাটে ঘুরে তার মনে হয়েছে কাজের ক্ষেত্রে এদেশের মানুষের মনে এখনও সিরিয়াসনেস তৈরি হয়নি। পঞ্চাশভাগ মানুষের যেন কোনো দায় নেই, চল্লিশভাগ করছে দায়সারা ভাবে। কাজকর্ম যা হচ্ছে তা মাত্র দশভাগ মানুষের নিষ্ঠার জন্যেই। রাজনৈতিক দলগুলো এই বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে মদত দিচ্ছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি সত্য হলো সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্ররোচনাকে ব্যবহার করে নিজেকে তাৎক্ষণিক লাভের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। গৌরবের দ্বিধা হচ্ছিল, এই পরিবেশে ঠিক ঠাক কাজ করা সম্ভব হবে কি না।

গৌরবের এই ভাবনাটা বাড়িতে তিন রকমের আবহাওয়া তৈরি করেছিল। মা এবং টনি বনি খুব খুশি। ও এখানে থাকলে এঁদের মন ভালো থাকবে। মা তো বলেই ফেললেন, যা শিখেছিস তা যদি দেশের জন্য খরচ করিস তাহলে একটা ভালো কাজ হয়। তোরা দুই ভাই মিলেমিশে আছিস জানলে মরার সময় শান্তি পাব। বউদি একটু অন্য কথা বলল, যদি এদেশে থাকতে চাও তো কখনও কলকাতায় নয়। কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউন নয়তো দিল্লি বোম্বেতে চাকরি খোঁজো। আরামে থাকবে। আর সৌরভ বলল সম্পূর্ণ উল্টো কথা, খেপেছিস? ভারতবর্ষে চাকরি করবি। সুখে থাকতে ভূতে কিলোচ্ছে কেন? কথায় কথায় মালিকের খামখেয়ালিপনা আর ইউনিয়নের হুমকি সইতে পারবি না!

মোটরবাইকে চেপে গৌরব এইসব ভাবছিল। হঠাৎ ওর টুলুর কথা মনে পড়ল। সেই ঘটনার পর টুলু আর তার সঙ্গে দেখা করেনি। এমন কি ওর বাড়ি থেকেই কোনো খবর আসেনি। রত্না কেমন আছে জানতে আগ্রহ হলো। সে বাইক ঘোরাল।
 
মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়াটা সকালবেলায় বেশ আলস্য নিয়েই থাকে। রত্নাদের বাড়িতে যখন গৌরব পৌঁছল তখন ওর বাবা বাজার থেকে ফিরছেন। পক্ককেশ বৃদ্ধ ওকে দেখতে পেয়েই উল্লসিত হলেন, ওঃ। তোমার কথা রোজ ভাবি কিন্তু যেতে পারি না।

গৌরব বিস্মিত হলো, কেন? আমার ঠিকানা।

না না ঠিকানা নয়। আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে যাব তা আমার মেয়ের পছন্দ নয়। বলে এতে নাকি তুমি অস্বচ্ছন্দ বোধ করবে। অকপটে বললেন বৃদ্ধ।

ঠিকই বলেছে ও। গৌরব হাসল, বাজার হলো?

হ্যাঁ কিন্তু বাবা, যা সত্য তা স্বীকার না করাটা তো অন্যায়। তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমার একটু অন্য কথাও আছে। ওরা প্রায় বাড়ির দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল। গৌরবের মনে হলো বৃদ্ধ একটু একান্তে কোনো কথা বলতে চান। সে অপেক্ষা করল।

রত্নার বাবা বললেন, ব্যাপারটা কি জানো, টুলু খারাপ নয়।

গৌরব বলল, টুলু আমার আত্মীয় কিন্তু ওর মেরুদণ্ডটি মোমের তৈরি।

না-না। পুরনো ভ্যালুস যারা মানে তারা বাপ মায়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। ও তো নিজে কখনও রত্নার ওপর অত্যাচার করেনি। আমি বলছিলাম কি, তুমি যদি টুলুকে একবার আমার বাড়িতে আসতে বলো তাহলে খুব ভালো হয়। হাজার হোক ওরা স্বামী-স্ত্রী। নিজেদের মধ্যে কথা বলে একটা পথ খুঁজে নেওয়ার সুযোগ ওদের করে দেওয়া দরকার। কী বলো তুমি? বৃদ্ধ ব্যাকুল চোখে গৌরবের দিকে তাকালেন। গৌরবের চোয়াল শক্ত হলো। জানতে চাইল, রত্নারও কি একই ইচ্ছে?

-না। সে এসব কিছুই জানে না। এখন তো শাঁখা খুলে ফেলেছে, সিঁদুরও পরে না।

তাহলে আপনি আবার এসব ভাবছেন কেন?

ওই যে বললাম পুরোন ভ্যালুসের কথা। সেটাও তো আমি ছাড়তে পারছি না। জানি ওরা আমার মেয়েকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রেখে পাগল বানাতে চেয়েছিল। বরপণের টাকা মেটাতে আমার বাড়ি বিক্রি হতে যাচ্ছিল। তবু যে শিশু আসছে তার জন্যে, তার তো একটা পরিচয় দরকার!

মায়ের পরিচয় তো শিশুর অনেকখানি। তাছাড়া এসব ব্যাপার নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? যাদের সমস্যা তারা যদি আপনার মতামত জানতে চায় তাহলে নাহয় বলবেন।

কিন্তু নিজেকে ওভাবে আলাদা করে রাখতে পারি না যে।

এতে আপনি অনর্থক কষ্ট পাচ্ছেন। অপমানের বিষ যে কোনো সম্পর্ককেই মেরে ফেলে মেসোমশাই। যদি সেটা বাঁচে আপনি বাঁচবে। আপনি চেষ্টা করবেন না। রত্না আছে?

হ্যাঁ আছে। এসো এসো। তোমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেই–দ্যাখো।

গৌরব বুঝল বৃদ্ধ তার কথাগুলো মেনে নিতে পারছেন না। ভারতবর্ষে মানুষ যত আধুনিক হোক না কেন কন্যাকে খুশি করার ব্যাপারে জামাই ছাড়া কিছু কি ভাবতে পারে না? নইলে যে অবস্থার মধ্যে রত্না ছিল টুলু যা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিল, তারপর ইনি ওদের পুনর্মিলনের কথা ভাবতেন না।

ওমা গৌরব। হোয়াট এ সারপ্রাইজ। রত্না প্রায় চিৎকার করে উঠল। কেমন আছ?

খুব ভালো। রত্নাকে খুব ঝকমকে দেখাচ্ছিল, তুমি কিন্তু আমার খুব অসময়ে এসেছ!

মানে? গৌরব রসিকতা করল, আমি কি শুধু অসময়েই আসি?

কোথায় আস? এই তো প্রথম এলে! রত্না রসিকতাকে সম্ভবত ধরতে পারল না।

দ্বিতীয়বার।

ওহো। তখন আমি ছিলাম না এখানে। তোমাকে অসময় বললাম তার কারণ আমাকে এখনই স্কুলে যেতে হবে।

ও তাই তো। না না তুমি যাও। তোমাকে দেরি করিয়ে দেবো না।

তুমি কোথায় যাচ্ছ এখান থেকে?

কোথাও না। আমি বেকার তা তো জানোই।

বেশ। তাহলে তোমার জন্যে মিনিট দশেক বসতে পারি কিন্তু সেটা একটা শর্তে।

শর্ত? অবাক হলো গৌরব।

হ্যাঁ। তোমার বাইকে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে বাস ধরার ঝামেলা করতে হবে না। নতুন চাকরি, আমি এখন পর্যন্ত একদিনও লেট করিনি।

ও তাই বলো। কিন্তু তুমি বাইকে বসবে?

আপত্তি আছে?

তা নয় তোমার শরীর পারমিট করবে তো?

আচমকা রত্নার মুখে রক্ত জমল, নানা। সেসব অনেক দেরি আছে।
 
রত্নার বাবা বাজার নিয়ে ভেতরে চলে গিয়েছিলেন। রত্না দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে গলা তুলল, বাবা, ওগুলো যে অবস্থায় আছে তাই থাক, শুধু মঙ্গলাকে বল মাছটাকে কেটে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে।

গৌরব বলল, নতুন স্কুল কেমন লাগছে?

ভালো। তাছাড়া ওখানে আমাদের–। রত্নার কথা শেষ হলো না আগেই দরজায় দাঁড়িয়ে ওর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, গৌরব, চা খাবে?

না মেসোমশাই।

আরে বানিয়ে দিতে আমার চার মিনিট লাগবে।

রত্না বলল, বাবা চা খুব বানাতে ভালবাসে। নিজেরও খাওয়া হয়ে যায় ওই ফাঁকে। আর শুনলে তো, চার মিনিট সময়ের ওই হিসাবটা যে কি করে করে!

গৌরব মাথা নাড়ল, না মেসোমশাই। আমি আর রত্না এখনই বেরিয়ে যাব।

তাহলে থাক। তুমি একদিন সময় নিয়ে এসো। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলেন।

গৌরব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, টুলু কি যোগাযোগ করেছিল এর মধ্যে?

রত্না বলল, কেন? তার তো কিছু করার নেই।

রত্নার বাবা বললেন, হয়তো করবে বলে ভাবছে কিন্তু মা বাবার জন্যে সাহস পাচ্ছে না

। রত্না মাথা নাড়ল, ওই সুবোধ বালকটাকে বাদ দিয়ে অন্য কথা বলো।

রত্নার বাবা গৌরবকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল?

গৌরব মাথা নাড়ল, না মেসোমশাই।

হঠাৎ রত্না শক্ত গলায় বলল, গৌরব। আমি মনে করি না তোমার আত্মীয়টি আমার স্বামী। বিয়ের সবকটা স্মারক চিহ্ন আমার শরীর থেকে খুলে ফেলেছি। নাউ আই অ্যাম এ সিঙ্গল লেডি। বিধবা বললে ওই লোকটিকে বেশি সম্মান দেখানো হয়। গৌরব যদি তুমি গল্প করতে চাও করো আমার দেরি হয়ে গেছে, আর অপেক্ষা করতে পারব না।

মেসোমশাইকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গৌরব রাস্তায় নামল। মোটরবাইকের দিকে যাওয়ার সময় সে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ এত খেপে গেলে কেন?

এই এক কথা আর ভালো লাগে না গৌরব। বাবাকে আমি চিনি। যখন ওখানে আমি অত্যাচারিত হচ্ছিলাম তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। আবার এখন মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ স্বামী ছাড়া অন্ধকার। যে নোংরা জীবন আমি পেরিয়ে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। যে লোকটা আমার স্বামী হয়েও নীরবে সেই নোংরামিটাকে সমর্থন করছিল তার মুখদর্শনের কোনো বাসনা আমার নেই। জানি আমাকে নিয়ে এবার গল্প তৈরি হবে কিন্তু আমি আর মানতে বাধ্য নই।

মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে গৌরব বলল, সাবধানে উঠে বসো।

পেছনের সিটে বসে নিজেকে সামলে নিয়ে রত্না জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তোমার মতলবটা কী বলো তো? আমেরিকায় এতকাল থেকেও তুমি কি আবার পুনর্মিলনের বাণী শোনাতে এসেছ?

গলি থেকে বেরিয়ে গৌরব প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, কোন দিকে যাব?

ডান দিকে।

বাইক ঘুরিয়ে গৌরব এবার জবাব দিল, আমেরিকায় থাকলেই যে মানুষের বোধবুদ্ধি ধারালো হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে কোনো বাণী শোনাতে আসি নি। তাহলে সেদিন টুলুদের বাড়িতে তোমাকে সাহায্য করতে যেতাম না।

আই অ্যাম সরি গৌরব। রত্নার গলাটা খাদে নেমে এল, আসলে সবাই আমাকে এমন জ্ঞান দিচ্ছে আজকাল! মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল।

ওটা করো না। আমি বিশ্বাস করি ইকনমিকাল ইন্ডিপেন্ডেস থাকলে যে কোনো মেয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু যা করবে ঠাণ্ডা মাথায় করো।
 
রত্নার নির্দেশ অনুযায়ী বাইক চালিয়ে ওর স্কুলের সামনে পৌঁছে গেল গৌরব। রত্না ঘড়ি দেখল, ইস। আর মাত্র তিন মিনিট আছে। থ্যাঙ্কু গৌরব।

ওঃ। চাকরি করছ বটে। গৌরব ঠাট্টা করল।

না হলে। চাকরি চলে গেলে কী হবে ভেবেছ? এর ওপর যতি আজ আসবে না বলে গেছে। এর ক্লাসগুলোর কিছুটা আমাকে সামলাতে হবে। চলি। একদিন বিকেলে এসো।

যতি? কোনো মেয়ের নাম যতি হয়? খুব সাধারণ গলায় প্রশ্নটা করেছিল গৌরব।

কিন্তু রত্না ঠোঁট কামড়াল। ওর মুখটা কেমন হয়ে গেল। গৌরবের মনে হলো কিছু লুকোতে চাইছে রত্না। সে বাইক থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না।

কেন কী ব্যাপার?

কী করে তোমাকে বলি? ও যে তোমাকে বলতে নিষেধ করেছে।

কে?

রত্না জবাব দিলো না। কিন্তু ঘড়ি দেখল। হঠাৎ মাথায় চমকে উঠল যেন। গৌরব খুব উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, যতি কি জয়তী?

রত্না ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমার ঘটনাটা ওকে বলেছিলাম। আমরা কলেজেই তোমাদের কথাটা আবছা জানতাম। স্কুলে এসে পুরোটা। আসলে এই চাকরি জয়তীর জন্যেই হয়েছে। ওর নিষেধ ছিল তোমাকে ওর কথা বলতে।

কেন? তুমি জানো না কীভাবে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি।

আমাকে কোনো কারণ বলেনি। চলি গৌরব।

দাঁড়াও একটু। ও কোথায় থাকে এখন?

ভবানীপুরে। সাতাশের ডি রমানাথ মল্লিক স্ট্রিটে। রত্না আর দাঁড়াল না। গৌরব খানিকক্ষণ চুপচাপ রইল। স্কুলের ছাত্রীরা যাওয়ার পথে তাকে দেখছে। জয়তী তার আসার খবর পেয়েও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে কেন?

.

বুকের ভেতর প্রচণ্ড অস্বস্তি, গৌরব বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। যে তার সঙ্গে দেখা করতে চায় না তার সামনে যেচে দাঁড়ানো উচিত হবে কি? নাকি সে রত্নার সঙ্গে আরও কথা বলবে। রত্না নিশ্চয়ই তার ও জয়তীর ব্যাপারে আরও খবর দিতে পারে। জয়তী যদি অন্য কাউকে ভালবাসে এই অবধি ভাবতেই গৌরব অজান্তেই মাথা নাড়ল। না, সে বিশ্বাস করে না এমন ঘটনা। কিন্তু রত্নার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে আর ধৈর্য রাখতে পারছিল না গৌরব। আজ যখন জয়তী স্কুলে আসছে না তখন বাড়িতে পাওয়া স্বাভাবিক। বাইক ঘোরাল সে। জয়তী শুধু বাড়ি পাল্টায়নি, স্কুলও বদলেছে। এসব কি শুধু তাকেই এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে। কলকাতার রাস্তায় মোটরবাইক চালাতে গেলে যে সতর্কতা দরকার এখন সেটা গৌরবের ছিল না। ফলে দুবার অন্য গাড়ির ড্রাইভারদের কাছে বকুনি শুনতে হলো। একবার তো শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষে অবশ্যম্ভাবী অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে গেল সে। ভবানীপুরের রমানাথ মল্লিক লেন খুব বিখ্যাত রাস্তা নয়। বারো বছরে কলকাতার অনেক রাস্তার নাম পাল্টেছে। কিন্তু খোঁজ করে নির্দিষ্ট রাস্তার সঠিক বাড়িটির সামনে উপস্থিত হয়ে গেল গৌরব। বাইক থেকে নেমে সে বাড়িটাকে দেখল। দোতলা পুরোন ধাঁচের বাড়ি। দরজার গোড়ায় বাচ্চারা খেলছে। দরজাটা বন্ধ।
 
গৌরব দুবার কড়া নাড়ার পর সেটা খুলল। মাসীমাকে চিনতে কোনো অসুবিধে নেই। বারো বছরেও মহিলা একই রকম আছেন। এমন কি মাথার কোথাও সাদা চুল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ঝুঁকে প্রণাম করার মুহূর্তে তিনি চিনতে পারলেন, আরে! গৌরব? তুমি? তুমি কবে এলে বিদেশ থেকে?

গৌরব হাসল, কয়েক সপ্তাহ। এসে অবধি আমি আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। এই নতুন বাড়ির ঠিকানাটা জানতাম না। আজ রত্নার মুখে জানতে পারলাম।

ওমা! তোমাকে জয়তী লেখেনি বাড়ি বদলের কথা? মাসীমার ঘোর যেন তখনও ভাঙছিল না।

হয়তো লিখেছিল। কিন্তু সে-চিঠি আমি পাই নি।

এসো ভেতরে এসো। দেখলে কাণ্ড, রাস্তায় দাঁড় রেখেছি। দরজা বন্ধ করে প্রথম যে ঘরটায় তিনি প্যাসেজ থেকে উঠলেন সেটি সাদামাঠা। গৌরবকে ঘর দেখিয়ে বললেন,

ওই বাড়ির ভাড়া আর টানা যাচ্ছিল না। এটা একটু সস্তায় পাওয়া গেল। নিচে একটা আর ওপরে দুটো ঘর। তাও জয়তীর একার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ছোটটা চাকরি পেয়ে গেল।

আরে! প্রণতি চাকরি করছে? গৌরব সত্যি অবাক হলো। বিদেশে যাওয়ার আগে সে কয়েকবার প্রণতিকে দেখেছে। গোলগাল, শান্ত। স্মার্টনেসের খুবই খামতি ছিল ওর মধ্যে। সেই মেয়ে চাকরি করছে?

মাসীমা বললেন, ওকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে না। একদম মেমসাহেব হয়ে গেছে।

আপনি কেমন আছেন? জয়তীর কথা মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ হলো গৌরবের।

আমার আর থাকা। উনি বলতেন লোকের ছেলে থাকতে যা করে তোমার মেয়েরা তাই করবে। করছেও। কিন্তু গৌরব, এভাবে ওরা করুক তা আমি কখনও চাই নি। নিজেদের সাধ-আহ্লাদ না মিটিয়ে এই সংসারের বোঝা টেনে যাবে কতকাল। ছেড়ে দাও এসব কথা। তুমি কেমন আছ? বিয়ে করেছ?

শেষ প্রশ্নটিতে চমকে উঠল গৌরব। কখনও প্রকাশ্যে আলোচনা হয়নি কিন্তু মাসীমা যে তাদের সম্পর্কের কথা জানেন না তা নয়। তাহলে? সে মাথা নাড়ল, এখনও সময় পাইনি।

তবে যে শুনলাম তুমি আর এদেশে ফিরবে না। বিয়ে করে ওদেশেই থাকবে।

এই গল্প কে করল আপনার কাছে?

তা মনে নেই বাবা। তুমি তো আর আজ যাওনি আমেরিকায়। তোমার মা-বউদি?

ভালো আছেন। শুনলাম জয়তী যেত আগে, ইদানীং যায় না।

ও। বলেই সম্ভবত খেয়াল হলো, দাঁড়াও জয়তীকে ডাকি।

ও কোথায়?

ছাদে গিয়েছে কাপড় মেলতে। আজ তো স্কুলে যায়নি। আজ দুপুরে– তুমি যাও না ওপরে। জয়তীর মা তাকে পথটা দেখিয়ে দিলেন। বাড়িটা বেশ পুরনো কিন্তু পরিচ্ছন্ন। গৌরব একা ওপরে উঠে এল। নিশ্চয়ই আরও ভাড়াটে রয়েছে কিন্তু এদিকটা বোধহয় একহারা। দোতলার দুটো ঘরের সামনে দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। গৌরব ছাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ভাড়াটে অনুযায়ী সম্ভবত ছাদ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো তার ঝুলছে। ভেজা শাড়ির দেওয়াল তৈরি হয়েছে তা থেকে। একটু এগিয়ে গেল গৌরব। এবং জয়তীকে দেখতে পেল। ওর দিকে পেছন ফিরে কাঁচা শাড়ির প্রান্ত তারের বুকে ছুঁড়ে দিলো। বারো বছরে খুব একটা পাল্টায়নি জয়তী। শুধু বয়সের কারণে শরীরে খানিকটা ভার জমেছে। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল গৌরবের। এই মেয়ে যার জন্যে প্রতিটি দিন মনে মনে ভেবেছে সে আর একা নয়। এই মেয়ে যে তার ভালবাসা দিয়ে সমস্ত পতনের হাত থেকে রক্ষা করে এসেছে। গৌরব ছাদের থেকে নড়ছিল না। অন্যমনে কাপড় মেলে জয়তী ঘুরে দাঁড়িয়েই যেন বরফ হয়ে গেল। তার চোখের পলক পড়ছে না, ঠোঁট ঈষৎ বিস্ফারিত। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল জয়তী। তারপর অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুমি?

এলাম। শব্দটা উচ্চারণ করে যেন হালকা হলো গৌরব।
 
জয়তী কয়েক পা এগিয়ে এল। তার চোখ গৌরবের মুখ থেকে সরছিল না। গৌরব দেখল অজ্ঞাত জয়তী যেন একটু বেশি রুক্ষতা এনে ফেলেছে মুখে শরীরে। জয়তী এই সময় জিজ্ঞাসা করল, তারপর? কেমন আছ? কী উত্তর দেবে গৌরব? ভালো? সে কি সত্যি ভালো ছিল।

আর সে যে ভালো ছিল তা জেনে জয়তী কি সুখী হবে? নাকি বলবে ভালো নেই। ব্যাপারটা কি ন্যাকা লাগবে না? একথা বলে জয়তীর করুণা কুড়োবার চেষ্টা করা হবে না? সে বদলে বলল, তুমি?

এটা আমার প্রশ্নের জবাব হলো না। তুমি যেমন আছ আমি তেমনি আছি।

গৌরবের কথা শেষ হতেই আচমকা কেঁপে উঠল জয়তী। গৌরব সেটা লক্ষ্য করে কাছে এগিয়ে যেতেই ওর মাথা নেমে আসছিল। একহাতে জয়তীর পিঠ জড়িয়ে ধরতেই সে মাথা রাখল গৌরবের কাঁধে। কয়েক মুহূর্তে, যেন অনন্তকাল শব্দমালায় অনেক কথা বলে গেল। তারপরেই চাপা ফোঁপানির শব্দ কানে এল গৌরবের। আর তখনই সে সতর্ক হলো। ভবানীপুরের এমন খোলা ছাদের নাটক দেখতে আশেপাশের অনেক ছাদের মানুষ এখন তৎপর। সে কোনোরকমে বলতে পারল, জয়তী। বি স্টেডি!

শুধু এটুকুতেই কাজ হলো। চট করে মুখ তুলে চোখের তলা আঙুলের ডগায় মুছে নিয়ে জয়তী বলল, সত্যি বুঝতে পারিনি। আমি দুঃখিত।

গৌরব বলল, আমার জন্যে নয়। আশেপাশের ছাদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছি আমি।

হঠাৎ ওপরে চলে এলে কী করে? জয়তী যেন কথা ঘোরাতে চাইল।

তোমার মা পাঠিয়ে দিলেন।

প্রণতির সঙ্গে দেখা হয়নি?

না। শুনলাম ও অফিস করছে।

হ্যাঁ। কিন্তু আজ অফিসে যায়নি।

ও। দুই বোনেই যাওনি বলো।

তুমি? জয়তীর মুখে সন্দেহ ফুটল, রত্নার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ। ও বলতে চায়নি। কিন্তু আমি একটা কথা জানতে চাই, তুমি কেন আমার কাছে নিজেকে এমন ভাবে গোপন করতে চেয়েছ?

গোপন? মানুষ অপমানিত হলে হয় আঘাত করে নয় নীরবে সরে যায়। আমি দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি। আমার কি সেই স্বাধীনতাটুকুও নেই?

জয়তী এবার গম্ভীর।

আমি তোমাকে অপমান করেছি? বিস্ময় সোচ্চারিত হলে গৌরবের গলায়।

যাক এসব কথা। বাড়িতে এসেছ যখন তখন তোমাকে আর রূঢ় কথা শোনাতে চাই না। নিচে চলো। অসময়ে এসেছ, চা দিলে খাবে? গৌরবের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রাখল জয়তী।

গৌরব প্রায় আর্তগলায় জিজ্ঞাসা করল, আমি এবাড়িতে আসি তা তুমি চাওনি?

এসে পড়ার পর এমন প্রশ্নের কী দরকার?

তবু, তবু তুমি উত্তর দাও।

স্থির চোখে তাকিয়ে জয়তী উত্তর দিলো, না।

অজান্তেই শব্দটা ছিটকে এল গৌরবের ঠোঁট থেকে, কেন? গৌরব এগিয়ে এল সিঁড়ির মুখে।

আমি তোমাকে সুখী দেখতে চেয়েছি গৌরব। আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তুমি সুখী হবে না।

এটা তোমার ধারণা।

আমার ধারণা মিথ্যে নয়। হ্যাঁ আমি ইচ্ছে করে বাড়ি পাল্টানোর খবর জানাইনি তোমায়। না, তোমার জন্যে বাড়ি পাল্টাইনি। বাবা চলে যাওয়ার পর আগের স্কুলের টাকায় ওই বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু যখন বাড়ি পাল্টানোই হলো তখন মনে হলো এবার তোমাকে মুক্তি দেওয়া যাক। জয়তী হাসবার চেষ্টা করল।

আমার অপরাধ?

অপরাধের শাস্তি কি মুক্তি? তোমাকে শেষ চিঠি যেটা দিয়েছিলাম সেটা পাওনি?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top