What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (4 Viewers)

ছোট বউদি ঘরে ঢুকে গৌরবের সামনে একটা চায়ের কাপ আর প্যাস্ট্রি সমেত ডিশ এগিয়ে ধরলেন, আমেরিকায় থেকে সময়টা রাখতে শেখা উচিত ছিল। আমি চা বানিয়ে বসে আছি আর–। হ্যাঁ, ও এসে গেছে। তাড়াতাড়ি নিচে আসা হোক।

গৌরব বলল, কি ব্যাপার, এত চা খাবে কে? তার চেয়ে ছোটদাকেও এখানে ডাক, সবাই মিলে খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

ছোট বউদি বললেন, না ভাই, সে নিচে চা খাচ্ছে। একটু বাদেই আমরা বের হব। এসো কিন্তু।

ছোট বউদি চলে গেলে ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। শেষ পর্যন্ত গৌরব কথা বলার চেষ্টা করল, একেই বলে কম্যুনিকেশন গ্যাপ। আমি ওদের বলে আসিনি চা খাব না। দোষ আমার। ঠিক আছে, তিন কাপ চা আমরা তিনজনেই খাই। পিসীমা, তুমি বড় বউদিরটা নাও, পিসেমশাইকে ছোট বউদির চা আর আমি পিসীমার। দুটো কাপ দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। পিসেমশাই খুশি হলেন। এই সময় বোধহয় পিসীমা তাকে চা দিতেন না। বাড়তি পাওয়াটুকু বেশ উপভোগ করতে করতে তিনি বললেন, আমার একবার সৌরভের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি শুধু পেন্সন আনার দিন বাইরে যাই। দেখি। তাকে বলো, কিছু মনে না করতে।

পিসেমশাই যে কথাটা বলতে পারছে না সেটা স্পষ্ট হোক গৌরব চাইল না। তিনশো টাকার জন্যে কোনো সম্পর্ক যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা নষ্ট হওয়াই উচিত।

পিসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, কদিন থাকবি?

গৌরব হাসল, ইচ্ছে আছে একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে এখানে থেকে যাই। না জুটলে ফিরে যেতে হবে। ছুটি আছে তেরো সপ্তাহের।

পিসেমশাইম আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, কত মাইনে পাও ওখানে?

গৌরব জবাব দিলো, বছরে ষাট হাজার ডলার।

পিসেমশাই বিড়বিড় করলেন, তার মানে মাসে পাঁচ হাজার। এক ডলার বারো টাকা। ওরে বাব্বা, মাসে ষাট হাজার টাকা মাইনে? কী বলছ কী?

না পিসেমশাই, ডলারকে টাকায় ট্রান্সফার করবেন না। ওরা মাইনে দিচ্ছে ওখানে খরচ করার জন্যে। ওখানে এক ডলার মানে একটাকাই।

আমি ভাবতে পারছি না। এত টাকা। উফ। চোখ বড় হয়ে গেল পিসেমশাই-এর।

তা কবে বিয়ে করবি? নাকি করে ফেলেছিস? পিসিমা অন্তরঙ্গ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

ফেললে তো বাড়িতে একটা কার্ড আসত, তাই না?

গোপনে গোপনে কোনো মেমসাহেবকে ঘরে আনিসনি তো?

সে ভাগ্য হলো না আমার। বিয়ে করলে আমি দেশের মেয়েকেই করব।

করবি? তাহলে আমি সম্বন্ধ দেখি।

এই সময় পিসীমাকে থামিয়ে দিলেন পিসেমশাই, থাম তো। তুমি যেসব চেন তাদের বাপ দুআড়াই হাজার মাইনে পায়। ষাট হাজারি ছেলের যোগ্য মেয়ের সঙ্গে তোমার আর এ জন্মে আলাপ হবে না।

গৌরব মাথা নাড়ল, না পিসীমা, পিসেমশাই ঠিক বললেন না। বিমর্ষ পিসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গৌরব বলল, ছেলেবেলায় যাঁর বুকের দুধ খেয়েছি তিনি নিশ্চয়ই আমার জন্যে ভালো কাজ করবেন। হাজারের ব্যাপারটা কোনো বাধাই নয়। যখন সময় হবে তখন ঠিক বলব তোমাকে। গৌরব উঠে দাঁড়াল।

পিসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, চলে যাচ্ছিস?

না, নিচে এল গৌরব। বড়দার ঘরে সে ঢুকল প্রথমে। খাটের ওপর বইপত্র নিয়ে পড়তে বসেছে রাজা। বড়দা খালি গায়ে লুঙি পরে তার পড়া দেখছেন। বড় বউদি এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় তরকারি নিয়ে বসেছেন। তাকে দেখে বললেন, শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেলে? এসো। গৌরব দেখল ছোট ঘরটা জিনিসপত্র ঠাসা। একটুও নড়বার উপায় নেই। আর আসবাব যা আছে তা আদ্যিকালের পুরনো। বড়দা একপাশে সরে ওকে খাটে বসার জায়গা করে দিলেন। স্বভাবতই রাজার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটল। গৌরব বলল, আমি আসার জন্যে ওর পড়ায় ডিস্টার্ব হলো।
 
বড় বউদি বললেন, না না, আমাদের ঘরের ছেলেকে তো এইভাবেই বড় হতে হবে।

গৌরব বলল, কিন্তু এত ছোট জায়গায় তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে না?

বড় বউদি বললেন, হচ্ছে। ওপাশের ঘরে জিনিসপত্র আছে, তোমার দাদা ওখানেই শোয়। ছেলে আবার ওই ঘরে গিয়ে পড়বে না।

কেন?

বড্ড স্যাঁতসেতে। বহুদিন তো হোয়াইট ওয়াশ করা হয় নি। বড়দা বললেন, পৈতৃকবাড়ি, ছেড়ে কোথাও যাব তার উপায় নেই। আমাদের অফিস কো-অপারেটিভ থেকে গড়িয়ায় জমি দিচ্ছে খুব সস্তায়। আড়াই কাঠা কিনে রেখেছিলাম। বাড়ি করতে গেলে যে টাকা দরকার তা পাব কোথায়? বাবা-মা যদ্দিন আছেন তদ্দিন এই করেই থাকতে হবে। বড়দার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ঝুপ করে আলো নিভে গেল। চারপাশ থেকে একটা হতাশজনক শব্দ উচ্চারিত হলো। আর সবচেয়ে খুশি হলো রাজা। সে বইপত্র রেখে চিৎকার করে উঠল, আমি কিন্তু হ্যারিকেনের আলোয় পড়ব না।

বড়দা বললেন, হ্যারিকেন জ্বালো।

বড় বউদি ঝটপট খাটের তলা থেকে হ্যারিকেন এনে সেটাকে জ্বালতেই গৌরব বলল, তোমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ না?

বড়দা হাসলেন, আমি কিন্তু অন্ধকারে ভালো শুনতেও পাই না। এই সময় বাইরে কাশি শব্দ হলো। তারপরেই ছোটদাদার, গলা, গোরা আছিস।

হ্যাঁ, বলো। গৌরব উত্তর দিলো।

আয়, তোর সঙ্গে কথাই হচ্ছে না।

যাচ্ছি। যা অন্ধকার।

আমার ঘরে আলো আছে। ইনভার্টার। চলে আয়। হাওয়াও পাবি।

বড় বউদি উদাস মুখে বললেন, যাও ভাই, এই গরমে তো মিছিমিছি পচবে। ইনভার্টারের হাওয়া খেয়ে এস। আর কদিন পরেই তো তিনলাখ টাকার ফ্ল্যাটে উঠে যাবে।

গৌরব বলল, না বউদি, বেশ দেরি হয়েছে। ওদের সঙ্গে কথা সেরেই যেতে হবে।

বড়দা বললেন, আর একদিন আসিস।

গৌরব বলল, নিশ্চয়ই।

একই ধরনের ঘর। কিন্তু ঢুকলেই বোঝা যায় রুচি এবং পয়সা আছে। লোডশেডিং-এর তোয়াক্কা না করে ফ্যান-আলো জ্বলছে ইনভার্টারে। ছোটদা বললেন, বাঃ, চমৎকার চেহারা হয়েছে তোর। আয় বোস। চা খাবি আর একবার?

গৌরব মাথা নাড়ল, না। তোমরা তো বেরুচ্ছো।

ছোট বউদি বললেন, হ্যাঁ। নেমন্তন্ন করেছি একজনকে। আমাদের খাইয়েছিল তা তাকে তো পালটা খাওয়ানো উচিত। তাই হোটেলে যাছি।

হোটেলে কেন? এখানে ডাকলে না কেন?

ছোট বউদি বললেন, এখানে? এই ছোট ঘরে ভারি লজ্জা করে।

ছোটদা বললেন, পৈতৃক বাড়ি, ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে হয় না। একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি কিন্তু অত টাকা পাব কোথায়? দাদাও শুনলাম গড়িয়ায় জমি কিনেছে। বাবা মা বেঁচে থাকতে কিছু হবে না।

ছোট বউদি বললেন, ছেড়ে দাও এসব কথা। বিদেশ থেকে কী আনলে? সেন্ট, সাবান, না ইলেকট্রনিক্স!

ছোটদা বললেন, ওর বিদেশি জিনিসের খুব শখ। ওর এক মাসতুতো দাদা থাকে জার্মানিতে, মাঝে মাঝে এনে দেয়।

গৌরব হাসল, কিছুই আনা হয়নি এবার। আচ্ছা দাদা, আজ চলি, যাওয়ার আগে একদিন দেখা করে যাব।

ছোট বউদি বললেন, তুমি সেদিন আমার এই ছোট ঘরে বসে খাবে কিন্তু।

দেখা যাবে। হাসল গৌরব। তারপর আলো ঝলমল থেকে বেরিয়ে প্যাসেজটায় এসে দাঁড়াল। পুরো বাড়িটা অন্ধকারে ডুবে আছে। একবার পিসীমাদের সঙ্গে কথা বলে যাওয়া দরকার।

সে অন্ধকারে সন্তর্পণে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। ওপরে উঠেই সে থমকে দাঁড়াল। একটা চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে। কান্নাটা মহিলার গলায়। খুব সাবধানে পা ফেলে সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা আধা ভেজানো। কান্নাটা আসছে ভেতর থেকেই, পিসীমার গলায়।
 
হঠাৎ পিসেমশাই খেঁকিয়ে উঠলেন, কেন আর কাঁদছ। কপালে যা আছে, তা মানতেই হবে। তখন থেকে বলছি হ্যারিকেন জ্বালো সেটা শুনতে পাচ্ছ?

পিসীমার কান্না বন্ধ হলো কিন্তু উত্তর এল না।

পিসেমশাই আবার বললেন, আলো জ্বালো আলো জ্বালো, আমার দম অন্ধকারে বন্ধ হয়ে আসছে।

পিসীমা কাতর গলায় বললেন, তিনদিন ঘর ছেড়ে বের হওনি।

তাতে কী হয়েছে?

ঘরে যে একফোঁটা কেরোসিন নেই, আলো কী দিয়ে জ্বালব!

গৌরব পা টিপে টিপে নিচে নেমে এল। ওই নিঃসঙ্গ দুটি মানুষকে নতুন করে লজ্জিত করতে চাইল না সে। প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরের আকাশের তলায় দাঁড়াল সে। এই মুহূর্তে সে উপকার করতে পারে কিন্তু বাকি জীবন পিসীমারা কী নিয়ে থাকবেন তাহলে?

.

বারো বছরে একটা শহরের চেহারা কতটা আর পাল্টাতে পারে? কিন্তু গৌরবের মনে হচ্ছিল এই শহরের মানুষ তার জায়গার মতো বেশ পাল্টে গেছে। একটা পাতাল রেল প্রকল্প নিশ্চয়ই সাময়িক কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যে জায়গায় যে পরিচিত দোকান ছিল তা হয়তো রাস্তা বাড়াবার কারণে নেই কিন্তু তার বেশি কি চোখে ঠেকবে? কিন্তু এই ঘিঞ্জি শহরটায় লক্ষ লক্ষ মানুষ থাকা সত্ত্বেও একটা নিজস্ব আরামবোধ ছিল। সেটাই যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে বড়লোকদের পাড়া বলতে ছিল আলিপুর, নিউ আলিপুর আর অভিজাত এলাকা বালিগঞ্জ। এখন নিও অতিবড়লোক পাড়া তৈরি হয়ে গেছে, সল্টলেক। এই ঘিঞ্জি শহরের নাকের ডগায় কিছু মানুষ আপাতস্বস্তিতে বাস করার জন্য বিরাট এলাকা তৈরি করে নিয়েছে যা অনেকের কাছেই স্বপ্নের বিষয় হবে। দক্ষিণের শেষপ্রান্তে মধ্য উচ্চবিত্তদের জন্যে যে গলফ গ্রীন এলাকা তৈরি সেখানেই কি শেষপর্যন্ত কলকাতার ফুসফুস বাঁচবে? এসব তো ভৌগোলিক বিস্তৃতি। এই বিস্তৃতির উল্টো ক্রিয়া ঘটেছে মানুষের ক্ষেত্রে। মানুষের মনের পরিধি যেন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। নিজস্ব সত্তা, নিজস্ব পরিবারের বাইরে কেউ কিছু ভাবতে রাজি নয়। সেই সঙ্গে বহন করে আসছে অতীতের যা কিছু খারাপ সংস্কার, প্রথা এবং মধ্যযুগীয় ধারণা। আর তার পাশেই তৈরি হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষের প্রজন্ম এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার আর একটা শ্রেণী যাদের মধ্যে কোনো বোধ কাজ করে না। শিক্ষা-দীক্ষার প্রশ্নই নেই, একটা হিংস্র কঠোর অথচ দিকশূন্য জীবন নিয়ে, সেই প্রজন্ম বেড়ে চলেছে। এই পরিবর্তনটা বড্ড চোখে পড়ে। অথচ এই নিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না।

বাড়িতে আপাতত শান্তি। যদিও বউদির সঙ্গে মায়ের একটা অদৃশ্য ফাঁক থেকেই গেছে। দাদা অনেকটা স্বাভাবিক। বেচারা মা অথবা স্ত্রী কাউকেই নিজের মতো করে বোঝাতে পারছে না, ক্রমশ পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের দিন যে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে দাদাকে দেখে।

বনিকে বাইকে নিয়ে বেরিয়েছিল গৌরব। মেয়েটা তার খুব ন্যাওটা হয়েছে। ওর মানসিকতায় বাঙালীয়ানা বেশি কিন্তু বউদি ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে জোর করে ঠেলে দিয়ে চাইছেন সেগুলোকে বর্জন করাতে। গৌরব আসার পর মেয়েটা যেন স্বস্তি পেয়েছে। ইদানীং ওর মোটরবাইকে চড়ে বেড়াতে ভালবাসে সে।

বাড়ির সামনে বাইকটা স্টার্ট করার মুখেই একটা গাড়ি চলে যেতে যেতে আচমকা ব্রেক কষল। গৌরব তাকিয়ে দেখতেই চোখাচোখি হলো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, আরে সন্দীপ না? কী খবর?
 
সন্দীপ তখন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। তারও মুখে বিস্ময় এবং আনন্দ, নাঃ শালা! তোর চেহারা কি হয়েছে রে? কবছরে এতটা বদলে গেছিস? আমেরিকার চালে ভাত বোধহয় অন্যরকম হয়, না?

বনিকে বাইকটা ধরতে ইশারা করে গৌরব কাছে এগিয়ে এল, খুব পাল্টে গেছে চেহারা? কি জানি। কেমন আছিস বল?

ফার্স্ট ক্লাস। কবে এলি? জানালি না পর্যন্ত।

আরে এসেছি কিছুদিন। আর তারপর থেকে নানা ঝামেলায়–।

ওহো আয় তোর সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।

সন্দীপ সামান্য ঝুঁকে গাড়িতে বসে থাকা একজন যুবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই তোমাকে গৌরবের নাম বলেছিলাম মনে আছে? এই সেই গৌরব। আমার–। শেষটায় সে ইশারায় গৌরবকে বোঝাল। গৌরব হাতজোড় করতে ভদ্রমহিলা বললেন, আপনার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি। আসুন না একদিন আমাদের বাড়িতে।

যাব। নিশ্চয়ই যাব। গৌরব আন্তরিকভাবে বলল।

সন্দীপ বলল, কথার কথা নয় কিন্তু। হোয়াট অ্যাবাউট ইউ। বিয়ে থা করেছিস? আমি তো কিছুই জানি না।

সময় পাইনি। ঠিক আছে যাব, নিশ্চয়ই যাব।

সন্দীপরা বারংবার কথা আদায় করে যখন চলে যাচ্ছে তখন গৌরব জিজ্ঞাসা করল চললি কোথায়?

স্টেশানে। আজ আমাদের জীবনের খুব অন্যতম দিন। আমার দাদু মোর দ্যান এইটটি। ছেলেবেলায় আমার তাঁর কাছেই কেটেছে। অনেক বলেছি, এতকাল কিন্তু কিছুতেই গ্রাম থেকে নড়তে চান নি। শেষপর্যন্ত বরফ গলেছে। আজ আসছেন কিছুদিন আমার কাছে থাকতে। সন্দীপ জানাল। জানিয়ে চলে গেল।

বাইকে বসামাত্র গৌরবকে বনি জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধু?

হ্যাঁরে। একসময় আমার খুব বন্ধু ছিলাম।

এখন?

এখনও আছি তবে অনেকদিন পরে দেখা হলে সেটা প্রথমেই বোঝা যায় না।

আচ্ছা কাকু, তোমার সেই বন্ধু, যাঁর খোঁজে আমরা একদিন গিয়েছিলাম, ওই যে যারা বাড়ি পাল্টেছে অথচ ঠিকানা রেখে যায় নি বলে তুমি ঠাকুমাকে বলেছিলে, তার খোঁজ পেয়েছ? বনি জিজ্ঞাসা করল।

গৌরব ঠোঁট কামড়াল। আশ্চর্য ব্যাপার। জয়তীকে কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছে না সে। যে বাড়িতে ছিল সেটা পাল্টেছে ওরা। কোথায় গেছে কেউ জানাতে পারছে না। পুরনো বন্ধু-বান্ধবরা কেউ ওর খবর রাখে না। কোথায় গেল মেয়েটা। স্কুলে কাজ করত জয়তী। কিন্তু কোন্ স্কুল তা জানে না গৌরব। এই শহর এমন যে কেউ ইচ্ছে করলে চিরকাল জনতার আড়ালে থেকে যেতে পারে। কিন্তু জয়তীকে খুঁজে বের করতেই হবে। ও যখন কলকাতা থেমে আমেরিকায় গিয়েছিল পড়াশোনা করতে তখন যে জয়তীকে রেখে গিয়েছিল সেই জয়তীর মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। প্রথমদিকে নিয়মিত চিঠি যেত আসত। যখন গৌরবের মাসিক রোজগার হাজার ডলারে পৌঁছলো তখনই সে চেয়েছিল জয়তী সব ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসুক। প্রেমের পরিণতি সার্থক হোক বিবাহে। কিন্তু সেখানেই লাগল বিরোধ। জয়তী জানিয়েছিল ব্যক্তিগত সুখের জন্যে সে সংসারের অন্য সবাইকে বঞ্চিত করতে পারবে না। ওর বাবা অসুস্থ, ওকে চাকরি নিতে হয়েছে। এখন তার চলে যাওয়া সম্ভব নয়। গৌরব লিখেছিল, যদি টাকাই বড় কথা হয় তাহলে সে নিয়মিত আমেরিকা থেকে টাকা পাঠাতে পারে। চাই কি জয়তীও সেখানে গিয়ে চাকরি নিয়ে এঁদের সাহায্য করতে পারে। আর যদি কলকাতায় অন্য কোনো আকর্ষণ থাকে তাহলে আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে সরাসরি জানানোই শোভনীয়। তারপর থেকেই জয়তী চুপচাপ হয়ে গেল। গৌরব চিঠি দিয়েছে। একের পর এক, উত্তর পায়নি।
 
ভেবেছিল, বেলেঘাটার ওর এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে গৌরব যে সম্ভবত জয়তীর খবর রাখে বলে কোনো কোনো বন্ধু জানিয়েছে। কিন্তু তার বাড়িতে সে শুনল বন্ধু অফিসের কাজে বাইরে গেছে। আর একটা ব্যাপার বেশ চোখেই পড়ছে। বত্রিশে একদল বন্ধু বেশ সেটলড হয়ে বিয়ে থা করেছে। কিন্তু কেউ কেউ তো এখনও বেকার। প্রথম দলের সঙ্গে মিশলে কোথায় যেন একটা ফাঁক থাকছে, দ্বিতীয় দলের সঙ্গে একটা আড়াল। দুপক্ষের আচরণে সবসময় এটাই বোঝা যাচ্ছে।

বেলেঘাটায় গৌরবের দূরসম্পর্কের এক কাকা থাকতেন। ছেলেবেলায় ওই বাড়িতে বেশ যাতায়াত ছিল। গৌরব স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করে বনিকে নিয়ে পাড়ায় এল। তার একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বাড়িটা খুঁজে বের করতে। দুটো নতুন বাড়ি এলাকার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। সে লক্ষ্য করল একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলে গুলতানি মারছে। বাইকটা থামাতেই একটা সিটি বাজল। একটি কর্কশ গলা গেয়ে উঠল, দিল দিয়া দরদ লিয়া।

একজন প্রবীণ ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন, তাঁকে কাকার নাম বললে তিনি বাড়িটাকে দেখিয়ে দিলেন। গৌরব বাইকটাকে বাড়ির সামনে রেখে দরজায় কড়া নাড়ল। সেই সময় আরও কিছু মন্তব্য ছুটে এল। আর এই সবই যে বনিকে উদ্দেশ করে তা বুঝতে সময় লাগল না। গৌরবের চোয়াল শক্ত হলো, বনির মুখে রক্ত জমল। সেই সময়, ভেতর থেকে চাপা ক্রোধ ভেসে এল, কেন বিরক্ত করছ। আমি তো বলেই দিয়েছি সম্ভব নয়।

অবাক হয়ে গৌরব ডাকল, কাকাবাবু।

এবার দরজা খুলল। একজন বছর ষাটের মানুষ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে। তার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। তিনি একবার গৌরবের, আর একবার বনির দিকে তাকালেন, কাকে চান?

আমাকে চিনতে পারছেন না কাকাবাবু? আমি গৌরব।

সত্যিই চমকে গেলেন ভদ্রলোক, তারপর সেটাকে সামলে নিয়ে বললেন, আরে কী খবর? এসো এসো, হোয়াট এ সারপ্রাইজ! শুনছ, দেখ কে এসেছে।

গৌরব একবার চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে বনিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কাকা দরজা বন্ধ করে দিলেন। এই সময় ভেতর থেকে কাকিমা বেরিয়ে এলেন। বয়স তার শরীরে ছাপ ফেলেছে, ওমা গোরা না? কী চেহারা হয়েছে তোর? রাস্তায় দেখলে তো চিনতেই পারতাম না। কবে এলি?

এইতো কিছুদিন। কেমন আছেন সবাই।

আমি তো খারাপ থাকি না কখনও। এটি কে?

দাদার মেয়ে। বনানী। গৌরব পরিচয় করিয়ে দেওয়া মাত্র বনি দুজনকে প্রণাম করল। কাকিমা ওর চিবুক ধরে বললেন, বাঃ বেশ মিষ্টি হয়েছে তো। সৌরভের মেয়ে এতবড় হয়ে গেছে আমি জানিই না।

কাকাবাবু বললেন, যাতায়াত না থাকলে জানবে কী করে?

গৌরব বলল, হ্যাঁ, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না এখানে এসে, কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না কেন? মাও বললেন অনেককাল আপনাদের খবর উনি পান না। শুধু বিজয়ার সময় চিঠি দেওয়া পাওয়া ছাড়া।
 
কাকাবাবু বললেন, তাও বউদি যতদিন আছেন। আসলে আমাদেরও নানান ঝামেলা। ওদিকে সৌরভের স্ট্যাটাস তার আর এক জীবন–এইসব মিলিয়েই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। যাক, ছেড়ে দাও, তুমি যে এলে এতে ভারি খুশি হয়েছি।

ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হলো। কাকিমা বললেন, তুমি একদম রাগারাগি করবে না। এ পাড়ায় থাকতে হলে এসব সহ্য করতেই হবে।

সহ্য করার একটা সীমা আছে। কাকা বিড়বিড় করলেন। বাইরে থেকে চিৎকার এল, সব কি কানে তুলো দিয়েছেন? খামটা এবার শো করুন।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে কাকাবাবু?

কাকা বললেন, পাড়ার মস্তানরা শেতলাপুজো করবে। আমাকে একশো টাকার চাঁদার স্লিপ ধরিয়েছে। আমি বলছি পারব না। তাই ঝামেলা শুরু হয়েছে।

একশো টাকা চাঁদা? শেতলাপুজোর জন্যে? গৌরব অবাক হয়ে গেল।

দরজার শব্দ বাড়ছিল। কাকা দরজা খুলে একটু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?

সেটা তো আপনি জানেন মেসোমশাই। কেন রেলা করছেন। মালটা ছাড়ুন।

আমি তো তোমাদের বলেছি অত টাকা চাঁদা দিতে পারব না।

আপনি কী বলেছেন সেটা কে শুনবে? আমি যা বলেছি তাই শুনবেন। আমার নাম তিকরি, বেলেঘাটার সব মস্তান আমাকে গুরু বলে এটা নিশ্চয় আপনি জানেন। পাত্তি বের করুন। একটি গলার অনেক রকম হুমকি। এই ভাষা বিদেশে যাওয়ার আগে গৌরব শোনেনি। এটা কি বাংলা?

সে উঠে গিয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তোমরা এসব কি বলছ? প্রথম কথা তোমরা কি পুজো করার আগে ওঁর সম্মতি আছে কিনা জেনেছ? তা যখন জানাওনি তখন উনি যা দেবেন তাই নাও।

একটি কালো রোগা চোয়াড়ে দেখতে লম্বা চুলের ছেলে বলল, আরে এই লম্বুটা আবার কে? কথা হচ্ছে পাড়ার মধ্যে, বেপাড়ার মাল কেন ওভারটেক করছে?

গৌরব একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, যা বলেছি তার জবাব দাও আগে।

জবাব? ছেলেটা হাসল, মোটরবাইকটা হাপিস করে দেব নাকি? চাম্পুকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন বেড়িয়ে যান আমাদের ঘরোয়া কথায় কান দেবেন না। দিন দাদা, মালটা ফেলুন। বহুৎ সময় খরচ হয়ে যাচ্ছে আপনার জন্যে।

গৌরব ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসে খপ করে ছেলেটার কলার ধরে ফেলেছে, কী বললে? চাম্পুকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি। চাম্পু মানে কী বলে?

প্রথমে ছেলেটার চোখে মুখে অসহায় ভঙ্গি ফুটে উঠল। গৌরবের মুঠোয় আটকে ছেলেটা ছটফট করছে। তার বন্ধুরা ঠিক প্রস্তুত না থাকায় কী করবে বুঝতে পারছে না। এর ঝটকা দিয়ে গৌরব ওই ছেলেটিকে দূরে ফেলে দিয়ে বলল, তোমাদের মতো নোংরা ছেলের গায়ে হাত দিতেও ঘেন্না লাগে।

সঙ্গে সঙ্গে একটা ছুরি বেরিয়ে এল ছেলেটির হাতে। মাটি থেকে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, জান্ নিয়ে নেব শালা তোর। ভোগে যাওয়া থেকে কে তোকে বাঁচায় দেখি। সরে যা তোরা। খুনকা বদলা খুন।
 
গৌরব ছেলেটার অস্বাভাবিক ছোরা হাতে দেখে একটু অবাক হলো! এবং তখনই একটা চিৎকার ভেসে এল, তিকরিদা, কালো দল নিয়ে অ্যাকশনে আসছে। তাড়াতাড়ি এস।

সঙ্গে সঙ্গে বাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল তিকরি, কালো! শালা কালোর এত হিম্মত! আমার পাড়ায় অ্যাকশন করতে এসেছে? ঠিক হ্যায়। তোমার হিসেব পরে হবে লম্বু। কালোকে দেখে আমি আবার আসছি।

দলটা দৌড়ে চলে গেল গলি দিয়ে।

গৌরব কাকাকে বলল, এরা কারা কাকা?

আমাদের পাড়ার গার্জেন। কাজটা তুই ভালো করলি না গৌরব।

কেন? ওরা আমাকে মেরে ফেলবে?

ওদের অসাধ্য কিছু নেই। বিবেক, ভদ্রতা, শিক্ষা বলে কিছুই নেই ওদের।

দেখা যাক। গৌরব হাসল, কিন্তু তোমরা এখানে আছ কী করে?

কোথায় যাব? পৈতৃক বাড়ি। কলকাতার যেখানেই যাব সেখানেই বাড়িভাড়া আকাশছোঁয়া। আর সেখানেই যে এরা, মানে এদের মতো আর কোনো দল থাকবে না তার বিশ্বাস নেই। এই রক্তবীজরা হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছে।

ঘরে ঢুকে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, পুলিশকে খবর দিচ্ছ না কেন?

পুলিশ! বলবে, কেন জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করছেন। তাছাড়া পুলিশ দুদিন না হয় এখানে থাকবে। তারপর? আমাকে তো কাজকর্মে বের হতেই হবে তখন কে বাঁচাবে? তাছাড়া খুকি কলেজে যায়, টিউশনি করে।

খুকি? খুকি এত বড় হয়ে গেছে? গৌরব বিস্মিত হলো।

বাঃ হবে না? ওর একুশ হলো। ওকে নিয়েই তো দুশ্চিন্তা। এইসব ছেলের সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করতে হয়ে ওকে।

কাকিমা বললেন, খুকি কিন্তু ওদের ভয় পায় না, যাক তোমরা ভেতরে এস। চা করতে যাচ্ছি আমি। তুমি এসো মা আমার সঙ্গে।

বনিকে নিয়ে কাকিমা চলে গেলে গৌরব বলল, আমি যাওয়ার আগে কলকাতায় মাস্তান ছিল। কিন্তু এত ব্যাপক হারে এবং এই ভাষায় কথা বলার ছেলে ছিল না। কাকা বললেন, ওদের দোষ নয়। এদের বেশির ভাগই জন্মেছে ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান হিসেবে এখানে। বাবা-মায়ের স্নেহ এবং সাচ্ছল্য পায়নি। রাস্তায় বড় হয়েছে। তার ওপর হিন্দি সিনেমার প্রভাবে আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ওদের এই চেহারা দিচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখ, প্রত্যেকের একজন ফিল্ম হিরোর মতো কানঢাকা বাবড়ি চুল। আগামীকাল বলে এদের কিছু নেই।

এই সময় খুকি এলো। মাঝারি চেহারার প্রাণবন্ত মেয়ে। পরিশ্রমের চিহ্ন মুখে। এসে অবাক হয়ে তাকাল, গৌরবদা না?

কাকা বললেন, তুই কী করে চিনতে পারলি?

বাঃ, চিনব না কেন? কবে এলে তুমি? ভালো আছ? কতদিন বাদে দেখলাম। কী খবর?

এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে দিতে পারব না। গৌরব হাসল, আমি ভালো আছি। তোর খবর কী?

এই তো। ও হ্যাঁ, বাবা, আমাদের বাড়িতে কি পাড়ার ছেলেরা কোনো ঝামেলা করেছে?

কাকাবাবু উত্তর দিলেন, ওরা একশো টাকা চাঁদা চেয়েছে শীতলা পূজোর জন্যে। আমি দেবো না বলায় যা-তা বলেছে একে। গৌরব বোঝাতে গেলে ওকে অপমান করেছে। তখন গৌরব ছেলেটার কলার ধরেছিল।
 
খুকি মাথা নাড়ল, জয়দা সেই কথাই বলল। ওরা খুব খেপে আছে। তবে জয়দা বলেছে যে ছেলেটা অপমান করেছিল তাকে নিয়ে এখানে আসবে।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, জয়দা কে?

কাকা বললেন, পাড়ায় থাকে। মাস্তান। তবে একটু ভদ্রতা এখনও আছে। ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বেসিক্যালি হি ইজ এ মাস্তান বাট নট ইয়েট রুইনড। খুকির সঙ্গে ভদ্রগলায় কথা বলে।

খুকি বলল, আসলে গৌরবদা, পাড়ার পরিবেশ যখন এই রকম তখন কারো কারো সঙ্গে যদি একটু ভদ্রভাষায় কথা বলা যায় তাহলে সে অনেক উপকারে আসে। জয়দা মাস্তানি করে ঠিক তবু কোথায় যেন এখনও ভালত্ব লেগে আছে।

কাকা বললেন, তোকে নিয়েই আমায় ভয়। কোনোদিন যদি কিছু করে বসে ওরা।

এই সময় কাছাকাছি বোমের শব্দ শুরু হলো। খুকি বলল, দুদলে লাগল। এবং তখনই দরজার কড়া নড়ল। কাকা দরজা খুলতে একটি ফর্সা স্বাস্থ্যবান ছেলে আর একজনের কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল ভেতরে, ক্ষমা চা এঁদের কাছে। পাড়ার মা-বোনদের ইজ্জত নেই না?

ছেলেটা সেই অবস্থায় কোনরকমে বলল, কাজটা ভালো করছ না জয়দা। আমি বদলা নেবই। সঙ্গে সঙ্গে জয় তার পেটে এমন একটা আঘাত করল সে ককিয়ে উঠে চুপ করে গেল। কাকাবাবুর সামনে ওকে এনে জয় বলল, কিছু মনে করবেন না কাকাবাবু, ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। একে দেখে রাখুন। যদি কোনোদিন কিছু করে আমাকে বলবেন। তারপর কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, যা।

ছেলেটি ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। জয় বলল, ওরা একশো চেয়েছিল? দিতে হবে না। আপনি পঁচিশ দিন। ওদের আমি বুঝিয়ে বলব।

কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে পঁচিশ টাকা বের করে জয়ের হাতে দিলেন। সে টাকাটা নিয়ে খুকিকে বলল, চলি ভাই খুকি।

খানিকক্ষণ বসে চা খাবার খেয়ে গৌরব উঠল। কাকাবাবু তখনও শঙ্কিত ছিলেন। বললেন, সাবধানে যেও।

বাইরে বেরিয়ে মোটরবাইক স্টার্ট দিল গৌরব। বনিকে পেছনে বসিয়ে স্টার্ট দিল সে। খানিকটা যাওয়ার পর সে ব্রেক কষল। সামনের গলিতে একটা ঝামেলা হচ্ছে। গৌরব জয়কে দেখতে পেল।

তাকে ঘিরে কয়েকজন খুব তড়পাচ্ছে। হঠাৎ একজন ছুরি বের করে জয়কে আঘাত করে দৌড়ে পালাল। জয় দেয়াল ধরে মাটিতে বসে পড়েছে। আর তৎক্ষণাৎ গলিটা ফাঁকা হয়ে গেল।

গৌরব ছুটে গেল কাছে। এক হাত দিয়ে তার কাঁধে চেপে ধরেছে। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন। সে তাড়াতাড়ি ওকে ধরে জিজ্ঞাসা করল, উঠতে পারবেন?

জয় চোখ তুলে দেখল। তারপর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ওর কাঁধ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। গৌরব বলল, আপনি আমার সঙ্গে হসপিটালে চলুন।

না। ঝটকা দিলো জয়, হাসপাতালে যাব না। এই কেস ওরা পুলিশে রেফার করবে।

কিন্তু আপনি উন্ডেড!

এমন কিছু বেশি নয়। আমার চেনা ডাক্তার আছে।

ও। তাহলে অন্তত খুকিদের বাড়িতে চলুন। ফার্স্ট এইড দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিই।

গৌরবের কথায় জয়ের মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল, আপনি খুকিদের বাড়িতে ছিলেন না? ওরা আপনাকে মারতে চেয়েছিল বলে ঝামেলা হলো। আপনি, আপনি আমার উপকার করতে চাইছেন কেন?

আপনি মানুষ বলে।

মানুষ? আমাকে কেউ মানুষ বলে না, জানেন! আপনার কথা আমার মনে থাকবে। টলতে টলতে উল্টোপথে চলে গেল জয়।

মোটরবাইকে ফিরে স্টার্ট দিতেই বনি জিজ্ঞাসা করল, ও তোমাকে কি বলল কাকা?

অন্যমনস্ক গলায় গৌরব বলল, কিছু না।

.
 
রাত বেশ হয়েছিল। মোটরবাইক নিয়ে বেশ দ্রুতগতিতেই বাড়ি ফিরছিল গৌরব। পার্ক স্ট্রিট থেকে ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে ঢুকে সে থিয়েটার রোডের দিকে আসছিল। রাস্তা ফাঁকা, দুপাশের দোকানপাট বন্ধ। জায়গায় একটু পাল্টায়নি। তবে বারো বছর আগে এলাকাটা অফিস পাড়া আর কিছু ধনওয়ালা বড়লোকদের থাকার জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। এখন প্রচুর মাল্টিস্টোরিড বাড়ি উঠেছে। এতে অবশ্য সন্ধের পরের চরিত্র পাল্টায়নি।

থিয়েটার রোড থেকে মিন্টোপার্কের দিকে যেতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল গৌরবের। একটি অল্পবয়সী মেয়ে ছুটছেই বলা যায়। তার পিছু নিয়েছে দুটো লোক। দূর থেকেই মনে হচ্ছে ওদের পদক্ষেপ সুস্থ নয়। মোটরবাইকে বসে গৌরব ভাবল ব্যাপারটা এ পাড়ায় আগেও ছিল। সন্ধের পরে খদ্দের ধরতে পতিতারা সেজেগুজে এসব এলাকায় ঘোরাফেরা করে। কিন্তু পুলিশের তাড়া ছাড়া ছোটে না কেউ। ব্যাপারটা আমল না দিয়ে সে বাঁদিকে বাঁক ঘুরতে যাবে এমন সময় মেয়েটি ফুটপাত থেকে ছিটকে নেমে এল পথে। প্রায় জোরে ব্রেক কষে নিজের পতন এবং দুর্ঘটনার সামাল দিলো গৌরব। মেয়েটি এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল যে মুখে হাত চাপা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল।

খুব খেপে গিয়ে গৌরব চিৎকার করে উঠল, মরার ইচ্ছে হয়েছে না? দেখে রাস্তায় নামতে পারেন না? আর একটু হলেই–। কথা বলতে বলতেই গৌরবের মস্তিষ্কে যে বোধের জন্ম নিল তা হলো মেয়েটি পতিতা শ্রেণির নয়। পরনে জিনসের প্যান্ট এবং বাগী শার্ট, কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। মুখে রঙ নেই। কিন্তু শিক্ষার ছাপ রয়েছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অনুসরণকারীরা দূরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ওরা কারা? ছুটছিলে কেন? যার বয়স কখনই উনিশের ওপরে নয় তাকে আপনি বলার কোনো মানে হয় না।

মেয়েটি তখনও স্বাভাবিক নয়। কোনোমতে মাথা নেড়ে বলল, জানি না। ওরা আমাকে ডাকছিল।

এত রাত্রে তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?

জানি না। থ্যাঙ্কস। বলে মেয়েটি উল্টো ফুটপাতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই গৌরব বাধা দিলো, দাঁড়াও। কী করো তুমি?

কলেজে পড়ি। ইটস এনাফ, ইজন্ট ইট? আমাকে বাঁচিয়েছেন বলে ধন্যবাদ দিয়েছি। ঘুরে দাঁড়িয়ে তীব্র স্বরে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল মেয়েটি।

কিন্তু লোকদুটো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এই নির্জন রাস্তায় এত রাত্রে তুমি সেফ নও।

আমি কী করে জানব যে আপনার কাছে আমি নিরাপদ?

ওয়েল। তা বলতে পার। তবে আমার সঙ্গে আইডেন্টিটি কার্ড রয়েছে। তুমি দেখতে পার। তাছাড়া তোমাকে আমি ছাড়তে পারি না নৈতিক কারণে। উঠে এসো।

কেন?

তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।

না। আমি বাড়িতে এখন যাব না।

এখন? তুমি জানো এখন কটা বাজে?

জেনেই বলছি। আপনি যেতে পারেন। আই ক্যান লুক আফটার মাইসেল।

গৌরব হাসল, তার নমুনা তো একটু আগেই দেখলাম। লোকদুটো আবার পিছু নিলে ভালো লাগবে? ওঠো পেছনে, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

কোথায় পৌঁছে দেবেন?

তোমার বাড়িতে।

বললাম তো আমি এখন বাড়ি ফিরব না।

মেয়েটি যে রকম জেদী গলায় কথাগুলো বলল তাতে ফাঁপরে পড়ল গৌরব। অথচ একে এভাবে ছেড়ে যেতেও ওর ইচ্ছে করছিল না। আমেরিকায় এ রকম প্রচুর মেয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় ঘোরে এবং তাদের সর্বনাশ হতে বেশি সময় লাগে না। এতক্ষণ কথা বলে তার স্পষ্ট ধারণা হয়েছে মেয়েটি অত্যন্ত ভদ্রঘরের এবং পড়াশোনা আছে। সে গলা ভারী করে বলল, দ্যাখো ভাই তুমি যদি আমার কথা না শুনতে চাও তাহলে আমাকে রূঢ় হতে হবে। লোকাল থানার ও.সি. আমার পরিচিত। তোমাকে থানায় যেতে হবে।

আপনি কি আমার মরাল গার্জেন? ফুঁসে উঠল মেয়েটি।

না। কিন্তু তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না।
 
মেয়েটি এক মুহূর্তে ভাবল তারপর পাশ কাটিয়ে গৌরবের বাইকের ব্যাক সিটে উঠে বসল, ঘুরিয়ে নিন। মেয়েটি যে দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল এখন তার বিপরীত দিকে যেতে চাইলে গৌরব ইঞ্জিন চালু করল। বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে স্পিড তুলতেই সে বুঝল অনুসরণকারীরা খুব হতাশ হলো। খানিকটা যাওয়ার পর মেয়েটির নির্দেশে বাঁ দিকে বাঁক নিল। একদা সাহেবপাড়া এখন সামান্য বদলালেও রাস্তাঘাট ছায়া ছায়া জনশূন্য। মাঝে মাঝে কোনো উঁচু ফ্ল্যাটের স্টিরিও থেকে বাজনা ভেসে আসছে। সেইরকম একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বলল, থ্যাঙ্কস। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, এখানেই তুমি থাকো?

দ্যাটস নট ইওর প্রব্লেম। বলেই মেয়েটি হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। খুব জেদ চেপে গেল গৌরবের। মেয়েটির মা বাবার সঙ্গে দেখা করে বলা দরকার ব্যাপারটা। সে বাইক একপাশে সরিয়ে রেখে লম্বা পায়ে অনুসরণ করল। ততক্ষণে লিফটটা ওপরে উঠে গেছে। বাইরের ফ্লোর ইনডিকেটর চোখ রেখে সে দেখল আলো জ্বলতে জ্বলতে লিফট থামল ছয় তলায়। বোতাম টিপতে সেটা নিচে নেমে আসতেই গৌরব লিফটে উঠে ছতলায় বোতাম টিপল। এত রাত্রে লিফটম্যান থাকে না। শূন্য লিফটে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে না তো! কিন্তু শেষ দেখে যাওয়ার ইচ্ছাই প্রবল হলো। দরজা খুলে যেতেই বাইরে পা দিয়ে সে একটু হকচকিয়ে গেল। তিনটে ফ্ল্যাটের দরজা তিনদিকে। তিনটেই বন্ধ। মেয়েটি কোন্ ফ্ল্যাটে ঢুকেছে? ঘড়ি দেখল সে। এত রাত্রে দরজায় দরজায় নক করে জিজ্ঞাসা করা আদৌ শোভন নয়। লিফট নেমে গিয়েছিল। গৌরব দেখল ওটা যখন আবার উঠে এল তখন ছতলার দুজন পুরুষ-মহিলা যাত্রী বেরিয়ে এলেন। গৌরবকে একবার বিরক্ত চোখে দেখে চাবি বের করে একটা দরজা খুলে ওরা ভেতরে ঢুকে যেতেই গৌরবের চোখ বাকি দুটো দরজার ওপর পড়ল। সে মরিয়া হয়ে একটি দরজার বেল টিপল। কোনো সাড়া নেই দ্বিতীয়বার টিপতেই দরজাটা খুলল। একটি একুশ বাইশ বছরের ছেলে দরজাটা ধরে রেখে ঈষৎ জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ প্লিজ?

তৎক্ষণাৎ একটু কটু গন্ধ ধক্ করে নাকে লাগল গৌরবের। সে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, একটু আগে যে মেয়েটি এখানে ঢুকেছে তাকে একটু ডেকে দাও।

কেউ এখানে ঢোকেনি। ছেলেটির গলা ওপরে উঠল, ডোন্ট ডিস্টার্ব আস।

কী করছ তোমরা? দ্যাটস নট ইওর বিজনেস।

ভেতর থেকে আর একটি জড়ানো কণ্ঠ ভেসে এল, কী ফালতু বকছিস। বন্ধ করে দে। ছেলেটি দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু গৌরব ততক্ষণে অনেকটাই ঢুকে পড়েছে। এবং তখনই সে দৃশ্যটি দেখতে পেল। কার্পেট পাতা ঘরে উনিশ থেকে বাইশ বছরের গোটা ছয়েক ছেলেমেয়ে আধশোয়া বসা অবস্থায় রয়েছে। একজন গাঁজা খাচ্ছে তখনও। বাকিরা সম্ভবত কোনো ড্রাগে আচ্ছন্ন। গৌরব বলল, এই ব্যাপার? ফ্ল্যাটটা কার?

তখন দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটি এবার নরম গলায় বলল, আমাদের।

তোমার বাবা-মা কোথায়?

দে আর আউট ফর দ্য নাইট।

সেই মেয়েটি কোথায়, যে এসেছে একটু আগে।

আপনি কে?

পুলিশ।

সঙ্গে সঙ্গে গাঁজা খাচ্ছিল যে সে সোজা হয়ে বসল। বাকি ছেলেমেয়েগুলোর কোনো প্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব ছিল না বলেই হলো না। গৌরব আবার বলল, আমি তোমাদের বেশি সময় দেব না, মেয়েটিকে এখানে আসতে বলো। নইলে তোমাদের থানায় যেতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার চেহারা পাল্টে গেল। দরজা ছেড়ে কয়েক পা ভেতরের দিকে গিয়ে সে চিৎকার করে ডাকল, টিনা, এই টিনা বেরিয়ে আয়। উই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ট্রাবল। কাম আউট প্লিজ। ছেলেটির কথা শেষ হতেই ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটি, এসে প্রতিবাদী ভঙ্গি তে দাঁড়াল। গৌরব মাথা নাড়ল, সত্যি কথাটা বলতে পারতে তো। যাদের ফ্ল্যাট সেই ছেলেটি বলল, টিনা তুই চলে যা। আমরা কোনো ঝামেলা চাই না। তুই খাবি না অথচ এসে ঝামেলা করিস। বাবা যদি জানতে পারে পুলিশ এসেছিল!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top