What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

এখন পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক। ডাইনিং টেবিলে সৌরভ বসেছিল গৌরবের পাশে। স্নান করে নেওয়ায় সৌরভের ব্যবহারটাও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। উল্টোদিকে বসে খাচ্ছে টনি বনি। টনির চোখে ঘুম। তার পাশে দাঁড়িয়ে সরলা আদুরে গলায় ঘুম ভাঙাচ্ছিলেন। মলি পরিবেশন করছিল। হঠাৎ গৌরব মুখ তুলে বলল, মা, তুমি খাবে না?

সরলা হাসলেন, আমি আজ একটু দুধ মিষ্টি খেয়ে নেব।

কেন? হঠাৎ এত বৈরাগ্য কেন? গৌরব প্রশ্ন করল।

বৈরাগ্য আবার কি! তুই খা তো। সরলা চাপা ধমক দিলেন।

সৌরভ খাওয়া শুরু করেছিল, থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মায়ের খাবার তৈরি হয় নি?

প্রশ্নটা যার উদ্দেশে তার ঠোঁটে টান পড়ল। মলি নিচু গলায় বলল, করেছি।

গৌরব বলল, তাহলে দুধ মিষ্টি কেন! বউদি তুমি মায়ের খাবারটা এখানে এনে দাও।

সরলা বললেন, না না, কী করছিস তোরা?

গৌরব মাথা নাড়ল, আমাদের সঙ্গে খেলে তোমার জাত চলে যাবে?

ব্যাপারটা ক্রমশ অন্যরকম হয়ে গেল। সরলা না খেলে কেউ খেতে চাইছে না। এমন কি টনি বনিও সেই তালে তাল দিল। সৌরভ স্মিত মুখে দেখছিল। গৌরব আসার পর অনেকদিন বাদে বাড়িটায় এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরলা বললেন, তোরা সত্যি পাগল। বউমা, তুমিও বসো।

এতক্ষণ মলি যেন বৃত্তের বাইরে ছিল হঠাৎ নিজের নামটা শুনে তড়িঘড়ি বলল, আমি–আমি তো খাবার দিচ্ছি, আপনারা বসুন।

গৌরব চোখ বড় করল, তা বললে চলবে না। সমস্ত খাবার টেবিলের ওপর জড়ো করো। কাউকে দিতে হবে না, যার দরকার সে নিজেই নিয়ে নেবে! তুমি বসে যাও।

এবার দৃশ্যটা চমৎকার। গৌরব ভাবল। টনি বনি মা বউদি দাদা এবং সে একই টেবিলে। মলি মুখ নিচু করে খাচ্ছিল। হঠাৎ তার শরীরে কাঁপুনি এল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে মুখ চাপা দিল। সরলা সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। খাওয়া থামিয়ে বাঁ হাত মলির পিঠে রাখলেন তিনি, ছি বউমা, খাওয়ার সময় চোখের জল ফেলতে নেই।

হঠাৎ আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না। সরলা চাপা গলায় বললেন, সহজ হও বউমা। মানুষ মাত্রই ভুল করে, মানুষই তা শুধরে নেয়। অতীতের কোনো কথা আমার মনে নেই। তুমিও মনে রেখো না। এক হাতে তালি বাজে না, দোষ হয়তো আমারও ছিল।

মলি কোনো উত্তর দিলো না। চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক করল সে। সৌরভ বলল, শুনলে কথাগুলো? চিরকাল মনে রেখো। ভাগ্যিস গোরা আজ দেশে ফিরল নইলে মা তুমি হয়তো আসতেই না।

সরলা দ্রুত মাথা নাড়লেন। তারপর হেসে বললেন, না খোকা, আমি আসতাম।

সৌরভের বিশ্বাস হলো না কথাটা। সে আবার প্রশ্ন করল, তুমি আসতে? আজ?

সরলা বললেন, আজ নয়। এমাসের দশ তারিখে আমাকে আসতেই হতো খোকা।
 
সবাই উৎসুক চোখে সরলার দিকে তাকিয়ে। সরলা কিন্তু টনির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, দেখেছ কাণ্ড! ছেলেটা ঘুমে ঢুলছে। এইটুকুনি ছেলে এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকতে পারে। থাক ওকে আর খেতে হবে না। না না, তুমি বসো বউমা। আমি ওকে হাত ধুইয়ে শুইয়ে দিয়ে আসছি। চট করে উঠে বেসিনে নিজের হাত ধুয়ে টনিকে তুললেন সরলা। বেচারা সত্যি আর পারছিল না। কোনোরকমে হাত ধুইয়ে সরলা ওকে ওপরে নিয়ে গেলেন।

সৌরভ জিভে একটা শব্দ করল, মাঝখান থেকে মায়ের আর খাওয়া হলো না।

গৌরব এক দৃষ্টিতে মায়ের চলে যাওয়া দেখছিল। এবার মুখ ফিরিয়ে সৌরভকে জিজ্ঞাসা করল, দশ তারিখে কী ব্যাপার দাদা?

দশ তারিখ। সৌরভ চিন্তা করল। তারপর বলল, ওহো। তার মুখ লাল হয়ে গেল আচমকা।

কী ব্যাপার? গৌরব এবার দাদার দিক থেকে বউদির দিকে ফিরল।

মলির ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসি জন্ম নিল। নিচু গলায় সে বলল, আমাদের বিয়ের তারিখ।

.

সকালবেলায় ড্রইংরুমে বসে মলি তার হিসেবের খাতায় কিছু লিখছিল। এখন তার পরনে নীল ডুরে কাটা সাদা শাড়ি। সাজগোজ তেমন নেই কিন্তু সে কারণেই বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে তাকে। উল্টোদিকের সোফায় বসে সৌরভ জুতোর ফিতে আঁটছিল। লিখতে লিখতে মলি জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আজ তোমার অফিসে না গেলেই নয়?

জুতো বাঁধা হয়ে গেলে সৌরভ বলল, একবার যেতেই হবে। ফাইল দুটোয় সই করে চলে আসব।

আজকের দিনে ছুটি নিলে ভালো করতে।

সেভেনটিনথ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে ছুটি চাইতে গেলে জুনিয়াররা ঠাট্টা করবে।

তাই নাকি? মলির নাক কুঁচকে গেল, তাহলে তো অ্যানিভার্সারিটা না করলেই পারতে।

সৌরভ হেসে উঠল শব্দ করে, তুমি এই চটজলদি রেগে যাওয়ার হ্যাবিটটা ত্যাগ করো। থাক, কতজনকে বললে?

কেটেছেঁটে পনেরো। মলি গম্ভীর গলায় জবাব দিলো। এখন কাঁচা বাজারে যেতে হবে।

মোক্ষদাকে পাঠাও। সৌরভ উঠে দাঁড়াতেই বেল বাজল। সে এগিয়ে গিয়ে দেখল একটি পোস্টাল পিয়ন দাঁড়িয়ে, টেলিগ্রাম।

সৌরভ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, সেকি। কার টেলিগ্রাম?

পিওন সই করিয়ে খামটা দিয়ে গেলে সৌরভ কাঁপা হাতে সেটাকে খুলল। মলিও উদ্বিগ্ন মুখে উঠে এসেছিল কাছে। টেলিগ্রাম পড়ে সৌরভ সেটাকে বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। খবরটা জেনে মলি জিজ্ঞাসা করল, এখন কী করা যায়?

বুঝতে পারছি না। সৌরভ জবাব দিলো।

শোন, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মানেই মারা যায় নি। টেলিগ্রামটা একদিন দেরিতেও আসতে পারত। আজ বাড়িতে কাজ। আজ যদি ও চলে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মলি বলল।

তাহলে?

শোন, বলতে হয় কালকে বলব। বাড়িতে এত লোকজন আসবে আমি একা সামলাতে পারব না!

সৌরভ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর। ও হ্যাঁ, গোরাকে এই ব্যাপারটা জানাতে যেও না। হি ইজ ভেরি মাচ সেন্টিমেন্টাল।


খেপেছ। গোরাকে আমার জানাতে বয়ে গেছে। মলি ফিরে এসে টেলিগ্রামটা হিসেবের খাতায় ঢুকিয়ে রাখল। সৌরভ বেরিয়ে গেল অফিসে। সেই সময় গৌরব নেমে এল ওপর থেকে। চিৎকার করে বলল, অনেক অভিনন্দন বউদি। তোমাদের দাম্পত্যজীবন দীর্ঘজীবী হোক।

মলি হেসে বলল, ফাজিল। কোথায় বেরুনো হচ্ছে?

স্রেফ আড্ডা মারতে। দেশটায় কতদিন পরে ফিরলাম। একটু ঘুরে-টুরে দেখি। আচ্ছা বউদি, জয়তী কোনোদিন এখানে ফোন করেছিল?

কে জয়তী?

ওঃ, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমরা কলেজে একসঙ্গে পড়তাম।

ওহো, তোমার সেই বান্ধবী? বছর তিনচার হলো তার কথা তো এ বাড়িতে শুনি না। আগে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মাকে জিজ্ঞাসা করেছ?

হ্যাঁ। মাও একই কথা বলল।

বেশ, আমাকে এখন বেরুতে হবে।

কোথায়?

বাঃ, এতগুলো লোক খাবে বাড়িতে, কেনাকাটা নেই?

মোক্ষদাকে নিয়ে যাও।

মোক্ষদা? মলির মুখ গম্ভীর হলো, না। ও বাড়িতে থাক।

তাহলে চলো আমি তোমার সঙ্গী হই।

তুমি যাবে? বা, তাহলে খুব ভালো হলো। দাঁড়াও, আমি শাড়িটা পাল্টে আসি। মলি আনন্দিত হয়ে ওপরে উঠে গেলে গৌরব শিষ দিল। তারপর টেলিফোনের কাছে গিয়ে ডাইরেক্টরি খুঁজল। কাছাকাছি না পেয়ে সে চেয়ারের কাছে ফিরে এসে হিসেবের খাতাটাকে দেখতে পেল। ওটাকে তুলে নিয়ে আবার রাখতে গিয়ে টেলিগ্রামটা নজরে এল তার। একটু দ্বিধা করে সেটাকে খুলতেই মুখ গম্ভীর হয়ে গেল গৌরবের। ঠোঁট কামড়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে সে টেলিগ্রামটা যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর চটজলদি রান্নার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
 
বাজার করে ঘর্মাক্ত হয়ে ফিরল ওরা। পনেরোজন লোক খাবে। এদের মধ্যে গৌরবদের মাসতুতো ভাই টুলুও আছে। গৌরব খুশি হলো, টুলু বিয়ে করেছে রত্নাকে। রত্না ওর সঙ্গে কলেজে পড়ত। জয়তীর সঙ্গে রত্নার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। হলঘরে ঢুকে মলি ডাকল, মোক্ষদা, মোক্ষদা! কেউ সাড়া দিল না। মলি উষ্ণ হলো। চাপা গলায় বলল, কি আশ্চর্য! কাজের তাড়ার মধ্যে কোথায় গেল সে! জিনিসপত্রগুলো এক জায়গায় রেখে সোফায় বসে গৌরব লক্ষ্য করছিল। সমস্ত বাড়িটা তোলপাড় করছে মলি। মোক্ষদা কোথাও নেই। সরলা পর্যন্ত অবাক। মোক্ষদা কোথাও গেলে না বলে যায় না। তাছাড়া এ পাড়ায় তার তেমন আড্ডাও নেই। ওপাশে পার্কের ধারে ওর এক বোনপো কাজ করে মুদির দোকানে। সেখানে মোক্ষদা যায় না, প্রয়োজনে ছেলেটি আসে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যখন মোক্ষদার দর্শন পাওয়া গেল না তখন মাথায় হাত পড়ল। মলি ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! এতগুলো লোক খাবে, বাজারহাট সব করা হয়ে গেছে, একা পেরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া মোক্ষদা চীনে এবং মোগলাই রান্নায় আজকাল এক্সপার্ট। সে থাকলে কোনো সমস্যাই থাকে না। এতদিনের পুরনো লোক না বলে কয়ে এমন-উধাও হয়ে যাবে কেউ চিন্তা করতে পারছেনা। এই সময় সৌরভ অফিসের বুড়ি ছুঁয়ে বাড়িতে ফিরতেই মলি তাকে সমস্যাটা জানাল। মোক্ষদা এ বাড়িতে আছে অনেককাল। কখনও এমন করেনি। এমনও হতে পারে সে কিছু আনতে দোকানে বেরিয়েছিল এবং পথে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অতএব হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া দরকার। কিন্তু সেরকম কিছু হলে তো পাড়ার মধ্যেই হবে। সৌরভ একবার পাক দিয়ে এল। এমন কি মোক্ষদার বোনপোর সঙ্গে দেখা হলো তার। কোনো দুর্ঘটনা আজ সকালে ঘটেনি। বোনপো বলল, তার মাসীকে আজ দেখেনি।

সৌরভ শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব দিল শোন, আমার মনে হচ্ছে, মোক্ষদা যখন নেই, হোটেল থেকে খাবার আনা যাক। খরচ বেশি পড়বে কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

সরলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। মোক্ষদার এই ব্যবহারে তিনিও খুব আহত। মুখ তুলে বললেন, বাড়িতে নেমন্তন্ন করে হোটেলের খাবার খাওয়াবি?

সৌরভ বলল, এ ছাড়া আর উপায় কি মা। মলির পক্ষে এতো রান্না করা সম্ভব নয়। মাছ মাংস তুমি রান্না করো না। তাছাড়া তোমারও বয়স হয়েছে। এখন হোটেলই ভরসা।

মলি বলল, এখন এইগুলো নিয়ে আমি কী করি! এত মাছ মাংস ফ্রিজে ঢুকবে না। সব্জিগুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে এসেছি। একটু পরেই সেসব এসে যাবে। এত টাকা লোকসান।

সৌরভ বলল, যা যাবার তা যাবে। মোক্ষদা এলে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত চাইবে।

মলি ঠোঁট ওল্টাল, ওদের কৈফিয়ত! আমি বলি কি সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দাও কোনো হোটেলে যেতে। আমরা বাড়ির বদলে হোটেলে করছি।

হোটেলে? সৌরভের কথাটা মনঃপুত হলো না।

হ্যাঁ। হোটেল থেকে না হয় খাবার আনলে। কিন্তু এত ডিশ গ্লাস কে ধোবে? বাসন মাজার লোকটার ওপর তো ভরসা করা যায় না।

এবার সৌরভ চিন্তিত হলো। এখন টেলিফোনে সবাইকে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এই শেষ সময়ে হোটেলে ব্যবস্থা করাটা সম্ভব হয়ে উঠলেও খবরটা হবে সীমা ছাড়ানো। তার খুব রাগ হচ্ছিল মোক্ষদার ওপরে। পুরো ব্যাপারটাই ডুবিয়ে দিলো। গৌরব এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। সে সোফা ছেড়ে উঠে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে এল বাজারের ব্যাগগুলো দুহাতে তুলে। গ্যাস আছে, প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। মোক্ষদা চমৎকার গুছিয়ে রেখেছে সব। রান্নাঘরের এবং ডাইনিং রুমের ছোট্ট একটা জানলা আছে। গৌরব ইশারায় সেখান থেকে বনানীকে ডাকল। বনানী এতক্ষণ বিপর্যয়ের কথা শুনছিল চুপচাপ। ডাক পেয়েই সে কাকার কাছে চলে এল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তোর এখন কী করার আছে?

কিছু না। বনানী মাথা নাড়ল।

তাহলে আমার সঙ্গে হাত লাগা। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে সব্জিগুলো কাটবি, ঠিক সেই ভাবে ছুরি দিয়ে কাটতে আরম্ভ কর। পারবি না?

এই বয়স অবধি কখনো রান্নাঘরের ত্রিসীমা মাড়ায়নি বনানী। কিন্তু আজ ব্যাপারটা তার কাছে বেশ অভিনব মনে হলো। সে জিজ্ঞাসা করল, কে রান্না করবে?

সবাই। গৌরব কাজ আরম্ভ করল।

তখন মলি সরলাকে জিজ্ঞাসা করছে, আচ্ছা বাইরে থেকে কেউ এসে মোক্ষদাকে কোনো খবর দেয়নি তো? আপনি ঠিক জানেন?

সরলা মাথা নাড়লেন, কেউ তো বেল বাজায়নি বউমা।
 
মলি সৌরভের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। এই সময় গৌরব রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, বউদি, তোমাদের বিবাহবার্ষিকীতে কী কী মেনু হবে বলো?

মলি হকচকিয়ে গেল, তার মানে?

মানে টানে কিছু নেই। চটপট বলে ফেলো। আমাকে আর একবার বাজারে যেতে হবে।

সৌরভ বলল, তুই কী বলছিস? আমার মাথায় ঢুকছে না।

তোমরা যে কজনকে ইনভাইট করেছ তাদের রান্না করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। শুধু বলো, এখানকার লেটেস্ট মেনু কী!

কে রান্না করবে?

কেন আমি? হাঁ করে দেখছ কী?

সরলা চাপা গলায় বললেন, আর মাথা খারাপ করে দিস না গোরা। কোনো কালে তুই রান্নাঘরে ঢুকলি না আর আজ রান্না করবি?

গৌরব হেসে ফেলল, তুমি আমাকে কী ভাবো বলতো মা? বারো বছর আমেরিকায় আছি, ওখানে আমার রান্না করে দেয় কে? যত বড়লোকই হোক বাড়িতে তো কারও চাকরবাকর নেই। চাকরের যা মাইনে তা দিতে গেলে পথে বসতে হবে। সেটাও আবার ওখানে বেআইনি। আমি এখন চাইনিজ মোগলাই এবং ইংলিশ চমৎকার রাঁধতে পারি।

মলি অবিশ্বাসীর গলায় বলল, সত্যি?

একশোবার সত্যি। ওখানে কারও বাড়িতে পার্টি থাকলে আমাকে তোয়াজ করে ডেকে নিয়ে যায়। বলো মেনু কী হবে? গৌরব হাসছিল।

সৌরভ কিন্তু কিন্তু করে বলল, আমার বাবা বিশ্বাস হচ্ছে না। দেখ গোরা, এটা ফাজলামির ব্যাপার না। এতগুলো লোক আসবে, শেষ পর্যন্ত বেইজ্জত না হই।

সেটা আমার ওপরে ছেড়ে দাও। বউদি চটপট।

মলি আনন্দিত এবং লজ্জিত একই সঙ্গে। সে বলল, কী বলি বলোতো। যা বাজার হয়েছে তাতে ঠিক ছিল ফ্রায়েড রাইস, চিলিচিকেন, চিংড়ির একটু টকমিষ্টি, আর স্মোকড ইলিশ।

ব্যস? গৌরব হাত নাড়ল, এ তো দেখতে দেখতে হয়ে যাবে। দাদা, তুমি একটা কাজ করো। দুডজন ভালো পেপার প্লেট এবং গ্লাস কিনে আনো। তাহলে আর বাসন ধোয়ার ঝামেলা হবে না। আর বউদি তুমি ঘরদোর একটু গুছিয়ে ফেলো। বনি আমাকে হেল্প করছে, আর কাউকে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না।

সরলা বললেন, তুই যে কী করছিস আমি বুঝতে পারছি না। আমি বরং তোর সঙ্গে থাকি।

মাথা নাড়ল গৌরব, উঁহু। তোমার ওপরে অন্য কাজ দিচ্ছি। তুমি টনিকে সামলাও। আচ্ছা, সবাই যে যার কাজে লেগে যাও।

.

এতো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান শেষ হবে কেউ ভাবেনি। প্রতিটি খাবারের প্রশংসায় অতিথিরা পঞ্চমুখ। রত্নার শরীর খারাপ বলে সে আসেনি। টুলু এসেছিল। গৌরবের চেয়ে বয়সে বছর দুয়েকের বড় কিন্তু দেখে মনে হয় না। টুলু জিজ্ঞাসা করল, সত্যি তুই এইসব রান্না করেছিস?

গৌরব হাসছিল। এতোক্ষণ এখানে প্রচুর মদ্যপানের সঙ্গে তার ওপর প্রশংসা বর্ষিত হয়েছে। সবাই চলে গেলেও টুলু বসে কথা বলছিল। তার কথায় এখন সামান্য জড়ানো ভাব। সে তখনও তাকিয়ে আছে দেখে গৌরব বলল, আমেরিকায় বারো বছর থেকে এই সব দিশি রান্না শিখেছি। হ্যাঁ আমেরিকানরা তো এইসব রান্না করে না। রেস্তোরাঁতে গিয়ে চাউমেন চাইলে যা দেবে তা দেখে চোখ কপালে উঠবে। ওদের লামেন হলো আমাদের চাউমেন। অবশ্য চীনে রেস্তোরাঁয়।

ইয়ার্কি মারিস না। শুনেছি তুই কম্পুটার নিয়ে পড়াশোনা করেছিস। সেই সঙ্গে এইসব শিখলি কী করে? সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছি। টুলু বলছিল।

না শিখলে স্যান্ডুইচ আর হামবার্গার খেয়ে থাকতে হতো। ওখানে যে যার নিজের কাজ নিজেই করে। করতে হয়।

তুই কি আমেরিকায় থেকে যাবি?

দেশে এসে মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই। আমি যে বিষয়ে স্পেশালাইজড সে বিষয়ে কাজ করার সুযোগ পেলেই এখানে থেকে যাব।

কিন্তু ও দেশের মতো টাকা তো এখানে আশা করাই যাবে না।

টাকা তো কোনো ফ্যাক্টর নয়। মোটামুটি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট টাকা পেলেই চলবে। মায়ের কাছে তো থাকা যাবে।

টুলু উঠে দাঁড়াল, এবার বিয়ে-থা কর। বউদি গোরার জন্যে ভালো পাত্রী চাই?
 
মলি খুশি মনে কথাবার্তা শুনছিল। এতবড় ঝামেলা, এত সহযে যে উৎরে যাবে তা সে ভাবতে পারেনি। শুধু উৎরে যাওয়া নয় প্রত্যেকে প্রশংসা করেছে। এবার টুলুর প্রশ্নের জবাবে বলল, দাও না ভাই, তোমার হাতে যদি ভালো মেয়ে থাকে তাহলে ওকে ধরে বসিয়ে দিই।

আমার মতো কপাল যেন না হয়। টুলু বিড় বিড় করা মাত্র টেলিফোন বাজল।

সৌরভ উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরল, হ্যাঁ, কে বলছেন? মেশোমশাই? হ্যাঁ টুলু এখানে আছে। সৌরভ ইঙ্গিতে টুলুকে রিসিভার নিতে বলল।

আমার ফোন! একটু বিস্মিত হয়ে রিসিভার কানে নিল টুলু, হ্যালো।

কথাগুলো শুনে রিসিভার নামিয়ে রেখে টুলু উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, আমাকে এখনই চলে যেতে হবে।

গৌরব উঠে এল, কেন কী হয়েছে?

টুলু একটু অন্যমনস্ক। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল–রত্না আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। এখন ভালো।

বেরিয়ে গেলে গৌরব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বল তো?

সৌরভ বলল, বুঝতে পারছি না। মেসোমশাই তো টুলুকে ডেকে দিতে বললেন।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, টুলু কি সুখী নয়? অসুখী হলেই তো আত্মহত্যা করার কথা ভাবে লোকে। আমার মনে হয় এখনই ওদের বাড়িতে যাওয়া দরকার।

মলি বলল, মনে হয় ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস কিছু নয়। টুলুতো বলে গেল রত্না এখন ভালো আছে। মেসোমশাইও তো কিছু বলতে চাননি। এখন গেলে বোধহয় ওদের বিব্রত করা হবে। যদি যেতেই হয়–।

মলিকে থামিয়ে দিয়ে সৌরভ বলল, কাল যাস। আজ অনেক খাটুনি গেল, এখন রেস্ট নে।

গৌরব বুঝতে পারছিল এই রাত্রে টুলুদের বাড়িতে যাওয়াটা কেউ পছন্দ করছে না। তার মনে পড়ল খবরটা পেয়ে টুলুও তাদের সাহায্য চায়নি। কিন্তু রত্না কেন আত্মহত্যা করতে চাইবে?

টেবিলজোড়া কাগজের প্লেট, এবং উচ্ছিষ্ট। সে উঠে প্লেটগুলো একটা ট্রের ওপর জড়ো করতে করতে বনিকে ডাল, আয় বনি, ওগুলো পরিষ্কার করে ফেলি।

মলি হাঁ হাঁ করে উঠল, না না, ওসব তোমাদের করতে হবে না। কাল সকালে ঠিকে ঝি এলে ও পরিষ্কার করবে। তোমরা কেন নোংরায় হাত দেবে।


গৌরবের প্লেট গ্লাস গোছানো হয়ে গেছিল। বনির হাতে ট্রে তুলে দিয়ে বলল, ডাস্টবিনের পাশে রেখে দে। আর একটা ডাস্টার নিয়ে আয়। কী বলছিলে বউদি? সারাদিন তো নিজেরাই সবকিছু করলে। এই সামান্য কাজটা শেষ করলে বাড়ি ছিমছাম হয়ে যায়। আমরা ওদেশে নিজেদের প্লেট ডিশ নিজেরাই পরিষ্কার করি। এনেছিস? বনির হাত থেকে ডাস্টার নিয়ে চটপট টেবিল পরিষ্কার করতে করতে গৌরব বলল, চেয়ারগুলো সাজিয়ে রাখ। জানো বউদি, পৃথিবীতে কেউ অবশ্যই প্রয়োজনীয় নয়। একজন না থাকলে সব ভেস্তে যাবে কেন? নিজেরা যদি নিজেদেরটা করে নিই তাহলে কোনো সমস্যাই থাকে না। আমাদের দেশের নিয়মটাই গোলমেলে। এক কাপ চায়ের জন্যেও ছেলেরা হয় কাজের লোক কিংবা মেয়েদের ওপর নির্ভর করে থাকে।

সৌরভ বলল, আমাকে কিচেনে ঢুকতেই দেবে না।

মলি প্রতিবাদ করল, বাজে বকবে না। তুমি নিজে চা করবে? তা ভাই ঠিকই বলেছ গোরা। কাজের লোক আর মেয়েদের মধ্যে কোনো তফাত রাখবে না ছেলেরা।

সৌরভ উঠে দাঁড়াল, যত আজেবাজে কথা। আমার ঘুম পাচ্ছে।

গৌরব বলল নিজেরা এবার থেকে হাত লাগাও। স্বাবলম্বন না কি যেন বলে!

সৌরভ বলল, ঠেলায় না পড়লে হবে না। আজ মোক্ষদা হাওয়া হয়ে গেল বলে। আচ্ছা, মোক্ষদার কথা তো আর তালে-গোলে মনেই ছিল না। মলি, আমি একবার থানায় ফোন করি। যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে থানা থেকে আমাদেরই দোষ দেবে।

হেসে ফেলল গৌরব, মোক্ষদার কিছু হয়নি দাদা।

কিছু হয়নি মানে?

আমি ওকে দেশে পাঠিয়েছি।

তুই? তুই জানতিস?

হ্যাঁ। বেচারার মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। নইলে টেলিগ্রাম পাঠাত না। অথচ আমাদের ফাংশন নষ্ট হবে বলে ওকে তোমরা জানাচ্ছিলে না খবরটা। ঠিক করোনি। আমিই ওকে চুপচাপ দেশে পাঠিয়েছি। কিন্তু তাই বলে এখানে তো কারও কোনো অসুবিধে হয়নি। তাই না? চলো ওঠো, ওঠো, অনেক রাত হয়ে গেছে। গৌরব তাড়া দিল।

মলির চিবুক নেমে এসেছিল বুকে। সৌরভ নিচু গলায় বলল, চলো।

.
 
সকালবেলায় টুলুর ফোন এল। রত্না এখন ভালো আছে। ইদানীং মানসিক স্থিতি ছিল না ওর! বাথরুমে গিয়ে ও গলায় দড়ি দেবার চেষ্টা করছিল। মাসীমার নজরে পড়ে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। টুলু সৌরভকে ফোনে চাইল। সৌরভ সব শুনে বলল, দেখি আমি কী করতে পারি। তুমি দুটো দিন অপেক্ষা করো।

সরলা উদ্বিগ্ন হয়ে শুনেছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন– কী হয়েছে?

সৌরভকে চিন্তিত দেখালো, টুলু বলছে রত্নাকে ভালো মেন্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করতে চায়। আমার এক জায়গায় জানাশোনা আছে ও জানত। তাই রিকোয়েস্ট করছে।

সে কী? খামোকা মেয়েটাকে পাগলা গারদে দেবে কেন?

সৌরভ বলল, ওদের বাড়ির বউ, ওরা যা ভালো বুঝছে করছে। টুলু বলল বাড়ির কেচ্ছা বাইরে যাক চাই না, কিন্তু তোমার সাহায্য চাই।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, রত্নার মাথা কবে থেকে খারাপ হলো মা?

সরলা মাথা নাড়লেন, বিয়ের সময় দেখেছিলাম। আসা-যাওয়া তো নেই আজকাল। কিন্তু তখন তো আমার সুস্থ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। আমার মনে পড়ছে মেয়েটা বেশ হেসে তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। জয়তীও ছিল। ওই মেয়ে পাগল হয়ে গেল কী করে? খোকা, তুই চেষ্টা কর মেয়েটা যাতে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠে। নইলে আমার জামাইবাবুকে তো আমি চিনি।

কি চেনো? গৌরব জিজ্ঞাসা করল।

রত্না পাগল বলে বিয়ে ভেঙে দিতে কতক্ষণ!

সৌরভের চোয়াল শক্ত হলো, দেখি।

.

কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে বুক ভরে যায় গৌরবের। যতই খোঁড়াখুঁড়ি, ট্রাফিক জ্যাম হোক কলকাতা ইজ কলকাতা। খুব দূরে না হলে সে ট্যাক্সি নেয় না। অবশ্য বাসের ভিড় সে এড়িয়ে চলে। পায়ে হেঁটে হাঁটার একটা মজা আছে। পরিচিত জায়গাগুলোকে আরও নিজের বলে মনে হয়। পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। গতকাল সে জয়তীদের বাড়িতে গিয়ে অবাক হয়েছিল। জয়তীরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। এখন ওরা কোথায় গিয়েছে বাড়িওয়ালা বলতে পারলেন না। তবে পাইকপাড়ার টালাপার্কের কাছে কোথাও বলে জানালেন। জয়তীর বাবা মারা গেছেন, এই খবরটাও সে প্রথম জানল।

বারো বছর ধরে জয়তীর জন্যে একটা কষ্ট বুকে রেখেছে গৌরব। ও এমন একটা মেয়ে যাকে ধরা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। সে যখন প্রথম আমেরিকায় গেল তখন নিয়মিত চিঠি পেত। একটু গুছিয়ে নিয়ে যখন জয়তীকে সে ওদেশে যেতে লিখল তখন থেকেই মেয়েটা একটু একটু করে দূরে সরে যেতে চাইল। একসময় গৌরব লিখেছিল, যদি জয়তী মনে করে তাহলে পছন্দমত মানুষের সঙ্গে জীবন শুরু করতে পারে। যদি কোনো দায় থেকেই থাকে তাহলে গৌরব তা তুলে নিতে প্রস্তুত। তারপর থেকেই চিঠিপত্র বন্ধ। সত্যি, কোনো মেয়েকে সে সুখী করতে পারবে না যখন, তখন তাকে কেন আশায় রাখবে। তবু দেশে ফেরার সময় তার মনে হয়েছিল হয়তো জয়তী বিয়ে করেনি। বাড়িওয়ালাকে সেকথা জিজ্ঞেস করা যায়নি। কিন্তু পাইকপাড়ার ঠিকানাটা খুঁজে বের করতেই হবে।
 
টুলুদের বাড়িটা বেশ অভিজাত এলাকায়। মেসোমশাই বড়লোক ছিলেন কিন্তু এতটা অবস্থা ভালো বুঝতে পারেনি গৌরব। গ্যারেজে দুটো গাড়ি। নতুন কোলাপসিবল গেট বসেছে। শুধু দারোয়ানটাই যা নেই। যে চাকরটা দরজা খুলল তাকে সে কোনো দিন দ্যাখেনি। পরিচয় ভেতরে নিয়ে গিয়ে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত সে গৌরবকে বাইরে বসিয়ে রাখল। তারপর গৌরবকে ডেকে পৌঁছে দিল যে ঘরে সেখানে মেসোমশাই একা বসে দাবা খেলছেন। গৌরব দেখল মেসোমশাই বেশ মোটা হয়েছেন। গিলে করা পাঞ্জাবি এবং মসৃণ টাকে তাঁকে সফল মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

এই যে গৌরব। টুলুর মুখে শুনলাম তুমি দেশে ফিরেছ। কেমন আছ? দাবার বোর্ড থেকে একবার চোখ সরিয়ে গৌরবকে দেখলেন মেসোমশাই।

ভালো। আপনারা কেমন আছেন?

আর আমরা। একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে এখন! শুনেছ বোধহয়। টুলু তো কাল তোমাদের বাড়িতেই ছিল। সবই কপাল, তোমার দাদা কিছু খবর দিয়েছে?

না। টুলু সকালে ওকে ফোন করেছিল। ও খোঁজ নিয়ে জানাবে। রত্নার কী হয়েছে?

তুমি বউমাকে চেন? ও হ্যাঁ, তাই তো শুনেছিলাম। সত্যি কথা বলোতো, ওর কি আগে কারো সঙ্গে ইনভলভমেন্ট ছিল?

আমি জানি না মেসোমশাই।

হুঁ। আবার দাবার দিকে মন দিতে দিতে বললেন, কদ্দিন আছ?

আছি কিছুদিন। মেসোমশাই, মাসীমা কোথায়?

মাসীমা আর টুলু একটু বেরিয়েছে। এই ব্যাপারেই। পেটটা ভালো নেই হে, তুমি বসো, আমি একটু টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। খুব তাড়াতাড়ি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। পুরো বাড়িটাই শব্দহীন। কিছুক্ষণ একা বসে থেকে গৌরব উঠল। টুলুর বউ রত্নাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছিল। বারো বছর পর রত্নাকে সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে না কিন্তু আবছা ভাবতে পারছে। রত্না কি এখন এই বাড়িতেই আছে? নাকি ওর বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা। গৌরব উঠল। ভেতরে কেউ নেই। দোতলায় উঠে এল সে। টুলুর ঘরটা বন্ধ। দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ কি? ঠেলতেই খুলে গেল। আর দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠল সে। ডাবলবেড খাটের মাঝখানে যে মেয়েটি শুয়ে আছে, তার হাত পা চারটে দড়িতে বাঁধা। দরজার শব্দ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল মেয়েটি। এবং তখনই রত্নাকে চিনতে পারল গৌরব। সে অবাক বিস্ময়ে উচ্চারণ করল, রত্না!

রত্নার চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। সে বিড় বিড় করল, কে আপনি, কী চান?

রত্না, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি গৌরব।

গৌরব! ও, গৌরব। কী করতে এসেছ তুমি? মজা দেখতে? পাগল দেখতে। আঃ। চোখ বন্ধ করল রত্না আর তার গালের শুকনো জলের দাগ আবার ভিজে উঠল।

গৌরব চটপট পাশে এসে দাঁড়াল, কী হয়েছে তোমার?

আমি পাগল। ওরা আমাকে পাগল বলছে। আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম তাই।

কথা বলছে রত্না অস্বাভাবিক চোখে মুখে। গৌরব আবার জিজ্ঞাসা করল, কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে? কীসের দুঃখ তোমার?

আমার বাবাকে বাঁচাতে।

ঠিক সেই সময় মাসীমা এসে দরজায় দাঁড়ালেন, গোরা!

গৌরব ঘুরে দাঁড়াল, এই যে মাসীমা!

তুই হঠাৎ ওপরে চলে এলি কেন?

না, মানে–।

আয় নিচে আয়।

গৌরব রত্নার দিকে আর একবার তাকিয়ে মাসীমাকে অনুসরণ করল। বাইরে বেরিয়ে মাসীমা বললেন, তুই দেশে ফিরেছিস তা টুলুর কাছে শুনেছিলাম।

হ্যাঁ, অনেকদিন বাদে এসে অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড দেখছি। তুমি কেমন আছ মাসীমা?

এই নিয়ে কী করে ভালো থাকি। দেখলি তো নিজের চোখে।

রত্নাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন?

বউমাকে তুই–! ও হ্যাঁ, মনে পড়ছে। তোরা একসঙ্গে পড়তিস। ওর কি মাথার দোষ ছিল?

না, আমার তো মনে পড়ছে না। খুব ব্রাইট মেয়ে ছিল রত্না।

বেঁধে না রাখলে সামলানো যাচ্ছে না। হয়তো আমাদেরই খুন করে ফেলবে।

কী করে হলো এমন?
 
জানি না। একদিন ওর বাবা ফোন করল তারপর থেকেই এইসব হচ্ছে। আসলে ওই বাড়িতে সম্বন্ধ করাটাই ভুল হয়ে গেছে। রত্নার বাবা সৎ মানুষ নন। তাঁর কথার ঠিক নেই। যাকগে। ওকে আমরা বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তোর মেসোমশাই বললেন, বাড়ির বউয়ের চিকিৎসা বাড়িতেই করব। তাছাড়া নিজেদের লজ্জার কথা পাঁচজনে জানুক তাও চাই না। তোর দাদার হাত আছে হাসপাতালে তাই বলা। তোকে কী বলল ও?

সাধারণ কথাবার্তা।

ওইতো! শুনলে মনে হবে ভালো মানুষ। কিন্তু সেটাও পাগলামি। আয় চা খাবি। মাসীমা নিচের দিকে পা বাড়াল। গোরার বিন্দুমাত্র চায়ের প্রয়োজন ছিল না। সে নামতে নামতে বলল, মাসীমা, আজ চা থাক। আর একদিন এসে খেয়ে যাব।

মাসীমা চোখ তুললেন, প্রথম দিন বাড়িতে এসে না খেয়ে যাবি! ও হ্যাঁ, দিদি কেমন আছে?

ভালো।

রাণাঘাট থেকে শেষ পর্যন্ত ফিরল!

গৌরব উত্তর দিল না। মাসীমা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ছেলের বউ এনে দিদি শেষ পর্যন্ত ঘর ছাড়া হলো তো। তুই না এলে দাদার গলগ্রহ হয়ে থাকতে হতো। মলি এখন দিদির সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে? বাড়িতে মদের ফোয়ারা এখনও চলছে?

গৌরব হাসল, যা বলেছ। তবে ফোয়ারা একবার চালু হলে থামা বড় মুশকিল। চলি মাসীমা, টুলুকে বোলো এসেছিলাম। মেসোমশাই কোথায়?

সে দাবা নিয়ে ব্যস্ত। মাসীমা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

রাস্তায় বেরিয়ে ঠোঁট কামড়াল গৌরব। রত্নার কথাবার্তায় যদি অস্বাভাবিকতা এসেও থাকে তাহলে কি ওভাবে বেঁধে রাখার জন্যে? না সত্যি পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা! দ্বিতীয় চিন্তাটা কিছুতেই মনে ধরল না তার। কলেজে পড়ার সময় একদিন জয়তী আর সে রত্নার বাড়িতে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের জন্যে। পাড়াটা মনে আছে। গৌরব ঠিক করল সে একবার রত্নার বাড়িতে যাবে। রত্নার বাবা এ ব্যাপারে কী বলেন শোনা দরকার।

.

বাড়িটাকে চিনে বের করতে অসুবিধে হলো না। কিছু কিছু স্মৃতিকে দূর থেকে খুব অস্পষ্ট মনে হয়। মুখোমুখি হলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় আচমকা। রত্নার বাবাই দরজা খুললেন। এই বারো বছরে লোকটি কতটা বদলেছে তার মনে নেই। তবে সমস্ত চুল সাদা, চোখের তলায় ভাঁজ এই প্রায় বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই?

গৌরব বলল, আমি আর রত্না একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। আপনি তো ওর বাবা?

হ্যাঁ। কিন্তু তার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

জানি। সেই সুবাদেও আমি আত্মীয়। আমার নাম গৌরব। আমেরিকায় চাকরি করি। আমার মাসীমার ছেলে হলো টুলু। গৌরব এগিয়ে এসে প্রণাম করতেই ভদ্রলোক বললেন, ও, হ্যাঁ তোমার কথা শুনেছি রত্নার কাছে। এসো এসো, ভেতরে এসো।

বসবার ঘরটি ঠিক যত্নে নেই। গোরা বসতেই ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে চাকরকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন। গোরা বলল, আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমি এখন চা খাব না।

ও! রত্নার বাবা চেয়ারে বসলেন, আসলে বাড়িতে কোনো মহিলা নেই তো।

ঠিক আছে। মেসোমশাই, আমি একটু আগে রত্নাকে দেখে আসছি।

ও। কেমন আছে রত্না? বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

আপনি কিছুই জানেন না?

কী ব্যাপারে?

গৌরব একবার ভাবল বলবে কি না। ওরা কি এঁকে জানায়নি রত্নার আত্মহত্যার চেষ্টার কথা! সে বলল, ও বাড়িতে গিয়ে শুনলাম রত্নার মানসিক গোলমাল হয়েছে।

মিথ্যে কথা। টুলুর বাবা এইভাবে আমার ওপরে চাপ দিচ্ছে।

চাপ দিচ্ছে! কেন?

বৃদ্ধ চকিতে তাকালো গৌরবের দিকে। তারপর মুখ নামিয়ে বললেন, সে আমার অক্ষমতার কথা বাবা, লজ্জার কথা। তোমাকে বলাটা–!

আপনি বলতে পারেন।


একটা নিশ্বাস বৃদ্ধের বুক খালি করল। ছেলে ভালো বলে মেয়েকে লুকিয়ে আমি কথা দিয়েছিলাম পঞ্চাশ ভরি সোনা আর পঞ্চাশ হাজার নগদ দেব। সোনা কিনতেই ফতুর হয়ে গেলাম। এখনও তিরিশ হাজার টাকা দিতে পারিনি। উনি অনেকবার চেয়েছেন। শেষে মেয়ে যখন জানতে পারল তখন থেকেই কেলেঙ্কারি।

গৌরবের চোয়াল শক্ত হলো, কী কেলেঙ্কারি?

সে খেপে গেল। কেন আমি এই ভাবে বিয়ে দিলাম। অনেক বুঝিয়ে পাঠিয়েছি ওখানে। কিন্তু কিছুদিন থেকে শুনছি মেয়ের নাকি মাথা খারাপ হয়েছে। আমি ছুটে গিয়েছিলাম, দেখা করতে দেয়নি ওরা। বলেছিলাম ধার করে মেয়ের চিকিৎসা করাব। সে কথাও শোনেনি। তিরিশ হাজার না দিলে উনি আমার মুখ দর্শন করবেন না। আমি মিথ্যুক, অসৎ। কান্নায় বৃদ্ধের গলা বুজে এল। গৌরব একটু সময় দিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি বিশ্বাস করেন রত্না সুস্থ?

হ্যাঁ। অবশ্যই।

কেন এই বিশ্বাস?

কোনোদিন সে অসুস্থ ছিল না।

কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে আচমকাই মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হতে পারে।

তাহলে গত সপ্তাহে আমি ওর চিঠি পেলাম কী করে?

গত সপ্তাহে? চিঠিটা দেখাতে পারেন?

হ্যাঁ। বৃদ্ধ উঠে ভেতরে গেলেন। গৌরব মেসোমশাইকে এই ভূমিকায় ভাবতে পারছিল না। টুলুর বিয়ে দিয়েছেন এত টাকার বিনিময়ে? পুরোটা না পাওয়ায় এই চাপ দিচ্ছেন। এতদিনের দেখা মানুষটা! কিন্তু রত্নার সঙ্গে কথা বলেও তো তাকে পাগল মনে হয়নি। বৃদ্ধ চিঠিটা এনে দিলো। একটা ইনল্যান্ড লেটার। চিঠিটা পড়ল গৌরব–

বাবা, তুমি কিছুতেই ওদের একটা পয়সা দেবে না। আমার শরীরটার দাম কি পঞ্চাশ ভরি সোনা আর পঞ্চাশ হাজার টাকা। তুমি যে অন্যায় আমাকে না জানিয়ে করেছ তা আর শোধরাবার উপায় নেই। কিন্ত আর নয়। এবার হয়তো বাড়ি বাঁধা দিয়ে ওই টাকার ব্যবস্থা করবে। কেন? আমাকে সুখী করবার জন্যে? বাবা, তুমি যদি ওদের দাবি মেনে নিতে চাও তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। আত্মহত্যা করলে তো আর টাকাটা দিতে হবে না। টাকা না পেয়ে ওরা আমাকে পাগল প্রমাণ করতে চাইছে। পাগল বউকে তাড়ানো খুব সোজা। আমি স্বেচ্ছায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলাম। এরা আমার কথা বিশ্বাস করছে না। শেষবার আমার কথা ভেবো। এই চিঠি লিখছি লুকিয়ে। বাড়ির ঝি যদি দয়া করে পোস্ট করে তাহলেই তুমি পাবে। ইতি তোমার হতভাগিনী মেয়ে রত্না।
 
গৌরব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। বৃদ্ধ বললেন, তুমি বলো বাবা, এইরকম চিঠি কোনো পাগল কি লিখতে পারে? না, আমার মেয়ে পাগল নয়। ওরা পাগল বলছে যাতে খোরপোষ দিতে না হয়। আমি যে কী করি এখন।

কী করবেন? পুলিশে যান।

পুলিশে? না না। ঘরের কথা বাইরে যাক এ আমি চাই না। পুলিশ মানেই আইন আদালত, খবরের কাগজ। না, ওসব চিন্তা আমি করি না।

তাহলে?

আমি মেয়েকে লুকিয়ে টাকাটা তোমার মেসোমশাইকে দিয়ে আসব। সত্যি এই বাড়ি আমি বন্ধক রাখতে যাচ্ছি। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।

গৌরব উঠে দাঁড়াল, আপনি বিশ্বাস করে এই চিঠিটা আমাকে দিতে পারবেন?

বিশ্বাস করে বলছ কেন?

আমি তো ওদের হয়ে এসে এই চিঠি নিয়ে যেতে পারি।

তাতে আমার কী ক্ষতি! আমি তো মামলা করতে যাচ্ছি না। তুমি প্রথমেই পরিচয় দিলে রত্নার বন্ধু বলে। তুমি নিশ্চয় ওর ভালো চাইবে।

আপনাকে আমি বলছি, রত্না বোধহয়, আচ্ছা, চলি। কথাটা বলল না গৌরব। আত্মহত্যার চেষ্টার কথা বললে বৃদ্ধ খুব ঘাবড়ে যাবেন।

তুমি কি ওখানে, মানে, টুলুদের বাড়িতে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

তাহলে একটা চিঠি রত্নাকে দিতে পারবে?

কী চিঠি?

ওর নামে একটা স্কুল থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। বিয়ের আগে ইন্টার দিয়েছিল। তারা অ্যাদ্দিনে চাকরি দিয়েছে। এখন তো এর কোনো প্রয়োজন নেই। তবু যার চিঠি তাকে পৌঁছে দাও। বৃদ্ধ ভেতরে চলে গেলেন চিঠিটা আনতে।

.

টুলু বলল, আমার কিছু করার নেই গোরা। তুই বাবার সঙ্গে কথা বল।

গৌরব বলল, সেকী তোর বউ আর তোর কিছু করার নেই?

এই বাড়িটা এখনও পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। আর আমি নিয়মটা মেনে চলছি। রত্নার সঙ্গে আমার কোনো আন্ডারস্ট্যান্ডিং, আজ অবধি হয়নি। মানসিক অস্থিরতা না থাকলে কেউ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে না! টুলু জানাল

মেসোমশাই কোথায়?

বাবা একটু বেরিয়েছে মায়ের সঙ্গে।

একটু ইতস্তত করল গৌরব। তারপর বলল, আমি একবার রত্নার সঙ্গে দেখা করব।

কেন?

এমনি। তোর আপত্তি আছে?

টুলু বুঝতে পারছিল না কী বলবে। শেষপর্যন্ত মাথা নাড়ল, কাছাকাছি যাস না, একটু আগে আমাকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নেমে আসিস। বাবা পছন্দ করবে না।

ধন্যবাদ। তুই ততক্ষণ এই চিঠিটা পড়। রত্না ওর বাবাকে কদিন আগে যে চিঠি লিখেছিল এটা তার জেরক্স কপি। গৌরব চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল।

রত্না শুয়েছিল চোখ বন্ধ করে। গৌরব ডাকল, রত্না।

চোখ খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস ভঙ্গি করল রত্না, আবার এসেছ? কী চাই তোমার? কাছে এসো না, কামড়ে দেব।

তুমি আমার সঙ্গে পাগলামি করো না।

গৌরবের কথাটা শোনামাত্র রত্না যেন একটু ঘাবড়ে গেল। গৌরব বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই, তোমার বাবার সঙ্গে আমি একটু আগে কথা বলেছি। কথা বলতে বলতে গৌরব রত্নার বাঁধন খুলে দিল। বন্ধনমুক্ত হয়েও রত্না কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে পড়ে রইল। গৌরব ওর হাত ধরল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
 
ওরা যখন নিচে নামছে তখন, সিঁড়ির মুখে মেসোমশাই, মাসীমা। টুলুকে দেখা যাচ্ছে না। মেসোমশাই উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, কী হচ্ছে এসব। কে তোমাকে ওর বাঁধন খুলতে বলেছে?

আপনি অযথা রাগ করছেন। রত্না পাগল নয়।

সেটা ডাক্তার বলবে। তুমি সীমা ছাড়াচ্ছ গৌরব।

না। রত্না আমার বন্ধু। ওর বাড়িতে গিয়ে আমি প্রমাণ পেয়েছি আপনি কি জাল ছড়িয়েছিলেন। ওকে আমি বাড়ির বাইরে নিয়ে যাচ্ছি।

মেসোমশাই চিৎকার করলেন, এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে তোমার জন্যে দরজা চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে বউমা।

গৌরব বলল, ও-আর এখানে আসবে না। আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি– রত্না একটা চাকরি পেয়েছে। মাসে পনেরশো টাকা মাইনে। বছরে আঠারো হাজার।

প্রায় তিরিশ বছর কাজ করলে ও মোট পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকার ওপর রোজগার করবে। মনে হয় এই টাকায় ওর চলে যাবে।

মাসীমা হতভম্ব গলায় বললেন, পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজার! ও বউমা তুমি এই বাড়ির লক্ষ্মী। গোরার কথা কানে নিও না। ভুল বোঝাবুঝি তো মানুষ মাত্রেরই হয়। তুমি এসো আমার কাছে।

রত্না মাথা নাড়ল, না, আমাকে যেতে দিন। আপনার ছেলে কোথায়?

সে নিচের ঘরে। মাসীমা জানালেন।

চলো গৌরব। ওদের বিস্মিত মুখের পাশ দিয়ে রত্না দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গৌরব তার পেছনে। ঘরের দিকে মুখ করে রত্না বলল, আমি যাচ্ছি। তোমাদের কোনো দায় রইল না। স্বচ্ছন্দে তুমি আর একটা বিয়ে করতে পার। কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়াব না। এই হারটা তুমি বিয়ের দিন আমাকে দিয়েছিলে। এটা রইল। পাশের লম্বা টুলের ওপর হারটাকে রাখল রত্না। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, আর হ্যাঁ, বিয়ের পর এই কিছুদিন আগে ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছেয় হোক আমার শরীরে তুমি যাকে দিয়েছ তাকে আমি ফিরিয়ে দেবো না। সে আমার, একান্তই আমার। চলো গৌরব।

গৌরব এবং রত্না বাইরের আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালে রত্না ছেলেমানুষের মতো বলে উঠল, পৃথিবীটা কি সুন্দর, না গৌরব?

.

কলকাতায় পা দিয়েই গৌরব এখন কিছুটা হতভম্ব। বারো বছর একটা শহর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে? এক পা এগোবে না দেশটা? শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া হয়তো পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত থেকে যাবে। অধিকার হস্তান্তর কেউ সানন্দে মেনে নেয় না। কিন্তু এদেশের মানুষ যাদের হাতে পয়সা আছে তারা এখনও ঝি-চাকর নির্ভর হয়ে থাকবে? কখনও কখনও সেই নির্ভরতা যে অধিকারবোধের ফসল হিসেবে আসে তাতে ঝি-চাকরকে ক্রীতদাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনে। অর্থবান এবং আধুনিক রাষ্ট্রগুলো যখন মানুষের সমানাধিকার দিচ্ছে তখন অনুন্নত দেশের কিঞ্চিত মধ্যবিত্ত মানুষ এখনও সেই মধ্যযুগে বাস করছে। মলি কিংবা সৌরভ বিবাহবার্ষিকীর সাফল্য কদিন মনে রাখবে। কিংবা টুলুর ব্যাপারটা? এখানে এসে অবধি তো কাগজে বধূ-নির্যাতন বা হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা পড়ছে। সে এই দেশ থেকে যাওয়ার আগেও নগদ নিয়ে গোলমাল ছিল। এবং এটা নিয়মের মধ্যেই চালু ছিল। কিন্তু নিয়ম ভাঙার চেষ্টাও শুরু হয়েছিল কয়েকদশক থেকে। অথচ এখনকার মতো এত হত্যা নির্যাতনের কথা তখন কাগজে পড়েছে বলে মনে পড়ে না গৌরবের। দেশটা এগোচ্ছে না পিছিয়ে যাচ্ছে।

তেরো সপ্তাহের ছুটি। এখনও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মোলাকাত হলো না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। মনের মতো চাকরি পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টাও করতে হবে। যদি মেলে থেকে যাবে এখানে। এবং সবচেয়ে যেটা জরুরি, জয়তীর দর্শন চাই, সে যে অবস্থায় থাকুক, একবার তাকে দেখতে চায় গৌরব।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top