What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

কলকাতা শহরে নিজের গাড়ি না থাকলে কথা রাখা অসম্ভব। গৌরবের মনে হচ্ছে এই বারো বছরে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু বাস-ট্রাম বাড়েনি। ট্যাক্সিওয়ালাগুলোকে দুতিন টাকা বেশি দিলে যে কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। আমেরিকায় পারতপক্ষে ট্যাক্সিতে চাপে না সে। যে দূরত্ব ভারতবর্ষে ট্যাক্সিতে যেতে পঁচিশ টাকা লাগবে ওখানে তার জন্যে কম করে দুশো টাকা দিতে হবে। তার ওপর আছে টিপস্। কম করে মিটারের শতকরা দশ থেকে পনেরো ভাগ বখশিস দিতে হবে। অতএব যতটা সম্ভব ট্যাক্সিতে এড়িয়ে চলত সে। কিন্তু আমেরিকায় যারা থাকে তারা এক ডলারকে একটা টাকা বলেই মনে করে। অর্থাৎ দুশো চল্লিশ টাকা না ভেবে সেটা কুড়ি টাকা ভেবে নিলে স্বস্তি। কারণ কুড়ি ডলার মানেই দুশো চল্লিশ টাকা। যাহোক টিপস্ যখন ওখানে চালু আছে তখন এখানে সেটা দিতে দোষ কী। ওদেশ থেকে ডলার এনে এদেশে খরচ করার মধ্যে যে আরাম তার তুলনা নেই। ওখানকার দুটাকায় এখানকার চব্বিশ টাকার সুবিধে পাওয়া যায়।

কিন্তু ট্রামে যদিবা হলো বাসের দিকে তাকালে গায়ে জ্বর আসে। তার ওপর আছে জ্যাম। সাধারণত তিনটে কারণে এখানে জ্যাম হয় এবং জনসাধারণ দিব্যি মেনে নেয়। এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না। প্রথম কারণ মিছিল। যে কোনো কারণেই রাজনৈতিক দল বা ট্রেড ইউনিয়নগুলো মিছিল নামায় পথে। এবং তাদের যাওয়াটা এমন রাজকীয় যে সমস্ত যানবাহন জগন্নাথ হয়ে বসে থাকে। ওর মনে হচ্ছিল হাসপাতাল স্টেশন কিংবা জরুরি প্রয়োজনে যাওয়া মানুষদের জন্যে এইসব মিছিলের একটা আলাদা রাস্তা সরকারের করা উচিত। যেখানে মিছিল হলে শহরের মানুষদের কোনো অসুবিধে হবে না। দ্বিতীয় কারণ, আইন না মেনে গাড়ি চালানো। এদেশে পার্কিং লটের ব্যবস্থা নেই। ট্রাফিক রুল বলে যেটা আছে সেটা ছেলেমানুষি। ড্রাইভাররা কোনো নিয়মকানুন মানেন না। আর এই কারণেই গাড়িগুলো জট পাকায়। কলকাতার রাস্তা চওড়া নয়, এবং প্রতিটি নাগরিকের পৈতৃক সম্পত্তি বলে একবার জট পাকালে সেটা খোলা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। তৃতীয় কারণ, ট্রাফিক পুলিশ। জ্যাম হলে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র তৎপরতা দেখা যায় না সেটা ছাড়ানোর। গৌরব নিজে দেখেছে সমস্ত গাড়ি জ্যামে স্থির হয়ে আছে। মোড়ের মাথায় দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশ অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মুখে খইনি ডলছেন হাতে। তারপর সেটাকে মুখে পুরে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলেন একটা গাড়ির পিছনে দাঁড়ানো ঠেলার দিকে। এই পথে সে বেআইনিভাবে ঢুকেছে। অতএব একটা আধুলি হাত বদল হলো। অসহায় শিশুর মতো ফিরে এসে ট্রাফিক পুলিশ তার জায়গায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ভেবেছিল তিনটের মধ্যে কফিহাউস পৌঁছে যাবে গৌরব। কিন্তু ট্যাক্সি নেওয়া সত্ত্বেও সে মেডিক্যাল কলেজের সামনে পৌঁছালো সাড়ে তিনটের পর। আর গাড়ি এগোচ্ছে না। তাকে অনুরোধ করল ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ছেড়ে দিতে। সে ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ট্যাক্সি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল। বন্ধ-ঘরে পুরোনো জিনিসপত্র বাতিল হয়ে যেভাবে স্তূপ অবস্থায় থাকে সেইভাবে ডাবলডেকার, প্রাইভেট বাস, অ্যাম্বাসাডার, মারুতি ট্যাক্সি থেকে ঠেলারিকশা রয়েছে জড়াজড়ি করে। ভাঙা ফুটপাতে মানুষের ভিড়। ইউনিভারসিটির সামনে এসে চমকে গেল গৌরব। জোর বক্তৃতা চলছে। দুদল ছাত্রকর্মচারী আলাদা আলাদা মাইকে জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছে ফলে কারও কথা শোনা যাচ্ছে না। মিটিংয়ের শ্রোতারা ট্রাম রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে যানবাহন চলতে পারছে না। একটিও পুলিশ ধারে কাছে নেই। ওপাশের গাড়িগুলোও তেমনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। গৌরব বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করল। দুপক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করছে। পড়াশুনা সম্পর্কিত কোনো অবিচারকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভ নয়। ছাত্রদের স্বার্থরক্ষার জন্যে এই জেহাদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ক্লাস তিনমাস বন্ধ রাখা হয়েছে বলে উপাচার্যের মুণ্ডুপাত করা হচ্ছে। কিন্তু এই রকম বক্তৃতার মধ্যে কি করে ছাত্ররা ক্লাস করবে তা ভেবে পাচ্ছিল না গৌরব।
 
প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে এসে মনটা ভালো হলো। কলেজের চেহারাটা একই রকমের আছে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল একবার ভেতরে যেতে। কিন্তু হাতে সময় নেই-ই, বরং বেশ দেরি হয়ে গেছে। সে লক্ষ্য করল এখন কলেজের সামনে কোনো উত্তেজক পোস্টার সাঁটা নেই। পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তাপ কি আজকাল কলেজের গায়ে লাগছে না? কে জানে!

কফিহাউসে ঢুকে মনে হলো কতদিন পরে পরিচিত পরিবেশে সে আসতে পারল। সেই চিৎকার নয় অথচ কানের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন, টেবিল উপচে পড়া ছেলেমেয়েদের জমাটি আড্ডা একইরকম রয়েছে। অনেকে এটাকে যৌবনের অপচয় বলে থাকেন। শুধু কথা বলে মূল্যবান সময়টাকে নষ্ট করা। আমেরিকাতেও এইরকম বিরাট জায়গা নিয়ে আড্ডা মারতে সে কাউকে দেখেনি। কিন্তু গৌরবের নিজের কখনই অপচয় মনে হয় না। এই কয়েকঘণ্টা যদি বিভিন্ন পরিবারের ছেলেমেয়ে এক জায়গায় বসে মত বিনিময় করতে পারে তাহলে মনের সঙ্কীর্ণতা কমবে, দৃষ্টিশক্তি জোরদার হবে। কফিহাউসে আড্ডা মেরে জীবনে সফল হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা নিশ্চয়ই কয়েক হাজার। গৌরব একটা বসার জায়গা খুঁজল। কিন্তু কোনো চেয়ার খালি নেই। সুব্রতর সঙ্গে আজ সকালে ফোনে কথা হয়েছিল। ও বলেছিল ঠিক তিনটের সময় এখানে আসবে। সুব্রত পার্ক স্ট্রিটের কোথাও দেখা করতে চেয়েছিল। পুরোনো দিনের কথা ভেবে গৌরবই কফিহাউসের নাম করেছে। সুব্রত এখানকার সরকারের একজন বড় কর্তা। ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিট্রেটিভ সার্ভিসের কল্যাণে অল্প বয়সে যেখানে পৌঁছেছে তা অবশ্যই ঈর্ষার ব্যাপার অনেকের কাছে। তার গলা পেয়ে সুব্রত অবাক হয়েছিল। বারো বছর আমেরিকায় ছিল জানার পর কথা বলার ধরন সহজ হয়েছিল। সুব্রতটা চিরকালই বেশি ইংরেজী বলে। আজও সেই স্বভাবটা রয়ে গেছে। গৌরব ঘড়ি দেখল। পঁয়তাল্লিশ মিনিট নিশ্চয়ই সুব্রত অপেক্ষা করবে না। দেরি করে আসার জন্যে ক্ষমা চাইবে হবে।

ধীরে ধীরে কফিহাউস থেকে বেরিয়ে এল গৌরব। এই প্রায়-বিকেলে একটিও পরিচিত মুখকে দেখতে পেল না সে। বেয়ারাদের মধ্যে তিনজনকে সে চিনতে পেরেছিল। তাকে দেখে রানু একগাল হেসে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল বসবার চেয়ারের ব্যবস্থা করবে কি না! কিন্তু এখন একা একা বসতে খুব খারাপ লাগছিল গৌরবের। হঠাৎই ওর মনে হলো সে যেন এই জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বারো বছরের যোগাযোগহীনতা তার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে খুব বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল নিজেকে।

আর তখনই সে সুব্রতকে দেখতে পেল। শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের ফুটপাতে গাড়িটা পার্ক করছে সে। বারো বছরে সুব্রতর চেহারাটা পাল্টেছে বেশ। শরীরে ভালো মেদ জমেছে, মাথায় টাক শুরু হলেও গায়ের রঙ ফর্সা হয়েছে। জামা-প্যান্টে বেশ স্মার্ট ভাব এসেছে ওর। গৌরব গিয়ে সামনে দাঁড়াল, বিস্মিত হলো সুব্রত। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, সরি, এমন একটা জরুরি মিটিং পড়ে গেল যে, কিছু মনে করিস না।

করমর্দন করে গৌরব বলল, যাচ্চলে। আমি ভাবলুম তুই অপেক্ষা করে ফিরে গেছিস। আসলে জ্যামের জন্য আমিই দেরিতে পৌঁছেছি।

ও তাই নাকি। জ্যাম আমাদের জলভাত। আমেরিকায় তো আরামে আছিস!
 
আমেরিকাতেও জ্যাম হয়। মাঝে মাঝেই। তবে ছেড়ে যায় খুব দ্রুত। কোথায় বসবি? ওপরে একটা চেয়ার খালি নেই, গৌরব জানাল।

টেরিবল! কী করে যে ভদ্রলোকেরা ওপরে বসে! কারও কথা শোনা যায় না, গরম। আমি তো আজকাল ওখানে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। তুই বললি বলে এলাম। আয় গাড়িতে উঠে পড়। সুব্রত আবার দরজা খুলল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবি।

দেখি তোর যোগ্য একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে তো।

গৌরব সুব্রতর গাড়িতে বসতেই ও সামনে এগোল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কলেজ স্ট্রিটের যা ট্রাফিকের অবস্থা, তুই এলি কী করে?

ধুঁকতে ধুঁকতে। এখন আর রিস্ক নেব না। সোজা গলি তস্যগলি দিয়ে বেরিয়ে যাব। তারপর বল আমেরিকায় এতদিন কি করছিলি? সত্যি একটা গলিতে গাড়ি ঢোকাল সুব্রত। পায়ে হাঁটা মানুষ আর রিকশা ছাড়া কোনো গাড়ি বোধহয় এই পথে চলাচল করে না।

গৌরব জবাব দিলো, চাকরি। কম্পুটার নিয়ে পড়েছিলাম। ডক্টরেট করেছি। এখন তাই ভাঙিয়ে খাচ্ছি। মাসে হাজার পাঁচেক দেয় তাতেই চলে যায়।

হাজার পাঁচেক? টাকা না ডলার?

ওদেশে আমরা ডলারকে টাকাই বলি।

সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষল। সুব্রত। বড় বড় চোখে তাকাল। তারপর কোনো মতে উচ্চারণ করল, তুই তাহলে রীতিমত বড়লোক। সকালে ইয়ার্কি মারছিলি?

কোন্ ব্যাপারটা?

এখানে চাকরি পেলে থেকে যাবি, মামারবাড়ি।

না, সিরিয়াসলি। ইয়ার্কি মারতে যাব কেন?

কোন্ চাকুরে ভারতবর্ষে মাসে ষাট হাজার টাকা মাইনে পায়? কে দেবে?

আমি তো ওই টাকা চাইছি না। আমি একটি ভদ্র মাইনে চাইছি যা আমাকে দেশের হয়ে কাজ করতে সাহায্য করবে। গৌরব আন্তরিকভাবে কথাগুলো বলল।

পাগল! ওসব দেশপ্রেম ছাড়। এখানে থেকে কিস্যু হবে না।

তুই নিজে এ দেশের প্রশাসক হয়েও এ কথা বলছিস?

সিওর। এখানে কেউ কাজ করে না। কাজের কথা বললেই আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটির সামনে যা হচ্ছে তা সমস্ত দেশের প্রতীক। তুই খুব ভাগ্যবান যে এদেশ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিস। ওসব চাকরির ধান্দা মাথা থেকে তাড়া। বিয়ে করেছিস?

না। সময় হলো না।

চকিতে সুব্রত তাকাল গৌরবের দিকে, আচ্ছা! তোর একটা কেস ছিল না কলেজে?

কেস ছিল নাকি?

দাঁড়া, দাঁড়া! হ্যাঁ, জয়তী নাম মেয়েটার। ওকে বিয়ে করলি না কেন?

সুযোগ হলো না। আমি চলে গেলাম বিদেশে। বারো বছর দেখা সাক্ষাৎ নেই। আর সময়টা এত দীর্ঘ যে কারও মনের পরিবর্তন হওয়ার পক্ষে অনেকখানি। হয়তো সে এর মধ্যে সংসারী হয়ে গেছে। সময় কারও জন্যে বসে থাকে না সুব্রত।

আমেরিকায় থেকে প্রেম করিস নি?

বন্ধুত্ব হয়েছে, প্রেম জমেনি। জমতে চায়নি।

তুই একটা যাচ্ছেতাই। আমি ছিলাম গাড়িতে। মাসচারেক আগে বালীগঞ্জ প্লেস দিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হলো জয়তী। হাতে কিছু খাতাপত্তর। চেহারাটা একই আছে কিন্তু মুখে বয়সের ছাপ। বাঙালি মেয়েদের যেটা হয় আর কি! সুব্রত এবার বড় রাস্তায় গাড়ি তুলেছে। এদিকটা ফাঁকা। গৌরবের অবশ্য সেদিকে নজর ছিল না। জয়তী বালিগঞ্জ প্লেস দিয়ে খাতা হাতে হাঁটছিল। তার মানে ও নিশ্চয়ই ওই অঞ্চলে থাকে অথবা কাছে-পিঠে স্কুলে পড়ায়। সুব্রতর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হলো। মনে মনে ধন্যবাদ দিলো সে। অবশ্য রত্নাকে জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয়ই একটা হদিশ পাওয়া যেত। কিন্তু ও বেচারা নিজের সমস্যা নিয়ে এতটা বিভ্রাটে যে প্রশ্নটা করার মতো পরিস্থিতি পায়নি গৌরব। যা হোক, একটা মেয়ে কলকাতার স্কুলে পড়ায় আর তাকে খুঁজে বের করা যাবে না এমন হতে পারে না। সুব্রত একটা সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে ধরতে গৌরব মাথা নাড়ল। সুব্রত হাসল, আমেরিকায় গেলে এটা হয়, না? ও দেশের সিগারেটের কোম্পানিগুলো তো উঠে যাবে রে। আমার থিওরি যদ্দিন আছি ভোগ করে যাব।
 
এই ভোগ করার পদ্ধতিটা এক এক জনের এক এক রকম। বিয়ে করেছিস?

চল্লিশের আগে ব্যাপারটা ভাবছি না।

সেকি রে! তখন তো জীবন টলমলে।

সেই কারণেই তখন বিয়ে করা দরকার। টলমলে জীবনটা স্থির করতে আর একজনের সাহায্য চাই।

কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়? গৌরব লক্ষ্য করল তারা ভি. আই. পি. রোডে পড়েছে। এখনও আকাশে আলো। কলকাতার এই অঞ্চলটা সত্যি সুন্দর। এয়ারপোর্ট থেকে আসবার সময় সে এই পথে ফিরেছিল। সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, তোর হাতে সময় আছে তো?

আমি তো বেড়াতেই এসেছি। তবে এখানে আসার পর একটি নিয়ম চালু হয়েছে বাড়িতে। রাতের খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে হবে। অতএব তার আগেই ফিরব।

ঠিক হ্যায়। আমি যদি ফিরতে না পারি তোকে ট্যাক্সি ধরিয়ে দেবো।

কলকাতায় এত রকমের কায়দাবাজ বাড়ি এর আগে দেখিনি। গৌরবের ধারণা হলো বাছাই করা নবীন বড়লোক সল্টলেকে বাড়ি করেছেন। সুব্রত থাকে পার্কসার্কাসে। এখানে ও কোথায় যাচ্ছে টের না পেলেও গৌরবের মনে হলো সুব্রত জায়গাটাকে পছন্দ করে। নেহাৎ পৈত্রিক বাড়ি বলে ছেড়ে আসতে পারছে না। রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে গাড়ি ছাড়া কিছু নেই। লোকজনও হাঁটছে না। বা কোনো শহরের আশেপাশের সঙ্গে চমৎকার মিল আছে।

একটা ঝকঝকে দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সুব্রত। বাড়িটার সামনে ছোট্ট একটা লন, ফুলের গাছ মায় একটা বড় চৌবাচ্চাও রয়েছে। পুরো বাড়িটা যেন কাচে মোড়া। শেষ সূর্যের মরা আলোয় লালচে দেখাচ্ছে। সুব্রত বলল, নাম, এসে গেছি। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই কুকুরের ডাক শুনতে পেল ওরা। সুব্রত বেলের বোতামে চাপ দিতে একটি আধবয়সী মহিলা দরজা খুলে সন্তর্পণে একপাশে সরে দাঁড়াল। ভেতরে পা দিতে দিতে সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, মেমসাহেব কোথায়?

বাড়িতে নেই।

নেই মানে? কোথায় গিয়েছে?

চুলের দোকানে।

ওঃ। আর চুল তৈরি করার দিন পেলে না। বস গৌরব। চা না কফি কী দিয়ে হবে? গৌরব ঠিক ধরতে পারছিল না। তার মুখ দেখে সুব্রত বলল, কফিই হোক। আমরা তো কফিহাউসে গিয়েছিলাম। ভালো করে কফি করো তো। সুব্রত পরিচারিকাকে হুকুম করা মাত্রই সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। যেন যাওয়ার সুযোগ পেয়ে সে খুশি হলো।

চমৎকার গোছানো ড্রইংরুম। সাজানোর মধ্যে রুচির ছাপ আছে। রঙিন টি. ভি. এবং খুব মূল্যবান মাছের ঘর। আধুনিক টেলিফোন। সোফাসেট দেখলে বোঝা যায় অর্থ এবং পছন্দ একসঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আরাম করে বসেই আবার উঠে পড়ল সুব্রত, না, এখানে নয়। আমার একটা ফেবারিট জায়গা আছে, চল সেখানে গিয়ে বসি। বিনা বাক্যব্যয়ে সুব্রতর পেছন পেছন দোতলায় উঠে এল। বাড়িটার ঘর বেশি নেই কিন্তু এমন কায়দায় তৈরি হয়েছে যে মনে হয় বিশাল বাড়িতে এসেছি। দোতলায় ব্যালকনিতে পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসতেই গৌরব অনেকটা খোলা জায়গা আর আকাশ দেখতে পেল। নিচে কালো রাস্তায় সুব্রতর গাড়িটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে যেন তৃপ্তি পেল সুব্রত। তারপর বলল, খুব সৌখিন মেয়ে, বুঝলি।

কে?

কঙ্কা। চুল বাঁধতে গিয়েছে। এখনই চলে আসবে।

বুঝলাম কিন্তু বাড়িতে আর কাউকে তো দেখছি না। আমরা যেভাবে জবরদখল করে বসেছি সেটা খুব ভালো লাগছে না। আর সব কোথায়?

আর কাকে এক্সপেক্ট করছিস?

মহিলার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?

আছে। কিন্তু তারা এ বাড়িতে থাকে না। তুই কি রে! আমেরিকায় আছিস অথচ একজন মহিলা একা আছেন এটা ভাবতে পারছিস না? সুব্রত উঠে বসল।

তাই বল। তবে তার অনুপস্থিতিতে আসাটা আরও অন্যায় হলো না?

ন্যায় অন্যায় জানিনে। তুই আমার সঙ্গে এসেছিস অ্যান্ড দ্যাটস অল।

কঙ্কা নামক মহিলার সঙ্গে তোর কী সম্পর্ক? কিছু মনে করিস না প্রশ্নটা করলাম বলে।

বন্ধুত্ব। কঙ্কা খুব ভালো ছবি আঁকে। ভালো বিক্রি হয়। প্রায়ই একজিবিশান লেগে আছে।

আচ্ছা! গৌরব হাসল, এই প্রথম কোনো আর্টিস্টকে চুল বাঁধার দোকানে যেতে শুনলাম।

তার মানে? যে আঁকে সে চুল বাঁধে না?

আর্টিস্টরা শুনেছি খুব উদাসীন হয়।
 
সেসব দিন পাল্টে গেছে। তুই ব্যাটা ব্যাকডেটেড। কঙ্কা ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অব মাইন। উই জাস্ট স্টে টুগেদার। সুব্রত এতক্ষণে ঘোষণা করল।

সোজা হয়ে বসল গৌরব, তাই বল! ব্যাপারটা এ দেশেও চালু হয়েছে?

অনেকদিন। দুটো মানুষ তাদের ভালা লাগা দিয়েই একসঙ্গে বসবাস করতে পারে। সেটা দেশকালের গভীরে সীমাবদ্ধ নয়। সুব্রত আর একটা সিগারেট ধরাল।

গৌরব অন্যমনস্ক হলো। সুব্রতর ডাকে সে মুখ তুলল, কি অদ্ভুত ব্যাপার। যে দেশে এখনও নগদ টাকা গয়নার চাপ দিয়ে বিয়ে হচ্ছে, দিতে না পারলে কেউ মরছে সে দেশেই স্টে-টুগেদার চালু হয়েছে। আকাশ পাতালের মধ্যেও এত পার্থক্য নেই।

ঠিক সেই সময় নিচে একটা গাড়ি এসে থামল। সুব্রত বলল, এসে গেছে। গাড়ির দরজা খুলে যে মেয়েটি নামল সে ন্যুয়র্কেও থাকতে পারত। জিন্সের প্যান্টের ওপর লাল সার্ট। লম্বা, সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী। মাথার চুল নিতম্ব পর্যন্ত টানটান ইস্ত্রি করা। মুখে চকচকে ভাব। মহিলা শুধু চুল ঠিক করতে যান নি মুখেরও মেরামত করে এসেছেন। কাঁধে ব্যাগ। গেট খুলে কয়েক পা এগোতে ওপরের দিকে তাকাতেই দাঁড়িয়ে গেলেন তারপর চিৎকার করে বললেন, হোয়াট এ সারপ্রাইজ। কখন এলে?

গদগদ গলায় সুব্রত বলল, অনেকক্ষণ। মহিলা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখছিস?

উত্তর দেবার সুযোগ পেল না গৌরব। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এবং তার পরেই ভদ্রমহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন, হা-ই।

গৌরব উঠে দাঁড়াল, নমস্কার।

সুব্রত হাত বাড়িয়ে মহিলার হাত ধরল বসে বসেই, এ হলো কঙ্কা, আর এর নাম গৌরব, আমার কলেজের বন্ধু, আমেরিকায় বড় চাকরি করে। সুব্রতর কথার প্রতিবাদ করল গৌরব, বড় চাকরি কথাটা খুব গোলমেলে। সুব্রতর কথায় কান দেবেন না। হঠাৎ এসে আপনাকে বিব্রত করলাম বোধহয়

মোটেই না। আমি এইরকম ব্যবহারে অভ্যস্ত। বসুন। কফি দিয়েছে?

দিচ্ছে। গৌরব বলছিল, ভালো শিল্পী নাকি চুল নিয়ে মাথা ঘামায় না।

তাই? মহিলা অদ্ভুত ভঙ্গিতে গৌরবকে দেখলেন।

এই সময় সেই কাজের মেয়েটি কফি নিয়ে আসায় আপাতত রক্ষা পেল গৌরব। কঙ্কা কফির কাপ হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমি ভালো ছবি আঁকি আপনাকে কে বলল? আমার ছবি দেখেছেন?

সুব্রত কিছু বলতে যাচ্ছিল। গৌরব বলল, মাপ করবেন। ব্যাপারটা বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর ঠাট্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ওর উচিত হয়নি সেটাকে টেনে আপনার সামনে হাজির করা। এখানকার শিল্প সাহিত্যের কোনো খবর আমি জানি না। সুব্রত বলল আপনি খুব ভালো আঁকেন।

ও ছবির কিছু বোঝে? খুব নির্মোহ ভঙ্গিতে কঙ্কা বলল।

দ্যাটস রাইট, আমি ছবি বুঝি না। সবাইকে সব বুঝতে হবে তার মানে নেই। আমি তোমাকে বুঝি অ্যান্ড দ্যাটস অল।

আশ্চর্য! তুমি আমাকে বোঝো?

চেষ্টা করছি, করে যাচ্ছি।

এইভাবে কথা বোলো না।

গৌরববাবু, আমি কেমন আঁকি জানি না, তবে যেভাবে কাজ করতে ও খেতে হয়, স্নান করতে হয়, টয়লেটে যেতে হয় তেমনি নিজেকে সাজাতেও হয়। আপনার কাছে হয়তো বেমানান ঠেকতে পারে কিন্তু আমি নাচার। ওহো, সুব্রত, একটু বাদে আমার এক বন্ধু আসবে। তোমার খারাপ লাগলে আমার কিছু করার নেই। কঙ্কা উঠে দাঁড়াল।

বন্ধু আসবে! কে?

তুমি সবাইকে চেনো না।

স্টিল! কী রকমের বন্ধু?

ওহো! তুমি কি সব ব্যাপারে আমার কাছে এক্সপ্ল্যানেশন চাইবে?

কঙ্কা আমার খারাপ লাগবে এমন কাজ করছ কেন?

তুমি কী বলতে চাইছ? ক্ষমা করবেন গৌরববাবু, সুব্রত আর আমার মধ্যে এইসব কথাবার্তা আপনার সামনে হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমি জানতাম না আজ ও আপনাকে নিয়ে আসবে। অতএব মার্জনা করবেন।

হ্যাঁ,-–তুমি কী বলতে চাইছ সুব্রত?

কিছুই না। আমাদের মধ্যে চুক্তি ছিল পরস্পরের সম্পর্কে সৎ থাকতে হবে।

চুক্তি? বেশ, তাই মানছি। কিন্তু আমার বন্ধু এলে অসৎ হব কেন?

হতে পার। আমার সন্দেহ হতে পারে।
 
সেটা তোমার অক্ষমতা। সুব্রত, উই লাভ ইচ আদার, তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বসে আছি। এদেশের যা সিস্টেম তা মানব না বলেই আমরা মন্ত্র পড়ি নি বা সই করিনি। অতএব সেই মানসিকতা এখানে টেনে এনো না। তোমার যদি আমার বন্ধুকে পছন্দ না হয় তুমি চলে যেতে পার আজ। না না গৌরববাবু আপনি বসুন। আপনি প্রথম এলেন আর তাছাড়া আমার বন্ধুকে নিয়ে আপনার কোনো কমপ্লেক্স থাকার কথা নয়। কঙ্কা হাসল।

সুব্রত অত্যন্ত আহত গলায় বলল, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

চোখের বাইরে কিছু ঘটলে প্রতিক্রিয়া কম হয়, তাই।

বাঃ আমি যদি তোমার চোখের বাইরে পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ঘুমোই তাহলে তুমি সহ্য করতে পারবে? মানতে পারবে? উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল সুব্রত।

প্রথম কথা, পাঁচটা মেয়েকে ট্যাকল করার মানসিকতা তোমার আছে কি না সন্দেহ। দ্বিতীয়ত, তুমি বাইরে কি করছ তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি চাইব তুমি আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার কর, কেয়ার নাও এবং অপমান কোরো না। দ্যাটস অল। উই আর লিভিং টুগেদার, সপ্তাহে দুদিন উই আর স্টেয়িং টুগেদার টু। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক হলো পেঁয়াজের মতো। খুব টাইট, বড়সড়। কিন্তু যদি তুমি মূর্খ হও তাহলে খোসা ছাড়াবার চেষ্টা করবে। ছাড়াতে ছাড়াতে আলটিমেট শূন্যতায় পৌঁছাবে এবং আঙুলে গন্ধ হবে। সো ডোন্ট ট্রাই ফর ইট। আসুন গৌরববাবু আপনাকে আমার ছবি দেখাই।

গৌরব সুব্রতর দিকে তাকাল। সুব্রত বলল, কঙ্কা চাইছে না আমি আজ থাকি। কে আসছে জানি, তবে কঙ্কার ব্যাপারে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহ্য করতে পারি না আমি। আমি যাচ্ছি, তুই ছবি টবি দেখে চলে যাস।

সেকি! তোর সঙ্গে এলাম আর

আপনি কি আমার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না? কঙ্কা হাসল, আগামীকাল আপনি একা এখানে এলে সুব্রত অবশ্য আপনাকেও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববে।

স্টপ ইট। চিৎকার করে উঠল সুব্রত, ভীষণ বাড়াবাড়ি করছ।

চিৎকার কোরো না। আমার চিৎকার সহ্য হয় না।

তুমি ভুলে যাচ্ছ কঙ্কা আমি তোমার জন্যে কি করেছি! আমার বন্ধুর সামনে তুমি আজ আমাকে অপমান করছ। তোমার কাছে এলাম কোথায় আনন্দ করতে তা না–

আনন্দ করতে আমার কাছে। কলকাতা শহরে আনন্দ দেবার জন্যে কি কোনো মহিলা আজ তৈরি নেই? চাবুকের মতো কথাগুলো ছুড়ল কঙ্কা। এবং এই সময় একটি ট্যাক্সি এসে থামল নিচে গেটের সামনে। ট্যাক্সি থেকে নামলেন একটি বিদেশিনী মহিলা। কঙ্কা চিৎকার করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিচু গলায় বলল, আমার বন্ধু, যার কথা বলছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল সুব্রত, ওহো! তুমি একটি জিনিস। এতক্ষণ বলো নি কেন যে তোমার বান্ধবী আসছে। তুমি যা নাটক করতে পার না সোনা!

পারি, না? উদাস গলায় বলল কঙ্কা।

গৌরব এবার নমস্কার করল, আপনারা গল্প করুন। সুব্রত এবার তুই থাকতে পারিস মনে হয়। আমি চলি। তারপর সেখান থেকে চিৎকার করে বলল, ট্যাক্সি দাঁড়ান। সুব্রত হতভম্ব হয়ে গেল চলে যাবি মানে? তুই তো বললি ডিনার অবধি ফ্রি!

একটা ব্যাপার মাথায় ছিল না। কঙ্কা, আজ চলি। আপনাকে আমার অভিনন্দন। তবে একটা কথা, আকাশের গায়ে যতই রঙের তুলি বোলান তা ধোপে টেকে না। একসময় নিশ্চয়ই ক্লান্তি আসবে তাই না?

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে নেমে এল। দরজার গোড়ায় বিদেশিনীর সঙ্গে মুখোমুখি। মহিলা হেসে বললেন, হাই!


গৌরব মাথা নাড়ল, হাই। কঙ্কা ইজ দেয়ার। মাথা ঘোরাতে সে কঙ্কাকে দেখতে পেল। সিঁড়ির মুখে পাথরের মতো মুখ নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। সে হেসে বলল, আপনার সঙ্গে আবার দেখা করার ইচ্ছে রইল। ট্যাক্সিতে বসে রুমালে মুখ মুছল সে। সুব্রত কঙ্কা স্বামী-স্ত্রী নয়, কিন্তু পরস্পরকে ভালবাসে কি না তাতেও সন্দেহ হচ্ছে। যেই মহিলা ট্যাক্সি থেকে নামলেন অমনি সুব্রতর সব বদলে গেল? এতক্ষণের ঝগড়া, অস্তিত্ব নিয়ে কামড়াকামড়ি সব থেমে গেল? আর সেইটেই তাকে বাধ্য করল উঠে আসতে। কঙ্কাকে ভালো লাগছিল তার। মেয়েটার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা স্বচ্ছ। কিন্তু ব্যাপারটা কী হলো? কলকাতা শহরে এখন একটি মেয়ে একা যে কোনো পুরুষবন্ধুর সঙ্গে আইনের বন্ধন ছাড়াই নাক তুলে বসবাস করতে পারে? অবশ্য সুব্রত সপ্তাহে পাঁচ দিন ওই বাড়িতে থাকে না। কিন্তু তার আচরণ টিপিক্যাল স্বামীর মতনই। গৌরবের অস্পষ্ট ধারণা হচ্ছিল কলকাতার কিছু মানুষ খুব দ্রুত ইউরোপ আমেরিকাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছে। কিন্তু আদলটা রপ্ত করলেও সেখানকার মানুষদের নির্মোহ দৃষ্টিটা নিতে পারেনি। এক্ষেত্রে এরা দেশীয় সেন্টিমেন্ট আর পুরুষজাতির দখলদারি মনোভাবটা ত্যাগ করতে পরেনি। ফলে একটা দোঁআশলা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। যদিও এটা খুব সামান্য পুরো দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কিন্তু তা ব্যাপক হলে যে অবস্থা দাঁড়াবে তা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল গৌরব। ভি. আই. পি. রোডে পৌঁছে ট্যাক্সিড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল তাকে কোথায় যেতে হবে। এখন সবে সন্ধে। বাড়িতে ফেরার বদলে শোভাবাজারের দিকে যেতে বলল গৌরব।
 
গলির মুখে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলো গৌরব। কলেজে পড়ার সময় সে শেষবার এখানে এসেছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকায় এখনও কয়লার ধোঁয়া, রকে আড্ডা একই ভাবে চলছে যা সে দীর্ঘকাল আগে দেখে গিয়েছিল। এই গলিতেই পিসীমার বাড়ি। পিসীমার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এককালে খুব নিবিড় ছিল। শৈশবে সে পিসীমাকে যখনই দেখেছে তখনই একটা স্নেহজ সম্পর্ক যা এখনও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে যখন তাদের অবস্থা ভালো হচ্ছিল, যখন তারা দক্ষিণ কলকাতায় স্থায়ী বাস শুরু করল তখন থেকেই পিসীমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা আলগা হতে আরম্ভ করছিল। ফিরে এসে সে মায়ের কাছে শুনেছিল দাদা বউদি আর ওখানে যাওয়ার সময় পায় না। পিসীমারাও আসে না। পিসেমশাই নাকি একবার দাদার অফিসে গিয়ে তিনশো টাকা ধার নিয়ে এসেছিলেন। সেটা শোধ না করায় বউদি খুব উষ্ণ। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। যখন কেউ ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেয়ে যায় তখন তার যেমন নিজের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, নিচের মানুষরাও ঈর্ষায় তাকে এড়িয়ে চলে। গৌরবের ধারণা তাদের এবং পিসীমার সম্পর্ক এইরকম।

পাড়াটা যে অনেককালের তা বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। পিসীমাদের বাড়ির সামনে এসে গৌরবের মনে হলো এতগুলো বছরে একটুও পাল্টায়নি। কেউ যত্ন নেয়নি বাড়িটার, রঙ ছোঁয়ানো হয় নি কতকাল। একটি বাচ্চা ছেলে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল, ওকে দেখে থমকে গেল। গৌরব অনুমান করল দুই দাদার ছেলেমেয়েদের একটি। ততক্ষণে ছেলেটি ভেতরে ফিরে গিয়ে চেঁচাচ্ছে, মা, দেখ, একটা লম্বা লোক আসছে।

গৌরব দাঁড়িয়ে পড়ল। এইভাবে কেউ আগমন ঘোষণা করবে সে চিন্তা করেনি। সে মোটেই বেঁটে নয় কিন্তু এই মুহূর্তে লম্বা হওয়া প্রশংসা না নিন্দের তা বুঝতে পারল না। চিৎকার শুনে একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখল সে মাথায় ঘোমটা খুব সামান্য টানতে টানতে। বড় বউদির শরীরে বয়সের মেদ লেগেছে কিন্তু চেহারা আগের মতো নেই। বড় বউদি একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে আপনি? কাকে চাই?

গৌরব রসিকতা করার লোভ সংবরণ করতে পারল না, চাইব অনেক কিছু, কিন্তু এখন আপনাকে হলেই চলবে। আছ কেমন সব?

রাগ করতে গিয়ে চিনে ফেললেন বড় বউদি। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় মেশানো খুশির হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে, ওমা, তুমি! কি আশ্চর্য! দেখ, আমরিকা থেকে গোরা এসেছে। চিৎকার করে শেষ বাক্যটা ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বড় বউদি এগিয়ে এলেন, কি সুন্দর দেখতে হয়েছ গো, আমি একদম চিনতে পারিনি।

গৌরব উঠে এল, যাই বলো, বারো বছরে তুমি ভুলে যাচ্ছ এটা মোটেই ভালো কথা নয়।

বড় বউদি ওর হাত ধরলেন, কবে এলে? তোমাদের বাড়ির সঙ্গে তো কোনো যোগাযোগ নেই, এখানে না এলে জানতেও পারতাম না তুমি এসেছ। চলো, ভেতরে চলো। খুব অবাক করে দিয়েছ।
 
এই সময় দরজায় আর একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। বড় বউদি যেন তাকে এই মুহূর্তে আশা করেন নি। ভেতরে ঢুকতে গেলে ওঁর পাশ দিয়েই যেতে হবে। বড় বউদি বললেন, তোমার ছোট বউদি। তুমি অবশ্য যাওয়ার আগে দেখনি। বিয়ে হয়েছে আট বছর।

সঙ্গে সঙ্গে ছোট বউদি হাত তুলে নমস্কার করতেই গৌরব তা ফিরিয়ে দিল। ছোট বউদির বয়স তিরিশের কাছে। স্বাস্থ্য ভালো। শরীরে সুখের আলো মাখামাখি। সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েই তিনি বললেন, আমার পরিচয় তো শুনলেন, আট বছরে আটাশবার আপনার গল্প ওঁর কাছে শুনতে শুনতে আপনি আমার খুব চেনা মানুষ হয়ে গেছেন। কবে এলেন আমেরিকা থেকে?

এইতো কদিন হলো। আপনাদের বিয়ের খবর ওখানে বসেই পেয়েছিলাম। ছোটদা বাড়িতে আছে?

ওমা, ছোটদা না থাকলে বুঝি ঘরে আসবেন না? আসুন আমার ওখানে। ছোট বউদি ভেতরে এগিয়ে গেলে বড় বউদি বললেন, তা হবে না গোরা, আমি বড়, আমার ঘরে তোমাকে প্রথমে যেতে হবে। ওঃ, কতদিন পরে দেখছি তোমাকে। কি ভালো লাগছে যে কি বলব!

সঙ্গে সঙ্গে ছোট বউদি বললেন, আমি তো আর ওসব কথা বলতে পারছি না। তবে নতুন মানুষের কথা আগে রাখতে হয়। ছোট বউদি হিসেবে আমার আব্দার আগে গোরা ঠাকুরপো!

ঠিক তখনই বড়দাদা বেরিয়ে এলেন। পরনে লুঙ্গি এবং গলায় গামছা জড়ানো। হয়তো বাথরুমে গিয়েছিলেন ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এসেছেন তড়িঘড়ি, আরে গোরাসাহেব যে! বাঃ, চমৎকার চেহারা করেছিস তো। কবে এলি? আয় আয় ভেতরে আয়।

যাচ্ছি। হারহাইনেস কোথায়? তাঁকে দেখছি না?

বড় বউদি না বুঝে বললেন, কার কথা বলছ?

আরে সেই মহিলা যিনি তোমার শ্বাশুড়ি হন। গৌরব ততক্ষণে বাড়ির ভেতরের লম্বা প্যাসেজটায় চলে এসেছে। প্যাসেজটার শেষে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বাড়িটায় যদি বারো বছরে হাত না দেওয়া তাহলে দোতলায় ছাদে একটিই ঘর। আর বাড়াতে পারেননি পিসেমশাই পয়সার অভাবে। নিচের প্যাসেজের দুপাশে ঘর। সম্ভবত দুই দাদার দুই অংশ।

বড়দা বললেন, বোস না, মাতৃমন্দিরে না হয় পরে যাবি।

মাতৃমন্দির? গৌরব অবাক চোখে তাকাল।

ওই ওপরে। হাত দিয়ে সিঁড়ির প্রান্ত দেখিয়ে দিলেন বড়দা, গৌরব বলল, না বড়দা, আগে পিসিমা পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। তারপর আড্ডা মারা যাবে।

বড় বউদি অখুশি মুখে বললেন, আমি চা করছি আর চিড়েভাজা। তোমার খারাপ লাগবে?

দারুণ। কতকাল চিড়েভাজা খাইনি।

তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এস। বড় বউদির অখুশি ভাবটা সামান্য কমল। সঙ্গে সঙ্গে ছোট বউদি জানালেন, না ঠাকুরপো, নতুন পরিচয় হলো, আজ অন্তত আমার হাতে চা খেয়ে যাও। ঠাণ্ডা হয়ে আসার আগেই নেমে পড়ো কিন্তু।

গৌরব আর দাঁড়াল না। সে এমনভাবে হাত নাড়ল যাতে সবাই যে যার নিজের মতো মনে করে নিতে পারে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ও এটুকু বুঝতে পারল দুই বউদির মধ্যে বোধহয় সম্পর্ক ভালো নেই। রান্না যে আলাদা হয় তা চা-তৈরির ব্যাপারটা থেকে বোঝাই যাচ্ছে।

ছাদে উঠে গৌরব দেখল এখনই এই সন্ধেবেলায় প্রচুর জামা প্যান্ট কাপড় তারে মেলে দেওয়া আছে। সে একটিমাত্র ঘরের দিকে এগোতেই সুইচ বন্ধ করার শব্দ হলো। ততক্ষণে দরজায় পৌঁছে গেছে সে। পিসীমা দ্রুত হাতে হিটারের তারটা খুলছিলেন, ওকে দেখে স্থির হলেন। পিসীমার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল তার। শৈশবের অনেকটা অংশ জুড়ে এঁর স্মৃতি। ওর সমবয়সী একটি মেয়ে ছিল পিসীমার। সুধা। সুধার বিয়ে হয়ে গেছে এখন। কিন্তু গৌরব জন্মাবার পর সরলা খুব শক্ত অসুখে পড়েছিলেন। তখন গৌরবকে কাছে রেখেছিলেন পিসীমা। তার বুকের দুধ ভাগ করে খেয়েছে সুধা আর গৌরব। সেই পিসীমার চেহারা এখন আর তেমন নেই। প্রায় কঙ্কালের ওপর একটু আস্তরণ। গাল বসে গেছে, চোখ কোটরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা স্নেহময়ী ভঙ্গী রয়েছে প্রকাশে। মাথার ঘোমটা টেনে পিসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, কে?

গৌরব জুতো খুলে অন্ধকারে থেকে আলোয় আসার জন্যে ঘরে ঢুকল, আমায় চিনতে পারছ পিসীমা?
 
সঙ্গে সঙ্গে পাশের খাটে শব্দ হলো। ধীরে ধীরে সেখানে কেউ উঠে বসছে। পিসীমা যেন পাথরের মতো জমে গেছেন। তার দৃষ্টি গৌরবের ওপর স্থির। হঠাৎ ফোয়ারার মুখ থেকে চাপা-পাথর সরে গেল। ওই শীর্ণ শরীর সোজা হয়ে গেল। পিসীমা চিৎকার করে উঠলেন আনন্দে, ওমা, গোরা! দেখ দেখ, গোরা এসেছে, কবে এলি গোরা, তুই কবে এলি? প্রায় ছুটে এসে তিনি জড়িয়ে ধরলেন গৌরবকে।

হৃদয়ের উত্তেজনা যখন শরীর ছড়িয়ে যায় তখন অন্ধও তার প্রকাশ বুঝতে পারে। গৌরব কিছুক্ষণ সময় নিল, কেমন আছ তুমি?

আমি, কেমন দেখছিস?

খুব, খু-উব রোগা হয়ে গেছ তুমি।

না রে ভালো আছি। রোগা হওয়া ভালো। তোকে যে আবার দেখতে পাব ভাবি নি। গৌরব এবার পিসীমাকে প্রণাম করে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। পিসেমশাই চশমা হাতড়াচ্ছেন, গৌরব সেটাকে খাটের একপাশ থেকে তুলে ওঁর হাতে দিয়ে বলল, পাদুটো দেখি।

চশমা পরে পিসেমশাই ওর হাত ধরলেন, না না প্রণাম করতে হবে না। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে নেই।

এই অসময়ে শুয়ে আছেন কেন?

দেখ না, ঠাণ্ডা জলে স্নান করে তিনদিন হলো জ্বর বাধিয়েছে। আজ একটু কম। পিসীমা আস্তে আস্তে ফিরে হিটারের সঙ্গে তারটি যুক্ত করে সুইচ অন করলেন। গৌরবের খেয়াল হলো তার পায়ের শব্দ টের পেয়ে হিটার অফ করেছিলেন পিসীমা! কেন?

একটা মোড়া টেনে পিসীমার সামনে বসতেই পিসেমশাই খাটের ওপর বসে বললেন, আমেরিকায় এত দিন থেকে গোরা বেশ ফর্সা হয়ে গেছে না?

গৌরব খুব হাসল, আমাকে ফর্সা বললে আমেরিকানদের চোখ কপালে উঠবে। তারপর বলো, তোমাদের খবরাখবর কী?

পিসেমশাই জবাব দিলেন, আমাদের খবর? আছি, বেঁচে আছি।

পিসীমা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অমন করে বলছ কেন? ছেলেটা কত দিন পরে এল, ভাববে তোমার খুব কষ্ট। বুড়ো হলেই এইভাবে কথা বলতে হবে?

না কষ্ট কোথায়। শরীরটা নিয়েই যা। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছেলেরা যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত। তা গোরা, আমেরিকা দেশটা কি রকম? পিসেমশাই প্রশ্ন করলেন।

কী ব্যাপার জানতে চাইছেন?

এই খাবার দাবার, জীবনযাত্রা?

ভালো। এখনও সস্তায় মুরগির মাংস, দুধ পাওয়া যাচ্ছে। সস্তা মানে এখানকার চাইতেও সস্তা। রাস্তাঘাটে ধোঁয়া বা ময়লা নেই। বেড়াবার জায়গা আছে। সামান্য পরিশ্রম করলে ভালো রোজগার করা যায়। সরকার আপনাকে অধিকার দেবে কিন্তু অন্যের অসুবিধে করলে ক্ষমা করবে না। এই আর কি!

বাঃ, আর কি চাই! এইটুকু যদি এখানে পেতাম আমরা! ওখানকার বুড়ো বুড়িদের অবস্থা?

পিসেমশাই প্রশ্ন করা মাত্র পিসীমা বললেন, ওহো, তুমি একাই কথা বলছ। গোরা, চা খাবি তো? তোকে চায়ের সঙ্গে ঘরে ভাজা নিমকি দিতে পারি।

দারুণ। চটপট করো।

কেন, তাড়া কীসের? হ্যাঁরে, বউদি কেমন আছে? সৌরভ?

সবাই ভালো আছে।

আমাদের তো যাওয়াই হয় না। সৌরভের বউ নাকি অন্যরকম।

পিসীমা, সবাই তো আর একরকম হয় না। গৌরব লক্ষ্য করল পিসীমা হিটার অফ করে তার খুলে নিলেন। তারপর সন্তর্পণে চোখের আড়ালে হিটারটাকে চালান করে দিলেন।
 
গৌরব পিসেমশাইকে আমেরিকার বৃদ্ধদের গল্প করতে পারত। সেখানকার বাবা-মায়েরা সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর যেমন আর কোনো দায়িত্ব বহন করেন না তেমনি সন্তানও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না। অবসর নেবার পর সেই কারণেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার হাতে পয়সা থাকে। সন্তান বা নাতি-নাতনীদের সম্পর্কে আগ্রহ থাকলেও একসঙ্গে আর বাস করা হয় না। সেই সময় তারা নিজেরাও নির্জনতা পছন্দ করে। কেউ কেউ যদি সন্তানের জন্যে কাতর হন তাহলেও তাকে বিচ্ছেদ সইতে হবে। যেহেতু রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব অনেকটা বহন করে তাই কোনো বড় বিপাকে পড়েন না। কিন্তু নিঃসঙ্গতা রোগের শিকার হওয়া ছাড়া কোনো উপায় খোলা থাকে না। ওদেশে এখন মাদারস্ ডে ফাদারস্ ডে চালু হয়েছে। সেইদিন সন্তানেরা একটা অভিনন্দন জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। এদেশের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা হয়তো অর্থনৈতিক অসুবিধেয় বাস করেন কিন্তু তারা অন্তত সন্তানদের কাছাকাছি পান আমৃত্যু। এইসব কথা বলতে পারত গৌরব। কিন্তু একজন বৃদ্ধের কাছে আর একজন বৃদ্ধের নিঃসঙ্গ ছবি তুলে ধরতে ইচ্ছে করল না। হোক না সেই বৃদ্ধ অপরিচিত?

ঠিক এই সময় একটি বালক দরজায় এসে দাঁড়াল। তার ভঙ্গিতে কিছু লুকোনোর চেষ্টা। গৌরবকে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না। গৌরব ওকে চিনতে পারল। সে যখন এই বাড়িতে পা দিয়েছিল তখন এই বালক তাকে দেখে চেঁচিয়ে বড়বউদিকে ডেকেছিল। পিসীমা ছেলেটিকে দেখে উঠে গেলেন, এনেছিস?

ছেলেটি মাথা নেড়ে, হ্যাঁ, বলতে বলতে পকেট থেকে একটার পর একটা আলু বের করতে লাগল। উজাড় করে দিয়ে ছেলেটি বলল, আড়াইশো গ্রাম। কুড়ি পয়সা ফেরত এসেছে।

পিসীমা গৌরবের দিকে পেছন ফিরে আলুগুলো নিয়ে বললেন, লক্ষ্মী ছেলে। তারপর নিজের জায়গায় চলে এসে আলুগুলো বাটিতে রেখে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বড়র ছেলে, রাজা। খুব ন্যাওটা আমার। পকেট থেকে ওইভাবে আলু বের করা, আড়াইশো গ্রাম ওজনের কথা বলা এবং খুচররা পয়সা ফেরত দেওয়া–এসবেই প্রমাণ করে ছেলেটি ওই বস্তু দোকান থেকে এনেছে। কিন্তু ঠোঙায় বা ব্যাগে না এনে পকেটে লুকিয়ে আনল কেন? এবার ছেলেটি যেন কিছুটা ধাতস্থ হলো। এই সময় পিসীমা চা এবং নিমকি এগিয়ে দিলেন গৌরবের সামনে। আর তখনই পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দরজায় বড় বৌদি। হাতে চায়ের কাপ এবং একটা বাটিতে চিড়ে ভাজা, এই যে গোরা ঠাকুরপো, তোমার চা চিড়ে ভাজা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এখানে খেয়ে নাও। এই রাজা, তোর বাবা কাগজ চাইছে। কাগজ নিয়ে গিয়ে পড়তে বসো।

গৌরব জিনিসগুলো নিয়ে সামনে রেখে বলল, বসে পড় বউদি। দাদাকেও ডাকো। জমাট আড্ডা হোক।

না ভাই, নিচে অনেক কাজ পড়ে আছে। তুমি বরং খেয়ে নিয়ে নিচে চলে এস। বউদি ব্যস্ত পায়ে নিচে যাওয়া মাত্র রাজা বলল, তাড়াতাড়ি কাগজ দাও, বাবা বকবে।

পিসেমশাই বললেন, সারা সকাল দুপুর কাগজ রেখেও ছাই কি যে পড়ে ওরা? আমার এখনও এডিটরিয়াল পড়া হয় নি। একটু বাদে দিচ্ছি।

পিসীমা বললেন, আহ! ছেলেটা সারাদিন খেটেখুটে এল। নিশ্চয়ই কোনো দরকারি কিছু দেখতে চাইছে। নিয়ে যা বাবা, ওই ওখানে আছে।

রাজা টেবিলের ওপর থেকে কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আবার পায়ের শব্দ, এবার ছোট বৌদি। পিসীমা বললেন, এস বউমা। গোরা, তুই ওকে দেখিসনি। ছোটর বউ। ভারি ভালো মেয়ে। ওমা, তুমিও চা নিয়ে এলে যে!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top