What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

ছেলেটির কথা শেষ হওয়ামাত্র মেয়েটি বড় বড় পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে এল। গৌরব বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। বোতাম টিপল অসহিষ্ণু ভাবে। গৌরব কথা বলল না। লিফট এলে সে মেয়েটির পাশে দাঁড়াল। মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে আছে ওপাশে। লিফট নিচে নামলে হঠাৎ সে হিংস্র চোখে তাকাল আপনি কী চান? কেন আমাকে অপমান করলেন?

গৌরব হাসল, ব্যাপারটা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি চাই তুমি বাড়ি ফিরে যাও। এই আড্ডায় তুমি রোজ আস?

না। প্রত্যেক শনিবারে এরা এখানে বসে। মেয়েটি আবার মুখ ফেরাল।

এই যে এরা ড্রাগ খাচ্ছে, তুমি খাও?

না। একদিন গাঁজার কল্কেতে টান দিয়েছিলাম বিশ্রী লেগেছিল। ড্রাগ খেতে এখনও সাহস পাচ্ছি না। এসব কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?

এইভাবে এলে একসময় তুমি সাহস অর্জন করে ফেলবে।

তাতে আপনার কী?

আমার কিছুনা। তোমার মতো স্মার্ট সুন্দরী মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে ভেবে একটু খারাপ লাগছে এই মাত্র। এদের বাবা-মা কোথায়?

এত প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।

তাহলে তোমাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

আপনি কী চান?

তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।

হঠাৎ মেয়েটি গটগট করে হেঁটে গৌরবের বাইকের কাছে পৌঁছে গেল। তারপর ডাকল, চলুন। বাইকে স্টার্ট দিয়ে মেয়েটিকে বলল গৌরব, ডাইরেকশন দাও, কোনো রকম চালাকির চেষ্টা কোরো না। তোমার নাম শুনলাম টিনা, পুরোটা কী?

মেয়েটি কোনো উত্তর দিলো না। সে যে পেছনের সিটে বসে আছে তাও যেন টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে বাঁ দিক কিংবা ডান দিক বলে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। গৌরব ঠিক করল, টিনার বাবা-মাকে সে ডাকবে। সমস্ত ঘটনা খুলে বলবে এবং ভবিষ্যতের জন্যে সতর্ক হতে অনুরোধ করবে। সুযোগ পেলে দুজনকে একটু বুঝিয়ে দেওয়া যাবে এভাবে মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে তাঁরা ভালো কাজ করছেন না। বিশেষ ধরনের নয়, মাল্টিস্টোরিড একটা বাড়ির সামনে টিনা ওকে বাইক থামাতে বলল। ফুটপাতে উঠে জিজ্ঞাসা করল, নামবেন না? আমাকে পৌঁছে দিতে এসেছেন তো!

গৌরব খোঁচাটা বুঝল। সে বাইক বন্ধ করে মেয়েটিকে অনুসরণ করল। এবাড়ির লিফটও এত রাতে নিজেকেই চালাতে হয়। চারতলার একটা ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে টিনা দাঁড়াল, তারপর মিনিটখানেকের মধ্যে তিনবার বেল বাজাল। গৌরব অবাক হলো, কেউ খুলছে না কেন? এবার টিনা নিজের ব্যাগ থেকে চাবি বের করল। দরজা খুলে ভেতরে পা দিয়ে ডাকল সে, আসুন।
 
ঘরে আলো জ্বলছিল। এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সোফায় শুয়ে আছেন মুখ হাঁ করে। তাঁর পায়ের জুতো টেবিলের ওপরে। টিনা বলল, আমার বাবা। ভদ্রলোক যে অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রতিক্রিয়ায় অচেতন হয়ে রয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। ওপাশের দুটো ঘর থেকে ঘুরে এসে টিনা বলল, এটা পড়ে দেখুন। মা রেখে গেছেন।

এই রকম পরিবেশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল গৌরব। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল, দ্রুত হাতে লেখা রয়েছে, খেয়ে শুয়ে পড়বে। আই অ্যাম গোয়িং আউট ফর দ্য নাইট টু অ্যাটেন্ড এ পার্টি। গৌরব মুখ তুলে টিনাকে দেখল।

টিনা হাসল, আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আপনি। কিন্তু বলতে পারেন আমি কেন বাড়িতে ফিরব? প্রতি শুক্র এবং শনিবার রাতে আমাকে একা থাকতে হয়। বাবার সঙ্গে কথা বলা যায় না, মা থাকে না। আমি একা, একা এই বন্ধ ফ্ল্যাটে হাঁপিয়ে উঠি। মন খারাপ হয়ে যায়।

তুমি ওঁদের একথা বলেছ?

বলেছি কিন্তু কেউ শোনেনি।

ও। কিন্তু তুমি বড় হয়েছ। নিজেকে নষ্ট করো না। পড়াশোনায় মন দাও। গৌরব দরজার দিকে এগোল। হঠাৎ টিনা চিৎকার করে উঠল, না। আপনি আমাকে ফেলে যাবেন না।

কোথায় যাবে তুমি?

যেখানে হোক। কোথাও জায়গা না থাকলে আমার বন্ধুদের ওখানে রেখে আসুন।

এখন কত রাত খেয়াল আছে?

রাত? ভোরের আগে এ বাড়িতে রাত আসবে না।

কিন্তু তুমি বুঝছ না কেন এখন তোমার বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

এখন আমি এখানে থাকলে হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলব।

গৌরব টিনাকে দেখল। এই ফ্ল্যাটে পা দেবার পর থেকেই মেয়েটার আচরণ যেন পাল্টে গিয়েছে। কথার ধরনেই মনে হচ্ছে খুব স্বাভাবিক ও নেই। দ্বিধা কাটিয়ে গৌরব বলল, ঠিক আছে, এসো তুমি।

এখন মধ্যরাত। কলকাতার নির্জন রাস্তায় গৌরব টিনাকে বসিয়ে সমানে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। একটা পুলিশ ভ্যান ওদের থামাতে গিয়েও থামাল না। গৌরব একবার ভাবল টিনাকে নিয়ে মায়ের কাছে যাওয়া যাক। কিন্তু অত রাতে সেটাও একটা নাটকের মতো লাগবে। অথচ ওকে কিছুতেই বন্ধুদের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া যায় না। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধুদের মা-বাবা কিছু বলে না? ওরা রাত্রে বাড়িতে নেই!

জানেই না। আমার বন্ধুদের মা-বাবাও শনিবার রাত্রে বাড়িতে থাকে না। তাই তো এক একদিন এক একটা ফ্ল্যাটে ওদের আসর বসে।

ঠাকুমা কাকারা সেসব ফ্ল্যাটে নেই?

না। এখন সবাই হাম দো আউর হামারা এক।

ভোরের আগে লেকের একটা স্টাচুর ধারে বাইক রাখল গৌরব। বেশ ক্লান্ত লাগছে এখন। অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। জ্বলন্ত আলোগুলো বেশ হলদে হলদে। লেকের জল কালচে সবুজ। ওরা পাশাপাশি বসেছিল। একটা ধাপের ওপর। হঠাৎ টিনা বলল, আজ আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম, না? গৌরব কোনো উত্তর দিলো না। কথাটা সত্যি, কিন্তু কষ্টটা সে যেচে নিয়েছে। এরপর কেউ কোনো কথা বলছিল না। ধীরে ধীরে অন্ধকার উঠে যাচ্ছিল গাছের মাথায়। হঠাৎ বয়স্ক গলায় উচ্চারিত হতে শুনল সে সূর্যবন্দনা। পরিষ্কার সংস্কৃতে। টিনা জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন ভদ্রলোক?

গৌরব হাসল, যাও গিয়ে জিজ্ঞাসা কর। এই জলের ধারেই তো উনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
 
টিনা উঠল। কাছে গিয়ে দেখল, কেবল একজন বৃদ্ধ হাতজোড় করে পূবাকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। সংস্কৃতের বিন্দুবিসর্গ সে বুঝছে না। কিন্তু পুবের আকাশ ক্রমশ লাল হয়ে এল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল লাল বলের মতো সূর্য। প্রণাম সেরে ভদ্রলোক পিছু ফিরতেই টিনাকে দেখে হাসলেন। আর সেই মুহূর্তে একটি বালক ছুটতে ছুটতে এসে ওঁকে জড়িয়ে ধরে কিছু বলল।

বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বালককে সঙ্গে নিয়ে টিনার পাশে উঠে এলেন।

টিনা বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি কী করছিলেন?

বৃদ্ধ হাসলেন, সূর্য প্রণাম।

কেন?

যাতে অন্ধকার দূর হয়, পৃথিবীতে আলো আসে। এই যে আমার নাতি, আগামীকালের জন্যে আমি প্রার্থনা করে যাচ্ছি। ও যদি সুখে থাকে তাহলে আমি ভালো থাকব।

ও কী বলল আপনাকে?

ও আমাকে ডাকতে এসেছে। আমার বউমা পাঠিয়েছেন ওকে। চা হয়ে গেছে। বৃদ্ধ চলে গেলেন নাতিকে নিয়ে। আর টিনা এগিয়ে এল গৌরবের কাছে। গৌরব দেখল ওর মুখের চেহারা যেন পাল্টে গিয়েছে। টিনা বলল, আমি বাড়ি যাব।

গৌরব উঠে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা ভোরের বাতাস বইছে। বাইকে স্টার্ট দিয়ে সে বলল, ওঠো।

.

ভোররাতে বৃষ্টি নেমেছিল। আকাশের চেহারা সকাল সাতটাতেও খোলতাই হলো না। ব্যালকনিতে বসে গৌরব চা খাচ্ছিল একা। অনেকদিন বাদে এইরকম একটা সকালের মুখোমুখি হলো সে। মার্কিন মুলুকেও বৃষ্টি নামে, দিনের পর দিন স্যাঁতসেঁতে শীত নিয়ে আকাশ গম্ভীর হয়ে থাকে কিন্তু এই ছবির মতো বর্ষার্ত সকাল দেখেই বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠল। ছেলেবেলা থেকে কলেজ জীবনের অনেক বর্ষার স্মৃতি চলকে উঠে এল মনে। আর তখনই তার জয়তীকে মনে পড়ল।

জয়তীর মুখ, হাত, কাঁধ, লম্বাটে গড়ন, হাঁটার ভঙ্গি, চাহনি এমনকী মজা পেয়ে হেসে ওঠার ভঙ্গিটাও এখন তার সামনে। এতবছর ধরে সে যে মেয়েটার ছবি নিয়ে আমেরিকায় একা থেকেছে অথচ এই কলকাতা শহরে এখনও দেখা হলো না। কোন্ অভিমান মানুষকে এমন অন্ধ করে রাখে? শুধু এই দীর্ঘদিনের অদর্শন থেকে মানুষ ভুল বুঝতে পারে? যদি সে মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে তাহলে প্রশ্ন করবে তার অপরাধ কী? জয়তী আমেরিকায় যেতে চায়নি মা আর বোনকে এখানে একা রেখে। দায়িত্ব অস্বীকার করে গৌরবের স্ত্রী হয়ে সে দেশে সুখী হতে পারবে না বলে জানিয়েছিল। ভালবাসাকে প্রয়োজনের ওপরে স্থান দিতে চায়নি ও। সে জানিয়েছিল গৌরব যদি চায় তাহলে যে কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হতে পারে। বিবেক আছে এমন কোনো মানুষের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। কথাটা জানিয়েছিল গৌরব। এবং তারপর থেকেই যোগাযোগ ছিন্ন। আশ্চর্য, একটা মেয়ে তার পরিবার নিয়ে কলকাতা শহরে কোথায় আছে তা সে এসে অবধি বের করতে পারছে না। ওর আগের বাড়িওয়ালাও নাকি নতুন ঠিকানা জানেন না। বন্ধুবান্ধবরাও অন্ধকারে। গৌরব একটা বড় নিঃশ্বাস নিল। তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতেই মাকে দেখতে পেল। ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে মা নিচে নামছিলেন, ওকে একা বসে থাকতে দেখে কাছে এলেন।
 
তোমার ঠাকুরসেবা হলো? গৌরব পরিহাস করার চেষ্টা করল। মা হাসলেন। তারপর বললেন, এই বাদলায় এখানে বসে কী ভাবছিস? অনেককাল বাদে বাদলা শব্দটা কানে যেতেই মনটা প্রফুল্ল হলো। এমন অনেক শব্দ আছে যে বিশেষ মুহূর্তে বয়স্করাই ব্যবহার করেন। বাংলা জানলেও চট করে তার প্রয়োগ করা সচরাচর সম্ভব হয় না। গৌরব বলল, বসতে ভালো লাগছে।

মা বললেন, আমার বাবা এইরকম মেঘলা দিন দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কথা ঘোরাল গৌরব, টনি বনি স্কুলে বেরিয়েছে?

হ্যাঁ। তুই ঘুমাচ্ছিলি বলে আর ডাকেনি।

বউদি?

আছে নিচে।

শব্দদুটো মা চাপা গলায় বলতেই গৌরব মুখ তুলে তাকাল, কি হয়েছে মা?

মা মুখ ফেরালেন, ও এমন কিছু নয়।

গৌরবের কপালে ভাঁজ পড়ল, তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ?

মা হাসবার চেষ্টা করলেন, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার বুঝতে গেলে সংসারী হতে হয়।

এটাও উত্তর হলো না।

উঃ। কি নাছোড়বান্দা ছেলে। কাল রাত্রে একটু দেরি করে ফিরেছিল সৌরভ। কোথাও পার্টি টার্টি ছিল বোধহয়। হয়তো বেশি ড্রিংক করে ফেলেছিল। তাই নিয়ে তোর বউদি খুব রাগারাগি করেছে। আজ সকাল থেকে কারো সঙ্গে কথা বলছে না। তিনিও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

গৌরব একটু থম করে থেকে বলল, আমি বুঝতে পারি না, বউদি যখন পছন্দ করে না তখন দাদার এসব খাওয়ার দরকারটা কী! একসঙ্গে বাস করতে গেলে অন্যের পছন্দের সঙ্গে মানিয়ে চলতেই হবে। আমার ভালো লাগে না।

মা মাথা নাড়লেন, সত্যি, এতবছর আমেরিকায় থেকেও তুই একটুও পাল্টালি না। যাক, এসব কথা তোকে চিন্তা করতে হবে না। যাদের ব্যাপার তারা সামলে নেবে। আমার শুধু খারাপ লাগে বাচ্চা দুটোর কথা ভেবে। মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হলে আগে আঁচ লাগে সন্তানের গায়ে। তোর সঙ্গে জয়তীর এখনও দেখা হলো না?

আচমকা জয়তীর প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায় যে গৌরব অবাক হয়েছিল তা বুঝতে দিলো না। সে মাথা নেড়ে নিঃশব্দে না বলল। মা বিরক্ত হলেন একটু, আশ্চর্য! উত্তরটা দিতে তোর একটুও খারাপ লাগছে না?

ভালো লাগছে তা বুঝলে কী করে?

তাহলে খুঁজে বের করছিস না কেন?

যে নিজে থেকে আড়ালে থাকতে চায় তাকে খুঁজে বের করে অস্বস্তিতে ফেলা ঠিক হবে?

আমি তোদের কিছুতেই বুঝতে পারি না কথাটা শেষ করে মা আর দাঁড়ালেন না।

গৌরব আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। এখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি থেমে ইলশেগুঁড়ি নেমেছে। আজ সারাদিনের মতো সূর্যদেব আড়ালে থেকে যাবেন বলে মনে হচ্ছে। বাইরের দিকে তাকালেই আলস্য ভর করে মনে। গৌরব উঠল। দেখল মলি গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে গেল।

বউদিকে এবারে ঠিক বুঝতে পারছে না গৌরব। সবই করছেন কিন্তু কেমন ছাড়া ছাড়া। গৌরব দরজায় এসে দাঁড়াল। মলি শুয়ে পড়েছে এর মধ্যে বালিশে মুখ গুঁজে। শরীরটা স্থির হয়ে রয়েছে। গৌরব অবাক হলো। তারপর ঘরে ঢুকে বলল, তোমার শরীর খারাপ, বউদি?

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মলি। কাপড় ঠিক করে নিয়ে বলল, না। কেন, কিছু বলবে?

চেয়ারটা খাটের কাছে টেনে নিল গৌরব, কী হয়েছে বলো তো?

মলি ঠোঁট কামড়ালো। মুখের কালো ছায়া সরাতে পারল না। কিন্তু কথা বলতেও শক্তি পেল না।
 
গৌরব ব্যাপারটা বুঝল, থাক। মনে হচ্ছে একা থাকলে তোমার ভালো লাগবে। রেস্ট নাও। সে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু মলি বলল, গোরা একটু বসো।

অবাক হয়ে তাকাল গৌরব। তারপর আবার চেয়ারে ফিরে এল। মলি কপাল থেকে চুল সরাল, তোমার সঙ্গে মায়ের কোনো কথা হয়েছে? আমাদের ব্যাপারে?

গৌরব মাথা নাড়ল, সামান্য।

মলি মুখ নিচু করল, আমি তোমার সাহায্য চাই গোরা।

বলো কী করতে পারি? গৌরব বুঝতে পারছিল না তার ঠিক কী রকম ভূমিকা নেওয়া উচিত।

আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাব। মলি মুখ তুলল না।

চমকে উঠল গৌরব, কী বলছ বউদি?

মুখ তুলল মলি, হ্যাঁ। আমার পক্ষে আর এখানে থাকা অসম্ভব। মায়ের মুখ চেয়ে–! নিঃশ্বাস ফেলল মলি, না, আর না। কিন্তু মাকে ব্যাপারটা জানানো উচিত। এ কাজটা আমার হয়ে তুমি করবে?

কোনো কিছু না জেনে তোমায় কথা দিই কী করে! গৌরব তখনও হদিশ পাচ্ছিল না।

ও! কয়েক মুহূর্ত ভাবল মলি। বড় অস্বস্তিকর সেই সময়টা। শেষ পর্যন্ত সে বলল, তোমাকে আমি বুদ্ধিমান বলেই জানতাম, কিন্তু এত সতর্ক তা কখনও ভাবিনি।

গৌরব হাসল, ব্যাপারটায় প্রশংসা না নিন্দে কোনটা আছে তা যখন ধরতে পারছি না তখন বুদ্ধিমানই বা বলি কী করে। কিন্তু কী এমন হলো যাতে এত বছরের সম্পর্ক, এই বাড়ির অস্তিত্ব তছনছ করে তোমাকে চলে যেতে হবে? ছেলেমেয়ে দুটোর কথা ভেবেছ?

ম্লান হাসল মলি, অস্তিত্ব কারো অভাবে তছনছ হয় না গোরা। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী আর্থিক বিপদে পড়ে কিন্তু একথা কি কখনও শুনেছ কোনো বিধবা ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মারা গেছে? স্ত্রী মারা গেলে যে শোক তা ভুলতে কদিন লাগে? বাস্তব বড় নির্মম। আর নির্মম বলেই সুবিধে। শোক ভুলে যেতে বেশি সময় লাগে না। আমি চলে গেলেও এই বাড়ি একইরকম থাকবে। কে বলতে পারে, নতুন যে আসবে তার কাছে ছেলেমেয়েরা আরও ভালো থাকবে না।

নতুন যে আসবে! নাঃ, অনেক হয়েছে। এবার পরিষ্কার কথা বলো বউদি।

মুখ তুলে সরাসরি তাকাল মলি, তোমার দাদা প্রায়ই মধ্যরাতে বাড়ি ফেরে। আমি জানতাম তার অফিসে প্রচণ্ড চাপ, মাঝে মাঝে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হয়। মুখে মদের গন্ধ পাই। তা আজকাল তো কলকাতার বেশির ভাগ বাড়িই মদ খাওয়া মেনে নিয়েছে। মাতলামি না করলেই হলো। মাঝে মাঝে মদ খেলে মায়ের মুখোমুখি হবে না বলে তোমার দাদা নাকি দেরি করে ফিরত। আমিও তাই ভেবেছিলাম।

এইটুকুই আমি মায়ের মুখে শুনেছি। তুমি তাই নিয়ে ঝামেলা করেছ। আমি মদ খাই না কারণ আমার খেতে ভালো লাগে না। কোনো সংস্কারে নয়। দাদার যদি খেতে ভালো লাগে যদি মাতলামি না করে এবং এই খাওয়ার ব্যাপারে যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে সমস্যা চুকে গেল। আর আপত্তি থাকলে দুজনের উচিত একটা মাঝামাঝি রফায় আসা। এর জন্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা উনবিংশ শতাব্দীর ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।
 
গৌরবের মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে মলি শক্ত গলায় বলল, মদ খাওয়ার ব্যাপারে আমি কখনও আপত্তি করিনি, তোমার দাদা আর একটি মহিলাকে ভালবাসেন।

এবার চমকে উঠল গৌরব, মানে?

খুব স্বাভাবিক। আমি পুরনো হয়ে গিয়েছি। আমাতে তাঁর মন ভরছে না। অল্পবয়সী একটি মেয়ে তার সেই সব চাহিদা মিটিয়ে দিচ্ছে যখন তখন আমাকে আর প্রয়োজন কী! মলির মুখ থমথমে।

এত কথা তুমি জানলে কী করে?

জেনেছি।

দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে?

হ্যাঁ। উত্তর দিতে চায়নি।

কোথায় যেতে চাও তুমি?

বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে মেয়েরা বাপের বাড়িতে ফিরে যায়। ষোলো বছর কাটিয়ে কেউ যায় কিনা তা জানা নেই। কিন্তু এ ছাড়া আমার তো আর অন্য উপায় নেই।

আচ্ছা বউদি, ধরো দুটো মানুষ পাশাপাশি বাস করতে গিয়ে আবিষ্কার করল তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে অমিল প্রকাশ পাচ্ছে। অ্যাডজাস্ট করতে গিয়েও তারা শেষ পর্যন্ত পারছে না। দুজন দুজনকে প্রায় তখন অপছন্দ করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু যেহেতু হিন্দু বিবাহ মতে তাদের বিয়ে হয়েছিল তাই তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে হচ্ছে। ওরা পরস্পরকে অশ্রদ্ধা করে সারাজীবন একত্রে বাস করবে না আলাদা হয়ে যেটুকু কোমলতা রয়ে গেছে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবে? গৌরব প্রশ্ন করল।

মলি হাসল, ছেলেমেয়ে থাকলে সিদ্ধান্তটা সহজে নেওয়া যায় না গৌরব।

তুমি তো নিচ্ছ।

আমি আর পারছি না। ইটস টু মাচ ফর মি।

কোনো প্রমাণ দিতে পারবে?

হ্যাঁ। মেয়েটির একটা চিঠি আমি পেয়েছি।

তোমাকে লেখা? বিস্ময় ফুটে উঠল গৌরবের মুখে।

না। তোমার দাদা যখন গতমাসে ট্যুরে গিয়েছিল তখন চিঠিটা এসেছিল। অফিসের পিওন নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার আগেই তোমার দাদা রওনা হয়ে গিয়েছিল।

অফিসের পিওন? ভদ্রমহিলা কি দাদার অফিসেই চাকরি করেন?

করতেন। এখন অফিস চেঞ্জ করেছেন।

কেন?

হয়তো চক্ষুলজ্জায়। তুমি চিঠিটা দেখতে চাও গৌরব?

দেখে আর কী করব। গৌরব অন্যমনস্ক হলো। বউদির সঙ্গে দাদার ব্যবহারে অসুখী হবার কোনো লক্ষণ সে দেখতে পায়নি। সম্পর্কে অসুখ আসলে শুধু বিবাহিত বলে সেটাকে বয়ে বেড়ানোর বিপক্ষে সে। ছেলেমেয়েদের দোহাই দিয়ে একটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা হয় আজকাল। একথাও সত্যি আজ বউদি চলে গেলে তার প্রতিক্রিয়া টনি বনির ওপর পড়বেই। কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়া সামলে নেবার বয়সে পৌঁছে গেছে ওরা। কিন্তু একা বউদি কিভাবে দিনযাপন করবে? এদেশের মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় তারা বাধ্য হয় স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে থাকতে। গৌরব মলিকে দেখল। মলি তখন বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলছে। তারপর একটি বাক্স থেকে সযত্নে রাখা খামটা তুলে নিয়ে এসে গৌরবকে দিলো, তবু পড়ে দ্যাখো।
 
ভদ্রমহিলার হাতের লেখা সুন্দর। খামের ওপর দাদার নাম ঠিকানা পড়ল গৌরব। চিঠিটা বের করল। ইংরেজিতে লেখা। এদেশের মেয়েরা আজকাল ইংরেজিতে ব্যক্তিগত কথাবার্তা লিখতে এত সহজ হয়েছে তা ওর জানা ছিল না। মোটামুটি অনুবাদ করলে এমন দাঁড়ায়, প্রিয় সৌরভ। সকালে কয়েকবার চেষ্টা করেছি তোমায় টেলিফোনে ধরতে। যখন পেলাম তখন তুমি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছ। আমি খুব বিপাকে পড়েছি। এই মুহূর্তে তোমার সাহায্য ছাড়া কিছুতেই ভাবতে পারছি না। কলকাতা শহরে একা বাস করছি বলে যে গর্ব ছিল তা আর রাখতে পারব বলে মনে হয় না। তোমার কাছে যে উৎসাহ পেয়েছি তার ওপর ভরসা রেখে বলছি চিঠিটা পাওয়া মাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ কর। তোমায় দেখার জন্যে আমি উৎকণ্ঠিত। তোমার লীনা। ইংরেজি ভাষার ইউ শব্দটি তুমি আপনির ভেদাভেদ না রাখলে তার ব্যবহার বুঝিয়ে দেয় কখন আপনি কখন তুমি। এই চিঠিতে সরাসরি প্রেম নিবেদন নেই বটে কিন্তু দুজনের সম্পর্কের নৈকট্য স্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে লীনা নামক মহিলাটি সৌরভের ওপর নির্ভর করেন। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, দাদা তোমাকে এই চিঠির ব্যাপারে কিছু বলেছে?

ওকে আমি বলিনি চিঠির কথা। যে সম্পর্কের অস্বীকার করে তাকে বলে কী লাভ!

তাহলে তুমি কী বলেছ?

বলেছি ওর প্রেমের প্রমাণ পেয়েছি।

জিজ্ঞাসা করেছিল, কী প্রমাণ?

আমি এটা হাতছাড়া করতে চাইনি। তুমি বলো গৌরব, এই চিঠি পড়ার পর আমার এ বাড়িতে থাকা উচিত?

মলি চিঠিটা ফিরিয়ে নিল। নিয়ে আলমারির ভেতরে রেখে দিয়ে চাবি ঘোরাল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, টনি বনিকে কী বলবে?

যা সত্যি তাই। যাওয়ার আগে বলে যাব ওদের বাবার স্বরূপ কী?

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, দাদা কোথায়?

ছাদের ঘরে। কাল রাত্রে সেখানে গিয়ে শুয়েছে। অন্তত এক ঘরে শোওয়ার গ্লানি থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। যাক তুমি মাকে ব্যাপারটা বলতে পারবে? মলি শেষ করতে চাইল প্রসঙ্গ।

গৌরব উঠে দাঁড়াল, না পারার কোনো কারণ নেই। তবে তার আগে আমাকে দুটো দিন সময় দিতে পারবে বউদি? দুদিন বাদে তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো।

সন্দেহের চোখে তাকাল মলি, দুদিন কেন? কী করবে?

দেখি কী করা যায়। চিঠিটা পেয়ে যখন এতটা সময় অপেক্ষা করলে—

আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করো না। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার নড়চড় হবে না।

কিন্তু তুমি চাকরি করো না। এখান থেকে বেরিয়েও তো তোমাকে কারোর ওপর নির্ভর করতে হবে!

চক্ষুলজ্জা চলে গেলে এদেশে মেয়েদের রোজগারের কিছু না কিছু সম্মানজনক রাস্তা আছে। সেই রোজগার যতই কম হোক না কেন কিন্তু তাতে অসম্মানের নোংরা লেগে থাকবে না। ঠিক আছে, তোমার কথামত আমি দুটো দিন মুখ বন্ধ করে থাকছি। গৌরবকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মলি। এই বউদিকে সে চেনে না। প্রতিটি মেয়ের মধ্যে কি আর একটি মেয়ে থাকে যে অপমানিত বোধ করলে এমন নির্মম হয়ে উঠতে পারে, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়? এখনও তো এই ঘরের টেবিলে দাদা বউদির বিবাহ উৎসবে তোলা ছবি বাঁধানো। মা যত অভিমান করেই ভাই-এর বাড়িতে চলে যান না কেন তিনি ওদের বিয়ের দিনটা মনে রেখে ঠিক ফিরে আসেন। এই ঘরটিতে স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈত জীবনের নানান প্রমাণ ছড়ানো।
 
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে সৌরভকে আবিষ্কার করল গৌরব। ব্যালকনিতে বসে চা খাচ্ছে। ওখানে বসলে ঘরের ভেতরের কথাবার্তা শোনা সম্ভব নয়। তাছাড়া সৌরভের চোখ বাইরের দিকে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এখন ইলশেগুঁড়িতে নেমে এসেছে। আকাশের রঙ কিন্তু ধোঁয়াটে তবু মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবার জেঁকে নাও আসতে পারে। চেয়ার টেনে সৌরভের পাশে বসতেই সে চমকে ফিরে তাকাল। তারপর যেন চেষ্টা করে হাসল, দিনটা খুব বিচ্ছিরি কাটবে। তারপর যোগ করল, আমেরিকায় এরকম ওয়েদার প্রায়ই হয় বোধহয়। ইংলন্ডে তো এটাই স্বাভাবিক।

গৌরব বুঝল দাদা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সে নিজেও কিভাবে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসার পর সে আচমকা বলে ফেলল, বউদির সঙ্গে একটু আগে আমার কথা হয়েছে।

মুখ ফিরিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সৌরভ বলল, ও!

শেষ পর্যন্ত সরাসরি চলে এল গৌরব, তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে ব্যাপারটা অভিপ্রেত নয়।

কোন্ ব্যাপারটা? সৌরভ এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন সে সবে ঘুম থেকে উঠেছে।

বউদি এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।

আমার কিছু করার নেই গোরা। যদি কেউ বিশ্বাস করে সে ঠিক কাজ করছে তাহলে তাই করুক।

কিন্তু দাদা, আমার বলা উচিত হচ্ছে কিনা জানি না, বউদির অভিযোগটা তোমার ভাবা উচিত।

অভিযোগ? সেরকম চাইলে তো আমিও হাজারটা অভিযোগ করতে পারি। সৌরভ এবার ঘুরে বসল।

কিন্তু তাতে তো সমস্যার সমাধান হবে না।

হবেই না তো। সমস্যা যারা বাড়াতে চায় তারা সমাধান চায় না।

এব্যপারে তোমার কোনো দায়িত্ব নেই বলছ?

একশোবার নয়। তোর বউদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে কিন্তু কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি।

হয়তো চায়নি।

তাহলে আমার কিছু করার নেই।

অভিযোগটা তুমি অস্বীকার করতে চাও?

হ্যাঁ। যা সত্য নয় তা আমি মানতে পারি না।

তোমার সঙ্গে আর একজন মহিলার সম্পর্ক নিয়ে বউদি অপমানিত।

আচ্ছা গোরা, এতকাল তুই আমেরিকায় কাটিয়ে এসে গ্রাম্য কথা বলছিস কী করে? ছেলে ছেলের সম্পর্ক যদি সন্দেহজনক না হয় ছেলে মেয়েতে সম্পর্ক হলেই তা সন্দেহজনক হবে? সৌরভ কাঁধ ঝাঁকাল, তোর বউদির কাছে নিশ্চয়ই নামটা শুনেছিস। ও আমার অফিসে কাজ করত। এখন অন্য অফিসে গেছে, কালেভদ্রে দেখা হয়।

তোমার সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের?

অবশ্যই, কিন্তু সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারছি কই।

বউদি কিন্তু অন্যরকম ধারণা করছে।

তোর বউদির ধারণাটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমি সবচেয়ে সুখী হতাম। কিন্তু লীনার সঙ্গে অন্যরকম সম্পর্ক করতে চাওয়া মানে ওকে অপমান করা।

ব্যাপারটা বুঝলাম না।
 
সব কথা জেনে কি লাভ। কই, আমি তোর বউদির সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। রাত্রে ড্রিঙ্ক করে এসেছি এবং আমি মনে করি মাতলামি করিনি। আমার ছেলেমেয়েরা বলতে পারবে না যে ওদের মিসবিহেব করেছি। তোর বউদির বিয়ের আগের জীবন নিয়ে আমি কখনও প্রশ্ন করি। নি। এক ভদ্রলোক ওকে এমন ভালবাসত যে বিয়েই করেননি শেষপর্যন্ত। আমি জানি তোর বউদি মানুষটাকে কখনও অ্যাকসেপ্ট করেনি। কিন্তু এই নিয়েও তো আমি ঝামেলা তৈরি করতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কি লীনার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। হাঁপাতে লাগল একটানা কথা বলে সৌরভ।

ভদ্রমহিলা একা থাকেন?

হ্যাঁ। কলকাতা শহরের কোনো চাকরি করা মেয়ের একা থাকার সমস্যা যে কি ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। ডিভোর্সি হলে তো কথাই নেই। সৌরভ একটু চুপ করে থেকে যোগ করল, একা যারা থাকে সেই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দ্যাখে স্বামীপুত্র নিয়ে সংসার করা মেয়েরা। যেটা লীনার ভাগ্যে জুটছে।

কিন্তু বউদি যদি ভুল বুঝে থাকে সেটা শুধরে দিচ্ছ না কেন?

সন্দেহ আর ঈর্ষা মেয়েদের মন থেকে ঈশ্বরও মুছে ফেলতে পারবেন না।

তুমি চেষ্টা করোনি। তোমার আচরণে সেটা আরও জোরদার হয়েছে।

গৌরব না বলে পারল না। কপালে ভাঁজ পড়ল সৌরভের, আমার কোন্ আচরণের কথা বলছিস তুই? বলেই ম্লান হাসল সে, ও বুঝতে পেরেছি। রাত করে বাড়ি ফেরা, মদ্যপান করা, এসব যুক্তি তো মলির।

দ্যাখো দাদা, যদি ওই মহিলার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক নিবিড় না হয়ে থাকে তবে আমি চাই মা বউদি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাক। ব্যাপারটা বাচ্চাদের জন্য তো বটেই মায়ের পক্ষেও সহ্য করা কঠিন হবে। তোমরা নিজেদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাও। গৌরব উঠে দাঁড়াল। এছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। সৌরভ ওর দিকে তাকিয়েছিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে সে-ও সোজা হয়ে দাঁড়াল, যদি বলিস লীনাকে আমি ভালবাসি কিনা তাহলে বলব, ইয়েস, বাসি। যদি জিজ্ঞাসা করিস সেটা কী ধরনের ভালবাসা তাহলে বলব আর যাই হোক প্রেমিক প্রেমিকা কিংবা স্বামী স্ত্রীর মতো নয়। মলির যা ডেফিসিট আছে লীনার তা নেই। ও অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সহজ। ওকে বোঝা যায়। ওর সঙ্গে কথার বললে আরাম হয়। কারণ ও কথা বোঝে। আর এই ঈর্ষায় মলি যত ছোট হচ্ছে তত আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রচণ্ড শীতেও যেমন উষ্ণতার জন্যে কাদা মাখা কম্বল গায়ে দেওয়া যায় না তেমনি সম্পর্ক বাঁচাতে জোড়াতালিতে বিশ্বাস করি না আমি। এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই গোরা।

মন তেতো হয়ে গেল। আধুনিক জীবনের সম্পর্কের এই ব্যাপারটি ভারতবর্ষে যেমন একটি পাঁচিলের মধ্যে হাঁসফাস করে বন্দী হয়ে, পশ্চিমে তার কোনো সমাধান না পেয়ে শুধু ছিন্ন করেই স্বস্তি পেতে চায়। দুটোকেই মেনে নিতে পারে না গৌরব। নিজের ঘরে এসে সে কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছিল না। তখন বউদির কাছে সময় চেয়ে নেওয়ার পেছনে যে মতলব কাজ করছিল সেটাও অসাড় হয়ে গেছে। হঠাৎ তার সেই মহিলাকে দেখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন তা ওর জানা নেই। এখন দাদাকে জিজ্ঞাসা করলে সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
 
দুপুরের পর বৃষ্টি নামল। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও রাস্তায় হাঁটা যাবে। গৌরব দাদার অফিসে টেলিফোন করল। অপারেটর লাইনে আসতেই সে পরিষ্কার বলল, নমস্কার, আমি একটু বিরক্ত করব। আমি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছি। আপনাদের অফিসে এক ভদ্রমহিলা কাজ করতে যার নাম লীনা। দুঃখের কথা আমি উপাধিটা ভুলে গেছি। উনি এখন কোন্ অফিসে জয়েন করেছেন বলতে পারেন?

ভদ্রমহিলা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির নাম বলে লাইনটা ছেড়ে দিলেন। এখন বাড়ি নিঝুম। টনি বনিরা ফেরেনি। তৈরি হয়ে গৌরব নিচে নেমে দেখল মা এর মধ্যেই বাগানে নেমে গিয়েছেন। সারা রাত-সকালের জলে ভেজা গাছের ডাল ঠিকঠাক করে দিলেন। হঠাৎ গৌরবের মনে হলো নিজের ছেলেদের জীবনের ব্যাপারে একটা বয়সের পর মায়ের আর কোনো হাত থাকে না। তখন ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে শুধুই আফসোস করা ছাড়া আর কিছু উপায় থাকে না। সে তুলনায় এই ফুলের গাছগুলো বরং অতি বাধ্য হয়ে থাকবে। ওরা কখনও অনাত্মীয় হবে না।

ডাল সরিয়ে ডান দিকে তাকাতেই মা ওকে দেখতে পেলেন, এই মেঘ মাথায় নিয়ে কোথায় চললি? যে কোনো সময়ে বৃষ্টি আসতে পারে।

গৌরব হেসে ফেলল, বৃষ্টি তো এখন নেই কিন্তু ভেজা ডালের জলে তো তুমি ভিজে যাচ্ছ। আমি একটু বেরুচ্ছি মা, বেশি দেরি করব না।

মা বললেন, আজ তাহলে মোটরবাইক নিস না।

কেন?

বৃষ্টি এলে ভিজবি। তাছাড়া রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, গাড়ি স্লিপ খেতে কতক্ষণ!

অনুরোধটা রাখল গৌরব। রাখতেই দেখল মায়ের মুখে একধরনের অমল সুখের আলো জ্বলল। গত প্রজন্মের মানুষ কত অল্পে সুখী হয় অথচ সেটুকু দিতে এ প্রজন্মের মানুষ কেন যে অঙ্ক করে!

কলকাতায় ফিরে একমাত্র সকালবেলা ছাড়া বাসে ওঠার চেষ্টা করেনি গৌরব। বারো বছর আগে যা ছিল অভ্যাসে এখন আতঙ্কে পৌঁছে গেছে। একটি সভ্য দেশের শিক্ষিত মানুষেরা এমন ছাগল মুরগির মতো নিয়মিত যাওয়া আসা করতে বাধ্য হয় এবং সরকার চোখ বুজে থাকেন নিশ্চিন্তে! এ নিয়ে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয় না। কালিকটে গুলি চললে কলকাতায় বিক্ষোভ হয় কিন্তু কলকাতার মানুষের একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যাপারে কোনো আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে?

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল গৌরব। এই সময়ে শহরতলির রাস্তায় যদিও ট্যাক্সি পাওয়া যায় কিন্তু ডালহৌসি অঞ্চলে পেতে হলে ভাগ্যবান হতে হয়। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে একবার মনে হয়েছিল দাদাকে ফোন করে অন্তত ভদ্রমহিলার উপাধিটা জেনে নেবে। কিন্তু একটা জেদ থেকে সে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর সব দেশেই সম্ভবত মানুষের নিজস্ব নামের গুরুত্ব দ্বিতীয় পর্যায়ে। প্রথমে উপাধি থাকলেই কাজ দেয়। কোম্পানিটির নামকডাক আছে। দামী কার্পেট ডিঙিয়ে রিসেপশনে পৌঁছাল গৌরব। যে মহিলাটি ডেস্কের ওপাশে তিনি মগ্ন হয়ে হ্যারল্ড রবিন্স পড়ছেন। ওঁর সাজগোজে বোঝা যায় কোম্পানি যেমন ওকে স্বাচ্ছন্দ দিয়েছে তেমনি বিনিময়ে অতিথিদের জন্যে চোখের আরাম চায়। গৌরব সামনে পৌঁছাতেই মহিলা বই থেকে মুখ তুলে হাসলেন, ইয়েস! যেন যন্ত্রের মতো ব্যাপার।

গৌরব বলল, মিস লীনা আছেন?

পুরো নামটা বলুন।

সেটাই তো সমস্যা। আমার এক বন্ধু আমেরিকা থেকে টেলিফোনে ওঁকে একটা খবর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু ওঁর টাইটেলটা আমি মিস করেছি। কথাগুলো নিজের কানেই নির্বোধের মতো শোনাল। রিসেপশনিস্ট অপলক দেখলেন। তারপর বললেন, রেফারেন্স না দিতে পারলে আমার পক্ষে আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব হবে না।

ফাঁপরে পড়ল গৌরব। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না, আমি শুধু এটুকু জানি যে উনি সম্প্রতি এই কোম্পানিতে জয়েন করেছেন। সে দাদার কোম্পানির নামটা যোগ করল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top