What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনিমেষ বেশ মজা পাচ্ছিল কথাগুলো বলার সময়ে। মাধবীলতা বলল, তুমি বেশি বেশি ভাবছ। বাংলার মানুষ যদি তার ওপর আস্থা রাখে তা হলে তিনি নিশ্চয়ই তার সম্মান দেবেন। আচ্ছা বলো তো, পশ্চিমবঙ্গে এবং আগের অবিভক্ত বাংলায় অনেক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাদের জনপ্রিয়তা কম ছিল না। কিন্তু এই মহিলার জনপ্রিয়তা কি তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়নি?

অনিমেষ অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক বলল, মা, তুমি কী বলছ?

ঠিকই বলছি। বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু হয়তো অনেক মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন কিন্তু এই মহিলার জনপ্রিয়তার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারেননি। মাধবীলতা বলল, আমার তো মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বসু জনপ্রিয় হয়েছেন তার নিখোঁজ হওয়ার পরে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, এই কলকাতায় ছিলেন ততদিন কি তিনি এই মহিলার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন? আমার ধন্দ আছে।

অনিমেষ বলল, যা তা বলে যাচ্ছ! একজন মহিলা জপ করার মতো করে পশ্চিমবাংলার মানুষের কানে বামফ্রন্ট বিরোধী মন্ত্র বলে সুড়সুড়ি দিয়ে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তা যে-কোনও মুহূর্তে উধাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সুভাষ বোসের প্রতি শ্রদ্ধা বাঙালির মনে বহুকাল থাকবে। ভালবাসায় শ্রদ্ধা মিশে না থাকলে আর আয়ু বেশিদিন থাকে না। যাক গে, এসব দেখি আর মনে মনে গুমরোই। আমার তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। অনিমেষ ক্রাচ টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেল। মাধবীলতা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, তোর বাবার মুখে এরকম কথা বহু বছর পর শুনলাম!

বুঝলাম না! অর্ক বলল।

তুই তখন নার্সারিতে পড়িস। তোর বাবাকে জেলখানা থেকে ট্যাক্সিতে নিয়ে আসছিলাম। জেলে থাকার সময় আমি ওকে জানাইনি তোর কথা। তাই জেল থেকে বেরিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল। তখন বলেছিল, আমার তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারপর তোকে পেয়ে ধীরে ধীরে মনে জোর পেল। আজ আবার সেই কথাটা শুনলাম। মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, তুই চল, আমার সঙ্গে হাত লাগা। বাড়িটাকে একটু বসবাসযোগ্য করে নেওয়া দরকার। কেউ ভেঙে দিয়ে চলে গেলে আমি তার মধ্যে পড়ে থাকব কেন? আয়।

হাওয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। বামফ্রন্টকে হঠিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকারকে ক্ষমতায় আনলে বাংলার চেহারা বদলে যাবে। শহরের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা জঙ্গলমহল বা দার্জিলিং পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। সেখানে যা হচ্ছে তা সেখানকার মানুষের সমস্যা। শহরের বেকার যুবকদের চাকরি হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে, কলকাতা শহরটা ধীরে ধীরে লন্ডন হয়ে উঠবে। মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারবে। এগুলোর কোনওটাই বামফ্রন্টের আমলে হয়নি। তারা পেশিশক্তি দেখিয়েছে। যেখানে বাধা পেয়েছে সেখানেই রক্তবন্যা বইয়েছে। যারা নিখোঁজ বলে পুলিশের খাতায় ঘঘাষিত তাদের মাটির নীচে শুইয়ে দিয়েছে শক্ত হাতে। মা-মাটি-মানুষের সরকার এলে বদলার রাজনীতি বাতিল হবে। দলতন্ত্রের বদলে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। দিদি মুখ্যমন্ত্রী হলে যে সমস্ত বাঙালি নেতা, কবি, লেখক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁদের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, তাদের নতুন করে সরকারি সম্মান দেওয়া হবে। এই স্বপ্নের ঢেউ কোচবিহার থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বিশাল বটগাছের গোড়া ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেখানে পৌঁছেছে, একটা মৃদু ধাক্কা লাগলেই গাছটা হুড়মুড়িয়ে লুটিয়ে পড়বে। প্রায় সমস্ত মিডিয়া ওই ঢেউটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে হাত লাগালেও অনিমেষের মতো কিছু মানুষ যারা শিক্ষিত রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তারা একমত হতে পারছিলেন না। কিন্তু পরিবর্তন চাই স্লোগান আকাশ ছুঁয়ে গেল।

বিশ্বজিতের চাপে অর্ক এই ঢেউটাকে উপেক্ষা করতে পারল না। সে নিজের চোখে মাওবাদীদের কার্যকলাপ খঙ্গপুরের রাস্তায় দেখে এসেছে। জলপাইগুড়ির বাড়ি থেকে সুরেন মাইতিদের পেশিশক্তিতে ক্ষুব্ধ হয়েও চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ এই কদিন পর্যন্ত ছিল সরকারের ক্রীতদাস, নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। তাই যখনই সময় পাচ্ছিল তখনই সে বিশ্বজিৎদের প্রচারসভায় পৌঁছে যাচ্ছিল। বিশ্বজিৎ অনুরোধ করলেও অর্ক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে রাজি হয়নি। কিন্তু তার উপস্থিতি শ্রোতারা ভাল চোখে দেখছে বুঝে বিশ্বজিত্রা চাইছিল প্রায় প্রতিটি সভায় তাকে হাজির করতে। বক্তৃতা না দিলেও, এই কারণে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল অর্কর।
 
অফিস থেকে ফিরছিল অর্ক। সাধারণত সন্ধেবেলায় এবং ছুটির দিনে সে নির্বাচনী প্রচারে বের হয়। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখল একটা মিছিল ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকছে বামবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মিছিলে যারা হাঁটছে, স্লোগান দিচ্ছে, তাদের বেশ কয়েকজনকে এ যাবৎকাল সিপিএমের কর্মী বলে সে জানত। দুজনকে তো সুরেন মাইতির হয়ে চোখ গরম করতে দেখেছে। ওরা কখন কেমন করে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিল? এত সাহস পেল কী করে? অর্কর মনে পড়ল সেই সাব-ইন্সপেক্টরের কথা। বর্ষার আগে পিঁপড়েরা ঠিক টের পেয়ে যায় জল পড়বে। সাব-ইন্সপেক্টররা যখন টের পেয়ে গেছে তেমনি মস্তানবাহিনীও। কিন্তু কয়লা তার চরিত্র পালটায় না। দলে এদের দেখলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবেই, ভয়ও পাবে। কী করে বিশ্বজিত্রা এদের দলে ঢুকতে দিল?

বিশ্বজিৎকে খুঁজে বের করল সে। তৃণমূলের সদ্য তৈরি পার্টি অফিসে বসে সে অন্যদের কাজ বোঝাচ্ছিল। তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলল অর্ক।

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, অর্কদা, যখন জলোচ্ছাস হয় তখন কি জল পরিষ্কার থাকে? যাবতীয় আবর্জনা স্রোতের মধ্যে ঢুকে যায়। কী করব বলুন! এমন কোনও ছাঁকনি নেই যে তাদের আটকাব।

অর্ক বলল, আটকাতে হবেই। নইলে এরাই কিছুদিন পরে সিপিএমে থেকে যা যা করছিল তাই করবে।

না। তা করতে পারবে না। যদি নির্বাচনে আমরা জিতি তা হলে ঝাড়াই বাছাই করে এদের বাদ দেওয়া হবে। এখন কিছু করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া আমাদের দল নতুন। লড়াই করার মতো সক্রিয় কর্মীর সংখ্যাও বেশি নয়। সিপিএমের হার্মাদবাহিনীর সঙ্গে টক্কর দিতে এরাই পারবে। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। বিশ্বজিৎ তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

অস্বস্তির কাটাটা তবু দূর হচ্ছিল না। বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই অর্কর মোবাইল বেজে উঠল। অন করতেই শুনতে পেল, আপনি কোথায়?

হঠাৎ মন শান্ত হয়ে গেল। অর্ক বলল, বেলগাছিয়া। আপনি?

আর জি কর হাসপাতালে। একজন সহকর্মীকে দেখতে এসেছিলাম। এখন কি হাতে সময় আছে? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল।

.
 
শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের নির্বাচনী জনসভায় তৃণমূলের বক্তৃতা চলছে। বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে তৃণমূলের মিছিল নিপাত যাক নিপাত যাক ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এসেও মুখ ঘুরিয়ে খালের দিকে চলে গেল।

কর্নওয়ালিশ স্ট্রিস্টের একটি চায়ের দোকানে মুখোমুখি বসে কুন্তী হাসল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন হয়েছিল তখন কীরকম চিৎকার দুপক্ষ করেছিল বলে আপনার মনে হয়?

এই দোকানে ভরসন্ধ্যাতেও চায়ের সঙ্গে টোস্ট পাওয়া যায়। কারণটা জানা নেই, উত্তর কলকাতার বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানে যেমন বিকেল বেলায় জিলিপি তৈরি করে বিক্রি করা হয় না তেমনি চায়ের দোকানদাররা ওই সময় টোস্ট বিক্রি না করে চপ কাটলেট বিক্রি করতে পছন্দ করেন। চা-টোস্টের অর্ডার দিয়ে প্রশ্নটা শুনতেই হেসে ফেলল অর্ক, যুদ্ধের সময় নিশ্চই দুপক্ষই হুংকার দিত কিন্তু বিকেলে যখন যুদ্ধ স্থগিত রাখা হত ভোর অবধি, তখন একসঙ্গে গল্প করত সবাই।

কুন্তী মাথা নাড়ল, ঠিক। আমরা অনেক পালটে গিয়েছি।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এদিকে এসেছিলেন বলে আমার কথা মনে এল?

না। এদিকে এসেছিলাম বলে আপনাকে ফোন করলাম। মনে আসলেই যদি ফোন করি তা হলে কেন করলাম তার কৈফিয়ত দিতে হয়। তাই করিনি। কুন্তী বলল, আমার ফোন পেয়ে অবাক হয়েছেন?

একটু। কারণ অনেক আগেই ফোনটা আশা করেছিলাম। বলুন, খবর কী? অর্ক কুন্তীর দিকে তাকাল।

কুন্তী কপালে চলে আসা চুল পেছনে সরিয়ে বলল, ব্যান্ডেলের বাস চুকিয়ে দিলাম।

তার মানে? ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন?

না। চাকরিটাই ছেড়ে দিলাম। কুন্তীর মুখ গম্ভীর।

কিছু হয়েছিল?

হ্যাঁ। আমার ব্যক্তিগত জীবনে স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশিরকম নাক গলাচ্ছিলেন। সহ্য করে ছিলাম। নতুন সেক্রেটারি এসে তার সীমা পেরিয়ে গেলে ছেড়ে এসে স্বস্তিতে থাকতে পারলাম। কুন্তী বলল, এখন কলকাতার বাড়িতে?

হ্যাঁ। বাড়িতেই ছেলেমেয়েদের পড়াব। তাতে দিব্যি চলে যাবে। মায়ের মনে একটা ক্ষোভ ছিল আমি বাইরে থাকি বলে, সেটাও চলে গেল। কুন্তী বলল, আপনার খবর বলুন।

চা আর টোস্ট এসে গেল। টোস্টের প্লেট কুন্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে অর্ক বলল, চাকরিটা যেতে যেতে যায়নি বলে এখনও করে যাচ্ছি। যে ব্যাপারটা থেকে চিরদিন দূরে থাকতাম তা আর না থেকে সামনের নির্বাচনে একটি দলকে সমর্থন করছি। ভোট হয়ে গেলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাব।

অর্থাৎ আবার শামুকের মতো খোলের আড়ালে গুটিয়ে থাকবেন?

যা ইচ্ছে বলতে পারেন।

সমর্থন করছেন, তা মনে মনে নাকি সক্রিয় হয়ে?

কিছুটা সক্রিয় হয়েছি। না হলে নির্বাচনী সভাগুলোতে যাব কেন?

বেশ। যাঁদের সমর্থন করছেন তারা যদি ক্ষমতায় আসেন তা হলে তাদের পাশে থেকে দেখবেন না, যে কারণে সমর্থন করেছিলেন তা বাস্তবে হচ্ছে কিনা! কুন্তী তাকাল।

অর্ক হাসল, আমি কোন দলের সমর্থক তা আপনি বুঝে গেলেন?

স্বাভাবিক। বামফ্রন্টের প্রয়োজন নেই আপনাকে। এই নির্বাচনে কী হবে তা ওরা ভালভাবেই জানে। আপনি তৃণমূল নেত্রীকে সমর্থন করছেন। নির্বাচনে ওঁর জয়ের সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ। আমি জ্যোতিষী নই। সাধারণ মানুষের কথা শুনেই বলছি। তবে আপনি সমর্থন করেছেন বলে একটা সুবিধে পাবেন। আগামী পাঁচ বছর নিরাপদে বাস করতে পারবেন। কুন্তী বলল।

নইলে বিপদে পড়তাম? বাঁকা গলায় প্রশ্ন করল অর্ক।
 
দেখুন আমি রাজনীতি বুঝি না। বাবা একমাত্র রাজনীতি করতেন। পরে যখন রিয়েলাইজ করলেন তখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেন। এমনিতেই বাঙালি মেয়েরা রাজনীতি করতে চাইলে পরিবার থেকে তুমুল আপত্তি ওঠে। বাবার ব্যাপারটা আমাকেও রাজনীতি বিমুখ করেছিল। কিন্তু চোখ ভোলা থাকলে যা দেখা যায় তা কল্পনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একজন ভদ্রমহিলার ওপর যদি নির্ভর করে তা হলে তা বহন করতে হবে তাকেই। সেই হিমালয়ের চেয়ে ভারী বোঝার সঙ্গে তাকে সামলাতে হবে নির্বাচিত বিধায়ক থেকে পাড়ার নেতাদের যারা প্যারাসাইটের মতো তারই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ভেবে নেবে আমরাই রাজা। খুব কঠিন কাজ। বাবার মুখে শুনেছিলাম, সাতষট্টির নির্বাচনের আগে প্রবীণ কংগ্রেসি নেতারা বলতেন, আমরা তো খেয়ে দেয়ে ফুলে ফেঁপে গেছি, আর খাওয়ার ক্ষমতা নেই, কিন্তু কমিউনিস্টরা তো উপোসি ছারপোকার মতো শুকিয়ে আছে, ক্ষমতায় এসে খাওয়া ছাড়া অন্য চিন্তা করবে না। ভয় হয় নেত্রী যা চাইছেন তা তাঁর অনুগামীরা না শুনে ওই খাওয়ার পথে না চলে যান। সেরকম হলে বিপদ তো অনিবার্য। কুন্তী খুব সিরিয়াস গলায় কথাগুলো বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল। আপনি ভুল করছেন। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সময় অনেক নোংরা ভেসে আসে। পুরনো যা তা ভেঙে চুরমার করে জল যখন থিতিয়ে যায় তখন ওই নোংরাগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আপনি খুব আশাবাদী। সেরকম হলে আমিও খুশি হব। কুন্তী বলল। চা শেষ করেই সে মাথা নাড়ল, আচ্ছা, আমরা তখন থেকে শুধু রাজনীতির কথা বলে যাচ্ছি কেন? আমরা কি অন্য বিষয়ে কথা বলতে পারি না?

সামান্য দূর থেকে ভেসে আসা গরম বক্তৃতা, স্লোগান আচমকা থামতেই কুন্তী নিজেই জবাব দিল, ওঃ, শান্তি! ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো ওটা বেজে চলছিল বলে আমরাও প্রভাবিত হয়েছি। ঘড়ি দেখল সে, আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বললে আসবেন?

নিশ্চয়ই। অর্ক বলল।

নির্বাচনের পরে?

না না। যে-কোনও দিন। অর্ক পকেটে হাত ঢোকাল। কুন্তী মাথা নাড়ল।

না। আমি দেব। কারণ আমার ফোন পেয়ে আপনি এসেছেন।

অর্ক ওয়েটারের রেখে যাওয়া প্লেটে টাকা দিয়ে বলল, আপনি-আমি করবেন না তো!

আচমকা শব্দ করে হেসে উঠল কুন্তী। অর্ক অবাক হয়ে তাকাল। হাসি শেষ হলে কুন্তী বলল, গোটা পশ্চিমবঙ্গ যেখানে আমরা-ওরা-তে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে তখন আপনার গলায় অন্য কথা কেন?

অর্ক উত্তর দিল না। কুন্তী বলল, এবার বলুন। ওরা দোকানের বাইরে পা রাখামাত্র আবার স্লোগান শুরু হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনার কী মনে হচ্ছে এসব শুনে?

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। কুন্তী বলল।

কুরুক্ষেত্রে? অর্ক চোখ বড় করল।

হ্যাঁ। পাণ্ডব বনাম কৌরবদের। কুন্তী বলল, সে সময় ভারতবর্ষ দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুভাগ হয়ে দুপক্ষকে সমর্থন করেছিল।

তারপর?

অত্যাচারীর পতন হয়েছিল। শুভ ইচ্ছার জয় হয়েছিল।

এখন?

আমি তো জ্যোতিষী নই। তবে পড়েছি, ইতিহাস কথা বলে। ঘুরে ফিরে আসে। সেটা এবারও হতে পারে।

তার অর্থ হল বামফ্রন্টের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী?

হতেই পারে। কিন্তু তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলে সীমাবদ্ধ। কুন্তী হঠাৎ ব্যস্ত হল, এখন এদিকে বাস চলছে না বলে মনে হচ্ছে। আমি পাতাল রেলে ফিরে যাই। স্টেশনটা কোথায়?

এই তো, ওপাশের রাস্তায়। চলুন। অর্ক এগোল। ভিড়ের ফুটপাত দিয়ে ওরা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে পৌঁছে পাতাল রেল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা উচ্ছ্বসিত চিৎকার কানে এল, এই কুন্তী।
 
কুন্তী দাঁড়িয়ে মুখ ফেরাতেই মহিলা প্রায় দৌড়ে এলেন, সঙ্গে বছর পাঁচেকের বালক। বললেন, কী রে! তুই এখানে? উঃ, কতকাল পরে তোকে দেখলাম। একদম আগের মতো সুন্দর আছিস তুই। আর দ্যাখ, আমি কীরকম বুড়ি হয়ে গিয়েছি। প্রায় ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে গেলেন মহিলা।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাসল কুন্তী, শিপ্রা!

এই দ্যাখ, তোর চিনতে সময় লাগল! লাগবেই বা না কেন? সিজার হয়েছিল, তারপর থেকেই শরীরটা ভেঙে গেল। গলা নীচে নেমে গেল মহিলার, তলপেটের চর্বি কিছুতেই কমছে না। তোর বর?

না গম্ভীরমুখে বলল কুন্তী।

উড বি? বলেই মহিলা বলল, যাক গে, এখনও বিয়ে করিসনি, খুব ভাল করেছিস। তুই তো সাউথে থাকতিস?

হ্যাঁ। এখনও সেখানে আছি।

তুই একবার আমাদের বাড়িতে আয়। এই তো কাছেই! আচ্ছা এখন না। ইলেকশনের রেজাল্ট বের হওয়ার পর আসবি। তোর মোবাইলের নাম্বার দে।

তোর বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে ইলেকশনের রেজাল্টের কী সম্পর্ক? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল।

এই যাঃ। তোকে বলা হয়নি। আমার শ্বশুরবাড়ি তো মেদিনীপুর। ওর বাবা সেখানকার একটা আসনে তৃণমূলের ক্যান্ডিডেট হয়েছে। এই প্রথম দাঁড়াল। হারার কোনও চান্স নেই। সব পাবলিক তো তৃণমূলকেই ভোট দেবে। তার পরে আয়।

তখন এম এল এর বউ হয়ে স্পেশ্যাল খাতির করবি?

অর্ক দেখল মহিলার চোখেমুখে খুশি ছড়িয়ে গেল।

কুন্তী বলল, চলি।

নাম্বারটা দে?

কুন্তী নাম্বারটা বললে মহিলা তার মোবাইলে সেটা সেভ করে নিল, খুব ভাল লাগল রে। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে মশাই,

আপনিও আসবেন।

কুন্তী হটতে আরম্ভ করেছিল, জবাব না দিয়ে অর্ক তার সঙ্গী হল। পাতালরেলের দরজায় পৌঁছে কুন্তী জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলেন?

কোন ব্যাপারে?

শিপ্রাকে দেখে? আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। বহু বছর পরে দেখা। আর এই অল্প সময়ের মধ্যে ও ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো আমাকে জানিয়ে দিল।

মহিলা সম্ভবত খুব সরল।

না। সরল নয়, তরল হয়েছে। এম এল এর বউ হবেই এই আনন্দে। আপনাকে দেখে আমার সঙ্গে যে সম্পর্কটা বানিয়ে নিল তা বাঙালি বউদের মাথায় প্রথমে আসে।

আপনি তো সেটা ভেঙে দিলেন।

তাতে দমে যায়নি। বর্তমানে যখন নয় তখন ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বলে ভাবল!

আপনি খুব বিরক্ত হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে।

না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মেয়েরা এসবের বাইরে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ভাববে না কেন? এই একুশ শতকে? তা হলে ঠাকুমা দিদিমাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? যাক গে, কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে?

যাব।

নিশ্চয়ই বলবেন না ইলেকশনের রেজাল্ট বের হলে যাব?

হেসে ফেলল অর্ক, না। অবশ্যই না।

তা হলে এলাম। কুন্তী নেমে গেল পাতালের সিঁড়ি বেয়ে। অর্ক সেদিকে তাকিয়ে ভাবল একবার হয়তো মুখ ফিরিয়ে তাকাবে, কিন্তু তাকাল না।

ফুটপাতে না নেমে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অর্ক। এখন কলকাতায় রাত নেমে গেছে। সন্ধের মুখে যখন আলোগুলো জ্বলে ওঠে তখন চারধার যেরকম ঝকমকিয়ে ওঠে, রাত বাড়লে তা ক্রমশ নেতিয়ে যায়। একটা হলদেটে ভাব ফুটে ওঠে।

এতক্ষণ বেশ কেটে গেল। কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগছিল। এই যে কুন্তী উত্তর কলকাতায় এসে তাকে মনে করে ডেকে নিল, গল্প করল, তার কারণ কী? এই অঞ্চলে কি ওর অন্য কোনও পরিচিত মানুষ নেই? না থাকলেও তাকে কেন ডাকবে? কাজ শেষ করে ফিরে যেতেই পারত!
 
তাড়াহুড়োয় কাজে যাওয়ার সময় যে মোবাইলটা নিয়ে আসা হয়নি তা অর্ক টের পেল বেলা বারোটা নাগাদ। প্রথমে মনে হয়েছিল বাসে পকেটমার হয়ে যায়নি তো! তার মোবাইল প্রিপেইড। ব্যালেন্স বেশি ছিল না। হারিয়ে গেলে থানায় গিয়ে ডায়েরি করাই নিয়ম। অর্কর মনে হল সেটাও একটা ঝামেলা। তারপরেই খেয়াল হল, বাড়িতে ফেলে আসেনি তো? সে ল্যান্ডলাইন থেকে মাধবীলতার মোবাইলে ফোন করল।

মাধবীলতার সাড়া পেলে জিজ্ঞাসা করল, মা, দ্যাখো তো আমি সেলফোনটা বাড়িতে ফেলে এসেছি কিনা!

হ্যাঁ। দুটো ফোন এসেছিল। তাতেই জানতে পারলাম। মাধবীলতা বলল।

কারা ফোন করেছিল?

প্রথমটা একটা মেয়ের ফোন ছিল। নাম বলল কুন্তী। বলল তোর সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল। বেশ ভালভাবে কথা বলল মেয়েটি। কবে আলাপ হল?

বেশিদিন নয়। ওর বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন, মারা গিয়েছেন। বাবাকে চিনতেন। কুন্তী স্কুলে পড়াত। এখন সেটা ছেড়ে বাড়িতে ছেলে মেয়েদের পড়াবে। বলেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল। দ্বিতীয় ফোনটা কার?

আমি জানি না।

তুমি ধরোনি?

না। ধরলে তো বলতেই পারতাম। তোর বাবা ধরেছিল। কথা বলেছিল।

কার সঙ্গে কথা বলেছিল?

আমাকে বলেনি।

ঠিক আছে, বাবাকে দাও ফোনটা।

তোর বাবা বাড়িতে নেই।

কোথায় গেছে?

মোবাইলে কথা বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, আমি আসছি, দেরি দেখলে তুমি খেয়ে নিয়ো। মাধবীলতা বলল, প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে।

মোবাইলটা কোথায়?

সঙ্গে নিয়ে গেছে।

প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল অর্কর। কুন্তীর ফোন নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। গতকাল ফিরে যাওয়ার পর ভদ্রতা করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ফোনটা কে করেছিল? নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নইলে কথা বলার কিছুক্ষণ পরে বাবা বাড়ির বাইরে যাবে কেন? ইদানীং বাবা বড়জোর গলির ভেতরের কাকার দোকান অবধি যায়, ঈশ্বরপুকুর লেনের বাইরে কখনওই নয়। শরীরের জন্যে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি মন চায় না বলেই যেতে পারে না। তা হলে?

অর্ক ল্যান্ডলাইনে নিজের নম্বর ঘোরাল। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল ওটা সুইচ অফ করে রাখা হয়েছে।

কাজে মন দিতে পারছিল না অর্ক। তার মনে হচ্ছিল যে ফোন করেছিল সে নিশ্চয়ই বাবাকে ডেকে নিয়ে গেছে। বাবার কোনও পরিচিত মানুষ তার মোবাইলে বাবাকে চাইবে না। তা হলে যে ফোন করেছিল সে তারই পরিচিত। লোকটা কি সুরেন মাইতি? তার নাম্বার পেতে লোকটার একটুও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাকে না পেয়ে সুরেন মাইতি বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কী বলতে পারে? কেন অর্ককে তৃণমূলের নির্বাচনী সভায় দেখা যাচ্ছে তার কৈফিয়ত চাইবে? অর্ক নিশ্চিত এর উত্তর বাবা ঠিকঠাক দিতে পারে।

কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে অর্ক দেখল মাধবীলতা বস্তির কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছে, অর্ক তাদের এড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে মহিলারা বেরিয়ে গেলে মাধবীলতা দরজা বন্ধ করলে অর্ক বারান্দায় এল, বাবা এখনও ফিরে আসেনি?

না। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

আশ্চর্য! কোথায় গেছে?

দুপুরে ফোন করেছিল। বলল ফিরতে দেরি হবে।

আমি ফোন করেছিলাম তখন মোবাইল বন্ধ ছিল। অর্ক বলল।

ও।

তুমি এমন নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলছ? বাবা কি কখনও এভাবে এতক্ষণ কোথাও গিয়েছে? অর্ক উষ্ণ হল।

তোর বাবা ছেলেমানুষ নয়। সে বাইরে গিয়েছে, ফোনে খবর দিয়েছে আসতে দেরি হবে। তারপরে আমি খবরদারি করতে যাব কেন? মাধবীলতা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তুই হঠাৎ এত চিন্তিত হয়ে পড়লি কেন?

অর্ক জবাব দিল না। তার সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। এতদিন পরে মা এরকম নির্লিপ্ত হয়ে গেল কী করে?
 
অনিমেষ বাড়িতে ফিরে এল রাত আটটায়। হাতমুখ ধোওয়ার পরে মাধবীলতা খাবার দিল।

খাওয়া শুরু করে অনিমেষ মাধবীলতাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নিশ্চয়ই খুব কৌতূহল হচ্ছে, আমি কোথায় গিয়েছিলাম তা জানতে?

এই খবরটা তোমাকে কে দিল? মাধবীলতা তাকাল।

মানে? আমি একটি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলার পাঁচ মিনিট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। বলেছি ফিরতে দেরি হবে। মাঝে ফোনে তোমাকে খবর দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিরে এসে এত টায়ার্ড ছিলাম যে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে পারিনি। অনিমেষ বলল।

তুমি এভাবে কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল। অনিমেষ উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অর্কই মুখ খুলল, তুমি তো শরীরের কারণে বাইরে যাও না। আমাকে যারা ফোন করে তাদের বেশির ভাগকেই তুমি চেনো না, অথচ শুনলাম ফোনে কথা বলার পরেই বেরিয়ে গেছ। কে ফোন করেছিল তা বলবে?

মোবাইলে তার নাম্বার দেখিসনি?

ওটা তো তোমার সঙ্গে ছিল। এখনও ফেরত দাওনি। অর্ক বলল।

অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, টেবিলের ওপর মোবাইলটা রাখা আছে, এনে দেবে?

মাধবীলতা খাওয়া ছেড়ে ঘরে গিয়ে সেটা এনে অর্ককে দিল। ওটা এখনও সুইচ অফ করেই রাখা আছে। সেট অন করে বাঁ হাতের আঙুলের চাপে রিসিভড কলগুলো দেখতে গিয়ে চমকে উঠল।

অনিমেষ খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, চিনতে পেরেছিস?

রামজি ফোন করেছিল! হঠাৎ? অর্ক মাথামুন্ডু বুঝতে পারছিল না।

সে তোর বন্ধু। এই বাড়িতে আমাদের অনুপস্থিতিতে তাকে তুই আশ্রয় দিয়েছিলি। তুই তো ভাল বলবি সে কেন ফোন করেছে? হঠাৎ হবে কেন? অনিমেষ বলল।

আমার সঙ্গে ইদানীং কথা হয়নি। ও কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল? আর চাইলেই তুমি বেরিয়ে গিয়ে দেখা করবে কেন? অর্ক গম্ভীর হল।

তুই যদি ওকে নিয়ে বোলপুরে গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে পারিস আমি সামান্য দূরত্বে গিয়ে কথা বলতে পারব না কেন? অনিমেষ তাকাল।

রামজি কি এখন কলকাতায়?

ও যদি খগপুরে থাকত তা হলে কি আমি সেখানে যেতে পারতাম?

বাবা, তুমি স্পষ্ট কথা বলছ না কেন?

দ্যাখো অর্ক, তুমি স্পষ্ট কথা বলতে যা বোঝাতে চাইছ তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই, ভাবছ কেন? অনিমেষ বিরক্ত হল।

বেশ। রামজি কি কলকাতায় এসেছে? সরাসরি জিজ্ঞাসা করল অর্ক।

হ্যাঁ। সে এই শহরে না এলে আমি কথা বলতে যেতাম না।

কিন্তু তুমি খুব ঝুঁকি নিয়েছ। রামজিকে পুলিশ খুঁজছে। অর্ক বলল।

তুমি যখন তাকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলে, যখন তাকে নিয়ে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়িয়েছিলে তখনও তো পুলিশ খুঁজছিল।

কোথায় আছে রামজি?

কেন?

কিছুই না। কৌতূহল হচ্ছে তাই জিজ্ঞাসা করছি।

তোমাকে তো থানার বড়বাবু বলেছিলেন রামজির খবর পাওয়ামাত্র তাকে জানিয়ে দিতে। কারণ পুলিশের মতে সে মাওবাদী। কিন্তু তোমাদের নেত্রী তো বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। তা হলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? অনিমেষ নিজের ঘরের দিকে এগোল।
 
ছেলেটা যখন এখানে ছিল তখন তুই জানতিস না ও কোন রাজনীতি করে? এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাধবীলতা প্রশ্নটা করল।

রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা আমাদের মধ্যে হয়নি।

তা হলে তুই কীভাবে বুঝলি ও মাওবাদী?

একসঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝে গিয়েছি। ওর বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। কিন্তু সুন্দরবন দিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে কোথাও যেতে চাইছিল। সেটা বাতিল হওয়ার পর দিঘার কাছে তালসারিতে চলে গেল। সেখানে সমস্যা হওয়ায় আবার কলকাতায় ফিরে এসে আমার কাছে আশ্রয় চাইল। আমি বুঝেছিলাম ওকে এই বাড়িতে নিয়ে এলে বিপদে পড়ব। আবার ও এত ভদ্র ব্যবহার করেছে যে এড়িয়েও যেতে পারছিলাম না। ওকে নিয়ে গেলাম বোলপুরের কাছে একটা আশ্রমে। কোথাও ওকে রাজনীতির কথা বলতে শুনিনি। এমনকী মোবাইলে খবর পেয়ে ও যখন খড়গপুরে চলে গেল তখন বেশ স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়েছিল। তৃণমূলের নেত্রীকে রাজনীতি করতে হয়। তার সব কথার চুলচেরা বিচার করা ভুল হবে। অর্ক একটানা বলে গেল।

অনিমেষ বলল, আমার এখনও বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে যে আদর্শহীন কিছু লোককে জুটিয়ে নিয়ে একজন ব্যক্তি শুধু তার আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে একটি রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাস দেখা গেলে মিলিটারির মদতে বলীয়ান হয়ে ডিক্টেটাররা সেটা করতে পেরেছেন। এমনকী মাও সে তুং, হো চি মিনের মতো ব্যক্তিত্বও ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেননি। যদি তাও সম্ভব হয় তা হলে তোমার কি ধারণা ক্ষমতায় এলে মাওবাদী বলতে যাদের বোঝা হচ্ছে তারা অস্ত্র ফেলে রেখে নেত্রীর অনুগামী হবে? আর একটিও খুন জঙ্গলমহলে হবে না? যাক গে, অর্ক, যদি রামজি নিজে থেকে যোগাযোগ করে তা হলে তুমি জানতে পারবে কিন্তু আমি তোমাকে তার ঠিকানা জানাতে পারব না।

কেন?

আমরা যখন জলপাইগুড়িতে ছিলাম তখন তুমি রামজির ব্যাপারটা আমাদের জানাওনি। এখন তুমি যে দলের সমর্থক, তোমার যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে আমার কাছ থেকে খবরটা তুমি পেলে রামজি যদি বিপদে পড়ে তা হলে নিজেকে কী বলব? আমার শরীর ভাল নেই, শুয়ে পড়ছি। অনিমেষ ঘরে ঢুকে গেল।

অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখল মাধবীলতা এরই মধ্যে রান্নাঘরে চলে গেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে একা। এই সময় উঠোনের ওপাশের দরজায় শব্দ হল। কেউ মৃদু আঘাত করছে। একটু এগিয়ে গিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কে?

অর্কদা আমি সলিল। দরজা খুলুন, খুব জরুরি। চাপা গলা ভেসে এল।

একটা দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলল অর্ক। যে অল্পবয়সি ছেলেকে সামনে সে দেখতে পেল তাকে আগেও বিশ্বজিৎদের সঙ্গে দেখেছে। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

বিশ্বজিৎদা বলে পাঠাল আপনি যেন আজ রাত্রে ঘরে না থাকেন।

কেন?

সুরেন মাইতিরা আবার হামলা করতে পারে। আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।

দরকার নেই। বিশ্বজিৎকে বলো চিন্তা না করতে।

ওরা বাইরে থেকে ছেলে এনেছে অর্কা! ছেলেটি বেশ উত্তেজিত।

ঠিক আছে। দাঁড়াও।

অর্ক ভেতরে ফিরে গিয়ে মাধবীলতাকে বলল, মা, দলের ছেলেরা এসে ডাকছে। একটা জরুরি মিটিং আছে। তুমি শুয়ে পড়ো।

মাঝরাতে এসে ঘুম ভাঙালে বাকি রাত জেগে বসে থাকতে হবে। মাধবীলতা গম্ভীর মুখে বলল।

মাঝরাত হয়ে গেলে ওখানেই থেকে যাব।

যা ভাল বোঝো তাই করো!

বোঝো শব্দটা কানে লাগল। দূরত্ব বাড়াতে মা তুই থেকে তুমিতে উঠে যায়। ছেলেটির সঙ্গে চায়ের দোকানের কাছে পৌঁছে দেখল সেখানে বিশ্বজিত্রা জটলা করছে। বারো-চোদ্দোজন মানুষ বেশ উত্তেজিত। অর্ককে দেখে বিশ্বজিৎ এগিয়ে এল, দাদা, ওরা আজ রাত্রে আমাদের ওপর হামলা করতে চাইছে। বাইরে থেকে প্রচুর ছেলে আনবে, কিছু এসে গিয়েছে। আমরা ঠিক করেছি প্রতিরোধ করব। আজকের রাত্রে কেউ ঘুমাব না।

কিন্তু ওরা হামলা করবে কেন?
 
বুঝতে পেরেছে পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে তাই। নির্বাচনের আগে আমাদের কর্মীদের যদি হাসপাতালে পাঠাতে পারে তা হলে ওদের সুবিধে হবে। আপনি আজ আমাদের সঙ্গে থাকুন। বিশ্বজিৎ বলল।

পুলিশকে জানিয়েছ? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বড়বাবু নাকি অসুস্থ। সেজবাবু ছোটবাবুরা গৌরাঙ্গ হয়ে গেছেন।

তার মানে?

মাথার ওপর হাত তুলে দিয়েছেন। বলছেন গিয়ে সামাল দিতে গেলে সুন্দরবনে বদলি করবে বর্তমান সরকার আর সামাল না দিলে দার্জিলিং-এ পাঠিয়ে দেবে আগামী সরকার। তার চেয়ে না যাওয়াই ভাল। বুঝুন! বিশ্বজিৎ বলল।

ওরা যদি অস্ত্র নিয়ে মারপিট করে? অর্ক চিন্তিত।

আমরা প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে আবেদন জানিয়েছি ঠিক এগারোটা বাজলেই সবাই যেন ঘরে ঘরে জেগে থাকেন। প্রয়োজন হলে তারা বাইরে বেরিয়ে আসবেন। এত লোক দেখলে যত অস্ত্র হাতে থাক কেউ সাহস পাবে না এগোতে। কথাগুলো বলে বিশ্বজিৎ চলে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে থামাল অর্ক। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সুরেন মাইতি কোথায়?

জানি না।

বাড়িতে নেই?

বোধহয় না। হয়তো থানায় গিয়ে বসে আছে।

আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

মানে?

ওঁর সঙ্গে কথা বলে যদি এই ঝামেলাটা বন্ধ করা যায়, আমার মনে হয় সেই চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত। অর্ক বলল।

বিশ্বজিৎ কাধ নাচাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। আজ রাতে এখানে একটা নাটক হবে জেনে সবাই দেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। এরা সেইসব মানুষ যারা যে চোখে বিসর্জনের মিছিল দেখে সেই চোখে মাস্তান বাহিনীর ঝগড়া, মারপিট দেখে তৃপ্ত হয়।

অর্ক ভিড় ছাড়িয়ে সুরেন মাইতির বাড়ির কাছে এসে দেখল বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই সময় বিছানায় চলে যায় কিন্তু সুরেন মাইতি সাধারণ নয়। ইতস্তত ভাব কাটিয়ে অর্ক বারান্দায় উঠে দরজায় কড়া নাড়ল। দ্বিতীয়বারে ভেতর থেকে সাড়া এল। একটি মহিলা জানতে চাইলেন কে কড়া নাড়ছে। অর্ক নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল সুরেন মাইতির সঙ্গে কথা বলতে চায়।

মহিলা বললে, ও তো বাড়িতে নেই।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছেন?

হাসপাতালে।

কোন হাসপাতালে?

পিজি হাসপাতালে।

কারও কিছু হয়েছে?

ওর মায়ের খুব অসুখ, তাই।

অর্ক সরে এল। এই মহিলা কে এবং তিনি সত্যি কথা বলছেন কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। সুরেন মাইতি বাড়িতে থেকে মহিলাকে মিথ্যে কথা শিখিয়ে দিতেই পারে।
 
মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে মানুষের ঔৎসুক্য উবে গেল। কোনও নাটক হল না, হারে রে আওয়াজ করে অস্ত্র নিয়ে কোনও দল ধেয়ে এল না যখন, তখন দর্শকরা যে যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেল। বিশ্বজিৎ এবং তার সঙ্গীরা তখনও অনড়। এই সুযোগটা নিশ্চয়ই নেবে সুরেন মাইতির বাহিনী। শেষরাত্রে হানা দিলে কোনও বাধা পাবে না বলে অপেক্ষা করছে তারা।

কিন্তু রাতটাও ফুরিয়ে গেল। খুব হতাশ দেখাচ্ছিল বিশ্বজিৎদের। অর্ক বেরিয়ে এল ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে। সামনেই বাসস্টপ। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই বাস পেয়ে গেল। ওটা যাবে প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের দিকে, পিজি হাসপাতাল হয়ে।

ভোরের পিজি হাসপাতাল প্রায় মর্গের মতো চুপচাপ। কোনও জীবন্ত মানুষ বাড়িগুলোর বাইরে নেই। শুধু ইমারজেন্সি লেখা ঘরটার সামনে কয়েকটি শরীর তখনও নিদ্রামগ্ন। আধঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে সুরেন মাইতির হদিশ পেল না অর্ক। গেটের বাইরে এসে ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় চা কিনে খেতে খেতে ভাবল, মহিলাকে দিয়ে কাল রাত্রে মিথ্যে বলিয়েছে সুরেন। মাইতি।

চায়ের দাম দিতেই ওপাশ থেকে একজন বলল, আপনি এখানে?

সে মুখ ফিরিয়ে ছেলেটিকে চিনতে পারল, সুরেন মাইতির একটি ছায়া।

ছেলেটি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কেউ কি অসুস্থ?

না। শুনলাম সুরেনবাবুর মা নাকি এখানে ভরতি হয়েছেন, তাই অর্ক থামল।

হ্যাঁ। হয়েছিলেন। ছেলেটি মাথা নাড়ল।

সুরেনবাবু কাল রাত্রে এখানে ছিলেন?

হ্যাঁ। তিনটের সময় মাসিমা চলে গেছেন। দাদা খুব ভেঙে পড়েছেন। আরও একটু বেলা হলে সবাই এসে পড়বে। তখন এখান থেকে নিমতলায় নিয়ে যাব।

অর্ক ঢোক গিলল।

আপনি দাদার কাছে যাবেন?

চলো।

পার্কের পেছন দিকে পাঁচজন মানুষের মধ্যে বসে ছিল সুরেন মাইতি। অর্ককে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। অর্ক কাছে এসে বলল, শুনলাম!

কিছুই করতে পারলাম না। কিছুই না। বলতে বলতে চোখ মুছল সুরেন।

অর্ক বলল, শক্ত হন, ভেঙে পড়বেন না।

আপনি, আপনি যে আসবেন তা আমি ভাবতেই পারছি না। অর্কর হাত ধরল সুরেন মাইতি, কী বলে ধন্যবাদ জানাব।

কথা না বাড়িয়ে অর্ক বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। ঠিক তখনই পকেটে রাখা যন্ত্রটা বেজে উঠল। ওটা বের করে অবাক হল সে। বোতাম টিপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞাসা করল, বলুন রামজি!বলামাত্র লাইন কেটে গেল। তৎক্ষণাৎ ডায়াল করল অর্ক। অন্তত চারবার। প্রতিবারেই রেকর্ড বাজল, আউট অফ রিচ।

অর্ক অপেক্ষা করতে লাগল, নিশ্চয়ই আবার ফোনটা বেজে উঠবে।

.
 

Users who are viewing this thread

Back
Top