What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

বাড়িতে ফিরে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল অর্ক। তার মনে হচ্ছিল সাঁড়াশির দুটো শক্ত হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। একটা পুলিশ অন্যটা সুরেন মাইতির দল। এরা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবেই।

এতদিন যে জীবন সে যাপন করেছে তা যেন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। চাকরিতে জয়েন করার তারিখ চলে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। চাকরিটা চলে গেলে নতুন সমস্যা যোগ হবে। অর্ক অফিসে ফোন করল। তাদের ইনচার্জ ভদ্রলোক ফোন পেয়েই খেপে গেলেন, কী ভাবছেন আপনি? এটা কি আপনার মামার বাড়ি? যখন ইচ্ছে ছুটি নেবেন, যেদিন জয়েন করার কথা সেদিন হাওয়া হয়ে থাকবেন, আবার মর্জিমতো ফোন করবেন, এটা কর্তৃপক্ষ মেনে নেবে বলে ভাবলেন কী করে?

আমি বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আচমকা এমন সমস্যায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম যে যোগাযোগ করতে পারিনি। অর্ক বলল।

কী সমস্যা? চুরিচামারি না খুন করেছেন? মানে?

না হলে পুলিশ এসে আপনার সম্পর্কে খোঁজ খবর করবে কেন?

অবাক হয়ে গেল অর্ক, পুলিশ এসেছিল আমার খোঁজে?

হ্যাঁ। আপনার চরিত্র কীরকম, মন দিয়ে কাজ করেন কিনা, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত তা জিজ্ঞাসা করছিল। আমরা যতটুকু জানি তা বলেছি, যা জানি না তা বলিনি। খোঁজ করার কারণ হিসেবে বলেছে রুটিন চেক আপ।

এসব কেন হল বুঝতে পারছি না। অর্ক বলল।

আমরাও বুঝতে পারছি না। দেখুন, আপনি আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আছেন, কাজের ব্যাপারে আপনার বিরুদ্ধে কোনও কমপ্লেন নেই, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু আপনার প্রচুর ছুটি পাওনা আছে তাই টানা এক মাস ছুটিতে আপনি থাকুন, কালকের মধ্যেই এই ছুটির জন্যে আবেদন করবেন, সেই ছুটির শেষে যদি জয়েন না করেন তখন, বুঝতেই পারছেন, ব্যবস্থা না নিয়ে কোনও উপায় থাকবে না। ফোন রেখে দিলেন ভদ্রলোক।

তৎক্ষণাৎ ছুটির জন্যে আবেদনপত্র লিখে ফেলল অর্ক। দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখের পোস্ট অফিস থেকে একটা খাম কিনে তাতে ঠিকানা লিখে সেটা পোস্ট বক্সে ফেলে দিল।

খুব খিদে পাচ্ছে এখন। অর্ক চারপাশে তাকাল। এই এলাকার রেস্টুরেন্টে সব খাবার পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলো বড় একঘেয়ে। অর্কর ইচ্ছে হল ধর্মতলায় গিয়ে মাটন চাপ আর তন্দুরি রুটি খাওয়ার। বহুকাল এসব খাওয়া হয়নি। সে দেখল ডিপো থেকে একটা ট্রাম বেরুবার উদ্যোগ নিচ্ছে। ট্রামগুলো ওখান থেকে মুখ বের করে এক মিনিট থমকে থাকে। এসপ্ল্যানেড লেখা দেখে সে দৌড়ে ট্রামে উঠতেই কন্ডাক্টার বললেন, ভাড়া ফেরত দিতে পারব না কিন্তু।

এরকম সংলাপ কখনও শোনেনি অর্ক। জিজ্ঞাসা করল, কী বললেন?

কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল বেরুবার কথা আছে। সেখানে গাড়ি পৌঁছাবার আগেই যদি মিছিল বের হয় তা হলে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে জানি না। সে সময় অনেকে ভাড়ার টাকা ফেরত চায় বলে আগাম জানিয়ে দিলাম।

কীসের মিছিল? সিটে বসে থাকা একটি যুবক বলল, আপনি আজকের কাগজ নিশ্চয়ই দেখেননি। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল যাবে ধর্মতলা পর্যন্ত।

তৃণমূলের মিছিল? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

তা বলতে পারব না। বিদ্বজ্জনেরা ডাক দিয়েছেন। ওই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাধারণ মানুষকে মিছিলে যোগ দিতে বলেছেন। লাক ভাল থাকলে মিছিল বের হওয়ার আগেই কলেজ স্কোয়ার পেরিয়ে যেতে পারব। যুবকটি বলল।

ট্রাম চলছে। যেই কোনও স্টপে থামছে অমনি উঠে আসা যাত্রীদের একই কথা শোনাচ্ছেন কন্ডাক্টার। অর্ক লক্ষ করল এর ফলে কেউ আর টিকিট কাটছে না, যার গন্তব্য কলেজ স্ট্রিটের আগে সে-ও টিকিট না কেটে নেমে যাচ্ছে।

মহাত্মা গাঁধী রোডের মোড়ে ট্রাম দাঁড়িয়ে গেল। সামনের রাস্তায় অচল গাড়ির জটলা। ওপাশ থেকেও গাড়ি আসছে না। সেই যুবকটি হঠাৎ বলে উঠল, মার গাড়িয়েছে, বলে নেমে গেল টিকিট না কেটেই। শব্দ দুটোর অর্থ বোধগম্য হল না অর্কর। ঈশ্বরপুকুর লেনের রকবাজরা যে সমস্ত শব্দ উচ্চারণ করত তা এখন বস্তির মেয়েরাও রপ্ত করে ফেলেছে। বাবার কাছে শুনেছে সে একসময় শালা শব্দটা বড়দের সামনে বললে প্রচণ্ড মার খেতে হত। কথাটা শুনে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে, কিন্তু ওই যুবকটি যা বলে গেল তা সে কখনও শোনেনি।
 
ফুটপাত ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই প্রচুর মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে মাইকে একজন জানাচ্ছিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রতিবাদ মিছিল পথে নামবে। আমরা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে চাই, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাই না, আমরা যারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ এই মিছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শ্রেণির যত শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এই মিছিলে অংশগ্রহণ করবেন, যিনি এর আগে কখনও মিছিলে যোগ দেননি তিনিও বামফ্রন্ট সরকারের ঘৃণ্য আচরণের প্রতি ধিক্কার জানাতে রাস্তায় পা রাখছেন। আমি আপনাদের কাছে আবেদন করছি, অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণভাবে এই মিছিলে অংশগ্রহণ করুন।

ভিড় ঠেলে খানিকটা এগোতেই বিখ্যাত মানুষগুলোকে দেখতে পেল অর্ক। এঁরা দীর্ঘদিন ধরে ছবি আঁকছেন, অভিনয় করছেন, লেখালেখি করে মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। এঁদের কেউই কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচারে নামেননি। এই মানুষগুলো আজ নেমে এসেছেন প্রতিবাদে সামিল হতে। অর্ক লক্ষ করল এখানে কোনও দলের পতাকা নেই। এমনকী তৃণমূলেরও নেই। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এমন প্রতিবাদ মিছিল এর আগে কখনও হয়েছে কিনা তা প্রাচীনরা বলতে পারবেন কিন্তু অর্ক মনে করতে পারল না।

মিছিল শুরু হল। একটা লম্বা ফেস্টুনের পেছনে বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিরা, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার, লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা, তারপরে সাধারণ মানুষ। অর্ক অবাক হয়ে সেই মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে দেখল রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর বারান্দায় যেসব মানুষ উৎসুক হয়ে মিছিল দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের অনেকেই নেমে এসে মিছিলে যোগ দিচ্ছেন। ফলে মিছিলের আয়তন ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

কোনও স্লোগান নেই, কলেজ স্ট্রিট বোধহয় এতবড় নীরব ধিক্কার মিছিল আগে দেখেনি। হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মনে পড়ল রামজিকে। রামজির যাওয়ার কথা ছিল সুন্দরবনে। সেখান থেকে কোথায় যেতে হবে তা ওকে বলা হয়নি। সুন্দরবন থেকে নৌকো করে নন্দীগ্রামের কাছাকাছি কোনও জায়গায় পৌঁছানো যায়?যদি যায় তাহলে রামজিকি পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হত? পুলিশের ধারণা সে ওই কাজটা করেছে, কিন্তু অর্ক নিশ্চিত জানে নন্দীগ্রামের যুদ্ধের সময় রামজি তার সঙ্গে ছিল। গুরুমায়ের আশ্রম থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে এসে তারা প্রথম শুনতে পেয়েছিল নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। খারাপ হওয়া গাড়িতে বসে আই পি এস ভদ্রলোকের স্ত্রী কথাটা বলেছিলেন। অতএব রামজি নন্দীগ্রামের সঙ্গে কোনওভাবেই জড়িত নয়।

মিছিল বউবাজারের মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন গলাটা কানে এল, আরে! আপনি? কেমন আছেন?

মুখ ফিরিয়ে অবাক হল অর্ক। কুন্তী সেন। গুরুমায়ের আশ্রমে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে বলল, ভাল। আপনি–?

সকালে কাগজে খবরটা দেখে চলে এলাম। গাড়ি আনিনি। হাওড়ায় এসে সোজা এখানে। নন্দীগ্রামে কী কাণ্ড হল বলুন তো? হাঁটতে হাঁটতে পাশে চলে এলেন কুন্তী সেন, আমি ভাবতেই পারি না, কোনও কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকতে থাকতে এরকম বুর্জোয়াদের মতো কাজ করতে পারে।

অর্ক কিছু বলল না। গত কয়েকদিনের খবরের কাগজ, টিভির সঙ্গে তার কোনও সংশ্রব ছিল না। এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন তাও তার জানা নেই। কিন্তু যাই বলুন না কেন এই বিষয়ে তিনি তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।
 
কিছুটা হাঁটার পর অর্ক জিজ্ঞাসা করল, মিছিলের খবর জেনে আপনি সেই ব্যান্ডেল থেকে চলে এলেন?

সেই ব্যান্ডেল মানে? এখান থেকে গড়িয়াতে যেতে যে সময় লাগে তার থেকে কম সময় ব্যান্ডেলে যেতে লাগবে। এলাম কেননা, মনে হয়েছিল এই প্রতিবাদের মিছিলে আমারও অংশ নেওয়া উচিত। কুন্তী সেন বললেন।

কয়েকদিন আমি খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পাইনি। তাই–।

বাইরে বাইরে ঘুরছিলেন?

হ্যাঁ।

সেদিন গুরুমায়ের আশ্রমে পুলিশ এসেছিল, জানেন?

অনুমান করছি।

তাদের কাছে খবর ছিল বাইরে থেকে দুজন মানুষ নাকি ওখানে আশ্রয় নিয়েছে। গুরুমা তাদের অনুমতি দিলে তারা তল্লাশি চালায় কিন্তু কোনও বাইরের লোককে না পেয়ে চলে যায়।

ওরা কী করে খবর পেল?

তা বলতে পারব না। কিন্তু আপনাদের কেন চলে যেতে হল?

অর্ক একটু ভাবল, তারপর বলল, আমার সঙ্গে যে ছিল তার কাজকর্ম সম্পর্কে আমি স্পষ্ট কিছু জানি না। ছেলেটিকে ভাল লেগেছিল, বুঝেছিলাম সে পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চায়। আমার অনুমান গুরুমাও তাই বুঝেছিলেন। আশ্রমে যাওয়ার পরই বলেছিলেন নদীর ধারটা ঘুরে দেখে আসতে। সত্যি কথা হল, আমার সঙ্গীর জন্যেই পুলিশ আসার আগে তড়িঘড়ি চলে আসি।

আপনার সঙ্গী কি মাওবাদী?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। তবে পুলিশ থেকে শুরু করে সিপিএম এবং তৃণমূলের পাড়ার নেতাদের তাই ধারণা। আমাকে প্রচণ্ড চাপে রেখেছে ওরা।

কুন্তী কিছুক্ষণ কথা না বলে হাঁটলেন। মিছিলে আরও মানুষ যোগ দিয়েছেন এর মধ্যে। কুন্তী বললেন, আমাকে বলা হয়েছিল আপনারা হাইওয়েতে অপেক্ষা করবেন। আমার কথা ছিল বোলপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে ওই রাতে থেকে যাওয়ার, কিন্তু তা না করে গাড়ি নিয়ে বর্ধমানের দিকে অনেকটা গিয়েও না দেখা পেয়ে বোলপুরে ফিরে গিয়েছিলাম।

ও। আমরা বোধহয় তার আগেই লিফ্ট পেয়ে গিয়েছিলাম।

সেই দুপুরের পর অর্কর মনে হল পশ্চিমবাংলার মানুষ আর বামফ্রন্টের সঙ্গে নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে। তাতে তার স্থির বিশ্বাস হল নন্দীগ্রামেই বামফ্রন্টের তেত্রিশ বছরের শরীর কবরে যাওয়ার জন্যে কফিন তৈরি করে ফেলল। কথাটা কুন্তীকে বলতেই কুন্তী হাসলেন, যত দিন এগোবে তত বামফ্রন্টের নেতারা উদ্ধত হবেন, তত মাথা গরম করে অসংলগ্ন কথা বলবেন। আমরা-ওরার বিভাজন তৈরি করবেন। বিরোধী মানুষের শরীর উধাও হয়ে যাবে পথের কাঁটা সরাবার কারণে। অথচ, বিশ্বাস করুন, সেই ছাত্রাবস্থা থেকে আমি কল্পনা করে এসেছি, কমিউনিজমই মানুষকে সুস্থ জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে, কমিউনিজমই সাম্যবাদের আঁতুড়ঘর। বাবার কাছে শুনেছিলাম তারা যখন নকশাল আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন এদেশের কেউ ভাবতেই পারত না কমিউনিস্ট সরকার আসবে। পরে যখন এল তখন মানুষ স্বপ্ন দেখতে চাইল, কিন্তু কোথায় গেল সব? ক্ষমতা মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, এখন সেই আমিই চাইছি, পরিবর্তন হোক।

মিছিলের শেষে নিউ মার্কেটের পাশে একটি রেস্টুরেন্টে মাটন চাপ আর তন্দুরি রুটির অর্ডার দিয়ে ওরা কথা বলছিল। অর্ক হাসল, পরিবর্তন তো চাই, কিন্তু পরিবর্তিত সরকার কোন দলের হবে?

দেখবেন, সেটা মানুষই ঠিক করে দেবে।

ভোটবাক্সে?

তা ছাড়া তো মানুষের আর কোনও অস্ত্র নেই।

কিন্তু সেটার জন্যে উপযুক্ত দল চাই। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে

মানুষ উপযুক্ত দল বলে এই মুহূর্তে ভাবতে পারে না। তার চেয়ে এই অল্প সময়ে তৃণমূল নেত্রী মানুষের সপক্ষে কথা বলে অনেকটা এগিয়ে আছে।

আমি কোনও মন্তব্য করব না। কুন্তী বললেন, মানুষই ঠিক করবে।

ধরুন, আপনি ঠিক বলছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ তৃণমূল নেত্রীর ওপর আস্থা রেখে বামফ্রন্টকে সরিয়ে দিল। একটি মানুষ তার বিশ্বাস ভাবনা নিয়ে যে দল তৈরি করেছেন সেই দল ক্ষমতায় এলে কি আপনি নিশ্চিত যে পরিবর্তন চাইছেন তা সম্ভব হবে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ভবিষ্যৎ এর উত্তর দেবে। কুন্তী বলামাত্র খাবার এসে গেল।

অর্ক হাসল, কিছু বলল না। কুন্তী খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে বললেন, এত মশলা দেওয়া খাবার, হজম করতে পারব তো?

অর্ক বলল, আগামীকাল উত্তরটা দেবে।
 
কুন্তীকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিল অর্ক। ধর্মতলা থেকে ট্যাক্সি নিয়েছিল কুন্তী, আসার পরে ভাড়া দিয়েছিল নিজেই। তারপর বলেছিল, আজ সকালে ভাবতেই পারিনি যে আপনি আমাকে এতটা সময় দেবেন। অর্ক হেসে ফেলল, বিখ্যাত লেখকরা বোধহয় এভাবেই উপন্যাসে লিখে থাকেন যা পাঠক আগে আন্দাজ করতে পারে না।

আমার কথা বলতে পারি, যে ভয়ংকর চাপে আমি স্যান্ডউইচ হয়ে ছিলাম তা থেকে এই সময়টুকু পেরিয়ে এসেছিলাম আপনার দেখা পেয়ে। আপনি চলে গেলে আবার–! কথা শেষ করল না সে।

কুন্তী বলল, একদিন আসব আপনার মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে।

অর্ক মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। কুন্তী চলে গেল ব্যান্ডেলে।

এতক্ষণ একসঙ্গে কাটানোয় কুন্তী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। অর্ক। কুন্তী ব্যান্ডেলে থাকে স্কুলের চাকরির কারণে। শনিবার বিকেলে কলকাতার বাড়িতে এসে রবিবার বিকেলে ফিরে যায়। কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে এখনও ওঁর মা বাস করেন। ব্যান্ডেলে দুজন শিক্ষিকার সঙ্গে একটা চার কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে কুন্তী থাকেন। রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার সময় এইসব তথ্য জানার আগে অর্ক জিজ্ঞাসা করেছিল, এই যে সকালের কাগজে প্রতিবাদের মিছিল হবে খবর পেয়ে চলে এলেন, তার জন্য কোনও সমস্যা হল না?

কীরকম সমস্যা?

সংসারে যা হয়ে থাকে।

ও। আমার হয়নি কারণ আমি সেই অর্থে সংসারী মানুষ নই।

অর্ক ব্যাপারটা অনুমান করার চেষ্টা করছে দেখে কুন্তী হেসে বলল, বুঝতে পারছেন না? আমি সিঙ্গল উয়োম্যান। এক মহিলা। কোনও সন্তান নেই। ফলে পিছুটান নেই। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে একটা চার কামরার বাড়ি ভাড়া করে ব্যান্ডেলে থাকি আর সেই বাড়ির যাবতীয় হ্যাঁপা ওরাই সামলে নেয়। আমি ঝাড়া হাত-পা। আপনি এই ব্যাপারটাকে সুবিধেবাদ বলতে পারেন।

আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায়নি অর্ক। একজন সুশ্রী শিক্ষিত মহিলা মধ্য তিরিশ পেরিয়ে এই জীবনযাপন করলে তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কিছুটা কৌতূহল তৈরি হয় যা কোনও পুরুষের ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু কোনও মানুষ অতীতে কী কাজ করেছিল বা করেনি তার নিরিখে বর্তমানকে বিচার করা কি অত্যন্ত জরুরি? এক জীবনে মানুষকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অবস্থান যতবার বদলাতে হয় অন্য কোনও প্রাণীকে তা করতে হয় না। গিরগিটিরও রং বদলাবার ক্ষমতা বেশ সীমিত।

ট্রামে উঠল অর্ক। সামনের আসনে বসা দুজন যাত্রী আজকের মিছিল নিয়ে কথা বলছে। একজন টিভিতে মিছিল দেখেছে, তার মুখ থেকে অন্যজন শুনছে।

শ্রোতা জিজ্ঞাসা করল, কী বলছ? অ্যান্টি বামফ্রন্ট মিছিল? খুব বড়?

যে টিভিতে দেখেছে সে বলল, ভুল হল। বলতে পারো সিপিএম-এর সরকারের আচরণের প্রতিবাদে ওই মিছিল হয়েছে, টিভি দেখলাম প্রায় সব স্তরের মানুষ রাস্তায় হাঁটছেন।

তৃণমূল, কংগ্রেসের নেতারা সামনে ছিলেন?

না। কোনও রাজনৈতিক নেতাকে মিছিলে দেখিনি।

মানে? এরকম হয় নাকি?

আগে হতে দেখিনি, আজ দেখলাম। চিত্রশিল্পী, লেখক, অভিনেতা অভিনেত্রী, অধ্যাপক থেকে সাধারণ মানুষ, যাঁদের নাম কখনওই কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখিনি, তারা মিছিলে হেঁটেছেন।

ভাবতেই পারছি না। কে কে ছিলেন?

আমি টিভিতে অপর্ণা সেন, বিভাস চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখার্জি, শুভাপ্রসন্নকে দেখেছি। ধরে নাও, আমরা যাঁদের চিনি তাদের অধিকাংশই ছিলেন।

শ্রোতা হাসল, বাপস, এ তো বৈপ্লবিক ব্যাপার। বামফ্রন্ট এই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাবে।

কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্কর মনে হল, আজকের দিনটা বামফ্রন্টের কাছে কালাদিবস হয়ে যাবে। নন্দীগ্রামের কৃষকরা যা শুরু করেছিলেন তা হয়তো গতি হারাত, কিন্তু আজকের মিছিলের পর তা বেগবান হবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলবেন, ভূমিহীন মানুষ, দরিদ্র কৃষক, শ্রমজীবীরা যখন রুখে দাঁড়ান তখন পরিবর্তনের সূচনা হয়। কিন্তু এত তত্ত্ব যখন তৈরি হয়েছিল তখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যারা সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত এবং সুবিধেবাদী, তাদের ঘুম ভেঙে গেলে যদি একত্রিত হতে পারেন তা হলে সেই শক্তিই শেষ কথা বলবে। আজ তারই সূচনা হয়ে গেল।

.
 
ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠল। মোড়ের মুখেই আট-নয়জনের একটা জটলায় যে যার মতো কথা বলছিল, অর্ককে দেখে সবাই চুপ করে গেল। ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আর একটু এগোতেই গলির রকে বসা কয়েকজন তার দিকে তাকিয়েই অন্য পাশে মুখ ঘোরাল। এবার দাঁড়াল অর্ক। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার ভাই? কিছু হয়েছে নাকি?

একজন বলল, বাড়িতে যান, দেখতেই পাবেন। কিন্তু বাড়ি অবধি যেতে হল না। বিশ্বজিৎ চারজন সঙ্গী নিয়ে উলটো দিক থেকে বেশ ব্যস্ত হয়ে আসছিল, অর্ককে দেখে দাঁড়িয়ে গেল, আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

কেন? আমার তো ব্যক্তিগত কাজ থাকতেও পারে।

তা থাকুক। চলুন। বিশ্বজিৎ ঘুরে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার বলো তো? অবাক হচ্ছিল অর্ক।

ঘণ্টা দুয়েক আগে এই বস্তিতে একটা হামলা হয়েছিল।

সে কী? কার ওপর কারা হামলা করল?

যারা করেছিল তারা পালিয়ে যেতে পেরেছে। ওরা ভাঙচুর করেছে, নষ্ট করেছে জিনিসপত্র। কিন্তু আগুন ধরাতে পারেনি, কারণ বস্তির মানুষের চিৎকারে ওরা ভয় পেয়েছিল, আমরাও ছুটে এসেছিলাম। বিশ্বজিৎ বলল।

পথটুকু হেঁটে বাড়ির সামনে এসে অর্ক দাঁড়িয়ে গেল। তাদের উঠোনে ঢোকার দরজার সামনে মানুষ জড়ো হয়ে কথা বলছে, তাদের দেখে সবাই চুপ করে যেতে অর্ক পা বাড়াল। দরজা খোলা, সেখানে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক। দুটো ঘর, রান্নাঘরের দরজা ভাঙচুর করা হয়েছে। খাট টেবিল থেকে যাবতীয় জিনিসপত্র উঠোনে এনে আছড়ানো হয়েছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল যেন, বুকে চাপ অনুভব করল অর্ক।

বিশ্বজিৎ বলল, হয়তো কেরাসিন সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছিল তাই পালাবার আগে আগুন ধরাতে পারেনি, ধরালে কী হত ভাবতেই পারছি না। আপনাদের বাড়ি তো বটেই পুরো বস্তি ছাই হয়ে যেত।

কারা করল এসব? কোনওমতে প্রশ্নটা করল অর্ক।

কেউ তো নিজের পরিচয় দিয়ে এসব করে না। কিন্তু আমরা এতটা মূর্খ নই যে বুঝতে পারব না। দেখুন, খবর দেওয়া হয়েছিল ঘটনার পরপরই। অথচ তাদের দেখা এখনও পাওয়া গেল না। বোঝাই যাচ্ছে যারা কাজটা করেছে তাদের আড়াল করতেই পুলিশ টালবাহানা করছে।

ভেতরে ঢুকল অর্ক। সঙ্গে বিশ্বজিৎ। তার সঙ্গীরা দরজায় দাঁড়িয়ে বস্তির লোকদের ভেতরে ঢোকা আটকাচ্ছিল। এতক্ষণ তারা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল,

অর্ককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ভেতরটা দেখার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল।

বিশ্বজিৎ বলল, আমরা দেখছি। যেসব ফার্নিচার ভাঙেনি সেগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ছেলেরা। যেগুলো ভেঙে গেছে সেগুলো ফেলে দিতেই হবে। এমনিতেই ওগুলো পুরোনো হয়ে গেছে।

অর্ক নিজের মনে বলল, মা-বাবার কালই এখানে আসার কথা। এসে এসব দেখলে ওঁরা যে কী করবেন!

ওঁরা কালই আসছেন?

সেইরকম কথা আছে।

মাথা নাড়ল বিশ্বজিৎ, দেখুন, ওঁদের কাছ থেকে তো আপনি এসব লুকোতে পারবেন না। আমরা এখনই কিছুটা ভদ্রস্থ করে দিতে পারি কিন্তু

পুলিশ এসে দেখার আগে তো এসবে হাত দিতে পারি না।

অর্ক এগিয়ে গিয়ে একটা ছবির ফ্রেম টেনে তুলল। কাঁচ ভেঙে গেছে। ছবিটা রবীন্দ্রনাথের। বিশ্বজিৎ বলল, অর্কা, হাত দেবেন না। যেমন আছে তেমন থাকুক। পুলিশ আগে আসুক–।

এই সময় বাইরের জনতা চেঁচিয়ে উঠল, পুলিশ, পুলিশ এসেছে।

বড়বাবু দেখা দিলেন, সঙ্গে একজন সেপাই। ভেতরে পা দিয়ে চারদিক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। ভুলটা আপনারই। মাওবাদীদের মধ্যে অনেক দল আছে। এক দল অন্য দলকে সহ্য করতে পারে না। যাকে আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তার অ্যান্টি দল বোধহয় জানত না লোকটা এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। তাকে না পেয়ে ভাঙচুর করে গিয়েছে।

অর্ক শান্ত গলায় বলল, আপনার কাছে এত তথ্য যখন আছে তখন যারা ভাঙচুর করেছে সেই দলটাকে ধরুন।

নিশ্চয়ই ধরব। আগে আপনি কানটাকে দিন, আমি মাথাটাকে টেনে নিয়ে আসি। হাসলেন বড়বাবু, আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা করবেন না অর্কবাবু।

আমি সেটা কখন করলাম? অর্ক বিরক্ত হচ্ছিল।

এইরকম জমজমাট এলাকায় বাইরে থেকে কয়েকজন ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র ভাঙল আর সেটা কেউ টের পেল না, যে শিশু মায়ের পেটে রয়েছে সেও বিশ্বাস করবে না। যেহেতু আমি আপনাকে চারদিন সময় দিয়েছি ওই মাওবাদীটার হদিশ জানাতে তাই নিজেকে ধোওয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করতে এই ঘটনা সাজালেন। ঠিক আছে। আমি রেকর্ড করে রাখছি আপনার বাড়িতে কে বা কারা হামলা করেছে, বাকিটা আপনার হাতে। বড়বাবু রবীন্দ্রনাথের ছবিটাকে দেখলেন। বললেন, ইস।

আমার হাতে মানে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
 
আজকের দিনটা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আরও তিনটে দিন আপনি সময় পাচ্ছেন। ওই লোকটা কোথায় আছে আমাকে জানিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বড়বাবু ঘুরে দাঁড়াতেই বিশ্বজিৎ কথা বলল। এতক্ষণ সে চুপচাপ শুনছিল। এবার এক পা এগোল, আচ্ছা, এখানে আসতে আপনার এত দেরি হল কেন?

কৈফিয়ত চাইছেন? অমায়িক হাসলেন বড়বাবু।

আমি তো পুলিশ কমিশনার নই যে কৈফিয়ত চাইতে পারি। অবশ্য তিনিও আজকাল ওইসব চাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ জানে কোথায় কাদের কাছে আপনাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। বিশ্বজিৎ বলল।

একজন পুলিশ অফিসারকে অপমান করার জন্যে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে পারি। আপনি কথাটা উইথড্র করুন। মুখের চেহারা পালটে গেল অফিসারের। চোখ ছোট হয়ে গেল তার।

আমাকে অ্যারেস্ট করতে হলে আর একজনকেও করতে হবে।

অ্যাঁ? মানে?

আচমকা আবার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলেন বড়বাবু, বাঃ, আপনি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান। ওহো, অর্কবাবু, আপনার এখানে যখন এসব নাটক হচ্ছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি মিছিলে গিয়েছিলাম।

মিছিলে? আজ মাওবাদীদের কোনও মিছিল হয়েছে বলে শুনিনি তো!

আজ সাধারণ মানুষ এবং শিল্পী সাহিত্যিকরা নন্দীগ্রামের ইস্যুতে বিশাল মিছিল করেছেন। অর্ক বলল।

ওরে বাব্বা। আপনি সেখানেও ছিলেন! চমৎকার। বড়বাবু তার সঙ্গে আসা সেপাইকে বললেন, এখানে যেসব ভাঙা জিনিস পড়ে আছে তার একটা লিস্ট তৈরি করে নাও। আমি যাচ্ছি।

বিশ্বজিৎ বলল, এক মিনিট স্যার। আপনি কি এই ঘটনা নিয়ে সুরেন মাইতির সঙ্গে কথা বলেছেন?

আবার ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন?

একদমই নয়। আপনি আমাদের থানার দায়িত্বে আছেন। আর সুরেন মাইতি সরকারি দলের আঞ্চলিক নেতা যাঁর কর্তব্য এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকা খুব জরুরি। বিশ্বজিৎ হাসল।

সেটা আমি বুঝে নেব, হ্যাঁ? বড়বাবু এগোলেন। ঠিক তখন একেবারে মুখ বন্ধ করে জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি গলা চেঁচিয়ে উঠল, সুরেনদা থানায় গিয়েছে দুঘণ্টা হল। এখনও ফেরেনি।

বিশ্বজিৎ বলল, এটা বললেই পারতেন। এই হামলার ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্যে সুরেন মাইতিকে থানায় ডেকেছেন।

বড়বাবু আর দাঁড়ালেন না। ভিড় দুভাগ হয়ে তাকে যাওয়ার পথ করে দিল। সেই সময় ভিড়ে মিশে থাকা কেউ চেঁচিয়ে উঠল, বাপি বাড়ি যা।

খানিকটা দূরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন বড়বাবু, তার হাত কোমরের অস্ত্রের কাছে পৌঁছে গেল, কে? কে বলল কথাটা? আয়, এগিয়ে আয় শালা। আমাকে পাক দেওয়া হচ্ছে? এতটা সাহস? কে বলল?

ভিড় এবার নিশ্ৰুপ হয়ে গেল।

বড়বাবু চিৎকার করলেন, বিশ্বজিৎ, এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটাকে নিয়ে থানায় এসে ক্ষমা চাইতে বলুন। নইলে ওকে বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। সুরেনবাবুকে বললেই ওকে পেয়ে যাব। তখন কিন্তু–! শেষ করলেন না কথা, বড়বাবু গলি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু গোলমালটা শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ শোনা গেল অনেকগুলো গলা একসঙ্গে চিৎকার করছে, বাপি বাড়ি যা। তারপর কথাটা বদলে গেল। ধ্বনি উঠল, সুরেন তুই বাড়ি যা।
 
বিশ্বজিৎ তখন তার ছেলেদের নির্দেশ দিচ্ছিল ভাঙা জিনিসগুলো সরিয়ে ভালগুলো ভেতরে সাজিয়ে রাখতে। নতুন আওয়াজ শুনে সে অর্ককে বলল, আমি এদের কাউকে এই স্লোগানটা বলতে শেখাইনি।

অর্ক কিছু বলল না। সে দেখল জনতা তাদের বাড়ির সামনে থেকে সরে বাইরের চায়ের দোকানের কাছে চলে গেল। এই সময় একজন ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে উত্তেজিত গলায় বলল, বিশুদা, তাড়াতাড়ি এসো, প্রতুলদারা চলে এসেছেন। তোমার খোঁজ করছেন।

বিশ্বজিৎ তৎক্ষণাৎ অর্ককে চলে যাওয়ার ইশারা করে দৌড়াল। ছেলেরা উঠোন মোটামুটি পরিষ্কার করে দিতেই মাইকের আওয়াজ ভেসে এল। সেটা শুনে দাদা আসছি বলে বিশ্বজিতের ছেলেরা বেরিয়ে গেল। কোনওমতে দরজাগুলো বন্ধ করে অর্ক দেখল গলি কঁকা হয়ে গিয়েছে। বস্তির প্রায় সবাই গিয়ে ভিড় করেছে চায়ের দোকানের সামনে যেখানে গলিটা বেশ চওড়া, সেখানে পৌঁছে অর্ক অবাক হয়ে দেখল মানুষের জমায়েত অনেক। বড় হয়ে গেছে এই সন্ধে পার হওয়া সময়ে। এরই মধ্যে রকের ওপর বেঞ্চি তুলে বক্তৃতা শুরু হয়ে গেল। মাইকে সকালে আলাপ হওয়া প্রতুল রায়ের গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছিল। তিনি বারংবার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, আপনারা একটুও উত্তেজিত হবেন না। ওরা চাইছে ওদের ফাঁদে পা দিয়ে এমন কাজ করুন যা থেকে ওরা ফায়দা তুলতে পারে। প্রিয় বন্ধুগণ, আজ আপনাদের এলাকায় ওরা যে কাণ্ড করেছে তার নিন্দা যে ভাষায় করতে হয় তা আমি উচ্চারণ করতে পারব না। তেত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকে ওরা এতটাই উদ্ধত হয়ে গিয়েছে যে এখন দেওয়ালের লিখন পড়তে পারছে না। ক্ষমতার নেশা ওদের অন্ধ করে রেখেছে। পুলিশকে করে রেখেছে ক্রীতদাস। যে পুলিশ অবাধ্য হবে তাকে সুন্দরবন অথবা পুরুলিয়ায় বদলি করে দিতে ওদের দুদিন সময় লাগে না। পুলিশ সেটা জানে বলে ওদের পদলেহন করে যাচ্ছে। কিন্তু বন্ধুগণ, আমি আপনাদের বলছি, সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন মা-মাটি মানুষের সরকার এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সভ্য ভদ্র মানুষ। সরকারে এলে আমরা দলতন্ত্রে না গিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করব। কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব না। কিন্তু জনতার টাকায় মাইনে নিয়ে যেসব পুলিশ অফিসার জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন তাদের তালিকা আমরা তৈরি করে রাখছি। আপনাদের আর একবার বলছি, প্ররোচনায় উত্তেজিত হবেন না। বন্দেমাতরম।

সঙ্গে সঙ্গে জনতা চিৎকার করল, সুরেন মাইতি বাড়ি যা।

ক্রমশ ভিড়টা এগিয়ে গেল সুরেন মাইতির বাড়ির দিকে। বাড়ির সব জানলা দরজা বন্ধ। সেই বাড়ির সামনে তেত্রিশ বছরে এই প্রথম জনতার সমস্ত ক্রোধ চিৎকার হয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসতেই জনতা সেদিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ করে তাকাল।

তারপরেই মুখগুলো থেকে শব্দ ছিটকে উঠল, পুলিশের গাড়ি, পুলিশের গাড়ি। তারপরেই যোগ হল, সুরেন মাইতি পুলিশের গাড়িতে।

কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। জনতা সেদিকে এগোতেই গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল।

অট্টহাসি হাসল জনতা।

দাদা, আপনার মোবাইল বাজছে। পাশের লোকটা অর্ককে সচেতন করতেই সে পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করল। মায়ের ফোন।

কানে চেপে গলা তুলে জনতার চিৎকারকে উপেক্ষা করে অর্ক বলল, হ্যাঁ, মা, বলল।

অস্পষ্ট হলেও অর্ক শুনতে পেল, আজ ট্রেনে উঠছি।

যন্ত্রটাকে বন্ধ করে ঠোঁট কামড়াল অর্ক। ঠিক তখনই বিশ্বজিৎ পাশে এসে বলল, দাদা, আজ রাত্রে বাড়িতে থাকবেন না।

.
 
ঈশ্বরপুকুর লেনের ছবিটা আচমকা পালটে গেল। অনেকেই মনে করতে পারছিল না শেষ কবে সুরেন মাইতিদের পার্টি অফিস বন্ধ থেকেছে। সুরেনের শিষ্যরা তখন উধাও, গলির ভেতর যারা আমোদ করছে তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ, তৃণমূল বা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থক নয়।

অর্ক ঘরে ফিরে এল। তাদের মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। প্রৌঢ়া। মুখে বেশ উদ্বেগের ছাপ। একজন জিজ্ঞাসা করল, সব ভেঙে দিয়ে গেছে, না?

প্রায় সব। অর্ক দরজার তালা খুলছিল, ভাঙা তালাটাকেই ঝুলিয়ে বেরিয়েছিল সে।

এ পাড়ার ছেলে নয় ওরা। দ্বিতীয়জন বলল।

আপনারা ওদের দেখেছেন? দরজা খুলে ঘুরে দাঁড়াল অর্ক।

যখন পালাল, ওই উলটো দিক দিয়ে, তখন দেখেছিলাম। ঢোকার সময় দেখিনি। নিঃশব্দে ঢুকেছিল। একজনকে মাঝে মাঝে সুরেন মাইতির কাছে আসতে দেখেছি। কিন্তু এসব বলে ফেললাম বলে পরে সাক্ষী মেনো না। এই ভাড়ায় ঘর তো আর কোথাও পাব না। সুরেন মাইতি শেষ করে দেবে আমাদের।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল অর্ক। বাইরের তালাটাই খারাপ করেছে। ওরা, কড়া ভাঙেনি। ওখানে একটা নতুন তালা ঝোলাতে হবে। উঠোনের এক কোণে ভাঙা আসবাবগুলোর তূপ দেখল সে। এই রাত্রে বাইরে ফেলতে ইচ্ছে করল না। দুটো ঘরে ঢুকে যেটুকু পারল সাজাবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু উঠোনে পা দিয়েই মা সব বুঝতে পারবে। কেমন এমন হল তার উত্তর বানিয়ে দেওয়া চলবে না। আশেপাশের মানুষ যেচে সত্যি কথা শোনাবে। আর তখনই রামজির প্রসঙ্গ চলে আসবে। রামজিকে এখানে থাকতে দেওয়া নিয়ে মা প্রশ্ন তুলেছিল। আগামীকাল মায়ের সঙ্গে সে ঝগড়া করবে, না তার সব অভিযোগ মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করবে?

অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা এখন ট্রেনে। কাল সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে ওরা। মাথা নাড়ল অর্ক। না, ঝগড়া করে কোনও লাভ নেই। মা যত কটু কথা বলুক মেনে নেওয়াই উচিত। একটা কথা তো ঠিক, সে যদি এখানে রামজিকে আশ্রয় না দিত তা হলে আজকের ঘটনাটা ঘটত না।

কিন্তু হঠাৎ আজকেই কেন ঘটনা ঘটল? যদি ধরে নেওয়া যায়, সুরেন মাইতির লোক ভাঙচুর করেছে তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করল? সে তো বামফ্রন্ট বা সুরেন বিরোধী কোনও কথা আজ দুপুর পর্যন্ত কাউকে বলেনি। থানাতেও সে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় তাকে ওরা বামফ্রন্ট বিরোধী বলে ভেবেছে তা হলে বাড়িতে এসব না করে তাকেই নির্যাতন করল না কেন? আর করার জন্যে এই বিকেলটাকেই বেছে নিল। কেন?

মাথা কাজ করছিল না। সন্ধে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ কিন্তু অর্কর ইচ্ছে হল এক কাপ চা খেতে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মায়ের প্রিয় রান্নাঘরেও তাণ্ডব চলেছে। চা-চিনির প্লাস্টিকের কৌটোগুলো মুখ খুলে মাটিতে পড়ে আছে। অর্ক মাথা নাড়ল। এই ঘরটাকে অন্তত ঠিকঠাক করতে হবে মা আসার আগে।

দরজায় নতুন তালা ঝুলিয়ে গলির চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়াল সে। বস্তির বাইরে বেরিয়ে দেখল দোকানটা এখন বন্ধ। অনেক রাত পর্যন্ত যে দোকান খোলা থাকে তা কী কারণে বন্ধ রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না।

হঠাৎ অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে ভেসে এল, বোঝা গেল স্লোগান দিতে দিতে ট্রামডিপোর দিক থেকে মানুষগুলো এগিয়ে আসছে। মিনিটখানেক পরেই দেখা গেল ওদের, বেশ বড়সড় একটা মিছিল বামফ্রন্টের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেল। মিছিলের পুরোভাগে হাতজোড় করে হেঁটে আসছেন সুরেন মাইতি। বিশ্বজিত্রা এখন ধারে কাছে নেই। যারা এতক্ষণ হইচই করছিল তারা একেবারে চুপ। স্লোগান উঠল, সর্বহারার বন্ধু কে? সিপিএম, আবার কে? স্বার্থলোভী উঠাইগিরির দল, দূর হঠো, দূর হঠো। মিছিল এগিয়ে গিয়ে থামল সুরেন মাইতির বাড়ির সামনে।
 
মিছিলের সঙ্গে হেঁটে আসা মানুষদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন অর্কর কাছে। এঁকে মাঝেমধ্যেই অনিমেষের সঙ্গে গল্প করতে দেখেছে অর্ক। এককালে সরকারি বাসের ডিপোয় কাজ করতেন। অবসর নেওয়ার পর খবরের কাগজ পড়ে আর এর ওর সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেন। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কবে আসবেন?

আগামীকাল।

শুনলাম তোমাদের বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। এসে কী দেখবেন ওরা? কারা করেছে তা জানো?

না।

যত কম জানা যায় তত ভাল। তুমি সে সময় কোথায় ছিলে?

সত্যি কথা বলল অর্ক, মিছিলে।

অ্যাঁ? তুমি রাজনীতি করো নাকি?

না, ওটা অরাজনৈতিক মিছিল ছিল। নন্দীগ্রামে পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে অরাজনৈতিক মানুষেরা ধিক্কার মিছিল করেছেন আজ। অর্ক বলল।

বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন, সোনার পাথরবাটি হয় নাকি?

মানে?

মিছিল হবে, তার ওপর ধিক্কার মিছিল বলে কথা, অথচ তাতে রাজনীতি থাকবে না, শিশুভোলানো কথা বলছ বাবা। তা তোমাকে ওই মিছিলে

এখানকার কেউ নিশ্চয়ই দেখেছিল। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

এ কথা কেন বলছেন?

দেখো, রাগ প্রকাশ করার জন্যে একটা উপলক্ষ তো চাই। ফিসফিসানি শুনছিলাম, তোমার বাড়িতে একটা মাওবাদী লুকিয়ে আছে। তোমাকে মিছিলে দেখে ওদের মনে হতেই পারে বাড়ির ভেতরটা খুঁজে দেখা দরকার। মানুষ না পেয়ে অন্যভাবে মনের ঝাল মিটিয়েছে। এতক্ষণে বুঝলাম। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

অর্ক বলল, আপনি যাদের কথা বলছেন তারা তো আপনার সঙ্গে এইমাত্র হেঁটে আসতে পারে।

হয়তো পারে।

আপনিও তাদের সঙ্গে হাঁটলেন!

কোনও অন্যায় করিনি বাবা। একটু হাঁটাহাঁটি হল আবার সময়ও কাটল। আজ ওদের সঙ্গে আমি ঝোলে আছি, কাল অন্য কেউ অম্বল নিয়ে এলে তাতেও থাকব। বাঁচতে হলে জলের মতো হতে হবে। যে পাত্রে যেমন। সাবধানে থেকো বাবা। এই যে এসব কথা যখন তোমার বাবাকে বলি তখন তিনি চুপচাপ শুনে যান। হ্যাঁ না কিছুই বলেন না। ওটাও বাঁচার একটা ভাল পদ্ধতি। বৃদ্ধ চলে গেলেন সুরেন মাইতির বক্তৃতা শুনতে।

অর্কর মনে হল বৃদ্ধের কথাটাই ঠিক। নিশ্চয়ই তাকে মিছিলে দেখে কেউ মোবাইলে সুরেন মাইতিকে জানিয়েছিল। সুরেন যা নির্দেশ দেওয়ার দিয়ে সোজা থানায় গিয়ে বড়বাবুর কাছে বসে ছিল।

এটুকু ভাবতেই অর্কর মনে হল বিশ্বজিৎ তাকে ভুল সতর্ক করেনি। আজ রাত্রে তার ওপর আবার আক্রমণ হতে পারে। যেভাবে বিশ্বজিৎত্রা এলাকা দখল করে সুরেন মাইতিকে চলে যেতে বাধ্য করেছিল তাতে মনে হয়েছিল এখান থেকে ওরা একেবারেই উৎখাত হয়ে গেল। কিন্তু আধঘণ্টার মধ্যেই সুরেন মাইতি বেশ বড় দল নিয়ে ফিরে এসে আবার জাঁকিয়ে বসল। বিপক্ষের কোনও সংগঠন নেই জানা থাকায় সুরেন মাইতি একটুও দেরি করেনি। এই অবস্থায় জেনেশুনে রাত্রে বাড়িতে একা থাকা খুবই বোকামি হবে।

দ্রুত বাড়ি ফিরে এসে একটা কাপড়ের কাধ ঝোলানো ব্যাগে দু-তিনটে জামা একটা প্যান্ট আর প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে এটিএম কার্ডটা নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে উলটোদিকের পথটা ধরল। এই পথটা বস্তির ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেলগাছিয়া ব্রিজের কাছে গিয়েছে, কপাল খুব খারাপ না হলে কেউ চট করে তাকে দেখতে পাবে না।
 
ডিপো থেকে বেরিয়ে আসা ট্রামে উঠে বসল অর্ক। খালি ট্রাম। বসামাত্র খেয়াল হল, কোথায় যাবে ঠিক করা হয়নি, কোথায় গিয়ে রাতটা থাকা যায়? এই মুহূর্তে পরিচিত কোনও মুখ মনে পড়ল না। কোথায় যাওয়া যায়? শিয়ালদায় বেশ কিছু অল্প দামের হোটেল আছে, তার একটা নিয়ে রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে ট্রাম থেকে নামল অর্ক। এখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে। শিয়ালদার হোটেলের পাড়ায় হেঁটে এল সে। প্রথম যে হোটেল চোখে পড়ল তাতেই ঢুকে পড়ল। ঘর পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই টেবিলের উলটোদিকে বসা লোকটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে হাত বাড়াল।

কী চাইছেন?

আপনার পরিচয়পত্র। ভোটার কার্ড আছে?

না।

তা হলে যা দিয়ে বোঝা যাবে আপনি কে তাই দিন।

আমি তো সঙ্গে কিছু আনিনি।

তা হলে ঘর দেওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু কেন? আমি শুধু আজকের রাতটা থাকব।

আর সঙ্গে মালপত্র নেই। তাই তো? দেখুন, থানা থেকে কড়া অর্ডার এসেছে। উইদাউট আইডেন্টিটি কাউকে ঘর দেওয়া যাবে না। যান। ঝামেলায় পড়তে চাই না। লোকটা বিরক্ত গলায় বলল।

মহাত্মা গাঁধী রোডে দাঁড়িয়ে কী করবে যখন মাথায় আসছিল না, ঠিক তখন ট্রামটাকে দেখতে পেল অর্ক, হাওড়া স্টেশন যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিটা মাথায় এল। সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে যে-কোনও একটা বেঞ্চিতে বসে সে দিব্যি রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে।

হাওড়া স্টেশন পৌঁছে ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই সে দেখল একটা যাত্রীকে খুব শাসাচ্ছেন স্টেশনের টিকিট চেকার। লোকটি ভেতরে ঢোকার জন্যে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনেছিল কিন্তু চেকার বলছেন প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনে রাত পর্যন্ত সেই অধিকারে ভেতরে থাকা যায় না। তা ছাড়া চেকারের ধারণা ওই প্ল্যাটফর্ম টিকিট সকালে কাটার পর অনেকবার হাতবদল হয়েছে। লোকটি স্বীকার করল সে ঘণ্টাখানেক আগে কম দামে টিকিটটি কিনেছে।

অর্ক সরে এসে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। এখন টিকিট কিনে ভোর পর্যন্ত স্টেশনে থাকা যাবে কি না তা ওর জানা নেই। ঝামেলায় না পড়ার জন্যে সে খড়গপুর পর্যন্ত একটা সাধারণ টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকল। ঢুকে চমকে গেল অর্ক। গিজগিজ করছে মানুষ। কোনও বেঞ্চি খালি নেই, মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে বসে আছে প্রচুর মানুষ। অর্ক অনুমান করল এরা হয় মধ্যরাতের নয় ভোরের ট্রেন ধরবে। কিন্তু এখানে রাত কাটাতে হলে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

খিদে পাচ্ছিল এবার। পাশের স্টল থেকে চিকেন রোল এবং চা খেয়ে সে দেখল এখন রাত পৌনে এগারোটা। কী করা যায় ভাবতেই সে দেখল সামনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে গেল। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ক্রমাগত কোন ট্রেন ছাড়বে এবং আসবে তার ঘোষণা চলছে। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল ভাবনাটা। তার পকেটে খগপুরের টিকিট আছে। কোনও লোকাল ট্রেনে সে স্বচ্ছন্দে আরাম করে খঙ্গপুরে চলে যেতে পারে। তারপর সেখানে নেমে হাওড়ার টিকিট কিনে ফিরে আসতে আসতে রাত শেষ হয়ে যাবে। ভাগ্য ভাল থাকলে বসার বদলে সে শুয়েও যেতে পারে। ট্রেনটা যদি খড়গপুরেই যাত্রা শেষ করে তা হলে ঘুমিয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top