What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

পুলিশের মুখোমুখি যদি হতে না চাও তা হলে আমার বিশ্বাস তোমরা আমাকে অপদস্থ করবে না। ওই অজয় নদের ওপারের জঙ্গলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারবে। তবে পুলিশ চলে যাওয়ার পর যদি এখানে তোমরা ফিরে আসো তখন তোমাদের থাকতে দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে ভাবতে হবে। সকালে তোমাকে বলেছিলাম অজয়ের ধারে ঘুরে দেখে আসতে। ইচ্ছে হলে দেখে এসো। গুরুমা উঠলেন, এবার আমাকে তৈরি হতে হবে। তোমরা আসতে পারো। কুন্তী, তুমি আজই ফিরে যেতে চাইছ?

হ্যাঁ। বোলপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে রাত্রে থাকব।

দ্যাখো। যদি মনে করো, এখানেও থাকতে পারো। আমার এই এখানে। গুরুমা সামনের ঘরটি আঙুল তুলে দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

রোদ মরে আসছে। অর্ক বলল, আচ্ছা, চলি।

কুন্তী বললেন, একটু দাঁড়ান, আপনার বাবার নাম কি অনিমেষ?

হ্যাঁ। আপনার বাবা তা হলে আমার বাবাকে চিনতেন?

নিশ্চয়ই। বাবার কাছে আপনার মায়ের কথাও শুনেছি। প্রচুর স্যাক্রিফাইস করেছেন মহিলা। কুন্তী বললেন।

অর্ক কিছু বলল না।

আর তা হলে আপনিই সেই অর্ক। কুন্তী হাসলেন।

পৃথিবী খুব ছোট জায়গা।

তাই তো দেখছি। পনেরো-ষোলো বছরে শোনা গল্পটা আজ আপনাকে দেখে নতুন করে মনে পড়ছে। খুব ভাল লাগছে।

অর্ক তাকাল, আপনি কি গুরুমায়ের শিষ্যা?

আমি? বুকে আঙুল রেখে মাথা নাড়লেন কুন্তী, প্রথাগত দীক্ষা নিয়ে শিষ্যা আমি হইনি। কোনও কোনও মানুষ যখন কথা বলেন তখন শুনলে ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এক অর্থে তিনি নিশ্চয়ই গুরু হয়ে যান। এরকম গুরু আমার কয়েকজন আছেন। তাদের আমি চোখেও দেখিনি।

যেমন?

রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, কার্ল মার্কস।

সে কী? ওই দুজনের পাশে কার্ল মার্কস?

কেন নয়? আপনি দাস ক্যাপিটাল পড়েছেন?

না।

আলোচনা থাকায় একবার এই আশ্রমে চাই না। কিন্তু

তা হলে এই আলোচনা থাক। কুন্তী বললেন, আমি মাঝে মাঝে বোলপুরে আসি। যখনই আসি তখনই একবার এই আশ্রমে এসে গুরুমায়ের সঙ্গে দেখা করে যাই। ওঁর অতীত আমি জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু এলে ভাল লাগে।

অর্ক বলল, আচ্ছা। তা হলে এখন চলি।

আপনি কি প্রার্থনাতে যোগ দিচ্ছেন?

প্রার্থনা?

মন্দিরের সামনে সবাই একত্রিত হন। পুজো শুরুর আগে গুরুমাকে সামনে রেখে কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। তারপর গুরুমা উপদেশ দেওয়ার পর নিজের হাতে মায়ের পুজো করেন। ওই পুরো ব্যাপারটাকেই এখানে প্রার্থনা বলা হয়।

না। আমি এখন অজয় নদের চরে যেতে চাই। গুরুমা আমাকে বেশ কয়েকবার ওখানে যাওয়ার কথা বলেছেন। আচ্ছা, এলাম।

অর্ক ঘর পেরিয়ে বাইরে আসতেই বৃদ্ধ শিষ্যকে দেখতে পেল। ইতিমধ্যে তার পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গিতে তাকে ঈশ্বরভক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। বললেন, প্রার্থনার পর এখানে চা এবং সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়। দূর থেকেই ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পাবেন। অন্য সময় এক-দুবার বাজলেও সে সময় পরপর সাতবার বাজবে।

মাথা নেড়ে এগিয়ে যেতেই অর্ক তরুণ শিষ্যকে দেখতে পেল। বেচারা সম্ভবত তখন থেকে এখানেই অপেক্ষা করছিল। দুবার ঘণ্টাধ্বনি হতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এখনই প্রার্থনা আরম্ভ হবে?

হ্যাঁ, সবাই মন্দিরে পৌঁছে গিয়েছেন। অতিথিরাও অংশ নিতে পারেন। আপনি কি সেখানে যাবেন না ঘরে ফিরবেন?

ঘরেই ফিরব।
 
অর্ককে পৌঁছে দিয়ে তরুণ শিষ্য দ্রুত চলে গেল প্রার্থনায় যোগ দিতে। এই যে ছেলেটি তাকে একটা সীমা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল এবং আবার ফিরিয়ে আনল, এটা নিশ্চয়ই স্ব-ইচ্ছায় করেনি। তা হলে কি আশ্রমের মধ্যে বহিরাগতদের চলাফেরা এঁরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান? এখানকার শেষ কথা যখন গুরুমাই বলেন তখন নির্দেশটা তারই। কেন?

রামজিকে ঘুম থেকে তুলল অর্ক। বলল, চলুন নদীর চরে যাব।

এখন রামজি অনেকটা চাঙ্গা। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ঘুমটা দরকার ছিল।

অর্ক রসিকতা করল, যে কাজে এসেছেন তাতে কি এভাবে ঘুমোনোর সুযোগ পাবেন? এখান থেকেই তো ছুটতে হবে সুন্দরবনে।

হাঁটতে হাঁটতে রামজি বলল, যতদূর জানি সেখানে তো খাল আর তারপর সমুদ্র। কুমির আর বাঘ আছে প্রচুর। মুশকিল হল আমি সাঁতার জানি না।

জেনেও কোনও লাভ হত না। সুন্দরবনের নদী বা খালে সাঁতরানো যায় না।

অর্ক নদীর ধারে এসে দাঁড়াল। যতই অজয়কে নদ বলা হোক অন্যমনস্ক মন নদীই বলে চেনে। এদেশের যাবতীয় নদীর নাম স্ত্রীলিঙ্গের পরিচায়ক, পুরুষ নাম হলেই নদ হয়ে যায়। কোনও মানে হয় না।

ওরা চরে নামল। রুপোলি বালির ওপর দিয়ে বিকেলের বাতাস বইছে, খানিকটা হাঁটার পর জলের ধারা। কোথাও হাঁটুর ওপরে কোথাও গোড়ালি ডোবা। ওরা জায়গা বেছে নিয়ে জল পেরিয়ে আবার বালির চরে আসতেই খানিকটা দূরে দুটো শেয়াল তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক হেসে ফেলল।

হাসছেন কেন? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

জলপাইগুড়িতে আমার ঠাকুমার পোষা শেয়াল আছে।

শেয়াল পোষ মানে?

তাই তো দেখে এলাম। বলতে বলতে অর্ক দেখতে পেল আশ্রমের দিক থেকে কেউ একজন দুহাতে জিনিস নিয়ে দৌড়ে এদিকে আসছে। চিৎকার করছে লোকটা। আর একটু কাছে আসতেই চিনতে পারল অর্ক, সেই তরুণ শিষ্য হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে, দুহাতে ওদের দুজনের ব্যাগ। জল পেরিয়ে এসে সে একটু দম নিয়ে বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি ওই জঙ্গলের ভেতর চলে যান।

কেন?

খবর এসেছে পুলিশ আবার সার্চ করতে আসছে। ছেলেটি শ্বাস ফেলছিল দ্রুত, ওই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুই মাইল গেলে বর্ধমানের রাস্তা পেয়ে যাবেন, পুলিশ চলে গেলে কুন্তীদিদি ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি চলি। পুলিশ আসার আগেই আশ্রমে ফিরতে হবে। তরুণ শিষ্য যেভাবে এসেছিল সেইভাবে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল, যদিও এখন গতি অনেক কম।

দ্রুত বালির চর ভেঙে ওরা জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপর ঘুরে দেখল ছেলেটি তখনও ওপারে পৌঁছায়নি। রামজি জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ কী করে আমাদের কথা জানতে পারল? তার মানে ওদের চর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা থেকে এখানে এসেছে?

না। তা হতে পারে না। আশ্রমের কেউ নিশ্চয়ই পুলিশকে জানিয়েছে। কিংবা আমরা আশ্রমে ঢোকার আগে লোকাল লোক যারা দেখেছিল তাদের মধ্যে পুলিশের ইনফর্মার ছিল। আবার দেখুন, পুলিশের কেউ আশ্রমে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে বলে ছেলেটা দৌড়ে এল। চলুন, হাঁটা যাক। পুলিশ আমাদের ওখানে না পেলে নিশ্চয়ই নদীর এপাশে আসবে। অর্ক হাঁটতে শুরু করল।

আর একটু পরে তো সব অন্ধকারে ঢেকে যাবে, কোথায় খুঁজবে ওরা? রামজি হাসল, অন্ধকার ঘন হওয়ার আগেই আমরা যতটা পারি এগিয়ে যাই।

এই জঙ্গল ঘন নয়। মাঝে মাঝে কিছু বড় গাছ থাকলেও বেশিরভাগ জায়গায় ঝোঁপ এবং লতানো গাছের জঙ্গল। অবশ্য একটা পায়ে চলা পথ। পেয়ে ওদের হাঁটতে সুবিধে হচ্ছিল।

কিন্তু সেই সমস্ত চরাচর অন্ধকারে ডুবে গেল, শিয়ালগুলো ডেকে উঠল সমস্বরে, সন্ধ্যাতারা লাফিয়ে উঠল আকাশের কোনায় অমনি ওরা দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনার কাছে কি টর্চ আছে?

না। পায়ে হাঁটি, চলুন।

কিন্তু এই পায়ে হাঁটা পথ যে বর্ধমানের রাস্তার দিকে যাচ্ছে তার নিশ্চয়তা কী?

তা ঠিক। তা হলে এক কাজ করি। এখানেই রাতটা কাটিয়ে ভোরের জন্যে অপেক্ষা করি। রামজি বলল।

সেটা ঠিক হবে না। দিনের আলোয় জঙ্গল থেকে বের হলে যে কেউ সন্দেহ করবে। চলুন। অর্ক এগোল। মাঝে মাঝেই ঝোঁপের পাতায় শরীরে। জ্বলুনি ধরছিল। রাত দশটা নাগাদ ওরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে অজয় নদের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে দূরে গুমগুম আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখল একটা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে।

কাছে এলে ওরা পাশাপাশি গাড়ি চলার সেতুটাকে দেখতে পেয়ে রাস্তার ওপর উঠে গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। অর্ক বলল, এই দিকটা দিয়ে গেলে বর্ধমানে পৌঁছোনো যাবে।

কতটা দূর? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

বোলপুর অনেক কাছে। গেলে ঝুঁকি নিতে হবে।

রামজি তাকাল। বোলপুরের দিক থেকে একটা বড় গাড়ি আসছে। তার হেডলাইটের আলো বেশ তীব্র। রামজি দ্রুত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল ওটাকে থামার জন্যে। গতি কমাচ্ছে না দেখে বাধ্য হয়ে সরে এল সে।

অর্ক বলল, কেউ থামবে না ডাকাতির ভয়ে।

তা হলে?

যা হওয়ার তা হবে। চলুন বোলপুরের দিকেই হাঁটি।

ওরা মিনিট পনেরো হাঁটার পর রাস্তার ধারে একটা গাড়িকে হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সামনের সিটে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বসে। অর্করা শুনল, হঠাৎ গাড়িটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক গাড়ির মেকানিজম জানেন না। সঙ্গে সঙ্গে রামজি বনেট তুলে পরীক্ষা শুরু করলে অর্ক বলল, গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে আমাদের বর্ধমান পর্যন্ত লিট দেবেন?

ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা বললেন, নিশ্চয়ই দেব।
 
রামজির কৃতিত্বে গাড়ির ইঞ্জিন প্রাণ ফিরে পেলে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা ঠিক কোথায় যেতে চাইছেন?

অর্ক বলল, আমরা কলকাতায় যাব, আপনারা যদি বর্ধমানে নামিয়ে দেন! ভদ্রমহিলা বললেন, উঠে পড়ুন। ওরা পেছনের দরজা খুলে উঠে বসার পর ভদ্রলোক গাড়ি চালু করলেন। অর্ক লক্ষ করছিল, এতক্ষণ ভদ্রলোক কোনও কথা বলেননি, ভদ্রমহিলাই যা বলার বলছেন।

গাড়ি চলছিল অন্ধকার চিরে। রামজি একটা বড় শ্বাস ফেলল। ওটা যে স্বস্তির শ্বাস তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ভদ্রমহিলা অন্ধকার গাড়িতেই মুখ ঘোরালেন, আপনারা ওরকম জায়গায় কী করছিলেন?

পাশেই তো অজয় নদ। ওখানে সুন্দর একটা বাংলো আছে, বেড়াতে এসেছিলাম। একটু আগে ওর বাড়ি থেকে ফোন এল, কারও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কার হয়েছে জানার আগেই লাইন কেটে গেল। তারপর কিছুতেই আর যোগাযোগ করা গেল না। তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছি, যা পাব তাতেই কলকাতায় ফিরতে চাই। চটজলদিতে মিথ্যে বলল অর্ক। এ ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি।

ভদ্রমহিলা বললেন, আশা করি দুর্ঘটনায় খারাপ কিছু ঘটেনি। আপনারা এলে হয়তো সারারাত ওই জায়গায় বসে থাকতাম আমরা। কিন্তু বর্ধমানে যাবেন বলছেন কেন?

কাছাকাছি বলে। ওখান থেকে ট্রেন ধরব।

আপনারা বর্ধমানে যেতে চাইলে নামিয়ে দিতেই পারি। কিন্তু আমরা শহরে ঢুকে বাইপাস ধরতাম, আমরা যাব নরেন্দ্রপুর। ভদ্রমহিলা বললেন।

বাঃ। খুব ভাল। আপনাদের তো কলকাতা দিয়েই যেতে হবে।

হ্যাঁ। বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে ঢুকব। ভদ্রমহিলা এবার সামনে ফিরে সিডি অন করলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় গান বেজে উঠল।

অর্ক ভেবে নিল, কলকাতায় পৌঁছোতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। তখন রামজিকে সঙ্গে নিয়ে বেলগাছিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। ঈশ্বরপুকুর লেনের বাসিন্দাদের কেউ না কেউ ফুটপাতে জেগে থাকে। অথচ অত রাতে ওকে শহরের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াও যাবে না। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবেই। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না কোথায় ওকে রাখা যায়। তার পাশে বসে আছে রামজি একদম নিশ্চিন্ত হয়ে। এরকম ছেলে কী করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে তা বোঝা মুশকিল।

ভদ্রমহিলা বললেন, আজকের খবর শুনেছেন?

না।

সে কী! ভয়ংকর খবর। নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গ্রামবাসীরাও পালটা লড়াই করেছে। গুলি চলেছে দুপক্ষ থেকে। শুনলাম হতাহত প্রচুর। বামফ্রন্ট এত বড় ভুল কী করে করল জানি না। ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন।

গ্রামবাসীরাও গুলি চালিয়েছে? অর্ক অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।

সিপিএম বলছে তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীরা হাত মিলিয়েছে। সেইসব মাওবাদীরাই গুলি চালিয়েছে। সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদের জমি হাতছাড়া করবে না বলে যে আন্দোলন করেছে তাদের ওপর সরকার কেন গুলি চালাবার অর্ডার দেবে? ছিঃ।

আড়চোখে রামজিকে দেখল। কথাগুলো রামজির কাছে এখন আর অবোধ্য নয়। অর্কর মনে হল নন্দীগ্রাম বামফ্রন্টের একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে। যে-কোনও ক্ষমতা তা রাজনৈতিক হোক, ব্যবসায়িক হোক বা শারীরিক, তার একটা চূড়ান্ত সীমা থাকে। সেই সীমায় ওঠার পর পতন শুরু হলে আর আটকানো যায় না।
 
রাত একটা নাগাদ বিদ্যাসাগর সেতুর টোলট্যাক্স দিয়ে গাড়ি কলকাতায় ঢুকল। ভদ্রলোক কোনও কথা বলেননি এই সময়ের মধ্যে। ভদ্রমহিলাও অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ গান শুনে গেছেন। একবার জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় নামবেন আপনারা?

আপনারা কি গড়িয়া হয়ে নরেন্দ্রপুর যাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

তা হলে গড়িয়াতেই নামিয়ে দিন।

ওমা! আপনারা ওখানেই থাকেন?

আমি নই। এর বাড়ি।

উনি তো গাড়িতে ওঠার পর কথাই বললেন না।

মন খারাপ, ভয় পেয়ে গেছে।

গড়িয়ার মোড়ে গাড়ি থামলে ওরা নেমে পড়ল। ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে অর্ক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ হল না।

কী দরকার? ওঁর সঙ্গে তো কথা বললেন। ভদ্রলোক গিয়ার টানলেন।

আপনার পরিচয়টা–।

ভদ্রমহিলা হাসলেন, উনি একজন আইপিএস অফিসার।

গাড়ি বেরিয়ে গেলে রামজির মুখ থেকে ছিটকে এল, বাঁচ গিয়া।

একজন আইপিএস অফিসার আমাদের লিস্ট দিলেন। বাঃ। দারুণ ব্যাপার। অর্ক বলল, এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে জেলে যেতে হবে।

রামজি জিজ্ঞাসা করল, এখানে কোনও রেলওয়ে স্টেশন নেই?

অর্ক চিন্তা করল। গড়িয়াতে একটা রেলের স্টেশন আছে। কিন্তু সেটা কোথায় তা তার জানা নেই। রাস্তায় কোনও লোক নেই যে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। সে একটা বন্ধ দোকানের শেডের নীচে রামজিকে নিয়ে চলে এল। বলল, কোনও উপায় নেই। এখানেই বসে পড়ুন। সামনে লরিটা থাকায় রাস্তা থেকে চট করে কেউ দেখতে পাবে না।

ওরা ধুলো ভরতি ফুটপাতে বাবু হয়ে বসে পড়ল। রামজি বলল, রাস্তায় কত ধাবা ভোলা ছিল, ওরা গাড়ি থামাল না।

খিদে পেলে কিছু করার নেই।

এই সময় রামজির মোবাইল বেজে উঠলে সে তাড়াতাড়ি শব্দটাকে থামিয়ে কানে চাপল, হ্যালো। তারপর ওপাশের কথা শোনার পর আচ্ছা বলে মোবাইল অফ করে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে খঙ্গাপুরে কী করে যাব?

এই তো যাচ্ছিলেন সুন্দরবনে। চেঞ্জ হয়ে গেল? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

রামজি বলল, সেখানে যে জন্যে যাওয়ার কথা ছিল সেই কাজটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই খড়গপুরে যেতে বলল।

কোনও ঠিকানা বলেছে?

হ্যাঁ। স্টেশনের বাইরে গিয়ে লালকেবিন চায়ের দোকানে গিয়ে বাসুদেব নামের একজনকে খোঁজ করলেই কোথায় যেতে হবে বলে দেবে। কথাগুলো বলেই রামজি এই রে বলে চুপ করে গেল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

এইসব কথা গুপ্ত রাখতে আমাদের শেখানো হয়েছিল। সরল গলায় বলল রামজি।

বাঃ, চমৎকার! আমি আপনাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে পাড়ার লোকদের মনে সন্দেহ তৈরি করলাম, আপনার বিপদ বুঝে এখানে ওখানে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিলাম অথচ আপনি আমাকেই একথা বললেন? ঝাঁঝিয়ে উঠল অর্ক।

না না। ভুল বুঝবেন না। আমার মাথা কাজ করছে না।

আমি একটা কথা বলব, শুনবেন?

বলুন।

আপনি হাজারিবাগে ফিরে যান।

ফিরে যাব?

হ্যাঁ। গিয়ে আগে যা করতেন তাই করুন। আপনার পক্ষে এই আগুনস্রোতে ভাসা বোধহয় সম্ভব নয়। আপনার মনের গঠন সেরকম নয়।
 
রামজি কথা বলল না কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে দুপাশে। তাদের মধ্যে পুলিশের গাড়ি থাকা খুবই স্বাভাবিক। রামজি বলল, আপনি সেইসব মানুষদের দেখেছেন যারা কেন বেঁচে আছে। তা নিজেরাই জানে না। জঙ্গল থেকে পাতা কুড়িয়ে এনে যারা বিক্রি করে শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকবে বলে, তাদের দেখেছেন? আরও কিছু মানুষ এই ভারতবর্ষে আছে যারা বহুকাল ভাতের গন্ধ পায়নি, তাদের দেখেছেন?

দেখিনি, তবে জেনেছি। অর্ক বলল।

কিছুই জানা যায় না যতক্ষণ নিজের চোখে না দেখছেন। মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে শুরু করে বিহারের কিছুটা আর ঝাড়খণ্ডের অনেকটা অঞ্চল জুড়ে এদের বাস। কোনও সরকার এদের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। এদের জন্যে টাকা বরাদ্দ হলে সেটা রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে বছরের পর বছর। গ্রামে জল নেই। এক কলসি জল আনতে তিন ক্রোশ হাঁটতে হয়। এতদিন ওরা জানত এটাই জীবন। এইভাবেই বেঁচে থেকে মরে যেতে হবে। কিন্তু এখন ওরা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে যে অন্যভাবে বেঁচে থাকা যায়। তার জন্যে মাথা নিচু করে মেনে না নিয়ে অধিকার কেড়ে নিতে হবে। রামজি মাথা নাড়ল, একটাই তো জীবন। অলসভাবে নিজের জন্যে এই জীবনটা কাটিয়ে দিতে আমি চাই না। ওই মানুষগুলোর জন্যে কাজ করতে চাই। আমার মনের ইচ্ছা আপনার কাছে যাই মনে হোক আমি ঠিক এই কাজটা করে যেতে পারব। আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি। কোন বাসে উঠলে আমি এখান থেকে খড়গপুরে যেতে পারব সেটা বলে দিন।

অর্ক শ্বাস ফেলল, এখান থেকে খঙ্গপুরে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে হাওড়া স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে খড়গপুর। ট্রেনে ঘণ্টা আড়াই বোধহয় লাগে। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার ঝুঁকি কি আপনি নেবেন?

আর কোনও উপায় আছে?

ময়দান থেকে খঙ্গপুরের বাস পেতে পারেন।

রামজি একটু ভাবল। তারপর বলল, ভোর-ভোর স্টেশন পৌঁছেলে মনে হয় ঝুঁকি তেমন থাকবে না। আমাকে তো খড়গপুর স্টেশনের বাইরেই যেতে হবে।

আলো ফোঁটার আগেই বাস চলাচল শুরু হয়ে গেল। গড়িয়া-হাওড়া মিনিবাসে উঠল ওরা। রামজি টিকিট কাটল হাওড়ার, অর্ক ধর্মতলার। নামবার

আগে অর্ক বলল, সাবধানে থাকবেন।

আপনিও। হাতে হাত রাখল রামজি, ভুলে যাবেন না।

.

তালা খুলে উঠোনে ঢুকে আঁতকে উঠল অর্ক। উঠোন, বারান্দা এত নোংরা হয়ে আছে যে এই সময় মা যদি আসত তা হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। জামা প্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সব পরিষ্কার করল অর্ক। করতে করতে মনে পড়ল গলি দিয়ে আসার সময় বুড়িটাকে দেখতে পায়নি আজ। এরকম তো সাধারণত হয় না। এই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হতে সে এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলল, বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি উঠোনে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলেন দাদা?

এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কেন? অর্ক অবাক।

আপনার বাড়িতে যিনি ছিলেন তিনি কি মাওবাদী?

তার মানে?

মনে হচ্ছে সুরেনদা থানায় কথাটা জানিয়েছে। রোজ দুবার পুলিশ এসেছে আপনার খোঁজ করতে। আপনি তো কোনও রাজনীতি করতেন না। আপনাকে ফাঁসিয়ে সুরেনদার কী লাভ হবে জানি না। আমরা শিগগিরই ক্ষমতায় আসব। তখন সুরেনদাদের কী হাল করব দেখবেন। বিশ্বজিৎ বলল।

বামফ্রন্টকে হারিয়ে আপনারা ক্ষমতায় আসবেন?

ওদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে। বাংলার প্রতিটি নির্যাতিত মানুষ দিদিকে সমর্থন করছে। বিশ্বজিৎ বলল, আমার মনে হয় আপনার থানায় যাওয়া দরকার। পুলিশ কেন খোঁজ করছে

তা প্রশ্ন করুন। আপনি যদি চান তা হলে আমি সঙ্গে যেতে পারি।

আপনি?

বিশ্বজিৎ হাসল, কদিন আগে সুরেনদা আর তার লালপার্টি ছাড়া পুলিশ কাউকে পাত্তা দিত না। আমাদের সঙ্গে তো চাকরবাকরের চেয়ে খারাপ ব্যবহার করত। এখন হেসে কথা বলছে, অনেকটা পিঁপড়ের মতো।

বুঝলাম না।

আকাশে মেঘ জমার আগে দেখবেন পিঁপড়েরা মাঝে মাঝে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে লাইন বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। ওরা ঠিক টের পায় বৃষ্টি আসছে। গ্রামের মানুষ ওদের দেখে আকাশের দিকে তাকায়। এই পুলিশগুলো ঠিক পিঁপড়েদের মতো। ক্ষমতা বদলের গন্ধ আগাম টের পায়।

বেশ। কখন যাবেন বলুন?

ঘড়ি দেখল বিশ্বজিৎ। হাসল, এখন তো বড়বাবুর ঘুম ভাঙেনি। বেলা এগারোটা নাগাদ চলুন। কিন্তু আপনি নিশ্চিত তো লোকটা মাওবাদী নয়?

আমি এখনও ঠিক জানি না কে মাওবাদী, কে নয়। অর্ক বলল।

একদম ঠিক। দিদির কথা শোনেননি? বিশ্বজিৎ জিজ্ঞাসা করল।

কোন কথাটা?

পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী বলে কেউ নেই। সিপিএমই মাওবাদী সেজে ভয় দেখাচ্ছে। তবু শিয়োর হওয়ার জন্যে জিজ্ঞাসা করলাম।

বিশ্বজিৎ, আপনাকে আমি কতটুকু চিনি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
 
একই এলাকায় থাকি। আগে কংগ্রেস করতাম। দেখলাম কংগ্রেসের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তার চেয়ে দিদি তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে মানুষের পাশে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের জন্যে কাজ করতে হলে দিদির নেতৃত্ব চাই। তাই আমি তৃণমূলে এসেছি। এটা তো আপনার অজানা থাকা উচিত নয়। বিশ্বজিৎ বলল।

নিশ্চয়ই। তবে এসব তো শোনা কথা। গোপনে গোপনে আপনি তো মাওবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। আমি জানব কী করে?

এটা কী বললেন আপনি? বিশ্বজিৎ উত্তেজিত, আপনি আমার সততা সম্পর্কে সন্দেহ করছেন?

মোটেই না। আমি বলতে চাইছি, যিনি আমার কাছে ছিলেন তিনি যদি মাওবাদী হন তা হলে সেটা আমাকে জানাননি। আমি জানব কী করে? তা ছাড়া, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? পশ্চিমবাংলায় যখন কোনও মাওবাদী নেই তখন আপনার পক্ষে তো সেটা হওয়া সম্ভব নয়। অর্ক হাসল।

ও, তাই বলুন। এটা রসিকতা। সিপিএম এখন যাকে ফাঁসাতে চায় তার ওপর মাওবাদী তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। কী রাজত্বে আছি, বলুন? বিশ্বজিৎ আবার ঘড়ি দেখল, ঠিক আছে সাড়ে এগারোটার সময় আমি থানায় পৌঁছে যাব। লেট করবেন না প্লিজ, চলি।

সারারাত টেনশনে না ঘুমিয়ে শরীরে আর জুত ছিল না। কোনওমতে চা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ল অর্ক। তখনই তার মনে হল অনেকদিন বাবা-মায়ের খবর নেওয়া হয়নি। সে মোবাইল তুলে নাম্বার টিপল, আউট অব রিচ। পরপর দুবার একই কথা কানে এল। ওটা রেখে বালিশে মাথা রাখল অর্ক।

.

ছোটমায়ের নামে মহীতোষ মিত্রের সম্পত্তি আইনসম্মতভাবে করে দিলেন মিস্টার রায়। বললেন, অনিমেষবাবু, আপনার বাবার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। কাগজপত্র কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন আপনার মা।

এতদিন জানা ছিল খারাপ খবর বাতাসের আগে ওড়ে কিন্তু আজ দেখা গেল ভাল খবরও খোঁড়া নয়। স্বপ্নেন্দু দত্ত চলে এলেন এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে। সেটা মাধবীলতার হাতে দিয়ে বললেন, খবরটা পেয়ে যে কী আনন্দ হল বোঝাতে পারব না। শেষ ভাল যার সব ভাল…।

এখনও কি শেষ ভাল বলার সময় এসেছে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আর বাকি রইল কী? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।

পার্টিকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন?

ম্যানেজ তো হয়েই গেছে। আপনি কোনও খবর রাখেন না?

কী ব্যাপারে?

পুলিশের হাতে ধোলাই খেয়ে এই পাড়ার ক্লাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেগুলোকে তাদের বাপ-মা অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কানাঘুষোয় শুনলাম ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, আপনার বাড়ির ব্যাপারে কেউ যেন নাক না গলায়। শুনলাম মুখ্যমন্ত্রী নাকি আপনার সহপাঠী ছিলেন? স্বপ্নেন্দু গদগদ গলায় বললেন।

সমসাময়িক ছিলেন।

ইস। আপনি ওঁকে ব্যাপারটা জানালে এত ঝামেলাই হত না।

আপনি কী করে ভাবলেন যে উনি আমাকে দেখা করার অনুমতি দিতেন? তা ছাড়া ওঁর কাছে গিয়ে কিছু চাইতে হলে অনেক আগেই চাইতে পারতাম।

মাধবীলতা বলল, তাই যদি বলো, তুমি তো জেলা কমিটির সম্পাদকের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলে?


দুটো এক কথা হল না। জেলার লোক হিসেবে জেলা কমিটির সম্পাদকের কাছে যাওয়ার অধিকার আমার আছে। সমসাময়িক একজন সিপিএম নেতার কাছে নিজের প্রয়োজনে যাব ভাবতেই পারি না। অনিমেষ বলল।

তা হলে এবার আমরা কাজটা সেরে ফেলি? স্বপ্নেন্দু বললেন।

হ্যাঁ, মাধবীলতা বলল, আপনি কাগজপত্র তৈরি করুন।

স্বপ্নেন্দু চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ছোটমায়ের সঙ্গে আর একবার কথা বলা দরকার। গতকাল ওখান থেকে ফিরে খুব খুশিখুশি দেখেছিলাম। ওঁর কী ইচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করো।

তুমিই করো। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা ছোটমায়ের ঘরে গিয়ে অবাক হল। আলমারি থেকে একটার পর একটা রঙিন শাড়ি বের করছেন ছোটমা। মাধবীলতাকে দেখে তিনি বললেন, অনেক শাড়ি, কখনও পরিনি। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ঠিক করলাম আশ্রমে দিয়ে দেব। ওখানকার অনেকেই তো রঙিন শাড়ি পরেন।

আশ্রমটাকে আপনার মনে হচ্ছে ভাল লেগেছে।

খুউব। ছোটমা মাথা নাড়লেন।

আমরা চলে গেলে ওখানে গিয়ে থাকতে চান?

আমাকে কি দেবেশবাবু থাকতে দেবেন?

কথা বলব।

দ্যাখো।

মাধবীলতার মুখে কথাগুলো শুনে দেবেশকে ফোন করল অনিমেষ। বলল, খুব তাড়াতাড়ি যেন দেবেশ এই বাড়িতে আসে। খুব দরকার।

.
 
এখন না দুপুর না বিকেল। রোদের তাপ বেশ কম। একটা কাক তখন থেকে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বাগানের ডুমুর গাছের উঁচু ডালে বসে। মাঝে মাঝেই এই ডাল থেকে ওই ডালে ব্যস্ত পায়ে নামছে সে, স্থির থাকছে না যেমন, তেমনই তার চিৎকার বন্ধ হচ্ছে না। কেবলই মাথা ঘুরিয়ে নীচের দিকে কিছু খুঁজে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে কাকটাকে দেখতে দেখতে অনিমেষ বলল, সাপটা বেরিয়েছে।

এতক্ষণ চুপচাপ ছিল দেবেশ, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, সাপটা মানে?

এই বাগানে দীর্ঘদিন ধরে সাপ বাস করে। ছোটমা দাবি করেন ওটা তার পোষা সাপ। রোজ কিছু না কিছু খেতে দেন ওটাকে। আজ বোধহয় সাপ খাবার খুঁজতে ওপাশে গেছে তাই দেখে কাকের এই ডাকাডাকি। অনিমেষ বলল।

অদ্ভুত। দেবেশ বলল, তোর বড় পিসিমা তো শেয়াল পুষতেন বলে শুনেছিলাম। যাকগে–।

মাধবীলতা খানিকটা তফাতে বসে ছিল, প্রসঙ্গে ফিরে আসতে চেয়ে বলল, এই হল ব্যাপার। আপনার কথা কিছু বললেন না। দেবেশ মাথা নাড়ল, উনি আমাদের ওখানে থাকবেন এটা তো আনন্দের কথা। আবাসিকরা সবাই খুব পছন্দ করেছেন ওঁকে। এই যে তোমাদের ছাড়াই একা গেলেন। মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। কিন্তু–।

কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল মাধবীলতা।

দেবেশ বলল, দেখুন, আমার ইচ্ছে ছিল কারও কাছ থেকে একটা টাকাও না নিয়ে বয়স্ক নিরাশ্রয় মানুষগুলোকে আগলে রাখব। কিন্তু সাধ সাধ্যের কাছে হার মানল। এখন যারা আছেন তারা যে যেমন পারেন তা থাকা খাওয়ার জন্যে দেন। বাকিটা চাষবাস, গোরুর দুধ আর পুকুরের মাছ থেকে যখন কুলিয়ে উঠতে পারি না তখন শহরের অর্থবানদের কাছে হাত পাততে হয়। কিন্তু একজনের কাছ থেকে ঠিক ততটুকুই নেওয়া হয়, যতটুকুতে তার খরচ মেটানো যায়। কারও কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে সেই টাকায় অন্যদের অভাব মেটানোর কথা আমি কল্পনাও করি না। কারণ যারা উপকৃত হবে তারা এক ধরনের হীনমন্যতায় আক্রান্ত হবে। ভাববে ওই একজন বেশি টাকা দিচ্ছে বলে তার দয়ায় আমি বেঁচে আছি। আমাদের আবাসিকদের মধ্যে কোনও বিভাজন চাই না। তাই আপনাদের প্রস্তাব আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনিমেষ বলল, খুব যুক্তিসংগত কথা।

মাধবীলতা বলল, তা হলে কী হবে?

এই সময় ছোটমার গলা কানে এল। তারস্বরে ধমকাচ্ছেন, অ্যাই মুখপোড়া, কানের পরদা ছিঁড়ে যাবে তোর জন্যে? ওখানে ঘাসে ঘাসে ঘুরছে তাতে তোর কী? তুই ডালে ডালে উড়ে বেড়া না। শয়তান কাক।

দেবেশ হাসল, উনি বাড়ি বিক্রি বাবদ যে টাকা পেয়েছেন তা ব্যাঙ্কেই থাক। ওই টাকা থেকে যে মাসিক ইন্টারেস্ট পাবেন তার কিছুটা নিজের খরচের জন্যে আশ্রমকে দিলেই ওঁর কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে।

অনিমেষ বলল, কিন্তু দেবেশ, ওঁর বয়স হয়েছে, শরীরও সুস্থ নয়। উনি যখন থাকবেন না তখন টাকাটার কী হবে?

দেবেশ শব্দ করে হেসে উঠল, আচ্ছা, এ ব্যাপারে আমি কী বলব? ওঁর টাকা কীভাবে খরচ করবে তা তোমাদের ব্যাপার।

মাধবীলতা বলল, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। শোনো, আমি বলি কী, এক-এক করে এগোনো যাক। ছোটমা আশ্রমে যান। আপাতত ছয় মাসের জন্যে যে টাকা আশ্রমকে দিতে হবে তা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দেওয়া যাক। ওখানে থাকতে থাকতে ওঁর মনে যদি কোনও ইচ্ছে জন্মায় তখন সেইভাবে তা পূর্ণ করা যাবে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল সম্মতিতে, তারপর দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলল, দেবেশ, পৃথিবীর অনেক কিছু পালটাল। ইউরোপ থেকে কমিউনিস্টরা মুছে গেল, চিনের সেই বিখ্যাত কমিউনিজম চেহারা বদলে ফেলল। এদেশের মেয়েদের পোশাক এবং চালচলনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। আমরা মানুষ হয়েছিলাম যেসব তথ্য জেনে তা আজ একটানে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। অথচ তুই একই থেকে গেলি।

কীরকম? দেবেশ হাসল।
 
তোকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে বি সি ঘোষ টোকলাইতে টি-ম্যানেজার ট্রেনিং কোর্সে পাঠাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তোর মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল। ওই কোর্স করলেই চায়ের বাগানে লোভনীয় চাকরি পেতিস। প্রথমে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার, পরে ম্যানেজার। অথচ তুই যেতে চাইলি না। অনিমেষ বলল।

তুই এসব কথা জানলি কী করে?

অজিতের কাছে সেসময় শুনেছিলাম। অনিমেষ বলল।

চাইনি, কারণ সে সময়েও চাকরিটা ক্রীতদাসের ছিল। ব্রিটিশরা ওই চাকরিতে সেইসব ভারতীয়দের চাইত যারা আত্মীয়স্বজন যদি কম রোজগার করে তা হলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। মা যদি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হন তা হলে তাঁর সঙ্গে ম্যানেজার ছেলে দেখা করতে পারবে না। তার সমাজ হবে অন্যান্য ম্যানেজারদের নিয়ে। স্বাধীনতার দেড় দশকেও এই ব্যবস্থাটা বদলায়নি বলে আমার পক্ষে চাকরিটা নেওয়া সম্ভব হয়নি। আচ্ছা, একবার ছোটমায়ের সঙ্গে কথা বলব। দেবেশ বলল।

মাধবীলতা উঠে বাইরে চলে গেল।

অনিমেষ হাসল, সেটা বুঝলাম। আজ তুই ছোটমায়ের বাড়ি বিক্রির টাকা নিতে রাজি হলি না। কেন? লোভ বেড়ে যেতে পারে, এই ভয়ে?

দেবেশ মাথা নাড়ল, হয়তো তাই। বেশ আছি ভাই। বেশ আছি, খাই দাই, ডুগডুগি বাজাই। ঢাক ঢোল নিয়ে কী করব? চল, আমারই উচিত ওঁর কাছে যাওয়া। দেবেশ উঠে দাঁড়াল।

কিন্তু তখনই মাধবীলতার সঙ্গে এসে দাঁড়ালেন ছোটমা, ওমা। আপনি?

আমি যে এসেছি তা আপনি জানতেন না দেখছি।

বা রে, জানলে আগে এসে দেখা করে যেতাম না? বসুন।

এই মরেছে। আপনাকে আগেও বলেছি, অনিমেষ আর আমি স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। আমাকে আপনি বললে খুব অস্বস্তি হয়। প্লিজ আপনি বলবেন না। দেবেশ হাসল, আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। এই বাড়ি আপনাকে এতকাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। এখন সেই বন্ধন থেকে। আপনি মুক্ত হয়ে গেছেন। আশ্রমের সবাই চাইছে আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমার মনে হয় আপনারও আপত্তি নেই, তাই না?

না নেই। খুব খুশি হব থাকতে পারলে। দ্যাখো তো, এরা আমার জন্যে নিজের সংসার ফেলে কতকাল এখানে আটকে আছে। আমার একদম ভাল লাগে না। ছোটমা কথাগুলো বলতে বলতে মাধবীলতার কনুই ধরলেন।

অনিমেষ বলল, যিনি কিনলেন, স্বপ্নেন্দু দত্ত, তিনি অবশ্য বলেছেন মাস তিনেকের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে না। তারপরে বাড়ি না পেলে উনি একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমার মনে হয় তার দরকার হবে না।

এখনও তো মাস দুয়েক হাতে আছে? দেবেশ তাকাল।

হ্যাঁ।

ভাড়াটের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। নিবারণবাবুকে ছোটমা চেক কেটে দিয়েছেন। উনি শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেছেন। আজই বোধহয় সেখানে চলে যাবেন। মাধবীলতা বলল।

বাঃ। তা হলে তো আর সমস্যা নেই।

ছোটমা বললেন, একটা কথা বলব? না, একটা নয়, দুটো কথা।

দেবেশ অবাক হল, বেশ তো।

ছোটমা বললেন, নিবারণবাবুকে দেওয়ার পরেও ব্যাঙ্কে যে টাকা আমার নামে আছে তা আমি এখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ওই টাকার কথা ভাবলেই আমার কেমন ভয়ভয় করে।

বুঝলাম। হাসল দেবেশ।
 
ওই টাকা যদি আশ্রমের ফান্ডে নিয়ে নাও তা হলে আমি বেঁচে যাই। যার পেটে ভাত জুটত না তার সামনে পোলাও বিরিয়ানি ধরে রাখলে কী হয় তা তোমরা বুঝতে পারবে না। ছোটমা বললেন।

এ ব্যাপারে অনিমেষের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। দেবেশ বলল, টাকাটা কি ব্যাঙ্কে শুধু আপনার নামেই আছে?

মাধবীলতা বলল, না, মিস্টার রায়, মানে এই বাড়ির যিনি উকিল, তিনি ইনসিস্ট করলেন টাকাটা জয়েন্ট নামে রাখতে। ফলে ওঁর সঙ্গে আমার নাম রাখতে হল। আমি যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলাম।

এ কী কথা? ছোটমা প্রতিবাদ করলেন, তুমি এই বাড়ির বউ না? আর তা যদি বলল, জুড়ে বসেছি তো আমি। যাঁর সম্পত্তি তার ছেলে নাতি থাকা সত্ত্বেও আমাকে ওজন বইতে হচ্ছে। আমি তো বাইরের মানুষ।

দেবেশ বলল, প্রথমটা শুনলাম, দ্বিতীয়টা?

ছোটমা মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে যদি আর একজন যায় তা হলে কি তোমাদের খুব অসুবিধা হবে?

আর একজন? দেবেশ অবাক হল।

খুব ভাল মেয়ে। আশ্রমের সব কাজ করবে। ওর থাকা খাওয়ার জন্যে যে খরচ হবে তার জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ছোটমা বললেন।

কার কথা বলছেন? দেবেশ অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ ঠাওর করতে পারছিল না। ঠিক তখনই বাইরের বাগান থেকে নিবারণবাবুর গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু, ও অনিমেষবাবু।

মাধবীলতা বলল, নিবারণবাবু, বোধহয় চলে যাচ্ছেন।

ক্রাচ টেনে নিয়ে মেঝেতে নামল অনিমেষ। ওর পেছনে ঘরের সবাই বাইরে বেরিয়ে এল। নিবারণবাবু বারান্দায় উঠে এসে হাতজোড় করলেন, বহু বছর আপনাদের আশ্রয়ে ছিলাম। কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। আর আপনি সাহায্য না করলে তো আমি শিল্পসমিতি পাড়ার সুন্দর বাড়িটায় যাওয়ার সুযোগই পেতাম না।

এসব কী বলছেন। আপনাদের জিনিসপত্র?

সকালে একদফা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাকিটা এখন লরিতে তুলে দিয়েছি। আপনারা যদি একবার ওই বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন তা হলে খুব খুশি হব। সোনাউল্লা স্কুল ছাড়িয়ে শিল্পসমিতি পাড়ায় ঢুকে বাঁ দিকের গলি। ওখানে গিয়ে কল্যাণ শিকদারের নাম বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। ওঁর পাশের বাড়ি।

নিবারণবাবু এবার ছোটমায়ের দিকে তাকালেন, সুখে দুঃখে বহু বছর একসঙ্গে কাটিয়ে গিয়েছি। আমার ব্যবহার যদি আপনাকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকে তা হলে তার জন্যে ক্ষমা চাইছি।

ছোটমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

মাধবীলতা বলল, আপনার বাড়ির সবাই কি চলে গিয়েছেন?

হ্যাঁ। একজন ছাড়া। নিবারণবাবু হাসলেন।

মানে?

আপনি তো ওকে দেখেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আমার বাড়ির মানুষ। হয়েই এতদিন ছিল। এখানে জায়গা প্রচুর ছিল, কোনও অসুবিধে হয়নি। নতুন বাড়িতে ওর থাকা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। আপনার শাশুড়ি ওকে খুব স্নেহ করেন। উনি ওকে আশ্বাস দিয়েছেন একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার। কেউ যদি ভাল থাকে তা হলে আমি আপত্তি করব কেন? আচ্ছা, চলি। জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়েছি, দরজা খোলা আছে। একবার যদি দেখে নেন। নিবারণবাবু বললেন।

ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন। অনিমেষ বলল।

নিবারণবাবু বেরিয়ে গেলে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কার কথা বললেন?

ওঁর এক ভাইয়ের স্ত্রী। মাধবীলতা বলল।

আশ্চর্য? যেখানে যাচ্ছেন সেখানে তার জায়গা হল না?

জায়গা আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা মেয়েটির নেই, তাই হল না। মাধবীলতা বলল, আমি যাই, একবার জেনে আসি।

মাধবীলতা চলে গেলে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, আপনার কবে থেকে আশ্রমে গিয়ে থাকার ইচ্ছে?

যে দিন বলবে। ছোটমা জবাব দিলেন।

তা হলে আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে।

কীরকম?

আশ্রমের গোরু, হাঁস, মুরগি দেখার জন্যে তোক আছে। কিন্তু সে সামলে উঠতে পারছে না। আপনি যদি ওর মাথার ওপরে থেকে দেখাশোনা করেন তা হলে আমাকে আর ওদের জন্যে চিন্তা করতে হয় না। আপনি তো পশুপাখিদের ভালবাসেন।

অনিমেষ হেসে ফেলল। তাই দেখে ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, হাসির কী হল?

সাপকে পশুর পর্যায়ে ফেলা যায় কিনা বুঝতে পারছি না।
 
ছোটমা ঈষৎ রেগে গেলেন, মানুষও তো মাঝে মাঝে পশুর মতো আচরণ করে তা হলে সাপকে পশু বলতে দোষ কী? এই যে নিবারণবাবু, ইনি কি মানুষ না পশু?

দেবেশ বলল, একদম ঠিক কথা। তা হলে পরশু চলে আসুন। আপনার জিনিসপত্র যদি বেশি থাকে তা হলে আমি দোমহনী থেকে একটা ম্যাটাডোর পাঠিয়ে দেব। সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওখানেই লুচি তরকারি খাবেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, প্রতি মাসে কত দিতে হবে বললি না তো।

কেউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আগে উনি আশ্রমে আসুন, সড়গড় হন, তারপর ও নিয়ে ভাবা যাবে। হ্যাঁ তোরা কি এই বাড়িতে কিছুদিন থাকছিস?

না। এখন তো রিজার্ভেশন পাওয়াটাই সমস্যা। পেলেই কলকাতায় ফিরে যাব। অনিমেষ বলল, তার আগে স্বপ্নেন্দুবাবুকে জানাতে হবে।

আমি বলি কী, আমাদের ওখানে দুদিন থেকে তারপর কলকাতায় যাস। দেবেশ বলল, খারাপ লাগবে না। আমাদের অতিথিগৃহ খুব আরামদায়ক হয়তো নয় কিন্তু বাসযোগ্য। মাসিমার সঙ্গেই চলে আয় তোরা। যাচ্ছি রে।

এক মিনিট দাঁড়া। মাধবীলতাকে ডাকছি।

কিন্তু ডাকতে হল না। মাধবীলতা শীর্ণা বউটির হাত ধরে ভাড়াটেদের দিক থেকে বারান্দায় উঠে এসে বলল, এদেশের মেয়েদের নাকি পরিবর্তন হয়েছে। ছাই হয়েছে। গিয়ে দেখি খালি ঘরের মেঝেতে বসে হাঁটুতে মুখ রেখে ইনি কাঁদছেন।

ছোটমা বললেন, এখন তো তুমি স্বাধীন। স্বাধীনতা পেলে কি কেউ কাঁদে?

প্রশ্নটা শোনামাত্র বউটি ছুটে গেল ছোটমার দিকে। দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। ছোটমা বললেন, আরে আরে কী হল? তুমি এতদিন জলে পড়ে ছিলে এখন ডাঙায় উঠছ। ইনি অনির বন্ধু দেবেশবাবু। ওঁকে তোমার কথা বলেছি। তুমি আমার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে থাকবে। আমাকে যে ঘর দেবে সেখানেই তুমি শোবে। গিয়ে দেখবে তোমার মন একদম ভাল হয়ে গেছে? আর কাঁদতে হবে না।

দেবেশ বলল, হ্যাঁ। আমাদের ওখানে সব কিছু আছে শুধু কান্না বাদ।

দেবেশ চলে গেল।

অনিমেষ বলল, আমি ওকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।

মাধবীলতা বলল, যারা বিপ্লবের কথা বলে, মানুষ খুন করে, যারা সমাজ ব্যবস্থা বদলাতে চায় তারা তাদের রক্তাক্ত হাত ধুয়ে ফেললেও তাতে রক্তের গন্ধ থেকেই যায়। অথচ দেবেশবাবুর মতো কিছু মানুষ নীরবে যে কাজ করে চলেছেন তা কোনও অংশে বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। আমার তো ইচ্ছে করছে ওদের ওখানে কয়েকদিন থাকতে।

অনিমেষ হাসল, এই প্রস্তাবটাই দিয়ে গেল দেবেশ। দেখি, কলকাতার ট্রেনের টিকিট কবে পাওয়া যায়!

স্বপ্নেন্দু দত্ত দায়িত্ব নিলেন। আগের দিন জানতে পারলে তিনি রেলের বড় কর্তাকে বলে দার্জিলিং মেলের ভি আই পি কোটার টিকিট করে দিতে পারবেন। এ নিয়ে যেন অনিমেষ কোনও দুশ্চিন্তা না করে। শুনে মাধবীলতা হেসেছিল, এই দেশে দুধরনের মানুষ ভাগ্যবান। এক, যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষ করে সরকারে যে দল আছে তাদের কর্তাদের যোগাযোগ আছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডায়রি নেবে না, নিলেও চোখ বন্ধ করে থাকবে। তারাই কোটায় ফ্ল্যাট-জমি পাবে। পাড়ার মানুষ ভয় পাবে তাদের। বেশ আছে এরা।

অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, দ্বিতীয়টা?

যাদের প্রচুর টাকা আছে তাদের সঙ্গে প্রশাসনের খুব সুসম্পর্ক। তুমি আমি যদি রেলের কারও কাছে টিকিট চাইতে যাই তা হলে তিনি দেখাই করবেন না। কিন্তু স্বপ্নেন্দু দত্ত সুপারিশ করলে স্বচ্ছন্দে অনেক লোকের মাথা ডিঙিয়ে কলকাতায় যেতে পারব। আগে সমস্ত জনসাধারণের মাত্র এক ভাগ সুবিধে ভোগ করত, দশটা পরিবার দেশ চালাত। এখন রাজনীতি এবং কালো টাকার কল্যাণে শতকরা পাঁচভাগ মানুষ ক্ষমতা উপভোগ করে, বাকি পঁচানব্বই ভাগ মানুষ অসহায়; আশায় আশায় শুধু ভোট দিয়ে যায়। মাধবীলতা বলল, এসব নিয়ে আমি ভাবতে চাই না, তবু ভাবনাটা চলে আসে।

সকালে ম্যাটাডোর চলে এসেছিল। স্বপ্নেন্দু দত্তের লোক এসে শুধু বাড়ির মালিকানা বুঝে নেয়নি, ছোটমার যাবতীয় সম্পত্তি ম্যাটাডোরে তুলে দিয়েছিল। অবশ্য ওদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছিল লছমন এবং তার ছেলে। বাবা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top