What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

পেপারে পড়েছিস নিশ্চয়ই। তুই এতদিনে জানলি না যে পেপার খবর তৈরি করে, পাবলিককে খ্যাপাতে হলে তৈরি খবর চাই। প্রথমজন মোবাইলে সময় দেখল, তিনটে নাগাদ স্টেশনের বাইরে যেতে হবে। বাস আসবে।

কতক্ষণ লাগবে?

যতক্ষণ লাগুক তোর তাতে কী? সেই সন্ধে থেকে বীরভূম জেলার ক্যাডারদের তুলে নিয়ে বাসে করে নন্দীগ্রামে। ওঠ। প্রথমজন উঠে দাঁড়াল।

কোথায় যাবে?

চল, দেখি, ঠেকটা এখনও ভোলা আছে কি না।

বলমাত্র হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয়জন। ওরা ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলে অর্ক রামজির দিকে তাকাল। রামজির চোখ বন্ধ। ওইসব সংলাপ ওর কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। ঢুকলেও মানে বোঝা সম্ভব নয়।

কিন্তু এই ছেলেদের নন্দীগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? সেখানে ভূমি সংরক্ষণ সমিতির সঙ্গে সিপিএমের লড়াই চলছে। সিপিএমকে তাড়িয়ে গ্রামের মানুষ এখন দলবদ্ধভাবে প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। রাস্তা কেটে দিয়েছে যাতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে না পারে। বলা হচ্ছে, ওইসব গ্রামগুলোতে প্রশাসনিক কাজকর্ম একদম বন্ধ হয়ে গেছে। চরম দুরাবস্থায় পড়া সত্ত্বেও মানুষ তাদের পৈতৃক জমি ছাড়তে রাজি নয়। তৃণমূল পার্টি তাদের সাহস জোগাচ্ছে। এই ঘটনাগুলো তো খবরের কাগজের দৌলতে সবাই জানে। কিন্তু এই যে বীরভূমের মতো জেলা থেকে নিচুতলার কর্মীদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওখানে, এই খবর এখনও প্রকাশিত নয়। বোঝাই যাচ্ছে ওখানকার শক্তিহীন দলের শক্তি বাড়াতেই এই ব্যবস্থা। যারা যাচ্ছে তারা অবশ্যই কিছু পাওয়ার আশায় বাড়ি ছাড়ছে। এই দেশের রাজনীতি মানেই পাওয়ার আশায় হাঁটা।

ভোর চারটে নাগাদ রামজিকে ডেকে বাইরে বেরিয়ে এল অর্ক। এখনও পৃথিবীতে অন্ধকার চেপে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই লোকজন জেগে উঠেছে, রিকশায় যাত্রীরা স্টেশনে আসছে। একটু হাঁটতেই সদ্য খোলা চায়ের দোকান থেকে ওরা চা কিনে খেয়ে জেনে নিল বাস টার্মিনাস কত দূরে।

খানিকটা যেতেই রামজির মোবাইলে রিং শুরু হল। রামজি দ্রুত সেটা বড় করে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, রামপ্রসাদ। তারপর দেহাতি হিন্দিতে কথা বলে যেতে লাগল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিছু কিছু শব্দ বুঝতে পারল অর্ক। ফোন বন্ধ করে কাছে এসে রামজি বলল, রামপ্রসাদ ফোন করেছিল। রামগঙ্গা জায়গাটা কোথায়?

কোন রামগঙ্গা?

সুন্দরবনের কাছে। বলল, নদীর একদিকে রামগঙ্গা, অন্যদিকে পাথর, পাথর, –যাঃ ভুলে গেলাম নামটা। রামজি বলল।

পাথরপ্রতিমা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেক লাগবে যেতে? কেন?

ঠিক চারদিনের মাথায় ওই রামগঙ্গায় যেতে হবে আমাকে। রামজি বলল, কীভাবে যাব তা দয়া করে বলে দেবেন।

এর জন্যে দয়া করার কী আছে? কিন্তু চারদিনের জন্য আশ্রমে যাবেন, এখানকার কোনও হোটেলে থাকবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমার কাছে তো বেশি টাকা নেই। আর হোটেলে উঠলে তো মানুষের নজর পড়বে। রামজি বলল।

কথাটা ঠিক।

.
 
বাসে উঠে জায়গা পেয়ে গিয়েছিল ওরা। অর্ক সেই ছেলেদের কথা ভাবছিল যারা আজ নন্দীগ্রামে চলে গিয়েছে, আবার তার পাশে বসে আছে যে সে কদিন পরে সুন্দরবনে যাবে। এই যে রামজিকে সে সাহায্য করছে তা কি শুধু যে লোকটি ওকে পাঠিয়েছে তার কথা ভেবে? এই যে এতদিন রামজির সঙ্গে তার যেসব কথা হয়েছে তাতে তার মনেও কি একই ভাবনা জন্ম নেয়নি? কিন্তু ভাবনা জন্ম নেওয়া এক কথা, আর সেই ভাবনাকে বাস্তব করতে ঝাঁপিয়ে পড়া আর এক কথা। সেটা করতে গেলে মানসিক প্রস্তুতির দরকার। যারা নন্দীগ্রামে গিয়েছে তাদের আসল লক্ষ্য নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা। চাকরি, টাকা, ক্ষমতা হাতে পাওয়া। কিন্তু এই রামজি এবং তার মতো ছেলেরা পশ্চিমবাংলার বাইরে থেকে যে অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাদের তো এখান থেকে কিছু পাওয়ার নেই।

বাবার কথা সে মায়ের কাছে ছেলেবেলায় কিছু কিছু শুনেছে। ওই আন্দোলন যাকে নকশাল আন্দোলন বলা হত, তার উদ্দেশ্য ছিল বন্দুকের মাধ্যমে শ্রেণিহীন সমাজ তৈরি করা। ভারতীয় সংবিধান বা গণতন্ত্রকে তারা নাকি সোনার পাথরবাটি বলে মনে করত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা গ্রাস করে বড়লোক হয় আর গরিব আরও নিঃস্ব হয়ে যায়। নকশাল আন্দোলন এর উলটো পথে দেশকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের না ছিল সংগঠন, না অস্ত্রবল না উপযুক্ত নেতা। ফলে সেই আন্দোলনকে চুরমার করে দিতে সরকারের বেশি সময় লাগেনি।

বাবার দিকে তাকিয়ে অর্কের অনেকবার মনে হয়েছে এই মানুষটা যে আবেগ নিয়ে সব ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, জেল খেটেছিল, পুলিশ যাকে পঙ্গু করে দিয়েছে সে আজ কী অসহায় হয়ে বেঁচে আছে। সেই আবেগের কথা ভুলেও বোধহয় আর ভাবে না। আগুন যতক্ষণ দাউদাউ করে জ্বলে ততক্ষণ তার চেহারায় যে অহংকার তা ছাই হয়ে যাওয়ার পর খুঁজতে চাওয়া বোকামি।

কিন্তু রামজির সঙ্গে কথা বলে অর্ক বুঝেছে ওদের সংগঠন এখন বেশ মজবুত। ভারতবর্ষের কয়েকটি প্রদেশে ওরা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সব কথা রামজি খোলাখুলি না বললেও অর্কর অনুমান ও কয়েকমাস ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। দলের ওপরতলার সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ নেই, ওই রামপ্রকাশের সঙ্গেই তাকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই যে সে কলকাতায় এসে অর্কর সঙ্গে আছে, অর্কর সাহায্য পাচ্ছে তা দল অবশ্যই জেনে গেছে।

তরুণ বয়সে বস্তির মানুষকে নিয়ে কমিউন তৈরি করতে চেয়েছিল অর্ক। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সেই কমিউনে বস্তির মানুষদের একত্রিত করে দুবেলা ক্ষুধা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। ব্যাপারটা যখন ভাল দিকে এগোচ্ছিল তখনই তার ওপর আঘাত নেমে আসে কারণ সে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়নি। কমিউনের ভোটগুলো ওদের ব্যালট বাক্সে চালান করতে রাজি হয়নি। এতটা কাল ক্ষোভের ঘোলা জল একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে মনের ভেতর পাক খেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে এখনও বুঝতে পারছিল না কোন পথে সে হাঁটবে। অথবা হাঁটাটা দরকার, না বসে। থেকে দেখে যাওয়াটাই স্বস্তির?

.
 
বাস থেমে নেমেই ওরা নদী দেখতে পেল। এর মধ্যে অন্ধকার সরে গেছে, নবীন সূর্য আকাশে স্পষ্ট। হালকা রোদে পৃথিবী ঝলমল। জায়গাটার একেবারেই বীরভূমি নাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে আশ্রমের সন্ধান জানা গেল।

গ্রামের প্রান্তে নদীর ধারে সন্ন্যাসিনীর আশ্রম। এমন কিছু বড়সড় নয় কিন্তু একটি মন্দির এবং অনেকগুলো টিনের চালাঘর রয়েছে। বাখারির বেড়া দেওয়া আশ্রমের গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই দুজন শিষ্য কৌতূহলী চোখে তাকাল। অর্ক দুই হাত জোড়া করে বলল, নমস্কার।

জয় গুরুমা। আসুন। আপনাদের পরিচয়? একজন শিষ্য জানতে চাইলেন।

দেওয়ার মতো পরিচয় কিছু নেই। আমরা কলকাতা থেকে আসছি। অর্ক বলল।

এইসময় আর একজন প্রবীণ শিষ্য ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অর্কর দিকে তাকিয়ে বললেন, মহাশয়কে মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছি। নামটা…?

আমার নাম অর্ক, ওর নাম রামজি।

বাঃ! কী সৌভাগ্য। এই প্রভাতে সূর্যদেব এবং ভগবান শ্রীরামের নামধারীরা আমাদের আশ্রমে পদার্পণ করেছেন, কিন্তু কোথায় দেখেছি?

আপনি বোধহয় ট্রেনে দেখেছেন। নর্থ বেঙ্গল থেকে ফিরছিলাম।

ও তাই তো। বয়স মানুষের স্মৃতিকে দুর্বল করে দেয়। তা হলে আপনি এলেন। গুরুমা আমাকে আপনার কথা বলেছিলেন। আমাদের বলেছেন, দ্যাখ ও ঠিক আসবে। গুরুমায়ের কথা বৃথা হয় না। তারপর অন্য দুজনকে বললেন, তোমরা ওঁদের সাত নম্বর ঘরে নিয়ে যাও। হাতমুখ ধুয়ে একটু জলযোগ করুন। তারপর গুরুমার আদেশ হলে দর্শন করতে যাবেন।

.

টিনের চাল, ইটের দেওয়াল, মেঝেতে ইট পাতা, দুটো তক্তপোশে বিছানা। হাতমুখ ধুয়ে রুটি তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়ল রামজি। বলল, খুব ঘুম পাচ্ছে।

অর্ক কথা বলতে গিয়ে শুনল ঘণ্টা বাজছে। আর তার পরেই শুরু হয়ে গেল প্রার্থনাসংগীত। যারা গাইছে তাদের সবাই পুরুষ, কোনও নারীকণ্ঠ নেই। ঘরের দরজায় তরুণ শিষ্যদের একজন এসে দাঁড়াল, আপনারা নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে এসেছেন তাই এখন প্রার্থনায় যেতে হবে না। বিশ্রাম করুন। বেলায় গুরুমা দর্শন দেবেন।

অর্ক মাথা নাড়লে তরুণ চলে গেল।

দরজা ভেজিয়ে অর্ক বলল, ভদ্রমহিলা বেশ বাস্তববোধসম্পন্ন।

কী বললেন? রামজি পাশ ফিরল।

হিন্দিতে বাক্যটির অর্থ বুঝিয়ে দিল অর্ক।

কিন্তু এটা তো একেবারে ধর্মস্থান। আশ্রম শুনে ভেবেছিলাম হয়তো অনাথ আশ্রম অথবা বৃদ্ধাশ্রম। রামজি শ্বাস ফেলল।

আমাদের তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অর্ক শুয়ে পড়ল।

আপনার হচ্ছে না? কিন্তু যদি ওরা জানতে পারে আমি হিন্দুনই তা হলে? তখন কী করবে ওরা জানি না।

কেন এসব ভাবছেন?বরং ভাবুন, এখানে আপনি একদম নিরাপদ। পুলিশ কল্পনাও করতে পারবে না যে আপনি এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এইসব আশ্রমে পুলিশ কখনওই আসে না। তা ছাড়া, মনে হচ্ছে এই গুরুমায়ের বেশ ভাল নামডাক আছে। আপনি আরামে থাকবেন। অর্ক বলল।

বুঝলাম। কিন্তু আমি তো কখনও হিন্দুদের প্রেয়ার করিনি।

আপনার কি ধারণা আমি করেছি?

করেননি?

না। আমার মতো লক্ষ লক্ষ জন্মসূত্রে হিন্দু মন্দিরে যায় না। সকাল বিকেল পুজো করে না। এমনকী বেশিরভাগ বাড়িতে ঠাকুরঘরও নেই। আর আজকের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয় তারা বিনোদনের মজা পেতে চায়। অতএব, আমি যা করব আপনি তাই অনুসরণ করবেন। হেসে ফেলল অর্ক, একটা গান আপনি শোনেননি, তাতে বলা হয়েছে কৃষ্ণ এবং খ্রিস্ট একই। চোখ বন্ধ করে আপনি ভাববেন যিশুখ্রিস্টকে স্মরণ করছেন।

.
 
বেলা সাড়ে দশটায় যখন ডাক পড়ল তখন রামজি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছ। বেলগাছিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তালসারি ছুঁয়ে আবার কলকাতা হয়ে এখানে আসা পর্যন্ত যে টেনশনে ছিল তাতে এখন এই ঘুম খুব স্বাভাবিক। ওকে না তুলে অর্ক তরুণ শিষ্যটিকে একাই অনুসরণ করল।

মন্দিরটি বেশ সুন্দর। ছোট কিন্তু সাজানো। মায়ের মূর্তিটিও বেশ। মুখের আদলে স্নেহ জড়ানন। শিষ্য প্রণাম করায় অর্ক হাতজোড় করল। শিষ্য বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন না আমাদের মা খুব জাগ্রত।

আপনি কি গুরুমায়ের কথা বলছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। দ্রুত মাথা নাড়ল শিষ্য, তিনি তো বেঁচেই আছেন, তা ছাড়া তাকে আমরা গুরুমা বলে সম্বোধন করি। মা বলি এই দেবীকে। বহু বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাটির দশহাত নীচ থেকে এই দেবীমূর্তিকে তুলে আনা হয়েছে। আগে রোজ খুব ভিড় হত বলে গুরুমায়ের নির্দেশে শুধু শনি এবং মঙ্গলবারে সাধারণ ভক্তদের এখানে আসতে দেওয়া হয়। চলুন।

.

মন্দিরের সামনে কোলাপসিবল গেট ছাড়াও দেবীমূর্তির দুপাশে আর একটি দরজা আছে যা সম্ভবত মন্দির বন্ধ করার সময় টেনে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই দেবীমূর্তির সুরক্ষার ব্যাপারে আশ্রম কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সতর্ক। অর্কর মনে হল মূর্তিটি নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান।

মন্দিরের পেছনে একটি সুন্দর একতলা বাড়ি যার পাশেই অজয় নদী। নদীর জল এখন বেশ কম। চর দেখা যাচ্ছে, ওরা বাড়িটির সামনে যেতেই একজন বেশ বৃদ্ধ শিষ্য এগিয়ে এলেন, আসুন। আপনার সঙ্গী এলেন না?

না। ওর শরীর বেশ দুর্বল। ঘুমোচ্ছে বলে নিয়ে এলাম না।

সে কী? কী হয়েছে? বৃদ্ধ উদ্বিগ্ন হলেন।

না না। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ও। মায়ের আশীর্বাদে নিশ্চয়ই উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনি আসুন। গুরুমা আপনার জন্যে অপেক্ষায় আছেন। বৃদ্ধ শিষ্য কথাগুলো বলমাত্র তরুণ শিষ্য ফিরে গেল।

ঘরের পরদা সরিয়ে বৃদ্ধ শিষ্য বললেন, ভেতরে যান।

ভেতরে ঢুকেই সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেল না অর্ক। ছিমছাম এই ঘরটিতে আসবাবের বাহুল্য নেই। তখনই মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল, কই, এদিকে এসো, আমি বারান্দায়।

ওপাশের দরজা দিয়ে বারান্দায় পা রাখতেই সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেল অর্ক। বারান্দার ওপাশে ফুলের বাগান, তারপরেই নদীর জল। সন্ন্যাসিনী বসে আছেন একটা বেতের মোড়ায়। ট্রেনে যে পোশাকে সে ওঁকে দেখেছিল পরনে সেই একই পোশাক। হেসে বললেন, ওই মোড়া টেনে নিয়ে বসো।

অর্ক বসতে বসতে ভাবল প্রণাম করা ঠিক হবে কিনা। সে দুই হাত জোড় করে বলল, নমস্কার।

তা তো বুঝলাম, তবে আমি ভেবেছিলাম অনেক আগেই তোমার দেখা পাব। আমাকে বেশ অপেক্ষায় রাখলে তুমি।

সন্ন্যাসিনী হাসলেন। হাসলে ওঁকে খুব সুন্দর দেখায়।

আপনি কী কারণে এটা ভেবেছিলেন?

তোমার চোখ দেখে। মা মানুষকে চোখ দিয়েছেন পৃথিবীকে দেখার জন্যে। মানুষ তো নিজের চোখ দেখতে পায় না। তুমি বলতে পারো, তা কেন, আয়নায় তো দিব্যি দেখা যায়। কিন্তু আয়নায় মানুষ নিজের মুখ দেখে, কজন আর শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু সেই চোখ দেখলে আমি তার মনের খবর পেয়ে যাই। তোমার চোখ দেখে বুঝেছিলাম, তুমি আসবেই। আসবে। হাসলেন সন্ন্যাসিনী।

অর্ক অবাক হয়ে শুনছিল। একটু চুপ করে থেকে সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞাসা করলেন, এই দ্যাখো, কী ভাবছ তুমি?

আপনিই বলুন। আমার চোখ দেখে বলুন কী ভাবছি। অর্ক বলল।

বলছি। তুমি ভাবছ এ কোথায় এসে পড়লাম। এরকম কথা তো কখনও শুনিনি। বলতে বলতে সন্ন্যাসিনী বললেন, তোমার নামটা ভুলে গেছি।

আমি কি আপনাকে নাম বলেছিলাম? মনে পড়ছে না। তারপরেই দুষ্টুমি করতে চাইল অর্ক, আচ্ছা, নামে কী এসে যায়!

তা ঠিক। আমরা অবশ্য গৃহপালিত পশুদের একটা নাম দিই, কিন্তু তাদের চেহারা বেশ বড়সড়। হাঁস মুরগির কেউ নাম রাখে না। এখন বলো, তোমার এখানে আগমনের উদ্দেশ্য কী? সন্ন্যাসিনী বড় চোখে তাকালেন।
 
আমাদের কদিন একটু নির্জনে থাকার ইচ্ছে হল। আপনি বলেছিলেন নদীর ধারে আশ্রম। এখানে আসতে বলেছিলেন। তাই চলে এলাম।

বেশ করেছ। তুমি কি ঠাকুর দেবতা মানো?

না মানলে এখানে থাকতে দেবেন না?

ওমা! এ কথা কখন বললাম?

বলেননি। আমি জিজ্ঞাসা করছি।

দেখো, তুমি যদি না মানো তা হলে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তুমি যদি আমার ওপর ওই না মানাটাকে চাপিয়ে দিতে চাও তা হলে অবশ্যই তোমাকে সঙ্গ ত্যাগ করতে বলব।

মাথা নাড়ল অর্ক, ঠাকুর দেবতা নিয়ে কখনওই মাথা ঘামাইনি।

জোর করে মাথা ঘামাবে কেন? আচ্ছা, এই যে তুমি বসে আছ, একটু চেষ্টা করো তো, বসে বসে মাথায় ঘাম আনতে পারো কিনা?

অসম্ভব।

তা হলে ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ওই চেষ্টা করাও নিরর্থক। যখন মন চাইবে তখন আপনি ইচ্ছে করবে। তখন মাথা কেন, তোমার অস্তিত্ব জাগ্রত হবে। মন না চাইলে নির্লিপ্ত থাকাই তো ভাল।

আমরা এখানে দিন তিনেক থাকতে চাই। অর্ক বলল।

এ কী? এত অল্প দিন? কথা বলে আমার তো সুখই হবে না। বলেই সন্ন্যাসিনী হাসলেন, অবশ্য অল্পেই সন্তুষ্ট হওয়া ভাল। প্রসাদ কণিকাতেই যথেষ্ট।

আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। আমি খুব অবাক হয়েছি যখন এখানে এসেই একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, আপনি তাকে বলেছেন আমি এখানে আসবই। অর্ক বলল, স্বীকার করছি আপনি ঠিক অনুমান করেছিলেন।

সন্ন্যাসিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সংসার ধর্ম পালন করছ না, না?

আমি বিবাহিত নই।

তোমার মা, বাবা?

আছেন। মা শিক্ষিকা ছিলেন।

বাবা?

একটু চুপ করে শেষ পর্যন্ত বলল অর্ক, বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন। পুলিশের অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যান। মুক্তি পাওয়ার পর তাই কাজকর্ম করতে পারেননি।

কী নাম তোমার বাবার?

অনিমেষ মিত্র।

তুমি কী করো? একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন সন্ন্যাসিনী।

আমি একটা চাকরি করছি।

আর?

আর কিছু না।

আমার মনে হচ্ছে তুমি সত্য বলছ না। যাক গে, তোমাকে এখানকার প্রার্থনায় যোগ দিতে হবে না। ওই নদীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখো। খুব ভাল লাগবে। ভোরের আগের অন্ধকার আর সূর্য ডোবার পরের অন্ধকারের মধ্যে কোথাও মিল আছে কি না খুঁজতে চেষ্টা করো। তবে আশ্রম থেকে বেরিয়ে ওই বাসস্ট্যান্ডের দিকে না যাওয়াই ভাল। মানুষ অকারণে কৌতূহলী হয়। এসো। সন্ন্যাসিনী উঠে দাঁড়ালেন।

ঘরে ফিরে তক্তপোশে শুয়েও ঘুম আসছিল না অর্কর। পাশের তক্তপোশে রামজি নাক ডাকছে মৃদু। কাল গোটা রাত জেগে থেকে শরীর ঘুম চাইছে কিন্তু পাচ্ছে না। সন্ন্যাসিনী বারংবার চোখের সামনে চলে আসছেন। এরকম মহিলাকে সে কখনও দেখেনি। কথা শুনলে মনে হবে উনি বেশ শিক্ষিত। ওঁর প্রতিটি কথাই অসাধারণ। কিন্তু মহিলা কী করে অনুমান করলেন সে এখানে আসবেই। সাধু সন্ন্যাসিনীদের কী সব শক্তি থাকে বলে সে শুনেছে কিন্তু কোনওদিন বিশ্বাস করেনি। এখন মনে হচ্ছে এটাও কোনও শক্তির ব্যাপার নয়। ওঁর মনে হয়েছে সে এখানে এলে ভাল হয়। সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছেন ব্যাপারটা সত্যি হবে আর সেই ভাবনার কথা অন্যদের বলেছেন। কিন্তু সে এখানে এলে উনি কেন খুশি হবেন? ট্রেনে অত অল্পসময়ের আলাপে তো এরকম ভাবনা আসার কথা নয়। ঘুম আসছিল না, তারপরেই মনে পড়ল, অনিমেষ মিত্রের নাম শুনে একটু চুপ করে ছিলেন, সে যে শুধু চাকরি করে এটাও বিশ্বাস করেননি। করেননি বলে সতর্ক করেছেন যেন তারা বাসস্ট্যান্ডের দিকে না যায়। নদীর ধারে ঘুরতে বলেছেন, অন্ধকার দেখতে বলেছেন। এসব তো বলতে হয় তাই বলা। কিন্তু উনি নিশ্চয়ই অনুমান করেছেন ওরা এখানে আড়াল খুঁজতে এসেছে। রামজির ব্যাপারে একটুও উৎসাহ দেখালেন না। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মানুষের কৌতূহলী চোখ এড়াতে যিনি সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন জানাজানি হলে তারা বিপদে পড়বে। সেটা জেনেও কেন তাদের আশ্রয় দিলেন? অর্ক ব্যাখ্যা পাচ্ছিল না।
 
নদীতে জল কোথাও কোমরের ওপরে, কোথাও হাঁটু ছোঁওয়া। তরুণ শিষ্য বলল, আপনারা ইচ্ছে করলে নদীতেই স্নান করতে পারেন। না হলে ওই যে ইঁদারা আছে ওখানেও সেরে নিতে পারবেন। স্নান সেরে আমাদের খাওয়ার ঘরে চলে আসুন। মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়ে গিয়েছে।

নদীর জল খুব ধীরে বয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে বালির চরে কয়েকটা শকুন বসে আছে দেখে ওরা ইঁদারায় স্নান করে নিল। পোশাক বদলে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, অনেকক্ষণ তো ঘুমালেন, এখন কেমন লাগছে?

ভাল। ওঃ, ঘুমটার দরকার ছিল। আচ্ছা, এই আশ্রমের প্রধানের সঙ্গে কখন দেখা করতে হবে? আমার খুব নার্ভাস লাগছে। রামজি বলল।

ওঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আপনাকে যেতে হবে না।

যাক! আর পরীক্ষা দিতে হবে না।

খাওয়ার ঘরটিতে কোনও দেওয়াল নেই। টেবিলের পাশে বেঞ্চি পাতা। বাঁশের ওপর টিনের চাল। খেতে বসলে গায়ে বাতাস লাগে। ওরা যেতেই তরুণ শিষ্যটি বসার ব্যবস্থা করে দিল। আরও জনা আষ্টেক শিষ্য তখন দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত।

খাবার এল। কলাপাতায় ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর চাটনি। গুরুমায়ের কাছে যে বৃদ্ধ শিষ্যকে দেখেছিল অর্ক তিনি এসে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, খুব সামান্য ব্যবস্থা। আজ বৃহস্পতিবার তাই আমিষ গ্রহণ করি না। আপনাদের হয়তো খেতে অসুবিধে হবে।

অর্ক বলল, এ নিয়ে ভাববেন না। খেয়ে তৃপ্তি পেলে নিরামিষই অমৃত।

বাঃ। ভাল বলেছেন। একটা কথা, আমরা সাধারণ মানুষ। গুরুমা যা। পারেন আমরা তা কীভাবে পারব। যাঁর সঙ্গে কথা বলছি তাঁর নাম না জানা থাকলে অস্বস্তি হয়। আমার নাম যুধিষ্ঠির।

ভাত খেতে খেতে অর্ক বলল, আমি অর্ক মিত্র।

এরকম নাম আগে শুনিনি। সূর্য তো আকছার, কিন্তু অর্ক আমার কাছে নতুন। আর ওঁর নাম?

ওর নাম রামজি। অর্ক বলল, ও অবাঙালি।

বাঃ, স্বয়ং রামজি আমাদের এখানে অন্নগ্রহণ করছেন। কী সৌভাগ্য। গুরুমাকে সংবাদটা দিতে হবে। রামজিভাই, আপনার খেতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? খানা কি আচ্ছা হ্যায়?

রামজি হেসে ফেলল, বহুৎ আচ্ছা।

বৃদ্ধ শিষ্য খুশি হয়ে চলে গেলে অর্ক খেয়াল করল অন্যরা খেতে খেতে তাদের লক্ষ করছে। গায়ে পড়ে কথা বললে কথা বাড়বে বলে মুখ নামিয়ে খেয়ে নিল অর্ক। রান্না খুবই সুস্বাদু। তরকারিটা তো অসাধারণ। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে ওরা ঘরে চলে এল। এখন পেটে খাবার যেতে শরীর শিথিল লাগছিল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আবার ঘুমাবেন? না না। আপনি ঘুমিয়ে নিন। আমি একটু চারপাশ ঘুরে দেখে আসি। এদিকে নিশ্চয়ই কাছাকাছি থানা নেই। রামজি বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল, না, একা কোথাও যাবেন না। গুরুমাও চান না আমরা কোনও বিপদে পড়ি। শুয়ে পড়ুন। বিকেলে নদীর ধারে যাব।

.
 
কাল রাত্রে কথা এগোয়নি। ছোটমার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলেছিল, তোমার যা ইচ্ছে তাই হবে। আমার কোনও আপত্তি নেই।

শোনার পর ছোটমা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সকালে চা খেতে খেতে মাধবীলতা কথাটা তুলল, তুমি বললে উনি বৃদ্ধাশ্রমে গেলে তোমার আপত্তি নেই। আমার কিন্তু ভাল লাগছে না।

কেন? অনিমেষ চায়ের কাপ নামাল।

এতদিন একা ছিলেন, আমরা এসে বাড়ি বিক্রি করে ওঁকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলাম। মানুষ তো বলবে আমরা ঘাড় থেকে বোঝা নামালাম।

মাধবীলতার গলার স্বরে অনেকটাই হতাশা।

কোন মানুষ কী বলছে তা নিয়ে তুমি আজ ভাবছ লতা? এতদিন তো দেখেছি যেটা ভাল বলে মনে করো তা করতে, কারও কথা গ্রাহ্য করো না। তুমি এ কথা কেন ভাবছ না, এতদিন এই বাড়িতে একা থেকে উনি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। গতকাল দেবেশের ওখানে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে ওঁর মন থেকে অনেক চাপ সরে গিয়েছে। ওঁর কথাবার্তাও বদলে গিয়েছে অনেকটাই। মাঝে মাঝে ওঁদের কাছে গিয়ে যদি ওঁর মনে হয় ওখানে পাকাপাকি থাকলে উনি ভাল থাকবেন তা হলে সেটাই মেনে নেওয়া উচিত। অনিমেষ বলল। এর বিকল্প কি কিছু আছে?

হ্যাঁ, আছে।

বলো।

বাড়ি বিক্রির টাকায় ওঁর নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে আমরা তিনজনই সেখানে থাকতে পারি। আমি সঙ্গে থাকলে উনি ভাল থাকবেন।

ফ্ল্যাটটা কোথায় নেওয়া হবে?

উনি যেখানে গিয়ে থাকতে চাইবেন।

তারপর? উনি চলে গেলে? ফ্ল্যাটটা তো আমাদের হয়ে যাবে। আমি চাই না তারপরে ওটা অর্কর হাতে যাক।

শুধু অর্কর হাতে যাবে বলে তুমি রাজি হচ্ছ না?

না। আসল কারণটা তুমি জানো। এই বাড়ি বিক্রির টাকায় কেনা ফ্ল্যাটে আমি থাকতে পারি না। কারণ এই বাড়ির কাছে আমার যা ঋণ তা আমি শোধ করিনি। শোধ করার সময়ও চলে গেছে।

তা হলে আমার কিছু বলার নেই। মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল।

বাড়ি বিক্রি করার পর সেই টাকার কী হবে?

ভাবতে হবে। বিক্রির পরে ব্যাঙ্কে ছোটমার নামেই তো থাকবে।

দরজা পর্যন্ত চলে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল মাধবীলতা, আর একটা কথা। দেবেশবাবুরও তো বয়স হয়েছে। যদি ওঁর কিছু হয়ে যায় তা হলে অতগুলো মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন?

অনিমেষ তাকাল। এই প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই।

মাধবীলতা বেরিয়ে গেল, উত্তরের অপেক্ষা না করে।

.

বেলা নটা নাগাদ মিস্টার রায়ের সহকারী ফোন করে জানালেন, আজ ঠিক বারোটা নাগাদ কোর্টে চলে আসুন আপনার মাকে নিয়ে।

আজ? অনিমেষ অবাক।

হ্যাঁ। আজই তো শুক্রবার। কোর্ট কোথায় তা জানেন তো?

আগে তো আমাদের বাড়ি থেকে ডি এমের বাড়ির দিকে গিয়ে নদীর ধারেই ছিল। অনিমেষ বলল।

ছিল। এখন নেই। এখন নবাববাড়িতে। আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে করলা নদী পেরিয়ে সমাজপাড়ায় এসে এল আই সি বিল্ডিং থেকে ডানদিকে এগোলেই বাঁদিকে নবাববাড়ি দেখতে পাবেন। মিস্টার রায়ের নাম বললেই যে কেউ ওঁর চেম্বার দেখিয়ে দেবে। ফোন রেখে দিল ছেলেটি।
 
ভাগ্যিস নিবারণবাবু সাহায্য করলেন তাই দু-দুটো রিকশা পাওয়া গেল। ছোটমা যে এত সহজে যেতে রাজি হয়ে যাবেন তা মাধবীলতাও ভাবেনি। দরজায় তালা দিয়ে সেজেগুজে ওরা নবাববাড়িতে পৌঁছে গেল। এবার অনিমেষ একা রিকশায়। কোর্ট চত্বরে রিকশা থেকে নামতে একটু অসুবিধা হল তার। রিকশাওয়ালা সাহায্যের হাত বাড়াবার কথা ভাবেনি। অনিমেষের সমস্যা দেখে এক ভদ্রলোক দ্রুত এগিয়ে এলেন, আমার কাঁধে হাত রাখুন।

সোজা হয়ে নেমে অনিমেষ বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আরে না না–। ভদ্রলোক থেমে গেলেন, খুব চেনা লাগছে, কী নাম বলুন তো ভাই?

অনিমেষ মিত্র।

আরে তাই। কতদিন পরে দেখা হল। তোমার এই অবস্থা কেন?

হয়ে গেল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি?

আমি অজিত। একসঙ্গে জেলা স্কুলে পড়তাম। চাকরি করেছি এতকাল। আইন পাশ করা ছিল। এখন রিটায়ার করার পর বাড়িতে না বসে থেকে কোর্টে আসা যাওয়া করি। তুমি এখানে?

অজিতকে মনে পড়ে গেল অনিমেষের। খুব পাকা কথা বলত সে সময়। অজিতের চাপে অনিমেষকে বলতেই হল মিস্টার রায়ের কাছে কী উদ্দেশ্যে ওরা এসেছে। শোনার পর অজিত ওদের নিয়ে গেল মিস্টার রায়ের চেম্বারে। তিনি বা তার সহকারী তখন চেম্বারে নেই। অন্য কেসে সওয়াল করতে গেছেন। ওদের চেম্বারে বসিয়ে অজিত বলল, তোমাদের ব্যাপারটা যেখানে হবে সেখানে গিয়ে সবুজ আলো জ্বেলে আসি।

মানে?

এদের তো বত্রিশ মাসে বছর। কাজটা যাতে আজকেই হয়ে যায় তার জন্যে একটু তৈলমর্দন করতে হবে। তোমার মামলায় তো আমি ওদের পকেটে কিছু দিতে রাজি নই। অজিত চলে গিয়েছিল।

.

বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ মিস্টার রায় বললেন, এবার আপনারা যেতে পারেন। বাকি ফর্মালিটিগুলো আমরাই সামলে নেব। সামনের সপ্তাহে কাগজপত্র পেয়ে যাবেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা দিতে হবে?

ওই তো, আপনাকে আগে যেমন বলেছিলাম তাই দেবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সোমবারের মধ্যে দিলেই হবে। মিস্টার রায় বললেন।

এ কথা ঠিক, অজিতের উদ্যোগে অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেরোনোর অনেক আগে থেকেই তার দেখা পাওয়া যায়নি। অজিতকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার ছিল, হল না।

রিকশায় অনিমেষ উঠে বসলে মাধবীলতা পাশে এসে বলল, শোনো, আমাদের খুব খিদে পেয়েছে। চলো না, কোথাও খেয়ে বাড়ি যাই।

কোথায় খাবে?

বা রে! আমি কী জানি। এটা তো তোমার জায়গা।

কী খাবে?

নোনতা বা মিষ্টি। নিশ্চয়ই চপ কাটলেট নয়।

অনিমেষ ফাঁপরে পড়ল, দীর্ঘ সময়ে নিশ্চয়ই জলপাইগুড়ির খাবারের দোকানগুলো বদলে গিয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ল, নবাববাড়ির সামনেই কাঁঠালতলার মিষ্টির দোকান তাদের বাল্যকালে খুব বিখ্যাত ছিল। আর-একটা দোকান ছিল রূপশ্রী সিনেমার সামনে, গন্ধেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কিন্তু ওইসব দোকান এখনও রয়েছে কি না তা তার জানা নেই। সে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারল কাঁঠালতলার দোকান এখনও রয়েছে। সেখানেই যেতে বলল অনিমেষ। রিকশাওয়ালাকে বেশি ভাড়া দেবে বলে আশ্বস্ত করে ওরা কাঁঠালতলায় গিয়ে দেখল দোকান বন্ধ রয়েছে। অনিমেষ রিকশায় বসেই মাধবীলতাকে বলল, তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমি নোতা মিষ্টি কিনে নিয়ে আসছি।

বা রে। মাধবীলতা বলল, আমরা দোকানে বসে খেতে চাই। উনি কোনওদিন ওইভাবে খাননি।



শেষপর্যন্ত দিনবাজারে একটা দোকান পাওয়া গেল। শালপাতায় রাধাবল্লভী এবং ছোলার ডালের পর রসগোল্লা খাওয়া হল। মাধবীলতা বলল, তোমরা বোতলের জল বিক্রি করো?

হ্যাঁ মা। ছেলেটি বোতল নিয়ে এল।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী জল?

এই জল খেলে পেট খারাপ হবে না। মাধবীলতা বলল।

ওরা তো কলের জল দিচ্ছে। আমরাও তো বাড়িতে তাই খাই।

মাধবীলতা ফাঁপরে পড়ল। বলল, ওরা জল জমিয়ে রেখেছে, তাই থেকে দিচ্ছে। তাই একটু সাবধান হওয়া ভাল।

তা হলে থাক। বাড়িতে গিয়েই খাব। তা ছাড়া– হাসলেন ছোটমা।

তা ছাড়া মানে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই প্রথম রাধাবল্লভী খেলাম তো। জিভে স্বাদটা খানিকক্ষণ থাক না। ছোটমা উঠে দাঁড়ালেন।

.
 
এখনও বাইরে কড়া রোদ, অর্ক রামজির দিকে তাকাল। রামজি তার তক্তপোশে বসে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। কী ভাবছে তা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হল না।

ছেলেটাকে তার ভাল লেগেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এতদিন একসঙ্গে থেকেও রামজি তার অনেক কথাই বলতে চায়নি, অর্কও যেচে জিজ্ঞাসা করেনি।

অর্ক এখন বলল, না, রোদ কমলে অজয়ের ধারে যাব, এখন থাক। ঠিক তখনই সেই তরুণ শিষ্য দরজায় এসে দাঁড়াল, আপনি কি বিশ্রামে আছেন?

এখানে তো আর কিছু করার নেই। কী ব্যাপার ভাই? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

যদি বিশ্রামে না থাকেন তা হলে গুরুমা একবার যেতে বললেন।

অবশ্যই। উঠে দাঁড়াল অর্ক, চলুন।

যাওয়ার আগে সে রামজির দিকে তাকাল। রামজি মাথা নাড়ল।

মন্দিরের সামনে বসে কয়েকজন শিষ্য ধ্যান করছেন। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এই সময়ে ধ্যান? একটু আগেই তো দুপুরের খাওয়া শেষ হল।

ধ্যানের তো সময় অসময় নেই। তরুণ শিষ্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, গুরুমা বলেন যখনই ইচ্ছে হবে তখনই সময়। কিন্তু যাঁদের দেখছেন তারা মধ্যাহ্নভোজন করেন না। সকালে সামান্য জলযোগ করে সন্ধেবেলায় রাতের আহার সারেন।

অর্ক অবাক হল, মুসলমান বন্ধুরা তো রোজার সময় এই নিয়ম মেনে চলেন, তবে তারা সকালে না, ভোরের আগেই যা খাওয়ার খেয়ে নেন। অর্ক বলল।

গুরুমা বলেন, মাঝে মাঝে ঈশ্বরের আরাধনায় শরীর অভুক্ত রাখলে কোনও ক্ষতি হয় না, স্বাস্থ্যের উপকার হয়। তরুণ শিষ্য বলল।

বাঃ, আপনি দেখছি চমৎকার জ্ঞান লাভ করেছেন।

না না। আমি অতি সামান্য। গুরুমার কৃপা পেলে ধন্য হয়ে যাব। সেই বৃদ্ধ শিষ্য অপেক্ষা করছিলেন। হেসে বললেন, ওকে বিশ্রাম থেকে টেনে নিয়ে আসেননি তো?

অর্ক বলল, না না। আমি তো বসেই ছিলাম।

আসুন আমার কক্ষে। বৃদ্ধ শিষ্য পেছন ফিরতেই তরুণ শিষ্য যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল। অর্ক বুঝতে পারল এই আশ্রমে ডিসিপ্লিন মেনে চলে সবাই।

ভেতরের বারান্দার কাছে গিয়ে বৃদ্ধ শিষ্য বললেন, গুরুমা ওই বাগানে অপেক্ষা করছেন, যান।

অর্থাৎ এখন তার ওই পর্যন্ত যাওয়ার অধিকার তা তিনি জানেন।

অর্ক এগিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই শুনতে পেল, এই যে এসে গেছ।

অর্ক দেখল বাড়ির পূর্বদিকের বাগানে এখন ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে আছেন গুরুমা এবং একজন মহিলা। কিন্তু মহিলাকে দেখে শিষ্যা বা সন্ন্যাসিনী বলে মনে হল না। একটু রোগা কিন্তু যথেষ্ট ফরসা এবং টানটান শরীর। অর্ক হেসে বলল, এখানে আসার পর সবসময় হুশে আছি যাতে আপনি ডাকলেই চলে আসতে পারি।

ও মা? তাই। বেশ বলল, মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে?

অর্ক বলল, মার্জনা করবেন যদি ধৃষ্টতা দেখাই। মানুষ তো নিজের ইচ্ছেয় পৃথিবীতে আসে না।

গুরুমা কিছুক্ষণ তাকালেন, তারপর বললেন, বসো।

অর্ক নিঃশব্দে তৃতীয় চেয়ারে বসল।

গুরুমা জিজ্ঞাসা করলেন, একসময় মানুষের জীবন ফুরিয়ে যায়। এই আসা-যাওয়া কী কারণে? অন্য প্রাণীদের সঙ্গে তফাত কোথায়?

অর্ক বলল, তফাত একটাই, মানুষ দাগ রেখে যেতে পারে, অন্য প্রাণী পারে না।

জোরে হেসে উঠলেন গুরুমা, বাঃ। খুব ভাল। তুমি দেখছি পড়াশোনা করেছ।

কিছুই পড়িনি। মায়ের কাছে ওঁর লেখা বই ছিল, তাই অর্ক বলল।

এবার গুরুমা মহিলার দিকে তাকালেন, এই মেয়ে, তুমি যাকে দেখতে চেয়েছিলে সে এই।

মহিলা তার দিকে তাকাতেই অর্ক হাত জোড় করল, আমি অর্ক মিত্র।
 
আমি কুন্তী সেন। নমস্কার। হাত জোড় করলেন মহিলা। তারপর একটু থেমে বললেন, আপনার নামটা সচরাচর শোনা যায় না। কিন্তু আমি আগে শুনেছিলাম বাবার মুখে। তাই আপনাকে দেখার কৌতূহল হল। অবশ্য বাবা যে অর্কের কথা বলেছিলেন তিনি অন্য কেউ হওয়াই স্বাভাবিক।

গুরুমা হাসলেন, নাম শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠল মেয়ে, বলল দেখতে চাই। কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ। আপনি?

আমি এখন ব্যান্ডেলে থাকি, স্কুলে পড়াই।

আপনার বাবা–।

কলেজে পড়াতেন। অবসর নিয়েছিলেন। ছবছর আগে মারা গিয়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বাবার এক সহযোগীর ছেলের নাম অর্ক।

হতেই পারে। আমি একজন আইএএস অফিসারের নাম কাগজে পড়েছি যাঁর নাম অর্কপ্রভ দেব। তিনি অবশ্য আমার বাবার বয়সি ছিলেন।

আপনার বাবা কী করতেন?

অর্ক একটু চুপ করে বলল, কিছু না। কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।

বুঝলাম না।

একাত্তরের আন্দোলনে ধরা পড়ার পর পুলিশ তাঁকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। অনেকদিন জেলে থাকার পর বেরিয়ে এসেও হাঁটতে পারেননি। এখন অবশ্য ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। অর্ক গুরুমায়ের দিকে তাকাল, আপনার এখানে সবাই। এত শৃঙ্খলা মেনে চলেন যা বাইরে বেশি দেখা যায় না।

তাই বুঝি। গুরুমা হাসলেন, ওরা সবাই খুব ভাল। কতবার এখানে পুলিশ এসে দেখতে চেয়েছে ওদের মধ্যে কেউ ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে। কিনা। না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছে। জেলাশাসক এসে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে গিয়েছেন।

ছদ্মবেশে কারা লুকিয়ে আছে বলে ওরা ভেবেছিল?

ওই যারা মনে করে যেভাবে দেশ চলছে সেভাবে চললে গরিব মানুষরা আরও গরিব হবে। তাই তারা উগ্র পথ ধরেছে। গুরুমা বললেন, আমি বলি শরীরে যদি টিউমার তৈরি হয় তা হলে ছুরি চালিয়ে সেটা বাদ দিলেই তো সেরে যাবে না, আবার একটা জায়গায় সেটা মুখ তুলবে। অসুখটা সারাতে ঠিকঠাক ওষুধ দিতে হবে শরীরে। ভেতর থেকে রোগটাকে নির্মূল না করলে রোগ সারে?

অর্ক মুগ্ধ হল কথাটা শুনে। কিন্তু ভেতর থেকে নির্মূল করার জন্যে যে ওষুধ দরকার তা কি প্রশাসনের কাছে আছে? সে কিছু বলল না।

আপনারা কি বহুদিন কলকাতায় আছেন? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল। কিছু মনে করবেন না, আপনি বললেন আপনার বাবা একাত্তরের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বাবাও এম এ পরীক্ষা দিয়ে সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। বছর খানেক জেলেও ছিলেন। পরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে উনি সরকারি কলেজে চাকরি পান।

কোন জেলে ছিলেন?

বহরমপুরে।

কী নাম ওঁর?

অবনী সেন। কুন্তী বললেন, সিপিএম থেকে ওঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল দলের হয়ে কাজ করতে কিন্তু উনি রাজি হননি।

অর্ক গুরুমায়ের দিকে তাকাল, আচ্ছা, আপনি তো আমাদের সম্পর্কে কিছুই না জেনে আশ্রয় দিয়েছেন। পুলিশ যদি এখন এসে আমাদের ধরে

আপনার কৈফিয়ত চায় তা হলে কী বলবেন?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top