What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

আপনি অদ্ভুত লোক তো! মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে যাই। বাবা নেই কিন্তু বউদির কথা ভেবে যেতে পারি না। ও হ্যাঁ। যে কথা বলছিলাম, আমি তো কথা না বলে থাকতে পারি না। মেয়ের বাবা বলত আমি নাকি বড় বেশি কথা বলি। কিন্তু একটা কথা কখনও বলিনি তাকে। অলকা হাসল।

ওঁকে যখন বলেননি তখন মনে রেখে দেওয়াই ভাল।

কিন্তু আমি যে সমস্যায় পড়েছি। বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে ভাবতে হত না। দাদা-বউদিকেও বলা যাবে না। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?

দেখুন, আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার হলে আমাকে বলবেন না। আমার সঙ্গে আপনার মাত্র দুদিন কথা হয়েছে, কেউ কাউকে চিনি না–

শুনুন মশাই, অবিবাহিতা মেয়েরা অনেক সময় অন্ধ হয় কিন্তু যে বিবাহিতা মেয়েকে সব সামলাতে হয় সে মানুষ চিনতে ভুল করে না।

অলকার কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল অর্ক, বেশ, বলুন।

বাবা মারা যাওয়ার আগে আমার নামে কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন কাউকে না জানাতে। অলকা বলল।

বাঃ, ভাল কথা।

কিন্তু সময়টা শেষ হয়ে গিয়েছে। টাকাটাও দ্বিগুণ হয়েছে। অলকা বলল, মেয়ের বাবা ব্যাপারটা জানেই না। আমি এখন বুঝতে পারছি না ওই টাকাটা নিয়ে কী করব?

আপনার বাবা বলেছিলেন কাউকে না জানাতে, আমাকে জানালেন কেন?

বললাম না সমস্যায় পড়েছি, মাথায় কিছু ঢুকছে না।

আপনি সমস্যা ভাবছেন তাই–আসলে কোনও সমস্যাই নেই। ব্যাঙ্কে গিয়ে আবার পুরো টাকাটাই এমন সময়ের জন্যে ফিক্সড করে দিন যাতে অঙ্কটা আরও বেড়ে যায়। আপনার মেয়ে যখন বড় হবে তখন ওর পড়াশোনার প্রয়োজনে খরচ করবেন। অর্ক বলল।

হাসি ফুটল অলকার মুখে। বলল, ঠিক বলেছেন, ওর দাদুর টাকা ওর পড়াশোনায় লাগুক। আর একটা কথা, বাবার কথা আমি পুরোটা অমান্য করিনি।

মানে?

উনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে। আমি পুরোটা বলিনি। উনি কত টাকা আমার নামে রেখেছিলেন তা কি আপনি জানেন?

না।

ব্যস। কথা রাখা হয়ে গেল।

হেসে ফেলল অর্ক। তার মনে হল অলকা আদৌ জটিল নয়। চায়ের দাম দিয়ে অর্ক বলল, আপনি এখোন, আমি পরে যাব।

উঁহু। আপনি আগে যান, আমি বাজার করে বাসায় যাব। অলকা উঠে দাঁড়াল, মনে করে ফোন করবেন কিন্তু।

করব। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই বাস পেয়ে গেল অর্ক। খালি বাস। উঠেই বসে পড়ল সে। জানলার বাইরে তাকাতেই পাঁচ মাথার মোড়ে মানুষের চলাফেরা নজরে এল। এইসব মানুষ প্রত্যেকেই সমস্যা নিয়ে চলাফেরা করছে। আলাদা আলাদা সমস্যা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখে একটা ছোট বাজার প্রতি সকালে বসে। সেখান থেকে আলু পেঁয়াজ আদা রসুন আর ডিম কিনে নিল অর্ক। একদম টাটকা পাবদা মাছ চোখে পড়তে এক মুহূর্ত থমকে ছিল সে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ! মাছ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে যদি ফেলে দিতে হয়! তার চেয়ে যেটা পারে সেটা করাই ভাল।
 
বস্তির মুখে বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কয়েকদিন আগেও ছেলেটাকে প্রকাশ্যে কথা বলতে দেখা যেত না। নন্দীগ্রামের আন্দোলন এবং তৃণমূলের সক্রিয় সমর্থনের পর কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা বিশ্বজিতের সাহস বোধহয় একটু বেড়েছে। এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নিচ্ছে সে। অর্কর অনুমান, সিপিএম পার্টি ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

বাজার করে এলেন? বিশ্বজিৎ হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।

প্ল্যাস্টিকের থলে একটু ওপরে তুলে অর্ক বলল, যদি এটাকে বাজার বলা যায়! খেতে হবে তো!

মাসিমারা কবে ফিরবেন? তদ্দিন তো আপনাকেই রাঁধতে হচ্ছে!

ফিরবেন। তবে দিন ঠিক হয়নি।

আপনাদের দরজায় তালা দেখলাম। গেস্ট চলে গেলেন?

হ্যাঁ। আজ ভোরের বাসে চলে গেল। ওকে পৌঁছাতে গিয়েছিলাম।

দেখুন কাণ্ড!

কেন? কী হয়েছে? প্রশ্ন করার ফাঁকেই অর্ক দেখছিল তাদের আশেপাশে মানুষ জমছে।

আরে, আপনাদের গলির ওই বুড়ি, ভোররাতে চিৎকার করছিল, বস্তিতে চোর ঢুকেছে। কারও কিছু চুরি যায়নি কিন্তু বুড়ি নাকি স্পষ্ট দেখেছে দুটো লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার ঠিক আছে শুধু আপনাদেরটা জানা হয়নি, কারণ দরজায় তালা রয়েছে। তালা যখন ভাঙেনি তখন ভেতরে চোর ঢুকবে কী করে? তখন কথা উঠল, আপনারা গেলেন কোথায়? বিশ্বজিৎ বলল।

তারপর? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি বললাম, উনি কোথায় যাবেন তা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাঙালি সবচেয়ে ভালবাসে সন্দেহ করতে। হঠাৎ বড়দাদা হাওয়ায় কথা ভাসালেন। আপনার মা-বাবা আজ ফিরে আসছেন বলে গেস্টকে অন্য কোথাও নিয়ে গেছেন। কারণ হল, আপনার গেস্টকে ওঁরা একদম পছন্দ। করবেন না। ছেলের গেস্টকে অপছন্দের কারণ কী? এই নিয়ে জল্পনা চলেছে। আপনি যান, আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ নাক গলাক তা আমরা চাই না। বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল বিশ্বজিৎ।

গলিতে ঢুকল অর্ক। বুড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গলা ভেসে এল, অই তো। এসে গেছ? কখন গেলে তা তো দেখলাম না। তোমার বাড়ির সেই উটকো লোকটাও নাকি আর নেই। দেখো, চুরি করে পালাল কিনা!

.

ডিমের ঝোল মোটামুটি ম্যানেজ করতে পারে অর্ক। সেটা নামাতেই বাইরের দরজায় শব্দ হল। সাড়া দিয়ে গেট খুলতেই সুরেন মাইতির হাসিমুখ দেখতে পেল অর্ক। পেছনে দুটো চামচে দাঁড়িয়ে আছে।

আরে! আপনি? আসুন। অর্ক সরে দাঁড়াল।

চামচেদের ইশারায় বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকল সুরেন মাইতি। চার পাশে তাকিয়ে বলল, এই বস্তিতে এরকম বাড়ি আর একটাও নেই। নিজস্ব উঠোন, দুটো শোওয়ার ঘর, কিচেন, টয়লেট, বারান্দা। ওটা কী গাছ?

ডুমুর।

অদ্ভুত গাছ। ফুল হয় না কিন্তু ফল হয়। ইন্টারেস্টিং। বারান্দায় চেয়ার এগিয়ে দিতে সুরেন মাইতি বসল, তা হলে আপনার মা-বাবা আজ ফিরছেন? ভাল ভাল।

অর্ক হাসল, এখনও ফেরার দিন ঠিক হয়নি।

তাই নাকি? ও। তা হলে আপনার গেস্টকে তো কদিন থাকতে বলতে পারতেন।

কেউ না থাকতে চাইলে তাকে কি জোর করে রাখব?

তা বটে। থাকতে চাইল না কেন?

ওর বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল।

কোথায় যেন বাড়ি?

হাজারিবাগে।

ওইসব অঞ্চলে তো মাওবাদীরা থিকথিক করছে।

আমি যাইনি কখনও–

আরে জানতে গেলে কি সবসময় যেতে হয়? রানিগঞ্জে যে কয়লা পাওয়া যায় তা জানতে কি লোকে সেখানে যায়! মুশকিল কী জানেন, এই মাওবাদীরা ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে দলে দলে চলে আসছে কলকাতায়। লুকিয়ে থাকার জন্যে এমন চমৎকার শহর তো ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে না। এসে মিশে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে। আর সেই কাজটা সহজ করে দিচ্ছে এই শহরের কিছু বাঙালি। তাদের মধ্যে লেখক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তারও আছেন। যে-কোনও দিন এরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করতে পারে।

কী যা তা বলছেন! অর্ক প্রতিবাদ করল।

বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। এরাই গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে একটা রাজনৈতিক দলের মদতে। সেই দলের সবাই উপনেতা, একজনই প্রধান নেত্রী। তিনি তো বলেই দিয়েছেন মাওবাদী বলে কিছু নেই। পড়েননি? তা হলে গ্রামে খুন করছে কারা? আকাশ থেকে খুনিরা নামছে? যাক গে, আপনার বাড়িতে যে ছিল আশা করি সে মাওবাদী নয়। সুরেন মাইতি কথা শেষ করে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল অর্ক। মা বলত, মধ্যবিত্তরা প্রতিবেশীর সম্পর্কে বেশি আগ্রহী হয়। উচ্চবিত্ত এবং বিত্তহীনরা এই ব্যাপারে একদম উদাসীন। মা তাই এই বস্তিতে চলে এসেছিল। তা হলে কি সময়টা বদলে গিয়েছে?
 
গত সন্ধ্যায় দেবেশ ফোন করেছিল। বলেছিল, কোনও অজুহাত শুনব না, কাল সকালে আমার এখানে চলে আয় তোরা। সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে ফিরে যাবি।

ফোন বন্ধ করে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলতেই তার মুখে হাসি ফুটল, গেলে খারাপ হয় না। একটা অন্যরকম দিন কাটবে।

কিন্তু মিস্টার রায় যদি ডেকে পাঠান। উইলের প্রবেট নিতে নিতে মাস আটেক লাগবে, প্রবেটের ফি-ও দিতে হবে। মিস্টার রায় তাই চাইছেন ছোটমা একটা এফিডেবিট করুন যাতে তিনি বলবেন বাবার সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারী তিনি। দরকার হলে কোর্ট থেকে সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। আর এইসবের জন্যে যদি বলেন আগামীকালই দেখা করতে হবে, তা হলে? অনিমেষ মাথা নাড়ল।

আশ্চর্য! তোমার কী হয়েছে বলো তো? শুনেছি নীরদ সি চৌধুরী একশো বছর বয়সেও অবাস্তব কথা বলতেন না। তোমার এখনই সেটা হয়ে গেল! মাধবীলতা বলল।

কী বলতে চাইছ? বিরক্ত হল অনিমেষ।

এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আমি হলে মিস্টার রায়কে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম আগামীকাল তিনি আমাদের ডাকবেন কিনা! ওঁর উত্তরটা দেবেশবাবুর ওখানে যাওয়া বা না যাওয়াটা সহজ করে দিত।

অনিমেষ শ্বাস নিল, সত্যি! আমার মাথায় এত খেলে না! মোবাইলে নাম্বার ডায়াল করে মাধবীলতার কথাগুলো বলতেই মিস্টার রায় হাসলেন, আমি ডাকলেও কোনও কাজ হবে না। কাল কোর্ট মহরমের জন্যে বন্ধ।

শুনে মাধবীলতা বলল, হল তো?

তুমি জানতে কাল মহরম? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

স্কুলে যখন চাকরি করতাম তখন হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের ধর্মীয় কারণে যেসব দিন ছুটি বলে ঘোষণা করা হয় তার হিসেব রাখতাম। তা হলে আমরা যাচ্ছি। শোনো, ওঁকেও নিয়ে যাব। মাধবীলতা উঠে পড়ল।

যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি জোগাড় করতে হবে।

দেবেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করো। উনি স্থানীয় মানুষ, সস্তায় ব্যবস্থা করবেন।

ছোটমা তখন ঠাকুরদের রাত্রের জন্যে বিশ্রাম দিয়ে প্রণাম করে উঠেছেন, মাধবীলতা দরজায় এসে দাঁড়াল। ছোটমা বললেন, কিছু বলবে?

ওর বন্ধু দেবেশের কথা বলেছিলাম আপনাকে, ওই যে যার ওখানে সবাই মিলে যাওয়ার কথা হয়েছিল। সে ফোন করেছিল। কাল যাবেন?

মাধবীলতা দেখল ছোটমায়ের মুখটা যেন পালটে গেল। খুশি চেপে রেখে বললেন, গেলেই হয়, কিন্তু–!

কিন্তু কী?

এই বাড়ি পাহারা দেবে কে? ঠাকুর আছেন, তোমাদের জিনিসপত্র আছে। বাগান আছে। সব যে ভোলা পড়ে থাকবে।

দরজায় তালা দিয়ে দেব। আর বাগানে তো নারকেল ছাড়া কিছু নেই।

নেই কী বলছ? শেয়ালছানারা নেই! সাপও আছে। আমরা নেই জানতে পারলে কেউ এসে ওদের মেরে ফেলবে। দেখো। ছোটমা বললেন।

মাধবীলতা অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকাল। ওই শেয়াল অথবা সাপও ওঁর কাছে এত মূল্যবান হয়ে গিয়েছে। মায়া বড় গভীরে শেকড় ছড়ায়।

মাধবীলতা বলল, ভাড়াটেদের ছোটবউকে বললে হবে না? মাথা নাড়ল ছোটমা, ঘুম থেকে উঠে কাজের চাপে মাথা তুলতে পারে না বেচারা। দুপুরের পর চোরের মতো আমার কাছে আসে। একটা উপায় আছে, লছমন একটু পরে আসবে। ওকে বাতাসা আনতে দিয়েছি। ওকে বলব যদি কাল ওর বউ ছেলেকে এই বাড়িতে আসতে বলে। কিন্তু যদি রাজি হয় তা। হলে ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে তো হবে।

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ভোরবেলায় উঠে ওদের দুবেলার খাবার করে দিয়ে যাব। সকাল আর দুপুর। বিকেলে তো ফিরেই আসব। মাধবীলতা ছোটমাকে আশ্বস্ত করল।

.
 
দেবেশই গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল। দিনবাজার থেকে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার ছেলেটি পৌঁছে গেল সকাল সাতটায়। মাধবীলতা গতরাত্রে বলেছিল, গাড়ির ভাড়া কত দিতে হবে তা জেনে নাওনি, কী যে করো!

অনিমেষ বলেছিল, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও বলেছিল ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে নিতে। দেবেশের পরিচিত, কিন্তু ও তো গাড়ি ভাড়া নেয় না, তাই জানে না।

ওর ওখানে যেতে হলে বাস থেকে নেমে অনেক হাঁটতে হবে?

মাধবীলতার প্রশ্ন শুনে অনিমেষ তাকাল। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না মাধবীলতা টাকার কথা চিন্তা করছে। সে বলেছিল, বাসে যাওয়ার সুবিধে থাকলে দেবেশ গাড়ি ভাড়া নেওয়ার পরামর্শ দেবে কেন?

মাধবীলতা কথা বাড়ায়নি।

সকালে গাড়ি আসার আগেই বাবা তার মাকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল লছমনের রিকশায় চড়ে। মাধবীলতা দেখল বউটিকে। বিহারের গ্রামের মেয়ে, প্রায় নাক পর্যন্ত ঘোমটা টানা। লম্বা, ছিপছিপে। শাড়ি পরার ধরন এবং রঙে বাঙালিয়ানা নেই।

ছোটমা খুশিমুখে ডাকলেন, আয়, আয়। তোর বর, ছেলে আসে, তুই তো আসিসই না। কী যেন নাম তোর?

লছমন পেছন থেকে বলল, রাধা।

অ্যাঁ। সে তো আয়ান ঘোষের বউ। বলে হাসলেন ছোটমা। তারপর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

মাধবীলতা বলল, ওকে সব বুঝিয়ে দিন।

লছমন মাথা নাড়ল, আমি সব বলে দিয়েছি। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আজ বাবার স্কুল ছুটি। ও মায়ের সঙ্গে থাকবে।

তৈরি হতে আটটা বেজে গেল। দেরি করলেন ছোটমা, বেরোবার সময় একটা না একটা কাজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। ক্রাচ বগলে নিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে গাড়ির পাশে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী নাম ভাই? বছর পঁচিশের ভদ্র চেহারার ছেলেটি হাসল, আমাকে খোকন বলে ডাকবেন।

আচ্ছা। এবার বলো, আমরা কোথায় যাচ্ছি তা কি জানো?

হ্যাঁ। খোকন বলল।

তোমাকে গাড়িভাড়া বাবদ কত দিতে হবে?

কাকাবাবু, আপনারা কতক্ষণ গাড়িটাকে রাখবেন তার ওপর নির্ভর করছে। যদি সারাদিন রাখেন তা হলে তো বেশি পড়বে। আর যদি ড্রপ করে চলে আসি আর ফেরার টাইম বললে নিয়ে আসতে যাই তা হলে অনেক কম চার্জ লাগবে। দুই লিটার তেলের দাম এক্সট্রা দিয়ে দেবেন।

কেন?

দু-দুবার যেতে আসতে হবে যে!

তা হলে দ্বিতীয়টাই করো। অনিমেষ বলল।

পেছন থেকে মাধবীলতা কথা বলল, একটা সমস্যা হতে পারে। যদি কোনও কারণে আমাদের আগেই চলে আসতে হয় তা হলে?

খোকন বলল, চিন্তা করবেন না কাকিমা। আমাকে মোবাইলে ডেকে নেবেন। আমি চলে যাব।

অনিমেষ ছোটমাকে দেখে খুশি হল। এখানে এসে ওঁর পরনে ময়লাটে কাপড়, যা হয়তো কখনও সাদা ছিল তাই দেখে এসেছে। মাধবীলতার অনুরোধ সত্ত্বেও সেগুলো ছাড়তে রাজি হননি। বলেছেন, ঘেঁড়েনি যখন তখন ফেলে দেব কেন? কিন্তু এখন ধবধবে সাদা শাড়ি যার সরু পাড়ে হালকা নীল রং, সাদা জামায় ছোটমায়ের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। মাধবীলতা গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, বসুন। অনিমেষ লক্ষ করল, ছোটমায়ের হাতে ভাঁজ করা ঘিয়ে রঙের চাদর রয়েছে।

গাড়িটা মারুতি ওমনি ভ্যান। ড্রাইভারের পেছনে মুখোমুখি সিটে ওরা তিনজন উঠে বসল। বাবা আর তার মা দাঁড়িয়ে ছিল যাত্রা দেখতে। গাড়ি বাড়ি থেকে গলি দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে না গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এদিকে তো জেলা স্কুলে যাওয়া যায়, তুমি তো হাসপাতালের দিকে যাবে।

খোকন বলল, আপনি বোধহয় অনেকদিন আসেননি কাকা। এদিক দিয়ে গেলে রাস্তা কম হয়।

কৈশোরের পরিচিত বাড়িগুলো দেখতে দেখতে অনিমেষ নিজের মনেই বলল, সব একইরকম আছে!

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
 
জেলা স্কুলের হস্টেলের পেছন দিয়ে সেনপাড়ার ভেতর দিয়ে খোকন গাড়িটাকে নিয়ে রাজবাড়ির কাছে চলে এল। তারপর ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে তিস্তা ব্রিজে উঠে টিকিট কাটল। ছোটমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার বাইরে তাকিয়ে বললেন, এই নদীটা কত বড় ছিল, এখন দেখো, ছোট হয়ে গিয়েছে।

মাধবীলতা বলল, তিস্তা আর নদী কোথায়! জলই নেই। ওই ওপাশে অল্প একটা ধারা। তাও যাচ্ছে কি যাচ্ছে না বোঝা যাবে না!

তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে খানিকটা আসার পর হাইওয়ে ছেড়ে মেঠো রাস্তায় গাড়ি নামল। দুপাশে চাষের খেত, রাস্তাটা গর্তে ভরতি। একটা গোরুর গাড়ি সেটা আটকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলছে। খোকন চিৎকার চেঁচামেচি করেও যখন হুশ ফেরাতে পারল না তখন তার মুখ থেকে একটা অশ্লীল শব্দ ছিটকে বের হল। অনিমেষের মনে হল দুকান দিয়ে গরম সীসে শরীরে ঢুকল। তার সামনে মাধবীলতা এবং ছোটমা বসে আছে। সে চোখ বন্ধ করল যাতে ওদের মুখ দেখতে না হয়। একবার ভাবল খোকনকে খুব ভর্ৎসনা করবে। কিন্তু তখনই গোরুর গাড়ির চালক একপাশে সরে দাঁড়াল। তাকে পেরিয়ে যাওয়ার জায়গা পেয়ে খোকন চিৎকার করল, গালি না দিলে ভাল কথা শুনতে পাও তোমরা?

হঠাৎ অনিমেষের মনে হল, খোকনের উচ্চারণ করা অশ্লীল শব্দটা সে, মাধবীলতা এবং ছোটমা শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে থাকলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ড্রাইভাররা গালিগালাজ দিতে অভ্যস্ত এই তথ্যটা মেনে নিলে সব চুকে যাবে।

দোমহনি একটি ক্ষুদ্র জনপদ। ছোটখাটো কিছু দোকান, গরিব মানুষদের ঘরবাড়ি, দু-তিনটে ইট সিমেন্টের দোতলা বলে দিচ্ছে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা আদৌ ভাল নয়। অনিমেষের মনে পড়ছিল, ছেলেবেলায় সে শুনত দোমহনির কথা। বেশ জাঁকজমক ছিল। একটা রেলওয়ে জংশন ছিল।

খোকন, তুমি দেবেশের ওখানে আগে গিয়েছ?

না কাকা। জিজ্ঞাসা করতে হবে। খোকন গাড়ি দাঁড় করিয়ে একজন প্রৌঢ়কে ডেকে বলল, আচ্ছা, দেবেশবাবুর বাড়ি কোথায়?

দেবেশ? ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল।

অনিমেষের জানলার কাছে মুখ এনে বলল, যিনি এখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম চালান। সাইকেলে ফেরেন।

ও, তা বাড়ি বলছেন কেন? আশ্রম বলুন। ডানদিক ধরে সোজা চলে যান। রেললাইন পেরিয়ে খানিকটা গেলে যাকে জিজ্ঞাসা করবেন সে-ই বলে দেবে। দেবুদার আশ্রম। হাসলেন প্রৌঢ়।

ডানদিকে ঘুরে খানিকটা যেতেই রেললাইন দেখা গেল। একটাই লাইন, দেখে বোঝা যাচ্ছে ট্রেন চলাচল করে। ডানদিকে কিছুটা দূরে খোলা মাঠের ওপর একতলা ঘরটা বোধহয় স্টেশন। কোনও বাউন্ডারি নেই।

লাইন পার হতেই এগিয়ে আসা সাইকেল আরোহী হাত তুলে থামতে বলল, তারপর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

দেবেশকে দেখে খুশি হল অনিমেষ, তুই কোথায় যাচ্ছিস?

তোদের দেরি দেখে এগোচ্ছিলাম। ড্রাইভারভাই, তুমি আমার পেছনে এসো। কাছেই আশ্রম। সাইকেল ঘোরাল দেবেশ।

গাড়ি থেকে নেমে মুগ্ধ হয়ে গেল অনিমেষ। তারের বেড়ার ভেতরে অনেকটা জমিতে শাকসবজির চাষ হয়েছে। তার ওপাশে টিনের চাল ইটের দেওয়াল দেওয়া লম্বা লম্বা ঘরবাড়ি। দুপাশে খোলা মাঠ, পেছনে জঙ্গলের আড়াল।

গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় খোকন ডাকল, কাকা।

অনিমেষ তাকালে সে একটা কাগজ এগিয়ে দিল, আমার মোবাইল নম্বর।

মাধবীলতা সেটা নিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ ভাই।

দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, তুই কি গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছিস?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, সারাদিন আটকে রেখে লাভ কী? খরচ বাড়বে। দেবেশ খোকনের দিকে তাকাল, ফোন পেলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে।

মাথা নেড়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল খোকন। দেবেশ ছোটমায়ের সামনে গিয়ে বলল, আপনারা যে শেষ পর্যন্ত আমার এখানে এসেছেন, খুব ভাল লাগছে। আসুন, আসুন আপনারা!

আর একটু এগোতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। আশ্রমের বাসিন্দা বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারা পরিষ্কার জামাকাপড় পরে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। দেবেশ একে একে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মাধবীলতা মহিলাদের দিকে তাকিয়েছিল। ছয়জন আছেন। অতি বৃদ্ধা যিনি তার বয়স আশির ওপরে, লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধার হাত ধরল, আপনি কেন কষ্ট করে উঠে এলেন? চলুন, বসে কথা বলব।
 
বৃদ্ধা খালি হাতটা মাধবীলতার গালে ছোঁয়ালেন, কেউ তো খবর নিতে আসে না। ওই ছেলে ছিল বলে এখনও বেঁচে আছি। তা শুনলাম তোমরা আসছ। ছেলের স্কুলের বন্ধু আর তার মা-বউ। না এসে কি পারি?

দেবেশ বলল, চলুন, আমরা সবাই কমনরুমে গিয়ে বসি।

কমনরুম বলতে বাঁধানো মেঝের ওপর বাঁশের খুঁটিতে খড়ের ছাউনি আটকানো, চারধার খোলা। মেঝের ওপর চারদিক জুড়ে বেঞ্চি পাতা। সবাই বসলে দেবেশ বলল, অনিমেষ আর আমি একসঙ্গে জেলা স্কুলে পড়তাম। মাসিমা, আপনার সঙ্গে তখন আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ওদের বাড়িতে আমি সপ্তাহে একদিন অন্তত যেতাম। কেন জানেন?

মাধবীলতা হাসল, আমি জানি।

বেশ আপনিই বলুন। দেবেশ বলল।

না, আপনার মুখে শুনতে চাই।

আমরা কয়েকজন প্রথম গিয়েছিলাম স্কুল ছুটির পর। তখন ওই বাড়ি বড়পিসিমার কন্ট্রোলে। অনিমেষকে খুব ভালবাসতেন। বালবিধবা মহিলা। প্রথম দিনে সবার নাম জিজ্ঞাসা করলে যেই তিনি আমার নাম শুনলেন অমনি আমার খাতির বেড়ে গেল। অন্যরা যা খাবার পেত আমি তার দ্বিগুণ পেতাম। কারণটা খুব মিষ্টি। বড়পিসিমার এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, বারোর আগে তার স্বামী মারা যান। কিন্তু প্রৌঢ়া মহিলা তার স্বামীর নাম ভোলেননি। দেবেশ শুনেই আমার প্রতি তার মন নরম হয়ে গিয়েছিল। দেবেশ খুব গাঢ় গলায় কথা বলছিল।

ইতিমধ্যে জলখাবার এসে গেল। গরম গরম রুটি আর আলুর তরকারি। ছোটমা মাধবীলতাকে নিচু গলায় বললেন, আমাকে দিতে নিষেধ করো।

মাধবীলতার চোখে প্রশ্ন দেখে বললেন, সকালের এই সময়ে আমি তো খাই না।

পাশে বসা একজন বৃদ্ধা বললেন, কিছু মনে করবেন না দিদি, আপনি নিশ্চয়ই এই সময় বাড়ির বাইরে আসেন না, আজ যেমন এসেছেন।

না। কত বছর পরে এলাম তাও মনে নেই। ছোটমা বললেন।

তা হলে দিদি, আজ নিয়ম ভাঙলে কোনও ক্ষতি হবে না। খেয়ে নিন।

মাধবীলতা দেখল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছোটমা খাবারের থালা নিলেন।

কথা শুরু হল। এখানে যারা আছেন তাদের সবাই যে খুব অসহায় অবস্থা থেকে এসেছেন তা নয়। ছেলে প্রবাসে বাড়িঘর করে আছে। জলপাইগুড়িতে কখনওই থাকবে না, আবার বাবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় দুটো কারণে। এক, প্রবাসে গিয়ে বাবা এই বয়সে মানিয়ে নিতে পারবেন না। দুই, জলপাইগুড়ির পরিচিত পরিবেশে থাকতে তিনি অনেক বেশি স্বস্তি অনুভব করবেন। ফলে, ছেলে এসে পৈতৃক বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাবাকে এখানে রেখে গেছে। ভাড়ার টাকা প্রতিমাসে খরচ বাবদ আশ্রমকে দেওয়া হয়ে থাকে। কয়েকজন বৃদ্ধবৃদ্ধা, যাঁরা স্বামী-স্ত্রী, শুধু পেনশনের ওপর নির্ভর করে এখানে আছেন, আবার কয়েকজন আছেন, যাঁরা কোনও আর্থিক সাহায্য আশ্রমকে দিতে পারেন না। কিন্তু সেই কারণে দেবেশ কোনও শ্রেণিভাগ করেনি।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আপনারা সারাদিন কী করেন?

একজন প্রৌঢ় বললেন, আমরা সকাল ছটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে ওই বাগানে গিয়ে বসি। তখন সবে সূর্য উঠছে। যে যার মতো পনেরো মিনিট ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সূর্যের দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টি পড়লে এই কমনরুমে এসে প্রার্থনা করে নিই। তারপর চা বিস্কুট খেয়ে নিই। এরপরে, সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুরুষরা বাগানের কাজ করি। মাটি কোপানো, সার বীজ লাগানোর কাজ করতে দেবেশবাবুকে লোক ভাড়া করতে হয়। আমাদের যা শরীরের অবস্থা তাতে ওই পরিশ্রম সম্ভব নয়। কিন্তু সবজি এবং ফলের গাছগুলো মাটির ওপরে উঠে এলে আমরাই দেখাশোনা করি। বছরের নয়-দশ মাসের তরিতরকারি এই বাগান থেকেই পেয়ে যাই। মহিলারা তরিতরকারি কাটা, রান্নার ব্যাপারে ঠাকুরকে সাহায্য করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। কারও জামাকাপড় সেলাই করার দরকার হলে তা করে দেন। তারপর জলখাবার খেয়ে বিশ্রাম। দেবেশ একটা ছোট লাইব্রেরি করে দিয়েছে। সেই বই পড়ি যা পড়তে চাই। তারপর স্নান খাওয়া সেরে বিশ্রাম। তিনটের সময় একজন ডাক্তার এসে আমাদের শরীরের খবর নেন। পাগল ডাক্তার, নইলে রোজ আসত না। তারপর সবাই মিলে হাঁটতে বের হই। বড়দিদি হাঁটতে পারেন না বলে বাগানে বসে থাকেন।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তা হলে কি বুঝব আপনারা এখানে ভাল আছেন?

বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, খুব ভাল আছি মা। একসঙ্গে ভাল আছি।

এইসময় মোবাইল বেজে উঠতেই মাধবীলতা হকচকিয়ে গেল। সবাই কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাধবীলতা মোবাইল অন করে বলল, হ্যালো?

অর্কর গলা শোনা গেল, মা, তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?
 
মাধবীলতা আড়চোখে অনিমেষের দিকে তাকাল। মোবাইলের রিং শুনে সে মুখ ঘুরিয়েছিল এদিকে। মাধবীলতা বলল, খুব জরুরি কিছু?

তুমি কি ব্যস্ত আছ? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। চোখ বন্ধ করল মাধবীলতা, কী বলতে চাইছিস, বল!

আমাদের এই বস্তির একটা বাচ্চা খুব সমস্যায় পড়েছে। ও যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুল থেকে বলেছে ওকে অন্য জায়গায় ভরতি করতে। শুনতে পাচ্ছ?

হঠাৎ একটা বাচ্চাকে কেন এ কথা বলবে? সে কি কোনও সমস্যা করেছে?

না না, তার সমস্যা করার বয়সই হয়নি। ওর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিল। বোধহয় তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। সেই অপরাধে বাচ্চাটাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

অদ্ভুত ব্যাপার! মাধবীলতা বলল।

সত্যি অদ্ভুত। কিন্তু এটা ঘটনা। অর্ক বলল।

আমি এই ঘটনার কথা বলছি না।

তা হলে?

সেই কমিউনের ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তোকে কোনও পরিবারের সঙ্গে মিশতে দেখিনি। বস্তির কোনও মানুষের সঙ্গে কথাও বলতিস না। শুধু শোওয়ার জন্যে বাড়িতে আসতিস। আজ হঠাৎ তাদের একটা বাচ্চার জন্যে তোর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল কী করে তাই বুঝতে পারছি না।

খুব সহজ ব্যাপার। আজকাল তুমি বা বাবা যে-কোনও স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে অস্বাভাবিকতা খোঁজো। বাচ্চার মা তোমার কাছে এসেছিল। ভেবেছিল, তুমি বললে তোমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস না বলতে পারবেন না। তুমি এখন জলপাইগুড়িতে আছ, কবে আসবে জানা যাচ্ছে না শুনে ভদ্রমহিলা আমাকে অনুরোধ করেছেন তোমাকে ফোন করতে। তুমি যদি হেডমিস্ট্রেসকে একটা ফোন করে দাও! অর্ক খুব স্থির গলায় কথাগুলো বলে গেল।

এই মহিলা কে? কী নাম?

অলকা। তুমি বোধহয় চিনতে পারবে না।

অলকা–? তুই আগে দেখেছিস?

না। বস্তির পেছন দিকে থাকত।

ওই অলকা তোর কাছে এসেছিল? ওর স্বামী আসেনি?

মা, তুমি–।

আমি ঠিকই জিজ্ঞাসা করছি। মেয়ের সমস্যা দূর করতে বাবারই তো আসার কথা। আমি কলকাতায় নেই শুনে তোর কাছে স্বামীকেই পাঠানো কি উচিত কাজ নয়?

আমার কাছে ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ফোনটা যেহেতু তুই আমাকে করতে বলেছিস তাই আমি যা ভাবছি তাই বললাম। শোন অর্ক, যাকে চিনি না, জানি না, তার জন্যে আমি কাউকে অনুরোধ করতে পারব না কৃপা করতে। আমার ছেলে হয়েও তুই যে এতদিনে আমাকে বুঝিসনি দেখে খারাপ লাগছে। যাক গে, আমি, আমরা বাড়িতে নেই এখন। রাখলাম। মাধবীলতা ফোন বন্ধ করল। বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, তোমার মুখ এত শক্ত হয়ে গেল কেন মেয়ে?

মাধবীলতা হাসার চেষ্টা করল, কই, না তো!

বৃদ্ধা বড়দিদি মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখলেন, তোমার কথাটা আমার ভাল লেগেছে। যাকে জানো না তার জন্যে কেন সুপারিশ করবে? ঠিক কথা।

দেবেশ বলল, অনিমেষ, আমাদের বড়দিদি চমৎকার গান করেন।
 
বৃদ্ধা বড়দিদি দ্রুত হাত নাড়লেন, না না এ কী কথা। এই বয়সে কি গলায় সুর আসে? গান গেয়েছি বিয়ের আগে। আর তারপর তোমরা ধরো বলে এই আশ্রমে এসে। আমি কি গাইতে পারি?

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি বিয়ের পর গান গাওয়ার সুযোগ পাননি?

এবার আর একজন প্রৌঢ়া কথা বললেন, আমি বলি। বড়দিদি এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে খুব অস্বস্তি বোধ করেন। প্রৌঢ় বৃদ্ধা বড়দিদির দিকে তাকালেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারি।

পড়েছি মোগলের হাতে, বলো। বৃদ্ধা বড়দিদি হাসলেন।

প্রৌঢ়া বললেন, বড়দিদির বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে। ওঁর বাবা খুব ভাল গাইতেন। অতুলপ্রসাদের গান, রজনীকান্তের গান। অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন না।

বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, বাবা বলতেন, সবার গলায় গুরুদেবের গান মানায় না।

প্রৌঢ়া বললেন, বাবার কাছেই গান শিখেছিলেন বড়দিদি। বিয়ের পরে একান্নবর্তী সংসার ওঁকে বেশিদিন করতে হয়নি। ওঁর স্বামী পাটনায় চাকরি করতেন বলে ওঁকে সেখানে যেতে হয়েছিল। তখন সংসার সাজাতে ব্যস্ত তিনি, কিন্তু মাত্র ছয় মাস পরেই ওঁর স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। বাধ্য হয়ে পাটনায় বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন শ্বশুরবাড়িতে। ওঁর বাবা যতবার ওঁকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ততবার ওঁর শ্বশুর একটা না একটা বাহানা দেখিয়ে ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ভদ্রলোকের ভয় হয়েছিল বিধবা পুত্রবধূকে তার বাবা আবার বিয়ে দিতে পারেন।

বৃদ্ধা বড়দিদি হাসলেন, একটু বলি। আমার শ্বশুর ছিলেন ঠিক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, মহর্ষি?

বৃদ্ধা বড়দিদি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ গো। তুমি সাহানা দেবীর নাম শুনেছ? যাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের এক পাগল ছেলের সঙ্গে। সেই পাগলকে ঘুম পাড়াতে বেচারাকে সারা রাত গাইতে হত! তা সেই পাগল মারা যাওয়ার পর সাহানা দেবীর বাবা মেয়েকে নিয়ে গেলেন। জায়গাটা মনে নেই। হয় এলাহাবাদ বা লখনৌ। কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তিনি অনুমতি চাইলেন, মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চান। দেবেন্দ্রনাথ খুব রেগে গিয়ে সমরেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বললেন সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে আনতে। ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূ বিধবা হলেও সসম্মানে বাড়িতেই থাকবেন। তাঁকে আবার বিয়ে দেওয়া চলবে না। কিন্তু নিয়ে আসতে হলে অসত্য কথা বলতে হবে। দেবেন্দ্রনাথের ছেলেরা, সত্যেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাবার আদেশ পালন করতে যখন চাইলেন না তখন রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ল। বাবার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুর্বল হয়ে গেলেন। তিনি গিয়ে সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বড়দিদি হাসলেন, এসব ব্যাপার আগেকার দিনে খুব স্বাভাবিক ছিল।

মাধবীলতা অবাক হয়ে শুনছিল। জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন? রবীন্দ্রনাথ–!

তখন তো ওঁর অল্প বয়স। যুবকও হননি। পিতৃভক্ত ছিলেন। এরকম হয়।

প্রৌঢ়া বললেন, রবীন্দ্রনাথের সময় মানে একশো তিরিশ বছর আগেকার কথা। সে সময় যা হতে পারত তা বড়দিদির সময়েও হয়েছিল। ওঁর বাবা অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে আবার সংসারী করতে পারেননি। শ্বশুরবাড়িতে একাদশী-অমাবস্যা আর অম্বুবাচী করেই জীবনের অনেকটা পার করে দিয়েছিলেন।

বড়দিদি মাথা নাড়লেন, না না, সবকিছুর জন্যে ওঁদের দায়ী করা ঠিক নয়। আসলে কী জানো, তিন-চার বছর বিধবার জীবনযাপন করার পর আমিই আপত্তি করেছিলাম। আবার একটা পুরুষমানুষের সঙ্গে ঘর করব! এক স্বামীর ঘর ছেড়ে আর এক স্বামীর ঘরে? কীরকম ঘেন্না লাগার বোধ তৈরি হল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা এখন মেয়েরা বিবাহিত জীবনে অসুখী হয়ে বিয়ে ভেঙে আবার আর একজনকে ভালবেসে বিয়ে করে সংসার করছে, এটা নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ নয়?

ওমা! কে বলল? একটা মেয়ের বুকে যতদিন নিজের জন্য আবেগ থাকবে, যতদিন সে ভাববে আমার সংসার আমি নিজের ইচ্ছেয় তৈরি করতে পারি ততদিন সে পথ তৈরি করে নিতেই পারে। আমার মনে ওই ইচ্ছেটাই ছিল না। বড়দিদি বললেন, আসলে কী জানো, চিরকাল জেনে এসেছি আমার কোনও ঘর নেই। এই সেদিনও মেয়েদের কোনও ঘর ছিল না। হয় বাপের বাড়ি, নয় শ্বশুরবাড়ি। তারপর ছেলের বাড়ি। নিজের বাড়ি কোথায়? মেয়ে জামাই দুজনে যদি সংসার করে তা হলে সেটা হত জামাইয়ের বাড়ি। হাজার মাইল দূরে হলেও সেখানে গিয়ে তেরাত্তিরের মধ্যে চলে আসতে হত। মেয়ের বাড়ি বলে ভাবত না কেউ।
 
এতক্ষণ সবাই চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটু কেশে নিয়ে বললেন, আমি একটা কথা বলব?

ওমা! এ কী কথা? বড়দিদি হাসলেন, শুনি।

আমার মনে হয় এর জন্যে তখনকার সামাজিক ব্যবস্থাই দায়ী। প্রৌঢ় বললেন, একান্নবর্তী পরিবারে যুবক বাবার সঙ্গে তার ছেলেমেয়েদের কোনও যোগাযোগ থাকত না। অভিভাবক-অভিভাবিকারাই দেখাশোনা করতেন। বিশেষ করে মেয়ের সঙ্গে মা-ঠাকুমা-পিসিদের সম্পর্কই বেশি ঘনিষ্ঠ হত। বাবা যেমন দুরের মানুষ, যোগ্য মেয়েও বাবার কাছের মানুষ ছিল না। বিয়ের পরে সেই দূরত্ব আরও বেড়ে যেত বলে বাবা মেয়ের সম্পর্কে ততটা টান অনুভব করতেন না। ছেলেমেয়েরা কথা বলার সুযোগ হলে বাবাকে আপনি সম্বোধন করত। কিন্তু গত চল্লিশ বছরে ছবিটা একদম বদলে গেল। একান্নবর্তী সংসার ভেঙে যাওয়ায় বাড়িতে মা এবং বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ে বাবার সঙ্গে শৈশবে খেলেছে, কাঁধে মাথায় চড়েছে, তুমি সম্বোধন করাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাবা ক্রমশ বন্ধু হয়ে গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক তার চাইতে বাবার সঙ্গে বেশি নিকট সম্পর্ক। সে পড়াশুনা করেছে। যা পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যায় তাই পড়ে চাকরি করছে। বিয়ের পর তাই তাদের বাড়িটা আর বাবার কাছে জামাইয়ের বাড়ি নয়, মেয়েরও বাড়ি। আর আপনারা তো সবাই জানেন, এখন বৃদ্ধ বাবা মায়ের পাশে ছেলেরা যতটা না থাকছে তার অনেক বেশি মেয়েরা দাঁড়াচ্ছে। প্রৌঢ় হাসলেন।

দেবেশ বলল, খবরের কাগজে আদালতের খবর তো তাই বলে।

একজন প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন, ঠিক। বাবাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, মাকে খেতে দিচ্ছে না, বাড়ি লিখে দিতে বলছে, নইলে অত্যাচার বেড়ে যাচ্ছে, এইসব মামলা হাতে পেলেই বিচারক ছেলেকে ডেকে ভর্ৎসনা করছেন। খোরপোেষ দিতে বলছেন। মেয়ে এরকম করছে বলে খবর পড়িনি।

দেবেশ হেসে ফেলল, তা হলে দেখুন, মেয়েদেরই জয়জয়কার। বুঝলি অনিমেষ, এই যে মায়েরা এখানে আছেন, এঁদের সংখ্যা কিন্তু ছেলেদের থেকে বেশি।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এই যে আপনারা এখানে আছেন, এতদিন যে সংসারে ছিলেন তা ছেড়ে এসে এখানে কেমন লাগছে?

একজন বছর পঞ্চাশেকের মহিলা বললেন, দেখে কী মনে হচ্ছে?

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তা হলে দেখে যা মনে হচ্ছে তা সত্যি?

মহিলা বললেন, পুরোপুরি। আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, কিছু হারালে এ ওকে সন্দেহ করি, আবার কারও শরীর খারাপ হলে সবাই পালা করে তার পাশে দিন রাত থাকি। কিন্তু সবার মনে একটাই ভয়–!

কীসের ভয়?

যে মানুষটার জন্যে আমরা এখানে এসে শান্তি পেয়েছি তার যদি কিছু হয়েই যায় তা হলে আমাদের কী হবে! মহিলার মুখ অন্যরকম দেখাল।

সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ প্রতিবাদ করল, এ কী কথা? আমি তাড়াতাড়ি মরছি । আর দুর্ঘটনা যদি কিছু হয়েই যায় তা হলে আমার অবর্তমানে আপনারা যাতে ঠিকঠাক চালাতে পারেন সে ব্যবস্থা করেই দিয়েছি। চল, অনিমেষ, তোকে আমাদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে আনি। হাঁটতে পারবি তো?

নিশ্চয়ই। অভ্যেস এমন একটা ব্যাপার যার কোনও বিকল্প নেই।

দেবেশ এবং অনিমেষ উঠতেই পুরুষরাও বেরিয়ে গেলেন। মাধবীলতা বড়দিদিকে জিজ্ঞাসা করলে, এঁরা চলে গেলেন কেন?

বাগানে যাচ্ছে কাজ করতে। রোদ চড়া হয়ে গেলে তো পারবে না। ছেলেরাই তো শাক সবজি থেকে সমস্ত আনাজ তৈরি করে। বড়দিদি বললেন, কিন্তু মা, তখন থেকে আমরাই কথা বলে যাচ্ছি, উনি কিছু বলছেন না।

ছোটমা মাথা নাড়লেন, আমাকে আপনি বলবেন না। আমার কিছু বলার নেই।

ও কী কথা! আমাদের কাছে এসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?

আপনারা সবাই একসঙ্গে আছেন দেখে ভাল লাগছে। ছোটমা বললেন, আমি তো বহু বছর একা একা থাকছি, এখন একা থাকতেই ভাল লাগে।

বড়দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, সবাই মিলে হইচই করতে ইচ্ছে হয় না?

একসময় খুব হত। এখন হয় না। এই যে ওরা এত বছর পরে কলকাতা থেকে এসেছে, ভাল লাগছে আবার–! জানি আমারই ত্রুটি। ওদের সঙ্গে একটু কথা বলেই নিজের ঘরে চলে আসি। অথচ ওরা আমার ভাল চায়–! ছোটমা বললেন।

এইসময় রান্নার লোক এসে বলল, এখনও তরকারি কাটা হয়নি!

দুজন মহিলা উঠলেন। একজন জিভ কেটে বললেন, এই যাঃ!

হঠাৎ ছোটমা বললেন, আমি যেতে পারি? বড়দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়?

তরকারি কাটতে আমার ভাল লাগে।

তাই? যাও। এই, ওকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও।
 
মাধবীলতা একটু অবাক হয়ে তাকাল। এখানে আসার পর একদিনও সে ছোটমায়ের মুখে এমন কথা শোনেনি!

দেবেশের সঙ্গে আশ্রমের অনেকটা দেখে একটা মাঝারি পুকুরের পাশে এসে দাঁড়াল অনিমেষ, মাছ আছে?

আছে। তিন কেজির ওপর হয়ে গেলে বিক্রি করে দিই। খানিকটা আয় হয়। দেবেশ হাসিমুখে বলল।

এই যে এতগুলো মানুষ, কয়েকজন কর্মচারী, এদের খাওয়াদাওয়া ছাড়াও তো অনেক খরচ আছে, চালাচ্ছিস কী করে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

চলে যাচ্ছে। আসলে সবাই মিলে চালাচ্ছি। এখানে আসার সময় এঁরা কিছু টাকা যে যার মতো পারেন দিতে চেয়েছিলেন। আমি নিইনি। কিন্তু টাকাগুলো একটা নতুন অ্যাকাউন্ট করে ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছি যা থেকে প্রতিমাসে সুদ পাওয়া যায়। সিনিয়ার দুজন আবাসিক সই করে টাকা তোলেন। তা ছাড়া শাকসবজি তো ওঁরাই পরিশ্রম করে পেয়ে যান। গোয়ালে যে চারটে গোরু দেখলি তাদের দেখাশোনা করে যে রাখাল সে খুব ভাল ছেলে। মাত্র তিনশো টাকা মাইনে নেয় আর থাকা-খাওয়া। প্রায় সব মাসেই দুধ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আমি জলপাইগুড়ির তিনজন ধনী মানুষের সাহায্য পাই। এই করেই চলে যাচ্ছে। দেবেশ বলল।

তৃপ্তি পাস?

খুউব। সংসারে যাঁদের কেউ নেই, জীবনের উপান্তে যাঁরা চলে এসেছেন, তাদের মুখে হাসি দেখতে পেলে খুব আনন্দ হয়। জানিস, একটা কাণ্ড হয়েছে। ওঁরা সবাই মিলে কলকাতার বিখ্যাত লেখক এবং প্রকাশকদের কাছে আবেদন করেছিলেন বইয়ের জন্যে। বেশিরভাগই পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমাকে এখন দুটো কাঠের আলমারি কিনতে হবে। দেবেশ বলল।

তুই ভাল আছিস দেবেশ। নিচু গলায় বলল অনিমেষ।

হ্যাঁ। তা ঠিক। তুই কতদিন জলপাইগুড়িতে আছিস?

ঠিক নেই। বাড়িটা ছোটমায়ের নামে আদালত করে দিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উনি ওটা বিক্রি করে দেবেন কিনা! সেই অবধি তো আছি। অনিমেষ কথা শেষ করতেই দেখল একটা গাড়ি আশ্রমের দিকে আসছে।

দেবেশ বলল, কেউ আসছেন। চল, দেখি।

ওরা যতক্ষণে সামনের বাগানে এল ততক্ষণে তিনজন মানুষ গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করল দেবেশ, কী সৌভাগ্য, আপনি! আসুন, আসুন।

আর আসুন! আপনি তো আমাদের বাদ দিয়েই এসব করছেন।

আমার একার পক্ষে কি কিছু করা সম্ভব?

নয় তো কী? লাস্ট কবে ময়নাগুড়িতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন? ভোটার লিস্টে এদের নাম তুলেছেন?

বিশ্বাস করুন, বলেছিলাম, এঁরা কেউ রাজি হননি!

সে কী! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোট না দেওয়া অপরাধ, ওঁরা জানেন না?

বলেছিলাম। আসলে সব ত্যাগ করে এসে আর পেছনে তাকাতে চান না। বলুন, কী করতে পারি?

এই যে গুরুচরণবাবু, আমাদের পার্টির একজন প্রবীণ কর্মীর কাকা। খুব কষ্টে আছেন। স্ত্রী গত হয়েছেন। এঁকে আপনার আশ্রমে রাখুন। কিন্তু দেবেশবাবু, উনি পয়সাকড়ি দিতে পারবেন না।

আমরা খুব টানাটানির মধ্যে আছি–!

আরে! আপনার কাছ থেকে আমরা কখনও ডোনেশন চাইনি। ওকে রাখা মানে পার্টিকে সাহায্য করা। গুরুচরণবাবু, আপনার কিছু জানার থাকলে দেবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন।

অন্ধের কী বা দিন কী বা রাত! কী জিজ্ঞাসা করব? একটা আলাদা শোওয়ার ঘর, খাট বিছানা, চারবেলা খাওয়া। নিরামিষ দরকার নেই, একটু মাছের ঝোল আর ভাত হলেই হবে। বছরে চারটে পাঞ্জাবি আর পাজামা। আর হ্যাঁ, রোজ একটা খবরের কাগজ, এইটুকু। গুরুচরণবাবু বললেন।

আমাদের এখানে সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ হয়। দেবেশ বলল।

তা হলে সেই তিনদিন ডিম দেবেন। গুরুচরণবাবু বললেন।

দেবেশ বলল, আপনাকে দিন দশেক অপেক্ষা করতে হবে। আমি জানাব।

মাতব্বর ভদ্রলোক বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। কোনও দরকার হলে বলবেন।

ওঁরা গাড়িতে উঠে পড়লেন, হাত নাড়লেন, চলে গেলেন।

দেবেশ বলল, এই প্রথম।

লোকটা কে?

পার্টির লোকাল নেতা। ওই গুরুচরণবাবুকে লক্ষ করেছিলি? আশ্রমে ঢুকলে পরিবেশ বিষাক্ত করে দেবে। নৃপেনদার সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

নৃপেনদা বোধহয় কারও উপকার করেন না। অনিমেষ বলল।

দেবেশ হাসল, তুই ভুলে গিয়েছিস। ওঁর স্ত্রী আমার জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top