What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত নেড়ে থামিয়ে মাধবীলতা বলল, এর জন্য আমাদের কত দিতে হবে?

খুব বেশি নয়। আপনাদের যে টাকার কথা বলেছিলাম তার মধ্যেই হয়ে যাবে। কমও হতে পারে। আপনারা কি চা খাবেন? মিস্টার রায় তাকালেন।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না।

একটা সময় ছিল, এই শহরের মানুষ সমস্যায় পড়লে সিপিএমের নেতাদের কাছেও যেমন যেত তেমনি কংগ্রেসের নেতাদেরও সাহায্য নিত। দুই দলের নেতারা নির্বাচনের আগে যত যুদ্ধই করে থাকুন না কেন বাকি সাড়ে চার বছর সৌজন্যবোধ হারাতেন না। তখন চা-বাগানে আর এস পি-র প্রভাব খুব বেশি ছিল। কংগ্রেস বা সিপিএমের সংগঠন সেখানে খুব দুর্বল ছিল। কিন্তু কোনও মানবিক প্রয়োজনে খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যদি ননী ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করতেন তা হলে ননীবাবু মুখ ফিরিয়ে নিতেন না। এখন তো এখানে কংগ্রেস একটা সাইনবোর্ডের পার্টি। নতুন পার্টি তৃণমূল কলকাতায় মাথা চাড়া দিচ্ছে। মা দুর্গা যখন দশ হাতে যুদ্ধ করেছিলেন তখন দেবতারা তাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। তৃণমূল যাঁর স্বপ্ন তার পাশের কারও ওপর তো ভরসা করা যাচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের উচিত প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন মিস্টার রায়।

প্রশাসন আমাদের সাহায্য করবে?

সচরাচর করে না। ভয় পায়। জলপাইগুড়ি থেকে সুন্দরবনের রামগঙ্গাতে ট্রান্সফার করে দিতে পারে। পুলিশের ট্রেনিং তো মিলিটারিদের মতো নয় যে প্রয়োজনে দেশের সব জায়গায় যেতে তৈরি থাকবে। একটা কাজ করা যায়। আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন উত্তরবাংলার পুলিশের এক নম্বর কর্তা। সরকার তার সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। বছর খানেকের মধ্যেই অবসর নেবেন। আমি তাঁকে টেলিফোনে ব্যাপারটা বলছি। দেখা যাক কী হয়। আচ্ছা? মিস্টার রায় উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে দিলেন দরজা পর্যন্ত।

তখন সবে সন্ধে হয়েছে। লছমনের রিকশায় ওঠার পর অনিমেষ বলল, তোমার কী মনে হয়, পুলিশ সাহায্য করবে?

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তুমি এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ?

হুঁ। অনিমেষ অন্যদিকে তাকাল। তারপর বলল, আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে ফিরে অর্ককে দেখতে পাব। ও নিশ্চয়ই মত পালটাবে।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, সত্যি, তুমি খুব পালটে গেছ।

মানে? অনিমেষ তাকাল।

শান্তিনিকেতনের ওই রাতের পর যে তুমি স্বচ্ছন্দে আমার কথা ভুলে যেতে পেরেছিলে, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বিন্দুমাত্র দুর্বল হওনি, সেই তুমি ছেলে ফিরে যাবে শোনার পরেও ভাবছ আমাদের ছেড়ে ও যাবে না। পালটে যাওনি, বলো?

লতা, ও চলে গেলে কি তোমার ভাল লাগবে?

আমি এসব নিয়ে আর ভাবি না।

সে কী?

জীবনে দুবার প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিলাম। এক, লালবাজারের পুলিশ যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা দেখেও জামাকাপড় খুলে অত্যাচার করেছিল, দুই, জেল থেকে বেরিয়ে যখন শুনলে আমি সন্তানের মা তখন অদ্ভুতভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে। মাধবীলতা শ্বাস ফেলল।

লতা, আমি তো অনেকবার বলেছি, কথাটা বলা ভুল হয়েছিল!

যখন মনে পড়ে তখন খারাপ লাগাটা ঘিরে ধরে। হ্যাঁ, তারপর এই এতগুলো বছর, প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমরা একসঙ্গে আছি। তুমি যে অসাধারণ থেকে ক্রমশ সাধারণ বাবা এবং স্বামীতে চলে এলে তা দেখে, বিশ্বাস করো, স্বস্তি পেয়েছি। গোটা জীবন ঘরের মধ্যে বাস করতে কোনও মেয়ে চায় না। তার চেয়ে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমের দুপুর, সেও ভাল। আমি সব মেনে নিয়েছি। তোমার পাশে আছি। কিন্তু জোর করে দুঃখে জড়াতে চাই না। মাধবীলতা বলল।
 
বাড়িতে ঢোকামাত্র ওরা দেখল আলো জ্বালিয়ে বারান্দায় মোড়ার ওপর চুপচাপ বসে আছে ছোটমা। চারদিক শব্দহীন। মাধবীলতা সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এভাবে বসে আছেন?

তোমাদের ছেলে চলেই গেল। কান্না ছোটমার গলায়। মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল।

ছোটমার মোড়ার পাশে মেঝের ওপর বসে পড়ল মাধবীলতা। তারপর নিচু গলায় বলল, যে যাওয়ার সে যাক না।

এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা। মাধবীলতা তাঁর হাত ধরল, কাঁদবেন না।

তুমি বুঝবে না, বুঝবে না।

আপনি বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝব।

আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম দ্বিতীয়পক্ষ হয়ে। এসে দেখলাম স্বামী তার মৃত স্ত্রীর কথা একটুও ভুলতে পারছেন না। মদ খাচ্ছেন, অদ্ভুত আচরণ করছেন। আমাকে বিয়ে করেছেন অথচ–। তোমাকে কী বলব–। আবার কাঁদলেন ছোটমা। অনিমেষ ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে গেল।

বিয়ের আগে আমি যা ছিলাম বিয়ের পরেও তাই থেকে গেলাম। এমনকী অনিও প্রথম কয়েক বছর আমার সঙ্গে সহজ ছিল না। কিন্তু আমি জেদ ধরলাম। নাই বা হল আমার সন্তান, তবু এই পরিবারকে আমি নিজের করে নেবই। একদিন বড়দি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমার সন্তান হচ্ছে না কেন? আমি তাকে সত্যি কথা বলতে পারিনি। উনি ভেবে নিয়েছিলেন আমার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব নয় বলেই হতে পারছি না। বলেছিলেন, তার ভাইকে বলতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার কথা ওঁকে বলতে পারিনি। এবার মাধবীলতার হাত জড়িয়ে ধরলেন ছোটমা, আমি এই পরিবারে আসার পর অনি কলকাতায় পড়তে চলে গেল। ওর বাবা-দাদু খুব আশা করেছিলেন। পড়া শেষ করে এখানেই ফিরে আসবে। কিন্তু সে এল না। তারপর একে একে ওর ঠাকুরদা বাবা বড়পিসিমা আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। কেন? কেন আমি পড়ে রইলাম, আর ওঁরা। ঠোঁট কামড়ে কান্না গিলতে চাইলেন ছোটমা। তার রুগণ শরীর কেঁপে উঠছিল বারংবার।

এসব কথা আজ, এতদিন পরে কেন মনে এল? মাধবীলতা বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরতেই তিনি তার কাঁধে মাথা রাখলেন। মাধবীলতা অনুভব করল তার শরীরে ওঁর কাপুনি ছড়িয়ে পড়ছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছিল ছোটমার। তারপর একটু শান্ত হলে ছোটমা বললেন, আজ মনে হচ্ছে, সত্যি আমি অপয়া।

ছিঃ। এমন কথা বলবেন না। কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ এ কথা বলে।

কেন মনে করব না বলো? আজ অর্কও চলে গেল। সোজা হলেন বৃদ্ধা।

কলকাতায় ওর কাজ আছে তাই গিয়েছে।

যাওয়ার আগে বলে গেল, আপনি কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান। এই বাড়ি যদি বিক্রি না হয় তা হলে পুরোটাই ভাড়া দিয়ে দিন। সেই টাকায় দিব্যি থাকা যাবে বৃদ্ধাশ্রমে। আমি বললাম, আমি তা হলে এতদিন এই বাড়ি আগলে রাখলাম কেন? সে জবাব না দিয়ে হেসে চলে গেল। এই যাওয়াটাকেও আমাকে দেখতে হল। ছোটমা এবার আঁচলে চোখ মুছলেন।

আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার আজ মনে হচ্ছে আমরা কোথাও ভুল করেছিলাম। মাধবীলতার গলা ধরে এল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দুজন হাতে হাত রেখে। অন্ধকার আকাশে এখন ফিকে আলো। হয়তো অনেক পরে চাঁদ উঠবে।

ছোটমা বললেন, আচ্ছা মাধবীলতা, তুমি তো এতটা কাল অনিকে আগলে রাখলে, তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কি কোনও সম্পর্কই নেই?

শ্বাস ফেলল মাধবীলতা, আমি খবর রাখতাম। কিন্তু বাবা আমাকে মেনে নিতে পারেননি। মা আগেই গিয়েছিলেন।

তুমি জানতে?

হ্যাঁ। এ কথাগুলো আপনার ছেলেকেও বলিনি। আমাকে একজন খবর দিতে ছুটে গিয়েছিলাম শ্মশানে। আমাকে দেখে বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। তখন মনে হল থাকলে উনি আরও অসন্তুষ্ট হবেন। তার কয়েক বছর পরে বাবার চলে যাওয়ার খবর পেয়েছিলাম।

তোমার বাবা-মা সম্পর্কে অনি কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাধবীলতা বলল, ও অত বাস্তববাদী নয়।

তা অবশ্য। নইলে ঠাকুরদা, বাবার কথা বাদ দিলাম, যে বড়পিসিমার ও প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল, পেটে না ধরেও যিনি নিজেকে ওর মা ভাবতেন, তাঁর সম্পর্কে ও উদাসীন হয়ে থাকত না। এবার মাধবীলতার মাথায় হাত বোলালেন ছোটমা, তুমি অনিকে খুব ভালবাসো, তাই না?

মাথা নাড়ল মাধবীলতা, জানি না, বিশ্বাস করুন।

এইভাবে জীবনটা কাটিয়ে এখন কি আফশোস হয়?

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল মাধবীলতা, সবার তো সব হয় না।

যাও, ওঠো। অনিকে চা করে দাও। ছোটমা বললেন।

গলার কাছে একটা ভারী কিছু এসে ঠেকেছিল, শ্বাস ফেলল মাধবীলতা, আপনার জন্যও করি?

আলাদা করে করতে হবে না। আমার রান্নাঘরে দুকাপ চা বানিয়েছিলাম। এক কাপ অর্ক খেয়ে গেছে, আমারটা খাওয়া হয়নি। ওটাই গরম করে দাও। ছোটমা বললেন।
 
হেসে ফেলল মাধবীলতা। তারপর উঠে ঘরে গিয়ে দেখল অনিমেষ চুপচাপ শুয়ে আছে। সে কোনও কথা না বলে শাড়ি পালটে তিন কাপ চা তৈরি করে এককাপ অনিমেষকে দিয়ে বাকি দুকাপ নিয়ে ছোটমার পাশে এসে বসল, নিন।

তুমি আবার মেঝেতে বসলে কেন?

এখানে বসতে ভাল লাগছে। আপনি অর্ককে চা করে দিলেন?

আমার খেয়াল ছিল না। ও খেতে চাইল।

অদ্ভুত। মাধবীলতা চাপা স্বরে বলল, একটা কথা রাখবেন?

বলো।

শ্বশুরমশাইয়ের ইচ্ছেটাকে মেনে নিন।

তার মানে?

উনি তো উইল করে বাড়িটা আপনাকে দিয়ে গেছেন–।

একটু চুপ করে থেকে ছোটমা বললেন, সেই উইলের দুটো কপি তো ঘেঁড়া হয়ে গেছে।

দেখুন, এই বাড়ি নিয়ে যা সমস্যা হচ্ছে, মানে অর্ক বা আপনার অনিকে দেওয়া নিয়ে, তার সমাধান হতে অনেক সময় লাগবে। আমরা উকিলবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, চেষ্টা করলে তিনি শ্বশুরমশাইয়ের উইলটার আর একটা কপি উদ্ধার করতে পারবেন। আপনার আপত্তি না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির সমস্যা মিটে যাবে। তারপর আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন, আমি কোনও কথা বলব না।

মাধবীলতা বলতেই ছোটমা হেসে ফেললেন, তুমি, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।

এই সময় মোবাইলের রিং শোনা গেল। তারপর চুপচাপ। একটু পরে অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে বেরিয়ে এল বারান্দায়, শোনো, দেবেশ ফোন করছে। বলছে কবে ওর ওখানে যাবে? সবাইকে নিয়ে যেতে বলছে।

দেবেশ কে? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

ওর ছেলেবেলার বন্ধু। কাছাকাছি কোথাও নাকি আশ্রম করেছে। চলুন, সবাই মিলে একবার বেড়িয়ে আসি। মাধবীলতা বলল।

.

সাতসকালে একটা লোক সাইকেলে চেপে চলে এল বাগানের ধারে, এসে গলা চড়িয়ে বলল, এখানে অনিমেষবাবু থাকেন?

মাধবীলতা সেইমাত্র বাসি কাপড় বালতির জলে ডুবিয়ে পরিষ্কার হয়ে বাথরুমের বাইরে পা রেখেছিল, অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, থাকেন। কী ব্যাপার?

লোকটা সাইকেলে বসেই বলল, এস পি সাহেব ওঁকে এখনই ডেকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, দেরি যেন না করেন। কোনও কারণে এখন যেতে না পারলে রাত দশটা নাগাদ যেতে পারেন। আচ্ছা! লোকটা সাইকেল ঘোরাচ্ছিল।

দাঁড়ান। এস পি মানে পুলিশের–।

হ্যাঁ। কাছারির দিকে গেলে ওঁর বাংলো দেখতে পাবেন। আশ্চর্য, জলপাইগুড়িতে থাকেন আর এস পি-র মানে জানেন না! সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে লোকটা চোখের আড়ালে চলে গেল।

ছোটমা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। অর্কর সঙ্গে কারও কোনও ঝামেলা হল নাকি?

কী হয়েছে বলবে তো?

এস পি, পুলিশের বড়কর্তা ওকে এখনই দেখা করতে বলেছেন।

সর্বনাশ। পুলিশে ছুঁলে কী হয় তা তো তুমি জানো।

কিন্তু ওকে কি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে? কদিন থেকে মনে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। এখানে এসে ওর কথাবার্তার ধরন সেটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথা নাড়ল মাধবীলতা, জানি না, ভবিষ্যতে আর কী দেখব। ওকে বলি গিয়ে, যায় তো যাবে।

এখনও এই বয়সে অনিমেষের ঘুমাবার সময় শরীরে শিশুসুলভ ভঙ্গি তৈরি হয় যা দেখলে ডাকতে ইচ্ছে করে না মাধবীলতার। তবু আজ ওকে ডেকে তুলতে হল। ক্রাচ এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

কেন? এখন কটা বাজে? বিরক্ত হল অনিমেষ।

তোমাকে শহরের এস পি সাহেব এখনই দেখা করতে বলেছেন।

মানে? কোনও মানে জানি না। আরদালি গোছের একটা লোক বাড়িতে এসে তাই বলে গেল। এখন যেতে না পারলে রাত দশটার পর যেতে হবে। সে সময় বাড়ির বাইরে যাওয়া উচিত হবে না।

কিন্তু পুলিশ সুপার আমাকে কেন ডাকবেন?

তার উত্তর আমি কী করে দেব বলো? শুধু ভয় হচ্ছে, অর্ক কিছু করেনি তো! যে লোকটাকে ও আশ্রয় দিয়েছে সে কে? অপরাধ জীবনের সঙ্গে যুক্ত কোনও লোক? না, সেটা জেনে ও থাকতে দেবে না বলে এখনও বিশ্বাস করি। যাক গে, গিয়ে শুনে এসো।

বিছানা থেকে নামতে এখনও একটু অসুবিধে হয়। নেমে ক্রাচে ভর করে সোজা হয়ে অনিমেষ বলল, তুমিও তৈরি হয়ে নাও।

উনি তোমাকে ডেকেছেন। আমাকে নয়।

বেশ। তুমি বাইরে অপেক্ষা করতে পারো, আমি ভেতরে গিয়ে কথা বলব।
 
অনিমেষ বাথরুমের দিকে চলে গেলে মাধবীলতা উঠল। একটা পরিষ্কার কাপড় হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের মুখটাকে এই সকালে দেখল। অভ্যেসের দৈনিক চুল আঁচড়ানোর সময় আয়নার সামনে দাঁড়ানো থেকে আজ একটু আলাদা হয়ে নিজেকে দেখল। না, এখন চুলে ঈষৎ রুপোর ছোঁয়া লাগলেও কালোর আধিক্য আছে। কিন্তু চোখের তলায়, কপালের রেখায় আর গলার ভাঁজে সময়ের হাতুড়ি বেশ সক্রিয়। নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মাধবীলতা। না, এখনও তার চিবুক এবং হাসিকে বয়স দখল করতে পারেনি। সে চুল আঁচড়ে নিল।

অনিমেষ ঘরে ঢুকে বলল, এ কী! এখনও তুমি এখানে?

নিজেকে দেখছিলাম। তোমার চেহারা যতটা বদলেছে আমারটা তত হয়নি।

কী আশ্চর্য। কত যুগ পরে দেখে দেবেশ একবারেই চিনতে পারল। চুল

হয় সাদা হয়ে গেছে। যাক গে, যাওয়ার আগে এককাপ চা হবে?

নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু ছোটমা তো ঠাকুরঘর থেকে বের হওয়ার পর চা খান। ততক্ষণে আমরা ফিরে আসব। চলো, আজকে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ভাঁড়ের চা খাই। বেশ লাগবে।

এখানে কি কলকাতার মতো দুহাত দূরে দূরে ওই দোকান আছে? আচ্ছা। তাড়াতাড়ি তৈরি হও।

বলা না থাকায় এই সকালে লছমনকে পাওয়া যাবে না। ওরা মিনিট দশেক মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে রিকশা পেল। অনিমেষ লক্ষ করছিল ক্লাবের ছেলেদের দুজন কয়লার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। একজন হঠাৎ হাত নাড়ল। অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে নিল।

এস পি-র বাংলোর গেটে রিকশা আটকে দিল পাহারাদার। অনিমেষ তাকে বলল, এস পি সাহেব আমাদের দেখা করতে বলেছেন।

লোকটি বলল, এখন ভিজিটার্সদের সঙ্গে উনি দেখা করেন না। দশটার পরে আসুন। রিকশাওয়ালা বলল, বাবু, আমাকে ছেড়ে দিন।

ভাড়া মিটিয়ে দিল মাধবীলতা। এই এলাকাটায় মানুষের বসতি বলতে কয়েকটি সরকারি বাংলো। ওরা কী করবে বুঝতে পারছিল না।

অনিমেষ বলল, রিকশা পাওয়া মুশকিল হবে। চলো ফিরে যাই। পরে জানতে চাইলে বলব আপনার গার্ডই ঢুকতে দেয়নি। ওদের রিকশাওয়ালা রিকশা ঘোরাচ্ছিল, তাকে দাঁড়াতে বলল সে।

কথাগুলো গার্ডের কানে গিয়েছিল। সে চেঁচিয়ে ডাকল, আবদুলভাই। বাগানের ওপাশ থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে চিনতে পারল মাধবীলতা। সে গলা তুলে বলল, আপনি খবর দিয়েছিলেন তাই এসেছিলাম।

আবদুল নামক ব্যক্তিটি বলল, গেট খুলে দে। সাহেব ওঁদের ডেকেছেন। আসুন আপনারা আমার সঙ্গে।

অনেকটা হেঁটে ব্রিটিশ আমলের বিশাল বাংলো বাড়ির একতলার ঘরে তাদের বসতে বলে আবদুল ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাউকে বলল, সাহেব যাঁকে আসতে বলেছেন তিনি এসেছেন। তারপর সে বাইরে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে একজন ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, অনিমেষ মিত্র?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনি আসুন।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে যেতে বলল। বাংলোর পেছনের নেট-ঘেরা বারান্দায় মধ্যবয়সি ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। অনিমেষকে আসতে দেখে হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার। সরি, আমি জানতাম না আপনাকে ক্রাচের ওপর নির্ভর করে হাঁটতে হয়। আসতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হল। বসুন।

সুন্দর বেতের চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে উলটোদিকে বসলেন ভদ্রলোক।

অনিমেষ ক্রাচ দুটো চেয়ারের পাশে রেখে বলল, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কেন ডেকে পাঠালেন।

আমরা মানে?

আমার স্ত্রীও সঙ্গে এসেছেন।

সে কী! ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। এই প্রথম স্বস্তি পেল অনিমেষ। আর যাই হোক, অর্কর জন্য তাকে ডেকে পাঠাননি ইনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাধবীলতাকে নিয়ে ফিরে এসে ভদ্রলোক বললেন, ছি ছি। এরা আমাকে বলেইনি যে আপনিও ওঁর সঙ্গে এসেছেন। বসুন। আমি পঙ্কজ দত্ত। এস পি-র চাকরি করি। কী খাবেন? চা না শরবত?

মাধবীলতা হাসল, আপনার লোক এমন তাড়া দিয়েছে যে ভেবেছিলাম রাস্তায় চা খেয়ে নেব। কিন্তু এই এলাকায় কোনও চায়ের দোকান দেখতে পেলাম না। ও বলল এটা নাকি সাহেবপাড়া ছিল। চা–।

চায়ের হুকুম দিয়ে পঙ্কজ বললেন, এবার বলুন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী বলব?

সে কী! আমার বস কাল রাত্রে টেলিফোনে বললেন যে আপনারা খুব বিপদে পড়েছেন। ওঁর বন্ধু, এখানকার বিখ্যাত ল-ইয়ার মিস্টার রায় ফোনে ওঁকে জানিয়েছেন। তারপরে আমি মিস্টার রায়কে ফোন করে কিছুটা জেনে নিয়েছি। বাকিটা আপনার মুখে শুনতে চাই। পঙ্কজ দত্ত ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন।

অনিমেষ সমস্ত ঘটনাটা ওঁকে জানাল।
 
একটু চুপ করে থাকলেন পঙ্কজ দত্ত। ইতিমধ্যে চা এবং বিস্কুট এসে গেল। পঙ্কজ নিজে মাধবীলতার হাতে কাপ প্লেট তুলে দিয়ে বলল, আপনাদের এত সকালে আসতে বলার কারণ ছিল। আমি চাইনি আপনারা যে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন তা সবাই জানুক। নিন, চা খান।

চায়ে চুমুক দিয়ে মাধবীলতা বলল, আমরা এখন কী করব?

আপনাদের তো কিছু করার নেই। নৃপেনবাবুরা হাত গুটিয়েই থাকবেন। থানায় গিয়ে যদি বলেন ক্লাবের ছেলেরা আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে তা হলে আপনারা বাড়িতে ফেরার আগেই ওদের কাছে খবর পৌঁছে যাবে।

কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপচাপ। হঠাৎ মাধবীলতার মনে কথাটা আসায় জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আমরা আদালতে গেলে কি কোনও সুরাহা হবে?

হেসে নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন পঙ্কজ দত্ত, তা হলে তো মিস্টার রায় পরামর্শটা দিতেন। আদালতে গিয়ে আপনারা কীভাবে প্রমাণ করবেন ওই ছেলেরা হুমকি দিচ্ছে, ভাড়াটেকে শাসাচ্ছে? কোনও লিখিত বা রেকর্ডের প্রমাণ নেই। তা ছাড়া কেস লড়বার জন্যে কোনও উকিল এগিয়ে আসবেন কিনা সন্দেহ।

অনিমেষ বলল, ভাড়াটে মানে, নিবারণবাবু তো সত্যি কথা বলবেন।

না। বলবেন না। চাপে পড়ে উনি বিচারককে বলতে পারেন তাঁর কাছে কেউ যায়নি। এরকম কোনও ঘটনার কথা তিনি জানেন না। সোজা হয়ে বসে ঘড়ি দেখলেন পঙ্কজ দত্ত, আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আচ্ছা, অনিমেষবাবু, আপনারা তো কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ।

কী প্রফেশনে ছিলেন?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, আমি শিক্ষকতা করতাম। এখন অবসরে। আর ওর পায়ের অবস্থার কারণে–।

মাথা নাড়লেন পঙ্কজ দত্ত, আপনার সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের আর সম্পর্ক নেই?

না। পরিষ্কার বলল অনিমেষ।

কিছু মনে করবেন না, মাওবাদীদের কেউ যোগাযোগ করেনি?

অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

কারণ মাওবাদীদের শুভানুধ্যায়ীরা কলকাতায় আছেন। তাঁদের কেউ সমাজসেবী, কেউ ডাক্তার, আবার কেউ প্রাক্তন নকশাল।

না। আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। তা ছাড়া আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওদের ব্যাপারে। অনিমেষ বলল।

ঠিক আছে। আমার এই কার্ডটা রাখুন। খুব জরুরি দরকার হলে ফোন করবেন। আচ্ছা, নমস্কার। পঙ্কজ দত্ত উঠে দাঁড়ালেন, আপনারা বাংলোর সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে যেতে পারবেন। কষ্ট করে তিস্তার বাঁধে উঠতে হবে। অনিমেষবাবু কি পারবেন?

চেষ্টা করব। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

আবার বলছি, আমার কাছে আপনারা এসেছেন তা গোপন রাখার জন্যই এভাবে যেতে বলছি। পঙ্কজ দত্ত একজন পরিচারককে বললেন, ওঁদের বাঁধে তুলে দিয়ে এসো।

পেছনে এক চিলতে বাগান, যার পরে উঁচু তারের বেড়া। বেড়ার মাঝখানে। একটা শক্ত কাঠের দরজা। লোকটি ওদের নিয়ে এসে দরজা খুলে বলল, সামনেই বাঁধ। বাঁ দিকে গেলে জেলাস্কুল, ডানদিকে জুবিলি পার্ক। ওই ধাপে পা ফেলে উঠলে সুবিধে হবে।
 
বাঁধ কেটে সিঁড়ির মতো করে রাখা হয়েছে বলে অনিমেষ ওপরে উঠতে পারল। সামনেই তিস্তার চর ধু ধু করছে। বালির ওপর বেশ মজবুত ঘরবাড়ি শুধু নয়, চাষ আবাদও শুরু হয়েছে। অনিমেষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। মাধবীলতা পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী দেখছ?

যখন স্কুলে পড়তাম তখন বর্ষার সময়ে তিস্তার ঢেউ এই বাঁধে ছোবল মারত। এখন কোথাও তো জল দেখতে পাচ্ছি না। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা বলল, ওই ওপাশে, অনেক দূরে বোধহয় জল আছে, চিকচিক করছে। তিস্তায় বোধহয় বর্ষাতেও বেশি জল বয়ে যায় না, নইলে এই এত বাড়িঘর করে মানুষ থাকতে পারত না।

অনিমেষ বলল, সবকিছু কীভাবে বদলে গেল। চারপাশে তাকাল মাধবীলতা, এখানে তো রিকশা পাওয়া যাবে না। ওদিকে বলল কী একটা পার্ক আছে, ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে।

দূর! তার চেয়ে চলো বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাই।

কতটা দূর?

খুব বেশি নয়।

পারবে?

অনিমেষ হেসে ফেলল, ঠিক তো, সেই আমি আর নেই আমি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি। চলো।

ওরা ধীরে ধীরে বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ডানদিকে তিস্তার শুকনো চর, বাঁ দিকে বিশাল বাগানঘেরা ব্রিটিশদের তৈরি সরকারি বড়কর্তাদের বাংলো। প্রচুর পাখি ডাকছে সেইসব বাগানে।

অসুবিধে হলে বলবে। মাধবীলতা বলল।

কী করবে? অনিমেষ তাকাল।

তা হলে এই বাঁধের ওপর বসে জিরিয়ে নিতে পারবে।

ঠিক আছে। অনিমেষ বলল, আচ্ছা, এই ভদ্রলোক কি সত্যি পুলিশ? মাধবীলতা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এত ভদ্র, সুন্দর ব্যবহার কোনও পুলিশ অফিসার করতে পারেন তা আমার ধারণায় ছিল না। বোধহয় এখন শিক্ষিত ভদ্র ছেলেরা পুলিশে আসছে। অন্তত আই পি এস-এ।

হয়তো। কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। অনিমেষ বলল, কোনওভাবেই তো উনি উৎসাহিত করলেন না। এমনকী সবার চোখের সামনে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেও চাননি। হয়তো ভয় পেয়েছেন। মন্ত্রীদের কাছে খবর গেলে পঙ্কজবাবুকে বিপদে পড়তে হবে। কী করা যায়? পুলিশ কিছু করবে না, আদালতে গেলে সাক্ষী পাব না, পাড়ায় মানুষ পাশে দাঁড়াবে না। যেভাবে আছে সেভাবেই পড়ে থাক বাড়িটা।

কিন্তু একটা কথা পঙ্কজবাবু বলেছেন, আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দিন। কেন বললেন? নিশ্চয়ই ওঁর মাথায় কিছু আছে। মাধবীলতা কথা শেষ করামাত্র তার মোবাইল ফোন বেজেই থেমে গেল। মিস কল দিয়েছে কেউ। ব্যাগ থেকে সেটা বের করে দেখল মাধবীলতা। নাম্বারটা একদম অজানা।

.
 
জলপাইগুড়ি-নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় সুস্থভাবে পৌঁছাতে হলে অনেক আগে রিজার্ভেশন কাউন্টারে দাঁড়াতে হয়। যাওয়ার দিনে স্টেশনে গিয়ে যে কয়েকজন যাত্রী ঠিকঠাক দাম দিয়ে শোওয়ার জায়গা পেয়ে যান তাদের পেছনে দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের হাত থাকে।

মাস খানেক আগে অগ্রিম টিকিট কেনা যাত্রীরা ওয়েটিং লিস্টের নাম্বার সম্বল করে ট্রেনের কামরার সামনে ভিড় করতে পারেন কিন্তু রেলের পরিভাষায় আর এ পি-তে উন্নীত না হলে ভেতরে পা রাখতে পারবেন না। জলপাইগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে অর্ক বুঝতে পারল, সংরক্ষিত কামরায় শুয়ে কলকাতায় যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই তার নেই।

প্ল্যাটফর্মে দালাল ঘুরছিল। কোনও রেলকর্মীর পকেট ভারী করে জায়গা পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব তারা দিচ্ছে না। আজ নাকি সংরক্ষিত কামরার একটি বার্থও খালি না থাকায় কনডাক্টর গার্ডদের কিছু করার নেই। একজন বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে দালালকে সাহায্য করতে বললে সে জানাল, কোনও চিন্তা নেই। দিদিমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলুন। আপনি আমার সঙ্গে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একেবারে কনফার্মড টিকিট নিয়ে আসবেন।

স্টেশনের বাইরে কেন? বৃদ্ধ হকচকিয়ে গেলেন।

অফিসটা তো ওখানেই। শয়ে শয়ে টিকিট পাবেন। হাতে তো অনেক সময় আছে, ট্রেন ছাড়বে দেড় ঘণ্টা পরে। চলুন। দালাল হাসল।

অর্ক চুপচাপ শুনছিল, জিজ্ঞাসা করল, কত এক্সট্রা নেবে?

টিকিটের দাম আর সার্ভিস চার্জ।

বৃদ্ধ বললেন, আমার তো টিকিট হয়ে গিয়েছে। ওয়েটিং-এ।

রিফান্ড নিয়ে নেবেন কাউন্টার থেকে।

জনা পাঁচেক লোক দালালের অনুগামী হলে অর্ক ওদের অনুসরণ করল। কলকাতা থেকে আসার সময় এসি থ্রি টায়ারে জায়গা না পেয়ে অর্ডিনারি থ্রি টায়ারে উঠে কনডাক্টর গার্ডকে অনুরোধ করেছিল বার্থের জন্যে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, আপনার আগে যারা রিকোয়েস্ট করেছে তাদের সবাইকে দিতে পারব না। আপনি আমার জায়গায় আপাতত বসুন।

সেই আপাতত-র সময়সীমা শেষ হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ওভারব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের বাঁ দিকে গিয়ে রেলের আলোর নীচে টেবিল পেতে দুজনকে বসে থাকতে দেখল ওরা। তাদের আশেপাশে কয়েকজন স্বাস্থ্যবান মানুষ। দালাল বলল, পাঁচজন, হবে?

বসে থাকাদের একজন বলল, হবে। আরও তিনটে আনতে পারিস।

দালাল বলল, আপনারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। জলদি।

বৃদ্ধ অর্কর আগে, লাইনের প্রথমে দাঁড়ালেন, আমাকে দুটো টিকিট, দার্জিলিং মেলের টিকিট তো?

হ্যাঁ দাদু, সাইডের লোয়ার আপার। কী নাম হবে?

এস কে সেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস।

ঠিকানা বলুন। বৃদ্ধ বললেন।

এক হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ করে দুটো টিকিট, মানে একত্রিশ শো দিন।

অ্যাঁ? কোন ক্লাস? এসি টু টায়ার নাকি? আমরা তো সিনিয়ার সিটিজেন।

দাদু, আপনি সিনিয়র সিটিজেনের সুবিধে পাবেন রেলের কাউন্টারে। আমরা এই যে স্পেশ্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি তার জন্যে এত টাকা বেরিয়ে গেছে যে কনসেশান দেওয়া সম্ভব নয়। না যেতে চান, নেক্সট লোককে চান্স দিন।

আমার মেয়ে খুব অসুস্থ! পকেট থেকে পার্স বের করে গুনে গুনে টাকা দিলে লোকটি বলল, একেবারে শেষ দিকে কামরা। দেখবেন লেখা

আছে ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট। লোকটি টিকিট দিল।

বৃদ্ধ সেটাকে লক্ষ করতে লাগলেন, এ তো আমাদের নামে নয়।

নামে কী এসে যায় দাদু। ওটা আমাদের কামরা, কেউ প্রশ্ন করবে না।

এটা কি এসি কামরা?

আশ্চর্য! লোকটা রেগে গেল, আপনি সরে যান তো। ট্যুরিস্ট কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছেন তবু। নেক্সট।

অর্ক টেবিলের সামনে দাঁড়াল।

অর্ডিনারি থ্রি টায়ারের যা ভাড়া তার তিনগুণ নিচ্ছেন কেন?

পুরো কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করতে হয়েছে যে। দিন–।

আপনারা কি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দালাল লাগিয়ে ট্যুরিস্ট ধরে ব্যাবসা করছেন? অর্ক চেঁচিয়ে বলতেই স্বাস্থ্যবান লোকগুলো এগিয়ে এল, একজন চেঁচিয়ে লাইনে দাঁড়ানো লোকদের বলল, এই লোকটা ফালতু ঝামেলা করছে, এর জন্যে আপনাদের টিকিট দেওয়া যাবে না, আপনারা তাই চান?
 
সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিবাদ উঠল, জোর করে সরিয়ে দেওয়া হল অর্ককে। পরের যাত্রীরা এবার টিকিট কিনতে লাগল তৃপ্ত মুখে।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে অর্ক চলে এল স্টেশন মাস্টারের ঘরে। সেখানে তিনি নেই। বেরোতেই রেলের একজন অফিসারকে দেখতে পেয়ে ঘটনাটা জানাল সে। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, আমরা জানি, কিন্তু কিছু করার নেই।

সে কী! ট্রেনের টিকিট চড়া দামে বিক্রি করছে আর আপনি বলছেন কিছু করার নেই। এতে রেলের ক্ষতি হচ্ছে না?

হচ্ছে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে লোক ওয়েটিং লিস্টে থাকছেন কিন্তু আমরা তাদের জায়গা দিতে পারছি না। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

আপনারা অতিরিক্ত কামরার ব্যবস্থা করছেন না কেন?

দেখুন, একটা ট্রেনের বহন ক্ষমতা অনুযায়ী কামরার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এই ট্রেনে সেই সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

তা হলে ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে কামরা দিলেন কেন? ওই জায়গায় স্বচ্ছন্দে আর একটা কামরা দিয়ে ওয়েটিং লিস্টের যাত্রীদের তুলে দিতে পারতেন।

অবশ্যই পারতাম। কিন্তু অনেক ওপরের কর্তাদের হুকুমে ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে কামরা দেওয়া হচ্ছে। ওঁরা পুরো পেমেন্ট দিয়ে কামরা ভাড়া করে নিচ্ছেন। অভিযোগ না এলে ওই কামরায় রেল নাক গলায় না। ধরুন, আপনি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন দশ হাজার টাকায়। আপনি যদি সেই ফ্ল্যাটে গেস্ট রাখেন পার ডে হাজার টাকায় তা হলে বাড়িওয়ালা কী করতে পারে, যদি না সেই গেস্টরা বেআইনি কিছু করেন। এও তেমনি। আপনি কোথায় যাবেন?

কলকাতায়।

ও। আচ্ছা, নমস্কার। ভদ্রলোক চলে গেলেন।

ট্রেনের দিকে তাকাল অর্ক। তারপর হাঁটতে লাগল। তারপর একটা কামরা যার গায়ে কোনও রিজার্ভেশনের নোটিশ নেই, উঠে পড়ল। শোওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই, যাত্রীদের চেহারা দেখে বোঝা যায় বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নীচে আছেন। দু-তিন জন দাঁড়িয়ে আছেন, বাকিরা ঠাসাঠাসি বসে। একেবারে কোনার দিকে একজন মধ্যবয়সের সন্ন্যাসিনী তিনজন শিষ্যকে নিয়ে বসে আছেন। সন্ন্যাসিনীর পাশে ত্রিশূল রাখা। গায়ের রং বেশ ফরসা, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পরনে গেরুয়া কাপড় জামা। কপালে বিশাল টিপ। দুটো চোখে কাজল এমনভাবে টানা যেন দুর্গা ঠাকুরের নয়ন। অর্ক দেখল ওই বেঞ্চিতে আরও একজন স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। সন্ন্যাসিনী বলে কেউ ওদিকে যায়নি।

অর্ক এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বসতে পারি?

তিন শিষ্য নড়ল না। কিন্তু সন্ন্যাসিনী বললেন, ওরে, জায়গা দে, বাছা আমার বসতে চেয়েছে। বসো বসো। কেউ তো বলল না, তুমি মুখ ফুটে চাইলে।

শিষ্যরা এবার নড়েচড়ে বসার জায়গা করে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাওয়ার যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেল। ট্রেন ছাড়ল। অর্ক ভাবছিল মাকে ফোন করে জানাবে কিনা। সে একবার চেষ্টা করে জানল এখন সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক বছর পরে এবার জলপাইগুড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সত্যি কথাগুলো বলতে বাধ্য হল সে। অবশ্য সে যাকে সত্যি ভাবছে ওঁরা তা ভাবছেন না, এটাও স্পষ্ট। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে দেখে এসেছে বাবা শরীরের কারণে কোনও কাজ করছেন না, মায়ের রোজগারে সংসার চলছে। কিন্তু সংসারে বাবার প্রায় সব কথাই মা মেনে চলছেন। তার মনে হয়েছিল, পৃথিবীর অনেক মানুষ বাবার মতো প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কাজকর্ম করছে। পা না থাকা সত্ত্বেও ইংলিশ চ্যানেল পার হচ্ছে। বাবা তার ওই প্রতিবন্ধকতার দোহাই দিয়ে অলস হয়ে থাকলেন এতগুলো বছর। আর মা সেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে এলেন।
 
মা চাকরির শেষে বাবাকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে জলপাইগুড়িতে চলে এলে ছোট ঠাকুরমার উপকার হত। খামোকা কলকাতায় থাকার তো দরকার ছিল না। জলপাইগুড়ির বাড়িতে থাকতে বাবার যে আপত্তি ছিল তার কারণ সে অনুমান করতে পারে। আজ বাড়ি বিক্রি করে ছোট ঠাকুরমার নামে টাকা নিলে সেই টাকা কয়েক বছর পরে অনাথ আশ্রমে দান করে দেবেন না বাবা। তখন ওই আপত্তির কথা কেউ যদি মনে করিয়ে দেয় তা হলে কি অন্যায় হবে? খুব খারাপ লাগছিল অর্কর। কমিউন ভেঙে যাওয়ার পর থানা থেকে বেরিয়ে বহুকাল সে চুপচাপ থেকেছে। পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছে। কারও সঙ্গে আর নিবিড় যোগাযোগ রাখেনি। একটু একটু করে বাবার ওপর অভিমান জমতে শুরু করেছিল কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি।

ট্রেন ছুটছে হু হু করে। চোখ বন্ধ করল অর্ক।

এই যে বাছা, শুকনো মুখে বসে আছ কেন? আমাদের সঙ্গে খাবে এসো। গলা শুনে তাকিয়ে দেখল সন্ন্যাসিনী হাসছেন।

না, ঠিক আছে। অর্ক বলল।

কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তা কি তুমি ঠিক করবে বাছা?

মানে? অর্ক অবাক হল।

এটুকু বুঝলে না। আচ্ছা বলো, এই পৃথিবীতে কি তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেছ?

অর্ক হাসল, না।

সন্ন্যাসিনী বললেন, লোকে বলে অমুক জন্মগ্রহণ করলেন। যেন, যিনি পৃথিবীতে এলেন তিনি স্ব-ইচ্ছায় এলেন। অথচ তা তো নয়। শিশু মায়ের পেট থেকে বের হতে চায় না। মা তাকে জোর করে বের করে দেয়। তাতে সম্ভব না হলে ডাক্তাররা তাকে বের করে নিয়ে আসে। অর্থাৎ মানুষের জন্মটা তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। সারা জীবন সে যা করছে তাও কি তার ওপর নির্ভর করছে? না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সে ঠোক্কর খাবে, আবার চেষ্টা করবে আর এই করতে করতে যখন তার সময় শেষ হয়ে আসবে তখন অতীতের দিকে তাকালে তার দুঃখ হবে, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে ভয় পাবে। আর শরীর ফেলে চলে যাওয়াটাও তো তার ওপর নির্ভর করে না। এমনকী ঠিক কোন সময়টা চলে যাচ্ছে তাও সে অনুভব করতে পারে না। বলো, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক?

মুগ্ধ হয়ে শুনছিল অর্ক। এবার হেসে বলল, দিন, খাব।

এই তো ভাল ছেলের মতো কথা বললো সন্ন্যাসিনী ইশারা করলে একজন শিষ্য ঝোলার ভেতর থেকে কাপড়ে মোড়া সসপ্যান বের করে শালপাতার ওপর রুটি, আলুর তরকারি আর ক্ষীর সাজিয়ে এক এক করে সবাইকে দিল। সন্ন্যাসিনী বললেন, এই আলুর তরকারিতে কিন্তু পেঁয়াজ রসুন নেই।

আপনারা ওসব খান না? অর্ক খাওয়া শুরু করল।

না না। কেন খাব না। নিশ্চয়ই খাই। কিন্তু মাটির নীচে যা ফলে তার সঙ্গে পেঁয়াজ রসুন মেশাই না। ওরাও তো মাটির নীচে জন্ম নেয়। মাছ মাংসের সঙ্গে খাব না কেন? তাই বলে কচুর সঙ্গে খাব না। হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। সন্ন্যাসিনী খাওয়া শুরু করলেন।

বেশ লাগছে। অর্ক বলল। খাওয়া শেষ হলে শিষ্যের এগিয়ে দেওয়া বোতল থেকে জল খেল অর্ক। কিছুক্ষণ পরে সব যখন চুপচাপ, পাশে বসা শিষ্য ফিসফিস করে বলল, এখন আর মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন না।

কেন? উনি কি ঘুমাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

না। এখন উনি উপলব্ধি করবেন। শিষ্যটি বলল।

কীসের উপলব্ধি?

আত্ম-উপলব্ধি। আপনি ওটা বুঝবেন না।

অর্ক দেখল সন্ন্যাসিনী একটা গেরুয়া ওড়নায় নিজের মাথা মুখ ঢেকে নিলেন। মনে মনে হাসল অর্ক। সবার সামনে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর বদলে মাথা মুখ ঢেকে একটা বাহানা করে ঘুমানোটা ঢের সহজ।
 
ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম আসছিল অর্কর। পরের স্টেশনে টিকিট চেকার উঠলেন। অর্ক দেখল অনেকেই টিকিট দেখাচ্ছেন, যারা দেখাতে পারছে না তাদের সঙ্গে কথা বলছিল চেকারের সঙ্গে আসা সিঁড়িঙ্গে চেহারার একজন। দরাদরি করে লোকটা টাকা আদায় করছিল। চেকার নির্বিকার। ওসব তার চোখেই পড়ছিল না।

এগোতে এগোতে অর্কর সামনে চলে এসেছিলেন চেকার। অর্ক তাকে ইশারায় কাছে ডাকতেই তিনি বললেন, আরে না না। টিকিট না থাকলে কেন্টুর সঙ্গে কথা বলুন।

পকেট থেকে জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কেনা অসংরক্ষিত ক্লাসের টিকিট বের করে দেখাল অর্ক। সঙ্গে সঙ্গে চেকারের মুখ বিকৃত হল। তিনি উলটোদিকের লোকটির টিকিট দেখতে চাইলে অর্ক বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

বলুন। চেকার ফিরে দাঁড়ালেন।

ট্রেনের ভাড়া মন্ত্রী বাড়াচ্ছেন নাকি? না না, কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না।

তা হলে ভারতীয় রেলওয়ের বিপুল খরচ কীভাবে মিটবে?

চলে তো যাচ্ছে।

যাচ্ছে না। খোঁড়াচ্ছে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো। এই যে গোটা ভারত জুড়ে ট্রেন লাইন, তাতে কত মেল, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছুটছে প্রতি মিনিটে, তাতে কত টিকিট চেকার কাজ করে মাইনে নিচ্ছেন?

চেকারের চোখ ছোট হল, আপনার কথার মানে বুঝলাম না।

সংখ্যাটা কত তা জানেন?

না।

অন্তত হাজার আষ্টেক? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বললাম তো আমি জানি না। চেকার রেগে গেলেন।

ধরে নিলাম আট হাজার। ধরে নিচ্ছি তাদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ আপনার মতো কেন্দ্রবাবুদের পেছনে নিয়ে টিকিট চেক করতে ট্রেনে ওঠেন না। আচ্ছা, প্রতিদিন কেন্টুবাবুরা যা সংগ্রহ করেন তাকে দুহাজার দিয়ে গুণ করলে যে টাকাটা পাওয়া যায় তাকে তিনশো পঁয়ষট্টি দিয়ে গুণ করলে তো মাথা ঘুরে যাবে। সেই টাকা যদি রেলমন্ত্রী হাতে পেতেন তা হলে ভারতীয় রেলের কী বিপুল উপকার হত বলুন তো? ভাড়া বাড়ানোর দরকারই হত না। অর্ক শান্ত গলায় বলল।

জ্ঞান দেবেন না, জ্ঞান দেবেন না। চেকার ফিরলেন।

এবার সন্ন্যাসিনী মুখের আড়াল সরালেন, আমাদের টিকিট দেখবেন না?

সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আমি টিকিট চাই না। চেকার ট্রেনের অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় কেন্টুকে ইশারা করলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে।

মালদা স্টেশনে নেমে গেলেন ভদ্রলোক সঙ্গীকে নিয়ে।

সন্ন্যাসিনী একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি বসে ঘুমাতে পারো না বাছা?

না।

ভাবো তো কোন প্রাণী সারাজীবন দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। কে বলো তো?

ঘোড়ার কথা বলছেন।

বাঃ। এ বাছা তো অনেক খবর রাখে। কলকাতায় যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

সংসার করোনি?

কী করে মনে হল?

মুখ দেখলেই তো বোঝা যায়।

আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

বোলপুরে নামব। নেমে ট্রেন ধরব।

এক শিষ্য বলল, মা, ফাস্ট বাস ধরলে ভাল হয়।

বেশ তো। বাসেই উঠব। ওদিকে গেলে দেখা করে যেয়ো। যদি কষ্ট করে থাকতে পারো তা হলে শেষ পর্যন্ত ভাল লাগবে।

জায়গাটা কোথায়?

পাশে বসা শিষ্যটি বুঝিয়ে দিল অর্ককে। জানাল তাদের আশ্রমের সামনে অজয় নদ।

ভোররাতের আগেই ওঁরা নেমে গেলেন। নামার সময় সন্ন্যাসিনী অর্কর কাঁধে হাত রাখলেন, মন যা চাইবে তাই করবে। যদি ভুল হয় হবে। বুঝলে বাছা। তোমাকে আমার মনে থাকবে।

অর্কর মহিলাকে ভাল লাগল।

শেয়ালদা থেকে উত্তর কলকাতার শেষপ্রান্তে আগে ট্রামেই আসা যেত। এখন ট্রাম চলছে না। মোড়ে বাস থেকে নেমে পাড়ায় ঢুকল সে। বস্তির মুখে আসতেই বিশ্বজিৎকে দেখতে পেল অর্ক। তাকে দেখে হাত তুলে দাঁড়াতে বলছে। অর্ক দাঁড়াল। বিশ্বজিৎ কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বাইরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। কেন বলো তো?

আপনার মা-বাবা তো জলপাইগুড়িতে গিয়েছেন। পরশু সন্ধে থেকে আপনিও বাড়িতে ছিলেন না। অথচ একজন অবাঙালি ভদ্রলোক আপনাদের বাড়িতে যে একা থাকবেন তা পাড়ার কাউকে বলে যাননি। ফলে সবাই টেনশন করছিল। তবে আপনার সঙ্গে আগে ওঁকে দেখা গিয়েছে বলে কেউ কিছু বলেনি। বিশ্বজিৎ বলল।

আশ্চর্য। আমার কোনও গেস্ট বাড়িতে থাকতে পারে না?

নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু আপনার গেস্ট বাংলা বলতে পারেন না। কেউ কেউ প্রচার করছে উগ্রপন্থীরা নাকি কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। যাক আপনি এসে গেছেন, আর সমস্যা নেই। বিশ্বজিৎ চলে গেল।

একটু অবাক হল অর্ক। বিশ্বজিৎ সিপিএম করে না, আগে কংগ্রেসি ছিল, এখন কি তৃণমূলে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top