What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

দরজা বন্ধ। কড়া নাড়তেই শব্দ ছড়াল। সেকেন্ড দশেকে পৃথিবীর কেউ কেউ একশো মিটার দৌড়ে যায়, কিন্তু দরজা খুলল না। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তেই পেছন থেকে এক বিধবা বুড়ি বলল, চোরের মতন থাকে, সহজে সাড়া দেয় না।

এই বুড়ি বৃষ্টি না হলে গলির পাশে দরজার গায়ে বসে থাকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। কে যাচ্ছে, কে আসছে তা নাকি শকুনের মতো খুঁটিয়ে দেখে। এক রাত্রে কাজ থেকে ফিরছিল অর্ক, বস্তির একটি যুবতী বউ তার কিছুটা সামনে হেঁটে এখান দিয়ে ফিরছিল। বুড়ি ডাকল, ও বউ! যখন বেরোস তখন তো পাই না। ফেরার সময় এত ফুলের বাস ছড়িয়ে কোত্থেকে ফিরিস?

বউটি থমকাল, উঃ, সব গেছে কিন্তু নাক আর চোখ গেল না। মরলে বস্তির লোক বেঁচে যাবে। বউটি চলে গেলে বুড়ি অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল, সত্যি কথা আজকাল কারও ভাল লাগে না। অর্ক জবাব দেয়নি। দরজা খুলল রামজি, খুলে অর্ককে দেখে হেসে হিন্দিতে বলল, সরি, ল্যাট্রিনে ছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?

দরজা বন্ধ করে উঠোনে দাঁড়িয়ে অর্ক বলল, ওখানে তেমন কোনও কাজ ছিল না। আপনি কেমন ছিলেন? অসুবিধে হয়নি তো?

হাসলেন রামজি, তেমন কিছু নয়। যা হয়েছে তা স্বাভাবিক। চা বানাই?

মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকে গেল অর্ক। চারপাশে তাকিয়ে খুশি হল সে। মা বাড়িতে থাকতেও এই ঘর এত গোছানো থাকত না। রামজির রুচি খুবই ভাল।

বাড়িতে যেহেতু কোনও মহিলা নেই তাই রামজি বারমুডা আর গেঞ্জি পরে থাকে। প্রথম দিনেই সে অর্কর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিল। ওর সঙ্গে কথা বলতে হলে হয় হিন্দি নয় ইংরেজি বলতে হয়। অর্ক হিন্দিতে স্বচ্ছন্দ নয়, বলার সময় কোনও কোনও শব্দের হিন্দি জানা না থাকায় বাধ্য হয়ে বাংলাটাই বলে। রামজির গুণ হল শব্দ না বুঝলেও প্রশ্ন করে না।

শরীর আরাম চাইছিল। বাথরুমে ঢুকে একেবারে স্নান করে বেরিয়ে এল অর্ক। রামজি দুটো প্লেটে রুটি তরকারি নিয়ে এল। অর্ক খুশি হল, বাঃ, খুব খিদে পেয়েছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।

জলপাইগুড়িতে যাওয়ার আগে সে রামজিকে খাবার বানাতে দেয়নি। সকালে ভাতে-ভাত নিজেই করত। রাত্রের খাবার বেলগাছিয়ার মোড়ের ঠাকুরের দোকান থেকে কিনে আনত। এখন খেতে খেতে বুঝল রামজিরা নিশ্চয়ই মোটা মোটা রুটি খায়। মোটা হলেও সুস্বাদু।

পাড়ার ছেলেরা কিছু বলেছে আপনাকে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। রামজি হাসল, তেমন কিছু না। আমি কে? কোত্থেকে আসছি? আপনার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? এইসব। এই গলিতে যে বুড়ি বসে থাকে সে আমার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলেছে।

কী বলেছে?

আমি ভালমানুষ, বাড়ির ভিতর চুপচাপ থাকি। আমার কাছে এখন পর্যন্ত কোনও লোককে আসতে দিইনি। বস্তির কোনও মেয়ের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাই না। রামজি হাসল।

পাড়ার ছেলেদের কী জবাব দিয়েছেন?

একটু মিথ্যে বলতে হল। আমার ভোটার কার্ডে লেখা আছে আমি বলরাম মাহাতো। তাই বললাম, নাম বলরাম। থাকি হাজারিবাগে। আমার পাশের বাড়ির বাঙালিদাদার অনুরোধে অর্কদাদা থাকতে দিয়েছেন। ওঁরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তেন। আমি এখানে এসেছি চাকরির খোঁজে। ইন্টারভিউ দিয়েই চলে যাব।

রামজি উঠে ঘর থেকে ভোটার কার্ড নিয়ে এসে অর্ককে দিল, এই কার্ড দেখে ওরা আর কোনও প্রশ্ন করেনি। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
 
এ পাড়ার একটি ছেলে যে আগে কংগ্রেস করত এখন তৃণমূলে আছে, আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। অর্ক বলল। রুটি শেষ হলে রামজি রান্নাঘরে গিয়ে চা তৈরি করে নিয়ে এল। চা খেতে খেতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, জীবনদার কাছে গিয়েছিলে?

না। ওঁর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। উনি সন্দেহ করছেন বাড়ির ওপর ওয়াচ রাখা হচ্ছে। ফোন করতে বলেছেন। কিন্তু মোবাইল অফ করা আছে। রামজি নিচু গলায় বলল, আমি বাঙালি নই বলে কারও সন্দেহ হতে পারে, আপনি যদি একবার খোঁজ নেন–। এভাবে চুপচাপ কতদিন বসে থাকব?

অর্ক মাথা নাড়ল, জীবনদা আমাকেও যেতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, দরকার হলে তিনিই ফোন করবেন।

তা হলে আমি কি মেদিনীপুরে চলে যাব?

মেদিনীপুরের কোথায়?

হলদিয়ায়। ওখানে রামপ্রকাশ আছে।

রামপ্রকাশ কে?

রামপ্রকাশ মাহাতো, আপনি চিনবেন না।

আমার মনে হয় আপনি আরও দু-তিন দিন অপেক্ষা করে যান।

আপনার পেরেন্টস কবে আসবেন?

দেরি আছে। ওদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। অর্ক উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজায় শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কে?

অল্পবয়সি গলায় জবাব এল, অর্কদা, আপনাকে সুরেনদা এখনই যেতে বললেন। খুব জরুরি।

কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিল অর্ক, ঠিক আছে।

সুরেন মাইতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কথাবার্তাও হয় না। লোকটা একশোভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত, উদ্ধত। বস্তির লোকেরা ভয় পায় বলে চুপ করে থাকে। সে রামজির দিকে তাকাল, আপনার সঙ্গে যারা কথা বলতে এসেছিল তারা কোন পার্টির লোক?

রামজি বলল, আমি তো ওদের চিনি না–!

খুব উদ্ধত, মানে, মেজাজ দেখিয়ে কথা বলেছে?

না না। অস্বাভাবিক ব্যবহার করেনি। রামজি বলল।

একটু চিন্তায় পড়ল অর্ক। শুধু ঈশ্বরপুকুর লেন কেন গোটা পশ্চিমবঙ্গে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার সুরেন মাইতির পার্টি ছাড়া আর কারও এই মুহূর্তে নেই। অথচ রামজি বলছে পাড়ার যেসব ছেলে এসেছিল তারা স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। কী করে সম্ভব? সে বলল, দরজাটা বন্ধ। করে দিন, আমি একটু ঘুরে আসছি।

কোথায় যাচ্ছেন? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

এই এলাকার সিপিএমের সর্বময় নেতা সুরেন মাইতির কাছে হাজিরা দিতে।

এখনই সংঘাতে যাবেন না। রামজি বলল। হেসে বাইরে বেরিয়ে দরজা টেনে দিল অর্ক।

গলিতে পা বাড়াতেই সেই বুড়ি ডাকল, ও ছেলে, খবর শুনেছ?

কী খবর?

ওই যে মেয়েটা, যাকে তোমার মা আশ্রয় দিয়েছিল, সে পালিয়ে গেছে।

পালিয়ে গিয়েছে মানে? অর্ক অবাক হয়ে গেল।

পালিয়ে যাওয়া মানে বোঝে না? সরল কথা। বুড়ি বলল।
 
ওপাশের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল একটি অল্পবয়সি বউ। সে ঝঝিয়ে উঠল, তোমার দোষ কী জানো? তুমি অর্ধেক বলো অর্ধেক পেটে রেখে দাও। সুজাতা এখানে নেই। আমাদের বলেছে এখানে থাকতে তার ভয় করছে। কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয় কলকাতার বাইরে থাকে, তার কাছে চলে গেছে। পালিয়ে যায়নি। অবশ্য কোথায় গিয়েছে তার ঠিকানা বলেনি। বউটি বলল।

অর্ক আর দাঁড়াল না। তার মনে হল, এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ এই মুহূর্তে বেঁচে আছে। প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনও সমস্যায় কম বেশি ভুগছে। এক-একজনের এক এক রকমের সমস্যা। কেউ সম্পূর্ণ সমস্যা মুক্ত হয়ে বেঁচে নেই। কোটি কেন, আশেপাশের দশজনের সমস্যা শুনে যদি কেউ সমাধানের চেষ্টা করে তা হলে তাকে পাগল হয়ে যেতে হবে। অথচ রাস্তাঘাটে বা বাড়িতে ওইসব মানুষগুলো এমন মুখ করে থাকে যে মনে হবে তাদের কোনও সমস্যা নেই। অন্যের সঙ্গে তো বটেই, এখন নিজের সঙ্গেই অভিনয় করতে মানুষ বেশ পটু হয়ে গিয়েছে। অর্ক বস্তি থেকে বেরিয়ে সুরেন মাইতির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সুরেন মাইতির গলা রাস্তায় পৌঁছোচ্ছিল। কাউকে খুব ধমকাচ্ছে। অর্ক দরজায় পৌঁছে দেখল একজন মধ্যবয়সিনি মহিলা বালিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সুরেন মাইতি তার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলল, আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যান মা। আপনি কাকে বাড়ি ভাড়া দেবেন সেটা নিয়ে কেউ আপনাকে কোনও কথা বলবে না। যদি বলে তা হলে তাকে এ পাড়া ছেড়ে যেতে হবে। মা-বোনেদের ইজ্জত সবার আগে। যান আপনি।

কী বলে যে ধন্যবাদ দেব– ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞ গলায় বললেন।

ছি ছি ছি। এসব কী বলছেন। আসুন।

ভদ্রমহিলা বালিকাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে ঘরের একপাশের বেঞ্চিতে বসা ছেলেদের একজনকে বলল, অ্যাই! উঠে দাঁড়া। ছেলেটা উঠল।

অর্ক দেখল একেবারে লপেটামার্কা চেহারা। পরনে জিন্স আর গেঞ্জি। শরীরে মাংস নেই কিন্তু হাতে বালা আর গলায় হার আছে।

অ্যাই! হাঁড়ির জলে চাল ফেললেই ভাত হয়ে যায়? সুরেন জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়ল ছেলেটা, না।

ভাতটা হওয়ার জন্য সময় দিতে হয়। কিছু বুঝলি? ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

গুড। যা এখান থেকে। তর সইছিল না।

অর্ক বুঝতে পারল একেই একটু আগে ধমকাচ্ছিল সুরেন মাইতি।

আমাকে ডেকেছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আরে। আসুন আসুন। কিন্তু আপনি এটা কী বললেন? আমি কি আপনাকে ডাকতে পারি? আপনার বাবা কত বড় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন, আপনার মায়ের মতো মানুষ বস্তিতে ছিলেন এটাই ভাগ্যের কথা। আর আপনি, কত অল্প বয়সে বস্তিতে কমিউন করার চেষ্টা করেছিলেন। আপনাদের পরিবারের যে ইতিহাস তাতে আমারই উচিত ছিল দেখা করতে যাওয়া। যেতামও। কিন্তু মাঝখানে ওই ভদ্রমহিলার কেস এসে পড়াতে–, বসুন বসুন। অ্যাই, চা বল। সুরেন মাইতি হাঁক দিল।

আমি কয়েক মিনিট আগে চা খেয়েছি। অর্ক বলল।

অ। ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে কী ব্যাপারে কথা বলব যেন–। টেবিলে টোকা মারল সুরেন মাইতি, ও হ্যাঁ, আপনার বাবা-মা তো এখন জলপাইগুড়িতে। আপনিও গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ।

পৈতৃক বাড়ি। যাবেনই তো। আপনার কোনও বন্ধু বোধহয় এখানে ছিল!

হ্যাঁ। ছিল। অর্ক বলল, এখনও আছে।

থাকতেই পারে। আমার বাড়িতে আমি কাকে রাখব সেটা আমিই ঠিক করব। কিন্তু পাড়াপড়শির তো ঘুম নেই। আমি শুনলাম ওই যে ছোকরা, আগে কংগ্রেস করত এখন তৃণমূল করে, সে নাকি ছেলে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দিস ইজ ভেরি ব্যাড। আমরা সিপিএম পার্টির কর্মীরা ডিসিপ্লিন মেনে চলি কারণ আমাদের পার্টির একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। যাকে সংবিধানও বলতে পারেন। ওদের কী আছে? নাথিং। একজন মহিলা হয়ে দলটাকে বহন করছেন। তিনি যা বলবেন তা এদের কানে কতটা পৌঁছাবে কে জানে! তা শোনামাত্র মনে হল আমার উচিত আপনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করা। আপনার ব্যাপারে নাক গলিয়েছে ওরা, আপনি ক্ষমা করে দিন। খুব বিনীত গলায় কথাগুলো বললেন সুরেন মাইতি।

ওরা এমন কিছু বলেনি যে আপনাকে এসব কথা বলতে হবে।

বলেনি?

না।

আপনাদের বলেনি কিন্তু প্রচার করছে। আমরা নাকি অবাঙালি বাইরে থেকে এনে পাড়ায় লুকিয়ে রাখছি। সময় হলেই তাদের কাজে লাগাব। শব্দ করে হাসল সুরেন মাইতি। তারপর মুখে খানিকটা পানবাহার ছুঁড়ে দিয়ে বলল, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বাইরে থেকে লোক আনতে হবে কেন? সুরেন মাইতি তো মরে যায়নি। যাক গে, শুনলাম, লোকটা নাকি অবাঙালি?

হ্যাঁ।

কোথায় বাড়ি?

আপনার কি সেটা জানার খুব দরকার?

আরে না না। কথার পিঠে কথা বলছি। আপনি শুধু বলুন, ওকে বিলক্ষণ চেনেন কি না!

চিনি।

এই তো সমস্যায় ফেললেন।

কেন?

আপনি তো বেলগাছিয়ার বাইরে মাত্র দুবার গিয়েছেন। তাও জলপাইগুড়িতে। একজন অবাঙালিকে চেনার স্কোপ পেলেন কী করে?
 
আমার স্কুলের এক বন্ধু চাকরি নিয়ে হাজারিবাগে গিয়েছে। ও থাকে এই ছেলেটির পাশের বাড়িতে। তার কাছেই এর কথা শুনেছি। ও ফোনে বলেছিল ছেলেটি চাকরির পরীক্ষা দিতে কলকাতায় আসবে কিন্তু থাকার জায়গা নেই। আমি যদি থাকতে দিই তা হলে ও খুশি হবে। আমি রাজি হলে ও এসে ওর ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, অ্যাডমিট কার্ড দেখায়। বুঝতেই পারছেন, আমি কোনও উটকো লোককে বাড়িতে ঢোকাইনি। অর্ক স্পষ্ট করে কথাগুলো বলল।

হয়ে গেল। জলের মতো সহজ হয়ে গেল। সুরেন মাইতি দুরে দাঁড়ানো পার্টির ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, নেই কাজ তো খই ভাজ। যত উলটোপালটা কথা কানে ঢোকাচ্ছে। সরি, আপনাকে কষ্ট দিলাম।

অর্ক যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল, একটা কথা বলুন তো, এই যে আপনি এলেন, আমি কি খারাপ ব্যবহার করেছি? আপনার সঙ্গে উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলেছি?

একদম নয়।

গুড। এই কথাটা যদি বস্তির মানুষকে বলেন তা হলে খুব খুশি হব। উঠে দাঁড়াল সুরেন মাইতি, অপপ্রচার। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। দেশের উন্নতি করতে শিল্পস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু শিল্প তো আকাশে তৈরি হতে পারে না। কলকারখানা করতে জমি দরকার। মানেন তো?

নিশ্চয়ই।

তা হলে? আপনি বুঝলেন। কিন্তু ওরা কৃষকদের খেপাচ্ছে। কারখানার জন্যে শিল্পপতিদের জমি চাই। কৃষকদের সমস্ত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে একফসলি জমি যদি কারখানার জন্যে নিতে চাই তা হলে বলা হচ্ছে আমরা তাদের গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছি। এক বিঘে জমিতে খরচ করে চাষের পর যে ধান হয় তার দাম কত? একজন কৃষককে সেই এক বিঘের জন্যে যে টাকা দেওয়া হবে তা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদের পরিমাণ পাঁচ গুণ হবে। আরও ভালভাবে বাঁচতে পারবে তারা। কিন্তু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে জমিকে মা বানিয়ে ভূমি রক্ষা আন্দোলন করানো হচ্ছে। মানুষের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল কেউ যদি তার সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেয় তা হলে বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দেখুন, এত বছর গেল, কংগ্রেসকে কোথাও দেখেছেন? সাইনবোর্ডের দল হয়ে গেছে। ওই সেন্টিমেন্ট এক্সপ্লয়েট করে নতুন দলটা দাঁড়াতে চাইছে।

অর্ক হাসল, আমাকে এসব বলছেন কেন? আমি শহরের মানুষ, জমিজমা নেই। রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখি না। চলি।

হুম। আমাদের বড় শত্রু হল মাওবাদীরা। ওরা মদত পাচ্ছে এদের কাছ থেকে। এখন কলকাতা শহর হল মাওবাদীদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। একটা প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন আপনার অতিথির রেকর্ড থানায় থাকা উচিত। আমি বড়বাবুকে বলে দেব যাতে আপনি গেলে ভাল ব্যবহার করেন। না বললে, বুঝতেই পারছেন, পুলিশের চরিত্র বদলায় না।

অর্ক আর দাঁড়াল না। সুরেন মাইতিকে তার এতকাল মনে হত একজন গোঁয়ার, অশিক্ষিত, উদ্ধত মানুষ যে নেতাদের পায়ে তেল দিয়ে ক্ষমতা হাতে রেখে চলেছে। আজ বুঝতে পারল, পার্টি ওর ব্রেনওয়াশ এমনভাবে করেছে যে শিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলা রপ্ত করতে পেরেছে।

গলিতে ঢোকার পরেই বুড়ির গলা কানে এল, ও বাবা, দাঁড়িয়ে যাও।

আবার কী হল? অর্ক দাঁড়াল।

বস্তির ওপাশের অলকা দুবার তোমার দরজা থেকে ঘুরে গেছে। আমি যত বলি তোমরা বাড়ি নেই, বিশ্বাস করে না। ভগবান শরীর দিয়েছে বলে বড্ড দেমাক ওই মাগির। আবার নিশ্চয়ই আসবে। কী বলে তা আমাকে জানিয়ো তো! বুড়ি চকচকে চোখে কথাগুলো বলল।

দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ার পর অর্ক একটু জোরে বলল, খোলো।

রামজি দরজা খুলে বলল, একজন মহিলা দুবার দরজায় শব্দ করে ডেকেছিল। আমি খুলতে ভরসা পাইনি।

ঠিক করেছ।

কী কথা হল?

অনেক আলতু ফালতু কথা। আচ্ছা, রামপ্রকাশের কোনও ফোন নাম্বার আপনার জানা আছে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ মোবাইল নাম্বার জানি।

আপনি ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করুন আজকালের মধ্যে ওর কাছে। যেতে পারেন কি না?

অর্কর কথা শুনে রামজির চোখ ছোট হল। বোতাম টিপে যন্ত্রটা কানে চেপে বলল, সুইচ অফ। ঠিক তখনই ভেজানো দরজাটা খুলে গেল। অর্ক অবাক হয়ে দেখল একজন মহিলা দাঁড়িয়ে হাসছেন।

.
 
অর্ক কিছু বলার আগেই মহিলা ভেতরের উঠোনে চলে এল। তার বাঁ হাত কপাল থেকে চুল সরাল, মাসিমাকে ডেকে দিন না।

আপনি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি অলকা।

মা এখন এই বাড়িতে নেই। অর্ক বলল।

যাঃ। আপনিও ওই বুড়ির মতো কথা বলছেন।

আশ্চর্য! অর্ক বারান্দায় বসা রামজির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে সত্যি কথা বলছি। মা এখন কলকাতাতেই নেই।

এবারে মহিলার মুখের অবিশ্বাসের হাসি মিলিয়ে গেল, কবে আসবেন?

কোনও ঠিক নেই।

উনি তো কখনও বাইরে যান না!

দরকার বলে গিয়েছেন।

মহিলা অকারণে বুকের আঁচল টানল। অর্ক লক্ষ করল এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না মহিলা। শরীরের ভার কখনও বাঁ পায়ে কখনও ডান পায়ের ওপর রাখছে। এবার বলল, এখন আমি কী করব?

বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল মহিলা খুব হতাশ হয়ে পড়েছে, সেটা বুঝেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল, মায়ের সঙ্গে কী দরকার ছিল তা যদি বলেন।

চোখ তুলে কাতর গলায় বলল মহিলা, পারবেন আমায় সাহায্য করতে?

না শুনলে কী করে বলব?

আ-আমি একটু বসতে পারি?

অর্ক ঘর থেকে একটা মোড়া এনে বারান্দায় রাখলে মহিলা সেখানে বসে রুমালে গলা এবং কাধ মুছল। তারপর রামজির দিকে তাকাল, উনি–!

বাংলা বোঝেন না। ওঁর সামনে কথা বলতে পারেন। অর্ক বলল।

আমার মেয়েটাকে মাসিমার স্কুলে ভরতি করতে চাই। নিজে গিয়েছিলাম, বলছে, ক্লাস টু-তে ভরতি হবে না। কিন্তু ভেতর থেকে জানতে পারলাম তিনটে সিট খালি আছে। শুনলাম হেডমিস্ট্রেসের কোটা আছে। মাসিমা যদি হেডমিস্ট্রেসকে আমার মেয়ের কথা বলে দেন তা হলে খুব উপকার হবে।

মা অবসর নিয়েছেন অনেকদিন হয়ে গেল!

কথা শেষ করতে না দিয়ে মহিলা বলল, তাতে কী হয়েছে। আমি স্কুলে গিয়ে শুনে এলাম সবাই এখনও মাসিমার কথা বলে। একজন তো বলেই দিল, মাধবীলতা দিদিকে ধরুন, উনি বললে হয়ে যাবে।

অর্ক হেসে ফেলল, তা হলে মায়ের ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আপনি বলছেন কবে ফিরবেন ঠিক নেই!

ঠিকই বলেছি।

আপনার সঙ্গে হেডমিস্ট্রেসের চেনা নেই?

না।

কিন্তু নাম বললে তিনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। মহিলা করুণ চোখে তাকালেন।

বেশ অবাক হয়ে গেল অর্ক। মহিলার সমস্যা প্রবল বলে দিশেহারা হয়ে এইরকম কথা বলছেন। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মেয়ে এখন কোন স্কুলে পড়ে?

দত্তবাগানের একটা স্কুলে।

সেখানে কী অসুবিধে হল?

ওখানে সমস্যা হয়েছে বলেই তো।

সমস্যা কী?

দেখুন, আমার স্বামী অফিসে কংগ্রেসি ইউনিয়ন করেন। পইপই করে বলেছি, করতে হলে সিপিএমের ইউনিয়ন করো, কিন্তু শোনেনি। সেই মহাত্মা গাঁধীর ঘি হাতে মেখে গন্ধ শুঁকে চলেছে। আদর্শে বিশ্বাস করে। একবার ইউনিয়নের ইলেকশনে জিতেছিল বলে মাথা ঘুরে গেছে। অথচ ওর সঙ্গে যারা কাজ করে তারা সিপিএমের লোক বলে আখের গুছিয়ে নিয়েছে। মহিলা শ্বাস ফেলল।

আপনার মেয়ের সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল। অর্ক বলল।

হ্যাঁ। ওই দত্তবাগানের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ডেকে পাঠিয়ে বলল, মেয়েকে অন্য স্কুলে নিয়ে যান। এখানে রাখা যাবে না।

কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

প্রথমে কিছুতেই বলতে চায় না। তারপর আমাকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি কংগ্রেসি ফ্যামিলি? আমি না বললে তিনি মাথা নাড়লেন, সত্যি বলছেন না। আপনার স্বামী এতদিন কংগ্রেসি করতেন এখন তৃণমূলে ঢুকেছেন। এর বেশি আপনাকে কিছু বলতে পারব না। এখন ভরতি চলছে, মেয়েকে নিয়ে যান। বাড়িতে ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসা করে আমার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। উনি যে পার্টি বদলেছেন তা আমাকেই জানাননি অথচ স্কুলের হেডমিস্ট্রেস জেনে গেছেন। আমি চেঁচামেচি করলে বলল, কংগ্রেস এখন মরা পার্টি হয়ে গিয়েছে। তৃণমূল উঠছে। আর পার্টির সঙ্গে কংগ্রেস নামটা তো রয়েছে। তুমি চিন্তা কোরো না, অন্য স্কুলে ভরতি হয়ে যাবে।

তা হলে আপনি চিন্তা করছেন কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ছাই হবে। দুদিন সময় নষ্ট করে শেষ পর্যন্ত আপনার মায়ের কথা বলল। আপনি আমার সঙ্গে চলুন না!

কোথায় যাব?

স্কুলে। আপনি বললে হেডমিস্ট্রেস না বলতে পারবেন না।
 
আমি একটু ভাবি। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মা রাজি হলে যেতে পারি। তা ছাড়া মা চাইলে হেডমিস্ট্রেসকে ফোনও করতে পারেন। আমি এই প্রথম শুনলাম, বাবা বিরোধী পার্টি করে বলে মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হচ্ছে। কী ভয়ংকর অবস্থা। অর্ক বলল।

মহিলা গলা নামাল, আমি সুরেন মাইতির কাছেও গিয়েছিলাম।

ও। কী বললেন তিনি?

প্রথমে খুব খেপে গেলেন ও কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে গিয়েছে বলে। বললেন, কংগ্রেসে ছিল, ওটা থাকা আর না থাকা তো একই কথা, কিন্তু কোন আকেলে তৃণমূলে গেল? এ তো আমাদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামা! আমি বললাম, এ কথা কেন বলছেন। আমি বা আমরা কি কখনও আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি? তা ছাড়া ও তো কোনওভাবে রাজনীতি করে না। বস্তিতে কখনও কি দেখেছেন আপনাদের বিরুদ্ধে মিটিং করতে? আপনার ওপরই ভরসা করি।

অর্ক হাসল, কী বললেন তিনি?

অনেক বলার পর একটু নরম হলেন। বললেন, স্কুলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন। একদিন সন্ধেবেলায় ওঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে যেতে হবে।

গিয়েছিলেন?

না না। ওকথা বলার সময় উনি যেভাবে তাকিয়েছিলেন তারপর যেতে সাহস হয়নি। মেয়েরা পুরুষের কিছু কিছু চাহনি চিনতে পারে। মহিলা আবার জোরে শ্বাস ফেলল, বুকের আঁচল টানল। অর্ক বুঝল ওটা ওর অভ্যেস।

ঠিক আছে তা হলে? অর্ক কথা শেষ করতে চাইল।

আপনি এখানে এখন একাই থাকেন?

একা কোথায়? আমার এই বন্ধু তো আছেন।

ও। রান্না করেন আপনারা?

দুর। যা করি তাকে রান্না বলে না!

আমি তো বস্তির ওপাশে থাকি। মাঝে মাঝে এসে একটা-দুটো পদ যদি বেঁধে দিই তা হলে নিশ্চয়ই না খেয়ে ফেলে দেবেন না!

তার কোনও দরকার নেই।

মহিলা উঠে দাঁড়াল, আমার নাম নিশ্চয়ই আপনার মনে নেই? অর্ক বলল, অলকা। ওই বুড়ি আগেই বলেছিল।

ওঃ, ওই বুড়ি আপনার কান ভারী করেছে, মহা শয়তান বুড়ি। শুধু ওইখানে বসে শকুনের মতো চারপাশে খুঁটিয়ে দেখে। আমাকে বলে কিনা, ভগবান তোমাকে এমন শরীর দিয়েছে, এই বস্তিতে পড়ে আছ কেন? ও যাই বলুক আমি কিন্তু ওরকম না। আমার পুরো নাম হল অলকা দাস, মেয়ের নাম করিনা দাস। হাসল অলকা।

করিনা? এ তো অবাঙালি নাম!

আজকাল আর বাঙালি অবাঙালির পার্থক্য নেই। আপনি তা হলে আজই মাসিমার সঙ্গে কথা বলবেন, চলি। যেতে ইচ্ছে ছিল না তা বুঝিয়ে অলকা চলে গেল।

দরজা বন্ধ করে অর্ক রামজির দিকে তাকাল, এই মহিলা যা বলে গেল তার কিছু বোঝা গেল? হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল সে।

রামজি কাধ নাচাল, না।

না বোঝাই ভাল। কিন্তু রামজি, একটা ঘোঁট পাকছে আপনাকে নিয়ে। তৃণমূল তত বলেছে, এখন সিপিএমও খোঁজ নিচ্ছে। আমার মনে হয় আর দেরি না করে হলদিয়াতে চলে যাওয়াই ভাল। অর্ক বলল।

মাথা নাড়ল শ্রীরাম। কিন্তু বোঝা গেল সে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

.
 
শেষ পর্যন্ত রামপ্রকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারল শ্রীরাম। তখন অনেক রাত। অর্ক ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে বসে কথা বলছিল শ্রীরাম। রামপ্রকাশ বলল, এখনই এখানে আসা ঠিক হবে না। মোবাইলে কম কথা বলা ভাল। তুমি কয়েকটা দিন তালসারিতে গিয়ে থাকো। ওখানে শ্রীনিবাস আছে। সাত নম্বরটা কল্পনা করে নেবে। তার কয়েক মিনিট পরে এসএমএস এল–নাইন ফোর ড্যাশ, থ্রি টু ড্যাশ, ওয়ান ওয়ান, ড্যাশ, ড্যাশ।

ড্যাশের জায়গায় সাত বসিয়ে নাম্বারটা মুখস্থ করে ফেলল রামজি। তারপর এস এম এস মুছে ফেলে আর একটা নাম্বারে ডায়াল করল। রিং হচ্ছে। এখন রাত দুটো। কিন্তু লোকটা সাড়া দিল। শ্রীরাম বলল, শ্রীনিবাসের কাছে যাওয়ার অর্ডার হয়েছে।

বাসে যাও। দিঘার বাসস্ট্যান্ডে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে। হাতে সাদা রুমাল রেখো। লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে। শ্রীরাম বুঝতে পারে না সবাই এত সতর্ক কেন? এই রাত্রে কে জেগে থেকে যত মোবাইল ফোন হচ্ছে তার সবগুলোর কথা শুনবে। সে বিড়ি ধরাল। অর্ক বলেছে বিড়ির পোড়া অংশ যেন এক জায়গায় জমা করে রাখে। একটা ভাঁড় সংগ্রহ করে নিয়েছিল সে ওই কারণে।

ভোর চারটের সময় অর্ককে ঘুম থেকে তুলল সে, আমি চলে যাচ্ছি।

এখন? এই রাত্রে? অর্ক একটু বিরক্ত।

রাত কোথায়? ভোর হয়ে আসছে। দিনের আলোয় যেতে চাই না।

কিন্তু এখন হলদিয়াতে কীভাবে যাবেন? এত সকালে কি বাস পাবেন?

হলদিয়াতে যাচ্ছি না। তালসারি নামের এক জায়গায় যাব। ওটা কোথায় তা আপনি কি জানেন? শ্রীরাম তার জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছিল।

মনে পড়ছে না।

দিঘা কোথায়? সমুদ্রের ধারে, না?

হ্যাঁ। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কোথায় যেন পড়েছি। তালসারিও সমুদ্রের ধারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ওড়িশায়। দিঘা হয়ে যেতে হয়। অর্ক বলল।

সেইজন্য আমাকে দিঘায় যেতে বলা হয়েছে।

এখান থেকে বেরিয়ে ট্রাম পেয়ে যাবেন। হাওড়া স্টেশনের পাশ থেকে দিঘার বাস ছাড়ে। মনুমেন্টের ওখান থেকেও পেতে পারেন।

আপনি দয়া করে সাহায্য করবেন?

কী করতে হবে, বলুন।

মুখ ধুয়ে নিন। আমাকে একটু এগিয়ে দিন। এখন রাস্তায় লোক থাকবে না। একা হেঁটে যেতে চাই না। রামজি বলল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে পকেটে কয়েকটা টাকা নিয়ে অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রামজি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ক অনেকদিন পরে শুকতারা দেখতে পেল। দরজায় তালা দিয়ে কয়েক পা হাঁটতেই কণ্ঠস্বর কানে এল, কে যায়?

অর্ক জবাব না দিয়ে আধা অন্ধকারে রামজির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল, বুড়ি চেঁচিয়ে বলছে, আ মরণ, কথার জবাব দেয় না যে, মর, মর! অর্ক হেসে ফেলল।

ঈশ্বরপুকুর লেনের আলোগুলো এখন হলদেটে। দু-তিনজন মানুষ ব্যস্ত পায়ে চলে গেল। এখনও ঘুম সর্বত্র জড়ানো। রামজির পাশাপাশি হাঁটছিল অর্ক। সে মুখ তুলে দেখল মোড়ের বড় বটগাছটায় এখনও অন্ধকার সেঁটে আছে। রামজি নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, এখন ট্রাম পাব তো?

প্রথম ট্রাম তো এই সময় ডিপো থেকে বের হয়। অর্ক জবাব দিল।

গলি থেকে বের হতেই চোখে পড়ল ভ্যানটাকে। অর্ক কিছু বলার আগেই রামজি জিজ্ঞাসা করল, ভ্যানের পাশ দিয়ে যেতে হবে নাকি?

হ্যাঁ, চলুন। জিজ্ঞাসা করলে বলব আর জি কর হাসপাতালে যাচ্ছি।

সেটা কোথায়?

ব্রিজ পার হয়ে ডান দিকে। নিশ্চয়ই দেখেছেন। আপনি কথা বলবেন না। অর্ক গম্ভীর গলায় বলল। ভ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে কোনও পুলিশকে দেখতে পেল না। এমনকী ড্রাইভারও সিটে বসে নেই।

ডিপোর মুখে ট্রামস্টপে দাঁড়াল ওরা।

হাওড়া স্টেশনের কতদুরে বাসস্ট্যান্ড? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

একদম গায়ে। বলামাত্র ট্রামটাকে দেখতে পেল অর্ক। ডিপো থেকে বেরিয়ে আসছে সামনে আলো জ্বেলে। রামজি তৈরি হচ্ছিল ওঠার জন্যে। অর্ক বলল, এটা এক নম্বর ট্রাম, এসপ্ল্যানেড যাচ্ছে, হাওড়ায় নয়।

ও। পিছিয়ে এল রামজি।

আচ্ছা, উঠুন। ট্রাম দাঁড়াতেই রামজির সঙ্গে উঠে পড়ল অর্ক।

একদম ফাঁকা ট্রাম। সামনের দিকে বসে রামজি জিজ্ঞাসা করল, আপনি উঠলেন কেন? আমি নিজেই যেতে পারতাম।
 
নিশ্চয়ই পারতেন। হঠাৎ মনে হল, এখন ফিরে গেলে আর কেউ না দেখুক, ওই বুড়ি চেঁচাবে। অত ভোরে আমি বেরিয়েই কেন ফিরে এলাম তা নিয়ে বস্তির মানুষের কৌতূহল বাড়বে। যদি কেউ এর মধ্যে জেগে বাইরে আসে সে জানতে চাইবে কোনও বিপদ হয়েছে কিনা! তার চেয়ে একটু বেলা করে ফেরাই ভাল। কেউ প্রশ্ন করবে না। অর্ক বলল।

রামজি হাসল, আপনি তত খুব ভাবেন।

অর্ক কথা বলল না। ট্রাম তখন খাল পেরিয়ে শ্যামবাজারের দিকে ছুটছে। অর্ক লক্ষ করল এখনকার ট্রামের চলনের সঙ্গে দিনের অন্য সময়ের ট্রামের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এখন ঝড়ের মতো ছুটছে ট্রাম, স্টপে লোক না থাকলে দাঁড়াবার প্রয়োজন বোধ করছে না। গোটা দিনে যদি ট্রাম এইরকম রাস্তা পেত।

একবার তালসারিতে আসুন। সমুদ্রের গায়ে যখন তখন ভাল লাগবে। রামজি কথাটা বলতেই ওর দিকে তাকাল অর্ক। বলার ভঙ্গিতে বেশ আন্তরিকতা রয়েছে। হঠাৎ প্রশ্নটা করে ফেলল সে, কিছু মনে করবেন, আমার জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, হাজারিবাগ ছাড়ার পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

রামজি হাসল, আমি হাজারিবাগ থেকে এসেছি কিন্তু আমার বাড়ি ওখানে নয়। আমি দুমকার লোক। বাবা-মা মারা গিয়েছেন, এক বোন আছে জামসেদপুরে। ম্যারেড। তাকে অনেকদিন দেখিনি।

তা হলে হাজারিবাগে কী করতেন?

ট্রেনিং। বলেই মুখ ফিরিয়ে নিল রামজি। হেদুয়ার স্টপ থেকে কয়েকজন ট্রামে উঠে নিজেদের মধ্যে উঁচু গলায় কথা বলতে লাগল। অর্ক বুঝল এরা সবাই ময়দানে যাচ্ছে হাঁটার জন্যে। সামনে পেছনে ওরা বসতেই রামজি গুটিয়ে গেল। কন্ডাক্টর এলে টিকিট দুটো কাটল অর্ক।

এসপ্ল্যানেডের ট্রামডিপো থেকে বেরিয়ে একটু খোঁজ নিতেই জানা গেল ঠিক পাঁচটার সময় দিঘার বাস ছাড়ছে। সাধারণ চেহারার প্রাইভেট বাস, ভাড়া কম। অর্ধেকও ভরতি হয়নি, রামজি নিজের টিকিট কিনে নিয়ে বাসে উঠে পড়ল, সিটে বসে হাত নাড়ল।

কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়াবার পরে অর্ক দূরে চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। এখন কলকাতায় অন্ধকার সরে গিয়ে ছায়া নেমেছে, সূর্য ওঠেনি। চায়ের দোকানে ভিড় জমেনি। আড়াই টাকায় এক ভাঁড় চা কিনে চুমুক দিতে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হল।

দাদা, কোথায় যাচ্ছেন? পাশ থেকে একজন প্রশ্ন করলে অর্ক তাকাল, লোকটা একদম অচেনা। বলল, কোথাও না।

কাউকে কি ছাড়তে এসেছেন?

কী ব্যাপার বলুন তো?

না না কোনও ব্যাপার নয়। চারধারে প্রচুর খোচড় ঘুরছে তো। দেখে মনে হল আপনি ভদ্রলোক, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। লোকটা বেশ দ্রুত সরে পড়ল। দিঘার বাস বেরিয়ে গেছে। চা শেষ করে ভাঁড়টা একটা টিনে ফেলতেই চা-ওয়ালা বলল, আপনাকে কী বলছিল?

এখন খদ্দের মাত্র গোটা চারেক। অর্ক হেসে বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি, কাউকে ছাড়তে এসেছি কিনা, যত ফালতু প্রশ্ন।

এই হয়েছে মুশকিল। লোকটা পুলিশ। পাঁচজনের দল রোজ ভোরে আসে। একটু সাবধানে যাবেন। চা-ওয়ালা মাথা নাড়ল।

অর্ক শক্ত হল। লোকটা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে রামজিকে দেখেছে। তা না হলে জিজ্ঞাসা করবে কেন কাউকে ছাড়তে এসেছে কিনা! লোকটা কি রামজিকে সন্দেহ করেছে? একবার মনে হল রামজির মোবাইলে ফোন করে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু মোবাইলের সুইচ অফ থাকাই স্বাভাবিক।

কিছুই হয়নি এমন ভাব করে শিয়ালদার ট্রাম ধরতে এগোল সে। লোকটা যদি তাকে অনুসরণ করে তা হলে কিছুতেই বেলগাছিয়ার হদিশ যেন না পায়। এই সময় হকাররা ভোরের খবরের কাগজ নিয়ে হইহই করে চলে এল। একজন চেঁচিয়ে বলছিল, জোর খবর, জোর খবর, নন্দীগ্রামে জোর আন্দোলন চলছে। মাটি ছাড়বে না মানুষ। জোর খবর।

একটা কাগজ কিনে নিয়ে শিয়ালদার ট্রামে উঠল অর্ক।

.
 
ট্রামের জানলার পাশের সিটে বসে খবরের কাগজ খুলল অর্ক। প্রথম পাতা জুড়ে নন্দীগ্রামের খবর। মুখ্যমন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিং-এ ঘোষণা করেছেন, নন্দীগ্রামের মানুষদের সম্মতি ছাড়া সেখানকার জমি অধিগ্রহণ করা হবে না, কিন্তু এই ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারছেন না গ্রামের মানুষ। সিপিএমের সঙ্গে ভূমিরক্ষা কমিটির সংঘাত মাঝে মাঝেই হচ্ছে। এই প্রথমবার গ্রামের মানুষ সিপিএমের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। সংঘর্ষে সিপিএম কর্মীরা এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিলেও মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না। মাটি যাদের কাছে মায়ের মতো তারা কিছুতেই বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয়। পুলিশ শান্তি স্থাপনের জন্যে গ্রামে ঢুকতে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না, কারণ মাটির পথগুলোকে গ্রামবাসীরা কেটে রেখেছে। গাড়ি ঢুকতে পারছে না। এই অগ্নিগর্ভ পরিবেশকে শান্ত করতে বামফ্রন্ট সরকার এখনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এই অবস্থায় তৃণমূলনেত্রীর সমর্থন পাওয়ায় জমি রক্ষা কমিটি নতুন উদ্যমে প্রস্তুত হচ্ছে।

অর্কর পাশে এসে বসলেন একজন ভদ্রলোক। কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে বললেন, আবার একটা ঝামেলা–!

অর্ক কোনও মন্তব্য না করে কাগজটাকে ভাঁজ করে উঠে দাঁড়াল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল মৌলালির মোড়ে। এই লোকটা পুলিশের লোক কিনা তা কে জানে?

বাসস্টপে মানুষ নেই। বেলগাছিয়ার বাস আসতেই উঠে পড়ল অর্ক। সে নিশ্চিত, কেউ এখন তাকে অনুসরণ করেনি। দু-তিন জন যাত্রী নিয়ে বাস যাচ্ছিল শামুকের গতিতে। অর্ক এবং আর একজন যাত্রী জোরে চালাতে বললেও বধিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল কন্ডাক্টররা। বাসের চালক সম্ভবত আধঘুমে। শেষ পর্যন্ত প্রচুর সময় নিয়ে শ্যামবাজার ইলেকট্রিসিটি অফিসের সামনে এসে বাস থেমে গেল। ড্রাইভার দু-তিনবার ইঞ্জিনে শব্দ করে বেরিয়ে এল, বাস খারাপ হয়ে গেছে। নেমে যান।

ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত বোঝা গেলেও কিছু করার নেই। অর্ক নেমে পড়ল। অন্য যাত্রীটি নাছোড়বান্দা। তিনি বেলগাছিয়াতে যাওয়ার জন্যে বাসে উঠেছিলেন। আবার আর একটা বাসের ভাড়া দেবেন না। অর্ক হেঁটে চলে এল শ্যামবাজারের মোড়ে। আজ পর্যন্ত ছুটি নেওয়া আছে, কাল অফিসে যেতে হবে। সে নেতাজির মূর্তির দিকে তাকাল। মাত্র সত্তর বছর আগেও ভদ্রলোক বেঁচে ছিলেন এখানে। তখনকার মানুষের সঙ্গে এখনকার মানুষের কী বিপুল পার্থক্য হয়ে গেছে। এখনকার কোনও মানুষের মূর্তি বড় রাস্তায় ওইভাবে বসিয়ে পঞ্চাশ বছর পরের জনতা দেখতে চাইবে? অনেক ভেবেও সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কারও নাম মনে এল না।

ওমা! আপনি এখানে?

মহিলার গলা পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অলকাকে দেখতে পেল অর্ক। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে বলল, কাজে এসেছিলাম।

এই, অ্যাত্তো সকালে! চোখ বড় করল অলকা।

অর্ক জবাব না দিয়ে ভাবল ট্রাফিক সিগন্যাল বদলে গেলেই রাস্তার ওপাশে গিয়ে বাস ধরবে। অলকা বলল, আপনি তো অদ্ভুত মানুষ!

কেন? না জিজ্ঞাসা করে পারল না অর্ক।

একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না আমি এই সময় এখানে কেন!

নিশ্চয়ই কোনও দরকারে এসেছেন। অর্ক বলল।

উঃ। আমার মেয়ের বাবা রাতে বাড়ি ফেরেননি। মেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে দেখে ওর অফিসের একজনের বাড়িতে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম তিনি নাকি মেদিনীপুরে গিয়েছেন। অথচ বাসায় বলে যাওয়ার কথা মনে রাখেননি। ভাবুন, আমার সকাল থেকে চা খাওয়াও হয়নি।

মেদিনীপুরে যদি কেউ থাকেন তা হলে ফোনে খবর নিতে পারেন।

কেউ থাকে না। ওর বাপ, চৌদ্দ পুরুষ বরিশালের। ও হ্যাঁ, আজ কী হয়েছিল বলুন তো? আপনি কখন বেরিয়েছেন? অলকার মনে পড়ে গেল যেন!

কেন? কিছুই তো হয়নি। অর্ক বলল।

বাপ রে! বুড়ির চিৎকারে সমস্ত বস্তি জেগে উঠেছিল। সবাই ভিড় করে গেল আপনাদের গলিতে। লোক ছুটল সুরেন মাইতিকে ঘুম থেকে তুলতে। ওই বুড়িকে বিশ্বাস নেই। কল্পনা করে নিয়ে যা মনে আসবে তাই বলবে। চোখে হাসি ছড়িয়ে মুখ ঘোরাল অলকা।
 
সর্বনাশ। বুড়ি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল ঠিকই কিন্তু চলে আসার পরে বস্তিতে যে লোক জমা করবে তা ভাবেনি অর্ক! কিন্তু বুড়ি কি তাদের উদ্দেশে এইসব করেছে। বস্তিতে ফিরে যাওয়ার আগে জানলে সাবধান হওয়া যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক কী হয়েছিল তা জানেন?

উঁহু! ভীষণ চা-তেষ্টা পেয়েছে। একা একা দোকানে ঢুকে চা খেতে খুব সংকোচ হয়। কটা মেয়ে একা চা খেতে পারে বলুন। আপনি সঙ্গে থাকলে চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে!

কিন্তু এই সকালে তো চায়ের দোকান খোলেনি!

খুলেছে। ওপাশের একটা দোকান খুলে গেছে।

ঘটনাটা জানার জন্যেই অলকার পাশে হেঁটে সেই দোকানটায় ঢুকল অর্ক। চায়ের অর্ডার দিল অলকাই। জিজ্ঞাসা করল, শিঙাড়া আছে?

না নেই। লোকটা চলে গেল।

মুখোমুখি বসে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে বলুন তো?

বলছি। মাসিমার সঙ্গে কথা হয়েছে?

মাসিমা–!

ওঃ। আপনি তা হলে মাসিমাকে ফোন করেননি? আমার মেয়ের ভরতির ব্যাপারটা একদম ভুলে গেলেন?

মায়ের ফোন বন্ধ ছিল। একটু বেলা হলে করব। বলুন!

আমি তো বিছানা ছেড়ে ওই ভিড়ের মধ্যে যাইনি। চিৎকার কানে আসছিল। পরে ঘুম থেকে উঠে পাশের ঘরের স্বস্তিকার কাছে শুনতে পেলাম বুড়ি নাকি শেষ রাত্রে দুজন লোককে দৌড়ে বস্তি থেকে বের হতে দেখেছে। বুড়ি তাদের থামতে বললেও তারা থামেনি। অল্প আলোয় বুড়ি তাদের স্পষ্ট দেখতে পায়নি। নিশ্চয়ই কারও সর্বনাশ করে গেছে ভেবে সে তোক জড়ো করেছে।

তারপর? অর্ক শ্বাস চাপল।

সুরেন মাইতি আসার আগেই বিশ্বজিৎ এসে গিয়েছিল। ওকে চেনেন তো? এখন তৃণমূলের নেতা হয়েছে। আমার স্বামী আর ওর একই পার্টি। দেখা হলেই বউদি বউদি করে ভাব জমাতে আসে। মরণ! কথা থামিয়ে চায়ের কাপ টেনে নিল অলকা। আলতো চুমুক দিয়ে বলল, ওই বিশ্বজিৎ নাকি সবাইকে বলেছিল যে যার ঘর পরীক্ষা করে দেখুন কিছু চুরি গিয়েছে কিনা! সেটা করে যখন কেউ কান্নাকাটি করল না তখন কয়েকজন ছুটল ট্রামরাস্তার দিকে, যদি লোকগুলোকে পাওয়া যায়। কিন্তু খানিকক্ষণ পরে তারা ফিরে এসে যখন বলল কাউকে দেখা যায়নি তখন গুলতানি শুরু হল। কেউ বলল, বুড়ি স্বপ্ন দেখেছিল, কেউ বলল বুড়িকে ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে যেন এরকম চেঁচামেচি করে পাবলিকের ঘুম না ভাঙায়। অলকা চা খেল।

অর্ক একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, আমার কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন কেন?

আরে তারপরই তো সুরেন মাইতি এল, সব শুনে প্রথমে আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেল। গিয়ে দেখল বাইরের দরজায় তালা ঝুলছে। অথচ কেউ বলতে পারল না আপনি কোথায় গিয়েছেন। আপনি যে বাইরে থেকে ফিরে এসেছেন, ওই বাড়িতে আপনার বন্ধু ছিল, এ কথা সবাই জানে। তা হলে গেলেন কোথায় আর কখন গেলেন? কেউ মনেই করতে পারল না আপনাদের যেতে দেখেছে কিনা! তবে আপনাদের বাড়িতে চুরি হবে না, হলে বাইরের দরজায় তালা থাকত না। চা শেষ করতে গিয়ে থমকে গেল অলকা, এ কী! চা খাচ্ছেন না কেন?

খাচ্ছি। কাপ তুলল অর্ক।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? অলকা তাকাল।

আপনি তো পাড়ার কারও সঙ্গে মেশেন না। কেন?

চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ক হাসল, সময় পাই না।

আপনি কি সবসময় এইরকম কম কথা বলেন?

কী জানি!

আমি কথা না বলে থাকতে পারি না। অলকা বলল, হ্যাঁ, সংসার চালানোর জন্যে মাসের প্রথমে ঠিকঠাক টাকা আমায় স্বামী দেন। কিন্তু সমস্ত ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হয়। তিনি তো টাকা দিয়েই খালাস। মেয়ের পড়াশোনা থেকে বাজার-রান্না এক হাতে করতে হয় আমাকে।

অর্ক মুখ তুলে তাকাল, ও!

এখন আমাদের সম্পর্ক দাদা-বোনের মতো। অলকা বলল।

সেটা খারাপ নয়। অর্ক গম্ভীর মুখে বলল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top