What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

শেষপর্যন্ত অর্ক অলকাকে বলতে বাধ্য হল, মা ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনি এই বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।

কেন? চোখের কোণে তাকাল অলকা।

আপনি বুঝেও প্রশ্ন করছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে অলকা যখন হাসল তখন তার পেছনে বস্তির বালক-বালিকারা কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে। অলকা মাথা নাড়ল, আমি শুনেছি আপনি নাকি একসময় এই বস্তির সব পরিবারকে বাঁচাবার জন্যে একসঙ্গে রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সিপিএম পার্টি সেটা পছন্দ করেনি বলে শেষপর্যন্ত প্ল্যান ভেস্তে যায়। আপনাকে পুলিশ ধরেছিল বলে বস্তির অনেক মানুষ থানায় গিয়ে আপনার মুক্তির জন্যে ধর্না দিয়েছিল। সেই আপনি বস্তির একজন বউয়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলতে এত ভয় পাচ্ছেন?

না। আমি ভয় পাইনি। মানুষের মুখ কিছু একটা বানিয়ে গল্প তৈরি করতে উসখুস করে। আপনার নামে বদনাম ছড়াক আমি চাই না।

আমার কথা ভেবে বলছেন না নিজের কথা ভাবছেন?

ঠিক আছে। এটা নিয়ে ঝগড়া করে তো কোনও লাভ নেই। আমি আপনার মেয়ের কথা মাকে বলেছিলাম কিন্তু ডেফিনিট কিছু শুনিনি। অতদূরে থেকে ওঁর পক্ষে কিছু করা বোধহয় সম্ভব নয়। আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে স্কুলে যেতে বলুন। ডাইরেক্ট অ্যাপ্রোচে কাজ হলেও হতে পারে। অর্ক বলল।

অলকা বলল, আপনার যদি মেয়ে থাকত তা হলে আপনি যেতেন?

নিশ্চয়ই। তাই তো স্বাভাবিক। অর্ক বলল।

অলকা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। ওকে ওর অফিস মালদায় বদলি করে দিয়েছে। ওখানেই আছে। তবে প্রতিমাসে আমাদের যা দিলে কোনও অসুবিধে হয় তা ও পাঠায়।

উনি আসেন না?

প্রথম দুই মাসে এসেছিল। গতমাসে আসেনি। আমার যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে সেই ব্যাঙ্কের মালদা ব্রাঞ্চে টাকা জমা দিলে আমি সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাই। এবার অর্কর দিকে সরাসরি তাকাল অলকা, আপনি আমার সঙ্গে স্কুল যাবেন?

আমি? অর্ক অবাক।

নতুন স্কুলে যেতে বলছি না। ওখানকার টিচাররা হয়তো আপনাকে চিনতে পারবেন। মেয়ে যে স্কুলে এতদিন পড়ছিল তার হেডমিস্ট্রেসের কাছে গিয়ে অনুরোধ করবেন? আমার মেয়েটার কথা ভেবে বলুন, প্লিজ।

এখন গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমি সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত নই। উনি পাত্তাই দেবেন না।

আমাকে একটু মিথ্যে বলতে হবে। আমার স্বামী সঙ্গে থাকেন না, মেয়েকে নিয়ে আমি একাই থাকি শুনলে হয় তো…। থেমে গেল অলকা।

স্কুলের নাম কী?

অলকা নাম বললে অর্ক বলল, ঠিক আছে। আপনার মেয়ের জন্যেই আমি যাব। তাতে যদি শান্তি পান–দুপুর আড়াইটে নাগাদ ওই স্কুলে আসুন।

.
 
স্কুলের হেডমিস্ট্রেস খুব ব্যস্ত বলে আধঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। অলকা আর অর্ক অপেক্ষাঘরে বসে ছিল। আধঘণ্টা পরে দুজন মধ্যবয়সি মানুষ হেডমিস্ট্রেসের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হেডমিস্ট্রেস তাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন এক ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আসতে হবে না ম্যাডাম। যা বললাম তা মনে রাখবেন।

এক মিনিট প্লিজ–! হেডমিস্ট্রেস রোগা, লম্বা, গালভাঙা। ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্কদের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, সরি ভাই। আজ আমি খুব ব্যস্ত আছি। আপনারা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসবেন। ঠিক আছে?

তখনই মধ্যবয়স্কদের একজনের নজর পড়ল অর্কদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে! অর্ক না? তুই তো একইরকম রয়েছিস। ভদ্রলোক এগিয়ে এলে অর্ক উঠে দাঁড়াল, অপূর্ব না?

ইয়েস। সেই অপূর্ব, যে স্কুলে তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।

হাত মেলাল ওরা। হেডমিস্ট্রেস জিজ্ঞাসা করলেন, বহুদিন পরে দেখা হল?

বহুত দিন। ওর নাম অর্ক মিত্র। অন্যরকম রাজনীতি করতে গিয়ে এক বছর নষ্ট করেছিল স্কুলে। অন্যরকম বলতে নকশাল বা মাওবাদী ভেবে নেবেন না। ও বস্তির সব মানুষকে এককাট্টা করে অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিল। এই দেশে তা সম্ভব নয় বোঝার পর বসে গেছে। অথচ ও যদি আমাদের সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতিতে আসত তা হলে কত ওপরে উঠে যেত। তা তুই এখানে কেন?

অর্ক বলল, একটা বাচ্চার পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।

অপূর্ব হেডমিস্ট্রেসকে বলল, আপনি দশ মিনিট অর্কর সঙ্গে কথা বললে খুব অসুবিধে হবে কি? আমি চাই ও আমাদের সঙ্গে আসুক।

হেডমিস্ট্রেস মাথা নাড়ল, আসুন আপনি।

অলকা উঠে দাঁড়াল কথাটা শুনে। অপূর্ব তার দিকে তাকিয়ে হাসল, নমস্কার। অনেকদিন দেখা হয়নি অর্কর সঙ্গে তাই আপনার খবরও পাইনি।

অলকা হাতজোড় করল।

অপূর্ব চলে যাওয়ার আগে বলল, আমি সেই পৈতৃক বাড়িতেই আছি। আসিস একদিন ওঁকে সঙ্গে নিয়ে।

অর্ক প্রতিবাদ করার আগেই অপূর্ব সঙ্গীকে নিয়ে চলে গেল। হেডমিস্ট্রেসের ঘরে বসার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার বলুন। অলকার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মেয়েকে নিয়ে সমস্যা হয়েছিল তাই না!

অলকা পুরো ঘটনাটা হেডমিস্ট্রেসকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বললেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার। অর্কবাবু, আমরা শুনেছিলাম আপনি প্রথমে কংগ্রেস করতেন এখন তৃণমূলে গিয়েছেন। আপনাদের এলাকার পার্টির লোকাল কমিটি থেকেও অন্যরকম কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অপূর্ববাবু যা বললেন তাতে বুঝতে পারছি বিরাট ভুল হয়ে গেছে।

অর্ক মনস্থির করে নিল। এরা সবাই তাকে অলকার স্বামী বলে ধরে নিয়েছে। সেটা চালিয়ে গেলে হয়তো অলকার মেয়েটা এই স্কুলে ফিরে আসতে পারবে কিন্তু। সে মাথা নাড়ল, না, যা সত্যি তাই বলাই উচিত।

অর্ক বলল, ম্যাডাম, আমার নাম অর্ক মিত্র। ইনি অলকা, আমার প্রতিবেশী, মেয়েটা ওঁর মেয়ে। আমি বুঝতে পারছি না ভিন্ন রাজনৈতিক দল করার জন্যে আপনারা ওঁর স্বামীকে অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি তো কোনও অন্যায় করেনি। ও কেন শাস্তি পেল।

আচ্ছা, উনি আপনার স্ত্রী নন?

আমি অবিবাহিত। হেডমিস্ট্রেসের ঠোঁটে হাসি ফুটল, আপনারা প্রতিবেশী?

অর্ক বলল, হ্যাঁ।

হেডমিস্ট্রেস বললেন, তা তিনি এলেন না কেন? মেয়েটির বাবা?

এবার অলকা কথা বলল, উনি আর আমাদের সঙ্গে থাকেন না।

সে কী? কেন?

জানি না। ট্রান্সফার নিয়ে মালদায় চলে গেছেন।

অদ্ভুত। কী দায়িত্ববোধ! ডিভোর্সের কথা ভাবছেন?

নিজের পায়ে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে, তারপর– অলকা বলল।

হেডমিস্ট্রেস একটু ভাবলেন, অর্কবাবু, ওঁর স্বামী লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে আমাকে ঘেরাও করে অনৈতিক দাবি আদায় করা চেষ্টা করেছিল বলে গভর্নিং বডি এই স্টেপ নিয়েছে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে এর যখন কোনও সম্পর্ক নেই। তখন বিষয়টা নতুন করে ভাবতে হবে। গভর্নিং বডিতে অপূর্ববাবু আছেন। ওঁর সঙ্গে আপনার যে সম্পর্ক দেখলাম তাতে মেয়েটিকে আবার নিয়ে নিতে অসুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার নাম কী?

অলকা।

আপনি কালই মেয়ের জন্যে দরখাস্ত দেবেন। তাতে লিখবেন মেয়ের বাবার সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। দেখুন গিয়ে, লোকটা মালদায় নতুন করে সংসার পেতেছে কিনা। এটা দরখাস্তে লিখবেন না। ওটা কাল পেলে বিকেলে গভর্নিং বডির সভায় অনুমোদন করিয়ে নেব। অর্কবাবু, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল। মাঝে মাঝে এলে আরও খুশি হব। হেডমিস্ট্রেস হাতজোড় করলেন।
 
বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক অলকাকে বলল, আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। সকালে এসে দরখাস্ত জমা দিয়ে যাবেন।

যদি হয় আপনার জন্যে হবে। অলকা বলল।

বেশ তো, একদিন খাইয়ে দেবেন।

কী খাবেন? যা চান তাই পাবেন। অলকা হাসল।

অর্ক কথা না বলে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। অলকা বলল, হেডমিস্ট্রেস আপনাকে বললেন মাঝে মাঝে দেখা করলে খুশি হবেন। উনি কিন্তু সত্যিকারের ডিভোর্সি। বুঝে সুঝে যাবেন।

অর্ক হাসল। অলকা জিজ্ঞাসা করল, আপনার মোবাইলের নাম্বারটা বলবেন?

অর্ক তাকাল। অলকা হাসল, আপনার বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছেন, খুব দরকার হলে ফোনে তো কথা বলতে পারি!

মাথা নেড়ে অর্ক নিজের নাম্বারটা জানাল। অলকা বলল, আমাকে একটু বউবাজারে যেতে হবে। বাস আসছে। অলকা এগিয়ে গেল। ওপরে উঠে হাত নাড়ল।

অলকাকে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল অর্কর। বেশি হাসে, মনে হবে একটু গায়েপড়া, কিন্তু বোঝা যায়, এই ব্যাপারটা বানানো নয়। এটা ওর ভেতর থেকেই আপনিই তৈরি হয়। কিন্তু মেয়ের প্রয়োজনে স্বামী সম্পর্কে ও হেডমিস্ট্রেসকে যা বলল তা আগে বলেনি। চটজলদি ওখানে অভিনয় করল, না তাকে যা বলতে পারেনি সেই সত্যি কথাটা বলে ফেলল?

মাথা নাড়ল অর্ক, এসব ভেবে তার কী লাভ! মোবাইলটা জানান দিতে সে পকেট থেকে ওটা বের করে অন করল। দাদা, আমি শ্রীরাম বলছি।

অর্ক খুশি হল, বলুন রামজি। কী খবর?

খবর ভাল না। আমি এখন ধরমতলায়।

ধরমতলা মানে? আপনি তো বাসে চেপে–।

ফোনে সব বলা যাবে না। আপনি কি বাসায় আছেন? তা হলে আমি আপনার ওখানে যাচ্ছি। রামজি বলল।

আপনি ঠিক কোন জায়গায় আছেন?

একটা সিনেমা হলের সামনে। মেট্রো। মেট্রো হল।

ওখানেই থাকুন। আমি আসছি।

লাইন কেটে দিয়ে অর্ক তাকাল। এসপ্ল্যানেডে যাওয়ার বাস আসছে। দ্রুত উঠে পড়ল সে। খুব ভিড়। কোনওমতে দাঁড়াবার জায়গা পেতেই কানে কথা ভেসে এল। নন্দীগ্রামে ঢোকার সব রাস্তা কেটে দিয়েছে গ্রামের লোক। দূর মশাই! গ্রামের কৃষকরা এতটা অর্গানাইজড হতে পারে নাকি। পেছনে কোনও পার্টি কাজ করছে। আচ্ছা, এই যে কাগজে পড়লাম, কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, বেরুচ্ছে না, এরকম কদিন চলতে পারে? খাবারদাবার তো একসময় ফুরিয়ে যাবে। তখন? মরিয়া হয়ে করছে। অত্যাচার সহ্য করতে করতে পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেওয়ালে, এখন বাঁচার জন্যে মরিয়া হয়ে গেছে মানুষ। যাই বলুন, ওদের হাতে আমস আছে নিশ্চয়ই। আপনি কি পাগল? গ্রামের সাধারণ মানুষ আর্মস কোথায় পাবে? যারা পায় তারা ওদের মদত দিচ্ছে। সবাইকে ছাপিয়ে একটা গলা সোচ্চার হল, মুশকিল কী জানেন, আপনারা কল্পনাও করতে পারছেন না, নন্দীগ্রাম একটা বিপ্লবের জন্ম দিচ্ছে।

অর্ক চোখ বন্ধ করল। তারপর চট করে তার পকেটে ঢোকা আঙুলগুলো ধরে বলল, এক সেকেন্ডের মধ্যে নেমে যাও। নইলে প্যাদানি খাবে।

বলমাত্র ছেলেটি ছিটকে চলে গেল বাসের পাদানিতে। তারপর বাসের গতি কমতেই লাফিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

অর্ক মাথা নাড়ল, কিছু না।

মেট্রো সিনেমার সামনে এখন পাতলা ভিড় কিন্তু সেখানে রামজিকে দেখতে পেল না অর্ক। লোকটা কলকাতার রাস্তাঘাট না চিনলেও নিজেই বলেছিল মেট্রো সিনেমার সামনে তখন ছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করার পর সে যখন ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন রামজির গলা কানে এল, দাদা!
 
অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল, ফুটপাথের অর্ধেকটা জুড়ে স্টল বানিয়ে যে দোকান করে বসেছে হকাররা তার আড়াল থেকে মুখ বের করে ডাকছে রামজি। সে অবাক হয়ে এগিয়ে গেল, কী ব্যাপার?

পেছনে লোক লেগেছে। আপনি চট করে ট্যাক্সি ডেকে আনুন। রামজি বলল।

যেন রামজিকে দেখেনি এমন ভান করে রাস্তায় নেমে ডানদিকে তাকাতেই একটা খালি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে সেটা দাঁড় করাতেই প্রশ্ন শুনল, কোথায় যাবেন?

খুব রাগ হয়ে গেল। এই দিনদুপুরেও লোকটা নিজের পছন্দমতো জায়গায় যেতে চাইছে। সে পেছনের দরজা খুলে বসে পড়ে বলল, নরকে।

মাথা নাড়ল লোকটা, কোন রাস্তায় যাব, বলে দেবেন।

আপাতত একটু এগিয়ে বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ান। লোক উঠবে!

ট্যাক্সি দাঁড়াতেই রামজি তিরের মতো ছুটে এসে পেছনে বসে পড়ল। অর্ক বলল, সোজা চলুন।

ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি চালু করলে রামজি পেছন ফিরে বারংবার দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

না। বুঝতে পারেনি।

কী ব্যাপার বলুন তো?

রামজি ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে কঁধ নাচাল। আকাডেমির সামনে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ভিক্টোরিয়ার বাগানে রামজিকে নিয়ে ঢুকে পড়ল অর্ক। রামজি চারপাশে তাকিয়ে বলল, এখানে ঢুকলেন? বহুত খিদে পেয়েছে। কোনও দোকানে গিয়ে বসলে ভাল হত।

অতএব রাস্তা পেরিয়ে রবীন্দ্রসদনের পেছনের ক্যান্টিনে পৌঁছাল ওরা। খাওয়া হলে অর্কই দাম দিল। রামজি বলল, আমার জন্যে আপনার খরচ হয়ে যাচ্ছে।

অর্ক কোনও কথা না বলে নন্দনের পেছনে একটা নির্জন বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এখনই নন্দন চত্বরে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জমায়েত শুরু হয়ে গিয়েছে। রামজি কথা বলা শুরু করল।

দিঘায় বাস থেকে নেমে সে শ্রীনিবাসকে ফোন করেছিল। কিন্তু ওর ফোন সুইচ অফ করা ছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল রামজি, তালসারিতে যাওয়ার কোনও সরাসরি বাস নেই। আধঘণ্টা দুরের ওড়িশা সীমান্তে গিয়ে অটো ধরে যেতে হয়। সে বাসে চেপে সেখানে গিয়ে শেয়ারের অটোতে উঠেছিল। সমুদ্রের ধারে পৌঁছে বারংবার ফোন করেও সে শ্রীনিবাসকে ধরতে পারেনি। অথচ তাকে রামপ্রকাশ বলেছে হলদিয়ায় না গিয়ে আপাতত শ্রীনিবাসের কাছে ওই তালসারিতে থাকতে। সমুদ্রের ধারে যেসব হোগলার ছাউনি দেওয়া দোকান আছে তাদের একজনকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, শ্রীনিবাসকে চেনে কিনা! শ্রীনিবাস কোথায় থাকে। এই জিজ্ঞাসা করেই বিপদে পড়েছিল সে। লোকটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আর একজনকে নিচু গলায় কিছু বলেছিল। সেই লোকটা তার সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি শ্রীনিবাসের কেউ হন?

না। পরিচিত। উত্তর দিয়েছিল রামজি।

কী দরকার?

তেমন কিছু নয়। এমনি দেখা করব? কোথায় থাকে সে?

ওকে তো এখন পাবেন না। আপনি কোথায় উঠেছেন?

আমি ভেবেছিলাম ওর বাড়িতেই উঠব। এখনও–।

কোনও চিন্তা নেই। আপনি এই দোকানে বসুন। আমরা শ্রীনিবাসকে ডেকে নিয়ে আসছি। তাকে একটা দোকানের সামনে বালিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসিয়ে লোকদুটো দ্রুত চলে যেতেই দোকানদার হাসল, যাকে ডাকতে গেল সে এখন জেলের ভাত খাচ্ছে। যাকে বলেছিল সে একটা বাচ্চা ছেলে, দোকানের কাজ করে।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাই আমার খুব পায়খানা পেয়েছে।

যান না, ওপাশে সমুদ্রের ধারে আড়াল দেখে বসে পড়ুন।

দোকানদার বলমাত্র সে আর দাঁড়ায়নি। ব্যাগটা নিতে গেলে দোকানদার বলল, ওটা রেখে যান। চুরি যাবে না।

বাধ্য হয়ে ব্যাগ রেখে সে সমুদ্রের ধারে ছুটে গিয়েছিল। তারপর ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মাইল খানেক এসে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল। যখন রাত নামল তখন ঝাউবন ছেড়ে সমুদ্রের বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিঘার দিকে চলে এসেছিল ভোরের একটু আগে।
 
দিঘা থেকে বাস ধরতে গিয়ে বুঝতে পারল তার পেছনে লোক লেগেছে। বাস যখন চলছে তখন একজন গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন? সে বলেছিল, খঙ্গপুর। লোকটা হেসে বলেছিল, ভুল বাসে উঠেছেন। সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু মেছেদাতে বাস থেকে নেমে চা খাওয়ার জন্যে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে আড়ালে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আর একটা বাস ধরে কলকাতায় নামতেই দেখতে পেল একজন তোক তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। সে হাঁটতে শুরু করলেই লোকটা পেছন পেছন হাঁটছিল। কিছুতেই যখন ওকে কাটাতে পারা যাচ্ছিল না তখন সে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। তাই দেখে লোকটা দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকে চলে যায়। তারপর সে অর্ককে ফোন করে।

কাহিনি শুনে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, শ্রীনিবাসের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন বলে পুলিশ আপনাকে সন্দেহ করেছে বলে যদি মনে করেন তা হলে কলকাতা অবধি খবর চলে আসতে পারে কি?

আমি জানি না। মাথা নেড়েছিল রামজি।

কিন্তু রামজি, আপনার সম্পর্কে আমাদের ওখানেও খুব কৌতূহল তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় আপনার উচিত হলদিয়ায় রামপ্রকাশকে ফোন করা।

অর্কর কথা শুনে মোবাইল বের করল রামজি।

.

কিছুক্ষণ শোনার চেষ্টা করে রামজি মাথা নাড়ল, আউট অব রেঞ্জ বলছে। অর্ক চারপাশে তাকাল, নন্দন চত্বর এখন অল্পবয়সিদের দখলে। দেশের কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে যদি কারও মাথা ব্যথা হয়ে থাকে তা হলে এখানে বসে তর্ক করেই সেটা দূর হয়ে যাবে। অবশ্য ওই বিষয়ের চেয়ে পরনিন্দা অথবা আত্মপ্রচারেই ব্যস্ত থাকবে এরা। কী অসাড়ে এদের সময় কেটে যায়। রামজি বেশ হতাশ গলায় বলল, কী করা যায় বলুন তো!

অর্ক বলল, যদি পুলিশ সন্দেহ করে থাকে, আপনাকে অনুসরণ করে ধর্মতলা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তা হলে বলব, কলকাতায় থাকা আপনার পক্ষে আদৌ নিরাপদ নয়। আপনি হাজারিবাগে ফিরে যেতে পারেন না?

অসম্ভব, ওখানে যে কজনের নাম ওয়ান্টেড লিস্টে আছে তাদের দেখলে পাবলিকই ধরিয়ে দেবে। রামজি বলল।

এই কথাটাই কদিন ধরে আমার মাথায় পাক খাচ্ছে। অর্ক বলল।

কী কথা?

আপনারা যে কাজটা করতে চাইছেন তা যদি পাবলিক পছন্দ না করে তা হলে সেটা কার জন্য করছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

রামজি মাথা নাড়ল, মানুষের একটা বড় শত্রু হল তার অভ্যস্ত জীবন। সেই জীবন ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন সে তার মধ্যেই নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে থাকতেই পছন্দ করে। আমাদের বাইরে যেতে তার খুব স্বস্তি হয় না। তেতো ওষুধ অনেকেই খেতে চায় না স্বাদের কারণে। কিন্তু আমরা বোঝাতে চাইছি, তেতো ওষুধ শরীরের রোগ সারায়। এই বোঝাটা যখন পাবলিক বুঝবে তখন আর তারা ভুল করবে না, আমাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে।

পাশে না বলে পেছনে বললেন কেন?

কারণ জনতার চরিত্র হবে নেতৃত্ব দেওয়া নয়, পেছনে থেকে সমর্থন করা। যাক গে, আমি এখন কী করব। তালসারির সোর্স জেলে, হলদিয়ার ফোন আউট অব রিচ। উঃ! রামজি চোখ বন্ধ করল।

আচমকা অর্কর মনে পড়ে গেল। সে বলল, আমি একটা জায়গার কথা বলতে পারি, সেখানে গেলে কেউ আপনাকে সন্দেহ বোধহয় করবে না।

কোথায়? চোখ খুলল রামজি।

বীরভূমে।

জায়গাটা কোথায়? আমি নাম শুনিনি।
 
বীরভূম একটা জেলার নাম। সেখানে একজন সন্ন্যাসিনীর আশ্রম আছে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার এবারই আলাপ হয়েছে, জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে আসার সময়। সন্ন্যাসিনী হলেও বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। যেতে বলেছিলেন ওঁর আশ্রমে। আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি কীভাবে যেতে হবে! অর্ক বলল।

কতটা সময় লাগবে যেতে? রামজি দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

এখান থেকে বড়জোর ঘণ্টা পাঁচেক।

রামজি বলল, আমার সামনে কোনও বিকল্প নেই। আপনি যখন ভরসা দিচ্ছেন তখন নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু সন্ন্যাসিনী নিশ্চয়ই হিন্দু?

তার মানে? অর্ক হাসল।

খ্রিস্টানদের মধ্যেও সন্ন্যাসিনী রয়েছেন।

না না। ইনি হিন্দু। খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী হলে তো গির্জায় থাকতেন, আশ্রম তৈরি করতেন না। অর্ক বলল।

বুঝতে পারছি না, ম্যানেজ করতে পারব কিনা। রামজি বলল।

সমস্যা কী?

আমি তো হিন্দু ধর্মের অনেক কিছুই জানি না।

আমিও জানি নাকি? ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত কোনও ধর্মাচরণ কখনও করিনি। অর্ক বলল।

কিন্তু আপনি দেখেছেন আর আপনার রক্তেও নিশ্চয়ই কিছুটা আছে।

আপনার নেই কেন?

দাদা, আমি খ্রিস্টান। রামজি বলল।

হকচকিয়ে গেল অর্ক, কী বলছেন? আপনার নাম তো রামজি?

ঠিকই। আমাদের পূর্বপুরুষদের পাদরিরা খ্রিস্টান করে দিয়ে গিয়েছিল। গরিব মানুষগুলো কিছু পাওয়ার লোভে ধর্মান্তরিত হয়। কিন্তু তারা হিন্দু নাম ত্যাগ করেনি। এখন অনেক খ্রিস্টান ওখানে আছে যারা চার্চে যায় না, ছেলেমেয়ে হলে হিন্দু-খ্রিস্টান মিশিয়ে নাম রাখে। রামজি বলল।

অদ্ভুত ব্যাপার।

সেইজন্যই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমি খ্রিস্টান জানলে ওঁরা যদি আশ্রমে থাকতে না দেন? রামজি বলল, একটা অনুরোধ করব। আপনি আমাকে নিয়ে ওখানে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ফিরে আসুন। তাতে আমার থাকাটা সহজ হবে।

কিন্তু আমার চাকরি? যা ছুটি নিয়েছিলাম তা আজই শেষ হয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে পড়ল অর্ক।

আমি আপনাকে সমস্যায় ফেলছি। কিন্তু অপরিচিত জায়গায় একা যেতে সাহস পাচ্ছি না। আপনি সঙ্গে থাকলে ভয় থাকবে না। রামজি আচমকা অর্কর হাত ধরল।

.
 
রাত্রে খাটে বসে মাধবীলতা আর অনিমেষ কথা বলছিল। একটু আগে মিস্টার রায়ের ফোন এসেছে। তিনি জানিয়েছেন ছোটমার সঙ্গে সম্পত্তি হস্তান্তরের সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। সামনের শুক্রবারে ওঁকে নিয়ে কোর্টে গেলেই সমস্য মিটে যাবে। খবরটা পেয়ে ওরা খুশি হয়েছিল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এবার কী করবে?

যা ভেবেছিলাম তাই করা উচিত।

তোমার কি মনে হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করতে কোনও অসুবিধে হবে না?

সেটা স্বপ্নেন্দু দত্ত সামলাবেন। আমি আর ভাবতে পারছি না।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু, ও অনিমেষবাবু?

মাধবীলতা বলল, কেউ তোমাকে ডাকছে।

এত রাত্রে। ঘড়ির দিকে তাকাল অনিমেষ, রাত নটা।

ডাকটা আবার ভেসে এল।

অনিমেষ উঠল। ক্রাচ বগলে নিয়ে বারান্দায় আসতেই সে ভাড়াটে নিবারণবাবুর গলা শুনতে পেল, অনিমেষবাবু, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? এখানে কাউন্সিলার সাহেব এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কণ্ঠ বলে উঠল, সাহেব টাহেব বলছেন কেন? বলুন, ভোম্বল এসেছে।

অনিমেষ বারান্দার শেষ প্রান্তের দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখতে পেল ওদের। নিবারণবাবু তো আছেনই, রয়েছেন কাউন্সিলার এবং আরও তিনজন তরুণ। সে জিজ্ঞাসা করল, বলুন?

কাউন্সিলার বললেন, এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু এদের অনুরোধে না এসেও পারলাম না।

আমি জেগেই ছিলাম। কী হয়েছে?

আর বলবেন না, এদের ক্লাবের চারজন ছেলেকে পুলিশ অন্যায়ভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছে। জবাবে কেস সাজিয়েছে ওদের বিরুদ্ধে। ভদ্র ঘরের ছেলে ওরা। বাবা-মা কান্নাকাটি করছে খুব। বেশ বিমর্ষমুখে কাউন্সিলার খবরটা দিলেন।

অনিমেষ বলল, কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?

না না, আপনাকে আমার সত্যি কিছু বলার নেই। ব্যাপারটা হল, যে চারটে ছেলেকে পুলিশ ধরেছে তারা ক্লাবের নেতা। আর ওই চারজনই আপনার আর নিবারণবাবুর সমস্যা মেটাতে এ বাড়িতে এসেছিল। কাউন্সিলার তরুণদের দিকে তাকালেন, কী, তাই তো?

ছেলেগুলো নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

আমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছি না। নিবারণবাবুর সঙ্গে আমার তো কোনও সমস্যা হয়নি। উনি যা চেয়েছেন তা আমি মেনে নিয়েছি। অনিমেষ নিবারণবাবুর দিকে তাকাল, কী নিবারণবাবু?

নিবারণবাবু এমনভাবে মাথা নাড়লেন তাতে হ্যাঁ বা না বোঝা গেল না।

কাউন্সিলার বললেন, দেখুন, আগেও বলেছি, পার্টির নির্দেশ আছে ভাড়াটে বাড়িওয়ালার সমস্যার মধ্যে না যেতে। তাই আমি আসিনি। কিন্তু–।

ওঁকে থামিয়ে দিল অনিমেষ, আবার বলছি, আমাদের সমস্যা ছিল না।

ওহো! আমি একটু অন্যভাবে বলি। আপনারা বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবেন, এখানে থাকবেন না শুনে পাড়ার ক্লাব আপনাদের কাছে কিছু ডোনেশন চেয়েছিল। আপনারা দিতে রাজি হননি। খুব স্বাভাবিক। তা শুনে অল্পবয়সি ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে কিছু কথা বলেছিল। এখনও ম্যাচিওরিটি আসেনি। প্র্যাকটিক্যাল সেন্সের তো অভাব হবেই। কয়েক মাসের মধ্যে এই কাজটা ছাড়া ওদের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। কাউন্সিলার অমায়িক হাসি হাসলেন।

দেখুন, ওদের কথা আমি নৃপেনদা এবং আপনাকে জানিয়েছিলাম। তারপর আর ওদের সঙ্গে কোনও ঝগড়া হয়নি। আপনার কি মনে হচ্ছে আমি পুলিশের কাছে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আমি কেন ভাবব? আপনার তো পুলিশের ওপর আস্থা থাকার কারণ নেই। ওরা যেভাবে আপনার পা ভেঙেছে, অত্যাচার করেছে তা তো আমরা জানি। কিন্তু এই ছেলেদের মনে হচ্ছে আপনি হয়তো রেগে গিয়ে নালিশ করলেও করতে পারেন। আমি অবশ্য বলেছি উনি এমন ভুল করতে পারেন না। পাড়ায় বাস করে কেউ পাড়ার ছেলেদের জেলে পাঠাবে? কাউন্সিলার বললেন।
 
অনিমেষ বলল, দেখুন, আমি যদি অভিযোগ জানাই, যার ভিত্তিতে পুলিশ ওদের ধরেছে তা হলে সেটা থানায় ডায়েরিতে রেকর্ড করা থাকবে। আপনি ওদের বলুন সেরকম কিছু ওখানে আছে কিনা?

মাথা নাড়লেন কাউন্সিলার, ঠিক এই কথাই ওদের বলেছিলাম। ওরা গিয়েছিল। না, আপনি কোনও ডায়রি করেননি।

তার পরেও আপনি ওদের নিয়ে এখানে এসেছেন? এখন কাউকে খুন বা রেপ করলে থানা ডায়েরি নিতে চায় না যদি দেখে অভিযুক্তের পেছনে আপনাদের পার্টি আছে। হাজার হাজার অভিযোগ পুলিশ ধামাচাপা দিয়েছে। আমি গিয়ে পুলিশকে বললাম আর পুলিশ সেটা নথিভুক্ত না করে ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে মারধর করল, এ কথা কোনও শিশু বিশ্বাস করবে? আমি কে? অনিমেষ বেশ উত্তেজিত হল।

কাউন্সিলার হাত নাড়লেন, আমি তো তাজ্জব হয়ে গেছি।

ওসিকে জিজ্ঞাসা করুন।

ডেকে পাঠিয়েছিলাম। অতীব ভালমানুষ। হাতজোড় করে বললেন, উনি কিছুই জানেন না। একদম অন্ধকারে আছেন।

উনি কি আমার কথা বলেছেন?

না। আপনাকে চেনেন না।

তা হলে? কাউন্সিলার ছেলেদের দিকে তাকালেন, শুনলে তো? তখনই বলেছিলাম অনিমেষবাবু এমন কাজ করতেই পারেন না? কী করে হল?

অনিমেষ বলল, আমিও অবাক হচ্ছি। পুলিশের কোন অফিসার এতটা সাহস দেখালেন? কোনও পুলিশ এসেছিল?

সন্ধেবেলায় ঘটেছে ঘটনাটা, খোঁজ পেয়ে যাব।

তারপরেই ভদ্রলোককে আপনারা সুন্দরবনে বদলি করবেন।

দেখুন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। তবে যেই করুক, এসপি সাহেবকে না জানিয়ে করতে পারবে না।

ছেলেগুলোকে রেখেছে কোথায়? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

একটি তরুণ নিচুগলায় জবাব দিল, জানি না। মারতে মারতে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছে ওদের।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?

কাউন্সিলার বললেন, বুঝতে পারছি আপনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এরা আপনাকে ভুল বুঝেছে। একটা অনুরোধ করব?

বলুন। অনিমেষ তাকাল।

আপনি এই পাড়াতেই ছেলেবেলায় ছিলেন। এখনও আছেন। আর পাড়ার ছেলেরা বিপদে পড়েছে। মানছি, ওরা আপনার সঙ্গে একটু ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওরা ছেলেমানুষ বলে ক্ষমা করে দিন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনি যদি আমাদের সঙ্গে এসপি সাহেবের বাংলোতে একবার যান তা হলে খুব ভাল হয়। কাউন্সিলার বললেন।

অনিমেষ অবাক হল, আমি গিয়ে কী করব?

দেখুন, পুলিশ যখন কাজটা করেছে আর ওসিকে না জানিয়ে করা হয়েছে। তখন ওপরতলা থেকে নির্দেশ এসেছে। সেই নির্দেশটি এসপি অবশ্যই জানেন। আপনি যদি এসপিকে অনুরোধ করেন ছেলেদের ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তা হলে পাড়ায় সবাই খুব খুশি হবে। কাউন্সিলার বললেন।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। অনিমেষ বলল।

কেন?

এসপি কেন, কোনও ডিআইজি, আইজির সাহস হবে না পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করার। কলকাতার কোনও মন্ত্রী ফোন করলে এসপি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবেন ছেলেগুলোকে। অনিমেষ বলল।
 
ঘড়ি দেখলেন কাউন্সিলার, নাঃ, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি আর একবার নৃপেনদার সঙ্গে কথা বলি। উনি কলকাতায় আছেন। যদি ওখান থেকেই কাজ হয়ে যায় তো ভাল নইলে কাল একবার দয়া করে যাবেন আমাদের সঙ্গে। এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। চলি নমস্কার। ছেলেগুলোকে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন কাউন্সিলার।

নিবারণবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, ওঁরা গেট পেরিয়ে চলে যেতেই উৎফুল্ল হলেন, ওঃ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।

কেন?

এদের জমানায় পুলিশ এদেরকেই ধরে মেরেছে, তুলে নিয়ে গিয়েছে। এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। কী হল বলুন তো? নিবারণবাবু গলা নামালেন, আপনি কি মুখ্যমন্ত্রীকে চিনতেন?

মানে?

একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলে ওপরতলার পুলিশ এই কাজ করতে পারে। চেনাজানা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী এই নির্দেশ দেবেন কেন?

অনিমেষ হাসল, নিবারণবাবু, অনেক রাত হয়ে গেছে। যান খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। আসছি।

দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই মাধবীলতাকে দেখতে পেল অনিমেষ। সে জিজ্ঞাসা করল, সব শুনলে?

বিশ্বাস হচ্ছে না। মাধবীলতা নিচু স্বরে বলল।

এখনও এদেশে ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন। অনিমেষ ঘরের দিকে এগোেল।

খাটে বসে মাধবীলতা বলল, ওরা তোমাকেই সন্দেহ করেছে।

হ্যাঁ। কিন্তু প্রকাশ পায়নি।

এর পরে কী হবে?

আমার মনে হয়, ভালমতো শিক্ষা দিয়ে ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

শিক্ষা পেলে যদি এরা শোধরায়।

এর পরে ওই ক্লাবের ছেলেরা চুপচাপ থাকবে?

কিন্তু তুমি কি এসপির কাছে ওদের সঙ্গে যাবে?

এটা কাউন্সিলারের চালাকি। না, আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব।

হ্যাঁ। যেয়ো না। গেলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে যাবেন।

এসপি যে এতটা সাহসী হবেন ভাবতে পারিনি। সেদিন মনে হয়েছিল এসে কোনও লাভ হল না। সত্যি মানুষ চেনা সহজ নয়। কিন্তু লতা, আমার উচিত ফোন করে ওঁকে ধন্যবাদ জানানো। অনিমেষ বলল, মিস্টার রায়ের কাছে নম্বরটা পেতে পারি।

কাল সকালে কোরো। যাই খাবারের ব্যবস্থা করি।

ছোটমা খেয়েছেন?

আগে তো রাত্রে খেতেন না। এখন আটটা নাগাদ দই মুড়ি খাচ্ছেন। হয়তো শুয়ে পড়েছেন। মাধবীলতা উঠেই দাঁড়িয়ে গেল, আচ্ছা। অর্ক তো আর ফোন করল না।

দরকার নেই তাই করেনি। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা মোবাইল তুলে নাম্বার ডায়াল করল। বস্তুটাকে কানে চেপে শুনল, আউট অব রেঞ্জ। অবাক হয়ে বলল, গেল কোথায়? বলছে আউট অব রেঞ্জ।

সত্যি কথাই তো বলছে। কাল সকালে কোরো। অনিমেষ বলতেই দরজায় শব্দ হল। ফোন নামিয়ে মাধবীলতা ছোটমাকে দেখতে পেয়ে বলল, আসুন? কী ব্যাপার, আপনি এখনও ঘুমোননি?

না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ছোটমা হাসলেন।

আপনি কিছু বলবেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। অনেকদিন পরে, ঠিক কতদিন তা নিজেই জানি না, ওই আশ্রমে সারাদিন থেকে আমার খুব ভাল লেগেছে। দিদিরা আমাকে অনেক বার বলেছেন ওখানে যাওয়ার জন্য। আমি মাঝে মাঝে যেতে পারি না?

কেন পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। মাধবীলতা বলল।

আর তারপর যদি মনে হয় ওঁদের সঙ্গে থেকে গেলে ভাল থাকব, তা হলে? ছোটমা এবার অনিমেষের দিকে তাকালেন।

.
 
রাত দশটায় ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে বোলপুরে পৌঁছোয় মধ্যরাতে। ওই ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় রামজিকে নিয়ে উঠেছিল অর্ক। আশ্চর্য ব্যাপার, সংরক্ষিত কামরার কোনও সিট যখন খালি নেই, টিটির পেছনে যাত্রীরা ঘুরছে করুণা পাওয়ার জন্যে তখন ওই অসংরক্ষিত কামরায় পা ছড়িয়ে বসা গেছে। মাঝখানে বর্ধমান, তার পরেই বোলপুর। এই ট্রেনে যাত্রীরা সচরাচর বোলপুরে যায় না। যারা ওঠার তারা উঠে গেলে ট্রেন যখন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল তখন প্লাটফর্ম শুনশান।

রামজি বলল, এত রাত্রে তো কোথাও যাওয়া যাবে না।

ওয়েটিংরুমে চলুন। ভোর অবধি থাকতে হবে। অর্ক হাঁটল।

ওখানে গেলে পুলিশের নজরে পড়ব না তো?

আচ্ছা, পুলিশ কি আপনার ছবি ছাপিয়ে হুলিয়া জারি করেছে যে বোলপুরের রেল পুলিশ দেখলেই চিনতে পারবে?

না না। মাথা নাড়ল রামজি।

ওয়েটিং রুমের চেয়ারগুলো দখল করে যাত্রীরা ঘুমোচ্ছে। মাটিতেও কয়েকজন শুয়ে। ওরা তাদের পাশেই বসে পড়ল। ঝিমুনি আসছিল। ধুলোটে মেঝের ওপর শোওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, এই সময় দুজন লোক ঘরে ঢুকল। তারা চারপাশে তাকিয়ে দেখল। একজন বলল, দূর শালা, হাউজফুল।

ওই লোকটা দুটো চেয়ার দখল করে আছে? বসার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাটা পা রেখেছে একটাতে, তোল ওকে। দ্বিতীয়জন বলল।

না, কাউকে ডিস্টার্ব করবি না। ফালতু গোলমাল হবে। এই মেঝের ওপর বসে পড়া যাক। প্রথমজন মেঝেতেই বসে একটা সিগারেট বের করল বুকপকেট থেকে, আগুন দে।

দেশলাই দিয়ে দ্বিতীয়জন বলল, দুটো টান দিয়ে।

ধোঁয়া ছেড়ে প্রথমজন বলল, লক্ষ্মণদা নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। সব শালাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে। দেখবি, দুদিনেই সব বেলুন চুপসে যাবে।

দেখো দাদা, কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার দাদার চাকরিটা দরকার। বিন্টুদা বলেছে ওটা হয়ে যাবে। পার্টি থেকে নাম পাঠিয়েছে। তা বিদা যখন বলল তোমার সঙ্গে নন্দীগ্রামে যেতে তখন

বলতে পারলাম না। না গেলে যদি দাদার চাকরি কেঁচে যায়? দ্বিতীয়জন বলল।

এটাই মুশকিল। তোরা কেউ পার্টির কথা ভাবিস না। শুধু পার্টিকে ভাঙিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। নে– প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে সিগারেট এগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে লম্বা টান দিয়ে দ্বিতীয়জন বলল, কিছু মনে কোরো না, নিজের পেট ভরে গেলে উপদেশ দেওয়া যায়। এই যে তোমার বাইক, দোতলা বাড়ি, তোমার দাদার প্রোমোটারি বিজনেস, এসব তো আকাশ থেকে পড়েনি। সিগারেট ফেরত দিল দ্বিতীয়জন।

প্রথমজন হাসল, তোর কথা শুনে একটুও রাগলাম না। পার্টি করছিস মাত্র দুবছর। লেগে থাকলে তোরও হবে। এই যে আজ যারা বীরভূম থেকে নন্দীগ্রামে যাচ্ছে তাদের সবাই তো ওই আশা নিয়ে যাচ্ছে, একদিন তাদেরও হবে।

দাদা, অনেকে বলছিল, খুব মারপিট হতে পারে। সত্যি?

দূর! বন্দুকের সামনে কে আসতে সাহস করবে? আমাদের সঙ্গে তো পুলিশ আছে। সব শালাকে লাশ বানিয়ে দেবে। প্রথমজন সিগারেট নেভাল।

ওখানকার গাঁয়ের লোক নাকি রাস্তা কেটে পুলিশের গাড়িকে ঢুকতে দিচ্ছে না। মেয়েরাও শুনলাম এককাট্টা হয়েছে? দ্বিতীয়জন একটু নার্ভাস।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top