What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা একটা চওড়া পিচের রাস্তার সামনে পৌঁছোল। প্রৌঢ় বললেন, বাঁ দিকে গেলে তিস্তা ব্রিজ এবং তারপরে ডুয়ার্স, ডানদিকে শিলিগুড়িতে যাওয়ার রাস্তা। সোজা জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পাশ দিয়ে রায়কতপাড়া, মানে শহরে পৌঁছাবেন। আপনার ইতিহাসে আগ্রহ আছে?

অল্পস্বল্প।

দেবী চৌধুরানির নাম শুনেছেন?

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র।

হ্যাঁ, কিন্তু তিনি বাস্তবে ছিলেন। ডান পাশে একটু হাঁটলেই একটা কালীবাড়ি দেখতে পাবেন। দেবী চৌধুরানির কালীবাড়ি। ওর চেহারা-চরিত্র অন্য যে-কোনও কালীবাড়ির থেকে আলাদা। সোজাই চলুন। প্রৌঢ় পা চালালেন।

আপনার নাম শুনতে পারি? হাসলেন প্রৌঢ়, কী নাম বলব? বাবা-মা যে নাম রেখেছিলেন সেই নাম বললে কেউ তো আর আমাকে চিনতে পারে না। সেই নামটা হল বলরাম দত্ত।

কী নামে সবাই আপনাকে চেনে?

রেডক্রশ দত্ত।

মানে? অর্ক হকচকিয়ে গেল।

ওই নামের যোগ্যতা আমার নেই। কেউ একজন শুরু করেছিল, সেটাই মুখে মুখে চাউর হয়ে চালু হয়ে গেছে। বলরাম দত্ত মাথা নাড়লেন।

এটা কী করে হল?

জুনিয়ার স্কুলে মাস্টারি করতাম। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত। চাকরির শেষদিকে একদিন জলপাইগুড়ির হাসপাতালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম একটি বউ হাউহাউ করে কাঁদছে। হাসপাতালের সামনে নতুন দৃশ্য নয়। কেউ মারা গেলে মানুষ ওইভাবে কাঁদে। কিন্তু শুনলাম কান্নার কারণ অন্য। হাসপাতাল বলেছে পেশেন্টকে এখনই শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে, এখানে তার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। অথচ পেশেন্টপার্টির কাছে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। মৃত্যু অনিবার্য বলে বউটি কাঁদছে তার স্বামীর জন্য। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কীরকম ঘোর লাগল মনে। আধঘণ্টার মধ্যে ধারধোর করে টাকা জোগাড় করে পেশেন্ট আর তার বউকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেলাম। যমে ডাক্তারের মধ্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যম হেরে গেল। হাসপাতালে পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। একটা ওষুধের দোকানের মালিক, যিনি আমার ছাত্রের বাবা, পাশে দাঁড়ালেন। ছেলেটি সুস্থ হল সাড়ে ছয় হাজার টাকার বোঝা আমার ওপর চাপিয়ে। হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল। ওর বউয়ের কাছে আমি তখন ঈশ্বরের মতো। কিন্তু কী বলব ভাই, বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, সাড়ে ছয় হাজার আমার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তার কোনও বিকল্প জীবনে পাইনি।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরা আপনাকে টাকাটা শোধ করেনি?

কী করে করবে? কোনওরকমে যাদের দিন চলে তাদের পক্ষে সম্ভব? আমাদের দেশে গরিবদের অসুখ হলে চিকিৎসা করানো বিলাসিতা। কিন্তু আমি মুশকিলে পড়লাম। বলরামবাবু হাসলেন।

কীরকম?

লোলাকে এসে আমাকে অনুরোধ করতে লাগল। প্রত্যেকের কোনও আত্মীয়ের খুব অসুখ, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে না। এমনকী সেখানকার ইসিজি মেশিনও খারাপ। ডাক্তাররা পাঠাচ্ছে নার্সিংহোমে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের নেই। না না বললেও কেস খারাপ দেখলে রাজি হয়ে যেতাম। বলতাম, যা খরচ হবে তা আপনারা জোগাড় করে আনুন, চিকিৎসা যাতে ভালভাবে হয় সেটা আমি দেখব। তবু শেষ মুহূর্তে আটকে গেলে পকেট থেকে বের করতে হয়। তখন একজনের পরামর্শে শহরের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করলাম। দশজনের মধ্যে একজন সাহায্যের হাত বাড়ালেন। কিন্তু ততদিনে আমার নাম হয়ে গেছে রেডক্রশ দত্ত। বলরাম বললেন।

কিন্তু এসব করলে আপনার নিজের সংসার কী করে চলবে?

আমার সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে করিনি, মা-ও চলে গিয়েছেন। তবে যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, অথচ লোকবল নেই, জানাশোনা কম, তারা নিজেরাই খুশি হয়ে আমাকে কিছু দেন। আর ডাক্তাররা তো বটেই, জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির হাসপাতালের স্টাফরাও আমাকে এখন সাহায্য করেন। ওঁরা সব জেনে গেছেন। বলরাম বললেন, এই তো, আলিপুরদুয়ার থেকে একজন এসেছিল তার মাকে নিয়ে, গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। অপারেশন করিয়ে আজ ফিরে গেলেন। ওঁদের পৌঁছে দিতেই স্টেশনে এসেছিলাম।

আপনি কোন পাড়ায় থাকেন?

সেনপাড়ায়। আমার মনে হয় এখানে রিকশা পেয়ে যাবেন। ওই তো একটা আসছে। ডানদিকে জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। আর-একটু এগিয়ে বা দিকে চলে যাব। ভাল থাকবেন ভাই।

বলরামবাবু রিকশাওয়ালাকে বললেন হাকিমপাড়ায় যেতে। রিকশাওয়ালা বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কত ভাড়া দিতে হবে?

রিকশাওয়ালা হাসল, রেডক্রশদার লোক আপনি, বেশি ভাড়া কি নিতে পারি?

বিদায় নিয়ে রিকশায় ওঠার কিছুক্ষণ পরে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁকে চিনলে কী করে?

কী বলছেন বাবু, চিনব না? আমাদের অসুখ হলে উনি ছাড়া আর কে আছেন এখানে?
 
রিকশা চলছে। হঠাৎ অর্কর মনে হল যেসব রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতারা দেশসেবার কথা বলেন, নিজের এবং দলের কর্মীদের স্বার্থ ঠিকঠাক রেখে মানুষের উপকার করতে বক্তৃতা দেন, তারা হয় বলরামবাবুদের দলে টানতে চাইবেন, নয় এড়িয়ে চলবেন। দারিদ্র্যসীমার নীচে যারা বাস করে তারা প্রয়োজনে ছুটে যাবে বলরামবাবুদের কাছে কিন্তু তাদের বিপদের সময় কজন পাশে দাঁড়াবে তাতে খুব সন্দেহ থাকছে।

ডানদিকের লম্বা বাড়িগুলো যে হাসপাতাল তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কেমন গুম হয়ে আছে চারধার।

একটা মজা খালের ওপর ছোট ব্রিজ। দেখলেই বোঝা যায় জল খুব নোংরা। নিশ্চয়ই নিয়মিত মশারা ডিম পাড়ে ওখানে। সেটা পার হয়ে এসে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, বাবু, হাকিমপাড়ার কোনখানে যাবেন?

তিস্তার চরের কাছে বাড়ি।

রিকশা দাঁড় করিয়ে লোকটা হাসল, হাকিমপাড়ার একটা দিক তো তিস্তার পাড়েই। কার বাড়ি বলুন তো?

অর্ক বুঝল বাবার নাম বললে কোনও কাজ হবে না। সে বলল, যাঁর বাড়ি তিনি নেই। মহীতোষ মিত্র।

রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে নামটা বললে তিনি বললেন, উনি তো বহুদিন হল দেহ রেখেছেন। তবে ওঁর বিধবা স্ত্রী এখনও আছেন বলে শুনেছি। তুমি বাঁ দিকের রাস্তা ধরো। বিপুল ব্যানার্জির বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা যখন বাঁ দিকে জেলা স্কুলের দিকে বাঁক নিচ্ছে তখনই দেখতে পাবে ডান দিকে একটা গলি আছে যেটা টাউন ক্লাবের দিকে গেছে। ওই গলিতে ঢোকার পর বাঁদিকের দ্বিতীয় বাড়ি।

রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘোরাল। অর্ক মাথা নাড়ল। বাবার কাছে শুনেছিল এই শহরে ঠাকুরদার বাবা সরিশেখর দীর্ঘকাল ছিলেন। তাঁকেই সবার চেনার কথা। তুলনায় ঠাকুরদা বেশিবছর থাকেননি। তবু ওই বৃদ্ধ চিনতে পারলেন। এঁরা বোধহয় অনিমেষ মিত্রকে চিনতেই পারবেন না।

একটা গাছপালায় ঘেরা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়াল। অর্ক মনে করতে পারছিল না। তার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আছে একটা লোহার গেট যেটা খুলে ঢুকতে হয়। সে জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ি?

হ্যাঁ। রিকশাওয়ালা বলল।

কত দিতে হবে তোমাকে?

কী বলব! পাঁচটা টাকা দিন।
 
টাকাটা দিয়ে অর্ক এগোল। এদিকে কোনও গেট নেই। সোজা হেঁটে সে বাড়ির ভেতরের বাগানে পৌঁছে গেল। ডানদিকে উঁচু লম্বা বারান্দা। এবার যেন চেনা চেনা মনে হল। হঠাৎ কানে এল মহিলা কণ্ঠের চিৎকার, কে? কে ওখানে? না বলে-কয়ে ভেতরে চলে এসেছে। থতমত হয়ে অর্ক দেখল বেশ জীর্ণ একজন বৃদ্ধা বারান্দার প্রান্তে এসে তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কথাগুলো বললেন। সে দুপা এগিয়ে গিয়ে অনুমান করল ইনিই ছোট ঠাকুমা। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ওপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল মাধবীলতা। অর্ককে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

কী আবার হবে! এদিকে তো গেট নেই, একটা কাঠের দরজা ছিল যেটা তিন বছর আগে চুরি হয়ে গিয়েছে। এতদিন রাতবিরেতে চোর আসত নারকোল চুরি করতে এখন দিনদুপুরে উটকো লোক ঢুকে পড়ছে। কথাগুলোতে ছোটমার যাবতীয় বিরক্তি ঝরে পড়ল, এত কথা বলছি, দেখো না, ঠুটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাধবীলতা কপট ধমক দিল, এই, এগিয়ে এসো।

অর্ক সামনে আসতেই আবার হুকুম হল, ওঁকে প্রণাম করো।

ছোটমা ছুটে হাত সামনে বাড়িয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন, না না, এসবের কোনও দরকার নেই, তুমি এখান থেকে বিদায় হও!

এবার মাধবীলতা হেসে ফেলল, এই, তুই নিজের পরিচয় দিতে পারছিস না?

সুযোগ পাচ্ছি না। তারপর ছোটমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি অর্ক, এইমাত্র কলকাতা থেকে এসেছি।

অ্যাঁ? ছোটমায়ের চোখ কপালে উঠল, তুমি অর্ক?

ততক্ষণে অর্ক প্রণাম সেরে নিয়েছে।

ছি ছি ছি। চিনতে না পেরে কী সব বললাম। আর চিনবই বা কী করে? কোনও সম্পর্ক তো রাখোনি! আমার কী দোষ! বাপ-মা আসতে পারেনি, ঠিক আছে, তুমি তো আসতে পারতে। সেই কত ছোট অবস্থায় দেখেছিলাম! হঠাৎ গলা ভিজে গেল ছোটমার।

বাবা কোথায়? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

খাটে শুয়ে বই পড়ছে। তার বাবার পছন্দের বই। মাধবীলতা হাসল।

ছোটমা বললেন, যাও, ভেতরে গিয়ে ভাল করে হাত মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নাও। ট্রেনের কাপড় পরে ঘরে থাকতে নেই। তুমি ওকে কিছু খেতে দাও।

মাধবীলতার পাশাপাশি যেতে যেতে অর্ক নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, খুব পিটপিটে, না?

চুপ! চাপা ধমক দিল মাধবীলতা, একদম না!

ঘরে ঢুকে অর্ক বলল, আমার সবকিছু ঝাপসা মনে পড়ছে।

অনিমেষ শুয়ে ছিল, উঠে বসল যাক, আসতে পারলি শেষ পর্যন্ত।

একটা চেয়ারে বসে অর্ক বলল, মা যা তাগাদা দিচ্ছিল তাতে না আসাটা–। যাক গে, কী ব্যাপার বলো তো?

মাধবীলতা বলল, এখনই সব জানতে হবে? চল, তোকে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি, হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে নে। ধীরে সুস্থে কথা হবে।

অর্ক তাকাল, মনে হচ্ছে বেশ গুরুতর ব্যাপার?

অনিমেষ বলল, আজ রাত্রে তোকে আমার সঙ্গে উকিলের বাড়িতে যেতে হবে।

রাত্রে? অসম্ভব! আমি তো সন্ধের ট্রেন ধরে ফিরে যাব। অর্ক গলা তুলে বলল।

অনিমেষ অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকাল, তুই আজই চলে যাবি? তা হলে এলি কেন?

বাঃ। মা বলেছিল সকালে এসে কী সব কাজ আছে তা করে বিকেলে ফিরে যাস। কী মা, তুমি এ কথা বলোনি?

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এ কথাও বলেছিলাম যে কবে আসতে হবে তা তোকে জানিয়ে দেব। আজ সেই দিন নয়।

কাজটা কী? অর্ক জানতে চাইল।

এসব কথা পরে ধীরে সুস্থে আলোচনা করলে ভাল হয় না? মাধবীলতা বলল, আগে হাত মুখ ধুয়ে নিবি চল। আমি চা খাবার করি।

অর্ক মাথা নাড়ল, এখন কিছু খাব না।

মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন?

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পুরি তরকারি আর চা খেয়ে নিয়েছি। অর্ক বলল, খুলে বলো তো, কাজটা কী?
 
মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ বলল, যা বলার তুমিই বলো। আমার এখন কথা বলতে ভাল লাগছে না।

মাধবীলতা বলল, তোর ছোট ঠাকুমাকে তো দেখলি! এত বড় বাড়িতে ওঁর পক্ষে আর একা থাকা সম্ভব নয়। এই বাড়ি বিক্রি করতে হবে। বিক্রির সময় এই বাড়ির আইনসম্মত মালিক চাই। উনি নিজে সেটা হতে চাইছেন না। উনি চাইছেন তোর নামে মালিকানা লিখে দিতে।

গম্ভীর হয়ে শুনছিল অর্ক। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আমি কেন? বাবা তো রয়েছে। বাবার নামে লিখে দিতে বলো।

অনিমেষ আবার শুয়ে পড়ল। সেদিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে মাধবীলতা বলল, তোর ঠাকুরদার তেমন ইচ্ছে ছিল না।

কথাটা তোমরা জানলে কী করে?

তোর ছোট ঠাকুমা বলেছেন।

মাথা নাড়ল অর্ক, তোমরা আমাকে এসবের সঙ্গে জড়িয়ো না।

তার মানে? মাধবীলতা অবাক হল।

ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? ছোট ঠাকুমা আমাকে মালিকানা দিচ্ছেন যাতে এই বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারি। আমার কোনও মতামত থাকছে না মালিক হওয়া সত্ত্বেও। নিজেকে পুতুল ভাবতে আমি আর রাজি নই মা। অর্ক বলল।

পুতুল? কী বলছিস তুই? মাধবীলতার শরীরে কাঁপুনি এল।

নয়তো কী? আমি মালিক হব আর তোমরা আমাকে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করাবে। আমার অন্য প্ল্যান থাকলেও করতে পারব না। অর্ক বলল।

কী প্ল্যান? অনিমেষ আবার উঠে বসল।

এই তো শুনলাম। ভাবার সময় পেলে ভেবে বলব।

বেশ। তোমার ছোটঠাকুমার কথা ভেবে আমাদের জানাও।

তুই কী ভাবছিস বাড়ি বিক্রির টাকা আমরা ভোগ করব? হঠাৎ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল মাধবীলতা।

আমি কিছুই ভাবিনি। বললাম তো ভাবার সুযোগ পাইনি। অর্ক মাথা নাড়ল।

অনিমেষ ছেলেকে বোঝাতে চাইল, ওই টাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া হবে ছোটমাকে। বাকি টাকা ওঁর নামেই ব্যাঙ্কে রাখা হবে যার সুদে ওঁর দিব্যি চলে যাবে। বুঝতে পেরেছিস?

তা হলে একটা সহজ ব্যাপারকে তোমরা জটিল করছ কেন? অর্ক তাকাল।

জটিল করছি? উত্তপ্ত হল অনিমেষ।

ঠাকুরদার বাড়ি ছোট ঠাকুমা পেয়েছেন। তিনি মালিক হিসেবে বিক্রি করে দিলে তোমরা পাশে দাঁড়িয়ে যা যা করতে চাও করে দিতে পারো। তা না করে আমাকে শিখণ্ডীর মতো দাঁড় করাচ্ছ কেন? অর্ক কথাগুলো বলতেই মাধবীলতা চিৎকার করল, অর্ক! তার গলার শিরা ফুলে উঠেছিল। মাথা ঘুরে যেতেই সে বিছানার ওপর টলতে টলতে বসে পড়ল। অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, লতা!

অর্ক দৌড়ে এল মায়ের কাছে, শুয়ে পড়ো, তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছ। মাধবীলতাকে বিছানায় শুইয়ে দিল সে। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল মাধবীলতা। মুখ রক্তশূন্য।

অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল, এই পাড়ায় ডাক্তার পাওয়া যাবে?

অনিমেষ জবাব না দিয়ে ক্রাচে ভর করে নীচে নামল। ততক্ষণে শ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, মাধবীলতা হাত নেড়ে নিষেধ করল।

অনিমেষ বলল, লতা, তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি, একবার দেখানো দরকার।

মাধবীলতা এবার উঠে বসল, না। দরকার নেই। আমি এখন ঠিক আছি। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যা, হাত মুখ ধুয়ে নে। তুমি ওকে বাথরুমটা দেখিয়ে দাও।

অর্ক বলল, না না, আমিই দেখে নিচ্ছি।

অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মাধবীলতার পাশে বসল অনিমেষ, সত্যি বলো তো, এখন কোনও কষ্ট নেই তো?

অনিমেষের গলার স্বরে চোখ তুলল মাধবীলতা, তারপর তার ঠোঁটে হাসি ফুটল, অনেকটা ভাল লাগছে। তখন চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল।

প্লিজ, এত উত্তেজিত হোয়ো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব বলো তো? ভাবলেই পৃথিবীটা কীরকম ফাঁকা হয়ে যায়। অনিমেষ গাঢ় স্বরে বলল।

একটা লাভ হল। মাধবীলতা বলল।

লাভ? মানে?

ওরকম না হলে তোমার এই কথাগুলো শুনতে পেতাম না। আজকাল আমরা কথা বললে শুধু কাজের কথাই বলি। তাই না? মাধবীলতা বলল, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অর্কর কিছু একটা হয়েছে। যে ছেলে এতগুলো বছর মুখ বুজে থাকত সে আজ কী কথা শোনাল!

অনিমেষ বলল, ছেড়ে দাও। আমার মনে হয় ওকে আজ বাড়ির ব্যাপারে আর কথা বলার দরকার নেই।
 
দুপুরের খাওয়া সেরে অর্ক গিয়েছিল তার ছোটঠাকুমার ঘরে। মাধবীলতা এখন অনেকটাই সুস্থ। ওদের পাশের ঘরটি অর্ককে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির প্রসঙ্গ আর তোলেনি কেউ। অনিমেষ শুয়ে ছিল, তার হাতে বই। একটু দূরে খাটের ওপর মাধবীলতা বসে কাগজ পড়ছিল। এ বাড়িতে এসে খবরের কাগজ পড়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। ছোটমার অভ্যেস না থাকায় কাগজ আসে না। সকালে নিউ জলপাইগুড়ির স্টেশন থেকে কাগজটা কিনেছিল অর্ক। পড়ে ব্যাগে রেখেছিল। ছোটঠাকুমার ঘরে যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রেখে গিয়েছিল।

কাগজে চোখ রেখে মাধবীলতা বলল, ডেবরা, গোপীবল্লভপুর তো মেদিনীপুর জেলায়, কখনও গিয়েছ?

না বইয়ে চোখ রেখে অনিমেষ বলল।

নন্দীগ্রামে?

হেসে ফেলল অনিমেষ, গেলে তো তোমাকে নিয়ে যেতাম।

উঁহু। যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলে তখন কোথায় কোথায় গিয়েছ তা কি আমি জানি? তখন আমাকে নিয়ে যাবে কী করে? মাধবীলতা বলল।

ও। নন্দীগ্রামের কথা জিজ্ঞাসা করলে কেন?

এই যে, কাগজের প্রথম পাতায় নাম বেরিয়েছে। সেখানকার কৃষকরা সরকারকে জমি দখল করতে দেবে না। উত্তেজনা দানা বাঁধছে। মাধবীলতা বলল।

বামফ্রন্ট যদি জোর করে জমি দখল করতে চায় তা হলে ওরা এতদিনে নিজের কবরের জন্যে গর্ত খোঁড়া শুরু করেছে। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা কাগজ ভাঁজ করল, আমার তো মনে হয় না আগামী কয়েকটা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে গদিচ্যুত করা যাবে। এত মেজরিটি, এত মানুষ বছরের পর বছর ওদের ভোট দিয়ে যাচ্ছে, যতই অত্যাচার করুক, রাতারাতি ওদের সরানো সম্ভব না।

অনিমেষ বলল, কী ব্যাপার? তুমি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছ! হঠাৎ কী হল?

কলকাতার বাড়িতে কাগজ এলে চোখ বুলিয়ে রেখে দিতাম। একই খবর প্রত্যেক দিন। মনে হত দুদিন আগের কাগজ আজ আবার ছাপা হয়েছে। এখানে কয়েকদিন কাগজ না পড়ে কিছুই মিস করিনি। আজ হঠাৎ হাতে পেয়ে মনে হল ভাল করে পড়ি। পড়তেই ভাবনাটা চলে এল। মাধবীলতা বলল। অর্ক ফিরে এল। এসে চেয়ারে বসল, ছোটঠাকুমার সঙ্গে কথা বললাম।

ওরা তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।

আমি বললাম, আপনি বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইছেন আর একা থাকতে পারছেন না বলে। ঠিক আছে। যদি একা না থাকেন তা হলে কি বাড়িটা বিক্রি করবেন? উনি প্রথমে বুঝতে পারেননি, আমি বুঝিয়ে বললে জানতে চাইলেন সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি বললাম, যদি এই বাড়িতে বৃদ্ধাদের জন্যে একটা আশ্রম খোলা যায় তা হলে তো আর আপনাকে একা থাকতে হচ্ছে না। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকায় কথাটা ওঁর মনঃপূত হল বলে মনে হচ্ছে না। তোমরা কি এ ব্যাপারে কথা বলবে?

এই বাড়িতে বৃদ্ধাশ্রম? অনিমেষের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

হ্যাঁ। শুধু বৃদ্ধাদের জন্যে। অর্ক বলল।

মাধবীলতা বলল, খুব ভাল প্রস্তাব। এতে তোর পূর্বপুরুষের তৈরি বাড়িটা থেকে যাবে। কিন্তু তোকে যে দায়িত্ব নিতে হবে।

মানে? অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল।

দেখ, এই বাড়িতে যত ঘর আছে তার দুটো বাদ দিলে অন্তত পনেরো জন বৃদ্ধাকে জায়গা দেওয়া যাবে। তারপর তাদের চারবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিকঠাক করতে হবে। বয়স্কা মানুষরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। এসব তো ছোটমা করতে পারবেন না। তোকেই দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। এতে মানুষের উপকার করাও হবে। শান্তিও পাবি। মাধবীলতা বলল।

এসব তো তোমরা করতে পারবে। তুমি রিটায়ার করেছ, কলকাতায় তোমাদের করার কিছুই নেই। এখানে এসব কাজের মধ্যে ইনভলভড় হয়ে থাকলে সময় ভালভাবে কেটে যাবে। অর্ক বলল।

খুব ভাল বলেছিস। আমরা এটা নিয়ে ভাবব। মাধবীলতা বলল।
 
আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আজই আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম বলরাম, কিন্তু রেডক্রশ বললে শহরের সবাই চিনতে পারে। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে না। অর্ক বলল।

বাঃ। খুব ভাল হল। তোর ট্রেন কখন?

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে জেনেছি এখানকার সন্ধেবেলার লোকাল ট্রেন ধরলেই হবে। ওখানে ট্রেন পেয়ে যাব।

তা হলে যা, একটু ঘুমিয়ে নে।

আমাকে আর উকিলের বাড়িতে যেতে হচ্ছে না তো? অর্ক হাসল।

আর কী দরকার। তুই যে পরামর্শ দিলি– ।

হ্যাঁ। এসব কথা অবশ্য টেলিফোনেও বলা যেত কিন্তু তুমি বুঝতে চাইতে না। এসে লাভ হল, ছোটঠাকুমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। অর্ক উঠে দাঁড়াল।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার উঠে বসল, আর একটু বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।

আবার বসল অর্ক, বলো।

তোর সঙ্গে হাজারিবাগের লোকটির আলাপ হল কী করে?

অর্ক আচমকা প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পড়ল, ঠিক সরাসরি আলাপ আগে হয়নি। আমার পরিচিত একজনের মাধ্যমে ফোনে কথা হয়েছিল। মাস তিনেক আমরা কথা বলেছি।

তাতেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল? এমন বন্ধুত্ব যে লোকটাকে তুই বাড়িতে থাকতে দিলি? যার মাধ্যমে আলাপ হল তার ওখানে উঠল না কেন?

ওর বাড়িতে জায়গা নেই। অর্ক গম্ভীর গলায় বলল।

ও। মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমরা যদি জলপাইগুড়িতে না আসতাম তা হলে ওকে কোথায় রাখতিস তোরা? বাড়িতে নিয়ে আসতিস?

আচ্ছা, একটা মানুষ আমাদের বাড়িতে কদিন আছে, এতে তোমার এত অসুবিধে হচ্ছে কেন তা আমি বুঝতে পারছি না। অর্ক শান্ত গলায় বলল।

পরিচিত কেউ থাকলে অসুবিধে হত না। বাঙালি?

না।

পুরুষ না মহিলা?

আশ্চর্য! ও যদি মহিলা হয় তাতে কী এসে যায়?

এবার মাধবীলতা কথা বলল, আমরা আলাদা আমাদের মতো থাকি ঠিকই কিন্তু সেটা বস্তির এলাকার মধ্যে। যখন ফিরে যাব তখন লোকে জিজ্ঞাসা করবে, তার তো জবাবটা দিতে হবে।

অর্ক হাসল, মা, তুমিই তো বলতে অতি উচ্চবিত্ত আর বিত্তহীন মানুষরা মধ্যবিত্তদের মতো সংকীর্ণ হয় না। তা হলে জবাব দিতে হবে কেন? যাক গে, ও পুরুষ। ঝাড়খণ্ডের মানুষ। পাটনা থেকে বি এ পাশ করেছিল। তোমরা যখন কলকাতায় নেই তখন ফাঁকা বাড়িতে ও থাকলে কী অসুবিধে তোমাদের?

অনিমেষ অবাক হল, আমরা যদি ছমাস এখানে থাকি তা হলে সে অতদিন তোর সঙ্গে থাকবে! কী করছে সে কলকাতায়?

ওর কাজকর্ম আছে। নানান মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

অর্ক উঠে দাঁড়াল, তা হলে আমি আজ চলে যেতে পারি?

অনিমেষ বা মাধবীলতা কোনও কথা বলল না। ঠিক তখনই বাইরে থেকে উত্তেজিত কয়েকটি কণ্ঠ ভেসে এল।

মাধবীলতা বলল, কারা এইভাবে চেঁচাচ্ছে?

অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে নীচে নামল, দেখছি।

কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে ভাড়াটেদের ঘরের সামনে থেকে। অনিমেষ সেদিকে এগিয়ে গেল। মাঝখানের দরজা খুলে ওপাশে যেতেই দেখল নিবারণবাবু হাতজোড় করে বলছেন, ভাই, তোমাদের অনুরোধ করছি আমাদের বিপদে ফেলো না।

সঙ্গে সঙ্গে সামনে দাঁড়ানো তিনটে ছেলের একজন চেঁচিয়ে বলল, বিপদ? আমরা আপনাকে বিপদে ফেলছি? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন, আপনাকে আমরা সাহায্য করছি। কোনও শালা আপনাদের এই বাড়ি থেকে তুলতে পারবে না। আপনার যতদিন ইচ্ছে এই বাড়িতে থাকবেন। ঠিক আছে?

দ্বিতীয় ছেলেটি চেঁচাল, আর যা বললাম, প্রত্যেক মাসের দুতারিখে ক্লাবে গিয়ে বাড়ির ভাড়া দিয়ে আসবেন। আর কাউকে ভাড়ার টাকা দেবেন না।

এইসময় নিবারণবাবুর চোখ পড়ল অনিমেষের ওপর। কাতর গলায় তিনি বললেন, এই দেখুন, এরা কী বলছে। হঠাৎ এদের কী হল?

কাকে বলছেন? কী করবে ওই ল্যাংড়া? যা বললাম তা মনে রাখবেন। না রাখলে আপনাকে উঠিয়ে অন্য ভাড়াটে বসাব আমরা। তৃতীয় জন বলল।

পেছন থেকে অর্কর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, এরা কারা?

.
 
অনিমেষ দেখল ছেলেগুলো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অর্ক কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল।

অনিমেষ বলল, ওরা এখানকার একটা ক্লাবের মেম্বার। ইনি নিবারণবাবু, ছোটমা এঁকেই বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন।

অর্ক নিবারণবাবুকে দেখল, বেশ অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তা হলে ওঁর কাছে এঁরা ভাড়া চাইছেন কেন?

নিবারণবাবু কাছে এলেন। অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে?

আমার ছেলে। অর্ক। একটু আগে কলকাতা থেকে এসেছে। অনিমেষ বলল।

অ। কী বিপদ বলুন তো। এখন আমি কী করি?

ওরা কি আপনাকে শাসাচ্ছে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

শাসাচ্ছে? বুকে বসে দাড়ি উপড়ে নেবে বলছে। নিবারণবাবু বললেন।

আপনি এসব কথা শুনছেন কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

কী করব তা হলে? জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করব?

শোনামাত্র অর্ক এগিয়ে গেল বাড়ির গেটের দিকে। ছেলেগুলো যেন অবাক হল। গেটের এপাশে দাঁড়িয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ভাই, আপনাদের সমস্যা কী?

আমাদের যে সমস্যা আছে এই খবর আপনাকে কে দিল?

তা হলে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝামেলা করছেন কেন?

তার আগে বলুন আপনি কে? এর মধ্যে নাক গলাচ্ছেন কেন?

নাক গলাতে আমি বাধ্য। উনি আমার ঠাকুমার ভাড়াটে।

ওই হ্যাঁন্ডিক্যাপড ভদ্রলোক আপনার বাবা?

এইভাবে কথা বলছেন, উনি কে তা জানেন?

যে তর্ক করছিল তাকে দ্বিতীয়জন থামাল, এই চেপে যা। কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলা উচিত নয়, জানিস তো।

তৃতীয়জন বলল, জানি জানি। সিপিএম থেকে ডিগবাজি খেয়ে উনি নকশাল হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু উনি কবে সিপিএমের ঘি খেয়েছিলেন, এখনও গন্ধ লেগে থাকতে পারে তাই ওঁকে কিছু বলিনি আমরা।

বলার কী ছিল সেটাই জানতে চাইছি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আপনি কোন পার্টি করেন? প্রথমজন জানতে চাইল।

আমি এখনও কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই।

কেন? দ্বিতীয়জন হাসল।

কারণ পশ্চিমবঙ্গের–। বলে থেমে গেল অর্ক, হাত নাড়ল, থাক ওসব। কেন এসেছিলেন আপনারা?

দ্বিতীয়জন বলল, ওই ভদ্রলোককে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম আমরা। বাবা জ্যাঠাদের সময়ে পাড়ায় ছিলেন, এখনকার হালচাল জানেন না, পাখির মতো বেড়াতে এসেছেন বলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তার ওপর একসময় তো সিপিএম করতেন সেটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। ভাড়াটে থাকলে বাড়ির দাম উঠবে না তাই ওকে ওঠাবার বিনিময়ে একটু খাওয়াদাওয়া করতে চেয়েছিলাম। উনি সোজা চলে গেলেন জেলা সম্পাদকের কাছে, নালিশ করলেন আমাদের বিরুদ্ধে। ভাবলেন তিনি ধমক দিলেই আমরা ভয়ে গর্তে ঢুকে যাব! উনি জানেন না রাজ্য কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ভাড়াটে বাড়িওয়ালার ঝামেলার মধ্যে পার্টি নাক গলাবে না। লোকাল পার্টির কাছে গেলে যদি তারা নাক গলাত তা হলে জেলাসম্পাদকের ধমক খেয়ে সরে যেত। কিন্তু আমরা তো একটা আলাদা ক্লাব। এই ক্লাবের সঙ্গে পার্টির ডিরেক্ট কোনও সম্পর্ক নেই। এই কথাটা ওঁর মাথায় আসেনি, তাই কমপ্লেন করে আমাদের বদনাম করলেন। এখন আমরা ভাড়াটের পক্ষে, যদি তিনি আমাদের কথা শুনে চলেন।

ছেলেগুলো চলে গেলে অর্ক ফিরে এসে বলল, কী অবস্থা!

নিবারণবাবু বিড়বিড় করলেন, এদের হারিয়ে যদি অন্য দল পাওয়ারে আসতে পারত। কিন্তু কাদের ভোট দেবে মানুষ? কংগ্রেস তো মেরুদণ্ডহীন। বিজেপি এখানে কখনওই হালে পানি পায়নি। রইল বাকি তৃণমূল। নতুন দল। তার ওপর ওই একজন মহিলার মুখ চেয়ে কতটা ভরসা পাওয়া যায়? বাকিরা সব– ।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারও সঙ্গে কথা বলছেন?

নিবারণবাবুর যেন সংবিৎ ফিরল, আঁ! না, মানে, কী করি বলুন তো?

অনিমেষ বলল, একমাত্র উপায় বাড়িটাকে তাড়াতাড়ি বিক্রি করে আপনাকে মুক্তি দেওয়া। আপনি যা চেয়েছেন তাই পাবেন।

নিবারণবাবু এগিয়ে এসে হাত ধরলেন, তা হলে তাড়াতাড়ি করুন। নেক্সট ভাড়াটা যেন ওদের দিতে না হয়।

ঘরে ফিরে এসে অর্ক বলল, এখানে তো সাংঘাতিক অবস্থা। এরকম ব্যাপার কলকাতাতে কখনও হয়নি।

হয়নি। হবে। অনিমেষ বলল।

কিন্তু মানুষের তো সহ্যশক্তির সীমা আছে। যখন সেটা ছাড়িয়ে যাবে তখন এই বামফ্রন্ট সরকারকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্ক বলল।

মাধবীলতা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। সম্ভবত, আড়ালে থাকলেও তার কানে সব কথা পৌঁছেছে। এবার মুখ খুলল, মানুষ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। যা যা করলে ব্যক্তিগত লাভ হয় সেটা শিখতে একটুও দেরি করে না।

মানে বুঝলাম না। অর্ক বলল।

নকশাল আন্দোলনের সময় একটা ছেলে বোমা হাতে নিয়ে পাড়া কপাত। লোকে জানলা দরজা বন্ধ করে ভয়ে বসে থাকত। বস্তির বাচ্চাগুলো
 
অবাক হয়ে সেই ছেলেকে হিরো বলে ভেবে নিত। তারপর নকশালরা যখন হারিয়ে গেল, যুব কংগ্রেসিরা এল, তখন ওই বাচ্চাগুলো সামান্য বড় হয়ে বোমা ছোঁড়াছুড়ি আরম্ভ করল হিরো হওয়ার জন্যে। তারপর যখন বামফ্রন্ট এল তখন তাদের হার্মাদবাহিনী সেই শিক্ষাকে আরও ধারালো করে নিল। মাধবীলতা হাসল, আমার মনে হয়, বামফ্রন্টকে সরিয়ে যদি কোনও দল ক্ষমতায় আসে তাদের নিচুতলায় এই ধারা আরও বেশি ক্ষমতা দেখাতে গজিয়ে উঠবে। এ বড় সংক্রামক রোগ।

অনিমেষ কাঁধ নাচাল, কবে কী হবে তা নিয়ে এখন ভেবে কী লাভ। তুই তা হলে আজই চলে যাচ্ছিস। তফাত কী জানিস, আমার বাবা-মা তাঁদের প্রয়োজনে ডাকলে আমি সকালে এসেই বিকেলে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না।

অর্ক হাসল, মানতে পারছি না।

তার মানে? অনিমেষ অবাক।

তুমি তোমার দাদু-পিসিমা-বাবা-ছোটমায়ের কথা ভুলে গিয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলে। কখন কোথায় আছ তা জানাবার প্রয়োজন মনে করোনি। এমনকী মাকেও অন্ধকারে রেখেছিলে। অর্ক হাসল।

এসব কথা তোকে কে বলেছে? যারা তোমাকে জানে তাদের কাছে শুনেছি। তাই বলে ভেবে নিয়ো না, মা এসব বলেছে। আজ পর্যন্ত মা তোমার বিরুদ্ধে একটা শব্দও আমাকে বলেনি।

অর্ক বলামাত্র মাধবীলতা বলল, অনেক হয়েছে। এবার তোমরা থামো।

মোবাইলে রিং শুরু হল। মাধবীলতা সেটা অন করতেই কানে এল, স্বপ্নেন্দু দত্ত বলছি। অনিমেষবাবু আছেন?

মাধবীলতা বলল, একটু ধরুন।

মোবাইল ফোন অনিমেষের হাতে দিয়ে বলল সে, স্বপ্নেন্দু দত্ত।

অনিমেষ যন্ত্রটাকে কানে চেপে বলল, হ্যাঁ। বলুন।

অনিমেষবাবু?

হ্যাঁ।

আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন কেন?

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

আপনি বলেছিলেন পার্টির সঙ্গে আপনার কথা হয়ে গেছে। পশ্চিম বাংলার অন্য কোথায় কী হচ্ছে জানি না, এই শহরে পার্টির সঙ্গে কথা না বলে কাজ করা অসম্ভব। আপনার কথায় বিশ্বাস করে আমি অ্যাডভান্স দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি যদি আমাকে সত্যি কথা বলতেন তা হলে আমিই ওদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিতাম। বেশ জোর গলায় কথাগুলো বললেন স্বপ্নেন্দু দত্ত।

আপনি এসব কেন বলছেন আমাকে?

আজ একটু আগে আপনার পাড়ার ছেলেরা এসেছিল আমার কাছে। তারা কীভাবে জেনেছে তা জানি না। বলছে, বাড়ি কিনতে হলে ওদের ক্লাব ফান্ডে পাঁচ লাখ ক্যাশ দিতে হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।

তারপর? অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল।

ওরা বলল, আপনি নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গিয়েছিলেন। এখন দুটো রাস্তা আছে। এক, আপনি অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত দিন। আমি বাড়িটা কিনব না। দুই, আপনার অংশ থেকে পাঁচ লাখ ওদের দিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের

সেটা মেনে নিতে হবে।

ওদের কেন দিচ্ছেন? ওরা তো কোনও রাজনৈতিক দল নয়।

ওরা রাজনৈতিক দলের অস্ত্র যার সাহায্য ছাড়া পার্টি ভোটে জিততে পারবে না। যদি সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে, সিপিএম হেরে যায়, তা হলে জানবেন এই অস্ত্র তাদের হারিয়ে যেদিকে হাওয়া বইছে সেদিকে গিয়েছে। স্বপ্নেন্দু হাসলেন, এবার বলুন দুটোর মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দ?

আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন। অনিমেষ বলল।

ও হ্যাঁ, আপনাদের কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেছে তো?

হয়ে যাবে।

দেখুন, বেশি দেরি করবেন না। আমি চাই না ওদের দাবি পাঁচ থেকে দশ লাখে উঠুক। পরে ফোন করব। লাইন কেটে দিলেন স্বপ্নেন্দু দত্ত।

মাধবীলতা তাকিয়ে ছিল। টেলিফোনে কথা বলার সময় অনিমেষ লক্ষ করছিল অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

মাধবীলতা বলল, কোনও সমস্যা হয়েছে।

স্বপ্নেন্দুর বক্তব্য জানাল অনিমেষ। মাধবীলতার চোখ কপালে উঠল, কী সর্বনাশ!
 
একটু আগে ওই ছেলেগুলো আমাকে হ্যাঁন্ডিক্যাপড বলে গেল। ক্রাচ ছাড়া যখন চলতে পারি না তখন তো মেনে নিতেই হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু আমি নই, আমার মতো যারা সাধারণ জীবনযাপন করে তাদের সবাই হ্যাঁন্ডিক্যাপড। বিষণ্ণ গলায় বলল অনিমেষ।

সব দিক দিয়েই তো এক অবস্থা। মাধবীলতা বলল, এই যে অর্ক তার নিজের মতন চলছে, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা তো হ্যাঁন্ডিক্যাপড বলেই।

ওকে যেতে দাও। মিস্টার রায়কে বলব আর কারও নামে প্রপার্টি ট্রান্সফার করার দরকার নেই। অনিমেষ বলল।

ছোটমা অর্কর মুখে খবরটা শুনে অবাক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, মাধবীলতা, ও মাধবীলতা, এদিকে এসো।

অর্ক বলল, আরে! মাকে ডাকছ কেন?

মাধবীলতা বেরিয়ে এল, বলুন।

তোমার ছেলে সকালে এসে বিকেলে চলে যাচ্ছে কেন?

ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।

অর্ক বলল, প্রথমত, এখানে আমার করণীয় কিছু নেই। উলটে কলকাতায় প্রচুর কাজ পড়ে আছে।

তোমার বাবা-ঠাকুরদা-বড়দাদুর এই বাড়ির জন্য কোনও টান নেই?

দেখো, এখানে তো আমি একবারই ছিলাম। তখন বয়স খুব কম ছিল আর সেটা কয়েকদিনের জন্যে। কিন্তু বাবা তো পুরো স্কুলজীবন এই বাড়িতে থেকেছে। তারপর কি টান অনুভব করেছিল? কোনও কাজ ছাড়াই কলকাতায় থেকে গেছে। এই যে এখানে এবার এসেছে, তুমি একা আছ তাই। বলতে পারত এখানেই থেকে যাবে। অনেক ভাল থাকত তা হলে। তা না করে বাড়িটাই বিক্রি করে দিতে চাইছে। তার মানে ওরও কোনও টান নেই। অর্ক বলল।

মাধবীলতা কথা বলতে যাচ্ছিল হাত তুলে তাকে থামতে বলল ছোটমা, বুঝেছি বাবা। এটা বোঝার জন্য হয়তো এতদিন বেঁচে আছি।

অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে ছেলের কথা শুনছিল। এবার ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোর কী হয়েছে বল তো?

মানে? পেছন ফিরল অর্ক।

এতগুলো বছর ধরে একসঙ্গে থেকে আমরা তোর মুখে প্রয়োজনের বাইরে কোনও কথা শুনিনি। তোর মা বলত, তুই নাকি নিজের মধ্যে থাকিস। এখানে এসে যেসব কথা বলছিস তা–।

অনিমেষকে থামিয়ে দিল অর্ক, অস্বীকার করতে পারো? একটাও মিথ্যে বলেছি?

মাধবীলতা বলল, না। বলিসনি।

তোমাদের ভাবনাচিন্তাগুলো যে পুরনো হয়ে গিয়েছে সেটা কেউ বোঝে না। এই যে এখানে সিপিএমের দাদাগিরি দেখছ, দেখে কী করছ? গুমরে মরছ। কেউ ভেবেছে এর প্রতিবাদ করা উচিত? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি তোর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাই না।

বলার কিছু থাকলে তো বলবে। তুমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে, তা সিপিএম হোক বা নকশাল হোক, তার সঙ্গে এদেশের মাটির কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু ধার করা শব্দ উচ্চারণ করে ভেবেছ দেশে কমিউনিজম এনেছ, আর তোমাদের নীচের কর্মীরা সেই সুযোগে লুটেপুটে খাচ্ছে। আজ তাদের হাত তোমাদের ওপর পড়লে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছ। এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের তোমরাই তৈরি করেছ। অর্ক বলল।

তুই এসব কথা বলছিস কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই তথাকথিত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিপ্লব আসতে বাধ্য। তার বেশি দেরি নেই। অর্ক বড় বড় পা ফেলে বাগানে নেমে গেল।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ও হঠাৎ খেপে গেল কেন? প্রসঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও এসব কথা বলছে কেন?

আমি বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, যে লোকটাকে ও আশ্রয় দিয়েছে সে কে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ঠিক বলেছ। ওই লোকটার সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে।

বিশেষ কোনও রাজনীতি করা লোক নয় তো? মাধবীলতা নিজের সঙ্গে কথা বলছিল, আমার ভয় করছে।

যা শুনলে তার পরেও ওর জন্য ভয় পাচ্ছ? অনিমেষ হাসল।

.

হঠাৎ দৌড়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অর্ক, একটা লাঠি দাও তো, তাড়াতাড়ি। সে বেশ উত্তেজিত।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

একটা সাপ, বেশ বড়–।

উঠে এসো। উঠে এসো বলছি। ছোটমার গলা ওপরে উঠল।

মানে? সাপটা–।

ওটা আমার বাগানে আছে। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। উঠে এসো। ছোটমা মাধবীলতার দিকে তাকাল, আমি ঠাকুরঘরে যাচ্ছি।
 
লছমনের রিকশা পাওয়া গিয়েছিল। মাধবীলতা এবং অনিমেষ রোদ মরতেই মিস্টার রায়ের বাড়িতে চলে এল। অর্ক তখন তার ঘরে পা গুটিয়ে শুয়ে ছিল। মাধবীলতা বলল, শোন, আমরা বেরোচ্ছি।

ও। আমিও একটু পরে বের হব। শোওয়া অবস্থাতেই বলছিল অর্ক।

তা হলে চলেই যাচ্ছিস!

হ্যাঁ। মিছিমিছি দৌড় করালে। এই বাড়িতে একটা সাপের গুরুত্বও আমার চেয়ে বেশি। ঠিক আছে, কলকাতায় ফেরার আগে ফোন করবে। অর্ক বলল।

কেন? ফোন না করে গেলে তোর কী অসুবিধে হবে? মাধবীলতা শক্ত হল।

হাসল অর্ক, আমার নয়, তোমাদের অসুবিধে হবে। দরজায় তালা দেখলে বাইরে বসে থাকতে হবে আমি না ফেরা পর্যন্ত।

আসছি। মাধবীলতা আর দাঁড়ায়নি।

অনিমেষ ততক্ষণে বাড়ির সামনে রিকশায় উঠে বসেছে লছমনের সাহায্যে। মাধবীলতা উঠলে রিকশার প্যাডেল ঘোরাল লছমন।

আজ ছুটির দিন তাই মিস্টার রায়কে বাড়িতেই পাওয়া গেল। কাজের লোক চেম্বারের দরজা খুলে ওদের বসতে বলার পাঁচ মিনিট পরে এলেন ভদ্রলোক, কী ব্যাপার? হঠাৎ! ছুটির বিকেলে আমি চেম্বার করি না, কিন্তু আপনারা এসেছেন বলে টেবিলের ওপাশের যে চেয়ারে উনি বসেন সেটায় না বসে আর-একটা চেয়ার টেনে নিলেন ভদ্রলোক।

আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আসলে বাড়ির মালিকানা আইনত ঠিক না হলে অনেক সমস্যা হচ্ছে। রাজনীতি এসে গেছে এর মধ্যে। মাধবীলতা কথাগুলো না বলে পারল না।

তাই বলুন। পার্টি কি চাইছে বাড়ির দখল নিতে? মিস্টার রায় হাসলেন।

না। ঠিক তা নয়। অনিমেষ বলল, আমরা নৃপেনদার কাছে গিয়েছিলাম, তিনি সৌমেনবাবুর কাছে পাঠালেন। তার কাছেও কোনও সাহায্য পাইনি।

তা হলে? হার্মাদ বাহিনী?

পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা যারা পার্টির সমর্থক, সদস্য নয়। অনিমেষ কথাগুলো বলে মাধবীলতার দিকে তাকাল।

মাধবীলতা বলল, ওর বাবার উইলটাকে আইনসংগত করে দিন।

আপনার শাশুড়ি অ্যাকসেপ্ট করবেন?

মনে হচ্ছে এখন করবেন।

তা হলে তো কোনও সমস্যা নেই। কালই মুভ করছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটা করতে কতদিন লাগবে?

পয়সা খরচ করলে খুব দ্রুত হয়ে যাবে। নইলে–।

পয়সা খরচ মানে, ঘুষ? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আচ্ছা ভাই, পৃথিবীতে এত রকমের পরিবর্তন হয়েছে দেখছেন, ঘুষ শব্দটাও যে বাতিল হয়ে গেছে তা জানেন না। তৎকাল শব্দটা শুনেছেন? ট্রেনের বার্থ যখন আর বিক্রির জন্য পড়ে থাকে না তখন রেল কোম্পানি যে কয়েকটা বার্থ হাতে রেখে দেয় সেগুলো অতিরিক্ত চার্জ বসিয়ে বিক্রি করে। লোকে বলে তৎকালে টিকিট কেটেছি। এটা অবশ্যই সরকারি আইনে হয়ে থাকে। এই আইনটা একদম বেসরকারি করে নিয়েছেন যাঁরা তাঁদের আনুকূল্যে কাজটা দ্রুত হয়ে যেতে পারে। মিস্টার রায় চোখ বন্ধ করে হাসলেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top