বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা একটা চওড়া পিচের রাস্তার সামনে পৌঁছোল। প্রৌঢ় বললেন, বাঁ দিকে গেলে তিস্তা ব্রিজ এবং তারপরে ডুয়ার্স, ডানদিকে শিলিগুড়িতে যাওয়ার রাস্তা। সোজা জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পাশ দিয়ে রায়কতপাড়া, মানে শহরে পৌঁছাবেন। আপনার ইতিহাসে আগ্রহ আছে?
অল্পস্বল্প।
দেবী চৌধুরানির নাম শুনেছেন?
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র।
হ্যাঁ, কিন্তু তিনি বাস্তবে ছিলেন। ডান পাশে একটু হাঁটলেই একটা কালীবাড়ি দেখতে পাবেন। দেবী চৌধুরানির কালীবাড়ি। ওর চেহারা-চরিত্র অন্য যে-কোনও কালীবাড়ির থেকে আলাদা। সোজাই চলুন। প্রৌঢ় পা চালালেন।
আপনার নাম শুনতে পারি? হাসলেন প্রৌঢ়, কী নাম বলব? বাবা-মা যে নাম রেখেছিলেন সেই নাম বললে কেউ তো আর আমাকে চিনতে পারে না। সেই নামটা হল বলরাম দত্ত।
কী নামে সবাই আপনাকে চেনে?
রেডক্রশ দত্ত।
মানে? অর্ক হকচকিয়ে গেল।
ওই নামের যোগ্যতা আমার নেই। কেউ একজন শুরু করেছিল, সেটাই মুখে মুখে চাউর হয়ে চালু হয়ে গেছে। বলরাম দত্ত মাথা নাড়লেন।
এটা কী করে হল?
জুনিয়ার স্কুলে মাস্টারি করতাম। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত। চাকরির শেষদিকে একদিন জলপাইগুড়ির হাসপাতালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম একটি বউ হাউহাউ করে কাঁদছে। হাসপাতালের সামনে নতুন দৃশ্য নয়। কেউ মারা গেলে মানুষ ওইভাবে কাঁদে। কিন্তু শুনলাম কান্নার কারণ অন্য। হাসপাতাল বলেছে পেশেন্টকে এখনই শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে, এখানে তার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। অথচ পেশেন্টপার্টির কাছে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। মৃত্যু অনিবার্য বলে বউটি কাঁদছে তার স্বামীর জন্য। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কীরকম ঘোর লাগল মনে। আধঘণ্টার মধ্যে ধারধোর করে টাকা জোগাড় করে পেশেন্ট আর তার বউকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেলাম। যমে ডাক্তারের মধ্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যম হেরে গেল। হাসপাতালে পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। একটা ওষুধের দোকানের মালিক, যিনি আমার ছাত্রের বাবা, পাশে দাঁড়ালেন। ছেলেটি সুস্থ হল সাড়ে ছয় হাজার টাকার বোঝা আমার ওপর চাপিয়ে। হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল। ওর বউয়ের কাছে আমি তখন ঈশ্বরের মতো। কিন্তু কী বলব ভাই, বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, সাড়ে ছয় হাজার আমার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তার কোনও বিকল্প জীবনে পাইনি।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরা আপনাকে টাকাটা শোধ করেনি?
কী করে করবে? কোনওরকমে যাদের দিন চলে তাদের পক্ষে সম্ভব? আমাদের দেশে গরিবদের অসুখ হলে চিকিৎসা করানো বিলাসিতা। কিন্তু আমি মুশকিলে পড়লাম। বলরামবাবু হাসলেন।
কীরকম?
লোলাকে এসে আমাকে অনুরোধ করতে লাগল। প্রত্যেকের কোনও আত্মীয়ের খুব অসুখ, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে না। এমনকী সেখানকার ইসিজি মেশিনও খারাপ। ডাক্তাররা পাঠাচ্ছে নার্সিংহোমে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের নেই। না না বললেও কেস খারাপ দেখলে রাজি হয়ে যেতাম। বলতাম, যা খরচ হবে তা আপনারা জোগাড় করে আনুন, চিকিৎসা যাতে ভালভাবে হয় সেটা আমি দেখব। তবু শেষ মুহূর্তে আটকে গেলে পকেট থেকে বের করতে হয়। তখন একজনের পরামর্শে শহরের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করলাম। দশজনের মধ্যে একজন সাহায্যের হাত বাড়ালেন। কিন্তু ততদিনে আমার নাম হয়ে গেছে রেডক্রশ দত্ত। বলরাম বললেন।
কিন্তু এসব করলে আপনার নিজের সংসার কী করে চলবে?
আমার সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে করিনি, মা-ও চলে গিয়েছেন। তবে যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, অথচ লোকবল নেই, জানাশোনা কম, তারা নিজেরাই খুশি হয়ে আমাকে কিছু দেন। আর ডাক্তাররা তো বটেই, জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির হাসপাতালের স্টাফরাও আমাকে এখন সাহায্য করেন। ওঁরা সব জেনে গেছেন। বলরাম বললেন, এই তো, আলিপুরদুয়ার থেকে একজন এসেছিল তার মাকে নিয়ে, গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। অপারেশন করিয়ে আজ ফিরে গেলেন। ওঁদের পৌঁছে দিতেই স্টেশনে এসেছিলাম।
আপনি কোন পাড়ায় থাকেন?
সেনপাড়ায়। আমার মনে হয় এখানে রিকশা পেয়ে যাবেন। ওই তো একটা আসছে। ডানদিকে জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। আর-একটু এগিয়ে বা দিকে চলে যাব। ভাল থাকবেন ভাই।
বলরামবাবু রিকশাওয়ালাকে বললেন হাকিমপাড়ায় যেতে। রিকশাওয়ালা বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কত ভাড়া দিতে হবে?
রিকশাওয়ালা হাসল, রেডক্রশদার লোক আপনি, বেশি ভাড়া কি নিতে পারি?
বিদায় নিয়ে রিকশায় ওঠার কিছুক্ষণ পরে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁকে চিনলে কী করে?
কী বলছেন বাবু, চিনব না? আমাদের অসুখ হলে উনি ছাড়া আর কে আছেন এখানে?
অল্পস্বল্প।
দেবী চৌধুরানির নাম শুনেছেন?
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র।
হ্যাঁ, কিন্তু তিনি বাস্তবে ছিলেন। ডান পাশে একটু হাঁটলেই একটা কালীবাড়ি দেখতে পাবেন। দেবী চৌধুরানির কালীবাড়ি। ওর চেহারা-চরিত্র অন্য যে-কোনও কালীবাড়ির থেকে আলাদা। সোজাই চলুন। প্রৌঢ় পা চালালেন।
আপনার নাম শুনতে পারি? হাসলেন প্রৌঢ়, কী নাম বলব? বাবা-মা যে নাম রেখেছিলেন সেই নাম বললে কেউ তো আর আমাকে চিনতে পারে না। সেই নামটা হল বলরাম দত্ত।
কী নামে সবাই আপনাকে চেনে?
রেডক্রশ দত্ত।
মানে? অর্ক হকচকিয়ে গেল।
ওই নামের যোগ্যতা আমার নেই। কেউ একজন শুরু করেছিল, সেটাই মুখে মুখে চাউর হয়ে চালু হয়ে গেছে। বলরাম দত্ত মাথা নাড়লেন।
এটা কী করে হল?
জুনিয়ার স্কুলে মাস্টারি করতাম। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত। চাকরির শেষদিকে একদিন জলপাইগুড়ির হাসপাতালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম একটি বউ হাউহাউ করে কাঁদছে। হাসপাতালের সামনে নতুন দৃশ্য নয়। কেউ মারা গেলে মানুষ ওইভাবে কাঁদে। কিন্তু শুনলাম কান্নার কারণ অন্য। হাসপাতাল বলেছে পেশেন্টকে এখনই শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে, এখানে তার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। অথচ পেশেন্টপার্টির কাছে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। মৃত্যু অনিবার্য বলে বউটি কাঁদছে তার স্বামীর জন্য। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কীরকম ঘোর লাগল মনে। আধঘণ্টার মধ্যে ধারধোর করে টাকা জোগাড় করে পেশেন্ট আর তার বউকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেলাম। যমে ডাক্তারের মধ্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যম হেরে গেল। হাসপাতালে পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। একটা ওষুধের দোকানের মালিক, যিনি আমার ছাত্রের বাবা, পাশে দাঁড়ালেন। ছেলেটি সুস্থ হল সাড়ে ছয় হাজার টাকার বোঝা আমার ওপর চাপিয়ে। হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল। ওর বউয়ের কাছে আমি তখন ঈশ্বরের মতো। কিন্তু কী বলব ভাই, বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, সাড়ে ছয় হাজার আমার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তার কোনও বিকল্প জীবনে পাইনি।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরা আপনাকে টাকাটা শোধ করেনি?
কী করে করবে? কোনওরকমে যাদের দিন চলে তাদের পক্ষে সম্ভব? আমাদের দেশে গরিবদের অসুখ হলে চিকিৎসা করানো বিলাসিতা। কিন্তু আমি মুশকিলে পড়লাম। বলরামবাবু হাসলেন।
কীরকম?
লোলাকে এসে আমাকে অনুরোধ করতে লাগল। প্রত্যেকের কোনও আত্মীয়ের খুব অসুখ, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে না। এমনকী সেখানকার ইসিজি মেশিনও খারাপ। ডাক্তাররা পাঠাচ্ছে নার্সিংহোমে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের নেই। না না বললেও কেস খারাপ দেখলে রাজি হয়ে যেতাম। বলতাম, যা খরচ হবে তা আপনারা জোগাড় করে আনুন, চিকিৎসা যাতে ভালভাবে হয় সেটা আমি দেখব। তবু শেষ মুহূর্তে আটকে গেলে পকেট থেকে বের করতে হয়। তখন একজনের পরামর্শে শহরের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করলাম। দশজনের মধ্যে একজন সাহায্যের হাত বাড়ালেন। কিন্তু ততদিনে আমার নাম হয়ে গেছে রেডক্রশ দত্ত। বলরাম বললেন।
কিন্তু এসব করলে আপনার নিজের সংসার কী করে চলবে?
আমার সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে করিনি, মা-ও চলে গিয়েছেন। তবে যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, অথচ লোকবল নেই, জানাশোনা কম, তারা নিজেরাই খুশি হয়ে আমাকে কিছু দেন। আর ডাক্তাররা তো বটেই, জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির হাসপাতালের স্টাফরাও আমাকে এখন সাহায্য করেন। ওঁরা সব জেনে গেছেন। বলরাম বললেন, এই তো, আলিপুরদুয়ার থেকে একজন এসেছিল তার মাকে নিয়ে, গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। অপারেশন করিয়ে আজ ফিরে গেলেন। ওঁদের পৌঁছে দিতেই স্টেশনে এসেছিলাম।
আপনি কোন পাড়ায় থাকেন?
সেনপাড়ায়। আমার মনে হয় এখানে রিকশা পেয়ে যাবেন। ওই তো একটা আসছে। ডানদিকে জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। আর-একটু এগিয়ে বা দিকে চলে যাব। ভাল থাকবেন ভাই।
বলরামবাবু রিকশাওয়ালাকে বললেন হাকিমপাড়ায় যেতে। রিকশাওয়ালা বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না।
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কত ভাড়া দিতে হবে?
রিকশাওয়ালা হাসল, রেডক্রশদার লোক আপনি, বেশি ভাড়া কি নিতে পারি?
বিদায় নিয়ে রিকশায় ওঠার কিছুক্ষণ পরে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁকে চিনলে কী করে?
কী বলছেন বাবু, চিনব না? আমাদের অসুখ হলে উনি ছাড়া আর কে আছেন এখানে?