What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

মালপত্র ম্যাটাডোরে ভোলা হয়ে গেলে সেই ট্যাক্সিটা চলে এল। দেবেশ ড্রাইভারকে খবর দিয়েছিল। মালপত্র রাখার পর ম্যাটাডোরে জায়গা যদি না হয় সেইজন্যে। ছোটমা তার ঠাকুরদের সযত্নে পুটুলিতে বেঁধে নিয়ে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পাশে সেই বউটি। ছোটমা যত মুখ ঘোরাচ্ছেন তত তার চোখ উপচে জল নামছিল। ছোটমা বললেন, এই বাগান কেটে পরিষ্কার করে ফেলবে ওরা। শেয়াল সাপগুলোকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে। সেই কতকাল আগে আমি চা-বাগানের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছিলাম। তখন ওরা, ওই গাছগুলো যেমন ছিল, তেমনই রাখতে পেরেছিলাম। শুধু আমার শরীরটা বুড়ি হয়ে গেল।

অনিমেষকে দেখা গেল, একটু এগিয়ে এসে ডাকল, চলুন, আপনারা। চোখে বারংবার আঁচল চাপতে চাপতে বারান্দা থেকে নেমে গলির মুখে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন ছোটমা। পাশে বউটি। মাধবীলতা ওপাশের দরজা খুলে বসতেই লছমনের ছেলে বাবা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ছোটমা দুহাতে নিজের কান চেপে ধরলেন। মাধবীলতা ড্রাইভার ছেলেটিকে বলল, একটু হর্ন দাও তো। কোথায় গেল।

অনিমেষ অপলক বাড়িটাকে দেখছিল। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বাড়ি ছেড়ে সে ঠাকুরদা-বড়পিসিমার সঙ্গে চলে এসেছিল এখানে। চোখের ওপর এই বাড়ি তৈরি হতে দেখেছিল। আজ সেই বাড়িটাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে চিরকালের জন্যে। আজ থেকে তার আর কোনও বাড়ি নেই। এই সময় ট্যাক্সির হর্ন সজোরে কানে ধাক্কা মারল অনিমেষের।

.

বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে ছিল, সঙ্গে একজন দাড়িওয়ালা যুবক। অর্ককে দেখে হাত তুলল। কাছে এলে সে বলল, ইনি আমাদের পার্টির একজন যুবনেতা। ওঁকে আপনার কথা বলেছি।

খানিকটা দূরেই থানা। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে যুবক বলল, আঃ, বিশু কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে নাম বলতে হয়। নমস্কার দাদা, আমি প্রতুল রায়। একটা কথা বলুন, যে মানুষটিকে নিয়ে পুলিশকে চিন্তিত করা হয়েছে তাকে আপনি কি দীর্ঘদিন চেনেন?

না। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক ঝাড়খণ্ড থেকে ওকে পাঠিয়েছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। ও কলকাতার কিছুই চেনে না।

নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন আপনি। পুলিশ মনে করে ঝাড়খণ্ডি মানেই মাওবাদী।

প্রতুলের কথা শুনে হেসে ফেলল অর্ক।

আপনি হাসছেন? প্রতুল বিরক্ত।

বাবার কাছে শুনেছি, নকশাল আন্দোলনের সময় পশ্চিমবাংলার বাইরের মানুষ ভাবত বাঙালি মানেই নকশাল। অর্ক বলল।

হুম। দেখুন, আমরা মা-মাটি-মানুষের জন্যে সংগ্রাম করছি। বামফ্রন্ট মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নন্দীগ্রাম ওদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। গরিব মানুষদের জমি সামান্য টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে বুর্জোয়া টাটাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করবই। মুশকিল হল ওদের এবারে মানুষ এখনও ভুল বুঝছেন। জঙ্গলমহলে ওদের হার্মাদ বাহিনী ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করছে তারাই নাকি মাওবাদী। অথচ মানুষ জানে না মাওবাদীদের সাপ্লাই দেওয়া হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে। প্রতুল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সযত্নে ধরাল, শুনলাম আপনার বাবা নকশাল ছিলেন। তার মানে তিনি চূড়ান্তভাবে সিপিএম বিরোধী। জেল খেটে বেরিয়ে অনেক নকশাল রাতারাতি সিপিএম হয়ে গিয়েছিলেন, আপনার বাবা হননি। আপনার অল্পবয়সে আপনি মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিপিএমের চাপে সরে আসতে বাধ্য হন। আপনাদের ওপর ওদের রাগ থাকা স্বাভাবিক। তাই আপনার বাড়িতে একজন মাওবাদী আশ্রয় নিয়েছে বললে ওরা এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে পারবে। এক, আপনাকে জেলে ঢোকাতে পারবে, দুই, পাবলিককে আরও ভয় পাইয়ে দিতে পারবে। তাই এই কারণে ওদের মুখোশ খুলতে আমরা আপনাকে সাহায্য করব। আপনি বিশুর সঙ্গে থানায় যান। তবে একটা অনুরোধ, আমাকে যা বললেন তা ওখানে বলবেন না।
 
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল।

আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি যে ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছেন এবং তাকে আপনি চেনেন না, আর একজনের সুপারিশে রাজি হয়েছেন, এ কথা পুলিশকে জানানোর কোনও দরকার নেই। শুনলেই এখন যদি ধোয়া হয়ে থাকে তা হলে তা দাউদাউ আগুন হয়ে যাবে। বুঝতে পারলেন? প্রতুল রায় বলল।

তা হলে কী বলব?

বলবেন আপনার পূর্ব পরিচিত। নর্থ বেঙ্গলে থাকেন। প্রতুল বলল। বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, নর্থ বেঙ্গল বলাই ভাল। আপনাদের বাড়ি তো ওখানেই।

প্রতুল বলল, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আশা করব সুরেন মাইতিদের সঙ্গে লড়াইয়ে আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। বিশু, তোমরা যাও। কী হল তা বেরিয়ে এসে আমাকে জানিয়ো।

.

অর্ক আর বিশ্বজিৎ থানায় ঢুকল। যে সাব-ইন্সপেক্টার দরজার ওপাশে টেবিলে ঝুঁকে কিছু লিখছিলেন, মুখ তুলে বললেন, আরে! বিশুবাবু যে। কী ব্যাপার?

বড়বাবু কোথায়?

সাব-ইন্সপেক্টার দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে শরীর একটু মুচড়ে বললেন, বিশ্রাম করছেন। এই সরকার যদি চলে যায় তা হলে তো বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যাবে না।

বিশ্বজিৎ বলল, তার মানে, তখন আপনাদের কাজ করতে হবে? নিঃশব্দে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসলেন সাব-ইন্সপেক্টার, এখনই তো আপনারা বলছেন আমাদের নাকে দড়ি লাগিয়ে হামাগুড়ি দেওয়াবেন। যাক গে, একটা সত্যি কথা বলি, তিরিশ বছর চাকরি হয়ে গেল, এমন জাঁদরেল মহিলা কখনও দেখিনি। একদম একা দেশটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। তা কী ব্যাপার, বলুন।

বড়বাবু এঁকে দেখা করতে বলেছেন। বিশ্বজিৎ বলল।

অর্কর দিকে তাকিয়ে সাব-ইন্সপেক্টার বললেন, চিনলাম না।

অর্ক হাসল, চেনার মতো কোনও পরিচয় নেই। আমি অর্ক মিত্র।

কপালে ভাঁজ পড়ল সাব-ইন্সপেক্টারের, ঈশ্বরপুকুর লেন?

হ্যাঁ। অর্ক মাথা নাড়ল।

হয়ে গেল। কোথায় পালিয়ে গিয়ে গা-ঢাকা দেবেন, না নিজেই চলে এসেছেন খাঁচায় ঢুকতে! সুরেন মাইতি তো বলে গেল আপনি ডেঞ্জারাস লোক। সাব ইন্সপেক্টার একজন সেপাইকে ডাকল, দেখো তো, বড়বাবু কী করছেন।

চা খাচ্ছেন।

অ উঠে দাঁড়ালেন সাব-ইন্সপেক্টার, আসুন।

বন্ধ দরজা ঠেলে সাব-ইন্সপেক্টার ভেতরে ঢুকে গেলে বিশু নিচু গলায় বলল, শুনলেন তো, সুরেন মাইতি কী চিজ। বলুন।

ঘরের ভেতরে ঢুকে ওরা দেখল ঘরোয়া পোশাকে বড়বাবু বসে চা খাচ্ছেন। তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সাব-ইন্সপেক্টার কিছু বললেন। সেটা শুনে মুখ তুললেন বড়বাবু। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আসতে পারি?

ঘরে ঢোকার পরে এ কথা জিজ্ঞাসা করার কোনও মানে নেই। আসুন। বসুন।

সাব-ইন্সপেক্টার বললেন, উনি বিশ্বজিৎবাবু। তৃণমূল নেতা। ইনি অর্ক মিত্র।

বড়বাবু বিশ্বজিতের দিকে তাকালেন, বলুন, আপনার কী সমস্যা?

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, আমি অর্কদার সঙ্গে এসেছি।

অ্যা? চমৎকার। কিন্তু আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। ও। আমি তা হলে বাইরে অপেক্ষা করছি।

আপনার ইচ্ছে।

এটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে নয়। অর্কদা, আপনি কথা বলুন। বিশ্বজিৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সাব-ইন্সপেক্টার ওকে অনুসরণ করছিলেন কিন্তু বড়বাবু তাকে থামালেন, এঁকে আমার কাছে নিয়ে আসার আগে সার্চ করেছেন?

না স্যার!

কী আশ্চর্য! আপনার যে কেন প্রমোশন হচ্ছে না তার কারণ জানতে চেয়েছিলেন না?
 
বড়বাবুর ধমক খেয়ে সাব-ইন্সপেক্টার এগিয়ে এসে অর্কর শরীর, পকেট খুঁজে দেখে হাসলেন, না স্যার, কিছুই নেই। সিগারেটের প্যাকেটও নেই।

যান। বড়বাবু বলমাত্র সাব-ইন্সপেক্টার বেরিয়ে গেলেন।

বড়বাবু বললেন, আপনি বসুন।

অর্ক টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড়বাবু বললেন, আপনি মাওবাদীদের ঘনিষ্ঠ, তাদের আশ্রয় দিয়েছেন বলে আপনার এলাকার বামপন্থী নেতা আমাদের জানিয়েছেন। কাজটা কতদিন ধরে করছেন?

আমি জ্ঞানত এরকম কাজ কখনও করিনি।

কলকাতায় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মাওবাদী সমর্থকের সংখ্যা প্রচুর। এরকম কার কার সঙ্গে আপনার সরাসরি যোগাযোগ আছে?

আমি তাদের কাউকেই চিনি না।

যে লোকটিকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন তার নাম কী?

রাম, রামচন্দ্র। ইচ্ছে করে রামজি বলল না অর্ক।

রামচন্দ্র। টাইটেল কী?

রামচন্দ্র রায়।

কতদিন চেনেন ওকে?

অনেকদিন।

ওর বাড়ি কোথায়? কোত্থেকে এসেছিল?

শিলিগুড়ি। এখানে ওর পরিচিত কেউ নেই বলে থাকতে চেয়েছিল।

আপনি কী করেন?

চাকরি।

তৃণমূলে ঢোকার আগে কী করতেন?

আমি তৃণমূলে ঢুকিনি। কোনও দলেরই সমর্থক ছিলাম না।

তা হলে ওই তৃণমূল নেতা আপনার সঙ্গে কেন এলেন?

আমরা একই পাড়ায় থাকি।

বড়বাবু সোজা হয়ে বসলেন, আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

মা এবং বাবা।

তাঁরা রামচন্দ্রকে দেখেছেন?

না। তারা এখন জলপাইগুড়ির বাড়িতে আছেন।

বড়বাবু হাসলেন, চমৎকার। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন। কলকাতায় রামচন্দ্র কী কাজে এসেছিলেন?

আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করিনি।

একজন লোক আপনার বাড়িতে এসে থাকছে, কেন এসেছে, কী কাজ করতে এসেছে তা জানার আগ্রহ আপনার নেই? মিথ্যে বলছেন। বড়বাবু ঠোঁট মোচড়ালেন।

অর্ক একটু ভাবল, আপনাকে সুরেন মাইতি বলেছে যে ও মাওবাদী?

আরও বেশি বলেছে। আচ্ছা, এই রামচন্দ্র এখন কোথায়?

ও চলে গেছে। এর বেশি কিছু জানি না।

কিন্তু জানি না বললে তো চলবে না। জানতেই হবে।

মানে? অর্ক অবাক হল।

আপনাকে আমি চারদিন সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে ওই সো কলড রামচন্দ্রকে খুঁজে বের করে আমাকে জানাতে হবে।

আশ্চর্য! আমি কোথায় খুঁজব?

সেটা আপনার সমস্যা। মাথা দোলালেন বড়বাবু।

আপনি অযথা আমার ওপর চাপ তৈরি করছেন। একটু গলা তুলল অর্ক।

এখনও করিনি। আমার কথা না শুনলে সেটা করব।

মানে?

আমি আপনার সঙ্গে এতক্ষণ ভদ্রভাবে কথা বলেছি কারণ এটা আমার স্বভাব। কিন্তু আপনি যদি সমানে মিথ্যে বলে যান, আমাদের কোনও সাহায্য না করেন তা হলে যেটা স্বাভাবিক তাই করা হবে। অর্কবাবু, আপনি আপনার বাড়িতে যাকে আশ্রয় দিয়েছেন তার সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না বললেন, কোনও বাচ্চা ছেলেও এ কথা বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি চারদিনের মধ্যে তার খবর আমাকে না দেন, তা হলে আমি ধরে নেব আপনিও একজন মাওবাদী। আপনি দেশের শত্রু। আপনি জঙ্গলমহলে গিয়ে অস্ত্র ধরেননি বটে কিন্তু শহরে থেকে তাদের মদত দিচ্ছেন। আপনাকে নিয়ে এসে ওষুধ প্রয়োগ করলেই মিথ্যের বদলে সত্যি কথাগুলো বলতে শুরু করবেন। আপনার দল বলছে পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী বলে কিছু নেই। তা হলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সিপিএমের কর্মীদের খুন করছে কারা? এখন আপনার ওপর নির্ভর করছে আপনি কী চান। বড়বাবু টেবিলে রাখা বেল বাজালেন।

একজন সেপাই ঘরে ঢুকলে বড়বাবু বললেন, ওই তৃণমূলি নেতা কি আছেন?

হ্যাঁ স্যার।

ডাকো তাকে।

সেপাই গিয়ে খবর দিলে বিশ্বজিৎ ঘরে ঢুকল। বড়বাবু বললেন, আপনার পাড়ার লোক মনে করছে ইনি মাওবাদীদের আশ্রয় দিয়েছেন। আমি এঁকে অনুরোধ করেছি লোকটার হদিশ আমাকে দিতে। ঠিক আছে, যেতে পারেন।

বিশ্বজিৎ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বড়বাবু হাত নাড়লেন, না, কিছু বলতে হবে না। আপনি সঙ্গে এসেছেন বলে ওকে আজই অ্যারেস্ট না করে একটা সুযোগ দিলাম। আসুন আপনারা।

কোনও কথা না বলে বিশ্বজিৎ অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে সে জিজ্ঞাসা করল, লোকটা এখন কোথায় বলুন তো?
 
অর্ক মাথা নাড়ল, যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেছে। বিশ্বজিৎ সন্দেহের চোখে অর্ককে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে আমরা সাহায্য করতে চাইছি কেন জানেন? আপনি তৃণমূল দূরের কথা, কখনও কংগ্রেসই করেননি। কিন্তু আমাদের শত্রু যখন আপনার সঙ্গে শত্রুতা করছে তখন আপনাকে মিত্র ভাবাই যেতে পারে। যাক গে, চারদিনের মধ্যে লোকটার খবর বড়বাবুকে দিয়ে যাবেন।

আমি খুব বিপদে পড়লাম বিশ্বজিৎ।

বিশ্বজিৎ তাকাল। এবার দৃষ্টি নরম। বলল, আপনি আমাদের পার্টি অফিসে আসুন।

কেন?

আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে হয়তো আপনার বিপদ কেটে যেতে পারে। বিশ্বজিৎ বলল, আচ্ছা অর্কদা, আমি এখন যাচ্ছি। বিকেলে পার্টির অফিসে থাকব।

বিশ্বজিৎ চলে গেলে অর্ক চুপচাপ হাঁটতে লাগল। রাস্তায় নোকজন বেড়ে গেছে। সে পেছন দিকে তাকাতেই একজোড়া বুটজুতো দাঁড়িয়ে গেল। এখনও পাঞ্জাবি এবং ধুতির নীচে বুটজুতো পরার অভ্যেস যারা ছাড়তে পারেনি তাদের চিনতে অসুবিধে হয় না। লোকটা কি তাকে অনুসরণ করছে?

অর্ক খানিকটা হেঁটে ফুটপাথ বদল করলে দেখা গেল লোকটাও রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির জন্যে দাঁড়িয়ে গেছে। সন্দেহ সত্যি হতেই অর্ক উলটোদিক থেকে আসা একটা বাসে উঠে পড়ল। বাসটা লাল আলোয় দাঁড়িয়েছিল। ওঠামাত্র আলো বদলাতে বাস যখন চলতে শুরু করল তখনও লোকটা পৌঁছোতে পারেনি। বড়বাবু তাকে চোখের আড়ালে রাখতে চাইছেন না। এটা আর একটা চাপ তৈরি করল।

শ্যামবাজারের মোড়ে বাস থেকে নেমে কিছু একটা করার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট আর দেশলাই কিনল অর্ক। সিগারেট সে খায় না, কখনও শখ হলে একটা যদি খায় তা হলে তাকে খাওয়া বলে না। আজ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া টানার পর আচমকা বেশ ভাল লাগল। পাঁচ মাথার মোড়ের ফুটপাত ঘেঁষা রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবার চেষ্টা করল, কী করা উচিত।

এ কথা সত্যি, ঠিক কোন জায়গায় এখন রামজি আছে তা সে জানে না। রামজি যে সূত্র তাকে দিয়ে গিয়েছিল সেটা পুলিশকে জানালে ওরা নিশ্চয়ই একটা হদিশ পেয়ে যাবে। কিন্তু–।

মাথা নাড়ল অর্ক। রামজি তাকে বলেনি, অন্তত খোলাখুলি বলেনি ও কেন পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। ও মাওবাদী স্কোয়াডের সদস্য কি না তাও জানায়নি। অর্ক অনুমান করেছে। যারা সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে রামজি তাদের সঙ্গে আছে। কিন্তু সেই অনুমানের ওপর নির্ভর করে ছেলেটার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা কি উচিত কাজ হবে? আবার এমনও তো হতে পারে রামজির দেওয়া সূত্রগুলিকে জানিয়ে দিলে যদি পুলিশ ওকে খুঁজে না পায় তা হলে নির্ঘাত ধরে নেবে সে ওদের ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। তখন যা হবে তা কল্পনাও করতে পারছে না সে।

মোবাইল বেজে উঠতেই সেটা পকেট থেকে বের করে সামনে ধরতেই মা শব্দটা দেখতে পেল অর্ক। বোতাম টিপে সে বলল, বলো।

তুই কোথায়? মাধবীলতার গলা।

শ্যামবাজার।

অফিসে যাসনি?

যাওয়া হয়নি। কেন?

বাড়ি পরিষ্কার আছে তো?

তোমরা কি আসছ?

হ্যাঁ। আজ টিকিটের জন্যে চেষ্টা করা হবে। ভি আই পি কোটায় বোধহয় পাওয়া যাবে।

ভি আই পি কোটায়? অর্কর গলায় বিস্ময়।

যাওয়ার আগে ফোন করব। খোলা রাখিস।

বাড়ির কী ব্যবস্থা হল?

যা হয়েছে তার চেয়ে ভাল এই মুহূর্তে হতে পারত না। রাখি।
 
ফোনটা কেটে দিল মাধবীলতা। মন খারাপ হয়ে গেল অর্কর। মাধবীলতা তার সঙ্গে যে গলায় কথা বলল তাতে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই। তাকে মা এখন দূরের মানুষ বলে ভেবে নিয়েছে। বাবার এই ব্যাপারে ভূমিকা থাকলেও মা তাতে প্রভাবিত হওয়ার মহিলা নয়। ওরা কাল বা পরশু এখানে ফিরে এলে নিশ্চয়ই সুরেন মাইতির লোকজন সাতকাহন করে সব শোনাবে। রামজিকে নিয়ে মায়ের প্রচুর ঔৎসুক্য ছিল, খানিকটা সন্দেহও। এখানকার কথা শোনার পর সেটা মায়ের কাছে নির্ভুল বলে মনে হবে। স্বামীর জন্যে যে মহিলা সারা জীবন স্যাক্রিফাইস করে এলেন, ছেলের জন্যে সেটাই তিনি মেনে নেবেন না।

তা হলে তার কী করা উচিত?

এই যে মশাই, আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?

অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল অলকা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

ও, আপনি?

আপনাকে খবরটা দেওয়া হয়নি। মেয়ে আবার স্কুলে যাচ্ছে।

বাঃ। ভাল খবর।

কিন্তু আপনার সম্পর্কে যেটা শোনা যাচ্ছে তা কি সত্যি?

কী শুনছেন তাই তো জানি না।

আপনি নাকি ভয়ংকর মাওবাদীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার কাছে এ কে ফর্টি সেভেন রাইফেল ছিল। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।

হেসে ফেলল অর্ক। মুখে কিছু বলল না।

অলকা হাসার চেষ্টা করল, আপনাকে হয়তো বিরক্ত করলাম। চলি।

ওর চলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে অর্কর মনে হল, যেতে পেরে ও যেন বেঁচে গেল। সেই গায়ে-পড়া আত্নাদি ভাবটা একদম উধাও হয়ে গিয়েছে।

দেখতে দেখতে প্রবল চাপ অনুভব করল অর্ক। সে কোনও অন্যায় করেনি, কোনও দেশবিরোধী কাজ করেনি। তা হলে তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা থাকবে না কেন?

.

দেবেশ গিয়েছে নিউ জলপাইগুড়িতে, ফিরবে দুপুরের পরে। অনিমেষ আশ্রমের বাগানে চেয়ার পেতে বসে ছিল। মাথার ওপর বেশ বড়সড় কাঁঠাল গাছ থাকায় রোদ নামছিল না নীচে। এখন আকাশ জুড়ে শুধু নীল আর নীল। কালচে দুরের কথা সাদা মেঘের টুকরোগুলোও সেখানে ভাসছে না। এই আকাশ কলকাতায় দেখা যায় না। এখানে সে অনেক কিছু পাচ্ছে যা কলকাতায় পাওয়া যায় না। জোরে শ্বাস নিলে বুক ভরে শান্তি নামে। এই মাটি গাছগুলোকে বন্ধু বলে মনে হয়। কান খাড়া করলেও শুধু পাখির গলা। আর হাওয়ার শব্দ দুই কানে মোলায়েম আরাম ছড়িয়ে দেয় যা কলকাতায় মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যাবে না। সেখানে শুধু মানুষের তৈরি উৎকট শব্দ সারাক্ষণ কানের পরদাকে বিব্রত করে রাখে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বেকার ছোঁড়াগুলো অকারণেই শব্দ তৈরি করে উল্লসিত হয়।

একেবারে দুহাত দূরে কাঠবিড়ালিটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। কাঁঠাল গাছ থেকে নেমে এসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনের দুটো পায়ের ওপর ভর করে সোজা দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। বেশ মজা লাগল অনিমেষের। ঠিক তখনই পেছন থেকে আর একটা কাঠবিড়ালি তীব্র স্বরে ডেকে উঠল। পঁড়িয়ে থাকা কাঠবিড়ালি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল একবার কিন্তু নড়ল না, এবার পেছনের কাঠবেড়ালি দৌড়ে এসে যেভাবে সঙ্গীকে ধাক্কা দিয়েই ফিরে গেল তাতে না হেসে পারল না অনিমেষ। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনওমতে নিজেকে সামলে সঙ্গীকে অনুসরণ করল সে, ওরা কি স্বামী স্ত্রী? অথবা প্রেমিক প্রেমিকা? এবার অনিমেষ লক্ষ করল শুধু ওরা দুজন নয়, এই বাগানে প্রচুর কাঠবিড়ালি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অনি।

নিজের নামটা কানে যেতেই অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে ছোটমাকে দেখতে পেল। পরনে সাদা শাড়ি কিন্তু তাতে নীলের আলপনা রয়েছে। অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল কিন্তু ছোটমা হাত নাড়লেন, না না, উঠতে হবে না। তোমরা কি আজই চলে যাচ্ছ?

দেবেশ গিয়েছে এনজেপিতে। যদি টিকিট পায় তা হলে–। কথা শেষ করল না অনিমেষ।

তুমি তো শ্ৰাদ্ধশান্তিতে বিশ্বাস করো না, তাই না? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ হাসল, মুখে কোনও কথা বলল না।

আসলে তোমার বাবা, বড়পিসিমা, ঠাকুরদা চলে গেছেন অনেককাল আগে। আমার আয়ু আর কতদিন তা জানি না। তুমি মানো না জেনেও বউমার সঙ্গে কথা বলেছি। বউমা রাজি হয়েছে। তুমি তাকে বাধা দিয়ে না।

কী ব্যাপারে রাজি হয়েছে মাধবীলতা?

গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধের কাজ করতে।

অ্যাঁ? মাধবীলতা আপনাকে বলেছে এ কথা?

হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছি একেবারে চারজনের কাজ যেন করে সে।

হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, চারজন? ওঁরা তো তিনজন। চতুর্থজন কে?

ছোটমা হাসলেন, আমি।

কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে অনিমেষ বলল, এই কাজটা করতে মাধবীলতা রাজি হয়েছে?

ছোটমা বললেন, প্রথমে হয়নি। আমি অনেক বলার পরে নিমরাজি হয়েছে। তোমাকে নিশ্চয়ই বলবে। তুমি নিজে ইচ্ছুক না হলেও ওকে বাধা দিয়ো না।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি না এসব কী হচ্ছে!

পৃথিবীতে অনেক কিছুই হয় যা মানুষ বুঝতে পারে না। ছোটমা বললেন।

আচ্ছা সেই কবে দাদু-বড়পিসিমা চলে গিয়েছেন। বাবা গত হয়েছেন বহু বছর হয়ে গেল। আত্মা আছে কি না তার কোনও প্রমাণ মানুষ পায়নি। শুধু কল্পনা করে তার অস্তিত্ব প্রচার করেছে। তর্কের খাতিরে যদি ওই কল্পনা করি তা হলে এত বছরে তাদের একটা গতি হয়ে গিয়েছে। গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করা হয়নি বলে তারা পৃথিবীতে বন্দি হয়ে নিশ্চয়ই নেই।

তুমি কী করে বুঝছ যে তাদের আত্মা মুক্তি পেয়েছে?

আমি কোথাও পড়িনি, কারও মুখে শুনিনি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মার মুক্তির জন্যে গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করা হয়েছে। তা যদি না করা হয়ে থাকে তা হলে হেসে ফেলল অনিমেষ, কী উদ্ভট কথা।
 
ছোটমা গম্ভীর হলেন, অনি, তোমার কাছে এসব উদ্ভট বলে মনে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। তা ছাড়া এতদিন তো এসব আমার মাথায় আসেনি। আজ এল। যে বাড়িতে তোমার দাদুর মনপ্রাণ পড়ে ছিল, যেখানে তোমার বড় পিসিমা, বাবা অনেককাল থেকেছেন সেই বাড়ি চিরকালের জন্যে ছেড়ে চলে এলাম। আজ বাদে কাল প্রোমোটার বাড়িটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো চার-পাঁচতলা বাড়ি তুলবে। তখন সেই বাড়িতে তোমার পূর্বপুরুষের কোনও স্মৃতিচিহ্ন থাকবে না। তুমি ভাবো তো, তোমার দাদু বেঁচে থাকলে, যত অভাব হোক, নিজের হাতে তৈরি বাড়িটাকে বিক্রি করতেন? মানুষ যদি কাউকে বা কিছুকে খুব ভালবাসে তা হলে তার চলে যাওয়ার পরে সেই ভালবাসাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। তুমি বিশ্বাস করো না, কিন্তু আমি করি। ওই জমিতে নতুন বাড়ি তৈরি হওয়ার আগেই ওঁদের আত্মার শান্তি হওয়া উচিত। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, গয়ায় শ্রাদ্ধ করলেই সেটা সম্ভব হয়। আমি পথঘাট চিনি না, শরীরও ভাল না, তা না হলে নিজেই যেতাম। মাধবীলতা বিচক্ষণ মেয়ে। আমার কথা ওর পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছে কারণ ও আমাকে হতাশ করতে চায়নি।

তা হলে তো হয়েই গেল। কিন্তু তোমার নাম জুড়লে কেন?

এবার হাসলেন ছোটমা, শখ হল।

শখ?

এই যে তোমরা এসে আমার কত উপকার করে যাচ্ছ, আবার কবে আসবে তা তো জানি না। ভেবে দেখো, কত বছর পরে এলে। আমি চলে গেলে নিশ্চয়ই খবর পাবে কিন্তু তখন তো আমি থাকব না। তাই জানতেও পারব না আমার শ্রাদ্ধ কেউ করল কি না? মাধবীলতা করে দিলে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারব। মরার পর আর এই পৃথিবীর মুখ দেখতে হবে না। ছোট মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার ভেসে এল, নতুন দিদা, নতুন দিদা!

ছোটমা ব্যস্ত হয়ে বাগানের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী?

এই সময় ছেলেটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছেলেটি দুদিকে দুটো হাত ছড়িয়ে বলল, ইয়া বড়া সাপ। মুরগির বাচ্চাদের খেতে ছুটে আসছিল। দেখতে পেয়ে আমি মাটিতে লাঠির বাড়ি মারতে ভয় পেয়ে পুকুরের জলে নেমে গেছে। কিন্তু ব্যাটা আবার আসবে। কী হবে?

চল, দেখি গিয়ে। মুরগির বাচ্চারা এখন কোথায়?

পুকুরের পাশেই মায়ের সঙ্গে ঘুরছে।

ওদের ওখান থেকে সরাতে হবে। চল, চল!

ছোটমা যে গতিতে ছেলেটির সঙ্গে অদৃশ্য হলেন তাতে অনিমেষের মনেই হল না ওঁর শরীর ভাল নয়। ক্রাচ টেনে নিয়ে অনিমেষ উঠল। ওরা যেদিকে গিয়েছে সেই দিকে কিছুটা হাঁটতেই পুকুর চোখে পড়ল। ছোটমা খানিকটা ঝুঁকে তু তু করে ডাকছেন যাদের সেই মুরগি-মা এবং তার ছানারা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে। ছোটমা ছেলেটাকে কিছু বলতেই সে ছুটে আশ্রমের পেছন দিকে চলে গেল।

অনিমেষ কাছে পৌঁছে জিজ্ঞাসা করল, এরকম মুরগিছানা কত আছে?

আছে, তবে তারা একটু বড় হয়ে গেছে। বিপদ বুঝলে পালাতে পারে। এরা একেবারেই শিশু। জ্ঞানগম্যি হয়নি এখনও। বলেই ছোটমা চেঁচালেন, না, ওদিকে নয়। খুব বকব ওদিকে গেলে।

মুরগিছানাগুলো জলের দিকে যাচ্ছিল, ধমক শুনে থমকাল। সঙ্গে সঙ্গে মুরগি-মা ডেকে উঠতেই ওরা ফিরে গেল তার কাছে।
 
অনিমেষ পুকুরের দিকে তাকাল। ওখানে নাকি প্রচুর মাছ বড় হচ্ছে। কিন্তু সাপ থাকলে তারা কি আর বড় হতে পারবে? হঠাৎ চোখে পড়ল পাড় থেকে খানিকটা দূরে জলের ওপর একটা মাথা যেন উঁচু হয়ে আছে। অনিমেষ উত্তেজিত হল, সাপ।

ছোটমা তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই।

তার মানে?

ওটা জলঢোঁড়া। বিষ নেই কিন্তু খুব বদমাশ। ছোটমা একটা নুড়ি তুলে ছুঁড়ে মারতেই মাথাটা জলের তলায় চলে গেল। এই সময় ছেলেটা একটা প্যাকেট নিয়ে এসে ছোটমায়ের হাতে দিল। তিনি একটু একটু করে চাল ছড়িয়ে মা-মুরগি এবং তার ছানাদের আশ্রমের পেছনে নিয়ে গেলেন।

দৃশ্যটি দেখতে খুব ভাল লাগল অনিমেষের। এবারে জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসে অনেকদিন থেকে ছোটমাকে যেরকম দেখেছিল তার সঙ্গে এই ছোটমার কোনও মিল নেই, যেন নতুন জন্ম হয়ে গেছে ওঁর। অনিমেষের খেয়াল হল, নিবারণবাবুর বাড়ির বউটি সেই যে এখানে এসেছে তারপর থেকে তাকে আর দেখতে পায়নি সে। নিশ্চয়ই সে মনের মতো কাজ পেয়ে গেছে। ছোটমা তাকে নিয়ে অবশ্যই ভাল থাকবেন। এই সময় সাপটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। একটু ওপাশের পুকুরের জল থেকে ওপরে উঠে আসছে ধীরে ধীরে। তার লক্ষ্য যে আশ্রমের পেছন দিক সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ছোটমা বললেন ওই সাপ নির্বিষ। কিন্তু বেশ মোটা এবং অনেকটাই লম্বা। ও যে মুরগির বাচ্চাদের লোভ এখনও ছাড়েনি তা আশ্রমের পেছন দিকে যাওয়ার চেষ্টাতেই বোঝা যাচ্ছে, অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গেল। সে যতটা সম্ভব দ্রুত ক্রাচ নিয়ে চলে গেল সাপের কাছে। সাপটা নির্বিকার। হয়ে এগোচ্ছিল। অনিমেষকে আসতে দেখে মুখ ফিরিয়ে হাঁ করল। কিছু না ভেবেই অনিমেষ মাথার কিছুটা নীচে ক্রাচের লোহা বাঁধানো নীচের অংশটি যতটা জোরে সম্ভব চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে সাপটা শরীর দুমড়ে লেজটাকে ওপরে এনে ক্রাচটাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। অনিমেষ কিছুতেই ক্ৰাচটাকে সাপের শরীর থেকে সরাচ্ছিল না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এভাবে বেশিক্ষণ চেপে ধরে থাকতে সে পারবে না। সাপের লেজের টানে ওটা যে-কোনও মুহূর্তেই উঠে আসতে পারে। অনিমেষ চিৎকার করল। দুবার চিৎকার করতেই ওপাশের বাগানে কাজ করা কয়েকজন বৃদ্ধ দ্রুত চলে এসে দৃশ্যটা দেখতে পেলেন। তারপর তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় সাপটাকে বেঁধে ফেললেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কিছু হয়নি তো?

না। তবে আপনারা না এলে হয়তো হত।

আপনি খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এটা ঠিক করেননি।

হঠাৎ মনে হল মুরগির বাচ্চাগুলো সাপটা খেয়ে নেবে। মনে হওয়ামাত্র এগিয়ে এসেছিলাম। অনিমেষ হাসল।

হাসছেন যে? একজন জিজ্ঞাসা করল।

আমাদের চারপাশে এরকম কত সাপ প্রতিদিন হাঁ করে বসে আছে দুর্বল মানুষদের গিলে ফেলতে, দেখেও মুখ ঘুরিয়ে থাকি। এগিয়ে গিয়ে আটকাবার চেষ্টা করি না। অনিমেষ বলল।

.
 
অনিমেষ তার ক্রাচের সাহায্যে একটা মোটা লম্বা সাপ ধরেছে এই খবরটা আশ্রমের সবাই জেনে গেল। তাদের সবাই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা আহত সাপটাকে দেখে গেল। অনিমেষ লক্ষ করল মাধবীলতা এদের সঙ্গে সাপ দেখতে আসেনি।

সে ফিরে গেল আশ্রমের ভেতরে। সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল কীভাবে সে সাপটাকে আটকাল? উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে গেল সে। শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পেতেই আশ্রমের পেছনে চলে এল। সেখানে বড় বড় তারের খাঁচায় হাঁস এবং মুরগিদের সংসার। ছোটমা ছেলেটির সঙ্গে তাদের পরিচর‍্যা করছেন। তাকে দেখে বললেন, সাপটাকে মেরে ফেললে?

মরেনি। বেঁধে রাখা হয়েছে। একটু আহত হয়েছে।

কোনও দরকার ছিল? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

অবাক হল অনিমেষ। কী বলছ? ওটা তো এদিকে আসছিল মুরগির বাচ্চাদের খাওয়ার জন্যে।

খেতে আসছিল মানেই খাওয়া নয়। আমরা যদি এদের ঠিকঠাক আগলে রাখি তা হলে সাপ খাবে কী করে? ওটাও তো একটা প্রাণী। ওকেও তো বাঁচতে হবে। এই, চল। ছোটমা ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেলেন। অনিমেষের খেয়াল হল দেবেশ এখনও ফোন করেনি। যে সময়ে সে আশ্রম থেকে বের হয়েছে তাতে অনেক আগেই এনজেপি স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া উচিত। ফোন করেনি মানে ধরে নেওয়া যেতে পারে আজকের কোনও ট্রেনে টিকিট পায়নি। টিকিট না পাওয়া মানে এখানেই থাকতে হবে।

থাকতে তার খারাপ লাগছে না। বহুদূরের হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়া বাসের ঈষৎ আওয়াজ ছাড়া কোনও যান্ত্রিক শব্দ এখানে শোনা যায় না। পাখির ডাক, হাওয়ার শব্দ আর মাঝে মাঝে আশ্রমে পালিত গোরু ছাগলের ডাক এখানকার নির্জনতাকে সমৃদ্ধ করে। এই গাছগাছালি, পুকুরে জলের শিশু ঢেউ দেখতে দেখতে দিন চমৎকার কেটে যায়। এইরকম পরিবেশে সে। স্বর্গভেঁড়াতেও থাকেনি।

স্বৰ্গছেঁড়া এখান থেকে বড়জোর পঁচিশ মাইল দূরে। বাসে প্রায় এক ঘণ্টা লাগত সে সময়ে। শৈশব-বাল্যকালের সেই জায়গাটার এত কাছে এসেও যাওয়া হল না। অনিমেষ হাসল, মানুষের জীবনে না শব্দটি বারংবার ফিরে ফিরে আসে। একটু তৃপ্তির সঙ্গে অনেকটা অতৃপ্তি চাকার মতো ঘোরে।

গতকাল এখানে আসার পরে মাধবীলতার সঙ্গে দেখা হয়নি। এই আশ্রমে। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা আলাদা। অনিমেষ শুয়েছিল দেবেশের ঘরে। কাল দুবেলা খাওয়ার সময় বয়স্করা পরিবেশন করেছিলেন, মাধবীলতা ছিল রান্নাঘরে। অর্থাৎ অনিমেষকে না দেখেই একটা দিন বেশ কাটিয়ে দিল মাধবীলতা।

তুমি এখানে? শুনলাম একটা সাপকে ধরতে সাহায্য করেছ? বলতে বলতে মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়াল।

তুমি তো দেখতে গেলে না।

জখম হওয়া প্রাণীকে দেখতে আমার খারাপ লাগবে। স্নানঘরে জল তুলে দিয়েছি, চান সেরে নাও। মাধবীলতা বলল।

অনেক ধন্যবাদ।

আরে। এভাবে কথা বলছ কেন?

কারণ তুমি এখন আমার সঙ্গে কথা না বলেই সিদ্ধান্ত নিতে পারো। আমার মতের বিরুদ্ধে যেতে তোমার এখন কোনও আপত্তি নেই।
 
বুঝতে পারলাম। মাধবীলতা হাসল, সারা জীবন তুমি যা বলেছ, যাতে তোমার খারাপ না লাগে সেইমতো কাজ করে এসেছি। অনেক সময় পছন্দ না হলেও সেটা তোমাকে জানাইনি। কিন্তু একটা সময় তো মনে হয়, আমিও একজন মানুষ, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু কাজ করি। তোমার পরিবারের পাশে তুমি কখনও দাঁড়াওনি, অবশ্য সেই ক্ষমতা শরীরের জন্যে তোমার ছিল না। আমিও তোমাকে অনুসরণ করে গেছি। ওই বাড়িটাকে এতকাল বুক দিয়ে যিনি আগলে রেখেছিলেন, তিনি যদি আমাকে একটা অনুরোধ করেন তা হলে তা আমি পছন্দ না করলেও শুধু তার শান্তির জন্যে করতে চাই। কাউকে তৃপ্তি দিয়ে নিজেকে সংকুচিত করতে আমার আপত্তি নেই। তুমি স্বামীর ভূমিকা নিয়ে আমাকে নিষেধ করবে বলেই আমি তোমাকে জানাইনি।

বাঃ। চমৎকার। এখন থেকে আমরা যে যার মতো ভাবব?

আমি সে কথা একবারও বলিনি। ভাবতে পারো কিন্তু দোহাই খেয়োখেয়ি কোরো না। কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমি দুরাতের জন্যে গয়া থেকে ঘুরে আসব।

তিনজন মৃত মানুষ আর একজন জীবিত মানুষের আত্মার শান্তির জন্যে।

ওহো। তাই তো। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। মাধবীলতা বলল।

তুমি তো কিছুই ভোলো না।

হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার মুখ থেকে শুনেছিলাম। তুমি যখন কলেজ হস্টেলে ছিলে তখন একদিন তোমার দাদু সরিৎশেখর মজুমদার আচমকা উপস্থিত হয়েছিলেন। তার মাথা কামানো ছিল এবং বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তোমার কি এখনও সে কথা মনে আছে? মাধবীলতা তাকাল।

হ্যাঁ, মনে আছে।

তা হলে তিনজন মৃত মানুষের শ্রাদ্ধের কথা বলছ কেন? তোমার দাদু। তো বেঁচে থাকতেই নিজের শ্রাদ্ধ গয়ায় গিয়ে করে এসেছিলেন, তাই না? তা হলে তার পুত্রবধূ হয়ে ছোটমার একই ইচ্ছে হলে তোমার কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। দুজন মৃত এবং একজন জীবিত মানুষ, যারা তোমার পরিবারের তাদের জন্যে আমি যেতেই পারি। মাধবীলতা হেসে চলে যাচ্ছিল কিন্তু অনিমেষ বলল, হিসেবে ভুল হল। আমার মাকে বাদ দিচ্ছ কেন?

তোমার মায়ের কথা ছোটমা আমাকে বলেননি। আমি তো নিজে কাজটা করতে যাচ্ছি না। উনি যাঁদের কথা বলেছেন, শুধু তাদের কাজ করব। মাধবীলতা বলল, যাও, স্নান করে নাও।

শোনো, আমি কদিন এখানে থেকে যেতে চাই।

হঠাৎ?

এই আশ্রমে এসে আমার ভাল লাগছে, তাই।

ভাল তো আমারও লাগছে। রিটায়ার করার পর যে হাঁপিয়ে পড়া জীবনযাপন করছিলাম এখানে এসে মনে হচ্ছে মুক্তি পাচ্ছি। তুমি দেবেশবাবুর সঙ্গে কথা বলো না, ছোটমায়ের মতো আমরাও যদি এখানে থেকে যাই।

আমি কদিন থাকতে চেয়েছি। সারা জীবন নয়। তুমি যদি সারা জীবন থাকতে চাও তা হলে দেবেশ এলে কথা বলল।

তুমি কলকাতায় আর আমি এখানে। পারবে? মাধবীলতা তাকাল।

মানুষ পারে না এমন কোনও কাজ নেই। অনিমেষ বলল।

অনিমেষ। অনিমেষ। ডাকতে ডাকতে দেবেশ চলে এল সামনে, বলল, তোরা দুজন এখানে? তৈরি হয়ে নে। তিস্তাতোর্সায় তোদের টিকিট পেয়েছি। এই কাছেই জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দেব। কিন্তু বেশি সময় নেই। আমি মোবাইলে তোদের কিছুতেই ধরতে পারিনি। এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে নে। দেবেশ যেমন এসেছিল তেমন চলে গেল।

মাধবীলতা হাসল, দেবেশকে বললে না তো আরও কদিন এখানে থাকতে চাও। অনিমেষ কথা না বলে দ্রুত সামনে থেকে সরে গেলে মাধবীলতা মোবাইল বের করে অর্কর নাম্বার টিপল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুনতে পেল, আউট অফ রিচ।

.
 
ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখেই সুরেন মাইতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কয়েকজন অল্পবয়সি ছেলেকে উত্তেজিত হয়ে কিছু বোঝাচ্ছে। শ্রোতাদের একজন ইশারায় অর্কর কথা বলতেই সুরেন মাইতি ঘুরে দাঁড়াল। একেবারে মুখোমুখি বলে অর্ক ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এনে গলির ভেতর ঢুকতে যাচ্ছিল কিন্তু সুরেন মাইতি শূন্যে হাত তুলেছে দেখে তাকে থামতে হল। সে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?

শ্রোতাদের কিছু বলে সুরেন মাইতি এগিয়ে এল, বাড়িতে ফিরছেন নিশ্চয়ই, চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।

অর্ক বুঝতে পারল তার সঙ্গে আলাদা কথা বলার জন্যেই সুরেন মাইতি দল ছেড়ে চলে এল। কয়েক পা হেঁটে সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবুকে কেমন লাগল?

বড়বাবু? অবাক হল অক।

দূর মশাই। থানার ওসিকে যে বড়বাবু বলা হয় তা জানেন না?

ও। আপনি তা হলে জেনে গেছেন ব্যাপারটা!

জেনে গেছি মানে? এই যে আপনি লকআপে না ঢুকে বাড়ি ফিরছেন তার জন্যে এই লোকটার সামান্য অবদান আছে। একজন মাওবাদীকে সাহায্য করার অপরাধে দশ বছর ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে পারত। যেহেতু আপনার বাবা মুখ্যমন্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন, নকশাল হয়ে জেল খেটেও বন্দি মুক্তির সুযোগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে কোনও রাজনীতি দলে যোগ দেননি, আপনাকে সেসব করতে দেখিনি বলে আমি বড়বাবুকে অনুরোধ করেছিলাম একটা সুযোগ আপনাকে দিতে। হাসিমুখে মাথা নাড়ল সুরেন মাইতি।

অর্ক কোনও কথা বলল না। খানিকটা হাঁটার পর সুরেন মাইতি আবার কথা বলল, আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সে নন্দীগ্রামে গিয়ে আমাদের কজন কমরেডকে গুলি করে মেরেছে তার হিসেব রাখেন?

অর্ক হেসে ফেলল, এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?

লোকটা যেদিন ঈশ্বরপুকুর থেকে উধাও হয়েছিল তার পরের দিন থেকেই। নন্দীগ্রামে মাওবাদীরা ঢুকেছিল সুন্দরবন দিয়ে। দেখুন, আপনারা কি ভাবেন আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করি? যারা জমি নিয়ে আন্দোলন করছিল তারা আধুনিক বন্দুক চালানো শিখে গেল? কোথায় পেল ওইসব অস্ত্র? যারা এই কাজ করেছে তাদের আড়াল করতে তৃণমূলের নেত্রী ঘোষণা করে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। উত্তেজিত হল সুরেন মাইতি।

যারা কৃষকদের হয়ে লড়াই করেছিল তারা কি ধরা পড়েছে?

কী করে ধরা পড়বে? তার আগেই তাদের সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। যাক গে, আপনি আমাকে বলুন, লোকটা এখন কোথায়?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না।

হু! শেষ প্রশ্ন, আপনি কি তৃণমূলে জয়েন করেছেন?

সুরেন মাইতির প্রশ্ন শুনে অর্ক একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি বলুন তো, তৃণমূলের রাজনীতি কোন তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে?

কাঁধ নাচাল সুরেন মাইতি, কেন? ওই মা-মাটি-মানুষকে টুপি পরানো।

অর্কর গলার স্বর শক্ত হল, সুরেনবাবু, আপনি কোনও মতবাদকে শ্রদ্ধা নাও করতে পারেন কিন্তু তাকে ব্যঙ্গ করার কোনও অধিকার আপনার নেই।

দূর মশাই। ব্যঙ্গ করার মতো কেউ কিছু করলে তাকে পুজো করব? কোনও মতবাদ নেই, আদর্শ নেই, শুধু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে পাবলিককে খেপিয়ে তুলছেন মহিলা, স্বপ্ন দেখছেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলে সবাইকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন? পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কখনও হয়েছে? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

পৃথিবীর ইতিহাসে কি এমন উদাহরণ আর একটা খুঁজে পাবেন যেখানে একজন সাধারণ মহিলা একা যে আন্দোলন গড়ে তুলছেন তাতে ভয়ংকর শক্তিশালী বামফ্রন্ট সরকারের মতো আদর্শবাদী সরকার ভয়ে কাঁপছেন? একজন একদম একা, তাঁর পাশে যারা গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অধিকাংশের কোনও পরিচিতি নেই, নেত্রী যা বলছেন তাই তাদের কাছে বেদমন্ত্র, সেই একা মহিলাকে আপনারা যখন ভয় পাচ্ছেন তখন বুঝতেই হবে আপনারা টের পাচ্ছেন জনসমর্থন কার সঙ্গে আছে। অর্ক বেশ স্পষ্ট কথাগুলো বলল।

অর্থাৎ আপনি স্বীকার করলেন যে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।

আমি সেটা একবারও বলিনি।

আর কী বাকি রাখলেন বলতে? বিশ্বজিৎকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন যাতে বড়বাবুকে একটু চমকানো যায়। শুনে রাখুন বামফ্রন্ট তিন দশকের ওপর যেমন ক্ষমতায় আছে তেমনি আগামী তিন দশকও থাকবে। প্রায় হুংকার দিল সুরেন মাইতি, শুনুন অর্কবাবু, আপনার সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করতে চাইছি। ওই মাওবাদী লোকটি কোথায় আছে তা আমাদের জানিয়ে দিন। ওকে ধরে যদি জেরা করা যায় তা হলে নন্দীগ্রামের নেপথ্য কাহিনি আমরা মানুষকে জানাতে পারব। আমি সন্ধেবেলায় আবার আপনার কাছে আসব। চলি।

.
 

Users who are viewing this thread

Back
Top