What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

রাত সাড়ে এগারোটার লোকাল ট্রেনে উঠে খুব খুশি হল অর্ক। দু তিনজন যাত্রী ছাড়া কামরা বিলকুল ফাঁকা। ট্রেন চলতে শুরু করলে বেঞ্চিতে শরীর মেলে দিল সে। আঃ, কী আরাম! সেই সকালের পর এরকম বিশ্রামের সুযোগই পাওয়া যায়নি। সারাদিন শুধু টেনশন আর টেনশনে কেটে গেছে। কাল সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা সে শিয়ালদায় চলে যাবে। মা বাবা যে ট্রেনেই আসুক সকাল নটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। স্টেশনে ওকে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবে ওরা।

ব্যাপারটা ভেবে আরাম বোধ করল অর্ক। সে কঁধব্যাগ মাথার নীচে রেখে আরাম করে পাশ ফিরে শুল। ট্রেনটা চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মাঝেমধ্যে স্টেশনগুলোতে থামছে কিন্তু যাত্রী উঠছে খুব কম। ফলে অর্কর ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল না। হঠাৎ মাথাটা ওপরে উঠেই বেঞ্চিতে আছাড় খেলে সে উঃ বলে উঠে বসতেই একটা লোক দৌড়ে নেমে গেল প্ল্যাটফর্মে। থেমে থাকা ট্রেন চলতে শুরু করেছে, অর্ক দৌড়ে দরজার সামনে পৌঁছোতে না পৌঁছোতে প্ল্যাটফর্ম পেছনে চলে গেল।

এইরকম মড়ার মতো ঘুম কেউ কি রেলগাড়িতে ঘুমায়?

প্রশ্নটা শুনে মুখ ফেরাল অর্ক। পাকা দাড়ি, মাথায় সাদা টুপি পরা প্রৌঢ় মানুষটি বললেন, আসুন শান্ত হয়ে বসুন, যা গেল তার জন্যে শোক করবেন না।

লোকটাকে আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে দেখেও চিৎকার করলেন না কেন? অর্ক রেগে গেল।

প্রাণের ভয়ে। ওর কাছে নিশ্চয়ই ছুরি আছে, সেটা যদি আমার বুকে বসিয়ে দিত তা হলে কি আমার ভাল লাগত? আপনি খুশি হতেন। দামি কিছু ছিল?

জামাকাপড়।

ইনসাল্লা। আল্লা যা ভাল মনে করেন তাই করেছেন।

আমার আর কোনও জামাকাপড় সঙ্গে থাকল না এটা ভাল হল?

মনে করুন, আরও খারাপ কিছু হতে পারত। এটা মনে করলে বোঝাটা কমে যাবে। প্রৌঢ় হাসলেন, বসুন। রাতের এইসময় লোকাল ট্রেনে কেউ ঘুমায়?

অভিজ্ঞতা ছিল না বলে! এইরকম ছিনতাই হয় কে জানত?

ও অতি নিম্নশ্রেণির ছিনতাইবাজ। অতি উচ্চশ্রেণির হলে আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলত। ব্যাগের দিকে হাত না বাড়িয়ে বলত, পকেটে যা আছে সব বের করে দিতে। আপনি কোনও প্রতিবাদই করতে পারতেন না কারণ আগ্নেয়াস্ত্র দেখাত। তারপর দিব্যি সিগারেট খেত আপনার সামনে বসে। যে স্টেশনে দরকার নেমে যেত। এই কারণেই মাঝরাত্রের ট্রেনে উঠলে আমি সঙ্গে কিছু রাখি না। প্রৌঢ় তাঁর সাদা দাড়িতে আঙুল বোলালেন।

অর্ক বসল, তার পকেটে ট্রেনের টিকিট, কিছু টাকা আর এটিএম কার্ড, মোবাইল রয়েছে। এখন ফিরে আসার ট্রেন থাকলেও সেটা না ধরে ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। যাতে ওগুলো ছিনতাই না হয়ে যায়।

কোথায় যাচ্ছেন?

প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন।

কোথাও না।

লাখ টাকার উত্তর। সত্যি তো আমরা কে কোথায় যাচ্ছি জানি না।

আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

খড়্গপুরে, আমার ভাইয়ের বাসায়। ও কাল সকালে হজ করতে যাবে। বাসা খালি পড়ে থাকবে। তাই কদিন পাহারা দিতে হবে। প্রৌঢ় হাসলেন, সেখান থেকে যাব ইসলামপুরে। বাপ-মাকে নিয়ে এক বন্ধু আজমিরে যাবে, তারও বাসা পাহারা দেবার জন্য আমাকে দরকার।

অর্ক অবাক হল, আপনি বিয়ে থা করেননি?

করেছিলাম। আমাকে তার পছন্দ হয়নি বলে আর একজনের সঙ্গে চলে গেছে। ওই যে বললাম, যা গেছে তার জন্যে শোক না করতে। আমিও করিনি। প্রৌঢ় বললেন, খড়্গপুর অবধি ঠিক আছে, তারপরেই আসল। বিপদ।

কীরকম?

কখন ট্রেনলাইন বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে তা কামরায় বসে জানতেও পারবেন না। দেখছেন না, খোদ সরকারও মাওবাদীদের ভয় পাচ্ছে। প্রৌঢ় গলা নামালেন শেষ কথাগুলো বলতে।
 
অর্ক সতর্ক হল। এই বৃদ্ধ আসলে কী তা যখন সে জানে না তখন মুখ খোলা অত্যন্ত বোকামি হবে। লোকটা তো পুলিশের চর হতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল, খঙ্গপুর আর কতদূর?

প্রৌঢ় শব্দ করে হাসলেন, কতবছর পরে আপনি মনে করিয়ে দিলেন। তা একসময় খুব গল্প পড়তাম। উপন্যাস পড়ার ধৈর্য ছিল না। বউ চলে যাওয়ার পর ওই পড়াটড়া ছেড়ে দিয়েছি। সেই সময় একটা গল্প পড়েছিলাম, ডানকুনি আর কতদূর? লেখকের নাম শ্রীশচীন ভৌমিক। এখনও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি খঙ্গপুর আর কতদূর জিজ্ঞাসা করতে মনে পড়ে গেল। এই যে কথা থেকে কথা মনে পড়ে যাওয়া, গন্ধ থেকে স্মৃতি ফিরে পাওয়া, ভারী চমৎকার ব্যাপার। খড়গপুর থেকে কতদূরে যাবেন?

কোথাও না। হাওড়ায় ফিরে যাব। অর্ক উঠে চলন্ত ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে একটু-আধটু টিমটিমে আলো, বাতাসও বেশ শীতল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুন্তীর মুখ মনে পড়ল। অদ্ভুত ছিমছাম মেয়ে যার সঙ্গে কথা বললে দূরের মানুষ বলে মনে হয় না। যদি আরও আগে ওর সঙ্গে আলাপ হত? হেসে ফেলল সে। তবে কী হত? কুন্তী নিশ্চয়ই এম এ পাশ করে শিক্ষকতা করছে। ওর ধারেকাছে বিদ্যে তার নেই। যেসব কারণে সংসারী হওয়ার কথা ভাবা যায় তা কোনওদিন মাথায় আসেনি এবং তার জন্য কোনও আক্ষেপ কখনও হয়নি। আজ হঠাৎ এসব ভাবছে কেন সে? মোবাইল বের করে সময় দেখল অর্ক। এখন গভীর রাত। ট্রেন কোনও নদী পার হচ্ছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটছে বলে অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ বাবার মুখ মনে এল। ছেলেবেলায় বাবাকে কবিতা আবৃত্তি করতে শুনত স্কুল থেকে ফিরে। একটা কবিতা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তার। আজ এই রাতের এমত সময়ে আচমকা লাইনগুলো বুকে পাক খেয়ে গেল, আধেক লীন হৃদয়ে দূরগামী/ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি/সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া/অবনী বাড়ি আছ?

খড়গপুরে এর আগে গিয়েছেন?

না। অর্ক ফিরে দাঁড়াল।

স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনটা বিশাল অজগর সাপের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। কয়েকজন যাত্রী চোখের পলকেই চলে গেলেন যে যার গন্তব্যে।

প্রৌঢ় বললেন, চলুন ফেরার ট্রেনটা কখন পাবেন বোর্ড দেখে বলে দিই। দেখা গেল তাকে আরও একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। প্রৌঢ় চিন্তিত হলেন। এরকম নির্জন স্টেশনে একা বসে থাকা ঠিক হবে না।

কেন?

পুলিশ এসে খামোকা হয়রানি করবে। তার চেয়ে বাইরে চলুন। স্টেশনের বাইরে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে বসে চা খেয়ে সময় কাটাতে পারবেন। আমিও ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। প্রৌঢ় বললেন।

চায়ের দোকান এত রাত্রে ভোলা থাকবে?

আগের বার দেখেছি খোলা ছিল। প্রৌঢ় এগোলেন।

এত রাতেও দোকানে আলো জ্বলছে। দুজন খদ্দের। অর্ক প্রৌঢ়ের সঙ্গে ভেতরের বেঞ্চিতে গিয়ে বসার আগে সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল। সুন্দর করে লেখা, লাল কেবিন।

এই নাম সে কার মুখে শুনেছে? চোখ বন্ধ করল অর্ক।

.
 
প্রৌঢ় বললেন, দুকাপ চা নতুন করে বানিয়ে দিন লালবাবু। খুব রোগা, লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা বৃদ্ধ, যিনি ক্যাশবাক্সের পাশে বসে ছিলেন তিনি বললেন, রাত বারোটার পর এই দোকানে পুরনো চা বিক্রি হয় না। বসুন।

বেঞ্চিতে বসতে বসতে মনে পড়ে গেল অর্কর। রামজির মুখে এই দোকানের কথা সে শুনেছিল। হাওড়া থেকে এই দোকানে এসে কোথায় যাবে তার খবর নিতে বলা হয়েছিল তাকে। বৃদ্ধের দিকে তাকাল অর্ক। তা হলে কি নিরীহ দেখতে এই মানুষটির সঙ্গে রামজির দলের লোকদের যোগাযোগ রয়েছে? একেবারে স্টেশনের বাইরে এই দোকান ঘেঁষে যদি বৃদ্ধ পোস্ট অফিসের কাজ করেন তা হলে তা পুলিশ জানতে পারল না? অর্কর ইচ্ছে হচ্ছিল বৃদ্ধকে রামজির ব্যাপারে প্রশ্ন করে। রামজি এখন কোথায় তা ইনি নিশ্চয়ই জানেন, কিন্তু নিজেকে সামলাল অর্ক। যদি সন্দেহ সত্যি হয় তা হলে অচেনা লোকের কাছে ইনি মুখ খুলবেন না।

চা দিয়ে গেল একজন। প্রৌঢ় সেটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পেট খালি নাকি?

মাথা নাড়ল অর্ক, তারপর চুমুক দিল। চায়ের স্বাদ ভাল।

প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে এইসময় রাস্তায় হাঁটা কি নিরাপদ?

বৃদ্ধ বললেন, ভবিষ্যৎ বলতে পারব না। তবে এখন চোর ছিনতাইবাজের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত গত কয়েকমাসে সেরকম খবর কানে আসেনি।

প্রৌঢ় হাসলেন, তা হলে তারা সবাই লোকাল ট্রেনগুলোতে আস্তানা গেড়েছে। এই যে, আমার এই ভাইয়ের ব্যাগ ট্রেন থেকে ছিনতাই হয়ে গেল।

খবরটা খুব দুঃখের। আপনারা কোথায় যাবেন? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বি-ই কলেজের কাছে যাব। ভোর হোক, তখন রওনা হব। প্রৌঢ় চায়ের কাপ রাখলেন, ইনি ফাস্ট ট্রেন ধরে ফিরে যাবেন।

সে কী? এসেই ফিরে যাবেন কেন?

হোটেলে থাকলে যা খরচ হত ট্রেনে যাতায়াত করলে তার চেয়ে অনেক কমে হয়ে গেল। অর্ক জবাব দিল।

তা ভাই কি হোটেলেই বসবাস করেন? স্থায়ী বাসা নেই? বৃদ্ধ হাসলেন।

তা থাকবে না কেন? কিন্তু আজকের রাতটা বাইরে কাটাতে হচ্ছে।

তাই বলুন। অনেকে শুনেছি পুলিশের ভয়ে বেশ্যাপাড়ায় গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আসে। বোধহয় তেমন ঘরে গেলে হোটেলের চেয়ে সস্তা হয়। আপনি তা না করে নতুন পথ দেখালেন। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। বেঁচে থাকলে আরও কত নতুন দেখব।

প্রৌঢ় বললেন, দেখবেন তো নিশ্চয়ই। এখন থেকেই তো পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে দিয়েছে। পরিবর্তন হয়ে গেলে নতুন দেখার সুযোগ পাবেন।

হাওয়া বলছেন কী ভাই, ঝড় উঠল বলে। এই দোকানে আমি দিনের বেলায় বসি না। রাত দশটায় আসি, আলো ফুটলে চলে যাই তখন দুই ছেলে পালা করে বসে। কী করব বলুন? রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না। যত ঘুম দুপুরে। তাই রাত জেগে চেয়ে চেয়ে দেখি। পরিবর্তনের ঝড় আসছে। বলতে বলতে বৃদ্ধ মুখ ফেরালেন। একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। ড্রাইভারের পাশে বসে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও খবর আছে। লালবাবু?

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, না স্যার। রাতের বেলায় কোনও খবর পাইনি।

ছেলেদের বলবেন দিনের বেলায় কান খাড়া রাখতে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলে অফিসার চেঁচিয়ে বললেন, এবার নিজের আর দোকানের নাম পালটাতে হবে যে, নতুন নাম ভাবুন। জিপ বেরিয়ে গেল।
 
বৃদ্ধ অর্কদের দিকে তাকালেন, শুনলেন? ঠাকুরদার দেওয়া নামটা এবার বদলাতে হবে। আর সবুর সহ্য হচ্ছে না ।

এই সময় একটি ছেলে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে দোকানের সামনে চলে এল, দাদু, এখনই এলাকা ঘিরে সার্চ করবে পুলিশ? বড়বাবু কিছু বলল?

না ভাই। খবর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করল। বৃদ্ধ জবাব দিতেই ছেলেটা উধাও হয়ে গেল।

প্রৌঢ় উঠে দাঁড়ালেন, চায়ের দাম নিন। এখন এখানে বসে থাকলে ঝামেলায় পড়তে হবে। কী বলেন দাদা?

বৃদ্ধ বললেন, ওরে বাবুর কাছ থেকে টাকাগুলো নে।

যে চা দিয়েছিল সে দাম নিয়ে গেল। অর্ক বুঝতে পারল লালবাবু প্রৌঢ়ের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। সে উঠে দাঁড়াল, আমি তা হলে প্ল্যাটফর্মেই চলে যাই। ওয়েটিং রুম নিশ্চয়ই খোলা পাব।

বৃদ্ধ বললেন, কুমিরের মুখে মাথা গলিয়ে দেবেন? অবশ্য আপনার যা ইচ্ছে।

প্রৌঢ় বললেন, ভাই, চলুন, পায়ে হেঁটে এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাই। আঁধার কাটলে না হয় রিকশায় ফিরে এসে ট্রেন ধরবেন।

বৃদ্ধ বললেন, সেই ভাল, সেই ভাল।

প্রৌঢ়র পেছন পেছন বেরিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল অর্ক, আমি আগে কখনও খঙ্গপুরে আসিনি, কিন্তু আপনার দোকানের নাম শুনেছি।

প্রশংসা না নিন্দে? বৃদ্ধ নিরুত্তাপ।

কোনওটাই নয়। আমার পরিচিত একজন বলেছিল সে আপনার দোকানে আসবে।

কী নাম?

রামজি।

মনে নেই। রাম লক্ষ্মণ থেকে নকুল সহদেব, কতজনই তো আসছে। যান, আর দেরি করবেন না। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন। খঙ্গপুরের রাস্তায় যথেষ্ট আলো। কিন্তু এই সময়ে চারধার খাঁ খাঁ করছে। প্রৌঢ় হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা ছেড়ে গলির ভেতর ঢুকলেন, একটু শর্টকাট করি। তা ছাড়া বড় রাস্তায় হাঁটলে মহাজনদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ভাইয়ের নামটা বোধহয় এখনও জানা হয়নি।

অর্ক।

বা রে, বা। চমৎকার নাম। আমি আবুল কালাম আজাদ। অবাক হওয়ার। কোনও কারণ নেই। আমার এই নাম অন্তত দশ হাজার মুসলমানের আছে। তবে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত তার দশ হাজারের এক ভাগ গুণ আমার নেই। কথাগুলো বলে খানিকটা পথ চুপচাপ হাঁটলেন আজাদভাই। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু ভাই, আপনি তখন বললেন রামজির কাছে লালবাবুর দোকানের নাম শুনেছেন। রামজি তো বাঙালির নাম হতে পারে না।

রামজি বাঙালি নয়। ঝাড়খণ্ডের মানুষ।

তাই বলুন।

কিন্তু গলি থেকে বড় রাস্তায় আসতেই হল ওদের। এঁকেবেঁকে সেটা আবার বেরিয়ে এসেছে। খানিকটা হাঁটতেই পেছন থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। প্রৌঢ় বললেন, তাড়াতাড়ি পা চালান, স্টেশনে গুলি চলছে।

পুলিশ? প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অর্কর।

জবাব দিলেন না প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদ। দুটো সাইকেলে চারটে ছেলে পাঁইপাঁই করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গা এখান থেকে কত দূরে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

প্রৌঢ় বললেন, আমার সব হিসেব গুলিয়ে গেছে।

তার চেয়ে রাস্তার পাশে কোনও শেড-এর নীচে ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বোধহয় ঠিক হবে। অর্ক বলল।

বৃদ্ধ চারপাশে তাকালেন। এই রাস্তায় দোকানপাটও তেমন নেই। যা আছে। তাদের সামনে কোনও শেড নেই।
 
এইসময় তৃতীয় সাইকেলটি পেছন থেকে চলে এল। অর্ক দেখল সাইকেল নড়বড় করছে। রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে যেতে যেতে মাটিতে পড়ে গেল। যে চালাচ্ছিল তার গলা থেকে গোঙানি ছিটকে বের হল।

প্রৌঢ় দৌড়ে গেলেন ছেলেটার কাছে। রাস্তার আলোয় বোঝা গেল ওর পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে ভাই?

ছেলেটা ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল, মা! মাগো!

প্রৌঢ় ওকে টেনে সোজা করার চেষ্টা করলেন। রক্তাক্ত হয়ে জ্ঞান হারায়নি ছেলেটা। জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি পুলিশ?

প্রৌঢ় বললেন, না

তা হলে আমাকে বাঁচান। আমাকে সামনের গলির ভেতরে স্কুলের পেছনে নিয়ে চলুন। প্লিজ। ছেলেটি কাতরাতে লাগল।

প্রৌঢ় অর্কর দিকে তাকাল, ওকে কি সাহায্য করবেন?

অর্ক বলল, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটাই জরুরি।

ছেলেটি দ্রুত মাথা নাড়ল, হাসপাতালে গেলেই পুলিশ অ্যারেস্ট করবে। স্কুলের পেছনে গেলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার হাঁটুর ওপরে একপাশে গুলি লেগেছে। উঃ, মাগো!

অর্ক বলল, তা হলে ওকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়।

সাইকেল দাঁড় করিয়ে ছেলেটিকে সিটে বসিয়ে ওরা যখন গলির ভেতর ঢুকছে তখন দেখতে পেল স্টেশনের দিক থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি আসছে। ওটা যে পুলিশের গাড়ি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

গলির ভেতরে খানিকটা যাওয়ার পর প্রৌঢ় ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাসা কোথায় ভাই?

এখানে আমার বাসা নেই। আমাকে ওই বারান্দায় নামিয়ে দিলেই হবে।

ওই বারান্দায় নামালে কে তোমাকে দেখবে? এখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার, কী করি বলুন তো? অর্ককে প্রশ্ন করলেন প্রৌঢ়।

আমরা ওকে কোথায় নিয়ে যাব? ও যা বলছে তাই করাই ভাল। বলতে বলতে অর্ক দেখল দুটো গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা গলির দিকে মুখ করে দাঁড়ালেই তাদের দেখতে পেত।

অগত্যা প্রৌঢ়র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছেলেটিকে বারান্দায় শুইয়ে দেওয়া হল। এখন আশেপাশের সব বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ। গলির ভেতরের দিকটা অন্ধকার। শোওয়ার পর ছেলেটি পকেট থেকে সেলফোন বের করে চোখের সামনে যন্ত্রটা এনে বোতাম টিপতে গিয়ে থমকাল, আপনারা চলে যান, প্লিজ।

প্রৌঢ় বললেন, চলুন। কয়েক পা হেঁটে অর্ক পেছন ফিরে দেখল ছেলেটা সেলফোনে কথা বলছে। আশ্চর্য! অত রক্তপাতের পরেও ছেলেটার হুশ ঠিকঠাক রয়েছে। গলির মুখে এসে অর্ক বলল, বড়রাস্তায় হাঁটলেই পুলিশ আটক করবে।

করলে করবে। আমি রাতের শেষ ট্রেনে এসেছি! কোন ঠিকানায় যাব তা ওদের বলব। খোঁজ নিলেই বুঝবে মিথ্যে বলছি না।

প্রৌঢ়র গলায় বেপরোয়া সুর। অর্ক অবাক হয়ে বলল, আমি তো কিছুই বলতে পারব না।

প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ। আপনি সমস্যায় পড়বেন।

তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সমস্যা বলছি কেন? আপনি একজন ভদ্রলোক। খুন জখম বা ছিনতাই কখনও করেছেন? যাকে বলে উগ্রপন্থী রাজনীতি, সেই দলে কি আপনি?

না।

তা হলে আপনি সমস্যায় পড়বেন না।

মানে? পুলিশ ধরলে সত্যি কথা বলবেন। নিজের পরিচয় দেবেন।

কিন্তু পুলিশ নিশ্চয়ই জানতে চাইবে এত রাত্রে খড়গপুরের রাস্তায় আমি কী করছি? কী জবাব দেব?

একটা কিছু ভেবে নিন ভাই।

মাথায় কোনও জবাব প্রথমে আসছিল না। প্রৌঢ় হাঁটতে শুরু করলে অর্কর আচমকা মনে হল, সে পুলিশকে বলবে ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে থানার বড়বাবুর চাপে বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। বড়বাবু বলেছেন, যেমন করেই হোক রামজির সন্ধান তাকে দিতে হবে। সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু রামজির ঠিকানা সে জানে না। আজ বিকেলে মনে পড়ে গেল রামজি তার কাছে খঙ্গপুর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। ওর গ্রামের এক বন্ধু খঙ্গপুরের থানায় পোস্টেড। জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই লোকটাকে বের করলে হয়তো তার কাছ থেকে রামজির ঠিকানা জানা যাবে এই আশায় মরিয়া হয়ে সে চলে এসেছে।
 
প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদ হনহনিয়ে হেঁটে যাওয়ায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল লোকটার সঙ্গে গিয়ে তার কী লাভ হবে? রাত ফুরোতে তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। তার চেয়ে ফিরে গিয়ে লালবাবুর দোকানে বসাই ভাল। চট করে ট্রেনে ওঠা যাবে। তার মধ্যে পুলিশ ধরলে তো জবাব তৈরি হয়ে গেছে।

প্রৌঢ় মানুষটাকে এখন আবছা দেখাচ্ছে। এই সময় ওপাশ থেকে একটা জিপ হেডলাইট জ্বালিয়ে আসতেই মানুষটাকে সিলুট হয়ে যেতে দেখল সে। জিপটা থেমে গেল। চিৎকার কানে আসতে অর্ক দ্রুত গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াল। সে দেখল প্রৌঢ় মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন এবং দুটো পুলিশের অবয়ব তার সামনে। তখনই প্রচণ্ড শব্দ হল। পরপর চারটে বোম পুলিশের গাড়ির ওপর আছড়ে পড়তেই প্রৌঢ় দৌড়ে পালাতে চাইলেন। যে দুটো পুলিশ তার সামনে ছিল তাদের একজন রিভলভারের ট্রিগার টিপতেই প্রৌঢ় রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়লেন। পুলিশের গাড়ি তখন ধোঁয়ার আড়ালে। এখনই জায়গাটায় অনেক পুলিশ এসে যাবে। অর্ক আর ভাবতে পারল না। রাস্তার ধার ঘেঁষে সে দ্রুত হাঁটতে লাগল স্টেশনের দিকে। ভূতে তাড়া করলে মানুষ যেভাবে ছোটে দিকবিদিকে জ্ঞান হারিয়ে সেইভাবে হাঁটতে গিয়েও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল অর্ক। স্টেশনের দিক থেকে একের পর এক পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ঘটনাস্থলে। সেই আলো দেখেই তাকে লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হচ্ছিল। এই করতে করতে সে যখন স্টেশনে পৌঁছাল তখনও লালবাবুর দোকান খোলা কিন্তু সেখানে না গিয়ে সে সোজা টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে দেখল ভিতরে লোক বসে আছে। হাওড়ার টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ভুতুড়ে চেহারার ট্রেনটাকে দেখতে পেয়ে চুপচাপ উঠে বসল। একটাও মানুষ নেই কামরায়। এই ট্রেন আদৌ কোথাও যাবে কি না সে জানে না। রাত শেষ হয়ে আসছে। কামরার ভেতরে অন্ধকার। সে জানলা দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল দুজন রাইফেলধারী রেলের পুলিশ হেঁটে যাচ্ছে। মিনিট পনেরো পরে হঠাৎ ট্রেনে আলো জ্বলে উঠল। তারপর যেতে হয় তাই যাওয়ার ভঙ্গিতে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে হাওড়ার দিকে এগোতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল অর্ক। ঘুমিয়ে পড়লেও তার পকেট থেকে জোর করে বের না করলে কেউ লাভবান হবে না। সে চোখ বন্ধ করল। করতেই প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদের শরীরটাকে রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়তে দেখল। নিশ্চয়ই পিঠে বা মাথায় গুলিটা লেগেছিল। যে পুলিশ ছুঁড়েছিল সে কী ভেবেছিল? মাওবাদীরা প্রৌঢ়কে টোপ দিয়ে পুলিশের গাড়ি থামিয়েছে? থামার পর তারা বোম চার্জ করেছে? এই ঘটনার আর কেউ সাক্ষী আছে কি না কে জানে, কিন্তু কাল কাগজে ছাপা হবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন মাওবাদী প্রৌঢ় নিহত। ওই মানুষটা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিল। তাকে চা খাইয়েছিল। মানুষটার জীবিকা কী তা অর্ক জানে না, কিন্তু আত্মীয় বন্ধুদের উপকারের জন্যে এর বাড়ি ওর বাড়ি পাহারা দিতে ভালবাসত। প্রৌঢ় জানত না, প্রশ্নের বদলে পুলিশ বুলেট ব্যবহার করতে অনেক বেশি পছন্দ করে। যারা লুকিয়ে থেকে পুলিশের গাড়িতে বোমা ছুঁড়েছিল তারা সন্ত্রাসবাদী অথবা মাওবাদী হলে যে পুলিশ প্রশ্ন না করে প্রৌঢ়কে গুলি করে মেরেছে সে উগ্রপন্থী নয় কেন?

প্রথম রোদে কলকাতাকে এখনও মোলায়েম দেখায়। এখনও চিৎকার, শব্দের কোরাস শুরু হয়নি। গঙ্গার জল এই সময় সত্যি পবিত্র বলে মনে হয়। হাওড়া থেকে অর্ক ট্রাম ধরে চলে এল শিয়ালদায়। একটু একটু করে শহর জাগছে। স্টেশনও।
 
সত্তরের নকশাল আন্দোলন হয়েছিল ভারতের সংবিধান পালটাতে, সমাজব্যবস্থা বদলাতে। তখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট তারপর আবার কংগ্রেস। সে সময় রাজনৈতিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্যে। সরকার পুলিশকে ব্যবহার করতেন। মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগে পুলিশ দিয়ে মানুষ খুন করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। বুর্জোয়া শাসকদের সমালোচনা করে গিয়েছে সমানে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তাদের ঔদ্ধত্য যত বেড়েছে, যত তারা আগের আদর্শচ্যুত হয়েছে, তত পুলিশকে ব্যবহার করে আনন্দিত হয়েছে।

দূর থেকে বাবা এবং মাকে দেখতে পেল অর্ক। কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে মা তাকে সামলে হেঁটে আসছে, একটু পেছনে ক্রাচ হাতে বাবা। অর্কর মনে হল দুজনকেই বেশ ভাল দেখাচ্ছে। চেহারায় পরিবর্তন এসেছে।

এই যে, দাঁড়াও। কুলিকে দাঁড়াতে বলে মাধবীলতা সামনে এল, তুই?

তোমাদের নিতে এলাম, চলো। অর্ক হাসল।

অনিমেষ ততক্ষণে চলে এসেছিল কাছে। অর্ককে দেখে মাধবীলতাকে বলল, ওর চেহারাটা দেখেছ? রাত জেগে চুরিচামারি করে বেড়াচ্ছে নাকি?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, রাতে ঘুমোসনি?

অর্ক বলল, চলো, তোমাদের সব বলছি। এই কুলি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড চলো।

লাইন দিয়ে ট্যাক্সি পেতে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল। ট্যাক্সি যখন চলতে শুরু করেছে তখন মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী বলবি বলছিলি?

আমাদের বাড়িতে সুরেন মাইতির লোকজন হামলা করেছিল কাল।

সে কী? কেন? মাধবীলতা অবাক।

আমার কাছে যে ছেলেটি ছিল তাকে ওরা মাওবাদী বলে সন্দেহ করেছিল। বিশ্বাস করো আমার সঙ্গে ছেলেটি কখনওই রাজনীতি নিয়ে কথা বলেনি। ও চলে যাওয়ার পরে পুলিশ আমায় ডেকে ওর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিল। অর্ক বলল।

এইজন্যে হামলা করেছে! মাধবীলতার গলায় বিস্ময়।

হ্যাঁ, তার সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে রেগে যাওয়াটাও ছিল। আমি গতকাল বামফ্রন্ট বিরোধী বিশাল অরাজনৈতিক মিছিলে হেঁটেছিলাম এই খবরটা ওরা পেয়েছিল। সেই রাগে বাড়ি ভেঙে তছনছ করেছে। অর্ক বলল।

সর্বনাশ। তা হলে আমরা থাকব কোথায়? মাধবীলতা যেন পরে পড়ল। এতক্ষণে অনিমেষ কথা বলল, মনে হচ্ছে এতদিনে তুমি রাজনীতিতে নামবে। নামো, আরও নামমা, কিন্তু আমাদের জড়িয়ে নয়।

.
 
বিস্তারিত শোনার পরে মাধবীলতা একটি কথাও বলেনি, বাড়িতে ঢুকে হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকাল। জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে গিয়েছিল অর্ক। অনিমেষ হতাশ গলায় বলল, এখানে না ফিরে এলেই ভাল হত।

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। তারপর শ্বাসজড়ানো শব্দগুলো উচ্চারণ করল, আর কতদিন কতবার আমি সহ্য করব! কথাগুলো একেবারেই নিজেকে বলা। সেটা বুঝেই অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল। বহু বছর, সেই জেল থেকে বের হয়ে মাধবীলতার সঙ্গে চলে আসার পর থেকে যে হীনমন্যতাবোধ তার মনে আঁচড় কাটত, যা ক্রমশ নেতিয়ে ধুলোচাপা হয়ে গিয়েছিল তা মাধবীলতার কথায় আবার জেগে উঠল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উঠোনে পা রেখে বারান্দায় বসে পড়ল। নিজেকে অর্থহীন বলে মনে হচ্ছিল তার।

অর্ক বেরিয়ে এল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ তোর ডায়েরি নেয়নি?

ডায়েরি করার সুযোগ পাইনি। থানার ওসি নিজেই দেখতে এসে আমাকেই যা ইচ্ছে তাই বলে গেলেন। অর্ক জানাল।

কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমিই নাকি এসবের জন্যে দায়ী।

সত্যি কথা বল, তুই জেনেশুনে একটা মাওবাদী ছেলেকে বাড়িতে রেখেছিলি?।

সত্যি কথাই বলছি মা, আমি কিছুই জানতাম না। ও ঝাড়খণ্ডের ছেলে। আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। আমার তো ওকে ভদ্র সরল মানুষ বলে মনে হয়েছে। পরে বুঝেছি ও কোনও দলের সঙ্গে যোগ দিতে এসেছে। সেই দল প্রকাশ্যে কাজ করে না। কিন্তু এটা যখন বুঝেছি তখন ওর চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অর্ক বলল।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তাকে ফিরতে দেখে ইতিমধ্যেই বস্তিতে ছোটখাটো জটলা তৈরি হচ্ছিল, এখন তারাই কৌতূহলী হয়ে সঙ্গ নিল। মাধবীলতা বস্তি থেকে বেরিয়ে সোজা সুরেন মাইতির পার্টি অফিসে পৌঁছে গেল। অত সকালে অফিসের দরজা খোলেনি কিন্তু সুরেন মাইতির দুজন ছায়াসঙ্গী বারান্দায় বসে ছিল। মাধবীলতা তাদের বলল, সুরেনবাবুকে একটু ডেকে দাও তো ভাই।

মাধবীলতা এবং তার পেছনে জনা পনেরো মানুষ, যাদের বেশিরভাগই মহিলা, দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল ছেলে দুটো। দ্রুত মাথা নেড়ে চলে গেল সুরেন মাইতিকে ডাকতে। তাদের সঙ্গে সুরেন মাইতি আসার আগেই ভিড়ের আয়তন বেড়ে গেল। লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে সুরেন মাইতি মাধবীলতার সামনে এসে নমস্কার জানাল হাতজোড় করে। তারপর বলল, যাক আপনি এসে গেছেন। কী ঝামেলা বলুন তো! আপনার ছেলে না জেনেশুনে উটকো লোককে বাড়িতে ঢুকিয়ে বিপদ ডেকে আনল। মাওবাদী এক্সট্রিমিস্ট। যে ছিল তার অ্যান্টি গ্রুপ এসে ওই হামলা করে গেছে। আমি তখন এলাকায় থাকলে ওদের হাতেনাতে ধরে বাপের নাম ভুলিয়ে দিতাম। আপনি বাড়ি যান, বিশ্রাম নিন। আমি চেষ্টা করছি যে ক্ষতি আপনাদের হয়েছে তার অন্তত কিছুটা পূর্ণ করে দিতে।

মাধবীলতা শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার কথা শেষ হয়েছে?

সুরেন মাইতি একটু বোকা হাসি হাসল, হ্যাঁ, এই আর কী!
 
মাধবীলতা বলল, দেখুন, আমি রাজনীতির মানুষ নই, সাদা চোখে যা দেখছি তাই বলছি, আপনারা নিজেদের পায়ে কুড়োল মারছেন, আপনাদের যে শক্তি ছিল তা অপব্যবহারে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন মানুষ আপনাদের একফোঁটা ভালবাসে না। ভয় করতে করতে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে ভাবছে কবে আপনারা চলে যাবেন। মিথ্যে দিয়ে যে অন্যায়গুলো ঢাকতে চাইছেন তা সবাই বুঝতে পারছে শুধু আপনারা তা পারছেন না। খুব খারাপ লাগে, বুঝলেন?

কথাগুলো শেষ করে মাধবীলতা হনহন করে ফিরে গেল। সুরেন মাইতি তার যাওয়াটা দেখে হাত ঘোরাল, কী বলে গেল তা মাথায় ঢুকল না।

যারা এতক্ষণ সবিস্ময়ে দেখছিল তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সারা সকাল ধরে আলোচনা করার সুযোগ পেয়ে বর্তে গেল।

তৃতীয় দিনের শেষে থানায় গেল অর্ক। বড়বাবুর জন্যে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই সময় একজন এস আই, যিনি ডিউটিতে ছিলেন, বসতে বললেন। চা খাওয়ালেন। তারপর বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝছেন?

কী ব্যাপারে?

চারধারে যা হচ্ছে তা দেখছেন, শুনছেন তো?

অর্ক বলল, ও, কিন্তু আমি তো রাজনীতি করি না।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি রাজনীতি করি? এস আই হাসলেন। আমরা পিঁপড়ের মতো। কেন বললাম?

বুঝতে পারলাম না।

ঝড়বৃষ্টি আসার কিছু আগে, দেখবেন, পিঁপড়েরা লাইন বেঁধে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেন করে? কারণ ওরা ঠিক টের পেয়ে যায় বৃষ্টি আসছে। আমরাও টের পেতে শুরু করেছি। আপনাদের বস্তির লোকজন কিছু বলছে না?

আমি শুনিনি। কারণ আমি সকালে বেরিয়ে যাই, রাত্রে ফিরি। কারও সঙ্গে আড্ডা মারার সময় পাই না। অর্ক বলল।

বুঝলাম, আপনি কেন বড়বাবুর দেখা চাইছেন?

উনি আমাকে বলেছিলেন যাকে আমি আমাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম তার হদিশ জানাতে। না হলে আমার বিপদ হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে যে এখন কোথায় তা আমি জানি না। এটাই ওঁকে বলতে চাই। অর্ক সরল গলায় বলল।

ঠিক আছে, ওঁর জন্যে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমি বলে দেব আপনি এসেছিলেন। নিশ্চিন্তে চলে যান।

আমি সত্যি জানি না। অর্কর অবিশ্বাস হচ্ছিল এস আই-এর কথায়।

কী করে জানবেন? পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী না থাকলে তার ঠিকানা আপনি কী করে জানবেন? এস আই হাসলেন।

মানে? হকচকিয়ে গেল অর্ক।

খবরের কাগজ পড়েন না? বিরোধী নেত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। বড়বাবু কাল থেকে সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। তা হলে আপনাকেও কোনও মাওবাদীর ঠিকানা জানাবার জন্যে চাপ দেওয়া হবে না।

কথাটা বিশ্বজিৎকে বলতেই সে খুব হাসতে লাগল।

হাসছ কেন?

হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে, বুঝলেন না? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, একটার পর একটা ব্রহ্মাস্ত্র বামফ্রন্টের হাত পা কাটছে। সামনের নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়বেই। দাদা আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আপনাদের ওপর সুরেন মাইতিরা যে অত্যাচার করল তার কি কোনও কারণ ছিল? আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। আপনাকে দেখলে মানুষ ভরসা পাবে। এত বড় সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনে এখনই পরিবর্তন আসা দরকার। বিশ্বজিৎ বলল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কী করতে বলছ?

আপনি টিএমসির সক্রিয় সদস্য হন। আপনার মতো একজনকে পেলে দল শক্তিশালী হবেই। দিদি যে স্বপ্ন দেখছেন তা সার্থক করতে এগিয়ে আসুন অকা। আমাদের পার্টি অফিসে আপনাকে নিয়ে কথাও হয়েছে। বিশ্বজিৎ বলল।

কিন্তু বিশ্বজিৎ, আমি আজ অবধি রাজনীতি করিনি। করতে চাইও না।
 
ছোটমুখে বড় কথা বলছি, অনেকেই জীবনে যা করেননি তা চাপে পড়লে করতে বাধ্য হন। আপনি কি আগে কখনও কলকাতার রাস্তায় মিছিলে হেঁটেছেন? অপর্ণা সেন, শুভাপ্রসন্ন কি রাজনীতি করেছেন? কিন্তু ওঁদের সঙ্গে আপনিও পথে মিছিল করেছেন। কারণ আপনারা কৃষকদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলি চালানোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বামফ্রন্টকে ধিক্কার দিয়েছেন। দাদা, এটাও তো রাজনীতির অঙ্গ। বিশ্বজিৎ অর্কর হাত ধরল।

অর্ক হাত ছাড়িয়ে নিল, এ কী বলছ? ওই প্রতিবাদ মানুষ হিসেবে করা উচিত বলেই সবাই করেছেন, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।

তা হলে তো দিদি কোনও রাজনীতি করছেন না। বিশ্বজিৎ বলল।

মানে?

দিদি সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মা-মাটি-মানুষের সম্মান বজায় রাখতে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের কাছে আবেদন করেছেন। আজ চৌত্রিশ বছর ধরে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে সুরেন মাইতির মতো অত্যাচারী শোষকরা যে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে তা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চাইছেন উনি। এই মহৎ কাজে আমরা যদি তার পাশে না দাঁড়াই তা হলে দেশটা শেষ হয়ে যাবে। অর্কা, এই জনসেবাকে কি আপনি রাজনীতি করা বলে ভাববেন? বিশ্বজিৎ বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল।

একমুহূর্ত ভাবল অর্ক। তারপর বলল, ঠিক আছে, তুমি যা বললে তা নিয়ে একটু ভাবি। ভেবে বলব।

বাড়িতে ফিরে এলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী কথা হল? আমি তো ভাবলাম তোমাকে লকআপে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

সাব-ইন্সপেক্টারের সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা বলল অর্ক। মাধবীলতা চুপচাপ শুনছিল। বলল, অদ্ভুত ব্যাপার। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

অর্ক বলল, আমারও প্রথম বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, পাগল!

মাধবীলতা বলল, কে?

অনিমেষ বলল, একজন মহিলা যাঁর দেশপ্রেম ছাড়া কোনও আদর্শ নেই, যাঁর পাশে কোনও সুশৃঙ্খল দল নেই, কোনও রাজনৈতিক চিন্তাধারা নেই, যাঁদের একমাত্র স্লোগান বামফ্রন্ট হঠাও তারা দেশের মানুষের ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে না। বামফ্রন্ট যতই অত্যাচার করুক তাদের সাংগঠনিক শক্তি এতটাই যে বন্দুকের সঙ্গে তিরধনুক নিয়ে লড়ে জিততে হবে বিরোধীদের। সেটা কি সম্ভব? এটা হল একজন বনাম এক লক্ষ লোকের লড়াই। ইম্পসিবল।

মাধবীলতা বলল, মিরা তো হয়েই থাকে।

অনিমেষ শব্দ করে হাসল। বলল, বেশ, তোমার কথাই সত্যি হল। ভদ্রমহিলা তার দলবল নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন। হওয়ার পর তাকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে হবে। কংগ্রেস তার ভোটসঙ্গী হলে তাদের কিছু দপ্তর দিতে হবে। কিন্তু তারপর কী হবে সেটা ভেবেছ?

কী হবে মানে?

উনি যে দল করেছেন সেই দলের প্রথম সারির নেতাদের একটাই পরিচয়, তারা দিদির আলোয় আলোকিত। বটগাছ থেকে নেমে আসা ঝুরির মতো। তাই মুখ্যমন্ত্রী হলে দিদি কাদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করবেন? মুখ্যমন্ত্রী দিদি, অর্থমন্ত্রী দিদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিদি, শিল্পমন্ত্রী দিদি। এইসব মন্ত্রকে রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ওইসব নেতাদের নিয়োগ করা ছাড়া তার অন্য কোনও উপায় থাকবে না। অবশ্য আর একটা উপায় আছে। দলের বাইরে থেকে যোগ্য মানুষদের এনে নির্বাচন জিতিয়ে পূর্ণমন্ত্রী করতে পারেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top