What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

হঠাৎ অনিমেষ দেখল একটা ঘুসি ওর মুখ লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু বোঝার আগেই ও মাথা নিচু করে রম্ভাকে নিয়ে বসে পড়ল। তাল সামলাতে না পেরে না পড়ে যেতে ওর হাত অনিমেষের শরীর থেকে খুলে গেল। অনিমেষ নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণে ছেলেটার উদ্দেশে একটা লাথি ঝাড়ল ওই অবস্থায়। ককিয়ে-ওঠা একটা শব্দ কানে যেতেই অনিমেষ দেখল ওর চারপাশে পাগুলো ঘিরে ফেলেছে। কোনোরকমে মাটি থেকে লাথি-খাওয়া ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এবার বুঝবে আমার গায়ে হাত তুললে কেমন লাগে। শালাকে শেষ করে ফেলব। অনিমেষ মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসেছিল। রম্ভা খানিক পেছনে উঠে দাঁড়িয়েছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল, ও যদি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে তা হলে সব দিক দিয়ে আক্রমণ শুরু হবে। ও হির.করল যদি মরতে হয় একজনকে মেরে মরবে।

ঠিক এই সময় মণ্টুর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, কী হচ্ছে কী?

সঙ্গে সঙ্গে চারটে ছেলেই ঘুরে দাঁড়াল। অনিমেষ ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখল মটু অর্ক আর তপন পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ বুকের মধ্যে যে-ঢিপঢিপানিটা শব্দ তুলছিল সেটা চট করে থেমে গেল। এখন ওরা সমান-সমান, ও আর একা নয়। এই সময় এক নম্বর ছেলেটি বলে উঠল, আরে মণ্টু, তুই ওখানে।

মণ্টু বলল, তোরা কী করছিস? ওর গলার স্বর গম্ভীর।

ছেলেটি বলল, আরে শালা এখানে লায়লামজনুর জোর পেয়ার চলছিল। কী হাম খাওয়ার শব্দ? আমরা কেসটা হাতে নিতেই এই মাল ছুটে এল। আবার আমার গায়ে লাথি মারে, বোঝ। জানে না তো আমি কার শিষ্য!

মণ্টু এগিয়ে এল, সেমসাইড হয়ে যাচ্ছে। ও আমার বন্ধু, চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে।

ছেলেটা যেন ভীষণ হতাশ হল, বলল, যাঃ শালা! তারপর অনিমেষের হাত ধরে তুলে বলল, খুব বেঁচে গেলে ভাই। কিন্তু ফিউচারে এরকম করলে ছাড়ব না।

এতক্ষণে মণ্টু রম্ভাকে ভালো করে লক্ষ করেছে, জাঙ্গিয়া-পরা ছেলেটাকে ও আগেই দেখেছিল। ও অনিমেষের কাছে এসে দাঁড়াল, খুব সাহস তো!

রম্ভা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে উঠল এই সময়, আমি কিছু জানি না।

এক নম্বর চাপা গলায় বলল, বৃহৎ হারামি মেয়েছেলে মাইরি! একদম বিশ্বাস করবি না। ওর কীর্তি আমি নিজের চোখে দেখেছি।

মণ্টু অনিমেষকে বলল, কী করা যায় রে?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই অর্ক বলল, ছেড়ে দে, বালিকা জানে না ও মরে গেছে।

হঠাৎ মণ্টু ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে খুব জোরে চট মারল। বেচারা এমনিই দাঁড়িয়ে কাঁপছিল, চড় খেয়ে পাথরের ওপর উলটে পড়ল। মণ্টু এগিয়ে গিয়ে ওকে আবার তুলে ধরল, এই, এই, তোকে বলেছিলাম না যে-এ পাড়ায় আসবি না! আবার সাইকেলে কেষ্টর বাঁশি বাজিয়েছে!

কোনোরকমে ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসতে চাইনি, ও জোর করে এনেছে।

চাপা গলায় মণ্টু বলল, কী করে দেখা হল।

ছেলেটা গড়গড় করে বলে গেল, আমার বোন ওর সঙ্গে পড়ে। বোনের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছিল।

একটু চিন্তা করল মণ্টু, ঠিক আছে। তুই ওকে বিয়ে করবি?

একটুও দ্বিধা করল না ছেলেটা, না!

কেন? প্রেম করছ আর বিয়ের বেলা না কেন? ধমক দিল মণ্টু।

ও মিথ্যেবাদী। নিজেই সব কাজ করে এখন ভান করছে।

অর্ক বলল, মেয়েছেলে মানেই তা-ই। এই সত্যটা চিরকার মনে রেখো চাঁদ। এখন কেটে পড়ো। রেডি, ওয়ান টু থ্রি-। অর্কের কথা শেষ হতেই ছেলেটা তীরের মতো দৌড়াতে লাগল সেনপাড়ার দিকে।
 
এক নম্বর ছেলেটি সেদিকে তাকিয়ে বলল, যা চলে, পাখি উড়ে গেল! কিছু আমদানি হত। তারপর ঝুঁকে মাটি থেকে ছেলেটার শার্টপ্যান্ট তুলে তার পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করল। অনিমেষ দেখল তার মধ্যে বেশকিছু টাকা আছে। অন্ধকারে ছেলেটার ছুটন্ত জাঙ্গিয়া-পরা শরীরটা আর দেখা যাচ্ছে না। এই সময় তিস্তার পাড়ায় চমৎকার একটা চাঁদ উঠে পা ঝুলিয়ে বসে ওদের দিকে চেয়ে রইল। এক নম্বর ছেলেটি টাকাগুলোর পর একটা কাগজ বের করে সামনে ধরে বলল, আরে এ যে লাভ-লেটার। আমার প্রাণ-পাপিয়া, আজ বিকেলে বাঁধের পেছনে জেলা স্কুলের শেষে আমায় দেখতে পাবে। তোমাকে বুকভরে আদর না করতে পারলে আমার শান্তি নেই।

চাঁদের আলোয় চিঠিটা পড়ে ফেলল সে।

পড়া শেষ হতেই মণ্টু হাত বাড়িয়ে খপ করে চিঠিটা কেড়ে নিল, এটা আমাকে দে।

এক নম্বর তাতে একটুও অখুশি হল না। টাকাগুলো পকেটে পুরে ছেলেটার ফেলে-যাওয়া জামা প্যান্ট ও মানিব্যাগ টান মেরে তিস্তার জলে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কেসটা তোদের দিয়ে দিলাম। চলি। ওর সঙ্গীদের নিয়ে সেনপাড়ার দিকে চলে গেল সে।

এবার মণ্টু অনিমেষকে বলল, চল, আমরা বিরাম করের সঙ্গে দেখা করি।

সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা চেঁচিয়ে উঠল, না।

মণ্টু বলল, কেন? বিখ্যাত কংগ্রেসি নেতার কন্যা তিস্তার ধারে প্রেম করছে-এটা তাকে জানাতে হবে না?

রম্ভা বলল, আমি অন্যায় করলে আমিই শাস্তি পাব। বাবা তার জন্য দায়ী নয়।

অর্ক বলল, বয়স কত খুকি তেরো না চোদ্দ?

রম্ভা বলল, আপনার তাতে কী?

অর্ক হাসল, আমরা জন্মেছি বাপ-মায়ের প্লেজার থেকে। অতএব বাপ-মাকে না জানিয়ে কিছু করা ভালো?

হঠাৎ রম্ভা মরিয়া হয়ে গেল, আমার চিঠি ফেরত দিন।

মণ্টু বলল, ফেরত পাবার জন্য লিখেছ?

রম্ভা বলল, যাকে লিখেছি তাকে লিখেছি। আপনাকে লিখতে যাইনি।

মণ্টু বলল, তা লিখবে কেন? আমি তো তোমার বাবাকে তেল দিয়ে কংগ্রেসি হইনি। আর আমার বাপের জমিদারিও নেই।

রম্ভা বলল, নিশ্চয়ই। আপনি তো একটা গুণ্ডা। রোজ দুবেলা ড্যাবড্যাবে করে রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, আমি দেখিনি? এই চিঠি যদি আপনাকে লিখতাম তা হলে আপনার জীবন ধন্য হয়ে যেত।

মণ্টু চেঁচিয়ে বলল, মুখ সামলে কথা বল, এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব, বদমাশ মেয়েছেলে। বাপ কংগ্রেসের নাম করে ঘুষ খাচ্ছে, মা দিনরাত ছেলে ধরছে আর মেয়ে তিস্তার পাড়ে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে চোখ রাঙাচ্ছে। আমি ছিলাম বলে বেঁচে গেলি, বুঝলি! নইলে ওরা তোকে সঁড়ে ছিঁড়ে খেত। আমি গুণ্ডা, না? থুঃ থুঃ করে একরাশ থুতু মাটিতে ফেলে ও অনিমেষকে বলল, অনিমেষ, এটাকে বাড়ি পৌঁছে দে, নইলে তোর মুভিং ক্যাসেল কান্নাকাটি করবে। কথাটা শেষ করে ও দাঁড়াল না। অনিমেষ দেখল অর্ক আর তপন ওর সঙ্গে ফিরে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে। বলল, সচিত্র প্রেমপত্র আমিও পড়েছি। বলে মুঠো-পাকানো রম্ভার চিঠিটা ওদের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটতে লাগল। অনিমেষ দেখল কাগজটা শুন্যে ভাসতে ভাসতে তিস্তার জরে গিয়ে পড়ল। জ্যোত্সা সমস্ত শরীরে মেখে জলেরা দ্রুত ওটাকে টেনে নিয়ে গেল মণ্ডলঘাটের দিকে।
 
হঠাৎই যেন সমস্ত চরাচর শব্দহীন হয়ে গেল। মণ্টুদের শরীরগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, তিস্তার চর থেকে উত্থাত-হওয়া শেয়ালগুলো আজ আর ডাকাডাকি করছে না। শরতে পা-দেওয়া আকাশটা নবীন জ্যোৎস্নায় সুখী কিশোরীর মতো আদুরে হয়ে আছে। এমনকি তিস্তার ঢেউগুলো অবধি নতুন বউ-এর লজ্জা রপ্ত করেছে। অনিমেষ রম্ভার দিকে তাকাল। তিস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে দাঁড়িয়ে, তার দীর্ঘ কেশ নিতম্ব ছাড়িয়ে নেমে এক মায়াময় ছবি হয়ে রয়েছেল রম্ভা এখনও মহিলা হয়নি, কিন্তু ঈশ্বর ওকে অনেক কিছুই অগ্রিম দান করে বসে আছেন। এই রম্ভা ওকে চুম্বন করেছিল। তিক্ত সেই স্বাদটা অনিমেষ এখনও বেশ অনুভব করতে পারে। আজকের এই ছেলেটিকে রম্ভা কি সেই স্বাদ দিয়েছে। একাধিক ছেলের সঙ্গে এইরকম সম্পর্ক যে করে সে কখনোই সৎ নয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ল রম্ভা তার কাছে এগিয়ে এলেও সে সায় দেয়নি। বোচার ভালোবাসা পেতে নিশ্চয় এই ছেলেটির শরণাপন্ন হয়েছে। এতে ঠিক ওকে দোষী করা যাচ্ছে না। কিন্তু ছেলেটি তো ওদের বাড়িতে যেতে পারত। বিশেষ করে যে-তিস্তা বাধের এত দুর্নাম সেখানে আসার ঝুঁকি ওরা কেন নিল? রম্ভার বয়সের মেয়েরা কখনোই এত সাহসী হয় না। অন্তত সীতা বা উর্বশীকে ও এই শ্রেণীতে ফেলতে পারবে না কিছুতেই। হয়তো কোনো কোনো মেয়ে এমন অকালে যৌবন পেয়ে যায় যে কাউকে ভালোবাসতে না পারলে সবকিছু বৃথা হয়ে যায় তাদের কাছে। কিন্তু মণ্টুর বেলায়। ওর মনে হল মণ্টু আজ বেশ একহাত নিয়ে গেল রম্ভাকে। রম্ভার জন্য মণ্টু ছটফট করত, একবার দেখবার জন্য চারবার সামনের রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করত। কিন্তু সেই যে ওর সঙ্গে মুভিং ক্যাসেলের বাড়িতে গিয়ে চা খেল, ব্যস, তার পর থেকেই ও যেন রম্ভাকে আর চেনে না। আজ এই অবস্থায় পেয়ে রম্ভাকে নিয়ে ও যা ইচ্ছে করতে পারত। বিশেষ করে মস্তানগুলো ওর পরিচিত এবং রম্ভার চিঠিটা হাতে পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব কিছুই না করে ও থুতু ফেলে চলে গেল। অনিমেষ এরকম আচরণের কারণটা ঠিক ধরতে পারছিল না। আবার মটুর ওপর সব নি করছে জেনেও রম্ভা কিন্তু ওর কাছে মাথা নোয়ায়নি। সামনে তর্ক করে গিয়েছে। এমনকি এরকম জেনেও দাঁড়িয়ে মটুর মুখের ওপর ওকে গুপ্তা বলে গালাগালি দিয়েছে। কেন? রম্ভা যদি পুরুষ ঘেষা হত তা হলে নিশ্চয়ই এরকম করত না এবং বিশেষ করে ওর লেখা চিঠিটা যখন মটুর মুঠায় তখনও ধরা ছিল। ভাবতে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল অনিমেষের। কী করে যে সব কীরকম হয়ে যায়। ও মুখ তুলে দেখল রম্ভা পায়ে পায়ে তিস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানটায় পাথর রয়েছে ছড়ানো। কাঠোর বিমগুলো নদীর গায়ে এখনও পোতা হয়নি। ফলে জলে নামা অসুবিধের নয়। পাথরের গা বাঁচিয়ে স্বচ্ছন্দে যাওয়া যায়। অনিমেষ দ্রুত গিয়ে রম্ভার পাশে দাঁড়াল, কোথায় যাচ্ছ?

রম্ভা মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল। পাথরের মতো মুখ, কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু দুচোখ উপচে মোটা জলের রেখা গালের ওপর দিয়ে নিচে নেমে গেছে। অনিমেষ চোখ সরিয়ে নিল। কেউ কাঁদলে ও সহ্য করতে পারে না। কারও জল-টলমল চোখের দিকে তাকালেই মায়ের মুখটা চট করে মনে এসে যায়। অনিমেষ আবার বলল, বাড়ি চলো, রাত হচ্ছে!

রম্ভা কীরকম উদাস গলায় বলল, আমি খারাপ, না?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, জানি না। তবে তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি।

রম্ভা বলল, কী করব! ওদের বাড়ি খুব কড়া। আর আমাদের বাড়িতে দিদির জন্য আজকাল কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলা যায় না। কিন্তু এখানে এসে কী লাভ হল।

অনিমেষ বলল, লাভ তো দূরের কথা, তোমার বাবার সম্মান নষ্ট হয়ে যেত একটু হলে।

রম্ভা মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মনে হল ওর গালের ওপর কয়েকটা মুক্তো যেন টলমল করছে। রম্ভা বলল, সে যাহোক হত, কিন্তু ও সবার সামনে আমাকে অপমান করে গেল, আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তার মানে সমস্ত সম্পর্ক এখানেই শেষ! অথচ প্রথমে এখানে এসে বসতেই ও-ই হাঘরের মতো করছিল। কত আবদার! হঠাৎ দাঁড়াল রম্ভা, ওর চোখমুখ পলকেই হিংস্র হয়ে উঠল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই ওর জামা দুহাতের মুঠোয় ধরে ঝাঁকুনি দিতে-দিতে চিৎকার করে উঠল, তোমরা ছেলেরা সবাই সমান। স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক। চুরি করে উঠল, তোমরা, তোমরা ছেলেরা সবাই সমান। স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক। চুরি করে মধু খেতে চাও, স্বীকার করার সাহস নেই। বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে ফেলল.ও। কান্নার দমকে ওর মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল। ওর বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি; তোমার কাছে চুরি করে কিছু নিতে চাইনি। কিন্তু ও কিছু না বলে রম্ভাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল।

অনিমেষ বলল, অনেক রাত হয়েছে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। চলো।

আর এই সময় সেই উৎখাত-হওয়া শেয়ালগুলো তারস্বরে ডেকে উঠল! বাঁধের আশপাশ থেকেই ডাকগুলো আসছিল। সেই কর্কশ শব্দে ভীষণরকম চমকে গিয়ে রম্ভা অনিমেষের হাত ধরল।
 
ধীরপায়ে ওরা-হাকিমপাড়ার দিকে হেঁটে আসছিল। এখন এ-অঞ্চলটায় লোকজন নেই। শুধু কোনো বিরহী রাজবংশী বাঁধের জন ফেলে রাখা পাথরের ওপর বসে বাঁশিতে একলা কেঁদে যাচ্ছে। জ্যোত্সায় চারধার বড় কোমল, মোলায়েম লাগছে। খুব নিচুগলায় রম্ভা বলল, তুমি আমাদের বাড়িতে, বলে দেবে না তো?

অনিমেষ হাসল, মাথা-খারাপ, এসব কথা কাউকে বলে?

রম্ভা বলল, তোমার বন্ধুরা তো সবাই বলবে।

অনিমেষ এটা অস্বীকার করতে পারল না। কাল বিকেলের মধ্যে সমস্ত শহর নিশ্চয়ই ঘটনাটা জেনে যাবে। ওর রম্ভার জন্য কষ্ট হচ্ছিল।

হঠাৎ রম্ভা বলল, একটা উপকার করবে?

কী? অনিমেষ জানতে চাইল।

তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে বলো যে আমরা এখানে বেড়াতে এসেছিলাম, এমন সময়। কয়েকজন ছেলে আমাদের অপমান করেছে। রম্ভা সাগ্রহে ওর হাত ধরল।

সে কী! কেন? অনিমেষের সমস্ত শরীর চট করে অবশ হয়ে গেল।

তা হলে পরে যার কাছ থেকেই বাবা-মা শুনুক বিশ্বাস করবে না। তোমাকে মা খুব ভালোবাসেন। প্লিজ, এই উপকারটা করো।

কিন্তু তা তো সত্যি নয়। আর খামোকা তোমার সঙ্গে আমি বেড়াতে যাব কেন?

অনিমেষ ওর হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু রম্ভা যেন একটা অবলম্বন পেয়ে গেছে, দিদি সেদিন তোমার আমার ব্যাপারটা দেখে ভেবেছে যে আমরা লাভার। একথা ও দিদিভাইকে বলেছে। তাই আমরা বেড়াতে গিয়েছি শুনলে ওরা সহজেই বিশ্বাস করবে।

অনিমেষ বলল, রম্ভা, আমি মিথ্যে কথা বলতে পারব না।

রম্ভা বলল, কেন? আমার জন্য বলো। তুমি যা চাও সব পাবে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না, সত্যি হলে আমি যেতাম তোমাদের বাড়ি।

রম্ভা বলল, বেশ, সত্যি করে নাও।

অনিমেষ বলল, তা হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা খেপে উঠল, ও, তুমি খুব সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, না?

অনিমেষ কোনো জবাব দিল না। কথা বলতে বলতে ওরা জেলা স্কুলের পাশে এসে পড়েছিল। নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রম্ভা আচমকা দৌড়াতে আরম্ভ করল। অনিমেষ প্রথমটা বুঝতে পারেনি, ওর ভয় হল রম্ভা বুঝি কিছু-একটা করে ফেলবে। নিজের অজান্তেই সে রম্ভার পেছন পেছন ছুঁটতে লাগল। খানিকটা যেতে-যেতে হঠাৎ ওর মাথায় একটা ছবি হুড়মুড় করে জুড়ে এসে বসল। এলো চুল বাতাসে উড়িয়ে দুর্গা ছুটছে, পেছনে অপু।

চট করে থেমে গেল অনিমেষ। রম্ভার ছুটন্ত শরীরটা ওদের বাড়ির গেটের কাছে চলে গেল। গেট খুলে রম্ভা ভেতরে চলে গেল।

রাত হয়ে গেছে। সন্ধের মধ্যে বাড়িতে না ঢুকলে দাদু রাগ করেন। আজকে যে কীসব ব্যাপারে। হয়ে গেল! দ্রুত পা চালাল অনিমেষ। কিছুদূর যেতেই ওর মনে হল কেউ যেন ওর পেছনে আসছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে ও হা হয়ে গেল। প্রথমে ওর মনে হল বোধহয় ভূত দেখছে সে। তারপর ছেলেটা কথা বলল, আমাকে একটা কাপড় বা যাহোক কিছু দাও, আমি এভাবে শহরের মধ্যে ঢুকতে পারছি না। কেঁদে ফেলল সে। এই জ্যোৎস্নায় জাঙ্গিয়া-পরা শরীরটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের ক্রমশ কষ্ট হতে লাগল। বেচারা বোধহয় এতক্ষণ ওদে কাছাকাছি ছিল, সাহস করেনি কাছে আসতে। এভাবে শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটা যায় না।

অনিমেষ কোনো কথা না বলে ইঙ্গিতে ছেলেটাকে ওর সঙ্গে আসতে বলল। ও হেঁটে যাচ্ছে আর ওর হাতে-ছয়েক দূরে একটি জাঙ্গিয়া-পরা শরীর লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে হাঁটছে। দৃশ্যটা আর-একবার দেখেই অনিমেষ আর পারল না। ওকে সেখানেই দাঁড়াতে বলে একটা-কিছু এনে দিতে ও জীবনের সবচেয়ে দ্রুত দৌড়টা দৌড়াল। বাড়ির কাছাকাছি হতে অনেক মানুষের কথাবার্তা ও কান্নার শব্দ শুনতে পেল সে।

বাগানের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে প্রথমে একটু থমকে দাঁড়াল অনিমেষ। কিছু গুঞ্জন,এবং একটি পুরুষকণ্ঠে কান্না ভেসে আসছে। ও খুব ত্রস্ত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কাঁদছে কে না তো, কল্পনাতেও অনিমেষ সরিৎশেখর এইরকম গলায় কাঁদছেন ভাবতে পারে না। রান্নাঘরের ভেতর থেকে আলো আসছে। অনিমেষ শব্দ না করে বারান্দায় উঠে এল। ওকে দেখে পিসিমার শেয়ালটা যেন বিরক্ত হয়েই নেমে দাঁড়াল সিড়ি থেকে। ফুটফুটে জ্যোত্যায় বাগানের গাছপালাগুলো স্নান করে উঠে এইবার ফুরফুরে হাওয়ায় গা মুছে নিচ্ছে। অনিমেষ দেখল রান্নাঘরে কেউ নেই। এমনকি দরজাটা অবধি বাইরে থেকে টেনে দেওয়া, চোর এলে সব ফাঁক হয়ে যাবে। পিসিমা তো এত অসতর্ক হয়ে বাইরে যান না! দাদুর ঘরের দিকে যাবার সময় ওর মাথায় উঠোনের তারে ঝুলেথাকা একটা ময়লা গামছা ঠেকল। দাদুর ঘামমোছা এই গামছাটা এখনও শুকোচ্ছ-এই বাড়িতে এরকম আগে হয়নি। নিশ্চয়ই গোলমালটা খুব গুরুতর ধরনের। দেরি করে বাড়িতে আসার জন্য যেসংঙ্কোচ এবং কিছুটা ভয় ওর মধ্যে ছিল, ক্রমশ সেটা কমে যাচ্ছিল।
 
গুঞ্জনটা হচ্ছে বাইরে ভাড়াটের দিকে। কান্নাটা এখন একটু কমেছে, মাঝে-মাঝে গোঙানির শব্দ হচ্ছে। অনিমেষ দ্রুত সেদিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর ফিরে এসে তারে-ঝোলানো ভিজে গামছাটা একটানে নামিয়ে নিয়ে বাগান পেরিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। সুপুরিগাছের ছায়া থেকে চট করে ছেলেটা সামনে বেরিয়ে এল, কী হয়েছে।

অনিমেষ মাথা নেড়ে বলল, জানি না। এটা ছাড়া কিছু পেলাম না।

ছেলেটা বলল, কেউ মারা গেল এইরকম কাঁদে।

অনিমেষ কথাটা শুনে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ঠিক আছে, এটা নিয়ে এবার কাটো।

ছেলেটা হাত বাড়িয়ে ভিজে গামছাটা নিয়ে করুণ গলায় বলে উঠল, এ মা, এই ভেজা গামছা পরে আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটব?

অনিমেষের মাথায় তড়াক করে রক্ত উঠে গেল। ও জাঙ্গিয়া-পরা শরীরটার দিকে একবার তাকাল, তা হলে যা পরে আছে তাতেই যাও।প্রেম করতে যাওয়ার সময় খেয়াল ছিল না! বসতে দিলেই শুতে চায়! আর দাঁড়াল না সে। হনহন করে ফিরে এল একবারও পেছনে না তাকিয়ে।

নতুন বাড়ির বারান্দা দিয়ে এগোতে শব্দটা বাড়তে লাগল। বাইরের বারান্দায় যাবার মুখটায় পিসিমা দাঁড়িয়ে আছেন। আঁচলটা এক হাতে মুখে চাপা দেওয়া। ঠিক তার পাশে একটা মোড়ায় দাদু হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে চুপচাপ বসে। আর সামনের হোট লনটা লোকে ভরতি হয়ে গিয়েছে। খুব আস্তে সবাই কথা বলছে। কিন্তু সেটাই গুঞ্জন বলে ওর এতক্ষণ মনে হচ্ছিল। সবার মুখ ডানদিকের বারান্দার দিকে ফেরানো, অনিমেষ এখান থেকে সেদিকটা দেখতে পাচ্ছিল না। পিসিমার পাশে যেতেই খপ করে তিনি ওর হাত ধরলেন, তারপর অস্বাভাবিক চাপা গলায় বললেন, এতক্ষণ কোথায়। ছিলি? কী উত্তর দেবে ঠিক করার আগেই তিনি বললেন, চিন্তায় চিন্তায় আমার বুক ধড়ফড় করছিল। বাবা জিজ্ঞাসা করছিল তোর কথা, আমি বলেছি অনেকক্ষণ এসেছিস।

অনিমেষ খুব নিচুগলায় জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে, এত লোক কেন?

মুখ থেকে আঁচল না সরিয়ে তেমনি গলায় পিসিমা বললেন, সুনীল মরে গেছে।

সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল অনিমেষের। ও কিছুক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে পিসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন?

পিসিমা বলল, কী জানি, শুনছি মেরে ফেলেছে। প্রিয়র জন্যে ভীষণ ভয় হচ্ছে।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না অনিমেষ, দৌড়ে ও লনে নেমে পড়তেই সুনীলদাকে দেখতে পেল। ওদের বারান্দায় প্রচুর মানুষ মাথা নিচু করে বসে আছে, আর তার ঠিক মাঝখানে একটা খারিয়ায় সুনীলদা চুপচাপ শুয়ে আছে। বুক অবধি সাদা কাপড় টানা, হাত দুটো তার তলায় মাথায় লাল ছোপলাগা ব্যান্ডেজ। নাক চোখ ঠোঁট জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে। সুনীলদার বাবা যাঁকে কোনোদিন কথা বলতে দেখেনি অনিমেষ, তিনি ছেলের মাথার কাছে বসে মাঝে-মাঝে ড়ুকরে উঠছেন। জয়াদিদের দরজা বন্ধ, ওঁদের ফিরতে দেরি আছে।
 
অনিমেষ পায়েপায়ে সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ উঠে এল। সুনীলদার কাছে যাবার জন্য একটা সরু প্যাসেজ করে রেখেছে উপবিষ্ট মানুষেরা। একদৃষ্টে সুনীলদার বন্ধ চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ ভীষণ কাঁপুনি অনুভব করল। যেন প্রচণ্ড শীত করছে, হাতে পায়ে সাড় নেই, একটা শীতল স্রোত ক্রমশশিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। সুনীলদা মরে গেছে। যে-সুনীলদা ওকে কত কথা বলত, ওর চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়, সুন্দর চেহারার সুনীলদা ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির ভঁজ রেখে মরে গেছে। কিন্তু কেন? কেন সুনীলদাকে মরতে হল? স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওকে কেউ হত্যা করেছে। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল, অনেকেই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে এখানে কোনো কথা বললে সেটা বিচ্ছিরি লাগবে, এটা অনুভব করতে পারল অনিমেষ। ও আস্তেআস্তে বাকি ধাপগুলো পেরিয়ে সুনীলদার খাটিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সুনিলদার বাবা ওকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক দুহাত বাড়িয়ে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরলেন, দ্যাখো, দ্যাখো, আমার সুনীলকে তোমরা দ্যাখো। চিৎকারটা শেষদিকে কান্নায় জড়িয়ে যেতে অনিমেষ এই প্রৌঢ়ের হাতে বাঁধনে দাঁড়িয়ে থেকে হুহু করে কেঁদে ফেলল।

কেউ-একজন পাশ থেকে এই প্রথম কথা বলল, মেলোমশাই, একটু শক্ত হন।

শক্ত হব? কান্নাটা তখনও শব্দগুলোকে নিয়ে খেলা করছিল, আমি তো শক্ত আছি। আমার ছেলে কমিউনিস্ট পার্টি করে-আমি কিছু বলি না, কলকাতা থেকে বই আনায়-আমি টাকা দিই, দশবারো দিন কোথায় গিয়ে সংগঠন করে-আমি চুপ করে থাকি। আমার চেয়ে শক্ত আর কোন বাবা থাকবে?

অনিমেষ ওঁর আলিঙ্গনে বন্দি হয়ে পাশে বসে পড়েছিল। সুনীলদার মুখ এখন ওর এক হাতের মধ্যে। সুনীলদা কোথায় গিয়েছিল? স্বৰ্গছেঁড়ায়? স্বৰ্গছেঁড়াতে কেউ সুনীলদাকে খুন করতে পারে? কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ওর। সুনীলদার কেউ শক্ত হতে পারে। পারে, সুনীলদা বলেছিলেন, শক্র চারধারে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তারাই আমাদের শত্রু। তা হলে স্বৰ্গছেঁড়ায় ক্ষমতা আগলে থাকবে এবং শত্রু হবে-এরকমটা শুধু বাগানের ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো পুলিশ আছে। ওই ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ স্পষ্ট শুনতে পেল, এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, মৃত পৃথিবী ভগ্ন ধ্বংসস্তুপ পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব, তবু দেহে যতক্ষণ আছে, প্রাণ, প্রাণপণে এ পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল। এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি। এই বারান্দায় এক সন্ধেবেলায় পায়চারি করতে করতে আবৃত্তি করেছিল সুনীলদা। এখন এই জ্যোৎস্নায়-ঘোয়া। সুনীলদার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল সুনীলদা হয়তো সামান্য বড় ছিল বয়সে, কিন্তু তার কোনো কথা ও স্পষ্ট বুঝতে পারেনি।

ঠিক এই সময় একটা রিকশা এসে গেটের কাছে থামল। দু-তিনজন লোক সেদিকে এগিয়ে যেতে অনিমেষ দেখল রিকশা থেকে একটা বিরাট ফলের মালার নামিয়ে যিনি আসছেন তাঁকে সে চেনে। এক হাত কাটা অথচ কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। মালাটা নিয়ে দৃঢ় পায়ে নেমে এসে সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে গেলেন তিনি। সুনীলদার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে কয়েক মুহূর্ত ওর মুখে দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মালাটা সুনীলদার বুকের ওপর এমন আলতো করে নামিয়ে রাখলেন যাতে একটুও না লাগে। তারপর খুব মৃদুস্বরে বললেন, সুনীল, আমরা আছি, তুই ভাবিস না।

অনিমেষ ওঁর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল, না, চিনতে পারেনি। সেই সন্ধ্যায় ছোটাকার সঙ্গে ওঁর বাড়িতে সে যে গিয়েছিল নিশ্চয়ই খেয়াল করতে পারেননি। এই মানুষটির হাঁটাচলা এবং কথা বলা তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ছোটকাকা কী করে পকেট থেকে রিভলবার বের করে ওর মুখের ওপর ধরেছিল, তা হরে ছোটকাকাও কি ওঁর শত্রু! যা, ছোটাকাক তো ক্ষমতাবান মানুষদের একজন-ক্রমশ ঘোলা জলটা থিতিয়ে আসছিল।
 
প্রায় নিঃশব্দেই সুনীলদাকে ওরা ঠিকঠাক করে নিল। সুনীলদার বাবা হঠাৎ যেন একদম বোবা হয়ে গেছেন, কোনো কথা বলছেন না। সেই কান্নাটাও যেন আর ওঁর গলায় নেই। এতক্ষণের নাগাল পেল। না, স্বৰ্গছেঁড়ায় নয়, ড়ুয়ার্সের অন্য এক চা-বাগানে দুদল শ্রমিকের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ থামাতে সুনীলদা ছুটে গিয়েছিল। আসন্ন হরতাল বানচাল হয়ে যেত তাতে। শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে সংগঠনকে আরও মজবুত করে আজ সকালে জলপাইগুড়িতে ফিরে আসছিল সে। তোরবেলায় বাসস্ট্যান্ডে আসবার সময় কেউ ওকে ভোজালি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে চা-বাগানের ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে গাড়িতে ময়নাগুড়ি হাসপাতালে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। সুনীলদা ডাক্তারদের কাছে কিছু বলতে পারেনি বলে শোনা যাচ্ছে, যেটা এই জনতা বিশ্বাস করছে না। পুলিশ বিকেলবেলায় অনেক তদ্বির করার পর মৃতদেহ ছেড়েছে। কোনো ধরপাকড়ের কথা শোনা যায়নি এখনও। জনতার ধারণা হরতাল হোক এটা যারা চায়নি তারাই সুনীলদাকে মেরেছে। সুনীল রায়ের মৃত্যুতে আগামীকাল সেই চা-বাগানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।

শেষ মুহূর্তে সুনীলদার বাবা ঘাড় নাড়লেন। না, তিনি শোনে যাবেন না। অনেকের অনুরোধে তার এক কথা, আমার স্ত্রীকে অমি দাহ করেছি, সুনীলকে আমার সঙ্গে সে রেখে গেছে বলে। সুনীলকে আমি দাহ করে কার জন্যে অপেক্ষা করব?

শেষ পর্যন্ত সরিৎশেখর এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ দূরে বসে তিনি চুপচাপ সব দেখছিলেন। ভদ্রলোক শোনে যাবেন না শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন হেমলতা নিষেধ সত্ত্বেও, মিঃ রায়, আপনি গেলে যে ওর অমঙ্গল হবে।

সুনীলদার বাবা বোধহয় এখনও মানুষ চিনছিলেন না, না, ও এখন মঙ্গল-অমঙ্গলের বাইরে।

সরিৎশেখর বললেন, কিন্তু পিতা হিসেবে আপনার কর্তব্য তো শেষ হয়নি। আপনি ওকে জন্ম দিয়েছেন, পালন করেছেন, উপযুক্ত করেছেন, তাই তার শেষ যাওয়ার সময় আপনার উপস্থিতি ওকে মুক্তি দেবে।

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে ঘাড় নাড়তে লাগলেন তিনি, হল না, হল না, ও বলত, মরে গেলেও আমি আবার কমিউনিস্ট হব। আচ্ছা, আপনার আঙ্গুল আগুনে পুড়ছে আপনি সহ্য করতে পারবেন? পারুন, আমি বড় দুর্বল, পারব না।

প্রায় নিঃশব্দে সুনীলদাকে বাড়ির গেট খুলে বের করা হল। ওরা যখন যাত্রা শুরু করছিল, অনিমেষ তখন দৌড়ে পিসিমার কাছে গেল। দাদু নেই বারান্দায়। সুনীলদার বাবা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর লনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। অনিমেষ পিসিমাকে বলল, আমি শ্মশানে যাব। …।

ও ভেবেছিল পিসিমা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন, তাই প্রশ্ন করেনি, নিজের ইচ্ছাটা জানিয়েছিল। কিন্তু ও অবাক হয়ে দেখল পিসিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর বললেন, জামাপ্যান্ট পালটে একটা গামছা নিয়ে যা। কেউ চলে গেলে প্রতিবেশীর শুশানবন্ধু হওয়া উচিত। এই প্রথম পিসিমা এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দাদুর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলেন না।

গামছা নিয়ে একটা পুরনো শার্ট গায়ে চাড়িয়ে অনি বারান্দায় এসে দাঁড়ানো দাদুর শরীরের পাশ দিয়ে দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে এল। সুনীলদাকে নিয়ে ওরা এতক্ষণ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে দাদু যেন কিছু বললেন পেছন থেকে, কিন্তু তা শোনার জন্য অনিমেষ অপেক্ষা করল না। টাউন ক্লাবের পাশের রাস্তায় শুশানযাত্রীদের ধরে ফেলল। ওরা তেরাস্তার মোড়ে আসতেই অনিমেষ খাটিয়ার পাশে চলে এল। ওপাশের হাসপাতাল-পাড়ার রাস্তা দিয়ে কয়েকজন ফুল নিয়ে এদিকে আসছিল, তাদের দেখে শুশানযাত্রীরা থামল। যে চার-পাঁচজন এসেছিল তারা ফুলগুলো সুনীলদার বুকে ছড়িয়ে দিতেই একজন বলে উঠল, সুনীল রায়-তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না।
 
চাপা গলায় অদ্ভুত অভিমান নিয়ে বলে-ওঠা এই বাক্যটির জন্য যেন এতক্ষণ সবাই অপেক্ষা করছিল। প্রত্যেকটি মানুষের বুকের এই কথাটা একজনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে সবার মুখ খুলে গেল। চলতে চলতে একজন চাপা গলায় বলল, সুনল রায়-তোমায় আমরা বাকি কণ্ঠগুলো দৃঢ় ভঙ্গিতে পূরণ করল, ভুলছি না, ভুলব না।

এই স্বপ্নের মতো জ্যোত্যায়-চুবানো শহরের পথ দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে অনিমেষের বুকের মধ্যে অদ্ভুত শিহরন জাগল। আজ রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলছে না। চন্দ্রদেব তাঁর সবটুকু সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েছেন, কারণ সুনীলদা শেষযাত্রায় চলেছে। শহরের পথে-পথে যারা জানত না এসবের কিছু তারাও উৎসুক হয়ে এবং কিছুটা শ্রদ্ধার সঙ্গে ওদের দেখছিল। শোকযাত্রা: ক্রমশ মিছিলের আকার নিয়ে নিল। অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলে যাচ্ছিল, ভুলব না, ভুলব না। কেন, সে ভুলবে না এই মুহূর্তে ভাববার অবকাশ তার নেই।

দিনবাজারের পুল পেরিয়ে বাজারের সামনে দিয়ে ওরা বেগুনটুলির রাস্তায় এসে পড়ল। এতক্ষণ অনিমেষ চুপচাপ হেঁটে আসছিল, এখন চলতে চলতে একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একে ও সুনীলদার কাছে দুএকদিন যেতে দেখেছে। এতক্ষণ সুনীলদাকে কাঁধে নিয়েছিল বলে ওকে লক্ষ করেনি অনিমেষ। সুনীলদার সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল এর সেদিন। সুনীলদা বলেছিল, পার্লামেন্টরি গণতন্ত্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বড়লোরে গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পালটে বড়লোকদের বাঁচাবার জন্য তাদের প্রয়োজনেই এর সৃষ্টি।

ছেলেটি বলেছিল, তা হলে আমরা সেটা সমর্থন করেছি কেন? কেন আপনি প্রকাশ্যে তা বলেন?

বলার সময় এলে নিশ্চয় বলব। ফোঁড়া না পাকলে অপারেশন করা হয় না। সুনীলদার এই কথা নিয়ে ওদের তর্ক উত্তপ্ত হয়েছিল। অনিমেষ তার সবটা মাথায় রাখতে পারেনি। এখন হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটি নিজের মনে বলল, আশ্চর্য, রমলাদি আসেননি!

রমলাদি। অনিমেষ মহিলাকে মনে করতে পারল। ওই যে হাতকাটা প্রৌঢ় নরম চেহারার মানুষটি পেছন পেছন হেঁটে আসছেন। তার চেয়ে রমলাদি অনেক বেশি শক্ত হয়ে ছোটকাকার সঙ্গে কথা বলেছিলেন সেই রাত্রে। দলের ছেলে কেউ নিহত হলে কর্মীরা সবাই আসবেই, অতএব স্বাভাবিক কারণেই রমলাদি না আসায় এই ছেলেটিকে ক্ষুন্ন হতে দেখল অনিমেষ।

না, একবারও হরিধ্বনি দেয়নি কেউ। এতক্ষণ দমবন্ধ-করা পরিবেশে ওকে না-ভোলার অঙ্গীকার করা হচ্ছিল, হঠাৎ গলাগুলো পালটে গেল। কে যেন চাচাল, লং লিভ সুনীল রায়–লং লিভ লং লিভ।

সুনীল রায়ের হত্যাকারীর কালোহাত খুঁড়িয়ে দাও, ভেঙ্গে দাও।

হত্যা করে আন্দোলন বন্ধ করা-যায় না, যাবে না।

সুনীল রায়কে মারল কারা-কংগ্রেসিরা জবাব দিও।

শেষ স্লোগান কানে যেতে থমকে দাঁড়াল অনিমেষ।.ওরা হঠাৎ কী বলতে আরম্ভ করেছে। এর মধ্যে কংগ্রেসিরা আসছে কী করে! সুনীলদাকে কি কংগ্রেসিরা মেরেছে? কংগ্রেসি মানে ভবানী মাস্টার, হরবিলাসবাবু, কংগ্রেসি মানে বন্দেমাতরম্। আবার চট করে ছোটকাকার মুখ মনে পড়ে গেল ওর, ছোটকাকা কি কংগ্রেসি এখব? ছোটকাকার কাছে লিভারভার থাকে যে!

মিছিলটা ওকে ফেলে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকদিন পরে হরবিলাসবাবুর নামটা মনে পড়তেই ওর মনটা কেমন করে উঠল। হরবিলাসবাবুকে সে শহরে আসার পর দেখেছে। এখন আর রাজনীতি করেন না তিনি। প্রথমে নিশীথবাবু পর্যন্ত ওঁর খবর বলতে পারেনি। কংগ্রেস অফিসে আসেন না। এককালে স্বাধীনতা আন্দোলনে এই জেলায় সবচেয়ে যে-মানুষ আলোড়ন তুলেছিলেন, তার কথা। আজ আর কারও মনে নেই। অনিমেষ এক বিকেলে তাকে ডি সি অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিল। ভীষণ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, শরীর ভেঙে পড়েছে আর দারিদ্র্যের ছাপ পোশাক থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ লোভ হয়েছিল সেদিন ছুটে গিয়ে প্রণাম করতে। কিন্তু যদি চিনতে না পারেন, যদি ভুলে গিয়ে থাকেন সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের সকালে স্বৰ্গছেঁড়ায় তিনি কোন বালককে কী দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তা হলে? হরবিলাসবাবু ওর সামনে দিয়ে ক্লান্তপায়ে চলে গেলেন, দমবন্ধ করে অনিমেষ দেখল তিনি ওকে চিনতে পারলেন না।
 
চাপা আক্ষেপের মতো দূরে-মিলিয়ে-যাওয়া মিছিলটা থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। স্কুলের মাঠে একদিন সিনেমা দেখিয়েছিল ওদের। চেন বেঁধে বিরাট এক দুর্ধর্ষ জন্তুকে নিয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল তাতে। প্রচণ্ড আক্রোশে সে গজরাচ্ছিল, অথচ বন্দি থাকায় সেই মুহূর্তে তার কিছুই করার ছিল না। অনিমেষের মনে হল এই মিছিলটা যেন সেইরকম।

এখন রাত কটা কে জানে! কিন্তু একটুও ক্লান্তি লাগছে না ওর। এদিকটায় দোকানপাট কম এবং সেগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চাঁদটা এখন হেলতে মাথার ওপর এসে টুপির মতো বসে আছে। এই নির্জন রাস্তায় একা একা দাঁড়িয়ে ওর কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল। দুপাশে লোকজন নেই, মাঝে-মাঝে এক-আধটা সাইকেল-রিকশা দ্রুত চলে যাচ্ছে। সুনীলদাকে কংগ্রেসিরা মেরেছে মাথা নাড়ল ও। কিন্তু অপঘাতে মারা গেলে আত্মার শান্তি পায় না। ঝাড়িকাকুর মুখে শোনা হরিশের গল্পটা মনে পড়তেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন যদি সুনীলদা কাছে এসে বলে, হ্যাঁ অনমেষ, তোমার কংগ্রেসিরা আমাকে মেরে ফেলেছে, তা হলে সে কী করবে? সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। মিছিলের ধ্বনিটা আর আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষণ একা বলে মনে হতে লাগল ওর। সুনীলদা বলেছিল, যারা কংগ্রেস করে তারা সবাই খুনি-একথা আমি বিশ্বাস করি না। তবে তাদের নেতাদের মধ্যে কেউ দরিদ্র নয়। এই গরিব দেশে কিছু বড়লোক নেতা চিরকাল। লাঠি ঘোরাতে পারে না। অনিমেষের খেয়াল হল, কথাটা প্রায় সত্যি। কংগ্রেস অফিসে গিয়ে সে। দেখেছে সাবই হাজাররকম গল্প বলে, কন্ট্রাক্টরদের আশ্বাস দেয়, মন্ত্রীর সুপারিশ চায়। কিন্তু এরা তো সেরকম কথা বলে না। যেন একই দেশে দুরকমের মানুষ বাস করে। কী ধরনের ক্ষোভ থাকলে মানুষ এত রাত্রে একই রকম জেহাদ সারা শহরের মানুষকে শুনিয়ে যেতে পারে! আচ্ছা, এরা তো সবাই। স্বচ্ছন্দে কংগ্রেসি হয়ে যেতে পারত। কেন হয়নি? হলে তো এরা সুখেই থাকত।

অনিমেষ পায়েপায়ে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। একা থাকতে ওর ভীষণ ভয় করছিল। বেগুনটুলির পাশ দিয়ে গিয়ে ও থমকে দাঁড়াল। বাদিকে একটু এগিয়ে গেলে ছোটমায়ের বাপের বাড়ি। আজ অবধি কখনো যায়নি সে ওখানে। কেউ তাকে যাওয়ার কথা বলেনি, আর আগ্রহও হয়নি। তার। একমাত্র বাবার বিয়ের দিন-হাসি পেল অনিমেষের! কী মজাই-না সেদিন হয়েছিল। অল্পের জন্য ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিল ও। একছুটে পালিয়ে-অনিমেষের মনে পড়ে গেল গলিটার কথা। ওর পা কেটে গিয়েছিল, আনন্দমঠটা হারিয়ে গিয়েছিল। আর সেই মেয়েটি-কী যেন নাম তার, আঃ, অনেক করেও নামটা মনে করতে পারল না। পেটে আসছে তো মুখে আসছে না। এটুকু মনে আছে সে ছিল অন্য সবার থেকে একদম আলাদা ধরনের। তাকে বলেছিল এই গলিতে আর কখনো না। আসতে। কেন বলেছিল সেটা অনেক পরে বুয়েসে। স্কুলের বন্ধুরা ইদানীং বেগুনটুলির এই গলিটার অল্প রসিয়ে করে। এদিক দিয়ে শর্টকাটে সানাউল্লা স্কুলের ফুটবল মাঠে যাওয়া যায়। ওরা দল বেঁধে শর্টকাট করার নাম করে এদের দেখতে-দেখতে যায়। এখন ব্যাপারটা ওর কাছে ঘৃণ্য এবং ভীতিকর হওয়া সত্ত্বেও যখনই মনে পড়ে সেই মেয়েটি কী মমতায় ওর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল তখনই সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়। আচ্ছা, সেই মেয়েটি, কী যেন তার নাম এখন সেই ঘরটায় আছে তো?

ওকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন রিকশাওয়ালা ঠাঠা করে হেসে উঠল। লাইটপোস্টের পাশে রিকশা রেখে সে তাতে চেপে বসে আছে। চোখাচোখি হতে খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এমন সময় ও দেখল একটা মোটামতন লোক টলতে টলতে গলি থেকে বেরিয়ে আসছে আর তার। পেছন পেছন বিভিন্ন বয়েসের কুড়ি-পঁচিশজন ভিখিরি চাঁচামেচি করতে করতে আসছে। গলিটার মুখে এসে ওরা লোকটাকে হেঁকে ধরতের রিকশাওয়ালা চেঁচিয়ে উঠল। তারপর যে ছুটে গিয়ে লোকটাকে উদ্ধার করে রিকশায় বসিয়ে উধাও হয়ে গেল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে ভিখিরিগুলো কিছু করার অবকাশ পেলন না। হতাশ হয়ে ও ওকে গালাগালি দিতে গিয়ে প্রায় মারামারি বেধে গেল ওদের মধ্যে। এমন সময় কয়েকজনের নজর পড়ল অনিমেষের উপর। ওর দিকে তাকিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে আরম্ভ করতেই অনিমেষ প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। অবশ্য ওর কাছে কিছুই নেই যা ওরা কেড়ে নিতে পারবে। তুব এই এত রাত্রে মাতাল-ফসকে–ফেলা ক্রুদ্ধ ভিখিরিদের এই চাহনিকে ও সহ্য করতে পারছিল না। প্রায় প্রাণের ভয়ে অনিমেষ দৌড়াতে লাগল।

শিল্প সমিতি পাড়ার কাছাকাছি ও মিছিলটাকে ধরে ফেলল। এখন যেন অতটা দীর্ঘ নয়, মিছিলের আকার বেশ ছোট হয়ে গেছে। কোনো হরিধ্বনি নেই, শুধু একটিই লাইন ঘুরে ঘুরে প্রতিটি মানুষের মুখে ফিরছে-সুনীল, রায়, আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলব না। অমর শহীদ সুনীল রায়, মরছে না মরবে না।
 
অনিমেষ মিছিলের পাশাপাশি চলতে চলতে শুনল, কে যেন গলা খুলে হাঁটতে হাঁটতে কবিতা আবৃত্তি করছে। কবিতাটি ওর চেনা, সুনীলদা ওকে পূর্বাভাস বলে একটা বই পড়তে দিয়েছিল, তাতে ওটা আছে। ও দেখল সেই ছেলেটি যার সঙ্গে সুনীলদার তর্ক হয়েছিল, সুনীলদার শরীরের পাশে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়াময় গলায় কবিতাটি বলে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিটা আস্তে হয়ে এলে, যেন কবিতার কথাগুলো গান হয়ে গেল আর ধ্বনিটা তার সঙ্গে স্ত্র হয়ে সঙ্গত করে যেতে লাগল-সময় যে স্ত্ৰ বিন্ধ্যাচল, ছেঁড়া আকাশের উঁচু ত্রিপল, দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল-শত শত। মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল, মোছ উদগত অশ্রুজল, যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল? ভোল ক্ষত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ উঠল, ভুলছি না, ভুলব না। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তাধারা একটা শোকের মুতোয় বাঁধা পড়ে ক্রমশ এক হয়ে যাচ্ছে–অনিমেষ অনুভব করছিল। ওর হঠাৎইছে করেছিল সুনীলদার খাটিয়াতে কাঁধ দিতে। আজ অবধি কোনোদিন সে কাউকে কাঁধে করে শোন নিয়ে যায়নি। সত্যি বলতে কি, শোনে সে গিয়েছিল একবারই। খুব অস্পষ্ট সেই যাওয়াটা মনে পড়ে। কিন্তু একটা লকলকে চিতার আগুন আর মা তার মেঘের মতো চুল ছড়িয়ে সেই আগুনে শুয়ে আছেন, বুকের মধ্যে জন্মটিকার মতো এ-দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে আছে। আজ এতদিন বাদে শ্মশানে যাচ্ছে। যে-অনিমেষ সুনীলদার পাশে চলে এল। যে-চারজন ওকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে তাকাল সে। প্রক্যেকের মুখ এত গম্ভীর এবং যেন মহান কোনো কর্ম সম্পন্ন করার নিষ্ঠায় মগ্ন যে। অনিমেষ চেষ্টা করেও তাদের নিজের ইচ্ছেটা জানাতে পারল না।

মাষকলাইবাড়ি ছাড়িয়ে ওরা শ্মশানে এসে গেল। ছোট্ট পুলটা পেরিয়ে শুশানচত্বরে ঢুকতেই অনিমেষের চট করে সমস্ত কিছু মনে পড়ে গেল। মাকে নিয়ে ওরা এখানে এসে ওই গাছটার তলায়। বসেছিল। চিতা সাজানো হয়েছিল এই নদীর ধারটায়। বুকের মধ্যে সেই ব্যথাটা তিরতির করে ফিরে আসছিল যেন, অনিমেষ অনেকদিন পর মায়ের জন্য কেঁদে ফেলল। কোনো-কোনো সময় চোখের জল ফেলতে এত আরাম লাগে-কখনো জানতে না সে। হঠাৎ একজন ওকে জিজ্ঞাসা করল, সুনীল আপনার কেউ হয়? কথাটা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকাতেই সে প্রশ্নটা শুধরে নিল, আত্মীয়?

এবার চট করে চোখের জলটা মুছে ফেলল অনিমেষ, আমরা এক বাড়িতে থাকি।

ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। দাহ করার তোড়জোড় চলছে। অনিমেষ ভালো করে নজর করে দেখল সুনীলদার জন্য কেউ কাঁদছে না। সবাই যেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সুনীলদার শেষকৃত্য করে যাচ্ছে। এখন কেউ কোনো ধ্বনি দিচ্ছে না।

খুব অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের। যেহেতু সুনীলদা হিন্দু, তাই অন্তর এই সময়ে হরিধ্বনি দেওয়া উচিত। একথাটা কারও মাতায় ঢুকছে না কেন এই সময় হরিধ্বনি নেই, কান্না নেই-যদিও সে কখনো দাহ করতে শ্মশানে আসেনি, তবু পিসিমার কাছ থেকে শুনে-শুনে এটা একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে হচ্ছিল তার। শেষ সময়ে হরিনাম করলে আত্মার শান্তি হয়। কথাটা ও সেই ছেলেটিকে বলল। এতক্ষণ কবিতা আবৃত্তি করার পর শ্মশানে এসে সে চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। কথাটা শুনে সে ম্লান হাসি হাসল, সব মানুষের আত্মা কি এক নিয়মে চলে? কোটিপতি চোরাকারবারি আর সত্যিকারের একজন শহীদ মরার পর হরিনাম শুনলেই যদি আত্মা শান্তি পায় তা হলে বলার কিছু নেই। সত্যিকারের কমিউনিস্ট তার যতক্ষণ দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি পাবে না।

অনিমেষ হঠাৎ অনুভব করল, ও যেন কথাটা অস্বীকার করতে পারছে না। ক্ষুদিরাম বলেছিলেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি ফিরে জন্ম নেবেন। সত্যি একটা চোর আর শহীদের আত্মা সমান সম্মান এবং সুবিধে পেতে পারে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top