What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

কোনোদিন এত সকাল-সকাল ও স্কুল থেকে বের হয়নি। স্কুলের বাগানটা এখন হরেকরকম ফুলে উপচে পড়ছে। এত প্রজাপতি আর মৌমাছি উড়ে বেড়ায় যে সাবধানে শান-বাঁধানো প্যাসেজটা দিয়ে হাঁটতে হয়। বাড়িতে কার কী হল? আসবার সময় তো তেমন-কিছু দেখে আসেনি! দাদুর কি শরীর খারাপ হয়েছে? কে এসে খবর দিল? ও হঠাৎ দৌড়তে শুরু করল। স্কুলের গেট খুলে রাস্তায় পা দিতেই দেখল মেনকাদি ওদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই হাত নেড়ে কাছে ডাকল।

এই, তোমার জন্য ঠায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসো।

মেনকাদি একগাল হাসল। অনিমেষ বুঝতে পারল না মেনকাদি কেন তার জন্য অপেক্ষা করবে। ও বলল, আমাকে বাড়িতে যেতে হবে, খুব বিপদ। কিছু-একটা হয়েছে, খবর এসেছে।

ঠোঁট ওলটাল মেনকাদি, তুমি একদম বন্ধু, আমরাই খব দিয়েছি। প্রিয়দই দিতে বললেন। নিজের হাতে গেট খুলে দিলেন মেনকাদি।

এক-এক সময় অনিমেষের নিজের ওপর খুব রাগ হয়। সবকথা অনেক সময় ও চট করে ধরতে পারে না। যেমন এই মুহূর্তে ও মেনকাদির কথার মানে বুঝতে পারছে না। ওর বাড়িতে বিপদ হলে মেনকাদিরা কী করে জানবেন! নাকি বিপদটিপদ কিছু নয়, শুধুশুধু মেনাদিরা ওকে ডেকে আনল! কিন্তু কেন?

মেনকাদি গেট বন্ধ করতে করতে অনিমেষ দেখে নিল গেটের বাইরে বিরাম কম শব্দটার আগে আজ অ অক্ষরটা লেখা নেই! মেনকাদি ওর চোখ দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল, হেসে বলল, আজ বাবার নামটা ঠিক আছে, না! আচ্ছা, যারা দেওয়ালে এসব লেখে তারা কী আনন্দ পায় বলো তো?

অনিমেষ বলল, জানি না, আমি কখনো লিখিনি।

মেনকাদি বলল, জানি না, আমি কি তা-ই বলছি। তারপর অনিমেষকে নিয়ে বারান্দার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আচ্ছা, আমাদের বাড়িতে তো তুমি সেদিন এলে, কাকে তোমার সবচেয়ে ভালো লাগল? বাবা, মা, আমি, উর্বশী আর রম্ভা-চটপট ভেবে নাও, কাকে খুব ভালো লেগেছে তোমার?

এরকম বোকা-বোকা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল। অনিমেষ হাসল, সবাইকে।

মিথ্যে কথা! একদম মিথ্যে কথা! রম্ভা আমাকে বলেছে। হাসতে হাসতে মেনকাদি বারান্দায় উঠে পড়লেন। রম্ভা আবার কী বলল মেনকাদিকে রম্ভার সঙ্গে তো ওর তেমন কোনো কথা হয়নি। কিন্তু এ-ব্যাপারে মেনকাদি ইতি টেনে দিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, এই নিন, আপনার ভাইপোকে এনে দিলাম।

অনিমেষ দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল ঘরে বেশ একটা মিটিংতো ব্যাপার চলেছে। বিরাম কর তেমনি গিলে–করা দুধ-রঙা পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন, তাঁর একপাশে নিশীথবাবু একটা লম্বা কাগজে কীসব লিখছেন! উলটোদিকে ছোটকাকা গম্ভীরমুখে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ছোটকাকার পাশে মুভিং ক্যাসেল বসে। অভিং ক্যাসেলের দিকে নজর যেতেই অনিমেষ চোখ সরিয়ে নিল। অসাবধানে আঁচল সরে যাওয়ায় মুভিং ক্যাসেলের বড়-গলার জামার উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না, কেমন অস্বস্তি হয়।

প্রিয়তোষ বলল, আয়! আজ আর স্কুল করতে হবে না। তোর মাস্টারমশাই অনুমতি দিয়েছেন।

অনিমেষ নিশীথবাবুকে আর-একবার দেখল। এর আগে অসুখবিসুখ ছাড়া নিশীথবাবু কোনদিন স্কুল-কামাই করেননি। নিশীথবাবু বললেন, ফার্স্ট পিরিয়ড কেউ নিল? ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

প্রিয়তোষ বলল, মোটামুটি একইভাবে কাজ হলে কিছু আটকাবে না। নিশীথবাবু, আপনি তা হলে জেলার সবকটা স্কুলের প্রথম চারজন ছেলের একটা লিস্ট করে ফেলুন। ক্লাস এইট আর নাইন। টেন দরকার নেই, ওদের ইনফ্লুয়েন্স করার সময় পাবেন না। এইট নাইনের মেরিটোরিয়াস ছাত্রদের জন্য স্কলারশিপ দিলে কাজ হবে। কটা বাজল?

বিরাম কর সরু গলায় বললেন, দেরি আছে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করেছি?

মুভিং ক্যাসেল বললেন, তা হোক, গরিবের বাড়িতে একটু খেয়ে যেতে হবে ভাই।

প্রিয়তোষ বলল, কী দরকার। দুপুরের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে যাব।

মুভিং ক্যাসেল ছেলেমানুষের মতো মুখভঙ্গি করলেন, আহা! না খেয়ে গেলে আমার মেয়েদের বিয়ে হবে না, সেটা খেয়াল আছে।

যেন বাদ্য হয়েই মেনে নিল ছোটকাকা, মাথা নাড়ানো দেকে অনিমেষের তা-ই মনে হল। নিশীখবাবু বললেন, আমরা কি সবাই এয়ারপোর্ট যাব?
 
মাথা নাড়ল ছোটকাকা, না না, আপনারা পরিচিত লোক, ওদের দৃষ্টি এড়াতে পারবেন না। বেশি লোক যাবার দরকার নেই। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, অনি, তুই এক কাজ কর, বাড়িতে গিয়ে আমার ব্যাগটা চট করে নিয়ে আয়। দিদিকে বলবি না এখানে আমি আছি, বলবি জরুরি দরকারে এখনই চলে যেতে হল। পরে চিঠি দেব। আর কেউ যদি তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় আছি না-আছি তুই কোনো উত্তর দিবি না। যা।

অনিমেষকে অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল। ছোটকাকা এখন বাড়ি ফিরবে না। তার মানে যাবার আগে দাদু-পিসিমার সঙ্গে দেখা করবে না। এখানে এইভাবে ছোটকাকা বসে আছে কেন? বললেন, এখানে খেয়েদের বাড়ি গেলে ওঁর প্লেন ধরতে দেরি হয়ে যাবে বলে তোমাকে ব্যাগটা এনে দিতে বলেছেন।

মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অনিমেষ। বারান্দা থেকে নামতেই পেছনে ছোটকাকার গলা পেল, অনি!

অনিমেষ ঘুরে তাকাল। ছোটকাকা কাছে এসে বলল, রাজনীতিতে অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়, তুই আর-একটু বড় হলে ব্যাপারটটা বুঝতে পারবি। যদি দেখিস বাড়ির সামনে লোকজন আছে, পেছন-দরজা দিয়ে লুকিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসবি। তুই তো কংগ্রেসকে ভালবাসিস। আজ তুই যা করছিস তা কংগ্রেসের জন্যে। কেউ যেন না জানতে পারে আমি এখানে আছি। যা।

আচ্ছন্নের মতো সমস্তটা পথ অনিমেষ হেঁটে এল। ছোটকাকা কি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসি হয়ে গেল। দ্যুৎ তা কী করে হবে! কাল রাত্রেই তো তেজেনদাকে বলল অ্যান্টিকংগ্রেস মুভমেন্ট করতে, টাকার চিন্তা নেই। অথচ আজ যেভাবে বিরামবাবুদের সঙ্গে বসে মিটিং করছে তাতে তো কালকের রাত্রের ঘটনাটা বিশ্বাস করাই যায় না। বাড়ির সামনে এসে ও দেখল পাঁচ-ছয়জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একজনের দাড়ি আছে। সরু গলি দিয়ে যেতে গেলে ওদের পাশ কাটাতে হবেই। একজনরেই অনিমেষ বুঝতে পারল এরা এপাড়ার ছেলে নয়। চুপচাপ গলি জুড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কাছাকাছি হতেই ওরা অনিমেষকে ঘিরে ধরল, কোথায় যাচ্ছ?

অনিমেষ দেখল দাড়িওয়ালা লোকটা ওর সঙ্গে কথা বলছে। প্রথমে একটু নার্ভাস-নার্ভাস লাগছিল ওর, কিন্তু চট করে ভেবে নিল নিজের দুর্বলতার প্রকাশ করলে বোকামি হবে। আর দেশের কাজ করতে গেলে এর চেয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। ও গম্ভীরমুখে বলল, কেন? বাড়িতে যাচ্ছি!

ওদের মধ্যে কে যেন বলল, হ্যাঁ, এই বাড়িতেই থাকে?

প্রিয়তোষবাবু তোর কে হন? দাড়িওয়ালা জিজ্ঞাসা করল।

কাকা।

এখন বাড়ি যাচ্ছ যে, স্কুল নেই।

এই প্রশ্নটার সামনে পড়তেই একটু হকচকিয়ে গেল অনিমেষ। সত্যি তো, এখন ওর স্কুলে থাকার কথা। কী উত্তর দেওয়া যায় বুঝতে না পেরে ও খিঁচিয়ে উঠল, তাতে আপনার কী দরকার? আর বলমাত্র ওর নাভির কাছটা চিনচিন করে গেল।

দরকার আছে বলেই বলেছি।

দাড়িওয়ালার গলার স্বরে এমন একটা গম্ভীর ব্যাপার ছিল যে অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে এবার সত্যি সত্যি একটা কারণ খুঁজতে গিয়ে ব্যাথাটাকে সম্বল করল, আমি ল্যট্টিনে যাচ্ছি।

দাড়িওয়ালা যেন এরকম উত্তর আশা করেনি, চোখ কুঁচকে বলল, সত্যি?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

তোমার কাকা কোথায় গেছে জান?

কেন?

বড় প্রশ্ন করে তো! শোনো, তোমার কাকাকে আমাদের দরকার। প্রিয়তোষবাবুর বাবা বললেন যে বাড়িতে নেই, কোথায় গেছে জানেন না। তুমি জান।

এমন সরাসরি মিথ্যে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। যতই শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের গল্প পড়া থাক এই মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল এরা একদম খারাপ লোক নয়। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দাড়িওয়ালা আরও কাছে এগিয়ে এল, শোনো ভাই, তুমি জলপাইগুড়ির ছেলে, আমাদেরই মতন, তুমি নিশ্চয়ই জান না তোমার ছোটকাকা এতদিন পর এখানে এসে কী বিষ ছড়াচ্ছে। তাকে আমরা মারব না, কিছু বলব না, শুধু চাইব এই মুহূর্তে সে যেন জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে যায়। দালালরা এসে আমাদের সর্বনাশ করুক তা আমরা চাই না। তুমি চাও?
 
আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। কিন্তু ওর মনে হল টের চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমশ পাক খেতে শুরু করেছে। ছোটকাকা বলল, দেশের কাজ করতে। এরা নিশ্চয়ই কংগ্রেসি নয়। যা-ই হোক, এরা যদি ছোটকাকার চলে-যাওয়া যায় তো ছোটকাকা তো একটু বাদেই চলে যাচ্ছে। ছোটকাকার যাওয়াটা যদি কাম্য হয় তা হলে তার ঠিকানা না বললেও তো এদের কাজ হচ্ছে।

অনিমেষ বলল, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।

খুব হতাশ হল দাড়িওয়ালা। একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, বাড়িতে গিয়ে যদি জানতে পার কিছু আমাদের বলবে, বলবে তো?

অনিমেষ সত্যি আর দাঁড়াতে পারছিল না। ওর কপালে ঘাম, আর দুটো হাঁটু হঠাৎ দুর্বল হয়ে শিরশির করছিল। পেটের মধ্যে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে ও আড়ষ্ট পা জোরে জোরে ফেলে বাড়িতে চলে এল। বাইরের দরজা বন্ধ। কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে এখন। সমস্ত শরীর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে অনিমেষ দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল। ভেতর থেকে সরিৎশেখরকে কে বলে চিৎকার করতে করতে এসে দরজা খুলতেই অনিমেষ তীরের মতো তার পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল। আচমকা ছেলেটাকে ছুটে যেতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন সরিৎশেখর, মেয়ে নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলেন, হেম, ও হেম, দ্যাখো অনিকে বোধহয় ওরা মেরেছে। ছেলেটা ছুটে গেল কেন, ও হেম!

মহীতোষ অনেকদিন আগে স্বৰ্গছেঁড়া থেকে ভালো কালামোনিয়া চাল এনে দিয়েছিলেন। হেমলতা রান্নাঘরে বসে কুলোয় করে সেই চাল বাছছিলেন। প্রিয়তোষের জন্য আজ স্পেশাল ভাত। বাবার ডাকে তিনি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিলেন, কে মেরেছে, কে ছুটে গেল, ও বাবা, কার কথা বলছেন, ও বাবা!

সরিৎশেখর ভেতরে এসে তেমনি গলায় বললেন, অনি ছুটে গেল, কোথায় গেল দ্যাখো, আঃ, আমি আর পারি না!

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা রান্নাঘরের বাইরে এসে চিৎকার করে অনিকে ডাকতে লাগলেন, ও অনি, অনিবাবা, তোকে মারল কে? এ-ঘর সে-ঘর উঠোন বাথরুম কোথাও না পেয়ে হেমলতা থমকে দাঁড়ালেন, ও বাবা, আপনি ঠিক দেখেছেন তো, অনি না অন্য কেউ!

সরিৎশেখর বিরক্ত হয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন, আঃ, আমি অনিকে চিনি না?

কী জানি, ও হলে তো বাড়িতেই থাকত। মা-মরা ছেলেটাকে মারবেই-বা কেন? না, আপনাকে ঠিক বাহাতুরে ধরেছে, কী দেখতে কী দেখেছেন।

পেছনে দাঁড়ানো বাবার দিকে চেয়ে হেমলতা এই প্রথম দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা যা তিনি কিছুদিন হল মনেমনে বিশ্বাস করছিলেন অর্কপটে ঘোষণা করলেন। সরিৎশেখর নিজের কানকে হেমলতার অভিযোগটা সত্যি হয়ে যাবে তিনি ভেবে রাখলেন যে মেয়েকে এই ব্যাপারে পরে আচ্ছা করে কথা। শোনাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে ছেলেটাকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

পৃথিবীতে এর চেয়ে মূল্যবান আনন্দ আর কী থাকতে পারে? সমস্ত শরীরে অদ্ভুত তৃপ্তি, জমেথাকা ঘামগুলোয় বাতাস লেগে একটা শীতল আমেজ-অনিমেষ উঠোনের আর-এক প্রান্তের পুরনো পায়খানার দরজা খুলে বাইরে এল। প্যান্টের বোম আঁটতে আঁটতে ওর নজরে পড়ল, দুটো মুখ অপার বিস্ময় মুখচোখে এঁটে তার দিকে চেয়ে আছে। ওর চট করে মনে পড়ল যে, পায়খানায় ঢোকার সময় আজ একদম সময় ছিল না স্কুলের জামাকাপড় ছেড়ে যাবার। আক্রমণটা বোধহয় এদিক দিয়েই আসবে। অবশ্য নির্ভয় হতে-হতে ও দাদু পিসিমার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু সূত্রটা ধরতে পারছিল না।

হেমলতা প্রথম কথা বললেন, তুই! পায়খানায় গিয়েছিলি?

খুব দ্রুত ঘাড় নাড়র অনিমেষ হুঁ।

পেছন থেকে সরিৎশেখর হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, হবে না! দিনরাত গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াচ্ছ, পেটের আর দোষ কী? হ্যাঁ, আমায় বাহাত্তরে ধরেছে, না? চোখে কম দেকি! দ্যাখো হেম, তোমার দিনদিন জিভ বেড়ে যাচ্ছে, যা নয় তা-ই বলছ। হবে না কেন, যেমন ভাই তেমনই তো বোন হবে!

একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন হেমলতা, সত্যি সত্যি অনি এসেছে, বাবা ভুল দেখেননি। কিন্তু শেষ কথাটায় ওঁর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল, কী বললেন, যেমন ভাই নে বোন, না? তা আমরা কার ছেলেমেয়ে? আমি যদি না থাকতাম তবে এই শেষ বয়সে আপনাকে আর ভাত মুখে দিতে হত না!

কী বললে! তুমি খাওয়া নিয়ে খোটা দিলে? সরিৎশেখর চিৎকার করে উঠলেন।

আপনি কি কম দিচ্ছেন! আপনার কফ ফেলা থেকে শুরু করে কী না আমি করেছি! বিনা পয়সার চাকরানি। আর-কেউ এক বেলার বেশি আপনার সেবা করতে ঘেঁষত না। থাকত যদি সে-চট করে পালটে গেল হেমলতার গলার স্বর, আমার পোড়া কপাল যে!

এবার সরিৎশেখর চাপা গলায় বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

অনিমেষ দাদু-পিসিমার এই রাগারাগি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। হঠাৎ দেখল পিসিমা তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছেন, কপালের আর দোষ কী! বাড়িসুদ্ধ সবাই উচ্ছন্নে গেলেও এই ছেলেটা আমার কথা শুনত। মাধুরী চলে যাবার পর বুকের আড়াল দিয়ে রাখলাম, সে এমন হেমস্তা করল আমাকে!

সরিৎশেখর অবাক হয়ে বললেন, কী করল ও!

অনিমেষ এতক্ষণ আক্রমণটাকে এভাবে আসতে দেকে দৌড়ে বাথরুমে যেতে-যেতে শুনল পিসিমা বলছেন, বাইরের জামাকাপড় পরে পায়খানায় ঢুকছে, সাহস দেখছেন!
 
জামাকাপড় পালটে অনিমেষ বাইরে এসে দেখল সরিৎশেকর চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ওকে দেখে আঙুল তুলে কাছে ডাকলেন। দাদুর এরকম ভঙ্গি এর আগে দেখেনি ও কাছে গিয়ে দাঁড়াতে সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি চলে গেছেন?

কার কথা জিজ্ঞাসা করছেন বুঝতে অসুবিধে হল না অনিমেষের, সে নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

কোথায় আছে জান? সরিৎশেখর চাপা গলায় প্রশ্ন করছিলেন।

হুঁ! দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলা যায় না।

কোথায়?

বিরাম করে বাড়িতে। অনিমেষ এমন গলায় কথা বলল যেন তৃতীয় ব্যক্তি শুনতে না পায়।

বিরাম কর! কংগ্রেসের বিরাম কর তোমাদের স্কুলের সামনে যার বাড়ি?

হ্যাঁ।

ওখানে সে কী করছে। সেই মুটকি মেয়েছেলেটার খপ্পরে পড়েছে নিশ্চয়ই। যাক, আমার কী! কিন্তু ওর সঙ্গে আলাপ হল কবে? নিজের মনেই সরিৎশেখর কথাগুলো বলছিলেন।

মুটকি মেয়েছেলেটা! সামলাতে সময় লাগল অনিমেষের। দাদুর মুখে এ-ধরনের কথা এর আগে শোনেনি ও। আর খপ্পরে বললেন কেন, উনি কি রাক্ষুসী না ছেলেধরা যে তার খপ্পরে পড়েছে বলতে হবে! অনিমেষ নির্লিপ্ত হয়ে বলতে চেষ্টা করল, কাল এয়ারপোর্টে আলাপ হয়েছিল। ওঁরা কংগ্রেসের নেতা।

কংগ্রেস! ওদের তুমি কংগ্রেসি বলছ চোরের আবার ভালো নাম! কংগ্রেসের নাম করে এখানে বসে রক্ত চুষে খাচ্ছে! কংগ্রেস যারা করতেন তারা স্বাধীনতার আগেই মারা গিয়েছেন। শেষ মানুষ ওই গান্ধীবুড়ো। এসব চোখে দেখতে হবে বলে ঈশ্বর সাততাড়াতাড়ি সরিয়ে নিলেন। তোমার কাকা কার দালাল? সরিৎশেখর ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন।

দালাল।

হ্যাঁ, বাইরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোকে দেখনি? ওরা বলল তোমার কাকার ঠিকানা চায়। সে নাকি দালাল। টাকা দিয়ে সব কিনতে চায়। আমাকে তো মাত্র হাজার টাকা দিল, দিয়ে কিনে নিল। কার দালাল ও?

জানি না!

করত কমিউনিজম, এখন দেখছি কংগ্রেসিদের বাড়িতে আড্ডা মারছে। আর বেছে বেছে তার বাড়িতে যার বউ-মেয়ের নাম শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে লেখা আছে। শাবাশ।

হঠাৎ হেমলতার গলা পাওয়া গেল। তিনি যে কখন রান্নাঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায়নি আঁনি। হেমলতা বললেন, প্রিয়তোষ যা-ই করুক সে বুঝবে, এই বাপে-তাড়ানো মায়েবেদানো ছেলেগুলোর তাতে মাথা ঘামানোর কী দরকার?

সরিৎশখর সোজা হয়ে বসলেন, আছ তো রাতদিন রান্নাঘরে বসে, কিছু টের পাও না। পিলপিল করে পাকিস্তানের লোক এসে জুটছে এদেশে, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়েছে খবর রাখ। কিন্তু কংগ্রেস সরকারের সেদিকে খেয়াল আছে। মানুষ কী খাবে তাদের সেসব ভাববার সময় কোথায়? এই ছেলেগুলো অন্তত দিনরাত চাঁচাচ্ছে দ্রব্যমূল্য কমাও, এটা চাই সেটা চাই বলে। পরজন্মে বিশ্বাস কর? আমার মনে হয় এইসব কমিউনিস্ট হয়ে গেছে।

হেমলতা বললেন, কী যে আবোলতাবোল কথা বলেন! জিজ্ঞাসা করলাম প্রিয়তোষের কথা, আপনি সাতকাহন শুনিয়ে দিলেন।

সরিৎশেখর আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, তোমার ভাই হল দুমুখো সাপ। এর কথা তাকে বলে, ওর কথা একে। জনসাধারণের উপকার হোক এ-ই নেই। কম চাকরি করে সে যে অত টাকা পায়। বিদ্যে তো জানা আছে। নিশ্চয়ই কেউ দিচ্ছে কোনো অপকর্ম করার জন্য। তা এই ছেলেগুলো ওকে দালাল বলে ছিঁড়ে খাবে না?

এতক্ষণে একটু ফুরসত পেল অনিমেষ, ছোটকাকা আমাকে ব্যাগটা নিয়ে যেতে বলেছে, আজকের প্লেনেই চলে যাবে!

ফ্যাসফ্যাসে গলায় হেমলতা জিজআসা করলেন, এখানে খাবে না?

না। মিসেস কর খেতে বলেছেন। অনিমেষ টের পেল কাকাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ওর বেশ আনন্দ হচ্ছে।

সে কী। আমি যে এত রান্না করলাম! পিসিমার আর্তনাদ অনিমেষকে নাড়া দিল।

সরিৎশেখর গম্ভীর গলায় বললেন, হেম, পাখি যখন ডানায় জোর পায় তখন তার মা-বাপ আর একফোঁটা চিন্তা করে না। বিরাম করে বাড়িতে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে, তোমার ভাই সেসব ছেড়ে দিদির রান্না খেতে আসবে কেন? বরং চৌকিদারের ছেলেমেয়েকে ডেকে দিয়ে দাও, ওরা খেয়ে সুখ পাবে।
 
হেমলতা কেঁদে ফেললেন। অনিমেষ আর দাঁড়াল না। একদৌড়ে ঘরে গিয়ে ছোটকাকার ব্যাগটা আলমারির ওপর থেকে নামিয়ে আনল। টেবিলে টুকিটাকি জিনিস ছড়ানো ছিল, সেগুলোজড়ো করো ব্যাগে রাখতে ওটাকে খুলতে হল। একটা সুন্দর গন্ধ ভক করে নাকে লাগল। ব্যাগটার মুখে চাবি নেই। ওর হঠাৎ মনে হল একবার দেখে সেই রিভলভারটা ব্যাগের মধ্যে আছে কি না। না নেই। অনিমেষ পেল না সেটা। তার মানে ছোটকাকা রিভালভার পকেটে নিয়ে বসে আছে বিরাম করের বাড়িতে। গাটা শিরশির করে উঠল অনিমেষের।

ব্যাগ নিয়ে বাইরে এল সে। চড়চড়ে রোদ উঠেছে। ও দেখল, দাদু-পিসিমা উঠোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ও একবার সদরদরজার দিকে তাকাল। এখান দিয়ে গেলে ছেলেগুলো নিয়েই তাকে ধরবে। এপাশের মাঠ পেরিয়ে গেলে নিশ্চয়ই কোনো বাধা পাবে না। ও চলতে শুরু করতেই সরিৎশেখর বললেন, শোনো, প্রিয়তোষকে বলে দিও, আমার কোনো উপকার করতে হবে না, আর এ-বাড়িতে যেন সে কখনো না আসে, বুঝলে?।

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বলে উঠলেন, আপনি ওর টাকা ফেরত দিয়ে দিন বাবা। ও টাকা ছোবেন। কাল থেকে ভাড়াটে এসে যাচ্ছে, এ-মাসটা আমার বালা বিক্রি করে চালান।

প্রথমে যেন একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন সরিৎশেখর, তার মাথা নেড়ে বলরেন, কেন নেব না টাকা আমার এক-একটা ছেলের পেছনে আমি কত খরচ করেছি সে-খেয়াল আছে আমি সব হিসেব করে রেখেছি। সেগুলো আগে শোধ করুক তারপর অন্য কথা।

হেমলতা বললেন, আপনাকে আমি বুঝতে পারি না না বাবা। ওর টাকা ছুঁতে আমার ঘেন্না হচ্ছে।

হাসলেন সরিৎশেখর, তাহলে বোঝে, ওই ছেলেগুলো কেন এত রেগে গেছে।

হঠাৎ কী হল অনিমেষের, ও পেছনের মাঠের দিকে না গিয়ে সদরদরজার দিকে হাঁটতে লাগল। সরিৎশেখর সেটা লক্ষ করে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। অনিমেষ যখন দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন চেঁচিয়ে বললেন, অনিমেষ, বিনা কারণে এইভাবে তোমার স্কুল-কামাই করা-আমি একদম পছন্দ করছি না।

মাথা নিচু করে ব্যাগটা নিয়ে হাঁটছিল অনিমেষ। ও নিজে থেকে স্কুল-কামাই করেনি, দাদু কি জানেন না? দাদু যেন কেমন হয়ে গেছেন! বিরামবাবুর মেয়েদের নিয়ে ছোটকাকার সঙ্গে ইঙ্গিত করে কীসব বললেন! যাঃ, হতেই পারে না! হঠাৎ ওর উর্বশীর কথা মনে পড়ল। উর্বশী আজ স্কুলে গেছে। মেনকাদির সঙ্গে তো নিশীথবাবুর ভ, দাদু এসব কথা জানে না। না জেনে কথা বলা ওদের বাড়ির স্বভাব।

কিন্তু দাদু ছোটকাকুকে এ-বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছেন। জ্যাঠামশাই-এর তা ত্যজ্যপুত্র করলেন না অবশ্য, কিন্তু আসতে না-বলা মানে সম্পর্ক ছিন্ন করা। ওর মনে হল, একটু একটু করে দাদু কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছেন ইচ্ছে করে। কেন?

ছোটকাকার ওপর ওর কাল সন্ধে থেকে জমা রাগটা অস্তে-আস্তে বে; যাচ্ছিল। তপুপিসি, তেজেনদা-সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে ওর মনের মধ্যে একটা আক্রোশ তৈ হয়ে গেল। ও টিক করল দাড়িওয়ালা ছেলেটাকে গিয়ে সব কথা বলে দেবে, ব্যাগটা দেখাবে। : হোক ছোটকাকার, ওর কিছু এসে যায় না। দোষী মানুষের শাস্তি হওয়া দরকার। ছোটকাকা তো কংগ্রেসি নয়। কাল রাত্রে অ্যান্টিকংগ্রেস মুভমেন্টের কথা বলেছে। অতএব ছোটকাকাকে ধরিয়ে দিলে কোনো অন্যায় হবে না।

বড় বড় পা ফেলে ও সরু গলিটায় চলে এলে। ক্রমশ ওর গতি কমে গেল এবং অবাক হয়ে চারধারে চেয়ে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। গলিটা একদম ফাঁকা। যেখানে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একটা গোরু নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। খুব হতাশ হয়ে পড়ল অনিমেষ। ওরা গেল কোথায়? একটু একটু করে গলিটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও ভীষণভাবে আশা করছিল ছেলেগুলোর দেখা পাবে। অথচ এই দুপুরবেলায় গলি এবং বড় রাস্তা ঠাসা রোদ্দুরে মেখে চুপচাপ পড়ে আছে। ওরা কি খোঁজ পাবে না বলে চলে গেল।

ব্যাগটা ওজন যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। কোনো উপায় নেই, অনিমেষ সেটাকে টেনে টেনে বিরাম করের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।
 
ছোটকাকা চলে যাবার পর বিরাম করের বাড়িতে অনিমেষের খাতির যেন বেড়ে গেল। মুভিং ক্যাসেল পরদিন স্কুল ছুটি হতেই ধরলেন। গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা, জেলা স্কুলের ছেলেরা ছুটির পর পিলপিল করে বেরিয়ে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। স্কুলের গেট পার হবার আগেই তপন ওঁকে দেখতে পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে একটা খোঁচা খেল অনিমেষ, ওই দ্যাখ, হোলি মাদার দাঁড়িয়ে আছেন। উইদাউট ডগ।

অনিমেষ বলল, কী হচ্ছে কী?

তপন থামল না, মাইরি, জলপাইগুড়িতে কোনো মেয়ের এরকম ব্লাউজ পরার হিম্মত নেই। শালা নিশীথবাবুটা বহুৎ চালু মাল!

অনিমেষ এবার রেগে গেল, তপন, তুই যদি ভদ্রভাবে কথা না বলতে পারিস তা হলে আমার সঙ্গে আসিস না।

মণ্টু এতক্ষণ শুনছিল চুপচাপ, এবার অনিমেষের পক্ষ নিল, সত্যি কথা। সব ব্যাপারে ইয়ার্কি করা ঠিক নয়। তারপর ফিসফিস করে বলল, মাসিমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দে না ভাই।

ততক্ষণে ওরা রাস্তায় এসে পড়েছে। চোখাচোখি হতে মুভিং ক্যাসেল ঠোঁট টিপে মাথা সামান্য কাত করে হাসলেন অনিমেষ বলল, তোরা দাঁড়া, আমি আসছি। কাছাকাছি হতেই মুভিং ক্যাসেল অদ্ভুত মিষ্টি গলায় বললেন, বাবাঃ, ছুটি আর যেন হয় না, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বাড়িতে একটু আসবে না

অনিমেষ দেখল স্কুলের অন্যান্য ছেলে যেতে-যেতে ওদের দেখছে। মণ্টু আর তপন চুপচাপ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। অনিমেষ বলল, আমার সঙ্গে যে বন্ধুরা আছে?

ও। চোখ বড় বড় করলেন মুভিং ক্যাসেল, ওঁরাও কংগ্রেসকে সার্পোট করে?

অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না।

মুভিং ক্যাসেল তাতে একটুও দুঃখিত হলেন না, আচ্ছা! তোমার বন্ধু যখন তখন ওরা নিশ্চয়ই ভালো ছেলে, কী বল? তা ওদের ডাকো না, ওরাও আসুক, বেশ আড্ডা দেওয়া যাবে খন। তোমার দাদা আবার আজকে প্লেনে কলকাতায় গেলেন। ঘোটকুটার শরীর খারাপ বলে আমি থেকে গেলাম।

অনিমেষ হাতে নেড়ে বন্ধুদের ডাকল। মণ্টু বোধহয় এতটা আশা করতে পারেনি, ও তপনকে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু বলল, তারপর দুজনে আড়ষ্ট-পায়ে এদিকে আসতে লাগল। মুভিং ক্যাসেল গেটটা খুলে ওদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন, এসো এসো, তোমরা তো অনিমেষের বন্ধু, এক ক্লাসেই পড় বুঝি?

মণ্টু ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। তারপর ঝুঁকে পড়ে ওঁকে প্রণাম করতে গেল। প্রথম বুঝতে পারেনি মুভিং ক্যাসেল, তারপর সাপ দেখার মতো যতদূর সম্ভব শরীরটাকে সরিয়ে নিলেন, ওমা, এর যে দেখছি দারুণ ভক্তি! দিদি বউদিকে কি কেউ প্রণাম করে, বোকা ছেলে! এসো।

মুভিং ক্যাসেলের পেছন পেছন যেতে-যেতে অনিমেষ মণ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। আজকাল কথায়-কথায় মুভিং ক্যাসেলের প্রসঙ্গ উঠলে মণ্টু মাসিমা বলে, বেচারার প্রথম চালটাই নষ্ট হয়ে গেল।

বারান্দার বেতের চেয়ারে ওরা বসল। মুভিং ক্যাসেলের বসবার সময় চেয়ারটায় মচমচ শব্দ হতেই তিনি বললেন, খুব মোটা হয়ে গেছি, না?

অনিমেষ কোনো কথা বলল না। উত্তরটা দিলে কারও স্বস্তি হবে না। মুভিং ক্যাসেলও বোধহয় চাননি জবাব, কী গরম পড়েছে, বাবা! পুজো এসে গেল কিন্তু ঠাণ্ডার নাম নেই। কথা বলতে বলতে বুকের আঁচল দিয়ে একটু হাওয়া নিলেন উনি, এবার তোমাদের দুজনের নাম জানা যাক।

অনিমেষ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখল দুজনেই মুখ নিচু করে নাম বলল। কারণটা বুঝতে পেরে চট করে অনিমেষের কান লাল হয়ে গেল। আঁচলে হাওয়া খাওয়ার পর ওটা এমনভাবে কাঁধের ওপর রয়েছে যে মুভিং ক্যাসেলের বুকের গভীর ভাজটা একদম ওর মুখের মতো উন্মুক্ত। মুভিং ক্যাসেলের কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই, নাম শুনে বললেন, বাঃ! সামনের বছর তো তোমরা সব কলেজ স্টুডেন্ট। এখন বলো তো, তোমরা কংগ্রেসকে কেন সাপোর্ট কর না?

মণ্টু সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের দিকে তাকাল। তপন বলল, আমি এসব ভাবি না।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, তুমি?

মণ্টু আস্তে-আস্তে বলল, আমি কংগ্রেসকে পছন্দ করি না।

গুড। হাততালি দিয়ে উঠলেন মুভিং ক্যাসেল, আজ বেশ জমবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার আগে একটু চা হলে ভালো হয়, না? চা খাও তো সবাই?
 
অনিমেষ বাড়িতে চা খায় না। কখনো-কখনো সর্দিকাশি হলে পিসিমা আদা দিয়ে চা তৈরি করে। দেন। কিন্তু আজ বন্ধুরা কেউ আপত্তি না করাতে ও চুপ করে থামল। মুভিং ক্যাসেল চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করে আবার বসে পড়লেন, আর পারি না। অনিমেষ ভাই, তুমি একটু যাও-না, ভেতরের রান্নাঘরে দেখবে আমাদের মেইড-সার্ভেন্ট আছে, ওকে বলবে চার কাপ চা আর খাবার দিতে। তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে। আদুরে মুখভঙ্গি করলেন উনি।

বই-এর ব্যাগটা রেখে অনিমেষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মণ্টু আর মুভিং ক্যাসেলের আলোচনাটা শোনে। মণ্টু ইদানীং খুব কংগ্রেসকে গালাগালি দেয়। অনিমেষকে ঠাট্টা করে বলে, কবে ঘি খেয়েছিস এখন হাত চেটে গন্ধ নে। ও চটপট ফিরে আসবার জন্য ভেতরে পা বাড়াল। ড্রইংরুমটায় কেউ নেই। বিরাম কর যেখানটায় বসেন সে-জায়গাটা চোখে ফাঁকা ঠেকল। সেদিন যে-ঘরটায় ওরা বসেছিল তার দরজায় এল, কেউ নেই এখানে। উর্বশীদের স্কুল এত দেরিতে ছুটি হয় কেন? মেনকাদিও বাড়িতে নেই। ও গরমূখে একদম শেষপ্রান্তে এসে একটা বড় উঠোন দেখতে পেল। উঠোনের এক কোনায় কুয়োর ধারে বসে একজন মাঝবয়সি বউ কী সব ধুচ্ছে। অনুমান করে অনিমেষ তাকেই মুভিং ক্যাসেলে হুকুমটা শোনাল। ও দেখল মুখ ঘুরিয়ে বউটা তাকে দেকে নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। ভেতরটা বেশ ছিমছাম, সুন্দর। অনিমেষ দেখল উঠোনের এপাশে আর একটা ঘর, তাতে পর্দা ঝুলছে। ওটা কার ঘর? এই সময় ওর মনে পড়ল বাড়িতে ঢোকার সময় মুভিং ক্যাসেল বলেছিলেন, ওঁর বিরাম করের সঙ্গে কলকাতায় যাওয়া হল না ছোটকুটার অসুখের জন্য। ছোটকু কে? বাড়ির সবচেয়ে ছোট তো রম্ভা, নাকি আর কেউ আছে? ওর মন বলল, যে-ই হোক সে। অসুস্থ হয়ে ওই ঘরে শুয়ে আছে। মুভিং ক্যাসেল বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর কেউ একজন অসুস্থ। হয়ে ঘরে শুয়ে আছে ভাবতে খারাপ লাগল অনিমেষের। ওর ইচ্ছে হল একবার ঘরটা দেখে যাবার। কুয়োর ধারে বসে কাজ করে-যাওয়া বউটার দিকে তাকিয়ে ওর একটু সঙ্কোচ হচ্ছিল, ফট করে একটা পর্দা-ফেলা-ঘরে উঁকি দিয়ে কিছু ভাববে না তো? তারপর সেটা ঝেড়ে ফেলে পায়েপায়ে উঠোনটা পেরিয়ে পর্দাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। আশ্চর্য, বউটা একবারও ঘুরে ওকে দেখল না, কিন্তু দাঁড়ানোমা ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কেউ বলে উঠল, কে? অনিমেষের আর সন্দেহ রইল না ছোটকু মানে রম্ভাই। ও-ই অসুস্থ। কী হয়েছে রম্ভার? এখন এই মুহূর্তে আর এখান থেকে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। ও মণ্টুর কথা ভাবল। মণ্টু এখন বাইরে মুভিং ক্যাসেলের সঙ্গে পলিটিকস্ নিয়ে আলোচসা করার সময় ঘৃণাক্ষরে ভাবতে পারছে না রম্ভা এখানে অসুস্থ হয়ে রয়েছে! এক হাতে পর্দাটা সরাল অনিমেষ।

ভেতরটা আবছায়া, খাটের ওপর রম্ভাকে দেখতে পেল ও। পর্দা তোলামাত্র রম্ভা চট করে কী যেন সরিয়ে ফেলতে গিয়ে ওকে দেখে সেটা নিয়েই অবাক হয়ে উঠে বসল, আরে! কী আশ্চর্য ব্যাপার!

অনিমেষ সেখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার?

হঠাৎ মুখটা গম্ভীর করে রম্ভা শুয়ে পড়ল, বলব না।

এরকম ব্যাপার কখনো দেখেনি অনিমেষ, কেন?

মায়ের কাছে জেনে নাও। দরজায় দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে থা বলা দ্রতা নয়। রম্ভা বলল।

আনিমেষ ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, এবার বলল, কী হ যছে?

সর্দি জ্বর। কাছে এসেছ তোমারও হয়ে যাবে। রম্ভা চাদরটা গলা অবধি টেনে নিল। অনিমেষ হাসল। মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রম্ভা বলল, দিদির কাছে এসেছে।

চমকে উঠল অনিমেষ, না না। আমাদের মাসিমা ডেকে এনেছেন। দিদি বলতে উর্বশীর মুখ মনে পড়ে গেল ওর। এবং এখন ওর ইচ্ছে হচ্ছিল উর্বশী তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক।

আমাদের মানে? রম্ভ কথা ধরল।

এবার অনিমেষ একটু মজা করল, আমি আর আমার দুই বন্ধু। যার একজনের কথা তুমি সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে, তোমার কথাও ও আমাকে জিজ্ঞাসা করে।

মুখ বেঁকাল রম্ভা, ও, সেই গুন্ডাটা! ও আবার এল কেন?

গুণ্ডা? হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ।

একটা ছেলে সাইকেলে চেপে এসেছিল, তাকে ও মারেনি? বদমাশ ইতর। রম্ভার গলায় তীব্র ঝাঁঝ, কীসব বন্ধু তোমার! আবার তাদের নিয়ে এসেছ!

অনিমেষ চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, আমি যাই।

সঙ্গে সঙ্গে খিঁচিয়ে উঠল রম্ভা, যাই মানে? ইয়ার্কি, না? আমার ঘুম ভাঙিয়ে এখন চলে যাওয়া হচ্ছে। বসো এখানে পাঁচ মিনিট।

তুমি ঘুমিচ্ছিলে কোথায়? বই পড়ছিলে তো! অনিমেষ বালিশের পাশে উপুড় করে রাখা বইটা দেখাল।

রম্ভা বলল, আচ্ছা আচ্ছা। একটু বসে যাও প্লিজ।

মাসিমা খোঁজ করবেন, আমি চা বলতে এসেছিলাম। অনিমেষ ইতস্তত করছিল।
 
মা এখন তোমার বন্ধুদের সঙ্গে বকবক করবে, খেয়াল করবে না। তা ছাড়া তোমার বাকা হল। মায়ের ফ্রেন্ড। কথাটা বলার ভঙ্গি অনিমেষের ভালো লাগল না। ঘরের এক কোণে টেবিলের গায়ে একটা চেয়ার সাঁটা আছে। ওখানে বসলে এদিকে মুখ ফেরানো যাবে না। এরকম চেয়ার-টেবিল স্কুলে থাকে। নিশ্চয়ই পড়ার টেবিল। ও কোথায় বসবে বুঝতে পারছে না দেখে রুয়া হাত বাড়িয়ে বিছানার একটা পাশ দেখিয়ে বলল, এখানে বসো, কথা বলতে সুবিধে হবে। অবশ্য তোমার যদি ছোঁয়া লেগে। যাবার ভয় থাকে তো অন্য কথা। এরপর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, অনিমেষ সন্তর্পণে বিছানার একপাশে। বসল। বসেই ও বইটার মলাট স্পষ্ট দেখতে পেল।

রম্ভা সেদিকে তাকিয়ে বইটা সরাতে গিয়ে থেমে গেল, এই বইটা তুমি পড়েছ?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। মাথার ওপর চাঁদ, বকুলগাছের তলায় আলুথালু হয়ে দুটো ছেলেমেয়ে জড়াজড়ি করছে, নিচে লেখা হনিমুন। এ-ধরনের বই এর আগে কখনো দেখেনি ও। একদিন ওদের ক্লাসের ফটিক কেমন বিশ্রী ছাপা মলাটা-ছাড়া একটা বই নিয়ে এসেছিল। ফটিকদের একটা দল আছে যাদের সঙ্গে ওরা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। প্রত্যেক বছর একবার করে ফেল করে ফটিক ওদের ক্লাসে উঠেছে। বইটার নাম বাকি লাল গামছা। এরকম নামের কোনো বই হয় বিশ্বাষ হয়নি প্রথমে। তপন বলেছিল, ওটা নাকি খুব জঘন্য বই। এখন এই হনিমুনটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হল এটাও সেরকম নাকি?

তুমি এখন কচি, নাক টিপলে দুধ বের হবে। রম্ভা বইটাকে বালিশের তলায় চালান করে দিয়ে বলল, আমি যে বইটা পড়ছি দিদিকে বলবে না।

হঠাৎ রাগ হয়ে গেল অনিমেষের, তখন থেকে দিদি-দিদি করছ কেন?

ঠোঁট টিপে হাসল রম্ভা, কেন বলব না, তুমি তো উর্বশীহরণ করেছ।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনিমেষ বলল, কী যা-তা বলছ!

চোখ বড় বড় করল রম্ভা, ওমা তাই নাকি! বেশ, তা হলে আমার মাথাটা একটু টিপে দাও তো, খুব যন্ত্রণা করছে। বলেই চোখ বুজে ফেলল ও।

খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এই মেয়েটা ওর থেকে অনেক ছোট, অথচ এমন ভঙ্গিতে কথা বলে যে নিজেকে কেমন বোকা-বোকা লাগে। ও বলল, ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি মাথা টিপতে জানি না। আমি উঠি, মাসিমা বসে আছেন।

রম্ভা হাসল, তুমি ভীষণ দুটু। মা ঠিকই বুঝবেন যে তুমি আমার সঙ্গে গল্প করছ, রুগির সঙ্গে থাকলে কেউ অখুশি হয় না। তারপর একটু চেয়ে থেকে বলল, তুমি কী জান?

মানে?

রম্ভা এবার কাত হয়ে শুয়ে বাঁ হাতটা ধপ করে অনিমেষের পায়ের ওপর রাখল, মানে তুমি মাথা টিপতে জান না, গল্প করতে পার না, একদম ভোঁদাই।

অনিমেষ টের পেল ও পা নাড়তে পারছে না, কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি রম্ভা ওকে শেষ যে-কথাটা বলল, সেটা শুনেও রাগ করতে পারছে না। আঙ্গুল দিয়ে ওর থাই-এর ওপর টোকা মারতে মারতে রম্ভা বলল, তুমি তো বললে দিদির সঙ্গে কিছু হয়নি। তা তোমার আর লাভার আছে?

লাভার। অনিমেষ চোখ খুলেই উর্বশীর মুখ দেখতে পেল। উর্বশী কি ওর লাভার? কী জানি? আর কোনো মেয়ে-যেন গভীর কোনো কুয়ো থেকে দ্রুত টেনে-তোলা-বালতির মতো ওর সীতাকে মনে পড়ল। সীতা কি ওর লাভার সীতাকে কতদিন দেখেনি ও! কতদিন স্বৰ্গছেঁড়ায় যাওয়া হয়নি। সীতার তো এখানে তপুপিসির স্কুলে পড়তে আসার কথা ছিল, ইস, একবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলে হত।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রম্ভা বলল, আছে, না?

আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না।

যাঃ, বিশ্বাস করি না! আজকালকার ছেলেদের আবার লাভার নেই! দিদিভাই-এর তিনজন আছে, একজন কলেজে, একজন কলকাতায় আর একজন তোমার মাস্টার নিশীথদা। দিদিভাই অবশ্য কলকাতার ছেলেটাকে বিয়ে করবে। রম্ভা খবরটা দিল।

সে কী! নিশীথবাবুর সঙ্গে বিয়ে করতে! রম্ভা বলল।

হঠাৎ অনিমেষ সোজা হয়ে প্রশ্ন করল, তোমার দিদির লাভার আছে?

চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল রম্ভা, নাঃ। একজন ছিল কিন্তু বাবার জন্যে কেটে গেছে। আসলে দিদি খুব কাওয়ার্ড।

এবার মোক্ষম প্রশ্নটা করল অনিমেষ, তোমার?

খিলখিল করে হেসে উঠল রম্ভা, কী চালু, এই কথাটা জিজ্ঞাসা করার জন্য কত ভান! হুঁ, আমার পাঁচজন লাভার আছে। কিন্তু কারও সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলিনি। ওদের সবাই আমাকে লাভলেটার দিত, একজন যা ফার্স্ট ক্লাস লিখত না!

তারা কোথায় গেল? অনিমেষের মজা লাগছিল।

দিদিভাই টের পেয়ে গিয়ে মাকে বলে দিল। মা বলল, কলেজে ওঠার আগে এসব করলে বাড়ি থেকে বার হওয়া বন্দ। আমি যে কী করি! রম্ভা হতাশ গলায় বলল।

অনিমেষ এবার উঠে দাঁড়াল, তারপর রম্ভার হাতটা সন্তর্পণে বিছানায় রেখে দিল, এবার তুমি ঘুমোও, আমি চলি।

রম্ভা বলল, আমার বোধহয় আবার জ্বর আসছে।

অনিমেষ দেখল, ওর মুখটা সত্যি লালচে দেখাচ্ছে। ও একটু ঝুঁকে রম্ভার কপালে হাত রাখতেই আঙুলে উত্তাপ লাগল। ও বলল, ইস, তোমার দেখছি বেশ জ্বর!
 
রম্ভা ততক্ষণে ওর হাত দুহাতে ধরে গলায় ঘষতে আরম্ভ করেছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না কী করবে। একবার চেষ্টা করেও রম্ভার শক্ত মুঠো থেকে হাতটাকে সে ছাড়াতে পারল না। শেষ পর্যন্ত টাল সামলাতে পারল না অনিমেষ, ধপ করে রম্ভার বালিশের পাশে বসে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনিমেষ দেখল ওর কোলে একরাশ লক্ষ ফুল ফুলেফেঁপে আট হয়ে ওঠানামা করছে। কিছুতেই যেন কান্না থামছিল না রম্ভার, অনিমেষ টের পেল ওর গা যেন রম্ভার শরীরের জুর-উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। কেমন মায়া হল ওর, আলতো করে রম্ভার চুলের ওপর আঙুল রেখে প্রশ্ন করল, এই, কাঁদছ কেন?

সেইরকম কোলে মুখ ড়ুবিয়ে শুয়ে থেকে কান্নাজড়ানো গলায় রম্ভা বলল, আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ না। আমি ছেলে হইনি বলে জন্ম থেকে মার আফসোস। আমার যে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, আমি কী করব?

অনিমেষ কী বলবে প্রথম বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর ও বলল, ঠিক আছে।

ওকে শক্ত করে ধরে রেখে কেমন করুন গলায় রা জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমাকে ভালোবাসবে?

রম্ভার শরীর থেকে উঠে-আসা উত্তাপ হঠাৎই অনিমেষের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। এর জন্য সে একটুও প্রস্তুত ছিল না, যেন অন্ধকার ঘরে ঢুকে কেউ টপ করে সুইচ অন করে দিয়েছে। সেই তিস্তার চর থেকে পালিয়ে-আসা অনিমেষের মুখোমুখি হয়ে গেল সে। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম হাত-পা অবশ। রম্ভা আবার বলল, এই বলো-না, আমাকে ভালোবাসবে তো?

সিল্কি চুলের ওপর আলতো করে রাখা আঙুলগুলো হঠাৎ গোড়ায় গোড়ায় অক্টোপাসের মতো ঢুকে পড়ল। আর সেই মুহূর্তেই ঘরের আলোটা একটু নড়ে উঠতেই অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে দেখল এক হাতে পর্দা সরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে উর্বশী ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে আলোটা নিভে গেল, উর্বশীর চোখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর শরীরটা আস্তে-আস্তে শীতল হয়ে যাচ্ছে। উর্বশীর এই উপস্থিতি ওর কোলে মুখ ড়ুবিয়ে শুয়ে থাকা রম্ভা টের পায়নি। কান্নার রেশটা গলায় নিয়ে নিজের মনে এই সময় ও বলল, আমি খারাপ, খুব খারাপ, না?

এভাবে বসে থাকা যায় না, অনিমেষ সমস্ত শক্তি দিয়ে রম্বার দুটো হাত কোমর থেকে ছাড়িয়ে নিল। ওর চোখ উর্বশীর দিকে-দরজা থেকে একটুও নড়ছে না সে। পরনে স্কুল-ইউনিফর্ম, কপালে ঘাম রুক্ষ চুল আর চোখে পাথর-হয়ে-যাওয়া বিস্ময়। অনিমেষ জোর করে রম্ভার মাথাটা বিছানায় নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রম্ভার মুখ তখনও উলটোদিকে পাশ-ফেরানো। একটা ঘোরের মধ্যে সে বলে যেতে লাগল, তুমিও আমাকে সরিয়ে দিলে!

অনিমেষ উর্বশীকে কিছু বলতে যেতেই ও দেখল পর্দাটা পড়ে গেল, উর্বশী যেমন এসেছিল তেমন নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর এই আসা এবং চলে যাওয়াটা রম্ভা টের পেল না। অনিমেষের ইচ্ছে হল ও এখনও ছুটে গিয়ে উর্বশীকে সব কথা বলে। ও রর সঙ্গে ইচ্ছে করে এরকম করেনি, রম্ভার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু উর্বশী কি একথা বিশ্বাস করবে? অনিমেষ নিজের মনে সমর্থন পেল না। হঠাৎ ওর বুকের ভেতর অনেকদিন বাদে সেই কান্নাটা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে গলার কাছে জড়ো হয়ে থাকল।

আস্তে-আস্তে বিছানায় উঠে বসে রম্ভার ওর দিকে তাকাল, কী হয়েছে?

নির্জীব গলায় অনিমেষ বলল, তোমার দিদি এসেছিল।

কখন? অনিমেষ অবাক হয়ে শুনল রম্ভার গলা একটু কাঁপল না।

একটু আগে। তারপর বলল, যদি এখন মাসিমাকে বল দেয়!

না, বলবে না। আমি তা হরে অনেক কথা বলে দেব। একদিন বাবার এক বুড়ো বন্ধু ওকে বিচ্ছিরিভাবে আদর করেছিল, আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। ও তো সেকথা মাকে বলেনি? রম্ভা মাথা নাড়ল।

অনিমেষ বলল, কী জানি!

হঠাৎ যেন কারণটা ধরতে পেরে রম্ভা বলে উঠল, ও, দিদি এসেছিল বলে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরে কথা বলছিলে না, তা-ই বলো! তুমি একদম ভোঁদাই!

অনিমেষ এগোল, আমি যাচ্ছি।

খুব ক্লান্ত হয়ে গেল রম্ভার গলা, আবার কবে আসবে?

অনিমেষ বলল, দেখি।

রম্ভা বলর, দাঁড়াও, তোমাকে একটা কথা বলবে, আর বিরক্ত করব না।

বলার ধরনটা এমন ছিল অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াল, কী কথা?

তোমার খুব অহঙ্কার, না?

না তো!

ভালো ছেলে বলে ভীষণ গর্ব তোমার!

হেসে ফেলল অনিমেষ, তুমি বাজে কথা বলছ!

ওর চোখে চোখ রেখে রম্ভা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব, শুনবে?

বলো?

উঁহু, এতদূর থেকে চেঁচিয়ে বললে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ শুনে ফেলবে। প্লিজ, একটু কাছে এসো-না! একদম মুভিং ক্যাসেলের মতো ঘাড় কাত করে রম্ভা বলল।

খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে অনিমেষ বলল, বলো।

ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রম্ভা আস্তে-আস্তে খাট থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়াল। অনিমেষ ওর ভাবভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কথাট বলার জন্য ডেকে যেন ভুলে গেছে রম্ভা। ওর সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরাল, তারপর কী অবলীলায় দীর্ঘ ফীত চুলের। গোছাকে দুহাতে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে ধরে আঁট খোঁপার মতো জড়িয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে রম্ভার চেহারাটাই পালটে গেল। সেদিকে চেয়ে থাকতে রম্ভা দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ওর সমস্ত শরীর দিয়ে ওকে চুমু খেল।
 
অদ্ভুত একটা স্বাদ-ঠোঁট, ঠোঁট থেকে জিভে এবং সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে অনিমেষ দুহাতে ঠেলে রম্ভাকে সরিয়ে দিল। শরীরটা হঠাৎ গুলিয়ে উঠল যেন ওর, বিচ্ছিরি লাগছে রম্ভার ঠোঁটের গন্ধ। বোধহয় এরকমটা হবে রম্ভার অনুমানে ছিল তাই খানিকটা দূরে ছিটকে সরে দাঁড়িয়ে ও মুখটা বিকৃত করল, ভীতু, বুন্ধু, ভোঁদাই! ছি!

কথাগুলো বলে ও আর দাঁড়াল না, দ্রুত গিয়ে বিছানায় উঠে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। বিহ্বল অনিমেষ দেখল শোয়ার আগে রম্ভা হনিমুনটাকে বিছানার তোশকের তলায় চালান করে দিতে ভুলাল না।

অদ্ভুত একটা অবসাদ, গা-রি-বি-বা অস্বস্তি এবং অপরাধবোধ নিয়ে অনিমেষ চুপচাপ পর্দা সরিয়ে বাইরে এল। উঠোন এবং কুয়োর পাড়ে কেউ নেই। এখন ওর সমস্ত শরীরে কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো মেয়ে তাকে এই প্রথম চুম্বন করল অথচ ওর মনে হচ্ছে মুখটা ভালো করে ধুয়ে ফেলতে। পারলে বোধহয় স্বস্তি হত। ও দেখল সেই বউটা একটা ট্রেতে চায়ের কাপ আর খাবার নিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছে। উঠোনে নামল অনিমেষ। কুয়োর ধারে গিয়ে ও অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে। সংবরণ করে পায়েপায়ে বারান্দায় উঠে এল। একটা দুটো ঘর পেরোতেই ও প্রথম দিনের বসার ঘরটার সামনে এল। বাড়ির জামা পরে উর্বশী চুল বাঁধছে। ও যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে উর্বশী যেন। দেখেও দেখছেন না। আয়নার ওপর একটু বেশি ঝুঁকে পড়েছে যেন সে! অনিমেষ বুঝতে পারল উর্বশী ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় না। সঙ্গে সঙ্গে ও ঠিক করল উর্বশীকে সব কথা খুলে বলে যাবে। রম্ভাকে ও ভালোবাসে না, কোনো অন্যায় কিছু করতেও চায়নি, যা হয়েছে সবই রম্ভার ইচ্ছা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে ও শরীরে কোন স্বস্তি পাচ্ছে না-এইসব খুলে বলবে। উর্বশীকে ডাকতে গিয়ে ও আবিষ্কার করল গলা দিয়ে প্রথমে কোনো স্বর বের হল না; জোরে কেশে গলা পরিষ্কার করে ও ডাকল।

মুখ ফেরাল না উর্বশী, সেই ভঙ্গিতে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, তোমাদের চা দেওয়া হয়েছে, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

অনিমেষের মনে হল সেদিন যে-মেয়েটা বন্ধুর মতো কথা বলেছিল এ সে নয়। ওর বুকের ভেতরটা কেমন করছিল, অকারণে কেউ ভুল বুঝবে অনিমেষ ভাবতে পারছিল না। নিজেকে শক্ত করে অনিমেষ বলেই ফেলল, তুমি যা দেখেছ সেটাই সত্যি না।

একটুও অবাক হল না উর্বশী, আয়নার ওপর ঝুঁকে পড়ে কপালে টিপ আকঁতে আঁক-৬ লল, এ-বাড়িতে এই ব্যাপার নতুন নয়, জ্ঞান হওয়া থেকেই তো দেখছি। যাও, মা হয়তো ভাবছেন। একবারও তাকাল না সে, অনিমেষ মুখ দেখার কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রচণ্ড অভিমানে অনিমেষের চোখে জল এসে গেল। ও চুপচাপ আচ্ছন্নের মতো পা ফেলে বিরাম করের ঘরে এল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না কেন? রম্ভার ওপর যে-বিতৃষ্ণা ওর মনে। জমেছিল সেটা এখন প্রচণ্ড ক্রোধ হয়ে উর্বশীকে লক্ষ করল। রম্ভা ওকে অহঙ্কারী বলেছিল, ওর মনে। হল উর্বশী ওর চেয়ে হাজার-গুণ অহঙ্কারী। মেয়েরা সুন্দর হলে এরকম হয় বোধহয়। রম্ভাকে ওর। একদম ভালে লাগে না, এখন ও আবিষ্কার করল উর্বশীকে ও বন্ধু বলে ভাবতে পারছে না আর।

বাইরে বোরতে গিয়ে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। ও বুঝতে পারছিল শরীর এবং মনের ওপর যেঝড় এতক্ষণ বয়ে গেছে, ওর মুখ দেখলে যে-কেউ টপ করে বুঝে ফেলবে। অন্তত মুভিং ক্যাসেলের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। ও জলদি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা রগড়ে নিল। তারপর অনেকটা নিশ্বাস নিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বারান্দায় এল। ওকে দেখতে পেয়েই তিনজনে একসঙ্গে ওর দিকে তাকাল। মুভিং ক্যাসেল বললেন, তোমার চা বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আমরা কিন্তু শেষ করে ফেলেছি।

জড়সড় হয়ে অনিমেষ চেয়ারে বসে দেখল প্লেটে একটা কেক ওর জন্যে পড়ে আছে। কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না, ও চায়ের কাপটা তুলে নিল। সত্যি ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে। মুভিং ক্যাসেল বলরেন, ওমা, কেকটা খেলে না?

কাচুমাচু করে অনিমেষ বলল, খিদে নেই।

সে কী! এইটুকুনি ছেলের খিদে নেই কী গো! তোমাদের বয়সে আমি কত খেতাম! বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন। চা খেতে-খেতে অনিমেষ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে নিল। মটুর মুখটা বেশ গম্ভীর। ওদের খাওয়া হয়ে গিয়েছে, বইপত্তর নিয়ে উঠবার জন্যে তৈরি।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, ছোটকুটার শরীর নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। কথা বলল তোমার সঙ্গে?

চমকে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল অনিমেষ। ও দেখল, মণ্টু সোজা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুভিং ক্যাসেল কি কিছু বুঝতে পারছেন?

ও ঘাড় নাড়ল, ই। খুব জ্বর আছে এখন। যেন জ্বর হরে কেউ কোনো বাজে কিছু করতে পারে।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, একটু আগে আমি দেখলাম নাইন্টি নাইন। তুমি ভুল করেছ। আর ওমেয়ে সবসময় বাড়িয়ে বলে।

অনিমেষ বই-এর ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল, আমরা যাই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top