What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

এতক্ষণে যেন একটু জোর পেয়েছে ছেলেটি পায়ের তলায়, দুহাত দিয়ে মণ্টুর মুঠো থেকে নিজের জামাটা ছাড়িয়ে বলল, এসব ব্যাপারে কি কোনো ড্রশান থাকে। তবে যদি বিশ্বাস না কর ওকে ডেকে আনন, আমি তোমাদের সামনে জিজ্ঞাসা করব।

সঙ্গে সঙ্গে মণ্টু একটা ঘুসি মারল ছেলেটরি মুখে, কিন্তু দ্রুত মুখটা সরিয়ে নেওয়ায় ঘুসিটা কাঁধে গিয়ে লাগল। যন্ত্রণায় ছেলেটা দুহাতে কাঁধ চেপে ধরল। মণ্টু বলছিল, শালা, ভদ্রলোকের মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভজাতে চাও? কোনো প্রমাণ-ফ্রমাণ নেই। আমি একদম বিশ্বাস করি না।

হঠাৎ ছেলেটা রুখে দাঁড়াল, আমি এখানে আসি না-আসি তা তোমাদের কী? তোমরী ওর কেউ ওর?

মণ্টু বলল, আবার কথা হচ্ছে। আমি কেউ হই না-হই সে-জবাব তোকে দেব? আজ প্রথম দিন বলে ছেড়ে দিলাম, আবার যদি কোনোদিন দেখি এইখানে টাকি মারতে তা হলে ছাল ছাড়িয়ে নেব। যাঃ।

ছেলেটা ঘুরে সাইকেলটা ধরতে যেতে তপন বলল, লেগেছে তোর?

একটু অবাক হয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে ছেলেটা বলল, না। বোধহয় নিজের কষ্টের কথা স্বীকার করতে চাইছিল না।

তপন হাসল, গুড। তা হরে ক্ষমা চা, বল, আর কোনোদিন এসব করব না।

ছেলেটা বলল, তোমরা আজ সুযোগ পেয়ে যা ইচ্ছে করে নিচ্ছ। বেশ, আমি ক্ষমা চাইছি। তপন ওকে সাইকেলটা দিয়ে দিতে সে দৌড়ে লাফিয়ে তাতে উঠে পড়ে একটু নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, এই শালারা, শোন, এর বদলা আমি নেব। পাপাড়ার সাধন মৃধার পার্টিকে আজই বলছি। কথা শেষ করেই জোরে প্যাডেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল।

কয়েক পা ফুটে থমকে দাঁড়াল মটু, যা যা, বল শালা সাধনকে। আমি যদি রায়কতপাড়ার আশেকদাকে বলি তোর সাধন লেজ গুটিয়ে নেবে।

কিন্তু কথাগুলো ছেলেটার কোন অবধি পেীছাল না। আর কোনো মজার দৃশ্য দেখা যাবে না বুঝে ভিড়টা পলকে হালকা হয়ে গেল। অনিমেষ ওদের কাছে এগিয়ে গেল। তপন প্রথমে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

অনিমেষ বলল, এখানে কী হয়েছে রে?

মণ্টু বলল, আরে তোকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে দেখি এই মালটা সাইকেলে পাক খাচ্ছে আর বেল বাজাচ্ছে। টাঙ্কি মারার আর জায়গা পায়নি! আবার সাধন মৃধার ভয় দেখাচ্ছে। মণ্টু যেন তখনও ফুসছিল।

অনিমেষ বলল, মারতে গেলি কেন মিছিমিছি।

মণ্টু বলল, বেশ করেছি মেরেছি। প্রেমের জন্য জীবন দেয় সবাই, তা জানিস?

তারপর টেনে টেনে বলর, আই লাভ রম্ভা।

হঠাৎ মুখ ফসকে অনিমেষ বলে ফেলল, রা তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল।

সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হয়ে গেল মণ্টু। ও যেন বিশ্বাস করতেই পারছে না কথাটা। তারপর কোনোরকমে বলল, তোকে জিজ্ঞাসা করেছে।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল।

তোর সঙ্গে আলাপ আছে বলিসনি তো! গুল মারবি না একদম। মণ্টু ওর সামনে এসে দাঁড়াল।

অনিমেষ বলল, আগে আলাপ ছিল না, একটু আগে হল। এখানে আসতে নতুন স্যার আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

কথাটা শেষ করতেই তপন দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল, তোর কী লাক মাইরি, একই দিনে বেদিং বিউটি থেকে লাভিং বিউটি সব দেখলি। তোকে একটু হেঁদে দে।



তিস্তার পাড়ে হাঁটাত হাঁটতে ওদের সব ব্যাপারটা বলতে হল। শুধু উর্বশী যে কথাটা ওকে সবশেষে বলেছে সেটা বন্ধুদের ভাঙল না। শোনা হয়ে গেলে মটু বলল, না রে অনি, অ অক্ষরটা যে-ই লিখুক এবার আমি ধরবই! র যখন আমাকে লাইক করে তখন এটা আমার প্রেস্টিজ ইমু। তুই মুভিং ক্যাসেলকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলিস। আসামি ধরা পড়লে আমাকে ভাই ও বাড়িতে নিয়ে যাস।

তপন বলল, আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। অনিমেষ ঘাড় নেড়ে না বলল। হতাশ গলায় তপন নিজের মনে বলল, আমাকে শালা মেয়েরা পছন্দ করে না। এইখ্রনগুলো যতদিন না যাবেনিজের গাল থেকে হাত সরিয়ে ও মণ্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, মাইরি, নিশীথবাবুটা হেভি হারামি। গাছেরও খাচ্ছে তলারও কুড়োচ্ছে!

গালাগালি শুনে প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। ও চিষ্কার করে উঠল, খুব খারাপ হচ্ছে তপন। না জেনেশুনে একটা অনেস্ট লোককে গালাগালি দিবি না! কিন্তু অনেস্ট শব্দটা বলার সময় ওর কেন জানি না বিরামবাবুর মুখটা মনে পড়ে গেল।

মণ্টু হাসল, তুই কিছুই জানিস না অনি, আগে মুভিং ক্যাসেলের সঙ্গে নিশীথবাবুকে সব জায়গায় দেখা যেত। কলকাতায় কতবার নাকি ওরা দুজনে গিয়েছে। তখন মেয়েরা ছোট ছিল। মেনকার সঙ্গে লাইন হয়েছে, তা সবাই অনুমান করতাম, কিন্তু শিওর ছিলাম না। তুই আজ ঠিক খবরটা দিলি।

একই দিনে একটা মানুষের এতরকম ছবি দেখতে পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল অনিমেষ। নতুন স্যার দেশকে ভালোবাসেন, মেনকাদিকেও. ভালোবাসতে পারেন, মেনকাদির বাবা অসৎ হলেও মেনকাদি তো সৎ হতে পারে। কিন্তু তার মেনকাদির মাকে-এই ব্যাপারটা সব গোলমাল করে দিচ্ছিল।

হঠাৎ তপন মণ্টুকে বলল, তুই শালা এবার থেকে বাংলা হেভি নম্বর পাবি।

মণ্টু অবাক হয়ে বলল, কেন?

কেন আবার! ভায়রাভাইকে কেউ কম নম্বর দেয়? কথাটা বলে ও চোঁচোঁ করে দৌড় মারল।

মানে বুঝতে পেরে মণ্টু ওকে দৌড়ে ধরতে যেতে যখন বুঝতে পারল ও নাগালের বাইরে চলে গেছে, তখন দাঁড়িয়ে পড়ে অনিমেষকে বলল, বন্ধু হোক আর যা-ই হোক, মেয়েদের ব্যাপারে সবাই খুব জেলাস, না রে!

অনিমেষের কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ও চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। যত বড় হচ্ছে তত যেন সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। একটা মানুষের কতরকম চেহারা থাকে!
 
ইদানীং সরিৎশেখর কোরা ধুতি পরেন। একজোড়া মিলের কাপড় সস্তায় কিনে দুটো টুকরো করে নেওয়া যায়। সব দিক থেকে খরচ কমিয়েও যেন আর তাল ঠিক রাখতে পারছেন না। হেমলতার সঙ্গে এখন প্রায়ই তার ঝগড়া হয় জিরে মরিচ কয়লা নিয়ে। বিশ সের কয়লায় এক সপ্তাহ যাওয়ার কথা, সেখানে একদিন আগে হেমলতা কোন আক্কেলে ফুরিয়ে ফেলেন! এসব কথাবার্তা চলার সময় যদি অনি এসে পড়ত তা হলে আগে ওঁরা চুপ করে করে যেতেন। কিন্তু ইদানীং আর যেন তার। প্রয়োজন হয় না। খালিবাড়িতে দুজন চিৎকার করলে বাইরের লোকের কানে যাবে না। পরম সুখে ওঁদের ঝগড়া করতে দ্যাখে অনিমেষ। পিসিমার মেজাজ আরও খারাপ, কারণ কদিন আগে ব্যাংক থেকে পিসিমার টাকা তুলে দাদু বাড়ির কাজে লাগিয়েছেন।

বাড়িতে এখন মাছ আসে না। হেমলতার যত বয়স হচ্ছে তত মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারছেন না। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, মাছ খাবার ইচ্ছে হলে লোক রাখুন বা হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসুন। সরিৎশেখরের মাছ খাওয়া বন্দ হয়েছিল আগেই, শুধু অনিমেষের জন্য মাছ আসত বাড়িতে। হেমলতার ঠ্যাচামেচিতে তিনি সেটা বন্ধ করে দিলেন এবং হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। জলপাইগুড়িতে মাছের দাম এখন আকাশছোঁয়া। কই মাগুর চল্লিশ টাকা সের বিক্রি হচ্ছে। পোনামাছ চালান আসে বাইরে থেকে, সেখানে ঢোকে কার সাধ্য! বাজারের বরাদ্দ টাকার প্রায় আড়াই ভাগ অনির মাছের পেছনে চলে যেত। সেটা বেঁচে যেতে মনটা একটু খারাপ হলেও স্বস্তি পেলেন। সম্প্রতি ইংরেজি কাগজে একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে আমিষ-নিরামিষ নিয়ে। ভেজিটেবল প্রোটিন অ্যানিমেল প্রোটিনের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। ভারতবর্ষের প্রচুর মানুষ যে নিরামিষ আহার করে তাতে তাদের কার্যদক্ষতা বিন্দুমাত্র কমে না, বরং অনুসন্ধানে জানা গেছে যে নিরামিষাহারী মানুষ দীর্ঘজীবি হয়। কাগজটা তিনি অনিকে পড়তে দিয়েছিলেন। যদিও মাঝে-মাঝে তার এই নাতির মুখে এক টুকরো মাছ দিতে পারছেন না বলে মনেমনে আক্ষেপ হয়, কাউকে বলেন না।

বাজারদর হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। গ্রাম-অঞ্চল থেকে মানুষের মিছিল কাজের আশায় শহরে ভিড় করছে। এমনিতেই তাঁদের শহর পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি খরচের জায়গা, কারণ এখানে ধনীদের প্রাধান্য বেশি। সরিৎশেখরের মাথার ঠিক থাকছে না, হেমলতার সঙ্গে ঝগড়া বেড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সবাই ঠকাছেআকে। যে-গয়লাটা দুধ দিয়ে যায় তার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল অতিরিক্ত জল মেশাচ্ছে বলে। কয়লাওয়ালা কাঁচা কয়লা দিয়ে টাকা লুটছে। পরপর কয়েক বছর বন্যা এসে পলিমাটি ফেলে বাগনটার যে-চেহারা হয়েছে তাতে তোক দিয়ে শাকসবজি লাগালে কোনো কাজ হবে না। মহীতোষ যে-টাকা পাঠায় তা বাড়ছে না। এদিকে বাজারদর যে থেমে থাকছে না! ছেলের কাছে টাকা। চাইতে এখন আর কুণ্ঠা নেই, কিন্তু মহীতোষের সাধ্যের সীমাটা তিনি জানেন। যে-টাকাটা সে পাঠাচ্ছে তাতে অনিমেষ হোসেটলে আরামে থাকতে পারত।

মাস শেষ হতে আর দুদিন আছে। সরিৎশেখর কিং সাহেবের ঘাট থেকে বেড়িয়ে ফিরছিলেন। আজ ছুটির দিন, কোর্টকাছারি বন্ধ। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে কোনো লোক তাই শহরে আসেনি। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন তিনি। আজ সকালে বাজার করার পর ওঁর কাছে তিনটে আধুলি পড়ে আছে। সামনে আর দুটো দিন, তারপর স্বৰ্গছেঁড়া থেকে টাকা আসবে। কী করে এই দুদিন চলবে? চাকরি করার সময় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাকে কোনোদিন এই অবস্থায় পড়তে হবে হঠাৎ ওঁর মনে হল রিটায়ার করার পর বেশিদিন বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। দীর্ঘজীবি অর্কর্মণ্য হয়ে থাকলে এইসব সমস্যার সামনে দাঁড়াতেই হবে।
 
আজকাল জোরে হাঁটলে ভাঙা পা-টা টনটন করে। খুব আস্তে-আস্তে তিনি পি ডর ডি অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। ওদিকে তিস্তার পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। এতদিন পর তিস্তা বাধ প্রকল্প হয়েছে। প্রতি বছরের বন্যা থেকে বাঁচার জন্য জলপাইগুড়ি শহরের গা-ঘেঁষে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। জোর তোড়জোড় চলছে ওখানে। পি ডর ডির অফিসটা পেরোতেই একটা জিপগাড়ি সজোরে ওর পাশে ব্রেক কষে দাঁড়াল। এখন খুব সতর্ক হয়ে রাস্তার বাঁপাশ ঘেঁষে হাঁটেন সরিৎশেখর। চোখ তুলে দেখলেন দুই-তিনজন লোক জিপ থেকে নেমে তার দিকে আসছেন।

ধুতিপরা এক ভদ্রলোক বললেন, যা স্যার, আমার ভুল হয়নি, ইনিই সরিৎশেখরবাবু। মাথা নেড়ে একজন লম্বাচওড়া টাই-পরা ভদ্রলোক সরিৎশেখরের সামনে এসে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন, আপনি সরিৎশেখর?

একটু অবাক হয়ে ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর।

ভালোই হল পথে আপনার সাথে দেখা হয়ে। আমরা আপনার বাড়িতে যাচ্ছিলাম। আমি তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের অ্যাসিস্টেন্ট একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।

সরিৎশেখর নমস্কার করে উদ্দেশ্যটা শুনবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সঙ্গের ভদ্রলোক বললেন, স্যার, বাড়িতে গিয়ে কথা বললে ভালো হয় না?

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সে-ই ভালো। আপনি বোধহয় বাড়িতেই যাচ্ছিলেন, তা আসুন আমার গাড়িতেই যাওয়া যাক।

তার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে ভদ্রলোক জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন। এক-একজন মানুষ আছেন যারা কথা বললেই একটা কওঁতের আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায়, যেন তিনি যা বলছেন তার পর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। সরিৎশেখর বুঝতে পারছিলেন না যে তার সঙ্গে তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের কী সম্পর্ক থাকতে পারে। ইঞ্জিনিয়ার জিপে বসে আবার ডাকলেন, কই, আসুন!

অগত্যা সরিৎশেখরকে জিপে উঠতে হল। ধারের দিকে জায়গা করে দিলেও সরিৎশেখরের বসতে অসুবিধে হচ্ছিল। শক্ত-হাতে সামনের রড আঁকড়ে বসেছিলেন তিনি জিপটা হুহু করে টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। ইঞ্জিনিয়ার বললেন, আপনার ফ্যামিলি মেম্বার কত, মানে এই বাড়িতে?

সরিৎশেখর বললেন, তিনজন। কেন?

ইঞ্জিনিয়ার অবাক হলেন, সেকী! আপনার বাড়ি তো শুনেছি বিরাট বড়। তা এত বড় বাড়িতে তিনজন মানুষ কী করেন?

সরিৎশেখর এবার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন, ব্যবহার হয় না ঠিক নয়, আত্মীয়স্বজনরা এলে থাকবে তাই করা।

ততক্ষণে জিপটা বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। রাস্তাটা আগ বড় ছিল। কিন্তু যেহেতু জমিটা পি ডব্লু ডির, সরিৎশেখর অনেক চেষ্টা করেও তাদের স্টাফদের কোয়ার্টার বানাবার ব্যাপারে বাধা দিতে পারেননি। এখন জমি ঘিরে রাস্তাটা এত সরু হয়ে গেছে যে রিকশা অথবা একটা জিপ কোনোক্রমে ঢুকতে পারে। এই নিয়ে বহু চিঠি লিখেছেন তিনি, কোনো কাজ হয়নি।

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, বাবঃ, এত সরু রাস্তা! মিউনিসিপ্যালিটি অ্যালাউ করল? সরিৎশেখর বললেন, আপনাদের সরকার বাহাদুরের ব্যাপার, আমরা বললে তো হবে না।

ভদ্রলোক যেন বিরক্ত হয়েছেন খুব, না না, এ খুব অন্যায়। বাড়ি করতে দিলে তাকে যাতায়াতের রাইট দিতে হবে। ঠিক আছে, আমি ব্যাপারটা দেখছি।

গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো, আপনাদের আসবার উদ্দেশ্যটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না।
 
ইঞ্জিনিয়ার তখন কোমরে হাত দিয়ে বাড়িটা দেখছিলেন। এখন ভর-বিকেল রোদ গাছের মাথায়। নতুন বাড়িটা খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সরিশেরের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমরা শহরে ভালো বাড়ি খালি পাচ্ছি না। আজ আপনার বাড়ির খবরটা পেয়ে চলে এলাম। তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে এ-বাড়িটা আমরা চাই।

চাই মানে? হতভম্ব হয়ে গেলেন সনিৎশেখর।

অবশ্যই ভাড়া চাই। তবে ভেতরটা দেখে নিতে হবে আগে।

আপনি বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছেন?

আমি নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

সরিৎশেখর কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। বাড়িটা ভাড়া দেবার কথা হেমলতা প্রায়ই বলে থাকেন তাকে। যেভাবে রাজারদর বাড়ছে তাতে সামলে ওঠা যাচ্ছে না। এই তো আজই তার পকেটে কয়েকটা আধুলি পড়ে আছে। আগে গল্পচ্ছলে বলতেন এই বাড়ি তার ছেলের মতন, অসময়ে দেখবে। কিন্তু যাকে-তাকে ভাড়া দিতে একদম নারাজ তিনি, বিশেষ করে ফ্যামিলিম্যানকে। এর আগে অনেকেই এসেছে তার কাছে। কিন্তু হেগে-মুতে একাকার হয়ে যাবে বলে মুখের ওপর না বলে দিয়েছেন সবাইকে। এখন সরকার যদি তার বাড়ি ভাড়া নেয় তা হলে তো ঝামেলার কিছু থাকে না। মাস গেলে ভাড়াটা নিশ্চিত। তা ছাড়া জলপাইগুড়িতে এখন বাড়িভাড়া হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। খালি পড়ে থাকলে বাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। ভাড়া দিলে প্রতি মাসের টাকাটায় কী উপকার হবে ভাবলে পায়ে জোর এসে যায়। কিন্তু, তবু একটা কিন্তু এসে যাচ্ছে যে মনে! যারা এসে থাকবে তারা লোক কেমন হবে। সরকারি অফিস তো, পাঁচ ভূতের ব্যাপার, বাড়ির ওপর কারও দয়াময়া থাকবে না।

ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেছেন। সরিৎশেখর ওঁর পেছন পেছন উঠতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ভাবছেন আপনি?

সরিৎশেখর সত্যি কথাটা একটু অন্যভাবে বললেন, এ-বাড়ি ভাড়া দেব কি না আমি তো এখনও ঠিক করিনি। তা ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ভদ্রলোক এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমাদের ওপর নির্দেশ আছে যেকোনো খালি বাড়ি আমরা প্রয়োজন বোধ করলে রিকুইজিশন করে নিতে পারি। যে-কয় বছর ইচ্ছে আমরা থাকব-আপনার কিছু বলার থাকবে না। তাই আপনি আমার সাজেশনটা নিন, ভাড়া দিতে রাজি হয়ে যান, নইলে পরে আফসোস করবেন।

এদিকটা জানতেন না সরিৎশেখর। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর মাথা গরম হয়ে গেল। এরা কি ভয় দেখিয়ে তার বাড়ি দখল করতে চায়? সরকারের কি এ-ক্ষমতা আছে? ওর মনে পড়ল সেই পঞ্চাশ সালে কংগ্রেস থেকে তাঁর বাড়িতে অফিস করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখন কেউ ভয় দেখায়নি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন তিনি। তারপর হেমলতাকে ডেকে দরজা খুলতে বললেন। অনিমেষ বাড়িতে নেই। খুব বিরক্ত হলেন কথাটা শুনে। আজকাল যেস কোথায়-কোথায় যোরে টের পান না। তিনি। মাথায় লম্বা হয়েছে, গালে দুএকটা ব্রন বের হয়েছে। এই সময় মন চঞ্চল হয়।

সরিৎশেখর ইঞ্জিনিয়ারকে বাড়িটা দেখালেন। দুটো ঘর তার চাই। বাকি ঘরগুলো ওঁরা নিতে পারেন। বাড়ি দেখে খুব খুশি ইঞ্জিনিয়ার। সরিৎশেখরের থাকার ঘর দুটো আলাদা করে দিলে সামনের দিকে সমস্ত বাড়িটাই ওঁদের হাতে আসবে। একদম সাহেবি বন্দোবস্ত, অফিস কাম রেসিডেন্স করতে কোনো অসুবিধা নেই। ঘুরে ঘুরে খুব প্রশংসা করলেন সরিৎশেখরের বাড়ি বানাবার দক্ষতার। দেখলেই বোঝা যায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করানো, কোনো কন্ট্রক্টরের ওপর ছেড়ে দেওয়া নয়।

শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার বললেন, কাল আমার অফিসে আসুন, ভাড়াটা ঠিক করে নেওয়া যাবে।

সরিৎশেখর এতক্ষণ মনেমনে আঁচ করছিলেন কীরকম ভাড়া পাওয়া যেতে পারে।

এখন বললেন, সরকার কত ভাড়া দেবেন মনে হয়?

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, আমি এখনই বলতে পারছি না। ওপরওলার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সাধারণত সরকার বাড়িভাড়া ঠিক করেন ভ্যালয়ার দিয়ে, স্কোয়াফিট মেপে। কিন্তু এখন তার সময় নেই। আমাদের ইমিডিয়েটলি বাড়ি দরকার। তাই এমাজেন্সি ব্যাপার বলে আমরা নিজেরাই ঠিক করে অ্যাপ্রভ করে নেব।

সরিৎশেখর বললেন, তবু যদি আভাস দেন!

ভদ্রলোক হাসলেন দেখুন, এসব কথাবার্তা তো এভাবে হয় না। আপনি চাইবেন ভাড়াটা বেশি হোক, আমরা চাইব কম হোক। ভ্যালুয়ার অবশ্যই বেসরকারি ভাড়া থেকে অনেক কম রেট দেবে। তাই মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

সরিৎশেখর নিজের অজান্তে কেমন বিগলিত গলায় বললেন, আপনাকে আর কী বলব, এই বাড়িটাই আমার অসা। এখন শহরে বাড়িভাড়া হুহু করে বাড়ছে, কিন্তু কোনো ফ্যামিলিকে ভাড়া দিতে চাই না। আপনি একটু দেখবেন।
 
ভদ্রলোক হেসে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ালেন। সরিৎশেখর ওঁর পিছুপিছু আসছিলেন। এখন একটু খাতির করা উচিত। মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোকের হাতেই সব নির্ভর করছে। সরিৎশেখর বললেন, একটু চা খেয়ে যদি যান!

দ্রুত মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, না না। সন্ধে হয়ে গেলে আমার চা চলে না তাছাড়া পাবলিক অন্যভাবে নেবে। তা হলে কাল ঠিক দশটায় আমার অফিসে আসুন। আমি কাগজপত্র রেডি করে রাখব। পয়লা তারিখ থেকেই আমরা ভাড়া নেব। আমার অফিসটা চেনেন তো?

সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন। এই শহরে কোনোকিছুই অচেনা থাকে না। হঠাৎ ইঞ্জিনিয়ার ওঁর দিকে এগিয়ে এলেন, সরিৎশেখরবাবু, আপনার ভাড়াটা যাতে রিজনেবল হয় আমি নিশ্চয়ই দেখব, কিন্তু দেখাটা যেন পারস্পারিক হয়। বুঝতে পারছেন আশা করি। কাল একটু সকাল সকাল আসুন। অ্যান্ড কিপ ইট এ সিক্রেট। হনহন করে হেঁটে গিয়ে ভদ্রলোক জিপে উঠলেন।

জিপটি চলে গেলেও সরিৎশেখর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, এমন সময় হেমলতার ডাকে তার চেতনা এল। বাবা যে এদের বাড়িটা দেখাচ্ছেন কী জন্যে তা তিনি অনুমান করতে পারছিলেন। এতদিনে বাবার যে হুঁশ হয়েছে তাতে তিনি খুশি। এইভাবে বুড়ো মানুষটার অর্থকষ্ট তিনি দেখতে পারছিলেন না। তবু খানিকটা দূরত্ব রেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা, বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন নাকি?

সরিৎশেখর ঘুরে মেয়েকে দেখলেন, তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, সেদিনের একটা পুঁচকে ছেলে আমার কাছে ঘুষ চাইল, বুঝলে, ঘুষ!

ভাড়ার সঙ্গে ঘুষের কী সম্পর্ক আছে বুঝতে পারলেন না হেমলতা। সরিৎশেখর তখন বলছিলেন, ভাড়া না দিলে সরকার জোর করে বাড়ি নিয়ে নেবে। আমি ন্যায্য ভাড়া চাইলাম তো বলল ওকে দেখতে হবে আমাকে। চা খেতে চায় না, ঘুষ খেতে চায়। ভগবান! স্বাধীন হয় আমরা কোথায় এলাম! নেহরুর পোষ্যপুত্রদের চেহারা দেখলে!

হেমলতা বললেন, যে-যুগ সেরকম তো চলতে হবে! তা যদি বেশি ভাড়া দেয় তা হলে আর আপত্তি করবেন না!

আপত্তি! সরিৎশেখর হাঁহ করে উঠলেন, আমার পকেটে মাত্র দেড় টাকা পড়ে আছে, আমি আপত্তি করব কেন? কোনো মানে হয় না। আপত্তি করা তো বোকামি। চাকরি করার সময় যে ঘুস নিইনি সে-বোকামিটা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি! এখন কাল সকালে দর-কষাকষিটা কীভাবে করব তা চিন্তা করতে হবে।

হেমলতা একটু ভেবে বললেন, সাধুবাবুর কাছে একবার যান-না, ওঁর তো এসব রাস্তা ভাল জানা আছে।

সরিৎশেখর মেয়ের ওপর খুশি হলেন। সত্যি, সাধুচরণই ভালো পথ বাতলাতে পারে। খুব ধূর্ত লো। আর দাঁড়ালেন না তিনি, দরজাটা বন্ধ করে দাও, আমি এখনই ঘুরে আসি! গেট খুলে বাইরে আসতেই নজরে পড়ল অনিমেষ বাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে।

কাছাকাছি হতেই সরিৎশেখর চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলো তোমার এখন সিরিয়াস হওয়া উচিত, সেকেণ্ড ক্লাসে পড়ছ, এভাবে চললে রেজাল্ট ভালো হবে না।

দাদুর মুখে হঠাৎ এই ধরনের কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল অনিমষে। ইদানীং ওর ব্যাপারটাকে চাপা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি ডান হাতে ধরা খামটাকে এগিয়ে দিল। কী ওটা? সরিৎশেখর খামটার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন।

টেলিগ্রাম। টাউন স্কুলের সামনে পোস্টঅফিসের লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে ও দিয়ে দিলে। আজ অবধি অনিমেষ কখনো এ-বাড়িতে টেলিগ্রাম আসতে দেখেনি। পিয়নের কাছ থেকে প্রায় আবদার করেই ও খামটা এনেছে।

হঠাৎ কেমন নার্ভাস হয়ে গেলেন সরিৎশেখর। খামটা হাতে নিয়ে ছিড়তে ছিড়তে বললেন, আবার কার কী হল!

তারপর একনিশ্বাসে টেলিগ্রামটা পড়ে ফেলে চিৎকার করে হেমলতাকে ডাকলেন, হেম, প্রিয় টেলিগ্রাম করেছে, আগামীকাল প্লেনে করে আসছে।

হেমলতা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কে আসছে বললেন? প্রিয়-মানে আমাদে প্রিয়তোষ?
 
জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি বড় এয়ারপোর্ট বাগডোগরা-শিলিগুগি ছাড়িয়ে যেতে হয়। কিন্তু চা-বাগান এবং ব্যবসায়ীদের সুবিধের জন্য কলকাতা থেকে বেসরকারি কোম্পানি জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি একটা প্লেন নামর জায়গা করে নিয়েছিল। জায়গাটাকে কখনোই এয়ারপোর্ট বলা যায় না তবু যেহেতু অন্য নাম মাথায় চট করে আসনা তাই প্লেনে করে কলকাতায় যেতে হলে লোকে বলে এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। ঠিক এ-ধরনের বেসরকারি প্লেন নামার জায়গা ছিল স্বৰ্গছেঁড়ার কাছাকাছি তেলিপাড়ায় এবং কুচবিহারে। মালবাহী প্লেনগুলো যাত্রী নিত খুব কম ভাড়ায়। তবু সাধারণ মানুষ কেউ প্লেনে আসছে শুনলে লোকে বুঝত তার পয়সা আছে বেশ। প্রিয়তোষের প্লেনে করে জলপাইগুড়ি আসার টেলিগ্রাম পেয়ে খুব নার্ভাস হয়ে গেলেন সরিৎশেখর।

যে-ছেলেটা কমিউনিস্ট হওয়ায় পুলিশের ভয়ে এক রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল আচমকা এবং এতগুলো বছরে যার কোনো খোঁজখবর পাওয়া গেল না, সে হঠাৎ প্লেনে করে ফিরে আসে কীভাবে? প্রিয়তোষ যদি হঠাৎ বড়লোক হয়ে গিয়ে থাকে (কমউনিস্টদের সঙ্গে বড়লোক কথাটা কিছুতেই জুড়তে পারেন না সরিৎশেখর) আলাদা কথা, তা হলে এর মধ্যে তো সে তাকে চিঠি দিতে পারত! এতদিন ড়ুব দিয়ে হঠাৎ এত জানান দিয়ে আসছে সে-সরিৎশেখর খুব অস্বস্তিতে পড়লেন। ওকে আনতে যাওয়ার কথা লেখেনি প্রিয়তোষ, কিন্তু সরিৎশেখরের অভিজ্ঞতায় প্লেনে করে কেউ আসছে জানলেই রিসিভ করতে যেতে হয়।

বাড়িভাড়া এবং প্রিয়তোষ এই দুটো চিন্তা কাল রাত্রে তাকে ঘুমোতে দেয়নি। আজ ভোরে উঠেই মনে পড়ল সকাল-সকাল বাঁধ প্রকল্প অফিসে তাকে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিক করলেন প্রিয়তোষকে আনতে অনিমেষকে পাঠাবেন। একবার ভেবেছিলেন, যে-ছেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে তাকে বরণ করে আনার দরকার নেই। কিন্তু হেমলতা তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, এই বংশে কেউ কখনো প্লেনে, চাপেনি, প্রিয়তোষ যখন সেই দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছে তখন সেই পালিয়ে যাওয়া প্রিয়তোষের সঙ্গে এই প্রিয়তোষের নিশ্চয়ই অনেক পার্থক্য। কথাটা চট করে মনে ধরেছিল সরিৎশেখরের। এই বংশে কেউ যদি সম্মানজনক বিরল দৃষ্টান্ত দেখায় তাকে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন, তার জন্য গর্ব হয় তাঁর। এইরকম একটা গর্ব নিয়ে তিনি সযত্নে লালন করছেন যে অনিমেষ একদিন এম এ পাশ করবে-এই বংশে যা কোনোদিন হয়নি।

অতএব স্থির হল অনিমেষ তার ছোটকাকাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাবে।

আজ অবধি শিলিগুড়িতে কখনো যায়নি অনিমেষ। শিলিগুড়ির বাসে চেপে ওর খুব রোমাঞ্চ হচ্ছিল। তা ছাড়া এয়ারপোর্টে প্লেন ওঠানামা দেখার কৌতূহলটা ক্রমশ ওকে অস্থির করছিল আজ স্কুল খোলা অথচ ও যাচ্ছে না-এরকম ঘটনাও কখনো ঘটেনি। আসবার সময় দাদু ওকে একটা টাকা দিয়েছেন, দুটো আধুলি! বাস-বদল করে যেতে আটআনা লাগে। ও যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছাল তখন বেলা দশটা, শুনল কলকাতার প্লেন আসতে দেরি আছে। জায়গাটা দেখে খুব হতাশ হল অনিমেষ। মাঠের একপাশে কিছু ঘরবাড়ি, মাঝে-মাঝে বিভিন্ন রঙের কাপড় উড়ছে মাঠের এখানে-সেখানে। একটাও প্লেন নেই ধারেকাছে। যে-জায়গাটায় প্লেন নামে সেটাও খোলামেলা। একটি টিস্টল দেখতে পেল সে। বয়ামে কেক রাখা আছে। ওর খুব লোভ হচ্ছিল কেক খেতে, কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। যদি ছোটকাকা না আসে তা হরে ফেলার বাসভাড়া থাকবে না। দাদু এত টায়-টায় পয়সা দেয়। অনির মনে পড়ল আজ সকালে পিসিমা বাজারে যাওয়ার কথা বলতে দাদু রেগে গিয়েছিলেন। বাড়িতে যা আছে তা-ই খেতে হবে ওঁকে বলে ধমক দিয়েছিলেন। পিসিমা অনিমেষকে আসবার সময় বলে দিয়েছিলেন, ফরেস্ট বাংলা চৌকিদারকে ডেকে দিতে। ও জানে চৌকিদার বাড়িতে মুরগি পুষে ডিম বিক্রি করে। ডেকে দিয়েছিল অনিমেষ। আজ দুপুরে নিশ্চয়ই ডিমের ডালনা হবে-ঘোটকাকা আসছে বলে অনেকদিন বাদে ডিম খাওয়া যাবে।

প্লেন আসছেনা। অনেকেই গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে। তিন-চারটে ট্যাক্সি সামনে দাঁড়িয়ে। কলকাতায় বৃষ্টি হয়েছে বলে প্লেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে। অনিমেষ ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিছু সুরেশা মহিলা ওর পাশ দিয়ে চলে গেল। ওর মনে হল এবার জোর করে ফুলপ্যান্ট বানাতে মরে। মেয়েদের সামনে হাফপ্যান্ট পরে হাঁটতে আজকাল বিশ্রী লাগে। দাদু যে কেন ছাই বোঝে না।
 
ছোটকাকাকে সে চিনতে পারবে তো? পিসিমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন সকালে। যদি জ্যাঠামশাইকে অ্যাদিন পর চিনতে পারে, তাহলে ছোটকাকাকে পারবে না? আপনমনে হাসল অনিমেষ। ইয়ে আজাদি ঝুট হ্যায়-মনে রাখিস অনি! হঠাৎ ওর মনে হল, এই ভারতবর্ষ বিরাট দেশ। সেই পাঞ্জাব থেকে কন্যাকুমারিকা–ম্যাপে যে-ভারতবর্ষ মুখ বুজে পড়ে থাকে, ছোটকাকা বোধহয় সেই ভারতবর্ষের মানুষকে এই কথাটা নিয়ে এল-ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। কিন্তু ছোটকাকাকে সে এবার জিজ্ঞাসা করবে, এই কথাটা সত্যি কি না। আজাদি যদি মিথ্যে হত, তা হলে ছোটকাকাকে সে এবার জিজ্ঞাসা করবে, এই কথাটা সত্যি কি না। আজাদি যদি মিথ্যে হত, তা হলে ছোটকাকারা সব কথা এত খোলাখুলি বলছে, কিন্তু কই পুলিশ তো তাদের অ্যারেস্ট করছে না। ইংরেজ আমলে সেরকম ব্যাপার কি হত? নিশীথবাবু বলেন (অনিমেষ ওঁকে আজকাল আর নতুন স্যার বলে ডাকে না), ভারতবর্ষ স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক মানুষ তার ইচ্ছেমতন কথা বলতে পারেন, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন শুধু তার আচরণের দ্বারা অন্যের অথবা দেশের যেন ক্ষতি না হয়। কংগ্রেস সরকার এই মহৎ অধিকার দেশবাসীর হাতে তুলে দিয়েছে। দীর্ঘ সগ্রামের পর কংগ্রেস যে-অধিকার অর্জন করেছে তা সে নিজের মুঠোয় লুকিয়ে রাখেনি। সেক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস কী বলে? দেশবিভাগে। আগে এরা নেতাজির নামে নোংরা ছিটোয়নি? যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের সঙ্গে হাত মেলায়নি। স্বাধীনতার পর তারা এমন বাড়াবাড়ি করেছিল যে দেশের স্বার্থে তাদের দলকে ব্যান করে না দিরে চলত না। কন্তু সে কটা কমিউনিস্টদের ছুড়ে ফেলে দিল। কথাটা ভীষণ সত্যি-অধিকার কেউ হাতে তুলে দেয় না, তাকে অর্জন করতে হয়। কমিউনিস্টরা তা পারেনি, এটা তাদের ক্রটি। আর এই যে ওর কংগ্রেস সরকারকে যা-তা বলতে পারছে, তা আমাদের এই স্বাধীনতা সত্যি বলেই পারছে।

নিশীথবাবুর এই কথাগুলো আজ ছোটকাকাকে জিজ্ঞাসা করবে অনিমেষ। মটুর কথাটা চট করে মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মণ্টু বলে, কংগ্রেস হল চোরের সরকার। যে যেখান থেকে পারে চুরি করে যাচ্ছে। অবশ্য এসব কথা আমি বিরাম করাকে উদ্দেশ করে বলছি না। উনি যে রম্ভার বাবা!

কংগ্রেসের সব ভালো, ইতিহাস ভালো, নেতারাও ভালো। কিন্তু কেন যে সবাই ওদের চোর বলে কে জানে! আচ্ছা, চোর যদি তবে ভোট দিয়েছে কেন?

হঠাৎ মাইকে কে যেন কী বলে উঠতে অনিমেষ দেখল সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দিল। খুব জড়ানো ইংরেজি বলে ও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু এখন তো সবাই বুঝতে পারছে যে কলকাতার প্লেন এখনই নামবে।

আর কয়েক মিনিট বাদে ডানায় রুপোলি রোদ মেখে একটা মাঝারি চকচকে পাখি এয়ারপোর্টের ওপর দুবার পাক খেয়ে অনেক দূর থেকে নিচে নেমে আসতে লাগল। একসময় তার বুক থেকে চাকা। বেরিয়ে মাটির ওপর গড়িয়ে যেত লাগল যতক্ষণ-না সেটা নিরীহ মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ওর বুকের র খুলে গিয়ে সিঁড়ি জুড়ে গেল। আর লোকগুলো কেম গম্ভীরপায়ে নেমে আসতে। লাগল মাটিতে। অনিমেষ দেখল রেলস্টেশনে অথবা বাসে প্যাসেঞ্জাররা যেরকম জামাকাপড় পরে যায় এঁরা তার চেয়ে দামি-দামি জামাকাপড় পরেছেন। একজন খুব মোটা ভীষণ কালো গোঁফওয়ালা মানুষ-ধুতি, ভূঁড়ি-সামলানো পাবি আর মাথায় ইয়া বড় গান্ধীটুপি, নামতে অনেকে মালা নিয়ে ছুটে গেল তার দিকে। চার-পাঁচজন পুলিশ অফিসার তাকে স্যালুট করে ঘিরে দাঁড়াল। ওপাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, মিনিস্টার আয়া, মিনিস্টার।
 
এই প্রথম মন্ত্রী দেখল সে। রাজা ভারতবর্ষের মানুষরা, আর মন্ত্রী মাত্র কয়েকজন। তাদের একজনকে দেখতে পেয়ে অনিমেষের খুব গর্ব হচ্ছিল। কেমন বিনয়ী হয়ে হাতজোড় করে এগিয়ে আসছেন। ও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশ দিয়ে ওঁকে যেতে হবে, অনিমেষ যন্ত্রচালিতের মতো দুটো হাত জোড় করে নমস্কার জানাল। আর সেই সময় ওর নজরে পড়ল মন্ত্রীর পেছন পেছন যে হেঁটে আসছে তার দিকে। ছোটকাকা। একদম চেনা যাচ্ছে না, অ্যাশ কালারের সুট, লম্বা সরু নীল টাই, চোখে চশমা, হাতে বড় অ্যাটচিব্যাগ। এই পোশাকে অনিমেষ ছোটাকাকাকে কখনো দেখেনি। চট করে চেনা অসম্ভব। কিন্তু ছোটকাকার মুখচোখ এবং হাঁটার ভঙ্গি একই রকম আছে। ও দেখল। মন্ত্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে ছোটকাকাকে কিছু বলতেই ছোটকাকা হেসে জবাব দিয়ে নমস্কার করে এবার একা এগিয়ে আসতে লাগল লম্বা-লম্বা পা ফেলে। তার মানে মন্ত্রীর সঙ্গে ছোটকাকার ভাব আছে। অনিমেষ কেমন হতভম্ব হয়ে পড়ল। কংগ্রেসি মন্ত্রীর সঙ্গে ছোটকাকার ভাব হল কী করে? আর সেই ছোটকাকার সঙ্গে এই ছোটকাকার পোশাকে একদম মিল নেই কেন?

ভীষণ নার্ভাস হয়ে ছোটকাকার দিকে এগিয়ে গেল সে।

চোখাচোখি হলেও প্রিয়তোষ অন্যমনস্ক হয়ে কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ঘুরে অনিমেষের দিকে ভালো করে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, আরে অনি না?

অনিমেষের ভালো লাগল বলার ধরনটা। ও হেসে সামনে এগিয়ে এসে নিচু হল প্রণাম করতে। সঙ্গে সঙ্গে ওকে এক হাতে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরল প্রিয়তোষ, আরে কী আশ্চর্য, তুই যে দেখছি ভেরি গুড বয়, প্রণাম-ট্রনাম করিস! আমি তো তোকে প্রথমে চিনতেই পারিনি-কী লম্বা হয়ে গেছিস! তা তুই কি আমাকে রিসিভ করতে এসেছিস?

ঘাড় নাড়ল সে, দাদু আসতে বললেন।

আমি ভাবছিলাম টেলিগ্রামটা আমার আগে আসবে কি না। যাক, বাবা এখন কেমন আছেন? প্রশ্ন করল প্রিয়তোষ। অনিমেষ দেখল ছোটকাকার মাথা ওর চেয়ে সামান্য ওপরে।

অনিমেষ বলল, দাদু ভালো আছেন। এই সময় ও দেখল পাঁচ-ছয়জনের একটা দল এগিয়ে আসছে। দলের সামান্য বিরাট মোটা একটা ফুলের মালা-হাতে বিরাম কর মহাশয়। বিরামবাবুর ছোই শরীররটার পেছনে মুভিং ক্যাসেল। বিরামবাবু এগিয়ে গিয়ে মন্ত্রীমশাই-এর গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। একটা হাততালির ঝড় উঠল। বিরাম কর কিছু বলতেই মন্ত্রীমশাই মুভিং ক্যাসেলকে নমস্কার করলেন। অনিমেষের মনে হল এই মুহূর্তে মুভিং ক্যাসেলকে একদম বাচ্চা মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। এই দলের মধ্যে নিশীথবাবুকে দেখতে পেল না সে।

কোন পাড়ায় থাকে?

আমাদের পাড়ায়। আমার সঙ্গে আলাপ আছে। অনিমেষ বেশ গর্বের সঙ্গে কথাটা বলল। বাইরে তখন গাড়িগুলো নড়াচড়া করছিল।

প্রিয়তোষ বলল, একটা ট্যাক্সি দ্যাখ, সোজা বাড়ি যাব।

ছোটকাকা যে বাস যাবে না এটা ও অনুমান করতে পারছিল। এখান থেকে পুরো ট্যাক্সি রিজার্ভ করে যাওয়া যায়। অনির খেয়াল হল ওর আট আনা পয়সা বেঁচে যাচ্ছে। দাদু যদি ফেরত না চান তা হলে কী ভালোই-না হয়!

মন্ত্রীর জন্য সরকারি গাড়ি এসেছিল। তিনি তাতে চলে গেলেন। অনিমেষ ট্যাক্সিওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে হতাশ হচ্ছিল। সবাই আজ রিজার্ভড হয়ে আছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়তোষ ব্যাপারটা, দেখছিল। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসে অনিমেষকে বলল, তুই এখনও নাবালক আছিস। দাঁড়া আমি দেখছি।
 
প্রিয়তোষ গিয়ে ট্যাক্সি-ড্রাইভারদের সঙ্গে যখন কথা বলছিল তখন অনিমেষ দেখল বিরামবাবুরা সদলে ফিরে যাচ্ছেন। মুভিং ক্যাসেল ওকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে এলেন কাছে, ওমা তুমি! একদম দেখতে পাইনি গো! কখন এলে?

অনিমেষ বলল, অনেকক্ষণ।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, কালই নিশীথকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম, ছেলের দেখা নেই কেন? তা মিনিস্টারকে দেখতে এসেছ বুঝি?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। আমার ছোটকাকা এসেছেন ওই প্লেনে। ও ইশারা করে প্রিয়তোষকে দেখাল।

ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে কথা শেষ করে প্রিয়তোষ তখন এদিকে আসছিল। তাকে এক পলক দেখে নিয়ে একটু উত্তেজিত গলায় মুভিং ক্যাসেল বললেন, ওমা, ইনি বুঝি তোমার কাকা। মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন না প্লেন থেকে নেমে? অনিমেষ ঘাড় নাড়তেই ফিসফিস করে বললেন, খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক মনে হচ্ছে। কলকাতায় থাকেন?

প্রিয়তোষ কোথায় থাকে জানে না অনিমেষ। কিন্তু জলপাইগুড়ির বাইরে সভ্য জায়গা বলতে চট করে কলকাতার নামই মনে আসে। ও দ্বিধা না করে মাথা নেড়ে হাঁ বলল। প্রিয়তোষ তখন প্রায় কাছে এসে পড়েছে, মুভিং ক্যাসেল ফিসফিসিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও।

প্রিয়তোষ বলল, চল, ট্যাক্সিটা পাওয়া গেছে! এই কয় বরে জলপাইগুড়ির হাল কী হয়েছে রে, ট্যাক্সির রেট দিল্লির থেকেও বেশি?

মুভিং ক্যাসেলকে প্রিয়তোষ যেন দেখেও দেখল না, অনিমেষের হাতে-ধরানে অ্যাটচিটা নিয়ে ট্যাক্সির দিকে ফিরল। মহা ফাপরে পড়ে গেল অনিমেষ। মুভিং ক্যাসেলের ভালো নাম তো জানা নেই, কী বলে পরিচয় করিয়ে দেখে ও! প্রিয়তোষকে ফিরতে দেখে মুভিং ক্যাসেল জকটি করে আলতো চিমটি কাটলেন অনিমেষের হাতে। তৎক্ষণাৎ অনিমেষ বলল, ছোটকাকা, ইনি-মানে ইনি না আমাদের মাস্টারমশাই-মানে এখানকার কংগ্রেসের…, কীভাবে কথাটা শেষ করবে বুঝতে না পেরে চট করে শেষ করে দিল, শ্রীবিরাম করের স্ত্রী।

খুব অবাক হয়ে প্রিয়তোষ ভাইপোকে একবার দেখল, তারপর হাতজোড় করে মুভিং ক্যাসেলকে নমস্কার করল। অনিমেষ শুরু করা থেকেই মুভিং ক্যাসেল যুক্তহস্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখন হাত নামিয়ে সলজ্জ মিষ্টি হাসলেন, আমি সামান্য কংগ্রেস করি, কোনো ইতিহাস নেই, আর ভূগোল তো দেখছেন।

এইভাবে নিজের পরিচয় দিতে বোধ করি প্রিয়তোষ কাউকে শোনেনি। খুব অবাক হয়েও সেটাকে দ্রুত কাটিয়ে নিয়ে বলল, আমি তো অনেকদিন জলপাইগুড়ি ছাড়া, তুই আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমি প্রিয়তোষ।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, আপনারা তো বাড়ি ফিরবেন, তা আমাদের গাড়িতে আসতে পারেন, কোনো অসুবিধে হবে না।

প্রিয়তোষ বলর, না না, অনেক ধন্যবাদ। ট্যাক্সিওয়ালাটাকে আমি কথা দিয়ে ফেলেছি।

মুভিং ক্যাসেল খুব ছোট একটা ভাঁজ দুই ভুরুর মাঝখানে এনে বললেন, আপনি বুঝি কথঘা দিরে কখনো খেলাপ করেন না।

প্রিয়তোষ হাসল, ঠিক উলটো। এত বেশি খেলাপ করি যে মাঝে-মাঝে রাখবার জন্য বদখেয়াল হয়। শহরে আশা করি আপনার দেখা পাব।

মুভিং ক্যাসেল হঠাৎ কেমন নিস্তেজ গলায় বললেন, বাঃ, নিশ্চয়ই। তারপর এক হাতে অনিমেষের চিবুক নেড়ে দিয়ে বললেন, এই ছেলে, কাকাকে নিয়ে আমার বাড়ি আসবে।
 
প্রিয়তোষের সঙ্গে ট্যাক্সির দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের মনে হল এতক্ষণ সেয়ানে-সেয়ানে। কক-ঠোকাঠুকি হচ্ছি। কার্তিকদা যখন অন্য কারওর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেন তখন ককটা বেশিক্ষণ শূন্যে থাকে না, কিন্তু প্রতুলদার সঙ্গে ম্যাচ হলে শুধু ছটফটিয়ে এপার-ওপার করতে থাকে, মাটিতে পড়তে চায় না। নিশীথবাবু বা তার কাছে মুভিং ক্যাসেল যত সহজভাবে বলতে পেরেছেন, আজ ছোটকাকার সঙ্গে যেন তা একদমই পারেননি। খুব মজা লাগছিল ওর।

ট্যাক্সির পেছন-সিটে ওরা দুজন, ছোটকাকা পকেট থেকে একটা চকচকে সিগারেটের টিন বের করে সিগারেট ধরাল, তারপর খবরাখবর বল।

অনেকক্ষণ থেকে যে-প্রশ্নটা অনিমেষের মুখে আসছিল সেটা ফস করে বলে ফেলল এবার, ছোটকাকা, তুমি একদম বদলে গিয়েছ।

অ্যাঁ? বলে চমকে ওর দিকে তাকিয়ে হোহো করে হেসে উঠল প্রিয়তোষ, তারপর বলল, আমার কথা পরে হচ্ছে। আমি চলে যাবার পর কী হয়েছিল বল!

চট করে অনিমেষ সেসব দিনের কথা মনে করতে পারল না। একটু ভেবে নিয়ে বলল, পুলিশ এসে খোঁজ করেছিল, দাদু রেগে গিয়েছিলেন তোমার ওপর।

সিগারেট খেতে-খেতে প্রিয়তোষ বলল, তারপর?

অনিমেষ বলল, দাদু অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছিলেন কিন্তু কোনো খবর পাননি। তারপর এতদিন আর কোনো কথা হত না তোমাকে নিয়ে।

দিদি কেমন আছেন?

পিসিমার শরীর খারাপ। অনিমেষ একটু ভেবে নিয়ে বলল, আজ দাদু বাড়িভাড়া দেবার জন্য সরকারের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন।

বাড়িভাড়া? কেন?

অনিমেষ ছোটকাকার দিক তাকিয়ে বলল, তুমি কাউকে বোলো না। দাদুর হাতে একদম পয়সা নেই। আমরা অনেকদিন মাছ খাই না।

সে কী! চমকে সোজা হয়ে বসল প্রিয়তোষ, তোর বাব টাকা পাঠায় না? আমি জানি তোর বাবা আবার বিয়ে করেছে। আমি এখানকার সব খবর রাখি। কিন্তু বাবা যে অর্থকষ্টে আছে তা তো কেউ বলেনি!

অবাক হয়ে ছোটকাকাকে দেখল অনিমেষ। এখানকার সব খবর রাখে ছোটকাকা! কী আশ্চর্য! ও বলল, বাবা টাকা পাঠান, কিন্তু তাতে চলে না। জলপাইগুড়িতে জিনিসপত্রের দাম নাকি খুব বেশি।

ছোটকাকা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অনিমেষ দেখল জলপাইগুড়ি এসে যাচ্ছে।

ও হঠাৎ সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ছোটকাকা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে নলি?

দ্রুত ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, কারও কাছে না!

খুব ঠাণ্ডা গলায় প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ তোর একথা মনে হল কেন?

প্রিয়তোষের বলার ধরনের এমন একটা অস্বাভাবিক সুর ছিল যে, অনিমেষ বুঝতে পারছিল প্রশ্নটা করা ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। ও তাকিয়ে দেখল ছোটকাকা ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরায়নি। খুব অস্বস্তি নিয়ে অনিমেষ বলল, এখানে যারা কমিউনিষ্ট তাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।

প্রিয়তোষ যেন এ-উত্তরটা আশা করেনি, মানে?

এখানকার কমিউনিস্টদের চুলটুল উশকোখুশকো হয়, বেশিরভাগ গেরুয়া পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে আর কাধে একটা কাপড়ের ঝোলা থাকে। দেখলেই বোঝা যায় খুব গরিব-গরিব। তারপর যেন মনে করতে পেরে বলল, আগে তুমি এইরকম পোশাক পরতে।

হোহো করে হেসে উঠল প্রিয়তোষ। হাসি যেন আর থামতেই চায় না। তা দেখে অনিমেষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। শেষ পর্যন্ত প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করল,আর কংগ্রেসিরা, তাদের কী দেখে বোঝা যায়। ফিনফিনে ধুতি, খদ্দরের ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি আর মাথায় সাদা ধবধবে গান্ধীটুপি-তাই তো?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top