What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর কাঁঠালগাছতলায় এসে দাঁড়াল অনি। বাড়ি ফেরার পর থেকে ছোটমার সঙ্গে কথাই হচ্ছে না প্রায়। এমনকি অনিকে খাবার দেবার সময় মনে হচ্ছিল রান্নাঘরে ওর খুব কাজ, সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় পাচ্ছেন না। উঠোনে ডাই-করা বাসন অথচ বাড়িতে কাজের লোক নেই-বাবার ওপর ক্রমশ চটে যাচ্ছিল। ছোটমাকে এখন সব কাজ করতে হয়। বিয়ের পর পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে ওর ঘরে-আসা ছোটমার সঙ্গে এখন কেমন রোগা জিরজিরে হয়ে যাওয়া ছোটমার কোনো মিল নেই। সত্যি বলতে কী ছোটমার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছিল।

অনির খাওয়া হয়ে যাবার পর মহীতোষ এলেন। ভাগ্যিস একসঙ্গে খেতে বসা হয়নি। তখন বাবার পাশে চুপচাপ শব্দ না করে চিবিয়ে যাওয়া, একটা দমবন্ধকরা পরিবেশে কথা না বলে খাবার গেলা-অনির মনে হল ও খুব বেঁচে গেছে। কাঁঠালগাছতলায় দাঁড়িয়ে বাবার গলা শুনতে পেল সে, অনি কোথায়? ছোটমার জবাবটা স্পষ্ট হল না। মহীতোষ গলা চড়িয়ে বললেন, এই রোদ্দুরে টোটো করে না ঘুরে মায়ের কাছে গিয়ে বসতে তো পারে। ভক্তি নেই, বুঝলে, আজকালকার ছেলেদের মাতৃভক্তি নেই। ছোটমার গলা শোনা গেল না।

অনি ঘরে দাঁড়াল। ও ভাবল চেঁচিয়ে বাবাকে বলে যে মাকে ও যেরকম ভালোবাসে তা বাবা কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু বলার মুহূর্তে যেন অনির মনে হল কেউ যেন তাকে বলল, কী দরকার, কী দরকার। কিছুদিন হল অনি এইরকম একটা গলা মনেমনে শুনতে পায়। যখনই কোনো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে, তার খুব অভিমানবা রাগ হয়, তখনই কেউ-একজন মনেমনে কদিন আগে একটা ব্যাপার হয়েছিল। ওদের স্কুলে একজন নতুন টিচার এসেছেন দক্ষিণেশ্বর থেকে খুব ভক্ত লোক। আর বেশ ভালো লেগেছিল দেখতে। একদিন হলঘরের প্রয়ারের পর উনি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিলেন ওঁ ভগবতে · শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ। ওরা ভেবেছিল এটা মাস্টারমশাই-এর নিছক খেয়াল। দিন-সাতেক পরে হঠাৎ ক্লাসে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন লাইনটা কার স্পষ্ট মনে আছে, কে লিখতে পারবে? কেউ খেয়াল করেনি, ফলে এখন ঠিকঠাক সাহস পাচ্ছিল না। অনি সঠিক জবাব দিতে তিনি ওকে কাছে ডেকে বললেন, চিরকাল লাইনটা মনে রাখবে। সুখে কিংবা দুঃখে, বিপদে-আপদে মনেমনে লাইনটা বলে নিজের কপালে মা শব্দটা লিখবে। দেখবে তোমার অমঙ্গল হবে না। কথাটা বলে ওর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রামকৃষ্ণ কে ছিলেন জান তো? ঘাড় নেড়েছিল অনি।

গুড! অনি ছিলেন পরম সত্য, পরম আনন্দ। তার আলোর কাছে কোনো আলো ঘেঁষতে পারে না।

কথাগুলো তখন ভালো করে বুঝতে না পারলেও মনেমনে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়েছিল অনি। তার পর থেকে এই প্রক্রিয়াকে অনেকবার কাজে লাগিয়েছে ও। যেমন, বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে হয়ে গেলে দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্য বুকটা যখন চুকচুক করে ওঠে তখন চট করে ওই চারটে শব্দ আওড়ে কপালে মা লিখলে অনি লক্ষ করছে কোনো গোলমালে পড়তে হয় না। এই আজকে যখন ঝাড়িকাকুকে চৌমাথায় ছেড়ে ও বাড়ি ফিরল তখন মনে হচ্ছিল এখন বাবার মুখোমুখি হতে হবে, একসঙ্গে খেতে হবে। বাড়িতে ঢোকার আগে প্রক্রিয়াটা করতে ফাড়া কেটে গেল।

রামকৃষ্ণকে ভগবান মনে করে প্রণাম করার একটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এটা অনিমেষের কাছে স্পষ্ট নয় মাস্টারমশাই কেন মা শব্দটা কপালে লিখতে বলেছিলেন। আশ্চর্য, শব্দটা লেখার পর সারা শরীরে মনে কেমন একটা নিশ্চিন্তি সৃষ্টি হয়।
 
সারা দুপুর ওর প্রায় টেটো করেই কেটে গেল। ওদের বড়ির পেছনের বাগানের সেই চেনা-চেনা গাছগুলো অদ্ভুত বড়সড় আর অগেছালো হয়ে গিয়েছে। সেই বুনো গাছগুলো যাদের বুকে জোনাকির মতো হলুদ ফুল ফুটত তেমনি ঠিকঠাক আছে। এই দুপুরে ঘুঘুগুলো একা একা হয়ে যায় কেন? এমন গলায় কী কষ্টের ডাক যে ডাকে! অনি ঘুরতে ঘুরতে নদীর কাছে এসে দেখল জলেরা এখনও তেমনি চুপচাপ বয়ে যায়।

একসময় সূর্যটা খুঁটিমারির জঙ্গলের ওপাশে মুখ ডোবালে স্বৰ্গছেঁড়া ছায়া-ছায়া হয়ে গেল। এখন একরাশ পাখির চিৎকার আর মদেসিয়া কলিকামিনদের ভাঙা-ভাঙা গান জানান দিচ্ছিল রাত আসছে। নদীর ধারে-ধারে অনি চা-বাগানের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ছোট ছোট পায়েচলা পথ দুপাশে ঠাসবুনোট কোমর-সমান চায়ের গাছে ফুল ফুটেছে, শেডট্রিগুলোতে ঝাঁকে-ঝাঁকে টিয়াপাখি বসে সবুজ করে দিয়েছে। এখন চা-বাগানের মধ্যে কেউ নেই। লাইনে ফেরার জন্য পথসংক্ষেপ করে কোনো-কোনো কামিন মাথায় বোঝা নিয়ে দূর দূর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এই নির্জন পরিবেশে বিশাল সবুজের অঙ্গীভূত ঢেউ-এ দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে-দেখতে অনির মনে হতে লাগল ও খুব একা, ভীষণ একা। ওর মা নেই, বাবা নেই, কোনো আত্মীয়-বন্ধু নেই। ঠিক এই মুহূর্তে ও দাদু বা পিসিমার কথা ভাবতে চাইছিল না। ওঁদের বিরুদ্ধে অনির কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু বয়সবাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওঁরা যেন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর কিছুই যেন তাদের স্পর্শ করে না তেমন করে। তোমাদের দুটো জননী, একজন গর্ভধারিণী অন্যজন ধরিত্রী-যিনি তোমাকে বুকে ধারণ করেছেন। নতুন স্যারের সেই কথাগুলো মনে হতেই এই নির্জন সন্ধ্যা-নামা সমটায় চা-বাগানের ভিতর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে গলা কাঁপিয়ে গাইতে লাগল, ধন-ধান্য-পুষ্প-ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।

না, বাড়িতে ইলেকট্রিক আসেনি। অনিরা প্রথম যখন জলপাইগুড়িতে গেল তখনই মহীতোষ সব বন্দোবস্ত করে কলকাতা থেকে ডায়নামো আনবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আসেনি। ফলে এখন রাত্রে এ বাড়িতে হারিকেন জ্বলে। দুটো নতুন জিনিস দেখল অনি, সন্ধে চলে গেলেও ক্লাবঘরে হ্যাজাক জ্বলল না, কেউ এল না তাস খেলতে। আর সব বাবু সাইকেলে চেপে টর্চ জ্বালতে জ্বালতে যে যার কোয়ার্টারে ফিরে গেলেও মহীতোষ ফিরলেন না। অথচ রাত হয়ে গেছে বেশ, চাবাগানে-যে রাতটায় কুলিলাইনে মাদল বাজা শুরু হয়ে যায়। অনি ঠিক বুঝতে পারছিল না ও কোন ঘরে থাকবে। যদি বাইরের ঘরে থাকতে হয় তা হলে মহীতোষ ফেরার আগেই খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লেই ভালো।সন্ধের পর বাড়ি ফিরলে ছোটমা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, খাবে না। সত্যি সারাদিন এত ঘুরেও একটুও খিদে পায়নি অনির। ও না বলেছিল, ছোটমা আর কথা বাড়ায়নি। সামনের মাঠে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। আসাম রোড দিয়ে মাঝে-মাঝে শহুশ করে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। অনি ঠিক করল কাল সকালের ফাস্ট বাসে ও জলপাইগুড়ি ফিরে যাবে।

একটু বাদে ও খিড়কিদরজা খুলে উঠোন পেরিয়ে ভেতরে এল। ঘরের মধ্যে দিয়ে এলে মায়ের ছবিটা ঘরটা পার হতে হবে যেটা অনি কিছুতেই চাইছিল না। রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে ও দেখল দরজাটা খোলা। ভিতরে কাঠের উনুনে কিছু-একটা ফুটছে আর উনুনের পাশে উবু হয়ে গালে হাত দিয়ে ছোটমা বসে আছে। জ্বলন্ত কাঠের লাল আগুনের আভা এসে পড়েছে গালে, স্থির হয়ে কোনো ভাবনায় ড়ুবে থাকা। চোখের পাতায়, চলে, কাপড়ে। চারপাশের অন্ধকারে ছোটমাকে কাঠের উনুনের আঁচ মেখে এখন একদম অন্যরকম দেখাচ্ছিল। অনি এসে দরজায় দাঁড়াতেও ছোটমার হুঁশ হল না। ভাগ্যিস এখানে চুরিচামারি বড়-একটা হয় না। .
 
অনি রান্নাঘরে ঢুকতে ছোটমা চমকে সোজা হয়ে বসল, তারপর অনিকে দেখে আঁচলটা ঠিক করে নিল, ওমা তুমি। সারাদিন কোথায় ছিলে?

ঘুরছিলাম।অনি খুব আস্তে উত্তরটা দিল। ও রান্নাঘরটা দেখছিল। যখন ছিল তখন এরকম ব্যবস্থা ছিল না। বোধহয় কাজ করার সুবিধে অনুযায়ী চোখাচোখি হতে বলল, খিদে পেয়েছে।

অনি ঘাড় নাড়ল, না। আচ্ছা, একটা লম্বা কাঠের সিঁড়ি ছিল, ওপরে গোলাপের ফুল আঁকা, সেটা কোথায়?

অবাক হল ছোটমা, কেন?

অনি বলল, ঐ পিড়িটায় আমি বসতাম। রাত্তিরবেলায় খুব ঘুম পেয়ে গেলে এই ঘরে পিড়িটায় বসে খেয়ে নিতাম।

কথা শুনে ছোটমা হাসল, তারপর উঠে পাশের ঘরে গিয়ে সেই পিড়িটাকে এনে মাটিতে পেতে দিল, বসো, গল্প করি।

অনি পিড়িটায় বসে বেশ আরাম পেল, আজকাল ক্লাবে তাসখেলা হয় না?

প্রশ্নটা করতেই ছোটমা ঘাড় নাড়ল, না।

কেন?

তরকারিতে হয়তো খন্তি চালাবার কোনো দরকার ছিল না, তবু ছোটমা সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তারপর বলল, জানি না।

বাবা কখন আসবে?

অনির দিকে পেছন ফিরে তরকারি নামাতে নামাতে ছোটমা বলল, ওর ফিরতে দেরি হবে, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ে। কালকে আবার যেতে হবে তো!

এখানে থাকতে যদিও তার একটুও ইচ্ছা করছিল না, তবুও এখন অনির কেমন রাগ হয়ে গেল, বাঃ, তুমি তো আমাকে একসময় আসার জন্য চিঠি লিখেছিলে, এখন চলে যেতে বলছ কেন?

মুখটা পলকে কালো হয়ে গেল ছোটমার। অনি দেখল, নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিচ্ছে ছোটমা। তারপর বলল, তখন তো তোমার এত পড়াশুনা ছিল না।

হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, অনি, ঝাড়িকাকুকে বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে কেন?

ছোটমা দুচোখ তুলে ওকে দেখল, তাড়িয়ে দিয়েছে কে বলল?

আমার সঙ্গে ঝাড়িকাকুর দেখা হয়েছিল। অনির অমন জেদ ধরে যাচ্ছিল। ছোটমা কি ওকে খুব বাচ্চা ভেবেছে। এভাবে কথা লুকিয়ে যাচ্ছে কেন?

এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না, আমি বলতে পারব না।

তুমি আমাকে বন্ধু বলেছিলে না।

ছোটমা কোনো উত্তর দিল না। উঁচু করে রাখা দুটো হাঁটুর ওপর গাল রেখে চুপ করে রইল। অনি বলল, বাবা আগে এমন ছিল না, মা থাকতে বাবা একদম অন্যরকম ছিল।

খুব গাঢ় গলায় ছোটমা বলল, কী জানি! বোধহয় আমি খারাপ, তাই।

উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল অনি, তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

হঠাৎ ঝট করে উঠে বসল ছোটমা, বেশ, আমি মিথ্যে কথা বলছি। আমার খুশি তাই বলছি।

কেন? মিত্যে কথা বললে-। অনি কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কেউ অন্যায় করছে এবং এরকম জেদের সঙ্গে স্বীকার করছে-কখনো দেখেনি সে।

খুব কাটা-কাটা গলায় ছোটমা বলল, উনি যা করছেন করুন তবু আমাকে এখানে থাকতে হবে। আমার পেটে বিদ্যে নেই যে রোজগার করব। ভাইদের কাছে গলগৃহ হয়ে থাকার চেয়ে এখানে। অপমান সহ্য করা অনেক সুখের। নিজের জন্যে মিথ্যে বলতে হবে, আমাকে আর প্রশ্ন করবে না তুমি।
 
অনি চুপ করে গেল। ছোটমার কথাগুলো বুঝে উঠতে সময় লাগল। ওর হঠাৎ মনে হল এতক্ষণ ও যেভাবে কথা বলেছে সেটা ঠিক হয়নি। জলপাইগুড়িতে প্রথম পরিচয়ের দিন যাকে বন্ধু এবং নিজের চৌহদির মধ্যে বলে মনে হয়েছিল, এখন এই রাত্রে তাকে ভীষণ অচেনা বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু ছোটমা তাকে একটা মুখ সত্যের মুখোমখি দাড় করিয়ে দিয়েছে। বাবার এইসব কাজ, কাজ না বলে অত্যাচার বলা ভালো, ছোটমাকে মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে তার ভাইদের কাছে গিয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে। ছোটমা যদি লেখাপড়া শিখত তা হরে চাকরি করতে পারত সেটাও সম্ভব নয়। আচ্ছা, আজ যদি বাবা তাকে। সঙ্গে সঙ্গে অনি যেন চোখের সামনে সরিৎশেখরকে দেখতে পেল, পেয়ে বুকে বল এল। দাদু জবিত থাকতে তার কোনো ভয় নেই। কিন্তু দাদুকে আজকাল কেমন অসহায় লাগে মাঝে-মাঝে, পিসিমার সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে প্রায়ই চা কথা-কাটাকাটি হয়। হোক, তবু তার দাদু আছে, কিন্তু ছোটমার কেউ নেই। ও গম্ভীর গলায় বলল, তুমি চিন্তগা কোর না আমি পাশ করে চাকরি করলে তুমি আমার কাছে গিয়ে থাকবে। বাবা কিছু করতে পারবে না।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছোটমা বলল, ছি! বাবাকে কখনো অসম্মানের চোখে দেখতে নেই, ভুল বুঝতে পারলে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।

অনি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, বাবার বিরুদ্ধে কিছু বললেই ছোটমা একদম সমর্থন করে না কেন? ছোটমা উঠে মিটসেফ থেকে একটা বিরাট জামবাটি বের করে ওর সামনে এনে রাখল, তোমার জন্যে করেছি। বাড়িতে তো আর দুধ হয় না, অনেক কষ্টে এটুকু যোগাড় করতে পেরেছি। অনি দেখল জামবাটির বুক-টইটম্বুর পায়েসের ওপর কিমিসগুলো ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে আছে, একটা তেজপাতা তিনভাগ শরীর ড়ুবিয়ে কালো মুখ বের করে আছে। চোখাচোখি হতে ছোটমা বলল, ভালো না হলেও যেতে হবে অনি, দিদির মতো হয়নি আমি জানি।

অনি হাসল, ছোটমা সেই প্রথম দিনের কথাটা এখনও মনে রেখেছে।

এ-বেলা একদম নিরামিষ, তোমার খেতে অসুবিধে হবে খুব।

ছোটমার কথা শুনে হাসল অনি, এতখানি পায়েস পেলে আমার কোনো খাবারের আর দরকার নেই। একটা চা-চামচ দিয়ে ধারের দিকে একটু পায়েস নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, ফাইন! তারপর চোখ বুজে সেটাকে ভালোভাবে গলাধঃকরণ করে বলল, পিসিমার চেয়ে একটু কম ভালো হয়েছে, তবে মায়ের চেয়ে অনেক ভালা। পিসিমা ফার্স্ট, তুমি সেকেন্ড, মা থার্ড।

অনির কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল ছোটমা। সারাদিন এবং এই একটু আগেও যে-অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, ছেলেটা খেতে আরম্ভ করার পর থেকে সেটা টুপ করে চলে গেল। যে যা ভালাবাসা তাকে সেটা তৈরি করে খাওয়াতে যে এত ভালো লাগে এর আগে এমন করে জানা ছিল না। কী তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে ছেলেটা। আর এই সময় প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ উঠল, কেউ যেন মনের সুখে দরজায় লাথি মারছে। খেতে-খেতে চমকে উঠে অনি বলল, কিসের শব্দ?

ছোটমার খুশির মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেল যেন, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে কোনোরকমে বলে গেল, তুমি খাও, আমি আসছি।

শব্দটা থামছে না, ঘড়ির আওয়াজের মতো বেজে যাচ্ছে। তারপর দরজা খোলার শব্দ হতে একটা হুঙ্কার এদিকে ভেসে এল। খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে অনি সোজা হয়ে উঠ দাঁড়াল, তারপর একছুটে বাঁধানো উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। ছোটমার ঘরে একটা ছোট্ট ডিমবাতি জ্বলছে, এত অল্প আলো যে চলতে অসুবিধে হয়। মায়ের ছবির ঘরের দরজায় এসে থমকে দাঁড়াল। ও। বাবা কথা বলছেন, জড়িয়ে জড়িয়ে, কোনো কথার শেষটা ঠিক থাকছে না, কোথায় আড়া। মারছিলে, আমি দুঘন্টা ধরে নক করছি খেয়াল নেই, এ্যা?

ছোটমা বলল, অনিকে খেতে দিচ্ছিলাম।

অনি? হু ইজ অনিঃ মাই সন? সন বড় না ফাদার বড়, অ্যাঁ? আমার আসবার সময় কেন দরজায় বসে থাকনি, অ্যাঁ?

ছোটমা খুব আস্তে বলল, কাল ছেলেটা চলে যাবে, আজকের রাতটায় এসব না করলেই নয়?

জ্ঞান দিচ্ছ? সেদিনকার ছুঁড়ি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে, অ্যাঁ! বিনে পয়সায় মা হয়েছে, মাগিরি দেখাছ ভালো, ভালো। মাধু গিয়ে আচ্ছা প্রতিশোধ নিয়েছে। নইলে একটা বাঁজা মেয়েছেলে কপালে জুটল! গলাটা টলতে টলতে মায়ের ঘরে চলে এল, অ্যাই, ধূপ জ্বলছে না কেন?

ছোটমা দৌড়ে মহীতোষের পাশ দিয়ে এসে বোধহয় ধূপ জ্বেলে দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার গলা থেকে একটা আর্তনাদ উঠল, উঃ!

কৌতূহলে অনিমেষ এক পা বাড়াতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ছোটমার ডান হাতের কবজিটা বাবার মুঠোয় ধরা, বাবা সেটাকে মোচড়াচ্ছেন। সমস্ত শরীর বেকিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করেও পারছে

ছোটমা। বাবা সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, শান্তি দিচ্ছি, অন্যায় করলেই শাস্তি পেতে হবে, হুঁহুঁ বাবা!
 
বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনি মাধুরীর ছবিটা দেখতে পেল। অত বড় ছবিটার ওপর দুটো চাইনিজ লণ্ঠনের আলো পড়ায় মুখটা একদম জীবন্ত। সকালে ছবিটায় অদ্ভুত একটা বিমর্ষভাব দেখতে পেয়েছিল অনি, এখন সেটা নেই যেন। বরং উল্লাসময় একধরনের উপভোগ করার অভিব্যক্তি মায়ের মুখে। চোখ দুটো কি খুব চকচক করছে! না, আলো পড়ায় ওরকম হয়েছে। ছবির মাকে ওর একদম পছন্দ হচ্ছিল না! ও মহীতোষের দিকে তাকাল। এখনও উনি ছোটমাকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছেন, ছোটমা ইচ্ছে করলে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন বাবাকে, কিন্তু দিচ্ছেন না। অনি যেন শুনতে পেল কে যেন তার কানের কাছে বলে গেল, বল বল, ভয় কিসের? অনি সঙ্গে সঙ্গে মহীতোষকে বলল, ছোটমাকে মারছেন কেন?

মহীতোষ পাথরের মতো শক্ত হয় দাঁড়িয়ে পড়লেন, দুচোখ কুঁচকে লক্ষ করার চেস্টা করলেন কে বলছে। এই সময় তার শরীরের নিম্নভাগ স্থির ছিল না। অনিকে চিনতে পেরে বললেন, আমি যে মারছি তোমাকে কে বলল? তোমার এই মা বলছে? তুমি একে মা বল তো, অ্যাঁ?

অনি দেখল ছোটমা সামান্য জোর দিয়ে নিজের হাতটা বাবার মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিল। মহীতোষ বললেন, গতরে জোর হয়েছে দেখছি!

মেরে ছোটমার গালে দাগ কে করে দিয়েছে। অনি প্রশ্নটা এমন গলায় করল যে মহীতোষ প্রাণপণে সোজা হবার চেষ্টা করলেন। ছোটমা মুখে আঁচল দিয়ে বিস্ফারিত-চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। দুই পা এগিয়ে এক হাত বাড়িয়ে মহীতোষ বললেন, অনি, পুত্র, পুত্র আমার! এখানে এসো, এই বুকে মাথা রেখে শুনে যাও।

অনি কিছু বোঝার আগেই মহীতোষ কয়েক পা টলতে টলতে হেঁটে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনির স্পর্শ শরীরে পেতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি, মাধু দ্যাখো, কে আমার বুকে এসেছে, অ্যাঁ!

এই প্রথম অনিমেষ জ্ঞানত পিতার আলিঙ্গন পেল এবং সেই আলিঙ্গনে ওর সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠল যেন। বাবার মুখ দিয়ে যে-বিশ্রী ক্লেদাক্ত গন্ধ বের হচ্ছে তা সহ্য করতে পারছিল না অনি। তীক্ষ্ম গলায় ও চিৎকার করে উঠল, আপনি মদ খেয়েছেন?

প্রশ্নটা শুনেই ছোটমা দাঁড়িয়ে ড়ুকরে কেঁদে উঠল। মহীতোয় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে চমকে দিলেন, আঃ, ফাঁচা কোরো না তো, পিতাপুত্রের কথাবার্তার মধ্যে ফ্যাঁচফ্যাচানি! হ্যাঁ বাবা, ইয়েস আমি ড্রিঙ্ক করেছি। ইউ মে আস্ক মি, হোয়াইট লুক অ্যাট হার! এক হাতের আঙুল তীরের মতো মাধুরীর ছবিটার দিকে বাড়িয়ে মহীতোষ বলরেন, দ্যাখো ও কেমন খুশি হয়েছে। ইওর মাদার! তোমাকে ও পেটে ধরেছিল, হোলি মাদার! ওর খুশির জন্য খেয়েছি।

আপনি কি ওঁর খুশির ছোটমাকে মারেন? গলাটা এত জোরে যে মহীতোষ দুহাতের মধ্যে দাঁড়ালেন প্রায় অর চিবুক অবধি লম্বা ছেলের মুখ দেখবার চেষ্টা করে বললেন, ইউ আনফেথফুল সন, কোনোদিন নিজের মাকে ছোট করে দেখবে না। আমি প্রত্যেক রাত্রে মাধুরীর সঙ্গে কথা বলি। এখানে, এই ঘরে দাঁড়িয়ে, ড়ু ইউ নোর।

অনির আর সহ্য হচ্ছিল না। আপনি মিথ্যে বলছেন!

কী? আমি মিথ্যে বলছি? আমি মিথ্যে বলছি! হাত বাড়িয়ে খিমচে ধরলেন মহীতোষ ছেলেকে। মাতাল হলেও বাবার গায়ের জোরের সঙ্গে পেরে উঠছিল না অনি, মাকে যদি আপনি এত ভালোবাসেন, মা যদি-না, তা হলে আপনি মদ খেতেন না, ছোটমার উপর অত্যাচার করতেন না। শুনেছি ভুতে ধরলে মানুষ অন্যরকম হয়ে যায়, আপনার সেরকম হয়েছে!

সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছেড়ে দিয়ে মহীতোষ ছোটমার দিকে ছুটে গেলেন, তুমি ওকে এসব শিখিয়েছ, আমার ছেলেকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছ

দুহাতের আড়ালে মুখ রেখে ছোট সেই চাপাকান্নার মধ্যে গলা ড়ুবিয়ে বলে উঠল, আমি বলিনি, বিশ্বাস করো, আমি কিছু বলিনি।

কিন্তু কথাটা একদম বিশ্বাস করলেন না মহীতোষ, রাগে উন্মাদ হয়ে বলে চললেন, কাল সকালে বেরিয়ে যাবে, তোমাকে আমার দরকার নেই, একটি বাজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ। তোমার জন্য সে এই কয় বছর আমার কাছে আসছিল না, তুমি আমার ছেলেকে।

প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে কেঁদে উঠল ছোটমা, আমি কাউকে কিছু বলিনি।
 
বোধহয় সমস্ত শরীরের ওজন দিয়ে মহীতোষ ডান হাতখানা শূন্যে তুলেছিলেন, যেটার লক্ষ্য ছিল ছোটমার গাল। ঠিক সেই পলকে অনিমেষ যেন শুনতে পেল, যাও, ছুটে যাও। কিছু বোঝার আগেই সে তীরের মতো এগিয়ে গিয়ে মহীতোষের ডান হাত চেপে ধরে ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে মহীতোষ ছেলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন, অনি নিজেকে বাঁচাতে সরে দাঁড়াতেই নেশাগ্রস্ত শরীরটা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল। পড়ে যাওয়াটা এত দ্রুত ঘটে গেল এবং একটা মানুষ যে পুতুলের মতো সোজা চিত হয়ে পড়তে পারে অনি বুঝতে পারেনি ; মেঝের ওপর পড়ে-থাকা নিথর শরীরটার দিকে ওরা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল যেন বিশ্বাস করাই যায় না যে এই লোকটাই এতক্ষণ এখানে ছিল। অনির আগে ছোটমা চিষ্কার করে ছুটে গেলেন মহীতোরে কাছে। অনি দেখল ছোটমা বাবার মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে প্রাণপণে ডাকছেন। বাবার মাথাটা একটা পাশে বারবার ঘুরে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় কোলের ওপর নিয়ে প্রাণপণে ডাকছেন। বাবার মাথাটা একটা পাশে বারবার ঘুরে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় ঠোঁট দুটো বেঁকে গেছে। হাত-পা টানটান, শরীরে কোনো আলোড়ন নেই। প্রথমে সন্দেহের চোখে তাকালি অনিমেষ, বাবার ওপর আর কোনোরকম শ্রদ্ধা ছিল না তার, এই মুহূর্তে। বাবা মদ খায়, ছোটমাকে মারে, তার মৃতা মায়ের নাম করে যা ইচ্ছে। বলে–এখন যে এভাবে পড়ে আছে তা স্বাভাবিক নয়। বাবার জোরের সঙ্গে সে পারবে না কিছুতেই, তাই ওর সামান্য ঠেলায় এভাবে পড়ে মাথা থেকে বেরিয়ে-আসা রক্তে ছোটমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে।

আমি! কোনোরকমে বলল সে।

কেন মাতাল মানুষটাকে ঠেলে দিলে! আমাকে মারলে তোমার কী এসে যেত, যদি আমাকে মেরে সুখ পায়, পাক-না! নিজের আঁচলটা বাবার মাথায় চেপে ধরে ছোটমা ড়ুকরে ড়ুকবে কথাগুলো বলল।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনি চারপাশে অনেকগুলো মুখ দেখল, নড়ে নড়ে ভেঙেচুরে যাচ্ছে। মুখগুলো কার? নাকি একনজরের মুখ হাজার হয়ে যাচ্ছে! শিরশিরে একটা শীতল বোধ ওর শিরদাঁড়ায়। উঠে এল। মুহূর্তে কপাল ভিজে যাচ্ছে ঘামে। ও দেখল মায়ের ছবিটা বড় বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

অদ্ভুত একটা ভয় ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে বেড়াচ্ছে। ও কি বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল? না
, কখনো নয়। গলা প্রায় বুজে যাচ্ছিল অনির, ওকথা বলল, বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমি ভাবিনি, বাবা পড়ে যাবেন।

হঠাৎ যেন ছোটমার গলার স্বর বদলে গেল! খুব ধীরে ছোটমা বলল, ওকে একটু ধরবে অনি! খাটের ওপর শুইয়ে দিই।

মহীতোষকে শুইয়ে দিতে ওদের একটু কষ্ট হল, দেহটা বেশ ভারী। ছোটমার হাত মাথার ফেটেযাওয়া জায়গায় আঁচল চেপে রেখেছে। অনি বলল, আমি একছুটে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনছি।

ও যেই বেরুতে যাবে এমন সময় ছোটমার ডাক শুনল। দরজা অবধি পৌঁছে ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল সে। ছোটমার মুখটা অস্পষ্ট। পাশে বাবার শরীরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। ওদের পেছনে দেওয়ালে মায়ের ছবিটা ঝকঝক করায় সামনেটা কেমন হয়ে গিয়েছে। ছোটমা যেন অনেক দূর থেকে তাকে বলল, অনি, আমার একটা কথা রাখবে

গলার স্বরে এমন একটা মমতা ছিল যে অনি স্পষ্ট শুনতে পেল কে যেন তাকে বলছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও বলর, হ্যাঁ।

মানে?

ও নিজেই ভার সামলাতে পারেনি, একথা সবাই জানবে!

কিন্তু বাবা–?

মাতাল মানুষের কোনো খেয়াল থাকে না। জেগে উঠলে যা বলব বিশ্বাস করবে।

অনি বুঝতে পারছিল না কেন ছোটমা একথা বলছে। সবাই যদি শোনে অনি বাবাকে ফেলে দিয়েছে, তা হলে-। ওর বুকে ভেতর থেকে অনেক অনেক অনেকদিন পরে একটা কান্নার দমক উঠে এল গলায় কেন?

ছোটমা বলর, আমার জন্য। আর জানতে চেয়ো না। কেউ যেন জানতে না পারে, মনে থাকে যেন। যাও, দেরি কোনো না। ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনন।

কখনো কখনো অন্ধার,বন্ধুর মতো কাজ করে। এখন স্বৰ্গছেঁড়ায় গভীর রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকিরা ঘুরে বেড়ায়,লাইনে মাদল বাজে। সার-দেওয়া কোয়ার্টারের দরজাগুলো বন্ধ। মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের দিকে যেতে-যেতে এই অন্ধকারটা যদি শেষ না হত তা হলে যেন ও বে; যেত। বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে কী করবে সে?

ডাক্তারবাবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ও বুক ভরে নিশ্বাস নিল। তারপর অন্ধকারে উচ্চারণ করল, ও ভাগবতে শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ। একটা ঘোরের মধ্যেও মা শব্দ আঙুলের ডগা দিয়ে কপালে লিখতেই অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল শরীরটা মাধুরী ওকে জড়িয়ে ধরে যেমন হত।

নিশ্চিন্তে ডাক্তাবাবুর দরজার কড়া নাড়তে লাগল অনিমেষ।
 
বালির চরের ওপর দিয়ে ওরা তিনজন হেঁটে যাসিল। এখন তিস্তার একটা খাতেই বয়ে যাচ্ছে, সেটা বার্নিশের দিকে। ফলে এদিকের বিরাট চারটা শুকিয়ে খটখট করছে। চরে নেমে কিছুটা গেলেই কাশগাছের জঙ্গল চাপ বেধে ওপরে উঠে গেছে। জেলা স্কুলের মুখোমুখি নদীর বুকের জঙ্গলটা বেশ ঘন, দিব্যি লুকিয়ে থাকা যায়। মাঝে-মাঝে পায়ে-চলার পথ আছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। সেনপাড়ার ওদিক থেকে গরিব মেয়েরা তিস্তায় কাঠ কুড়োতে যায়। পাহাড় থেকে ভেঙেপড়া গাছের শরীর তিস্তায় ভাসতে ভাসতে আসে। মেয়েরা সাঁতরে সাতরে সারাদিন ধরে সেগুলো জড়ো করে নদীর ধারে। বিকেলে সেগুলো জড়ো করে নদীর ধারে। বিকেলে সেগুলো মাথায়-মাথায় চলে যায় পাড়ায়। তারপর টুকরো হয়ে রোদে শুকিয়ে বাবুদের রান্নার জ্বালানির জন্য বিক্রি হয়ে যায়। জঙ্গলের যেখানে শুরু সেখানে কিছু লোক তরমুজের ক্ষেত করে দিনরাত পাহারা দেয়। এখন তরমুজ পাকার সময় আর কদিন বাদেই জঙ্গলটা একদম সাদা হয়ে যাবে। দারুণ কাশফুল ফুটবে তখন।

অনি এর আগে দুই-তিনবার বালির চরে এসেছে, জঙ্গলে ঢোকেনি। মণ্টুর এসব জায়গা খুব চেনা। প্রায়ই টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে ও একা একা এখানে যোরে। এই জঙ্গলে কোনো হিংস্র জানোয়ার সচরাচর থাকে না, কিন্তু শিয়াল তো আছে। মাঝে একবার তিস্তার জলে ভেসে সে একটা বাচ্চা বাঘ এখানে সুকিয়ে ছিল। অতএব ভয় যে একদম নেই তা বলা চলে না। জলে রে ও কী দ্যাখো কিছুতেই বলতে চায় না, জিজ্ঞাসা করে বিজ্ঞের মতো হাসে। তপন থাকে আশ্রমপাড়ায়, সবকটা দেশাত্মবোধক গান ওর মুখস্থ। অথচ এ নতুন স্যারকে নিয়ে খারাপ খারাপ রসিকতা করে।

জঙ্গলে ঢোকার আগে তরমুজক্ষেত। পাকাপাকি কোনো ব্যাপার নয়, জল এলেই পালিয়ে যেতে হবে তবু ক্ষেতের বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে। মাঝে-মাঝে খুঁটি পুঁতে সেগুলোর মধ্যে দড়ি বেঁধে দেওয়ায় আলাদা হয়েছে ক্ষেতগুলো। ওদের তিনজনকে বালির চর পেরিয়ে সেদিকে যেতে দেখে একজন হেঁকে উঠল, কে যায়। কারা যায়।

মণ্টু বলল, আমি গো বুড়োকর্তা। সঙ্গে আমার বন্ধুরা।

অনি দেখল ক্ষেতের মধ্যে অনেক জায়গায় লাঠির ডগলায় কাকাতাড় য়ারা ছেঁড়া জামা পরে হাওয়ায় দুলছে। তেমনি একজন শুধু মাথায়, চোখমুখ আঁকা কালো হড়িটাই যা নেই, বালির ওপর উবু হয়ে বসে এক হাতের আড়ালে চোখের রোদ্দুরে ঢেকে ওদের দেখছে। মণ্টুর কথা শুনে একগাল হাসল বুড়ো, অ খোকাবাবু, তা-ই কও! এত চোরের আওন-যাওন বাড়ছে আজকাল যে চিনতে পারি না। কালকের ফলটা মিষ্টি ছিল?

হ্যাঁ, খুব মিষ্টি ছিল। মণ্টু বলল।

যাও কই?

এক আনি পয়সা আছে, একটা তরমুজ দেবে।

বুড়ো হাসল, বোঝলাম।

তা হলে যাওয়ার সময় নিয়ে যাব, কেমন কথাটা বলে ও চাপা গলায় অনিদের বুঝিয়ে দিল, যাওয়ার সময় প্রত্যেক একটা করে নিয়ে যাব, বুঝলি!

তপন বলল, পয়সা?

মণ্টু খিঁচিয়ে উঠল, আমাকে পয়সা দেখাচ্ছিস? আমি তোমাদের মতো বাচ্চা নাকি?

জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়লে আর হাকিমপড়া দেখা যায় না। শুধু দূরে জেলা স্কুলের মতো লাল ছাদটা চোখে পড়ে। জঙ্গল সরিয়ে সামান্য এগিয়ে একগ খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। চারধারে জঙ্গল, মাঝখানে টাকের মতো পরিস্কার বালি। হঠাৎ মণ্টু বলল, এই অনি, আজকে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বল তো!

অনি মণ্টুকে ভালো করে দেখল। ওর মাথার চুল বেশ কোকড়া, গায়ের রঙ খুব ফরসা। কিন্তু ওকে তো অন্যরকম কিছু দেখাচ্ছে না। রোজকার মতো ইউনিফর্ম পরাই আছে। ওর মুখ দেখে মণ্টু সেই বিজ্ঞের হাসিটা হাসল। এই হাসিটা দেখলে অনির নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হয়। মণ্টু ওদের বন্ধু, এক ক্লাসে পড়ে, কিন্তু ও অনির চেয়ে অনেক বেশিকিছু জানে। মণ্টু হাসিটা শেষ করে জিজ্ঞাসা করল, আজকে আসবার সময় কর-বাড়ির দিকে তাকাসনি

অনি ঘাড় নেড়ে না বলল।

তপন বলল, মুভিং ক্যাসেল পায়চারি করছিল বারান্দায়।

মণ্টু বলল, জানলার ফাঁক দিয়ে রম্ভার চোখ দুটো তো দেখিসনি তোরা, আহা। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে।
 
ওদের স্কুলের উলটোদিকে যে বিরাট বাড়িটা অনেকখানি গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা এখানকার মিউনিসিপ্যালিটি অন্যতম কর্তা শ্রীবিরাম কর মহাশয়ের। মণ্টু একদিন ওকে দেখিয়েছিল বাড়ির গেটের গায়ে ওঁর নামের আগে কে যেন অ অক্ষরটা লিখে গেছে। মানেটা ঠাওর করতে পারেনি প্রথমটায়। মণ্টু বলেছিল, তুই একটা গাড়ল। নতুন স্যারের চ্যালা হয়ে বন্ধু রয়ে গেলি। তারপর মুখ-খারাপ করে কথাটার মানে বুঝিয়ে দিয়েছিল। কানটান লাল হয়ে গিয়েছিল অনিমেষের। অথচ মণ খারাপ ছেলে ভাবতে পারে না। ক্লাসে যে-কোনো প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দেয়। অ্যানুয়েল পরীক্ষার সময় ইচ্ছে করে দুটো উত্তর না-লিখে ছেড়ে দেয় যাতে ফার্স্ট না হতে পারে। নতুন স্যার কারণটা জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল, ফার্স্ট হলে ঝামেলা। ক্লাসের ক্যাপ্টেন হতে হয়, সবাই গুড বয় ভাবে। সবই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। নতুন স্যারও।

মণ্টু যেসব খারাপ কথা জানে, অনিমেষ তা জানে না। সেইজন্যে মণ্টু ওর চেয়ে যেন এক হাত এগিয়ে আছে। তপনটা মুখে কিছু বলে না। কিন্তু মণ্টুর সব ইঙ্গিত ও চটপট বুঝতে পারে। আলাউদ্দিন খিলজির চিতোর আক্রমণটা ক্লাসে পড়ানো হয়ে গেলে তপন আর মণ্টু দুজনে মিলে দেবলাদেবীর নাচ ওদের দেখাল। নাচটা দেখতে খুব বিশ্রী, তপন মেয়েদের, ঢং করে দেবলাদেবী। সাজছিল আর মণ্টু আলাউদ্দিন খিলজি। নাচ শেষ হলে মণ্টু বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞাসা করেছিল, পৃথিবীতে সবচেয়ে আরাম কিসে পাওয়া যায়?

কে যেন বলেছিল, ঘুমুতে সবচেয়ে আরাম।

পেটুক অজিত বলেছিল, খুব পেটভরে রসগোল্লা খেতে দারুণ আরাম।

তপনের মাথা নেড়ে বলেছিল, ধুস! একবার খেলার মাঠে আমার পেট কামড়েছিল। উঃ, কী যন্ত্রণা! দৌড়ে বাড়ি ফিরছি, কপালে ঘাম জমে যাচ্ছে। তারপর একসময় আর পা যেন চলতে চায় না। যখন ল্যাটিন থেকে বেরিয়ে এলাম, ওঃ, তখন এত আরাম এত হারকা লাগল-এরকম আরাম হয় না।

তপনের বলার ভঙ্গিতে ব্যাপারটা এত জীবন্ত ছিল সবাই যেন বুঝতে পেরে একমত হয়ে গেল। কিন্তু মণ্টু বলল, তপন অনেকটা ঠিক কথা বলেছিস কিন্তু পুরো নয়। আচ্ছা অনিমেষ, ট্রয়ের যুদ্ধটা কার জন্য হয়েছিল?

হেলেনের জন্য। তপর উত্তরটা দিয়ে দিল।

লঙ্কাকাণ্ড?

সীতার জন্য। উত্তরটা অনেকগুলো মুখ থেকে বুলেটের মতো ছুটে এল।

আলাউদ্দিন খিলজি কেন চিতোর আক্রমণ করেছিল?

পদ্মনীর জন্য।

সবাই হেসে উঠতেই মণ্টু সেই বিজ্ঞের হাসিটা হেসে হাত তুলে ওদের থামাল, আমরা কেন মুভিং ক্যাসেলকে মাসিমা বলে ডাকি,

এবার কিন্তু কোনো শব্দ হল না, চট করে উত্তরটা খুঁজে না পেয়ে এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। শুধু তপন খিকখিক করে হেসে উঠল। অনি বুঝতে পারছিল না এর সঙ্গে আরামের কী সম্পর্ক। মুভিং ক্যাসেল হল বিরাম কর মশাই-এর স্ত্র। গোলগাল লম্বা এবং প্রচণ্ড ফরসা মহিলা। বাংলায় বলা হয় চলন্ত দুর্গ, পেছন থেকে দেখলে মনে হয় ওঁর শরীরের মধ্যে অনেকে লুকিয়ে থাকতে পারে। দারুণ সাজেন মহিলা, ওর মেয়েরাও টিক পাত্তা পায় না। জলপাইগুড়ি শহরের মেয়েরা। খুব একটা উগ্র নয়, বরং স্কুলগুলোর সুবাদে একটা গোড়া রক্ষণশীল ভাব বজায় আছে। অবশ্য ইদানীং বাইরের কিছু মেয়ে আসার পর হাওয়া বদলাতে শুরু করলেও দেখলেই বোঝায় যায় কে বাইরের! সেক্ষেত্রে মিসেস বিরাম কর যাকে সবাই মুভিং ক্যাসেল বলে সত্যিই ব্যতিক্রম। গায়ের রঙ ফরসা বলেই হাতকাটা লাল সরু রাউজ: যে ওকে মানাবে একথা ওঁর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। অনি পেছনথেকে ওঁর রিকশায় চলে-যাওয়া শরীর দেখে একদিন ভেবেছিল বোধহয় চাপ-চাপ মাখন দিয়ে ওঁকে তৈরি করা হয়েছে। বিরাম কর মহাশয়ের নাম ছেলেরা রেখেছে ফড়িংদা। মণ্টু বলে ওর দাদা। নাকি বারো বছর আগে জেলা স্কুলে পড়ত, তারাও নাকি এই একই নামে ওঁদের ডেকে গেছে। মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশনের সময় ফড়িংদার চেয়ে মুভিং ক্যাসেলকে বেশি ব্যস্ত দেখায়। মুভিং ক্যাসেলের তিন মেয়েরই নাম, শুধু ওদেরই, জলপাইগুড়ি শহরে আর কারও নেই। তিনজনেই মায়ের কাছ থেকে গমের মতো রং পেয়েছে, জেলা স্কুলের ছেলেরা কাকে ফেলে দেখবে বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েগুলো এমন নির্লিপ্তর মতো তাকায় যে কাউকে দেখছে কি না বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। মণ্টুর অবশ্য নিশ্চিত ধারণা যে রম্ভার ওর দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে। রম্ভা সবচেয়ে ছোট। মেনটা উর্বশী রম্ভা। মেনকাই শুধু শাড়ি পরে। নতুন স্যারে সঙ্গে কর-বাড়ির খুব হয়েছে। হোস্টেলের ছেলেরা বলে প্রায়ই, নতুন স্যার রাত্রের মিল অফ করে মুভিং ক্যাসেলের নেমন্তন্ন খান। এখন তাই জলপাইগুড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে নিশীথ+মেনকা লেখাটা দেখা যাচ্ছে। নতুন স্যারকে নিয়ে এসব ব্যাপার অনির খুব খারাপ লাগে।

মণ্টু বলল, কেউ পারলি না তো! পারবি কী করে, তোরা তো আর নভেল পড়িস না!

অনি বলল, এর সঙ্গে আরামের কী সম্বন্ধ?

মণ্টু হাসল, চিরকাল মেয়েদের জন্য যুদ্ধ হয়েছে, কত রাজ্য ছারখার হয়ে গিয়েছে, তাই তা থেকে যে-আরাম হয় সেটার কোনো তুলনা হয় না। মানুষ তো কষ্ট পাবার জন্য এসব করে না। সে তোরা ঠিক বুঝবি না। সত্যি ব্যাপারটা ওরা ঠিক বুঝল না এবং অনি মনেমনে একমত হল না।
 
এখন তরমুজের ক্ষেত পেরিয়ে কাশবনের ভেতর সরু পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তপন বলল, শুল, মারিস না। রম্ভা দেখেছে, বলে তুই অন্যরকম হয়ে গেছিস, না? রম্ভা আজকাল আমার দিকেও তাকায়। আমি গান গাই জানে বোধহয়।

চট করে ঘুরে দাঁড়াল মণ্টু, খুব খারাপ হয়ে যাবে তপন। মুখ সামলে কথা বলবি। রম্ভা ইজ মাই লাভার, আই লভ রঙা।

ভেংচি কাটল তপন, ইস! তুই তুই জেনে বসে আছিস না যে রম্ভা তোকে ভালোবাসে?

একটু থতমত হয়ে মণ্টু বলল, আমি বললেই বাসবে।

তপন চিৎকার করে উঠল, এঃ, তোর কেনা চাকর না? যখনই হুকুম করবি তখনই ভালোবাসবে! আবার উট মারা হচ্ছে।

আলবত মারব। তুই কি পুরুষমানুষ যে রম্ভা তোকে চাইবে? পরিস তো একটা ঢলঢলে প্যান্ট, আবার কথা! মটু কথাটা শুনে তপন হাঁ হয়ে গেল। অনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। ওর মনে হচ্ছিল যে-কোনো মুহূর্তে ব্রা মারামারি শুরু করে দেবে।কার কথাটা যে সত্যি বুঝতে পারছিল

ও। এতদিন ধরে মিশে অনি ওদের এই ব্যাপারটার কথা একটুও টের পায়নি বলে নিজেই অবাক হচ্ছিল।

তপন বলল, তুই পুরুষ নাকি পুরুষ হলে দাড়ি কামায়, বুঝলি! তুই দাড়ি কামাস?

মণ্টু হঠাৎ খেপে গিয়ে দুই হাত আকাশে নেড়ে চ্যালেঞ্জ করে বসল ঠিক আছে তপন, তুই যখন প্রমাণ চাস তো প্রমাণ দেব। অনি, তুই শুনলি সব, আমি চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করছি। বেশ তোর প্যান্ট খোল, অমরা দেখব।

কেমন আমশি হয়ে গেল তপনের মুখ। বোধহয় এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে কোনো কথা বলতে পারল না। অনিও চমকে গিয়ে মণ্টুর দিকে তাকাল।

সেইরকম বিজ্ঞের হাসি হাসল মণ্টু, কাওয়ার্ড! শুধু মুখেই জগৎ জয় করিস। বেশ দ্যাখ আমার দিকে। এই বলে ঝটপট করে ওর চাপা প্যান্ট খুলে ফেলল। প্যান্ট খোলার সময় অনি চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ও দেখল মটু বালির ওপর ওর শার্ট প্যান্ট ছুড়ে দিল। তারপর শুনল মণ্টু বলছে, এবার দ্যাখ। খুব সঙ্কোচে মুখ ফেরাল অনি। কোমরে হাত রেখে গোড়ালি উঁচু করে ব্যায়ামীরের মতো মণ্টু ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখাচ্ছে। ওর পরনে একটা সাদা ল্যাঙট, ব্যায়াম করার সময় অনেকে পরে। আর সঙ্গে সঙ্গে অনির খুব খারাপ লাগতে আরম্ভ করল। ওর নিজের একটাও জাঙ্গিয়া নেই, ল্যাঙটা তো দূরের কথা। দাদু ওকে সুন্দর জামাকাপড় কিনে দেন কিন্তু ওর যে একটা জাঙ্গিয়া দরকার তা কারও খেয়াল হয় না। এখন এই মুহূর্তে ও অনুভব করল জাঙ্গিয়া ল্যাঙট না পরলে পুরুষমানুষ হওয়া যায় না। মণ্টু বলল, দ্যাখ, পুরুষমানুষ কাকে বলে। তুই লাইফে পরেছিস?

তপন খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। কী বলবে বুঝতে না পেরে অনির দিকে তাকাল। তারপর মুখ নিচু করে ও বলল, বুদ্ধদেব বলেছেন মনটাই সব, শরীর কিছু নয়।

ওসব বাক্যি বইতে থাকে। ফের জামাপ্যান্ট পরতে পরতে মণ্টু বলর, রম্ভা যদি আমাকে এই ড্রেসে দেখত তা হারে একদম ম্যাড হয়ে যেত।

কথাটা শুনে অনি হেসে ফেলল, ম্যাডহলে তো কামড়াবে!

দুস! সে-ম্যাড নাকি? তোদের সঙ্গে কথা বলে সুখ নেই। তারপর গলার স্বর ভারী করে বলল, তপন, ফ্রেন্ডশিপ রাখতে চাস তো ল্যাঙ মারতে যাস না। আমি তোর চেয়ে আগে পুরুষ হয়েছে, আমার চান্স আগে। একেই শালা আমি জ্বলেপুড়ে মরছি। কদমতলার একটা ছেলে রোজ বিকেলে। ওদের বাড়ির সামনে নাকি তিনবার সাইকেলের বেল বাজিয়ে যায়। বল তোরা, এসব কি ভালো কথা?

তপন যেন এতক্ষণ এইসব কথা কিছুই শুনতে পায়নি এমন ভান করে সামনের জঙ্গল দুহাতে সরাতে সরাতে বলল, আর ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিস না। যা দেখাবি বলেছিলি তা কোথায়, নাকি সব গুল?

শার্টের বোতাম আটকে মণ্টু বলল, এ-শর্মা বলল, এ-শর্মা ও মারে না। ফলে দেখাচ্ছি, এই যে অনিমেষচন্দ্র, চলো, দেখব তোমার শরীর কেমন ঠান্ডা থাকে। কাটা শুনে অনিমেষের কান গরম হয়ে গেল আচমকা।
 
জঙ্গলটা ধরে খানিক এগোতেই কয়েকটা মিহি গলা শুনতে পেল অনিমেষ। আওয়াজটা কানে যেতে মণ্টু হাত নেড়ে ওদের থামতে লাগল। ও মুখে কোনো কথা বলছে না, কিন্তু ইশারা ইঙ্গিতে এমন একটা পরিবেশ চটপট তৈরি করে ফেলল যে অনিমেষের মনে হল ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। মণ্টু এখন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে, ওরা পেছন পেছন মাথার ওপর কাশগাছ ছাদের মতো ছেয়ে রয়েছে, দূর থেকে ওদের বুঝতে পারবে না। হই দুটো ক্রমশ জ্বালা করতে লাগল বালিতে ঘষা লেগে। কী-একটা সরসর করে ওদের পাশ দিয়ে দ্রুত চলে যেতে অনি ফিসফিস করে বলল, এই, আজ বাড়ি চল।

তপন বলল, দূর বোকা, ওটা তো শিয়াল!

মণ্টু হাসল, ফক্স দেখে ভয় পাচ্ছিস, টাইগ্রেস দেখে কী করব? আর ঠিক সেই সময় একগাদা হাসি ছিটকে এল ওদের দিকে। মেয়েলি গলায় কে যেন কী-একটা কথা বলে উঠল চেঁচিয়ে! আর একটু এগোতেই জঙ্গলটা পাতলা হয়ে এল। জলের শব্দ হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ করে। অনিমেষ দেখল মণ্টু কাশগাছ সরিয়ে ছোট্ট একটা ফাঁক তৈরি করেছে। অনিমেষ আর তপন ওর পাশে মাথা রাখতেই পুরো নদীটা সিনেমার মতো ওদের সামনে উঠ এল ভির জল এখন অত ঘোলা নয়, করলা নদীর চেয়ে একটু অপরিষ্কার। নদীটা এখানে বাঁক নিয়েছে সামান্য। প্রথমে কাউকে নজরে এল না অনিমেষের, শুধু একটা মেয়ে গান গাইছে এটা বুঝতে পারছিল। গানের সুরটা অদ্ভুত মিষ্টি, অথচ কেন কান্না-কান্না গলায় মেয়েটি গাইছে। ওকে দেতে পাওয়া যাচ্ছে না বটে, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে গাইছে তার খুব দুঃখ। আর এই সময় অন্য কেউ হাসাহাসি কমছে না আগের মতো। শুধু ছলাৎছলাৎ শব্দ যেন সেই গানের সঙ্গে আবহসঙ্গীতের মতো বেজে যাচ্ছিল। ভালো করে কান পাতলা অনি, মেয়েটি গাইছে

এখে অঙ্গে এখে সঙ্গে
ওহে পরভু মুই
নাই রহিম মুই ঘরেরে পরভু,
হামু না যামু অরণ্যে জঙ্গলেরে।

মণ্টু ফিসফিসিয়ে বলল, মেয়েটা ঘরে থাকবে না বলছে, জঙ্গলে চলে যাবে রে!

হঠাৎ তপন বাদিকে সরে গিয়ে জঙ্গলটা ফাঁক করল। করেই খুব উত্তেজিত হয়ে ওদের ডাকল। অনিমেষ নড়বার আগেই মণ্টু ঝাঁপিয়ে পড়ে জায়গা করে নিয়েছে। ফুটোতে চোখ রেখে অনিমেষ দেখতে পেল প্রায় আট-দশজন মেয়ে ছোট ছোট কাঠ জল থেকে পাড়ে টেনে তুলছে। দুজন সতরে নদীর মধ্যে চলে গেল। আর–একটু দূরে বালিশ ওপর বসে জলে পা ড়ুবিয়ে একটি প্রৌঢ়া চোখ বন্ধ করে গান গাইছে যা ওরা এতক্ষণ শুনতে পাচ্ছিল।

মণ্টু বলল, কী রে, কেমন দেখছিস?

আর তখনই ওর নজরে পড়ল, মেয়েগুলোর কেউ শাড়ি জামা পরে নেই। কোমর থেকে একটা কাপড় গোল করে জড়িয়ে রেখেছে সবাই। ওপরে কাশগাছের গায়ে অনেকগুলো জামাকাপড় ঝুপ করে রাখা আছে, বোধহয় জলে ভিজে যাবে বলে এই পোশাকে সবাই জলে নেমেছে। ওদের নিয়েই বেশি জামাকাপড় নেই। কিন্তু ওদের দিকে তাকিয়ে অনির কেমন লজ্জা-লজ্জা করতে লাগল। এখন এই নির্জন নদীর তীরে এতগুলো নারীর বিভিন্ন আকারের বুক দেখতে দেখতে ওর শরীরে অদ্ভুত একটা। শিরশিরানি জন্ম নিল। তাকিয়ে থাকতে ওর ক্রমশ কষ্ট হতে লাগল, আর তখনই ওর কানে এল মণ্টু। বলছে, কীরে অনি, তোর মুখ এত লাল হয়ে গেল কী করে?

তপন বলল, বেদিং বিউটি একেই বলে, আহা! থ্যাঙ্ক ইউ মণ্টু।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top