What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

ছোটমার হাতের রান্না ভালো, তরকারিটা খেতে-খেতে অনির মনে হল। একটু ঝাল-ঝাল, কিন্তু বেশ সুস্বাদ। সুচি র খুব প্রিয় জিনিস, ফুলকো হলে কথাই নেই। ঠিক এই সময় অনি নতে পেল। বাইরের ঘরের দরজায় কে যেন খুব জোরে জোরে শব্দ করছে খেতে-খেতে ও উঠতে যাবে, ছোটমা রান্নাঘর থেকে ছুটে এল, তুমি খাও, আমি দেখছি।

ভেতরের বারান্দায় জলখাবার খাবার চল এ-বাড়িতে এখনও আছে। টুলমোড়াগুলো পালটায়নি। খেতে-খেতে অনি পিসিমার পেয়ারাগাছটা তার সব ডালপালা যেন নামিয়ে দিয়েছে, বেশ ডাশা ডাঁশা পেয়ারা হয়েছে গাছটায়। এই সময় বইরের ঘরে বেশ জোরে একটা ধমক শুনতে পেল অনি, কোথায় আড্ডা মারা হচ্ছিল, অ্যাঁ? আধঘন্টা ধরে ডাকছি, দরজা খোলা নাম নেই। ছোটমা বোধহয় কিছু বলতেই চিৎকারটা জোরদার হল, কেন, আস্তে বলব কেন? বিয়ের সময় তোমার বাপ তো বলে দেয়নি তোমার কান খারাপ!

খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, অনি উঠে দাঁড়াল। গলাট নিচে নেমে আসতে ও স্পষ্ট চিনতে পারল। আর চিনতে পেরেই হতভর হয়ে গেল। মহীতোষকে এ-গলায় কোনদিন কথা বলতে শোনেনি অনি। আজ অবধি বাবাকে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেনি পর্যন্ত। মায়ের সঙ্গে যখন ঠাট্টা করতেন তখন বাবার গজদাঁত দেখা যেত। ও কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। এমনকি বাবা যখন জলপাইগুড়ি যান তখনও তো এধরনের কথা বলেন না। মেয়েদের এ-বাড়িতে কেউ বকেছে এমন গলায়, মনে করতে পারছিল না অনি। তা ছাড়া, ওর যেজন্য আসা, বাবার এই গলা শুনে কিছুতেই মনে হচ্ছে না যে তার কোনো অসুখ করেছে।

ধুপ জ্বলছে না কেন, ধুপআবার চিৎকার ভেসে এল, এবার কাছে। বোধহয় বাবা এখন মাঝের ঘরে চলে এসেছেন। তবে স্বরটা কেমন কাপা-কাঁপা, সুস্থ নয়।

ছোটমার গলা শুনতে পেল ও, নিবে গেছে।

অ্যাই! গর্জনটা অভূতভাবে গোল যেন, সারাদিন খ্যাটন মারছ, একটা কাজ বললে পাওয়া যাবে না, না?

আঃ! আস্তে কথা বলো। ছোটমা যেন ধমকে উঠলেন।

ও বাবা, আবার গলায় তেজ হয়েছে দেখছি। ঝেড়ে বিষ নামিয়ে দেব?

জবাবে ছোটমা বলল, অনিমে এসেছে।

প্রথমে বোধহয় বুঝতে পারেননি বাবা, কে এসেছে। আবার কে জুটল?

ছোটমা বলল, অনিমেষ-অনি।

এবার চটপট বাবার কেমন-হয়ে-যাওয়া গলাটা কানে এল, অনি? অনি এসেছে! কোথায়? ভেতরে, খাচ্ছে। খুব নির্লিপ্ত ছোটমার গলা।

তুমি আনালে?

না, বাবা পাঠিয়েছেন তোমাকে দেখতে। অসুখের খবর পেয়েছেন কার মুখে। কাল বাবারও পা ভেঙেছে।

সে কী! কী করে?

রিকশার ধাক্কা লেগে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন। তবু ছেলেকে পাঠিয়েছেন তোমায় দেখতে, আর তুমি-। কেমন ধরা-ধরা লাগল ছোটমরা গলা।

অ্যাই, আগে বলিনি কেন যে ও এসেছে ছেলেকে দেখাতে চাও, না? প্রতিশোধ নিতে চাও, না।

তুমি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাওনি। রোজ রোজ তুমি যা কর, আমি আর পারি না। এবার যেন কেঁদে ফেলল হোট।

সঙ্গে সঙ্গে বাবা বলে উঠলেন, অ্যাই চুপ! খবরদার এ-ঘরে দাঁড়িয়ে তুমি কাঁদবে না। ছেলেকে শোনাচ্ছ বুঝতে পারছি। খবরদার, কোনো নালিশ করবে না।

ছোটমা বলল, চমৎকার। তোমার নামে আমি ঐটুকু ছেলের কাছে নালিশ করব? গলায় দড়ি জোটে না তার চেয়ে!

বাবা বললেন, গুড। তা সে কোথায়? অনেকদিন পরে এল, না?
 
অনির খুব লজ্জা করছিল। বাবার গলা তার আসার খবর পেয়ে অদ্ভুতভাবে যে পালটে গেল এটা টের পেয়ে লজ্জাটা যেন আর বেড়ে গেল। মা বেঁচে থাকলে বাবা কি কখনো এরকমভাবে কথা বলতে পারত? বাবার গলা ক্রমশ এদিকে এগিয়ে আসছে। ওর ইচ্ছে করছিল দৌড়ে এখান তেকে চলে যায়, বাবার সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা না হলেই যেন ভালো হয়।

মহীতোষ এলেন। খুব শব্দ করে। জুতো মশমশিয়ে। বারান্দায় পা দিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। এই কয় মাসে পাউডগার মত চড়চড় করে বেড়ে গেছে শরীরটা, মাথায় মহীতোষকে ধরতে আর দেরি নাই। নিজের ছেলেকে এখন হঠাৎ লোক-লোক বলে মনে হল মহীতোষের। চোখাচোখি হতেই গলা ঝাড়লেন মহীতোষ, কখন এলে?

বাবার চেহারাটা এরকম হয়ে গেল কী করে? কেমন রোগা-রোগা, চোখের তলায় কারি, গাল ভাঙা, মাথার চুল লালচে-লালচে-মাঝে-মাঝে চিকচিক করছে। অসুখটা কী! মহীতোষ বললেন, স্কুল বন্ধ?

না। অসুখের খবর শুনে দাদু জোর করে পাঠালেন।

অসুখ? কার অসুখ? আরে না না, কে এসব বাজে কথা রটায়! আমি ভালো আছি। স্কুল যখন খোলা তখন তোমার আসা উচিত হয়নি। তোমার মা থাকলে রাগ করতেন। তোমার এখন ফার্স্ট ডিউটি অধ্যয়ন! তোমার মায়ের ঘরে গিয়েছ। মহীতোষ চোখ বড় বড় করে তাকালেন।

অনির হঠাৎ মনে হল বাবা ঠিক স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন না। কথাগুলো যেন অসংলগ্ন এবং সেটা তিনি নিজেও টের পাচ্ছেন। মায়ের ঘর মানে? যে-ঘরে মায়ের ছবি আছে সেই ঘর? ও না-বুঝে ঘাড় নাড়ল।

মহীতোষ বললেন, শুড।–ঘরে গিয়ে চুপচাপ করে বসে থাকলে দেখবে, ইউ ক্যান ফিল হার। অনি লক্ষ করল কথাটা বলার সময় বাবার চোখ কেমন জ্বলজ্বল করে উঠল। ওর মনে পড়ল ছোটমা খবর দেওয়া সত্ত্বেও বাবা দাদুর অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলেছেন না কিছু। ও ঠিক করল, না বললে সেও কিছু জানাবে না। কারণ ওর মনে হল বাবার মাথায় এখন অন্য কোনো চিন্তা রয়েছে, দাদুর কথাটা একদম ভুলে গিয়েছেন।

ছোটমাকে রান্নাঘর থেকে জলখাবার নিয়ে বের হতে দেখে বাবা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ারেন, আচ্ছা, তুমি তা হলে আজকের দিনটা থাক অনি। স্কুল কামাই করা ঠিক নয়। দাদুর ওখানে তোমাকে রেখেছি-হ্যাঁ, দাদুর নাকি পা ভেঙে গেছে, রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে?

অনি ঘাড় নাড়ল, কাল বিকেলে হয়েছে, হাসপাতালে ছিলেন। আজ প্লাস্টার করে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।

এবার যেন মহীতোষের কানে-শোনা চেহারাটাকেই সামনাসামনি দেখতে পেল অনি, অ্যা! দাদুকে হাসপাতালে রেখে তুমি চলে এসেছ। আশ্চর্য অকৃতজ্ঞ ছেলে। লেখাপড়া শিখে তুমি বদর তৈরি হচ্ছ যে তোমাকে বুকে আগলে রেখেছে তার প্রতি কর্তব্য বলে কিছু নেই? ছি ছি ছি।

জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে এসব শব্দ দিয়ে তৈরি কড়া বাক্য শোনাল। অনি বাবার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা আলোড়ন অনুভব করল। তারপর কোনোরকমে বলল, আমি আসতে চাইনি, দাদু জোর করে পাঠালেন। এখন অনির রি কান্না পাচ্ছিল না, এত শক্ত কথা শুনেও ওর ভেতরে কোনো অভিমান হচ্ছিল না। বরং ও খুব শক্ত হয়ে সিটিয়ে দাঁড়াল।

তুমি আসতে চাওনি, গুড গুড। তা এই প্রথম বাপ-মায়ের কথা মনে পড়ল? গিয়েছ তো অনেকদিন, আমরা এখানে আছি খোঁজ রেখেছ! আমি আসতে চাইনি-তা তো করবেই!মহীতোষ। কেমন ঠাট্টা অথচ রাগরাগ গলায় বললেন। এর জবাব কী দেবে অনি? মা থাকতে বাবা তাকে আনতে চাননি। এখন এলেও দোষ, না-এলেও দোষ। অনি কোনো কথা বলছে না দেখে মহীতোষ ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর দুপা এগিয়ে অনির কাঁধে হাত রাখলেন, রাগ কোরো না, একটু বুঝতে শেখো। তোমার মা তো তোমার জন্যই মারা গেলেন।

চমকে উঠল অনি, আমার জন্য?

ঘাড় নাড়ালেন মহীতোষ, হ্যাঁ। তোমার জেলে যাবার ভবিষ্যদ্বাণীটা শোনার পর থেকেই ছটফট করছিল। না হলে বৃষ্টির মধ্যে কেউ ঐ অবস্থায় ছাদে আসে। আমিও দোষী, বুঝলি অনি, আমি যদি তখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। ওর চলে যাওয়ার জন্য আমরা সবাই দায়ী।

হঠাৎ ছোটমার গলা মহীতোষের যেন বাধা দিল, অনেক হয়েছে, ছেলেটা এল আর সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিয়ে পড়লে। ওকে ছেড়ে দাও। লুচির থালাটা টেবিলের ওপর রাখল ছোটমা।

মহীতোষ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার মা আমার সঙ্গে এভাবে কোনোদিন কথা বলেনি।

অনি কোনোদিন উত্তর দিল না। বাবার দিকে না তাকিয়ে আস্তে-আস্তে উঠোনে নেমে এল। এই মুহর্তে ও বাবাকে যেন সহ্য করতে পারছিল না।
 
বাইরের খোলা মাঠে একাশ ছাগল গলায় ঘন্টি বেঁধে টুংটুং শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনি আচ্ছন্নের মতো সেখানে এসে দাঁড়াল। এখন মনে হচ্ছে এই বাড়িতে ওর কোনো জোর নেই। নিজের বাড়ি বলে ও আর ভাবতে পারছে না। এখন যদি জলপাইগুড়িতে চলে যেতে পারত। ও ঠিক করল বিকেলের বাসে ফিরে পাবে। বাবা কী করে বদলে গেলেন! বাবার এই চেহারাটা জলপাইগুড়িতে ওরা কেউ টের পায়নি।

সামনের আসাম রোড দিয়ে হশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। একরাশ মদেসিয়া মেয়ে পিঠে টুকরি বেঁধে চা-পাতি নিয়ে ফ্যাক্টরি দিকে ফিরে যাচ্ছে। অনি কোয়ার্টারগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। মাথার ওপর ঠা-ঠা রোদ এখন। বিশু বা বাপীরা এখন নিশ্চয়ই স্কুলে। সীতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে অনি শুনতে পেল কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। ও দেখল বাড়ির জানালায় সীতার ঠাকুমা বসে আছেন। ওকে তাকাতে দেখে ঠাকুমা রোজ বিকেলে ওদের বাড়িতে পিসিমার কাছে বেড়াতে লাগল। অনি যখন এখানে থাকত তখন ঠাকুমা রোজ বিকেলে ওদের বাড়িতে পিসিমার কাছে বেড়াতে আসতেন। ঠাকুমার কাছে ওরা কত মজার গল্প শুনেছে।

গেট খুলে বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল অনি সীতাদের কোয়ার্টারটা একই রকম আছে, চোখ বন্ধ করে ও ঘোরাফেরা করতে পারে। বাঁদিকের ঘরে ঠাকুমা বসে আছেন। ওকে দেখেই ফোকলা দাঁতে বলে উঠলেন, আয় দাদু, কাছে এসে বোস, কখন এলি?

ঠাকুমার চেহারা একই রকম আছে। বিছানার ওপর ছড়ানো পা দুটো দেখল অনি, বেশ ফোলাফো।চোখে বড় কম দেখি আজকাল, তাই ভাবলাম সত্যি দেখছি তো! কী লম্বা হয়ে গেছিস দাদু, আয় কাছে এসে বোস।

হাত বাড়িয়ে বিছানার একটা ধার দেখিয়ে দিতে অনি সেখানে বসল, কেমন আছ ঠাকুমা?

ওমা, গলার স্বর দ্যাখ, একদম ব্যাটাছেলে-ব্যাটাছেলে লাগছে। তা হ্যাঁ দাদু, এখান থেকে চলে গিয়ে আমাদের এমন করে ভুলে যেতে হয়? ঠাকুমা তার শির-বার-করা হাত অনির গায়ে বোলাতে লাগলেন।

মনটা কেমন হয়ে যাচ্ছিল অনির,আস্তে-আস্তে বলল, তুমি একইরকম আছ।

সে কী! দুরকম হতে যাব কেন? কিন্তু আজকাল একদম হাঁটতে পারি না রে, বাতে পেড়ে ফেলেছে, পা দুটো দ্যাখ, কলাগাছ। কবে যে ছাই যমের কচি হবে। সে-বেটি তো স্বার্থপরের মতো কলা দেখিয়ে চলে গেছে। ঠাকুমার শেষ কথাটা শুনে অনি ওঁর মুখের দিকে তাকাতেই তিনি কেঁদে ফেললেন, গৃহপ্রবেশে যাবার আগে আমায় বলে গেল তোমার ওপর সব দায়িত্ব, এবার দিদি নেই। তা আমি বসে আটখানা কাঁথা সেলাই করে রেখেছিলাম, মাধুর বড় ইচ্ছে ছিল মেয়ে হোক এবার। ড়ুকবে-ওঠা কান্নাটাকে কোনোরকমে সামলে আবার বললেন, তা সেসব কথা আমার কাছে পড়েই রইল। মহীকে এত করে জিজ্ঞাসা করলাম, বাঁচাতে পারলি না কেন? জবাব দেয় না।

মায়ের কথা ঠাকুমা এভাবে বলবেন আন্দাজ করতে পারেনি অনি। এসব কথা শুনেও ওর কান্না পাচ্ছে না কেন আজ? হঠাৎ ঠাকুমা গলা নামিয়ে যেন কোনো গোপন কথা বলছেন এই ভঙ্গিতে বললেন, তোর সত্য বড় ভালো মেয়ে রে! এত লোককে দেখলাম, মেয়ে দেখলে আমি চিনতে পারব না? বেশ মেয়ে, কিন্তু বড় দুখি। তুই ওকে কষ্ট দিস না ভাই।

হাসতে চেষ্টা করল অনি, কী যা-তা বলছ! আমি কষ্ট দিতে যাব কেন?

ঠাকুমা যেন কী বলতে গিয়ে বললেন না। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, তোর দাদু কেমন আছে রে?

অনি দাদুর খবরটা দিতেই মাথা নাড়তে লাগলেন, বুড়ি, এই বয়সে পা ভাঙলে কি আর জোড়া লাগে। দেখেশুনে তো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। তা হ্যাঁ দাদু, তেনার পা সেরে গেলে শিগগির একবার নিয়ে আসতে পারবি?

কেন?

দরকার আছে ভাই। নইলে যে সব ভেসে যাবে। আমি তো বিছানা থেকে উঠতে পারি না, আমার কথা কে শোনে। কিন্তু আমার কানে তো সবই আসে। দাদুভাই, আমাদের সবাইকে ভগবান নিজের নিজের জায়গায় থাকতে দিয়েছেন, আমরা যদি বাড়াবাড়ি করি তবে তিনি সইবেন কেন? তা তুই কিন্তু মনে করে তেনাকে বলিস।

ব্যাপারটা কেমন অস্পষ্ট অথচ কিছু-একটার ইঙ্গিত পাচ্ছে অনি। ও জানে ঠাকুমাকে, এ-বিষয়ে বেশি প্রশ্ন করে লাভ হবে না।

ঠাকুমা হঠাৎ চিৎকার শুরু করেন, ও বউমা, দ্যাখো কে এসেছে! তোমার বন্ধুর ছেলে গো।

সাধারণত চা-বাগানের এইসব কোয়ার্টারের রান্নাঘর একটু দূরে, উঠোন পেরিয়েই বেশি ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সেখান থেকে মহিলাকণ্ঠে সাড়া এল।

অনি বলল, সীতা কোথায়? স্কুলে

সে-মুখপুড়ি গলা ফুলিয়ে বিছানায় কাত হয়ে আছে। যা না, পাশের ঘরে গিয়ে দ্যাখ-না, দুদিনের জলে কী চেহারা হয়েছে।
 
অনি উঠে পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানে দাঁড়িয়েই ও সীতাকে দেখতে পেল। একটা বড় খাটের ঠিক মধ্যখানে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মুখটা ঘামে ভরতি। চোখ দুটো বোজা-অঘোরে ঘুমুচ্ছে। শব্দ না করে পাশে এসে দাঁড়ালানি। বোধহয় জ্বর ছাড়ছে ওর, বালিশ অবধি ঘামে ভিজে গেছে। ঘুমালে মানুষের মুখ কেমন আদুরে-আদুরে হয়ে যায়।

ডাকতে মায়া হল অনির, ফিরে যাবে বলে মুরতেই ও সীতার মাকে দেখতে পেল। রান্না করতে করতে বোধহয় ছুটে এসেছেন, ও মা, অনি কখন এলি? দেখেছেন মা, কী লম্বা হয়ে গেছে।

ঠাকুমা বললেন, ওদের গুষ্টির ধাত লম্বা হওয়া।

এই তো আজ সকালে। অনি হাসল।

তোর নাকি এত পড়ার চাপ যে আসবার সময় পাস না? সীতার মা বললেন।

অনি বলল, কে বলল?

তোর নতুন মা। কথাটা বলেই দ্র মহিলা চট করে শাশুড়ির দিকে তাকালেন। তারপর বলে উঠলেন, দড়িয়ে কেন, বোস। আজকে নাড় বানিয়েছি, খেয়ে যা। ছেলেবেলায় ও নাড় খেতে ভালোবাসত, না মা?

ঠাকুমা হাসলেন, একবার হেমের ঠাকুরঘরের নাড় চুরি করে খেয়েছিল বলে দশবার ওঠ-বোস করেছিল।

অনি বলল, আজ থাক ঠাকুমা। আমি এইমাত্র খেয়ে আসছি।

ঠাকুমা বললেন, পাক মানে? এ-বাড়ি থেকে না খেয়ে যাবি বড় হয়ে গেছিস বুঝি! আর ওমেয়েটা যদি ঘুম থেকে উঠে শোনে যে তুই এসে না কথা বলে চলে গেছিস তা হলে আমাকে আস্ত রাখবে?

সীতার মা বললেন, তুমি ওকে ডেকে তোলো, অবেলায় ঘুমোচ্ছে। আমি তোমার নাড় নিয়ে আসছি। রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি।

অনি আবার সীতার দিকে ফিরে তাকাল। ঠোঁটটা ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকায় সাদা দাঁত চিকচিক করছে। মুক্তোর মতো ঘামের ফোঁটা কপালময়, গলায় ছড়ানো। রুক্ষ একরাশ চুপ কেঁপে ফুলে বালিশটাকে অন্ধকার করে রেখেছে। হঠাৎ অনির খুব অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল। ও ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ঠাকুমা পাশের ঘরের খাটে বসে খোলা দরজা দিয়ে তাকে দেখছেন। চোখাচোখি হতে হেসে বললেন, কী, কী হল, চেঁচির ডাক। মেয়েটা একটু কালা আছে।

হঠাৎ অনির মনে পড়ল ছেলেবেলায় সীতা কানে একটু কম শুনত। ও এবার ঝুঁকে পড়ে চেঁচিয়ে ডাকল, সীতা সীতা।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে যে-অস্বচ্ছতা থাকে সেটা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল সীতার। মুখের সামনে একটি অনভ্যস্ত মুখ দেখতে পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

একটু সময় উঠতে দিয়ে অনি বলল, খুব ভয় পেয়ে গেছিস, না।

খুব দ্রুত খাটের উপর বাবু হয়ে বসে গায়ের চাদরটা শরীরে জড়িয়ে নিতে নিতে সীতা হাসতে চেষ্টা করল, দুর্বলতার হাসিটা সচ্ছল হল না, শেষ পর্যন্ত আমাদের মনে পড়ল?

জবাব দিতে গিয়ে কথা আটকে গেল অনির। সীতা কেমন বড়দের মতো কথা বলছে। এখন ও বসে আছে গায়ে চাদর জড়িয়ে, কিন্তু তবু কেমন বড় বড় দেখাচ্ছে। যুতসই উত্তর খুঁজে না পেয়ে সামান্য হাসল অনি, জ্বর বাধিয়ে বসে আছিস?

এই একটু। কখন আসা হল? সীতার বোধহয় অস্বস্তি হচ্ছিল, খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।

অনি বলল, সকালে। তুই শো, উঠলি কেন?

সারাক্ষণ তো শুয়ে আছি। তা নিজের থেকে আমাদের বাড়িতে আসা হয়েছে, না ঠাকুমা ডাকল? সীতা চোখ বড় বড় করল।

এখন এই মুহূর্তে সত্যি কথাটা বলতে অনির ইচ্ছে করছিল না। ওকে ইতস্তত করতে দেখে সীতা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠাকুমা, তুমি ওকে ডেকেছ, না?

বুড়ি প্রথমে ঠাওর না করতে পারলেও শেষে বললেন, ও আসব-আসব করছি আর আমিও ডেকে ফেললাম, কেন, কী হয়েছে।

সীতা বলল, জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়ে তো, আমাদের এখানে আসা মানায় না।

ঠাকুমা হেসে বললেন, পাগলি!

অনি ঘাড় নাড়ল, ঠিক ঠিক। এখনও বাচ্চা আছিস তুই।

চোখের কোণে তাকাল সীতা, তাই নাকি? এখনও হাফপ্যান্ট পরা হয় কিন্তু!
 
অনি চট করে জিভটা সামলে নিল। ও সীতাকে বলতে পারত যে, সে-ও ফ্রক পরে, কিন্তু ক্রমশ টের পাচ্ছিল সীতা যেন ওর চেয়ে অনেক বেশি বুঝে কথা বলে। সেই ছেলেবেলার সীতা যে কিনা শক্ত হাতে হাত ধরলে কেঁদে ফেলত, সে কেমন করে কথা বলছে দ্যাখো।

প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল অনি, বিশু বাপীদের খবর কী রে?

পিঠের ফুলে-থাকা ডানগোছের চুলটাকে সামনে এনে সীতা আঙুলে তার ডগা জড়াতে জড়াতে বলল, বিও তো কুচবিহারে জেঙ্কিংস স্কুলে পড়ছে। চিঠি লেখালেখি পর্যন্ত হয় না?

ঘাড় নাড় অনি, না।

চমকার! আমি ভাবলাম শুধু আমিই বঞ্চিত। আর বাপীর কথা না-বলাই ভালো। অন্যের কাছে শুনলেই হয়। সীতা গভীরমুখে বলে আবার খাটে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। বোধহয় দাঁড়াতে ওর কষ্ট হচ্ছিল।

কেন, কী হয়েছে ওর?

খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে বাপী। মেয়েদের টিটকিরি দেয়, সাইকেল নিয়ে পেছন পেছন ঘোরে। রাজারহাট স্কুলে ভরতি হয়েছিল, যায়ই না। মুখ বাঁকাল সীতা।

তোকে কিছু বলেছে। বাপীর চেহারাটা ও এই বর্ণনার সঙ্গে মেলাতে পারছিল না।

ইস, অত সাহস আছে। একদিন রাস্তায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিস-এই সীতা, রাবণ এলে খবর দিল, কী অসভ্য ছেলে!

আমি খুব চ্যাঁচামেচি করে উঠতে ও পালিয়ে গেল। যাবার আগে কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বলে গেল, তুই আমাদের সেই সীঅতো রে, বড় হয়ে গেলে তোরা সব কেমন হয়ে যাস। ও চলে গেলে দম ফেলে বাচি বাবা। সীতা বুকে হাত রাখল, জানি না, আমার সামনে যিনি আছেন তিনি শহরে এসব করেন কি না! দেখে তো মনে হয় খুব শান্তশিষ্ট।

হঠাৎ অনি আবিষ্কার করল যে, সীতা ওকে এতক্ষণ ধরে তুই বা তুমি কোনেটাই বলছে না। এভাবে সম্বোধন না করে কথা বলা খুব সহজ নয়, কিন্তু সীতা বেশ অবলীলায় তা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই সময় সীতার মা এক ডিশ খাবার-হাতে ঘরে এলেন। অনি দেখল, তিল আঁর নারকেলের নাড় তে ডিশটা সাজানো, সন্দেশও আছে।

সীতার মা বললেন, নাও, খেয়ে নাও। তুমি যা ভালোবাস তা-ই দিলাম।

খাবার দেখে আঁতকে উঠল অনি, এখনও পেট ভরাট, এত খেতে পারব না।

সীতা হঠাৎ হেসে উঠল শব্দ করে, ও ঠাকুমা, শুনছ, তোমার নাড় গোপাল বলছে খেতে পারবে, শহরের জল পেটে পড়লে সব পালটে যায়।

অনি একটু ধমকের গলায় বলল, খুব পাকা-পাকা কথা বলছিস তুই।

সীতার মা বললেন, ঠিক বলেছ তুমি। ভীষণ অসভ্য মেয়ে। ভাবছি এবার ওকে এখানকার স্কুল থেকে ছাড়িয়ে জলপাইগুড়িতে তপুদের স্কুলে পাঠিয়ে দেব। হোস্টেল আছে, বেশ হবে তখন।

পাশের ঘরে খাটের ওপর বসে ঠাকুমা বললেন, মেয়ে হয়েছে যখন, তখন পরের ঘরের তো যাবেই একদিন, এখন থেকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর কী দরকার?

সীতার মা বললেন, না, এখানে ওর পড়াশুনা হচ্ছে না।

ঠাকুমা বললেন, জন্মেছে তো হাঁড়িবুনতি ঠেলতে-বিদ্যে নিয়েও তো সেই একই গতি। মেয়েকে পড়াশুনা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে দেবো

চট করে কথাটার জবাব দিলেন না সীতার মা, যা-ই বলুন,শহরের ভালো স্কুলে পড়লে চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়। এই দেখুন আমাদের অনিকে, এখানকার ছেলেদের চেয়ে কত আলাদা, দেখলেই বোঝা যায়।

সীতা ফুট কাটল, নড় গোপাল-নাড় গোপাল!

সীতার মা মেয়েকে ধমক দিলেন।
 
অনি যতটা পারে খেল, তারপর খানিকক্ষণ গল্প করে চলে আসার জন্য উঠল। ঠাকুমা আবার দাদুকে বলার জন্য অনিকে মনে করিয়ে দিলেন। বাইরে এখন রোদ নেই বলা যায়। একটা বিরাট মেঘ ভুটানের পাহাড় তেকে ভেসে এসে এই স্বৰ্গছেঁড়ার ওপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাই চারধার কেমন ছায়া-ছায়া।

সীতা বাইরের দরজা অবধি হেঁটে এসে জিজ্ঞাসা করল, কবে যাওয়া হবে?

অনি বলল, বোধহয় কাল।

কেমন উদাস গলায় সীতা বলল, আজ বিকেলে কি বাপীর সঙ্গে আড্ডা মারা হচ্ছে?

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল অনি, কেন?

এখানে এলেই হয়। সীতা দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর গায়ে এখন চাদর নেই। জুর না থাকলেও তার ছাপটা মুখে স্পষ্ট। ওর শরীর এবং পায়ের দিকে তাকাতেই অনির মনে হল-সীতা খুব বড় হয়ে গেছে। সেই কামিনটার মতো সীতার শরীর এখন। চাহনিটা দেখে বোধহয় সীতা সোজা হয়ে দাঁড়াল, বিকেলে না এলে আর কথা বলব না। অসভ্য! বলে সীতা দ্রুতপায়ে ভেতরে চলে গেল।

হঠাৎ অনির বুকের ভিতর কী যেন কেমন করে উঠল। সীতাকে আর-একবার দেখার জন্য মুখ ফিরিয়ে ও দেখল জানলায় বসে ঠাকুমা ওর দিকে চেয়ে আছেন।

বাগানের এলাকা আসাম রোড ধরে বাজারের দিকে হাঁটতে বেশ অবাক হয়ে গেল অনি। দুপাশে এত দোকানপাট হয়ে গেছে যে, জায়গাটাতে চেনাই যায় না। আগে যেসব জায়গায় শুধু হাটবারে ত্রিপল টাঙিয়ে দোকান বসত সেখানে বেশ মজবুত কাঠোর দোকানঘর দেখতে পেল সে। দোকানদারের অধিকাংশই অচেনা, বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে প্রচুর লোক স্বৰ্গছেঁড়ায় এসে স্থায়ী আস্তানা গেড়ে বসেছে। শুয়োরকাটার মাঠটা ছাড়িয়ে আগে নদী, ওপারের ধানক্ষেত স্পষ্ট দেখা যেত, এখন সব আড়ালে পড়ে গিয়েছে।

বিলাসের মিষ্টির দোকানটা বেশ বড় হয়েছে যেন, নতুন শো-কেসের মধ্যে মিষ্টির ডালাগুলো দূর থেকে দেখা যায়। বিলাসকে কাছেপিঠে দেখল না সে। আঙরাভাসা নদীর পুলটার ওপরে এসে দাঁড়াল অনি। নিচে লকগেটের তলা দিয়ে সেইরকম জল প্রচণ্ড স্রোতে ফেনা ছড়িয়ে বয়ে যাচ্ছে ওদের কোয়ার্টারের পিছনদিক দিয়ে ফ্যাক্টরির হুইল ঘোরাতে। অনির মনে পড়ল বাপী একবার বলেছিল, এখান থেকে সাঁতরে বাড়িল পেছন অবধি যাবে, আর যাওয়া হয়নি। বাপীটা এরকম হয়ে গেল কী করে? মেয়েদের টিটকিরি দিলে কী লাভ হয়? বরং সীতার মতো মেয়েরা তো চ্যাঁচামেচি করবে। তা ছাড়া খামোক টিটকিরি দেবেই-বা কেন?

ভরত হাজামের দোকানটা নেই। সেখানে এখন বেশ বড়সড় সেলুন হয়েছে, ওপরে সাইনবোর্ডে নাম পড়ল অনি, কেশচর্চা। রাস্তা থেকেই ভেতরের বড় বড় আয়না, চেয়ার দেখা যায়। বুকে সাদাকাপড় বেঁধে তিনজন লোক চুল কাটছে খদ্দেরের। সেই ল্যাংডা কুকুর বা বরত হাজাম, কাউকে কাছেপিঠে চোখে পড়ল না। নাচ বুড়িয়া নাচ, কান্ধে পর নাচ-অনি হেসে ফেলল।
 
চৌমাথায় এসে অনির চমক আরও বেড়ে গেল। স্বৰ্গছেঁড়া যেন রাতারাতি শহর হয়ে গেছে। পুরো চৌমাথা ঘিরে পান-সিগারেট, রেস্টুরেন্ট আর স্টেশনারি দোকানে ছেয়ে গেছে। ওপাশের পেট্রলপাম্পের গায়ে অনেক নতুন নতুন সাইনবোর্ড ঝুলছে। সকাল-পেরিয়ে-যাওয়া এই সময়টায় আগে স্বৰ্গছেঁড়ার রাস্তায় লোকজন থাকত না বললেই চলে, এখন জলপাইগুড়ির মতো জমজমাট হয়ে আছে। এমন সময় কুচবিহার-জলপাইগুড়ি রুটের একটা বাস এসে স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াতে অনি সেদিকে তাকাল। দুতিনজন কুলি মাল বইবার জন্য ছুটে গেল সেদিকে। তাদের একজনের দিকে নজর পড়তে অনি সোজা হয়ে দাঁড়াল, ঝাড়িকাকু। হাফপ্যান্ট আর ময়লা একটা ফতুয়ামাতন পরে বাসের মাথার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, স্বৰ্গছেঁড়ায় এখন কেউ মালপত্র নিয়ে নামল না। অনির মনে। হচ্ছিল, ও ভুল দেখছে। সেই ঝাড়িকাকু এখন কুলিগিরি করছে! ভিড়টা একটু হালকা হতে ঝাড়িকাকু ঘুরে দাঁড়াতে রাস্তার এপাশে দাঁড়ানো অনির সঙ্গে চোখাচোখি হল। অনি দেখল, পথমে যেন চিনতে পারেনি চট করে। তারপর হঠাৎ ঝাড়িকাকুর চেহারাটা একদম অন্যরকম গেল। যেন অনিকে দেখেনি এমন ভান করে দ্রুত পা চালিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে চাইল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনি আর দেরি করল না। পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল, ও ঝাড়িকাকু, ঝাড়িকাকু।

কয়েক পা হেঁটে বোধহয় আর এড়াতে পারল না, ঝাড়িকাকু দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল অনি, আরে, তুমি আমাকে দেখেও চলে চ্ছিলে কেন? ঝাড়িকাকুর একটা হাত ধরল সে। খুব বুড়িয়ে গেছে ঝাড়িকাকু। মুখে কাঁচাপাকা খোচা-খোচা দাড়ি। গাল থরথর করে কাঁপছে। তার পরই মুখ বিকৃত করে অতবড় মানুষটা একটা কান্না চাপবার চেষ্টা করে যেতে লাগল প্রাণপণে। কারও চোখে জল দেখলেই অনির চোখ কেমন করে উঠে, এই, তুমি কাঁদছ কেন?

এবার হাউমাউ করে উঠল ঝাড়িকাকু, তোর বাবা আমাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে রে, এই একটুখানি দেখেছি যে-মহীকে সে আমাকে দূর করে দিল।

এরকম একটা দৃশ্য প্রকাশ্য চৌমাথায় ঘটতে দেখে মুহূর্তেই বেশ ভিড় জমে গেল। দুতিনজন কুলিগোছের লোক ঝাড়িকাকুকে বারংবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কী হয়েছে। কোন শালা মেরেছে? ঝাড়িকাকু কারও কথার জবাব দিচ্ছিল না বটে, কিন্তু অনির খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সবাই তার দিকে সন্দেহের চোখে ও তাকাচ্ছে এটা বুঝতে পারছিল সে। যারা অনিকে চিনতে পারছে তারা কেউ-কেউ বলতে লাগল, নিজের হাতে মানুষ করেছে-এ বাবা নাড়ির বাধনের চেয়ে বেশি। ভিড়টা যখন বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে, এমন সময় দু-তিনটে সাইকেল খুব জোরে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে ওদের পাশে এসে ব্রেক কষে দাঁড়াল। কী খেলা হচ্ছে, পকেটমার নাকি গলাটা খুব চেনা-চেনা মনে হল অনির, সামনে মানুষের আড়াল থাকায় দেখতে পাচ্ছিল না। আর দুজন কী-একটা বলে এগিয়ে আসতেই ভিড়টা চট করে হালকা হয়ে গেল। অনি দেখল, একটা লম্বাটে ছেলে এসে ওদের দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠল, ক্রাইং কেস!

সে আবার কী! ওপাশে সাইকেলে ভর দিয়ে কথাটা যে বলল তাকে এবার দেখতে পেল অনি। চোখাচোখি হলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর অনি কিছু বোঝার আগেই বাপী তীরের মতো ছুটো এসে জড়িয়ে ধরল। ঝনঝন করে একটা সাইকেলকে মাটিতে পড়ে যেতে শুনল সে। সেদিকে কান না দিয়ে বাপী ততক্ষণ একনাগাড়ে কীসব বলে গিয়ে শেষ করল, গুড বয় হয়ে শেষ করল, গুড বয় হয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে ভুলে গেলি, অনি?

ভীষণ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল অনি, না, ভুলব কেন? তুইও তো আমাকে চিঠি দিস না?

বাপী বলল, ভেবেছিলাম দেব, কিন্তু এত বানান ভুল হয়ে যায় না যে লজ্জা করে। আমি-না খুব খারাপ হয়ে গেছি, সবাই বলে।

কেন? খারাপ হতে যাবি কেন? অনির কেমন কষ্ট হচ্ছিল।

দূর শালা, তা আমি জানি নাকি! এই শোন, আমি এখন বীরপাড়ায় যাচ্ছি, একটা ঝামেলা হয়েছে, সামলাতে হবে। বিকেলবেলায় দেখা হবে, হ্যাঁ? অনি ঘাড় নাড়তেই বাপী দৌড়ে সাইকেলটাকে মাটি থেকে তুলে লাফিয়ে সিটে উঠল। অনি দেখল ওর দুই সঙ্গীকে নিয়ে তিনটে সাইকেল দ্রুত বীরপাড়ার দিকে চলে গেল।
 
বোধহয় অন্য একটা ঘটনা সামনে ঘটে যাওয়ায় ঝাড়িকাকু সামলে নিয়েছিল এরই মধ্যে। বাপীরা চলে গেলে কয়েকজন দূর থেকে ওদের দেখতে লাগল, কিন্তু আগের মতো কাছে এসে ভিড় করল না। অনি দেখল লঙ্কাপাড়া থেকে একটা প্রাইভেট বাস এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই কুলিরা সেদিকে ছুটে গেল। ঝাড়িকাকু একবারও বাসটার দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কখন এলি? কর্তাবাবু কেমন আছে?

সকালে। দাদুর পা ভেঙে গেছে কাল, এমনিতে ভালো আছে।

সে কী! পা ভাঙল কেন? এই বুড়ো বয়সে-পড়ে গিয়েছিল?

না, রিকশায় ধাক্কা লেগেছিল।

শুনে ঝাড়িকাকু জিভ দিয়ে কেমন একটা চুক চুক শব্দ করল।

দিদি কেমন আছো ভালো।

কিন্তু তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো নেই রে! ঝাড়িকাকু ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগল স্কুলের রাস্তায়।

যদিও শরীর দেখেই বোঝা যায় তবু অনি জিজ্ঞাসা করল, কেন?

আমার যে কেউ নেই রে! ঝাড়িকাকু ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগল স্কুলের রাস্তায়।

যদিও শরীর দেখেই বোঝা যায় তবু অনি জিজ্ঞাসা করল, কেন?

আমার যে কেউ নেই রে, একা কি ভালো থাকা যায়! অনি কথাটা শুনে ঝাড়িকাকুর হাতটা চট করে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল। ঝাড়িকাকু বলল, তুই আমার সঙ্গে হাঁটছিস দেখলে মহী রাগ করবে।

কেন, রাগ করবে কেন? তুমি কি আমার পর?

তুই যে কবে বড় হবি!

আমি তো বড় হয়েছি, তোমার চেয়ে লম্বা!

এই বড় নয়-যে-বড় হলে মহীর মতো আমাকে চড় মারা যায়!

কেন আমাকে মেরেছিল বাবা? কী করেছিলে তুমি?

কী হবে সেকথা শুনে! হাজার হোক মহী তোর বাবা, বাবার নিন্দে কোনো ছেলের শুনতে নেই। মুখ ঘুরিয়ে নিল ঝাড়িকাকু।

তবু অনি জেদ ধরল, মা বলত সত্যি কথা বললে শুনলে কোনো পাপ হয় না।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ঝাড়িকাকু, মা! তোর মায়ের কথা মনে আছে?

অবাক হয়ে গেল অনি, কেন থাকবে না! সব মনে আছে।

আমি খবরটা শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। এই সেদিন কর্তাবাবু মহীকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলেন তোর মাকে। তারপর তুই হলি-কী যে হয়ে যায় সব! তোর মা চলে গেলে মহীটা একদম ভেঙে পড়েছিল। তখন রোজ রাত্রে ওর ঘরে শুতাম আমি। এক শুলেই কান্নাকাটি করত। ওর খাটের পাশে মাটিতে শুয়ে আমি শুধু তোর মায়ের কথা ছাড়া সব গল্প করতাম। ঝাড়িকাকু কথা থামিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল।

এসব খবর অনির জানা নেই। ঝাড়িকাকু কোনোরকমে তখন বাবাকে রান্না করে খাওয়াচ্ছে-এই খবরটাই শুনেছিল শুধু। তাই বাকিটা শোনার জন্য বলল, তারপর?

বাঁ হাতের ডানায় চট করে মুখটা ঘষে নিয়ে ঝাড়িকাকু বলল, তারপর যখন মহীর আবার বিয়ের কথা উঠল তখন ও কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আমারও পছন্দ ছিল না। কিন্তু অন্য বাবুরা বুঝিয়েসুঝিয়ে ওর মত করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। হঠাৎ ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝাড়িকাকু বলল, তোর মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

হেসে ফেলল অনি, বা রে! কেন হবে না।

ঝাড়িকাকু বলল, বড় ভালো মেয়ে রে। বিয়ের পর বছর তিনেক তো বেশ ভালো সবই। আমি ভাবতাম, যাক, এই ভালো হল। তোর মায়ের অভাব টের পেতে দিত না মেয়েটা। এমনকি আমার সঙ্গে থেকে গোরুর কাজও শিখে নিয়েছিল। যে গেছে তার জন্যে মানুষ কতদিন দুঃখ করতে পারে! কিন্তু এই মেয়েটা রাতারাতি যেন এই বাড়ির লোক হয়ে গেল।

আরে! তুমি আমাদের বড়বাবুর নাতি না।

অনি মুখ ঘুরিয়ে দেখল, একজন বৃদ্ধমতন লোক ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। মাথা নাড়ল অনি, হ্যাঁ।
 
বড়বাবু কেমন আছেন? বৃদ্ধ যেখানে দাঁড়িয়ে তার পিছনে বিরাট স-মিল। অনি এতক্ষণ চিনতে পারল। ওঁর নাম হারাণচন্দ্র পাল। খুব বড়লোক। দু-তিনটে স-মিল আছে, বাস-ফাস, জমি-টমি আছে। দাদুর কাছে শুনছে অনি, একদম ছোটবেলায় ইনি স্বৰ্গহেঁড়ায় এসে মুড়ি বিক্রি করতেন। পা ভাঙার কথাটা বলতে গিয়েও ঘাড় নাড়ল অনি। ক্লাসে সংস্কৃতের স্যার পড়া জিজ্ঞাসা করলে মন্ট এইরকমভাবে ঘাড় নাড়ে। হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হয়। ভালো, ভালো। তুমি তো বড় হয়ে গেছ হে। কিন্তু এত রোগা কেন? তালপাতার সেপাই! আরে দেশ গড়তে গেলে স্বাস্থ্য ভালো চাই। সেই পনেরোই আগস্ট সকালে ফ্লাগ তুলেছিলে তুমি যতই বড় হও, দেখেই চিনেছি। হেঁ হেঁ। বেশ বেশ। বৃদ্ধ হাসিহাসি মুখ করে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দেখে ওরা আবার হাঁটতে লাগল। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের কথাটা বৃদ্ধ বলতেই ওর বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। স্বৰ্গছেঁড়ায় অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করে রেখেছে তার কথা। বৃদ্ধ বলতেই ওর বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। স্বৰ্গছেঁড়ায় অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করে রেখেছে তার কথা। উঃ, ফ্লাগটা কী দারুণ উড়েছিল।

ভবানীমাস্টারের মধুটা মনে পড়তেই ও দেখা করার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল। ঝাড়িকাকু চুপচাপ কিছু ভাবছিল। ও বলল চলো, স্কুলে যেতে-যেতে সব শুনব।

কেন, স্কুলে কী হবে ঝাড়িকাকু ব্যাপারটা পছন্দ করল না।

ভবানীমাস্টারকে দেখে আসি।

কাকে?

ভবানীমাস্টার। আমাদের পড়াত না? ভবানীমাস্টার, নতুন দিদিমণি!

ও। সে-স্কুলে তো উঠে গিয়েছে মরাঘাটে। আর বানীমাস্টারের খুব অসুখ, বাঁচবে না।

কী হয়েছে অনি সেই মুখ মনে করতে চেয়ে স্পষ্ট দেখে ফেলল।

শরীর নাকি অবশ হয়ে গেছে। কলোনিতে আছে, আমি দেখিনি।

একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা-বোধ অনিমেষকে ঘিরে ধরল আচমকা। এইসব মানুষ এবং এই পরিচিত জায়গাটা যদি এমনি করে তার চেহারা পালটে একদম অচেনা হয়ে যায় তা হলে কী করবে!

অনি জিজ্ঞাসা করল, কলোনিতে কোথায় অনি আছেন তুমি জান?

ঝাড়িকাকু ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, কেন?

আমি যাব। তুমিচলো আমার সঙ্গে, খুঁজে নেব। অনি জোর করে ঝাড়িকাকুর হাত ধরে কলোনির দিকে হাঁটতে লাগল। দুপাশে কাঁচা কাঠের গন্ধ বেরুচ্ছে। স.মিলগুলো থেকে একটানা করাত চালাবার শব্দ হচ্ছে। একটা ট্রাক্টর চজা-পাতা-বোঝাই ক্যারিয়রকে টেনে নিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে চলে গেল।

অনি পুরনো কথার যেই ধরে জিজ্ঞাসা করল, তারপর কী হল? বাবা তোমাকে মারল কেন?

ঝাড়িকাকু বলল, এসব কথা থাক।

তুমি বারবার থাক বোলো না তো! অনি প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠল।

ঝাড়িকাকু বিব্রত হয়ে ওর দিকে তাকাল। এই ছোট্ট মানুষটা খুব দ্বিধায় পড়েছে বোঝা যাচ্ছিল। তারপর যেন বাধ্য হয়ে বলল, তোর নতুন মাকে নিয়ে তোর বাবা মাঝে-মাঝে কুচবিহার যেত ডাক্তারের কাছে। শেষে একদিন দুজনের মাঝে কী ঝগড়া। মেয়েটাকে সেইদিন প্রথম কথা বলতে দেখলাম। লোকে বলে, মহী নাকি বাচ্চা-বাচ্চা করে খেপে গিয়েছিল। থাক, তুই এসব কথা শুনিস না–

আঃ! বলো মদ খেতে লাগল। প্রথমে লুকিয়ে লুকিয়ে খেত। কোথা থেকে ও একজন লোককে ধরে এনেছিল যে নাকি সামনে বসে ভূত নামাতে পারে। রোজ রাত্রে দরজা বন্ধ করে ওরা নাকি তোর মাঝে নামাত। একদিন তোর মায়ের একটা ছবি বিরাট করে বাঁধিয়ে নিয়ে এসে খুব ধূপধুনো দিতে লাগল-দরজা বন্ধ করে দিল। নাকি ও তোর মায়ের সঙ্গে ওখানে কেমন চুপচাপ হয়ে যেতে লাগল। একদিন ঘরে ঝাট দিতে গিয়ে আমি জানালাটা খুলেছিলাম, সে সময় ও মদ খেয়ে বাড়ি ফিরল। জানলা খোলা দেখে কী হম্বিতম্বি, আমি আর পারলাম না, বললাম, এরকম করলে আমি কর্তাবাবুকে সব বলে দেব। এই শুনে ও আমাকে মারতে লাগল। বলল, চাকর চাকরের মতো থাকবি। একে মাতাল, তারপর ইদানীং ওর মাথার ঠিক নেই, আমি চুপচাপ মার খেতে লাগলাম। তাই দেখে নতুন বউ ছুটে এসে ওকে ধরতে মহী বলল, ও, খুব দরদ! এই মুহূর্তে তুই বেরিয়ে যা। আমি চলে এলাম।

আসার সময় কিছু বলল না।

তোর নতুন মা আমাকে অনেক করে বলেছিল, ক্ষমা চেয়েছিল মহীর হয়ে। কিন্তু যে-বাড়িতে সারাজীবন কাটিয়ে এলাম নিজের দিকে না তাকিয়ে, সেই বাড়ির ছেলে চ মারলে আর থাকা যায়। কর্তাবাবু যাওয়ার সময় আমার সব মাইনের টাকা মহর কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা আর ফেরত নিইনি। চলে আসার সময় ও মনে দেয়নি। যদি কোনোদিন ইচ্ছে হয় তো দেবে, আমি চাই না।

কেন চাইবে না, তোমার নিজের টাকা না? শক্ত হয়ে গিয়েছিল অনি এসব কথা শুনে। ছোটমায়ের মুখের কাটা দাগটা যে কোত্থেকে এল এতক্ষণে বুঝতে অর অসুবিধে হচ্ছে না। অনি দেখল ও বাবার ওপর রাগতে পারছে না। অত নিরাসক্ত হয়ে বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। বাবা যেন ওর কষ্ট হতে লাগল। বাবা যখন বিয়ে করেছিল তখনও ওর কিছু মনে হয়নি, এখনও হল না। শুধু ওর মনে হল, ও-বাড়িতে দুজন খুব কষ্ট পাচ্ছে, একজন ছোটমা আর একজন যাকে ছবিতে পুরে দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

অনি আবার প্রশ্নটা করতে ঝাড়িকাকু বলল, সবসময় কি চাওয়া যায়। টাকা চাইলেই তো ও চাকর বরে দিয়ে দিত। ও নিজে থেকেই দেবে।

দাদুকে বললে না কেন? তুমি তো জলপাইগুড়িতে যেতে পারতে!

লজ্জা করছিল। তা ছাড়া এসব শুনলে কর্তাবার কষ্ট পাবে। তাই একজনকে দিয়ে কাল খবর পাঠিয়েছিলাম যে দেখা হলে বলতে মহীর খুব অসুখ। এ-বাড়ির ছেলে হয়ে মদ খায় কী করে? বড়দা যে ত্যাজ্যপুত্র হয়েছে ভুলে গেল! আর মহীর মতো শান্ত ছেলে, আ! নিশ্চয় ভূতে পেয়েছে ওকে। এরকম হলে বাগানের কাজ থাকবে না ওর! লোকে বলছে ওর নাকি মাথার ঠিক নেই। আমি তো আর যাই না যে দেখব!

অনি ঝাড়িকাকুর দিকে তাকাল। দাদুকে গিয়ে সব কথা বলতে হবে। শুনলে নিশ্চয়ই দাদু বাবাকে ত্যজ্যপুত্র করে দেবেন। কিন্তু তা হলে ছোটমায়ের কী হবে? কী করা যায় বুঝতে পারছিল না অনি। বাবাকে কি ভূতে পেয়েছে। বন্ধ জানলা-দরজার অন্ধকার ঘরে বসে যদি মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে, তবে তো সে মায়ের ভূত! কথাটা মনে হতেই ও হেসে ফেলল। মা কখনো ভূত হতে পারে না। ওসব বুজরুকি। ও ঠিক করল ব্যাপারটা কী আজ রাত্রে দেখবে।
 
কলোনির মুখটাতে এসে ঝাড়িকাকু কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল ভবানীমাস্টার কোথায় থাকেন। আগে স্বৰ্গছেঁড়ার এই অঞ্চলটায় লোকবসতি ছিল না। ওপাশে হিন্দুপাড়ায় কুলিলাইনটা অবশ্য ছিল, কিন্তু সে বানারহাটের রাস্তায়। এদিকটায় খুটিমরি ফরেস্টের গা-ঘেঁষে স্বৰ্গছেঁড়া টি এস্টেটের অন্য প্রান্ত। খাসমহলের জায়গাগুলো তখন আগাছা জঙ্গলে প্রতি ছিল। সাতচল্লিশ সালের পর ওপারের মানুষেরা এপারে আসতে শুরু করলে এইসব জায়গার চেহারা পালটে গেল রাতারাতি। অনি এই প্রথম এমন একটা জায়গায় এল যাকে কালোনি বলে। কলোনি শব্দটা এর আগে ও শোনেনি। ভেতরে ঢুকে ও দেখল সরু রাস্তার দুপাশে কাঠ আর টিনের ছোট ছোট বাড়ি, এর উঠোনের গায়ে ওর শোওয়ার ঘর। সদর অন্দর কিছু নেই। বোঝাই যায় যারা এসেছেন তারা বাধ্য হয়ে এখানে আছেন।

ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ির গায়ে আলকাতরা বোলানো, দরজা বন্ধ, ওরা জানল এখানেই ভবানীমাস্টার থাকেন। একটা ভাঙা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওরা দরজার গায়ে এসে দেখল একটা মাকুকুর তার তিন-চারটে বাচ্চাকে চোখ বুজে শুয়ে বুকের দুধ খায়াচ্ছে। বোধহয় এ-সময় কারও আসার কথা নয় বলে সে খুব বিরক্ত হয়ে দুবার ডাকল। বন্ধ দরজায় শব্দ করতেই ভেতরে কেউ খুব আস্তে কিছু বলর। কয়েকটা বাচ্চা ওদের দেখছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তাদের একজন বলল, দরজার খোলাই আছে, জোরে ঠেললেই খুলে যাবে। সত্যি দরজাটা খোলাই ছিল। অনি ভেতরে ঢুকেই ভবানীমাস্টারকে দেখতে পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে অতিকষ্টে দরজার দিকে ঠিকরে-বেরনো দুটো চোখে যিনি তাকিয়ে আছে তাকে দেখে পাথর হয়ে গেল অনি। সমস্ত শরীর বিছানার সঙ্গে ল্যাপটানো, বিছানাটা অপরিষ্কার। মাথার পেছনে জানলাটা খোলা।

কে? সামনে এসো–অদ্ভুত একটা শব্দ গলা থেকে। বুঝতে কষ্ট হয়।

অনি পায়ে পায়ে ভবানীমাস্টারের সামনে এল। ঝাড়িকাকু ঢুকল না ঘরে। অনি দেখল দুটো চোখ ক্রমশ তার মুখের ওপর স্থির হল এবং সেই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

মাস্টারমশাইয়ের শরীর শুকিয়ে চিমসে হয়ে গেছে, কিন্তু মুখোনা প্রায় একই রকম আছে। যদিও কাঁচাপাকা দাড়িতে সমস্ত মুখ ঢাকা, তবু চিনতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ বেরুল গলা থেকে, অ-নি-মে-ষ!

তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়ল অনি, হ্যাঁ। ঘরঘড় শব্দটা উচ্চারণের অনেকটা ঢেকে দিচ্ছিল। কথা বললে হয়তো কষ্ট বেড়ে যাবে, অনি বলল, কথা বলবেন না।

ভবানীমাস্টার হাসলেন, প্যা-রা-লা-ইসিস।

এমন সময় বাইরের থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল, কে আইছে শুনলাম, দুদিন পরেই তো মরব, এখন আইয়া কামটা কী? অ, আপনারা আইছেন, উনার কেউ হন নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়িকাকুর গলা শুনল অনি, না না। মাস্টারের ছাত্র এসেছে।

উত্তরে সেই মহিলাকণ্ঠ বিরক্ত হল, এখন আর পড়াতেই পারব নাকি উনি। উনি যাইলে আমার পরান জুড়ায়, আর পারি না।

ভবানীমাস্টার বললেন, তো-তো-মার মানে আছে পতাকা তুলেছিলে?

অনি বলল, হ্যাঁ। আপনার সব কথা মনে আছে আমার।

বড় হও বাবা, বড় হও! কথাটা বলতে বলতে চোখের কোল বেয়ে একটা সরু জলের ধারা। বেরিয়ে এসে কানের দিকে চলে গেল। অনি আর দাঁড়াতে পারছিল না। শায়িত মানুষকে প্রণাম করতে নেই। ও চট করে এগিয়ে গিয়ে হাতের চেটো দিয়ে ভবানীমাস্টারের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে দৌড়ে বাইরে চলে এল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top