What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

হেমলতা প্লেট সাজিয়ে বসে ছিলেন। তিলের নাড়, নারকেলের নাড় আর মোটা পাকা কলা। হেমলতা বললেন, যারে, ও আবার এসব খাবে-টাবে তো! নাহলে বল দুটো লুচি ভেজে দিই।

অনি বলল, কে খাবে না, কার কথা বলছ?

হেমলতা বললেন, ঐ যে, ফরসামতন—

অনি বলল, দুজনেই তো ফরসা। তপন?

হেমলতা দ্রুত ঘাড় নাড়লেন, না না, যে প্রণাম করতে আসছিল–।

ও, শচীনের কথা বলছ? তুমি কিন্তু ওকে প্রণাম না করতে দিয়ে খুব অন্যায় করেছ। আমার বন্ধুরা শুনলে খ্যাপাবে। অনি সোজাসুজি বলে ফেলল।

হেমলতা বলে উঠলেন, না বাবা, প্রণাম করতে হবে না। তা ও কি খাবে এসব?

খাবে না কেন? অনি দুটো প্লেট হাতে নিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটাতে বেশি দিয়েছ কেন অত।

হেমলতা হাসলেন, বেশি কোথায়? ওটা ওকে দিবি।

অনি বলল, কেন দুজনকেই সমান দাও। তপন কী দোষ করল? একেই প্রণাম নেবার সময় অমন করলে, খাবার সময় যদি তপনকে কম দাও তো ও ছেড়ে কথা বলবে?

হেমলতা যেন অনিচ্ছায় দুটো প্লেটের খাবার সমান করতে চেষ্টা করলেন, হারে ছেলেটা খুব শান্ত, না রে?

কোন ছেলেটা? অনির হঠাৎ মনে হল পিসিমাকে অন্যরকম লাগছে। এমন ভঙ্গিতে পিসিমাকে কথা বলতে ও কোনোদিন দেখেনি।

ওই যে, বদ্যিব্রাহ্মণ-।

ওঃ, অনি প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, তুমি বারবার.ওই যে ওই যে করছ কেন? শচীন নামটা বলতে পারছ না?

হেমলতা কিছু বললেন না। অনি খাবার নিয়ে চলে গেলে একা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার কোনো ছবি নেই, মুখ মনে নেই, এই শরীরে কোনো চিহ্ন সে একে যেতে পারেনি, কারণ শরীরটা তখন তৈরি হয়নি। সে শুধু বেঁচে আছে হেমলতার কাছে একটা নাম হয়ে, বুকের মধ্যে একটা নামজপের মন্ত্রের মতো অবিরত ঘুরেফিরে আসে। সে-মানুষতে তিনি মনে করতে পারেন না, শুনেছেন বড় সুন্দর ছিল লোকটা, খুব ফরসা। তারপর এতদিন ধরে নামটাকে সম্বল করে কল্পনায় চেহারাটাকে তৈরি করে নিজের সঙ্গে খেলে-খেলে যাওয়া। আজ এতদিন বাদে সেই নামের একটি মানুষকে তিনি প্রথম দেখলেন। ফরসা সুন্দর চেহারার একটি কিশোর। হোক কিশোর, নামটা শুনে বুকের মধ্যে লোহার মুঠোয় কে দম টিপে ধরেছিল। এ-নামের মানুষের কাছে কী করে তিনি প্রণাম নেবেন?

হেমলতা চুপচাপ একা একা কাঁদতে লাগলেন। যৌবনের শুরুতে যে-মানুষটা তাকে কুমারী রেখে চলে গিয়েছিল স্বার্থপরের মতো, আজ এতদিন পরে তার নামটার সঙ্গে মিলিয়ে একটি ছবি পেয়ে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

সরিৎশেখরের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তপন আর শচীন চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল অনি যেন অবশ্যই যায়, ওর দাদুকে যেন অনি বলে যে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। জলপাইগুড়িতে তখন একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু ছিল। কোনো বিবাহ-অনুষ্ঠানে পত্র দিয়ে অথবা মুখে নিমন্ত্রণ করলেই চলবে না, অনুষ্ঠানের দিন ঘনিষ্ঠদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে। এরকম অনেকবার হয়েছে, এই সামান্য ক্রটির জন্য বিবাহ-অনুষ্ঠান ফাঁকা হয়ে গেছে, বাড়িতে বলা হয়নি বলে অনেকেই আসেননি।

শচীনরা চলে গেলে অনি চুপচাপ গেটের আছে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন খেলার মাঠে গিয়ে কোনো লাভ নেই। পিসিমা আজ ওরকম করছিলেন কেন? শচীনকে নাম ধরে ডাকছিলেন না পর্যন্ত হঠাৎ ওর খেয়াল হল পিসিমার বরের নাম ছিল শচীন। দাদু একদিন সেসব গল্প বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনি ঘুরে দাঁড়াল। এখন ও বুঝতে পেরে গেছে কেন শচীনকে উনি প্রণাম করতে দেননি। ইদানীং ও পিসিমার সঙ্গে ঠাট্টাতামাশা করে, বয়স হয়ে যাবার জন্যে বোধহয় পিসিমা ওকে প্রশ্রয় দেন। এরকম একটা ব্যাপার তাকে ডেকে উঠল। অনি ফিরে দেখল, এদের পাড়ার একটি বড় ছেলে ওকে ডাকছে, এই খোকা, তোমার নাম অনি তো?

অনি ঘাড় নাড়ল।

তাড়াতাড়ি বাড়িতে খবর দাও, তোমার দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছেলেটি গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অনি হতভম্বের মতো তাকাল। কী করতে হবে কী বলতে হবে বুঝতে পারছিল না। ছেলেটি আবার বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও। খুব খারাপ কিছু না, পায়ে চোট লেগেছে বোধহ, ভয়ের কিছু নেই।
 
দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অথচ ভয়ের কিছু নেই-একথা লোকে চট করে বিশ্বাস করতে চায় না। তা ছাড়া প্রিয়জনের দুর্ঘটনা মানেই একটা মারাক ব্যাপার হয়ে যায়। অনি যখন ছুটে গিয়ে হেমলতাকে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন। বাবার দুর্ঘটনা ঘটেছে, যে-লোকটা একটু আগে সুস্থ শরীরে বেড়াতে গেল সে-লোকটা এখন হাসপাতালে-একথা ভাবতেই বুকটা কেমন করে ওঠে। এই দীর্ঘ জীবনটা তার বাবার সঙ্গে কেটেছে, বাবা ছাড়া তিনি কিছু ভাবতেই পারেন না। ফলে এই খবরটা ওঁর শরীর নিংড়ে একটা ভয়ের কান্না বের করে আনল। স্বামীর কথা ভাবতে গিয়ে যে-কান্নাটা বুকে ঘোরাফেরা করছিল এতক্ষণ, আশ্চর্যভাবে সেটা চেহারা পালটে ফেলল এখন। সেই কান্নাটা এখন হেমলতাকে যেন সাহায্য করল।

হাসপাতালে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ঘরদোর বন্ধ করে তালা দিতে গিয়ে হেমলতা আবিষ্কার করলেন বাড়িটা একদম খোলা পড়ে থাকবে। এত বড় বাড়িতে তালা দিয়ে এর আগে সাবই মিলে কোথাও যাওয়া হয়নি। হেমলতা দেখলেন বাগানের ভেতর দিয়ে কেউ এসে তালা ভেঙে যদি সব বের করে নিয়ে যায় তবে পাড়ার লোকে কেউ টের পাবে না। কিন্তু একটা বড় আতঙ্ক ছোট ভয়ের সম্ভাবনাকে চাপা দিতে পারে, হেমলতা ইষ্টনাম করতে করতে অর্ক নিয়ে বের হলেন।

অনি দেখল, পিসিমা থান-শোমিজের ওপর একটা সুতির চাদর জড়িয়েছেন। এর আগে কখনো সে পিসিমার সঙ্গে রাস্তায় বের হয়নি। এখানে আসার পর পিসিমা কখনো বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কি না মনে পড়ে না। সন্ধে হয়ে এসেচে। টাউন ক্লাব মাঠের পাশ দিয়ে যেতেই ওরা রিকশা পেয়ে গেল। হেমলতা তখন থেকে শুধু নাম জপ করে যাচ্ছেন। দাদুর পায়ে চোট লেগেছে, ভয়ের কিছু নেই, শোনার পরও কিন্তু অনি সহজ হতে পারছিল না। খারাপ খবর নাকি লোকে টপ করে দেয় না, সইয়ে সইয়ে দেয়। দাদু যদি মরে গিয়ে থাকে এতক্ষণে তা হলে ও কী করবে?

হাসপাতালে প্রথম ঢুকল অনি। পিসিমা পেছন পেছন। রিকশা থেকে নেমেই অনি দেখল পিসিমা মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। এরকম বেশে ওঁকে দেখে অনির খুব হাসি পেলেও কিছু বলল না। তাড়াহুড়োয় পয়সাকড়ি আনা হয়নি বলে রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। ফিরে গিয়ে একেবারে ডবল পাবে। কলা ওষুধের গন্ধ নাকে ধক করে আসতেই অনির মনে হল, হাসপাতালে থাকতে খুব কষ্ট হয়। অনুসন্ধান লেখা কাউন্টারটায় কেউ নেই। একটা ওটকোমতো বেয়ারাগোছের লোক মেঝেতে বসে ছিল, অনিদের বোকার মতো চাইতে দেখে বলল, কী খুঁজছ বাবা?

অনি বলল কি বলবে না ভেবে বলে ফেলল, আমার দাদু কোথায় তা-ই জানতে এসেছি।

লোকটা কেমন অথর্বের মতো তাকাল, জানতে চাইলেই জানতে পারবে না। ছটার পর বাবুদের ডিউটি খতম। হাত দিয়ে পাকা চেয়ার দেখাল সে, কী কেস?

অমি ঠিক বুঝতে পারল না প্রথমটা, মানে?

বাঁচবে না কষ্ট পাবে? লোকটা উদাস গলায় জিজ্ঞাসা করল। অনিকে ঘুরে পিসিমার দিকে চাইতে দেখে লোকটা বুঝিয়ে দিল, চুকে গেলেই বেঁচে যাওয়া যায়, এখানে থাকলেই তো ভোগান্তি, কষ্ট। কিন্তু চাইলেই কি যাওয়া যায়? এই যে দ্যাখো, আমি একেবারে খোদ যাবার দরজা-এই হাসপাতালে কাজ করছি আর প্রতিদিন চলে যাবার জন্য চেষ্টা করছি, তবু সে-মালা কি আমাকে টিকিট দেবে? তা কখন ভরতি হয়েছে।

বিকেলে। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে পায়ে। অনি বলল।

ও, সেই রিকশা-কেস বাঁচার কোনো আশা নেই, সে-শালা দয়া করবে না, অনেক ভোগান্তি আছে। তা তিনি আছেন ওই সামনে হলুদ বাড়িতে। এসে অবধি ডাক্তার নার্সদের ধমকে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। যাও, রিকশা-কেস বললেই যে-কেউ এখন বলে দিতে পারবে। লোকটা একফোঁটা নড়ল না।

তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে অনি বলল, বাঁচার আশা নেই বলল, না?

হেমলতা বললেন, তার মানে ভগবান নিয়ে যাবে না, ওর কাছে মরে যাওয়া মানে বেঁচে যাওয়া। যত বদ লোক।
 
হেমলতা হাঁটছিলেন টিপটিপে পায়ে। হাসপাতালের বারান্দায় রুগিরা সার দিয়ে শুয়ে রয়েছে। রাজ্যের মানুষের ছোঁয়া লেগে যাওয়ায় তার হাতটা শ্লথ হচ্ছিল। দুবার তাগাদা দিয়ে অনি এগিয়ে গিয়েছিল হলুদ বাড়ির দরজায়। এখন ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেছে। দলেদলে মানুষজন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। দরজায় একজনদারোয়ানগোছের লোক ওদের আটকাল। অনি ব্যাপারটা তাকে বললেও সে যেতে দিতে নারাজ, সময় চলে গেছে।

ততক্ষণে হেমলতা এসে পড়েছেন, মুনে খেঁকিয়ে উঠলেন, আমরা কি জেনে বসে আছি যে কখন ওর অ্যাক্সিডেন্ট হবে আর আমাদের সে-খবর পেয়ে আসতে তোমাদের সময় চলে যাবে।

দারোয়ান বলল, কখন অ্যাডমিট হয়েছে আপনার স্বামী?

হেমলতা সব ভুলে চিৎকার করে উঠলেন, মুখপোড়া বলে কী! ওরে উনি আমার বাবা, স্বামীকে অনেক দিন আগে খেয়েছি। অনির চট করে মনে পড়ে গেল, দাদু বরেন পিসিমা নাকি রাক্ষসগণ।

দারোয়ানটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কী হয়েছিল?

এবার অনি চটপট বলর, রিকশায় লেগেছে।

সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ানের চেহারা বদলে গেল, আরে বাপ, যান যান, বাঁদিকে ঘুরে তিন নম্বর বেড।

লোকটা এরকম ভয় পেল কেন বুঝতে পারল না অনি। পিসিমা তখনও গজগজ করেছেন, এদের এখানে চাকরি দেয় কেন? মেয়ে বউ বুঝতে পারে না যত বদ লোক!

সরিৎশেখর বিছানার ওপর হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার একটা পা মোটা ব্যান্ডেজ জড়ানো, টানটান করে রাখা। ওদের দেখে তিনিই কাছে ডাকলেন, এই যে, এদিকে এসো। দ্যাখো কীভাবে এরা সব আছেন। এটা কি হাসপাতাল না শুয়োরের খাচা! ঘরময় নোংরা ছিল, আমি বলেকয়ে। সরিয়েছি, নইলে আমরা ঢুকতে পারতে না।

হেমলতা বাবার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

সঙ্গে সঙ্গে গলা তুললেন সরিৎশেখর, স্বাধীন হয়ে সব উচ্ছন্নে গেছেন। আমি এখানে এসে এক ঘণ্টা পড়ে আছি, একটা ডাক্তার নেই যে এসে দেখবো নাকি তার ডিউটি ওভার, নতুন লোক, আসেনি। ভাবতে পার? ইংরেজ আমলে এসব জিনিস হলে হ্যাঙ আনটিল ডেথ হয়ে যেত। আমি কালই জওহরলাল নেহরুকে লিখব।

সরিৎশেখরের পাশের বেডে শুয়ে-থাকা একজন রুগি চিনচিনে গলায় বলে উঠলেন, আমাদের খাবার থেকে চুরি করে ওরা, কী জঘন্য খাবার!

সরিৎশেখর হেমলতাকে বললেন, শুনলে? চুরি করা আমি বের করছি। আমি এখানকার দেখনবাহার নাইটিঙ্গেলদের বলেছি খাবারের চার্ট দেখাতে, একটা-কিছু বিহিত করতে হবে। ওই যে আট নম্বরের বাচ্চাটা-চল্লিশ মিনিট চেঁচিয়েও বেডপ্যান পায়নি, আমি এলে তবে দিল। হ্যাঁ মশাই, সিভিল সার্জন কখন আসেন হাসপাতালে?

হেমলতা এবার প্রায় অসহিষ্ণু গলায় বললেন, আপনার পায়ের অবস্থা কীরকম?

যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। এতক্ষণে মুখ-বিকৃতি করলেন সরিৎশেখর, কাল সকালে বোধহয় প্লাস্টার করবে। দুপুরনাগাদ বাড়ি গিয়ে ভাত খাব।

পারবেন? হেমলতা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

পারব না কেন? আমার একটা পা তো ঠিক আছে। হঠাৎ যেন তার কথাটা মনে পড়ে যেতেই তিনি অনিকে কাছে ডাকলেন, শোনো, তুমি কাল সকালের ফাক্ট বাসে স্বৰ্গছেঁড়ায় চলে যাবে।

অনি অবাক হয়ে বলল, কেন? আমার স্কুল যে খোলা!

সরিৎশেখর বললেন, সারাজীবনে অনেক স্কুল খোলা পাবে। আমি যেতে পারছি না, তুমি অবশ্যই যাবে। তোমার বাবার খুব অসুখ।
 
কিং সাহেবের ঘাটের চায়ের দোকানগুলো বোধহয় দিনরাত খোলা থাকে। এই কাক-ভোরেও তাদের সামনে লোকের অভাব নেই। ভাতের হোটেল এখনও খোলেনি। সেগুলো ছাড়িয়ে সামান্য এগোতেই অনিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। একই সঙ্গে চার-পাঁচজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সাক্ষাত এসে ওকে যেন কোলে করেই নিজের গাড়িতে তুলতে চাইছে। অনি অসহারে মতো এপাশ-ওপাশ। তাকাচ্ছিল। সামনে সার দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। মণ্টু এগুলোকে বলে মুড়ির টিন। থার্টি টু পার্টস অল আউট। পুরো গাড়িটাই নাকি ভাঙাচোরা-সবকটা অংশ কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। হর্ন নেই, দরকারও হয় না। চলার সময় এক মাইল দূর থেকে সবাই এদের গর্জন শুনতে পায়। অনি কোনোদিন এই ট্যাক্সিতে চড়েনি। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে আসবার সময় লরিতে চেপে জোড়ানৌকায় পার হয়ে এসেছিল। অনেকদিন ওরা কিং সাহেবের ঘাটে এসে দেখেছে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপিয়ে আগাপাশতলা যাত্রী বোঝাই করে ট্যাক্সিগুলো তিস্তার কাশবন চিরে চুটে যায় বার্নিশের দিকে। বছরের যে-কটা মাস চর শুকনো থাকে ট্যাক্সিগুলো প্রতাপ দেখিয়ে বেড়ায়। তাও পুরো চর নয়, বার্নিশের কাছে সিকি মাইল গভীর জলের ধারা আছে। সে-অবধি গিয়ে আবার যাত্রী নিয়ে ফিরে। আসে ট্যাক্সিগুলো। তারপর যখন বর্ষা বেশ জমে ওঠে, নদীর এপার-ওপার দেখা যায় না, ঢেউগুলো খ্যাপা গোখরোর মতো ছোবল মারতে থাকে অবিরত, তখন ট্যাক্সিগুলো কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায়। অনি দেখল সামনের একটা ট্যাক্সির দরজা খুলে গেল হঠাৎ। তারপর একজন বয়স্ক মানুষ চাপা গলায় ধমে উঠলেন, কী হচ্ছে!

সঙ্গে সঙ্গে অনি দেখল লোকগুলো বেশ থতমত হয়ে গেল। একজন চট করে বলে উঠল, কেন ঝামেলা করস, বাবু তখন থিকা বইস্যা আছেন, ইনারে পাইলেই গাড়ি খুলুম-আসেন কত্তা, আমাগো পিক্ষিরাজে বসেন, আমি ডেরাইভার সাহেবকে ডাইক্যা আনি।

লোকটা ওকে যেন পথ দেখিয়ে খানিকটা দূর এগিয়ে এসে গাড়িটা চিনিয়ে দিল। অনি দেখল অন্যান্য গাড়ির তুলনায় এটা তবু দ্ৰ চেহারার, মাথার ওপরের ত্রিপলটা আস্ত আছে। বয়স্ক ভ্রলোক তখনও বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনি দেখেই বুঝল অনি নিশ্চয়ই খুব বড়লোক, কারণ এর ফিনফিনে ধুতি, গিলে-করা পাঞ্জাবি আর ফরসা গোলগাল চেহারা থেকে একটা আভা বের হচ্ছিল।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, গাড়িতে উঠিয়ে ছাড়ার নাম নেই! তোমাদের প্যাসেঞ্জার না হওয়া অবধি বসে থাকতে হবে।

কথাটার কোনো জবাব দিল না কেউ। ভদ্রলোক এপাশ-ওপাশ তাকালেন। অনি দেখল যে-লোকটা ওকে গাড়ি চিনিয়েছে সে একটা পাটকাঠির মতো ফিনফিনে লোককে সঙ্গে নিয়ে এদিকে আসছে। অনি শুনতে পেল ভদ্রলোক তাকে ডাকছেন, এই খোকা, ওপারে যাবে তো? গাড়িতে উঠে বসো। এবার না ছাড়লে দেখছি! অনি গাড়িতে ওঠার আগেই ফিনফিনে লোকটি দরজা খুলে ওকে সামনে বসতে বলল। ডাইভারের সিটে কোনো গদি কোনো গদি নেই। গোল গোল.শ্রিং-এর ওপর মোটা বস্তা পাতা রয়েছে। খুব চওড়া ফুটবোর্ডের ওপর পা রেখে নিচু হয়ে বসতেই মনে হল ওর পাছায় অজস্র পিপড়ে কামড়াচ্ছে। ড্রাইভারের সঙ্গীটি তখন চাঁচাচ্ছে-ফাস্টো টিপ–বার্নিশ, ফাস্টো টি-বার্নিশ!।

গাড়িতে ওঠার সময় অনি লক্ষ করেছিল ভদ্রলোক একা নেই। একজন মহিলা এবং একটি ছেলেকে এক পলকে নজর করেছিল সে। এখন গাড়িতে উঠে ও দেখল ওর সামনে আয়নাটা আস্ত আছে এবং ভদ্রলোকের পাশে ভীষণ ফরসা একজন মহিলা বসে আছেন লাল কাপড় পরে। মহিলার চোখে নতুন ধরনের চশমা যা অনি কোনোদিন দেখেনি, জামাটার হাতা নেই। এরকম জামা ছোট ঠাকুমা পরত। দাদুর তোলা ছোট ঠাকুমার একটা ছবি দেখছিল সে, ঠিক এইরকম, তবে একটু ঢোলা। অনি উঠতেই তিনি চোখ কুঁচকে তাকে একবার দেখলেন, রাবিশ! এত করে বললাম গাড়ি বের করো, শুনলে না, এখন বোঝে।

ভদ্রলোক বললেন, তিস্তার চরে প্রাইভেট গাড়ি চালালে বারোটা বেজে যাবে।

ভদ্রলোক বললেন, ছেলে শুনছে।

শুনুক! এখন তো শোনার বয়স হচ্ছে।

ভদ্রমহিলার কথা শেষ হওয়ামাত্র হুড়মুড় করে চার-পাঁচজন কাবুলিওয়ালার একটা দল এসে পড়র। ওদের দেখে অন্যান্য ট্যাক্সি-ড্রাইভার কিন্তু একদম চিৎকার করল না। ওরা বোধহয় এই ট্যাক্সিতে প্যাসেঞ্জার দেখে সোজা এখানেই চলে এল। ড্রাইভারের সঙ্গী চেঁচিয়ে বলল, এক কপিয়া খান সাব এক আদমি কো।

একটা মোটা কাবুলিওয়ালা, যার ঘাড় মাথার অর্ধেক অবধি কামানো, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, পচ আদমি-চার রুপয়া।

এই নিয়ে যখন ওদের মধ্যে কথা চলছে অনি শুনল ভদ্রমহিলা বললেন, এই গাড়িতে ওরা যাবে নাকি? ভদ্রলোক জবাব না দিলেও অনি বুঝতে পারল, তিনিও ওদের যাওয়াটা পছন্দ করছেন না। ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি ড্রাইভারকে বলো ওদের না নিতে।

ভদ্রলোক বললেন, ও শুনবে কেন? আমরা তো পুরো ট্যাক্সি রিজার্ভ করিনি।

এবার যেন মহিলা ধৈর্য রাখতে পারলেন না, তা-ই করো। আঃ! তুমি জান না ওরা কীরকম। আজ অবধি কেউ কাবুলিওয়ালার বউ দেখেনি, জান?

হঠাৎ ভদ্রলোকের গলার স্বর পালটে গেল, তাতে তোমার কী এসে গেল, তুমি তো আমার স্ত্রী।
 
অনি দেখল ভদ্রমহিলার মুখ সব লাল হয়ে গেছে। তার একপাশে ওর বয়সি যে-ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে তার মুখটা অসম্ভব রকমের গোবচারা। এরকম লালটু পোলাটু-মার্কা ছেলে ওদের দলে একটাও নেই। হঠাৎ ছেলেটা বলে উঠল, কাবুলিওয়ালারা খুব ভালো, না মা? আখরোট দেবে আমাদের?

ভদ্রমহিলা খিঁচিয়ে উঠলেন, আঃ, তুমি চুপ করো। যেমন বাপ তেমনি ছেলে!

ছেলেটি হতচকিত হয়ে বলল, হ্যাঁ মা, মিনিকে দিত, আমি পড়েছি।

অনি ঠিক বুঝতে পারছিল না ছেলেটি কোন পড়ার কথা বলছে। তবে আন্দাজ করল ও কাবুলিদের নিয়ে কোনো গল্প পড়েছে।

দর ঠিকঠাক হয়ে গেলে লোকগুলো যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখন অনি পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখল, ভদ্রমহিলা অনেকটা ঝুঁকে প্রায় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলছেন, তুমি আমাদের এখানে এসে বসো তো ভাই, সামনের সিটটা ওদের ছেড়ে দাও।

অনি কী করবে বুঝে না উঠতেই ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, চলে এসো পেছনে, কুইক।

অনি কী করবে বুঝে উঠতেই ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, চলে এসো পেছনে, কুইক। ভদ্রলোক জানা ছাড়বেন না, তার কীসব দেখার আছে। গোলালু ছেলেটা প্রায় নাকে কেঁদে উঠল, সে ওপাশের জানালা থেকে সরবে না। অনি নেমে দাঁড়িয়েছিল। একটা ছোকরা-কাবুলি ওর মাথায় আলতো করে টোকা মারল। তারপর ওরা চারজন ড্রাইভারের পাশে গিয়ে অদ্ভুত ভাষায় উঃ আঃ করতে করতে বসে পড়ল। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক নেমে দাঁড়াতে অনি পেছনের সিটে বসতে পেল। ছোট্ট কাপড়ের ঝোলাটা কোলের ওপর রেখে মহিলার পাশে বসতেই অনির মনে হল অত এক ফুলের বাগানে সে ঢুকে পড়েছে। তরকম ফুলের গন্ধ একসঙ্গে নাকে আসছে যে দিশেহারা হয়ে যেতে হয়। মায়ের গা থেকে যেরকম গন্ধ বের হত এটা সেরকম নয়, মহিলার শরীর থেকে যে-সৌরভ বের হচ্ছে তা মানুষকে যেন অবশ করে দেয়। সামনের সিটে বসে যে কেন গন্ধটা পায়নি বুঝতে পারছিল না অনি। কাবুলিরা উঠে বসেই প্রায় একই সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখল। একজন কী-একটা মন্তব্য করতেই সবাই ঠাঠা করে হেসে উঠল। অনি দেখল ভদ্রমহিলা এক হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন, অন্য হাত তার পিঠের উপর রাখা।

ড্রাইভারের সঙ্গী এবং অবশিষ্ট কাবুলিটা ফুটবোর্ডে উঠল। সঙ্গীটি ওঠার আগে হ্যাণ্ডেল নিয়ে কয়েক মিনিট প্রাণপণে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করতে সেটা সফল হয়ে এল। ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই গাড়িটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। অনিরমনে হতে লাগল মণ্টুর কথা সত্যি, যে-কোনো সময় গাড়ির সবকটা অংশ খুলে পড়ে যেতে পারে। বিকট চিৎকার করে গাড়িটা চলতে শুরু করল এবার। ভেতরে বসে কানে তালা লাগার যোগাড়। অনি দেখল পেছনের সিটের গদি এখনও সবটা উঠে যায়নি।

দুপাশে বালি আর বারি, ইতস্তত কিছু কাশগাছ, গাড়িটা যত জোরে ছুটছে তার বহুগুণ বেশি শব্দ করছে। মাঝে-মাঝে মরা নদীর খোঁজে কিছু জল জমে রয়েছে। অবলীলায় ট্যাক্সি সেটা পেরিয়ে এল। কাবুলিগুলো খুব মজা পেয়েছে, অনি শুনল, ওরা চিৎকার করে গান ধরেছে। অনির বসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মহিলা তাকে প্রায় চেপটে ফেলেছেন। ওঁর পেটের গমের মতো রঙের চর্বি যত নরম হোক ওজনে দমবন্ধ করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ভদ্রমহিলা বোধহয় অনির পেছনদিক দিয়ে স্বামীকে চিমটি কেটেছিলেন, কারণ তিনি হঠাৎ উঃ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মহিলা কেমন হাসিহাসি গলায় বললেন, কাবুলিওয়ালারাও গান গায়, শুনেছ আগে?

ভদ্রলোক বললেন, হুঁ। সেক্স এলে ওরা গান গায়।

প্রায় আঁতকে উঠলেন মহিলা, সে কী!

সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় ভদ্রলোক বলে উঠলেন, তোমার অবশ্য ভয়ে দিন অনেক আগে চলে গেছে। আয়নায় মুখ দ্যাখো না তো!
 
অনি দেখল মহিলা হঠাৎ চুপ করে গেলেন। ওঁর হাতটা নির্ভার হয়ে ওর পিঠের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। মুখ ঘুরিয়ে অনি দেখল একটা ঠোঁট চেপে ধরে তিনি ছেলের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। কেন হঠাৎ এমন হল সে বুঝতে পারছিল না। সেক্স মানে কী? এই শব্দটাই সব গোলমালের কারণ। মানে জিজ্ঞাসা করলে যদি ভদ্রলোক চটে যান? ও মনে মনে কয়েকবার আওড়ে শব্দটা মুখস্থ করে ফেলল। বাড়িতে ফিরে গিয়ে ডিকশনারিতে এর মানেটা দেখতে হবে। আর এই সময় আর্তনাদ করে গাড়িটা থেমে গেল। অনি দেখল চারধারে এখন মাথা অবদি কাশগাছের বন। একটা ডাহুক পাখি ডাকছে কোথাও। ড্রাইভারের সাক্ষাত লাফিয়ে নামল, হালারে টাইট দেবার লাগব। বলে পাশ থেকে একটা কাশগাছের উঁটা ছিঁড়ে নিয়ে ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে ভেতরে কোথাও খুঁজে দিতেই আবার শব্দ করে গাড়িটা ডেকে উঠল। ব্যাপারটা এতটা আকস্মিক যে কাবুলিগুলো পর্যন্ত হাঁ হয়ে গেল। ভদ্রলোক চাপা গলায় বললেন, আমার গাড়ি হলে মেকানিক ডাকতে হত।

নদীর ধারে এসে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতেই কাবুলিগুলো আগে লাফিয়ে নামল। এপারে কোনো দোকানপাট নেই। প্রায় রোজই ঘাট জায়গা বদলাচ্ছে, তা ছাড়া পাহাড়ের বৃষ্টি হলেই শুকনো চরে আট-দশটা মেটো ধারা গজিয়ে এক হয়ে যাবে। ওপারে বানিশ! বার্নেশও বলে অনেক। লোকজন দোকানপাটে জমজমাট। এই সাতসকালে সেখানে গঞ্জের ভিড়। সমস্ত ড়ুয়ার্স এবং সুদূর কুচবিহার থেকে বাসগুলো এসে ওই বার্নিশে বসে থাকে। তিস্তা পেরিয়ে জলপাইগুড়িতে আসার উপায় নেই। তাই বার্নিশের রবরবা এত। বার্নিশের নিচে মণ্ডলঘাট, জলপাইগুড়িতে আসার সময় রা মওলঘাট দিয়ে এসেছিল।

গাড়ি তেকে নেমে অনি দেখল জোড়া-নৌকো একটাও নেই, ছোট ছোট নৌকো দুটো দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ে ভিড় নেই একদম, একটা নৌকোয় গোটা-আটেক লোক বসে আছে। তবে এই সিকি মাইল চওড়া তিস্তায় এখন প্রচণ্ড ঢেউ, জলের রঙ লালচে। হঠাৎ দেখলে কেমন ভয়-ভয় করে। ড্রাইভারের সঙ্গী এসে তার কাছে টাকা চাইল। ও দেখল ভদ্রলোক মহিলা এবং গোলালুকে নিয়ে নৌকোর দিকে এগোচ্ছেন। টাকাটা দিয়ে ও চটপট এগোল। আসবার সময় পিসিমা তিনটে একটাকার নোট তাকে দিয়েছেন, একটাকা ট্যক্সির ভাড়া, চার আনা নৌকোর ভাড়া, পাঁচসিক বাসভাড়া আর আটকায় দুটো রাজভোগ। একদম হিসেব করে দেওয়া টাকা। সকালবেলায় সাততাড়াতাড়ি না খেয়ে বেরনো-তাই রাজভোগ বরাদ্দ।

ভদ্রলোক উঠে গেছেন নৌকোয়, উঠে ছেলেকে প্রায় কোলে করে টেনে তুলেছেন। অনিকে আসতে দেখে মহিলা বললেন, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি ভাই। একসঙ্গে এলাম তো, যাই কী করে!

অতবড় মহিলা তাকে ভাই বলছেন, অনির কেমন অস্বস্তি হল। ও কি মাসিমা না বলে দিদি বলবে? ওরা নিশ্চয়ই খুব আধুনিক। বড়লোক হলেই বোধহয় আধুনিক হয়। মণ্টু বলে বিলেতে আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের বন্ধু। ওঁদের চেয়ে আধুনিক কে আছে। মহিলা তো তাকে শুধু ভাই বললেন।

অনি দেখল ঢেউ-এর দোলায় নৌকোটা পাড়ের বালিতে ঘষা খেয়ে আবার হাতখানেক সরে যাচ্ছে। সে-সময় তার ফাঁক দিয়ে লালচে জলের স্রোত দেখা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা বোধহয় সেই দিকে চোখ পড়ার আর এগোতে পারছেন না। ওদিকে ভদ্রলোক কিন্তু উদাস-চোখে বার্নিশের দিকে চেয়ে আছেন। নৌকোটা ছোট। দুধারে সরু তক্তা পাতা, যাত্রীরা সেখানে বসে আছে। মাঝখানে কাঠের বিমগুলো এখন ফাঁকা। গোলাপু জুলজুল করে বাবার পাশে বসে মাকে দেখছিল। অনির একটু ভয়-ভয় করছিল। সে সাবধানে নৌকোতে উঠতেই সেটা সামান্য দুলে উঠল। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি এবার ব্যালান্স থাকবে না, কিন্তু সেটা চট করে ফিরে এল। সোজা হয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। ও ঘুরে দেখল ভদ্রমহিলা ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, বেশি দুলছে না তো? অনি ঘাড় নেড়ে হাত ধরতেই ভদ্রমহিলা শরীরের সব ওজন নৌকোর ওপর অনিকে ভর করে ছেড়ে দিলেন। অনির মনের হল ওর দমবন্ধ হয়ে যাবে, ও উলটে জলে পড়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হল না, সামনে নিয়ে ভদ্রমহিলা সেখানেই কাঠের ওপর বসে পড়ে অনিকে বললেন, বসো। অনি বসতে বসতে শুনতে পেল মহিলা বলছেন, স্বার্থপর, জেলাস। ঠিক বুঝতে না পেরে ওঁর দিকে তাকাতেই তিনি হেসে ফেললেন, না না, তোমাকে নয় ভাই। এখা, তোমাকে কেন বলব! তুমি আমার কত উপকার করলে। কোথায় যাচ্ছ?

স্বৰ্গছেঁড়ায়। অনি বলল।

দারুণ রোমান্টিক নাম, না? আমরা যাচ্ছি ময়নাগুড়ি। আজই ফিরে আসব। জলপাইগুড়িতে থাক কাঁধে হাত রেখে পা নাচালেন মহিলা।

হ্যাঁ।

এলে দেখা কোরো। আমরা থাকি বাবুপাড়ায়। বাড়ির নাম ড্রিমল্যান্ড। মনে থাকবে তো?

অনি ঘাড় নাড়ল। ও কোন স্কুলে পড়ে।

কে? ও, প্রিন্স? কার্শিয়াং-এ পড়ে। ছুটিতে এসেছে। আমার একটা মেয়ে আছে, দারুণ সুন্দরী, আমার চেয়েও। ওর সঙ্গেই আমার মেলে বেশি। প্রিন্স ওর বাবার মতন, স্বার্থপর। অহো, তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়। এত কথার পর মহিলার এবার যেন প্রশ্নটা মনে পড়ল। ঠিক সে-সময়:মাঝিরা এসে নৌকোয় উঠতে সেটা খুব জোরে দুলে উঠল। মহিলা ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। সেইরকম ফুলের বাগানে ঢুকে পড়ে অনি বলল, আমার নাম অনিমেষ, জেলা স্কুলে পড়ি।
 
নৌকোটা ছেড়ে দিল। নৌকোর মুখে একটা মোটা লম্বা দড়ি বেঁধে কয়েকজন সেটাকে টানতে লাগল পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে। সেই টানে নৌকো এগিয়ে যেতে লাগল ওপরের দিকে। অনি শুনতে পেল ভদ্রলোক গোলালুকে বলছেন, একে বলে গুণ টানা। গোলা বুঝল কি না বোঝা গেল না। ও কেন জেলা স্কুলে না পড়ে কার্শিয়াং-এ পড়ে সেখানে নিশ্চয়ই একা থাকতে হয়। ওর হঠাৎ সোলালুর জন্য কষ্ট হল। মা থেকেও ও মার কাছে থাকতে পারছে না। ঢেউ বাচিয়ে নৌকোটাকে অনেক দূরে নিয়ে এসে মাঝিরা লাফিয়ে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ছপছপ করে বৈঠা পড়তে লাগল জলে। বাঁধন খুলে যেতেই স্রোতের টানে শেশো করে নৌকো নদীর ভিতর ঢুকে পড়ল।

বড় বড় ঢেউ দেখা যাচ্ছে মাঝনদীতে। এক-একটা বড় যে তার আড়ালে বার্নিশটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পলকের জন্য। হঠাৎ নৌকোর একধারে বসে-থাকা রাজবংশীরা চিৎকার করে উঠল, তিস্তা বুড়িকি জয়! সঙ্গে সঙ্গে সেটা গর্জন করে ফিরে এল। মাঝিলা প্রাণপণে নৌকো ঠিক রাখার চেস্টা করছে। চিৎকার করে নিজেদের মদ্যে কথাবার্তা বলছে ওরা। অনি দেখল বড় ঢেউয়ের কাছাকাছি নৌকো এসে যেতেই একটা দিক কেমন উঁচু হয়ে যাচ্ছে নৌকোর।

গোলালু ওর বাবাকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ভদ্রলোক অন্য হাতে নৌকোর তক্তা শক্ত করে ধরে আছেন। ভদ্রমহিলা এই সকালে কলকল করে ঘামছেন। তাঁর মুখের রং কাদা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে একধারে। সমস্ত শরীর দিয়ে যেন অনিকে জয়ি ধরেছেন। ছিটকে ছিটকে জল আসছে নৌকোয়। কাবুলিগুলো পর্যন্ত নদীর চেহারা দেখে ভয়ে। পচাপ হয়ে বসে গেছে।

এবার ঢেউটা পার হবে নৌকো। অনি দেখল স্রোতটা এখানে গর্তের মতো নিচে নেমে গিয়ে হঠাৎ তুবড়ির মতো ওপরে সে উঠছে। নৌকো সেই টানে নিচে নেমে যেতেই অনুত একটা ঝাঁকুনি লাগল। সেটা সামলে জলের টানে ওপরে উঠতেই একটু বেটাল হয়ে গেলে হুড়মুড় করে একরাশ জল নৌকোয় উঠে এল। আর তখনই অনি দেখল বেটাল নৌকোর একপাশে বসে থাকা একটা লোক টুপ করে জলে পড়ে গেল চুপচাপ। যেন ভেতরে ভেতরে কেউ কাজ করে যায়, নইলে সেই মুহূর্তে মহিলার বাঁধন খুলে অনি ঘুরে বসত না। আর বসতেই ও দেখল সেই শরীরটা ছুটন্ত জলের সঙ্গে পাক খেয়ে তার নিচ দিয়ে নৌকোর তলায় ঢুকে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বকে পড়ে অনিমেষ তার পিঠের জামা চেপে ধরল মুঠোয়। জলের স্রোতে শরীরটার ওজন কমে গিয়েছে, তবু তাকে ধরে রাখা অনির পক্ষে অসম্ভব। পিঠের দিকে টান লাগায় শরীরটার নিচ দিক নৌকোর তলায় ঢুকে গেল আর লোকটা চট করে আধা উলটে গেল। অনি দেখল লোকটার সারা শরীর কাপড়ে মোড়া, বাঁচার স্বাদ পেয়ে একটা হাত ওপরে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে কতক্ষণ সে ধরে থাকতে পারে? মহিলা না থাকলে সে নিজে পড়ে যেত। মহিলা তার কোমর দুহাতে ধরে রাখায় সে ব্যালেন্স রাখতে পারছে। এতক্ষণে নৌকোটা সেই বড় ঢেউ-এর জায়গাটা পেরিয়ে এসেছে। দুজন মাঝি দৌড়ে ছুটে এল অনিকে সাহায্য করতে। তারা এসে। ঝুঁকে পড়ে লোকটাকে ধরতেই সে হাত বাড়িয়ে নৌকোর কাঠ ধরতে গেল। নাগাল পাচ্ছে না দেখে। অনি হাতটা ধরে সাহায্য করতে যেতেই দেখল সে কোনোরকমেই মুঠো করতে পারছে না। কারণ মুঠো করার জন্য আঙুলগুলোই তার নেই। এই জলে-ভেজা হাতের যেখানে সে চেপে ধরেছিল সে জায়গাটা যেন কেমন-কেমন লাগছে। আর এই সময় চিৎকারটা শুনতে পেল অনি। কানের কাছে মহিলা প্রচন্ড আর্তনাদ করে তার কোমর ছেড়ে দিলেন। দিয়ে আলথালু হয়ে দৌড়ে স্বামীর পাশে গিয়ে বসলেন।

যেহেতু এখন নৌকো দুলছে না, অনি সোজা হয়ে একা দাঁড়াতে পারল। ততক্ষণে নৌকোটা পাড়ের কাছে এসে গেছে এবং এই মাঝি দুটো লোকটাকে টেনে অনিরা যেখানে বসেছিল সেখানে তুলেছে। অনি দেখল মৃতপ্রায় একটা মানুষ নৌকোর কাঠের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। মুখভরতি দাড়ি দাঁত নেই, হাঁ করে বুক কাঁপিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। অনি দেখল লোকটার নাক নেই, কানের অর্ধেকটা খসা, চুলের জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ। পুরো মুখটা ঢেকে বসেছিল সে নৌকোয়। আর এতক্ষণ পরে অনি টের পেল ওর শরীর থেকে অদ্ভুত একটা পচা গন্ধ বের হচ্ছে। কেমন একটা গা-ঘিনঘিনে ভাব সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল এবার। অনি নিজের হাতের দিকে তাকাল। তারপর ঝুঁকে তিস্তার জলে হাত ধুয়ে নিল। আর এই সময় একটা মাঝি ওকে বলে উঠল, পণ্য করলেন না। ভাই, আপনার পাপই হইল। কথাটার মানে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, এ তো মানুষ না, জন্তুর অধম। মইরা গেলেই এশান্তি পাইত, তিস্তাবুড়ির কোল থিকা ছিনাইয়া আইন্যা কী লাভ হইল!
 
অনি এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ওর জামাকাপড়ের অনেকটা যে জলে ভিজে গেছে টের পেল, কিন্তু ও মরে যেত যে!

মাঝিরা হাসল, হক কথা। কিন্তু বাঁইচ্যা যাইত।

ঠিক তখন কাল সন্ধেবেলায় হাসপাতালের সেই লোকটার মুখ মনে পড়ল। এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানে বেঁচে যাওয়া-লোকটা বলেছিলেন। এখন এই মাঝিও প্রায় সেই কথাই বলছে নিজের মায়ের কথা ভাবল অনি, মা কি বেঁচে গেছে তাকে ফেলে রেখে মা কি শান্তিতে আছে? মানুষের কেন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না বুঝতে পারছিল না অনি। হঠাৎ ওর মনে হর হাসপাতালের সেই লোকটা অথবা খসে-যাওয়া-শরীরে লোকটা বোধহয় একই রকমের।

পাড়ে নৌকো এসে ভিড়তেই ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভিড় জমে গেল নৌকোটার সামনে। সবাই একে একে পয়সা দিয়ে নেমে গেলে অনি মাঝিটাকে পয়সা দিতে গেল। সে ঘাড় নেড়ে বলল, না, আপনের ভাড়া লাগবে না।

পাড়ে দাঁড়িয়ে দুলন্ত নৌকোয় দাঁড়ানো মাঝিকে সে বলল, কেন?

মাঝি হাসল, আপনি যা করছেন তা কজনা করে!

কিছুতেই পয়সা নিল না সে! অনেকগুলো বিস্মিত মুখের সামনে দিয়ে অনি ওপরে উঠে এল। সারা সার বাস দাঁড়িয়ে। জায়গাগুলোর নাম মাথার ওপর লেখা-সাপাড়া-আলিপুরদুয়া-কুচবিহার-নাগুয়া-ফালাকাটা। এইসব চেনা বাসগুলোকে দেখতে পেয়ে ওর খুব খিদে পেয়ে গেল। খাবারের দোকান খুঁজতে গিয়েও দেখল ভদ্রলোক, মহিলা আর গোলালু একটা মিষ্টির দোকানে বসে আছেন। হাসিমুখে ওঁদের কাছে যেতেই অনি দেখল মহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। একটা চেয়ার খালি ছিল, অনি সেটা ধরতেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, বসো,, বসো না, খবরদার, ছোঁয়া লেগে যাবে! হ্যাঁ হয়ে গেল অনি। মহিলা স্বামীকে বললেন, ওকে এখান তেকে যেতে বলে দাও। সংক্রামক রোগ, অলরেডি ওর ভেতরে এসে গিয়েছে কি না কে জানে!

ভদ্রমহিলার দিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে ওর স্বামী অনিকে বললেন, তুমি বরং কার্বলিক সোপ দিয়ে হাতটা ধুয়ে নিও। হিরোর সব মানুষের কাছে সমান নয় ভাই। উইশ ইউ গুড লাক।

ভীষণ কান্না পেয়ে গেল অনির! কোনোরকমে দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে এল সে। খাবার ইচ্ছেটা এখন একদম চলে গেছে। এসব রোগ কি সংক্রামক। তার ভেতরে কি চলে আসতে পারে? এখানে কার্বলিক সোপ সে কোথায় পাবে। চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ নাকের কাছে সে দেখল তার ওপর আলিপুরদুয়ার লেখা, বাসটা এখনই ছাড়বে। স্বৰ্গছেঁড়ার ওপর দিয়ে একে যেতে হবে।

প্রায় অন্ধের মতন সে বাসে উঠে বসল। এখান থেকে মিষ্টির দোকানটা দেখা যাচ্ছে। জানলার পাশের সিটে বসে অনি দেখল ওদের টেবিলে বড় বড় রাজভোগ এসে গিয়েছে। আজ অবধি কেউ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেনি। সে কি জানত লোকটার খারাপ অসুখ আছে একটা মানুষ ড়ুবে যাচ্ছে দেখে তার বুকের মধ্যে এমন একটা ব্যাপার হল যে সে ঠিক থাকতে পারেনি। হঠাৎ ওর মনে পড়ল, মাঝিগুলো তো নির্দিধায় লোকটাকে টেনে তুলেছিল। ওরা কি কার্বলিক সোপে হাত ধোবে? ওদের মনে যদি কোনো চিন্তা না এসে থাকে সে এত ভাবছে কেন? মহিলা নিশ্চয় ভুল বুঝেছেন অথবা তিনি মোটেই আধুনিক নন। সংস্কার না থাকার নামই নাকি আধুনিক হওয়া, আমেরিকানদে মতো-মণ্টু প্রায়ই বলে। ওর মনে পড়ল মাঝি ওকে বলেছে আপনি যা করেছেন তা কজনে পারে? অদ্ভুত একটা শান্তি একটু একটু করে ফিরে আসছিল অনির।

এই সময় ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল দুবার হর্ন বাজিয়ে। সামান্য লোক হয়েছে গাড়িতে। কন্ট্রাক্টর দরজা বন্ধ করে চাচাল, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, স্বৰ্গছেঁড়া, বীরপাড়া-আলিপুরদুয়ার। আর বাসটা এবার নড়তেই হঠাৎ অনি লক্ষ করল কী-একটা ছুটে আসছে তার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই কালোমতন জিসিসটা চটাং করে এসে লাগল জানলার ওপরে। একটা কাদার তাল ঝুলে থাকল জানলায়। একটু নিচু হলেই সেটা গলে অনির মুখে এসে লাগলত। বিস্মিত, হতভম্ব অনি সমস্ত শরীরে কাঁপুনি নিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল একটা লোক ওকে দেখে চাচাচ্ছে, কেন বাঁচালি, মরতে চেয়েছিলাম তো তোর বাপের কী, শালা! কেন বাঁচালি? সেই আধখানা শরীরটা নৌকোর ওপর থেকে এসে ভেজা কাপড়ে হিংস্র হয়ে লাফাচ্ছে আর নাকিম্বরে অনির দিকে তাকিয়ে একই কথা বলে যাচ্ছে। ও কী করে টের পেল যে অনি চিয়েছে: নিশ্চয়ই কেউ বলে দিয়েছে। অনির বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল, চোখের সামনে জলের আড়াল। ও তাড়াতাড়ি কাচের জানলাটা বন্ধ করে দিল। ঝাঁপসা হয়ে গেলে সব মানুষকে সমান দেখায়।
 
বাবার অসুখের খবর পেয়ে জোর করে দাদু তাকে পাঠালেন কিন্তু ধূপগড়ি না পেরনো পর্যন্ত সেকথা খুব-একটা মনে পড়েনি অনির। ড়ুড়ুয়া নদী ছাড়িয়ে রাস্তাটা বাঁক নিতে যেই স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের গাছগুলো চোখে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে একা উত্তেজনা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। কদিন বাদে সে আবার এইসব গাছগাছালি, ডানদিকের মদেসিয়া কুলিদের ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছে। মুখ বাড়িয়ে একটা পরিচিত মুখ দেখল না ও। যদিও স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার এখান থেকে মাইল দুয়েক, তবু কেউ-কেউ তো এদিকে আসতেও পারে। তারপর সেই বিরাট শালের মাঝখানে কাজ-করা ফুলের মতো চা-বাগানের মধ্যখানে মাথা-তোলা ফ্যাক্টরি-বাড়িটা চোখে পড়ল তক্ষুনি ওর বুকটা কেঁপে উঠল। বাবার খুব অসুখ, ওই ফ্যাক্টরিতে বাবা নিশ্চয়ই কাজ করতে যেতে পারছেন না। চা-বাগানের শেষে বাদিকে বাবুদের কোয়ার্টার, দু-দুটো চাপাগাছ বুকে নিয়ে নিয়ে বিরাট খেলার মাঠ চুপচাপ পড়ে আছে। অনি চিৎকার করে বাস থামাল।

মাটিতে নামতেই ইউক্যালিপটাস গাছের শরীর-ছোঁয়া বাতাসটাকে নাক ভরে টেনে নিয়ে ও চারপাশে তাকাল। কোয়ার্টারগুলোর দরজা বন্ধ। রাস্তার এপাশে মাড়োয়ারিদের দোকানের সামনে একজন পশ্চিমগোছের লোক উবু হয়ে বসে তাকে দেখছে। চোখাচোখি হতে দাঁত বের করে হাসল, অনি তাকে চিনতে পারল না। ক্লাবঘর তালাবন্ধু, অনি বারান্দায় উঠে এসে দরজার কড়া নাড়ল।

ডানদিকের খিড়কিদরজা খুলে বাগান দিয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়া যায়, কিন্তু হঠাৎ এই সদরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর মনটা কেমন হয়ে গেল। এখন এ–বাড়িতে মা নেই। এই বারান্দা, এ-বাড়ির ঘর উঠোন যে-কোনো জায়গায় ও মাকে কল্পনা করতে পারে। মা মারা গেছেন জেনেও মাজে মাঝে নিজের সঙ্গে খেলা করে তাবত মা স্বৰ্গছেঁড়ায় আছে, গেলেই দেখা হবে। এখন এই সত্যটার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল ওর। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে বাবাকে মনে পড়ে যেতে শক্ত হয়ে দাঁড়াল অনি। বাবার কী হয়েছে। দাদু কেন জোর করে ওকে স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠালেন। হঠাৎ অনি কুইকঁই শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল একটা কালো রঙের ঘেয়ো নেড়িকুকুর চার পা মুড়ে মাটিতে বসে ওর দিকে কেমন আদুরে চোখে তাকিয়ে শব্দ করছে। কুকুরটাকে চিনতে পারল ও, মা এঁটো ভাত দিতেন, কালু বলে ডাকতেন, আর একদম পছন্দ করতেন।

পিসিমা কুকুরটাকে। আশ্চর্য, ও কী করে অনিকে চিনতে পারল। আর-একবার কড়া নাড়তেই ভেতরে খিল খোলার শব্দ হল। দরজার কপাট খুলে যেতে অনি দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে আছে।

ওমা, তুমি। কী চমকে দিয়েছ, আমি ভাবলাম কে না কে। সত্যিই অবাক হয়ে গেছে ছোটমা, হাত বাড়িয়ে অনির ব্যাগটা নিয়ে কাছাকাছি হতেই আবার বলল, আরে, তুমি যে দেখছি আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছ মাথায়!

অনি এখন চট করে কথা বলতে পারছিল না। অনেক ছোটমা জলপাইগুড়ি যায়নি। মহীতোষ একা গেছেন মাসখানেক আগে। কিন্তু একটা মানুষের চেহারা যে এই সামান্য কয়েক মাসের ব্যবধানে এত খারাপ হতে পারে ছোটমাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। কী রোগ হয়ে গেছে শরীরটা! দেখে মনে হয় ছোটমারই খুব কঠিন অসুখ হয়েছে। কিন্তু গলার ওপর অতখানি কাটা দাগ কেন? অনি সেদিকে তাকিয়ে বল, তুমি পড়ে গিয়েছিলো।

না তো! বলেই ছোটা প্রশ্নটা বুঝতে পারল, ও হ্যাঁ, খোচা লেগেছিল একবার। তা তুমি হঠাৎ করে এলে যে, স্কুল কি ছুটি।

না, ছুটি না। দাদু জোর করে পাঠালেন, বাবার নাকি খুব অসুখ, কী হয়েছে অনি ছোটমার পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ওদের বাইরের ঘরটা সেইরকমই রয়ে গেছে। এমনকি দু-দুটো সোফার ওপরে যে কভার ছিল সেগুলো অবধি একইরকম আছে, ছিঁড়ে যায়নি। ছোটমা বলল, অসুখ মানে? বাবাকে কে খবর দিল? ছোটমা ঘুরে ওর দিকে তাকাল।

জানি না। কাল বোধহয় কেউ দাদুকে বলেছে। কিন্তু বাড়ি আসার সময় একটা রিকশার সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টে দাদুর পা ভেঙে গেছে, আজ প্লাস্টার করে হাসপাতাল থেকে আসবে। অনি খবরটা দিল।

ও মা! কী করে হল? এখন কেমন আছেন?

ভালো।

কিন্তু ওঁর এই অবস্থায় তুমি চলে এলে কেন?

কী করব! দাদু যে জোর করে আমাকে পাঠলেন, কোনো কথা শুনতে চাইলেন না। বাবা কোন ঘরে? এখন কেমন আছেন?

খুব আস্তে ছোটমা বলবেন, এখন ভালো আছেন, ফ্যাক্টরিতে গিয়েছেন।

অবাক হয়ে গেল অনি, সে কী! তা হলে কাল যে দাদু খবর পেলেন বাবা খুব অসুস্থ! দাদু লোকের কথায় চট করে বিশ্বাস করেন। অনির মনে হল ছোটমা খুব কষ্ট করে হাসতে চেষ্টা করল।
 
মাঝের ঘরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অনি। কোনো জানলা খোলা নেই, যাওয়া-আসার দরজায় ভারী পর্দা ঝোলানো। প্রায়ন্ধকার ঘরে এক কোনায় টেবিলের ওপর প্রদীপ জ্বলছে। সেই প্রদীপের আলোয় অনি দেখতে পেল মাধুরী খুব গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছেন। বেশ বড় ফ্রেমের চৌহদ্দিতে মাধুরীর একটা অচেনা ছবি এনলার্জড় করে ধরে রাখা হয়েছে। যেহেতু ঘরের ভেতর আলো আসার রাস্তা নেই তাই ছবির ওপর পড়া প্রদীপের আলোটা অদ্ভুতভাবে চোখ কেড়ে নেয়। অনির মনে হল মাকে যেন দেবদেবীর মতো লাগছে, এ-বাড়ির সবাই এখানে এসে পূজা করে যায়। কিন্তু এই বন্ধ ঘরে কিছুক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। একটা চাপা অস্বস্তি সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মুখ ঘুরিয়ে ছোটমার দিকে তাকাতেই দেখল ছোটমা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। খুব দ্রুত অনি বলল, জানলা বন্ধ করে রেখেছ কেন,খুলে দাও।

সঙ্গে সঙ্গে ছোটমা চমকে উঠল, না না, এ-ঘরের জানলা কোলা বারণ। চলো, ভেতের যাই। ছোটমা আমার দালি না। অনি দেখল ঘরের ভেতর ঠিক ছবির সামনে একটা খাট পাতা। ঘরটা থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে ছবিটার দিকে আর-একবার তাকিয়ে ওর মনে হল মা যখন খুব গম্ভীর হয়ে যেতেন অথবা কোনো কারণে যখন মায়ের মন-খারাপ হয়ে যেত তখন এইরকম দেখাত।

ভেতরের ঘরে যেখানে অনিরা শুত সেখানে একটা ছোট ছোট খাট আর তার চারপাশের কাপড়চোপড় দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না যে এটা ছোটমার ঘর, ছোটমা একাই শোয় এখানে।

ছোটমা বলল, আগে একটু জিরিয়ে নাও, আমি তোমার জন্য খবর করি।

অনি বলল, ঝাড়িকাকু কোথায়?

ছোটমা যেন সামান্য ভ্রূকুটি করল, তুমি জান না?

অনি ঘাড় নাড়ল। ছোটমা মুখ নিচু করে বলল, তোমার বাবার সঙ্গে তর্ক করেছিল বলে উনি তাড়িয়ে দিয়েছেন। তা আমার অসুবিধে হচ্ছে না কিছু, একা মানুষ সারাদিন বসে থাকতাম, এখন কাজ করতে করতে বেশ দিনটা কেটে যায়। ছোটমা উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে অনি মনে হল ও যেন একদম অচেনা কোনো পরিবেশে চলে এসেছে।

জুতো খুলে খালিপায়ে অনি উঠোনে এসে দাঁড়াল। ঝাড়িকাকুকে বাবা ছাড়িয়ে দিয়েছেন? পিসিমা বলতেন, ঝাড়িকাকু এ-বাড়িতে এসে বাবাকে কোলে পিঠে করেছেন, কাকুকে তো মানুষ করেছেন বলা যায়। ইদানীং অনির মনে হত ও সবকিছু বুঝতে পারে, ও অনেক বড় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখন এই কাঁঠালগাছ আর তালগাছের দিকে তাকিয়ে ও কিছুতেই বুঝতে পারল না যে বাবা কী করে ঝাড়িকাকুকে ছাড়িয়ে দেন!

বাড়ির ভেতর যে-বাগানটা ছিল সেটা অপরিষ্কার হয়ে গেছে। অনি তারের দরজা ঠেলে পেছনে এল। গোলাঘরের আশেপাশে বেশ জঙ্গল হয়ে গিয়েছে। সেদিকে এগোতেই খুব দ্রুত হাম্বা হাখা ডাক শুনতে পেল অনি। গলাটা ধরা-ধরা, কিন্তু অনি চিনতে পারল। কাছাকাছি হতে ও একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। গোলাঘরের কাছে বিচলির স্তুপের পাশে কালীগাইকে বেধে রাখা হয়েছিল। অনিকে দেখে সে সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এখন ওর অনেক বয়স, শরীর হাড়জিরজিরে হয়ে গেছে, ফলে বেচারার গলায় দড়ির চাপ লাগায় চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। অনি। দৌড়ে ওর পাশে যেতে গরুটা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর খুব অভিমানী মেয়ের মতো মাথা নিচু করে ফেঁসফোঁস শব্দ করতে লাগল। অনি ঘাড়ে হাত রাখতেই কালী ওর লম্বা গলাটা চট করে তুলে যেন অনিকে জড়িয়ে ধরতে কোমরের কাছে ঘষতে লাগল। সেই ফোঁসফোঁস শব্দটা সমানে চলছে। অনি শব্দটার মানে বুঝতে পারছিল। বেচারার প্রচুর বয়স হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই আর দুধ দেয় না। মা ওকে এইটুকুনি কিনে এনেছিল। তারপর ওর নাতিপুতি বিরাট বংশে গোয়ালঘর ভরতি হয়ে গেল। হঠাৎ অনির খেয়াল হল, আর-কোনো গোরুকে দেখতে পাচ্ছে না তো! কালীর আদরের চোটে যখন অস্থির তখন অনি ছোটমার গলা শুনতে পেল, তোমাকে দেখে ওর খুব আনন্দ হয়েছে, না?

অনি দেখল ছোটমা তাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। কালী ওকে সরতে দিচ্ছে না, ওর গলায় হাত বোলাতে বোলাতে অনি বলল, আর গোরুগুলো কোথায়?

ছোটমা বলল, ঝাড়ি চলে যাওয়ার পর তোমার বাবা রাগ করে সবকটাকে বিক্রি করে দিলেন।

অনি অবাক হয়ে বলল, বিক্রি করে দিলেন?

ছোটবা হাসল, দিদি খুব যত্ন করত, আমি পারি না, তাই। ঝাড়ি থাকতে ও-ই করত সব। তা যেদিন সবগুলোকে নিয়ে হাটে চলে যাবে সেদিন এই গরুটার কী কান্না। ঠিক বুঝতে পেরেছিল এবাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। এখন তো আর দুধ দেয় না বোচারা, গায়ে জোরও নেই যে চাষ করবে, বোধহয় কেটেই ফেলত ওকে। এমনভাবে কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে তাকাল যে আমি পারলাম না। তোমার বাবাকে অনেক বলেকয়ে ওকে রেখে দিলাম। বেশিদিন আর বাঁচবে না।

হঠাৎ অনি আবিষ্কার করল কালীগাই-এর গলায় আদর করতে করতে কখন ওর দুই চোখ ঝাঁপসা হয়ে গেছে। ছোটমা সেই সময় ডাকল, এসো, হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে নাও। সেই কোন সাতসকালে বেরিয়েছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top