হেমলতা প্লেট সাজিয়ে বসে ছিলেন। তিলের নাড়, নারকেলের নাড় আর মোটা পাকা কলা। হেমলতা বললেন, যারে, ও আবার এসব খাবে-টাবে তো! নাহলে বল দুটো লুচি ভেজে দিই।
অনি বলল, কে খাবে না, কার কথা বলছ?
হেমলতা বললেন, ঐ যে, ফরসামতন—
অনি বলল, দুজনেই তো ফরসা। তপন?
হেমলতা দ্রুত ঘাড় নাড়লেন, না না, যে প্রণাম করতে আসছিল–।
ও, শচীনের কথা বলছ? তুমি কিন্তু ওকে প্রণাম না করতে দিয়ে খুব অন্যায় করেছ। আমার বন্ধুরা শুনলে খ্যাপাবে। অনি সোজাসুজি বলে ফেলল।
হেমলতা বলে উঠলেন, না বাবা, প্রণাম করতে হবে না। তা ও কি খাবে এসব?
খাবে না কেন? অনি দুটো প্লেট হাতে নিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটাতে বেশি দিয়েছ কেন অত।
হেমলতা হাসলেন, বেশি কোথায়? ওটা ওকে দিবি।
অনি বলল, কেন দুজনকেই সমান দাও। তপন কী দোষ করল? একেই প্রণাম নেবার সময় অমন করলে, খাবার সময় যদি তপনকে কম দাও তো ও ছেড়ে কথা বলবে?
হেমলতা যেন অনিচ্ছায় দুটো প্লেটের খাবার সমান করতে চেষ্টা করলেন, হারে ছেলেটা খুব শান্ত, না রে?
কোন ছেলেটা? অনির হঠাৎ মনে হল পিসিমাকে অন্যরকম লাগছে। এমন ভঙ্গিতে পিসিমাকে কথা বলতে ও কোনোদিন দেখেনি।
ওই যে, বদ্যিব্রাহ্মণ-।
ওঃ, অনি প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, তুমি বারবার.ওই যে ওই যে করছ কেন? শচীন নামটা বলতে পারছ না?
হেমলতা কিছু বললেন না। অনি খাবার নিয়ে চলে গেলে একা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার কোনো ছবি নেই, মুখ মনে নেই, এই শরীরে কোনো চিহ্ন সে একে যেতে পারেনি, কারণ শরীরটা তখন তৈরি হয়নি। সে শুধু বেঁচে আছে হেমলতার কাছে একটা নাম হয়ে, বুকের মধ্যে একটা নামজপের মন্ত্রের মতো অবিরত ঘুরেফিরে আসে। সে-মানুষতে তিনি মনে করতে পারেন না, শুনেছেন বড় সুন্দর ছিল লোকটা, খুব ফরসা। তারপর এতদিন ধরে নামটাকে সম্বল করে কল্পনায় চেহারাটাকে তৈরি করে নিজের সঙ্গে খেলে-খেলে যাওয়া। আজ এতদিন বাদে সেই নামের একটি মানুষকে তিনি প্রথম দেখলেন। ফরসা সুন্দর চেহারার একটি কিশোর। হোক কিশোর, নামটা শুনে বুকের মধ্যে লোহার মুঠোয় কে দম টিপে ধরেছিল। এ-নামের মানুষের কাছে কী করে তিনি প্রণাম নেবেন?
হেমলতা চুপচাপ একা একা কাঁদতে লাগলেন। যৌবনের শুরুতে যে-মানুষটা তাকে কুমারী রেখে চলে গিয়েছিল স্বার্থপরের মতো, আজ এতদিন পরে তার নামটার সঙ্গে মিলিয়ে একটি ছবি পেয়ে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
সরিৎশেখরের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তপন আর শচীন চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল অনি যেন অবশ্যই যায়, ওর দাদুকে যেন অনি বলে যে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। জলপাইগুড়িতে তখন একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু ছিল। কোনো বিবাহ-অনুষ্ঠানে পত্র দিয়ে অথবা মুখে নিমন্ত্রণ করলেই চলবে না, অনুষ্ঠানের দিন ঘনিষ্ঠদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে। এরকম অনেকবার হয়েছে, এই সামান্য ক্রটির জন্য বিবাহ-অনুষ্ঠান ফাঁকা হয়ে গেছে, বাড়িতে বলা হয়নি বলে অনেকেই আসেননি।
শচীনরা চলে গেলে অনি চুপচাপ গেটের আছে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন খেলার মাঠে গিয়ে কোনো লাভ নেই। পিসিমা আজ ওরকম করছিলেন কেন? শচীনকে নাম ধরে ডাকছিলেন না পর্যন্ত হঠাৎ ওর খেয়াল হল পিসিমার বরের নাম ছিল শচীন। দাদু একদিন সেসব গল্প বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনি ঘুরে দাঁড়াল। এখন ও বুঝতে পেরে গেছে কেন শচীনকে উনি প্রণাম করতে দেননি। ইদানীং ও পিসিমার সঙ্গে ঠাট্টাতামাশা করে, বয়স হয়ে যাবার জন্যে বোধহয় পিসিমা ওকে প্রশ্রয় দেন। এরকম একটা ব্যাপার তাকে ডেকে উঠল। অনি ফিরে দেখল, এদের পাড়ার একটি বড় ছেলে ওকে ডাকছে, এই খোকা, তোমার নাম অনি তো?
অনি ঘাড় নাড়ল।
তাড়াতাড়ি বাড়িতে খবর দাও, তোমার দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছেলেটি গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।
দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অনি হতভম্বের মতো তাকাল। কী করতে হবে কী বলতে হবে বুঝতে পারছিল না। ছেলেটি আবার বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও। খুব খারাপ কিছু না, পায়ে চোট লেগেছে বোধহ, ভয়ের কিছু নেই।
অনি বলল, কে খাবে না, কার কথা বলছ?
হেমলতা বললেন, ঐ যে, ফরসামতন—
অনি বলল, দুজনেই তো ফরসা। তপন?
হেমলতা দ্রুত ঘাড় নাড়লেন, না না, যে প্রণাম করতে আসছিল–।
ও, শচীনের কথা বলছ? তুমি কিন্তু ওকে প্রণাম না করতে দিয়ে খুব অন্যায় করেছ। আমার বন্ধুরা শুনলে খ্যাপাবে। অনি সোজাসুজি বলে ফেলল।
হেমলতা বলে উঠলেন, না বাবা, প্রণাম করতে হবে না। তা ও কি খাবে এসব?
খাবে না কেন? অনি দুটো প্লেট হাতে নিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটাতে বেশি দিয়েছ কেন অত।
হেমলতা হাসলেন, বেশি কোথায়? ওটা ওকে দিবি।
অনি বলল, কেন দুজনকেই সমান দাও। তপন কী দোষ করল? একেই প্রণাম নেবার সময় অমন করলে, খাবার সময় যদি তপনকে কম দাও তো ও ছেড়ে কথা বলবে?
হেমলতা যেন অনিচ্ছায় দুটো প্লেটের খাবার সমান করতে চেষ্টা করলেন, হারে ছেলেটা খুব শান্ত, না রে?
কোন ছেলেটা? অনির হঠাৎ মনে হল পিসিমাকে অন্যরকম লাগছে। এমন ভঙ্গিতে পিসিমাকে কথা বলতে ও কোনোদিন দেখেনি।
ওই যে, বদ্যিব্রাহ্মণ-।
ওঃ, অনি প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, তুমি বারবার.ওই যে ওই যে করছ কেন? শচীন নামটা বলতে পারছ না?
হেমলতা কিছু বললেন না। অনি খাবার নিয়ে চলে গেলে একা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার কোনো ছবি নেই, মুখ মনে নেই, এই শরীরে কোনো চিহ্ন সে একে যেতে পারেনি, কারণ শরীরটা তখন তৈরি হয়নি। সে শুধু বেঁচে আছে হেমলতার কাছে একটা নাম হয়ে, বুকের মধ্যে একটা নামজপের মন্ত্রের মতো অবিরত ঘুরেফিরে আসে। সে-মানুষতে তিনি মনে করতে পারেন না, শুনেছেন বড় সুন্দর ছিল লোকটা, খুব ফরসা। তারপর এতদিন ধরে নামটাকে সম্বল করে কল্পনায় চেহারাটাকে তৈরি করে নিজের সঙ্গে খেলে-খেলে যাওয়া। আজ এতদিন বাদে সেই নামের একটি মানুষকে তিনি প্রথম দেখলেন। ফরসা সুন্দর চেহারার একটি কিশোর। হোক কিশোর, নামটা শুনে বুকের মধ্যে লোহার মুঠোয় কে দম টিপে ধরেছিল। এ-নামের মানুষের কাছে কী করে তিনি প্রণাম নেবেন?
হেমলতা চুপচাপ একা একা কাঁদতে লাগলেন। যৌবনের শুরুতে যে-মানুষটা তাকে কুমারী রেখে চলে গিয়েছিল স্বার্থপরের মতো, আজ এতদিন পরে তার নামটার সঙ্গে মিলিয়ে একটি ছবি পেয়ে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
সরিৎশেখরের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তপন আর শচীন চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল অনি যেন অবশ্যই যায়, ওর দাদুকে যেন অনি বলে যে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। জলপাইগুড়িতে তখন একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু ছিল। কোনো বিবাহ-অনুষ্ঠানে পত্র দিয়ে অথবা মুখে নিমন্ত্রণ করলেই চলবে না, অনুষ্ঠানের দিন ঘনিষ্ঠদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে। এরকম অনেকবার হয়েছে, এই সামান্য ক্রটির জন্য বিবাহ-অনুষ্ঠান ফাঁকা হয়ে গেছে, বাড়িতে বলা হয়নি বলে অনেকেই আসেননি।
শচীনরা চলে গেলে অনি চুপচাপ গেটের আছে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন খেলার মাঠে গিয়ে কোনো লাভ নেই। পিসিমা আজ ওরকম করছিলেন কেন? শচীনকে নাম ধরে ডাকছিলেন না পর্যন্ত হঠাৎ ওর খেয়াল হল পিসিমার বরের নাম ছিল শচীন। দাদু একদিন সেসব গল্প বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনি ঘুরে দাঁড়াল। এখন ও বুঝতে পেরে গেছে কেন শচীনকে উনি প্রণাম করতে দেননি। ইদানীং ও পিসিমার সঙ্গে ঠাট্টাতামাশা করে, বয়স হয়ে যাবার জন্যে বোধহয় পিসিমা ওকে প্রশ্রয় দেন। এরকম একটা ব্যাপার তাকে ডেকে উঠল। অনি ফিরে দেখল, এদের পাড়ার একটি বড় ছেলে ওকে ডাকছে, এই খোকা, তোমার নাম অনি তো?
অনি ঘাড় নাড়ল।
তাড়াতাড়ি বাড়িতে খবর দাও, তোমার দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছেলেটি গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।
দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অনি হতভম্বের মতো তাকাল। কী করতে হবে কী বলতে হবে বুঝতে পারছিল না। ছেলেটি আবার বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও। খুব খারাপ কিছু না, পায়ে চোট লেগেছে বোধহ, ভয়ের কিছু নেই।