অনি দেখল দরজাটা খুলে গেল, এক হাতে বাটি নিয়ে নতুন মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতে মুখ নিচু করল অনি। এ–ঘরে কেন এসেছে নতুন মা? ও তো কাউকে বিরক্ত করতে যায়নি। যেন কিছুই দেখেনি এইরকম ভঙ্গি করে অনি সামনে খুলে-রাখা একটা বই-এর দিকে চেয়ে থাকল।
পায়েসটা খেয়ে নাও। বড়দের মতন নয়, একদম ওদের মতো গলায় কথাটা শুনতে পেল অনি। অবাক হয়ে তাকাল ও। পায়েস খেতে ওর খুব ভালো লাগে কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি রান্নাঘরের বাইরে ভাতের সকড়ি এ-বাড়িতে কাউকে আনতে দেখেনি। পিসিমা এ-ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। জামাকাপড় না ছেড়ে পায়খানায় গেলে চিৎকার করে পাড়ামাত করে দেন। পায়েস শোয়ার ঘরে বসে কেতে দেবেন, এ একেবারেই অবিশ্বাস্য। হয় পিসিমা জানেন না, নতুন মা না বলে নিয়ে এসেছে। উলটো ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না অনিমেষের। খুব আস্তে ও বলল, আমি শোবার ঘরে পায়েস খাই না।
থতমত হয়ে গেল নতুন বউ। কথাটা ওর একদম খেয়াল হয়নি, আসার সময় দিদিও বলে দেয়নি। এইটুকুনি ছেলে যে এতটা বিচক্ষণের মতো কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি সে, শুনে লজ্জা এবং অস্বস্তি হল। মাথায় বেশ লম্বা ছেলেটা, গড়ন অবিকল মহীতোষের মত। মুখটা খুব মিষ্টি, চিবুকের কাছে এমন একটা ভাঁজ আছে যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। এই ছেলে, এত বড় ছেলের মা হতে হবে, বরং দিদি হতে পারলে ও সবচেয়ে খুশি হত।
চেষ্টা করে হাসল নতুন বউ, তারপর ঘরটা দেখতে দেখতে অনির পাশে এসে দাঁড়াল, ঠিক বলেছ, আমার ছাই মাথার ঠিক নেই। যেই শুনলাম তুমি পায়েস খেতে ভালোবাস নিয়ে চলে এলাম। একবারও মনে হল না যে এটা রান্নাঘর না, এখানে সকড়ি চলে না। তা এসেছি যখন তখন এক কাজ করা যাক, আমি হাতে ধরে থাকি তুমি চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাও। পায়েসে গাঁথা চামচসুদ্ধ বাটিটা আনির সামনে ধরল নতুন বউ। সেদিকে তাকিয়ে অনির জিভে জল প্রায় এসে গেল, কী পুরু সর পড়েছে। কিন্তু কেউ বাটি ধরে থাকবে আর তা থেকে ও খাবে এরকম কোনোদিন হয়নি। হঠাৎ ও নতুন বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বাঙাল, না?
হকচকিয়ে গেল নতুন বউ, মানে?
পায়েসের দিকে তাকিয়ে অনি বলল, পিসিমা বলেন, বাঙালরা সকড়ি-কড়ি মানে না!
খিলখিল করে হেসে ফেলল নতুন বউ। হাসির দমকে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম সে বিয়ের আগের মতো হাসতে পারছে। অনির খুব মজা লাগছিল। নতুন মা একদম তপুপিসির মতো করছে। কোনোরকমে হাসির দমক সামলে নতুন বউ বলল, ঘটি ঘটি ঘটি, বাঙাল চললে চটি। তার পরেই হঠাৎ গলার স্বর পালটে প্রশ্ন করল, তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ, না?
মাথা নিচু করল অনি। সেই রাত্রে বাড়িতে ফিরে বারান্দায় দাঁড়ানো সরিৎশেখরকে সে রেগেমেগে যেসব কথা বলেছিল তা কি বাবা জানেন?বাবা জানলেই নতুন বউ জানবে। পিসিমা তো কোনোদিন অনির সঙ্গে ও-বাপরে কথা বলেননি। কিন্তু অনি জানে পিসিমা সব শুনেছিলেন আবার কেউ-এর দিকে ও পূর্ণচোখে তাকাল। শরীর দেখে খুব বড় বলে একদম মনে হয় না। একটুও ভারিকি দেখাচ্ছে না, কিন্তু এখন যেভাবে ঠোঁট টিপে হাসছে চট করে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। অনি বলল, আমি তোমাকে চিনি না, খামোকা রাগ করতে যাব কেন?
এক হাতে পায়েসের বাটিটা তখনও ধরা, অন্য হাত অনির চেয়ারের পেছনে রাখল নতুন বউ, আমাকে তুমি কী বলে ডাকবে?
একটু ভেবে অনি বলল, তুমি বলো।
তোমাকে কেউ বলে দেয়নি?
হুঁ বলেছে। পিসিমা বলেছে নতুন মা বলতে।
খুব ফিসফিস করে শব্দটা উচ্চারিত হতে শুনল অনি।
তোমার নতুন মা বলে ডাকতে ভালো লাগবে তো?
অনির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কথাবার্তাগুলো এমনভাবে হচ্ছে যে, অন্য একটা অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল সে।
অনি, আমাকে তুমি ছোটমা বলে ডাকবে? আমি তো চিরকাল নতুন থাকতে পারব না!
ঘাড় নাড়ল অনি। নতুন মার চেয়ে ছোটমা অনেক ভালো। মায়ের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন ছোটমা বলা।
তাহলে এই পায়েসটা খেয়ে ফ্যালো। চামচটা এগিয়ে দিল ছোটমা।
হেসে ফেলল অনিমেষ, যদি না খাই?
কপট নিশ্বাস ফেলল ছোটমা, কী আর করা যাবে। ভাবব আমার কপাল এইরকম। তোমাকে তো আর বকতে পারব না।
কেন? মায়েরা তো বকে।
ঘাড় নাড়ল অনি, ওর খুব মজা লাগছিল।
বন্ধু হলে কিন্তু সব কথা শুনতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়। আমার আজ অবধি একটাও বন্ধু ছিল। তুমি আমার বন্ধু হলে।
হাত বাড়িয়ে চামচটা ধরল সে, পুরু সরের চাদর কেটে এক চামচ পায়েস তুলে মুখে পুরতে পুরতে জিজ্ঞাসা করল, তুমি পেয়েছ?
একগাল হেসে ছোটমা বলল, কেন?
পিসিমা দারুণ পায়েস রাঁধে, খেয়ে দেখো। নিশ্চিত বিশ্বাসে বলল অনি, মাও এত ভালো পারত না।
পায়েসটা খেয়ে নাও। বড়দের মতন নয়, একদম ওদের মতো গলায় কথাটা শুনতে পেল অনি। অবাক হয়ে তাকাল ও। পায়েস খেতে ওর খুব ভালো লাগে কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি রান্নাঘরের বাইরে ভাতের সকড়ি এ-বাড়িতে কাউকে আনতে দেখেনি। পিসিমা এ-ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। জামাকাপড় না ছেড়ে পায়খানায় গেলে চিৎকার করে পাড়ামাত করে দেন। পায়েস শোয়ার ঘরে বসে কেতে দেবেন, এ একেবারেই অবিশ্বাস্য। হয় পিসিমা জানেন না, নতুন মা না বলে নিয়ে এসেছে। উলটো ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না অনিমেষের। খুব আস্তে ও বলল, আমি শোবার ঘরে পায়েস খাই না।
থতমত হয়ে গেল নতুন বউ। কথাটা ওর একদম খেয়াল হয়নি, আসার সময় দিদিও বলে দেয়নি। এইটুকুনি ছেলে যে এতটা বিচক্ষণের মতো কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি সে, শুনে লজ্জা এবং অস্বস্তি হল। মাথায় বেশ লম্বা ছেলেটা, গড়ন অবিকল মহীতোষের মত। মুখটা খুব মিষ্টি, চিবুকের কাছে এমন একটা ভাঁজ আছে যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। এই ছেলে, এত বড় ছেলের মা হতে হবে, বরং দিদি হতে পারলে ও সবচেয়ে খুশি হত।
চেষ্টা করে হাসল নতুন বউ, তারপর ঘরটা দেখতে দেখতে অনির পাশে এসে দাঁড়াল, ঠিক বলেছ, আমার ছাই মাথার ঠিক নেই। যেই শুনলাম তুমি পায়েস খেতে ভালোবাস নিয়ে চলে এলাম। একবারও মনে হল না যে এটা রান্নাঘর না, এখানে সকড়ি চলে না। তা এসেছি যখন তখন এক কাজ করা যাক, আমি হাতে ধরে থাকি তুমি চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাও। পায়েসে গাঁথা চামচসুদ্ধ বাটিটা আনির সামনে ধরল নতুন বউ। সেদিকে তাকিয়ে অনির জিভে জল প্রায় এসে গেল, কী পুরু সর পড়েছে। কিন্তু কেউ বাটি ধরে থাকবে আর তা থেকে ও খাবে এরকম কোনোদিন হয়নি। হঠাৎ ও নতুন বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বাঙাল, না?
হকচকিয়ে গেল নতুন বউ, মানে?
পায়েসের দিকে তাকিয়ে অনি বলল, পিসিমা বলেন, বাঙালরা সকড়ি-কড়ি মানে না!
খিলখিল করে হেসে ফেলল নতুন বউ। হাসির দমকে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম সে বিয়ের আগের মতো হাসতে পারছে। অনির খুব মজা লাগছিল। নতুন মা একদম তপুপিসির মতো করছে। কোনোরকমে হাসির দমক সামলে নতুন বউ বলল, ঘটি ঘটি ঘটি, বাঙাল চললে চটি। তার পরেই হঠাৎ গলার স্বর পালটে প্রশ্ন করল, তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ, না?
মাথা নিচু করল অনি। সেই রাত্রে বাড়িতে ফিরে বারান্দায় দাঁড়ানো সরিৎশেখরকে সে রেগেমেগে যেসব কথা বলেছিল তা কি বাবা জানেন?বাবা জানলেই নতুন বউ জানবে। পিসিমা তো কোনোদিন অনির সঙ্গে ও-বাপরে কথা বলেননি। কিন্তু অনি জানে পিসিমা সব শুনেছিলেন আবার কেউ-এর দিকে ও পূর্ণচোখে তাকাল। শরীর দেখে খুব বড় বলে একদম মনে হয় না। একটুও ভারিকি দেখাচ্ছে না, কিন্তু এখন যেভাবে ঠোঁট টিপে হাসছে চট করে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। অনি বলল, আমি তোমাকে চিনি না, খামোকা রাগ করতে যাব কেন?
এক হাতে পায়েসের বাটিটা তখনও ধরা, অন্য হাত অনির চেয়ারের পেছনে রাখল নতুন বউ, আমাকে তুমি কী বলে ডাকবে?
একটু ভেবে অনি বলল, তুমি বলো।
তোমাকে কেউ বলে দেয়নি?
হুঁ বলেছে। পিসিমা বলেছে নতুন মা বলতে।
খুব ফিসফিস করে শব্দটা উচ্চারিত হতে শুনল অনি।
তোমার নতুন মা বলে ডাকতে ভালো লাগবে তো?
অনির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কথাবার্তাগুলো এমনভাবে হচ্ছে যে, অন্য একটা অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল সে।
অনি, আমাকে তুমি ছোটমা বলে ডাকবে? আমি তো চিরকাল নতুন থাকতে পারব না!
ঘাড় নাড়ল অনি। নতুন মার চেয়ে ছোটমা অনেক ভালো। মায়ের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন ছোটমা বলা।
তাহলে এই পায়েসটা খেয়ে ফ্যালো। চামচটা এগিয়ে দিল ছোটমা।
হেসে ফেলল অনিমেষ, যদি না খাই?
কপট নিশ্বাস ফেলল ছোটমা, কী আর করা যাবে। ভাবব আমার কপাল এইরকম। তোমাকে তো আর বকতে পারব না।
কেন? মায়েরা তো বকে।
ঘাড় নাড়ল অনি, ওর খুব মজা লাগছিল।
বন্ধু হলে কিন্তু সব কথা শুনতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়। আমার আজ অবধি একটাও বন্ধু ছিল। তুমি আমার বন্ধু হলে।
হাত বাড়িয়ে চামচটা ধরল সে, পুরু সরের চাদর কেটে এক চামচ পায়েস তুলে মুখে পুরতে পুরতে জিজ্ঞাসা করল, তুমি পেয়েছ?
একগাল হেসে ছোটমা বলল, কেন?
পিসিমা দারুণ পায়েস রাঁধে, খেয়ে দেখো। নিশ্চিত বিশ্বাসে বলল অনি, মাও এত ভালো পারত না।