What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনি দেখল দরজাটা খুলে গেল, এক হাতে বাটি নিয়ে নতুন মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতে মুখ নিচু করল অনি। এ–ঘরে কেন এসেছে নতুন মা? ও তো কাউকে বিরক্ত করতে যায়নি। যেন কিছুই দেখেনি এইরকম ভঙ্গি করে অনি সামনে খুলে-রাখা একটা বই-এর দিকে চেয়ে থাকল।

পায়েসটা খেয়ে নাও। বড়দের মতন নয়, একদম ওদের মতো গলায় কথাটা শুনতে পেল অনি। অবাক হয়ে তাকাল ও। পায়েস খেতে ওর খুব ভালো লাগে কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি রান্নাঘরের বাইরে ভাতের সকড়ি এ-বাড়িতে কাউকে আনতে দেখেনি। পিসিমা এ-ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। জামাকাপড় না ছেড়ে পায়খানায় গেলে চিৎকার করে পাড়ামাত করে দেন। পায়েস শোয়ার ঘরে বসে কেতে দেবেন, এ একেবারেই অবিশ্বাস্য। হয় পিসিমা জানেন না, নতুন মা না বলে নিয়ে এসেছে। উলটো ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না অনিমেষের। খুব আস্তে ও বলল, আমি শোবার ঘরে পায়েস খাই না।

থতমত হয়ে গেল নতুন বউ। কথাটা ওর একদম খেয়াল হয়নি, আসার সময় দিদিও বলে দেয়নি। এইটুকুনি ছেলে যে এতটা বিচক্ষণের মতো কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি সে, শুনে লজ্জা এবং অস্বস্তি হল। মাথায় বেশ লম্বা ছেলেটা, গড়ন অবিকল মহীতোষের মত। মুখটা খুব মিষ্টি, চিবুকের কাছে এমন একটা ভাঁজ আছে যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। এই ছেলে, এত বড় ছেলের মা হতে হবে, বরং দিদি হতে পারলে ও সবচেয়ে খুশি হত।

চেষ্টা করে হাসল নতুন বউ, তারপর ঘরটা দেখতে দেখতে অনির পাশে এসে দাঁড়াল, ঠিক বলেছ, আমার ছাই মাথার ঠিক নেই। যেই শুনলাম তুমি পায়েস খেতে ভালোবাস নিয়ে চলে এলাম। একবারও মনে হল না যে এটা রান্নাঘর না, এখানে সকড়ি চলে না। তা এসেছি যখন তখন এক কাজ করা যাক, আমি হাতে ধরে থাকি তুমি চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাও। পায়েসে গাঁথা চামচসুদ্ধ বাটিটা আনির সামনে ধরল নতুন বউ। সেদিকে তাকিয়ে অনির জিভে জল প্রায় এসে গেল, কী পুরু সর পড়েছে। কিন্তু কেউ বাটি ধরে থাকবে আর তা থেকে ও খাবে এরকম কোনোদিন হয়নি। হঠাৎ ও নতুন বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বাঙাল, না?

হকচকিয়ে গেল নতুন বউ, মানে?

পায়েসের দিকে তাকিয়ে অনি বলল, পিসিমা বলেন, বাঙালরা সকড়ি-কড়ি মানে না!

খিলখিল করে হেসে ফেলল নতুন বউ। হাসির দমকে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম সে বিয়ের আগের মতো হাসতে পারছে। অনির খুব মজা লাগছিল। নতুন মা একদম তপুপিসির মতো করছে। কোনোরকমে হাসির দমক সামলে নতুন বউ বলল, ঘটি ঘটি ঘটি, বাঙাল চললে চটি। তার পরেই হঠাৎ গলার স্বর পালটে প্রশ্ন করল, তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ, না?

মাথা নিচু করল অনি। সেই রাত্রে বাড়িতে ফিরে বারান্দায় দাঁড়ানো সরিৎশেখরকে সে রেগেমেগে যেসব কথা বলেছিল তা কি বাবা জানেন?বাবা জানলেই নতুন বউ জানবে। পিসিমা তো কোনোদিন অনির সঙ্গে ও-বাপরে কথা বলেননি। কিন্তু অনি জানে পিসিমা সব শুনেছিলেন আবার কেউ-এর দিকে ও পূর্ণচোখে তাকাল। শরীর দেখে খুব বড় বলে একদম মনে হয় না। একটুও ভারিকি দেখাচ্ছে না, কিন্তু এখন যেভাবে ঠোঁট টিপে হাসছে চট করে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। অনি বলল, আমি তোমাকে চিনি না, খামোকা রাগ করতে যাব কেন?

এক হাতে পায়েসের বাটিটা তখনও ধরা, অন্য হাত অনির চেয়ারের পেছনে রাখল নতুন বউ, আমাকে তুমি কী বলে ডাকবে?

একটু ভেবে অনি বলল, তুমি বলো।

তোমাকে কেউ বলে দেয়নি?

হুঁ বলেছে। পিসিমা বলেছে নতুন মা বলতে।

খুব ফিসফিস করে শব্দটা উচ্চারিত হতে শুনল অনি।

তোমার নতুন মা বলে ডাকতে ভালো লাগবে তো?

অনির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কথাবার্তাগুলো এমনভাবে হচ্ছে যে, অন্য একটা অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল সে।

অনি, আমাকে তুমি ছোটমা বলে ডাকবে? আমি তো চিরকাল নতুন থাকতে পারব না!

ঘাড় নাড়ল অনি। নতুন মার চেয়ে ছোটমা অনেক ভালো। মায়ের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন ছোটমা বলা।

তাহলে এই পায়েসটা খেয়ে ফ্যালো। চামচটা এগিয়ে দিল ছোটমা।

হেসে ফেলল অনিমেষ, যদি না খাই?

কপট নিশ্বাস ফেলল ছোটমা, কী আর করা যাবে। ভাবব আমার কপাল এইরকম। তোমাকে তো আর বকতে পারব না।

কেন? মায়েরা তো বকে।

ঘাড় নাড়ল অনি, ওর খুব মজা লাগছিল।

বন্ধু হলে কিন্তু সব কথা শুনতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়। আমার আজ অবধি একটাও বন্ধু ছিল। তুমি আমার বন্ধু হলে।

হাত বাড়িয়ে চামচটা ধরল সে, পুরু সরের চাদর কেটে এক চামচ পায়েস তুলে মুখে পুরতে পুরতে জিজ্ঞাসা করল, তুমি পেয়েছ?

একগাল হেসে ছোটমা বলল, কেন?

পিসিমা দারুণ পায়েস রাঁধে, খেয়ে দেখো। নিশ্চিত বিশ্বাসে বলল অনি, মাও এত ভালো পারত না।
 
নতুন বউ-এর সঙ্গে অনির ভাব হয়ে গিয়েছে জানতে পেরে মহীতোষ সবচেয়ে খুশি হলেন। হেমলতার মনটা ব্যবহারে বোঝা যায়, নতুন বউ-এর ওপর তার টেনে বেড়ে গেছে। সরিৎশেখরকে চট করে বোঝা মুশকিল। হেমলতা দুপুরে খাওয়ার সময় পাখার হাওয়া করতে করতে অনেকবার নতুন বউ-এর সঙ্গে অনির ভাবের কথা তুলেছেন। সরিৎশেখর হা-না করেননি। চিরকালেই আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তার একটা আড়াল-রাখা সম্পর্ক আছে, মনে কী হচ্ছে বোঝা যায় না। মহীতোষের বিয়ের রাত থেকে এ-ব্যাপারে একটা কথাও তার মুখ থেকে বের হয়নি।

এবার মহীতোষরা ফিরে যাবার পর বেশ কিছুদিন আসতে পারলেন না। চা-পাতা তোলা হচ্ছে। এখন ফ্যাক্টরিতে দিনরাত মেশিন চলছে। রবিবারেও সময়-অসময়ে ডাক পড়ে। এখন স্বৰ্গছেঁড়া ছেড়ে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর অনির স্কুল এখন ছুটি। কিন্তু নতুন স্যার ওদের প্রত্যেকদিন স্কুলে যেতে বলেছেন। রোজ দুটো থেকে স্কুলের মাঠে মহড়া হচ্ছে। ছাব্বিশে জানুয়ারি আসছে। নতুন স্যার বলেছেন, আমরা জন্মেছি পনেরোই আগস্ট আর আমাদের অন্নপ্রাশন হবে ছাব্বিশে জানুয়ারি।

ঠিক এই সময় এক অনি সেজেগুঁজে বেরুচ্ছে, ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে গেল। শীতের এই দুপুরে পশ্চিমে সূর্য চলে গেলে সরিৎশেখর পেছন-বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে শুয়ে থাকেন রোদে গা। ড়ুবিয়ে। ডাকপিয়ন ওঁর হাতে চিঠিটা দিয়ে গেল। খামের উপর ঠিকানা পড়ে তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, দাদুভাই তোমার চিঠি।

ভেতরের কলতলায় বাসন মাজছিলেন হেমলতা। এখনও মান হয়নি তার, জল লেগে পায়ের হাজা জ্বলছে, বারবার চিৎকার শুনে হাত থামিয়ে বললেন, ওমা, অনিকে আবার কে চিঠি দিল!

ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল অনিমেষ। আজ অবধি তাকে কেউ চিঠি দেয়নি। চিঠি দেবার মতো বন্ধু তার কেউ নেই।

অবশ্য ওর ঠিকানা স্কুলের অনেকের কাছে আছে। স্কুল বন্ধ হবার সময় যারা বাইরে যায় তারা পছন্দমতো ছেলের ঠিকানা নিয়ে যায়। কিন্তু কোনোবার চিঠি দেয়নি কেউ তাকে। বিশু আর বাপী যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। ওরা কোনোদিন তাকে চিঠি দেয়নি। বেশ একটা উত্তেজনা বুকের ভেতর নিয়ে অনিমেষ বারান্দায় দাদুর কাছে গেল। ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন সরিৎশেখর, এক হাত ওপরদিকে ভোলা, তাতে একটা মোটা নীল খাম ধরা। খামটা নিয়ে একছুটে ভিতরে চলে এল ও এদিক-ওদিক চেয়ে সোজা বাগানে নেমে গেল। সুপারিগাছে বসে একজোড়া ঘুঘু সামনে ডেকে যাচ্ছে। পেয়ারাতলায় এসে খামটা খুলতেই মিষ্টি একটা গন্ধ বেরুত। মার একটা খুব বড় সেন্টের শিশি ছিল। এই চিঠি যে লিখেছে সেও কি সেই সেন্ট মাখে! খামের ওপর লেখাটা দেখল ও। গোটা-গোটা মুক্তোর মতো অক্ষরে তার নাম লেখা দাদুর কোর অফে। নীল আকাশের চেয়ে নীল খামটা সন্তর্পণে খুলতেই ভাঁজ করা কাগজ হাতে উঠে এল। চিঠি বুক চিরে চারটে ভজের রেখা চারদিকে চলে গিয়েছে। চিঠির তলায় চোখ রাখল অনি, আমার স্নেহাশিস জানিও। ইতি, আশীর্বদিকা, তোমার ছোটমা। উত্তেজনাটা হঠাৎ কমে এল অনির। জানা হয়ে গেলে কোনোকিছু আশীবাদিকা, তোমার ছোটমা। উত্তেজনাটা হঠাৎ কমে এল অনির। জানা হয়ে গেলে কোনোকিছু নতুন থাকে না। উত্তেজনার জায়গায় কৌতূহল এসে জুড়ে বসল। চিঠিটা পড়ল সে, স্নেহের অনি। এই পত্র পাইয়া নিশ্চয়ই খুব অবাক হইয়াছ। এখানে আসিয়া শুধু তোমার কথা মনে পড়িতেছে। তুমি নিশ্চয় জান এই সময় তোমার পিতার চাকরিতে ছুটি থাকে না, তাই আমাদের জলপাইগুড়ি যাওয়া হইতেছে না। তাই বলি কি, তোমার যখন পাশের পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে তখন আমার নিকট চলিয়া আসিও। এখন তো আমরা বন্ধু, বন্ধুর নিকট বন্ধু আসিবে না?

তোমাকে লইয়া আমি নদীর ধারে বেড়াইব। শুনিয়াছি নদী বন্ধ হইবে, উহা কী জিনিস আমি জানি না। কুলগাছে প্রচুর কুল ধরিয়াছে। তুমি জানিয়া খুশি হইবে কালীগাই-এর একটি নাতনি হইয়াছে। রং সাদা বলিয়া নাম রাখিয়াছি ধবলি। বাড়িতে এখন এত দুধ হইতেছে যে খাইবার লোক নাই। তুমি আসলে আমি তোমাকে যত ইচ্ছা পায়েস খাওয়াইব। জানি দিদির মতো ভালো হইবে না।
 
গতকাল এখানকার স্কুলের ভবানী মাস্টার আমাদের বাড়িতে আসিয়াছিলেন। তোমাদের স্কুল এই বৎসর হইতে নতুন বাড়িতে উঠিয়া যাইতেছে। ভবানী মাস্টারের ইচ্ছা তুমি অবশ্যই আগামী ছাব্বিশে জানুয়ারি এখানে থাক। কারণ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রথম পতাকা তুমি উত্তোলন করিয়াছিলে। ছাব্বিশে জানুয়ারিতেও সেই কাজটি তোমাকে দিয়া তিনি করাইতে চান। শুনিলাম এই বৎসরই তিনি অবসর লইয়া দেশে যাইবেন।

তোমার পিতা পরে পত্র দিতেছেন, দিদিকে বলিও। গুরুজনদের আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম দিলাম। তুমি আমার স্নেহাশিস জানিও। ইতি, আশীর্বাদিকা, তোমার ছোটমা।

পুনশ্চ।। এ-জীবনে আমি কাহাকেও দুঃখ দিই নাই। অনি, তুমি কি আমাকে দুঃখ দিবে?

চিঠিটা পড়ে অনিমেষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন সেই ঘুঘু দুটোই শুধু নয়, একরাশ পাখি সমস্ত বাগান জুড়ে তারস্বরে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছ। চোখের সামনে স্বর্গহেঁড়ার গাছপালা মাঠ নদী যেন একছুটে চলে এল। সেই কাঁঠালগাছের ঝুপড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাল চিংড়িগুলো কিংবা সবুজ লালচের মতো বিছানো চা-গাছের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসা কুয়াশার দঙ্গল একটা নিশ্বাস হয়ে অনিমেষের বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।

ভবানী মাস্টার চলে যাবেন! একটা কথা মনে রাখবা বাবা, নিজের কাছে সৎ থাকলে জীবনে কোনো দুঃখই থাকে না। একটু ঘাম-জড়ানো নস্যির গন্ধ যেন বাতাসে ভেসে এল। স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবার যে ইচ্ছেটা মাধুরী চলে যাওয়ার পর একদম চলে গিয়েছিল সেটা হঠাৎ ঝুপঝুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মায়ের কথাটা ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা শীতল ছোঁয়া লাগল অনির। স্বৰ্গছেঁড়ায় গেলে সবাইকে দেখতে পাবে ও, শুধু মা নেই। তার জায়গায় ছোটমা সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিয়ের পর হেমলতা রাগ করে বলেছিলেন, দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? মা হল মা, সত্য সৎমাই। আচ্ছা, সত্য বলে কেন? সৎ মানে তো ভালো, ভালো মা-রা আবার খারাপ হবে কী করে! কিন্তু ছোটমাকে তো মায়ের মতো মনেই হয় না, বরং দিদির মতো নিজের মনে হয়। সত্যরা নাকি খুব অত্যাচার কার। ছোটমাকে দেখে, এই চিঠি পড়ে, কেউ সে কথা বললে অনি তাকে মিথ্যক বলবে। এখানে। ছোটমাকে তার ভালো লেগেছে, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ায় গেলে মাকে মনে পড়বেই, তখন ছোটমাকে–। অনির মনের হল বাবাকে যদি সে জিজ্ঞাসা করতে পার, মাকে ভুলে গেছে কি না। কিন্তু তবু স্বৰ্গছেঁড়ায়। যাবার জন্যে বুকের মধ্যে যে–ছটফটানি শুরু হয়ে গেছে সেটা যাচ্ছে না। নতুন স্যার বলেছিলেন, মা নেই কে বলল? জন্মভূমিই তো আমাদের মা। বন্দেমাতরম্। শব্দটা উচ্চাণ করলেই শরীর গরম হয়ে ওঠে। তখন আর কারও মুখ মনে পড়ে না ওর। পেয়রাগাছের তলায় পায়চারি করতে করতে ও নিচগলায় আবৃত্তি করতে লাগল, আমরা অন্য মা জানি না-জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই-আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়সীমরণ শীতলা, শস্যশ্যামলা-। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল অনি। একদৃষ্টে ও মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পেয়ারাগাছের তলায় ছোট ছোট ঘাসের ফাঁকে কালো মাটি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই মাটিটাকে চেনা যাচ্ছে না আর। সেই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে চলে আসার দিন ও কুমালে করে লুকিয়ে একমুঠো মাটি এনে পেয়ারাগাছের তলায় রেখে দিয়েছিল। যখনই মন-খারাপ করত তখনই এসে মাটিটাকে দেখত, মাটিটা দেখা মানে স্বৰ্গছেঁড়াকে দেখা। তারপর একসময় ভুলে গিয়েছিল সেই মাটির কথা। এতদিন ধরে কত বৃষ্টি গেল, প্রতি বছরের বা গেল। এখন আর কাউকে আলাদা করে চেনা যাবে না। মাটিদের চেহারা কেমন এক হয়ে যায়। মামাদের মা নাই, বাপ নাই, আমাদের জন্মভূমি আছে। চিঠিটা পকেটে রাখতে অনি ঠিক করল এখন ও স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবে না।
 
এবারও অনি ভালো রেজাল্ট করে নতুন ক্লাসে উঠল। তবে প্রথম তিনজনের মধ্যে ও জায়গা পাচ্ছে না, সরিৎশেখর ওর প্রগ্রেস রিপোর্ট দেখেছেন, অঙ্কে ও খুব কম নম্বর পাচ্ছে। মহীতোষ চাইছেন, স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাইকে বাড়িতে শিক্ষক হিসেবে রাখতে, কিন্তু অনির এক গোঁ-নতুন স্যার ছাড়া ও কারও কাছে পড়বে না। সরিৎশেখর নতুন স্যার নিশীথ সেনের সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছেন। ভদ্রলোক বাংলার শিক্ষক, টিউশনি করেন না, তা ছাড়া ইদানীং জলপাইগুড়ির একটি দলের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগের কথা সবাই জানে। নিজে সারাজীবন কংগ্রেসকে সমর্থন করেছেন সরিৎশেখর, কিন্তু সেট দূর থেকে। জলপাইগুড়িতে আসার পর সকাল-বিকাল বাইরে বেরিয়ে স্থানীয় নেতাদের যে চেহারা দেখেছেন তাতে এখানকার পলিটিকস ঠিক কী জিনিস তিনি বুঝতে পারছেন না। এই সেদিন বাজারে যাবার সময় দিনবাজার পোস্টঅফিসের সামনে দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি দেখা, দুজনেই খদ্দর পরেছেন, একজনের মাথায় গান্ধীটুপি। টুপিহীন লোকটিকে যেন কোথায় দেখেছেন একথা মনে হতে ওরা এসে তার সঙ্গে আলাপ করলেন। টুপি-পরা লোকটি বললেন, নমস্কার, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।

সরিৎশেখর বললেন, আমার কাছে?

হ্যাঁ। আপনি তো স্বৰ্গছেঁড়া টি-এস্টেটের বড়বাবু?

একদিন ছিলাম।

আপনি আমাকে চেনেন না। আমি বনবিহারী সেন, মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনের সময় কংগ্রেসের হয়ে আপনার কাছেই দাবি জানাতে যেতাম, হা হা হ্যাঁ। প্রাণ খুলে হাঁসলেন ভদ্রলোক।

দাবি কেন বলছেন, কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য। সরিৎশেখর খুব সৎ গলায় বললেন।

ভালো ভালো। কিন্তু জানেন, এত কষ্টে স্বাধীনতা এনে দিলাম তবু দেশের লোকজন আমাদের প্রাপ্য সম্মানটা দিতে চায় না। আচ্ছা, আপনার একটি ছেলে শুনেছি কমিউনিস্ট, কী নাম যেন

বনবিহারীবাবু পাশের লোকটির দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, প্রিয়তোষ।

বনবিহারীবাবু ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ, সে ফিরেছে। পুলিশ কিন্তু ওয়ারেন্ট উইথড্র করে নিয়েছে। আসলে আমরা কারও সঙ্গে শক্তভাবে থাকতে চাই না। ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

সরিৎশেখর বললেন, এ-ছেলের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে উষ্ণু গলায় বনবিহারীবাবু চিৎকার করে উঠলেন, এই তো, এই যে আদর্শের কথা বললেন সমস্ত দেশবাসীর তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আপনার মতো লোকই তো এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। হ্যাঁ, আপনার কাছে কেন যাচ্ছিলাম, বলি।

পাশের লোকটি বললেন, এসব কথা ওঁর বাড়িতে গিয়ে বললে হত না?

বনবিহারীবাবু ঘাড় নাড়লেন, আরে না না হল ধর, ইনি হরেন আমাদের ঘরের লোক, এর সঙ্গে অত ভদ্রতা না করলেও চলবে। হ্যাঁ, সরিৎবাবু, আপনি তো জানেন ছাব্বিশে জানুয়ারি আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস। তা এই দিনটিকে সার্থক করে তোলার জন্য আমরা একটা বিরাট পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। চাঁদমারির মাঠে ঐতিহাসিক জমায়েত হবে, কলকাতা থেকে নেতারা আসবেন, কিন্তু আমাদের স্থানীয় অফিসে বসে এতবড় ব্যাপারটা অর্গানাইজ করা যাবে না। আমাদের ইচ্ছা আপনার বিরাট বাড়িটা তো পড়েই আছে, ওটা আমরা সাময়িকভাবে অফিস হিসেবে ব্যবহার করি। আপনি কী বলেন?

থতমত হয়ে গেলেন সরিৎশেখর, কিন্তু আমার বাড়ি তো খুব বড় নয়। তা ছাড়া, বাড়ি ভাড়ার কথা–।

আমি জানি আপনি ভাড়া দেবেন না, আর সেটা দিয়ে আপনাকে অপমান করব না। আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। প্রকৃত দেশসেবী হিসেবে এটা আপনার কাছে নিশ্চয়ই আশা করতে পারি। বনবিহারীবাবু রুমালে নাক মুছলেন।

মুহূর্তেই সরিৎশেখর চিন্তা করে নিলেন। পার্টি অফিস করতে দিলে বাড়িটার হাল কয়েক দিনেই যা হবে অনুমান করা শক্ত নয়। এত সাধের তৈরি বাড়িতে পাঁচ ভূতে আড্ডা জমাবে, প্রাণ ধরে সহ্য। করতে পারবেন না তিনি। হোক সেটা কংগ্রেসের অফিস, এ-ব্যাপারে তাঁর কোনো দুর্বলতা নেই। এবাড়ি তার ছেলের মতো, অসময়ে দেখবে, তাকে বকে যেতে দিতে পারেন না তিনি। বনবিহারীবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না আমি অ্যাকটিভ পলিটিকস্ কোনোদিন করতাম না। তবে দূর থেকে কংগ্রেসকে সমর্থন করে এসেছি। আমার ভূমিকা আজও একই। আপনাদের এই প্রজাতন্ত্র দিবসের কর্মযজ্ঞে দূর থেকে সমর্থন জানিয়ে যাব। আচ্ছা, নমস্কার–।

সরিৎশেখরকে হাঁটতে দেখে বনবিহারীবাবু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন প্রথমটা, তারপর কোনোরকমে বললেন, কিন্তু আমি যে নিশীথের কাছে শুনেছিলাম–

ঘুরে দাঁড়ালেন সরিৎশেখর, কে নিশীথ?

জিলা স্কুলের চিটার নিশীথ সেন।

কী বলেছে সে?

নিশীথ বলল, আপনারা কংগ্রেসের সাপোর্টার। আপনার এক নাতি যে জেলা স্কুলে পড়ে, সে নিশীথের কংগ্রেসিজমের প্রচণ্ড ভক্ত। নিশীথ তাকে গড়েপিঠে তৈরি করছে, তারও ই আপনার বাড়িতেই কংগ্রেস অফিস হোক। আমি কি তা ভুল রিপোর্টেড হলধর? তুমি তো সেই সাপ্লাইয়ারের কাজ করা থেকে সরিত্বাবুকে চেনা সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত বনবিহাববাবু প্রশ্নটা কলেন।
 
এতক্ষণে টুপিহীন লোকটিকে চিনতে পারলেন সরিৎশেখর। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের একজন ফায়ারউড সাপ্লায়ারের হয়ে এই লোকটি মাঝে-মাঝে অফিসে যেত। মাল না দিয়েও সাপ্লাই হয়েছে বলে চেষ্টা করার জন্য সাপ্লায়ারে কন্ট্রাক্ট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সরিৎশেখর তখন শুনেছিলেন এই লোকটিই নাকি সেজন্য দায়ী। হলধর বলল, নিশীথ তো মিথ্যে কথা বলবে না আপনাকে।

সরিৎশেখর হাসলেন, আমার নাতিকে আমার চেয়ে সেই ভদ্রলোক দেখছি বেশি চিনে গেছেন। ভালো ভালো। আচ্ছা চলি। আর দাঁড়ালেন না তিনি।

বাজার থেকে ফিরে সরিৎশেখর সোজা অনির ঘরে এলেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসে অনি, সরিৎশেখর ঘর দেখে খুশি হলেন। নিজের জামাকাপড় ও নিজেই কাছে, হেমলতা ইস্ত্রি করে দেন। কিন্তু বই-এর টেবিল দেখে বিরক্ত হলেন সরিৎশেখর, সব স্তুপ হয়ে পড়ে আছে। পড়ার টেবিলে বসে অনি তখন ছবি আঁকছিল, দাদুকে দেখে সেটা চাপা দিল। সচরাচর এই ঘরে সরিৎশেখর আসেন না, দরকারে অনিই তার কাছে যায়।

সরিৎশেখর বললেন, নতুন বইগুলোর এই অবস্থা কেন, সাজিয়ে রাখতে পার না? বুকলিস্ট পাবার পর সদ্য কেনা হয়েছে বইগুলো। ওর ওপর একটা পুরনো বই দেখে হাতে তুলে নিলেন সরিৎশেখর, বঙ্কিমবাবুর আনন্দমঠ। পাতা উলটে দেখলেন, বেশির ভাগ জায়গায় লাল পেন্সিলে আন্ডারলাইন করা আছে। নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি, এই বই কোথায় পেলে?

অনি বলল, নতুন স্যারের কাছ থেকে এনেছি।

পড়েছ?

ঘাড় নাড়ল অনি, যা, আমার অনেকটা মুখস্থ হয়ে গেছে। ধরবে?

কেন মুখস্থ করলে?

প্রশ্নটা যেন আশা করেনি অনি, একটু থেমে বলল, আমার ভালো লাগে।

নাতির দিকে ভালো করে তাকারেন সরিৎশেখর। হঠাৎ ওঁর মনে হল অনি আর সেই ছোটটি নেই। জলপড়া গাছের মতো হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে অনেকখানি উঠে এসেছে। প্রতিদিন দেখতে দেখতে এই বড়-হয়ে-ওঠা ব্যাপারটা তিনি টের পাননি। এমনকি গলার স্বর পর্যন্ত পালটে যাচ্ছে ওর।

সরিৎশেখর বললেন, নতুন স্যার তোমাকে কী বলেছেন একটু শুনি।

অনি দাদুর দিকে তাকাল, কী কথা?

সরিৎশেখর বললেন, এই দেশের কথা, কংগ্রেসের কথা।

অনি হাসল, নতুন স্যার আমাকে খুব ভালোবাসেন দাদু। বলেন, তোমার মতো সিরিয়াস ছেলে এই স্কুলে আর কেউ নেই।

সরিৎশেখর বললেন, আচ্ছা! খুব ভালো।

অনি যেন উজ্জীবিত হল কথাটা শুনে, পরিশ্রম, আত্মদান আর ইতিহাস ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে না। আমাদের এই দেশ স্বাধীন হয়েছে একমাত্র কংগ্রেসের ওইসব গুণ চিল বলে। তা ছাড়া যে-কোনো জাতির যদি উপযুক্ত নেতা না থাকে সে-জাতি দেশ শাসন করতে পারে না। আমাদের পণ্ডিত নেহরু হলেন সেইরকম এক নেতা।

চোখ বন্ধ করলেন সরিৎশেখর। কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। এখন রাস্তাঘাটে যেসব ছেলেকে দেখেন তাদের থেকে অনি আলাদা। কিন্তু ওর নিশীথ সেন এইসব ব্যাপার ওর মাথায় ঢুকিয়ে ভালো করছে না খারাপ কমছে বোঝা যাচ্ছে না।

তুমি কি নতুন স্যারকে বলেছ যে, এই বাড়িতে কংগ্রেস অফিস হলে আমার আপত্তি হবে না? গীর গলায় প্রশ্নটা করলেন তিনি।

দাদুর গলার স্বর শুনে অনি চট করে মাথাটা নিচু করে ফেলল। নতুন স্যার যখন বলেছিলেন, ছাব্বিশে জানুয়ারি প্রিপারেশনের জন্য বড় বাড়ি চাই তখন ও এই কথাটা বলেছিল। তাদের বাড়িতে কংগ্রেস অফিস হরে বড় বড় নেতা এখানে আসবেন, তাদের দেখতে পাবে অনি-এটা ভাবতেই কেমন লাগছিল। খুব সন্তর্পণ মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ।

সরিৎশেখর এতটা আশা করেননি। তাঁর খুব বিশ্বাস ছিল নিশীথ সেন নিয়ে বানিয়ে কথাটা বলছে। হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল ওর, গলা চড়িয়ে বললেন, কিসে আমার আপত্তি আছে আর কিসে নেই-একথা তুমি জানলে কী করে?
 
দাদুর গলা সমস্ত ঘরে গমগম করছে এখন। খুব অবাক হয়ে অনি দাদুর দিকে তাকাল। এইরকম মুখ নিয়ে দাদ কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলেননি। অসহায় ভঙ্গিতে ও বলল, কিন্তু তুমি তো কংগ্রেসি। দেশবন্ধু, সুভাষ বোস, মহাত্মা গান্ধীর কথা তুমি তো বলতে। তাই আমি ভাবলাম

হঠাৎ হাত বাড়িয়ে নাতির কান ধরলেন সরিৎশেখর। উত্তেজনায় তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপছিল, ভীষণ পেকে গেছ তুমি। আমি কংগ্রেসি তোমাকে কখনো বলেছি। মহাত্মা গান্ধী একসময় কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুভাষ বোসকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এসব খবর নতুন স্যার বলেছে টকটকে লাল কানটাকে এবার ছেড়ে দিরেন সরিৎশেখর, মানুষের ইতিহাস দিয়ে মানুষকে বিচার করি না। আমি, একটা মানুষ কীরকর্ম সেটা তার বর্তমান দেখেই বোঝা যায়। স্বাধীনতার আগে আমরা যা ছিলাম, এই তো তিন বছর চলে গেল প্রায়, কতটুকু এগিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস দেশটাকে? শেষের কথাটা নাতিকে ধমকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

কানের ব্যথায় এবং সহসা দাদুর এই নতুন চেহারাটা দেখতে পেয়ে অনি কেঁদে ফেলল এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল, নতুন স্যার বলেছেন রাতারাতি দেশ তৈরি যায় না।

পঁচিশ বছরেও পারবে না। সব নিজের পকেট ভরার ধান্ধায় রয়েছে, দেশটা উচ্ছনে গেলে ওদের লাভ! সে-কংগ্রেস আর এই কংগ্রেস এক নয়। আটচল্লিশ সালের তিরিশে জানুয়ারি গান্ধীজির সঙ্গে সে-কংগ্রেস মরে গেছে। এতক্ষণে সরিৎশেখরের খেয়াল হল একটি নাবালকের কাছে এসব কী বলে যাচ্ছেন! বিদ্যাসাগরি চটিতে শব্দ করে বেরিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। ঘুরে নাতির দিকে তাকালেন। অনি এখন কাঁদছে না, হাঁ করে দাদুর দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল সরিৎশেখরের। জীবনে এই প্রথম তিনি অনির গায়ে হাত দিলেন। তার সারাজীবনে অনেক কঠোর কাজ তিনি করেছেন, কিন্তু এই নীতির ব্যাপারে তার মনের ভেতর যে-দুর্বলতা ওর জন্মমুহূর্ত থেকে এসেছিল তাকে সরাতে পারেননি কখনো। কিন্তু আজ যখন শুনলেন কে এক নিশীথ সেন ওকে গড়েপিটে তৈরি করছে তখন থেকে বুকের মধ্যে অভূত একটা ঈর্ষা বোধ করতে শুরু করেছেন তিনি। ছোট ছেলেরটা কখন তার অজান্তে রাজনীতির মধ্যে ঝাঁপিয়ে এখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর। ভবিষ্যৎ কী তিনি জানেন না। সে-রাজনীতি ব্যক্তিগতভাবে তিনি অপছন্দ করেন। কিন্তু সেটাও তাকে খুব বড় আঘাত দেয়নি। সহ্য হয়ে গেছে একসময়। এখন এই ছোট্ট কাদার তালটাকে যদি কেউ রাজনীতির আগুনে সেঁকে, তা হলে সহ্য করতে কষ্ট হবে বইকী।

অনির কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। আস্তে করে দুহাতে মুখটা ধরলেন, দাদু, তুমি তো এখন অনেক চোট, এসব কথা তোমার ভাববার সময় নয়। এখন তোমার কর্তব্য অধ্যয়ন করা। নিজের দেশের ইতিহাস পড়ে দেশকে প্রথমে জান, তারপর বড় হয়ে নিজের চোখে তার সঙ্গে দেশকে মিলিয়ে নিয়ে তবে স্থির করবে এসব করবে কি না।

অনি দাদুর এই পরিবর্তনে খুব খুশি হতে পারছিল না। সামনের দিকে মুখ তুলে সে বলল, কিন্তু নতুন স্যার বলেন, আমাদের কোনো ইতিহাস নেই। যা আছে তা ইংরেজদের লেখা।

সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সরিৎশেখর। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, শোনো, আমি চাই তুমি এসবের মধ্যে থাক। দাদুভাই, একটা কথা চিরকাল মনে রেখো, নিজে উপযুক্ত না হলে কোনো জিনিস গ্রহণ করা যায় না। আমি চাই তুমি ফার্স্ট ডিভিশন স্কুল থেকে বেরুবে। তার আগে তোমাক এসব কথা বলতে যেন না শুনি। আর হ্যাঁ, ওই নতুন স্যারের সঙ্গে বেশি মেলামেশা না। করলেই ভালো। সামনের মাস থেকে তোমাদের অঙ্কের মাস্টার বাড়িতে পড়াতে আসবেন।

হনহন করে বেরিয়ে যেতে-যেতে সরিৎশেখরের নিজেরই মনে হল, তিনি বৃথা এই শব্দগুলো ব্যবহার করলেন। বঙ্কিমাবাবু ঠিকই বলেছেন, এ যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবে কে? কিন্তু সেই তরঙ্গটাকে এরা দশ বছর বয়সেই চাপিয়ে দিল যে।
 
বন্দেমাতরম্ জেলা স্কুলের বিরাট মাঠ জুড়ে চিৎকারটা উঠে সমস্ত আকাশ ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় সাড়ে চারশ ছেলে তিনটে লাইনে ভাগে ভাগে মাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। প্রথম দিকে স্কাউটরা, পরে সমস্ত স্কুল। একটু আগে হেডমাস্টারমশাই ছাব্বিশে জানুয়ারির পতাকাটা তুললেন। লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে অনির মনে পড়ছিল স্বৰ্গছেঁড়ার কথা। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট পতাকা তোলার সময় তার কী অবস্থাটাই না হয়েছিল। প্রত্যেকটা ক্লাসের ছেলেদের সামনে একজন করে লিডার দাঁড়িয়ে। নতুন স্যার অনিকে ওর ক্লাসের লিডার ঠিক করেছেন। এই নিয়ে রিহার্সালের সময় থেকে মণ্টু ওর পেছনে লেগে আছে, নেহাত নতুন স্যারের জন্য কিছু বলতে পারছে না। আজকেও একটু আগে লাইনের দাঁড়িয়ে নেতাজির পিয়াজি বলে খেপাচ্ছিল। যেহেতু সে লিডার তাই মুখটা সামনে ফেরানো, ফলে মটুকে কিছু বলতে পারছে না। বন্দেমাতরম্ ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ওর গায়ে সেই কাঁটাটা আবার ফিরে এল। এমনকি দাদু যে অনেক গম্ভীরমুখে আজকের মিছিলে যেতে পারমিশন দিয়েছেন-সেকথাটা ভুলে গিয়েছিল। আজকাল দাদু যেন কেমন হয়ে গিয়েছেন।

হেডমাস্টারমশাই-এর বক্তৃতার পর নতুন স্যার মঞ্চে উঠলেন, এবার আমরা সবাই সুশৃখলভাবে মার্চ করে চাঁদামারির মাঠে যাব। তোমরা জান নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে বিশিষ্ট নেতারা সব সেখানে এসেছেন। তা ছাড়া সরকারের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত আছেন। আমরা স্কুলের তরফ থেকে সেই ঐতিহাসিক জমায়েতে যোগ দিয়ে পবিত্র কর্তব্য পালন করব।

স্কুলের সমস্ত মাস্টারমশাই এমনকি ওদের পাগল ড্রইং-স্যার অবধি সামনে হাঁটতে লাগলেন। সাড়ে চারশো ছেলে ভাগে ভাগে মাঠ ছেড়ে রাস্তায় নামল মার্চ করতে করতে। অনি একবার দেখতে পেল ক্লাস টেনের অরুণদার হাতে বিরাট জাতীয় পতাকাটা উড়ছে। অত বড় পতাকা নিয়ে অনি কখনোই সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না। অরুণদাকে খুব হিংসে হচ্ছিল ওর।

রাস্তায় পড়তেই গান শুরু হল। চল-চল-চল, উধ্ব গগনে বাজে মাদল। তালে তালে, এতদিনের রিহার্সাল মনে রেখে যখন সবাই গাইতে গাইতে পা ফেলছে তখন মানুষজন অবাক হয়ে ওদের দেখতে লাগল। টাউন ক্লাব মাঠের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ও দেখল রাস্তার দুপাশে ভিড়ের মধ্যে সরিৎশেখর দাঁড়িয়ে আছেন লাঠি-হাতে। হঠাৎ দাদুকে ভীষণ বুড়ো বলে মনে হল ওর। চোখচোখি হতে দাদু মাথা নেড়ে হাসলেন। তখন দ্বিতীয় গানের মাঝামাঝি জায়গায় এসে গিয়েছে। অনি দাদুর দিকে চেয়ে লাইনটা সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইল সপ্তকোটিকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে দ্বিসপ্তকোটিভুজৈধৃত-করকরলে অবলা কেন মা এত বলে।

করলা নদীর কাঠের পুলটা পেরিয়ে পোস্টঅফিসের সামনে দিয়ে ওদের মিছিলটা এঁকেবেঁকে গাইতে গাইতে এগোতেই ওরা দেখতে পেল এফ. ডি. আই. থেকে ছেলেরা বেরুচ্ছে। এফ. ডি. আই-এর সঙ্গে জেলা স্কুলের চিরকালের প্রতিদ্বন্দিতা, খেলাধুলায় ওদের কাছে হেরে গেলেও পড়াশুনায় জেলা স্কুল ওদের থেকে এগিয়ে থাকে প্রতিবার। এফ. ডি. আই-এর ছেলেদের দেখে চিকারটা যেন হঠাত্ব বেড়ে গেল। হঠাৎ মণ্ট চেঁচিয়ে বলল, অনিমেষ, ওদের রাস্তা ছাড়িস না, আমরা আড়ে বেরিয়ে যাব। ওদের রাস্তা জুড়ে চলতে দেখে অসহায় হয়ে এফ. ডি. আই.-এর ছেলেরা অপেক্ষা করতে লাগল।
 
চাঁদমারির মাঠে তিলধারণের জায়গা নেই। সামনের দিকে ওরা যেতে পারল না। স্কাউট ড্রিল-স্যারের সঙ্গে অন্যদিকে চলে গেল। পুলিশ, স্কাউট, গার্লস গাইড পতাকাকে অভিবাদন জানাল। চাঁদমারি গায়ে বিরাট মঞ্চ তৈরি হয়েছে। মণ্টু বলল, চল সামনে যাই, এখান থেকে কিছুই দেখতে পাব না। ভিড় ঠেলে সামনে যাওয়া সোজা কথা নয়, অনির মাঝে-মাঝে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ভিড়ের চাপে। শেষ পর্যন্ত ওরা একদম মঞ্চের সামনে যখন এসে দাঁড়াল তখন সমস্ত শরীর এই শেষ-জানুয়ারি সকালেও প্রায় ঘেমে উঠেছে। অনি দেখল বিরাট মঞ্চের ওপর নেতারা বসে আছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন বিরাট লোক, যার ছবি প্রায়ই কাগজে বের হয়, অনি তাকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পাশেই পুলিশ ব্যান্ডে ধনধান্যেপুষ্পেভরা বাজছে। মণ্টু বলল, আমি এরকম কখনো দেখিনি।

অনি হাসল, কী করে দেখবি, প্রজাতন্ত্র দিবস তো এর আগে আসেনি।

একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। প্রথমে পায়ে পায়ে বিরাট পুলিশবাহিনী:মার্চ করে এসে পতাকাকে স্যালুট করে গেল। পেছনের ব্যান্ডের তালে তালে ওদের পা পড়ছিল। স্কাউট আর গার্লস গাউডদের যবার সময় মাঝে-মাঝে হাসি শোনা যাচ্ছে জনতার মধ্যে থেকে। একটি মোটা মেয়ে ঠিক সোজা বিরাট ব্যক্তিটি কপালে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন তখন থেকে। অনি বুঝতে পারছিল ওঁর হাত ব্যথা করছে। এর পরেই বন্দে-এ-এ মাতরম্ ধ্বনি দিতে দিতে কংগ্রেসের ফ্ল্যাগ নিয়ে নেতারা এগিয়ে এলেন অভিবাদন জানাতে। সেই চিৎকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জনতার মধ্যে কেউ-কেউ বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিল। অনির সমস্ত শরীর এখন অদ্ভুত উত্তেজনা তিরতির করে ওঠানামা করছে। আর সেই সময় ঘটে গেল ব্যাপারটা।

কংগ্রেসের লোকজন যখন প্রায় মঞ্চের সামনে এসে পড়েছেন ঠিক তখনই আট-নটি যুবক দৌড়ে জনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে মঞ্চের কাছাকাছি চলে গেল। ওদের হোটার ভঙ্গিতে এমন একটা তৎপরতা ছিল যে জনতা এমনকি মার্চ-করে-আসা কংগ্রেসিরাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনি শুনল ওরা পাগলের মতো হাত নেড়ে চিষ্কার করছে, ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। এ আজাদি-ঝুটা হ্যায়। প্রথম কথাটার মানে অনি বুঝতে পারছিল না। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের ওপর শোরগোল পড়ে গেল। হঠাৎই অজস্র পুলিশ এসে ওদের ঘিরে ফেলল। ওরা তখনও সামনে চেঁচিয়ে যাচ্ছে-ইনকিলাব জিন্দাবাদ। অনি বিস্ময়ে ওদের দেখছিল। পুলিশ লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু ওরা যাচ্ছে না কিছুতেই। ঠিক সেই সময় কংগ্রেসিরাও ধ্বনি তুলল-বন্দেমাতরম্। এদেরও গলার জোর যেন হঠাৎ বেড়ে গেল, ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। তার পরই অনির সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ও দেখল নির্দয়ভাবে পুলিশের লাঠি লোকগলোর ওপর পড়ছে। যন্ত্রণায় চিষ্কার করতে করতে ওরা মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আর সেই জটলা থেকে একপাটি জুতোশা করে তীরের মতো আকাশে উঠে মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো পেছনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। মঞ্চের সবাই এসে তাকে ঘিলে ধরেছেন। একজন লোক, বোধহয় ডাক্তার, ব্যাগ হাতে ছুটে এলেন।

এতক্ষণে পুলিশ ওদের সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। একটা বড় গাড়িতে ওদের তুলে পুলিশরা শহরে চলে গেল।

এখন একটা থিতনো ভাব চারধারে। কেউ কোনো কথা বলছে না। জনতার কেউ-কেউ উসখুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে। অবস্থা স্বাভাবিক করতে থেমে-দাঁড়ানো কংগ্রেসিরা আবার বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিতে দিতে চলে গেলেন। মঞ্চের ওপর তখনও সবাই ওই নেতাকে নিয়ে ব্যস্ত কংগ্রেসিদের এই যাওয়াটায় কারও মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হল না।

মণ্টু বলল, চল, আমরা পালিয়ে যাই।

অনিমেষ বলল, কেন?

মণ্টু চাপা গলায় বলল, মারামারি হতে পারে। বলে ছু দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওদের ক্লাসের কয়েকজন ওর পেছন ধরল। অনি দৌড়তে গিয়ে হঠাৎ কী মনে হতে না দৌড়ে হাঁটতে লাগল জনতার মধ্যে দিয়ে। আসবার সময় মানুষ–ঠাসা হয়ে ছিল মাঠটা, এখন কেমন ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে গেছে, হাঁটতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ মানে কী? অনি হাটহাঁটতে ভাবছিল। এই ধ্বনি এর আগে শোনননি সে। কথাটা কি বাংলা নতুন স্যার বলেন, ইংরেজ পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেও কংগ্রেসি বন্দেমাতরম্ ধ্বনি ছাড়েনি। এরাও তো আজ পুলিশে মার খেয়েও ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলেছে। কেন? এখন তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ওরা তবে কী বলতে চায়? কেন ওরা মারকেও ভয় করে না? হঠাই ওর ছোটকাকা প্রিয়তোষের কথা মনে পড়ে গেল। এই লোকগুলো কি ছোটকাকার দলের? ছোটকাকা কোথায় চলে গেছে। পিসিমা বলতেন পুলিশের ভয়ে প্রিয় আসে না। কেন পুলিশকে ভয় করবে? এখন তো সবাই বন্দেমাতরমের পুলিশ। অনির বকের মধ্যে আজকের মার-খাওয়া ছেলেগুলোর জন্যে একটু মমতা জমছিল। কেন কংগ্রেসিরা পুলিশদের নিষেধ করল না মারতে? ওরা তো প্রথমে কোনো অন্যায় করেনি, পরে অবশ্য জুতো ছুড়েছিল। ইনকিলাব জিন্দাবাদের মানেটা জানবার জন্য অনি নতুন স্যারকে খুঁজতে লাগল।
 
সরিৎশেখর আজ সকালে শিলিগুড়ি গিয়েছেন। ওঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত পাগলঝোড়া টি এস্টেটের রিটায়ার্ড হেডক্লার্ক তেজেন বিশ্বাসের গৃহপ্রবেশ আজ। সরিৎশেখরের যাবার ইচ্ছে ছিল না বড়-একটা, গেলেই খরচ। ইদানীং টাকা পয়সার ব্যাপারে আগের মতন দরাজ হতে পারেন না তিনি। পেনশনের টাকা, সামান্য শেয়ার ভিডিডেন্ড আর মহীতোষের পাঠানো অনির নামে কিছু টাকা-এর মধ্যেই তাকে ম্যানেজ করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে এখন একটা আধুলি তার কাছে একটা টাকার মতোই মূল্যবান। তাই তেজের বিশ্বাস যখন এসে হাতজোড় করে যাবার জন্য অনুরোধ করল তখন সরিৎশেখর ব্রিত হয়ে পড়েছিলেন। এখন প্রতিদিন তাকে হিসাব করে চলতে হয়। ব্যাংকে বেশকিছু টাকা তিনি একসময়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সে-টাকার কথা চিন্তা করতে গেলে নিজেকে কেমন ছোট মনে হয়। তা তেজেন বিশ্বাসের বাড়িতে হেমলতা প্রায় জোর করে পাঠালেন বাবাকে। এই একঘেয়ে জীবনের বাইরে একটু ঘুরে আসা হবে, মনটা ভালো থাকবে। সেজেগুঁজে আজ সকাল নটার ট্রেনে শিলিগুড়ি চলে গেলেন সরিৎশেখর, সন্ধের ট্রেনে ফিরে আসবেন অবশ্যই।

আজ স্কুল ছুটি। দাদু চলে যাওয়ার পর অনি পড়ছিল নিজের ঘরে। শীত চলে গেছে, স্কুলে পড়াশুনা এখন জোর কদমে চলছে। এমন সময় বাইরে দরজায় খুব জোর কড়া নড়ে উঠল। বই রেখে ঘরে বাইরে এসে অনি দেখল পিসিমা রান্নাঘরে রয়েছেন, কড়া নাড়ার শব্দ বোধহয় কানে যায়নি। ইদানীং হেমলতা কানে একটু কম শুনছেন। কড়াটা আর-একবার শব্দ করে উঠতেই অনি.দৌড়ে এসে দরজা খুলল।

মাঝবয়সি একজন মহিলা, মাথায় অনেকখানি ঘোমটা দেওয়া, অথচ ঘোমটা দেওয়ার ধরন থেকে বোঝা যায় অনভ্যস্ত হাতে দেওয়া, একটি বছর দুয়েকের বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অনিকে দেখামাত্র মহিলা হাসলেন, তারপর বললেন, তুমি নিশ্চয়ই অনি, না? অনি দেখল হাসবার সময় মহিলার কালো মাড়ি বেরিয়ে পড়ে। কেমন একট বিচ্ছিরি সেন্ট না পাউডারের গন্ধ ওঁর শরীর থেকে আসছে। অনি ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা বাচ্চাটাকে বললেন, প্রণাম করো, প্রণাম করো, তোমার দাদা হয়। বলামাত্র দম-দেওয়া পুতুলের মতো বাটি হেট হয় হাত বাড়িয়ে ওর পায়ের মাটি ছুঁয়ে মাথায় বোলাল। অনি চমকে উঠে সরে দাঁড়াতে গিয়েও সুযোগ পেল না। আজ অবধি কেউ তাকে প্রণাম করেনি, এতকাল ও-ই সবাইকে প্রণাম করে এসেছে। ওর মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছিল। এই সময় বাচ্চাটা আধো-আধো গলায় বলে উঠল, জল খাব।

মহিলা বললেন, খাবে বাবা, একটু দাঁড়াও। দাদা তোমাকে জল খাওয়াবে, দুধ খাওয়াবে, সন্দেশ খাওয়াবে, তা-ই না?

অনি হতভম্ব হয়েজিজআসা করল, আপনি কে?

আমি? মহিলা আবার হাসবার চেষ্টা করলেন, চিনতে পারছ না তো! আচ্ছা আগে বলল, বাড়িতে এখন কে আছেন?

আমি আর পিসিমা।

দাদু কোথায় গেছেন, বাজারে।

না। দাদু আজ শিলিগুড়িতে গিয়েছেন।

ও, তা-ই নাকি! বলে মহিলা ঘুরে দাঁড়ালেন গেটের দিকে। সেখানে কেউ নেই, কিন্তু মহিলা গলা তুলে ডাকলেন, চলে এসো, তোমার বাবা বাড়িতে নেই। অনি অবাক হয়ে দেখল গেটের একপাশে ইলেকট্রিক পোস্টের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে এদিকে আসছে। তার মুখচোখ কেমন বসা-বসা, গায়ের শার্ট খুব ময়লা আর পাজামার নিচের দিকটায় অনেকটা ফাটা। কাছাকাছি হতে অনির মনে হল একে সে চেনে, থুতনির কাছে অতখানি দাড়ি ঝোলা সত্বেও ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছে। ও চকিতে মহিলার দিকে তাকাল। এতক্ষণ যেটা লক্ষ করেনি সেটা দেখতে পেয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। মহিলার শাড়িটা বোধহয় ঠিক আস্ত নেই আর বাচ্চার জুতোর ডগা ফেটে পায়ের আঙুল বেরিয়ে এসেছে। ঠিক এই সময় লোকটি কাছাকাছি হয়ে মোটা গলায় বলল, আমাদের অনির দেখি স্বাস্থ্য বেশ ভালো হয়েছে। কথাটা শোনামাত্র অনি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। কয়েক লাফে সমস্ত বাড়িটা ডিঙিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। হেমলতা তখন মাটিতে বাটি নিয়ে বসে তরকারি কুটছিলেন। ছেলেটাকে হনুমানের মতো দুপদাপ করে আসতে দেখে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই অনি তার কানের কাছে গরম নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, জ্যাঠামশাই এসেছে।
 
অল্পের জন্যে বাটিতে আঙুলটা দুটুকরো হল না, হেমলতা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এসেছে।

জ্যাঠামশাই, সঙ্গে একজন বউ আর এইটুকুনি একটা বাচ্চা ছেলে।

কথাটা বলতে বলতে অনি দেখল পিসিমা সোজা হয়ে বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এমন গলায় হেমলতা বললেন, পরিতোষ এসেছে তুই চিনতে পারলি? কিন্তু ও তো বিয়ে-থা করেনি-যাঃ, তুই ভুল দেখেছিস!

হেমলতা উঠতে যাচ্ছেন এমন সময় হাঁকটা ভেসে এল রান্নাঘরে, ও দিদি, কোথায় গেলে! দ্যাখো কাদের এনেছি।

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বস্ত্রহাতের মতো বললেন, পরিই তো৷ কিন্তু এখন আমি কি করব এখন?

আরে তোমাকে ডাকতে ডাকতে গলা ধরে এল, আর তুমি এখানে বসে আছ, বাইরে এসো, প্রণাম করি। অনি দেখল জ্যাঠামশাই রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। :

হেমলতা ভাইয়ের দিকে তাকালেন। এত বিচ্ছিরি চেহারা হয়েছে যে চট করে চেনা মুশকিল। এই ভাই তার বড় ভাই, এককালে সেই ছেলেবেলায় ওঁর কত আদরের ছিল-হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন নড়েচড়ে উঠতেই কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলেন হেমলতা। বাবা ওকে ত্যজপুত্র করেছেন, এ-বাড়িতে ওর প্রবেশাধিকার নেই। এতদিন পর কোথা থেকে উদয় হল।

যেন হেমলতা কী চিন্তা করছেন টের পেয়ে গেল পরিতোষ, কিছু কোরো না, তোমাদের ফাদার ফেরার আগেই কেটে পড়ব।

এতক্ষণে হেমলতা যেন সাড়া পেলেন, শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এলি?

তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, তা ছাড়া-একটু থেমে অনির দিকে তাকাল পরিতোষ, অনেকদিন বউ-বাচ্চারা পেটভরে খায়নি। অবশ্য তোমাদের ফাদার বাড়ি থাকলে আমি ঢুকতাম না। বউটা শালা কিছুতেই শুনতে চায় না, একবার শ্বশুরবাড়ি আসবেই, বাঙাল তো, গো ভীষণ।

বাঙাল? বাঙালের মেয়ে বিয়ে করেছিস তুই?

বিয়ে করিনি। করতে বাধ্য হয়েছি। আমার একটা বাচ্চা ছেলে আছে, তাকে তুমি দেখবে না?

হেমলতা উঠে দাঁড়ালেন। বাবাকে তিনি চেনেন। আজ অবধি ভুলেও একবার বড় ছেলের নাম করেননি কখনো। বরং প্রিয়তোষের খোঁজখবর গোপনে নেবার চেষ্টা করছেন তিনি-হেমলতা সেটা বুঝতে পারেন। পরিতোষ তার কাছে মৃত। এই অবস্থায় হেমলতার কী করা উচিত? ভাইকে থাকতে বলা মানে বাবাকে অসম্মান করা নয়? আর সবার মধ্যেই তো তিনি ফিরবেন, তখন অবশ্য সন্ধে হতে অনেক দেরি আছে। হেমলতা দরজার সামনে এলে পরিতোষ ঝুঁকে তাকে প্রণাম করতে যেতেই তিনি চমকে পিছিয়ে দাঁড়ালেন, রাস্তার ময়লা কাপড়ে ছুঁয়ে দিয়ো না, আমার জ্ঞান হয়ে গেছে।

পরিতোষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমার তো আর জামাকাপড় নেই।

হেমলতা বললেন, তা হলে সরে দাঁড়াও, প্রণাম করার প্রয়োজন নেই।

পরিতোষ দিদির কাছ থেকে এই ধরনের কথা আশা করেনি, স্থলিত গলায় সে উচ্চারণ করল, তুমি মাইরি ফাদারের মতোই নিষ্ঠুর।

সঙ্গে সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, নিজে যেন সাধুপুরুষ। এক ফোঁটা দয়ামায়া নেই যার সে আবার অন্যকে নিষ্ঠুর বলে!

কথাটা শুনেই পরিতোষ গর্জে উঠল, অ্যাই, চুপ।

চুপ করব কেন? অনেক চুপ করেছি, আর নয়।

কয়েক পা এগিয়ে হেমলতা উঠোনের দিকে তাকাতেই দেখলেন বারান্দার সিঁড়িতে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটি রোগাটে বউ বসে আছে। বুঝতে পেরেও জিজ্ঞাসা করলেন হেমলতা, এরা কারা?

যেন কিছুই হয়নি এমন গলায় পরিতোষ বলল, ওই তো, তোমার ভাই বউ আর ভাইপো। দিদিকে আবার প্রণাম করতে যেও না, রাস্তার কাপড়ে আছ।

এমন ভান কর যেন বুদ্ধিতে বৃহস্পতি। মুখ নেড়ে পরিতোষকে কথাটা বলল মহিলা, তারপর হঠাৎ গলার স্বর বদলে গেল তার। বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে হেমলতার দিকে এগিয়ে এসে প্রায় কেঁদে ফেলল, মুখে বড় বড় কথা বলত লোকটা, তাই শুনে ভুলে গেলাম। বিয়ের পর একদিনও পেটভরে খেতে পাইনি, বুকের দুধ শুকিয়ে যাবার পর একে আর দুধ দিতে পারিনি। দিদি, আমি ওকে জোর করে নিয়ে এসেছি আপনার কাছে, আপনিও তো মেয়ে, আমাকে ক্ষমা করবেন না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top